অজানা মানুষ - প্রতীক মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

          অজানা মানুষ

                  প্রতীক মন্ডল




আমি ভ্রমর। আমার নামটা খুব চেনা আপনার। রাত হলে আমায় খুঁজে পান নিজের ঘরের আশেপাশে। স্বপন চারিনী, কবিতার ছন্দের মতন। তবে, হ্যাঁ অন্য লোকে চেনে আমায় অন্য নামে।


বাজারি মেয়ে বলে কথা। বাজারে নাম চামেলী। রাত হলেই ঘরের দরজা খুলে যায়। সকলে বের হয়ে আসে। কেউ শাড়ি,কেউ ছোট পোশাক, কেউ আবার রাজকীয় লেহেঙ্গা। কিন্তু, পেশাটি ভয়ঙ্কর নিম্ন। টাকা আছে, সম্মান নেই, আছে এক গুচ্ছ যন্ত্রনা। তবে সে আমায় যন্ত্রনা পেতে দেয় নি। পাগলের মতন ভালোবাসতো আমায়। ঠিক যেমন এক প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকে, ঠিক তেমনই। সে কোনোদিন দূরে ঠেলে দেয় নি। আমায় মরতে দেয়নি। বারবার বাঁচিয়ে রেখেছে। মনে হয় যেন সে আমার কত কাছের। কিন্তু ওই যে চৌকাঠ পেরোলে তার ঠিকানা জানিনা। আমিও এই চৌকাঠ ছেড়ে বেরোইনি। বাইরের জগৎকে ভয় লাগে। ওদের ভাষায়, ' জিসম কা সওদা ' করতে পারিনা। তাই আমি হয়ত এখনো গনিকার পদমর্যাদা পাই নি। ঘরে কেউ আসে না। মদ গাজা খেয়ে খদ্দের ডাকতে পারিনা। সে দিতো না। সে আমায় আগলে রাখতো। এখনো রাখে। অনেক দূর থেকে রাখে। তবে একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনা আমার জীবন বদলে দিয়ে এক নতুন পথে নিয়ে এসেছিল। হয়ত সেটাই ছিলো আমার ভাগ্য।




মনে পড়ে সেই দুর্দিনের কথা। যেদিন প্রথম এসেছিলাম এই লালবাড়িতে। চোখ খুলতেই দেখি এক ভয়ানক চোখ। ঘিরে রয়েছে অদ্ভুত পোশাকের কিছু মেয়ে আর একটা সাদা ধোঁয়া। কেউ হাসছে কেউ করুণা করছে। কিভাবে এসে পড়েছিলাম জানি না। এটুকু মনে আছে,থাকতে চাইনি। পালাতে গেছিলাম, কিন্তু চুলের মুঠি ধরে টেনে এনেছিল এই ঘরেই। তারপর যখন রাত বাড়ে,ওরা আসে। নিশাচর প্রাণীগুলো। তাদের চোখ হিংস্র, নখ গুলো ভোঁতা,কিন্তু আমার পিঠে সেগুলোর দাগ বেশ স্পষ্ট।  




আমায় সবাই হিংসে করে এখানে। বাকিদের কাছে আমি নাকি রাক্ষুসী। কারন,রূপটা নাকি একেবারে লক্ষ্মী প্রতিমার মতন। কিন্তু, রাতের বেলায় সে প্রতিমার মুখে মিশে যায় কত অযাচিত জন্তুর চিহ্ন সে খবর কে রাখে। তখন থেকে নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হত। কিন্তু বাঁচতেও তো ইচ্ছে হয়। বাঁচিয়ে রাখে আমারই রঙিন স্বপ্ন গুলো। 




তবে আমার খিদে কম।তাই হয়ত, একরাতে একটা জন্তুই যথেষ্ট ছিল। তবে খিদেটাই সব নয়। বেঁচে থাকতে গেলে যে ওষুধ লাগে সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম।কখনো জ্বরে গা পুড়ে যেত। কেউ আসতো না ঘরে। তাই টাকাও নেই। এমনিই সুস্থ হয়ে যেতাম। মাসে একবার এটা হতই।কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতো না। লাল বাড়িতেও খবর যেতো না।সকলে মরত হিংসের আগুনে,আর আমি জ্বরে পুড়ে যেতাম।কিন্তু, সেই রাতটা অন্যরকম ছিল। যদিও শরীরটা বেশ খারাপ ছিলো। এদিকে পেটের ও কিছুটা টান। তাই দরজা খুলে রেখেছিলাম। একটু আফিমও ধার নিয়েছিলাম ।


আজ একটু লড়াই করতেই হবে। 




এখানে সবাই করে। আমি কোনো রাণী নই, আমি কোনো রাজকুমারী নই। আমি এক দেবদাসী মাত্র। এই গলির মাটি ছাড়া দুর্গা মূর্তি তৈরি হয় না। তাহলে আমরা কেমন করে দেবদাসী নই।




কিন্তু, আজ সেসব কথা থাক। কারন ঘরে একজন এলো। আধ ঘন্টা পরে মুখের উপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কি ভয়ানক ব্যাথা করছে তলপেটে। মনে হচ্ছে যেন কেউ জোর করে বেরোতে চাইছে । একটু আফিম নিলাম। কিছুক্ষণ পর ব্যাথা কমতে থাকলো। তবে একটা গরম রক্তের স্রোত নিচের দিকে বয়ে চলেছে সেটা খেয়াল করলাম না। আবার একজন এলো। এসে হুকুম করল, ' দরজা বন্ধ করো।' ……করো! তুমি করে ডাকলো? তার চোখের দিকে দেখলাম। মুখটা হালকা দাড়িতে ভর্তি। একটা কাঠিন্যের ছাপ আছে। ঘরে ঢুকেই সে মাথা নিচু করে বসে রইল। পিঠটা কাঁপছে। আমি গিয়ে বললাম, ' কি রে বাবু। কিছু করবি না? যদি না করিস তাহলে টাকা দিয়ে চলে যা।'


সে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তার চোখটা হালকা লাল হয়ে আছে। বলল,' আমার মন শান্ত নেই।আমার কাছে এসে আমায় একটু শান্ত করো।' 


আমি গিয়ে তার কোলে বসলাম। তার কথা বার্তা শুনে কোনোমতেই মনে হয় না যে সে কোনো খারাপ লোক। এখানে তো ভালো কেউ আসে না। 


তবে?




সকালে ঘুম ভাঙলো। কখন যে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে উঠে দেখি পাশে একটা চিঠি ,আর কিছু ওষুধ। দেখে অবাক হয়ে গেলাম।সঙ্গে লক্ষ্য করলাম আমার বিছানাটা। রক্তে লাল হয়ে গেছে। সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। গায়ে জ্বর ভাব। 




সন্ধ্যে তে দরজা বন্ধই রইলো। ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে রেখেছিলাম।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।কিছু রান্না করতে পারিনি।ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা পরিচিত কণ্ঠের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। দেখি সে বসে আছে। বলল, ' তোমরা নিজেদেরকে এত কষ্ট দাও কেন। খেয়ে নাও এটা। আজ আমি না এলে তো মরেই যেতে হয়ত। আজকে এই ওষুধগুলো খাও, আর আমি যতদিন না বলব ততদিন কোনো কাস্টমারকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। ' বলে সে চলে গেল। কে এই লোকটা, আমার এত খেয়াল কেন রাখছে। সেতো আমার নাম ও জানে না।আমি তার কে হই? তোমাকে চিনিও না, কে হে তুমি! কিন্তু শরীরটা এতটাই অবসন্ন লাগছে, সেটাও জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম যে , ভিতর থেকে আটকানো শিকল টা খুলে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পরে।




ঠিক তিন চারদিন পরের কথা। অনেকটাই সুস্থ লাগছে, কারণ রাতে সে আসে। দেখভাল করে আমার। থাকতে না পেরে আজকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ' তুমি কে? আমি তোমার কি কেউ হই? তাহলে আমার এত কিছু কেন করছ ?এখানে তো কেউ কাউকে দেখে না। কেউ কাউকে ভালোবাসে না।'


কোন উত্তর দেয় না। তারপর বলে ওঠে, ' সেদিন কি আমার আগের লোকটা তোমার সবচেয়ে প্রথম কাস্টমার ছিল তাই তো। আর সেই জানোয়ার, কোন রেয়াত না করে এমন অবস্থায় ফেলে চলে গেছিল। দেখে আমার মায়া পড়ে গেছিল।'


' যদি ওভাবে না দেখতে তুমিও কি আমার সাথে একই কাজ করতে? সত্যি করে বলোতো।'


' না আমি খারাপ লোক হতে পারি কিন্তু জন্তু নই।'


এটা শোনার পরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বহুদিন হয়ে গেল এভাবে কেউ ভালবেসে এরকম কথা আমায় বলেনি। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমি কেঁদে উঠলাম। যেন মনে হচ্ছিল কোন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমায় আশ্রয় দিয়েছে তার মনে। কি আত্মীয়ের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এতো আমি জানিনা, শুধু জানি যে আমি তাকে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলছিলাম। এতদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো না কিন্তু ইচ্ছে বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ পেয়েছিলাম। 


এরপর সে রোজ রাতে আসতো। আমাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যেত আর বলতো যেন আমি কোন কাস্টমারকে ঘরে না ঢুকাই। এ খবর লাল বাড়িতে ও গেল না কারণ আমি আমার আসল আত্মীয় দের কাছে যেমনভাবে ব্রাত্য ঠিক তেমনভাবে এরাও আমাকে দূরে ঠেলে রেখেছে। যাক এটাতো মন্দের ভালো। 


কিন্তু আমার উপর তার কিসের মায়া। সে এত পায় কোথায়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম,উত্তর আসেনি। মৃদু হেসে বলেছিলো একটু, ' ওসব প্রশ্ন ছাড়ো। এগুলোর উত্তর আমিও জানিনা। তবে এটুকু জানি যে রাত হলে আমার শক্তি বেড়ে যায়। …. তখন আমি সব পারি। যা চাইবে তাই এনে দিতে পারি।' 


' পারবে! সত্যি? তবে একটা আবদার করতেই পারি। রাখবে?... আমায় চিরদিনের জন্য তোমার করে নিতে পারবে?... পারবে না? কি হলো চুপ কেন?' 


' আমি আসি। এর উত্তর আমি দেবো না।'




কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চলে গেছিলো। আমি দৌড়ে বাইরে গেলাম, তাকে আটকাতে চেয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। এত দ্রুত সে হারিয়ে গেলো এই আলোর মতন আঁধারের শহরে? 




এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। না, সে এলো না। আমার আশার পাহাড় ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ল। না, বলা ভালো গুঁড়িয়ে গেল। তার সেবায় আমার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, সে আর কতদিন। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সে আর আসবে না। এক গণিকার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানো যায় না, সেটা সেও জানে। তাই তার জন্য আমি এক শয্যা সঙ্গী ছাড়া কেউ না। এসব ভেবে লাভ কি! পেটের টানে শরীর বিক্রি করার কাজ আবার শুরু করলাম। এটা বিক্রি না, এটাকে দেহ বন্ধক রাখা বলে। কিছুক্ষণের জন্য।কিন্তু রাখতে হয়।




১৫ দিন পর বাইরে এসে দাড়ালাম।সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দালালের দলের মুখে একটাই প্রশ্ন, ' এত সুন্দর, তবু মুখটা শুকনো কেন? আজ হটাৎ বাইরে কেন? আরো কত কি!




রোজ আসে অনেকে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকি। তারপর ও দাড়াতে হয়। তবে ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে যেতে থাকে। ব্যাথা গুলো মুছে যায় নেশার অতলে। হিলহিলে সাপ গুলো ভিতরে ঢোকে, বিষ ঢালে,বেরিয়ে যায়। মনে হয় যেন ভিতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। না, আজও বাড়ির কথা মনে পড়ে না। সেসব ও ছিলো দুঃস্বপ্নের মতন।রাত যত বাড়ে সেই গুলো একটু করে ভুলে যেতে থাকি। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে যাই। কে যে আসে, কে জোরে থাপ্পড় মেরে যায় কিছুই মাথায় ঢোকে না। 


পাশের ঘরে থাকা মেয়েটি এসে জিজ্ঞাসা করেছিলো, ' কেমনে থাকো একা একা। কাস্টমার নাও না, পেট চলে?সেই প্রথম থেকে দেকসি,তোমার ঘরে কাউকে তো যেতে দিকিনি বাপু।এত টাকা পাও কোত্থেকে।'


আমি শুনে তাজ্জব হয়ে গেছিলাম।তবে কি, তাকে ও দেখেনি? সবই কি মনের ভুল? আফিমের নেশা? সে উত্তর খুঁজতে চাওয়ার ইচ্ছেটা বেড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু, সব ইচ্ছে থেমে যায়।




 একদিন রাতে হটাৎ একসঙ্গে তিনজন এলো। মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছে ভয়ানক।সেদিন আমার হুশ ছিলো ভালোই। আমি প্রতিবাদ করলাম যে, একসঙ্গে তিনজনকে সম্ভব না। কিন্তু তারা শোনে না। আমায় বিছানায় ফেলে দেয় । এক নিমেষে কেড়ে সব পোশাক। একজন আমার হাত চেপে ধরেছে, আর একজন মুখ। 


প্রায় তিন ঘন্টা পরে বেরিয়ে গেলো। আমি রাগে যন্ত্রনায় কাদতে লাগলাম। নিচ দিয়ে আবার রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন সব কিছু ছিঁড়ে একাকার হয়ে গেছে। কোমর থেকে নিচ অবধি যেন আমি বেঁচে নেই। সব কিছু অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু… কিন্তু আমার কান্না শোনার যে কেউ নেই! ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। 




' ভ্রমর, ও ভ্রমর। কি হয়েছে তোমার। ওঠো!আমি শ্যামল'


চোখ খুলে দেখি বুকের উপর শাড়িটা কোনরকমে চাপা দিয়ে রেখে সে বসে আছে পাশে। আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম , ' শ্যামল!... তুমি!!'




সে এসেছে, আমার জন্য ফিরে এসেছে। বেলা বাড়লো, অনেকটাই সুস্থ লাগছে এখন l আমার ক্ষত গুলোতে যত্ন করে ওষুধ লাগানো রয়েছে। '


হ্যাঁ,সব ক্ষত তেই। আর কোনো লজ্জা নেই আমার।আমি এখন তার জন্য বেঁচে আছি এটুকুই অনেক। সন্ধ্যে তে আরো ঠিকঠাক হয়ে এলো শরীরটা। তখন জিজ্ঞাসা করলাম,


' তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?'


' আমার আসলে খুব বিপদ। আমায় কিছু লোক খুঁজছে। ওরা পেলে আমায় মেরে ফেলবে। আমার বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী।তাই আসিনি। যদি তোমার কোনো ক্ষ্তি হয়। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।'


' কিন্তু তুমি কি করো, যে তোমায় ওরা মারতে চায়।'


' ওসব বাদ, আগে বলো তোমার এই অবস্থা কে করল।  




আমি সব খুলে বললাম। বলতে বলতে তার মুখটাও দেখতে থাকলাম। তার মলিন মুখে এত রাগ কোনোদিন দেখিনি। আমার কথা শেষ হতেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ' কে তারা!!! ওদের আমি শেষ করে ছাড়বো। আমায় বলো কে ? কোথায় থাকে।'




আমার নীরবতা জানিয়ে দেয়, আমি কিছুই জানি না। সে নিজের জামা পরে বেরিয়ে যায় হনহনিয়ে। চলে গেল। সে কি আর ফিরবে?যদি এবার সত্যি না ফেরে! তাহলে আমি নিজেকেই শেষ করে ফেলবো। 




পরদিন রাতে। দরজায় কড়া পড়ল। ভোর ৫টা বাজে। ঘুমোতে যাবো ভাবছি,এমন সময় শ্যামল এলো। হাতে দুটা বড় সুটকেস। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে এতে কি। সে বলল, ' এতে তোমার জন্য একটু উপহার আছে। দেখে ভয় পেয়ে যেও না যেন ,আমাকে এটা করতেই হত , তোমার জন্য।' বলে সুটকেসের ডালাটা খুলল। সুটকেসের ভিতরের জিনিসটা দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠলো। তিনটে উল্টানো কাটা মাথা। সে হাসতে হাসতে একটা করে মাথা তুলে আমাকে দেখাতে থাকলো। এই যে তারাই, যারা সেদিন কি আমাকে ধর্ষণ করেছে একটা জানোয়ারের মতো। আমি ভয় পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ' তুমি কে? তুমি এদেরকে চিনলে কি করে? আমিও চিনি না এদেরকে। ….আর…আর…তুমি জানলে কি করে আমার নাম ভ্রমর। এখানে তো সবাই জানে আমার নাম চামেলী। '


' আমি কি তোমায় জানতে হবে না। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি এটুকুই তুমি জেনে রাখো, এর বেশি কিছু আমি তোমাকে বলতে পারব না। শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখবে?


' কি বলো।'


' আমি এখন চলে যাচ্ছি। তুমি এই বাক্সটা নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও। ওর ভিতরে একটা ঠিকানা দেওয়া আছে সেখানে গিয়ে থাকো। সব ব্যবস্থা করে রেখে এসেছি।' বলে বন্ধ করা বাক্সটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর দ্রুত পায়ে আমি আসছি বলে চলে গেল। আমি আবার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথায় যাব? আমি কি এখান থেকে মুক্তি পেতে পারবো এত সহজে। যদি সত্যিই পারি একটা তো চেষ্টা করতেই হবে। ভেবে বাক্সটা খুলেই ফেললাম। দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে ও কিছুটা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল ।


থরে থরে ২০০০ টাকার নোট সাজানো রয়েছে। কিন্তু, কোথায় ঠিকানা। কিসের মুক্তি। কিছুই খুঁজে পেলাম না। তবে সেদিন বুঝেছিলাম যে সে আর আসবে না। আমাকেই তার কাছে যেতে হবে। কিন্তু, কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো?


আর সেটার উত্তর এসেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাইরে হটাৎ দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। 


'জল জল ,জল আন!' বলে চিৎকার করছে কে একজন। বাইরে দেখতে পাই কালো ধোঁয়া। আর দূরে ,সেই লাল বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সকলে সেদিকেই ছুটে চলেছে। আমি কি করব ভেবে পেলাম না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু না! এভাবে চুপ থাকলে চলবে না। ভালো পোশাক পরে সুটকেসটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাতের আঁধারে এই ধোঁয়া যেন আমার ছদ্মবেশ হয়ে উঠলো। সকলের নজর আগুনের দিকে। আমি সকলের অলক্ষ্যে পালিয়ে গেলাম। যেদিকে পারলাম দৌড়ালাম। জানিনা কোথায় যাচ্ছি। এখন সেটা ভাবার সময় নেই। 




সকাল হয়েছে। ঘুম ভাঙলো আশেপাশে গাড়ির আওয়াজে । তাকিয়ে দেখে চিনতে পারলাম না কিছুই। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল যে, এটা নাকি ডালহৌসি। সেটা কোথায়! কিছুই জানি না। এই ভরা রাস্তায় ব্যাগ খুললে বিপদ হতে পারে। রাতের অপেক্ষা করলাম। তারপর সেই সুটকেসের ভিতর খুঁজতে থাকলাম সেই ঠিকানা। নেই! কোথাও নেই। না, এই তো….




প্রায় ৫ দিনের চেষ্টায় একে ওকে জিজ্ঞাসা করে বর্ধমানের ট্রেনে উঠে বসলাম। শ্যামল আমার জন্য বর্ধমানে অপেক্ষা করছিলো? নাকি আবার কোনো এক আঁধারে ভেসে যাচ্ছি,জানি না তো সেটা। 




একটা বাড়িতে ভাড়ায় উঠলাম। ঠিকানায় লেখা বাড়িটাই এটা। কিন্তু সে এলো না। ১ মাস গেলো, ২ মাস গেলো, কিন্তু শ্যামলের দেখা নেই। তার দেওয়া সুটকেস আর টাকা গুলোই যেন আমার কাছে তার শেষ স্মৃতি। সময় কেটে গেলো অনেকটাই। আমি বাড়িতে বাড়িতে কাজ নিলাম। বাড়ির মালিক আমায় বেশ পছন্দ করত। কাকু কাকিমা দুজনেই ষাটোর্ধ। একদিন উপরের ঘরে ডাকলেন কাকু। ঘরের কয়েকটা কাজ করতে হবে। সত্যি বলতে ওরা কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেন নি আমি একা কেন থাকি। তাই ওদের ও বেশ পছন্দ হয় আমার। 


আমি ঘরে গিয়ে কাজ করতে লাগলাম। কাকিমা এসে গল্প করতে লাগলেন। তারপর ওনার ছেলের কথা উঠতে জানতে পারলাম ওনার ছেলে কলকাতাতে খুন হয়ে গেছে বছর পাঁচেক আগে। তার মৃতদেহ ও সৎকার করতে পারেনি কেউ।গঙ্গায় আধ খাওয়া দেহ পাওয়া যায় নাকি। আমি কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ,' ছেলের নাম কি?' 


কাকিমা উত্তর করলো, ' শ্যামল।…… এই যে ছবি।'




দেখে আমি চুপ করে গেলাম। এ তো আমার শ্যামল। যার জন্য আমি আজ এখানে। সে যদি ৫ বছর আগে খুন হয়,তাহলে ৫ মাসের আগের সেই লোকটা কে?


মাথাটা কেমন যেন টলে উঠলো। ঘরে এসে বসে রইলাম চুপচাপ। অশরীরী? মৃত্যুর পরেও আরেক জীবন? তাহলে কি সব সত্যি? কিন্তু কেন? আমি কে হই তার।সে…সেই রাতে বন্ধ দরজা দিয়ে ও ঢুকে গেছিলো, তারপর এত টাকা….ওই তিনটে লোকের মাথা… সবই তাহলে শ্যামলের মৃত্যুর পরের ঘটনা! আমার জন্য যে অসাধ্য সাধন করেছে সেটা কোনো জীবিত মানুষের কাজ নয়! বুক চিরে যেন কান্নাটা বের হয়ে এলো।' আমি এরকম মুক্তি চাইনি, এরকম মুক্তি দরকার নেই। একা থাকতে চাইনি। তোমায় খুব দরকার আমার। কোথায় তুমি।' 




জানি উত্তর আসবে না, তবু যেন কেউ বলে উঠলো, ' তুমি যতদিন মনে রাখবে, ততদিন আমিই তোমার কাছে থাকবো।'

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024