এক কামরার ফ্ল‍্যাট - সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় || Eek Kamrar Flat - Sudipta Chattyapadhay || Short Story || ছোটগল্প

 এক কামরার ফ্ল‍্যাট

      সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় 



জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিল সুমনা। কাঁচ ভেদ করে আলো ঢুকতেই তীর্থজিৎ এর ঘুমটা ভেঙে গেল। 

আঃ ঘুমোতে দাও। পায়ের কাছে রাখা চাদর টা মাথা পর্যন্ত টেনে নিল তীর্থ। 

বাথরুমে ঢুকে পড়ল সুমনা। সকাল সকাল স্নান সেরে পুজো করা অভ‍্যেস।

কি হচ্ছে তীর্থ! এবার ওঠো। আট টা বাজতে চলল। বাশি বিছানা, বাশি কাপড় সুমনার একদম সহ‍্য হয়না। বাধ্য হয়েই বিছানা ছাড়তে হল তীর্থকে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলে চ‍্যাট করেছে। ঘুমটা ভাল হয়নি। এত সকালে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল না কিছুতেই। 

একটা সিগারেট ধরাল। টয়লেট গেলেই একটা সিগারেট তাকে ধরাতে হয়। 

এক কামরার ছোট্ট ফ্ল‍্যাট। তারই মধ্যে সামান্য জায়গা নিয়ে ঠাকুরের সিংহাসন। দক্ষিণ দিকে ছোট্ট ব‍্যালকনি। বিছানার পাশেই বড় জানালা। ছোট্ট ফ্ল‍্যাট টা মনের মত সাজিয়েছে সুমনা। 

কতবার বলেছি তোমায়, বাথরুমে সিগারেট খাবে না। সারা ঘর এক বিচ্ছিরি গন্ধে ভরে যায়। সুমনা চিৎকার দেয়। 

টয়লেটে সিগারেট না খেলে আমার টয়লেট হয়না। জানোই তো সেটা। তবু চিৎকার করাটা তোমার স্বভাব।

উঃ রোজ এক কথা! আমাদের কি করে হয়। মনে মনে ভাবল সুমনা।

দশ বছরের বিবাহিত জীবন। কোনো সন্তান নেই। মেলা থেকে একটা গোপাল কিনেছে। সারাদিন তার সেবায় নিজেকে ব‍্যস্ত রাখে সুমনা। রোজকার ছোট বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ আছে। বন্ধুত্ব আছে। মান-অভিমান আছে। কিন্তু সত্যিকারের স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ক তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি কখনো। তাই ছোট্ট গোপাল মূর্তির মধ্যেই সুমনা খুঁজতে থাকে তার মাতৃত্ব। 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা 

মিসড কল। ফোনটা ঘোরাতে থাকে তীর্থজিৎ। প্রিয়াঙ্কার ফোন। প্রিয়াঙ্কা এখনো তাকে ফোন করে। মাঝে অবশ‍্য দীর্ঘ দিন তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুকে বন্ধুত্ব হবার পর ফোনটা আরও বেশি আসছে। খুব আপসেট আছে প্রিয়াঙ্কা। সবে তাদের ডিভোর্সটা হয়েছে। ঘুরে একটা ফোন করবে ভেবেও ফোনটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিল তীর্থজিৎ।

তোমার চা।

সিঁথি ভর্তি সিঁদুর আর লাল শাড়িতে আজও তাকে কী সুন্দর লাগে। চা টা নিতে গিয়ে হাত টা ধরতে ইচ্ছে হল। নিজেকে সংযত করে নিয়ে চায়ে চুমুক দিল তীর্থজিৎ। 

কোথাও বেরোচ্ছ? তীর্থজিৎ পিছু ডাকলো।

হ‍্যাঁ, আজ তো রবিবার। গানের ক্লাস আছে।

তোমার গোপাল সেবা হয়ে গেল। কথাটা বলেই তীর্থজিৎ এর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল।

ও ভাবে বলো না তুমি। গোপাল আমার সন্তান। আমার ঈশ্বর।

তীর্থজিৎ বিশ্বাস করে না। কমিউনিস্ট দের ঈশ্বর বিশ্বাস করতে নেই। কলেজ মাঠে লাল লাল বলে চিৎকার করতে করতে এটাই বুঝেছিল সে। তারপর কলেজে পার্ট টাইম জব করতে করতে বাবার আদেশ।

'কন‍্যাদায়গ্রস্থ এক পিতাকে কথা দিয়েছি আমি। আমার পছন্দ মত মেয়েকেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে।'

মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল। এক প‍্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছিল সারা রাত ধরে। 

সিগারেট খাও? ফুলসয‍্যার রাতে নব বধুকে অপমান করার জন্যই তীর্থজিৎ সিগারেট টা ধরিয়ে ছিল। ভয়ে বিছানার এক কোনে সিটিয়ে ছিল সুমনা। সিগারেটে একটা টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,কিসে অনার্স। 

নব বধুটি কাঁপা গলায় বলল, মাধ্যমিক।

লাল স্কাট পরে প্রিয়াঙ্কা যখন তার সাথে দেখা করতে আসত, তীর্থজিতের মনে হত পৃথিবীর সর্ব সুখ তার কাছে ধরা দিতে এসেছে। দৌড়াতো প্রিয়াঙ্কা। লাল স্কাট টা হাওয়াতে উড়তো। উঃ কী ড্রেস পরো প্রিয়াঙ্কা! এই ভাবে দৌড়াবে না। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না।

ঠোঁট ব‍্যাকাতো প্রিয়াঙ্কা। কি ড্রেস পরেছি। বুড়িদের মত শাড়ি পরে আসব বুঝি! 

তারপর নিজেই হেসে লুটিয়ে পড়ত তীর্থজিতের বুকে। 

বাবা, বিয়েটা আমি করতে পারব না। খুব সাহস করে কথাটা বলেছিল।

তোমাকে ত‍্যাজ‍্য পুএ করা হবে তীর্থ। আমি একজন মেয়ের বাবাকে কথা দিয়েছি। বাবার মুখের উপর আর কোনো কথা বলতে পারেনি তীর্থজিৎ। কলকাতায় চলে আসে। একটা ফ্ল‍্যাট ভাড়া নিয়ে প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যাবে ঠিক করে। একটা টেলিগ্রাম। বাবাকে দেখতে ছুটে যায়। স্টোক। 

তীর্থ বিয়েটা করে নে। কথার খেলাপ হলে তোর বাবা বাঁচবে না। মায়ের কাতর আবেদন। অবিশাপ লাগবে তীর্থ। মেয়ের বাবার অবিশাপ।

রবিবার বাড়িতেই থাকে তীর্থ। আগে পার্টি অফিস যেত। এখন আর ভাল লাগে না। রবিবার সুমনা বাড়ি থাকে না। সে সপ্তাহের এই একটা দিন গান আর ছাত্র - ছাত্রী নিয়েই কাটিয়ে দেয়। একদিন এই গান শুনেই তীর্থর বাবা সুমনাকে পছন্দ করেছিলেন। বিশ্বজিৎ বাবু বৌমার গান শুনতে ভালবাসতেন। বৌমার সেবা আর ভাল ভাল রান্না খেয়েই তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন।

একটা রাত তীর্থজিৎ সিগারেটে টান দিতে দিতেই কাটিয়ে দিয়েছিল। সারা ঘর ধোঁয়া আর বিচ্ছিরি এক গন্ধ। নব বধু নাক মুখ বন্ধ করে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সকালেই বেরিয়ে পড়েছিল তীর্থ। তার এক কামরার ফ্ল‍্যাটে। প্রিয়াঙ্কার কাছে। প্রিয়াঙ্কার অভিমান ভাঙিয়ে ছিল।

ঐ মেয়েটার সাথে আমার কখনও বনিবনা হবে না। ও আমার যোগ্য নয়। বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি ডিভোর্স নেব। একটু অপেক্ষা কর প্রিয়াঙ্কা।

স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি সুমনা। ঘরের কাজ আর শ্বশুর,শাশুড়ির সেবা করেই তার দিন কেটে যায়। মাঝে মাঝেই শাশুড়ির গলায় অভিযোগের সুর। কী মেয়েমানুষ! স্বামীকে ধরে রাখতে পারল না।

প্রিয়াঙ্কাকে কলবেক করে তীর্থ।

হ‍্যালো,

আমি তীর্থ।

কেমন আছো তুমি?

প্রিয়াঙ্কার গলাটা কান্নায় ধরে আসে। ছেলেটাকে ভর্তি করতে হবে। অপারেশন হবে।

উত্তেজিত হয়ে ওঠে তীর্থ। কী হয়েছে তোমার ছেলের?

ডাক্তার বলেছে, লাংসে ফুটো আছে। অপারেশন ছাড়া কোনো উপায় নেই।

তোমার বর কোথায় প্রিয়াঙ্কা?

জানোই তো সব। ও বিদেশে। কোনো দায়িত্ব নেবে না বলেছে।

কেন? ছেলেটা তো তারও। অন্তত বাবা হিসাবে!

বিশ্বাস করে না। তোমার আমার সম্পর্ক জড়িয়ে!

নিজেকে সংযত করে নেয় প্রিয়াঙ্কা।

বড্ড বিরক্ত লাগছিল তীর্থর। মাথাটা গরম হয়ে ওঠে তার। যত্ত সব ভুল ধারণার শীকার। নীচ মেনটেলিটি।

প্রিয়াঙ্কা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। ফোন কেটে দেয়।

তীর্থ আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না। বাবা আমার বিয়ের ঠিক করেছে। তুমি ডিভোর্সটা কী আদৌ দিতে পারবে? তোমার বাবা,মা তোমার স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল। অতএব আমি আমার বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়েটা করছি।

চিঠিটা পেয়েছিল তীর্থ। ছুটে গিয়েছিল সে। তখন প্রিয়াঙ্কাদের বাড়িটা ফুলে সাজানো।

এই কিছু দিনের মধ্যেই প্রিয়াঙ্কা তার জীবনের চরম সিদ্ধান্ত টা নিয়ে নিল। যখন তীর্থ এন.সি.সি ছেলে, মেয়েদের নিয়ে কলেজের বাইরে।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই চমকে গিয়েছিল সুমনা।

ছেলেকে দেখেই সুহাসিনী দেবী কেঁদে ফেলেছিলেন। অভিমানে বিশ্বনাথ বাবু ছেলের সাথে কথা বলেন নি। বৌভাতের পর দিনেই কাউকে কিছু না বলেই ছেলে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। কোনো খোঁজ নেয়নি। নব বধূর সেবায় যত্নে দিন কাটাচ্ছিলেন সুহাসিনী দেবী ও বিশ্বনাথ বাবু। হঠাৎ ছেলেকে এভাবে সামনে দেখে দীর্ঘ দিনের জমে থাকা অভিমান, রাগ, অভিযোগ জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় দুই অসহায় বৃদ্ধ, বৃদ্ধার চোখ দিয়ে। তীর্থ বেশ কিছুদিন থেকে যায় বাবার রাগ আর মায়ের অভিমান ভাঙানোর জন্য। কলেজের চাকরিটা পারর্মানেণ্ট হয়ে যায় তীর্থর। পার্ট টাইম থেকে ফুলটাইম। নিজেকে অধ্যাপক হিসাবে ভাবতে বেশ ভাল লাগে তীর্থর। সে আর পিছনে ফিরে তাকাতে চায়না। ভাবতে চায়না প্রিয়াঙ্কার কথা। সময়ের সাথে সাথে মায়ের অভিমান ভাঙলেও বাবা এখনো কঠিন হয়ে আছে। 

নিজের স্ত্রীকে যেদিন মেনে নেবে,সেই দিনেই তোমার সাথে কথা হবে।

বাবার এই দৃঢ়তার কাছে ডিভোর্সের কথাটা আর উচ্চারণ করতে পারেনি তীর্থ। 

সুমনার গানের সুরে সারা ঘর ভরে উঠত। যত দিন এগিয়ে আসতে লাগল সুমনার গুনে মুগ্ধ হতে লাগল তীর্থ। গানটা ভাল গাও তুমি। বলেছিল তীর্থ। নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল সুমনা। ধন্যবাদ শব্দটা ধাক্কা দিয়েছিল তীর্থজিৎ কে। একদিন সুমনার দুটো চোখে চোখ রেখেছিল তীর্থ। শান্ত নিস্পাপ সরল দুটো চোখ। ডুব দিতে ইচ্ছে হয়েছিল তার সেই দুটো চোখে। বড্ড একা লাগে। নিজেকে অপরাধি মনে হয়। প্রিয়াঙ্কা আজ অন্য কারুর। ফুলসয‍্যার রাতে যে মেয়েটিকে দেখেছিল,সে ছিল ভীতু। এখন যে মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে সে আত্মসম্মানে পরিপূর্ণ এক নারী। তার অবর্তমানে তার মা, বাবার নিঃস্বার্থ সেবা করে গেছে। গানের স্কুল চালিয়েছে। অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

একটা নীল কালারের শাড়ি পরে প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে আসছে।

কলেজের বেশ কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল মুহুর্তের মধ্যে। প্রিয়াঙ্কার ছুটে আসা। জড়িয়ে ধরা। প্রথম চুমু। নিজেকে সংযত করে নিল তীর্থ। শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট টা পা দিয়ে পিষে ফেলল। দীর্ঘ সময় পর দেখা। সময়ের সাথে সাথে প্রিয়াঙ্কার মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের সেই চঞ্চলা প্রিয়াঙ্কা কেমন যেন শান্ত হয়ে উঠেছে। শরীরে মেদ জমেছে। মুখে পড়েছে বলিরেখা। সারা মুখে চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রিয়াঙ্কা মেসেজে লিখেছিল দেখা করার কথা। বিয়ের পর প্রিয়াঙ্কার সাথে এই প্রথম দেখা। প্রিয়াঙ্কার বিয়ে হয়ে যাবার পর তীর্থ তার ব‍্যাপারে মাথা ঘামায় নি। তার নতুন জীবনে ঢুকে পড়েনি কখনো।

চা খাবে। তীর্থ বলল।

একটু ভেবে নিয়ে প্রিয়াঙ্কা বলল, চলো না আমাদের সেই আগের রেস্টুরেন্টে। যেখানে আমরা কফি খেতাম।

আর কোনো কিছুই আগের মত নেই প্রিয়াঙ্কা। তীর্থ দেখল, জবাবটা পাওয়া মাত্রই প্রিয়াঙ্কার মুখটা ফ‍্যাকাসে হয়ে গেল।

চায়ে চুমুক দিল তীর্থ।

ঠোঁটের কাছে চায়ের কাপটা নিয়ে গিয়েও ঠোঁটে ঠেকাতে পারল না প্রিয়াঙ্কা। জানো তীর্থ, প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠিয়েই ও ওর দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে। বিদেশে ওর নতুন সংসার হয়েছে। সেখান থেকে দীপ কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারবে না। 

দীপ, তোমার বরের নাম?

হুম।

 তোমাদের ডিভোর্সটা হয়ে গেছে? 

দীপ বিদেশ চলে যাবার আগেই। 

তুমি এখন কোথায় থাকো?

বাবা চলে যাবার পর, মায়ের কাছেই ছেলেকে নিয়ে থাকি। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেছি। ফেসবুকে তোমাকে দেখার পর, এই রকম এক ক্রাইসিসে তোমাকেই-----।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা তো বন্ধু। এত হেজিটেড করছো কেন! অপারেশন এর ডেট কবে?

কাল। আজ এই মাত্র ছেলেকে ভর্তি করে তোমার কাছে আসছি। বড্ড একা লাগছে তীর্থ। প্রিয়াঙ্কার চোখের কোনে জল। 

খুব দুর্বল হয়ে উঠল তীর্থ। একটা অজানা কষ্ট ঘিরে ধরল তাকে। নিজের অজান্তেই প্রিয়াঙ্কার হাতের উপর হাত রাখল তীর্থ।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা। এখনো সুমনা বাড়ি ফেরেনি। ছাএ-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গানটা বেশ ভালই গায় সুমনা। চা টা বসাল তীর্থ। চিনি আর চা পাতা দিতে দিতে ভাবল, আজ প্রিয়াঙ্কার সাথে তার দেখা করার কথাটা কি বলবে সুমনাকে! তারপর নিজেকে বোঝাল, না থাক। সে শুধু শুধু চিন্তা করবে। প্রিয়াঙ্কার সাথে তার একটা অতীত আছে। সুমনা জানে। কিন্তু সে এ বিষয়ে কোনো কৌতুহল দেখায়নি। প্রশ্নও করেনি কোনো দিন। একসময় তীর্থ কিছু টাকা দিয়ে সুমনার দায় ঘাড় থেকে নামাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা,মার মৃত্যুর আগে তারই অসুস্থ বাবা,মাকে সে যে ভাবে সেবা করেছে, সে ছেলে হয়েও তা করতে পারেনি। আস্তে আস্তে যত দিন গেছে সে নিজেও সুমনার উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। ভালবেসেছে। বলা হয়ে ওঠেনি। কলিং বেলের আওয়াজ। সুমনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চা টা এগিয়ে দেয় তীর্থ। সুমনা কাপড় ছেড়ে সন্ধ‍্যে দেয়। গোপালের শয়নের ব‍্যবস্থা করতে হবে। গোপালকে শয়ন দেয় সুমনা। 

 কী সব ছেলেমানুষী! পুতুল খেলা। ভাবতে থাকে তীর্থ। অন্য দিনের থেকে সুমনাকে আজ বেশিই ক্লান্ত লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তিত। সুমনার চিন্তার কারণ সে জানে না।

কিছু জিজ্ঞাসা করতে তার আজ ইচ্ছে হচ্ছে না। সেও খুব চিন্তায় আছে। প্রিতমকে নিয়ে। কাল ছেলেটার অপারেশন। সুমনাকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না তীর্থ। কুকারে সুমনা খিচুড়ি বসায়। সিটি পড়তে থাকে। সারা ঘর খিছুড়ির গন্ধে ভরে যায়। মনটা ভাল হয়ে যায়। খিদেটা আরও বাড়তে থাকে তীর্থর।

হসপিটালের বেডে প্রিতম শুয়ে। ছ'বছরের একটা বাচ্চা। প্রিতম নামটা তীর্থর খুব পছন্দের ছিল। কলেজ মাঠে প্রিয়াঙ্কাকে বলেছিল, তাদের ছেলে হলে প্রিয়াঙ্কার নামে নাম মিলিয়ে রাখবে প্রিতম। কিন্তু তার দেওয়া নামটাই বা কেন রাখল প্রিয়াঙ্কা! প্রিতমকে দেখার পর থেকেই সে আলাদা একটা টান অনুভব করছে। মায়া ভরা দুটো চোখ। নাকটা যেন তারই মত।

হসপিটালের মধ্যে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। টেনশেনটা বেড়েই চলেছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। প্রিয়াঙ্কা হসপিটালের ভেতরেই আছে। একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে। সিগারেটে টান দিতেই তীর্থ দেখে, গেটের কাছে সুমনা। সে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তীর্থ কিছু বলার আগেই প্রিয়াঙ্কা ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। তীর্থ অপারেশন সাকশেসফুল। এই মাত্র ডাক্তার জানালেন। 

সুমনা তুমি এখানে! তীর্থ বেশ অবাক হয়েই সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তীর্থর বুক থেকে মুখ তোলে প্রিয়াঙ্কা। মুখে এক গাল হাসি নিয়ে বলে, ইনি আমার ছেলের গানের শিক্ষিকা। 

এনার কাছে গান শিখতে গিয়েই প্রিতম জ্ঞান হারায়। অনেক চিকিৎসার পরেই জানা যায় প্রিতমের এত বড় অসুখ।  

তীর্থ ভেবে পায়না কী বলবে। সুমনার পাশে দাঁড়ায়। প্রিয়াঙ্কা,এ আমার স্ত্রী।

 রাত গভীর হতে চলল। তীর্থর চোখে ঘুম নেই। হসপিটাল থেকে ফেরার পর সুমনার সাথে কোনো কথা হয়নি। সুমনা কখন বাড়ি চলে এসেছে তীর্থ তা টের পায়নি। প্রিতমের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তীর্থ হসপিটালেই থেকে গিয়েছিল। কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার উপর। প্রিতমকে স্পর্শ করলে তীর্থ এক আলাদা শান্তি পায়। সুমনার সামনে এভাবে তার অতীত চলে আসবে ভাবতে পারেনি সে। সুমনা আজ গোপালকে শয়ন দেয়নি। রান্না ঘরে রান্নার কোনো চিহ্ন নেই। বিছানার এক কোনে পড়ে আছে সুমনা। কীসের এত অভিমান, বোঝে না তীর্থ। প্রিয়াঙ্কার কথা গোপন করেছে বলে! কিন্তু তাদের মধ্যে তো কোনো স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। শুধু বন্ধুত্বের দাবী নিয়েই তারা এই এক কামরার ফ্ল‍্যাটে থেকে গেছে দীর্ঘদিন ধরে। 

খোলা ব‍্যালকনির সামনে এসে দাঁড়ায় তীর্থ। অনেক দিন আগে সুমনা একবার বলেছিল, তার এক ছাত্রের লাংসে ফুটো ধরা পড়েছে। অপারেশন করতে হবে। 

কোন ছাত্র, তীর্থ জিজ্ঞাসা করেনি। সময়ের সাথে সাথে ভুলে গেছে সুমনার বলা ছাত্রের কথা। এই এক কামরার ফ্ল‍্যাটটাতে প্রিয়াঙ্কার সাথে একের পর এক রাত কাটিয়েছে তীর্থ। প্রিয়াঙ্কা বাধা দিয়েছে। তীর্থ শোনেনি। আর কিছু ভাবতে পারছে না তীর্থ। দীপ প্রিয়াঙ্কাকে সন্দেহ করে ডিভোর্স দিয়েছে।

মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। সুমনার সিগারেটের গন্ধ সহ‍্য হয়না। সিগারেট টা ধরাতে গিয়েও ধরাতে পারল না তীর্থ। সুমনার কাছে শুনেছিল, ফুলসয‍্যার রাতেই তার ছাত্রের মাকে তার স্বামী সন্দেহ করতে শুরু করে দিয়েছিল। তার মানে সেদিন সুমনা প্রিয়াঙ্কার কথাই বলছিল। আর কিছু ভাবতে পারল না তীর্থ। সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। রাগে মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। কেন কিছু বলল না প্রিয়াঙ্কা! এত বড় কথাটা গোপন করে গেল। বিশ্বাস করতে পারেনি তাকে। ভরসা করেনি। প্রিয়াঙ্কা বুঝেছিল, তীর্থ কখনোই পারবে না তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বিয়ে করতে। স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স নিতে।  

কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না তীর্থ। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সুমনা ঘুমিয়ে পড়েছে। তীর্থর ইচ্ছে হল,সুমনাকে ডাকতে। জড়িয়ে ধরতে। চিৎকার করে বলতে, আমি তোমাকে ভালবাসি। প্রিয়াঙ্কা আমার অতীত। তুমি আমার বর্তমান। 

আস্তে আস্তে তীর্থর চোখে ঘুম নেমে এল। একটা রাত সে চেয়ারেই কাটিয়ে দিল। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। জানালা বন্ধ। ঘরে আলো ঢোকেনি। চায়ের গন্ধ নেই। গোপালের থালায় পিঁপড়েতে বাসা বেঁধেছে। আয়নায় বেশ কিছু টিপ চেটানো। চিরুনিতে কয়েকটা চুল। তীর্থর ঘুম ভাঙে। তার সাধের ফ্ল‍্যাট টা শ্রীহীন হয়ে আছে। তীর্থ খুঁজতে থাকে সুমনাকে। ফোন করে। রিং বেজে যায়। হাতে পায় একটা চিঠি।

'আমি চললাম আমার গানের জগতে। গানই আমার সাধনা। দীপ প্রথম রাতেই জেনেছিল, প্রিয়াঙ্কা তার প্রেমিকের সন্তানের মা। তুমি তোমার সন্তানের মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিও। '

সুমনার চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে তীর্থ। নিজের অজান্তেই গোপালের সামনে হাত জোড় করে বসে পড়ে সে। কোলে তুলে নেয় ছোট্ট গোপালকে। কিছুই চাইতে পারে না। শুধু গোপালের মধ্যেই তীর্থ দেখতে পায় প্রিতমের মুখটা।

                       

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024