উত্তর ছাড়া অঙ্ক - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Uttar Chara onko - Dorpona Gangapadhyay || Short Story || ছোটগল্প
উত্তর ছাড়া অঙ্ক
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
এখন আমি এসে পড়েছি একজন পুরনো আমলের জজের বাড়ি। পেল্লায় উঁচু পেল্লায় বড় কিন্তু সব ঘর গুলোই ভীষণ অ যেস্বাস্থ্যকর।উঠোন ভর্তি আগাছায় ভরা,--- ড্রেনগুলো বুঝে গিয়ে ময়লা জমে দুর্গন্ধ বেরচ্ছে : বাঁ পাশ দিয়ে পরপর দুটো ঘর তালা বন্ধ ।জানলা গুলো ভাঙা,পাল্লা নেই, দেয়াল গুলো প্লাস্টার খসে দাঁত বার করে একেবারে বীভৎস ।
ওরই একটা ঘরে বন্দী আছে সুতপা। তারপরের পশ্চিম দিকের ঘরে ভাড়াটে বহু বছর ধরে ভাড়া না দিয়েই রয়ে গেছে, উত্তরে দুটো ঘর ছোট বড় সে ঘর গুলোও তালা মারা প্রমোটিং হলেই ছুটে আসবে পুরনো উঠে যাওয়া ভাড়াটিয়া।
উপরে থাকে বাড়ির মালকিন। সিঁড়িগুলো বেখাপ্পা ,আর কোন জানলা নেই, অন্ধকার ঘুট ঘুট করছে, ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে লেফট রাইট করতে করতে ওপরে উঠেই দেখি ওরে বাবা,! খোলা বারান্দা ! ঝুলছে ---সেখানেই প্রবেশ করতে দেখি ,এখানে আলো আছে ,কিন্তু ভুল পদক্ষেপে একেবারে নিচে পড়ে যেতে পারি। ভয়ে খুব ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। মালকিন এগিয়ে এসে বললেন," এই আমার রান্নাঘর ", দেখলাম! বিশাল বড় একটা ঘর, চারিদিকে প্লাস্টার খসে পড়ছে , মেঝে গুলো ওদোল খোদল ,জানলার একটা পাল্লা আছে তো অন্য পালা নেই, নিচে বিড়ালরা ঘুরোঘুরি করছে আরশোলাটা ঝটপট করে উড়ে টিকটিকির মুখে পড়ে গেল।
মালকিন বলল দরজার পাল্লা নেই ,
এইটা শোবার ঘর, আসুন---, শোবার ঘর দারুণ অসুস্থ ,নোংরা চাদর বালিশ, মোটা কালো মশারি, খড়খড়ির জানলা বেয়ে হুহু করে উত্তুরে হাওয়া ঢুকছে ,যত্র তত্র বিচ্ছিন্ন জামাকাপড় ,নোংরা একটা পুরনো আগেকারের টিভি, ফ্রিজে জং পড়ে গেছে, ওখানেই বসার অনুরোধ করল। আমি বললাম ,না না---, আমি বসবো না। আমি একটু সুতপার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম যদি ভালো হতো।
আর ওকে নিচে রেখেছেন কেন?
আপনি আপনার সঙ্গে রাখেননি কেন ?
প্রশ্নের উত্তরে বলল মালকিন, কি করব বলুন ,বারান্দাগুলো খোলা--- জানালা দরজার ঠিকমত পাল্লা নেই ওরকম মানুষ খেয়ালে কি করে বসে কে জানে?
চলুন নিচে সুতপার ঘরে যাই,---
যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম রান্না কি আপনি করেন ? মালকিন উত্তরে বলল, না, ছেলে অথবা বোন দুজনের কেউ না কেউ খাবার দিয়ে যায় ।নিচের ঘরের তালা খুলতেই দেখি সুতপা বসে আছে ।ঘরের মাঝখানে একটা ফুটো টুল বসানো তাতেই বসে চান পায়খানা সারে, মা পরিষ্কার করে। চারিদিকে ফিনাইল ছড়ানো ,অল্প একটা এল-ই-ডি আলো জ্বলছে, টিমটিম করে !একটা ছোট ক্যাম খাট তার ওপর বসে আছে। মশা সারা ঘরে ভোঁ ভোঁ করে ডাকছে ,ঘরের উত্তরে ও পশ্চিমে দুটো জানলা থাকা সত্বেও ,জানলা গুলো বন্ধ। দক্ষিণের দিকে দরজা,---
দরজা সব সময় তালা বন্ধ থাকে । জিজ্ঞাসা করলাম ঘরের মধ্যে সব সময় ভালো লাগে ?
অবলীলায় উত্তর দিল,--- হ্যাঁ ! বাইরের সব লোক খারাপ! বদমাইশ ! কেউ আমার ভালো চায় না,--- তাছাড়া আমি পাগল !
আমার সঙ্গে তো খারাপ ব্যবহার করবেই ----
আশ্বস্ত করে বললাম ,তোমায় দেখে তো আমার পাগল বলে মনে হচ্ছে না ,শুনেই সে ভীষণ জোরে হাসতে শুরু করল,---
হা হা হা হা ঐ যে নাটের গুরু আসছে,--- কে আসছে ? প্রশ্ন করলাম,
উত্তরে, ওই যে প্রভাস ! বড়লোকের মেয়ের থেকে টাকা খেয়ে ওকে আগে মঞ্চে তুলে গান গাওয়ালো
যখন সব লোক চলে গেছে তখন আমাকে তুলল ,আমি গাইলাম মেরি খৃস্ট মাস, জিংগেল বেল কিন্তু সবাই পেছন ফিরে গল্প করছিল কেউ আমার গান শুনছিল না। তখন হঠাৎ রবীন্দ্র সংগীত ধরি। "তোমারও অসীমে
প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই ---" সুন্দর গলা একবার হাতে তালি দিয়ে মেরি ক্রিসমাস গাইছে একবার রবীন্দ্র সংগীত গাইছে, সুন্দর!
তারপর জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করল, আমি শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কাঁদছো কেন ? সুন্দর হচ্ছে গান শুনছি তো---
প্রভাস তুমি শুধু পয়সাটাই দেখলে ,আমার ভালোবাসা তোমার চোখে পড়লো না। প্রভাস আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। শান্ত করে বললাম। কেঁদো না ,তোমার জন্য আমরা অন্য ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেব ,যে তোমাকে ভালবাসবে তোমার সব কথা শুনবে,--- ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে বলল পাগলের বিয়ে ,----
হা হা হা হা আবার বিকট হাসতে শুরু করল---
থামিয়ে বললাম, চুপ। তুমি পাগল এ কথা কে বলেছে,? সবাই বলেছে ---বিকট চিৎকার করছে,--- চেঁচিয়ে ওঠে সুতপা। পাগলা গারোদ চেনো? মার জানো ? ইলেকট্রিকের শক ? ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে বাথরুম থেকে বের করে মার,--- অত্যাচার তারপর হুহুঁহু সুর করে কাঁদতে থাকে ,
আমি বাইরে যেতে চাই না--- বাইরের সব লোক খারাপ! আমি বলি চিপস খাবে? তুমি তো খুব ভালোবাসো, লজেন্স ? তখনো হু হু করে কাঁদতে থাকে। মালকিন
বলেন সেই পরশুদিন আমাকে দিয়ে এই চিপসটা আনিয়েছে। এখনো পড়ে আছে। কিছুই খেতে চায় না।
সুতপা হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে
মশা মারতে শুরু করল--- তারপর বলল, আমি ভূত নিজের চোখে দেখেছি, একটু পরেই ওরা আসবে ,তোমরা চলে গেলেই ,ওরা আমার চারপাশে জুড়ে নাচবে। গান গাইবে, তালি দেবে !আমিও ওদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গান গাইবো !তালি দেবো !
কিন্তু কখনো কখনো ওরাও রাগ করে,-- বেসুর হলেই ! গলা টিপে দেয় ---
আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর স্বরটা লাগিয়ে আবার গাই, তখন আবার ঠিক হয়ে যায় ।"মানুষ হয়ে তো বাঁচতে পারলাম না, ভূত হয়ে বেঁচে আছি "--- আবার হা হা হা হা হাসি
একবার আমি আর প্রভাস শ্রুতি নাটক করেছিলাম,---
মাত্র ১০ বার রিহার্সাল, দুটো পিরিয়ডের সময়ের মধ্যে,
তারপরই মঞ্চস্থ ---
" একবার আমি ভুল করে স্মার্টলি পরের ডায়লগ টা বলে ফেললাম, কটমট করে প্রভাস তাকিয়ে দাঁতে চেপে চেপে অন্য ডায়ালগ বলে দরকারি প্রথমের ডায়ালগ টা নিজেই বলে নিয়ে পরেরটা বলে সামনে নিল। আমি এবার থেকে সিরিয়াস হয়ে গেলাম আমার আর ভুল না কিন্তু হোঁচট খেলো প্রভাস, আমিও ওর মত করে সেই হোঁচট সামনে নিলাম নাটক শুনে সকলেই বলল,--- দারুন ! দারুন ! দারুন ! নাটকের মধ্যে আমাদের নাটকীয়তা কেউ বুঝতে পারল না।
সেসব মানুষের জীবনের কথা ভুলতে চাই ,পারিনা!---
আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম তোমার ঘরে এত ফিনাইল ফেলা কেন ?সুতপা বলে ওই যে, মাঝে মাঝে আমি বাথরুম করার কথা ,অনুভব করতে পারি না, করে ফেলি। ঘরে গন্ধ ছাড়ে মা পরিষ্কার করে, জানি মার কষ্ট হয়। ওরা যে আমায় মেরে মেরে অত্যাচার করে আমায় শেষ করে দিয়েছে ,তারপর ও খুব ক্লান্ত অনুভব করে। কেমন যেন এক পাশে ঘাড় গুঁজড়ে চুপ হয়ে বসে যায় ।
ও- আর -এস গোলা জল ওর মুখে ঢেলে দেয় ওর মা ,আস্তে আস্তে খেতে খেতে জলটা ঘুমিয়ে যায় ।ওর মা গুছিয়ে বালিশটা মাথায় দিয়ে, চাদরটা চাপা দিয়ে একটা মশার ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণ আমি নীরব দর্শক হয়ে থাকি।।
তারপর মালকিনকে বলি, আপনি বাড়িটা প্রমোটিং করে নিন, ছেলের জন্য আলাদা, আর মেয়ে আর আপনার জন্য আলাদা, দুটো ফ্ল্যাট নিন,--- সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকুন, কিছু টাকাও পাবেন, ছেলে আর মা
মিলে ভাগ করে নেবেন।
মালকিন বলল আমি চাইলেই তো হবার নয় ,
সুস্থ পরিবেশ ছেলেমেয়েদের সুস্থ জীবন ,সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি--- কে না চায় ! কিন্তু সব কিছু ভাবলেই তো কাজ হয় না !
ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে,--- না ,আমি চাকরি পাবো!
অনেক টাকা রোজগার করব। তখন নিজেই বাড়ি ভেঙে ,বাড়ি বানিয়ে নেব। বজ্জাত ননী, আমাদের বাড়ি এতদিন বিনা পয়সায় থেকে হয় না, ঘর নেবে? আমি জজের নাতনি। আমিও জজ হবো, না হতে পারি দাদার ছেলেমেয়েরা হবে ,কিছুতেই প্রমোটিং করতে দেব না। আমাদের বাড়ি ভাঙ্গা পচা। পচাই থাক । মা,--- এই দুষ্টু বদমাশ লোকটাকে তাড়াও না হলে, আমি মেরে ,মেরে ফেলবো। আমি ফ্ল্যাট করে সুস্থ থাকবো, আর আমার পরবর্তী জেনারেশন ভাঙ্গা ফ্লাটে থাকবে।
বের হও ,---হও বলছি !দুমদাম ভেতর থেকে ভয়ানক আওয়াজ আসতে লাগলো! মালকিন আমায় ইশারায় চুপ থাকতে বললেন, তারপর ধীরে ধীরে মেয়েকে ডাকলেন, মানা ও প্রোমোটার নয়। তুই ভুল করছিস। মানা শোন ও এনজিওর লোক তোর বিয়ের জন্য এসেছে।
ভেতর থেকে,--- আমি জানি আমি "পাগল "
তাছাড়া অত্যাচারিতা ধর্ষিতা---!
আমাকে কেউ কখনো বিয়ে করবে না,
কেউ না
কক্ষনো না
তুমি সব জানো
তুমি যাও যাও
তোমার সহ্য হচ্ছে
আমার হচ্ছে না
ওদের ঘোড়ার ঘাস কাটতে বলো
শুধু গসিপ করা ওদের কাজ! ছবি তুলে বিদেশের লোককে আমাদের উলঙ্গ চেহারা দেখানো ছাড়া ওদের কাজ নেই, একটা লুঙ্গি দান করলেও সেটার ছবি তুলে রাখে ,লোককে দেখায় "দান" করেছে। ওরা স্যান্টাক্লজ নয় মা!
মালকিন জানায়, আমি ছেলের জন্য অনেক টাকা ব্যয় করেছি, তবে ছেলে চাকরি পেয়েছে,
মেয়ের জন্য টাকা রেখেছিলাম,
চাকরি অথবা বিয়ে দেবো বলে, কিন্তু মেয়ের এই অবস্থা।
বিদায় নিয়ে পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলি ,এত অসুস্থ সমাজে আমরা আর কতো দিন হাঁটতে পারবো।।
কালো রাত্রি শেষ হোক। আসুক নতুন সকাল ,---
আসুক সত্যের দিন ,
সুন্দর দিন ,
ভালোবাসা দিন।।
Comments