স্বয়ংপ্রভা - পিনাকী দত্ত || Soyomprova - Pinaki Dutta || ছোটগল্প || Short Story

স্বয়ংপ্রভা

পিনাকী দত্ত 



একবুক অভিমান নিয়ে আকাশ যেন আজ কাঁদতে বসেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা সাদা জলকণা।প্রকৃতি নিজ হাতে সর্বাঙ্গে যেন সাদা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে।কাল রাত থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি ।মনে হচ্ছে কেউ যেন আকাশটাকে ফুটো করে দিয়েছে ।মাঠগুলো জলে থই-থই করছে ।কোথাও কোথাও ঘাসের সবুজ ডগাগুলো নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পা উচিয়ে একটু উঁকি মারছে ।জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো স্বয়ংপ্রভা।এখনো হস্টেলের কেউ সেইভাবে জেগে উঠেনি।যে করিডর সারাদিন গমগম করে তা এখন ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাওয়া প্যাণ্ডেলের মতই ফাঁকা।ওর রুমমেট রূপসাদি গভীর ঘুমে মগ্ন ।কী গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে ওর চোখে-মুখে।


স্বয়ংপ্রভার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আজও বুঝি যাওয়া হবে না ।অথচ সারা মাস সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটার জন্য । গতমাসেও এক্সাম এর জন্য সে যেতে পারেনি।মাও অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে এই দিনটার দিকে।মা দূর থেকেই যেন তার শরীরের ঘ্রাণ পায়

আর সেই ঘ্রাণকে জাপটে ধরে অপেক্ষা করে পরের মাসের।

আর তো কয়েকটা মাস।তারপরই তো তার কলেজ জীবন শেষ।হস্টেলটাও তাকে ছেড়ে দিতে হবে।এরপর কোথায় দাঁড়াবে সে ?এই ভাবনাটা ভাবতে বসলেই তার হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়।এতবড় পৃথিবী অথচ তার মাথা গোঁজার এতটুকু জায়গা নেই।


মামারা যদিও তার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। তবু তার সঙ্গে এমন একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছে যে, সেখানে ঠিক যাওয়া যায় না।তবে স্বয়ংপ্রভা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ ।নবম শ্রেণী থেকেই তো সে হস্টেলে।ঐ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পরেই তো ছোটমামা স্কুল চেঞ্জ করে বহুদূরে এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে ।কারণ এখানে মেয়েদের হস্টেল আছে ।দ্বিতীয়ত ঐ ভয়ানক রাতের স্মৃতি যেন তাকে তাড়া না করে।আর এখন তো স্কুল টপকে সে কলেজে ।


কিন্তু সত্যিই কি সে সব ভুলতে পেরেছে?না সমাজ তাকে ভুলতে দেবে ?কারও গায়ে একবার দাগ লেগে গেলে সমাজ তো তুলতে দেয়ই না বরং তার গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেয়।আর মেয়ে মানুষ হলে তো কথাই নেই ।


যত নষ্টের গোড়া এই শরীরটা।সে আড়চোখে একবার দেখে নেয় নিজের শরীরটাকে ।যেন বর্ষার ভরা নদীর ঢল নেমেছে তার শরীরে।যেমন একমাথা ঘন চুল তেমনি উদ্ধত বুক আর তার সাথে লাবণ্যমণ্ডিত মুখশ্রী। ব্যাস ! আর যায় কোথায়?এমনিতেই অরক্ষণীয়া মেয়েদের প্রতি পদে পদে বিপদ।তার উপর ভরা যৌবন । সমাজে রসিক পুরুষের তো অভাব নেই ।এক এক সময় স্বয়ংপ্রভার মনে পড়ে চর্যাপদের সেই প্রবাদটির কথা --'অপণা মাসেঁ হরিণা বৈরী'।


স্বয়ংপ্রভা লক্ষ করেছে কলেজে,হাটে-বাজারে সমস্ত পুরুষের দৃষ্টি তার বুকের দিকে ফেভিকলের মত সাঁটা থাকে ।অথচ প্রতিটি নারীর বুকের ভিতরেই চড়ুইপাখির মতই ভীরু ভীরু নরম তুলতুলে একটা মন থাকে-সেটা কয়জন পুরুষ বোঝার চেষ্টা করে ।প্রায় প্রতিটা পুরুষের মধ্যেই শরীরটাকে পাওয়ার জন্য কেমন যেন একটা হ্যাংলামো থাকে।ভাবে ওতেই বুঝি সব পেয়ে গেলাম ।শরীরের সাথে মনেরও যে একটা গভীর যোগ রয়েছে তা তাদের কে বোঝাবে? এসব দেখে ঘেন্না ধরে গেছে ওর পুরুষজাতটার উপর।তার উপর সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তো আছেই ।


শুধু রাতুলকেই একটু অন্যরকম লেগেছিল।ঘন কালো চুলের সদা হাস্যময় এক সহজ -সরল যুবক।যে বলে কম হাসে বেশি ।কলেজের প্রথম দিন, ম্যাম নাম ডাকতে গিয়ে তার নামের কাছে এসে থমকে গিয়েছিল।তারপর শ্যাওলা ধরা পুরানো প্রাচীরের মত মুখটা করে বিরক্তির সাথে উচ্চারণ করেছিলেন-'স্বয়ংপ্রভা সরস্বতীপুত্রী'। অ্যা ! এ আবার কিরকম নাম?বাপের জন্মে তো শুনিনি!


স্বয়ংপ্রভাও উঠে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠকন্ঠেই বলেছিল -'সরস্বতী আমার মায়ের নাম আর আমি তার কন্যা'।

'কেন তোর বাপ নেই বুঝি?'-সবাই হেসে উঠেছিল ।শুধু রাতুল ছাড়া ।

দ্বিধাহীন কন্ঠে বলেছিল -না ,নেই।

যদিও এর জন্য ছোটমামাকে কম লড়তে হয়নি।তবে তিনি হাল ছাড়েননি।স্বয়ংপ্রভা শুনেছে- মা ছোটমামাকে একটাই অনুরোধ করেছিল -তার মেয়ে যেন তার নামেই বড় হয়। তার নামেই পরিচিতি পায়।নামের শেষে কোন পুরুষের পদবী বসুক তিনি চাননি ।পুরুষমানুষের জন্যই যখন সে এই বিরাট পৃথিবীতে একা হয়ে গেল তখন তাদেরই দেওয়া কোন পদবী তার মেয়ের গায়ে সেঁটে থাক তিনি চাননি ।


স্বয়ংপ্রভা প্রথম থেকেই নিজের চারপাশে একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছিল ।সেখানে সে নিজেই রানি।কাউকে কৈফিয়ত্ দেওয়ারও নেই,কারো হুকুম তামিল করার দায়ও নেই।এজন্য হস্টেলে অবশ্য তাকে কম বাঁকা কথা শুনতে হয়নি।কেউ বলেছিল 'ঢং দেখে আর বাঁচি নে' ,কেউবা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল -'রূপের দেমাক।দেখি কতদিন থাকে'?

আসলে ওর ভেতরটা কেউ উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেনি।ভেতরে ভেতরে যে সে কতটা নিঃস্ব, তা কাকে বলবে?

হ্যাঁ ।রাতুল, রাতুল হয়তো তার দুঃখ বুঝতে পারত।কিন্তু সে-ই তো রাতুলকে মনের দরজাতেই আটকে দিয়েছে।সেবার নবীনবরণে গ্রিনরুমে ওকে একা পেয়ে রাতুল সাহস করে বলেছিল-


'ঐচোখে চোখ যদি মেলাতে না পারি

তবে বৃথা এ জনম, একবার নয়, শতবার মরি'।


প্রভার মন-কলস চলকে উঠেছিল। কিন্তু উপুড় হতে দেয়নি ।তার আগেই সামলে নিয়েছিল।কারণ ও জানে এসব চুটকো চাটকো প্রেম - ভালোবাসা ওর জন্য নয়।ওর সামনে একটাই লক্ষ্য।


পুরুষদের ওর বড্ড ভয়।সে জানে, চুন খেয়ে যদি মুখ পুড়ে তবে দই দেখলেও ভয় করে।ওর হাতে আর মাত্র পাঁচটা বছর আছে ।যা করার তা এই পাঁচ বছরেই করতে হবে ।মাকে শেষ জীবনটা একটু সুখে রাখতে হবে।

রাতুল বলেছিল -' আমরা দুজনে কি মাকে সুখে রাখতে পারি না'?

আৎকে উঠেছিল প্রভা।না,এসব কথা শুনতে চায় না সে।এসব কথা শুনলেই তার ভয় হয় ।পাছে লোভ হয় ।এতদিনের সাধনা কি বিফলে যেতে দিতে পারে?মন যে মাঝে-মাঝে বিদ্রোহ করেনি তা নয়।শত হলেও সেও তো রক্ত মাংসের মানুষ ।আর হস্টেলের মেয়েদের মুখে তো প্রায়ই তাদের নূতন নূতন প্রেমের কথা ,বয়ফ্রেন্ড্ এর সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনতে পায়।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন য়েছিল ।হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তেই সে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল।দেখল রূপসাদি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।

রূপসাদি বলল-কিরে ,এখনো বের হোসনি?যা ,আমার রেনকোটটা নিয়ে যা।এরপর বেরিয়ে তো আর লাভ হবে না ।

স্বয়ংপ্রভা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রূপসাদি নিজেই চুপ করিয়ে দিল।বলল-না, এখন না ,পরে কথা হবে ।তুই ফিরে আয় আগে ।

রূপসা আজ প্রায় দুবছর ধরেই দেখছে যে,স্বয়ংপ্রভা প্রতি মাসেই মায়ের সাথে দেখা করতে যায়।কিন্তু কোথাও যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে তা তার নজর এড়ায়নি ।স্বয়ংপ্রভা যেহেতু বিষয়টা গোপন করতে চেয়েছে সেহেতু রূপসাও কৌতূহল না দেখিয়ে সম্মান জানিয়েছে।

রূপসাদির আরেকটা কথাও খুব মনে পড়ে-'ঠিক একদিন তুই নিজে থেকেই বলবি ।প্রতিটি মানুষেরই একটা অবলম্বন দরকার হয়।সেই অবলম্বন মানুষ ঠিক খুঁজে পায়।যেদিন পায় সেদিন তার সব বাঁধন খুলে যায় ।একদিন আসবে যেদিন ঝর্ণার মতই সব কথা তোর ভেতর থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসবে ।তুই কিছুতেই তার গতি রোধ করতে পারবি না।


আরও বলেছিল, প্রতিটি মানুষের মনেই একটা গোপন চোরকুঠুরি আছে।যা তার একান্ত নিজস্ব।এখানে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে না ।আর এখানকার লুক্কায়িত সম্পদ হল - দুঃখ,যন্ত্রণা, কষ্ট। যা তোর -শুধুমাত্রই তোর।


সে যখন হস্টেলে এসেছিল তখন এই রূপসাদিই তাকে দুহাতে আগলেছে।অথচ একটিবারের জন্যও তার পারিবারিক জীবনের প্রতি অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ করে নি।শুধু নামটাই জেনে নিয়েছিল ।হেসে বলেছিল-'বাবারে! অতবড় নাম আমি বলতে পারব না ।শুধু প্রভা-ই বলব।তোর আপত্তি নেই তো?'

বড় ভালো লেগেছিল রূপসাদির এই আপন করে নেওয়ার ক্ষমতাকে।সে ঘাড় নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলেছিল।সেই রূপসাদিও কাল চলে যাবে।ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ।


রূপসাদিকে দেখলে কে বলবে, ওর ভেতরেও একটা গভীর ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি লুকিয়ে আছে।ওর জামা -কাপড় ,কসমেটিক্স, দেশি-বিদেশি পারফিউম ,রিস্টওয়াচ ,জুতোর কালেকশন্ দেখলেই বোঝা যায় কতটা অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে।ওর বাবা একটা নামী কলেজের অধ্যাপক ।মাও নামকরা স্কুলের শিক্ষিকা ।যথেষ্ট সুন্দরী ।বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোথাও কোন অসংগতি নেই। অথচ বাবা -মা দুই মেরুর বাসিন্দা ।বাবা তার বিশেষ ছাত্রীর উন্নতি নিয়ে চিন্তিত আর মাও তার স্কুলের কলিগকে নিয়ে ভাবিত ।এর মধ্যে রূপসা কোথায় ?


রাত নটা বাজতেই হস্টেলের খাবার ঘন্টি বেজে গেল ।সবাই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করল।আজ বিশেষ খাবার দাবারের বন্দোবস্ত হয়েছে ।সব জুনিয়র মেয়েরাই করেছে ।কাল 6th sem এর দিদিরা চলে যাবে।তাই ফেয়ারওয়েল পার্টি আর কি।স্বয়ংপ্রভা নামেনি।ওর এসব হৈ- হুল্লোড় কোনদিনই ভালো লাগে না। পরে এক ফাঁকে গিয়ে খেয়ে আসবে ।


যদিও আজ মেনুতে যা-যা হচ্ছে তার মধ্যে মাটনকষা ওর খুবই প্রিয় ।সন্ধ্যার সময় ও একবার কি দরকারে যেন কিচেনে গিয়েছিল। দেখেছে খাসির মাংসের সাথে প্রচুর চর্বি এসেছে ।এখানে তো চর্বিগুলো ঝোলে দিয়ে একরকম নষ্টই করবে ।মা হলে চর্বির বড়া করত। চর্বির বড়া ওর খুবই প্রিয় ।মায়ের হাতে চর্বির বড়া হতোও ফাটাফাটি ।মা প্রথমেই চর্বিগুলোকে আলাদা করে নিয়ে একটু গরম জলে ভাপিয়ে পিস পিস করে নিত।তারপর আতপচাল বেটে তার সাথে পরিমাণ মত নুন-হলুদ ও মিষ্টি মিশিয়ে বড়া করত।গরম ভাতের সাথে কাঁচালংকা আর নুন মাখিয়ে খেতে যা লাগত না ! স্বয়ংপ্রভার জিভে জল চলে এল।যদিও হস্টেলে এই সব ভাবা বিলাসিতা ।হস্টেলের সেই একঘেয়েমি রান্না ।

রূপসাদি অবশ্য অনেক আগেই নেমে গেছে ।ওর যাওয়াটাই স্বাভাবিক।কলেজ লাইফের শেষদিন বলে কথা।তার উপর জুনিয়র মেয়েরা কি সব নাচ গানের ব্যবস্থা করেছে।সবাই তো আর ওর মত কুড়িতে বুড়ি নয়।


ঘুম আসছে না।কেবল থেকে থেকে মায়ের কান্না ভেজা মুখটাই ভেসে উঠছে ।স্বয়ংপ্রভা বুঝল ,ঐমুখ আজ আর তাকে ঘুমাতে দেবে না।সে একটা বই টেনে নিল।

এমন সময় রূপসাদি ঘরে ঢুকেই ছো মেরে বইটা তুলে নিল।তারপর সেটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা হাত কাঁধে রেখে ও একটা হাত দিয়ে থুতনিটা তুলে ধরে গুনগুন করে গেয়ে উঠল-

'

'এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি, কেন একা বয়ে- বেড়াও

আমায় যদি তুমি বন্ধু মান,কিছু জ্বালা আমায় দাও'।


তারপরই টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। বলল-'আজ সারা রাত ঘুমাব না।তোর কথা শুনব'।


জান রূপসাদি ,মায়ের বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে,-প্রবাসী বাঙালি পরিবারে।কানপুরের কাছাকাছি কোন জায়গায় ।আমার ঠাকুমা বাঙালি ছিলেন না ।কিন্তু বৌ হয়ে এসে বাংলাটা মোটামুটি শিখে নিয়েছিলেন।ঐ হিন্দী টানে বাংলা বলতেন আর কি।মাকে দারুণ ভালোবাসতেন।একদিনের ঘটনা তো মা খুব বলতেন।

'বহু, এ বহু ,জলদি ইধার আ।দেখ্ তোর জন্যে হামি কি লিয়ে এসেছি '- বলে এমন হাঁক পাড়তে লাগল যে, মা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।মা ছুটে গিয়ে দেখে ,ঠাকুমা মিটিমিটি হাসছে আর চোখে খুশি ঝিলিক মারছে ।

'খোল তো বহু '।বৌ বলতে চাইলেও ঠাকুমার মুখ দিয়ে 'বহু'বের হত।কিন্তু তিনি ভাবতেন বাঙালির মতই তিনি বৌ বলেছেন-এইভেবে খুশি হতেন ।

মা সাবধানে প্যাকেটটা খুলে দেখে কয়েক পিস মাছ।মা মুখ তুলতেই ঠাকুমা খুশি খুশি মুখে বলে উঠল- 'রুহি মছলি।আচ্ছাসে পাকাবি কেমন।'অথচ মা জানে পুরো পরিবারটিই নিরামিষাশী।শাশুড়ি তো কোনদিন মাছ ধরেনইনি।অথচ সেই শাশুড়ি আজ তার জন্য মাছ নিয়ে এসেছে।এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠেছিল।

আমি তখন পেটে।বাবা-মা যখন তাদের আগত সন্তান নিয়ে খুশিতে মশগুল তখন মাঝরাতে একদিন বাবার কাছে এল সেই কালান্তক ফোন-'সাবজী ,কারখানামে আগ লগ গ্যায়া'।বাবা গিয়ে দেখল সব শেষ।

ধাক্কাটা সামলাতে পারল না।সারাদিন কোন কথা বলত না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।হা-হা-হা করে হাসতে হাসতে কান্নায় ভেঙে পড়ত।প্রথম প্রথম মা খাবার দিতে গেলে চিনতে পারত ও খাবার খেত।ধীরে ধীরে খাবার খাওয়ায় বন্ধ করে দিল।আর চিনতেও পারত না কাউকে ।কেউ সামনে গেলেই আঁচড়ে কামড়ে দিত।বদ্ধপাগল হয়ে গেল।শেষ পর্যন্ত পাগলা গারদে রেখে আসতে হল।

আমি হলাম ।ঠাকুমাই সব করলেন ।আমাকে পেয়ে ঠাকুমার খুশি আর ধরে না।বলতেন-' হামার ঘরে লকসমী এসেছে ।বহু তুই এর যতন করবি ।'তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন 'মেরে অরবিন্দ্ দেখে যেতে পারল না।হায় রামজী!'

সেদিন গুমোট গরম। মা আমাকে নিয়ে বারান্দায় শুয়েছিল। এমন সময়-ঠাকুমা মাকে ডাকল।মা দেখল-ঠাকুমা কাঁদছেন।মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন-'বহু,তু হামার বিটিয়া আছিস ।ফিরসে নয়ি জিন্দগি শুরু কর।অরবিন্দ্ ঠিক নেহি হোগা।আপনা জিন্দগি কিউ বরবাদ করবি।মেরে ঘরমে আ কর তুঝে সুখ অর চ্যান কুছভি নেহি মিলা।হো সাকে তো মুঝে মাফ কর দেনা।' বলেই মায়ের হাত দুটো জ্ড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

মা-ও কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে নীরবেই কাঁদছিল ।ঠাকুমা হঠাৎই বাচ্চা মেয়ের মত মার কোলে মাথা দিয়ে শুতে চাইল।বলল- ' মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো।নিদ্ আসছে না'।

মা হাত বুলাতে লাগল ।ঠাকুমা পরম শান্তিতে ঘুমাতে লাগলেন ।কিন্তু কে জানত এই ঘুমই ঠাকুমার শেষ ঘুম।পরের দিন ঠাকুমাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল।

ছোটমামা আমাদের নিয়ে এল।স্বয়ংপ্রভা একটু থামল।আসলে এগুলো তো আর কথার কথা নয়,এগুলো হলো মনের সাথে এক একটা যুদ্ধ ।

কিছুদিন যাওয়ার পর মা কিছুতেই বসে থাকতে চাইলো না।ভাগ্যক্রমে বাড়ি থেকে একটু দূরে দুই বুড়ো-বুড়িকে দেখার দায়িত্ব পেল।দেখতে-দেখতে আমিও সাত- আটে পা দিলাম।মায়ের ব্যবহারে দুই বুড়ো-বুড়ি মাকে আপন করে নিল।মাকে ছাড়া তাদের একমুহূর্তও যেন চলে না।সবসময় মুখে সরস্বতী-সরস্বতী লেগেই আছে। সেবার বুড়ো মাকে বলল, -'চল্ সরস্বতী আমাদের দেশের বাড়ি।দেখবি বর্ধমানের চরকের মেলা কিরকম হয় ?তোর খুব ভালো লাগবে ।অনেক দিন তো কোথাও বের হোসনি।চল্। না করিস নে।'


এই প্রথম মাকে একটু সাজতে দেখলাম।সেরকম কিছুই না।চোখে হালকা একটু কাজল,মুখে একটু ক্রিম আর চুলটা খোপা করে বেঁধে তাতে একটা ফুলের মালা ।ব্যাস ।আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।আমার মা এত সুন্দরী!মা আমাকে অনেক আদর করে দিদার কাছে লক্ষ্মী হয়ে থাকতে বলে চলে গেল।যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেল-'আমার মামণির জন্য ইঅয়াব্বড় পুতুল আনব'।


সেখানেই মায়ের সাথে আমার নূতন বাবার (দ্বিতীয় স্বামী)প্রথম দেখা।চোখাচোখি, মন বিনিময়।কি যে এমন হল, মা পাগল হয়ে উঠল।নূতন বাবাও মাঝে মাঝে দেখা করার জন্য চলে আসতে লাগল ।ব্যাপারটা চাপা থাকল না।বুড়ো-বুড়িই দিদা, মামাদের সাথে কথা বলে উদ্যোগ নিয়ে মায়ের বিবাহ দিলেন।আমি দিদার কাছে রয়ে গেলাম ।

প্রথম থেকেই নূতন বাবাকে আমার কেন জানি ভালো লাগতো না।অবশ্য প্রথম প্রথম নূতন বাবা মামাবাড়িতে আসলেও শেষদিকে একদমই আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।তাই খুব যে বেশি দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে এমন নয়।


এদিকে মামাদের বিয়ে হল।সংসারের কর্তৃত্বের সুতোটা ধীরে ধীরে দিদার হাত থেকে মামিদের হাতে চলে গেল।মামিদের ইচ্ছে অনিচ্ছেতে সংসারের চাকাটা ঘুরতে লাগল।মামিদের বক্তব্য-'এবার ঠাকুরঝি নিজের মেয়ের দায়িত্ব বুঝে নিক।তারা এতবড় মেয়ের দায়িত্ব নিতে আর রাজী নয়'।

মায়ের কাছে এসেই বুঝলাম, মা একদম ভালো নেই।আমার নূতন বাবা কেবল নেশাখোরই নয়,ওসব বাজে পাড়ায় যাওয়ার অভ্যাসও রয়েছে।আমি কলতলায় গেলে বিশ্রীভাবে উঁকি ঝুকি মারে।মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে ।


সেদিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল ঝড় আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং ।আমারও পড়তে ভালো লাগছিল না।মা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল-'ইশ্ ! চুলের কি অবস্থা করেছিস?আয় তো এদিকে চুলটা ভালো করে বেঁধে দিই।বহুদিন পর আমি মায়ের বুকে মাথা রাখলাম।মন কেমন করা একটা মা মা গন্ধ পেলাম।মা থুতনিটা আমার মাথার উপর রেখে কোন গভীর ভাবনায় যেন তলিয়ে গেল।বুঝলাম, মা বুঝি তার মন্দ ভাগ্যের কথাই ভাবছে ।


'মা' ( আমি ডাকলাম )

'হুমম্ '- বহুদূর থেকে যেন উত্তর ভেসে এল।

'তুমি ভালো নেই, না মা?' মা উত্তর দিল না।শুধু মাথাটা দুদিকে নাড়াল।আর আমার ঘাড়ের উপর কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ল।

আমার খুব ভয় করে ।জান মা ?নূতন বাবার চাহনিটা কেমন যেন ।

মা আছে তো।কোন ভয় নেই।

বাইরে খুব জোরে একটা বাজ পড়ল।ভয়ে আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম।এমন সময় দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ ।মা দরজা খুলতেই নূতন বাবা টলতে টলতে ভেতরে এসে দাঁড়ালো ।

জড়ানো কন্ঠে আমাকে বলল-'চল্ ,তোকে একটা ভালো জায়গায় রেখে আসার বন্দোবস্ত করেছি ।খুব ভালো থাকবি ওখানে।যত্ন-আত্তির কোন অভাব হবে না।'


মা বলল, খবরদার !আমার মেয়ের দিকে একপাও এগুবে না।আমাকে ছেড়ে কোথ্থাও যাবে না ও।


নূতন বাবার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল।মাকে এমন ধাক্কা মারল যে, মা ছিটকে গিয়ে তক্তার নীচে পড়ল।তক্তার নীচেই ছিল কাটারিটা।মা শক্ত করে ধরল ওটা।

নূতন বাবা আমার হাতটা ধরতে যাবে, এমন সময় মাটি ফুঁড়ে যেন উঠে এল মা। উঠেই গলা লক্ষ্য করে কাটারিটা চালিয়ে দিল।

আমি ছুটে গিয়ে মার পিছনে লুকোলাম।

রক্ত ছিটকে এসে মার কপালে পড়ল ।মা বা হাত দিয়ে আমাকে সামনে এনে বুকে জড়িয়ে নিল।তারপর পরম নিশ্চিন্তে ডানহাতটা দিয়ে শুধু রক্তই মুছলো না, সেইসঙ্গে নিজের সিঁদুরটাও মুছে দিল।

মায়ের জেল হয়ে গেল---এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামল স্বয়ংপ্রভা।

রূপসাদি আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখল ।

তখনো ভোরের আলো ফুটেনি।পূবাকাশ সবেমাত্র একটু একটু লালবর্ণ ধারণ করেছে।একটু পরেই অন্ধকারের বুক চিরে নূতন আলো পৃথিবীতে এসে পৌছাবে।বহুদিন ধরে এই আলোর খোঁজেই তো স্বয়ংপ্রভা রয়েছে ।যে করেই হোক, আলোর ঠিকানা তো তাকে খুঁজে বের করতেই হবে ।স্বয়ংপ্রভা দেখল -মাঠ-ঘাট,খাল ,বিল সমস্ত কিছুই তার কাছ থেকে ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে ।আর আলোর সন্ধানে সে ছুটছে তো ছুটছেই।




Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024