মনুষ্যত্ব - সংযুক্তা পাল || Manusatta - Sanjukta pal || Short Story || ছোটগল্প
মনুষ্যত্ব
সংযুক্তা পাল
......টিং টং।
বেলা সবে কাজকর্ম সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ভাত-ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছে এ.সি.তে শুয়ে। বৈশাখের মাঝামাঝি গরমটা অসহ্য লাগছে এই পাঁচতলার উপরে। বিশেষ করে যখন ও রান্নাঘরে থাকে তখন গলগল করে ঘামতে থাকে। তখন শখ করে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল। এখন আর ভালো লাগছে না। এ.সি.তে সব সময় তো আর থাকা যায় না। আর দুটো ঘরেই শুধু এ.সি. লাগানো।ওই ঘুমোবার সময়'টুকুই শুধু আরাম।এখন ছেলে-মেয়েরা স্কুলে। বর অফিসে। এ.সি.র মধ্যে একটু আয়েস করা যেতেই পারে। চোখটা লেগে এসেছিল ঠান্ডার আরামে। কলিং-বেলের আওয়াজে ঘুমটা ভাঙল। 'উফ' বলে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বেলা উঠে বসল।মনে মনে ভাবল এখন আবার কে! শান্তিতে একটু শুতেও দেবে না! আবারও একবার বেলটা বাজল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেলা বিছানা ছেড়ে নামল।
দরজার আইহোল দিয়ে দেখল। একটা সেলসগার্ল মনে হল দাঁড়িয়ে আছে। দু'কাধে অনেকগুলো ব্যাগ। মনে মনে কেয়ারটেকারটার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে দরজা খুলল। যতীন পইপই করে বলে দিয়েছে অচেনা কাওকে দেখলে দরজা খুলবে না। এই কেয়ার-টেকারের ওপর ভরসা নেই। নিজের চেয়ারে কম, আর অন্য জায়গায় বেশি সময় বসে থাকে। ফালতু গল্প করার স্বভাব। তাও বেলা খোলে। ওর আবার নাকি যদি বড় ঘর থেকে দরজা অবধি আসতেই হয় তবে দরজার ওপাশে অপর ব্যক্তির কী বক্তব্য আছে তা জানতে দরজা খোলাটাই শ্রেয় মনে হয়।
দরজা খুলেই বেলা অচেনা সেলস গার্লটাকে এক ধমক দিল, 'এই তোমাদের ওপরে উঠে আসতে নীচে বসে থাকা কেয়ারটেকার বারণ করেনি? কোথায় থাকে ব্যাটা কে জানে! আজকেই কম্প্লেন জানাতে হবে। কি জ্বালা এই ভরদুপুর বেলা একটু শোওয়া-বসার জো নেই গো। আর তোমরা এই দুপুর রোদে বের হও কি করে গো? শরীর খারাপ লাগে না'!
মেয়েটি যেন মন মতো প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। চটপট বলে উঠল, 'আমাদের আবার শরীর দিদি। সেলিং এর ওপর আয়। একবেলা খেতে পেলে তখন থেকেই আবার ভাবতে হয় পরের বেলা খেতে পাব কিনা! সকাল থেকে না খেয়েই রয়েছি দিদি। শুধু জল খেয়ে আছি। এই কয়েকটা জিনিস একটু দেখবেন। শুধু দেখবেন। কিনতে হবে না'। বেলা আবার 'জিনিস' কেও দেখাতে চাইলেই আর না বলতে পারে না। মনে মনে ভাবল দেখতে কি দোষ! কোলাপসিবল গেটটা তো লক করা আছে। শুধু দরজা খুলেছে। এইভাবেই কি কি জিনিস মেয়েটা দেখাতে চায় দেখে নিয়ে অবশেষে পছন্দ হয়নি বলে দরজা দিয়ে দেবে। ও মাঝে মাঝে ভুলে যায় ওর ছেলে-মেয়েরাও ওকে কতভাবে ভয় দেখিয়ে এসব সেলস গার্লদের থেকে সাবধান করেছে! ছেলে বলেছে, 'মা এই দরজাটাও খুলবে না তুমি। কারণ ওরা যদি ডাকাত হয় ওদের কাছে বন্দুক থাকবেই। আর ওই বন্দুক নিয়ে কোলাপসিবলের ফাঁক দিয়ে তোমাকে ভয় দেখিয়ে লক খোলাতে বাধ্য করতে পারে। তখন তুমি খুলতে বাধ্য হবেই আর ওরা ওদের সংকেত ব্যবহার করে আরো লোক আনিয়ে ডাকাতি করবে'। বেলা তখনকার মত ভয় পেয়ে সাবধান হয়ে গেলেও পরেরদিন আবার যে কে সেই। সেলস-বয় আর সেলসগার্ল দেখলে আবার ওইসব আকর্ষণীয় ঘর-কন্নার 'জিনিস' দেখার জন্য মোহিত হয়ে পড়ে। এবারেও তাই করল। ছেলে-মেয়ে-বরের নিষেধ পাত্তা না দিয়ে কোলাপসিবল গেট খুলে মেয়েটির আনা নন-স্টিক বিভিন্ন জিনিস দেখতে আরম্ভ করল। নিজের ঘরে এসব রাখার আর জায়গা নেই। যতীন খালি খিটখিট করে ও এসব কেনে বলে। মনে মনে বলল, সেলসগার্ল যে এসেছিল ও ওর বর আর বাচ্চাদের একদম বলবে না। তাহলেই হবে। কিন্তু ওর পেটে যে কোনো কথাই থাকে না। নিজের সে দোষটাও ভালো করেই জানে।
মেয়েটা ছ'টা ব্যাগ নামিয়ে খুলে শুধুই জিনিস দেখাচ্ছে আর কপাল-গলার ঘাম মুছছে। বেলা নেড়ে-চেড়ে কড়াই,প্যান দেখেই চলেছে। মেয়েটিকে অত ঘাম মুছতে দেখে একবার বলল, 'তুমি জল খাবে'? ও বলল, 'না না ম্যাম। আপনি দেখুন'। মেয়েটা সেই কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিনিসপত্র দেখাচ্ছে। এত কিছু দেখার পর বেলা বলে উঠল, 'ধুর তোমার এসব জিনিসগুলো একদম ভালো না। না না নেব না। তুমি এখন এস বুঝলে'। মেয়েটির মুখে হতাশার থেকেও এক চরম অস্বস্তি বেলা লক্ষ্য করল। ও বিশেষ পাত্তা না দিয়ে কোলাপসিবল গেটটা লক করে দিতে উদ্যত হল। মেয়েটা তখন হঠাত কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, 'ম্যাম আমার একটা উপকার করবেন প্লিজ? আমি চার মাসের প্রেগন্যান্ট। সকাল থেকে জল......' 'এই দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি এসব কথা বলে কী চাইছ আমার কাছ থেকে। বড় জোর তোমাকে দুটো টোস্ট বিস্কিট দিতে পারি। ঘরে এখন বানানো সেরকম কিছুই নেই।ছেলে-মেয়েরা এলে নুডলস বানাবো'। মেয়েটি অসহায়ভাবে বলল, 'ম্যাম আপনাদের টয়লেটটা একটু ব্যবহার করতে দেবেন প্লিজ আমাকে? এই অবস্থায় আপনি তো জানেন ঘনঘন ইউরিন পাস করার দরকার পড়ে। প্রেশার ধরে রাখা যায় না। আর একটু ঘাড়ে-মুখে জল দিলেই আবার বেরিয়ে বাড়ি অবধি চলে যেতে পারব'।
বেলা পড়ল মহাফাপড়ে। কি করে ও এখন! ওকে পুরো ফ্ল্যাটের ভেতরে মেয়েটাকে ঢুকতে দিতে হবে। সরাসরি যে না করবে তাও পারছে না। এতক্ষণ সত্যি ও খেয়ালই করেনি মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। পেটটা ঈষৎ ফোলা। ওর বিবেক ওকে বলল মেয়েটাকে সাহায্য করতে। মেয়েটি খেতে পর্যন্ত চায়নি। শুধু এ'টুকুই.....ভয়ে ভয়ে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে, মানা-নামানা'র দোলাচলে বিশ্বাসী মনোভাবটুকু সম্বল করে বলল, 'ঠিক আছে তুমি এস'। মেয়েটি বাথরুমে ঢুকে গেল।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বেলাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকল। বেলা ওর জন্য নুন-চিনির শরবত আর বিস্কিট নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি গোগ্রাসে সব খেয়ে নিল। আসি বলে এগোতেই বেলা হাতটা বাড়িয়ে কীছু টাকা দিয়ে বলল, -'কোথায় থাকো তুমি? ভাড়াটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। এই অবস্থায় আর এখন বেরোবে না। কী করে তোমার বাড়ির লোক এই রোদে তোমাকে বেরোতে দেয় ভেবে পাই না'।
-'না ম্যাম। বর অ্যাক্সিডেন্ট করে হঠাৎই বিছানাতে শয্যাশায়ী। ভালোবাসার বিয়ে। দুই বাড়ির কেও এখনো মেনে নেয়নি আমাদের এই সম্পর্ক। তাই আমাকে বের হতে হচ্ছে পেটের তাগিদে কাজে। ওদিকে বর বেচারা আমার জন্য কিছু করতে পারছে না বলে শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলছে।
বেলার খুব কষ্ট হল মেয়েটার জন্য। মেয়েটাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে আজকের অভিজ্ঞতার কথা ও ওর ডায়েরীতে লিখে রাখল। ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বর বাচ্চাদের কিছুতেই এসব বলবে না। না বললেই শান্তি। তবে কত দিন পারবে কে জানে!
কিন্তু বেলার মাথায় আবার চলে এল ছেলের বলা কথাগুলো। ডাকাতি? তবে কী মেয়েটি ডাকাত দলের কেউ? রেইকী করতে বেরিয়েছে ডাকাতি করার আগে। মনুষত্ব্যের সত্যি কোনো মূল্য আছে কি? ধুর আবোল-তাবোল ভাবনা।
Comments