Wednesday, June 15, 2022

ছোট গল্প - কালো রঙের চাঁদ || লেখক - তৈমুর খান || Short story - Kalo Ronger Chand || Written by Taimur khan


 

কালো রঙের চাঁদ 

তৈমুর খান 



     এক. 


নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠল। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল এতটুকু চিড় ধরেনি মনে। নানা কাজে ভুলে গেছি হয়তো। সাংসারিক জটিলতা আর টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু যখনই একা হয়ে গেছি, যখনই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি তখনই মনে পড়েছে ওকে। ওই আমার প্রথম নির্বাচিত নারী। যাকে আমি আমার জীবনের সঙ্গী করতে চেয়েছিলাম। 


       উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও যখন চাকুরি পাচ্ছি না, শুধু টিউশানই একমাত্র ভরসা, তখন কোন্ মেয়ের বাপ আমার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেবে? সুতরাং বিয়ে করার ভাবনা মাথাতেই আসেনি। কোনও রকম দিন কেটে যাচ্ছে। কোথাও ঝিলিক দিচ্ছে নারীমুখ ।জ্যোৎস্না রাত হাতছানিও দিচ্ছে না তা নয়। মধ্যরাতে ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে । স্বপ্নের ভেতর কখনও কখনও ছাত্রীরাও উঁকি মারছে। তা মারুক, কেউকেই বেশি প্রশ্রয় দিতে পারছি না। এমন সময়ই কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করি আর জুটে যায় একটা কলেজের আংশিক শিক্ষকের চাকুরি। একে কি চাকুরি বলে! নিজেরই সন্দেহ হয়। মাস গেলে দেড় হাজার টাকা। তা হোক, টিউশানের বাজার বাড়তে থাকে। আয়ও প্রায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। 


        দিব্যি একটা সংসার চলবে, তুই বিয়ে কর! চা খেতে খেতে এক হাতুড়ে ডাক্তার বন্ধু পরামর্শ দেয়। নিজেও ভাবতে থাকি বয়স প্রায় তিরিশে পা দিতে চলেছে। এ সময় তো বিয়ে করা জরুরি বইকি! ভাবতে ভাবতে বলি, কিন্তু কাকে বিয়ে করব? 


          বন্ধুটি দ্রুত উত্তর দেয়, আমারই মামা শ্বশুরের মেয়ে আছে, নোনাডাঙা বাড়ি। এবছরই বি এ পাস করেছে। আমাকে বর খুঁজতে বলেছে। আগামি রবিবারই চল্, দেখে আসি। 


         সম্মতি না দিয়ে পারিনি। একটা বয়সে বিয়ে করার ইচ্ছা সব নারী-পুরুষেরই থাকে। আমারও ছিল। একটা বি এ পাস মেয়ে, দেখতে ভালো হলে এবং আমাদের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে মানিয়ে নিলে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? 


       কিন্তু সেই সপ্তাহে রবিবার দিনটি আসতে বড়োই দেরি করছে আমার মনে হল। প্রতিদিনই বারের হিসেব করি আর রাত দীর্ঘ হয়ে যায়। অবশেষে বহু নির্ঘুম রাত আর প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত রবিবারটি এসে উপস্থিত হল। বুঝতে পারলাম, বাসনা তীব্র হলে সময় তখন দীর্ঘ মনে হয়। মুহূর্তগুলিও বছরে পরিণত হয়ে যেতে পারে। 


        সকাল সকাল স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম চুপচাপ। বন্ধুটিকে সঙ্গে নিতে হবে। ওরই পরামর্শ ছিল, কাউকে জানানোর দরকার নেই, আগে পছন্দ হোক, তারপর কথাবার্তা। বাড়ির লোকও জানবে না। 


         বাসে করে যাচ্ছি। সমস্ত রাস্তা কত রকম চিন্তা এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কী জিজ্ঞেস করব? হ্যাঁ, কোন্ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, ইসলাম সম্পর্কে কেমন ধারণা, সংসারে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে কিনা ইত্যাদি। কখনও আবার মনে আসছে, কী হবে ওসব জিজ্ঞেস করে? বরং মেয়েটি দেখতে কেমন হবে, কাজ করার ক্ষমতা আছে কিনা, সহিষ্ণু কিনা ইত্যাদি। বাস ছুটছে, যেন আমরা যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছি। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সেই রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি। কী আনন্দ! মনপ্রাণ যে নাচছে, কিন্তু কেউ দেখতে পাচ্ছে না। হাওয়া এসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বারবার কল্পনায় দেখে নিচ্ছি মেয়েটির চোখ। কী উজ্জ্বল! কী স্নিগ্ধ! কী বিস্ময়! 

    
         


দুই. 


যথারীতি খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মেয়েটিকে আনা হল আমাদের সামনে। না, সাজপোশাকের কোনও বালাই নেই। যে শাড়িটি পরে সে এখানে ওখানে বের হয় কোনও অনুষ্ঠানে, সেই শাড়িটিই পরে এসে উপস্থিত হল। সকালের রোদ রং শাড়ি। অপূর্ব মানিয়েছে। সাদা সাদা বেলফুলের ছাপ সমস্ত শাড়ি জুড়ে। আরও পবিত্র ও স্নিগ্ধ করে তুলেছে ওকে। সামনে দাঁড়িয়েই সকলকে সালাম জানাল। যথারীতি সালামের উত্তরও দিলাম। তারপর বললাম, বসুন! 


     প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল, আমাকে "তুমি" বলুন। 

   

      বেশ, তাই হবে। তারপর মুখ তুলে তাকাল। 

মুখটি খুব সুন্দর নয়, কিন্তু বড়ো সরল ও সতেজ মনে হল। নাকের নিচে ঠোঁটের বাঁ দিকে একটা কালো তিল, কালো রঙের চাঁদের মতো চনমন করছে দেখলাম। শ্যামবর্ণ ঠোঁটের লাল আভা অস্ফুট পদ্মের লাল পাপড়ির মতো। কপালের এক গোছা চুল যেন স্থির তরঙ্গের মতো। মুখটি গোল হতে হতে শেষ পর্যন্ত আর গোল হয়নি। আঁটসাঁট শরীরের সঙ্গে বেশ মানানসই। বন্ধুটি বলেছিল, ভালো ছেলে খুঁজছে, চাকুরি না হলেও হবে। ওর বাপের যা আছে তাতে বহু বড়োলোক জামাই ও পাবে। কিন্তু তা দেবে না। সৎ, শিক্ষিত ভালো ছেলে হলেই হবে। 


       আমি এই তথাকথিত ভালো ছেলের পর্যায়ে পড়ি কিনা সে কথাই ভাবছিলাম বারবার আর ভাবতে ভাবতেই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু হয়েছিল। 

—তোমার নাম কী? 

—খালিদা রহমান। 

—পিতার নাম? 

—হাফিজুর রহমান। 

—কত দূর লেখাপড়া করেছ? 

—বি এ পাস। 

—কী কী বিষয় ছিল? 

—বাংলা, ইতিহাস, দর্শন। 

—কোন্ বিষয় পড়তে ভালো লাগে? 

—বাংলা। 

—আচ্ছা, একটা খুব অপ্রিয় কথা জানতে চাই, আমি তো চাকুরি করি না, টিউশান করি আর কলেজের আংশিক শিক্ষক, খুব সামান্য আয় করি। তুমি সব মানিয়ে নিতে পারবে তো? 


     এবার খালিদা মাথা নামিয়ে দেয়। এতক্ষণ যত দ্রুত উত্তর দিচ্ছিল এবার যেন থেমে যায়। আবার তাড়া দিয়ে বলি, বলো, কী হল? 


       মাথা ঝুঁকিয়ে সে নীরবে সম্মতি জানায়। 


  আমার পাশে থাকা বন্ধুটি বলতে থাকে, তা হলে যাও এবার। 

     

   ওকে থামিয়েই বলি, না থামো, এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব নিচু গলায় খালিদার কাছে জানতে চাই, আমাকে তোমার পছন্দ তো? 


       এবার জোরে হেসে ওঠে খালিদা, চোখের ভেতর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালনা করে দেয় আর এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। এতগুলো প্রশ্ন-উত্তর চলেছে, তার ফাঁকে খুঁটে খুঁটে দেখেছি খালিদাকে। বাঁশঝাড়ে ঘেরা তাদের গ্রাম্য মাটির বাড়িতে এক মনোরম আনন্দ আমাকে সর্বদা আকৃষ্ট করেছে। চাষি পরিবার হলেও এদের রুচিবোধ আছে, শান্তি ও সৌন্দর্য আছে। খালিদার পিতা একটা জুনিয়র হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টার মশাই। ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। একদণ্ড এসেই দেখে চলে গেছেন। আমাদের মুরগি পোলাও ফলমূল খাবারেরও কত আয়োজন করেছেন। একে একে সব আসতে দেখে অবাক হয়ে গেছি। মনে হয়েছে, আহা এরা কী ভালো লোক! মানুষের কদরও বোঝেন! 


    সব বুঝেসুঝেই বন্ধুটিকে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। বারবার সে জিজ্ঞেস করেছে, রাজি তো? 


      আমিও বারবার বলেছি, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ! 


    তারপর সে সব দায়িত্ব নিয়ে একাই গেছে মেয়ের পিতা অর্থাৎ তার মামা শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলতে। আমাকে একটু দূরে সরে যেতে বলেছে। আমাদের তো বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে, যা বলার তা এখনই বলতে হবে।

       

তিন. 


—তুমি কত টাকা বেতন পাও? 

—দেড় হাজার। 

—দেড় হাজার টাকায় সংসার যাবে? 

—টিউশান করি, তাতেও হাজার পাঁচেক… 

—টিউশানের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? মেয়েকে ফেলে দেওয়া হবে! তোমার সঙ্গে… 

—আমি তো আসতেই চাইনি, আপনাদেরই জামাই বলেছিল, তাই… 

—থাক্ ওসব শুনব না, সরাসরি বলাই ভালো, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। 


      তারপর জামাই অর্থাৎ আমার বন্ধুটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন, সবই ভালো, একটা চাকুরি করা ছেলের খোঁজ এসেছে। এন ভি এফ পুলিশ। বাবার মৃত্যুর পর ডাইং হারনেসে চাকুরিটি পেয়েছে। পড়াশোনা একটু কম, ওই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তা হোক, চাকুরি করে তো! বিয়েটা ওখানেই দেবার ইচ্ছা আছে। কী গো, ভালো হবে না? 


     বন্ধুটি উদাসীন ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। 


    লজ্জায় অপমানে আমার দুই কান রাঙা হয়ে উঠল। সেখানে আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। ঘটক বন্ধুটি অনেকক্ষণ পর ফিরে এল। শুকনো মুখে বলতে লাগল, মেয়েটির মা ও মেয়েটির খুব ইচ্ছা তোকে জামাই করার, কিন্তু ওর আব্বা চাইছে না। পাশের গাঁয়ের একটি লোক সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে ওই পুলিশ কর্মীর জন্য। 


      আমার আর কিছুই বলার নেই। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির ওজন যে ভীষণ হাল্কা একজন অষ্টম শ্রেণি পাস পুলিশ কর্মীর তুলনায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতক্ষণ ধরে মাংস পোলাও যা খেয়েছি সবই বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কোনও রকম ভাবে নিজেকে সামলে রাখছি। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। না, আর কোনওদিনও বিয়ে করতে চাইব না। বিয়ে করার জন্য আর কোনও মেয়েকে দেখতেও আসব না। তখনই হনহন করে ছুটছি। বন্ধুটি কী কথা বলছে পিছন থেকে বুঝতেও পারছি না, বোঝার প্রবৃত্তিও নেই। দুই কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। দুঃখী মায়ের মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাড়ি ফিরতে চাই, আমি দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাই। কিন্তু এ কী! বাঁশঝাড়ের অন্যপ্রান্তে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে খালিদা। সকরুণ চোখ দুটিতে মিনতি, ক্ষমা প্রার্থনা। চমকে উঠি। কেন ও এভাবে তাকাচ্ছে? হে আল্লাহ, যেখানে ওর আব্বা এত হিসেবি মানুষ, এত অহংকারের সঙ্গে আমার মুখের উপর কথাগুলি বলে আমাকে অপমান করলেন, সেখানে তারই কন্যা কেন এরকম ভাবে আমাকে হাতছানি দিচ্ছে? কোনও প্রশ্নেরই ঠিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমার অপমান, আমার পথহাঁটা যে অনেকটাই কমিয়ে দিতে পেরেছে সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। মনটা কীরকম উদাসীন হয়ে গেল। সারা রাস্তা চোখের সামনে ভাসতে লাগল সেই সকরুণ মুখটি। একটাও কথা বলতে পারিনি, নীরবে যেন বহুকথাই বলে দিয়েছি। 


   চার. 


আজ যে বাস থেকে নামছি সেই বাসেই উঠতে যাচ্ছে খালিদা। নাকের পাশের তিলটি তেমনই কালো রঙেই জ্বল্ জ্বল্ করছে চাঁদ হয়ে। নামতে নামতে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। সেই সকরুণ দৃষ্টি, সেই হাতছানি। কেমন আছ খালিদা? মুখে এনেও কথাটি বলতে পারলাম না। পেছনে জোর ধাক্কা, কী করছেন মশাই? রাস্তা ছাড়ুন! 


     মনে মনে বলতে লাগলাম, আমি তো রাস্তা কারও ঘিরে নেই, কেউ আমারই রাস্তা ঘিরে আছে! 


       বাস থেকে নেমে অনেকক্ষণ বাসের জানালায় চেয়ে থাকলাম বাসটা যতক্ষণ না ছাড়ল। খালিদাও জানালায় মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। তেমনই নির্বাক। তারই পাশের সিটে মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। মনে হল ওর স্বামী। আমি তো ওর কেউ নই, কেনই বা আমার সঙ্গে কথা বলবে? তাহলে এমন চোখে তাকায় কেন? কী যেন হারিয়ে গেল আমার! আর নিজের অজান্তেই খুঁজতে লাগলাম। চোখের পানিতে চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেল। দূরে বা কাছে কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটা গোল শূন্য অস্বচ্ছ বল ওঠানামা করতে লাগল সামনের দিকে। 

Monday, June 13, 2022

ছোট গল্প - মরণকূপ || লেখক - ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী || Short story - Moronkup || Written by Isita Biswas Choudhary

 




মরণকূপ
 
             ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী
           



রথীনবাবুর ট্রান্সফারেবল জব। ব্যাংকের চাকরি, তাই প্রতি চার বছর অন্তর নানা প্রত্যন্ত প্রান্তে  এবং বেশ দুর্গম কিছু অঞ্চলে পোস্টিং হবার জন্য ফ্যামিলিকে সঙ্গে রাখতে পারেন না তিনি। কিছুদিন আগে প্রান্তিক অঞ্চলের একটি মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তারপর চার বছর কেটে যাওয়ায় এবং একটি ব্রাঞ্চে তার প্রয়োজন পড়ায়, বীরভূমের 'সদরপুর'  বলে একটি জায়গায় বদলি হন তিনি। অবশ্য আজকাল এসব নিয়ে আর কিছু ভাবেন না রথীনবাবু। যেকোনো জায়গার সাথে এডজাস্ট করে নিতে তার আজকাল আর সেরকম সমস্যা হয় না। আগে বেশ সমস্যা হতো। চিরকাল কলকাতায় থাকার দরুন নিতান্ত গ্রাম্য পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হতো তার। তবে আজকাল ভালই লাগে। এক জায়গায় বেশিদিন তার আবার  মন বসেনা। বিভিন্ন স্থানে থাকার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর বলেই মনে হয় তার।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসেন। তাই যে অঞ্চলে পোস্টিং হয় শনি-রবিবার করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে সেই অঞ্চলকে এক্সপ্লোর করতে। মাসে একবার বাড়ি যান। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে যাওয়ায়  সাংসারিক দায়িত্ব সেভাবে থাকে আর নিতে হয় না তাকে।  রিটায়রমেন্টের আর বেশি দিন বাকি নেই। জীবনটা এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাটাতে চান তিনি।

যথারীতি ব্যাংকের লোকেরা তাকে ফেয়ারওয়েল দিল। এতদিন থাকার দরুন মনটা একটু খারাপ লাগছিলো তবে নতুন জায়গায় যাবার কথা ভেবে তিনি মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।  শনিবার  গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন ব্রাঞ্চ 'সদরপুর'।  আসতে আসতে  রাস্তায় দেখলেন লাল মাটির রাস্তা চারিপাশে বিভিন্ন রকম শাল-সেগুন এসবের জঙ্গল। ভীষণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চারিদিকে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ আসার পর তারা গ্রামে প্রবেশ করলেন।  অদূরে ছোট ছোট টিলা এবং ছোট ছোট মাটির বাড়ি, কোনটাতে টালির চাল বা খড়ের ছাউনি ।  গাড়ি এসে ব্যাংকের সামনে দাঁড়ালো। ছোট্ট একতলা বাড়ি। একটি ছোট গ্রামীণ ব্যাংক, অফিস আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ায় সুনসান। আজ শনিবারও তাই  সেরকম ভিড় নেই। রথীনবাবু  ভিতর প্রবেশ করলেন। একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল "আসুন স্যার, আমার নাম সুমন, আমি ব্যাংকের  কর্মী। আজ শনিবার অনেকেই বাড়ি চলে যায়, সোমবার সবাই ফিরে আসবে। আপনার জন্য বাড়ি ঠিক করাই আছে আগের ম্যানেজারবাবু যেখানে থাকতেন সেই বাড়িটি খালি আছে। চলুন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।" 
সুমন রথীন বাবুকে নিয়ে এলেন তার কোয়াটারে। গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট একতলা একটি বাড়ি। সামনে পেছনে অনেকটা জায়গা। সুমন তাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এসে বলল, "আসুন বাবু আমার নাম রঘু, আমি আপনার দেখাশোনা করবো।" সারাদিন ক্লান্ত রথীনবাবু ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নিলেন। উঠে দেখলেন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রঘু রান্নাঘর থেকে এসে বলল, "বাবু চা করছি, রাতের খাবার করে রেখে গেলাম। কাল সকালে আবার আসবো।"
রথীনবাবু বাইরে বেরিয়ে দেখলেন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, দূরে গ্রামে মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে সন্ধ্যা দিচ্ছে। তিনি  বাড়ির চারপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখলেন।  বাড়ির বেশ কিছুটা অংশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানান রকম গাছে ভর্তি। পাঁচিলের পেছনে শাল, শিমুল,মহুয়া,পলাশের জঙ্গল শুরু হয়েছে। বাতাসের মর্মরধ্বনি কানে আসছে তার। জঙ্গলের মধ্যে দূরে কোথায় সমস্বরে শেয়াল ডেকে উঠল। রথীনবাবু হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে গেলেন। আশেপাশে বাড়িঘর সেরকম নেই বললেই চলে। তার বাড়িটি বেশ নিরিবিলিতে ফাঁকা জায়গায়। রথীনবাবুর একা থাকার অভ্যাস আছে, তার হয়তো খুব একটা সমস্যা হবে না। তাও  বিদেশ বিভুঁই জায়গা, মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো তার। রঘুর ডাকে সম্বিৎ ফিরলে ঘরে ফিরে এলেন। রঘু বলল, "বাবু আপনার খাবার রেডি করে রেখে গেলাম। আমার বাড়ির সামনেই গ্রামে কাল ভোর হতেই চলে আসব। কালতো রবিবার, একটা ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াবো।" তিনি বাজার করার কিছু পয়সা দিয়ে বললেন,"ঠিক আছে কাল সকালে চলে এসো।" কি মনে হতে তিনি রঘুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,"আচ্ছা এই জঙ্গলে কোন বন্য পশু নেই তো? রাত্রে জানলা খোলা রেখে শোবো তাই বলছি।" কথাটা শুনে একটু চমকে উঠলো রঘু। ফিসফিস করে বলল, "ভর সন্ধ্যেবেলা ওই জঙ্গলের নাম নেবেন না বাবু , আপনি এখানে নতুন তাই বলছি আপনার বাড়ির পাঁচিলের পেছনে জঙ্গল শুরু হয়েছে সেটিকে 'নাড়াবোরা'র জঙ্গল বলে। আপনি দয়া করে ওদিকে বিশেষ যাবেন না। ওই জঙ্গল ভালো জায়গা নয়। জঙ্গলের মধ্যে একটা কুয়া আছে যেটি খুব সাঙ্ঘাতিক। অনেক মানুষের প্রাণ গেছে ওই মরণ কুয়োর ধারে গিয়ে। আগের ম্যানেজার বাবুর তো ওখানে গিয়েই মৃত্যু হয় আপনি জানেননা?" রথীন বাবু একটু বিস্মিত হলেন। একথা তো তাকে কেউ আগে জানায়নি! রঘু বলল, "এখানে অবশ্য ঠাকুরের মূর্তি আছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। বলে দূরে দেয়ালে টাঙ্গানো ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে প্রণাম করলো সে। এমনিতে ভয়ের কোন কারণ নেই তবে সাবধানে থাকবেন।" 
রঘু চলে গেলো। রাতে বাড়িতে ফোন করে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। তারপর রাতের খাবার খেয়ে এসে শুলেন বিছানায়। চারদিকে মহুয়ার সুবাস নাকে আসছে। তবে ঘরের ভেতরে বেশ বদ্ধ গরম তাই জানলাগুলো খুলে দিলেন। আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলেন চুপ করে। নতুন জায়গা, ঘুম আসতে সময় লাগে তাই ফোন খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন।
চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু কানে আসছে না। এরকম একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে একা, ফাঁকা বাড়িতে থাকা সত্যিই বেশ দুরূহ ব্যাপার। তবে যারা একাকী থাকতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই জায়গা স্বর্গ বলেই মনে হয়। রঘুর কথাগুলো মনে পড়তে একটু চিন্তা হল। এমন একটা ঘটনা তাকে জানানো হলনা কেন? সে বিষয়ে তিনি বেশ ধন্দে রইলেন। হঠাৎ দূরে জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা হালকা কমলা আলো আসছে। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার থাকায় আলো আরো বেশি দৃশ্যমান মনে হচ্ছে। এত রাতে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে কিসের আলো ? জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। সেরকম কিছু দেখতে পেলেননা। নিরাশ হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আগের ম্যানেজার অসীমবাবু কেন গেছিলেন জঙ্গলে? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালবেলা দরজায় করাঘাতের শব্দে  ঘুম ভাঙলো তার।  রঘু একগাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে, বাজার করে এনেছে সে। তারপর বলল,"দাঁড়ান বাবু আপনার জন্য জলখাবার বানাই।'
রথীনবাবু বললেন ,"সেই ভালো আমি ফ্রেশ হয়ে একটু হেঁটে আসছি। তুমি জলখাবার রেডি কর।"
রথীনবাবু ভাবলেন আশপাশ অঞ্চলটা একটু ঘুরে আসি। সকালের মিঠে রোদ, মৃদু হাওয়া বইছে বাতাসে। অনেক দূরে পাহাড়ের রেখা চোখে পড়ছে, দূর থেকে মনে হয় নীল মেঘের সারি । লাল মোরামের রাস্তা ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। চারপাশে জঙ্গল কোথাও বেশি কোথাও-কোথাও হালকা হয়ে এসেছে। সকালে গ্রামের লোকজন গবাদিপশু নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন উনি। রথীনবাবুকে দেখে বললেন, "আপনি বুঝি পুরনো ম্যানেজারবাবুর জায়গায় এসেছেন?" রথীনবাবু একটু অবাক হলেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন ,"হ্যাঁ, আপনি কি করে জানলেন ?"
"একটু আগে আপনাকে কোয়াটার থেকে বের হতে দেখলাম তো।'
তিনি বললেন, "ও আচ্ছা, আমি গত কালই এসেছি।"
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন," আমার নাম হরিহর দাস। আমি এই অঞ্চলের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। কালকে বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?"
রথীনবাবু বললেন,"  না সেরকম না। আমি তো বাইরে বাইরে সারাজীবন থেকে এসেছি তবে নতুন জায়গাতে ঘুম আসতে একটু সময় লাগে আর বাড়িটা একদম নিরিবিলিতে তাই একটু আর কি...."
" সেই। ভয় পাবেন না, আপনার বাড়িতে তো ভগবানের ছবি আছে, আর কোন কিছু মনে হলে ভগবান কে ডাকবেন।" 
রথীনবাবু একটু বিস্মিত হলেন। তাকে বললেন,"কি ব্যাপার বলুন তো? ওই বাড়িতে কি কোন সমস্যা আছে ? রঘু আমাকে বলছিল ভেতরে জঙ্গলের ব্যাপারে কিছু কথা... যদিও আমি ওসব  বিশ্বাস করিনি।"
হরিহরবাবু একটু থমকে বললেন ,"আপনি জানেন না, ও বাড়িতে কি হয়েছে? আপনার আগে যিনি ম্যানেজারবাবু ছিলেন অসীম বাবু, তিনি কিন্তু ও বাড়িতেই অপঘাতে  মারা যান।" 
"হ্যাঁ সে কথা আমি এখানে আসার পর জানতে পারি। তা বাড়িতে তো কেউ মারা যেতেই পারে সেখানে অসুবিধাটা কোথায় ?"
হরিহরবাবু আবার বললেন,"আপনি জানেন কিনা জানিনা তবে অসীমবাবুর মৃত্যুটা কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। জঙ্গলের পেছনে একটি প্রাচীন কুয়ো আছে, সেটি অবশ্য বহুদিন অব্যবহৃত। আমাদের গ্রাম থেকে কেউ কোনদিনই জল নেয়না। স্থানীয় লোকদের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে, তারা বিশ্বাস করে ওই কূপের  ভেতরে কোন অশরীরীর বাস এবং ওই জঙ্গলের মধ্যে  মধ্যরাতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। অসীমবাবুর মৃত্যু ওই কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার জন্যই হয়েছিল। রঘু সকালবেলায় কোথাও তাঁকে না পেয়ে গ্রামের লোকজন নিয়ে খুঁজে দেখে উনি কূপের  ভেতরেই মরে পড়ে আছেন। পুলিশও সেরম কিছু করতে পারেনি। আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা কিছুই বোঝা যায়নি। তবে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস নিশি ডেকে নিয়ে গেছিল ওনাকে সেদিন রাত্রিবেলা। যাই হোক, রঘু সারাদিন তো বাড়িতেই থাকে। রাত্রেবেলা ফিরে আসে। রাত্রিবেলা একটু সাবধানে থাকবেন আর ভুলেও জঙ্গলের দিকে যাবেন না।" এরকম আরও নানান রকম কথাবার্তা বলে হরিহরবাবু বিদায় নিলেন।

রথীন বাবু হেটে বাড়ি ফিরে এলেন। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে।  অসীমবাবু কেন সেদিন  মাঝরাতে সেখানে গিয়েছিলেন আর কি করেই বা কুয়োর  ভেতর পড়ে মারা গেলেন সেটি বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার বটে। যাইহোক সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে। তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঘু সারাদিন থেকে তার ফাই ফরমাশ খেটে রাতে বাড়ি ফিরে গেল যথারীতি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলো, নিঝুম নিথর রাত্রি। অনেক কষ্টে এদিক ওদিক করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। হঠাৎ একটা আওয়াজে  ঘুম ভেঙে গেলো তার। মনে হল জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই আওয়াজটা আসছে। কেউ যেন অদুরে করুন স্বরে বিলাপ করছে। আধো অন্ধকারে ঘড়ির দিকে চোখ পরতে দেখলেন প্রায় তিনটে বাজে। এত রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে কে বিলাপ করছে তার জানার কৌতুহল হল কিন্তু সকলের বারণ উপেক্ষা করে জঙ্গলে যাবার তার সাহস হলো না। নানা কথা ভাবতে ভাবতে, এপাশ-ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। 
পরদিন সকালে ফ্রেশ হয়ে ব্রাঞ্চে পৌছলেন। সেখানে সকল কর্মচারীদের সাথে আলাপচারিতায় পর দৈনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তবে সারাদিন মনটা তার কেমন যেন খচখচ করছিল।   বিকেলবেলা কি মনে করে সুমনকে ডেকে পাঠালেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, এই ব্যাংকের আগের ম্যানেজারবাবু অসীমবাবু, তাঁর নাকি আমার বাংলোতে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাটা আমাকে এখনো ব্যাংকের কোন লোক জানায়নি। আমি এখানে আসার পর স্থানীয় লোকদের কাছে কথা জানতে পারি  কোন বিশেষ কারণ আছে কি?" 
সুমন বেশ অবাক হয়ে গেল বলল,"আপনি কি কিছুই জানতেন না? যদিও আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলতে নিষেধ আছে। তাও আপনি যে একেবারেই জানতেন না এটা আমি জানতাম না। হ্যাঁ ওনার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, বাড়ির পেছনে একটি কুয়োর মধ্যে সকালবেলা ওনার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেটি নেহাতই দুর্ঘটনা বলে  সবাই ধরে নিয়েছে কারণ আত্মহত্যা করার মত ব্যক্তি তিনি ছিলেননা। আর একটি পরিত্যক্ত কুয়োতে কেউ আত্মহত্যা করবেই বা কেন? সেটাও যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার। পুলিশ সেটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করছে। কিন্তু অত রাতে উনি কেন ওই কুয়োর কাছে গেছিলেন সেটা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। তবে এখন সবকিছু আগের মতই চলছে। ব্যাংকের ভেতরে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করতে কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছেন কারণ গ্রাম্য জায়গায় এমনি লোকজন কুসংস্কারে জর্জরিত। এটা  নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলে লোকে হয়ত ব্যাংকে আসতে চাইবে না, তাই আর কি।"
রথীনবাবু সব শুনে একটু আস্বস্ত হলেন। তিনি ভাবলেন হয়তো সত্যিই দূর্ঘটনাবশত ওনার মৃত্যু ঘটেছে। এরকম তো হতেই পারে। যেকোনো কারণে সেদিন অসাবধানতাবশত তিনি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছিলেন। যাই হোক তিনি নিজের কাজে মন দিলেন। অনেক অনেক কাজ পেন্ডিং রয়েছে আস্তে আস্তে তিনি সেখানে মন বসাতে শুরু করলেন।

কদিনপর থেকে কাজের চাপে এসব কথা তার আর মনে রইলনা। তবে রাত হলেই জঙ্গলের দিকে তাকালে তার যেন কেমন অস্বস্তি হয়। মনে হয় যেন ওই জঙ্গলের ভেতর কি রহস্য আছে তা তাকে উদ্ধার করতেই হবে, নাহলে যেন কোনোভাবে তার শান্তি হবে না। তবু সবার বারণ  বলে নিজেকে  আটকে রাখেন তিনি। আজকাল তিনি একটু বেশিই চুপচাপ থাকেন। কাজের পর ফিরে এসে চুপ করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কিসব যেন ভাবেন। শনিবার সন্ধ্যাবেলায় রঘু চা দিতে এসে তা লক্ষ্য করে সে বলে, "বাবু ওদিকে কি দেখছেন? আজকাল তেমন কথা বলেননা? একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন অনেকদিন তো যাননি। আর একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেননা, এবাড়ীটা আপনি বদলে ফেলুন। ওরকম একটা ঘটনা ঘটলো সেদিন। এই জায়গাটা সুবিধার নয় রাত বাড়লে এমন সব কান্ড হয় আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না।"
রথীনবাবু হঠাৎ কিছুটা বিরক্তির সুরে রুক্ষ স্বরে বললেন, "আহ রঘু তোমার কাজ হয়ে গেলে তুমি এখন এস! আমি কোথাও যাবোনা।" রঘু মাথা নিচু করে  চলে গেল। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। সেদিন ছিল শনিবার, অফিসের সবাই বাড়ি যাবে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে। রথীনবাবু একাই বসে কাজ করছিলেন। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল তার। রোজ তিনি বাড়িতে হেঁটেই ফেরেন। এতে তার একটু হাঁটা হয়ে যায়। আজ অমাবস্যা, আকাশে চাঁদের দেখা নেই। সন্ধ্যেবেলায় নক্ষত্রের  আলো এই জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের অন্ধকারকে দূর করতে অক্ষম । বাড়িতে ঢুকতেই  রঘুর সাথে দেখা। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল তাকে দেখে বলল, "বাবু আজ এত দেরি করে এলেন? আপনার জন্যে চা জলখাবার রেখেছি। আর রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। আমার আজকে একটু কাজ আছে তাই যেতে হচ্ছে। ছেলেটার শরীরটা ভালো নেই।" বলে সে বিদায় নিল। ঘরে ঢুকে রথীনবাবু ফ্রেশ হলেন। তারপর চা খেতে খেতে ফোন করলেন বাড়িতে।  কথা বলার পর সংবাদপত্রে  মনোনিবেশ করলেন। আজসময় যেন কাটতে চায় না। হঠাৎ তার ভীষণ গরম অনুভূত হল। বাইরের পরিবেশটা আজ যেন অদ্ভুত। আকাশে জমাট মেঘ, সমগ্র পরিবেশকে আবদ্ধ করে রেখেছে। বারান্দায় এসে দেখলেন দূরে পাহাড়ের সীমারেখা বরাবর আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।আর মাঝে মাঝে কান বিদীর্ণ করা মেঘের আওয়াজ হচ্ছে। আজ  যা গরম তাতে কালবৈশাখী ঝড় উঠবে বলে মনে হচ্ছে। গ্রামের দিকে কারেন্ট গেলে সহজে আসবে না। তাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন তিনি।   

ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ প্রবল বাজ পড়ার শব্দে  উঠে দেখলেন ভীষণ ঝড় উঠেছে। চারিদিকে আকাশ কালো করে এসেছে। তার পশ্চিম দিকের অর্থাৎ জঙ্গলের দিকে জানলাটা ঝড়ের দাপটে বারবার খোলা-বন্ধ হচ্ছে। রথীন বাবু উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিতে সেখানে গিয়ে দেখলেন জঙ্গলের মধ্যে সেই অপার্থিব কমলা আলো আজ যেন অনেকটা অঞ্চল বিস্তার করে রয়েছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে চোখে যেন এক ধাঁধা  লেগে গেল রথীনবাবুর। ঝড়ের তান্ডব এবং আকাশে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যেও তিনি দেখতে পেলেন জঙ্গলের সামনে অনতি দূরে একটি অদ্ভুত দর্শন  ছায়ামূর্তি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখে তার নারীমূর্তি বলেই মনে হলো। চমকে উঠলেন তিনি সেই মূর্তি দেখে। ঘোলাটে তার দৃষ্টি, বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে সম্মোহনের ঘোর লেগে যায়। রথীনবাবু সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টির কাছে তার জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তাভাবনা সবকিছু বিসর্জন দিলেন। ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। 
বাগান পেরিয়ে তিনি এসে উপস্থিত হলেন ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে। পুরোনো পাঁচিলের একটি অংশ ভেঙে পড়েছে, তিনি সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে দুর্বার গতিতে হেঁটে চললেন সেই আলো লক্ষ্য করে। কিসের টানে তিনি ছুটে চললেন তা ভাবার মতন অবস্থায় তিনি ছিলেন না। তাঁর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি কিছু না ভেবে এগোতে থাকেন সেই মায়াবী আলোর টানে। কিছুদূর আসার পর তিনি দেখতে পেলেন একটি ভাঙা পরিত্যক্ত কূপ  এবং তার মধ্যে থেকেই অদ্ভুত এক আলো ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র জঙ্গলের প্রান্তর জুড়ে। সেই অদ্ভুত দর্শন নারীমূর্তিকে অবশ্য তিনি আর খুঁজে পেলেন না। তার মনে হলো তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যে আমরা কোন ঘটনার  কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করি কেন এরূপ ঘটনা ঘটছে তার ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করি, রথীনবাবু সেরকম মনে মনে ভাবলেন কেন আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? কিন্তু কোনো সদুত্তর তিনি পেলেননা। মনের কৌতূহল নিরসনের জন্য এবং কিছুটা সম্মোহনের কারণে তিনি এগিয়ে গেলেন সেই কূপের দিকে। তার পরিচিত সমস্ত মানুষ তাকে যে সেই কূপের কাছে যেতে নিষেধ করেছিল, কিছুদিন আগেই যেখানে তার পূর্বতন সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে সমস্ত কথা যেন তার মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। সেই নিশির ডাক কে কোনভাবেই যেন তিনি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। এগিয়ে এসে ওর মধ্যে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখলেন কূপের মধ্যে কোন জল নেই। তবে নিচে সুড়ঙ্গের মতন একটা অংশ বোঝা যাচ্ছে এবং সেখানে থেকেই আসছে সেই অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলে। অনেকক্ষণ সেই মায়াবী আলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে রয়েছেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পেলেন নারীকন্ঠে বিলাপের সুরে কেউ কাঁদছে। এত ঝড়ের আওয়াজ এর মধ্যেও সেই বিলাপ তার তার কানে এলো।  ধীরে ধীরে সেই বিলাপ পরিবর্তিত হলো কর্ণকুহর ভেদী হাহাকারে। যেন নরকের অতল থেকে ভেসে আসছে সেই চিৎকার। তারপর বিস্ফারিত নেত্রে তিনি দেখলেন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়াল দর্শন সেই মূর্তি যার আবছায়া একটু আগে তিনি দেখেছিলেন। বন্য পশু যেভাবে সন্তর্পণে সবার অলক্ষ্যে নিজের শিকারকে ধরার চেষ্টা করে, ঠিক সেইভাবে এক নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে যার চক্ষু রক্তবর্ণ, লালায়িত ঠোঁট এবং জিহ্বা,গায়ের চামড়া অনেকটা সাপের শরীরের মত আঁশযুক্ত,হাতে বড় বড় নখ। এই দৃশ্য  প্রত্যক্ষ করার পর রথীনবাবু মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারালেন। কতক্ষন সেভাবে পড়ে ছিলেন জানেননা।

বৃষ্টির ধারায় জ্ঞান ফিরে পেতে তিনি আধো -অন্ধকারে দেখলেন ভয়ালদর্শন নারীমূর্তি যে কোনোভাবেই মনুষ্য প্রজাতি সদস্য নয়, শ্বাপদ প্রাণীর মত চারপায়ে জঙ্গলে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। বিদ্যুতের ঝিলিকে তার স্বদন্ত  চকচক করছে। রথীনবাবুর মনে পড়ে গেলো অসীমবাবুর মর্মান্তিক পরিণতির কথা। হয়তো এই মায়াবীনি তাকে ডেকে নিয়ে এসে নিজের সম্মোহনের মাধ্যমে তাকে কূপের মধ্যে ফেলে তার জীবনহানি ঘটিয়েছে। মুহূর্তে মনে আসে রঘুর কথা, সে বলেছিলো বাড়িতে ভগবানের মূর্তি থাকলে তিনি বিপদ মুক্ত হবেন। তিনি মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকেন এবং সেই প্রেতনীর অলক্ষ্যে অতিকষ্টে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করেন বাড়ি লক্ষ্য করে। তিনি শুনতে পেলেন সেই ভয়ঙ্কর পিশাচিনীর রক্ত জল করা খলখল অট্টহাসি। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন নরকের শয়তানের দাস  সেই পিশাচিনি, পলায়নরত শিকারকে নিজের কুক্ষিগত করতে তার করালদন্ত বিস্তার করে ধেয়ে আসছে। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে প্রানপনে ছুটতে ছুটতে তিনি এসে পড়েন তার বাড়ির মধ্যে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একমনে ভগবানকে ডাকতে থাকেন। সারারাত সেই প্রেতনীর পৈশাচিক হাসি তিনি শুনতে পান। সেই ভয়ানক অমানুষিক আর্তনাদ উপেক্ষা করে কোনোক্রমে রাত্রিটা কাটান রথীনবাবু। ভোর হতেই রথিনবাবু গ্রামের দু একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যান হরিহর মাস্টারের বাড়ি। তিনি এত ভোরে রথীনবাবুকে দেখে অবাক। রথিনবাবু সবিস্তারে তার সাথে গতরাতে ঘটে যাওয়া অপার্থিব ঘটনাটি বর্ণনা করেন। সব শুনে আতঙ্কিত হরিহরবাবু বলেন ,"চলুন আপনাকে একজনের কাছে নিয়ে যাই, তিনি হয়ত আপনার মনের অন্ধকার কিছুটা দূর করতে পারবেন।"

তারপর তাকে গ্রামের আদিবাসিন্দা বৃদ্ধ ভোলানাথবাবুর কাছে নিয়ে আসেন হরিহরবাবু। রথীনবাবু   গতরাতের সমস্ত ঘটনা জানাতে তিনি বললেন, "অনেক বছর আগে এই গ্রামে ওই জঙ্গলে বসবাসকারী এক মহিলাকে একবার গ্রামবাসীদের ওপর ডাকিনি বিদ্যা প্রয়োগ ও সম্মোহনের মাধম্যে গ্রামের মানুষের ক্ষতিসাধন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়লে, ডাইনি সন্দেহে  তাকে  পিটিয়ে মেরে  ওই পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দেয়া হয়। তবে সে মারা যাবার আগে অভিশাপ দিয়ে যায়, যে তার বিচরণক্ষেত্রে আসবে তার মৃত্যু ঘটবে তারপর থেকে আমরা কেউ আর ঐ জঙ্গলে যাই না। ওই বাড়িতেও রাত্রি বাস করি না কারণ ওই পিশাচিনী একমাত্র মধ্যরাতে সক্রিয় রূপ ধারণ করতে পারে। অজান্তে অনেকের বেঘোরে প্রাণ গেছে ওই মরণকূপের মধ্যে। আগের ম্যানেজারবাবুকে বাড়িটি ভাড়া নেবার আগে গ্রামবাসীরা সতর্ক করেছিল ওখানে না থাকতে, কিন্তু  কথা শোনেনি তার ফলস্বরূপ তাকে প্রাণ দিতে হয়। আপনাকেও হয়তো অনেকে সচেতন করে থাকবে তার পরেও আপনি সেই অভিশপ্ত স্থানে গেলেন।" 
এতক্ষণে রথীনবাবু মুখ খুললেন,"তিনি বললেন কাল রাত্রে যা ঘটেছে তা সবটাই আমার অনিচ্ছাকৃত। আমি সব শুনেছিলাম, কখনোই ওই জঙ্গলে যেতাম না তবে ওই মায়াবী আলোর সম্মোহন এবং ওই পিশাচিনী নিশ্চয়ই কোন জাদু জানে যার মাধ্যমে সে আমাকে ওই মরণকূপের  কাছে টেনে নিয়ে যায়। বহুকষ্টে এবং অতর্কিতে ওর নজর এড়িয়ে আমি সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় পালিয়ে আসতে পারি। ও হয়তো আমায় মৃত ভেবে ভুল করেছিল। না হলে কালকে কি হতো আমি নিজেই জানিনা।"
"আপনি সত্ত্বর ঐ বাড়ি পরিত্যাগ করুন।" 
ভোলানাথ বাবু তাকে  সবিনয়ে অনুরোধ করলেন। রথীনবাবু সেদিনই রঘুকে সঙ্গে করে  সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ওই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে অনেক দূরে তিনি অন্যত্র একটি বাড়িতে চলে গেলেন।

 রোজ মধ্যরাত্রিতে 'নাড়াবোড়ার জঙ্গলে  '  পরিত্যক্ত মরণকূপের মধ্যে দিয়ে   নরকের পাতাল সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা সেই  বীভৎস দেহের ডাইনির অতৃপ্ত প্রেতাত্মা ওৎ পেতে থাকে তার নতুন শিকারের  অনন্ত অপেক্ষায়।

Sunday, June 12, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -6


 

রন্টুনা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আমায় বলল, জানিস রমা অনেক দিন পর গ্রামে এজুম পূজো দেখতে। তোদের অবস্থা সুমন্তর কাছে শুনেছিলুম প্রথমত আমি বিশ্বাস। করতে পারিনি ওর কথা। কোন মানুষ যে এই অবস্থায় পড়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন। জামার কল্পনাতীত। তোর বাবার মতো ব্যক্তি এদেশে বিরল। শত কষ্ট স্বীকার করে। ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন। বলতো রমা এইরূপ ত্যাগ স্বীকার। করে ক'জনই করতে পারেন। তোদের এইরূপ অবস্থা দেখে সংকল্প করেছি তোদের এই দুঃখের আমি অংশীদার হতে চাই। এই মায়ের মন্দিরে শপথ করছি তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখবো। রন্টুদার চোখের সামনে করুণ ছায়া নেমে এলো। পুনরায় আর্দ্র গলায় বলতে শুরু করলো, তোর দাদার সাথে মাত্র একটি বছর ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলুম, কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য সব কিছু হারিয়ে ফেললুম, অর্থাৎ নিজস্ব অর্থ না থাকলে এই বর্তমান যুগে কোন কাজেই সম্ভব নয়। মাসীমার অপার করুণায় ডাক্তারী পড়লুম। তাও কপালে সইলো না। এক বৎসর পরেই ডাক্তারী পড়ায় ইস্তফা দিতেও হলো। 


রন্টুদা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, সে অনেকবারে। তবে তোর মতো বোনকে লাভ করে আমি ধন্য হয়েছি। কারণ, দেখলাম রন্টুদার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হয়ে গেলো। বার কয়েক ঢোক গিলে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ওর ঐরূপ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কেমন যেন হয়ে গেলাম। মনটা বড় আকূল হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, হঠাৎ রন্টুদার এ অবস্থা হবার কারণ কি! 


আমি জিজ্ঞাসা করার আগে বলল, আজ বহুদিন পর আমার হারানো বোনকে ফিরে পেলাম। 


ওকথা শুনে আরো কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি।


 বলল, জানিস রমা, দেখতে সে তোর মতই ছিলো। তোর চেহারার মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য ছিলো। ওকে বড় ভালোবাসতাম রে। কিন্তু হতভাগী যে অকালেই চলে যাবে ভাবতে পারিনি। তার অকাল বিয়োগ আমাকে পাগল করে তুলেছিলো ও বিধাতার এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহী হয়েছিলুম। 


স্থির হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। দাদা অনেক আগে আমাদের কাছ হতে সরে গিয়ে পাড়ারই এক ছেলের সাথে গল্পে মেতেছিলো। আমার তার দিকে মোটেই খেয়াল ছিল না। রন্টুদার মলিন মুখ দেখে বেদনায় আকূল হয়েছিলাম। রন্টুদা বলে চলেছে। তখন হতে কোন পল্লী অঞ্চলে যেতে চাই না। কারণ পল্লী অঞ্চলেই হারিয়েছিলুম বোনকে। এখানে না আছে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র না আছে কোন চিকিৎসার সুব্যবস্থা। এমনকি একটা ডাক্তার পর্যন্ত থাকে না। যদি সে ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে মনে হয় বোনকে হারাতাম না। তোর বাবা উপযুক্ত কাজ করেছেন। সুমন্ত ডাক্তারী পড়ার কারণ আমি সব শুনেছি। সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করলে তোদের গ্রামে অনেক উপকার হবে। পল্লী গ্রামের চিকিৎসা অপ্রতুলতায় আমার বোনের জীবনদ্বীপ যে অকালে নির্বাপিত করে দিয়েছে। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমার, 


কি করে হারালো রন্টুদা? 


সে অনেক কথা রমা। শুনবি? 


শুনবো রন্টুদা। 


রন্টুদা মুখটাকে রুমাল দিয়ে মুছে বলতে শুরু করলো। গোল বেঁধে ছিলো ওখানে যদি মামার দেওয়া জিলিপিগুলো না খেতো তাহলে মনে হয় পুনরায় মুখটা মুছলো। দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। বেশ কিছু দিন আগে আমার মেজমামা আমাদের আনতে গিয়েছিলেন গ্রামের কীর্ত্তন উপলক্ষ্যে। আমার মামাবাড়ী পল্লী অঞ্চলে। যেখানে শুধু সবুজের সমারোহ। তাকাচ্ছে চারিদিকে আড়াল করে থাকে পুকুরকে। ভোরে কোকিলের কণ্ঠস্বর মনকে বড় মাতোয়ারা করে দেয়।


 সেই পল্লী গ্রামেই ছিলো আমার মামা বাড়ী। মা'র সাথে আমিও আমার বোন, হাজির হলুম মামা বাড়ীতে। বেশ ভালো লাগছিলো গ্রামখানিকে। বহুদিন পর মামাবাড়ীতে এলুম। ছোটবেলাতে কয়েকবারই এসে ছিলুম। তারপর বয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামাবাড়ীর আকর্ষণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছিলো। কিন্তু মা'র কথা কাটতে পারলাম না। কীর্ত্তন মোটেই ভালো লাগতো না। মামাতো ভাই সুব্রতর সাথে নানান জায়গায় আড্ডা দিতাম। পর পর দুটো দিন নানা রঙে ঢঙে তামাসায় কেটে গেলো। ভাবতে পারিনি কিভাবে সময় কাটছিলো। তৃতীয় দিন আমাদের সকলের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে আসবে কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। মামা বাড়ীতে যে বোনটার উজ্জ্বল শিখা নিভে যাবে তা বুঝতে পারিনি।


 ঐদিন কীর্তনের শেষে আমরা সকলেই উঠানে বসে আছি। একটু পরে গ্রামের বুকে অন্ধকার নেমে এলো। মামা একসময় বড় প্যাকেটে কিছু গরম জিলাপী নিয়ে এলেন। সকলের হাতে কিছু কিছু দিলেন। বেশ হৈ হুল্লোড়ে সকলেই কিছু কিছু খেয়ে ফেললুম। ঘন্টাখানেক পর শুরু হলো এক করুণ দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খাদ্যে বিষক্রিয়া শুরু হলো। বুঝতে পারলাম, এটা নিশ্চয়ই ফুড পয়েজিং এর কেস। যারা শক্তিশালী তারা সহ্য করতে পারল কিন্তু আমার বোন বীনা ও মামাতো বোন গোপা বিষক্রিয়ায় শিকার হয়ে উঠলো। আমি পাগলের মতো ডাক্তার ডাকার জন্য চিৎকার করতে থাকলাম। কি করবো অরণ্যের রোদন করে। ঐ এলাকায় কোন ডাক্তার নেই তো গ্রামের লোকেরা কি করবে। 


বীনার শেষ অবস্থা ঘনিয়ে এলো। গরুর গাড়ীতে করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার ব্যবস্থা করলাম। গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে হাসপাতাল। গোপা ও বীনাকে হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই বীনার জীবন দ্বীপ নিভে গেলো। সে চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে পরম শান্তি লাভ করলো।


রন্টুদা চুপ করলো। ওর চোখ দিয়ে গরম জল নির্গত হলো। লোমশ বুকের মধ্যে। হাত রেখে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, ওর মৃত্যুতে বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলুম। বিশেষ করে মা ওর শোক সহ্য করতে না পেরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সেই রোগ শয্যা হতে তিনি আজও পর্যন্ত উঠতে পারেননি। মনে হয় আর বাঁচবেন না। বীনার মতো উনারও আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।


 রন্টুদার দীর্ঘশ্বাস পড়লো, সে অপলক নেত্রে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে হয় সেই শোকাবহ ঘটনা তার স্মৃতিপটে উদিত হওয়ায় সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। পর পর দুবার ডাক দেওয়ার পর আমার কথায় সাড়া দিলো। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অতীতকে মনে এনে নিজেকে দুর্বল কোরো না রন্টুদা। ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শুধু তোমার বোন বীনা কেন, ঐ বয়সর কত কত মেয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে বলে কি বিধাতার উপর দোষারূপ করবো? নিয়তিকে কেউ বাধা দিতে পারে না। জানবে আমার মধ্যে তোমার হারানো বোন ফিরে পেয়েছো। দাদা কতক্ষণ আগে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে তা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।


 দাদা বলল, তোদের এই স্নেহের বন্ধন আমার মনে এক অপার্থিব আনন্দের স্পর্শ এনে দিয়েছে। রন্টু আশাহত ছেলে। ও জীবনে অনেক কিছু করবে ভেবেছিলো কিন্তু এ সমাজের নিষ্ঠুরতার ওকে বলি হতে হয়েছে। সে অনেক কথা, ওর জীবনী নিয়ে একদিন বলবো তোকে। তবে মনে রাখিস ওকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করে যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিস।


 বললাম, রন্টুদা আমার আপন দাদা, তাই চিরদিনই ওকে মনে রাখবো।


 কি রে রন্টু, রমাকে পেয়ে তোর জীবনের ভগ্নি হারানোর শূন্যতার স্থান পূরণ করলি তো?


 রন্টু ঘাড়টা নাড়লো। মিনিট খানেক পরে নীরব থাকার পর আমরা সকলে বাড়ী যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রন্টুদা বাক্যালাপ না করে আমাদের পিছনে হাঁটতে থাকলো। বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে রন্টুদার বোনের নিয়ে কথা বললে প্রথমতঃ তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।


 এমনি আনন্দের মাঝে শারদীয়া পূজো কেটে গিয়ে ওদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ওদের বিদায় দিতে হবে শুনে মনটা বড় কেঁদে উঠলো। মনে হলো ওদের যেন হারিয়ে ফেলছি। মন চাইছিলো ওরা যেন আজীবন আমাদের কাছে থাকে। কিন্তু কর্তব্যের অনুরোধে তাদের ছাড়তে বাধ্য হলাম। ওদের কর্তব্যে বাধা দেওয়া আমার কাম্য নয়।


রন্টুদাকে প্রণাম করে বার বার আসতে বললাম। সে সম্মতি জানালো নিশ্চয়ই আসবে দাদা বিদায়ের আগে বলল টাকা পাঠাবার জন্য। বাবা কথা দিলেন যথা সময়ে ওর নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন ওরা বিদায় নিলো। আমি ও বাবা কিছু দূরে এগিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফিরে এলাম।


                               ক্রমশ...

Saturday, June 11, 2022

ছোট গল্প - প্রায়শ্চিত্ত || লেখক - তপন তরফদার || Short story - Praichitto || Written by Tapan Kumar Tarafdar


 


        প্রায়শ্চিত্ত

                         তপন  তরফদার 



         মানুষ প্রেম করে, মানুষই ভালোবাসে, আবার মানুষই প্রায়শ্চিত্ত করে।  নিউ র্নমাল যুগের অনেক আগের ঘটনা। তখনও অনেক কালজয়ী প্রেম ঘটিত ঘটনা সমাজে দাগ কেটেছিল। আবার এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য আলোকিত হয়নি।দেশের রাজধানী,বা বড়ো শহরের ঘটনায়   যেমন আলোচিত ও আলোকিত হয় মফস্বল, এক অনামী গ্রামের ঘটনা বা রটনা বাতাসে ভেসে  থাকতে পারেনা। কিন্তু  ঘটনার মশলা অনেক অনেক প্রেমগাথার থেকেও ঝাঁঝালো। প্রায়শ্চিত্ত ও দাগা দিয়ে যায়। যুগের  পরিবর্তন হয়েছে, প্রেমের ও পরিবর্তন হয়েছে। চণ্ডীদাস কত কষ্ট ও কসরত করে প্রেম করেছিল সবাই  জানে। কেষ্টকে কত কষ্ট করে শরীরের সব দম বাঁশির পিছনে ফুঁকে রাধিকার মান ভঞ্জন করতে হয়েছিল।
         উত্তর বঙ্গের অনেক চা বাগান আছে। প্রত্যেক চা বাগানের কুলি কামিনদের নিজের গল্পকথন থাকে। ঠিক মত প্রচার পেলে লায়লা  মজনুর কাহিনী ম্লান হয়ে যেত।  মথুরা চা বাগানের ঘটনা। সিমলাবাড়ি থেকে  আরও চার মাইল খাড়াই পথের দূরত্বে মথুরা টি এস্টেট। সিমলাবাড়ি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্কুল,গ্রামীন হাসপাতাল, কিছু দোকান। আশেপাশের পয়সাওলা লোকেদের বিনোদনের জন্য  হোটেল কাম বার। হোটেলের নাম ব্লু হেভেন। সিমলাবাড়ির মুকুটে নতুন পালক যোগ হয়েছে ভানু ভক্ত স্কুল উচ্চমাধ্যমিকে উন্নত হয়েছে। আগে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য সদর শহরে যেতে হত, এখন আশেপাশের ধামগুজারি, চিলপাতা,চকোযা,কুর্মাই বাঁশবাড়ির  ছেলে মেয়েরা এখানেই পড়ছে। সিমলাবাড়ি আরও জমজমাট হচ্ছে।
             মথুরা চা বাগানের ক্লার্ক পরেশ চক্রবর্তী চুটিয়ে সংসার করছে। এখানে ব্রাম্ভনের বড়ই  অভাব। পরেশবাবু ও নিজের জাত নিয়ে গর্বিত। চা বাগানের কুলি কামিনরা উঁচু  জাতের মানুষকে সমীহ করে। পরেশ চক্রবর্তীর মেয়ে ওই ভানু ভক্ত স্কুলের ছাত্রী। কোদাল বস্তি হয়ে মালাঙ্গি পেরিয়ে হাইওয়ের পাশে বাঁশবাড়ি থেকে হাজিরা বাবু কদম ছেত্রীর দুর সম্পর্কের ভাগ্নে দেবেশ রায়,ভানু ভক্ত বিদ্যালয়ে বিঞ্জান নিয়ে  পড়বার জন্যে ভর্তি হয়েছে।
        গায়ত্রী  সেজেগুজে স্কুলে এসেছে। সরস্বতী  পুজোয়,প্রথম শাড়ি পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছে আর বলছে এই আমি  কি সেই আমি। সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। গায়ত্রী পড়েছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।শাড়িতে কাঠগোলাপ ফুলের নকশা। ফুল হাতা গোলাপি ব্লাউজ। মাথার্ভতি ঢেউ খেলানো চুল। চুলের রঙের সাথে মিশে যাওয়া কালো ক্লিপ দিয়ে মাথায় লাগিয়েছে কাঠগোলাপ ফুল। গায়ত্রীর উজ্জ্বল ত্বক,সুন্দর গড়ন। পেলব ঠোঁট, হাসলে গালে টোল পড়ে । গায়ত্রী সাইকেলই স্কুলে যায়। গায়ত্রী আজ উপোস করে আছে। স্কুলে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। স্কুলেই খিচুড়ি খাবে।
               পুষ্পাঞ্জলির “কুচ যুগল শোভিত” উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আলোড়ন ওঠে। গায়ত্রীর মুখে রক্তিম ছোপ। আবার মোচড়। এবার  বুঝতে পারে মেয়েদের প্রতি মাসের সেই সঙ্গী  মোচড়। দিশাহারা হয়ে যায়। গায়ত্রী কাউকেই কিছুই না বলে পাঁই পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফিরতে চায়। সোনপুর পেরিয়ে ঢালু বাঁকটা নামতে গিয়ে ধাক্কা মারে এক  মাউন্টেন সাইকেল চালককে। মাউন্টেন সাইকেলের চাকা চওড়া এবং পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তা কামড়ে চলে,সহজে পিছলে যায়না। গায়ত্রীর কমফর্ট সাইকেল যা পাহাড়ি রাস্তার উপযুক্ত নয়, অনেকটা ঝুঁকে চালাতে হয়। ছিটকে পড়ে গায়ত্রী। সাইকেল চালক দেবেশ গায়ত্রীকে শক্ত হাতে তুলে ধরে। দুজনের চোখ দুজনের চোখে। “বধূ কোন আলো লাগলো চোখে”। দেবেশ এক সুপুরুষ যুবক। গ্রীক ভাস্কর্যের প্রতিরূপ। টিকালো নাক। ধারালো মুখ। উজ্জ্বল দুটি চোখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। সব মেয়েরা শিব পুজো করে এরকমই শিবের জন্য। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে গায়ত্রী বলে আমার শরীরটা খারাপ  লাগছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাব। দেবেশের ঘোর কাটেনি। মনে হচ্ছে কোন পরি যেন তার কোলে ধরা দিয়েছে। দেবেশ বলে আমি বাড়িতে পৌঁছে দেবো। গায়ত্রী বলে, না না দরকার নেই। পরে কথা হবে। দেবেশ বলে, একই স্কুলের আমরা। নিশ্চয়ই দেখা হবে। গায়ত্রীর যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখেও এক তাৎপর্য পূর্ণ হাসি।
                ওদের  স্কুলের  যাতায়াতের পথে চিলপাথা ফরেস্ট গেটের ডান দিক দিয়ে সরু পাথরের রাস্তা মিশেছে বানিয়া নদীর কিনারায়। প্রত্যেক অঞ্চলেই একটা স্থান থাকে যেখানে কপোত-কপোতীরা বক-বকমের জন্য মিলিত হয়। এইসব স্থানে প্রেমিক -প্রেমিকারা তাদের প্রেমকে অমর করে রাখতে  গাছের কাণ্ডে কিংবা পাথরে নাম খোদাই করে রাখে। বানিয়া নদীর  পাথরের বুকেও তার  নিদর্শন আছে। একদিন গায়ত্রী বলে আমারা একটা ঝোপের আড়ালের পাথরে আমাদের  নাম খোদাই করি। দেবেশ পড়াশোনায় ভালো,খোঁজ খবর ও রাখে। দেবেশ বলে পৃথিবীতে প্রাচীনতম প্রেম পত্রটি পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়ার ক্যালডিয়া অঞ্চলে।  ২২০০খ্রিঃপূঃতে ব্যাবিলনের একটি ছেলে   এক খন্ড পাথুরে মাটির ফলকে  ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিপারাবাসী তার প্রেমিকাকে হিব্রু,আরবি,আরমিক ভাষা মিশিয়ে  প্রেমগাথা  লিখেছিল।    
               দেখতে দেখতে দু বছর কেটে গেল। গায়ত্রী ক্লাস ইলেভেন উঠলো। দুজনের বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। গায়ত্রীর মা বলে  দেবেশ ছেলেটা  ভালো  ওরা দুজনে  দুজনকে ভালোবাসে। ওদের পরে বিয়ে দেবো।। পরেশবাবু শুনেই  বলে কখনো না। আমরা ব্রাম্ভন।মেয়েকে প্রাণপণ ভালোবাসি। ওই নিচু জাতের বখাটে ছেলের সঙ্গে  বিয়ে কিছুতেই নয়। ভগবান পরেশবাবুর কথা শুনতে পায়। মালিঙ্গী চা বাগানের  ম্যানেজার মোনোজ মুখার্জ্জীর ছেলের সঙ্গে  বিয়ের ঠিক করে।
            গায়ত্রীকে ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। প্রেম যারা করে তারা ঠিক কোনো না কোন  উপায় বার করে। দেবেশ গায়ত্রীদের বাড়িতে ঠিকে ঝি বাসবীর মাধ্যমে চিঠি চালা চালি শুরু  করলো। সিদ্ধান্ত হলো বিয়ের দিন রাত্রে  পালিয়ে যাবে নয়তো বিষ খেয়ে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।
            “ স্টুপ টু কনকার।“ দেবেশ গায়ত্রীর বাড়িতে গিয়ে পরেশবাবু কে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে,বলে আমার বাড়ির লোকজনেরও এই বিয়েতে মত নেই। আমি ও চাই  ওর ভালো জায়গায় বিয়ে হোক। মেসোমশাই বিয়েতে খাটা খাটনির জন্য আমি আছি। দেবেশ ঘরের ছেলের মতোই বিশ্বাসী হয়ে গেল। সব কাজ  হাসিমুখে করছে। এমন কি সবার সামনেই গায়ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। বিয়ের ভোজের জন্য বাছাই করে পাঁঠা কেনা হয়েছে। পাঁঠারা পাতা চিবাচ্ছেই আর ব্যাঁ ব্যাঁ করে ডাক ছাড়ছে।  দেবেশ সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করে -এই বিয়েতে কত পাঁঠা  বলি হবে। যে যার মতোই অঙ্ক কষে উত্তর দেয়। গায়ত্রীর মনের কাঁটা খচখচ করে উঠে। তবে কি দেবেশদা ধরে নিচ্ছে ওর জীবন বলি হয়ে গেল। বিয়ের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ খবর এলো দেবেশের কোন কাকার স্ট্রোক হয়েছে  কলকাতা যেতে হবে। গায়ত্রী খবরটা শুনেও মনেমনে বলে,সন্ধ্যায় নিশ্চিত ও আসবেই।
              ম্যানেজারের ছেলের বিয়ে। বিয়েতে জমকালো কিছু  করতেই হবে। সাদরি মেয়েদের নাচের ট্রুপ এসেছে । ঝুরানি নাচ, একতার নাচ,মাছ ধরার নাচ সর্বপোরি জোৎস্না রাতের সেই মায়াবী ভালোবাসার নাচ। সঙ্গতে সেই লম্বা লম্বা কাল বাঁশি, ঢোল, ,ফ্লুট যোগে নাচ। সারা মহল্লায় সাড়া পরে যায়। ম্যানেজারের ছেলে মোনজিৎ মন জয় করতে বন্ধুদের আকন্ঠ দারু খেয়েছে ও খাইয়েছে। গায়ত্রী কনের সাজে বসে আছে,মনে মনে আশঙ্কা, দেবেশ এখনো কেন এলোনা।  কনেকে পিঁড়িতে করে বিয়ের আসরে নিয়ে  আসা হলো তবু  দেবেশের দেখা  নেই। বর মালা বদল করার জন্য দাঁড়াতে গেলে টলে পড়ে যায়।  গায়ত্রী সাহস করে বলে উঠে ওই মদমাতাল ছেলেকে বিয়ে  করবো না।  মা ও বলে এই বাজে ছেলের সঙ্গে  আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা। হৈচৈ বেঁধে যায়। বিয়ে বন্ধ ।
          গায়ত্রীর যে বিয়ে হল না এই খবরটা দেবেশ জানে কিনা তাও জানা গেল না। আবার বিয়ের ব্যবস্থা করতে গেলে গায়ত্রী জেদ করে বলে “বিয়ে করবে না।“ গায়ত্রীর মা স্বর্গবাসী হল। গায়ত্রী নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়ে মানুষের সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেবে। সময়ই সব দুঃখ কষ্টকে খেয়ে নেয়। কিছু  কষ্টের দাগ ছুরিকাঘাতের দাগের মতোই থেকে যায়। গায়ত্রীর মন থেকে দেবেশ মুছে যায়নি। প্রথম এবং শেষ প্রেম।
          বিলাসপুরের আমব্দেকার  মেমোরিয়ল হাসপাতালের নার্স গায়ত্রী। বাবাকে নিয়ে কোয়ার্টারেই থাকে। রবিবার রাতে  অ্যক্সিডেন্টে গুরুতর আহত  এক রুগি ভর্তি  হয়েছে। মাথায় সেলাই করে রক্ত বন্ধ করা গেছে,কিন্ত রোগি চোখে দেখতে পাচ্ছেনা। ডাক্তার চৌরাশিয়া বলেন,দৃষ্টি শক্তি হারানো, বিরল ঘটনা। বৃহস্পতিবারে ডিউটিতে গিয়ে শোনে সেই রুগিকে বাইশ নম্বরে আনা হয়েছে। রুগিকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। দেবেশ। দেবেশ এখানে কি করে আসলো। গায়ত্রী কোনো কথা না বলে রুগিকে পরম মমতায় শুশ্রূষা করে। সেবা আশ্রমের ম্যানেজার এসে বলে, উনার নাম ডাক্তার দেবেশ রায়। গত দশ বছর ধরে  আমাদের সেবা কেন্দ্রের ডাক্তার।ওনার দুকুলে কেউ নেই। রুগীই ওর আপন জন। উনি ডাক্তারি না করতে পারলে বাঁচবেন কি করে।
            গায়ত্রী অসতর্ক  মুহূর্তে কথা বলে ফেলে। দেবেশ কন্ঠস্বর শুনেই বলে গায়ত্রী কেমন আছো। এ জীবনে তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। সেদিন যেতে পারেনি। তুমি সুখে সংসার করো। গায়ত্রী বিয়ের দিনের সব ঘটনা বলে। দেবেশদা আমি  তোমাকে  ছাড়া কারও সঙ্গে ঘর বাঁধবোনা। আমি আমার একটা চোখ তোমাকে দেবো। দেবেশ বলে পাগলামি করোনা।  গায়ত্রী বাবাকে বলে দেবেশেকে ও ওর একটা  চোখ  দেবে। আগামী  রবিবার  দিন অপারেশন হবে। রবিবার  ভোরবেলায় দেখা যায় পরেশবাবু গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। বুকে বড়ো অক্ষরে লেখা, “আমার চোখ দুটো  দেবেশকে দিয়ে অমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।“

Friday, June 10, 2022

ছোট গল্প - হানাবাড়ি || লেখক - সন্দীপ কুমার পণ্ডা || Short story - Hanabari || Written by Sandip Kumar Panda


 

     হানাবাড়ি

                সন্দীপ কুমার পণ্ডা




                 আমি ভূতে মোটেই বিশ্বাস করি না ভূত হল মানুষের মনের দুর্বলতার স্বরূপ মাত্র যা আমরা কল্পনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলি।মানুষ যেখানে ভূতও সেখানে , যেখানে মানুষ নেই সেখানে ভূতও নেই এটাই আমার আদর্শ। অনেক বন্ধু -বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় ভূতের প্রসঙ্গে কথা হলে আমি বিপক্ষে সোয়াল করি সেজন্য আমাকে অনেকে 'ভূতনাস্তিক ' বলেও বাঁকে। আমি বহু পোড়ো বাড়ি,শ্মশানে ঘুরে বেরিয়েছি তবে ভূত দেখবার জন্য নয় ভূত দেখাবার জন্য মানে আমার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে 'ভূতান্বেষী' নামে যেখানে রাত ১২টায় কিম্বা ১টায়  আমি পোড়ো বাড়িতে ,শ্মশানে গিয়ে মানুষকে ভূত দেখাই তবে সত্যি কারের নয় আমার চ্যানেলে একটি মেয়ে আছে কোকড়ানো চুলওয়ালা ওকে সাজিয়ে বা অন্য সময় অন্য কাওকে সাজিয়ে দর্শকদের ভূত দর্শন করাই।তাহলে বোঝাই যায় আমি নিজেই একটা আস্ত ভূত।
বেশ ভালো চলে চ্যানেলটি অল্প রোজকারও হয়।এমনি করে দিন চলে যায় একদিন খবর পেলাম বাবুইপুরে একখানা পুরোনো বাড়ি আছে যেখানে নাকি ভূত আছে বলে এলাকার লোক। আমি গেলাম বারুইপুরে তবে ভূত দেখার জন্য নয় এখানে ভূতের ভিডিও করলে কেমন হয় সেজন্য গিয়েছিলাম। দেখলাম বেশ মনের মতো বাড়িখানা  একদিকটা ভেঙ্গে পড়েছে,সিড়িতে শেওলা জমেছে ঝুল তো আছেয়। বাড়ির পিছনে মোটা মোটা আমি জাম তেঁতুলের বাগান অন্ধকারছন্ন করে তুলেছে।মনে মনে খুব পছন্দ হল বাড়িখানা ঠিক করলাম সামনের অমাবস্যা পড়েছে ২৮ তারিখ সেইদিনই এখানে সুটিং করব।


                       বিকেলে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারুইপুরের দিকে। সন্ধের সময় পোঁছে গেলাম বারুইপুরের বাড়িতে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই বুকটা কেঁপে উঠলো মনে হলো সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সবাইকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিলাম আর পাপিয়াকে মেকাপের জন্য তৈরি হতে বললাম।মেকাপের পর ওকে বাড়ির একটা ঘরে বসে থাকতে বললাম ওকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম কীরকম আজকে সুটিং করব,ওর কীরকম অংশগ্ৰহন করবে?তাও আর একবার বুঝিয়ে দিলাম। নকল রক্ত,হাঁড় ও মানুষের খুলি আগেই তৈরি ছিল। আকাশ বেশ অন্ধকার চারপাশ ছমছমে  ভাব আর আমার মনে কেমন একটা অসস্তিকর অবস্থা অন্য কোথাও শুটিং এর সময় এমন অসস্তি বোধ করিনি। মনের চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লাম। সবাইকে ডেকে বললাম "প্রথমে বাড়ির চারপাশ দেখিয়ে ঘরে ঢ়ুকব সেখানে পাপিয়া আছে সে সেখানে ভূতুড়ে কান্না কাঁদবে আর আমাদের দেখে বাগানের দিকে ছুঁটে পালাবে"। তার একটু বাদে তখন ঘড়ির  কাঁটায় ১২টা তখন শুরু হল লাইভ ।ক্যামেরায় আছে রাজু , কথাবার্তায় দীপ, বিভিন্ন শব্দ কৌশলে রেখেছি সমু‌কে কৃত্রিম রঙ্গিন আলো ও ধোঁয়ার জন্য আছে সায়ন , সবাই কাজ করছে। ক্যামেরায় প্রথমে  বাড়িটার চারপাশটা দেখিয়ে তখন সিড়ি দিয়ে ঢ়ুকছি তক্ষুনি কতগুলো চামচিকা শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এলো আমি তো অবাক হয়ে গেলাম  চামচিকের কোনো অস্তিত্ব ছিল না হয়তো দিনের বেলার জন্যই ছিল না কিংবা দেখতে পাইনি কিন্তু  দিনের বেলাতেও চামচিকে দেখা যায় অন্ধকার ঘরে।এরপর যখন বাড়িতে ঢ়ুকতে যাচ্ছি ঝমঝমে ভাবটা মনে হলো বেড়ে গেছে আর কেন জানি না মনটাও সায় দিচ্ছল না এই ভুতুড়ে বাড়িতে থাকতে। যেহেতু সবাই ঠিকঠাক নিজ দায়িত্ব পালন করছিল সেজন্য আমার আর কিছুই করার ছিল না কেবল মাত্র দেখে যাওয়া ছাড়া।তারপর যে ঘরে পাপিয়া আছে সে ঘরে আমাদের নিজস্ব কৃত্রিম আলো,রং, হাঁড়, রক্ত দিয়ে সজ্জিত ঘর খানা ও দূর থেকে পাপিয়ার নাকি কান্না দেখাতে লাগলাম । পাপিয়ার অভিনয় আজ সত্যিই অবাক করার মতো অন্য দিনের চেয়ে অনেক ভালো যেন সতিই পাপিয়া ভূত হয়ে গেছে।ঝুলে ভর্তি দেওয়ালে পলেস্তার খসে পড়েছে আগাছা জন্মেছে ঘরের ভিতর আর ছাদ খসে  খসে পড়ছে।তারপর পাপিয়া বাগান দিকে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল আর আমরা বাগান দিকে ছুটলাম দর্শকদের আমারা  ভূত অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা দেখাব বলে।সবাই  সেদিকে গেল আমি আর গেলাম না। একটু বাদেই দেখি পাপিয়া ঘরের দিক থেকে ছুটে আসছে কিন্তু পাপিয়ার তো বাগানের দিকে থেকে আসা উচিত সেদিকেই পাপিয়া আর ইউনিটের সবাই গেছে আর বাড়ির পিছনে দিকে তো বাগান তাই ওকে জিজ্ঞাসা করতে ওর দিকে আমি এগিয়ে যেতেই ও হাঁপিয়ে বলতে লাগল "আমার ভুল হয়ে গেছে সচীনদা , আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে  আর কোনো দিন এমন হবে না।"
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম বলে কী মেয়ে টা।তারপর হেসে বললাম " তুই আজ অসাধারণ অভিনয় করেছিস খুব ভালো হয়েছে" ।
পাপিয়া অবাক হয়ে গিয়ে বলল "আমি তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম  এই বাড়িতে  তুমি যখন আমাকে রেখে এলে, বুঝতে পারিনি কিন্তু হঠাৎ চোখ লেগে গেল।"

আমি তো বিস্ময়ে , ভয়ে ,অবাকে  হতবুদ্ধি হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম আর শুনতে পেলাম কেও যেন আমার কানে বলছে " আমরা আছি......আমরা আছি....আমরা আছি...... আমরা চিরন্তন সত্য...... আমরা বাস্তব"।

Thursday, June 9, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -5


 


পাঁচ


ঋজুর ছেলে বাবি ক্লাস ফোরে পড়ে। নবনালন্দা স্কুলে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে সে যাতে খুব সহজেই ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে পারে, সে জন্য কাকে না ধরেছে ঋজু? রমাপদ চৌধুরী থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শেষে নীরেনবাবুর জামাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এ ডি এম আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্যন্ত। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টা করবেন। তবে ওখানে ভর্তির জন্য মিশনের উল্টো দিকে যে সব কোচিং সেন্টার আছে, সে রকম কোনও কোচিং সেন্টারে ছেলেকে ভর্তি করে দিতে বলেছিলেন তিনি। তিনিই দিয়ে দিয়েছিলেন এক মাস্টারের খোঁজ। ইনি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনেরই শিক্ষক। থাকেন মিশনের মেন গেটের উল্টো দিকে। বাড়িতেই কোচিং করান।
গত দু’বছর ধরে ঋজু ওর ছেলেকে প্রত্যেক রবিবার এখানে নিয়ে আসে। এখানে যারা পড়ে, তাদের বেশির ভাগ ছাত্রই নাকি মিশনে চান্স পায়। তাই দক্ষিণাও কিঞ্চিত বেশি। যে মাসে চারটে রবিবার সে মাসে দিতে হয় আটশো টাকা। আর যে মাসে পাঁচটা রবিবার, সে মাসে হাজার টাকা। মানে ক্লাস পিছু দুশো টাকা। সকাল সাতটা থেকে ক্লাস। সাড়ে ন’টার সময় মিনিট পনেরোর জন্য বিরতি। সে সময় বাইরে অপেক্ষা করা বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের মুখে ঠেসেঠুসে খাবার ঢুকিয়ে দেন। তার পর আবার ক্লাস। চলে এগারোটা, সাড়ে এগারোটা আবার কোনও কোনও দিন বারোটা অবধি।
তা, এত দিন এই শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের কী শিখিয়েছেন, আজ তার চূড়ান্ত পরীক্ষা। মিশনে সিট মাত্র ষাটটা। তিরিশটা বাংলা মাধ্যমের। তিরিশটা ইংরাজি মিডিয়ামের। অথচ পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় হাজার সাতেক ছাত্র।
শুধু ঋজু নয়, ছেলের পরীক্ষা, তাই ওর বউ ভারতীও সঙ্গে এসেছে। বাবি পরীক্ষা দিতে ঢুকে যেতেই ভারতীকে ‘একটু আসছি’ বলে ঋজু মিশন চত্বর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। আজ রবিবার। ছুটির দিনে কণিকা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। এতক্ষণে মনে হয় ও উঠে গেছে। না উঠলেও, ফোন করলে নিশ্চয়ই উঠে যাবে। ওকে বলে দেওয়া দরকার, বাবি পরীক্ষার হলে ঢুকে গেছে।
ফর্ম ফিল-আপের সময় নানান খুঁটিনাটি তথ্যের সঙ্গে, যদি থাকে, একটা মোবাইল নম্বর দিতে বলেছিল ওরা। ঋজুর নিজের কোনও মোবাইল নেই দেখে কণিকার নম্বরটাই দিয়েছে। ওকে না জানালে হয়!
বুথ থেকে ফোন করতেই ওর মেয়ে ধরল। ছোট বাবি না বড় বাবি ও বুঝতে পারল না। সামনাসামনি দেখলেও প্রথম প্রথম ও বুঝতে পারত না, কোনটা ছোট আর কোনটা বড়। দু’জনেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। লোকে বলে, ছোটবেলায় যতই একই রকম দেখতে থাকুক না কেন, যমজ বাচ্চারা যত বড় হয়, ততই নাকি তাদের মধ্যে পার্থক্য ফুটে উঠতে থাকে। কিন্তু ছোট বাবি আর বড় বাবির মধ্যে ও কোনও পার্থক্যই খুঁজে পেত না। তখন কণিকাই এক দিন বলে দিয়েছিল, যার চুল বফ বফ করে কাটা, সে ছোট। কিন্তু ফোনে গলার স্বর শুনে ঋজু বুঝবে কী করে, বফ বফ চুল ধরেছে না লম্বা চুল! ও বলল, মা উঠেছে?
— কখন...
— মাকে দাও।
— মা তো নেই আঙ্কেল।
— কোথায় গেছে?
— বেলুড়ে।
— বেলুড়ে?
— হ্যাঁ। কাল রাতে দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। ফোন পেয়ে মা কাল রাতেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অত রাতে তো গাড়িটারি কিছু পাবে না। তাই যায়নি। আজ সক্কালবেলায় উঠেই মা চলে গেছে।
— কখন আসবে কিছু বলেছে?
— কই, না তো।
ফোনটা কেটেই ফের টপাটপ বোতাম টিপল ওর মোবাইলের। আবার মেয়ের গলা— হ্যালো?
— মা মোবাইল নিয়ে যায়নি?
— না গো। এই তো ড্রেসিং টেবিলের ওপরে পড়ে আছে দেখছি। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেছে তো, হয়তো নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।
— একা গেছে?
— হ্যাঁ।
— একটু দরকার ছিল... দাদুর বাড়ির নম্বরটা দেবে?
— দাদুর বাড়ির নম্বর! একটুখানি কী যেন ভাবল মনে হয়, তার পরে বলল, দাদুর বাড়িতে তো ফোন নেই।
— দাদুর বাড়িতে ফোন নেই! খুব অবাক হল ঋজু। কই, কাল অত রাতে যখন কথা হল, তখনও তো ও কিছু বলল না! এমনিতে রবিবার রবিবার মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন না। চলে যান ক্লাইভ হাউস। সেখানে ওঁর একটা ফ্ল্যাট আছে। ওঁর মানে, ওঁর কেনা নয়। ওঁর কোন এক ছাত্রের ফ্ল্যাট। ফাঁকা পড়ে ছিল। উনি সেটা নিয়েছিলেন। যে ক’মাস থাকবেন, সে ক’মাসের ভাড়াও দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, উনি নাকি কোনও দিন এক পয়সাও দেননি। বহু দিন হয়ে গেছে ফ্ল্যাটটা আটকে রেখে দিয়েছেন। যার ফ্ল্যাট সেই ছাত্রটা ফোন করলে, উনি এখন তার ফোনটাও ধরেন না। সেই ফ্ল্যাটে উনি মাঝে মাঝে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। যারা পি এইচ ডি বা ডক্টরেট করছে, তাদের গাইড করেন। তাই রবিবার হলেই কণিকার বাড়ি চলে যায় ঋজু। ওখানেই খাওয়াদাওয়া করে। সারা দিন থাকে। কণিকার লেখা কবিতাগুলি ঠিকঠাক করে দেয়। কী করলে গল্পটা আরও ভাল হবে, কী ধরনের বিষয় নিয়ে লিখলে লোকে নেবে, বুঝিয়ে দেয়। কখনও সখনও নিজেও লিখে দেয়। নিজে যেখানে যেখানে লেখা পাঠায়, তার সঙ্গে ওর লেখাও দিয়ে দেয়।
কিন্তু এগুলি সবই হয় বিকেলের পরে। তার আগে খাওয়াদাওয়া। ঘুম। দু’মেয়ে চলে যায় পাশের ঘরে। বড় ঘরে ওরা দু’জন। যাওয়ার সময় মেয়েরাই দরজা টেনে দিয়ে যায়। কচিৎ-কদাচিৎ যখন মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন, ডাইনিং টেবিলে বইপত্র ছড়িয়ে এ ঘরের দিকে পিঠ দিয়ে লেখালিখি করেন, তখনও এ ঘরে ওদের মা আর ঋজু থাকলে, ওরা দু’বোন ও ঘরে পড়তে যাবার সময় ফালতু ফালতু কারেন্ট পুড়ছে বলে, এ ঘরের লাইট নিবিয়ে টান-টান করে পর্দা টেনে দিয়ে যায়।
বিকেল বা সন্ধের দিকে ঋজু কফি খেতে চাইলে অনেক সময় কণিকাই কোনও মেয়েকে ডেকে বলে, মহাদেববাবুকে বল তো একটু কফি বানাতে।
ঋজু এ ঘর থেকেই শুনতে পায়, ওরা তাদের বাবাকে বলছে, এই যে মহাদেববাবু, মা আপনাকে কফি করতে বলছে, শুনতে পেয়েছেন তো? পরে আবার বলবেন না, শুনতে পাইনি।
ও বহু ফ্যামিলি দেখেছে, কিন্তু এ রকম ফ্যামিলি এর আগে ও কখনও দেখেনি।
ওনার সঙ্গে তোমাদের এ রকম সম্পর্ক কেন? একদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছিল ও। তখন কণিকা অনেক কথা বলেছিল। তার মধ্যে যেমন ছিল, মহাদেববাবু কোনও পে রোলে নেই। উনি কোনও স্টাফ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রোজেক্টে কাজ করেন মাত্র। সামান্য মাইনে পান। তাও ঠিক মতো নয়। মিথ্যে কথা বলে উনি ওকে বিয়ে করেছেন। এক বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার দায়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। এক সময় খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় ভাষা পরিষদের স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যে দিন দুই মেয়ে জন্মাল, সে দিন হাসপাতাল থেকে ওষুধের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে যাবার নাম করে বেরিয়ে, সেই যে উনি উধাও হন, টানা তিন বছর তাঁর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। এখনও বাজার করতে হলে তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন তিনি। এই যে তার অফিসের ফ্ল্যাট উনি ভোগ করছেন, লাইট জ্বালাচ্ছেন, ফ্যানের হাওয়া খাচ্ছেন, যখন তখন ফোন করছেন, তার জন্যও কোনও দিন একটা পয়সাও তিনি দেন না। তাই নাকি ও মেয়েদের স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছে, ওর অবর্তমানে, টিউশুনি নিতে যাবার সময় ওরা যদি দেখে, বাড়িতে উনি আছেন, তা হলে যেন ফোনটা লক করে দিয়ে যায়। মেয়েদের যাবতীয় খরচখরচা নাকি কণিকাই চালায়।
ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রচুর কষ্ট দেখেছে ওরা। বাবার সঙ্গে তাদের মায়ের কী সম্পর্ক, ওরা তা জানে। তাই অন্য কারও সঙ্গে মাকে খুশিতে থাকতে দেখলে, ওরা তা হাসি মুখেই মেনে নেয়।
কিন্তু তা বলে এতটা! সে দিন যখন পিঠের নীচে দু’-তিনটে বালিশ দিয়ে খাটের ওপর আধ শোয়া অবস্থায় চায়ে চুমুক দিচ্ছিল ঋজু, তখন বড় বাবি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চোখ নাচিয়ে বলেছিল, আঙ্কেল আজ ক’বার হল?
ও কী বলতে চাইছে, বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখে আঙুল দেখিয়ে ও বলছিল, এক বার।
— উহু। মিথ্যে কথা। দু’বার। পাশের ঘর থেকে আমি শুনেছি।
— ধ্যাৎ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না ঋজুর কাছে।

আলাপের কয়েক দিনের মধ্যে কণিকা বলে দিয়েছিল, আমাকে পেতে গেলে কিন্তু আগে আমার মেয়েদের মন জয় করতে হবে। ঋজু তাই-ই করেছিল। ফোন করলে আগে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। তার পরে কণিকার সঙ্গে। প্রথম যে দিন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, সে দিন প্রচণ্ড গরম। ওদের জন্য ক্যাডবেরি আর দু’লিটারের একটা থামস আপ-এর বোতল নিয়ে গিয়েছিল ও। ছোট জন ওটা দেখে বলেছিল, অন্য কোনও রঙের পেলেন না!
তার পর থেকে ওদের জন্য ও আর কোনও দিনই ওই রঙের সফ্‌ট ড্রিংস নিয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে এ ফল ও ফল নিয়ে গেলেও ভুল করেও কখনও কালোজাম বা কালো আঙুর নিয়ে যায়নি।
দ্বিতীয় দিন যখন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, চা দিতে এসে ছোট বাবি ওর সামনেই দুম করে ওর মাকে বলেছিল, মা, আমি কিন্তু তোমার কাছে তিনশো টাকা পাই। মনে আছে? কাল কিন্তু দিয়ে দিও।
চায়ের প্লেট বিছানার পাশে রেখে সঙ্গে সঙ্গে পার্স থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বার করে ছোট বাবির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল ও। মেয়ে যখন কিছুতেই নিতে চাইছে না, ও তখন বলেছিল, এটা তোমার মায়েরই টাকা। আমার কাছে রাখা ছিল। নাও, নাও। যদি না নাও, তা হলে ভাবব, তোমরা আমাকে নিজের লোক মনে করো না।
কণিকাও বলেছিল, নে না। এত করে বলছে। একই তো। আঙ্কেল কি বাইরের লোক নাকি?
ধীরে ধীরে ঘরেরই লোক হয়ে উঠেছিল ও। যে সপ্তাহে রাত আটটা থেকে ডিউটি থাকত, ও কণিকাকে অফিস থেকে নিয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিত। খানিকক্ষণ কাটাত। তার পর অফিসে যেত। যে দিন কণিকা বলত, আজকে একটু তেরো নম্বরে নামব। ঋজু বুঝে যেত, ও আজ বাজার করবে। মাছ মাংস সবজি যা কিনত, ঋজু দাম দিয়ে দিত। প্রথম প্রথম কণিকা মৃদু আপত্তি করত ঠিকই, পরের দিকে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার দোকানদাররা পর্যন্ত ঋজুকে চিনে গিয়েছিল।

সব ঠিকই আছে। কিন্তু ও হঠাত্‌ বেলুড়ে গেল কেন! আর গেলই যদি, ফোনটা নিয়ে গেল না কেন! কাল রাতে ও যখন অফিস থেকে বেরোয়, তখনও কণিকার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। ‘কাল দুপুরে যাচ্ছি’ বলাতে কণিকা ওকে বলেছিল, এটা কোরো না গো। কাল তো তোমার ছেলের পরীক্ষা। তুমি তো বাবা। তোমার থাকা দরকার। একদম পাগলামো কোরো না। আমি তো আছিই। কোত্থাও যাব না। দরকার হলে ফোন করে নিও।
শেষ কথাটার মধ্যে, ঋজু যে ওকে সন্দেহ করে, সেই সন্দেহটা দূর করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রলেপ দেখতে পেয়েছিল ঋজু। তাই আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এটা কী হল! কোনও ফোন নেই, কিচ্ছু নেই, দুম করে চলে গেল! ওর বাবা কি কাল রাতে সত্যিই ফোন করেছিল! কখন!

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দোলের দিন ওরা রিনাদের বাড়ি যাবে। সেই মতো সকাল সাতটার মধ্যে ভারতীয় বিদ্যাভবনের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। কণিকা রেডিই ছিল। চার তলার জানালা দিয়ে ওকে দেখেই মিনিট কয়েকের মধ্যে নেমে এসেছিল। এমনি দিনেই অত দূরে সরাসরি কোনও অটো পাওয়া যায় না। তার ওপর সে দিন আবার দোল। অগত্যা একটা অটো রিজার্ভ করে ওরা রওনা হয়ে গেল সল্টলেক সেক্টর ফাইভ ছাড়িয়ে সোজা মহিষবাথানের দিকে। আগে নাকি গোয়ালারা ওখানে মহিষদের স্নান করাতে নিয়ে যেত। তার থেকেই এই নাম। ২৩৯/এ বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে অটোচালক বলল, ব্যাস। এ বার আপনাদের একটু হেঁটে যেতে হবে।
ওরা হাঁটা দিয়েছিল। এখানে পর পর অনেকগুলি ভেড়ি। টলটল করছে জল। হুহু করে হাওয়া বইছে। কণিকার শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। রিনাদের ‘আমরা এসে গেছি’ জানিয়ে দেবার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বার করেও ফোন না করে, ফোনটা টেপাটেপি করতে লাগল কণিকা।
ঋজু বলল, কী হল?
— বাইশখানা মিসড কল। আমরা কথার মধ্যে এত বিভোর হয়ে ছিলাম, শুনতেই পাইনি।
— একেই বলে প্রেম। কার নম্বর দেখো।
— কে জানে! চেনা নম্বর না। কয়েকটা নম্বর আবার বুথের। এত সকালে বুথ থেকে কে করল!
— কী করে বুঝলে বুথ থেকে?
— আট দেখে।
তখনই আবার ফোন। ঋজু বলল, ধরো। যে করেছিল, সে-ই হয়তো আবার করেছে।
ফোনটা অন করে কণিকা খুব নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল। একদম পাশে পাশেই হাঁটছিল ঋজু। কিন্তু ও যে কী বলছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না সে। ফোন ছাড়তেই ও জিজ্ঞেস করল, কে?
কণিকা বলল, ছোটকু।
— ছোটকুটা আবার কে?
— লোপার।
— লোফার?
— আরে বাবা, লোফার না। লোপার, লোপার। আমাদের অফিসে লোপা আছে না, ওর সঙ্গে ওর।
— ও-ও প্রেম করে?
— না। তুমি শুধু একাই করো। এই জানো কী হয়েছে, সে দিন ওর শাশুড়িকে অফিস যাচ্ছি বলে বেরিয়ে ছোটকুর সঙ্গে ও গড়চুমুক গিয়েছিল। ওহ্‌, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি, ওর কথা বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল। এর মধ্যে একটা কাণ্ড হয়েছে। লোপা তো ওর বরের সঙ্গে রোজ মর্নিং ওয়াক করতে যায়। এই ক’দিন আগে ও রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে ওর দুদু টিপে দে ছুট।
— সে কী? ওর বর ছিল না সঙ্গে?
— না। ওর বর একটু এগিয়ে গিয়েছিল।
— কথা বলতে বলতে রিনাদের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল ওরা। আবার ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ঋজু বলল, তোমার ফোন বাজছে।
কণিকা বলল, বাজুক, ধরলেই বকবক করতে হবে।

ঋজু আবিরের একটা প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল। ওটা খোলাই হল না। খোলা হল মদের বোতল। চিপসের প্যাকেট। রিনা আর আশিসের সঙ্গে পরামর্শ করে কণিকা নাকি গত কালই এগুলি কিনে রেখেছিল। ঋজুকে চমকে দেওয়ার জন্য।
গ্লাসে ঢালামাত্র ঢগঢগ করে খেয়ে নিল আশিস। রিনাও তাই। ওদের দেখাদেখি কণিকাও এক চুমুকে শেষ করে দিল গ্লাস।
ঋজুর মনে পড়ে গেল রাধানাথ মন্ডলের কথা। ওর একটা প্রকাশনা সংস্থা ছিল— সংবাদ। ও লোককে বলত, এটা একটা শিক্ষিত প্রকাশন সংস্থা। যেন বাকি প্রকাশকেরা সব মুখ্যু। পরে সেটা সমর নাগ কিনে নেন। এখন তো তাঁর বিশাল ব্যাপার। বেঙ্গল শেল্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে ফেলেছেন। কলেজ স্ট্রিট মার্কেট ভেঙে নতুন ভাবে বানাচ্ছেন।
সেই সংবাদ থেকে গল্পপত্র নামে একটি পত্রিকা বের হত। অনেক তরুণ লেখকেরা সেখানে আসতেন। আসতেন নবকুমার বসু, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, অমর মিত্র। কে নয়? আড্ডা হত। মাঝে মাঝেই মদের আসর বসত। সেই সংবাদে কাজের জন্য একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। রাধানাথ তাকে চাকরি দেয়নি। কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেবে বলে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ দিকে ও দিকে কাটাত।
রাধানাথ চাকরি করত। ফলে সংবাদে সময় দিতে পারত না। একটা ছেলে রেখেছিল। সে-ই দোকান খুলত। দেখাশোনা করত। হিসেবপত্র রাখত। একদিন সেই মেয়েটির সামনেই রাধানাথ তাকে বলল, আমি থাকি না-থাকি, ও যখন আসবে, যা টাকা-পয়সা চাইবে, ক্যাশ থেকে দিয়ে দিবি, কেমন?
ছেলেটি অবাক। তার মাইনেটা পর্যন্ত যে ঠিক সময়ে দেয় না, চাইলে, আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে সারা মাস ধরে কিছু কিছু করে দেয়, সে বলছে এই কথা! না। বেশিক্ষণ ধন্ধে থাকতে হয়নি তাকে। খানিকক্ষণ পরেই, ওই মেয়েটিকে বাসে তুলে দিয়ে এসে রাধানাথ বলল— ওর সামনে তোকে যে কথাটা বললাম, সেটাকে আবার সত্যি ভেবে নিস না।
ছেলেটি বলল, তা হলে? উনি যদি বলেন, তোমার সামনেই তো উনি সে দিন বলে গেছেন, তখন?
— বলে দিবি, আজ খুব খারাপ অবস্থা। কোনও বিক্রিবাট্টা হয়নি। ক্যাশে টাকা নেই, ব্যাস।
সেই মেয়েটি আবার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করত। দু’-এক বার তাকে নিয়েও সংবাদে এসেছিল সে। এক বার এমন দিনে এল, সে দিন ও রকমই এক মদের আসর বসেছিল। গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢালার সময় রাধানাথ ওই ছেলেটিকে বলেছিল, চলবে নাকি?
ছেলেটি মাথা কাত করেছিল। তাকে গ্লাস দিতেই, সে এক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে দিয়েছিল। তখন ওই মেয়েটি বলেছিল, দেখলেন তো, একেবারে চোস্ত্‌।
রাধানাথ বলেছিল, ও কোনও দিন মদ খায়নি।
— কী করে বুঝলেন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল।
রাধানাথ বলেছিল, যারা মদ খায়, তারা কখনও এ ভাবে খায় না। তারিয়ে তারিয়ে, রেলিশ করে খায়। চোখ দিয়ে ছেলেটিকে দেখিয়ে বলেছিল, গ্লাসে ওর চুমুক দেওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি, এ ব্যাপারে ও একেবারেই নবীশ।

এখন আশিস, রিনা আর কণিকার মদ খাওয়া দেখে ঋজুরও মনে হল, এর আগে এরা কখনও মদ খায়নি। এই প্রথম খাচ্ছে। যখন মদ খাওয়া চলছে, আবার ফোন বেজে উঠল কণিকার। তার পর আবার। আবার। দু’মিনিট ছাড়া ছাড়া ফোন। অথচ প্রতি বারই স্কিনে নম্বর দেখেই ও আর ফোনটা ধরছে না। একটু নেশা-নেশা মতো হয়ে গিয়েছিল সবারই। ঋজু হঠাত্‌ জানতে চাইল, কার ফোন? ধরছ না কেন? দেখি নম্বরটা? ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিল ঋজু। কিন্তু তার আগেই ঝট করে ফোনটা তুলে নিল কণিকা। ঋজুও ছাড়বার পাত্র নয়। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার পরে ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জোর জবরদস্তি। শেষে কণিকা বলল, দিতে পারি, কিন্তু তার আগে কথা দাও, ফোনটা তুমি ধরবে না।
ফোনটা নিয়ে ঋজু দেখল, একটা নম্বর থেকেই বারবার ফোন আসছে। যখন দেখছে, ঠিক তখনই আবার বেজে উঠল সেটা। অথচ কণিকাকে কথা দিয়েছে দেখে ও ফোনটা ধরল না। কণিকার কাছে দিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পরে নেশাটা একটু চড়তেই ও বলেছিল, যে ফোন করছে, তাকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো। কে করছে বলো? তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
বারবার জেরায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল কণিকা। কোনও রকমে উঠে, ঋজুর হাত ধরে টানতে টানতে ঝুল বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ও আর তুমি একই সঙ্গে আমার জীবনে এসেছ।
— তার মানে?
— ও আমাদের অফিসেই কাজ করে।
— কী নাম?
— এ কে পাল, অরুণকুমার পাল।
— কোথায় থাকে?
— কাঁচরাপাড়ায়।
— তুমি তো আমাকে এ সব কথা কখনও বলোনি।
— বহু বার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি।
— ঠিক আছে। এখন তো বলেছ। এ বার আমি বলি? তুমি আমাদের মধ্যে থেকে যে কোনও একজনকে বেছে নাও। একসঙ্গে দু’জনকে নিয়ে খেলা কোরো না।
কণিকা বলেছিল, আমাকে একটু ভাববার সময় দাও। কথাটা শুনে এক ঝটকায় নেশাটা কেটে গিয়েছিল ঋজুর। তখনই ও বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু আশিস আর রিনা ওকে আটকায়। কণিকাও এমন ভাবে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় যে, পুরো পরিবেশটাই পাল্টে যায়।
সে দিন রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি ঋজু। কী বলতে কী বলে ফেলবে, কিংবা কথা বলতে বলতে যদি কথা জড়িয়ে যায়, সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে, কারণ ও তো মদ-টদ খায় না। ওর বউ আবার কী ভাববে, হয়তো ভাববে এই বয়সে আবার কার পাল্লায় পড়ল! তাই আশিসই ফোন করে ভারতীকে জানিয়ে দিয়েছিল, আজকে একটু উল্টোপাল্টা খাওয়া হয়েছে তো,,, ও দু’-তিন বার বমিটমি করেছে। একটু কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে, না-হলে কথা বলিয়ে দিতাম। আজ তো দোলের জন্য গাড়িটারিও কম। এত রাতে ওকে একলা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছি না। আজকের রাতটা এখানে থাক। আমার মনে হয়, একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালে ওকে পাঠিয়ে দেব। আপনি আবার চিন্তা করবেন, তাই ফোন করলাম।
কণিকাও ফোন করল বাড়িতে। মেয়েকে বলে দিল, মহাদেববাবু যদি জিজ্ঞেস করে আমি কোথায়, তা হলে বলবি, আমি রিনাদের বাড়িতে আছি। রাতে এখানেই থাকব। কাল সকালে ফিরব। আর আঙ্কেল ফোন করলে বলবি, দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। মা বেলুড়ে গেছে। মোবাইলটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।

ঝট করে শক খেল ঋজু। ভুলে গেল, ছেলে এখন পরীক্ষা দিচ্ছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। ভুলে গেল, বউকে একটা গাছের তলায় বসিয়ে, ও বলে এসেছে ‘তুমি এখানে থাকো, আমি একটু আসছি’। একটু মানে কতক্ষণ? ওর মাথা আর কাজ করছে না। ওর মনে হল, ও যা শুনল, সেটা আসলে সে দিনের সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। তার মানে, কণিকা যা শিখিয়ে দেয়, ওর মেয়েরা তাই বলে। তা হলে কি ও আজ অন্য কারও সঙ্গে আছে! কিন্তু কার সঙ্গে! সে দিন যে নম্বর থেকে ঘনঘন ফোন আসছিল, তাঁর সঙ্গে কি? সেই নম্বরটা ওর মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। ও চটপট সেই নম্বরে ফোন করল— কণিকা আছে?
— এটা তো কণিকার নম্বর নয়। কে বলছেন? ও প্রান্ত থেকে এক গুরুগম্ভীর পুরুষ-কণ্ঠ।
ও বলল, আমি, আমি ঋজু। কণিকার বন্ধু।
— এই নম্বরটা পেলেন কোত্থেকে?
— না, আসলে দোলের দিন এই নম্বর থেকে ওর মোবাইলে বারবার ফোন আসছিল তো, তাই এই নম্বরে করলাম।
— দোলের দিন? আপনি জানলেন কী করে?
— আমি ওর সঙ্গে ছিলাম।
— ও, আপনি সে দিন ওর সঙ্গে বেলুড়ে গিয়েছিলেন?
— বেলুড়ে নয়। অন্য জায়গায়। ও আমার বিশেষ বন্ধু।
— বিশেষ বন্ধু মানে? একদম বাজে কথা বলবেন না। ও সে দিন বেলুড়ে গিয়েছিল। ওর মা ভীষণ অসুস্থ। ও এত টেনশনে ছিল যে মোবাইলটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। টিনা-মিনা আমাকে বলেছে।
— টিনা-মিনা! ঋজু ওর ভাই-বোন, তাদের ছেলেমেয়ে, এমনকী ওর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেরই নামধাম জানে। কিন্তু ওর মুখে কোনও দিন এই নাম তো ও শোনেনি! ও বলল, কে টিনা-মিনা?
— সে কী, আপনি বলছেন ওর বন্ধু, বিশেষ বন্ধু, আর ওর মেয়েদের নামটাও জানেন না? রাখুন। যত্তসব। বলে ফোনটা কেটে দিল। ঋজু স্তম্ভিত। ওর মেয়েদের নাম টিনা-মিনা! ওদের নাম তো বড় বাবি, ছোট বাবি! আমি কি কোথাও ভুল করছি! আচ্ছা, লোকটা কেমন যেন কেটে কেটে কথা বলছিলেন, না! তা হলে কি কণিকা ওঁর সঙ্গেই আছে! লোকটা ওর ইশারা অনুযায়ী কথা বলছিলেন! হতে পারে! খানিক পরে আবার ফোন করল ওই নম্বরে।
ফোনটা ধরেই লোকটা বললেন, কী হল?
— বিশ্বাস করুন, সে দিন ও আর আমি রিনাদের বাড়িতে ছিলাম। সারা রাত আমরা দু’জন একসঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছি।
— একদম বাজে কথা বলবেন না। ও যখন চাইছে না, কেন ওকে বিরক্ত করছেন? জানেন, ওর সঙ্গে আমার চার বছরের সম্পর্ক। কোনও ছাত্র যে কোনও শিক্ষকের বউকে এই ভাবে বিরক্ত করতে পারে, তা আপনাকেই প্রথম দেখলাম।
ছাত্র! আমি তো কখনও মহাদেববাবুর ছাত্র ছিলাম না! তা হলে কি ও ওর মতো করে ওনাকে সাত-পাঁচ বুঝিয়েছে! ও বলল, বিশ্বাস করুন, আমি এতটুকুও মিথ্যে বলছি না। দরকার হলে আপনি রিনাদের বাড়িতে ফোন করে জেনে নিতে পারেন।
— ওদের নম্বর কত?
কাঁধের ঝোলা হাতড়ে ছোট্ট ডায়েরিটা বার করে রিনাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা ও দিয়ে দিল। নম্বরটা নিয়েই ফোনটা কেটে দিলেন তিনি।

রিনাদের নম্বরটা বার করাই ছিল। দোলের দিন তারা যে ওদের বাড়িতে ছিল, কেউ ফোন করে জানতে চাইলে, তাকে যাতে রিনারা সত্যি কথাটা বলে দেয়, সেটা বলার জন্যই ও ফোন করল ওদের। কিন্তু যত বারই ফোন করল, শুধু এনগেজড আর এনগেজড।
উনি যত বারই ফোন করুন না কেন, এখন তো এনগেজড, পাবেন না। পরে যেন করেন। বলার জন্য লোকটাকে ফোন করতেই তিনি ধমকে উঠল,কী ব্যাপার? এত জ্বালাচ্ছেন কেন বলুন তো? কী চাই?
— না, বলছিলাম কি, রিনাদের ফোনটা এনগেজড, এখন হয়তো পাবেন না। পরে করলে নিশ্চয়ই পাবেন। সেটা বলার জন্যই...
— ওদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওরা তো ডিনাই করল।
— ডিনাই করেছে!
কথা শেষ হবার আগেই লোকটা লাইন কেটে দিলেন। তা হলে কি এতক্ষণ ওদের সঙ্গেই উনি কথা বলছিলেন! তা হলে তো ওদের নম্বরটা এখন ফাঁকা। ও ফের রিনাদের নম্বরে ডায়াল করল। রিনাই ধরল।
ঋজু বলল, আপনাদের কেউ ফোন করেছিল নাকি?
রিনা বলল, হ্যাঁ।
— দোলের দিন আমরা যে আপনাদের বাড়িতে ছিলাম, আপনি কি সেটা অস্বীকার করেছেন?
ঢোক গিলে রিনা বলল, আসলে, আমাদের বাড়িতে আপনারা রাত কাটিয়েছেন, এটা জানাজানি হলে আমাদের সম্পর্কে লোকে কী ভাববে বলুন তো... তা ছাড়া কণিকারও মান-সম্মানের ব্যাপার আছে। যতই হোক, মেয়ে তো, ওর কথা ভেবেই...
— ও।
আর একটা কথাও বলেনি ঋজু। হাঁটতে হাঁটতে যখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ঢুকল, বুঝতে পারল, অনেকক্ষণ আগেই পরীক্ষার পাট চুকে গেছে। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুটিকতক মাত্র লোক। বাঁ দিকের বিল্ডিংয়ের চাতালে ওর বউ আর ছেলে বসে আছে। কী ভাবে যে ও বাড়ি ফিরেছে, ও-ই জানে। সারা দিন শুধু ছটফট করেছে। সন্ধের দিকে ল্যান্ড ফোনে ফোন করতেই কণিকার গলা— হ্যালো?
— কোথায় গিয়েছিলে?
এক মুহূর্ত চুপ। তার পরেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল— কে বলছ? হঠাত্‌ গলার স্বর পাল্টে গেল। মহাদেববাবুর গলা ও চেনে। এটা তার গলা। তবে কি ওর গলা শুনেই রিসিভারটা মহাদেববাবুর হাতে দিয়ে দিল কণিকা!— একটু কণিকাকে দিন না।
— কণিকা! এ কী! তুমি বউদির নাম ধরে কথা বলছ কেন?
— না মানে, দিন না ওকে...
— ও সেই সক্কালবেলায় বেলুড়ে গিয়েছিল তো, ওর মায়ের কাছে। ওর মা খুব অসুস্থ। সারা দিন খুব ধকল গেছে। এখন একটু শুয়েছে। কাল কোরো। ভাল আছ?
আর ভাল! ও আর কোনও কথা বলতে পারল না। শুধু মনে মনে বলল, বুঝেছি, সারা দিন কোন ধকল গেছে।


                                              ক্রমশ...

__________________________________________________

চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-


ষষ্ঠ পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন --