Friday, October 25, 2024

বিসর্জন - সমীর কুমার দত্ত || Bisarjan - Samir Kumar dutta || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

     বিসর্জন 

      সমীর কুমার দত্ত

           


গোছগাছ প্রায় সমাপ্তির পথে। দুর্গাপূজো চলছে, তার মধ্যেই এই গোছগাছ। দশমীর পর দিনই সংসার ছেড়ে বিবাগী হতে হবে এমনটি নিশ্চিত হয়ে যাবার পর থেকেই তিন দিন ধরে একটু একটু করে চলেছে গোছগাছ কি কি নিতে হবে আর কি নয়। এমনিতেই কি বা নেওয়ার আছে একটা বিধবার। তবুও ঘর ছেড়ে বাইরে যাওয়া তো,কোথায় কখন কি লাগে কে বলতে পারে।নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তো নিতেই হবে। এ ছাড়া কখন কি লাগে ভেবে ভেবে ঠিক করতে হচ্ছে। খান আষ্টেক দশেক কালো পাড় শাড়ি বা থান, কয়েকটা শায়া, ব্লাউজ টাওয়েল বা গামছা, টুথপেস্ট,এটা অবশ্য ওখান থেকেই দেওয়া হবে, আর টুথব্রাশ। এছাড়া একটা থালা, গ্লাস,বাটি। তিনি আবার পাঁচ জনের থালা,গেলাসে খেতে পারেন না। একটা ছোট আয়না যদিও আয়না সেখানে থাকবে ‌, চিরুণী,গায়ের শাল ও চাদর, একটা বিছানার চাদর বা বেড কভার, স্টীল ফ্রেমে বাঁধানো স্বামীর একটি ফটো,পান- জর্দার থলি আর মানি ব্যাগ।—এই হলো লাবণ্যময়ীর একার ঘর সংসারের টুকিটাকি জিনিস।


তিন দিন ধরে একটু একটু করে লাবণ্যময়ী গোছগাছ করে চলেন আর অতীত দিন গুলোতে হারিয়ে যান। মাঝে মাঝে ছেলে সুপ্রিয়'র মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন—যদি ছেলে তাঁকে সংসার ছেড়ে না যাবার জন্য অনুরোধটুকু করে এই আশায়। সুপ্রিয় কী রকম শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে! কিন্তু ওর কিছু করার নেই। করতে গেলেই ঝগড়া অশান্তি হবে। লাবণ্যময়ী যতো ভাবেন তত তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। কত কষ্টে গড়ে তোলা এই সংসার সহজে কি ছেড়ে যাওয়া যায় । যদিও সবাইকেই একদিন সব ছেড়ে চলে যেতে হবে।আড়ালে চোখ মুছতে থাকেন। সুপ্রিয়'র তা নজর এড়ায় নি। আস্তে আস্তে তার ছোট বেলার স্মৃতি, মায়ের স্নেহ সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে।


ও একবার কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। বাঁচার আশা প্রায় ছিল না বললেই হয়। ওকে বাঁচাতে ওর মা -বাবা চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নি। বিশেষ করে মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে ওর চোখে জল এসে যায়। অসুখের ঘোরে ও একবার বলে ছিলো, "মা, আমি আর বাঁচবো না, মা ।" ওর মনে আছে, সঙ্গে সঙ্গে মা ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, " ছি বাবা, ও কথা বলতে নেই। আমি তখন কি নিয়ে বাঁচবো? আমিও মরে যাবো।" বলতে বলতে মায়ের চোখ জলে ভরে ওঠে। সে কথা সে আজও ভোলে নি।


আর একবার, তার স্পষ্ট মনে আছে, ও হারিয়ে গিয়েছিল।ছেলেধরা ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। দুপুর থেকে রাত ৯টা ১০টা কেটে গেছে হবে মা কিছুই মুখে দেয় নি,কেবল কান্নাকাটি করেছে। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়েছে । ভাগ্যক্রমে পাড়ার এক দাদা ওকে দেখতে পেয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনে,তবে মা মুখে কিছু দিয়েছে। আজ সেই মা কে অসহায় অবস্থায় সে তার বৌ এর জন্য বাড়ি ছাড়া করছে। ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। মুখে কিছু বলতে পারছে না। ঘন ঘন পায়চারী করছে আর আড় চোখে মায়ের গোছগাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক এক সময় তার মনে হয় — দৌড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলে, " মা গো তুমি যেও না মা আমায় ছেড়ে।" কিন্তু পারে না স্ত্রীর শাসনে।


এতক্ষণে পাঠক মাত্রেরই জানতে বাকি নেই যে লাবণ্যময়ী তার তৈরি সংসার থেকে বিতাড়িত। স্বামী সুধাময় মারা গেছেন আজ দু বছর হলো। স্বামীর শেষ জীবন ভালো কাটেনি। তার ছেলে -বৌ তার শেষ জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলে ছিলো। বৌমা মধুরা তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে ঝি -চাকরের মতো খাটাতে থাকে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সুপ্রিয়র সামনে শ্বশুর -শাশুড়ীর প্রতি খুব শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। আর পরে পরে তার অবর্তমানে ফাই ফরমায়েশ করে খাটিয়ে মারে। মনঃপূত না হলে মুখ ঝামটা দেয়। অপমান সূচক কথা বলে। বাইরের সমস্ত কাজ শ্বশুরকে দিয়ে আর ঘরের কাজ তাঁকে দিয়ে করাতে থাকে স্বামী সুধাময় সওদাগরী অফিসে কাজ করতেন। উপায় ভালোই ছিলো। কিন্তু অবসরের পর খুব বেশি টাকা তিনি হাতে পান নি মেয়ের বিয়ের সময় প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিতে হয়েছে বেশ খানিকটা টাকা।তারপর ব্যাঙ্কের জমানো টাকা থেকেও অনেকটা টাকা চলে গেছে।

সুতরাং শেষমেশ হাত অনেকটাই খালি হয়ে গেছে।বাকি যে টুকু বেঁচেছিল তার অর্জিত সুদ থেকে হাত খরচা চলতো। তার মধ্যে বৌমা সন্তান প্রসবের সময় প্রকারান্তরে দশ পনেরো হাজার টাকা আদায় করে নেয়। ফলত তারা খাই খরচ বাবদ ছেলের হাতে কিছুই তুলে দিতে পারে না।সংসারের গলগ্রহ হয়ে জীবন ধারণ করা ছাড়া আর গতি রইলো না। সুপ্রিয় ব্যাঙ্কে চাকরি করে।উপায় ভালোই কিন্তু হলে কি হবে, বৌমার হাতেই সব তুলে দেয়।‌বৌমা শ্বশুর -শাশুড়ির দায় না নিয়ে নিজের ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে।তা ভাবুক। ভাবতে তো হবেই কিন্তু বাবা মা কে না দেখে। উল্টে কি করে শ্বশুর-শাশুড়ির শেষ সম্বলটুকু আদায় করে নেয়া যায় সেই চেষ্টা।এই বাবা-মায়েরাই একদিন ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়তে গিয়েই তো আজ তাদের হাত শূণ্য। নিঃস্ব বাবা-মার দায় মানুষ হয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের নয় কি।


সুধাময় যৌথ পরিবারে মানুষ। ঘরের সঙ্কুলান না হওয়ায় বিয়ের বছর ছয়েকের মধ্যে তারা সংসার থেকে বেরিয়ে আসেন তাদের দ্বিতীয় সন্তান সুমনা জন্মাবার পর। সুপ্রিয় তখন পাঁচ বছরের। লাবণ্যময়ী তখন সংসারের আর কারোর কথা না ভেবে কেবল সুপ্রিয় ও সুমনার সুখের কথা ভেবে সংসার থেকে বেরিয়ে আসেন নির্বিবাদে। অবশ‌্য তাদের বের হওয়ার একটা অকাট্য যুক্তি ছিল—ঘরের সঙ্কুলান না হওয়ায় জন্য। কিন্তু যাদের জন্য তারা এ কাজ করতে বাধ্য হয়ে ছিলেন সেই ছেলের সংসার

তাদেরই নির্মিত বাড়ি থেকে তাঁকে আলাদা করে দিতে চাইছে। নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস! তফাৎটা হলো তিনি শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন আর এখন তাঁর বৌমা তাঁদের ভিটে থেকে তাঁকে বের করে দিচ্ছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাই লাবণ্যময়ী বউ হয়ে তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন আর এখন মধুরা বউ হয়ে শাশুড়ি লাবণ্যময়ীকে তাদেরই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে।পরের জন আগের জনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে। এই ভাবেই ভেঙেছে যৌথ পরিবার।আর তাতে স্ত্রীলোকের অগ্রণী ভূমিকা আছে। পুরুষ মৌন থেকেছে, আর 'মৌনতা সম্মতি লক্ষনম্'—

এই আপ্তবাক্যকে মেনে নিলে বলতে হয় —সংসার বিভাজনে পুরুষের পরোক্ষ ভূমিকা আছে। এই মৌনতার দুটি কারণ সম্ভব ।

প্রথমতঃ, অতিরিক্ত স্ত্রৈণতা। দ্বিতীয়তঃ, অশান্তি এড়িয়ে চলা। কারণ, যে নারী পুরুষকে বাগে আনতে পারে অসমর্থ, তারা সংসারে অশান্তির বীজ বপন করতে চায় —যা পুরুষের কাম্য নয়। যদিও সর্বক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কম হলেও কত মহীয়সী নারী এখনও আছেন উদাহরণের অপেক্ষায়। 


বর্তমানে চরম প্রতিবাদের মুখপাত্র হিসাবে আইনকে ব্যবহার করে অনেক নারীই সংসারে অশান্তির বীজ বপন করে । তাতে পুরুষটি বাগে এলে ভালো,নইলে সে নিজের কবর নিজেই খুঁড়বে। সে নারীও জানে যে তাকে আরও নিরাপত্তা ও বিসর্জন দিতে হবে। তবুও সে মরিয়া,  তার গোঁ চরিতার্থ করতে।বাল্যে মায়ের স্নেহ, ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে মায়ের আঁচল ছাড়া সন্তান আর কিছু জানে না। আবার দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী সোহাগে বিগলিত হয়ে স্ত্রীর আঁচল ছাড়া কিছু বোঝে না। পুরুষের কাছে নারীর এই যে দ্বৈত রূপের মুন্সিয়ানা, তার কাছে পুরুষ সর্বদাই নাবালক। নারীর স্ববিরোধী সংঘাত —বাল্যে মাতৃরূপে সন্তানের ওপর, আবার যৌবনে স্ত্রীরূপে স্বামীর ওপর বেপরোয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার , এই দুয়ের জাঁতাকলে পড়ে পুরুষের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। তার তখন ' রাই রাখি না শ্যাম রাখি ' অবস্থা।তখন সে ব্যক্তিসত্ত্বাহীন, প্রাণহীন এক কলের পুতুলে পরিণত হয়।


আবার এমন অনেক বেইমান,স্বার্থপর সন্তান আছে,যারা স্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও নিজের সংসারের অধিকতর সুখ -সমৃদ্ধির জন্য পিতা -মাতার কাছ থেকে সরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় , তাদের অপার স্নেহ - ভালবাসা , আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে। অনেকটা শিব গড়তে গিয়ে বানর তৈরি হওয়ার মতো।


নারী হলো প্রকৃতি। যা প্রকৃতির মতোই কোমল ও সুন্দর।এই  কোমল,সুন্দর নারী ফুলের সঙ্গে তুলনীয়। নারী স্বরূপ ফুল দিয়েই সংসার রূপ বাগিচা গড়ে ওঠে। আর ফুল যদি হয় বনফুল তবে তার জায়গা হয় অরণ্যে। তদ্রুপ নারী যদি হয় বনফুল তবে সংসার হয়ে ওঠে ভয়ংকর অরণ্য সদৃশ্য। নারী 'মমতাময়ী '  ' করুণাময়ী ' শব্দদুটি শুধু মাত্র তার মাতৃরূপেই ধরা পড়ে, স্ত্রীরূপে নয়। বর্তমানে আর্থ -সামাজিকতার যুগে নারীর স্ববিরোধী সংঘাত (স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকায় বিরোধ) প্রকট হওয়ার জেরে কতো বৃহৎ সংসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এককালে পুরুষ শাসিত সমাজ ছিল বলে নারী তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেনি।পুরুষের প্রচেষ্টায় সংসার যৌথ থেকেছে।তখন নারী ছিল মুখোশের আড়ালে। আজ নারী স্বাধীনতার যুগে নারী তার মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়েছে তার এই স্ববিরোধী সংঘাতকে ক্রিয়াশীল করতে।


মাতৃ ঋণ অপরিশোধ্য। নারীর মাতৃরূপ স্ত্রীরূপের চেয়ে ঢের বেশি মহিমাময়।কিন্তু বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত   সন্তানকে মা সন্তান বলে চিনতে পারেন। বিয়ের পরেই সন্তানকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয়।যেমন হচ্ছে লাবণ্যময়ীর। আজ এই মাতৃরূপের পরাজয়কে বরণ করে লাবণ্যময়ীকে তারই হাতে গড়া সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে এক বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে উঠতে হচ্ছে। লাবণ্যময়ীও তাঁর স্ত্রী সত্ত্বার অধিকার ফলিয়ে ছিলেন সংসার থেকে আলাদা হতে চেয়ে। তবে তফাৎ এটুকুই যে নিজের ভালো চেয়ে স্বামীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন প্রতিপক্ষ নারী অর্থাৎ শাশুড়িকে পথে বসিয়ে নয়। যেমনটি ঘটছে তাঁর নিজের জীবনে ।


লাবণ্যময়ীর নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে —বেশিদিন বাঁচার জন্য। স্বামীর আগেই তার মৃত্যু হলেই ভালো হতো। সধবা অবস্থায় পৃথিবী থেকে চলে গেলে সসন্মানেই যেতে পারতেন। তার মতো বিধবা আজ সংসারের গলগ্রহ। তার মৃত্যুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সংসারের সকলে, ব্যতিক্রম শুধু নাতি নাতনিরা। তারা সর্বদাই সচেষ্ট ঠাকুরদা - ঠাকুমা ও দাদামশাই - দিদিমার ভালবাসা পেতে। মাঝে মাঝে স্বামীর কথা মনে পড়ে —এ সংসারে আরও বেশিদিন বাঁচলে তাকে যে শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হতো এমন কি অর্দ্ধাহারও অসম্ভব নয়, তা লাবণ্যময়ী সহ্য করতে পারতেন না।তার চেয়ে মরে গিয়ে সে বেঁচেছে। তার বৌমা তাকে দিয়ে কি না করিয়েছে।দোকান,বাজার, নাতি টিপুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, বিকেল হলে পার্কে খেলতে নিয়ে যাওয়া, আবার সন্ধ্যে হলে পড়ানো, কি নয় ? জ্বর , শরীর খারাপ কোন কিছুতেই রেহাই নেই। তার ওপর একটু দুধও জোটেনি।ছেলে সুপ্রিয় সবই জানে তবুও সে মধুরার ভয়ে কিছুই বলতে পারে না। তার মতে —সংসারের সবাই খাটে, সবাইকে দুধ খাওয়াতে হলে তো পেটে আর ভাত জুটবে না।অথচ মধুরার বাপের বাড়ির লোকজন এলে ‌কি খাতির যত্নই না করে মধুরা নাম কেনার জন্য। তাও ছেলে চুপচাপ দেখে যায়। প্রতিবাদ করতে পারে না শুধু অশান্তির ভয়ে। কিন্তু শ্বশুর -শাশুড়ীকে খাওয়াচ্ছে বলে সে প্রায়ই বলে, " এই মাগ্গি- গণ্ডার বাজারে একটা লোকের আয়ের ওপর নির্ভর করে এতো গুলো পেট চালানো কি সম্ভব! এই করতে করতে মরে যাবে, সুখের মুখ আর দেখতে পাবে না।" কোন বাবা মা এসব শুনে খুশি হতে পারে। শ্বশুর -শাশুড়ীর দায় নেওয়াটাই দেখলো। শ্বশুর -শাশুড়ীর বাড়িতে থাকা, তাদের শ্রম নিঙড়ে নেওয়ার কথা ভেবে দেখার দরকার নেই। কখনও কখনও শ্বশুর -শাশুড়ীকে শুনিয়ে শুনিয়ে মধুরা বলে, " ছোট বেলায় ছেলেকে সুখে রেখেছিল বলে, তাই এখন তার শোধ তুলছে।"


সে ও তার স্বামী কেউই শুয়ে বসে খায় না। কেউই দুদণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারে না। একটা না একটা কাজ লেগেই আছে। তার নিজেরই কি না কম কাজ —সকালে উঠেই বিছানা ঝাড়া তারপর চা জলখাবার তৈরি, রান্নার জোগাড় করা, নাতি নাতনীর টিফিন ভরা । ওদের মায়ের‌ শুধু  স্নান করানো, খাওয়ানো আর বই পত্তর গুছিয়ে দেওয়া কাজ । সংসারের কোন কাজই বড়ো একটা করতে হয় না, নিজেদের কাপড় জামা কাচা ছাড়া। তবুও মন পাওয়া যায় না।এর ওপর আছে এটা ওটা ফরমায়েশ।এক এক সময়ে ফরমায়েশে জের বার হয়ে  হাতের একটা কাজ ফেলে অন্যটা করতে ছুটতে হয়। স্বামী এসব দেখে মর্মাহত হতো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তিনিও খেটে খেটে কাহিল হয়ে পড়তেন। তাঁকে চোদ্দ বার‌ দোকানে পাঠাতো বৌমা।একটু বসতে দিতো না। বেচারি আর পেরে উঠতো না, হাঁপিয়ে যেতো। এই বৃদ্ধ বয়সে এতো পরিশ্রম করে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। শেষের দিকে বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। লাবণ্যময়ীও মনে মনে ভাবতেন না মরলে এ সংসার থেকে মুক্তি পাবে না।কিন্তু উনি চলে গেলে লাবণ্যময়ীর দুর্গতির শেষ থাকবে না এটাও তিনি জানেন। সন্ধ্যে দেবার সময় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন দুজনে যেন এক সঙ্গে চলে যেতে পারেন। কিন্তু তা আর হবার নয়। কর্তা চলে যেতে তাঁর কপাল আরও পুড়লো। স্ত্রীলোকের জান সহজে যেতে চায় না। তাই বহুদিন বেঁচে থেকে এইসব সহ্য করতে হচ্ছে। ভগবান তাই বুঝি স্ত্রীলোকের সহ্য শক্তি পুরুষের চেয়ে বেশি দিয়েছেন। সুধাময় এসব দেখে সহ্য করতে পারেনি বলেই তাই পৃথিবী ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে গেছে।


লাবণ্যময়ীর বাঁচার সান্ত্বনা একটাই। মেয়ে সুমনা ও জামাই সৌমিত্র আর ওদের সন্তান পাপা তাঁকে মাঝে মাঝেই দেখতে আসে।কিছু টাকা তাঁর হাতে দিয়ে যায় ফলমূল , হরলিক্স, ওষুধ ইত্যাদি কেনার জন্য। প্রথম প্রথম তারা এইসব কিনে নিয়ে আসতো।কিন্তু সে সব বৌমা তাঁদের একটুখানি দিয়ে সবই ছেলে মেয়েকে খাইয়ে দিতো । আর তাছাড়া ওনারা নাতি নাতনিকে না দিয়ে খেতে পারতেন না।যে ভাবেই হোক, ওনাদের‌ একা একা খাওয়া হতো না। বাবু বেঁচে থাকতে মেয়ে জামাই আসতো দেখতে। সুমনা 'বাবু' বলতে অজ্ঞান। সে বাবাকে খুব ভালবাসে। মেয়ে বাবার গলার হার। কেননা মেয়ে হবার পর সুধাময়ের চাকুরীতে খুব উন্নতি হয়।জামাই সৌমিত্রকে ওনারা ভাগ্য করে পেয়েছেন। সরকারি অফিসার। কোন অহংকার নেই। নেই কোন পিছুটান। বাবা মা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। তাই তো শ্বশুর -শাশুড়ীকে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছেন নিজের কাছে।কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি নিজের বাড়ি ছেড়ে জামাই বাড়ি গিয়ে থাকতে চান না। যেমন ছেলের শ্বশুর শাশুড়ি করে ঠিক এর বিপরীত। বাবুর শরীর খারাপ হয়েছে শুনলে তারা পড়ি কি মরি করে ছুটে আসতো। সে কি কান্না সুমনার—" বাবা,তোমার শরীর খারাপ, তুমি আমাদের খবর দাও নি কেন। চলো আমাদের সঙ্গে।তোমার জামাই তো কতো বার বলেছে তোমাদের নিয়ে যাবার।------ইত্যাদি ইত্যাদি।" তারা যেমন জামাই পেয়েছেন তেমন বৌমা পান নি। সৌমিত্র খুব কর্তব্যপরায়ণ। মেয়ে তাদের সুখে আছে, হাজার দুঃখে একটাই সান্ত্বনা। বাবু মা'র কষ্ট হলে সুমনা দাদাকে ছেড়ে কথা বলে না, বৌদির সঙ্গে ঝগডা হয়। ওরা চলে গেলে সমস্ত ঝাল ঝাড়ে শাশুড়ির ওপর । বলে, "মেয়ের যদি এতোই দরদ কাছে নিয়ে গিয়ে রাখুগ না।" 

লাবণ্যময়ীও উত্তরে বলেন, " ওরা তো নিয়ে যেতেই চায়। তোমার শ্বশুর থাকতে থাকতেই তো কতবার বলেছে আমাদেরকে নিয়ে যাবার জন্য। নিয়ে গেলে রাজার হালে রাখবে। আমার মেয়ে জামাই তার বাবা মা'কে কত যত্ন আত্তি করতো ।

শ্বশুর শাশুড়ির সুমনাকে ছাড়া চলতোই না। সুমনা বাবাকে যেমন ভালোবাসতো তেমনি শ্বশুরকে।আজ তাঁরা স্বর্গে গেছেন । মিথ্যে বলবো না, তাঁরা কতো ভালো মানুষ ছিলেন।

আমরাই যেতে চাই নি। ছেলে থাকতে মেয়ের বাড়ি পড়ে থাকবো কেন। যাদের ছেলে নেই তাদের জামাই বাড়ি পড়ে থাকা মানায়।"

অমনি উল্টো মানে করে মধুরা বলে, "আমার বাবা মা আসেন বলে আপনি খোঁটা দিচ্ছেন?"

—মোটেই না। তোমার বাবা মা তো আসবেনই । তাঁদের ছেলে নেই। ছেলের কাজ তো তোমাদেরই করতে হবে। আমি তো তাই বলছি—তোমার বাবা মা 'র যা মানায়, আমাদের তা মানায় না। তাই যাই না।


এখন সুমনা এলে বৌদির সঙ্গে কথা বলে না। দাদা থাকলে দাদার সঙ্গে আর ভাইপো টিপুর সঙ্গে কথা বলে।ভাইঝি টিঙ্কুকে আদর করে। ওদের জন্য মাঝে মাঝে কিছু কিনে আনে।টিপু ও টিঙ্কু পিসিকে খুব ভালোবাসে। সুমনা মায়ের হাতে টাকা দিয়ে যায় কিন্তু সে টাকা সংসারেই ঢুকে যায়। সুমনা মা 'কে বলে, " কি করবো বলো।।ফলমূল দিয়ে গেলে ঠিক মতো খেতে পাবে না। টাকা দিয়ে গেলেও কিনে খেতে পারবে না , ওদের সংসারে সব ঢুকে যাবে।

আমার কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও যাবে না। এখানে পড়ে পড়ে কষ্ট পাবে সেই ভালো।তোমার জামাই দুঃখ করে বলে, " আমি কি মায়ের ছেলে নই ,সুপ্রিয়দাই শুধু তাঁর ছেলে।


তাই সুমনা ও সৌমিত্র ঠিক করেছে মা'কে কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। তবে তিনি যেতে চাইবেন কিনা কে জানে । সেখানে থাকলে তবু মাকে তারা দেখতে পারবে।আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলতে পারলে মনটাও অনেক ভালো থাকবে। অন্ততঃ ওই নরক থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারে ততই মঙ্গল।

নইলে বাবুর মতো কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে তাদের মাকেও। এ ব্যাপারে দাদার সঙ্গে সুমনা কথা বলেছে। সে কিছু দিতে পারলে দেবে না পারলে না দেবে।খরচ যা লাগবে তারাই দেবে। এতে দাদা রাজীও হয়ে যায়। কারণ মাকে দেখার পূর্ণ দায়িত্ব তাকে নিতে হবে না।

হ্যাঁ যদি সুমনা কিছুটা ব‌্যয়ভার বহন করতো তাহলে সে মাকে যেতে দিতো না। কারণ মাকে রাখলে তার‌ লাভই হতো । একটা রান্নার লোক রাখতে পারতো।কিন্তু সুমনা তো তা দেবে না।

সাত পাঁচ ভেবে সুপ্রিয় বলে, " যা করার কর। তোরা আমায় ভুল বুঝিস্ না। আমি সংসারকে বাঁচিয়ে যখন যা পারবো দেবো। তবু মায়ের কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না। আমার কিছু করার নেই। এবার মা চলে গেলে এ সংসারের কাজ মধুরা একা সামলাতে পারবে না জানি, কাজের লোক তো আছে,এবার রান্নার লোকও রাখতে হবে। সুতরাং আমি কি আর মায়ের জন্যে বেশি কিছু করতে পারবো ?" "তুই কিছু ভাবিস্ না দাদা। আমরা তো আছি।"—সুমনা সুপ্রিয়কে আস্বস্ত করে।


এদিকে মধুরার সামনে সুপ্রিয় মাকে বলে, "মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানি, এই বয়সে তোমার এ কষ্ট করা সম্ভব নয়। কবে থেকেই তো খেটে চলেছো। দুটো ভালোমন্দ খেতেও দিতে পারি না। তার ওপর এই অশান্তি, ঝগড়া আমার সহ্য হয় না মা। তুমি চোখের জল ফেলবে তাতে কি এ সংসারের অমঙ্গল হবে না? তার চেয়ে আমি বলি কি তোমাকে এক বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি সেখানে তুমি ভালোই থাকবে।তোমার খাটা খাটুনিটাও অনেক কমে যাবে। আমি না পারি, সুমনা সৌমিত্র ওরাই তোমার দেখাশোনা করবে। আমি যখন পারি তোমায় দেখে আসবো।যার সংসার সে এবার বুঝে নিক্।

—বৌমা কি একা পারবে। দু-দুটো বাচ্চা সামলে সংসারের কাজ করতে। টিপু ও টিঙ্কু আমাকে ছাড়া একা হয়ে পড়বে।আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে?

—খুব পারবে মা। সেটাই ওকে বুঝতে দিতে হবে।মাথার ওপরে ছাতা না থাকলে কি হয়। ওকে আমি বলেছি। ও তোমাকে আপদ ভাবে। কাজে কাজেই আপদ দূর হলেই ভালো।

সুপ্রিয় মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

—তা ছাড়া তোর কষ্ট হবে না?

—হলে কি করবো বলো? আমার কষ্ট হবে বলে তোমার কষ্ট দেখে যাবো? কষ্ট হয় হবে। তুমি আমার কথা ভেবো না মা।

বলতে বলতে সুপ্রিয়র গলা ভারী হয়ে আসে। চোখের কোণায় জল চিক্ চিক্ করে। লাবণ্যময়ী বুঝতে পারেন ছেলে নিরুপায়। ওর ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিয়তি কেনো বাধ্যতা।লাবণ্যময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যান।


মধুরা এটাই চেয়েছিলো তবে এতো তাড়াতাড়ি নয়।কারণ শাশুড়ির কাছে এখনও বেশ কিছু টাকা মজুত আছে।সেটাকে হাতাতে পারলে তো অনেক আগেই মধুরা শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমের দরজা দেখিয়ে দিতো। তবুও সে বলে,"হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো।এখানে আপনার কষ্ট হচ্ছে জানি কিন্তু আমাদেরও তো কিছু করার নেই। সংসারে থাকলেই কাজ, না থাকলে নয়।

আমরা বরং দেখতে যাবো। খোঁজ খবর নেবো। আপনি ভালোই থাকবেন। টিপু, টিঙ্কু আপনাকে মাঝে মাঝে দেখতে যাবে। তবে মা পূজোর কটা দিন এখানে থেকে পূজোটা কাটিয়েই না হয় যাবেন। পূজোর কটা দিন আপনাকে ছেড়ে থাকতে আমাদেরও ভালো লাগবে না।"

মধুরার সুর নরম শোনালো লাবণ্যময়ীর কানে। কিন্তু তাতে কি। আসলে পূজোর কটা দিন মেয়ে টিঙ্কুকে সকালে দু একটা ঠাকুর দেখিয়ে আনতে আর রাত্রে ঠাকুমার কাছে রেখে ঠাকুর দেখতে বের হতে হবে তো। মা বাবা বোন আসবে। শাশুড়ির ঘাড়ে সব ফেলে দিয়ে গল্প গুজব করতে হবে এই আর কি।তোমার পায়ে গড় নয়, তোমার কাজের পায়ে গড়। আর তাছাড়া পূজোর আগে বিদায় দিলে লোকে বলবে কি। সংসারের একটা কল্যাণ অকল্যাণ আছে তো। এসব কথা মাথায় রেখেই মধুরা পূজোর পর শাশুড়িকে বিদায় দিতে চেয়েছে।


মধুরার বাবা মা বোন আবার মামাতো বোন পঞ্চমীর দিন থেকেই এসে হাজির। বাড়ি গম্ গম্ করছে। খাওয়া -দাওয়ার পালা চলছে লাবণ্যময়ীর ওপর সমস্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে। বৌমা তার বাবা, মা, দুই বোন সকলকে নিয়ে ঘরের মধ্যে চালাচ্ছে শাশুড়ির বিরুদ্ধে শলা পরামর্শ। আসলে বৌমার মা কুচক্রী মন্থরা দেবী সর্বক্ষণ মেয়ের কান ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে সংসারটাকে ভাঙতে চেষ্টা করছে। বাবাটাও ধুরন্ধর।এনারা চান জামাইয়ের মাকে সংসার থেকে সরাতে পারলেই যখন তখন আসা যাওয়া করা যাবে। আপদে বিপদে জামাইয়ের কাছে হাত পাতা যাবে।আর একটা মেয়ে আছে, তার বিয়ের দায়িত্ব জামাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যাবে। শাশুড়ি থাকলে এগুলো তো করা যাবে না। তাই শাশুড়িকে সংসার থেকে বিতাড়িত করার মন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিয় অবশ্য দোকান বাজার করতেই ব্যস্ত। একদিকে চলছে আনন্দের ফোয়ারা আর অন্য দিকে বাজছে বিষাদের বাজনা । লাবণ্যময়ী মুখ বুজে রান্নাঘর সামলাচ্ছেন। শেষ কদিন সুমনা রোজই একবার করে আসে মায়ের ওপর অত্যাচারের বহরটা দেখার জন্য। এসে দেখে মা রান্নাঘরে হিমসিম খাচ্ছে।ঘেমে নেয়ে একশা।বয়স হয়েছে এই বয়েসে এত জনের রান্নার জোগাড় করা কি সোজা ব্যাপার। অথচ যার লোক এসেছে তিনি ঘরের মধ্যে গুলতানি করছেন । সুপ্রিয় দোকান বাজার করার ফাঁকে ফাঁকে সবই লক্ষ্য করছে। শ্বশুর শাশুড়ি শালীদের সামনে অশান্তি করতে হবে বলে কিছু বলতে পারছে না, আবার মাকে দেখেও কষ্ট হচ্ছে খুব। সুমনা দাদা সুপ্রিয়র দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের হাত ধরে টেনে বের এনে বললো, " দাদা, এসব হচ্ছেটা কি? এই মানুষটার‌ একার ভরসায় কি এনাদের এনেছিস্ ? মানুষটাকে তো বাড়ি থেকে তাড়াচ্ছিস্ , শেষ সময়েও তাকে রেহাই দিবি না? এজন্য বুঝি পূজো পর্যন্ত মাকে আটকে রেখেছিস্ ?


সুপ্রিয় এবার চুপ করে থাকেনি। ও ইশারা করে মধুরাকে ডাকলো। মধুরা হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, " কি হয়েছে কি ?"

— এই এতোগুলো লোকের রান্না একা মায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তুমি ঘরে বসে গল্প করছো। মা একা খাবে , আর কেউ খাবে না? ওরা তো অতিথি , তুমিও কি তাই ?

সুপ্রিয়র কথাগুলো শুনে মধুরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, তারপর সুমনার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, " ও বুঝতে পেরেছি, দরদের লোক এসে গেছে। তা অতই যদি দরদ তবে হাত লাগালেই তো পারো।"

কথাটা শুনে সুপ্রিয় আর ঠিক থাকতে পারলো না , বললো, " ও কেন করবে? ও কি খেতে এসেছে ? ও এসেছে মাকে দেখতে। যারা খেতে এসেছে, তারা তো হাত লাগালে পারে। "

সুপ্রিয় ওদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলতে চায় নি ।মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এটা বলা অবশ্যই ঠিক নয়। কারণ ওরা অতিথি, রান্না করে খাবে কেন ? সুপ্রিয় আসলে মধুরার কথা বলতে চেয়েছে ।

যেই না বলা, মধুরা ধেই ধেই করে নেচে উঠলো ।—" আমার মা, বাবা, বোনেদের খাবারের খোঁটা দিলে ? "

গণ্ডগোল শুনে মধুরার বাবা মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। " কি হয়েছে কি? এতো হৈ চৈ কিসের?"—মধুরার বাবা জানতে চাইলেন।

" বাবা,আপনি বলুন তো, এই বুড়ো মানুষটার ঘাড়ে এতসব চাপিয়ে ঘরে বসে গল্প করাটা কি ঠিক? তোমার ঘরে লোক এসেছে আর তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছো।"—সুপ্রিয় শ্বশুরের কাছে অভিযোগ করে।

মনের কথা মনে রেখে মধুরার বাবা বলে উঠলেন, " ঠিকই তো,বেয়ান কি বুড়ো বয়সে একা সব ঝামেলা সামলাতে পারেন। না না মধু,তুই শাশুড়ির একার ওপর ছেড়ে দিয়ে ঠিক করিস্ নি। শাশুড়ি আজ বাদে কাল চলে যাবেন, ওঁকে এ কটা দিন নাই বা খাটালি।দরকার হলে তুই মা বোনকে ডেকে নে।সবাই মিলে হাতে হাতে করে নিলেই তো হয়।"

কথাটা মন্দ বলেন নি মধুরার বাবা। মনে তার যাই থাক । মধুরা আর কথা না বাড়িয়ে গজ গজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়ে শাশুড়িকে বললো,

"যান মা যান। গিয়ে আমায় রেহাই দিন। আমি একাই করে নিচ্ছি। "


দশমীর দিন সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। মুখ ভার বাড়ির সকলের।এ বছর পূজোটা ভালো কাটলো না বাড়ির কারোরই ।লাবণ্যময়ীর তো নয়ই। পূজোর কটা দিন তিনি প্রতিমার মুখ দর্শন পর্যন্ত করেন নি। টিপু ও টিঙ্কুও ঠাকুর দেখতে যাবার জন্য বায়না পর্যন্ত করে নি। পরিবেশ পরিস্থিতি যেন ওই বাচ্চা দুটোও বুঝে ফেলেছে। আসলে ওরা তো ঠাকুমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বের হয়। ওদের যা কিছু সব ঠাকুমা। টিপু টিঙ্কু ঠাকুমার কাছে শোয়। ঠাকুমা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে ,গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যে দিন থেকে কথা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে যাবার,সে দিন থেকে ওরা লক্ষ্য করছে ঠাকুমা যেন কি রকম গম্ভীর হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছে চলেছে। টিপু ও টিঙ্কু ওদের ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে, " ঠাকুমা,তোমার কি হয়েছে ?"

—কিছু না তো দাদু।

—কিছু না বললেই হবে। ওরা সব কি বলাবলি করছে, তুমি কোথায় চলে যাবে।

—কোথায় আর যাবো দাদু । যাবার আর কোন চুলোয় জায়গা আছে। যাবার তো একটাই জায়গা আছে। ভগবান আর দয়া করছেন কোথায়। সেখানেই যেতে পারলে বাঁচি।

টিপু ছোট হলে কি হবে, ঠাকুমার কথা শুনে শুনে বুঝে গেছে ঠাকুমা মরার কথা বলছে। তাই ও বলে, " ঠাকুমা, তুমি মরার কথা বলবে না তো। তুমি মরলে আমায় সঙ্গে নিয়ে যাবে।  তোমায় ছাড়া আমি এখানে থাকবো না।" লাবণ্যময়ী সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, "বালাই সাট! ও কথা তুমি মুখেও আনবে না। আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করবো।"

তাঁর অবর্তমানে এই ছেলে মেয়ে দুটোর কি অবস্থা হবে তিনি ভেবে পারছেন না।জন্ম থেকেই ঠাকুমার কাছে মানুষ।তাঁকে কি সহজে ওরা যেতে দেবে? তিনি আর ভেবে পারছেন না।একে তো এক ফাঁসির আসামীর মতো রুদ্ধশ্বাস প্রহর গুনতে গুনতে তাঁর দিন কাটছে। চূড়ান্ত সময়ের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন।


আগে থেকেই ঠিক ছিল সুমনা বিজয়ার দিন মাকে তার বাড়ি টালা পার্কে নিয়ে যাবে।সেখান থেকে তার পর দিন অর্থাৎ একাদশীর দিন সুমনা সৌমিত্র মাকে নিয়ে সোজা চলে যাবে লেক টাউনের এক বৃদ্ধাশ্রমে।এখান থেকে পুত্র কন্যা সহ সুপ্রিয় ও মধুরা সোজা চলে যাবে ওখানে। সেই মতো বিজয়ার পর্ব চলাকালীন সময়ে সৌমিত্র তার গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলো। লাবণ্যময়ী প্রস্তুত হয়ে গেলেন সুমনার দেওয়া একটা নতুন শাড়ি পরে।এবার বিদায়ের পালা।আগের দিন সুমনা মাকে তার বাড়ি নিয়ে যাবার কারণ, লাবণ্যময়ী কোনদিন মেয়ের বাড়ি যান নি।অর যাওয়া হবে কি না এই ভেবে। এসময় নাতি বায়না ধরলো, " ঠাম্মা তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি তোমার সঙ্গে যাবো ।

—না দাদু, তুমি কোথায় যাবে মা বাবাকে ছেড়ে ?

—তুমি যে যাচ্ছ।

 —আমি জানি না বাবা আমি কেন যাচ্ছি। হয়তো আমায় যেতে হবে বলেই যাচ্ছি।

লাবণ্যময়ীর চাপা দুঃখ যেন নাতির স্পর্শে বেরিয়ে আসতে চাইলো। অশ্রুপূর্ণ নয়নে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকেন, "দুষ্টুমি করোনা। সাবধানে থেকো , কেমন? বাবা মার কথা শুনবে। বোনকে দেখবে।"

টিপু বালক হলে কি হবে।পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে যেন অনেকটাই সাবালোক করে তুলেছে। সে বুঝতে পারে তার বড়ো কাছের মানুষ ঠাম্মা তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দুরে কোথাও। ঠাম্মাকে মা একেবারে দেখতে পারে না। শুধু ঝগড়া করে। বাবা যেন মাকে ভয় পায়।তাই কিছু বলে না। তার মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হয়।ঠাম্মা কতো শান্ত, কতো গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

— তাহলে কে আমায় গল্প শোনাবে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে,চান করিয়ে দেবে?

টিপু হাতের চেটোর ওপর আঙুল ঘষতে ঘষতে খইনি পেশার মতো করে কথা গুলো বলতে থাকে। অর্থ হলো বড়োরা কেউ কিছু করতে পারছে না। ও নিজে বড়ো হলে দেখে নিতো। এখানে তার অসহায়ত্ব ফুটে।

লাবণ্যময়ীর গলা বুজে আসে।নাতির মুখের দিকে তাকাতে পারে না।ধরা গলায় বলেন , " কেন মা আছে তো,না হলে তুমি বড়ো হচ্ছ,একা একা করার চেষ্টা করবে। এবার থেকে সব শিখতে হবে।কখনও করোর ওপর নির্ভর করবে না দাদুভাই, বুঝলে।"

টিপু মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ে। ঠাকুমা নাতির মুখটা তুলে ধরেন,দেখেন টিপুর চোখ স্বজন হারানোর ব্যথায় জলে ভরে উঠেছে। এ কান্না একটা শিশুর বায়না নয়, এ এক গভীর জীবন বোধের কান্না, হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে বেরিয়ে আসা কান্না,তাই তো ও মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছে, যেমন তার বাবা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, ঠাম্মির কাছে আসছে না, সে কি না কেঁদে। বাবাও হয়তো কাঁদছে তার মতো । সে এক ছুটে ঘরে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ওর মনে হয় ও যদি বাবার মতো বড়ো হতো, কিছুতেই ঠাম্মিকে যেতে দিতো না , সে ছোট,তাই তার কিছুই করার নেই। কিন্তু ও তো জানে না, বড়ো হলে ও বাবার মতোই হয়ে যাবে পরিস্থিতির শিকার হয়ে।

"আসুন মা"—বলে সৌমিত্র লাবণ্যময়ীর জিনিষ পত্র গাড়িতে রাখতে গেলো। বাড়ির মধ‌্যে   মৃত্যুর ভয়ঙ্কর  হিমেল হাওয়ায় মতো এক ধরনের আবহাওয়া যেন বিরাজ করতে লাগলো। কারও মুখে কোন কথা নেই।সকলেই সকলের মুখের দিকে চেয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। এমন সময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সৌমিত্র ডাকলো,  "সুপ্রিয়দা, কোথায় গেলে ? এসো। আর দেরি করা যাবে না। বিসর্জনের প্রশেসন বেরিয়ে পড়বে।

চোখ মুছতে মুছতে সুপ্রিয় বেরিয়ে এলো অন্ধকার থেকে। কদিন ধরে চেষ্টা করেও যা করতে পারেনি, আজ মায়ের বিদায় লগ্নের চরম মুহুর্তে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে সুপ্রিয় কান্নায় ভেঙে পড়লো।আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলো , " মাগো, তুমি আমার সকল দুঃখের ভাগিদার ছিলে। আমার প্রতিমাকে আমি আজ বিসর্জন করে দিচ্ছি, সে যে আমার কি দুঃখ! সে দুঃখের বিশেষ অংশীদার আজ আর আমার কেউ রইলো না মা! আমি এমনটি চাইনি।আমায় তুমি ভুল বুঝো না।তোমার এই অধম সন্তানকে ক্ষমা করে দিও।স্বর্গ থেকে বাবাও আমার প্রতি বীতরাগ হবেন।"


লাবণ্যময়ীরও  এ সময় কথা বলার মতো অবস্থা ছিলো না। তবুও ছেলেকে আশ্বস্ত করতে থাকেন —" চূপ কর বাবা, শান্ত হ , তোর কোন দোষ নেই। এ আমার কপাল ! কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। কপাল ভালো থাকলে তোর বাবার আগেই চলে যেতাম। ভালো থাকিস্। বৌমা ও ছেলে মেয়েকে দেখিস্ । টিপুকে একটু চোখে চোখে রাখিস্।একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখিস্। ওদের  একা কোথাও ছেড়ে দিবি না। মাঝে মাঝে আমার কাছে নিয়ে যাস্।আমায় ছেড়ে থাকতে ওদের প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে।"

বলতে বলতে লাবণ্যময়ীর গলা বুজে এলো।

এ সময় মধুরা মাথা নিচু করে চোখের জল মুছতে মুছতে শাশুড়ির পা দুটো ধরে বলে, " মা আমার যদি কোন দোষ ত্রুটি থাকে তো ক্ষমা করে দেবেন। আমি চাইনি আপনি আপনার সংসার ছেড়ে চলে যান। "

—না বৌমা তোমার কোন দোষ নেই। বলছি না এ আমার কপাল । যাক গে, ভালোভাবে থেকো। টিপু টিঙ্কুর দিকে নজর রেখো। আমি আসি।"— বলে লাবণ্যময়ী এগিয়ে চললেন। পিছন পিছন সুপ্রিয়, মধুরা, টিপু ও টিঙ্কু গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এলো। সুমনা মাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চললো এ বাড়ির পাট চুকিয়ে। লাবণ্যময়ী তাদের তৈরি বাড়ি ও আত্মজের দিকে শেষবারের মতো উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন। টিপু টিঙ্কু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাত নাড়লো তাদের ঠাম্মির দিকে। বাক্ রূদ্ধ হয়ে লাবণ্যময়ীও হাত নাড়লেন। গাড়ি ছেড়ে দিল।


পরের দিন সুমনা সৌমিত্র মাকে নিয়ে বিকেলে হাজির হলো বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের নতুন ঠিকানায়। সুপ্রিয়, মধুরা টিপু, টিঙ্কুকে সঙ্গে নিয়ে আগেই এসে অপেক্ষা করছিলো। তারপর তারা সবাই বৃদ্ধাশ্রমের অফিস ঘরে এসে বসলো। বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালিকা অনামিকা খাসনবীশ, তাঁর করণীয় যা যা করার তা করে একজন সেবিকার নাম ধরে ডেকে লাবণ্যময়ীর জিনিষ পত্র দোতলার ৫ নম্বর ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে বললেন। তারপর সৌমিত্রকে সই সাবুদ যা করার করে টাকা পয়সা মিটিয়ে দিতে বললেন।

অনামিকা দেবী এক এক করে সবার সাথে পরিচিত হলেন। বেশ কিছু বৃদ্ধাকে অনামিকা দেবী লাবণ্যময়ীকে দেখিয়ে বললেন, " আপনাদের নতুন সাথী। নিয়ে যান এনাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন।"

আর লাবণ্যময়ীকে বললেন , 

" আপনি যান এনাদের সঙ্গে। "

লাবণ্যময়ীকে দেখে বৃদ্ধাশ্রমের সকল বৃদ্ধা আবাসিক একসঙ্গে বলে উঠলেন," আসুন দিদি, বসুন। কোথা থেকে আসছেন দিদি? এরা সব কারা?" ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করে লাবণ্যময়ীর কথা মন দিয়ে শুনে তাঁর ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলেন ।লাবণ্যময়ী কিন্তু একবারের জন্যেও বৌমার নিন্দে করেন নি। তবে এনারা অনেক অভিজ্ঞ যা বোঝবার বুঝেছেন নিশ্চয়ই । গৃহ অশান্তি না হলে কেউ বৃদ্ধাশ্রমে আসে। কারণ যাই থাক,সে নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নেই।তবু তো কিছু একটা বলতে হবে।কেউ বললেন, "আমরা সকলে একই পথের পথিক।" আবার কেউ বললেন, "আমাদের সকলের ভাগ্য এক সূত্রে বাঁধা।যতো দেখবো শুনবো হা হুতাশ ছাড়া আর কিছু করার নেই। আপনি চিন্তা করবেন না, আমাদের ভালোই কেটে যাবে এখানে। এটা একটা শান্তির নীড়। আপনার যেতেই ইচ্ছা করবে না এখান থেকে।


এবার সকলের বিদায় নেবার পালা। মেয়ে সুমনা উপস্থিত বৃদ্ধাদের 'মাসিমা' সম্বোধন করে বললো, " একটু দেখবেন মাকে।এখন আপনারাই ভরসা।"

বৃদ্ধারা সকলেই সুমনাকে আস্বস্ত করলেন এই বলে —" না না কিছু চিন্তা করো না। আমরা আছি তো।এখন থেকে উনিও তো আমাদেরই একজন। আমরা সকলেই পরষ্পরের ভরসা।এসে দেখো, তোমার মা খুবই ভালো আছেন।"

ইত্যবসরে বলে রাখি বৃদ্ধাশ্রমের সকলে লাবণ্যময়ীর সংসারের সকলের সঙ্গে পরিচিত হবার সময় লাবণ্যময়ীর বৌমার দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিচ্ছিলেন। কারণ তার হাবেভাবে কিছু আভাষ পাওয়া যায় কিনা বৃদ্ধাশ্রমে শাশুড়িকে পাঠানোর ব্যাপারে।ঘরের বধূ ভালো হলে, শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে সেই আগেভাগে বাধা দেবে। সে যাই হোক, সন্ধ্যা সমাগত।সবার বাড়ি ফেরার সময় এগিয়ে এলো।লাবণ্যময়ী সকলকে এগিয়ে দিতে এলেন বৃদ্ধাশ্রমের গেট অবধি। বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধাদের সকলের চোখে মুখে এক অসহায় অবস্থার অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখে ও লাবণ্যময়ীর প্রতি তাঁদের যে সহমর্মিতা ও তাঁকে আপন করে নেবার  ঐকান্তিক প্রয়াস প্রত্যক্ষ করে মধুরা তার মনের আয়নায় তার জীবনেও অনাগত বার্ধক্যের অসহায়ত্বের এক ছবি দেখতে পেলো । একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলো তার অনুভূতিতে।তার মনে হলো —এদের মতো বয়স তার জীবনেও আসবে একদিন।তখন হয়তো এভাবেই আসতে হবে তাকে এইসব অচেনা মানুষগুলোকে আপন করে নিতে। সে শিউরে ওঠে। আসলে ভালো মন্দ সব মানুষেরই একটা সুমন থাকে। সেই সুমন যতক্ষণ না জেগে ওঠে ,ততক্ষণ কেউ কেউ নিজেকে চিনতে পারে না, আর পাল্টাতেও পারে না। মধুরারও সেই দশা। তাছাড়া শাশুড়ির অবর্তমানে তার যে কি অবস্থা হবে,সে কথা চিন্তা করে সে হঠাৎই কাঁদতে কাঁদতে তার স্বামী সুপ্রিয়কে মাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। সুপ্রিয় বুঝতে পারে তার স্ত্রীর মনের আকাশ থেকে হিংসার কালো মেঘ কেটে গেছে। সে শাশুড়িকে মা বলে চিনতে পেরেছে। কিন্তু কিছু করার নেই —স্বার্থপর জগৎ । মধুরা শাশুড়ির পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকে—

" মা, আমি কি সুমনার মতো আপনার মেয়ে নই । মেয়ে যদি ভুল করে, তার কি ক্ষমা নেই?"

—না ‌বৌমা, তুমিও আমার মেয়ের মতোই। তোমার কোন দোষ নেই।এ আমার কপালের দোষ। তুমি বাড়ি যাও মা। তোমাদের জন্য আমার ক্ষমা সবসময় আছে। আমার কাল যেমন করে হোক কেটে যাবে।


বিদায়ের চূড়ান্ত পর্বে লাবণ্যময়ী যেন কিছু আশার আলো দেখতে পেলেন। অন্ততঃ এই ভেবে যে তিনি তাদের সুখের সংসারে অশান্তির বীজ বপন করে আসেন নি বরং আত্মশুদ্ধি ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু যে জীবন নির্দিষ্ট হয়ে গেছে,তা আর ইচ্ছে করলেই বদলানো যাবে না। কারণ, জীবন আবেগে গা ভাসানোর নয়। জীবনটা একটা কঠোর বাস্তব। আবার যে কোন দিন অশান্তির কালো ধোঁয়ায় সবাই সবাইকে হারিয়ে ফেলতে পারে।

সুমনা, সৌমিত্র, সুপ্রিয়, মধুরা, টিপু, টিঙ্কু ও পাপা সদল বলে গেট থেকে বেরিয়ে সামনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে লাবণ্যময়ীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতে থাকে ।লাবণ্যময়ী বৃদ্ধাশ্রমের গ্রীল ধরে স্বজনদের বিদায় জানাচ্ছেন হাত নেড়ে। তাঁর চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে আসে। আস্তে আস্তে তাঁর এতোদিনের চেনা মুখগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। আর পিছনে পড়ে থাকে একরাশ হতাশা।

লাবণ্যময়ী ফিরে এলেন বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর নিজের ঘরে। তাঁর মন মেজাজ কিছুই ভালো নেই। অন্যান্যরা টিভি দেখে সময় কাটিয়ে দেয়। সবার অনুমতি নিয়ে লাবণ্যময়ী তাঁর বিছানায় শুয়ে পড়লেন। রাতে খাবার সময় ডাকলে তিনি জানান যে তাঁর শরীর ভালো নেই,তাই কিছু খাবেন না। ঘুম ধরে না। শুয়ে শুয়ে বাড়ির কথা ভাবতে থাকেন। এখন কিছুদিন এরূপ চলতে থাকবে।অনেকের আবার বিছানা বদল হলে ঘুম আসতে চায় না। তাঁর এমন কিছু ব্যাপার নেই। সারাদিন খাটাখাটুনি করে শুলে ঘুম ধরে যেতো। তবে কিছুদিন তো লাগবে নতুন জায়গায় মন বসাতে।কিন্তু বেশ কদিন কেটে গেলো তাঁর খাওয়া দাওয়া ঘুম সব‌ মাথায় উঠেছে । খাবারে রুচি নেই। দুপুরের দিকে চোখটা জুড়ে আসে কিন্তু পরক্ষণেই ঘুম কেটে যায়। অহরাত্র টিপু, টিঙ্কু, সুপ্রিয়র কথা মনে পড়ে। তারা কি কষ্টেই না আছে। মধুরার কাজ বেড়েছে। কি জানি ছেলে মেয়েদের ঠিক দেখতে পারছে কি না। টিপুটা কেমন আছে কে জানে। ওরা হয়তো কেউই ভালো নেই।এইসব ভাবনা চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে সর্বক্ষণ। লাবণ্যময়ী কারও সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেন না। আর ওনারাও লাবণ্যময়ীকে নিজের মতো থাকতে ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চাতে ওনাকে নিয়ে সমালোচনা করেন নিশ্চয়ই।সামনা সামনি হেসে দু একটা কথা বলে ছেড়ে দেন। মনে মনে সকলে ভাবেন, থাকতে থাকতে ওসব ঠিক হয়ে যাবে। সুমনা রোজই ছেলে পাপাকে পড়াতে দিয়ে মাকে দেখতে আসে। কিছুক্ষণ থাকে।তারপর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। পাপার বয়স এই বছর পনেরো। দশ ক্লাসে পড়ে। সৌমিত্র রোজ আসতে পারে না। রবিবারে সপরিবারে শাশুড়িকে দেখতে যায়। কিছু লাগলে কিনে দিয়ে আসে।


এদিকে টিপু ভয়ানক মন মরা হয়ে পড়েছে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করে না। লেখাপড়ায়ও ভীষণ অমনোযোগী হয়ে গেছে। স্কুল থেকে প্রায়ই রিপোর্ট আসছে। কান্নাকাটি করে।কথা না শুনলে মার খায়।এ নিয়ে স্বামী স্ত্রী মধ্যে বচসা চলে। দিদা দাদু এলে ওদের অশান্তির চোটে আর থাকতে পারে না। ওরা যা ভেবে ছিলো তা হয়নি। ভেবেছিলো শাশুড়িকে সরাতে পারলে সংসারে এসে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।জামাইকে শোষণ করবে ছোট মেয়েটার বিয়ের জন্য। যাহোক, টিপুর প্রসঙ্গে আসা যাক। ছেলেটার যেন বাঁচার ইচ্ছাই চলে গেছে। একদিন ধূম জ্বর। জ্বরের ঘোরে ঠাকুমার কথা বলে। বলে তাকে নিয়ে যেতে। সে আর এ বাড়িতে থাকতে চায় না। ঠাম্মি ছাড়া এ বাড়িটা তার কাছে ভূতের বাড়ি মনে হয়। সুমনা জ্বর হয়েছে শুনে দেখতে আসে। বেশ কিছুদিন হলো জ্বর ছাড়ছে না। সুমনা দাদার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলে , " জানিস দাদা, আমার মনে হয় টেনশনে হচ্ছে ঠাকুমাকে না পাওয়ায় জন্য।চেহারাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার কি বলছে? না পারলে অন্য ডাক্তার দেখা।"

— তুই ঠিকই বলেছিস্, ওই টেনশনেই হয়েছে।এখন ঠাকুমাকে পেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মাকে তো শোনানো যাবে না।

—না না,একেবারই না। এমনিতেই মা টেনশন করছে।


লাবণ্যময়ীর অবস্থা তথৈবচ। না খেয়ে না ঘুমিয়ে চেহারাটা অর্ধেক হয়ে গেছে।শরীর ভীষণ খারাপ। নতুন জায়গায় গেছে, ঠিক মতো শ্যুট করছে না। একটা করে ঘুমের ওষুধে কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার দুটো করে দিতে সাহস পাচ্ছে না। একদিন ভোররাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখছেন—স্বামী সুধাময় সামনে এসে দাড়িয়েছেন,বলছেন, " তোমাকে ওরা তাড়িয়েই ছাড়লো। তোমার শবীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। টিপু খুব ভালো নেই। তোমাকে কাছে না পেয়ে ও খুব ভেঙে পড়েছে। ও আর বাঁচবে না।" তারপর ঘুমটা ভেঙে যায়।

তখন ভোর চারটে হবে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। দুর্বল লাবণ্যময়ী ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে যেতে গিয়ে অন্ধকারে পড়ে দেওয়ালে খুব জোরে মাথা ঠুকে যায় । সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেগে ওঠে।লাবণ্যময়ী জ্ঞান হারান। কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। হাসপাতালে ভর্তি করে সৌমিত্রকে তাড়াতাড়ি যেতে বলা হয়। সৌমিত্র যখন পৌঁছায় লাবণ্যময়ী তখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তখন ঘড়িতে ৫ টা বেজে ১৫ মিনিট।

এদিকে টিপুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে ওঠে। সেই দিনই ডাক্তার টিপকে হসপিটালাইজড করার কথা বলেন।কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।জ্বরের ঘোরে টিপু বলতে থাকে, " ঠাম্মি, তুমি এসেছো আমায় নিয়ে যেতে। দাঁড়াও আমি আসছি।"—বলতে বলতে চোখ ওপরের দিকে করে জাগ্রত অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচটা। ঠিক সেই সময় সৌমিত্রর ফোন আসে—"সুপ্রিয়দা, মা মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে। তুমি তাড়াতাড়ি আর জি করে চলে এসো।

—কি বলছো কি? কখন মারা গেছে? কেন?

—কেন ঠিক এখনও জানা যায়নি। তবে ৫ টা১৫ মিনিট হবে মারা গেছেন।

—এখানে টিপুও নেই। ৫ টা৩০মিনিটে সব শেষ।সকাল হলেই হাসপাতালে ভর্তি করার কথা ছিল। মারা যাবার সময় ও জ্বরের ঘোরে বলেছিল," ঠাম্মি তুমি এসেছো আমায় নিয়ে যেতে। দাঁড়াও আমি আসছি।" বলেই চোখ চেয়েই মারা যায়। ঠাকুমাই মরে গিয়ে তার স্নেহের ধন টিপুকে তার কাছে ডেকে নিয়েছে। মায়ের ছেলেকে মার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়ে নিজের ছেলেকে চিরতরে আলাদা করে দিলো। আমি সেদিন পারিনি মধুরার অত্যাচারকে দমন করতে। যদি পারতাম তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না।



অনুপ্রেরণা - সুভাষ সিংহ || Onupreona - Subhash Singha || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 অনুপ্রেরণা 

    সুভাষ সিংহ 


গোটা মাঠ উপছে পড়ছে, চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা। আজ ফাইনাল খেলা, ফুটবলের মহাযজ্ঞে আজো গঞ্জ গ্রামে আগের মতো উন্মাদনা লক্ষ্য করা না গেলেও নিয়ামতপুরের এই প্রতিযোগিতায় এখনো আলাদা একটা ফ্লেবার কাজ করে। আশেপাশের দশটি গ্রামের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস প্রতিযোগিতা। যারা বিজয়ী হয় তারা নগদ একলক্ষ টাকা আর সুদৃশ্য ট্রফি লাভ করে। আর তার সাথে পেয়ে যায় দশটি গ্রামের সম্মিলিত দূর্গোৎসবের দায়িত্ব। যারা ফাইনালে জেতে তাদের গ্রামেই হবে পুজোর সমস্ত আয়োজন।


এবার প্রথম থেকেই বনপুকুর একাদশ দূর্দান্ত ফুটবল খেলে সবার নজর কেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বনপুকুরের সমস্ত গ্রামবাসী জড়ো হয়েছে মাঠে। অপরদিকে অনেকটা ভাগ্যের সহায় হয়ে একক নৈপুণ্যে ভর করে ফাইনালে উঠেছে ডালিমপুর একাদশ। ডালিম পুরের নয় নম্বর সম্রাট এখন পর্যন্ত এই খেলায় একায় পাঁচটি গোল করে টপ পজিশনে আছে।


এই সম্রাটের গতকাল থেকে কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ডালিমপুরের কোচ বারবার ঘড়ি দেখছেন যদি শেষ মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়, তায় প্লেয়িং একাদশে তার নামটা রেখে দিয়েছেন। রেফারি মাঠে নেমে পড়েছেন, চিৎকারে কান পাতা দায়। 


কোন উপায় না দেখে অন্তিম সময়ে পরিবর্ত নাম পাঠাতে বাধ্য হলেন কোচ। খেলা শুরু হয়েছে,

বলের পজেশনে এগিয়ে রয়েছে বনপুকুর। দুটি সুযোগ ইতিমধ্যে হাতছাড়া হলেও একুশ মিনিটে লং শটে প্রথম গোলটি করলো বনপুকুর। 

বারবার আক্রমণে নাজেহাল অবস্থা ডালিমপুরের। সব চেষ্টা বিফল করে হাফ টাইমের ঠিক আগে আরো একটি গোল খেয়ে গেল ডালিমপুর। বনপুকুরের সাপোর্টারদের যত চিৎকার বাড়ছে ততই মিইয়ে যাচ্ছে ডালিমপুর।


অন্যদিকে নিয়ামতপুরের মাঠের পেছনে দিঘির পাড়ে বসে আছে সম্রাট। ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে বনপুকুরের মেয়ে অনন্যা, যাকে প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসে সম্রাট। তার গ্রাম হেরে যাওয়া মানে তার ভালোবাসার হার হবে এমনটাই বুঝিয়েছিল তার প্রানের বন্ধু বনপুকুরের অয়ন।

অনন্যা সত্যিটা জানতে পেরে ছুটে এসেছে।


--তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে অয়ন। তোমার হার মানে আমার হার, আমি তা চায়না, তাছাড়া আমি হেরোদের পছন্দ করিনা। তুমি যদি এখনই না যাও তবে সব সম্পর্ক শেষ।


হাফ টাইমের পর খেলা আবার শুরু হয়েছে, সম্রাট ফিরে এসেছে, ওকে দেখেই ডালিমপুরের খেলোয়াড় থেকে সমর্থকরা আশায় বুক বেঁধেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত সকলে হাঁ হয়ে দেখলো একটা আহত বাঘ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। পঞ্চান্ন মিনিটে কর্নার থেকে দুরন্ত শট চকিতে বাঁক নিয়ে গোলে ঢুকে গেল। গোওওওল। আবার সেই চিৎকার ফিরে এলো বাহাত্তর মিনিটে যখন দুর্দান্ত ব্যাকভলিতে বলটা বনপুকুরের জালে ঢুকে গেল।


এই চিৎকার অনন্যার কানেও পৌঁছলে ও ঠিক করলো ওর প্রিয় মানুষের জয় দেখতে ও নিজেও মাঠে উপস্থিত হবে।

খেলা প্রায় শেষের দিকে, ২-২ অবস্থায় হয়তো ট্রাইব্রেকারে খেলা গড়াতে পারে এমন সময় পাঁচজন কে কাটিয়ে যে দৃষ্টিনন্দন গোলটা করেই সম্রাট ফ্লাইং কিস টা ছুঁড়ে দিল তার প্রেয়সীর দিকে, সমবেত জনতা চিৎকার করতে ভুলে গিয়ে সেই কিসের অনুসরণ করে খুঁজে পেল সব রহস্য।

এতলোকের দৃষ্টির সামনে লজ্জায় পালিয়ে এলো অনন্যা, ওর আর দেখা হলোনা ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরস্কার হাতে সম্রাটের হাসিটা।

ভীরু ভালোবাসা - দীনেশ সরকার || Viru Valobasha - Dinesh sarkar || Anugolpo || অনুগল্প || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 ভীরু ভালোবাসা

                                                                                      দীনেশ সরকার  



 

  বীথি এত দেরি করছে কেন? অশোক পথের দিকে চেয়ে উস্খুস্‌ করতে লাগল। বীথিকে যে কথাটা এতদিনেও বলতে পারে নি এই গঙ্গার তীরে বসে গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে সেই কথাটা আজ বীথিকে বলবেই বলবে। মাস তিনেক আগে এক বন্ধুর বিয়েতে বাসরঘরে বীথির সাথে প্রথম আলাপ। বন্ধুর বউভাতের অনুষ্ঠানে আরও একটু ঘনিষ্ঠতা, মোবাইল নাম্বারের আদান প্রদান। কলকাতা বইমেলায় একবেলা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি, কত কথা, কত গল্প। তারপর রবিবার হলেই চুম্বকের মতো টানে এই গঙ্গার ঘাট। বীথিও আসে, বসে, গল্প হয় কিন্তু যে কথাটা মনের মধ্যে ছট্‌ফট্‌ করে মরছে সে কথাটা অশোকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে না। এখন সারা সপ্তাহে অফিসের কাজের মধ্যেও বীথির মুখটা অশোকের মনের অলিন্দে ঘুরপাক খায়। বীথির মনের আরও কাছে পৌঁছুতে চায়, বীথির পাশে থাকতে চায় অশোক। বীথির জন্য অশোকের মনের ভিতরে কেমন একটা অনুভূতি হয়। অশোক জানে না একে ভালোবাসা বলে কিনা। কিন্তু কিছু একটা তো বটে। তাই অশোক আজ ঠিকই করেছে, যে কথাটা মনের গোপন কুঠুরিতে ছট্‌ফট্‌ করছে তাকে আজ বীথির সামনে প্রকাশ করবেই করবে।


           হন্তদন্ত হয়ে বীথি এল, বলল, ’ও, তুমি এসে গেছো।‘


           অশোক বলল, ‘বোসো বীথি, আজ আমার অনেক কথা বলার আছে।‘


            বীথি বলল, ‘আজ যে আমার একেবারেই বসার সময় নেই অশোক। আজ আমাকে আরও চার-পাঁচ বন্ধুর বাড়ি যেতে হবে। পরে শুনব, কেমন? এই নাও।‘


           বীথি অশোকের দিকে একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল।   


           অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি?’


          বীথি বলল, ‘আমার বিয়ের কার্ড। আগামী রবিবার বিয়ে। মা-বাবার পছন্দ করা পাত্র। হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের পর সোজা অ্যামেরিকা। বিয়েতে তুমি আসবে কিন্তু। ইনভাইট করতে আরও চার-পাঁচ বন্ধুর বাডি যেতে হবে। এখন চলি?‘


            বীথি দু-পা এগিয়ে পিছন ফিরে অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল,’ইডিয়েট।‘ তারপর পা চালাল।


           অশোক বীথির চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বড় ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। মনে মনে বলল, ’ভালো থেকো বীথি, সুখে থেকো।‘ বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল।   

ভেজা বৃষ্টি - অমিত কুমার সাহা || veja brishti - Amit Kumar Saha || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

       ভেজা বৃষ্টি

    অমিত কুমার সাহা


সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরধারায়।এখন একটু সকাল সকালই ঋতভাস বেরিয়ে যায়, অফিসের জন্য।স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে যেতে হয়।

অন্যসময় এর দুটো ট্রেন পরে গেলেও চলে। সেজন্য বেশ ভোর থেকেই বিদীপ্তার তাড়াহুড়ো।

ঋতভাসের সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে হাতের কাছে দেওয়া, টিফিন তৈরি এইসব। ও অফিস চলে গেলে সারাটাদিন বিদীপ্তা একা।


আর পাঁচটা ফ্ল্যাটের মতো ওদের ফ্ল্যাটেও একটা ব‍্যলকনি আছে। ওটাই বিদীপ্তার খোলা মাঠ, ওটাই ওর সাধের বাগানের জায়গা।বেশ কয়েকটা গাছও লাগিয়েছে ওখানে। ছোটোবেলা থেকেই বৃষ্টি খুব ভালো লাগে বিদীপ্তার। ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। তবে এই শহরে এসে সেসবের পাট চুকেছে ওর।আর তাছাড়া ঋতভাস একটু

অন্যরকম,এসব রোমান্টিসিজমের ত্রিসীমানার

বাইরে।


সারাটাদিন সাংসারিক কাজকর্মে কেটে যায় বিদীপ্তার। বিকেলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে একমনে। হঠাৎ দমকা শ্রাবণের হাওয়া এসে লাগে ওর চোখে মুখে, সাথে উড়ো বৃষ্টি।আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ও।ছুটে চলে যায় ব‍্যলকনিতে। ওপেন ব‍্যলকনি থেকে দুহাত বাড়িয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয় বৃষ্টির মাঝে। বৃষ্টির বেগ আরও বাড়তে থাকে।ওর ঋতভাসের সাথে বছরতিনেকের সংসার, ভালোবাসাহীন কৃত্রিম শারীরিক উষ্ণতা, সময়ের খেলায় একসাথে বেঁধে দেওয়া সম্পর্কের অযাচিত জুটি এসব যেন এক লহমায় অতীত হয়ে যায়।বিদীপ্তা ফিরে যায় মুহূর্তেই ইউনিভার্সিটি জীবনের শেষ দিনটিতে।


সেদিনও দ্বৈপায়ন আর বিদীপ্তা একসাথে ফিরছে

ইউনিভার্সিটি থেকে,আর পাঁচটা দিনের মতো। দুজনে খুব ভালো বন্ধু।একে অন্যের চাওয়া পাওয়া, ভালো লাগা মন্দ লাগা সব জানে। সেদিন প্রায় বিকেল,এমনই এক শ্রাবণের দিন। পরিষ্কার খোলা আকাশ হঠাৎই ঢাকতে শুরু করল গাঢ় অন্ধকারে। দমকা হাওয়ায় কিছু একটা উড়ে এসে পড়ল দ্বৈপায়নের চোখে। দুজনে রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের নিচে সরে আসল। দ্বৈপায়ন চোখ থেকে ঐ অযাচিত উড়ো জিনিসটি বের করতে চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাজ হলো না।


"দেখি,সর্!আমায় দেখতে দে।"


"আরে তুই পারবি না!"


"বকিস না তো! দাঁড়া দেখছি।"এই বলে বিদীপ্তা

দ্বৈপায়নের চোখটা ফাঁক করে আলতো ফু দিল। নিজের ওড়নাটায় মুখের গরম ভাপ নিয়ে দ্বৈপায়নের চোখে বেশ কয়েকবার ঠেকালো।


"ছাড়্, হয়েছে।গেলো মনে হয়, ব্যথাটা করছে না আর।"এই বলে দ্বৈপায়ন বিদীপ্তার হাতটা ধরতেই বিদীপ্তার চোখ আটকে গেল ওর দুই চোখে।


"কিরে?কি দেখছিস্ এমন করে?"


বিদীপ্তা বলে ওঠে,"তোর দুচোখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।"


দ্বৈপায়নের কাছে  বিদীপ্তার বলে ওঠা এই একটি লাইনেই বিদীপ্তার গোটা মনটা আরো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হঠাৎ দ্বৈপায়ন আওড়ে ওঠে কয়েকটি লাইন, রবি ঠাকুরের:


"ভাষাহারা মম বিজন বেদনা

প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা

চিরজীবনেরই বাণীর বেদনা

মিটিল দোহার নয়নে....."


"এতদিন বলিস নি কেন?"বিদীপ্তা বলে ওঠে।


দ্বৈপায়ন বলে,"বলতে পারি নি বলে!"


এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। বড় গাছটার

পাতাগুলো সেই বৃষ্টির জল আর ধরে রাখতে পারে না। দুজনের গায়ে পড়তে শুরু করে। সম্বিত ফেরে ওদের। তাড়াতাড়ি করে দ্বৈপায়ন ছাতা বের

করতে যায় ব‍্য।গের থেকে। বিদীপ্তা বারণ করে, বলে:


"আজ দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।আজ তো আমাদের একসাথে বৃষ্টি ভেজারই দিন।"


দ্বৈপায়ন আর দ্বিমত না করে সায় দেয় ওর প্রস্তাবে।বিদীপ্তা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দ্বৈপায়নের হাত। রাস্তায় নেমে দুজনে ভিজতে থাকে, অঝোরধারায়।


নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক পেরিয়ে ওরা দুজন এক নতুন সম্পর্কের দিগন্তে প্রবেশ করে।


কিন্তু এ সম্পর্কের সুখ ওদের বেশিদিন টেকেনি।

মাস দুয়েক পর হঠাৎই একদিন হার্ট অ্যাটাকে

দ্বৈপায়নের বাবা মারা যান। গোটা সংসার চালানোর বোঝা এসে পড়ে দ্বৈপায়নের কাঁধে।

তখনও মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোয়নি। টিউশনের ওপর ভরসা করেই টেনেটুনে চলতে থাকে ও আর ওর মা এই দুজনের সংসার। তেমন আর আগের মতো সময় দিতে পারে না বিদীপ্তাকে।

অভিমান জমা বাঁধতে শুরু করে বিদীপ্তার মনে।

ইতিমধ্যে বিদীপ্তার বাড়ি থেকে একটা ভালো ছেলের খোঁজ পেয়ে যায়।বিদীপ্তা দ্বৈপায়নকে সে

কথা জানালেও একপ্রকার বেকার দ্বৈপায়নের ঐ মুহুর্তে বিদীপ্তার দায়িত্ব নেওয়া ছিল আদতেই অসম্ভব! আরো গাঢ় হয় দ্বৈপায়নের ওপর ওর অভিমান। একপ্রকার জেদের বশেই রাজি হয়ে যায় বিদীপ্তা,পারিবারিক সিদ্ধান্তে।


আজ এই ভেজা বৃষ্টি সব কিছু যেন এক ঝটকায় মনে করিয়ে দিল বিদীপ্তাকে। ইতিমধ্যে বিকেলের আকাশ বেয়ে নেমে এসেছে গাঢ় সন্ধ্যে। তবুও যেন ব‍্যলকনিটা আজ আর একটুও ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। এখন আবার কে এলো? এতো তাড়াতাড়ি তো ঋতভাস অফিস থেকে ফেরে না!


গেট খোলে বিদীপ্তা।


"একি তুমি?আজ এতো তাড়াতাড়ি?"


"হুমমম,আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস ছুটি হয়ে গেল।আর বিদীপ্তা, ইনি আমাদের অফিসে কয়েকদিন আগেই জয়েন করেছেন।অনেক দূরে বাড়ি।কাল সকালে আমাদের দুজনকে মুর্শিদাবাদে একটা কাজে যেতে হবে।ভোর পাঁচটার অফিসের গাড়ি আসবে।তাই উনি আজ রাতে আমাদের বাড়িতে একটু থাকবেন।" ঋতভাস এক নিঃশ্বাসে বলে যায়।


"সে তো বুঝলাম। কিন্তু সব কথা কি বাইরে দাঁড়িয়েই বলবে?"বিদীপ্তা বলে ওঠে।


"আসুন, ভেতরে আসুন।"ঋতভাস ওর কলিগকে ভেতরে ডেকে নেয়।


"জানো বিদীপ্তা, উনি বলছিলেন রাতটা কোনো হোটেলে কাটিয়ে দেবেন।আমিই একপ্রকার জোর করে ওনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলাম।"


"আচ্ছা, বেশ।যাও, তোমরা এবার ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি একটু চা আর টিফিনের ব‍্যবস্থা করতে যাই।"


"নিন্,এবার মাস্কটা খুলুন ভাই, আপনার সাথে আমার স্ত্রীর পরিচয়টা করিয়ে দি। তারপর না হয় ফ্রেশ হয়ে আসবেন।"


ঋতভাসের কথা মতো মাস্কটা উনি খুলতেই বিদীপ্তার চোখ আটকে যায় ঐ অতিথির মুখের দিকে।


"আলাপ করিয়ে দি," ঋতভাস বলে ওঠে,"উনি আমার স্ত্রী বিদীপ্তা আর ইনি দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।"


মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব চেনা দুটি মানুষ, মাঝখানে ব্যবধান তিন তিনটে বছর। বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল হঠাৎ, আবারো দুটি মন,ঠিক বছর তিনেক আগের মতো;অন‍্য দুটি চোখের আড়ালেই।








যেমন কর্ম তেমন ফল - মিঠুন মুখার্জী || Jemon kormo temon fall - Mithun Mukherjee || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

       যেমন কর্ম তেমন ফল 

                       মিঠুন মুখার্জী




মুখার্জী বাড়ির বড় ছেলের সম্পত্তি ও টাকা-পয়সার প্রতি ছিল ভীষণ লোভ। বড় বউ সুষমাও স্বামীর যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন। তাদের দুজনেরই একা খাওয়া একা পাওয়ার প্রবণতা ছিল প্রবল। তাই ভাই রবিনকে সবসময় তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করতেন। বৃদ্ধ বাবা-মার কানে সবসময় ছোট ভাই সম্পর্কে বিষ ঢালতেন তারা--- যাতে তাদের কাছেও সে খারাপ হয়ে যায়। এক সময় প্রতাপশালী পিতার দাপটে বাড়িটি গমগম করত। দুই ছেলে ও বউদের বুক ঠান্ডা হয়ে যেত। এখন বৃদ্ধ পিতা-মাতা বড় ছেলে ও বউকে যমের মতো ভয় পান। কোনো কথা বলার আগে চারিপাশ দেখে নেন, ওরা কেউ আসছেন না তো। ছোট ছেলের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কথা তারা সব জানেন, কিন্তু কিছু করতে পারেন না। অথচ এবাড়ির সমস্ত সম্পত্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতার।

          বাবার একটা মস্ত ব্যবসা আছে। সেটাকে বাবা ও বড় ভাই মিলে দেখাশোনা করেন। ছোট ভাই বাংলায় ডাবল এম.এ করেও চাকরি পাননি। এক কথায় বেকার। বাড়িতে সামান্য কয়েকটি ছাত্রছাত্রী পড়ান। বাবার ব্যবসা বড় ছেলে ছককষে বাবার কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে লিখিয়ে নেন। একবারও ছোট ভাইয়ের কথা চিন্তাও করেন না। আত্মস্বার্থ সিদ্ধি এখনকার মানুষের মূলনীতি। বাবা-মা ছোট ভাইকে একটা সামান্য জায়গা ব্যবসা করার জন্য লিখে দিলে তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ওই জায়গাটিতে পরবর্তীকালে মনের মত বাড়ি করার স্বপ্ন ছিল তাদের দুচোখে। কিন্তু সে আশায় জল পড়ে যায়।বাবা-মা তাদের সম্পত্তি কাকে দেবেন সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু বড় বউ-ও তার স্বামী সব একা ভোগ করতে চান। প্রতিনিয়ত ভাই ও ভাই বউয়ের সাথে ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করেন তারা। ছোট ভাই রবিন বাবা-মার এই চুপচাপ থাকা দেখে ভাবেন---"বাবা-মা বেঁচে থাকতে এরা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে, তারা না থাকলে কি করবেন!! এক মুহূর্তের জন্য তারা এ বাড়িতে  তাদেরকে থাকতে দেবেন না।"

     বাবা ও মা পড়েন ভীষণ সমস্যায়। বাবার ইচ্ছা তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সংসারকে ভাঙবেন না। অর্থাৎ হাড়ি আলাদা হবে না। কিন্তু বর্তমানে এটা সম্ভব নয়। কেউ কারো কাছে নত হয়ে থাকতে চান না। একদিন ছোট ভাই রবিনের ছয় বছরের মেয়ে আ‌রাধ্যা বাড়ির সামনে বাথরুম করায় বড় বউ তার উপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে উলফাল বলতে থাকেন। এই নিয়ে রবিনের সঙ্গে বৌদির তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। বড় বউ সুষমার এমন মুখ, যে কেউ সাধারণত তাকে নাড়াতে চান না। পাড়ার সবাই তাকে খুব ভালো করে চেনেন। কাউকে সে মানেন না। পেয়েছিলেন তার মায়ের ধারা। তার মা-ও ছিল এমন মুখরা। সেই বিষয়টার রেশ বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। একদিন ছোট বউয়ের একটা নতুন দামি ব্লাউজ ছিঁড়ে যায়। দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছেন। এই নিয়ে ছোট বউ কান্না করেন। সে ছোট ছেলেকে জানালে, ছোট ছেলে ছেঁড়া ব্লাউজ নিয়ে গিয়ে মাকে দেখান। কারো নাম না নিয়ে তিনি বলনে---"কেউ যদি ইচ্ছা করে ব্লাউজটা কেটে থাকেন, তবে তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।" বড় বউ কথাটি কোনভাবে শুনে নেন। তারপর সেই দিন বাড়িতে যা কান্ড ঘটিয়েছিলেন তা মুখে  বলার না। নিজের গায়ে মেখে নিয়ে ছোট ছেলে রবিনের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করেন। কাঁদতে কাঁদতে রবিনের নাম ধরে সে একই অভিশাপ দেন। রবিন বলেন---"আমি কারো নাম ধরে কিছু বলিনি, আর উনি আমাকে সরাসরি অভিশাপ দিলেন!!" বিষয়টা রবিনেরও খুব খারাপ লেগেছিল। তিনি মনে মনে সংকল্প করেন, দাদাদের ছায়া পর্যন্ত মারাবেন না। বড় বউ এতই ধূর্ত ও বদমাইশ যে, রবিনের অধিকারেও হস্তক্ষেপ করতেন। পাড়ার লোকের কাছে রবিন সম্পর্কে এমন এমন কথা বানিয়ে বলতেন, যা শুনে সকলে অবাক হতেন। সুষমার পেটের মধ্যে মিথ্যা কথা ও মাথার মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি ছিল প্রবল। সমস্ত কিছুর মধ্যে নিজের স্বামীর অবদানকে শুধু দুচোখে দেখতে পেতেন। আর কারোর কোনো ভূমিকা তার দুচোখে ঠেকতো না। এমনকি শ্বশুরের অবদানকে অস্বীকার করে বড় বউ সবাইকে বলতেন---"বাড়ি ও ব্যবসা যা দেখছন সবই আমার স্বামী করেছেন। শ্বশুরের তেমন কোন অবদান নেই। ও না থাকলে ভোদাই ছোট ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরমশাই এসব করতে পারতেন না।" নিজের মানসিকতার পরিচয় নিজেই সকলের সামনে তুলে ধরেন বড়বউ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে রবিনের বাবা ব্যবসার জন্য কি করেছেন, আশেপাশের সবাই তা জানেন। ফলে বড় বউ সুষমার কথা কেউ বিশ্বাস করেন না।

        কথায় বলে 'লোভে পাপ পাপে মৃত্যু'। কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। সম্পত্তি ও টাকার লোভ বড় বউ ও বড় ছেলেকে পাগল করে তুলেছিল। তাই কখনো কাউকে মানুষ জ্ঞান করতেন না তারা। বড় ছেলে একদিন বাবাকে বলেছিলেন---"আপনার আর ব্যবসা দেখতে হবে না। আমি একা দেখতে পারবো। আপনার তো বয়স হয়েছে। তেমন কোনো কাজেও আপনি লাগেন না। আমি না থাকলে এ ব্যবসা চলবেও না। আপনি তো তেমন টাকা পয়সা দ্যান নি। এই ব্যবসায় যা করেছি সবই আমি।" বড় ছেলের এই কথা শুনে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন---"এতদিন দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি।" বাবা বুঝেছিলেন বড় ছেলের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিলে, তিনি এই ব্যবসা দুদিনও টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। মদ খেয়ে আর লটারি কেটে শেষ করে দেবেন। তাই ব্যবসা পুরোপুরি ছাড়েন নি। একদিন সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বড় ছেলে ছোট ছেলেকে অকথ্য গালিগালাজ করেছিলেন। এই সকল কথা সভ্য সমাজে কখনো মুখে আনা যায় না। অহংকারের ঝাঁজ ছিল সেই সকল কথায়। ছোট ভাই রবিনকে মারতেও গিয়েছিলেন বড় বউয়ের কথায়। কিন্তু বাবা-মা ও পাড়ার লোক থাকায় তা পারেননি। কথায় বলে---"ভয় থেকে মুক্ত হলে ভাবনায় ভগবান জাগে।" রবিন একটুও ভয় পাননি। বরং মনে মনে দাদা সম্পর্কে ঈশ্বরকে বলেছিলেন--- "ওনার অহংকার যেন একদিন চূর্ণ হয় ঈশ্বর। মানুষকে উনি মানুষ জ্ঞান করেন না।" ওনার গালিগালাজ শুনলে কোনো মানুষই ওনাকে ভালো বলেন না। নিজের ছেলে-মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে পারেননি। তারা মানুষ হবেই বা কি করে! ছোটরা বড়দের কাছ থেকেই শেখে। মাতাল বাবার সন্তানও হয়েছিল একপ্রকার নেশাখোর। কোন নেশাই তেমন বাকি ছিল না। বাবা-মাকে তোয়াক্কাই করে না সে। তেজ ও কথা বলার ধরন দেখলে সকলেরই মাথা গরম হবে। মনে হবে---"ওইটুকু ছেলের এমন আচরণ!" টেনে গালে চড় মারতে ইচ্ছে হবে। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই দাদু-ঠাকুমার লাই পেয়ে সকলের মাথায় উঠেছে ছেলেটি। মেয়ের মেজাজ সপ্তমে। পান থেকে চুন খসলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। মাঝে মাঝেই বড় বউ স্বামীর মুখে মুখে কথা বলায় রামশ্যাম মার খান। তবুও লজ্জা হয় না। কথায় বলে না 'মরলেও স্বভাব যায় না'।

         'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল '। পাড়ার লোকেরা দীর্ঘ সময় বড় বউকে দেখে ও ওনার সাথে মিশে মানুষ হিসেবে উনি কী রকম তা বুঝে গেছেন। তাই বেশিরভাগ মানুষই ওনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরতে ওস্তাদ উনি। সংসারে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সব করার চেষ্টা করেন। নরম স্বভাবের শাশুড়িকে এতোদিন ধরে বুঝে নিয়েছেন। তাই তাঁকেও গুরুত্ব দেন না। বরং বিভিন্ন কাজ করার জন্য শাশুড়িকে আদেশ করেন। নিরীহ শাশুড়ি সংসারে অশান্তির ভয়ে মাথানত হয়ে সব কাজ করেন। 

         আজ থেকে বাইশ বছর আগে বড় বউ সুষমা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। তখন রবিন অস্টম শ্রেণীর ছাত্র। প্রথম পাঁচ-ছয় বছর সুষমার আসল রূপটি কারো সামনে আসে নি। রবিনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই ছিল। নিজের অনেক কাজ রবিনকে দিয়ে করিয়ে নিতেন তিনি। চিরকালই অন্যকে হুকুম করতে খুব ভাল পারেন ইনি। সুষমার ছেলে সৌভিতকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, বাড়িতে সৌভিতকে রাখা, সংসারের বিভিন্ন ফাইফরমাস খাটা, সবই করতেন রবিন। শ্বশুরের সাথে সুষমার প্রতিদিন অশান্তি হতো। মাথা গরম করে তিনি বাপের বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকতেন। মাথা গরম করে মুখে যা খুশি বলতেন সুষমার শ্বশুর। সেই অশান্তিও যাতে ঠান্ডা হয়ে যায় সেজন্য রবিন তার বাবাকে বোঝাতেন। যেখানেই ঘুরতে যেতেন তিনি ভাইপোর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন। পুজোর সময় পরিবারের সকলকে কিছু না কিছু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ইনকাম সোর্স বলতে প্রাইভেট টিউশন।

         সারা জীবন রবিনকে কম ঠকান নি এরা। বেশ কিছু বছর পর সুষমার গর্ভে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। মেয়ের নাম দেন সৃজনী। মেয়ে হওয়ার আগে থেকেই রবিনের সঙ্গে সুষমার সাংসারিক ঝামেলা বাঁধে। রবিন তার বৌদি সুষমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তবুও দাদার ছেলে-মেয়ের প্রতি তার ভালোবাসা একটুখানিও কমে নি। সৃজনীর জন্যও রবিন কম করেন নি। তবে আগের থেকে সে অনেক সচেতন ছিলেন। কোলে করে নিয়ে গিয়ে ভাইজির ছবি তুলে আনা, কাজের সময় তাকে আগলে রাখা সবই করেছেন। অথচ মানুষ কত বেইমান। রবিনের  বিয়ের একবছর পর যখন মেয়ে আরাধ্যা হল,তখন সুষমা হিংসায় জ্বলে গেলেন।কারণ তার ছেলে-মেয়ের আদরে ও সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে আর একজন অংশীদার এসেছে তাই। অবাক করার বিষয়, মেয়েটিকে একদিনের জন্যও ধরেন নি সে। মায়ের ও রবিনের শত ব্যস্ততার মাঝে আরাধ্যা অবহেলায় অনাদরে বড় হয়ে ওঠে। তাছাড়া রবিনের মাও মন্দিরের কাজের চাপে বাচ্চাটির দিকে নজর দিতে পারেন নি। অথচ সুষমার দুই ছেলে-মেয়ে দাদু-ঠাকুমার ও কাকার সহযোগিতায় বড় হয়ে উঠেছিল। সুষমা ও তার স্বামীর সন্তানদের বড় করতে তেমন কোন চাপ কোনোদিন নিতেই হয় নি। অথচ বার বার ব্রাত্য রবিনের পরিবার।

         আজ রবিনের মেয়ের বয়স সাত বছর। অনেক কিছুই ও এখন বুঝতে পারে। তবে বাবা-মার প্রতি হওয়া ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান এখনো ওর আসে নি। ছোট হওয়ায় বাবা-মার বারন করা সত্ত্বেও অনেক কাজ করে সে। ছোট বলে রবিনরা কিছু বলেন না। তবে মনে মনে রবিন ভাবেন, যেদিন ও বুঝতে শিখবে সেদিন থেকে তাদের অমতের কাজ অবশ্যই করবে না। সুষমা ও রবিনের দাদা আরাধ্যাকে লোক দেখানো ভালোবাসেন। এই বিষয়টি আরাধ্যর বাবা-মা দুজনেই বোঝেন। মাঝে মাঝে আরাধ্যার প্রতি রেগে গিয়ে গালাগাল করেন সুষমা ও তার স্বামী। পাড়ার লোকেরাও এই মেকি ভালোবাসার বিষয়টিও জানেন। রবিনের বাবার উপর তারা রেগে যান। কেউ কেউ বলছেন --- " রবিনের বাবার রবিনের প্রতি আচরণ দেখলে রাগ হয়। ওনার দুচোখ আছে। যার জন্য কোনোদিনও কারো কাছে একাটা কথাও  শুনতে হয় নি, সেই অবহেলিত ও মানসিক অত্যাচারিত হয় বেশি।অথচ আজ ত্রিশ বছর ধরে যে ছেলের জন্য প্রতিটি পদে পদে মানসম্মান হানি হয়েছে, বাড়িতে লোক এসে ঝামেলা করে গেছে , বাবার সঙ্গে মারামারি করেছে, লোকে মাতাল তকমা সেঁটে দিয়েছে সেই ছেলেই তার নয়নের মনি। এগুলি যোগ্য বিচার নয়।" আবার কেউ কেউ বলছেন --- "শুধু দুই ছেলে নয় দুই বউমার ক্ষেত্রেও আছে দুই চোখ। ছোট বউ শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য প্রাণপাত করলেও সংসারে তার কোনো নাম নেই। অথচ বড়বউ লোকদেখানো একটু কাজ করলেই তার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। তাছাড়া বড়বউ এই সংসারে অনেক আগে এসে সকলকে বুঝে গেছেন। বয়সের ভাড়ে ও বুদ্ধির জোরে ছোটবউ তার কাছে শিশু।"

         ‌ বড় ছেলে রথীন ও বড় বউ সুষমার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ছোটছেলে রবিন একসময় আলাদা হয়ে যান। বাবাকে বলেছিলেন-- " আজ চল্লিশ বছর আপনি আমাদের চালাচ্ছেন। আজ আপনার বয়স হয়েছে। আমিও হয়তো আর বছর কুড়ি বাঁচব। তা আপনাদের বাকী জীবনটা আমাকে সেবা করার সুযোগ দিন। আজ থেকে আপনারা দুজন আমার কাছে খাবেন। আপনাকে এই আটষট্টি বছর বয়সে আর খাটতে হবে না।" বাবা রবিনের কথায় রাজি হন নি। তিনি বলেছিলেন --- " না বাবা, আমরা কোনো ছেলের কাছে খাব না। আমাদের বুড়ো-বুড়ির মন্দিরের ভোগে হয়ে যাবে। তোমরা আলাদা খেলে খাও।" রবিন বুঝেছিলেন বাবা অভিমান করে এই কথা গুলো বলছেন। তিনি চান না এই বেঁধে রাখা সংসারটা আলগা হয়ে যাক। কিন্তু রবিনের আত্মসম্মান রবিনকে হাড়ি আলাদা করতে বাধ্য করেছিল। দাদার প্রতিটি মুহূর্তে অশ্রাব্য গালাগাল মেনে নিতে পারেননি সে। এই অপমান তার মনে প্রতিটা মুহূর্তে খুবই বাজত।

       ছোটছেলে রবিনের কথাগুলো বাবা মেনে না নিলেও, বড় ছেলে রথীনের সংসারে টাকা দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেন। বড় বউ সুষমা বড় সুযোগ পেয়ে যান ছোটছেলে রবিনদের নামে মগজ ধোলাই করার। সব জেনে শুনেও চুপ করে থাকেন তারা। এখনকার দিনে নিজের ছেলের থেকে বউমা বেশি আপনার হয়ে যায়। বাবা-মাও কখনো কখনো ভুল করেন। কিন্তু তারা সন্তানের কাছে ধরা দেন না। বাংলার প্রতিটি সংসারে আজ একই দশা।

     রবিন বাড়ির মধ্যে চুপচাপ থাকেন। কারণ 'জোর যার মুলুক তার'। আজ রবিনের এই দশার জন্য সে তার বাবাকেও দায়ি করেন। দুটো ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তিনি সারাজীবন বড় ছেলের কথা ভেবে গেছেন। ছোট ছেলে পড়াশোনা করে চাকরি না পেলে কি করবে -- তা ভাবেন নি। পাড়ার লোকেরাও সব জানেন। তিনি রবিনকে লঘু পাপে গুরু শাস্তি দেন। "একবার আমের সিজনে রাত এগারোটার সময় রবিনকে বাজার থেকে আম কিনে আনতে বলেন। রবিন তখন হাফপ্যান্ট পরে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। বাবাকে তিনি বলেন---"বাবা আমি এখন খাতা দেখছি, কালকে খাতাগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে। একটা বড় আম আছে, আপনার হয়ে যাবে।আজ আর আম আনতে হবে না।" রবিন এমন কথা বলে নিজের বিপদ ঢেকে এনেছিলেন। বাবা সকলের সামনে তাকে এমন গালাগালি দেন যে রবিন অবাক হয়ে ঘন্টা খানেক বসে ছিলেন আর দুচোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়েছিল। সাত বছর বাবা তার সঙ্গে কথা বলেননি। রবিন আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না এটা কেমন পিতৃসুলভ আচরণ। সকলের সামনে ছোটছেলেকে অপমান করে আনন্দ পেতেন রবিনের বাবা। কয়েকদিন লোকজনের সামনে এমন গালাগালি তিনি দিয়েছিলেন যে মনের কষ্টে ও লজ্জায় তিনি কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পিসিদের বাড়ি চলে যান। নিজের ছেলেদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেউ করেন!!

     তাছাড়া দুটো বউকেই তিনি পছন্দ করে এ বাড়িতে এনেছিলেন। কিন্তু দুজনের সঙ্গে দুরকম ব্যবহার কেন? ছোট বউয়ের সামান্য খুঁত পেলে ধুয়ে কাপড় পড়িয়ে দেন, কিন্তু বড় বউয়ের শত অপরাধও মাপ হয়ে যায়। গত হোলির দিন বড় বউ মদ খেয়ে বাড়ির সামনের তিন রাস্তার মোড়ে বেলাল্লাপনা করেও কোনো শাস্তি পান না। আবার পাড়ায় কারোবাড়ি যাওয়ার জন্য ছোটবউকে শ্বশুর-শাশুড়ির ভৎসনা সহ্য করতে হয় বছরের পর বছর। এ কেমন বিচার! এখনকার বেশিরভাগ সংসারেই এমনটি চলছে। আজকের সংসারে যে যত তেল দিতে পারে তার আদর ও কদরটাই বেশি।

           একদিন মেঘ না চাইতে জলের মতো বড় বৌমা সুষমার ছেলে সৌভিত লাইন পাড়ের একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি আনে। সুষমা দেখে আগুন হয়ে যান। বাড়িতে তাকে ঢুকতে দেয় না সে। কিন্তু দাদু-ঠাকুমা নাতির মুখের দিকে চেয়ে বড় ছেলে ও বড় বউকে বুঝিয়ে ঘরে তোলেন। সৌভিতের দাদু সুষমাকে বলেন---"লোক হাসিয়ে লাভ নেই। বিয়ে করেই যখন ফেলেছে, তখন মেনে নাও। কার ভাগ্যে কি আছে কেউ বলতে পারে না। তোমার ছেলের বাউন্ডুলেপনা এই মেয়েই ঠিক করে দেবে। আমরা অশান্তি চাই না। আর কদিন আমরা বাঁচব। আমার অনুরোধটি রাখো।" শশুরের কথা রেখেছিলেন সুষমা। কিন্তু মেয়েটির পরিবার ও মেয়েটিকে তার পছন্দ হয় না। কোন মতে নিজেদের মধ্যে বৌভাত সেরেছিলেন তিনি। রবিনরা এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই করেন নি। শুধু ঈশ্বরের কাছে বলেছিলেন--- " বড়বউকে যেন এই মেয়েটি উচিত শিক্ষা দেয়। এবার যেন ওনার অন্যের পিছনে লাগা বন্ধ হয়। যেমন কর্ম তেমন ফল লাভ করেন উনি।" 

            ঈশ্বর রবিনের কথা সত্যি সত্যি শুনেছিল। এক সপ্তাহ যেতে না যেতে বৌমার প্রতিটি কাজে খুঁত বের করে ঝামেলা করেন সুষমা। বৌমা চুপচাপ সব সহ্য করে চোখের জল ফেলে। সুষমা বুঝতে পারেন--- 'এই মেয়েকে সে উচিত শিক্ষা দিতে পাড়বে। এ খুবই নরম প্রকৃতির মেয়ে।' কিন্তু তার চিন্তা যে কতটা ভুল তা বুঝতে পাড়েন বিয়ের দুসপ্তাহ পর থেকে। একদিন রাতে সুষমার বৌমা তার ছেলের সাথে মায়ের এই আচরন নিয়ে তুমুল ঝগড়া করে। সে বলে--- "আমি এখনি  আত্মহত্যা করব। তোমার ভবিষ্যৎ যদি আমি নষ্ট করে দিতে না পাড়ি তবে আমিও বিপাশা নই। তোমার মা কী ভেবেছে আমাকে, আমার উপর মানসিক অত্যাচার করবে আর আমি মুখবন্ধ করে সব মেনে নেব। সেগুরেবালি। ওনাকেও আমার টাইট দিতে বেশি সময় লাগবে না। উনি 'ঘুঘু দেখেছেন ঘুঘুর ফাঁদ দেখেন নি'।" সৌভিতের চোখে জল দেখা যায়। সে বিপাশাকে বলে --- " আমি মার সঙ্গে কথা বলব। তুমি এমনটি করো না। লোকে জানলে ছিঃছিঃ করবে।" সৌভিতের কথা শুনে বিপাশা বলে --- " আমি এই দুই সপ্তাহ এসে বুঝে নিয়েছি তোমার মাকে। তাছাড়া এ পাড়ার মানুষের কাছ থেকে আমি তোমাদের সবার ইতিহাস জেনে নিয়েছি। সবার পিছনে লাগা তোমার মার অভ্যাস। অত্যন্ত লোভী ও একাসেরে মহিলা। তোমার কাকা-কাকিমার মতো মানুষের পিছনে লেগে এসেছেন চিরদিন। তারা নরম প্রকৃতির মানুষ বলে তোমার মার সঙ্গে পেড়ে ওঠেন নি। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়িকে চিরকাল হাত করে সর্বস্ব দখল করার খেলায় মেতে উঠেছেন উনি। বঞ্চিত করতে চান অন্যদের। তোমার বাবাও ভালো মানুষ নন। মদ খেয়ে নিজের ও এই পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করেছেন বারংবার। সেও তোমার মার মতো মানসিকতার। ভাই-বোনকে ঠকিয়ে একা ভোগ করতে চান। আমি জানি, আমি লাইন পাড়ের মেয়ে বলে তোমার মা আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমিও যে মানুষ সেটা উনি বোঝেন না।" এরপর সৌভিত বিপাশাকে বলে --- " তাহলে তুমি কী চাও? কী করব আমি?" বিপাশা বলে --- " তুমি তোমার মাকে বলে দিও উনি যেন আমার পিছনে না লাগেন, তাহলে উনাকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব। আমি কিন্তু তোমার কাকা-কাকিমার মতো নই। তুমি ভালোকরেই জানো আমি অন্যায় সহ্য করি না।"

         ছেলের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শোনেন সুষমা। বুঝতে পারেন এ মেয়ে সুবিধার নয়। এর সঙ্গে পেড়ে ওঠা যাবে না। তাই পরের দিন সকালে ছেলেকে ডেকে মনের কষ্টে বলেন ---" আজ থেকে তোরা আলাদা থাক। তোর বউয়ের সব কথা গতকাল আমি শুনেছি। ও আমাদের সঙ্গে সংসার করতে পাড়বে না। তাছাড়া ওর কথা আমি সহ্য করতে পাড়ছি না।" ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে পড়ে উভয় সংকটে। একদিকে মা, অন্যদিকে বউ। মার আচরন ও চরিত্র অবশ্য ছেলের অজানা নয়। কিন্তু সে কিছু বলতে পাড়ে না। মায়ের কথা মতো বাড়িতে কাকাদের মতো হাড়ি আলাদা করে নেয়। একমাত্র ছেলে মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। কাকা রবিন সমস্ত বিষয়টা শুনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলেন----- " আপনি আছেন প্রভু। এই দিনটির জন্যই বসে ছিলাম। যেমন কর্ম তেমন ফল।"




ক্ষিধে - পিনাকী || Khidhe - Pinaki || Anugolpo || অনুগল্প || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

      ক্ষিধে 

       পিনাকী



চওড়া রোদ মাথায় নিয়ে , প্রায় কুড়ি জন লোক, মোটা লাঠি, চোঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

সলমানের বাড়ির উঠান ; দেহটা তাজা -তাজা লাশ হয়েছে। 


ওদের কাছে আগেই খবর ছিল, নিষিদ্ধ প্রাণীর মাংস ফ্রিজে লুকানো।

 আজকে রামকর্ন ঠাকুর ; প্রধান চ্যালা বিল্লু, আরো অনেকেই দল বেঁধে এসেছে।

 গণ বিক্ষোভে, গো রক্ষক বাহিনী চড়াও হয়েছিল ; সলমনের দুর্বল , বছর ষাটের দেহ, দুমড়ে মুচড়ে শুইয়ে দিলো, বুকে লাথি, মুখে ঘুঁষি এলোপাথাড়ি ; বছর দশের ছেলেটিও ছাড় পায়নি, মহিলারা বাড়ির ভিতর থেকে কাঁদছিল, বছর সাতের বাচ্চা মেয়ে দিলরুবা বলল - আব্বা!!


রামকর্ন গোঁফে তা দিতে দিতে বলল - অপবিত্র কাজ করছিস! আগেই সাবধান করেছিলাম।


সবটুকু প্রাণ তখনও ফুরিয়ে যায়নি, সলমন হেঁচকি দিয়ে বলল - পানি, ব্যেটা পানি দিও। 


আফসার, বাইশ বছরের ছেলে, ছুটে গিয়ে পানি ঢেলে দিয়েছে, ঠোঁট বেয়ে জল গড়ায় ; দুহাত তুলে সলমন বলল - ম্যায় বেঈমান নেহি হু । উটা গোশত নয়।


ততক্ষণে বিল্লু , সলমনের বাড়ির মধ্যে ঢুকে , ফ্রিজ থেকে কাঁচা মাংস বের করে ফেলেছে , গন্ধ শুকছে, বলল - রেওয়াজি!




উত্তরপ্রদেশের আদালত, বিচারকের হাতে মাংসের নমুনার রিপোর্ট এসেছে - " Uttar Pradesh veterinary department said that the meat was mutton." ; খাসির মাংস ।


রামমকর্নের উকিল বলল - আমার মক্কেল, গণবিক্ষোভ থামাতে গিয়েছিল।


বিচারপতি মহাশয় , কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে, তাকিয়ে আছেন। বললেন - গণবিক্ষোভ কিসের? 

- হুজুর, নিষিদ্ধ মাংস থাকবার কথা কেউ গ্রামবাসীদের বলেছিল, ভুলবশত হয়েছে। 

- লেকিন , ভুল খবর ছিল। রিপোর্ট আমার সামনে রয়েছে।

- ধর্মাবতার এইজন্য আমার মক্কেল দায়ী নয়। 

- জননেতা রামকর্ন, বিক্ষোভ সামাল দিতে পারেনি কেন?


রামকর্নের উকিল হেসে বলল - গাই ছিল না মানছি, কিন্তু খাসি তো ছিল? 

বিচারক ,উকিলের দিকে তাকিয়ে বললেন - এই বিক্ষোভের কারণ তাহলে কী? 


বিল্লু ওদের দিকে তাকিয়ে চকচক চোখে বলল - রেওয়াজি খাসিই ছিল, পেটভরে বহুদিন পর খাসি - চাউল খেয়েছি! ক্ষিধে, পেটে ক্ষিধে ছিল।



 সলমনের ফ্রিজের মাংসটা খাওয়ার পর, বিল্লুর পেটে আর ক্ষিধে নেই! 

বিনির সৌর খোঁজ - মনোরঞ্জন ঘোষাল || Binir Souro khojh - Monoranjan Ghoshal || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

             বিনির সৌর খোঁজ

                 মনোরঞ্জন ঘোষাল


 

ডোমস শুধু আমাকে মেরে ফেলার প্লান করেছিল এমনটা নয়। সে আমার গবেষণাকে অসম্মান করেছে। তাই আমার গবেষণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন‍্য জেদ খানিকটা সে আমার বাড়িয়েই দিয়েছে। তার মত গবেষকদের মুখে ঝামা ঘসে দিতে আমি আবার আমার গবেষণা ভীত্তিক খোঁজ শুরু করলাম। আগে তো চাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবের দর্শন পেয়ে ছিলাম। সেই কথা বিজ্ঞানী মহলে জানিয়ে দিয়েছি। এবারে সূর্যের দিকে একবার নজর দেব বলে মনে করছি। প্রখর আলোর জন‍্য তার দিকে তো তাকানো যায় না। তার জন‍্য এক বিশেষ ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


 


এদিকে মাইক্রোস্কোপিক দূরবিক্ষন যন্ত্রটি এখন আমার কাছে একটা মস্ত বড় হাতিয়ার। যেমনটি ছিল গ‍্যালিলিয়ের। তবে এটি গ‍্যালিলিওর টেলিস্কোপের থেকে অনেক উন্নত। আসলে আমি এটিতে অত‍্যাধুনিক প্রযুক্তি ব‍্যবহার করেছি। আমি এক বিশেষ প্রকার লেন্স ব‍্যবহার করেছি এই যন্ত্রে। যেটি সাধারণ লেন্সের কার্যকারিতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিতে পারে। এই পদ্ধতি টিও আমার নিজস্ব।


 


এক বিশেষ সংকর লেন্স। লেন্সের কাঁচের সঙ্গে বিশেষ ধাতুর একটা শতকরা ভাগ মিশ্রিত করলে তার স্বচ্ছতার কোন পরিবর্তন ঘটে না। মানে কাঁচটি ঘোলাটে হয়ে যায় না। সেই কাঁচ দিয়ে লেন্স তৈরী করলে লেন্সের বিস্ফারিত করার ক্ষমতা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। আসলে ঐ অপদ্রব‍্যটি অর্থাৎ যেটিকে এক সামান‍্য ভাগে গলিত কাঁচে লেন্স তৈরীর সময় মেশানো হল। সেটি স্বাভাবিক কাঁচের তুলনায় অনেকটা ক্ষমতা শালী হয়ে ওঠে। সেই অপদ্রব‍্য মিশ্রিত কাঁচ দ্বারা গঠিত লেন্সের মধ‍্যে আলোর প্রতিসরণ ঘটলে তার চ‍্যুতি কোনকে বাড়িয়ে দেয় বেশ অনেকটা পরিমানে। বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর আমি এই সত‍্যটি উদ্ভাবন করতে সমর্থ হয়েছি। সেই বিশেষ ভাবে তৈরী লেন্স আমি আমার মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপে ব‍্যবহার করে অসাধারণ ফল পাচ্ছি।


 


এতদিন ওই দিয়ে আমার সৌর গবেষণাকে যাচাই করার কথা মনে আসে নি। সেটিকে গাণিতিক ভাবে আমি তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা করেছি। পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা হয় নি। আজ ডোমসের ওখান থেকে প্রত‍্যাবর্তন করার এক বৎসর কাল অতিবাহিত হল। সকালে আমার হাত ঘড়িটি আমাকে স্বরণ করিয়ে দিল। আমার এই ঘড়িটি এমন স্মরনীয় ঘটনা গুলিকে ওর স্মৃতিতে ধরে রাখে। আর সময় মত আমাকে মনে করিয়ে দেয়। মোবাইল ফোনেও ঐ কাজ করা যায় তবে মোবাইলের ক্ষতিকর বিকিরণের জন‍্য আমি ওটির ব‍্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। বদলে একটি অন‍্য যন্ত্র তৈরী করায় মনযোগ দেবো  বলে মনে করে আছি।


 


ডোমসের ওখানে আমি ষোলোই আগস্ট গিয়ে ছিলাম। আর ফিরেছি তেইশে আগস্ট। আজও সেই তেইশে আগস্ট।


 


আজ তেইশে আগস্ট ২০১৩ সকাল দশটা। আমার অদৃশ‍্য কাঁচ ঘরটায় সৌর খোঁজে মন নিবেশ করব বলে মন স্থির করে নিলাম। সকলের দৃষ্টিকে আড়াল করে আমি আমার সাধের ল‍্যাবে প্রবেশ করলাম। সেখানে এখন অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ক দিনের জন‍্য আমাকে টেবিলে সৌর দর্শনের যন্ত্রপাতি সব সাজিয়ে নিতে হবে। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছেই সাজিয়ে রাখতে হবে। নইলে সময় মত সব জিনিস পত্র দরকারে পাওয়া যাবে না। আমার স্টেচিং চেয়ারের পাশে যন্ত্রপাতি সজ্জিত করতে শুরু করলাম। মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ যন্ত্রটিকে একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করলাম। যাতে সেটি সূর্যের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমান ভাবে একই কৌনিক মাণের হারে আপনা থেকেই সরতে থাকবে। আমি তো আর সারাটা রাত আর দিন ধরে সব সময় সেই অনুবিক্ষনিক দূরবিন যন্ত্রের কাছে বসে থাকব না। মাঝে মাঝে অন‍্য কাজে সেখান থেকে সরে যেতে হতে পারে। তাই তার পর্যবেক্ষণের ছবি সে আপনা থেকেই তুলে রাখবে। আমার খোঁজের যাতে কোন রকম আসুবিধা না হয় তার পাকা পোক্ত ব‍্যবস্থা বলতে পার। এই সব জিনিস পত্র যথাযথ ভাবে সাজাতে বিকেল হয়ে গেল। সূর্য তখন দিগন্ত রেখার কাছে পৌঁছায় নি। একটি বার  যন্ত্রের নলে চোখ ঠেকিয়ে তাকালাম সেই হেলে পড়া সূর্যের দিকে। ভাল দেখতে পেলাম না। লাল রঙের বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ‍্যের আলোক রশ্মি গুলি আকাশে ছেয়ে দৃষ্টিকে অস্পষ্ট করে তুলছে। বুঝলাম তার প্রতিরোধের ব‍্যবস্থা করতে হবে। এই নিয়ে এক সময় মনযোগ দিয়ে ছিলাম। তখন এর প্রতিকার করার জন‍্য এক বিশেষ কোটেড চশমা তৈরী করে ছিলাম। আজ তার কথা মনে পড়ে গেল। সেই তৈরী করা স্পেশাল কোটেড চশমার কথা। যেটি চোখে পরে থাকলে চোখে আছড়ে পড়া উজ্জ্বল বেগ বান আলোক রশ্মিকে বাধা দেয়। ফলে চোখকে অযথা আলোর ঝাপটা সহ‍্য করতে হয় না। ঐ নীতি প্রয়োগ করলাম আমার মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ যন্ত্রের উপরের লেন্সে।  একটি লেয়ার সেই স্পেশাল কোট লাগিয়ে দিলাম তার ওপরে। ফলে অযথা অযাচিত আলোর ঝলকানি আর লেন্সের ভেতর দিয়ে যন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পারল না। তাতে আমার দেখাতে কোন বাধা সৃষ্টি হল না। ফলে আমি আরামে বিনা বাধায় সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। সেই জন‍্য আমার আলোক বিশ্লেষণটা অনেকটা সহজ হয়ে পড়ল। 


 


আলোক বিশ্লেষণ হল এক বিশেষ কৌশল। যেখানে আলোক রশ্মি গুলিকে পছন্দ মত ভাবে আলাদা করে নেওয়া যায়। আলোক রশ্মি যে কণিকার প্রবাহ তা আমরা জানি। সেই কণিকার নাম নিউটন দিয়েছিলেন ফোটন। তিনিতো আলোর কণিকা তত্ত্বের উদ্ভাবক। প্রমাণ করেছিলেন আলোকের কণিকা ধর্ম। তিনি আলো যে কণিকা সেটি বললেও সে কণিকারা যে আকার ও ভরে ভিন্ন হতে পারে তা বলেন নি। তিনি বলেছিলেন আলোর কণিকা গুলি ধর্মে অভিন্ন।


 


এই কথা সত‍্য নয়। আইন্সটাইন তার সমীকরণে সেই কথা স্পষ্ট দেখিয়েছেন। তা ছাড়া সনাতনী বলবিদ‍্যার ধারণাকে বিশ্লেষণ করলেই তা জানতে পারা যায়। সাধারণ আলো আর এক্স লশ্মির কথা ভেবে দেখ? সাধারণ আলোকের তুলনায় এক্স রশ্মির ভেদন ক্ষমতা অনেক বেশি। তা হলেই বোঝ? হয় এক্স রশ্মির কণিকা গুলোর গতিবেগ সাধারণ আলোর কণার তুলনায় বেশি। নতুবা এক্স রশ্মির কণিকা গুলো সাধারণ আলোক কণিকার তুলনায় আকারে অনেকটা ছোট। তবে সম্প্রতি প‍্যারিস-জার্মানিরর এল এইচ সির গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে আলোর থেকে বেশি গতি সম্পন্ন কণিকা আছে। সত‍্যেন বসুর নামে সেই কণিকা কে বোসন বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেকে অবশ‍্য ঈশ্বর কণা বলে সেই ক্ষুদ্রতর কণাকে অভিহিত করছেন।   ওই ক্ষুদ্রতর না ওর থেকেও ছোট ক্ষুদ্রতম কণিকার কথা আমি অনেক আগেই বলে ছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম একক কণিকা বা ইউনিট পার্টিকল। এটিও আমার এক অমোঘ ধারণা। আমার বস্তুবাদ তত্ত্বে এর উল্লেখ আছে।


 


আসলে বস্তু ছাড়া যে বস্তুর সৃষ্টি হতে পারে না সেটাকেই বলা হয়েছে সেখানে। তার সঙ্গে ইউক্লিডের জ‍্যামিতির ধারণা কে জুড়ে দিয়েছি মাত্র। শক্তি আর বস্তু আদতে এক জিনিস। বস্তুর এক বিশেষ অবস্থা হল শক্তি। বস্তুকে যেমন শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। তেমন শক্তিকে বস্তুতে রূপান্তর করা যায়। আমার ল‍্যাবে আমি তা করে দেখেছি। একটা আলোক রশ্মি থেকে ভারি কণার বস্তু গঠন করেছি। আলোক রশ্মি তো একটি কণা না। অজস্র কণার একটা স্রোত। কোয়ান্টামের ধারণায় এক ঝাঁক কণিকার সমাবেশ বলতে পার। এখন থাক সে কথা।


 


নানা বর্ণের আলোক রশ্মি আসলে নানা প্রকারের কণিকার প্রবাহ। নিউটনই আলোক রশ্মিকে প্রীজমের মধ‍্যে দিয়ে পাঠিয়ে আলাদা করে দেখিয়ে ছিলেন। চুম্বক ঐ নানা বর্ণের আলোক রশ্মির ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই যেমন লাল বর্ণের আলোক রশ্মি চুম্বক দ্বারা বেশি আকর্ষিত হয়। কারণটা খুবই সাধারণ। এতে লোহার কণা থাকে তাই। এই ভাবে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতিতে আলোর কণা গুলিকে আলাদা করে দিয়ে আমি আমার পছন্দ মত আলোক রশ্মি টিকে কাজের জন‍্য বেছে নেবার পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকি। একেই আলোক বিশ্লেষণ বলে থাকি।


 


সন্ধ্যা হবার কিছুটা আগে যখন সূর্য অনেকটা দূরে সরে গেছে। তার থেকে নির্গত আলো বেঁকে তেরছা হয়ে ধেয়ে আসছে আমার কাছে। সে আলোর বেগ অনেক কমে গেছে। ঠিক তখনই কিছুটা আলো আমি ধরে নিলাম আমার আলোর ফাঁদ যন্ত্রে। এটি আমার তৈরী এক বিশেষ যন্ত্র। যেটিতে আলো ধরে রাখা যায়।


 


সকলেই জানে আলো প্রতিফলিত হয়। এবং দর্পণে তা অনেকটাই বেশি পরিমানে হয়ে থাকে। কতগুলো দর্পণকে বিশেষ কোনে স্থাপন করে তাতে আলো ফেললে। সেই আলো যদি সর্বদা এই সকল দর্পণের মধ‍্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। তো সে আর কখনো প্রকৃতিতে মুক্ত হতে পারে না। তৈরী ঐ যন্ত্রে আটকা পড়ে থাকবে অনন্ত কাল। প্রয়োজন মত তুমি কোন একটি দর্পণকে সরিয়ে আলোকে ফাঁদ মুক্ত করে ব‍্যবহার করতে পারবে। আমি তাই করি। প্রয়োজন হলে আলো ধরে রাখি আর প্রয়োজনে সেই আলোকে কাজে ব‍্যবহার করে থাকি। আজ


 


দিন শেষ হবার আগে আমি কিছুটা আলো তাই ধরে নিলাম আমার আলোক ফাঁদ যন্ত্রে। এবার রাত ঘনিয়ে এল। আমি আমার অদৃশ্য কাঁচ ঘরেই সময় কাটিয়ে চলেছি। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্র সাজিয়ে নজর দিয়ে বসে আছি। অদৃশ‍্য কাঁচ ঘর এমন কিছুই না। আলোর প্রতিফলন ধর্মকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা।


 


বস্তু থেকে আলো বেরিয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে আমরা সেই বস্ত টিকে দেখতে পাই। সেই আলো বস্তুর নিজের দহনের আলো হতে পারে আর হতে পারে অন‍্য কোন উৎসের আলো। যা তার গায়ে  প্রতিফলিত হয়ে ছোটে চলেছে । যখন বস্তু আলো প্রতিফলন করে এবং সেই আলো কারো চোখে ফিরে না আসে। তবে সেই বস্ত টিকে আর দেখা যাবে না। আমার কাঁচ ঘরের সূক্ষ্ম কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে আলো আনায়াসে ভেতরে চলে আসতে পারে প্রতিসৃত হয়ে। যৎ সামান‍্য যা কাঁচের দেয়ালে বাধা পেয়ে প্রতিফলিত হয় তা  চোখে মালুম হয় না। আর ঐ প্রতিসৃত আলোক রশ্মি গুলিকে দর্পন দ্বারা বিশেষ কোনে প্রতি ফলিত করে একত্রিত করে এক বিশেষ কোনে মহাকাশে মুক্ত করে দিয়ে থাকি। ফলে আসে পাশের কেউ আমার ল‍্যাব দেখতে পায় না। উপর থেকে দেখলে আগুনের গোলা বলে মনে হয় । তাই ভয় পেয়ে উড়ন্ত কোন কিছুই এখানে উপর দিয়ে যায় না। সন্দেহের বসে অনেকে সে দৃশ‍্য দেখার পর খোঁজ করতে এসেছিল কিন্তু নীচে এসে দেখলে তারা কিছুই খুঁজে পায় নি। তবে আমার যন্ত্রটি পেলে তারা খুঁজে পাবে। আমি বাহিরে কোথাও গেলে এটিকে সঙ্গে নিয়ে যাই। নইলে আমি নেজেই আর ল‍্যাব খুঁজে পাব না। এটি এক প্রকার ডিটেক্টর। ল‍্যাবের মধ‍্যে থাকা এক বিশেষ যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে বাইরে থেকে এর অবস্থান জানতে সাহায‍্য করে। অবস্থান সূচিত হবার পর আমি কম্পাসে দিক নির্ণয় করে ল‍্যাবের ভেতরে প্রবেশ করি।  ভেতরে ঢোকার পর সব কিছু দৃশ‍্যমান হয়ে পড়ে। এটি তৈরীর মেকানিজম আমি লিখছি না। তাহলে সকলে বানিয়ে আমার ল‍্যাব খুঁজে বের করবে। আমি বড় বিরক্ত বোধ করব।


 


যদিও রাতে সূর্য আলো দেওয়া বন্ধ করে দেয় না। মনে করলে আমি স‍্যাটেলাইটের দ্বারা প্রতিফলিত আলোকে গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারি। অনেকে একটা কথা ঠিক বুঝতে পারে না। যে আকাশে সূর্যের আলো ছড়িয়ে থাকলেও আকাশ রাতে কালো থাকে কেন? আসলে আলো প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত হয়ে আমাদের চোখে না আসলে আমরা উৎস বা প্রতিফলককে দেখতে পাবো না। কারণ আলোক রশ্মিকে চোখে দেখা যায় না। তাই আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলোক রশ্মিগুলো কোথাও প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত হয়ে আমাদের চোখে আসে না। তাই  কিছুই দেখা যায় না। সে যাক।


 


রাতে আলোর ফাঁদে থেকে আলো নিয়ে একটা আলাদা যন্ত্রে একটু নাড়াচাড়া করলাম। কোন লাভ হল না। কারণ তার সূর্যের সঙ্গে  সংযোগ সূর্য থেকে অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই তার চলার পথ আর সূর্য পর্যন্ত বিস্তৃত নেই। সেই আলো সূর্যকে প্রত‍্যক্ষ করাতে পারছে না। এবার আর প্রতিফলিত আলোকে উৎস খোঁজায় ব্রতি হলাম না। জানি সে কাজ ভষ্মে ঘি ঢালার মত হবে। আগুনও জ্বলবে না আর ঘি টুকুও নষ্ট হবে।


 


পরের দিন সকাল হলেই আবার বসে পড়লাম টেবিলে সৌর খোঁজের কাজে। একেবারে সকাল এখনো সৌর কিরণ এখানে এসে পড়ে নি। দেখি বড় একটি মেচলার মত সূর্য সবে উঠে আসছে উপরের দিকে। যেন মনে হয় জ্বলন্ত কয়লা। একেবারে টক টকে লাল হয়ে জ্বলছে। দেখে মনে হয় না সেটি পৃথিবীর থেকে বড়। ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে এনে বড় করতে থাকলাম। ক্রমে বড় হচ্ছে একটা ঘরের মত বড় হয়ে গেল। আরো বড় করতে লাগলাম। এবার একটা গোটা গ্রামের মত হয়ে পড়ল। তখন তাতে সৌর কলঙ্ক খুঁজতে শুরু করলাম। কিচ্ছু পাওয়া গেল না। তাকে আরো বড় করতে করতে  একেবারে হাতের কাছে ছুঁয়ে ফেলার মত কাছে নিয়ে চলে এলাম। এবার তার দেহে আমাদের ঘরের মত এতটুকু জায়গা দেখতে কয়েক ঘন্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এতটাই বড় করা হয়ে গেছে তার দেহটি। ভেবে দেখলাম তাহলে তো গোটা গ্রামের মত একটা অংশ স্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বহু সময় লেগে যাবে! সম্পূর্ণ তার দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁজ করতে সারাটা জীবন লেগে যাবে! তাই তার আকার কিছুটা ছোট করে নিলাম। ছোট করতেই এক অদ্ভূত দৃশ‍্য নজরে পড়ল!


 


দেখলাম একটা আগ্নেয়গিরি! তার জ্বলা মুখ দিয়ে অগ্নুৎপাৎ হচ্ছে। কোন লাভার নির্গমন হচ্ছে না। বড় বড় জালার মত আগুনের গোলা নির্গত হয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। কয়েকটা তো আমাকে লক্ষ‍্যঃ করে ছুটে এল! আমি ভয় পেয়ে গেলাম! দেখলাম সেগুলি ঠিক যেন আমার মাথার উপর এসে আছড়ে পড়ছে। আমি জানি ওতে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি আমার ল‍্যাবের চারিদিকে অদৃশ‍্য লেজার শিল্ড প্রোটেকশন চালু করে রেখেছি। বড় ধুমকেতু এসে আছড়ে পড়লেও কিছু হবে না। তবে সূর্য এসে আছড়ে পড়লে কী হবে বলতে পারবো না। হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে সেটি যে হবার না তা আমি ভাল মত জানি। আর আমি তো কেবল আমার কথা ভাবি না। পার্থিব সকল জীব জগতের কথা আমাকে ভাবতে হয়। ঐ আগুনের ছুটে আসা গোলা আমার কোন ক্ষতি না করলেও পার্থিব বাকি সব কিছুর ক্ষতি করছে। মনে মনে তাই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ল‍্যব থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলাম দেখার জন‍্য। এই কথা ভেবে যে ঐ ধেয়ে আসা আগুনের গোলা গুলো আসে পাশের পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে। বাহিরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে গেলাম! কোথায় সেই ছুটে আসা আগুনের গোলা? কোথাও কিচ্ছু তো নেই! পরিবেশের এতটুকু ক্ষতি তো কোথাও হয় নি! চারি পাশে গাছ পালা জীব জন্তু সব কিছুই বহাল তবিয়তে রয়েছে।


 


বরং রৌদ্রে ঝলমল করে গাছেরা যেন খিল খিলিয়ে হাসছে। দিঘির জল  হালকা সেই রোদে তাথৈ তাথৈ নৃত‍্য করছে। পানকৌড়ী মনের আনন্দে টুপ টুপ করে জলে ডুব দিচ্ছে। প্রকৃতিতে মহা সমারোহ। এতটুকু বিমুর্ষতার চিহ্ন কোথাও চোখে পড়ল না।


 


মনে সনন্দেহ হল! তবে কী আমি যন্ত্রে ভুল দেখলাম! আমার যন্ত্র কী সঠিক দিশা দেখাতে পারছে না?মনটা ভাবনায় ভরে গেল। সমস‍্যাটি কী খুঁজে নেবার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষণ ভেবে একটা আন্দাজ করলাম তবে একবার পরখ না করে একেবারে নিশ্চিত হলাম না।


 


আবার গিয়ে বসলাম ল‍্যাবের ভেতরে আমার চেয়ারে। এবারে মন টাকে শান্ত করে চেয়ে দেখলাম সূর্যের দিকে তাক করে থাকা টেলিস্কোপের মুখে লাগানো স্ক্রীন টার উপর। প্রত‍্যক্ষ করলাম আবার সেই দৃশ‍্য। ঝাঁকে ঝাঁকে সেই ভাবেই আগুনের গোলাগুলো সূর্যের দেহের আগ্নের গিরির জ্বালা মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে আমার দিকে। যেন  ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র! তখনও ঠিক ভাবে আমার মাথায় আসছিল না কেন এমন দেখতে পাচ্ছি? অনেক ভাবনা চিন্তার পর বুঝতে পারলাম আসল সত‍্য টিকে! প্রত‍্যক্ষ করলাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব! শক্তির কণা গুলো দল বেঁধে নির্গত হয় উৎস থেকে। আর এ তো সেই ঘটনা। এগুলো আলোর কণা ফোটন। আমার ম‍্যাগনিফাইং গ্লাসে সেই অতিব সূক্ষ্ম ফোটন কণা গুলিকে এত বিশাল আকারে দেখাচ্ছে। তাই আলোর কণার নিক্ষেপকে গোলা বর্ষণ বলে মনে হচ্ছে। আমার যন্ত্রে এতটাই বর্ধিত করা সম্ভব হয়েছে যে আলোর ঐ তীব্র গতিও ক‍্যামেরায় ধীর গতি সম্পন্ন মনে হচ্ছে। সিনেমার পর্দায় যেমন স্লো মোশনে ছবি দেখা যায়। এখানে তেমন  সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলা আলোক কণাদের একটি সিধারণ কণার মত গতি শীল দেখাচ্ছে। কী আশ্চর্য! এমনটাও হতে পারে? তাহলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারিদিকে যে ইলেকট্রন গুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে বেড়ায় তাকেও তো একটি স্বাভাবিক গতিতে কেন্দ্রকের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে থাকা কণার মত দেখাবে? পরমাণু পর্যবেক্ষণের একটা খুব ভাল দিক উন্মোচন হল আমার কাছে এই গবেষণা করতে গিয়ে। সেই নিয়ে আর এক সময় কাজে বসা যাবে। এই অভাবনীয় দৃশ‍্য সচক্ষে দেখে


 


একবার মনে হয়েছিল এই দৃশ‍্য আমি বৈজ্ঞানিক সমাজকে প্রত‍্যক্ষ দর্শন করাব। কিন্তু সেটি যে সম্ভব না। আমার এই ল‍্যাবরেটরী আর যন্ত্রের সেটাপ ছাড়া এই দুর্লভ দৃশ‍্য দেখা অসম্ভব। সেটি যে দ্বিতীয় কোথাও সেট করা যাবে না। আর আমার ল‍্যাবের সন্ধানও কাউকে দেওয়া যাবে না। একটা প্রমাণ স্বরূপ এই লেখাটি  রাখলাম। তাতে যে যা বোঝে বুঝুক। অসত‍্য বলে মনে করে করুক। তবে কেউ কেউ সত‍্য বলে মনেও তো করতে পারে? তাদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখি আমার এই উক্তি যথার্থ সত‍্য এবং সচক্ষে দেখা বর্ণনা। এটিকে বিশ্বাস করে গবেষণায় লেগে থাকলে সাফল‍্য আসবেই।


 


এবার মনে এল আলোর কণা গুলো অগ্নুৎপাতের মত নির্গত হচ্ছে ঠিকই। তাবে তা সূর্যের দেহের সমগ্র তল থেকে নির্গত হচ্ছে না। তার দেহের কোথাও কোথাও টর্চ জ্বেলে রাখার মত এমন আগুনের গোলা বের করার আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আর বাকি বেশির ভাগ অংশটাই ফাঁকা। আমাদের পৃথিবীর মাটির মত। সমগ্র পৃথিবীর বুকে কয়েকটা মাত্র আগ্নেয় গিরি আছে তাও আবার সব গুলি জ্বলন্ত নয়। বেশির ভাগ দেহ তলই ফাঁকা। তবে আমাদে দেহ তলের মত এতটা ফাঁকা নয় সূর্যের দেহ তল। তবে সমগ্র তল যেমন আগুনের গোলা বলে মনে হয়। সূর্যের সেই দেহ তল তেমনটি না। সেখানে পাহাড় পর্বত ঘর বাড়ি সব রয়েছে। বড় বড় গর্তও রয়েছে চাঁদের মত। যেখানে কোন আগ্নেয় গিরি নেই তাই আলো জ্বলে না। বাহিরে কোথাও থেকে আলো পৌঁছে গেলেও সে আলো আর ফিরে আসে না কোথাও। তাই কালো হয়েই থাকে সব সময়। এই কালো অংশ গুলো হল সৌর কলঙ্ক।আমরা এগুলো খুব একটা দেখতে পাই না। কারণ সৌর ঝড় আর সূর্যের আবর্তণ গতির জন‍্য।


 


সূর্যের দেহে ঝড় বয়ে চলেছে প্রবল বেগে সর্বক্ষণ। সে ঝড় আলোর কণা গুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তার দেহে সর্বত্র। তাই সে দিকে তাকালে ও সব আর দেখা যায় না। শুধু জ্বলছে সারা দেহ বলে মনে হয়। যদিও এর জন‍্য বহুলাংশে দায়ী তার আবর্তণ গতি। পৃথিবীর মত সূর্যও তার নিজের অক্ষের চারিদিকে পোঁ পোঁ করে ঘুরছে। এতটাই তার বেগ যে মুহুর্তের মধ‍্যে আগ্নেয় গিরির জ্বলা মুখ আবার ঘুরে আসছে চোখের সামনে এক পাক ঘুরে। তাই সব সময় ঐ  জ্বলা মুখই আমাদের চোখে ধরা দেয়। অনেকটা চরকা বাজি মত ঘটনা বলে মনে করতে পার। চরকার মুখে আগুন জ্বেলে দিলে সে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। দেখে মনে হয় তার দেহের সর্বত্র দিয়েই আগুন জ্বলছে যেন। আদৌ তাই কি জ্বলে? এমন ঘোরার গতি আমাদের মনে করতে বাধ‍্য করায় তার এমন সর্ব দেহ  জ্বলমান অবস্থার কথা।


 


তাই সূর্যের সারা গায়ে আগুন জ্বলছে বলে দেখালেও আদৌ তার সারা গায়ে আগুন জ্বলছে না। তার দেহের বিস্তৃত জায়গা রয়েছে ফাঁকা পড়ে। সেখানে বাস করে সৌর মানব। আমাদের থেকে দীর্ঘাকায় ও সোনার মত তাদের গায়ের রং। সোনা রদ্দুরের দেশে বাস করে বলে হয়তো এমনটা হয়েছে। পরিবেশের প্রভাবে এমনটা হয়ে থাকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম বলে একটা ব‍্যাপার আছে।  আমরা অনেকেই জানি। যেখানে এক এক ইন্ডাস্ট্রি অঞ্চলে ঐ ইন্ডাস্ট্রির জন‍্য বিশেষ পরিবেশ গড়ে ওঠে। সেই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেবার জন‍্য জীব দেহে নানা রকম পরিবর্তন ঘটে থাকে। একেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম বলে। সূর্যের বাসিন্দাদের ঐ রকম সোনালী গড়ন হয়েছে সোনালী রদ্দুরের জন‍্য। আর দেহের আকার বড় হবার কারণ ওদের আবর্তন গতি। যেমন আমাদের বিষুব রেখার বা তার আসে পাশের অঞ্চলে থাকা লোক গুলোর আকার বেশ বড়। ততার পর অক্ষাংশ কমার কারণে আকার কমতে থাকে। অক্ষাংশ কমতে থাকলে তার আবর্তন গতিবেগ ও কম হয়। তাই বাহিরের দিকে ছিটকে যাবার বেগও কম হয়। অর্থাৎ কেন্দ্রাতিগ বল মানুষের লম্বা হয়ে বেড়ে ওঠার পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বল যত বেশি হবে তত তাকে খাঁটো করে দেবে। এটিকে অভিকর্ষ বলা হয়। অভিকর্ষের টান কাটিয়ে মানুষ কে বড় হতে হয়। মেরু দেশে মানুষের ওপর অভিকর্ষ টান বেশি তাই তারা লম্বা বেশি হতে পারে না। তাই বলে ঐ একটি কারণ শুধু লম্বা হবার জন‍্য দায়ী তা বলা যাবে না। অনেক কারণের মধ‍্যে এটিও একটি কারণ। না হলে গোর্খা জাতিদের বেঁটে হবার কারণ আর গাণিতিক হিসাব নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। কারণ ঐ একই অক্ষাংশে পাহাড়ের মাথায় আর ঠিক সেই পাহাড়ের নীচের মানুষদের আকারের উল্টো পরিণতি ঘটবে কেন? সেখানে তো  পাহাড়ের ওপরে বসবাসকারী গোর্খাদের লম্বা আর নীচে বসবাসকারী দের বেঁটে হবার কথা। এখানে আর একটা যে সত‍্য লুকিয়ে আছে তা বলে রাখি। তাহল অস্বাভাবিকতা। মানুষের ভর অনুযায়ী পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল তার জন‍্য বরাদ্দ আছে। সেই অঞ্চলের নীচের দিকে বা ওপরের দিকে বাস করলে তার শরীর একটা অস্বভাবিকতা অনুভব করে। ফলে সে স্বাভাবিক ছন্দে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। তখন তার সমস্ত চরিত্রে বৈশিষ্ট্যগত নানা পার্থক‍্য গড়ে ওঠে যেটি তাকে ঐ পরিবেশে মানিয়ে নিতে সাহায‍্য করে। এখন থাক ও কথা। কী আশ্চর্য! সূর্যের দেশে মানুষ!


 


সেখানে মানুষ দেখে উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আরো ভাল করে খোঁজ করতে থাকলাম সেখানের মাটি। কী আশ্চর্য! তাল তাল সোনায় পাহাড় তৈরী করে রেখেছে সেখানে! আমরা একটু সোনার টুকরোর জন‍্য হাপিত্তেষ করে মরছি।আর সেখানের লোকে সোনা পা দিয়ে মাড়াচ্ছে। সোনার ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সোনার বাড়ি তৈরী করে তাতে বাস করছে। আরো একটু লেন্সটি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখলাম সাদা কিসের যেন পাহাড় রয়েছে মনে হল। প্রথমে মনে হয়ে ছিল অভ্র। তার পরক্ষণেই বুঝলাম সেটি অভ্র না। সে তো হালকা ধাতু। তার তো ওখানে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর কথা। তবে এটি কী? প্লাটিনাম নয় তো?


 


 


আলোর দ‍্যুতি পরীক্ষা করে দেখলাম যে ঠিক তাই। যা মনে ভেবেছিলাম!সেটি প্লাটিনামের পাহাড়। ওরে বাবা! এত বড় প্লাটিনামের পাহাড়! এ মুলুকে থাকলে না হয় এক ধামা নিয়ে ঘরে রেখে দিতাম। এখানে তো ওটি সহজে পাওয়া যায় না তাই বেশ দামি ধাতু। তার পর নজর পড়ল এক ঝকঝকে গাছের ওপর। ঠিক যেমন বড় দিনে আমাদের এখানে গাছকে সাজিয়ে বানানো হয় তেমন ঝকছে কিন্তু কোথায় বাতি লাগানো তা দেখতে পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তবে বুঝলাম যে সেটি কোন সাজানো গাছ নয়। ওটি ওখানের স্বাভাবিক গাছ। আমাদের যেমন সবুজ পাতার গাছ হয় ওখানে তেমনই গাছ তবে তার পাতা সবুজ না। রোদের মত সোনালী।


 


সাধারণ টেলিস্কোপে এ সব কিছুই দেখা যায় না। ওরা তো দৃষ্টিকে আলোক বলয় ছাড়িয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে পারে না। তাই ও সব টেলিস্কোপে সূর্যকে জ্বলন্ত আগুনের গোলা বলে মনে হয়। আলোক বলয় তেমন বিশেষ কিছু নয়। অপেক্ষা কৃত ভারি আলোর কণা গুলো দেহ থেকে নির্গত হয়ে বেশি দূর পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে না। কিছুটা দূরে গিয়ে তারা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান করে সূর্যের মূল দেহকে বেষ্টন করে আবর্তন করতে থাকে। ঠিক যেমন শনির বলয়। শনির বলয় তো ঘন ধুলি কণার স্তর। যেটি তার দেহের চারি পাশে বলয়ের মত ঘুরতে থাকে। নানা ভরের ছোট ছোট কণা সেখানে ভীড় করে এমন বলয় গঠন করেছে।  সূর্যের দেহের চারি পাশেও তেমন ভারি আলোর কণার স্তর  ঘুরে বেড়িয়ে আলোক বলয় গঠন করে। সূর্যের দেহ থেকে নির্গত সূক্ষ্ম আলোর কণা গুলোই প্রচন্ড গতিতে ঐ আলোক বলয় ভেদ করে বাহিরে বেরিয়ে আসে। সেই সূক্ষ্ম রশ্মিকে অনুসরণ করা সাধারণ টেলিস্কোপের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। এমন কি হাবল টেলিস্কোপেও তাকে ধরতে পারবে না। যদি পারতো তো ওদেরকে পদ্ধতি বলে দিয়ে তা প্রত‍্যক্ষ দর্শন করাতাম।


 


অনেকে বলে থাকেন সূর্যের দেহে এত উত্তাপ ওখানে জীবন থাকা সম্ভব না। তাই গাছ পালা মানুষ এ সব কিচ্ছু নেই। তারা যে এত বোকার মত কথা বলে তা বলে বোঝাতে পারবো না। আগেই তো বললাম যে সূর্যের দেহে সর্বত্র আগুন জ্বলছে না। তাই যেখানে আগুন জ্বলছে না সেখানে জীব থাকতে পারে এবং আছে তা আমি প্রত‍্যক্ষ করলাম। আগুন তো অল্প কিছু জায়গাতে জ্বলছে। সেই আগুন ঝড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেহের অন‍্যত্র। তাই সূর্যের সমগ্র দেহ জুড়ে আগুন জ্বলছে বলে মনে হয়। সেখানের উত্তাপ যতটা মনে করা হয় ঠিক ততটা নয়। তবে আমাদের এখানের থেকে সেখানের উত্তাপ অনেক বেশি। তাই বলে ঠিক ততটাও না যতটা আমরা অনুমান করি অসহ‍্য বলে। আমরা তো জানি আগুনের কাছে পাশাপাশি  যতটা হাত নিয়ে যাওয়া যায় উপর থেকে ততটা কাছে হাত নিয়ে যাওয়া যায় না। ঘূর্ণনে অপ কেন্দ্রিক বলের কারণে ঐ ফোটন কণা গুলি ঘূর্ণন কেন্দ্রের বিপরীতে ছুটে চলে যায়। তাই উপরের দিকে হাত বেশি কাছে আনা যায় না। ঐ কণারা তাদের চলার পথে বাধা পছন্দ করে না। যদি কোন বাধা চলার পথে পড়ে তবে তাকে হয় বিদ্ধ করে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। নতুবা সে নিজে তার গায়ে ধাক্কা মেরে প্রতিফলিত হয়ে অন‍্য দিকে চলে যায়। আরো একটা কথা বলতেই হয়। যে মরুতে বা মেরুতে জীবেরা বসবাস করতে পারবে বলে আমরা কখনো ভেবেছিলাম! না তো? অথচ সেখানে জীব রয়েছে। মরুতে বিষাক্ত বালি বোড়া সাপ। কাঁকড়া বিছে ইত‍্যাদিরা উষ্ণ বালির ভেতরে বেশ আরামেই থেকে যাচ্ছে। আর মেরুর প্রচন্ড ঠান্ডায় ক্রায়োজেনিক্স ছত্রাক আর শৈবাল তো রয়েইছে। সঙ্গে মানুষও রয়েছে। এস্কিমো। কেউ ভেবেছিল এ সব কথা! তবে এরা সকলে ঠিক আমাদের মত না। শিতের দেশের পাখি পেঙ্গুইন কে যেমন গরমের দেশে নিয়ে গেলে তাকে তার মত ব‍্যবস্থা নিয়েই নিয়ে যেতে হবে। তেমনই অস্ট্রিচ এমু এদেরকে বরফের দেশে নিয়ে যেতে গেলে তাদের তার মত পরিবেশ গড়ে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ শিতের পাখিকে গরমের দেশে নিয়ে গেলে তাকে শিতের পরিবেশ তৈরী করে সেখানে রাখতে হবে। আর গরমের পাখিকে শিতের দেশে নিয়ে গেলে তাকে গরমের বাঁসা বানিয়ে সেখানে রাখতে হবে। ঐ দুই পরিবেশের পাখি দুটি তাদের পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারলেও বিপরীত পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই বলে গরমের পাখি কী মনে করতে পারে যে শীতের দেশে কোন পাখি বাস করতে পারে না? ওদের ক্ষেত্রেও তাই। সূর্যের দেশের জীবেরা তারা তাদের পরিবেশে বসবাস করায় অভ‍্যস্থ জীব থাকে। তারা গরম সহ‍্য করতে পারে। আবার আমরা অপেক্ষা কৃত ঠান্ডার ভূখণ্ডে বাস করি ওদের মত গরমে থাকতে পারবো না। তাই বলে ওখানে জীব থাকতে পারে না বলে আমাদের মনে করাটা কল্পনা। এটিকে বৈজ্ঞানিক সত‍্য বলে মেনে নেওয়া যাবে না। তবে বিজ্ঞান তো না দেখে সহজে বিশ্বাস করবে না। আমি দেখেছি ফলে সেটিই প্রমাণ এই কথা কেউ মেনে নেবে না। তাদেরকে হাতে নাতে দেখিয়ে দিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে আমার কথা সত‍্য। সেটি যে করা সম্ভব না তা আমি আগেই স্বীকার করেছি।  তাই আমার এই নিজের সচক্ষে দেখা ও তার সম্পর্কে লেখা বিবরণ সকলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। সে যাই হোক ওরা বিশ্বাস না করে করুক তাই বলে আমার চোখের দেখা সত‍্য তো আর মিথ‍্যা হয়ে যাবে না। আরো একটু মনযোগ দিয়ে সূর্যের দেহ তল পর্যবেক্ষণ করছি। নানান দৃশ‍্যের মাঝে


 


এ বার আরো একটা অদ্ভূত দৃশ‍্য দেখতে পেলাম। সেই দৃশ‍্য আমাকে কেবল অবাক করে দিল না বরং এক বিশেষ ভাবনার মধ‍্যে ঠেলে দিল। আমি ঠিক নাস্তিক না হলেও আস্তিক বলতে পারবো না। অর্থাৎ  আমি ধর্মকে তেমন অবিশ্বাস না করলেও তেমন বিশ্বাস করি তা বলা যায় না। তাই এই দৃশ‍্য দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম! তবে কী পুরাণ কাহিনী সব সত‍্য! তবে কী দেবতা আর অসুরেরা এখনো জীবিত? এখনো কী তাদের মধ‍্যে ঘটে চলেছে মহা সগ্রাম! এমন কথা মাথার মধ‍্যে ভীড় জমাতে থাকছে। যখন দেখলাম সেখানে রয়েছে দু প্রকার মানুষ!  কাল আর সাদা যেটি সোনালী দেখায়।


 


এক দল কালো যারা দল বেঁধে থাকে ঐ অন্ধকার ময় কালো গহ্বরে। আর এক দল সোনালী মানুষ যারা থাকে আলোর দিকে জড়ো হয়ে। এখন বুঝতে পারলাম তাই আলো এত উজ্বল আর অন্ধকার এতটা কালো।


 


তাকিয়ে আছি ঐ দিকে। দেখি ঘন কালো অন্ধকারে  ভিতর থেকে বিশাল দৈত্যাকার কিম্ভূত কিমাকার সব মানুষ বেরিয়ে আসছে। হাতে তাদের অস্ত্র। তারা এগিয়ে চলেছে আলোর দিকে। সেই আলোর দিকেও চলছে তোড়জোড়। আলো আর আঁধারের দুটি দল। তারা পরস্পরের শত্রু। দিন আর রাতের মত। অসুর আর দেবতাদের মত। এখনি বোধহয় বেধে যাবে যুদ্ধ যা অনন্ত কালের আলো আঁধারের বিরোধ। কেন? কিসের জন‍্য যুদ্ধ তা জানি না। বোধহয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একে অপরকে পরাস্ত্র করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সে জগতে। তাই আঁধার আলোকে গ্রাস করতে চায় সর্বদা। আর আলো অন্ধকারকে প্রতি হত করে চলেছে সর্বদা। একজন হল ধ্বংসের প্রতীক। আর অন‍্য জন সৃষ্টির। আমি অহিংস। হিংসাকে পছন্দ করি না আর প্রশ্রয় দিই না। তাই আমার ওই যুদ্ধ দেখার আর আগ্রহ থাকলো না। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম টেলিস্কোপ থেকে।


 



কিছু পলাশের নেশা - সুমিতা চৌধুরী || Kichu Polasher nesha - Sumita Chowdhury || অনুগল্প || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 কিছু পলাশের নেশা

   সুমিতা চৌধুরী


 শরৎ বিদায়ের পর ভোরের শিশির মাখছে সবে তৃণদল। উত্তুরে হাওয়া ফিসফিসিয়ে কথা কইছে প্রকৃতিতে। চারিদিকে নতুন আমন ধান মাথা দোলাচ্ছে আনন্দে। উৎসবেরই গন্ধ মেখে প্রকৃতি যেন গ্রাম বাংলাকে বলছে, "আসছে যে নবান্ন/ শোন, তোকেই শুধু বলি/ সাদরে বরণ করতে তাকে/ খুলিস মনের ডালি।"


  দোলাদের বাড়িতেও এবার যেন নবান্ন আরো রঙিন। পলার সদ্য বিয়ে হয়েছে, তাই নতুন আত্মীয়কুটুম্বরা সবাই নিয়ন্ত্রিত। নবান্ন শুরু হওয়ার আগে-ভাগেই দিদি, জামাইবাবু আর দিদির ছোট দেওর পলাশ এসে উপস্থিত হওয়ায় বাড়ি সরগরম হয়ে উঠল।


শহুরে পলাশদের গ্রাম দেখানোর দায়িত্ব পড়ল দোলার কাঁধেই। যদিও এ কাজ পলাই করতে পারত আজন্ম গ্রামে থাকার সুবাদে, কিন্তু তার জীবনের নতুন ফাগুন হাওয়ায় সদ্য সওয়ার সে, তাই উপরি দায়িত্ব দিতে চাইল না কেউই এই উৎসবের আবহে। অগত্যা দোলাকেই সেই দায়িত্ব পালন করতে হলো। 


পলা আর আকাশকে কিছুটা তফাতে রেখে পলাশ দোলার সাথেই গ্রাম দেখছে আজ দিন দুই/তিন। নতুন পরিবেশ, নতুন প্রকৃতির মাঝে কখন যেন তার শহুরে মনটায় গ্রামের বাউল বাতাস ফেরারী হওয়ার ডাক দিল। দোলার সাথে গ্রাম দেখার মাঝে দোলার চোখেই এ পৃথিবী দেখার অদম্য সাধ জাগলো তার। ওদিকে দোলার মনেও হেমন্তেই বসন্ত বাতাস দোলা দিয়ে গেল পলাশের অনুরাগে।


 বাতাসের কানাকানি থেকে দুই পরিবারে জানাজানি হতে বেশী সময় লাগল না। নবান্নের নতুন ধানের গন্ধের সাথেই মিশে গেল নতুন প্রেমের আতর গন্ধও। এক উৎসবের রেশ নিয়ে আরেক উৎসব সাজল অচিরেই পলাশের রাঙা নেশায়।

Thursday, October 24, 2024

এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী - শ্রাবনী আচার্য্য || Ek obishashyo kahini - Sharabani acharya || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

     এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী 

                       শ্রাবনী আচার্য্য


সাল টা ছিল ২০১৬।আমি হরিয়ানায় বি.এড এ পাঠরত ছিলাম।পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেই শুনলাম বাবা মা আমাকে না জানিয়েই পুরী বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।শুনে খুব খুশিই হলাম,কারণ আমি ভূগোলের ছাত্রী,বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।তার ওপর বেড়ানোটা যদি পরিবারের সাথে হয়,তাহলে তো একদম সোনায় সোহাগা।যাইহোক,যথারীতি লক্ষী পুজোর পরের দিন আমরা পুরী যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।বাসে উঠেই দেখি প্রায়৬০জন মতো রয়েছেন।সবাই বাবার পরিচিত,কেনকি বাবা ডাক্তার।তাই বাবার খাতিরে,ওনার মেয়ে এবং স্ত্রী হিসেবে আমার আর মায়ের সাথেও ওনাদের আলাপ হয়ে গেল।রাত ১০ তার সময় বাস ছাড়লো রামনগর থেকে।

পরেরদিন ভোরবেলা আমরা নন্দনকানন এ পৌঁছলাম এবং ওখানে চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখলাম।বিকেলে আমরা পুরী পৌঁছলাম।যেহেতু আমরা ট্রাভেলার দের সাথে গেছি তাই পুরীতে থাকার জন্য আমাদের ২দিন বরাদ্দ ছিল।তারপর কোনারকের সূর্য মন্দির,খন্ড গিরি,ধবলগিরি,ভুবনেশ্বর এর লিঙ্গেস্বর মন্দির -এসব ঘোরার পর এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা।৬দিন পর আমরা যখন ওড়িশা দিয়ে বাড়ি ফিরছি তখন বিকেল ৫টা বাজে।ওই রাস্তায় নাকি তারিনী মায়ের মন্দির পড়ে।বাসের সবাই বলছিলেন তারিনী মা নাকি খুব জাগ্রত,ওখানে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবেন।অগত্যা বাসের ড্রাইভার কাকু ওই মন্দিরের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেন।আমরা সবাই নেমে একে একে মন্দিরের দিকে রওনা দিচ্ছি।মন্দিরে ঢোকার মুখেই কয়েকজন ১৫-১৬বছরের ছেলে পুজোর ডালা সাজিয়ে বিক্রি করছে।একটা লাল ওড়না,একটা গোটা নারকেল,আর কিছু ফুল,বেলপাতা ও সিঁদুর ছিল ওই ডালা গুলোতে।যথারীতি আমরা একটা ডালা কিনে পুজো দেয়ার জন্য মন্দিরের মধ্যে ঢুকলাম।মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি,মন্দিরটা বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে।একটা ঘরের মাঝে তারিনী মায়ের মূর্তি রয়েছে,আর মায়ের চারদিকে প্রায় ১০ইঞ্চি দূরত্বে গোল করে পুরোহিতরা বসে রয়েছেন।আমরা একজন পুরোহিত কে পুজোর ডালা ধরিয়ে দিতেই উনি লাল ওড়নাটা নারকেল এর গায়ে বেঁধে দিলেন,তারপর নারকেল টাকে ফাটিয়ে তার জল টা তারিনী মায়ের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন,আর ফুল বেলপাতা ও ওড়না জড়ানো নারকেল এর টুকরো মায়ের কাছে নিবেদন করলেন মায়ের দিকে ছুড়ে ছুঁড়ে।এরকম পুজো দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো আমার।৫মিনিটের মধ্যে পুজোও শেষ হয়ে গেল।তারপর মন্দিরের ভেতরটা আর একটু ভালো করে ঘুরে নিয়ে, মাকে প্রণাম করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।মন্দিরের বাইরে এসে দেখি ফুলের ডালা বিক্রেতা ছেলেটার সাথে আমাদের বাসের ড্রাইভার কাকুর কোনও কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে,আর একটু এগিয়ে  এসে শুনলাম যে-বাসের ড্রাইভার কাকুএকজন মুসলিম ধর্মের মানুষ। তাই ওকে পূজার জন্য ডালা নিতে বললে কাকুটি রেগে ওর পরিচয় দিয়ে বলেন-আমি তো মুসলিম, কি করে তোমাদের মন্দিরে পূজো দেব?তুমি ডালা রেখে দাও ভাই, আমি পূজো দেব না।আমরা কিছু না বলেই চলে এলাম এবং যথারীতি বাসে উঠে নিজেদের জায়গায় গিয়ে  বসলাম।সবাই  না এলে তো বাস ছাড়বে না,তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম চিপস খেতে খেতে।২০-২৫মিনিটের মধ্যে সবাই  বাসের মধ্যে চলে ও এলেন।এবার বাস ছাড়ার পালা,আর কোথাও নামবার নেই, সোজা বাড়ি যাব। হালকা ঠান্ডাও পড়ছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো।আমরা সবাই এসে গেছি,ড্রাইভার কাকুও এসে গেছেন, কিন্ত বাস ছাড়ছে না কেন?সবাই পেছনের সিট থেকে বলছেন-কি হল গাড়ী ছাড়ুন,সবাই এসে গেছে তো,আর কেউ বাকি নেই তো।কিন্ত গাড়ি ছাড়ছে না দেখে বাবা উঠে গেলেন ড্রাইভার কাকুর কাছে। কি হয়েছে, গাড়ি ছাড়ছেন না কেন জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার কাকু বাবাকে বললেন- জঙ্গল এলাকা,জায়গাটা ভাল নয়,আমি তো আপনাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইছি।কিন্ত বাস টা যে কেন স্টার্ট নিচ্ছে না বুঝতে পারছি না।এটা শুনেই তো আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল।এই অচেনা অজানা জায়গায় কী এই বাসের মধ্যেই সারারাত থাকতে হবে নাকি?বাসটা আর খারাপ হওয়ার জায়গা পেলো না?এই জঙ্গলের মধ্যেই তাকে খারাপ হতে হলো?এখন কি হবে?আমরা বাড়ি যাব  কি করে?ধারে কাছে কোনও দোকান ও নেই যে কোনো মেকানিক কে ডেকে গাড়িটা সারিযে নেওয়া যায়।বাসের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষ ও ছিলেন, তারা প্রায় হই হটোগোল ফেলে দিলেন চারদিকে।আবার কিছু কুসংস্কার মাখা কথাও শোনা গেল,যেমন-কেউ হয়তো অপবিত্র ছিল?বা কেউ কোনও  দোষ ত্রুটি করে ফেলেছে?তাই তারিনী মা রেগে গিয়ে গাড়ি খারাপ করে দিয়েছেন। এইসব শুনে আমার প্রথমে হাসিই পাচ্ছিল। তারপর এই হাসিটাই মিলিয়ে  গেল যখন ব্যাপার টা আরও গুরুতর হয়ে উঠল। ড্রাইভার কাকু তখন পাশেই একটা ছেলেকে ডেকে বললেন-পাশাপাশি কোন মেকানিক আছে কিনা খবর দিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারবে?আমরা খুব বিপদে পড়েছি।তখন ছেলেটি বলল আছেন একজন,১০-১৫মিনিট লাগবে,আমি ডেকে নিয়ে আসছি।যথারীতি ২০মিনিট বাদে একজন মেকানিক কাকু এলেন। উনি অনেকক্ষন দেখার পর বললেন-কই বাসে তো আমি কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না,বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন?স্টার্ট না নেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। উনি প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলন,কিন্ত কোনও ফল পাওয়া গেল না।তখন ওই মেকানিক কাকু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আমার মালিক কে ডাকছি,যদি পারেন তো উনিই পারবেন,তা না হলে আর কিছু করার নেই। উনি ওনার মালিক কে ফোন করার প্রায় ২৫মিনিট পর ওনার মালিক এলেন।উনিও প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলেন, বললেন- না,বাসে কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন  বুঝে উঠতে পারছি না।তারপর উনি হঠাৎই বললেন ড্রাইভার কাকুকে- যে আপনাদের কোনও ভুল ত্রুটি হয় নি তো?সবাই মায়ের পূজো দিয়েছিলেন?মা কিন্ত খুব জাগ্রত, রেগে গেলে কাউকে ছাড়েন  না।আমি তো খুব অবাক হয়ে গেলাম ওনার কথা শুনে,ভাবলাম ড্রাইভার কাকু তো পুজো দেয়নি,তাই কি মা রেগে গেছেন?তখন দেখি হঠাৎ করে ড্রাইভার কাকুর চোখে জল,উনি বলেন আমি মুসলিম, তাই আমি ফুলের ডালা কিনে মায়ের পুজো দিতে চাইনি।তাই কি মা আমার ওপর রাগ করলেন?তখন মালিক মেকানিক কাকু বললেন- আমাদের তারিনী মা,সবার মা।উনি জাতপাত মানেন না,সবাই ওনার  সন্তান। আপনি শিগগির  যান,স্নান করে ফুলের ডালা নিয়ে মায়ের পুজো দিয়ে আসুন।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।অগত্যা  ড্রাইভার কাকু ছুটে গিয়ে পাশেই একটা নদীতে ডুব দিয়ে একটা ফুলের ডালা কিনে মন্দিরে ঢোকার ৫মিনিটের  মধ্যেই মালিক মেকানিক কাকু গাড়ি স্টার্ট দিতেই, বাস সঙ্গে সঙ্গেই স্টার্ট নিল।তখন বাসের সবাই অবাক। আমার তো গায়ে প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল।তারপর যথারীতি আমরা তারিনী মা কে স্মরণ করে ৭'৩০মিনিটে বাসে রওনা দিলাম। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।আমরা অনেকে বিশ্বাস ই করি না ভগবান আছেন বলে।কিন্ত সেদিন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম যে-না,ভগবান আছেন ই।আর যে জাতপাত নিয়ে সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে এত ভেদাভেদ, তারিনী মা আমাদের চোখের সামনে থেকে সেই ভেদাভেদ দূর করে দিলেন।তিনি জানালেন যে- "সবাই এক,সবার রক্ত এক,সবার একটাই পরিচয়-সবাই মানুষ। "


অরণ্যের প্রতিশ্রুতি - প্রণব কুমার কুন্ডু || Oronner protisruti - Pranab kumar kundu || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

                     অরণ্যের প্রতিশ্রুতি

                        প্রণব কুমার কুন্ডু 

  

সন্ধ্যার আকাশে লাল আভা যখন ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে, তখন গ্রামের সীমানায় অবস্থিত বিশাল অরণ্য যেন নিজের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে জেগে ওঠে। সূর্যের শেষ রশ্মি গাছের পাতার উপর দিয়ে হালকা সোনালি আভায় ছড়িয়ে পড়ে, এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। অরণ্যটি ছিল গ্রামের লোকদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ঠিক যেন তাদের পুরনো এক বন্ধু। অরণ্য শুধু তাদের জীবিকা নয়, তাদের রক্ষাকবচও। গাছের ছায়া, পাখির গান, আর সবুজে ভরা অজস্র প্রাণী মিলে এখানে অদ্ভুত সাম্যতা তৈরি হয়েছিল। 


গ্রামের লোকেরা প্রতিদিনের কাজ শেষে যখন অরণ্যের দিকে তাকাত, তাদের মন অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যেত। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন তারা ঘরে ফিরত, অরণ্যের স্নিগ্ধ বাতাস তাদের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিত। এই অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করা, ফল-মূল তোলা, এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে আসা ছিল তাদের রোজকার কাজ। অরণ্য তাদের অভয়ারণ্য, যেখানে দুঃখ-দুর্দশার ছায়া পড়ে না। কিন্তু সময়ের প্রবাহে, তাদের এই প্রিয় অরণ্য ঘিরে বিপদ দানা বাঁধতে শুরু করে।


শহরের দৃষ্টি পড়ল অরণ্যের ওপর। বড় ব্যবসায়ী আর আধুনিক স্থাপত্যের কারিগরদের চোখ পড়ল। একদিন, একজন ধনী ব্যবসায়ী গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। "আপনারা জানেন, এই অরণ্য যদি কেটে ফেলা হয়, তবে এখানে বড় বড় দালান-কোঠা গড়ে তোলা যাবে। আধুনিক রাস্তা হবে, নতুন নতুন কাজের সুযোগ হবে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে যাবে। আপনারা শুধু এই সুযোগটা নিন," তিনি তাদের বোঝাতে লাগলেন। 


গ্রামবাসীরা তাঁর কথায় হতবাক হল। এতকাল ধরে তারা অরণ্য থেকে যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আধুনিক জীবনের প্রলোভন, আর তার সঙ্গে ব্যবসায়ীর কথার মাধুর্য, তাদের বিভ্রান্ত করল। কিছুদিন গ্রামে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলল। গ্রামবাসীদের মাঝে মতভেদ দেখা দিল। কিছু লোক ব্যবসায়ীর প্রস্তাবে রাজি হল, আর কিছু লোক দ্বিধাগ্রস্ত রয়ে গেল। 


গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি দীনেশ মশাই চুপচাপ সব শুনলেন। তিনি জানতেন, অরণ্য শুধু তাদের জীবনযাত্রার অংশ নয়, এটা তাদের ইতিহাস, তাদের পরিচয়। তিনি গ্রামবাসীদের সতর্ক করতে চাইলেন, কিন্তু গ্রামের তরুণ প্রজন্ম ব্যবসায়ীর প্রলোভনে পড়ে গেল। "আমাদের ভবিষ্যতের জন্য উন্নতি দরকার," তারা বলল। "আধুনিক শহরের সুবিধা পেলে আমরা উন্নত জীবন পাব।" তাদের কথা শুনে গ্রামবাসীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। অরণ্য থেকে পাওয়া সেই স্নিগ্ধ বাতাস, পাখিদের গান, মাটির সুগন্ধ—সবই যেন তারা ভুলতে বসল।


দীনেশ মশাই গ্রামবাসীদের ডেকে বললেন, "তোমরা যদি অরণ্য নষ্ট করতে চাও, তবে একবার ভেবে দেখো, আমরা কী হারাব। আমাদের জীবনযাত্রার মূলভিত্তি এই অরণ্য। একে রক্ষা করতে না পারলে, ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানেরা কী নিয়ে বাঁচবে?" কিন্তু যুবকেরা তাঁর কথায় তেমন গুরুত্ব দিল না। আধুনিক জীবনের মোহ তাদের আচ্ছন্ন করল। গ্রামের বাকিরাও মনে করল, একটু উন্নত জীবন পেলে মন্দ হবে না। 


অরণ্য কেটে ফেলার কাজ শুরু হল। প্রথমে গাছগুলো কাটা শুরু হল, তারপর মাটি খুঁড়ে শিকড়গুলো তুলে ফেলা হল। ক্রমে ক্রমে অরণ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা খালি হতে লাগল। গাছগুলোর পতনে অরণ্যের প্রাণীরা উদ্বিগ্ন হল। তারা তাদের বাসস্থান হারাচ্ছিল, আশ্রয়ের অভাবে নতুন করে জীবন যাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পাখিরা তাদের ছোট্ট বাসাগুলো নিয়ে দূরে উড়ে গেল, হরিণেরা অস্থির হয়ে দৌড়াতে লাগল। 


দিন গড়িয়ে মাস গেল, শহরের লোকেরা আসতে থাকল। তাদের হাত ধরে এল মেশিন, যন্ত্রপাতি, আর বড় বড় ট্রাক্টর। অরণ্য একসময় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেল, তার জায়গায় তৈরি হতে লাগল বড় বড় দালান, রাস্তা, আর মেটালিক স্থাপত্য। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতা হারিয়ে যেতে লাগল। 


প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার অভ্যাস আছে। একদিন সন্ধ্যায়, যখন গ্রামে মেঘ জমেছিল, গ্রামের লোকেরা দেখল আকাশের অদ্ভুত এক কাণ্ড। কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, হাওয়া বইছে দ্রুত। একটু পরেই শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। অরণ্য তো আর ছিল না, তাই পাহাড়ের মাটি ধসে গ্রামের দিকে নেমে এলো। গ্রামের প্রায় অর্ধেক অংশ মাটির নিচে চাপা পড়ে গেল। যারা বাঁচল, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা ভাবল, এত বড় বিপদ এল কোথা থেকে?


দিনের পর দিন বৃষ্টি হলো, জলের স্তর ক্রমশ বাড়ল। গ্রামের পুরোনো কাঁচা বাড়িগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করল। মাটি ধসিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গ্রামের কিছু অংশ টিকে থাকল শুধুমাত্র পুরোনো কিছু গাছের জন্য, যারা তাদের শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে রেখেছিল। সেই গাছগুলোই মাটি ধরে রাখার শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়াল। 


যে মুষ্টিমেয় গাছ বেঁচে ছিল, তাদের যেন এক অলৌকিক শক্তি কাজ করল। বুড়ো দীনেশ মশাই, যিনি গ্রামবাসীদের সতর্ক করেছিলেন, সেই বাকি গাছগুলোর কাছে গিয়ে তাদের সেবা করতে লাগলেন। তিনি গাছের পাতায় জল ছিটিয়ে বললেন, "তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমরা ভুল করেছি। তোমরা আমাদের প্রাণ বাঁচাও, তোমাদের ফেরানো আমাদের একমাত্র উপায়।"


গাছগুলো যেন সেই প্রার্থনা শুনল। কিছুদিন পর বৃষ্টি থেমে গেল, জলের স্তর নামতে শুরু করল। গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে গেল। তারা ভাবতে শুরু করল, এই গাছগুলোর মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? তাদের জীবনের এই নতুন শুরুর জন্য তারা গাছের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করল। 


গ্রামবাসীরা প্রতিজ্ঞা করল, এবার থেকে তারা কখনও প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা করবে না। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখেই তাদের জীবনযাত্রা সুখের হতে পারে। বুড়ো দীনেশ মশাই গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে বললেন, "প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখেই তোমরা জীবনের উন্নতি করতে পারবে। আধুনিক জীবন গাছ কেটে অর্জন করা যায় না, প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।" 


বছর ঘুরতেই অরণ্য আবারও সবুজ হয়ে উঠল। গাছেরা ছায়া দিতে লাগল, বাতাসে আবারও সেই প্রাচীন শীতলতার পরশ ফিরে এল। গ্রামের বাতাসে মাটির গন্ধ ফিরল, পাখির গান শোনা যেতে লাগল। যে সবুজের অভাব গ্রামের মানুষ অনুভব করছিল, তা যেন আবার ফিরে এল। অরণ্যের মাটি শক্ত হয়ে দাঁড়াল, ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করল। 


তবে শুধু অরণ্যই নয়, গ্রামবাসীদের মধ্যে এক নতুন বোধের জন্ম হলো। তারা অনুভব করল, প্রকৃতি তাদের অংশ, এবং এর ক্ষতি করলে তার প্রতিক্রিয়াও ভয়াবহ হতে পারে। তারা বুঝতে পারল যে প্রকৃতির দান কেবল নেয়ার নয়, তাকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বও মানুষের। 


গ্রামের পুরোনো ঐতিহ্যগুলো আবারও ফিরে আসতে লাগল। উৎসবের সময়, অরণ্যের গাছগুলোকে সজ্জিত করে রাখার রীতি আবার ফিরিয়ে আনা হল। পাখির বাসার দিকে নজর রেখে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হল, যেন তারা নিরাপদে থাকতে পারে। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল যে শুধু নিজের লাভের জন্যই কাজ করা উচিত নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা সবার দায়িত্ব।


এক ভ্রমণকারী একদিন গ্রামে এসে পৌঁছাল। গ্রামের মাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে সে চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হল। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সবুজের ছোঁয়া, গাছের ছায়া, আর বাতাসে মিশে থাকা মাটির গন্ধ যেন তার মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি গাছ যেন কোনো না কোনো গল্প বলছে। সে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে চাইল, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিল।


গ্রামে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল, কাঁচা রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পাখিরা গাছে গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাতাসে তাদের মিষ্টি গান শোনা যাচ্ছে। ভ্রমণকারী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করল। বাতাসে একটি নিঃশব্দ নৃত্য চলছিল, পাতা ও পুষ্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীরা যেন নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে ব্যস্ত। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ এবং মাঝে মাঝে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া শুকনো পাতার আওয়াজ এক ধরনের মায়াবী অনুভূতির সৃষ্টি করছিল।


এরপর সে গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলল, যারা অরণ্যের ইতিহাস জানতেন। প্রবীণরা তাকে তাদের জীবনের গল্প শোনালেন—কীভাবে এই অরণ্য তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, আর কীভাবে তারা একসময় ভুল করে অরণ্য ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। তারা বললেন, "আমাদের অরণ্য একসময় খুব বিপদে পড়ে গেছিল, আমরা বুঝতেই পারিনি কী ভুল করছিলাম। কিন্তু প্রকৃতির দয়ায় আমরা আবার সেই ভুল শুধরে নিতে পেরেছি।" 


ভ্রমণকারী সেই গল্প শুনে আবেগে আপ্লুত হল। সে গ্রামের মানুষের চোখে অরণ্যের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দেখল। গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন অরণ্যকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, তার প্রতি যত্নশীল। ছোট্ট শিশুরা গাছের নিচে খেলছে, আর বয়স্করা গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে—এমন দৃশ্য দেখে ভ্রমণকারীর মনে হল, সে যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছে, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে এক অপূর্ব বন্ধন আছে।


ভ্রমণকারী গ্রামে আরও কিছু দিন কাটাল। প্রতিদিন সে নতুন কিছু শিখতে লাগল। সকালে যখন গ্রামের মানুষরা ঘুম থেকে উঠত, তখন তারা প্রথমেই অরণ্যের দিকে তাকাত। তারা জানত, তাদের দিন শুরু হয় অরণ্যের আশীর্বাদ নিয়ে। গ্রামের লোকেরা অরণ্যের প্রতিটি অংশকে গুরুত্ব দিত, এমনকি ক্ষুদ্র পোকামাকড়দেরও রক্ষা করার চেষ্টা করত। ভ্রমণকারী দেখল, গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত অরণ্যের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা নিজেদের হাতে গাছ লাগানোর আনন্দ উপভোগ করে, আর মাটির সঙ্গে খেলে। সেই শিশুদের মধ্যে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির মোহ ছিল না, তারা প্রকৃতির সঙ্গেই বড় হচ্ছে। 


একদিন বিকেলে, ভ্রমণকারী গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, কিছু গ্রামবাসী অরণ্যের মাঝে বসে আছে। তাদের চারপাশে কিছু গাছের চারা রাখা, আর তারা সেই চারাগুলো রোপণ করছে। ভ্রমণকারী কাছে গিয়ে জানতে চাইল, তারা কী করছে। এক যুবক বলল, "আমরা নতুন গাছ লাগাচ্ছি, যাতে অরণ্য আরও সবুজ হয়ে ওঠে। আমরা বুঝেছি, অরণ্য আমাদের বাঁচিয়েছে, এখন আমাদের দায়িত্ব তাকে আরও শক্তিশালী করা।"


ভ্রমণকারী এই কাজ দেখে মুগ্ধ হল। সে ভাবতে লাগল, কীভাবে আধুনিক জীবনের প্রলোভন থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামবাসীরা নিজেদের প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। সে মনে মনে ভাবল, "এটাই তো প্রকৃত উন্নতি। আমরা আধুনিকতার নামে যে ধ্বংস করছি, সেই ধ্বংসই আমাদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। এই গ্রামের মানুষরা প্রকৃতির প্রকৃত রূপ বুঝতে পেরেছে।" তার মনে হল, এই গ্রাম থেকে সে যে শিক্ষা নিচ্ছে তা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তার। 

গ্রামে কাটানো এই ক'দিনের অভিজ্ঞতা ভ্রমণকারীকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সে তার নোটবুকে লিখল, "এই গ্রামের মানুষরা আমাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। আমরা আধুনিকতার নামে যা কিছু করছি, তা প্রকৃতির উপর এক নীরব আঘাত। কিন্তু এই গ্রামে এসে আমি শিখেছি, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই আসল শান্তি। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে।"


ভ্রমণকারী যখন গ্রাম থেকে বিদায় নিল, তখন সে প্রতিজ্ঞা করল, সে এই শিক্ষা পৃথিবীর আরও মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। সে তার বন্ধুদের, সহকর্মীদের এবং পরিবারের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে। সে বলল, "আমাদের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা তখনই আসে যখন আমরা প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকি। অরণ্য আমাদের শুধু জীবন দেয় না, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সুন্দর করে তোলে।"


তার এই প্রতিজ্ঞা শুধু তার নিজের জীবনেই নয়, শহরের মানুষের মনেও দাগ কাটল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতিকে ছাড়া জীবন কতটা অর্থহীন। তারা ঠিক করল, নিজেদের শহরেও একইভাবে প্রকৃতির সুরক্ষা করতে হবে। তারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিল, নতুন গাছের যত্ন নেওয়ার পরিকল্পনা করল, আর পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিল। শহরের মানুষেরা প্রথমে যে সকল গাছকে উপেক্ষা করেছিল, তারা তাদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করল। নতুন উদ্যমে তারা একতা বজায় রেখে সেই গাছগুলোকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিল।


অন্যদিকে, গ্রামে ফিরে আসা ভ্রমণকারীর অনুপ্রেরণায় গ্রামের মানুষরা আরও সতর্ক হয়ে গেল। তারা নতুন উদ্যমে অরণ্যের যত্ন নিতে লাগল। তারা জানত, এই অরণ্য তাদের জীবন রক্ষা করেছে, আর তারা তা কখনও ভুলবে না। গ্রামের মানুষরা অরণ্যকে ঘিরে নানা উৎসবের আয়োজন করল। পাখির বাসার দিকে তারা আরও যত্নবান হলো, তাদের খাবার ব্যবস্থা করতে থাকল। গ্রামের শিশুদেরও অরণ্যের সুরক্ষা সম্পর্কে শেখানো হলো, যেন তারা বড় হয়ে এই অরণ্যকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে। শিশুরা প্রথমবার অরণ্যের অভ্যন্তরে রোপণ করা গাছগুলোর ফুল ফুটতে দেখল, এবং তাদের মুখে খুশির ঝিলিক ধরা পড়ল।


গ্রামের মানুষের এই প্রচেষ্টা শুধু তাদের জীবনেই নয়, আশেপাশের গ্রামের মানুষদেরও উদ্বুদ্ধ করল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্যমে তারা নিজেদের গ্রামেও গাছ লাগাতে শুরু করল। তাদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ জন্ম নিল।


ভ্রমণকারীর ফিরে যাওয়ার পরেও গ্রামে নতুন নতুন মানুষ আসতে থাকল। তারা এসে বুঝতে পারল, এই গ্রাম শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থান নয়, এটি একটি জীবন্ত উদাহরণ যে কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা যায়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এসে তারা এখানে প্রকৃতির অমোঘ শক্তি এবং জীবনের সত্যিকারের মানে খুঁজে পেল। গ্রামবাসীদের আন্তরিকতা, তাদের অরণ্যের প্রতি ভালোবাসা এবং প্রকৃতির প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস দেখে শহরের মানুষদের হৃদয়েও পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। 


গ্রামটি একসময় আড়ালে ছিল, কিন্তু এখন এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও এই গ্রামের অনুপ্রেরণায় নিজেদের অরণ্য রক্ষার উদ্যোগ নিতে শুরু করল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির সুরক্ষাই তাদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখার একমাত্র উপায়। গ্রামটি ধীরে ধীরে একটি প্রতীক হয়ে উঠল—একটি প্রতীক যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি একত্রে সহাবস্থান করতে পারে, যেখানে অরণ্য শুধু জীবিকা নয়, জীবনকেও পূর্ণতা দেয়।




অন্তরীন - অসীম কুমার সমাদ্দার || Ontorin - Ashim Kumar Samadar || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 অন্তরীন

   অসীম কুমার সমাদ্দার



আজ ঋত্বিকের অর্থাৎ আমার সত্তর পূর্ণ হল। মালা পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছে তাও প্রায় বছর আটেক হয়েছে । মালা এই দিনটা খুব ধুমধাম করে পালন করতো । আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতো , সারা সকাল ধরে অনেক পদ রান্না হতো আর রাতে নিজের হাতে খাওয়াতো।

 রাতে সবাই হই- হুল্লোড় করে বাড়ি ফিরে গেলে বলতো আরো একটা বছর শেষ হয়ে গেলো , কেন এতো তাড়াতাড়ি বছর শেষ হয় ! মালাকে বোঝাতাম এটাই স্বাভাবিক , ও চুপ করে থাকতো । আসলে আমার প্রতিটি ব্যাপারে ও খুব সিরিয়াস ছিল । কোন পাজামা পাঞ্জাবিতে আমাকে ভালো লাগবে , প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে শার্ট , ভালো সুগন্ধী , খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি সবকিছুতেই ওর বিশেষ দৃষ্টি ছিল । অনেকবার আমার জন্মদিনের সময় ছেলে বরুন , ছেলের স্ত্রী শ্রী রাধা ওদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে যখন মুম্বাই থেকে আসতো , মালার খুব আনন্দ হতো । প্রতিবছর আমার জন্মদিনের আগে ও বরুন আর রাধাকে বারবার ফোন করে আসার জন্য বলতো । একসময় ওরা আসা ছেড়ে দিল , মালার খুব কষ্ট হতো প্রথম প্রথম , শেষে আর ফোন করতো না । দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো এটা নাকি আমাদের কপাল ! আমি ওকে বোঝাতাম এত দূর থেকে একগাদা টাকা খরচা করে বাবার জন্মদিনে বারবার আসা সম্ভব না ।

 মালা সবাইকে নিয়ে থাকতে , আনন্দ করতে ভালোবাসতো । আমাদের যৌথ পরিবার যখন ভেঙে যায় , ও খুব কষ্ট পেয়েছিল । ওকে অনেক বোঝাতে হয়েছিল । ছেলে আগে বছরে তিনবার আসতো বাড়িতে , শেষে কমতে কমতে দু' বছরে একবারও হতো না । ফোনেই খোঁজখবর চলতো । মালা এতো কষ্ট পেয়েছিল যে ভিতরে ভিতরে ওর ক্ষয় শুরু হয় । আমি ওকে বাইরে ঘুরে আসার কথা বললেও যেতে চাইতো না । কেমন যেন ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে গেলো চোখের সামনে । শেষে একদিন চলে গেলো অভিমানে । ছেলে ওর পরিবার নিয়ে এসেছিল শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ।

 মিটে গেলে আমি একদম একা হলাম , সেই থেকে আমি আর কোথাও যাই না , ঘরই আমার সব আর মালার স্মৃতি আমার একমাত্র অবলম্বন । ঘরেই অন্তরীন হয়ে আছি আজ প্রায় আট বছর মালার চলে যাওয়ার দিন থেকে ।