Tuesday, September 6, 2022

ছোট গল্প - কৃষ্ণগোপাল ও অনুরাধা || লেখক - চন্দন চক্রবর্তী || Short story - Krishnagopal oo Onuradha || Written by Chandan Chakraborty


 


কৃষ্ণগোপাল ও অনুরাধা

চন্দন চক্রবর্তী



হিরন্ময়ের কাছে খবর পেলাম অনুরাধা মারা গেছে । অনুরাধা বেঁচে থেকেও তার মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছিল । অমানুষিক পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে গেছে আগেই । শেষে তিলে তিলে একাকিত্বের কষ্টে তার মনের মৃত্যু হয়ে আজ সে চিরতরে মুক্তি পেল,বলা চলে । 



মনে আছে আমার বন্ধু,বিখ্যাত সেতারী হিরন্ময় গাঙ্গুলীর বাড়িতে সেদিন বহু সম্মানে ভূষিত বিখ্যাত বাঁশি বাদক কৃষ্ণগোপালের একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল । নিমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম সেই আসরে । শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে,"সংগীত সাধনায় ফল লাভ অনেক জন্মের ফল",হিরন্ময়ের এই কথাটাকে অতিশয়োক্তি মনে হয়েছিল । আমার মনে হয় সাধনার সঙ্গে প্রতিভার মিলন হলে তার নব নব উন্মেষ ঘটে । ফলে নব নব চেতনা জাগে,যাকে আমরা নবজন্ম বলে থাকি । কৃষ্ণগোপালকে দেখে আমার ভাবনার সত্যতা খুঁজে পেয়েছিলাম । তাকে ধ্যানি ঋষির মত মনে হয়েছিল । পরে তার বাদন শুনেও আমার তাই মনে হয়েছে । 



হিরন্ময় তার কথার যুক্তির সাপেক্ষে শিল্পীর জীবনের শুরুর দিকের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের ঘটনাগুলো তুলে ধরছিল । টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো জোড়া দিলে বেশ গল্প হয় । তাই ঘরে ফিরে কৃষ্ণ গোপালের জীবনের অংশগুলো জোড়া দিয়ে গল্প লিখেছিলামও,নামগুলো পাল্টে ।



গল্পে কোন নদী ছিল । নাম দিয়েছিলাম যমুনা । নদীর পাড়ে গ্রামের রাখাল ছেলে,পিতৃ মাতৃ হারা,গোপাল প্রভাবশালী ব্রাহ্মন পরিবারে আশ্রিত । তার কাজ বাড়ির গরুগুলো নিয়ে নদীর ধারে চড়াতে নিয়ে যাওয়া । তাকেই গল্পে কৃষ্ণ ধরেছিলাম । গোপালের বাঁশি শেখা তার বাবার বাঁশি শুনেই । নদীর ধারে গাছের নিচে বসে সে সারাদিন বাঁশি বাজাতো । বাঁশিতে জাদু ছিল । যে একবার শুনেছে সেই মোহিত হয়েছে । 



বাড়ির মেয়ে অনুরাধা । গোপালের চেয়ে কিছু বড় । সে গোপালের বাজনা শুনে তার প্রেমে মজেছে । 



অনুরাধা দিদার কাছে রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা শুনেছে । সন্ধ্যাবেলা ধানের গোলার পাশে গোপাল তার ঘরে বাঁশি বাজায় । অনুরাধা অস্থির হয় । বাঁশির সুরে তার চোখে ভাসে যমুনার পাড় । সেখানে কদম গাছের নিচে গোপাল কৃষ্ণ হয়ে বাঁশি বাজায় । গাছে কদম ফোটে । ময়ূর নাচে । নদীর বুকে ঢেউ তুলে বাতাস বয়ে যায় । সে নিজেকে রাধা মনে করে মনে মনে সেখানে উপস্থিত হয় । গোপালই তার কৃষ্ণ ।



তবে সে কেন পারে না মনের মানুষের কাছাকাছি আসতে ! কানু বিনে রাধার যে,'মরনরে তুহু মম শ্যাম সমান" ! বাঁশি শুনলে তার যে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা !



মনে যখন যমুনা বয় তখন প্রেমের জোয়ারে তারা ভেসে যাবে সে আর বেশি কি ! শত বাঁধা থাকলেও তারা সুযোগ বুঝে মিলিত হত । গোপালকে সে কৃষ্ণগোপাল নাম দিয়েছিল । আর সে নিজে রাধা । 



কিছুই চাপা থাকে না । গ্রামে রটে যায় তাদের প্রেমের কথা । এই অসম প্রেমে তাদের অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে । অনুরাধাকে ঘরে আটকে থাকতে হয়েছে । গোপালকে তার আশ্রয় হারাতে হয়েছিল । তাকে চাবুক মেরে পথে শুইয়ে রেখে আসা হয়েছিল । তবুও থামানো যায় নি । 



এক ভোরে তারা ঘর ছেড়ে পালিয়ে পথে নেবেছে । 



সেবার গল্পটা নিছক কিশোর কিশোরী প্রেমের গল্প লিখেই শেষ করেছিলাম । 



সেদিনের আসরের পরে তাদের সংসারে অনেক বার গেছি । তখন দুজনের জীবনের অনেকটা খরচ হয়ে গেছে । যেটা জেনেছি, ওরাও পালিয়ে এসে শহরে ঘর বেঁধেছিল । গোপাল ফাংশনে বাঁশি বাজাত । অনুরাধার ছিল ঘরে ছেলে মেয়ে পড়িয়ে,সেলাই করে,রোজগারের চেষ্টা ।



যখনই গেছি অনুরাধা হাসি মুখে আপ্যায়ন করেছে । চা খাইয়েছে । কোন অনুযোগ ওর মুখে শুনিনি । তবে বেশি সময় দিতে পারতো না । মাফ চেয়ে নিত । আমরা কৃষ্ণগোপালের বাজনা শুনে ফিরে আসতাম । এমনও শুনেছি পাছে স্বামীর সাধনায় ক্ষতি হয়,অনুরাধা স্বামীকে শিক্ষকতা করতে দিত না ।



গল্পটা এখানে শেষ হলে মনে হবে কোন পতিব্রতা নারীর ভালোবাসার গল্প ।



না আমার তা মনে হয় নি । কৃষ্ণগোপালকে বরাবর স্বার্থপর মনে হয়েছে । কোনদিন স্ত্রীর ত্যাগের কথা তাকে বলতে শুনিনি । অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে দেখিনি । সংগীত ছাড়া তার অন্য দিকে কোন নজর ছিল না । এক কথায়,অনুরাধা অবহেলিত । অত্যাধিক খাটুনিতে সে বিছানা নিয়েছিল । কাজেই অনুরাধার মৃত্যুর পর দিন থেকে রাগ করে কৃষ্ণগোপালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি,খোঁজও করিনি ।



শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে যাবার পরে মাস ফুরোয়নি, হিরন্ময়ের ফোন পেলাম । বারবার যেতে বলছে । কারন না শুনেই ওকে আমার অনিচ্ছার কথা জানাতে,ওর কাছে ধমক খেলাম । ভালো করে এবার শুনে চমকে উঠলাম । কৃষ্ণগোপাল পাগল হয়ে গেছে !



যেতে হল । এই কদিনে কৃষ্ণগোপালের এত পরিবর্তন হয়েছে আগের থেকে চেনা না থাকলে কেউ চিনতে পারবে না । 



স্ত্রী অনুরাধার মৃত্যুর দিন থেকেই লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল । বাঁশিগুলো ভেঙে আগুনে পুড়িয়েছেa । নিজের গায়েও আগুন লাগাতে গিয়েছিল । বাড়িওলার চেষ্টায় পাড়ার ছেলেরা পাহারায় থেকে রক্ষা পেয়েছে । এখন সে কাউকে চিনতে পারে না । খায় না । পায়খানা প্রস্রাব বোঝে না । একদম বদ্ধ উন্মাদ।


ডাক্তারি পরামর্শে আমি আর হিরন্ময় কৃষ্ণগোপালকে বহরমপুর পাগলা গারদে রেখে এলাম । বিকট শব্দে করে হা হা করে তখনও হাসছে । তার হাসিতে প্রচ্ছন্ন কান্না এসে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল । কান্না সামলাতে পারলাম না । কানে তখনও হা হা শব্দ প্রকট ।



Monday, September 5, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -18


 


নিজের ভুল সংশোধন করবার পর শেষ সম্বল মা মরা মেয়েটাকে বাঁচাবার কসুর করলাম না । অনেক ডাক্তারকে চিকিৎসা করালাম কোন ফল হলো না । আমিও দু'বছর ডাক্তারি পড়েছিলাম , কিন্তু নিজের নৈতিক অধঃপতনকে ডেকে এনে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ঢেকে দিলাম ব্যাভিচারের ঘন কৃষ্ণ মেঘে।


 একদিন বিশিষ্ট অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনুরোধ করলাম যাতে মেয়েটাকে বাঁচানো যায় । সকলেই ভালোভাবে পরীক্ষা ও ব্যাক হিষ্টি শুনে সাজেশন দিলেন বা তারা একযোগে এই মত প্রকাশ করলেন যে , শিশুটি যদি কোন মেয়েকে নিজের মা বলে মেনে নিতে পারে , তাহলে শিশুটি বেঁচে যাবে । কারণ মেয়েটির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিল । আপনাকে এমন এক মহিলার সন্ধান করতে হবে যার সঙ্গে আপনার স্বর্গত পত্নীর চেহারায় অনেকটা সাদৃশ্য আছে। 


বিচিত্র আমাদের দেশ । এই দেশে বিভিন্ন চেহারার মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন । এমন কথা নয় যে ময়নার মায়ের মতো এ্যাকজাক্ট দ্বিতীয় কোন মেয়ে জন্মগ্রহণ করেনি । অনেক সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে যে একই চেহারায় অনেক নারী এবং পুরুষকে অবশ্য ওরা কেউ কারো সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্কে আবদ্ধ নয় । সুতরাং দেবীবাবু যদি একটু চেষ্টা করেন , তাহলে তার স্ত্রীর অনুরূপ চেহারার নারী পেতে পারেন।


 পদ্মাদেবী , সবই তো শুনলেন , ডাক্তারদের কথা মতো আমি বিভিন্ন স্থানে আমার স্ত্রীর মতো একটি রমনী খুঁজে বেড়াতে লাগলাম । কিন্তু কোন ফল হল না । ভাবলাম মেয়েটাকে আর ফিরে পাবো না । তাই মনের দুঃখে , অনুশোচনায় একদিন এই মহানগরীর কোন স্থানে বসে ভাবছিলাম নানান কথা , সেই অবসরে নজরে পড়লো আপনাকে , সাথে আপনার শ্যামলীদিও ছিলেন । কিন্তু তখন ব্যাভিচারিনী বলে বুঝতে পারিনি । কিছু বলার আগে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম । আপনাদের ফলো করলাম , দেখলাম এক কদর্য বঙ্গীতে গিয়ে উঠলেন । ন্যায় অন্যায়ের কোন প্রশ্ন তা তুলেই জেনে নিলাম আপনাদের কথা । আপনাদের আদরি মাসী অর্থ গৃধনু । তারপর আদরী মাসীকে বশীভূত করে আপনাকে আনার সুযোগ খুঁজছিলাম । কিন্তু আপনি ভুল বুঝে , আমাকে অবজ্ঞা করে তাড়িয়ে দিলেন । আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা । মেয়েকে আমার সুস্থ করতেই হবে এবং আপনাকে নিয়ে যেতেই হবে । আমার পত্নী চন্দ্রা ও আপনার মধ্যে চেহারায় এত বেশী সাদৃশ্য যে মনে হয় যেন আপনারা একই মায়ের দুই যমজ কন্যা।


 আপনি আমার প্রতি বিরক্ত বোধ করছিলেন বলে আদরি মাসীকে চেপে ধরেছিলাম । তিনি বলেছিলেন , শ্যামলীদিকে মত করতে । কারণ শ্যামলীর সাথে তার মেলামেশা গভীর । তাই পরদিন শ্যামলীকে সব কথা বললাম । মাতৃহারা ছোট শিশু ময়নাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আমার এই প্রচেষ্টার কথা শুনে তিনি আনন্দিত হলেন । আপনাকে ময়নার মা হয়ে পাঠাতে রাজী হলেন।


 তারপর - তারপর আপনাকে এখানে আনার সমস্ত চেষ্টা সার্থক হলো । এই মাতৃহারা শিশুটির দায়িত্ব আজ থেকে আপনার হাতেই তুলে দিলাম । কিন্তু একটু সতর্ক থাকবেন , যাতে ময়না কোন দিন আপনাকে ভুল বুঝতে না পারে । সে আপনাকে মা বলে মেনে নিয়েছে । তবে আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই । আমার ময়নার মা হয়ে , আপনি একটি ছোট্ট শিশুর জীবনকে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্য করলেন , সেজন্য আপনাকে আমি এক মহীয়সী নারী বলে মনে করি । ময়নাই আমার শেষ সম্বল।


 এই কথা বলার পর দেবীবাবুর মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো এবং চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। 


আমি কথা দিলাম ময়নার লুপ্ত মাতার দায়িত্বভার আমি নিজের হাতে তুলে নেব । তার আগে আপনাকে ক্ষমা করতে হবে এ কারণে , অজান্তে আপনাকে অনেক অপমান করেছি।


 তিনি বললেন , আপনার ব্যবহারে মোটেই রাগ করিনি । বরং আপনার এই মহৎ কাজের জন্য আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকব। 


সেদিন কোন রকম ময়নার কাছে কাটিয়ে ফিরে এলাম বিকেলে । দেবীবাবু পৌঁছে দিয়ে গেলেন । বস্তীতে এসে শ্যামলীদিকে আঁকড়ে ধরলাম । চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা উষ্ণ জল নির্গত হতে থাকল । শ্যামলীদির কাছে ময়নার কথা প্রকাশ না করে থাকতে পারলাম না । বুকের ভেতরটা যেন টন টন করে উঠল । অব্যক্ত যন্ত্রণায় নিজেকে স্থির থাকতে না পেরে বলল উঠলাম , একি করলে শ্যামলীদি , আমি এখন বিবেকের দংশন জ্বালায় ক্ষত - বিক্ষত । একজন পতিতা নারী হয়ে একটি নিষ্পাপ মেয়েকে মাতৃত্বের সোহাগ দিয়ে নিজ কন্যা বলে কিভাবে গ্রহণ করবো? 


শ্যামলীদি সান্ত্বনা দিয়ে বলল , ওরে আমরা পতিতা হলেও আমাদের অন্তরে নির্মল মাতৃত্ব ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত । উপরে আমাদের দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না । এই মাতৃস্নেহ যেন অন্তঃসলিলা । ময়নাকে গর্ভে না ধরে ওর মুখ দিয়ে যে মায়ের ডাক শুনেছিস, এজন্য তোর নারী জীবন ধন্য মনে করবি। কিন্তু সমাজের কি নিষ্ঠুর বিচার, কোনো এক বীরঙ্গনা নারী যদি সন্তান ব্রতী হয় তাহলে রেহাই নেই কুৎসা ও কলঙ্কের জালিমা তাদের ভাগ্যকে বিড়ম্বিত করে তুলবে । ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের পশরা নিয়েই আমাদের যাত্রাপথ শুরু।



 রাতে শোবার পর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না । শ্যামলীদি অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে । আমার মনে অতীতের বহু স্মৃতি আমাকে পাগল করে তুলল । সময়ে অসময়ে এবং কারণে অকারণে অতীতের বহু সুখ দুঃখের চিত্র আমার মনের আস্তিনায় ভিড় করতে লাগল । যদি আমি এই অধঃপতিত জীবনকে বেছে না নিতাম তাহলে আর পাঁচজন নারীর মতো স্বামী পুত্র নিয়ে সুখের স্বর্গ গড়ে তুলতে পারতাম । মনে হয় পূর্ব জন্মের বহু সঞ্চিত পাপের জন্য আমাকে এই ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের কলঙ্ক নিয়ে ঘর করতে হচ্ছে । বন্দিনী হয়ে দিনের পর দিন পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজে লাগছি।


 আজ না হয় পিপাসায় আকুল হয়ে এক ফোঁটা জলের আশায় শীতল সরোবরে ছুটে চলেছি । অবাক্ত পিপাসাকে মিটাতে চলেছি ময়নাকে স্নেহ করে । হঠাৎ কপাটে ধাক্কা হওয়ার জন্য বিস্মৃত হলাম । শ্যামলীদিকে উঠালাম । এই ঘটনায় একটু ভীত হলাম । শ্যামলীদি তার বিছানা হতে উঠে চোখ কচলাতে শুরু করল ।


 শুনতে পেলাম কার কণ্ঠস্বর যেন ভেসে আসছে । বহিন খিড়কী খোলে , কৌই ডর নেহি।


শ্যামলীদি চোখ রগড়ানো বন্ধ করে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে কপাট ফাঁক করতেই নজরে পড়ল এক হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ ব্যক্তিকে । পরণে চুস প্যান্ট ও গায়ে সেঁটে থাকা কালো গেঞ্জি । মাথায় কালো পাগড়ী । এক মুখ দাড়ি । দাড়িতে যেন সূক্ষ্ম কালো জালি দিয়ে দুগালকে চেপে রেখেছে । হাতে মোটা সোটা একটা বালা । লোকটা যে পাঞ্জাবী তাতে কোন সন্দেহ নেই । হাতে উদ্যত রিভলভার।


 ঐ অবস্থা দেখে শ্যামলীদি ও আমি পাষাণবত হয়ে গেছি । আমাদের অনড় অবস্থা দেখে লোকটা বলল , কৌই ডর নাই বহিন , হাম বহুত বিপদ মে পড়েছি । মুঝে কুছ জায়গাদো । হারামী বাচ্চা পুলিশ হামারা পিছা করেছে । তুম লোককা কৌই ডর নেহি । দেরী মত কর বহিন , জলদী দরজা খোল। 


শ্যামলী বুঝতে পারল কোন মানুষ বিপদে পড়েছে বা পুলিশের তাড়া খেয়েছে কারণ এই এলাকা একেবারে এক নম্বরী । আমি যে ভয় পেলাম না তা নয় , শ্যামলীদিকে কপাট খুলতে নিষেধ করলাম।


 শ্যামলী আমার কথা না শুনে কপাট খুলতেই লোকটা অর্থাৎ পাঞ্জাবী তো বটেই , আধা বাংলা মিশিয়ে বলল , হামাকে পনদেরহ মিনিট কা লিয়ে চুপনে কা জায়গা দে

জলদী কর বহেন মেরে পিছে পুলিশ হ্যায় । শ্যামলীদি দ্বিধা না করে প্রবেশ করতে বলল। 


পুনরায় কপাট লাগিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলল , এই তক্তাপোষের উপর কম্বলটা ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ুন । পাগড়ীটা খুলে ফেলুন । জলদী করুন , আর একথা মনে রাখবেন , পুলিশ এলে পর যা বলবার আমি বলব । আপনি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকুন। 


পাঞ্জাবী শ্যামলীদির নির্দেশ মতো কাজ করল । আমাকে পাশের রূমটাতে শুয়ে পড়তে বলল আলো নিভিয়ে । পাঁচ / সাত মিনিটের মধ্যে পুনরায় কপাটে ঠক্ ঠক্ শব্দ । বেশ কয়েকবার শব্দ হবার পর শ্যামলীদি ঘুমের ভাব দেখিয়ে ধরা গলায় বলল , এত রাত্রে কি দরকার ? রাত্রি দশটার পর কোন খদ্দেরকে আমি এলাউ করি না।


 কপাট খুলে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল , ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিলেন স্যার । দুই জন পুলিশ অফিসার ও তিন জন কনস্টেবল অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে বললেন , আপনাদের বাড়ীর মধ্যে কোন লোক প্রবেশ করেনি?


 শ্যামলীর উত্তর , তা জানিনে স্যার , যদি মনে করেন তল্লাশি করতে পারেন । আপনাদের সহযোগিতা করা আমার কর্তব্য মনে করি।

তাহলে ভেতরটা একটু দেখতাম।



                          ক্রমশ...

Saturday, September 3, 2022

ছোট গল্প - শৈশব || লেখক - চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি || Short story - Saisob || Written by Chandrani Gupta Bannerjee


 


শৈশব

চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি



                (১)

আজ সকালে  কাকার ফোনটা এল। বেশ অনেক দিন পর। যোগাযোগটা ক্ষীণ হয়ে গেছিল। মিথ্যে বলব না যোগাযোগটা আমার তরফ থেকেই কমে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম কাকা ফোন করত। আজকালকার এসএমএস কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও চিঠি লিখত ।ফোনেই কথা বলতাম ।চিঠির উত্তর লিখতে বসাতে আমার ভীষণ আলসেমি। তাই চিঠি লেখা থেকে যোজন খানেক দূরত্ব বজায় রাখতাম। আমার গ্রামের বাড়ির সমস্ত খবরা খবর কাকার চিঠি মারফত জানতে পারতাম ।গ্রামের বাড়িতে কাকা এখনো থাকেন ।প্রায় পঁচাত্তরের এর কাছাকাছি ওনার বয়স ।কাকিমা প্রায় সময়ই অসুখে ভোগেন। একমাত্র মেয়ে বুলির বিয়ে কাছাকাছি দিয়েছেন। বুলিকে দেখিনি আজ কত বছর হয়ে গেল। আমার সেই ছোট্ট বোনটা... নাদুস নুদুস ...গোলগাল ।ওই আমার খেলার পুতুল ছিল। বুলির কথা মনে পড়তেই নিজের অজান্তে হেসে উঠলাম। যখন আমার বিয়ে হয় তখন বুলি কত ছোট ছিল। সৌমেনও বুলিকে খুব ভালোবাসতো। একটা ছবিও বোধহয় আছে সৌমেনের কোলে বসা বুলি। ভাবতেও অবাক লাগে সেই বুলি এখন ঘোর সংসারী। দুই ছেলে-মেয়ের মা। দাপিয়ে সংসার করে বেড়াচ্ছে। কাকা চিঠি লেখে না আজ বহুদিন ।গ্রামের বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগের মাধ্যমটা ছিল কাকার লেখা চিঠিগুলো। হাতের আঙ্গুলগুলো কাকাকে আজ আর  সঙ্গ দেয় না।   অবাধ্যের মতো কাঁপতে থাকে। তাই লেখাগুলো হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্যতর। ধীরে ধীরে গ্রামের ছবিগুলো আমার দৃষ্টিপট থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। মা-বাবার থেকে কাকার আদুরে ছিলাম বেশি। যত আব্দার ছিল কাকার কাছে। কাকা ঘোড়া সাজত আর আমি হতাম  তার সওয়ারী। ভাই একটু বড় হবার পর--- সে আর  বুলিও এর আনন্দ উপভোগ করেছে। কিন্তু কাকার রাজকন্যা আমিই ছিলাম। মা কিংবা কাকিমা আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কখনো কোন তারতম্য করেননি। কাকিমা নারকেলের নাড়ু বানালে সবার আগে আমি আর ভাই পেতাম। তারপর বুলি। আবার মায়ের হাতে বোনা সবচেয়ে সুন্দর সোয়েটারটা বুলির জন্য তোলা থাকতো। আমার বাবার ছিল বিশাল ব্যবসা। নিজের পরিশ্রমের বিন্দু বিন্দু দিয়ে বাবা নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ঠাকুরদার সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ করে কাকাকে দেন ।কাকা কখনো বাবার মুখের ওপর টু শব্দটি বলেননি। বিশ্বাস করতেন দাদা যা করবেন তাতে তার মঙ্গলই হবে আর বাবাও ওনাকে কখনো নিরাশ করেননি। বাবা গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে ব্যবসার খাতিরে কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু গ্রামের বাড়ির অংশটা তিনি বিক্রি করেননি। বাকি অংশে কাকা কাকিমা এখনো থাকেন। ছেলেবেলায় আমরা পুজোর সময় কলকাতায় থাকতাম না। পঞ্চমীর দিনে একদম গ্রামের বাড়ি পৌঁছে যেতাম। তারপর লক্ষ্মী পুজো সেরে কলকাতায় ফিরতাম। চোখ বুজে সেই স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেছিলাম আমার সেই গ্রামের বাড়িতে । একটা বাক্সে জমিয়ে রেখে ছিলাম কাকার লেখা সেই পুরনো চিঠিগুলো। সেগুলি আমার পাশে রাখা ।যেই না চৌখাট পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে যাব তখনই সৌমেনের গলার আওয়াজ পেলাম।

---" কি হলো সবু?  কি ভাবছো চোখ বুজে? নতুন শাড়ি, নতুন গয়না কিনবে বুঝি ?"

 চোখ খুলতেই দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে  সৌমেন। গলার টাইটা বাঁধার চেষ্টা করছে ।সৌমেন আমায় আদর করে "সবু" ডাকে। আমার ভালো নাম সর্বানী। যাহোক আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলাম।

 বললাম ---"নতুন শাড়ি নতুন গয়নার কথা কেন ভাববো ।আমার প্রচুর আছে।"

---" তাহলে কিসের কথা চোখ বুজে ভাবা হচ্ছিল শুনি ?"

ছোট্ট করে বললাম ---"পলাশপুর।"জানি সৌমেন পলাশপুরের নাম শুনে আশ্চর্য হবে। তাই ছোট্ট জবাবেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলাম।

---" তা হঠাৎ পলাশপুর! এত বছর পর!"

---" কাকা ফোন করেছেন আজ সকালে ।"

---"কেন ?"

---"পলাশপুর যেতে বলছে।"

 ---"তুমি কি যেতে চাও সবু?"

একটু সময় নিলাম জবাব দিতে ।তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

---" তোমায় আমি কখনই কোন কিছুতে বাঁধা দিই না সবু ।শুধু একটা কথাই বলি তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্না একজন মানুষ। যা করবে, মস্তিষ্কের সাথে সাথে হৃদয়েরও সাহায্য  নিও।কবে যাবে আমায় বলে দিও টিকিট কাটতে হবে তো! "

               (২)
এবারের দুর্গাপূজা টা আমাদের, বিশেষ করে আমার পলাশপুরে কাটবে তা ভাবতেই  মনে কেমন একটা শিহরণ জাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মা তো আগেই চলে গেছিলেন ।তারপর বাবার মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন হওয়ার পর আর পলাশপুর মুখো হইনি। কাকা বহুবার অনুরোধ করেছিলেন অন্তত পুজোর দিন গুলো যেন আমরা সবাই মান অভিমান ভুলে পলাশপুরে কাটাই ।নাহ্... আমি জেদি, একগুঁয়ে। মান-অভিমান ভুলতে পারিনি ।শুধু কি আমি?  মান-অভিমান তো  অনিও ভুলতে পারেনি। ওকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা । অনি মানে আমার ছোট ভাই...  অনির্বাণ বসু ।দিল্লিতে সপরিবারে থাকে ।বেশ কয়েকটা বছর অনি আর আমি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি আমার রাগ ভুলতে পারিনা ।উল্টো প্রান্তে অনিও  হিমালয় পর্বতের মত তার সিদ্ধান্তে অটল। আমার ভাইফোঁটা ও রাখি উৎসবগুলি অনি বিহীন ভাবে কেটে গেছে বহুকাল। ভবিষ্যতেও একই রকম ভাবে কেটে যাবে ।কই অনির ওতো কখনো আমার কথা মনে পড়ে না ।আমাদের একসাথে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো... শৈশবের দিনগুলো! সৌমেন এর সাথে আমার বিয়েটা বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন। বেশ জাঁকজমক ভাবে পলাশপুরের বাড়িতেই বিয়েটা হয়েছিল। কলকাতায় ব্যবসা বিস্তার করলেও বাবা কখনোই  ওনার শেকড়টা ভুলে যাননি ।যাইহোক, আমার বিয়েতে বাবা কোনো কিছুরই কার্পণ্য করেননি। সোনার গয়নায় মুড়িয়ে দিয়েছিলেন আমায়। পাত পেড়ে লোক খেয়েছিল।  সে    স্মৃতিগুলো এখনো আমার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল ।আমায় যেমন আমার বাবা  অঢেল দিয়েছিলেন , অনির  বউ পৃথাকেও   উনি কিছু কম দেননি ।কিন্তু কোথাও অনির মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে বাবা দিদিকে পক্ষপাতিত্ব করে বেশি বেশি দিয়ে গেছেন। মা-বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন মুখে সে কথা প্রকাশ করতো না কিন্তু আচার-ব্যবহারে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত। বাবার মৃত্যুর আগে কোন  উইল করে যাননি। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার পর পলাশপুর থেকে ফিরে আসার আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা সবাই বৈঠকখানায় বসেছিলাম। কাকা কাকিমা সবাই ছিলেন ।সেখানেই সম্পত্তি নিয়ে অনি আর আমার মধ্যে প্রচন্ড ঝামেলা হয়। অনির বক্তব্য অনুযায়ী, আমি  অনিকে ঠকিয়ে বাবাকে দিয়ে অনেক ধনসম্পত্তি আমার নামে লিখে নিয়েছি ।অতএব আমার আর কোন কিছুতেই কোন অধিকার নেই ।আমিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নই ।কেনই বা লাখ লাখ টাকার বিশাল সম্পত্তি ছেড়ে দেব? দিলাম অনির নামে মামলা ঠুকে ।যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন অনি জমি-জমা ,ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কিছু বিক্রি করতে পারবে না।



                   (৩)

ট্রেনে বসে পুরনো সেই সব ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি, সৌমেন ও আমার ছেলে বাবলু পলাশপুর যাচ্ছি। কখন যে ট্রেন তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে তা বুঝতেও পারিনি ।যাত্রীদের কোলাহলে ঘোর কাটল। বাক্স-প্যাটরা নিয়ে স্টেশন চত্বরে নামলাম । পলাশপুরের বাতাসে কেমন যেন একটা মন ভালো করা গন্ধ ।কতদিন যে তার স্পর্শ পাইনি। আজ প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। স্টেশন থেকে গাড়িতে ঘন্টাখানেকের পথ কাকার বাড়ি। আমার ছোটবেলার পলাশপুর ... পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, পরতে পরতে স্মৃতির ঝাঁপি একটু একটু করে খুলছে। সময়ের সাথে সাথে পলাশপুর কিছুটা বদলেছে। গাড়ির ড্রাইভার খুব যত্ন করে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল। একটা সময় আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ আমাদের লেগেই থাকত। ঠাকুরদালানে দুর্গাপূজা হত। বাবা কলকাতায় ব্যবসার খাতিরে চলে যাওয়ায় আমাদের ভাগের দালানের ঘরগুলো আর সেভাবে ব্যবহৃত হতো না। কাকার পরিবার তাদের অংশের নিজের দালান ঘরে থাকতেন ।আজও আমাদের দালান ঘরগুলো তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়িটাতে ঢুকতেই গেটের ধারে দুটো বাঁধানো বসার জায়গা ছিল ।সেগুলো এখন আর নেই। ভগ্নপ্রায় অবস্থা তাদের পাশের বকুল ফুলের গাছটা কিন্তু একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ।কত ফুল কুড়িয়েছি , তারপর মালা গাঁথতাম। আমাদের আসার শব্দ পেয়ে কাকা শশব্যস্ত হয়ে গেটের কাছে চলে এলেন। আজ কত বছর পর কাকাকে দেখলাম। মানুষটার মুখের হাসি ও আন্তরিকতা আজও অমলিন। আমায় দু'হাতে জড়িয়ে ধরলেন। কোথাও যেন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে কাকার মাঝে ফিরে পেলাম।

                (৪)

ঘরে ঢুকতেই প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলাম । আমার চক্ষু স্থির ।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। অনিকে এখানে, পলাশপুরে দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। অনির ও হাবেভাবে স্পষ্ট যে ও আমাকে এখানে দেখবে তা আশা করেনি। বাক্যবিনিময় না হলেও হৃদয়ে যে প্রচণ্ড জোরে দামামা বাজছিল তা বুঝতে পারছিলাম। অনিও সপরিবারে পলাশপুরে এসেছে। বুঝতে পারছিলাম এসব আমার কাকার মস্তিষ্ক- প্রসূত। আমার পরিবারের সঙ্গে অনির পরিবারের টুকটাক কথাবার্তা হল। অনির মেয়ে টুবাইকে এই প্রথম দেখলাম। জড়োসড়ো হয়ে পৃথার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেনে সফর করে খুব পরিশ্রান্ত লাগছিলো। তাই কাকিমা ও বুলি আমাদের রাতের খাবারটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল ।হ্যাঁ ,বুলি ও তার ছেলে মেয়েরা আমরা আসবো জেনে কয়েকদিনের জন্য কাকার বাড়ি চলে এসেছে। কাকার ঘরে যেন চাঁদের হাট বসেছে। রান্নাঘরের পাশের বড় ঘরটায় সবাই মাটিতে খেতে বসে পড়লাম সেই ছোটবেলার মতো ।অনি খেতে খেতে আড়চোখে আমায় দেখছিল। আমিও চশমার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওর ভুড়িটা কতটা স্ফীতকায় হয়েছে ।রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার ঘরে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত হওয়ার দরুন খুব তাড়াতাড়ি ঘুম পরী দুচোখের পাতায় নেমে এলো ।

আমার আবার বরাবরই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস ।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজকার মতন প্রাতঃভ্রমণ করতে বেরিয়েছি। কাকার বাগানটায় অনেক ফুলের গাছ ।আমরা মানে... আমি ,অনি , বুলি ও আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পুজোর দিন গুলোতে ফুলবাগানে ভোর বেলায় এসে ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল তুলতাম। শিউলি ফুলের গাছের নিচে আগের দিন রাতে কাপড় বিছিয়ে রাখতাম ।পরদিন ভোর বেলায় গিয়ে দেখতাম রাশি রাশি ফুল ছেয়ে আছে ।এখনও দেখলাম ফুলে ফুলে চারিদিক ছেয়ে আছে । কিন্তু ফুল কুড়োবার বা তোলার লোক কোথায়? কাল বাদে পরশু ষষ্ঠী ।এখন আর ঠাকুরদালানে মা সপরিবারে আসেন না। শুধুমাত্র রাধাগোবিন্দর নিত্য পুজো করার জন্য ঠাকুরমশাই আসেন ।দুর্গাপুজার স্মৃতিটা শুধু মনে গেঁথে আছে ।হঠাৎ শুকনো পাতার উপর কারো হেঁটে আসার শব্দ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার পেছনে দাঁড়িয়ে অনি। আমরা দুজন দুজনকে অনেক কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না ।একটা অদৃশ্য দেয়াল আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে যে নিঃশব্দে। একসাথে দুজনে বাড়ির পেছনদিককার বাগানটায় হাঁটতে লাগলাম ।মনে হল অনন্ত কাল ।অনি ওর ভারী শরীরটা নিয়ে আর হাঁটতে পারছিল না ।চোখের ইশারায় কিছুটা এগিয়ে ঠাকুরদালানের সিড়িটায় ওকে বসতে বললাম। বহু বছর পর দুজনে পাশাপাশি বসলাম। আমি আর আমার ছোট ভাই অনি। সেই ঠাকুরদালান, সেই রাধা মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা আমাদের অহংকার, অর্থ, লোভ, প্রতিপত্তিকে চরিতার্থ করতে গিয়ে সম্পর্কের বাঁধনটাকে আলগা করে দিয়েছি।একে অপরের থেকে কত দূরে চলে গেছি । আমরা একই পিতা-মাতার সন্তান। কিন্তু আরো বেশী পাবার লোভ আমাদের সম্পর্কটায় তিক্ততা ভরে দিয়েছে।

--- "দিদি......"

আমার কানে কে যেন অমৃত সুধা ঢেলে দিল। বছরের পর বছর ওই ডাকটা শোনার জন্য অধীর হয়ে থাকতাম। ভাইফোঁটার দিন কিংবা রাখি -পূর্ণিমায় যদি আমার ভাইটা একটা ফোন করে। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠলো। অতিকষ্টে সেটাকে গিলে ফেললাম।

---" বল ভাই ।"

---"শিউলি ফুল কুড়োবি?"

---" মানে ?"

---" বাগানের শিউলি ফুলের গাছটার নিচে দেখলাম প্রচুর শিউলি ফুল ঝরে পড়ে আছে। কুড়োবি?"

---" তুই ভুঁড়ি নিয়ে পারবি ভাই?"
 আমি হেসে বললাম।

---" চল ছোটবেলার মতো রেস লাগাই দিদি।"

---" আর দরকার নেই। তুই হেরে ভূত হবি।"

---" তোরা এখানে!!! তোদের আমি কখন থেকে খুঁজছি।"
 
বুলি শশব্যস্ত হয়ে ঠাকুরদালানে আসে।

---" চলে বুলি, আমরা তিন ভাই বোনে এখন প্রাণভরে শিউলি ফুল কুড়োব। পুজোর ছোট ঝুড়িগুলো নিয়ে আয়। চল দিদি।"

 বুলি বাধ্য মেয়ের মত ঝুড়ি আনতে ছুটল লাগাল।

               (৫)

এখন প্রতিবছর আমরা সবাই মিলে পলাশপুরে যাই। আমার পরিবার, অনির পরিবার, বুলির পরিবার --- আমরা সবাই পুজোর দিনগুলোতে একত্রিত হয়ে হই হুল্লোড় করি। শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যাই। ঠাকুরদালানে মায়ের পুজো আমরা নতুন করে শুরু করেছি। কাকা কাকিমাও খুব খুশি ।আর হ্যাঁ, আমাদের বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হয়েছে ।আমি অনির নামে ঠোকা মামলা তুলে নিয়েছি ।পৈতৃক সম্পত্তির পুরোটাই আমরা আমাদের দুজনের সম্মতিতে বিক্রি করে দিয়েছি। বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গেছে তার সমস্তটাই পলাশপুরের উন্নতির কাজে ব্যয় করা হয়েছে। মা ও বাবার নামে একটি বিদ্যালয় ও হাসপাতাল খোলা হয়েছে। আর দুর্গাপুজোর কটা দিন দিন দরিদ্র মানুষদের নারায়ন সেবা ও বস্ত্র দান করা হয় ।

দিনের শেষে এসে আমরা এই উপলব্ধি করেছি যে অর্থ দিয়ে সম্পর্কের অমৃতসুধা কেনা যায় না। যতটা অর্থ প্রয়োজন ঠিক ততটাই থাকুক না আমাদের কাছে ।তার বেশি নয়।

Friday, September 2, 2022

ছোট গল্প - কাকের প্রতিশোধ || লেখক - ইমরান খান রাজ || Short story - kaker protisodh || Written by Imran khan raj


 

কাকের প্রতিশোধ 
ইমরান খান রাজ 

এক দেশে ছিল বিশাল এক বন। বনটি এতই বড় ছিল যে, তার ভিতরে কেউ ঢুকলে আর বের হতে পারতো না। হারিয়ে যেত ! সেই বনে বাস করতো এক ভয়ঙ্কর, বিশালাকৃতির হিংস্র বাঘ৷ সেখানে একমাত্র বাঘেরই রাজত্ব চলতো৷ অন্য কোন পশুপাখি তার উপরে কথা বলতো না। সবাই বাঘকে ভয় পেতো আর বাঘের থেকে সর্বদা দৌড়ে পালাতো। যেই প্রাণীটা বাঘের সামনে পরতো, হিংস্র বাঘটি তাকেই খেয়ে ফেলতো৷ বিশালাকৃতির দেহের ক্ষুধা মেটাতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে খাবার প্রয়োজন হতো তার। 

হঠাৎ একদিন বিকেলে সেই বনে শুরু হলো এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বনের প্রায় বেশিরভাগ বড় গাছগুলোই ভেঙে পরে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সেই বনটি। ঝড়ে বহু পশুপাখির বাসস্থান নষ্ট হয়ে যায় এবং ছোট-বড় অনেক প্রাণী মারা যায়। তবে বাঘের ঘর ঝড়ে কিছুই হয় না। কারণ সে তো গুহায় থাকে। 

পরদিন সকালে বাঘের ঘুম ভাঙলে, সে খাবারের উদ্দ্যশ্যে গুহা থেকে বের হয়। তবে বের হয়ে দেখে, চারিদিকে গাছপালার স্তুপ। সব ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এসব দৃশ্য দেখে সাতপাঁচ না ভেবে বাঘটি বের হয় তার খাবার খোঁজার জন্য। খাবার খুঁজতে খুঁজতে সকাল গড়িয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম হলো। কিন্তু বাঘটি কোনো খাবারই খুঁজে পেলো না। সারাদিন হাটাহাটি করার ফলে সে এখন অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে। আর এদিকে তার ক্ষুধাও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। হাটতে হাটতে হঠাৎ তার চোখে পড়লো দুটি কাকের ছানা। গতকালের ঝড়ে বাসা ভেঙে মাটিতে পরেছিল ছানা দুটো। উড়তে না পারায় মাটিতে বসেই তাদের মাকে ডাকছিল। কাকের ছানা দুটো দেখে লোভে বাঘের যেনো জিভে জল চলে এলো। সারাদিন না খাওয়ার ফলে প্রচুর ক্ষুধার্ত হয়ে পরেছিলো সে। তাই নিজের পেটের ক্ষুধা মেটাতে বাঘটি, কাকের দুটো ছানাকেই একবারে গিলে ফেললো। খাবার খেয়ে শান্ত মনে বাঘটা চলে যায় তার গুহায়। বিশ্রাম করতে। 

এদিকে 'মা' কাকটি সেই সকাল থেকেই তার বাচ্চাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা দুটো ছিল তার নয়নের মণি। খুব ভালোবাসতো তাদের। কোথাও কোন খোঁজ না পেয়ে অবশেষে কাকটি একটি ভাঙা গাছের ওপর বসে কাঁদতে লাগলো। পাশের আরেকটি গাছেই ঝুলে ছিল এক বানর। কাকের কান্না দেখে তার মায়া হয়। বানরটি কাকের কাছে এসে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে, কাকটি তার দুটো ছানা হারিয়ে যাবার সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। কাকের কথা শুনে বানর বলে, "কি বলো কাক ভাই !" ঐ দুটো ছানা তোমার ছিল ? আমি কিছুক্ষণ আগে দেখলাম, দুষ্টু বাঘটা দুটো কালো পাখির ছানাকে গিলে খেল ! তখন আমি পাশের গাছেই ছিলাম। ওপর থেকে সব দেখেছি। বানরের কথা শুনে কাক অনেক দুঃখ পেল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, দুষ্টু বাঘ তার দুটো বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে ! তাকে অবশ্যই সাজা পেতে হবে। সেই থেকে কাক বাঘের প্রতি সর্বদা নজর রাখা শুরু করলো। বাঘ'কে শায়েস্তা করার জন্য ! 

তারপর হঠাৎ একদিন খাবারের খোঁজে বাঘ তার গুহা থেকে বের হলো। ক্ষুধার জ্বালায় সারা বন হন্যে হয়ে খাবার খুঁজতে লাগলো সে৷ কিন্তু আজও কোন খাবার খুঁজে পেলো না। তাই ক্লান্ত হয়ে, বিশ্রামের জন্য দুষ্টু বাঘটি এক বিশাল আকৃতির তালগাছের নিচে বসে পড়ল। সে এতই ক্লান্ত ছিল যে, একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লো তালগাছের নিচে। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগালো কাক। সে তালগাছের একেবারে চূড়ায় বসে ছিল। তারপর তার ঠোঁট ও পায়ের ধারালো নখ দিয়ে বড় বড় তাল ছিড়তে শুরু করলো। আর সেই তাল অনেক উঁচু থেকে সোজা পড়তে লাগলো দুষ্টু বাঘটির মাথায়৷ এক এক করে সবগুলো তাল ছিড়ে বাঘের মাথায় ফেলে সে। গভীর ঘুমে থাকার ফলে বাঘটি দৌড়ে পালানোর সুযোগ পায় না। এদিকে বাঘের মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। একটা সময় বাঘটি ঐ তালগাছের নিচেই নিথর হয়ে পড়ে থাকে এবং অবশেষে মারা যায়৷ দুষ্টু বাঘের মৃত্যুতে, কাকটি যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। 

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -6


 



।১১

পিসেমশাই বলছেন, মনোজের আত্মার মনে পড়ছে  মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু সাদাসিধা মনের মানুষ। একটা সাধারণ প্যান্ট জামা পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে তার নিত্য যাওয়া আসা। ট্রেনে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা হাসি মস্করায় ব্যস্ত থাকে। দীনেশবাবু নিজে জানালার এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়েন। তিনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন। কলকাতার নামীদামী প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনো অহংকার নেই। ছাত্র ছাত্রীদের কি করে ভালভাবে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ করা যায়, এই নিয়ে তাঁর চিন্তা। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকে বাড়তি দায়ীত্ববোধ। তিনি এইকথা ভাবেন মনে মনে। কি করে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা যায়, এই নিয়েই দিনরাত চিন্তাভাবনা করেন।  স্কুলে পৌঁছান। ঘন্টা পড়ে প্রার্থনা সভার। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পরে শুরু হয় ক্লাস। ক্লাসে গিয়ে তিনি কোনোদিন চেয়ারে বসেন না। ছাত্রদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। পড়াশোনার কাজে সাহায্য করেন। স্টাফরুমে বসেন। তারপর কুশল বিনিময়ের পরে তিনি চলে যান ক্লাসে। কোন ক্লাস ফাঁকা আছে রুটিন দেখলেই জানতে পারেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই তাঁর ক্লাসে চলে যান নিয়মিত। টিফিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। সদাহাস্যময় দীনেশবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। স্কুল থেকে ফেরার পরে নিজের লেখা নিয়ে বসেন। কোনোদিন ভাষাসদনে যান। সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর বাজার সেরে বাড়িতে ঢোকেন।আমার মা বলেন, ভাল লোকের কোন পারফিউম লাগে না। তাদের গা থেকে আপনা আপনি চন্দনের সুগন্ধ পাওয়া যায়। মা আরও বলেন, ভরা কলসি টগবগ করে না।জ্ঞানী লোক কথা কম বলেন। তাঁরা প্রচারবিমুখ হন। দীনেশবাবু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথা কম বলেন কিন্তু কর্মি লোক। লোকের ভাল ছাড়া মন্দ ভাবেন না কোনোদিন। তাঁর স্বভাব দেখলেই সকলের ভাল লেগে যায়। দীনুবাবুও এই ধরণের লোক। দীনেশবাবুকে মা আদর করে দীনুবাবু বলেন। তিনি সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে, বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়। কথা বললেই নাকি চন্দনের সুবাস বেরোয়। শুনে অনেকে নিমকাঠির ব্যবহার করেন। কিন্তু মা বলতেন, শুধু নিমকাঠির ব্যবহার নয়, তার সঙ্গে মানুষকে ভালবাসতে হয়। কারও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। মিথ্যা কথা বলতে নেই। তাহলেই মানুষের মুখে সুগন্ধ হয়। এমনকি দেহের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মানুষ তো দেবতার আর এক রূপ। দীনেশবাবু ছুটির দিনগুলোতে ফুটপাতের অসহায় লোকগুলোর জন্য হোটেল থেক ভাত তরকারি কিনে, প্যাকেটে ভরে তাদের হাতে  দেন। তাঁর ইচ্ছে আছে গরীব লোকগুলোকে প্রত্যেকদিন একমুঠো করে  মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার।তিনি সংসারী লোক। তাই এগোতে হবে ধীরে ধীরে।তিনি জানেন,  এসব কাজে সবদিক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হয়। তিনি ভাবেন, সামাজিক, আর্থিক, আইনগত সমস্ত  দিক দেখে তবেই কাজে নামা প্রয়োজন। আজ সকাল সকাল দীনেশবাবু ছেলেকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। ছেলেকে বললেন, পড়তে বোসো বাবু। সকালে পড়া মুখস্থ হয় ভাল। ছেলে বলে, বাবা তোমার মুখ থেকে চন্দনের সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি । দীনেশবাবু বলেন, ও তাই নাকি?  তোমার মুখেও তে সুন্দর গন্ধ।রাস্তায়, স্কুলে যেখানেই দীনেশবাবু যাচ্ছেন সকলের মুখেই এক কথা,দীনুবাবু আর একটু কথা বলুন। আপনার মুখে চন্দনের সুবাস। বসুন বসুন। সকলের আদরে তিনি  নিজেও যেন চন্দনের সুবাস অনুভব করছেন। আদরের আতিশয্যে তিনি খুশি। একটি শিশু দৌড়ে তাঁর কাছে এল চন্দনের সুবাস নিয়ে। দীনুবাবু শিশুটির  কপালে একটা চন্দন সুবাসের চুমু এঁকে দিলেন সস্নেহে.... বাসস্টপেজেই  অতনুর বাড়ি। রাত বাড়লে বাসস্টপেজ একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর  আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর  অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে। অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানী তোর পকেটে রেখে দে।যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এইস্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে। অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে। এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। চিনু তার আদর্শ। কিন্তু চিনুর বংশ ভালো।   সে সমাজসেবী। চিনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে।সুনীতা ভাবে, চিনুদা এত বড় মন  পেল কোথা থেকে।সকলের উপকারে ছুটে যায় চিনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন  প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি চিনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় চিনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু চিনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।চিনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো বোকা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন বোকা থেকে যাব।  নীতা  গ্রামের বাড়ি যাবে। সে পরিবারের সঙ্গে বাসস্টপে এসেছে ব্যাগপত্তর নিয়ে। সুনীতাকে দেখে চিনু কাছে এল। মা বললেন, সুনীতার মুখে তোমার কথা শুনেছি। আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি পুজো দেখতে চল। চিনু বলল,আমি পুজোবাড়িতে আমার স্থান হবে?  সুনীতার মা বললেন, কে বললো তুমি বোকা। তুমি আমাদের পরিবারের একজন হলে। আমরা আছি, চল। অতনু তার সঙ্গিদের বললো, আমি পুজোয় গ্রামে যাচ্ছি। তোরা সাবধানে থাকিস।গ্রামের পুজোবাড়িতে আরতির বাজনা বাজছে। ধুনোর গন্ধে পুজোবাড়ি মাতোয়ারা। আর একটু পরেই ধুনুচি নাচ শুরু হবে।সুনীতা ধুনুচি নাচ নাচছে। ধুনোর গন্ধে চিনু খুশি। একটা শিহরণ তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুনীতার চোখ তার দিকে। সুনীতার মা চিনুকে হাত নেড়ে হাসিমুখে ডাকছেন। সুনীতার মায়ের মুখটা ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অতনু এই প্রথম বলে উঠলো, মা, মা গো...।চিনুু বুুুড়ো হল। 

১২


চিনু মরে গেল তারপর সে দেহের কাছেই তার আত্মা ঘুরঘুর করতে লাগলো মনে প্রথমে দেও ছাড়তে চায়না তা তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারে নিজের শরীর হালকা হয়ে গেছে তখন ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে তখন বুঝতে পারে সে শরীর ছাড়া। চিনুর অবস্থাও মনের মত হয়েছে মানুষ যখন ট্রেনে কাটা পড়ল সে বুঝতে পারেনি সে মনে করছে বেঁচে আছে কিন্তু তার আত্মা তখন বেরিয়ে এসেছে দেহকে দেখে ভাবছি দেহটা ওখানে পড়ে কেন তাহলে নিশ্চয়ই আমার মরন হয়েছে তাই আয়েশা আক্তার দেখছেন চিনুর শরীর।তিনি ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। কেউ কেউ কাঁদল।

এইগুলো আমার চিন্তা করছে মায়া ছাড়তে পারছেনা সে অনেকক্ষণ ঘুরঘুর করছিল দেহের আশেপাশে ট্রেন তার প্রতি বারবার চলে গেছিল কিন্তু আর কিছু হয়নি একবারই হয়েছে আত্মার মরন হয় না আর তাই সে বেঁচে আছে এবং অপেক্ষা করছে আজব ডাক্তার এখন কিছুক্ষণ অন্তত কয়েক ঘন্টা থাকবে তারপর হয়তো আসবে।এই পর্যন্ত অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়ে অনেকেই ফিরে আসেন। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স-লব্ধ মানুষের একটা বড় অংশ এমন সাক্ষ্য বহন করে। তাঁরা অনেকেই জানিয়েছেন, তৃতীয় স্তরে কোথাও একটা চয়েস রাখা হয়। চৈতন্য মহাচৈতন্যে লীন হতে পারে আবার ইচ্ছে করলে ফিরে আসতেও পারে। জীবন অথবা মৃত্যু এই ‘চয়েস’-এর উপরেই নির্ভর করে। যিনি ফিরে আসতে চান, তিনি তৎক্ষণাৎ ফিরে আসেন। যিনি আসতে চান না, তিনি ‘মৃত্যু’ প্রাপ্ত হন। এই অবস্থাকে অনেকে স্বপ্নে বা আবিষ্ট অবস্থাতেও প্রত্যক্ষ করেছেন। ধ্যানযোগেও এই যাত্রা করেছেন অনেকেই। তাঁদের প্রত্যেকের দেওয়া বিবরণেই কিন্তু এই আখ্যানটি কমন।

আমাদের সবার চৈতন্যই মহাচৈতন্যের অংশ। কিন্তু দেহ আমাদের সেই বোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তথাকথিত মৃত্যুর পরে সেই দূরত্ব লুপ্ত হয়। শুরু হয় আমাদের ‘নিজস্ব’ যাত্রা।     

 


অনেকে বলছে নানা বয়স হয়েছে ঠিকই গেছে কষ্ট পেত না হলে এই বয়সে মরে যায় ভালো গো। তা না হলে খুব কষ্ট হতো আর কান্নাকাটি করো না। মন থেকে থেকে যদি বিচিত্র আওয়াজ শোনেন ফাঁকা বাড়িতে, তবে নিশ্চিত হন, সেটা ছুঁচোর কীর্তি বা বিড়ালের ডাক কি না। তাতে যদি সন্দেহ না-মেটে, তবে সাবধান। আর একটা ব্যাপারেও তিনি খেয়াল রাখতে বলেছেন, যদি হঠাৎ হঠাৎ বাড়ির ভিতরে শীত বোধ হয় গরমকালে, তা হলে সমস্যা রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, সামান্য ঠান্ডা অনুভব করা মানেই তেনারা এসে গিয়েছেন, তা একেবারেই ঠি নয়।হঠাৎ কোনও বিশেষ গন্ধ পাওয়া। গন্ধপিশাচ হতে পারে।  মতে, । বিশেষত, আপনার কোনও অনুপস্থিত প্রিয়জনের সুবাস যদি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে ধাক্কা মারে, তা হলে সাবধান। গন্ধটা খুবই সন্দেহজনক বলে জানবেন। তান্ত্রিক  এবার বললেন একটি নতুন গল্প। এক নরখাদকের কাহিনী। সারা পৃথিবী জুড়েই নরখাদকদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের পাওয়া গেছে ফিজি, আমাজন অববাহিকা, আফ্রিকার কঙ্গোতে। এমন কি নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিলেছে নরখাদকের সন্ধান। ইউরোপের হল্যান্ডেও সন্ধান পাওয়া গেছে।শোনা যায় উগান্ডার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক ইদি আমিনও নাকি নরখাদক ছিলেন।প্রত্যেকটি মানুষকে খাওয়ার পর সর্দার রাতু উদ্রে উদ্রে তার শিকারের স্মৃতিতে একটি করে পাথর সাজিয়ে রাখতো। তারপর খেয়ালখুশি মত গুনতে বসত, এ পর্যন্ত কটা মানুষ খেল সে। সে চাইত তার মৃত্যুর পর তাকে যেন এই পাথরগুলির পাশে কবর দেওয়া হয়। হয়েছিলও তাই। মৃত্যুর পর উদ্রে উদ্রেকে উত্তর ভিটিলেভুর এলাকার সেই পাথরের স্তূপের মধ্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।উদ্রে উদ্রের উদরে যাওয়া সমস্ত হতভাগ্যই ছিল, ফিজির আদিবাসী গোষ্ঠী সংঘর্ষে হেরে যাওয়া যুদ্ধবন্দী। এছাড়া, উদ্রে উদ্রের দলে থাকা রাকিরাকির অনান্য আদিবাসী সর্দাররা তাদের জীবিত বন্দী ও মৃত শত্রুর দেহ উদ্রে উদ্রের হাতে তুলে দিত। মৃতদেহগুলির সৎকারের জন্য নয়, স্রেফ খাওয়ার জন্য।লিথ সাহেবকে উদ্রে উদ্রের ছেলে রাভাতু বলেছিল,  তার বাবা মানুষের মাংস ছাড়া আর কিছু খেত না। এবং  তার নরখাদক বাবা হতভাগ্য মানুষদের পুরো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আগুনে ঝলসে খেত। একেবারে একটা দেহের সব মাংস খেতে না পারলে অর্ধভুক্ত দেহ্টি একটা বাক্সে তুলে রাখত। কিন্তু পরে পুরোটা খেয়ে নিত।সেই মৃত মানুুষের আত্মাগুলো এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারপর ঘুরতে ঘুরতে একদিন সেই নরখাদকের গলা টিপে ধরে এবং সেই আপনাদের হাতেই তার মৃত্যু হয় তাকে পাওয়া যায় ছিন্নভিন্ন একদম টুকরো-টুকরো অবস্থায় তার হাত-পা সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন আঙুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এমনই পরিণতি তার একদম সত্যি ঘটনা বাবুরা...পাহাড়ের উপরে বসে আমরা এই সব কথাগুলো শুনছিলাম তারপর সন্ধ্যে হয়ে গেলে আমরা ফিরে এলাম পিসেমশায় বন্ধুর বাড়িতে তারপর খাওয়া-দাওয়া করে ঠিক এগারোটার সময় শুয়ে পড়লাম বন্ধু আমাদের একটা আলাদা ঘর দিয়েছিল তিনজনকে পেশায় ছিলেন আমরা মেঝেতে বসে ছিলাম তারপর ঠিক বারোটার সময় আমরা দেখলাম আমাদের মশারির ভেতরে কত মশা। অনেক মশা জমা হয়েছে। পিসেমশায় বলছেন এত মশা কেনরে? তখন বললাম যে মশাগুলো মারা উচিত কমে যাবে।পিসেমশাই বললেন দাঁড়া তাড়াহুড়ো করিস না। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে তারপর দেখলাম তিনি সাধনায় বসলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মশা কমে গেল।পিসেমশাই কিন্তু সাধনা ভেঙে উঠলেন না তিনি মারণ, উচাটন  শুরু করলেন।এক ঘন্টার পরে পিছনের ঘর থেকে বন্ধু চিৎকার করে বললেন, কেন রে এত রক্ত কেন? ঘরের মধ্যে দেয়ালে ট উপর দিয়ে রক্ত নেমে আসছে নিচে।পিসেমশাই চুপ করে থাকলেন কোন উত্তর দিলেন না পরদিন সকালে উঠে আমাদের নিয়ে ব্যাগ নিয়ে একদম বাইরে বেরিয়ে এলেন তখন পিছনে বন্ধু বলছেন এই নে  জল খেয়ে যাবি । পিসেমশাই বন্ধুকে বললেন খুব সাবধান আবার যদি আমি পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়, তোর কিন্তু জীবনের সংশয় হবে।তারপর পিসেমাশায়ের বন্ধুটি   আর কোন কথা বলল না।আমরা সকলে বাইরে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।রতন বললো,  বাবা রে, এমন জায়গায় ঢুকেছিলাম কি করে বেরিয়ে আসবো চিন্তা করছিলাম।পিসেমশায় বললেন ওকে আর কোন দিন ঘুরে এইসব লোকের ক্ষতি করতে হবে না। তার কারণ তিনদিনের মধ্যেই পঙ্গু হয়ে যাবে।আমরা ওদের গ্রামের একটা লোকের মুখে অনেকদিন পর শুনেছিলাম  লোকটি নাকি পঙ্গু হয়ে বসে আছে। পিসেমশায় বললেন, ইয়ার্কিকা কথা নেহি,সিরিয়াস ব্যাপার হ্যায় তন্ত্র জগতমে।তিনি বাংলা হিন্দী মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ী ভাষা তৈরি করেন আমাদের হাসাবার জন্য। রতন কাছেই ছিলো। পিসেমশাই বললেন, কি রতন কিছু বলবে? রতন বললো, আমি বোকা। অত কিছু বুঝি না। কিন্তু আপনার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে। কত কিছু শেখা যায়।পিসেমশায় বললেন, বিদুরের নাম শুনেছো?  আমি বললাম, হ্যাঁ উনি তো পন্ডিত ছিলেন। ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। 


১৩


রতন বললো, বিদুর মহাভারত মহাকাব্যে ধৃতরাষ্ট্রের ভাই। আসলে তিনি ছিলেন দাসিপুত্র। পিসেমশাই বললেন, হ্যাঁ আরও অনেক ঘটনা আছে। তবে সে প্রসঙ্গে না গিয়ে তাঁর বাণীগুলো বলি। কিছু শিখতে পারবে। তিনি বলতেন, যার মধ্যে অনেক জ্ঞান আছে সে জ্ঞানী। আর জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বুদ্ধিমান। আর যারা তার সঠিক ব্যবহার করতে পারেন না তাঁরা বোকা। যে মানুষ সফল সে সমস্ত নেতিবাচক ভাবনা থেকে বহুদূরে থাকে। আর জীবনের প্রথম দিন থেকে বেড়ে ওঠাই তাঁদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে তাঁরাই বুদ্ধিমান। কিন্তু বোকা মানুষ চিনতে গেলে তার কিছু লক্ষণ রয়েছে। যাঁদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো রয়েছে তাঁরাই বোকা। ধৃতরাষ্ট্রের সৎভাই বিদুর মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি বলে গেছেন বোকা মানুষের সাতটি লক্ষণ রয়েছে। এখন দেখা যাক সেগুলি কী কী১ যে ব্যক্তি সর্বদা অজান্তে আত্মঅহংকার নিয়ে বাস করেন এবং পরিশ্রম না করেই ধনী হতে চান। এ জাতীয় ব্যক্তিকে বোকা বলা হয়। যে ব্যক্তি তাঁর নিজের কাজ ছেড়ে অন্যের কর্তব্য পালন করেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। তাঁরা বোকা।  এ ছাড়া যারা সর্বদা ভুল কাজ করে চলেন তাঁদের বোকা বলা হয়।এমন ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দাবি করে এবং নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে শত্রুতা করে। সেই ব্যক্তিকে বোকা বলে মনে করা হয়।যে ব্যক্তি তার শত্রুকে বন্ধু তৈরি করে এবং তার জন্য বন্ধুদেরও ত্যাগ করেন। যাঁরা ভুল সংস্থাকে অবলম্বন করেন তাঁদেরই বোকা বলা যায়।যে ব্যক্তি নিজেকে সবোর্চ্চ দেখানোর চেষ্টা করেন তাঁদের বোকা বলা হয়। যে ব্যক্তি ভুল করে অন্যকে দোষারোপ করে এবং সর্বদা তার ভুলগুলি আড়াল করার চেষ্টা করে এমন ব্যক্তিকে মূর্খ বলা হয়। যে ব্যাক্তি নিজের বাপকে অসম্মান করে এবং অজ্ঞ লোককে প্রাধান্য দেয় তাকে বোকা বলে। রতন বললো, পিসেমশাই তন্ত্র সম্পর্কে সমগ্র জ্ঞান আপনার আছে আমরা জানি। যদি এই সমুদ্রজলের একচামচ জলের ধারণা করতে পারি তো ভালো লাগবে। আর আমাদের প্রয়োজনেও লাগতে পারে। পিসেমশাই কম্ববলের  আসনে বসে আমাদের চারদিকে গঙ্গার জল ও মন্ত্র পড়ে গন্ডি কেটে নিয়ে বললেন, যেখানে সেখানে এইসব মন্ত্র পড়তে নেই। তাই স্থানশুদ্ধি করে নিলাম। তারপর তিনি শুরু করলেন তার কাহিনী। তন্ত্র- ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু গভীর তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্র হল এক বৃহৎ ও অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, তন্ত্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। শিব ও মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলিকেও তন্ত্র সাধনা নামে অভিহিত করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে তন্ত্র সাধনার বিকাশ লাভ করে। গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র ভারতের অতিপ্রাচীন এবং গুরু পরম্পরার একটি গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। এটি গুরু পরম্পরা বিদ্যা বলে প্রকৃত গুরুর খোঁজ করতে হয়। দীক্ষা ছাড়া এ শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে কেউ কাউকে কিছু ব্যক্ত ভারতের আদি ও অকৃত্রিম তন্ত্র সাধনার জায়গা হল নীলাচল পর্বত। যা 'কামাখ্যাধাম' নামে পরিচিত। তন্ত্র এমনই একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায়। নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়।তন্ত্র শব্দটির অর্থ ব্যাপক ।


১৪


তান্ত্রিক পিসেমশাই বললেন,  সংক্ষেপে তন্ত্র হচ্ছে "সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম " । মহাদেব বা শিবের ডমরু থেকে তন্ত্রের উৎপত্তি । সতী বা দেবি দূর্গার দশ হাতে আছেন দশ মহাবিদ্যা । এই দশমহাবিদ্যার উপর ভিত্তি করেই অনেকটা তন্তশাস্ত্র গড়ে উঠেছে । তন্ত্রের বিষয়টা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । সাধারনভাবে, তন্ত্র অসীম জ্ঞানের আধার । সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনা রিসার্চ করলে দেখা যায়, যা অবিদ্যাকে গ্রাস করে তাই জ্ঞান । তন্ত্র জ্ঞানচক্ষু উম্মোচন করে ।সৃষ্টির কারন বুঝতে সাহায্য করে তন্ত্র । তন্ত্র সৃষ্টি , স্থিতি ও বিনাশের পরিচালনা শক্তি । ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিন শক্তির পরিচালনা নিয়ম ব্যাক্ত করে তন্ত্র ।তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত আছে মন্ত্র ,যন্ত্র । তন্ত্র সাধনায় সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে । আমি বললাম, একটু বিশদে বলুন। তিনি বললেন, হ্যাঁ তোমরা এখন সাবালক। সব বলা যাবে আশা করি। তন্ত্রমতে মদ, মোহ, মাৎসর্য এই নিয়ে সংসার। নারীর ভূমিকা তন্ত্র সাধনায় অপরিসীম।বায়ুরুপ লিঙ্গকে শূণ্যরুপ যোনীতে প্রবেশ করিয়ে কুম্ভক আসনে সাধনা করতে হয় সাধককে। খুব কঠিন সাধনা। চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী,  ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে 'চৈতন্যময়ী' বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল। কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে।রতন বললো, এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।



                                ক্রমশ...

Sunday, August 28, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -17


 


শ্যামলীদির মুখপানে তাকাতে তাকাতে এক সময় ওর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। মনে তবুও ভয়, জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। শ্যামলীদিকে

বার বার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি শুধু ওর মুখ দিয়ে একথা শুনতে পেয়েছিলাম ওখানে গিয়ে দেখতে পাবো ।


 দেবীবাবু নিজে ড্রাইভ করছেন । সোঁ সোঁ শব্দে পাশের বড় বড় মাথা উঁচু করে প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়া বাড়ীগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে । হাজার হাজার মানুষের মিছিলকে দুফাক করে তীরের মতো চলে যাচ্ছে গাড়ীখানা । বড্ড পাকা হাত দেবীবাবুর । ভয় যে পাচ্ছিলাম না তা নয় । ধীরে ড্রাইভ করতে বললাম । হয়তো আমার কথা তিনি শুনতে পেলেন না । 


দেখতে দেখতে একসময়ে একটা প্রকাণ্ড বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ীখানা । দেবীবাবু আমাকে নেমে আসতে বললেন । আমি গাড়ী হতে মাটিতে নেমে প্রকাণ্ড বাড়ীটার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকি এখানে কিসের জন্য এলাম । ওর কথায় ভাবনাকে দূরে সরিয়ে ওকে অনুসরণ করতে করতে হাজির হলাম ঐ প্রকাণ্ড বাড়ীটার তিন তলার উপরে । আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে , কি কারণে , তা জানার জন্য মনে কোন স্পৃহা জাগেনি । ওকে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে করে ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছি । 


দেখলাম তিন তলার উপরে বহু নরনারীর সমাবেশ । কিন্তু সকলে কাজে ব্যস্ত । মাঝে মাঝে অড় চোখে তাকাচ্ছিলাম । কেউ কেউ আমার পানে তাকিয়ে পুনরায় মুখ নামিয়ে নিচ্ছিলো । হঠাৎ দুটো নার্স এর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলাম । তবে কি এটা কোন ডাক্তারখানা বা নার্সিহোম ? কিন্তু ডাক্তারখানার কোন নিদর্শন দেখছি না ।


 নার্স দুজন এগিয়ে এসে দেবীবাবুকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন , কিন্তু দেবীবাবু বাধা দিতেই মুখ বন্ধ করল । আমার মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল । মনে হচ্ছে আমি যেন কোন ইন্দ্রজালে আবদ্ধ হয়েছি যার ফলে কিছু করতে পারছি না । 


এক সময় দেবীবাবু বলে উঠলেন , ঐ রুমটার ভেতরে যান আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি । 


ওকথা শুনে আমি কোন এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলাম । আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল । 


দেবীবাবু বললেন , কোন ভয় নেই , এটা নার্সিংহোম , কেউ আপনার ক্ষতি করবে না।


 আমি জেদ নিলাম আমি একা যাবো না । দেবীবাবু কথা না বাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন , আমিও করলাম ।


 আমি যেই মাত্র প্রবেশ করেছি , একটা ছোট মেয়ে বয়স বছর পাঁচ ছয়ের কাছাকাছি , ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো পরিস্কার গায়ের রঙ তার , আমার চোখ ওর চোখ এক হতেই মেয়েটা বিছানা হতে নেমে আমার আঁচল ধরে টানতে লাগলো ও কাঁদতে কাঁদতে বলল , মামনি , কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে মামনি , কেন আমাকে সাথে নিয়ে যাওনি মামনি , মামনি কথা বল মামনি ।


কি করব ভাবছি। ওর কথা শুনে শরীরটা তো শীতল হয়ে গেলো । সহজ , সরল শিশুর কোমল স্পর্শে আমার হৃদয়ে মাতৃত্ব জেগে উঠলো অনাস্বাদিত পূর্ণ মাতৃত্বের কোমল স্পর্শ আমার অন্তরকে স্বর্গীয় আনন্দে অভিভূত করে তুলল । ভুলে গেলাম আমি বারবণিতা রমা । 


মা তুমি কথা বলছ না কেন ? মেয়েটি কথা বলতে বলতে ওর ফুলের কুঁড়ির মতো ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকল ।


 বিলম্ব না করে মেয়েটিকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলাম । বার বার ওর ঠোঁটে চুমু খেতে থাকলাম । আমি তোকে ছেড়ে আর যাবো না মামনি । আর কোন দিন তোকে কষ্ট দেব নারে । গভীর অপত্য স্নেহে কচি শিশুটির মুখে আমার মুখ ঘষতে থাকলাম । ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি দারুন অন্তর্বেদনায় চিন্তা করতে লাগলাম । মা হতে তো জীবনে পারব না । মা হবার আশা অনেক আগে মুছে ফেলেছি কিন্তু একে কি মেয়ে বলে বুকে টানতে পারব না ? বারবনিতা বলে কি মাতৃত্বের সুকুমার প্রবৃত্তি কোন অংশ আমার দেহে নেই ?


 মেয়েটি কে- তা একটু পরেই জানতে পারবো । তার আগে আমার হৃদয় মরুভূমিতে মরুদ্যানের সজীবতা নিয়ে আসি । দেবীবাবু দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । জানি না তার অন্তরে কিরূপ প্রবাহ চলছিল । 


ধীরে ধীরে মেয়েটিকে কোলে তুলে ওর বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওকে আদর করতে থাকলাম । এমন সময় একজন নার্স প্রবেশ করে বললেন , এবার তোমার মাকে ফিরে পেয়েছো ময়না , এই দুধটুকু খেয়ে নাও ।


 ময়না যে মেয়েটির নাম তা জানতে পারলাম । ময়না বলল , সে আমার হাতে দুধ খাবে । নার্স স্বপ্নাদেবী আমাকে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে বেশ সুমিষ্টি কণ্ঠে বললেন , আপনি ওকে খাইয়ে দিন । বেচারা কোন দিন আমার হাতে কোন খাবার খেতে চায় না । এখন আসি ময়না , তোমার মা তোমাকে অনেক আদর করবে । স্বপ্নাদেবী অপেক্ষা না করে দেবীবাবুকে কি যেন বলে বাইরে বেরিয়ে গেল । 


যত্ন সহকারে ময়নাকে দুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলাম । ঘুমপাড়ানির গান আমার জানা নেই , তাহলে উপায় । ময়নার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে তার অবসন্ন দেহটা এক সময় ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে গেল । ধীরে ধীরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেবীবাবুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম মেয়েটি কে ? আর কেনই বা আমাকে ওর মা মনে করল । 


দেবীবাবু অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোকে রুমাল দিয়ে মুছে নম্র কণ্ঠে বললেন , বাইরে আসুন বলছি । ওর পিছনে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম । বললেন , ময়না আমার মেয়ে । নিজের অন্যায় অত্যাচারের জন্য সব কিছু হারিয়েছি । ময়নার মাঝে হারিয়েছি , বাবাকেও হারাতে বসেছি , জানি না ভাগ্য এরপর কতখানি সুপ্রসন্ন । যদি আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হতো তাহলে মনে হয় অবলা সরল এক নিষ্পাপ শিশুকে হারাতে বসেছিলাম । আমার অন্যায় অত্যাচারের কথা সময় হলে একদিন বলবো । ময়নার মা যেদিন আত্মহত্যা করল , পরদিন হতে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত অবোধ শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো । যাকে বলে সাইকিয়াট্রিক ভিস ওর্ডার । মায়ের আদর আবদারে সে পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কোন আপনজনকে চিনতো না , আমার সংস্পর্শেও থাকতো না । কারো সাথে কথা বলতো না । যদি জোরপূৰ্ব্বক কথা বলতে চেষ্টা করতাম , তাহলে শ্রাবণের বর্ষণের মতো চোখ ফেটে দরদর ধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।



                            ক্রমশ...

Saturday, August 27, 2022

ছোট গল্প - উপলব্ধি || লেখক - সিঞ্চিতা বসু || Short story - Upolobdhi || Written by Sinjita basu


 

উপলব্ধি

সিঞ্চিতা বসু 



রান্নাবান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো l দুর্গন্ধটা সকাল থেকেই নাকে লেগে আছে,কিন্তু এখন চোখে দেখে গা গুলিয়ে উঠলো পরমারl সমীর কর্মচারীদের তোয়াক্কা না করেই কাজে হাত,লাগিয়েছে l সামনে স্তূপীকৃত শুকনো গোবর,পাতা পচানো সার,ডিমের খোসা l দুজন লেবার ডিমের খোসাগুলোকে গুঁড়ো করছে l এছাড়া একটা বড়ো ড্রামে জমা আছে ফল সব্জির খোসা,মাছের আঁশ ইত্যাদি রান্নাঘরের ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে তৈরি কম্পোস্ট l ড্রামটা ঢেলে ফেলা হয়েছে উঠোনের মাঝখানে l বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল পরমার- এতো বার বলা সত্ত্বেও সমীর গ্লাভস পড়েনি l দুহাতে গোবর মাখা,গামছা পরা সমীরকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে এই লোকটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা l পাঁশকুড়া তে তাদের এই ফুল ফলের নার্সারী জন্ম সমীরের দাদুর হাতে l দুই পুরুষ ধরে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা  'মহামায়া নার্সারি'র খ্যাতি অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে সমীরের হাত ধরে l শ্বশুর মশাই অবশ্য এটাই চেয়েছিলেন, আর সেজন্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিখে আসার জন্য ছেলেকে প্রায় জোর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য l নার্সারি টা সমীরের এখন শুধু পেশা নয় নেশাতেও পরিণত হয়েছে l নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ফুল ফলের আকার আয়তন বৃদ্ধি, গ্রাফটিং করে একটি জবা কাছে আরো তিন চার রকম রং এর জবাগাছের ডাল প্রতিস্থাপন করাতে মজে থাকে সমীর l সন্ধ্যের পর দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হওয়া গাছপালা সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নালে ডুবে থাকে l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর থেকে পরমা প্রায় বোবা হয়ে গেছেl টিভিতে সিরিয়াল দেখতে ওর কোন কালেই ভালো লাগেনা, গান শুনেই বা কতটা সময় কাটানো যায়? মরীয়া হয়ে সমীরের সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে চায় পরমা,কিন্তু ' হুঁ 'বা 'না 'এর বাইরে কোন শব্দই বেরোয় না তার মুখ থেকে l অথচ এই মানুষই যখন তার কাজকর্ম নিয়ে,হরমোনের প্রয়োগ,ছত্রাকের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করে, তখন কথার কোনো

অভাব হয় না l চেন্নাই, পুনে,ব্যাঙ্গালোরের কৃষিবিজ্ঞানীদের সাথেই বেশি আলোচনা হয় ওর l সমীরকে তো প্রায়ই ভিডিও কলিং করতে দেখা যায় ডক্টর মহেশ মঞ্জরেকার বা প্রফেসর নাইডুর সাথে l প্রথম প্রথম পরমার ও খুব আকর্ষণ জন্মেছিল বিভিন্ন ধরনের ফুল ফলের গাছপালা ও অর্কিডে l সময় পেলেই সে সমীরের কাছে শুনতে চাইত বিভিন্ন গাছের পরিচর্যা,শিখে নিতে চাইতো নানা ধরনের ফুল ফলের নাম ও প্রজাতি l রান্নাঘরের সবজি ফলের খোসা,ডিমের খোলা যত্ন করে একটা মুখ ঢাকা ড্রামে জমা করে  রেখে দিতো l

    ছোট থেকে শহরে মানুষ হওয়া,আশুতোষ কলেজে পড়া পরমার গ্রামে মানিয়ে নিতে যে খুব অসুবিধা হবে একথা বিয়ের আগের আত্মীয়-স্বজনের মুখে বহুবার শুনেছি সে l খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর কলামে বাবা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল,সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই যোগাযোগ l বেশিরভাগ বাবাদের যেমন চাহিদা থাকে মানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার,সরকারি চাকুরীজীবি অগ্রগণ্য, বাবার দেওয়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু তেমন কিছু লেখা ছিল না l শিক্ষিত,ভদ্র মোটামুটি রোজগেরে হলেই চলবে এমনই ছিল বিজ্ঞাপনের বয়ান l তাই শিক্ষিত,মার্জিত কথা বলা সমীরকে বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল l

        গ্রাম্য জীবনযাত্রা সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল পরমা  l নিজেকে চেনে পরমা- বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ সে l সেই আবেগের বশেই বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ও শান্ত আপাত গম্ভীর মানুষটার সম্বন্ধে অনেক আকাশকুসুম কল্পনা করে ফেলেছিল l বছর দুয়েকের মধ্যেই সেই মিথ্যে কল্পনার জাল ছিঁড়ে গিয়েছিল l কোন মানুষ তার নতুন বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যে এত নিস্পৃহ থাকতে পারে তা সমীরকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না l কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পরমা নিজের বাবা দাদাকেও দেখেছে l কিন্তু কাজের সমুদ্রে শুধু অবগাহন করাই নয়,অন্তহীনভাবে এমন করে নিমজ্জিত থাকা হয়তো সমীরের পক্ষেই সম্ভব  l অদ্ভুত অদ্ভুত উদ্ভিদের ও ফুলের ছবি কালেক্ট করে, তার বিজ্ঞানসম্মত নামসহ ডায়রির পাতায় আটকানোর আগ্রহ সর্বদাই পরমার সাথে দুটো কথা বলার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় সমীরের কাছে l সমীরের দুনিয়ায় পরমার কোন স্থান নেই,ইদানিং সে সমীরের জীবনে একেবারে অনাহুত হয়ে গেছে l শারীরিক আকর্ষণ ও এখন তলানিতে l আজকাল বেশিরভাগ রাতেই সমীর বেডরুমে আসে না,লাগোয়া স্টাডিরুমের ক্যাম্প খাটেই শুয়ে  পড়ে l আগে পরমা এসব নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে চোখের জল বাঁধ মানতো না,রাতে ঘুম আসত না l পরে ধীরে ধীরে রাগ দুঃখ যন্ত্রণা সব স্তিমিত হয়ে এসেছে l দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে বুঝিয়েছে, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে যে এই অনাসক্তির পিছনে অপর কোন নারীসঙ্গ নেই l এ ব্যাপারে পরমা একশো ভাগ নিশ্চিত l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর দুটি প্রাণীর জীবন পাশাপাশি সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীর মত গতিময়,কিন্তু কখনো তাদের জলরাশি মেলে না l পরমার মাঝেমধ্যে সমীরের এই নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয় ও বুঝি এক ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী,জাগতিকতাকে দূরে ঠেলে সাধনায় মগ্ন l দিনের বেলা তবুও বাগানে প্রচুর লোকজন কাজ করে, কিন্তু যেই নিঝুম রাত্রি নামে পরমাকে একাকীত্ব গিলতে আসে l তখন নিজেকে পৃথিবীতে ভীষণ অপ্রয়োজনীয় মনে হয় l বিয়ে ঠিক চার মাস পরে শাশুড়ি মার জেদাজেদি তে সমীর তার নিজস্ব গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে ছিল l সেই প্রথম দুজনের ঘুরতে যাওয়া,সেটাই শেষ l কালিম্পং এর কাছে ছোটা মাংবার পাহাড়ে সেদিন সন্ধ্যে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছিল ,সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাত l হোমস্টের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিল পরমা l হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি তে আশপাশের পরিমণ্ডল, তিস্তা কিছুটা নজরে আসছিল,আবার পরক্ষনেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল lসেই নৈঃশব্দের মাঝে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিলো  তাকে l তখন সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে l একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে নিজের দিকে টেনে এনেছিল l  কথা বলার অবকাশ পায় নি পরমা,মনে হয়েছিল সেই চুম্বন বুঝি শেষ হবে না,তা বুঝি এই অবিরাম বারিধারার মত সারারাত চলবে l পরমার শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল l  দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডিনারের জন্য ডেকে ফিরে গিয়েছিল হোমস্টের কেয়ারটেকার l রাত গভীর হল,জেগে রইল শুধু আলিঙ্গনাবদ্ধ দুটো শরীর l পরমার মনে,চেতনায় সেই স্মৃতি স্পষ্ট ও অমলিন l আসলে যে স্মৃতি বারবার রোমন্থিত হয় তা যে কিছুতেই  ফিকে হয় না,ভিজে আঙুলে জড়িয়ে থাকা চুলের মতো মেখে থাকে l তারপর থেকে সমীরকে আর এমন করে ফিরে পায়নি পরমা lসেই কটা দিনের জন্য একান্ত নিজস্ব পরিসরে নতুন করে পাওয়া মানুষটা ফিরে এসে আবার নিজের চারপাশে গণ্ডী টেনে নিয়েছে lসেই গণ্ডী পার হওয়ার ক্ষমতা বা যোগ্যতা নেই পরমার l

      আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না, সেই উদ্দাম যৌনতার স্মৃতি আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে l মনে পড়লো - "আ লাইফ মেজার্ড ইন মেমোরিস " l

       ধীর পায়ে উঠে এলো সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিজের আটত্রিশ বছরের শরীরটাকে l  চামড়া নিভাঁজ,আলগা করে বাঁধা খোঁপা ভেঙ্গে এলিয়ে পড়া একঢাল চুল l না জানিয়েই সে ইতিমধ্যে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা  বা ডিপ্রেশন থেকে দূরে রাখার জন্য l অনেক ভেবেচিন্তে নাম দিয়েছে 'রাতজাগা তারা ' l সেই জেগে থাকা তারা কখনো তার নিজের মুখ দেখায় না  l স্ক্রিনে বইতে থাকে উত্তরবঙ্গের তিস্তা  তোর্সা,দাঁড়িয়ে থাকে পাইনের সারি,ফুটে থাকে রডোডেনড্রন এর গুচ্ছ,পেছনে থাকে নিশ্চল নিশ্চুপ মৈনাক lজেগে থাকা তারা তখন কখনো আবৃত্তি করে সুনীল গাঙ্গুলীর নীরা,কখনো বা পাঠ করে  'শেষের কবিতা 'থেকে l কোন কোন মন খারাপের রাতে সে বলে যায় কাদম্বরীদেবীর একাকিত্বের কথা l কেউ কেউ বাচিকশিল্পীকে চাক্ষুষ দেখারও ইচ্ছা প্রকাশ করে l 

        পরমা দমবন্ধ করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে অবদমিত করে শরীর মনের তৃষ্ণা l দাঁতের প্রবল চাপে পাতলা ঠোঁটে রক্তবিন্দু ফুটে ওঠে,হালকা হয়ে আসে শরীরের শিহরণ,মনের আলোড়ণ l মুখে ঘাড়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতে হবে,তাই চান ঘরের দিকে এগোলো পরমা l নভেম্বরের মাঝামাঝি, বাতাসে একটা শিরশিরে ভাব -তবুও পরমার কপালে নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম l বাথরুম থেকে ফেরার সময় প্যাসেজ এর জানালার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখলো পরমা l কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের নিস্তব্ধতা কে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা আওয়াজ, বাতাস মাতোয়ারা উঠোনের লেবু ফুলের গন্ধে l আনমনেই দাঁড়ালো সে সমীরের ঘরের সামনে, দরজাটা সামান্য ফাঁক করা,ভেতরের আলোর ভগ্নাংশ পরিমাণ বাইরে এসে পড়েছে l তবে কি সমীর এখনো কাজে ব্যস্ত বা পড়ছে কিছু?দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই হোঁচট খেতে হল l  স্তূপীকৃত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের কৌটো এলোমেলোভাবে রাখা আছে  l কি ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে ঘরটাl একটা ছোট গোলটেবিলে স্তুপিকৃত কাগজপত্র পাশেই ইলেকট্রিক কেটলি, চায়ের দাগ লাগা খান চারেক কাপ l প্রায় চারমাস সে এ ঘরে ঢোকে নি,ঘর মোছার জন্য রানীদিকেও ঢোকানো যায়নি,কারণ সমীরের একেবারে অপছন্দ তার জিনিসপত্রে কেউ হাত দিক l পরমা দেখল বড় টেবিলটাতে হাতের উপর মাথা দিয়ে সমীর ঘুমাচ্ছে l টেবিল ল্যাম্প এর আলো তার মুখে পড়েছে l কম্পিউটারের স্ক্রিন তখনও জ্বলজ্বল করছে l  সেখানে একটা অসাধারণ একটা জবা গাছের ছবিl   গাছটির পাঁচটি ডালে পাঁচ রঙের ফুল ফুটে আছে l নিচে তার বর্ণনা -গ্রাফটিং করার জন্য মাদার প্লান্টের নাম, গ্রাফটিং এর পদ্ধতি, হরমোনের নাম ও সংকেত ইত্যাদি তালিকাবদ্ধ করা l একদম নিচে হাইলাইট করা আছে সমীরের দেওয়া গাছটির নাম  -'রাত জাগা তারা'l

Friday, August 26, 2022

ছোট গল্প - রূপনারায়ণের ঘাট || লেখক - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Short story - Rupnarayaner Ghat || Written by Dorpona Gongopadhay


 


রূপনারায়ণের ঘাট

   দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়



নবগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাড়ি শুভদীপের পুরনো আমলের সাবেকি বাড়ি। রাম বিলাস বাবু শুভদীপের বাবা ।একদিক সারিয়ে দোতলার চারটি ঘরে বসবাস করেন।  শুভদীপ তার একমাত্র পুত্র ।

বাড়ির পশ্চিমে পুকুর ,পূর্বে বড় উঠোন ,দক্ষিণে ক্ষেত,

উত্তর দিকে রাস্তা ,-রাস্তার ওপারে আবার ক্ষেত সবুজে সবুজ।

রাম বিলাস বাবুর দাদুর আমল থেকেই বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। তাই দেশভাগের পর নিচের ঘর গুলো বাংলাদেশ থেকে আসা পরিবারগুলোকে ভাড়া দিয়ে দেন।

 শুভদীপ দের নিচের ঘরেও বিগত পাঁচ বছর আগেও চারটি ঘরে চারটি ভাড়াটে ছিল।

অনেক কষ্ট করে উহাদের তুলে নিচের ঘর চারটে  সারানো হয়েছিল। প্রতিটি ঘরের কোলে বড় দালান যে যার ঘরের দালানে তারা রান্না করত, বাইরে পুকুর উঠোনে কুয়ো,এই ছিল জলের ব্যবস্থা। আজ থেকে 35 বছর আগে বাঁশ বাগানেই অপকর্ম চলত। দিন বদলালো সবাই বাথরুমের অভাব অনুভব করতে লাগলো। বিশেষ করে শহুরে নতুন বউ শুভদীপের  মায়ের, তাই ওপরের একটি ঘরে আলাদা করে প্যান বসিয়ে পাইপ নামে নিচে পাৎকো সিস্টেম করে পায়খানা ও জল জমার জন্য একটা গর্ত খুঁড়ে ড্রেনিং সিস্টেম এবং কূয়ো থেকে ছাদের উপরে জল তুলে ওপরে কলের বিশেষ ব্যবস্থা,

যখন শুভদীপের বাবা এসব করছিল তখন  ভাড়াটিয়ারা এসব পছন্দ করছিল না, ওরা সবাই মিলে যৌথভাবে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে শুভদীপের বাবার নামে নালিশ দিল। তাতে গ্রাম প্রধান ভাড়াটিয়াদের পক্ষ অবলম্বন করল ,শুভদীপের দাদু তখন কোর্টের দ্বারস্থ হলো সেই থেকে মামলা এত বছর বাদে মিটলো তাও কি ভাড়াটেদের এক ঘরের তিন কন্যার বিবাহ হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে এবং কর্তা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে গিন্নি ও অসুস্থ তাই তার বড় মেয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল যখন চাবি এমনি দিয়ে গেল,শুভদীপের মাকে,কারন বড়ো মেয়ে শুভদীপের মায়ের বন্ধু ছিল।

দ্বিতীয়জন সরকারি চাকুরে ছিল সে বুঝতো যে আইন ওদের দিকেই তাই জিতবে না মামলা জেনে অন্যত্র বাড়ি করে এই ঘরে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে কেস ডিসমিস হয়ে যায় তৃতীয়জন স্বামী-স্ত্রী থাকতো তাদের দুই পুত্র পুত্রবধূ কেউই কখনো খোঁজ নিতে আসতো না আলাদা কোথাও থাকতো তাই তাদের এই অসহায় অবস্থা দেখে শুভদীপ ওদের বাঁধের পাড়ের বাড়িতে ওদের ব্যবস্থা করে দিল থাকার, আরেকটি ঘর চতুর্থ ঘর বিবাহ হবার পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত মেয়ে এবং বিধবা মা থাকতো তাও তার বয়স ৪০ ঊর্ধ্ব এরাও অসহায়। তাই শুভদীপ এদেরও বাঁধের পাড়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে থাকতে অনুরোধ করে এইভাবে নিচেটা খালি করে ওরা নিচেটা সারিয়ে নেয়। আর ওই বাঁধের পাড়ের বাড়িটার পাশে মন্দির আছে মন্দিরের পুরোহিত এবং দারোয়ান এই বাড়িটায় থাকতো বাঁধের পাড়ে বাড়িটায়, এখন অন্য টুরিস্টরা আসলেও থাকে। ফলে এই বাড়ি থেকে আয়ও হয় এইসব আয়ের টাকা দিয়ে এই নিচের তলাটা পুরোই সারিয়ে নেয় শুভদীপের বাবা। উঠোনের দক্ষিণ দিকে ঠাকুরদালান এবং ভোগ রান্নার ঘর সবটাই সারিয়ে নেয় আর উত্তর দিকে ঘর গুলোর অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ও দুটো ভেঙে পাঁচিল দিয়ে বড় গেট লাগিয়ে দেয়। বাকি পড়ে থাকে পূর্ব দিকে চারটি ঘর ,একতলা চারটি, দোতলায় চারটি। ঘর গুলো পিসিমার ভাগের ছিল, আগে পিসীমার ছেলে আসত ঘর পরিষ্কার করত ফসলের ভাগও নিয়ে যেত ইদানিং বছর দশেক আর আসেনা অনেক খোঁজ করে জানতে পারলো যে উনার মেয়ে এখনো বেঁচে আছে এবং শ্বশুর বাড়িতে আছে, শুভদীপ খোঁজ করে সেই পিসীমার ছেলের মেয়ে অর্থাৎ পিসিমার নাতনি শুভদীপের পিসি ঠাকুমা হয় তার বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। গিয়ে দেখল খুব বড় কোলকাতা শহরে বাড়ি কোন জিনিস নেই, নেই--- সব জিনিসে ভর্তি কোন অভাবের চিহ্ন নেই। জিজ্ঞাসা করল। আপনার এসব মেন্টেন হয় কি করে আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন কিভাবে আপনার চলে কিভাবে? --- উত্তরে একটু হেসে পিসি ঠাকুমা বললেন টাকার কোন অভাব নেই, তবুও আমার ছেলে মেয়ের অযথা টাকা রোজগারের নেশা ।ছেলে থাকে আমেরিকা তার বাবা মারা যেতেই সে আসেনি,--- বসে আছে মা ! মরে গেলেও সে আসবে না! আর মেয়ে থাকে বম্বেতে, মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে ---!

 তোমাদের ওই জঙ্গলে বাড়ি। আমি নিয়ে কি করব আমার ছেলে মেয়েও কখনো যাবে না। ওরা তো কখনো দেখেইনি,--- আমি তবু বাবা-মায়ের হাত ধরে গেছি; চিনি, তোমার ঠাকুমা আমার বৌদি হন। বৌদির সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল আমার একবার যাওয়ার ইচ্ছা হয়। তো চলনা পিসি ঠাকুমা আজই চলো আমি তোমায় গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছি আবার গাড়ি করে ফেরত দিয়ে যাব। যেমনি বলা তেমনি কাজ। একটা ওলা ডেকে শুভদীপের সঙ্গে বাড়িতে তালা দিয়ে পাশের বাড়িতে বলে পিসি ঠাকুমা নবগ্রামে এসে হাজির। তারপর যেন মনে হলো দুই কিশোরী মেয়ে নতুন দেখা হয়েছে। দুই ঠাকুমা শুভদীপের,--- গল্পে মেতেছে রান্নাবান্না শুভদীপের মা করছে, যথাসময়ে খেতে দিল এত আদর আর আপ্যায়ন দেখে বেশ আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ল,  পরের দিন দুজনে সারারাত জেগে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করল। দশটার সময় শুভদীপের দাদু পিসি মাকে ডাকিয়ে তালা ভেঙে দোতলার চারটে ঘর খোলালো তারপর ওরা পরিষ্কার করতে লাগলো মিস্ত্রি ডেকে। মিস্ত্রিরা দুটোর সময় গেল। তখন এসে পিসি মাকে বলে গেল যে বাড়ির অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে জানলা দরজা নষ্ট হয়ে গেছে, খাট বিছানা ঠিক নেই, দেখো কি নেবে আর কি ফেলবে, পিসেমা বলল পুরনো কিছুই আর নেব না সব নতুন করে সাজাবো তিনটে নাগাদ সবাই মিলে ওই চারটি ঘর পরিদর্শনে যাওয়া হলো। একে একে সব ঘরই ঘুরে দেখা হল। প্রতি ঘরেই অনেক আসবাবপত্র খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল দেরাজ টেবিল চেয়ার একটা ঘরে আগেকার পুরনো একটা কলের গানের মেশিন পিসি ঠাকুরমা বলল ওটা চালিয়ে দিতে। মিস্ত্রি চালিয়ে দিল। চলতে শুরু করল রবীন্দ্র সংগীত বাজতে লাগলো, বাড়ি গমগম করে উঠলো, শুভদীপের ঠাকুমা আষাঢ় ধানতোলার টাকায় এবার দুর্গা পুজো হবে ,অনেক লোক বলা হবে। তুমিও থেকে যাও। শুভদীপের ঠাকুরমা বলল যে দুর্গা পুজো কাটিয়ে যাবে। খুব আনন্দ হবে আগেকার মত। ঠিক এমন সময় একটি কবিতা আরম্ভ হলো কলের গানে --- "আমি গোপি বালা এইবারই ছোট বউ ছোট কথা ভীষণ অসুস্থ সবে ছয় মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে সবাই আমাকে ছোটকর্তার অসুখের জন্য দায়ী করছে। আমাকে অপয়া বলছে অথচ উনি নিশ্চিত আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন না হলে এই ছয় মাসের মধ্যে এত বড় অসুখ কি করে বাঁধে, আর ওনার অসুস্থতার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না! সকলেই বললে ছোটকর্তা মারা গেলে আমাকে সহমরণে যেতে হবে। অযথা যুবতীকে ঘরে রেখে কলঙ্কের দায় পরিবার নেবেনা!

মাছ ভেঙে পড়ল মাকে চিঠি পাঠালাম কিন্তু মায়ের থেকে কোন উত্তর এলো না। রাতদিন খাওয়া বন্ধ করে সকলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলাম। স্বামীর জন্য হিন্দু ছেলে মুসলিম ফকির এবং মসজিদে গিয়ে মৌলভীর কাছে নানা ওষুধের খোঁজ করতে লাগলাম। একদিন মৌলবী বললে মা, যে কদিন উনি আছেন উনার সঙ্গে থাকো এভাবে রাস্তায় ছুটে কোন লাভ হবে না কিন্তু ওনার কাছে যাওয়ার অধিকার তো আমার ছিল না। সবাই উনাকে ঘিরে রাখত। কারণ ওনার অনেক টাকা পয়সা গয়না গাটি অবশেষে একদিন ওনার কাছে পৌঁছে গেলাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কি দোষ উনি আমার দিকে চাইলেন বললেন পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তোমাকে আমি রাজরানী করে রাখবো এ জন্মে তুমি আমায় ক্ষমা করো বলেই তিনি চোখ বুঝলেন। সকলের রেড়ে করে উঠল। এই অপয়া মেয়েকে কে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে আমাদের ছেলের প্রাণ নিয়ে নিল কি অপরাধ কি অপয়া বাপু!

সকলেই বিকট চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে লাগলো, বাড়ি মাথায় করে তুলল তারপর শোভাযাত্রা সাজিয়ে আমাকেও সাজগোজ করিয়ে সহমরণে নিয়ে গেল ঢাকঢোল খুব আস্তে লাগলো। কি সুন্দর ঘাঁট রূপনারায়ণ ঘাট। নিচে নেমে গেছে। চওড়া সিঁড়ি। জল টলটল করছে---

তারি  পাড়ে উঁচু চিতা সাজানো

সেই চিতার ওপর ধীরে ধীরে ছোট কর্তাকে শুইয়ে দেয়া হলো । তারপর নিয়মকানুন শেষ করে আমাকেও হাত-পা বেঁধে ওই জলন্ত চিতার উপর বসিয়ে দিল আমি খুব চিৎকার করতে লাগলাম সবাইকে বারে বারে বলতে লাগলাম আমি এখান থেকে চলে যাব, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না, কখনো আসবো না; আমাকে ছেড়ে দাও! জোরে জোরে ঢাক বাজতে লাগলো আমিও চিৎকার করতে লাগলাম জ্বলন্ত শরীরের জ্বালাপোড়া নিয়ে! হঠাৎ হাতের বাঁধন খুলে গেল তখন পায়ের বাঁধন খুলে রূপনারানের জলে ডুব দিলাম ভাবলাম বেঁচে গেছি কিন্তু না ওরা আমাকে তুলে আনলো তারপর টানতে টানতে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ মাথায় একবাড়ি মারল,--- রক্ত ছিটকে গিয়ে লাগলো রূপনারায়ণের ঘাটের পাঁচিলে, 

তারপর সব চুপ! 

আজও তুমি পাবে ওই ধ্যাবড়ানো রক্তের দাগ যারা আমার গল্প শোনাবে। রূপনারায়নে কান পাতবে, ও তোমাদের আমার গল্প বলে দেবে। 

এখনো আমি এই ঘাটে অপেক্ষায়। 

তুমি আসবে তো!

ছোট বাবু!

Thursday, August 25, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -5


 


দাদু বললে, কি করে মাঠে এত জল  এল  আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। শরীরটা ছিল।সে সম্ভোগে ব্যস্ত।দেহের অণু পরমাণু  অংশ ভিজে।কিন্তু মন যে শুষ্ক।মনের শূণ্য অংশও অধিকারে নেই তার।সে ছুটেছে পদ্মবনে। সেখানে তার রূপ দর্শনে মোহিত তার মন। এদিকে শরীরলোভি সে খবর রাখে না। ভিজে ভিজে ভালোলাগা শেষে বিরক্তির বিশ্রাম।আর মনলোভি নাগর দখল করে নেয় প্রিয়ার মন। শরীরে তার আসক্তি নেই।ক্ষণিকের আনন্দ নয়, অসীম আনন্দের অনুসন্ধানী তার মন। 

মনোজকে চিনু একটা রাজার গল্প বলেছিল। চিনু বলেছিলো,

এক ছিলো রাজা।সে প্রজাদের রক্ত খেতো।তাদের পরিশ্রমের ফসলের সবটুকু হরণ করে নিত।প্রজারা বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে যেতে  শুরু করলো।শয়তান, রাজাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে যেত।সে ঝগড়া কলহ নিয়েই ভালো থাকত।প্রজারা তার অন্ধকারের দাসত্ব স্বীকার না করলেই তাকে সুস্থভাবে বাঁচতে দিত না।আলোর পরশ সহ্য করার ক্ষমতা রাজার ছিলো না।অত্যাচারী,ভন্ড ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠলো। একদিন প্রজাদের প্রার্থনায়  এলো আলোর ফেরিওয়ালা।তার আলোতে আলোকিত প্রজারা তার কাছে ভালো পরামর্শ পেতো।মানুষকে শান্তিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতো সে।  একদিন আলোর ফেরিওয়ালাও বন্দি হলো রাজার কারাগারে,নিষ্ঠুর অন্ধকারের অন্তরালে। রাজার কর্মচারিরাও আলোর ফেরিওয়ালার প্রেম পরশে চেতনা ফিরে পেলো।তারা প্রতিজ্ঞা করলো,আমরা বাঁচার মত বাঁচবো।শয়তানকে বন্দি করবো।রাজা একা হয়ে পড়লো।কারণ আলোর পরশ পেয়ে সকলের মনের অন্ধকার দূর হয়েছে।তারা ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে।সুস্থ জীবনের সন্ধান পেয়েছে।অবশেষে অত্যাচারী রাজা আলোর কাছে পরাজিত হলো।আলোর প্রাচুর্যে অন্ধকারের রাজার অন্তর আলোকিত হলো।

রাজা বুঝতে পারলেন,শান্তিতে বেঁচে থাকার  জন্য  পৃথিবীতে আলোর বিশেষ প্রয়োজন। সরল দে একজন সরল মানুষ। সে সস্তায় জীবন ধারণ করার জন্য ফুটপাতের সস্তা পোশাক ব্যবহার করেন। বাড়িতে এসে জামা পরতে গিয়ে দেখে সাইজে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার সস্তায় দর্জির দোকানে সেলাই করে ঠিক করে জামা। আবার জামা কাচাকাচি করার পরে ছোটো হয়ে যায়।  সরল সস্তায় খাবার খোঁজে। মুরগীর রোগ হলে সস্তায় কিনে খায়।   সস্তার শরীর সরলের, জোর কিন্তু বাড়ে। জমিতে ফসল ফলায়। খোলা আকাশের নিচে আনন্দে থাকে।    সস্তায় তার জীবন চলে বলে সকলে তাকে সস্তা সরল বলেই ডাকে। সরল এতে রাগ করে না। কারণ লোকে ঠিকই বলে। সস্তায় কোনো কিছু পেলে সে বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর বকুনি খায়। সস্তায় একবার একটা প্যান্ট কিনে সে বাড়ি গিয়ে কাচার পরে দেখে সেটা আর পরণের উপযুক্ত নয়। তবু সে পরে। সে বলে, যতই হোক টাকা দিয়ে কেনা। একবার সরল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে রইলো সস্তা মুরগীর মত রক্তাক্ত অবস্থায়। দামি কেউ নেই। তারা তাদের দামি জীবন নিয়েই ব্যস্ত। সস্তা জীবনের জন্য তাদের সময় নেই। 

কিন্তু সস্তা সরল রাস্তায় পড়ে থাকা  সস্তা রক্তাক্ত ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। চিনু নানারকম গল্প শোনাত। ভাল মানুষের, শিল্পী মানুষের। চিনু বলেছিল, ডাক্তারবাবু বললেন, রক্ত লাগবে। কিন্তু আমাদের স্টকে রক্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ পরীক্ষায় সস্তা রক্তের সাথে সস্তা রক্ত মিলে গেলো। সরল তার সস্তা  রক্ত দিলো  । ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। সরল রাস্তায় নেমে আবার একটা সস্তা মূল্যে পাঁউরুটি কিনে   খেতে শুরু করলো। দুপাশের মূল্যবান জীবন প্রবাহ,  সরলকে দেখে হাসতে থাকলো পোকা লাগা দেঁতো হাসির মত নিয়মিত সুরে। 


চিনুর বোন সীমার ইচ্ছে ছিলো নদী হবে। কুলু কুলু বয়ে যাবে নিরন্তর। পাড় উপচে ভাসানো ঢেউ মনে রোমাঞ্চ জাগাবে। কিন্তু কিছু লোকের বদখেয়ালে আর অর্থের লালসায় সব ইতিহাস চাপা পড়ে যায়।মিতা তার বাল্যবন্ধু। সে বলে, চাপা ইতিহাস ফুঁড়ে বেরোয় বটগাছের রূপ নিয়ে। একদিন রোদ ছিলো, সবুজ গাছ ছিলো। কিছু কাঁটাঝোপ থাকা স্বাভাবিক। সেই বাধা পেরিয়ে অনেকটা পথ একা হেঁটেছে সীমা। সঙ্গে ছিলো অদম্য ইচ্ছে। আজ সত্তরের তরুণী সীমা সফল। ইতিহাস কথা বলে মৃদুস্বরে। বেশ    কিছু  প্রকাশিত গ্রন্থে তার সমস্ত ইচ্ছে, সাধনা নিঙড়ে দিয়েছে মন। আজ সকালেই সে পেয়ে গেলো জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার সংবাদ। সত্য, সুন্দর । চিনুর বয়স হল পঁচাত্তর। কুষ্ঠিতে আছে চিনু উনআশি বয়সে মরে স্বর্গে যাবে। চিনু মনোজকে খুব ভালবাসত। সে তাকে দেখলেই পুরোনো দিনের গল্প শোনাত। চিনু বলত, ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেন ধরে চলে গেলাম কুমোরপুর হাটতলা হল্ট। মনে করলাম, তাড়াতাড়ি চলে আসব, দুপুরের আগে। পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাড়িতে শাসনের দড়িটা একটু ঢিলে হয়েছে। মা বলেছেন, খাওয়ার সময় যেন ডাকাডাকি করতে হয় না। আর সবসময় স্বাধীন এই কটা দিন। বন্ধুরা ডাকল ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য। আমাদের ফুল টিম খেলা দেখতে চলে এলাম কুমোরপুর হল্টে বিনা টিকিটে। ভাবলাম খাওয়ার সময়ের আগে বেলা দুটোর সময় হাজির হয়ে যাব মায়ের কাছে। কিন্তু সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।একটা টিম খেলতে আসে নি। এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে আমরা কমিটির কাছে একশ টাকা দিয়ে আবেদন করলাম। কমিটি রাজি হল। আমরা মাঠে নামলাম ফুল টিম নিয়ে। পরপর অনেক টিমকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠলাম।  ফাইনাল খেলা শুরু হবে বিকেল তিনটের সময়। এখন দুটো বাজে। মায়ের মুখটা মনে পরছে। ভাতের থালা সাজিয়ে বসে আছেন নিজে না খেয়ে। যেতে পারলাম না বাড়ি। খিদে লেগেছে খুব । পাশের বাড়ির কাকিমা মাঠের ধারেই বাড়ি। কাকু, কাকিমা দুজনে এসে বললেন, তোমাদের খেলা দেখে ভাল লেগেছে আমাদের। আমরা তোমাদের সাপোর্টারস। এই নাও এক থালা পিঠে তোমরা খাও। আমরা ভালোবেসে বানিয়েছি। আহা খিদে পেটে  অই পিঠে একদম অমৃত। পেট ভরে খেলাম। আমার ভাই বাবু বলল, দাদা আজ বাবা চামড়া তুলবে পিটিয়ে। আমি বললাম, কি আর করা যাবে। অন্যায় করলে তো কেউ ছাড়বে না।তারপর ফাইনালে জিতে শিল্ড নিয়ে আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বিজয় নাচ দেখতে হাজির হল গ্রামের লোকজন। বাবাকেও ভিড়ে দেখলাম। লাঠি হাতে চিৎকার করছিলেন। শিল্ড দেখে চুপ করে গেলেন। মাকে ডেকে দিয়ে নিজে চলে গেলেন ছাদে।তারপর বাড়ি ঢুকলাম সন্ধ্যাবেলায়। মা তখনও উপোসি। একসঙ্গে খেলাম পিঠে আর খেজুর গুড়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের বাবা খুব খুশি। আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন, যাও দেখ গিয়ে গ্রামের ছেলেরা খেলে শিল্ড এনেছে। গর্বের খবর গো।তারপর থেকে বাবা আমাদের আর কোনদিন গায়ে হাত দেন নি। চিনু ভাদু জেলের কথা বলত, মাটির মানুষের কথা, ভাদু জেলে মাছ ধরে। তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বাড়ির পাশেই কাঁদর। অনেকে বলেন ঈশানী নদী। ভাদু অত কিছু জানে না। কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার। একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য। ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয়। ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু। তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে ভ'রে মাছ বিক্রি   করত গ্রামে গ্রামে। ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে। এখন সে হাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস। খুব ফাঁকিবাজ। এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে। ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায়। সেখানে হরিনাম হয়। ভাদু হারমনিয়াম     বাজায়। বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে। এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে। পড়াশোনা তার ভাল লাগে না। কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায়। অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস। ভোলা বলে, এই সবুজ আমাকে বড় টানে। এই জল আমাকে শান্তি দেয়। চান করার সময় এক ডুবে সে কাঁদর পেরিয়ে যায়। অনিল ভোলার খুব ভাল বন্ধু। সে সবসময় ভোলার সঙ্গে থাকে, থাকতে ভালবাসে। ভোলা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করল। ভাদু বলল, আর স্কুলে যেয়ে লাভ নাই রে ভোলা। রোজগারের ধান্দা কর। ভোলা তাই চাইছিল। সে বলল,বাবা আমি জাল ফেলা শিখব। তার বাবা ভাদু বলল,তা শেখ। কিন্তু তুই তো ভালই জাল ফেলিস। আমি চাইছিলাম রামের সঙ্গে তু কেরালা যা। সোনার দোকানে কাজ শিখে লেগা। তারপর এখানে এসে একটা দোকান খুলবি। কত নাম হবে তখন তোর দেখবি। ভোলা বলল,না বাবা আমি কেরালা যাব না। বাবা ভাদু বলল,আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। তু আর অনিল কাল কেরালা চলে যা। মেলা পয়সা হবে, নামডাক হবে। তা না হলে জলে পচে মরবি। বাবার ভয়ে তারা কেরালায় চলে এল। দোকানে কাজ করে, কাজ শেখে। তাদের দোকান বাজার, কেনাকাটা সব কাজ করতে হয় ভোলাকে। বাঁশি বাজাতে দেয় না। তার মনে পড়ে কাঁদরের ধারে গেলেই মনটা ঘাসের গন্ধে ভুরভুর করে উঠত। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা তুলে দিত। বাঁশির সুরে কাঁদরের জল নেচে উঠত। ভোলার বাবা, মার কথা মনে পড়ত। কিছু ভাল লাগত না। তার বন্ধু অনিল কাজ করে অনেক দূরে আর একটা দোকানে। সন্ধ্যা হলে দুজনের কথা হত। অনিল বলত, ভাল করে থাক। অনেক পয়সা নিয়ে বাড়ি যাব। কত খাতির হবে, দেখবি, অনিলের বাবা, মা নেই। সে ছোট থেকে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। তাই তার পিছুটান কম। সে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে। কিন্তু ভোলার কিচ্ছু ভাল লাগে না। প্রায় দুমাস পরে সে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হল। মালিক বেগতিক বুঝে অনিলকে সঙ্গে করে ভোলাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে এসে ভোলা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। অনিল মামার বাড়ি গেল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে। ভোলা কিছুই আনতে পারে নি। সে রোগে ভুগে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। মা তার বাবার ওপর রেগে গিয়ে বললেন, আবার যদি তুমি ওকে কেরালা পাঠাও তো আমার দিব্যি রইল। বাবা ভাদু আর ভোলাকে কেরালা যেতে বলেনি। শুধু বলেছিল, এখানে ও খাবে কি?  আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না। তার মা বলেছিল, আমাদের একমুঠো জুটলে ওরও জুটবে। তারপর অনিল আবার কেরালা চলে গেল। ভোলা দুমাস বিছানায় পড়ে রইল। তারপর মায়ের সেবাযত্নে সে সুস্থ হয়ে উঠল। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল। ভাদু জেলে মরে গেল। তার হরিনামের দল তাকে উদ্ধারণপুর নিয়ে গেল ট্রাকটরে চাপিয়ে। ভোলা সেই হরিনামের দলে ভাল বাঁশি বাজিয়েছিল। সবাই বলল, সন্দেবেলায় পেত্যেকদিন হরিনামের আসরে যাবি। বাঁশি বাজাবি। আজ অনিল এসেছে পাঁচবছর পরে। গ্রামের মোহিনী ঠাকরুণ বলল, মামার একটু জায়গা নিয়ে গ্রামে সোনারূপোর দোকান কর। আমরা তোর খদ্দের হব। অনিল এইরকম    কিছু একটা করার কথা ভাবছিল। মামাকে বলে একটা ঘর করল রাস্তার ধারে। তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকানের শুভ উদ্বোধন হল। খুব ধূমধাম করে দোকান শুরু হল। এদিকে ভোলা কাঁদরে জাল ফেলে মাছ ধরছে ডোঙায় চেপে। পাশ দিয়ে কাঠগোলার বড়বাবু যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ও জেলে ভাই মাছ পেলে?  ভোলা মাথাটা উঁচু করে বলল, পেয়েছি বাবু একটা কাতলা। তা কেজি খানেক হবে। বড়বাবু একটা দুশ টাকার নোট বার করে মাছটা নিলেন। তারপর চলে গেলেন। ভোলা টাকাটা কোঁচরে গুঁজে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল। সুরে সুরে আকাশ ভরে গেল



।১০


চন্ডীদাসের মত ছিপ ফেলে বিপিন মাছ ধরা দেখছে ফাতনার কথা ভুলে। বাউরি বৌ গুগুলি আর  ঝিনুক ধরছ জলের তলা থেকে। তার সুডৌল স্তন ঝুঁকে পরেছে জল ছুঁয়ে। জল কখনও সখনও রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে যুবতী হৃদয়। বিপিন দেখছে ভিজে নিতম্ব ফুটে উঠেছে  খাজুরাহের ছবির মত। বিপিন ভাবছে ঝিনুক, গুগুলির জীবন বাউরি বৌকে স্বামী সোহাগী করে তুলেছে কোমল দেহসৌষ্ঠবের মাধ্যমে। পুকুরের পাড়ে গাছ গাছালির স্নেহচ্ছায়া। এই দুপুর হয়ে উঠেছে বসন্তমায়া। কোন এক অদৃশ্য মায়ায় বৌ মাঝে মাঝে তাকায় বিপিনের দিকে। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের অবসর বাউরি বৌ ধরে শামুক, ঝিনুক। অলস স্বামীর খপ্পরে পরে জীবনে তার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিপিন বেকার যুবক। তাই ছিপ নিয়ে বসে এই সময়ে বাউরিবৌকে দেখার লোভে। সুন্দরী বাউরি বৌ ভোলে না এই বসন্তসময়। কি বর্ষা, কি শীত বা গ্রীষ্ম দুজনের বসন্তসময় কেড়ে নিতে পারে না। আজ বিপিন জলে নেমেছে। বাউরিবৌ কাপড় ঝেড়ে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। দুজনেই ডুবে আছে আকন্ঠ শীতল জলিয় আবরণে। জলের নিচে চলে জলকেলি। একটা পানকৌড়ি ডুবে ডুবে   মাছ ধরার কৌশল দেখায় দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে। ছিপ ডাঙায় তুলে দেখল বিপিন একটা বড় রুই ধরা পড়েছে বড়শিতে। বাউরিবৌ সোহাগী আঁচলে তুলে নেয় বিপিনের প্রেম।      যে ছেলেটা পূর্ণিমা পুকুরের জ্যোৎস্না ভিজে চাঁদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে চাঁদ ছুঁতে পারেনি।সমস্ত যোগ্যতার ফানুস সে উড়িয়ে দিয়েছিলো ঘাসের শিশিরে,বাতসের খেলায়।হেলায় সে হয়েছিলো ফাঁকা মাঠের রাজা।আলপথের মাটির গন্ধে তার যোগ্য সম্মানের ঘ্রাণ নিতো প্রাণভরে।সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাইরে অনুভূতির জগতে তার আসা যাওয়া।বন্ধু বলতো,তোর ধনী হতে ইচ্ছে হয় না?ছেলেটিসে বলে, তার আপন জগতে সে শুধু রাজা নয়, সম্রাট।তাই সে অবহেলায় যাপন করতো সাধারণ জীবন।সে জানে তার মত ধনী কমই আছে।বাতাসের রেণু,আকাশের হৃদয় আর সবুজের হাতছানিতে সে ছুটে চলে যেতো।সেখানে গিয়ে সে কথা বলতো আপন মগ্নতায়।তার কথাগুলো হয়ে যেতো কবিতার পান্ডুলিপি..কাটোয়া থেকে ট্রেনে চেপে নবদ্বীপ যেতে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম। ইন্টারসিটি ধরে যাচ্ছিলাম।    একবার প্রয়োজনে বাথরুমে  ঢুকলাম। ঢুকেই চোখ দুটি স্থির হয়ে গেলো আমার। পা নাড়াতে পারছি না। দেখলাম একটা ছোটো ভূতের বড় মানুষের মত বড় বড় দাঁত। দাঁত কেলিয়ে হাঁসছে। ভয়ে বুকের লাবডুব  এত জোরে হচ্ছে যে নিজেই শুনতে পাচ্ছি।কোনোরকমে বাইরে এলাম। অন্যান্য যাত্রীদের বললাম। তিনজন বাথরুমে ঢুকলো।কিছু দেখতে না পেয়ে রেগে গিয়ে বললো,রাতে কি খেয়েছিলেন?  গ্যাস হয়েছে।যত পাগল, ছাগল নিয়ে কারবার।যান নিজের কাজে যান।  আমি আবার একবার ঢুকলাম ভিতরে। দেখলাম  ভূতটি সেইরকমই হাঁসছে। দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। রাগে বলে বসলাম,এত ভিতু কেন?পালিয়েছিলি কেন? ভূতটা সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে এক চড় মেরে জানালার ফাঁক গলে লাফিয়ে পড়লো।ভূতের কি অপরিসীম ক্ষমতা।   পরে জেনেছি আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ফলে গন্তব্যে না গিয়ে হাওড়া চলে গেছিলাম । আমার ঘুম ভাঙলো হাওড়া স্টেশনে। বাথরুমে নোংরা পরিবেশে শুয়ে থাকতে দেখে অনেকে বাথরুমে ঢোকে নি। হয়ত লাশ মনে করেছে। একটা ঝাড়ুদার বললো,পাগল কাঁহিকা। নিকালো শালা। বাথরুমমে শোতা হ্যায় চুতিয়া। তখন থেকেই আমাকে ভুতে ধরেছিল তারপর এই লাইনে কাটা পড়লাম ভুতের জন্য। চিনু বলেছিল মধু বা স কন্ডাকটার। খড়ের চাল ফুটো। মাটির ঘর। মাটির মানুষ। তবু তার অবসর সময়ে সে পড়ে। তার আশা পড়াশোনা করে সে বড় হবে। কালো কালো অক্ষরগুলো তার চোখে আলো জ্বালে। সে চলে যায় অন্য এক জগতে। আশায় আশায় বাড়ে তার বয়স। বাড়ি থেকে বলে, এবার বিয়ে থা করে নে। ভালো আয় করিস। তোর আর চিন্তা কিসের?  মধু বলে, না বিয়ে করলেই সব শেষ। পড়াশোনা, আশা সব শেষ হয়ে যায় সংসারের জালে। সে জাল কেটে বের হওয়া কঠিন ব্যাপার। কোনোকালে কেউ পারে নি। মহাপুরুষ হলে আলাদা ব্যাপার।মধু ভাবে অবসর সময়ে, সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে  কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে  টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে  শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে  । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়।  মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়।   বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে।  কত বসন্ত এল গেল। মধুর এখনও শীতসময়। ঝরা পাতার সময়ে সে মগ্ন হত  সরব পাঠে। পাড়ার বন্ধুরা বলত, বুড়ো বয়সে পাঠশালায় পড়াশোনার ভিমরতি। এ ঘোড়া ঘুরে ঘাস খাবে না। মধুর মন খারাপ হত। বই গুটিয়ে বসে পড়ুত মাটির বারান্দায়। একটা পায়রা দেখত সে। একটা একটা করে কাঠি সংগ্রহ করে বাসা বুনত। প্রথমে কাঠিগুলো ঠোঁট থেকে পড়ে যেত। আবার সে চেষ্টা করত। এইভাবে পায়রাটি সফল হত তার কাজে। মধু ভাবত, সে মানুষ। প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে, একটা পাখি যদি পারে সে পারবে না কেন?  সে শক্ত দড়িতে হৃদয় বেঁধে লেগে পড়ত কাজে। পড়াশুনা করত মনযোগ দিয়ে।সকাল হলেই বেড়িয়ে পড়ত কাজে। কাঁধে বাস কন্ডাকটারের ব্যাগ। বাসে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হত। কেউ কেউ অসম্মানও করত। ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়ত। বলতে গেলে ভয় দেখাত। মধু মনে মনে পড়ার বিষয়গুলো মনে মনে আউড়াত। অনেকে বলত, ছেলেটা পাগল নাকি?  একমাত্র গাড়ির খালাসি জানত তার বিষয়টি। সে মধুর বন্ধু। সে বলত, তোর কাজের চাপ হলে আমাকে বলবি। আমি তোকে সাহায্য করব। বাসের ভিতরে বাসস্টপে সে পড়ত মাঝে মাঝে। মধু পড়াশোনা করে যখন, সে শুনতে পায় আলোর আগমনী সংগীত। আর কেউ শুনতে পায় না। আলোময় চোখে আশার আলো দেখতে দেখতেই সে বিভিন্ন পরীক্ষায় বসে। হয় না। বিফলতাগুলো তার আশার আলো নেভাতে পারে না। বিফল হতে হতে সেএকদিন আই এ এস পরীক্ষায় সফল হল। চারিদিকে ঢাকের কাঠি পড়তে লাগল। শুধু প্রশংসার বন্যা। কিন্তু মধুএ বন্যায় হারিয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। বিফলতাগুলো তার মনের তার শক্ত করে বেঁধেছে। সহজে তা ছেঁড়া যাবে না।



                                     ক্রমশ...