Wednesday, October 23, 2024

এক রাজকুমারীর কথা - সুমন্ত রবিদাস || Ek Rajkumarir kotha - Sumanta Rabi das || বড় গল্প || Story || Bengali story || Big story || Bengali audio story || Short story

  এক রাজকুমারীর কথা 

                  সুমন্ত রবিদাস

                

                     ১

ধনে জনে পরিপূর্ণ আমরাবতী নগরী, প্রাণের কেন্দ্রস্থল। রাজা অমরেন্দ্রনাথ অমরাবতীকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের পূর্ণ করেছেন। বিশাল রাজপ্রাসাদ, সামনে সরোবর এবং এক পাশে শাহী উদ্যান। এসব কিছুই রাজা অমরেন্দ্রনাথেরই কীর্তি। তিনি তার নগরীকে পরিপূর্ণ করে নির্মাণ করেছেন। অমরেন্দ্রনাথ এর পূর্বে রাজা মহেন্দ্র অমরাবতীকে সৌন্দর্যের নগর হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলেও নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অমরাবতীর শ্রী বিলুপ্ত হয়। এবং সেই সংঘর্ষে মহেন্দ্র মারা যান। মহেন্দ্র মারা যাবার পর রাজা হন অমরেন্দ্রনাথ। তিনি সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের শ্রী ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন খুব বিলাসী এবং সৌন্দর্য পিপাসু রাজা। তিনি অমরাবতী নগরীকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে মুড়ে দিলেন। বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করলেন, সঙ্গে সৈন্য- সামন্তও সংগ্রহ করেন।

      রাজপ্রাসাদের সামনে বিশাল রাজ উদ্যান নির্মাণ করলেন। উদ্যানে নানা রং- বেরং এর ফুলের চারা বসালেন। অপরাজিতা, গোলাপ, গন্ধরাজ, গাঁদা, জুঁই, দোপাটি, মালতি, টগর, সূর্যমুখী প্রভৃতি ফুলের চারা বসালেন। অমরেন্দ্রনাথ প্রত্যহই সে রাজ উদ্যান পরিদর্শন করতে লাগলেন এবং নিজে সেই রাজ উদ্যান পরিচর্যার জন্য চন্দ্র নামে এক যুবককে নিযুক্ত করলেন। চন্দ্র মনে প্রাণে যত্ন সহকারে উদ্যানের ফুল গাছগুলির পরিচর্যা করতে লাগলেন। রাজাও খুশি হয়ে চন্দ্রের পারিশ্রমিককে দ্বিগুণ করে দেন এবং রাজা খুশি হয়ে চন্দ্রকে রাজ পরিমণ্ডলের মধ্যে একটি কক্ষ্ দান করেন। সেখানে শাহী মালি হিসাবে চন্দ্র কাজ করতে লাগল। চন্দ্রের মর্যাদাও বেড়ে গেল। রাজ প্রাসাদের সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত ঘটতে লাগল। প্রহরীরা কেউই তাকে কোনো কাজে বাধা দিত না। কারণ স্বয়ং রাজা অমরেন্দ্রনাথ তাকে এই বিশেষ অধিকার দিয়েছিল। রাজ আজ্ঞাতে তার প্রভাব বেড়ে গেল। চন্দ্র প্রতিনিয়তই ফুলগুলিকে পুত্রস্নেহে পরিচর্যা করতে লাগল। চন্দ্র প্রতিদিন সূর্য ওঠার পূর্বেই উঠত এবং সূর্যের যখন একটু রশ্মি প্রকাশ হত, সূর্যের যখন প্রথম কিরণ ফুলগুলিকে স্পর্শ করত; সেই সময়ই  ফুলগুলি যে আনন্দে দুলে উঠত, সেই অপূর্ব সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করত।

          সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যমুখী ফুলের যে আনন্দে সূর্যের অভিমুখে চেয়ে থাকা, তা দেখতে দেখতে চন্দ্রের এক এক সময় মনে হতো ফুলগুলি যেন সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করছে। সূর্যের প্রথম কিরণ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রার্থনা শুরু হত, এবং শেষ হতো সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে। সূর্যের শেষ কিরণ টুকু পৃথিবীর ছেড়ে চলে যেত এবং তারা আবার একটা সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করত। রাত্রের শান্ত পরিবেশে তারাও যেন ঘুমিয়ে পড়ত‌। সূর্যমুখী ফুলের সেই চলার দৃশ্য পূর্ব হতে পশ্চিমে প্রতিনিয়ত চন্দ্র ফুলের সামনে বসে দেখত আর নানান কল্পনা তার মনের মধ্যে ভেসে আসত।

         রাজা অমরেন্দ্রনাথ প্রাতঃ ভ্রমণে বের হতেন প্রতিনিয়তই। তিনিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তার সাধের উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। তারপর তিনি রাজকার্যে মন দিতেন। রাজকার্যে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। কখনো অন্যায় বিচার তিনি করেননি। তবে তার চরিত্রে কিছু কিছু ত্রুটিও ছিল। তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী আচার-বিশ্বাসের পক্ষপাতী। রাজ মর্যাদার হানি ঘটুক এমন কার্য তিনি কখনো করেননি এবং কাউকে করতেও দেননি।

       অমরেন্দ্রনাথ একমাত্র দুর্বল ছিলেন তার মেয়ে চন্দ্রিমার প্রতি। চন্দ্রিমা জন্মের ছ’ বছর পরে তার মা মারা যায়। সেই থেকেই চন্দ্রিমা পিতার কাছেই প্রতিপালিত। খুব স্নেহে অমরেন্দ্রনাথ তাকে মানুষ করেছেন। তার মা মল্লিকার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে মস্ত বড়ো রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার। ইচ্ছা থাকলেও তার মার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হবার আগেই দুরারোগ্য রোগে মারা যান, ফলে ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে যায়। সেই অপূর্ণ ইচ্ছাকেই অমরেন্দ্রনাথ পূর্ণ করার শপথ গ্রহণ করেন। অমরেন্দ্রনাথ মেয়েকে কোনো কিছুর জন্য অভাব বোধ হতে দেননি। সবকিছু চাওয়ার আগেই চন্দ্রিমা পেয়ে যেত। কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল রাজ্যে, সেটা হল নিরাপত্তার অভাব। নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব প্রচন্ড প্রতাপশালী। অতীতেও নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে রক্তক্ষয় সংঘর্ষে অমরাবতীর শ্রী বিলুপ্তি ঘটেছিল। অমরেন্দ্রনাথ ভালোভাবেই জানতেন নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। অমরাবতীও পরিপূর্ণ সুরক্ষিত ছিল না। এইতো সবে মাস দুয়েক হবে বিক্রম দেবের গুপ্তচর ধরা পড়েছিল রাজপ্রাসাদের ফটকের বাইরে। সেই থেকে অমরেন্দ্র খুব সচেতন। তার একমাত্র মেয়ে চন্দ্রিমাকে সে কিছুতেই বিপদের মধ্যে ফেলতে চায় না। এজন্য চন্দ্রিমার আশ্রয় সব সময় রাজপ্রাসাদের ভিতরেই, বাইরে বেরোনোর তার অধিকার নেই।

          রাজকুমারীকে পাহারা দেবার জন্য ভদ্রমল্ল নামে এক প্রহরীকে নিযুক্ত করেন নিযুক্ত করেন। রাজকুমারীর প্রকৃতি ছিল চঞ্চল। সব সময়ই বাইরে যেতে চেষ্টা করতেন কিন্তু ভদ্রমল্লের কড়া পাহারা এড়িয়ে যাওয়া তার সাধ্য ছিল না। ফলে তাকে সব সময় রাজপ্রাসাদের কক্ষেই বসে থাকতে হত। কক্ষের ভেতরেই রাজা তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কক্ষের মধ্যে তার প্রধান সখী ছিল সুনয়না। সব সময় তার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু কক্ষ মধ্যে রাজকুমারীর কোনো মতে ভালো লাগত না। সব সময় মন চাইতো বাইরে যাবার কিন্তু ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না। ফলে মনে নানা প্রশ্ন জাগত। সব প্রশ্নের উত্তর সখীর কাছ থেকেই পাওয়ার চেষ্টা করত।

       সখী আমি কেন বাইরে যেতে পারি না? আমারও ইচ্ছে হয় বাইরে যেতে, এই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দিগন্তে মিশে যেতে!

      কক্ষ থেকে বাতায়ন পথে রাজ উদ্যানের ফুলগুলিকে দেখে সুনয়নার কাছে প্রতিনিয়তই এ প্রশ্ন করতেন। সুনয়না এ প্রশ্নের উত্তরে বলতেন, আমি জানিনা রাজকুমারী। হয়তো তোমার ভালোর জন্যই তোমার পিতা তোমাকে রাজপ্রাসাদের বাইরে বেরহতে দেয় না। আর তুমি বাইরে বেরিয়েই বা কি করবে তোমার যা প্রয়োজন তা তুমি আমাকে বল আমি এখানেই এনে দেব।

        প্রতিনিয়তই সুনয়নার এ উত্তর শুনে চন্দ্রিমার মন খারাপ হয়ে যেত। রাজ উদ্যানে কত রকমের ফুল ফুটেছে, সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। অলি সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর গুনগুন শব্দের গান গেয়ে গেয়ে চলছে। রাজকুমারী এইসব দৃশ্য রাজকক্ষে বসে বসে প্রতিনিয়তই বাতায়ন পথ হতে দেখত আর মনে মনে ভাবত, আমিও যদি সেই অলি হতে পারতাম তাহলে আমিও ফুলের মধু পান করে তাদের সঙ্গে গান করতাম এবং সেই ফুলের উপর শুয়ে পরতাম ক্লান্ত শরীরে। আর বসন্ত বায়ু আমার সেই ক্লান্তি মুছে দিত!

         প্রতিনিয়তই চন্দ্রিমা রাজপ্রাসাদের জানালা দিয়ে শাহী উদ্যানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখত এবং মনে মনে কি যেন ভেবে মন উদাস হয়ে যেত। প্রতিনিয়ত রাজকুমারী চন্দ্রের উদ্যান ভ্রমণ এবং ফুলের সামনে বসে যে ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলত, তাদের খেলা দেখত, তাদের আনন্দে সেও আনন্দিত হত, সেইসব দৃশ্য গুলিই দেখত আর মনে মনে হাসত। আবার মনে ইচ্ছেও হত, সেও যদি এমনই ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলতে পারত, খেলতে পারত, তাদের স্পর্শ করতে পারত! কিন্তু এসব কিছু থেকে রাজকুমারী শত যোজন দূরে। মনে কল্পনা করতে পারলেও এসব যে কোনোদিনও সম্ভব হবে তারা রাজকুমারী ভাবতে পারে না।

        প্রতিনিয়ত এই দৃশ্য দেখতে দেখতে রাজকুমারীর মনের মধ্যেও এক উন্মাদনার সৃষ্টি হতে লাগল। মনে হতে লাগল এই বন্ধন ভেঙে এক্ষুনি রাজ উদ্যানে ছুটে যেতে। এমন সময় দেখল তার পিতা রাজ উদ্যানে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। এমন সময় রাজকুমারী ছুটে বাইরে বের হতে গেল কিন্তু ভদ্রমল্ল তাকে যেতে  দিল না। ফলে রাজকুমারী রেগে গিয়ে ইতস্ততভাবে রাজপ্রাসাদের এখানে- ওখানে ছুটতে লাগল আর তার পেছনে পেছনে ভদ্রমল্ল ছুটতে লাগল। রাজকুমারী যখন যেটা পাচ্ছে সেটা ছুড়ে মারছে মল্লভদ্রকে লক্ষ্য করে। রাজকুমারীর এই গতি দেখে ভদ্রমহল্য রাজাকে খবর পাঠাল। রাজা তাড়াতাড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল। একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে অমরেন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়ে মেয়েকে বলল, রাজকুমারী এরকম আচরণ কেন করছ? তোমার যা প্রয়োজন তুমি আমাকে বল, আমি এক্ষুনি তোমাকে তা এনে দেব। তুমি যদি এই আকাশের চাঁদটাকেও চাও আমি তাকেও এক্ষুনি তোমার কাছে এনে দিচ্ছি এই মুহূর্তে।

         কিন্তু আমি তো আকাশের চাঁদটাকে চাই না বাবা! আমি চাই মুক্তি। মুক্তির দিগন্তে আমি ছুটতে চাই। আমি চাই এই বন্ধন থেকে মুক্তি।

       তুমি তো মুক্তই আছ রাজকুমারী। তোমার যা চাই আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।

       আমি রাজপ্রাসাদ থেকে মুক্তি চাই। আমি ওই রাজ উদ্যানে যেতে চাই যেখানে চন্দ্র ফুলের সঙ্গে খেলে।

        কিন্তু রাজকুমারী তুমি তো সেখানে যেতে পারবে না।

       কিন্তু কেন পিতা? আমি কেন যেতে পারব না?

        তুমি রাজকুমারী। এই রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী।

       কেন পিতা আমি কেন যেতে পারব না? আমি রাজকুমারী হয়েছি তো কি হয়েছে, আমিও তো আর পাঁচটা মানুষের মতো। চন্দ্র যেখানে বাগানে ফুলের সঙ্গে খেলে তাহলে আমি কেন পারব না?

        কারণ তুমি রাজকুমারী। এই রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। রাজ্য শাসন তোমাকেই করতে হবে। তোমার প্রাণের সংশয় রয়েছে। তুমি আর পাঁচজনের মতো নও রাজকুমারী। আর ওই চন্দ্র ওত রাজ মালি, তার ঐ কাজই।

         তাহলে আমি কেন একবারও চন্দ্রের কাছে যেতে পারব না? আমিও চন্দ্রের মতন ফুলের সঙ্গে খেলতে পারব না কেন? আমি তো এই রাজ প্রাসাদ চাই না, রাজ কার্য চাইনা। আমি চাই আমার এই বন্ধন থেকে মুক্তি। আমি চাই মুক্ত দিগন্তে ঘুরতে, মনের মতোন ছুটতে, নাচতে।

         তোমার ভালোর জন্যই আমি এ কাজ করেছি রাজকুমারী। তুমি হয়তো ভুলে গেছো বা তোমার মনে নেই তোমার জ্যেষ্ঠর সঙ্গে কি ঘটেছিল—

        বলতে বলতে চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আর কিছু বলতে পারল না। রাজকুমারীও চুপ করে গেল। অতীতের জ্বলন্ত স্মৃতি যেন আবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন রাজকুমারী ছোট ছিল প্রায় ছয় বছরের হবে। সদ্য তার মা গত হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সময় অমরাবতী শোকে মগ্ন ছিল সেই সুযোগ নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায় বিক্রমদেব। সেই আক্রমণ কোনোরকমে  অমরেন্দ্রনাথ প্রতিহত করে। এতে অমরাবতী নগরীরও ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সব থেকে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছিল সেটা হল রাজকুমার জয়ের মৃত্যু। শোকের উপরে শোক। এক শোক থেকে উঠতে না উঠতেই অকস্মাৎ আর এক শোকের ছায়া এসে পড়ল। একমাত্র রাজপ্রদীপ নির্বাপিত হল। বিক্রম দেবের ছোড়া তীরে বৃদ্ধ হয়ে রাজকুমারের প্রাণ ত্যাগের ঘটনাটা আবার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরনো এক ছবির মতোন! রাজকুমারীর চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই কৈশোরের বিষাদময় স্মৃতি ভুলে গিয়েছিল রাজকুমারী, কিন্তু আবার সেই কথা স্মরণ হয় মনটা বিষাদে ভরে গেল। সেই সময়ের অনেক কথাই তার মনে নেই, অমরেন্দ্রনাথেরও সেই স্মৃতি স্মরণ করানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না। সেই দুঃখের ছায়া কাটিয়ে উঠেছিল, রাজকুমারীও ভুলে গিয়েছিল পিতার আদর -স্নেহে। মেয়ের এই চঞ্চল অবস্থা দেখে অমরেন্দ্রনাথ না বলতে চাইলেও মুখ থেকে হঠাৎ যেন বেরিয়ে গেল কিন্তু সম্পূর্ণ বেরল না। তার আগেই চোখে জল চলে আসল, অমরেন্দ্রনাথ কাঁদো কাঁদো চোখে আর দাঁড়িয়ে না থাকতে পেরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও বিমনা হয়ে পড়ল এবং আবার জানালার কাছে বসে বাইরে চেয়ে থাকল। চেয়ে দেখতে দেখতে মন বিষাদে ভরে উঠল।

                                   

                                    ২

      প্রতিদিনের মতো চন্দ্র আজও সকালে উদ্যানে ফুল গাছগুলির পরিচর্যা করছে এবং রাজকুমারীও এই সময় কক্ষ থেকে জানালা পথে চন্দ্রের হাসির সঙ্গে ফুলের হাসি দেখছে। ফুলগুলি বাতাসে নাচছে আর হাসছে, চন্দ্রও তা দেখে হাসছে। চন্দ্রের হাসির সঙ্গে ফুলের হাসি মিলে যাচ্ছে। রাজকুমারী রাজপ্রাসাদের কক্ষ থেকে দেখছে আর মাঝে মাঝে চন্দ্রকে দেখে হাসছে।

         রাজকুমারীর কক্ষের ঠিক নিচে সামনেই রাজ উদ্যানের অবস্থান ছিল। ফলে রাজকুমারী কক্ষ থেকে বসেই সবকিছু দেখতে পেতেন। ত্রিতলের একটি কক্ষে বসে প্রতিদিন প্রাতঃকালে চন্দ্রের খেলা দেখত। রাজাও এই সময় উদ্যান ভ্রমনে বের হতেন এবং ফুলের মিষ্টি সুগন্ধি বায়ু উপভোগ করতেন। রাজকুমারী উপর থেকে সবকিছুই দেখতেন। এভাবে রাজকুমারী প্রতিদিন চন্দ্রকে দেখত মুগ্ধ নয়নে আর আপন মনেই মাঝে মাঝে কি যেন মনে করে হাসত। আজকেও রাজকুমারী সকালে উঠে চন্দ্রকে দেখে দেখে হাসছে, ঠিক সেই সময় সুনয়না প্রবেশ করল। সখী সুনয়না রাজকুমারীর এই অবস্থা দেখে বলল, সখী তোমার কি পছন্দ হয়েছে। তাহলে বল আমি তোমার পিতাকে এক্ষুনি বলি।

         সখীর এই রসিকতা রাজকুমারীর মনে আঘাত দিল। কারণ রাজকুমারীও জানত তার ইচ্ছার কোনো দাম নেই। এখানে সে একটা বন্দীর মতো আছে। যার সামান্য বাইরে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই,আর সেখানে সখীর এই রসিকতা রাজকুমারীর মনকে ব্যাথা দিল। রাজকুমারীও তার উত্তরে বলল, সখী কি আর চাইব আমি! আমি কি কোনো কিছু পাওয়ার যোগ্য! চাই তো অনেক কিছু, পাই না কিছুই!

      কিন্তু তুমি যাই বল সখী চন্দ্র কিন্তু দেখতে খারাপ না।

     আমি কি খারাপ বলেছি সখী?

      তাহলে তুমিও মানছ চন্দ্র ভালো দেখতে। অবশ্য তোমার পাশে মানাবেও ভালো।

       সখী তুমি ছাড় রসিকতা। আমার আর এসব ভালো লাগছে না।

      এই বলে রাজকুমারী আবার বিমনা হয়ে গেল। সুনয়নাও একটু হেসে আর কিছু বলল না। কিন্তু মনের মধ্যে সখীর কথাটা গভীরে দাগ কেটে গেল। সত্যিই তো রাজকুমারী এতদিন চন্দ্রকে দেখে হেসেছে গোপনে গোপনে কিন্তু কখনো এ কথাটা তো ভাবেনি। হঠাৎ সখীর মুখে এই রসিকতা শুনে তার মনের অন্ধকারে যেন এক দীপশিখা জ্বলে উঠল। মনে হতে লাগল সখী যা বলেছে তাতে তো ভুল নেই। আজ চোখের সামনে দেখা জিনিসকে আবার নতুন করে, নতুনভাবে, নতুন রঙে দেখতে পেল। এতদিন মনের মধ্যে যে অন্ধকার জমে ছিল সখীর কথায় তা দূর হল। কিন্তু এখনো ভাবনা একটাই, এখান থেকে কেমন করে সে চন্দ্রের কাছে যাবে। কারণ তার বাইরে যাওয়া তো নিষেধ। এক চোখে আনন্দ, এক চোখে বিষাদ নিয়েই আর একবার পুরনো দেখা চন্দ্রকে নতুন ভাবে দেখল। আর সখীর কথাটাই বারবার মনে হতে লাগল। চন্দ্র কিন্তু দেখতে খারাপ নয়…অবশ্য তোমার পাশে মানাবেও ভালো। এই কথাগুলোই তার মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। বিষাদের মধ্যেও মনের মধ্যে এক আনন্দের ভাব অনুভূত হতে লাগল। এই প্রথম রাজকুমারীর চোখে মুখে এক আনন্দের ভাব লক্ষ্য করা গেল। সখী সুনয়নাও তার মনের অবস্থা দেখে একবার একটু হাসল। এই হাসি বলে দিল রাজকুমারীর মনের মধ্যে পূর্ব রাগের উদয় হয়েছে।

       এদিকে নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব আবার অমরাবতী জয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল গোপনে গোপনে। পুরনো আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে আবার জেগে উঠল তার। এর পূর্বে অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো সফলতা আসেনি, বারবার পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এবার বিক্রমদেব তার অপূর্ণ ইচ্ছা যে করেই হোক পূর্ণ করার শপথ গ্রহণ করল। এবং এই মর্মে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি বীরায়কে ডেকে পাঠালেন এই বিষয়ে যুক্তি -পরামর্শ করার জন্য। সিদ্ধান্ত হল গুপ্তচর ভিত্তিকে আবার সক্রিয় করতে হবে। অমরাবতীর সমস্ত গোপন অস্ত্র ভান্ডারের হদিশ আনতে হবে। এর সঙ্গে রাজ্যের কামারশালাকে নির্দেশ দেওয়া হল অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর জন্য।

         বিক্রমদেবের গুপ্তচর বৃত্তির জন্য টিয়া গুলিকে ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করলেন। এই মর্মের রাজ্যে ঘোষণা করা হল, যে ব্যাধ টিয়া ধরে রাজাকে দেবে রাজা তাকে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করবে।

        এই ঘোষণা শোনার পর রাজ্যের যত ব্যাধ ছিল সকলেই পুরস্কারের আশায় রাজ দরবারে এসে ভিড় জমালেন। বিক্রমদেব সবার বুদ্ধি বিদ্যার পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষায় হারু নামে এক ব্যাধ যায় যুক্ত হলেন। রাজা তাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে, টিয়া ধরার জন্য বিদায় দিলেন। হারু খুশি মনে স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে রাজাকে প্রণাম করে হাতে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়লেন। বিক্রমদেবও হারুর বিদ্যা- বুদ্ধি দেখে আশ্বস্ত হলেন।

        হারু রাজ্যের বনে বনে ঘুরে টিয়া গুলিকে তাড়া করতে লাগল কিন্তু কোথাও টিয়া ধরতে পারলেন না। এদিকে টিয়া না ধরতে পারলে রাজা আবার তার গর্দান নিবে। এই ভয়েই হারু সমগ্র দিনে এই বনে তো কখনো ওই বনে ঘুরতে থাকলেন কিন্তু কোথাও একসঙ্গে দু-একটির বেশি টিয়া দেখতে পেল না। হারু বিষন্ন মনে সব শেষে অমরাবতীর পার্শ্ববর্তী এক বনে প্রবেশ করে দেখল সেখানেও কোনো টিয়ার সন্ধান নেই। বিষন্ন মনে তিনি ভাবলেন, আজকে বোধ হয় রাজ্য থেকে টিয়া উধাও হয়ে গেছে। বোধহয় তারা আগেই জানতে পেরে কোথাও লুকিয়েছে। এমন অবস্থায় হারু দেখল সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে অথচ একটি টিয়ারও দেখা নেই। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝাঁকটিয়া উড়ে এসে হারু যে গাছের নিচে বসে ছিল ঠিক তার থেকে একটু দূরে বসল এক গাছের ডালে।

         এক ঝাঁক টিয়া দেখে হারু যেন প্রাণ ফিরে পেল। তৎক্ষণাৎ হারু কৌশল করে জাল পাতল এবং অদূরে ঝোপের মধ্যে বসে থাকল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও একটি টিয়াও ফাঁদে পড়ল না। এই দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন অবস্থায় কি করবে ভেবে না পেয়ে রাগের মাথায় হঠাৎ সামনে ডালে বসা একটি টিয়াকে তাক করে তীর ছুড়ল। তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গাছের ডালে লাগল। ফলে টিয়া গুলি উড়ে যেতে লাগল। এই দেখে হারু তাদের পেছন পেছন ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে অমরাবতীর সীমানায় এসে পৌঁছাল। এদিকে অমরাবতী রাজ্যের রাজা অমরেন্দ্রনাথ রাজ্যের অনেকদিন হল পশু বা পাখি শিকার করা নিষিদ্ধ করে দেয়। রাজ অনুমতি ব্যতীত কেউ পশু বা পাখি শিকার করলে রাজআজ্ঞাই তার প্রাণদণ্ড নিশ্চিত জেনে হারু আর এগোলো না। অমরাবতী রাজ্যের সীমানা থেকে ঘুরে আসল।

          এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসাতে একটি টিয়া দলছুট হয়ে রাত্রে আঁধারে পথ ভুলে অমরাবতী রাজ্যে প্রবেশ করল। কোথায় যাবে কিছু বুঝতে না পেরে রাত্রের অন্ধকারে উড়তে উড়তে প্রাণের ভয়ে রাজ উদ্যানে এসে আশ্রয় নেয়। রাজ উদ্যানে অমরেন্দ্রনাথ ছায়ার জন্য কিছু বড়ো বড়ো গাছ লাগিয়েছিলন।তার একটি গাছে এসে সেই দলছুট টিয়াটি আশ্রয় লাভ করে।

        হারু টিয়া ধরতে না পেরে মনদুঃখে সেই রাত্রেই রাজ্য ছেড়ে চলে যায়। ফলে বিক্রমদেবের ইচ্ছা অপূর্নই থেকে গেল।

        রাত্রের সেই ভয়ে টিয়াটি সেই গাছেই রাত্রি কাটানোর পর পরদিন সকালে কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে রাজ উদ্যানের এ গাছ থেকে ওগাছে উড়তে লাগল কিন্তু যাওয়ার কোথাও কূলকিনারা খুঁজে না পেয়ে উদ্যানের বাইরেও যেতে পারল না প্রাণভয়ে। ফলে রাজ উদ্যানই তার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল।



                                    ৩

        রাজকুমারী যখন চন্দ্রকে দেখছে আর হাসছে ঠিক এমন সময় চন্দ্রের দৃষ্টি রাজকুমারীর উপর পড়ল। রাজকুমারী একটু হেসে আবার লুকিয়ে গেল জানালার আড়ালে। চন্দ্র একটু হেসে পুনরায় আবার তার কাজে মন দিল। চন্দ্রও ভাবতে থাকল কার দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলিত হল, যেন মনে হল রাজকুমারী। কি অপরূপ চোখের চাহনি মিষ্টি হাসি ভরা! হাসি দেখলেই যেন সব দুঃখ ভুলে যায়, এমনই ছিল সেই হাসিটি। কিন্তু বিদ্যুতের ঝলক এর মতো একবার দেখা দিয়েই লুকিয়ে গেল! সেই কালো চোখ দুটো যেন বুকে এক জ্বালা তৈরি করছে। সেই চোখের তীরে চন্দ্রের মন যেন উদাসীন। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল কে ছিল সেই মেয়েটি? এমন চোখের চাহুনি কার এই রাজপ্রাসাদে? সে কি রাজকুমারী, না অন্য কেউ?

        মনের মধ্যে এমন অনেক শতশত প্রশ্ন উঠতে লাগল চন্দ্রের মনে। মন অশান্ত হতে শুরু করল। এতদিন ফুলগুলিকে ভালো লাগত, প্রতিনিয়ত সেই ফুলগুলির দুলে ওঠা, নেচে ওঠা, সূর্যমুখী ফুলের সেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাত্রা এগুলি দেখতে যেন আর ভালো লাগল না। কিছুক্ষণ পরে উদাসীন মন নিয়ে চন্দ্র তার কক্ষে চলে আসল। কক্ষে আসার পর থেকেই সেই চোখের চাহুনি আর ঠোঁটের হাসির ছবিটাই মনে ভেসে আসতে লাগল। ফলে কোনো কাজই তার আর ভালো লাগল না।

       চন্দ্র  এতদিন রাজকুমারীর কথা দু-তিনবার শুনেছিল, কিন্তু চোখে কখনো দেখেনি চন্দ্র। শুধু শুধুই সুনাকেই একবার দেখেছিল, সেওবা দূর থেকে। চন্দ্রিমার চাহুনির সেই তীব্র তীর হৃদয়কে যে যুদ্ধ করল তার থেকে মুক্তির উপায় কি?

       সুনয়না কক্ষে প্রবেশ করেই রসিকতার ছলে আবার বলল, সখী তোমার মন এত উতলা কেন? কার কথা ভেবে মন উদাসীন?

         কার কথাই বা ভাবব সখী। কেইবা আছে, যার কথা ভাবব।

       আছে সখী আছে তোমার মনে আছে যে।

        তুমি ছাড়া আমার মনে আর কেইবা আছে সখী।

       শুধু আমি, আর কি কেউ নেই?

        আর কেইবা আছে।

        তুমি নিজের মনে ভেবে দেখো সখী ঠিক উত্তর পাবে। যার জন্য তোমার মন খারাপ হয়, সে কি ওই চন্দ্র?

          সখী তুমি যে কি বলছ আমি তো বুঝতেই পারছি না। সে তো রাজমালি আর আমি—

          প্রেমে কোনো ভেদ হয় না সখী—

          চন্দ্রিমা বলল ঠিকই সে রাজমালী আর আমি রাজকুমারী কিন্তু মন যেন তা মানল না। মুখ দিয়ে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু মন থেকে মানাটা অনেক কঠিন। রাজকুমারীর মনও মানতে চাইছিল না মালি আর রাজকুমারীর ভেদকে। মন যেন বলছিল প্রেমে কোনো ভেদ হয় না।

          রাজকুমারীর মনে মনে এমন অনেক ভাবনা আসছে, ঠিক সেই সময় অমরেন্দ্রনাথ কক্ষে প্রবেশ করল। ফলে রাজকুমারীর ভাবনাতে ছেদ পড়ে গেল। একটু আশঙ্কার সুরেই অমরেন্দ্রনাথ বলল, রাজকুমারী এবার তোমাকে অস্ত্র শিক্ষা নিতে হবে। অস্ত্র চালনা শিখতে হবে।

         রাজকুমারী কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কিন্তু পিতা কেন? হঠাৎ কি হল যে আমাকে অস্ত্র শিক্ষা নিতে হবে?

          অমরেন্দ্রনাথ রাজকুমারীকে প্রকৃত কারণটি না বলে শুধু বলল, তুমি এখন যথাযথ বড়ো হয়েছ। এখন আমার বয়স হয়েছে, আর আমি একা কতদিন রাজ্য সামলাব। এবার থেকে তোমাকেও রাজকার্য বিষয়ে পারঙ্গম হতে হবে। আমার পরবর্তীতে তোমাকেই তো রাজ্যের ভার নিতে হবে। তার জন্য এখন থেকেই তোমাকে তৈরি হতে হবে।

          কিন্তু পিতা আমার এসব ভালো লাগে না।

        ভালো না লাগলেও কিছু কিছু কাজ আমাদের করতে হয়। আর তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। তুমি তো বুঝতে পারছ রাজকার্য তোমাকে শিখতেই হবে।

          কিন্তু পিতা—

          কোনো কিন্তু না। আমি তোমার আর কোনো কথা শুনবো না। কালকে তোমাকে রাজ মন্দিরের পূজো দিয়ে অস্ত্র গুরু বিজয় দেবের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে হবে। কাল প্রাতঃকালে স্নান সেরে প্রস্তুত থাকবে আমি তোমাকে এসে নিয়ে যাব।

         অমরেন্দ্রনাথ রাজকুমারীর কক্ষ থেকে বাইরে বের হতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় সুনয়নার প্রবেশ করতেই অমরেন্দ্রনাথ বলল, কালকে রাজকুমারীকে প্রাতঃ স্নান তৈরি রাখো, রাজকুমারীর অস্ত্র শিক্ষা শুরু হবে।

         জি মহারাজ।

        অমরেন্দ্রনাথ কি বলে গেল সুনয়না ঠিক বুঝতে পারল না। সঠিক বুঝতে না পারার জন্যই রাজকুমারীর কাছে এসে অস্ত্রশিক্ষার কথাটা জানতে চাইল। চন্দ্রিমা তাকে সব কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পিতা যা যা বলল সবগুলো সুয়নাকে বলল। কিন্তু প্রকৃত কারণটা কি সেটা না সুনয়না বুঝতে পারল, না চন্দ্রিমা। সুনয়না ভাবতে লাগল হঠাৎ রাজার এহেনও নির্দেশের কারণ কি। রাজ্যে কি কোন অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছে? কিন্তু কোনো মতেই প্রকৃত কারণ বুঝতে পারল না।

        অমরাবতীতে কয়েকদিন আগে যে গুপ্তচর ধরা পড়েছিল নারায়নী রাজ্যের সেখান থেকেই রাজা আজকে খবর পেয়েছে যে বিক্রমদেব পুনরায় অমরাবতী রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। আর কিছু খবর গুপ্তচর দিতে না পারলেও অমরেন্দ্রনাথ এর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, রাজ্যে কোনো এক অজানা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আবার রাজকুমারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও মনে নানান ভাবনা ভেসে আসতে থাকে। এক রক্তক্ষয় যুদ্ধে তার পুত্র মারা গেছে, আবার এক না জানা কি বিপদ আসছে, সেখানে আবার কি হয়। একথা ভাবতে গিয়ে প্রাণ যেন আঁকতে উঠছে। তাই সময় নষ্ট না করে রাজকুমারীর অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ভাবলেন। এই মর্মে অস্ত্রগুরু বিজয় দেবকে রাজপত্র পাঠালেন এবং রাজকুমারীকে তার জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথাও বলে এলেন। এতেও অমরেন্দ্রনাথ দুশ্চিন্তা গেল না। রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা আরো বাড়ালেন। রাজ্যের সীমানাগুলিতে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করলেন এবং রাজ্যের কামারশালা গুলিকে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। রাজ নির্দেশ পেয়ে রাজ্যের কামারশালা গুলি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল।

         পিতার নির্দেশের পর রাজকুমারীর মন আরো অশান্ত হয়ে উঠল। মনে হল সে জেলখানায় বন্দি আছে, প্রত্যেকটা নির্দেশ তাকে মানতে হবে। তার কোনো ইচ্ছার মূল্য নেই। রাজকুমারী সখীকে বলল, সখী আমি অস্ত্রশিক্ষা নিতে চাই না। অস্ত্রশিক্ষা করতে আমার ভালো লাগে না। আমি চাই এই বদ্ধ কারাগার থেকে মুক্তি।

        তুমি বুঝছো না কেন সখী। পিতা যা তোমাকে বলবেন তা তোমার ভালোর জন্যই বলবেন। আর এটা রাজপ্রাসাদ, কারাগার ন। আর এই রাজপ্রাসাদের জন্য কত কে লালায়িত হয়ে আছে তা তুমি বুঝতে পারছ না।

       আমি এই রাজপ্রাসাদ চাই না, চাই মুক্তি—

       তার জন্য তোমাকে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে হবে। অস্ত্রবিদ্যা শিখলেই তুমি পিতাকে বলতে পারবে যে, তুমি এখন নিজের রক্ষা নিজেই করতে পারবে। তখন তোমার জন্য পিতার আর কোনো ভয় থাকবে না। পিতা তোমাকে তো সেই ভয়ের জন্যই বাইরে যেতে দেয় না।

         কিন্তু পিতা তাতেও যদি বাইরে যেতে না দেয়।

        তাহলে সখী একটি উপায় আছে। তুমি তোমার পিতাকে বলবে, আমি একটি শর্তেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করব। তারপর তুমি তোমার বাইরে বেরোনোর কথাটা বলবে। তোমার পিতা তাতে নিশ্চয়ই অমত করবেন না।

         কিন্তু সখী আমাকে যে ভালই লাগেনা অস্ত্রবিদ্যাশিক্ষা করতে।

         তুমি অস্ত্র শিক্ষা না শিখলে তুমি রাজ্য শাসন করবে কেমন করে। আর তুমি বাইরেও যেতে পারবে না। তোমাকে এই রাজপ্রাসাদের ভেতরেই থাকতে হবে।

        সখীর কথা শুনে রাজকুমারীও শেষ পর্যন্ত অস্ত্র শিক্ষাতে রাজি হয়ে যায় কিন্তু একটি শর্তের বিনিময়ে। সেই শর্তের কথা সুনয়না গিয়ে রাজাকে জানায়। অমরেন্দ্রনাথ প্রথমে তা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে রাজকুমারীর জেদে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে রাজকুমারী রাজ উদ্যান পর্যন্তই যেতে পারবে এবং তার সঙ্গে দেহরক্ষ হিসাবে ভদ্রমল্ল থাকবে সব সময়। রাজকুমারী এতে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও সুনয়নার কথাতে এই শর্ত মেনে নেয়।

         রাজ নির্দেশ মতো রাজকুমারী প্রাতঃকালে স্নান সেরে সখী সুনয়নার সঙ্গে রাজ মন্দিরে পুজো দিতে প্রস্তুত হন। রাজা অমরেন্দ্রনাথ প্রস্তুত হয়ে মেয়েকে রাজ মন্দিরে বাদ্য বাজনার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। রাজকুমারী, সখী সুনয়না এবং অমরেন্দ্রনাথ মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে। রাজকুমারীর এই মন্দির যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য রাজ্যের নানাস্থান থেকে প্রজারা এসে ভিড় জমান। এরকম দৃশ্য তারা সচরাচর দেখতে পান না। অনেকদিন হল যখন রাজকুমারীর মা জীবিত ছিল, সেই সময় এইরকম মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার সময় খুব ধুম হত। তারপর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে গেল আর ধুমও বন্ধ হয়ে গেল। রাজকুমারীর আবার মন্দিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকের মনে আবার সেই পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠল। সমগ্র অমরাবতী যেন এই আনন্দে মেতে উঠল। কিন্তু কেউ জানতে পারল না এর পেছনে রাজার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল। রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ক্রোশ খানেক পথ। সমগ্রপথ জুড়ে আচার অনুষ্ঠানের ধুম চোখে পড়ার মতো। আবার রাজ মন্দিরও উৎসবে মেতে উঠেছিল। মন্দিরের বাহির ফটক থেকে শুরু করে গর্ভ গৃহ পর্যন্ত সমগ্র মন্দির যেন আলোর রোশনাই মেতে উঠেছিল। স্থানে স্থানে প্রদীপ, বিচিত্র কারুকার্য করা ঝালর, স্থানে স্থানে বাধ্য- বাজনা, নৃত্য- গীত যেন এক অপূর্ব উৎসবে মেতে উঠেছিল অমরাবতী।

        বাইরে সমগ্র সেনানী এবং দাস-দাসীদের রেখে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলো শুধু রাজা, রাজকুমারী এবং সখী সুনয়না। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র গুলি বন্ধ হল। রাজকুমারী লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে আরতী শুরু করে দিল। তারপর পূজো শুরু হল। যথাসময়ে পুজো শেষ করে রাজকুমারী মন্দিরের কুল দেবতাকে প্রণাম করে, তারপর পুরোহিতকে প্রণাম করে, আশীর্বাদ নিয়ে, মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করে আবার রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

          রাজকুমারীর এই প্রথম বাইরের জগতে তার পদার্পণ। বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখে রাজকুমারীর যেন মনটা একেবারে ভরে গেল। এই প্রথম তার প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা। তার মনে রুদ্ধ দ্বার যেন খুলে গেল প্রকৃতির সংস্পর্শে। মনে হতো লাগল আরো কিছুটা সময় যদি এভাবে সে কাটাতে পারত। কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেল আবার রাজকুমারীর দোলা রাজপ্রাসাদে এসে থামল। রাজকুমারী দোলার ভেতর থেকেই বাইরে দৃশ্য গুলি পর্দার আড়ালে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করায় আর দেখা হল না। সমগ্র রাত্রি রাজকুমারী আর সখী সুনয়না সেই মন্দিরের ঘটনাগুলিই বর্ণনা করতে লাগল।

        পরদিন সকালে রাজকুমারী তার যুদ্ধের সজ্জা পড়ে প্রস্তুত হল সুনয়নার সঙ্গে অস্ত্রগুরুর কাছে যাবার জন্য। এই সময় অমরেন্দ্রনাথ এসে রাজকুমারীকে নিয়ে গেলেন, সঙ্গে সুনয়না এবং ভদ্রমল্লও গেলেন।

       রাজ রীতি মতো প্রথমেই গুরুকে প্রণাম করে গুরুর দেওয়া অস্ত্র হাতে তুলে নিল রাজকুমারী।বিজয়দেব রাজকুমারকে অস্ত্র তুলে দিয়েই বলল, আজকে থেকে তোমার অস্ত্র শিক্ষা শুরু হল। এখন থেকে তোমার পুরো মন যেন অস্ত্র শিক্ষাতেই থাকে। এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার শিষ্যা হলে। তোমার অস্ত্র শিক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর থাকল। তোমাকে অস্ত্র শিক্ষায় পরিপূর্ণ করে রাজকার্যের উপযোগী করে তোলায় এখন আমার প্রধান লক্ষ্য। তার জন্য তোমাকেও কিছু নির্দেশ মেনে চলতে হবে।

       রাজকুমারী এতক্ষণ কি যেন ভাবছিল। বিজয়দেব কি বলল ঠিক তা বোধগময় যেন হল না রাজকুমারীর। সখী সুনয়নার একটু নাড়া দেওয়াতে হঠাৎ রাজকুমারীর সচকিত হয়ে কি বলবে ভেবে না উঠে পেরে বলল, যথা আজ্ঞা গুরুদেব।

        রাজকুমারীর অস্ত্রশিক্ষা তো শুরু হল কিন্তু তার মন অস্ত্রশিক্ষার্থী ছিল না। বিজয়দেব এই অমনোযোগী মনোভাব লক্ষ্য করতে করতে একদিন রাজকুমারীকে তিরস্কারের সুরে বলল, তোমার দ্বারা দেখছি কোনো কিছুই হবে না। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে রাজকার্যের উপযোগী করে তুলব কিন্তু দেখছি আমার ভাবনাই ভুল ছিল।



                                         ৪

         রাজকুমারীর মনে চন্দ্রকে দেখে যে পূর্ব রাগের সূচনা হয়েছিল, সেই পূর্বরাগ কখন যে অনুরাগে পরিণত হল রাজকুমারী তা বুঝতেই পারেনি। তাই তো অস্ত্রশিক্ষা করতে গিয়েও বারে বারেই মনের কোন কোনে যেন চন্দ্রের ছবিই ভেসে উঠত, আর রাজকুমারী অমনোযোগী হয়ে যেত। কিন্তু রাজকুমারীও জানতো তা, তার মাঝে মাঝে অমনোযোগের কারণ যে চন্দ্রই। রাজকুমারী চেষ্টা করেও কিছুতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারত না অস্ত্রশিক্ষাতে। রাজকুমারীর এই অমনোযোগী মনোভাব লক্ষ্য করে গুরুদেব তাকে তিরস্কার করল। তিরস্কৃত হওয়ার পর রাজকুমারী কক্ষে চলে আসলেন চোখে জল নিয়ে। কারণ জীবনে এই প্রথম তাকে তিরস্কৃত হতে হল। রাজকুমারী অভিমান ভরা চোখে চেয়ে রইলেন প্রাসাদ কক্ষ হতে বাতায়ন পথে রাজ উদ্যানের দিকে। যেখানে চন্দ্র ফুলেদের সঙ্গে খেলে। তার সেই খেলা রাজকুমারীরও ভালো লাগে। তাইতো রাজকুমারী চেয়ে চেয়ে গোপনে চন্দ্রের খেলা দেখে এবং আনন্দিত হয়। কিন্তু আজকে রাজকুমারীর মনকে ভালো করতে পারতো যে চন্দ্র সে নেই। তার  অনুপস্থিত থাকায় রাজকুমারীর মন আরো বিষন্নতার ভরে গেল। আজকে যেন রাজকুমারীর বেশি দরকার ছিল কিন্তু আজকে চন্দ্র নেই। রাজকুমারী সবকিছুর জন্য নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে শুরু করল।

         এমন সময় সুনয়না‌ এসে রাজকুমারী অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে বলল,সখী তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে কি হয়েছে তোমার? আর তোমার চোখে জল কেন? রাজ অস্ত্রগুরু কি কিছু বলেছ?

         সখী সুনয়নার কথা শুনে রাজকুমারী যেন আরো কাঁদতে শুরু করলেন। অভিমানে চোখ থেকে যেন জল আপনে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হতে লাগল। সখীর এই অবস্থা দেখে ও শুনে  দুঃখিত হয়ে বলল, সখী তুমি কাঁদো না। তোমার কান্না দেখে যে আমারও কান্না পায়।

        সখীর কথায় সুনয়না চোখে জল মুছে বলল, সখী অস্ত্রগুলো বিজয়দেব আমাকে তিরস্কার করে বলেছে, আমি নাকি কোনো কাজের যোগ্য নয়—

        সেই সামান্য কথার জন্য তুমি এত কাঁদছ সখী—

       কেন কাঁদবো না। আমাকে কেউ এমন কথা কখনো তো বলেনি।

       সখী অস্ত্রগুরু যা বলেছে, তা তোমার ভালোর জন্যই বলেছে। তার জন্য এত কাঁদতে হবে সখী। আর তোমার দ্বারা হবে না কে বলল, তুমি রাজকুমারী তোমার দ্বারাই সব হবে। রাজ্যের এতগুলো প্রজাদের দায়িত্ব তো তোমাকেই নিতে হবে।

         কিন্তু আমি পারব না সখী—

       তোমাকে যে পারতেই হবে সখী। তুমি ছাড়া এই দারিদ্র্য, দুঃস্থ প্রজাদের কে রক্ষা করবে। তুমি কি এদের শত্রুদের হাতে ছেড়ে দেবে মৃত্যুর জন্য—

        কিন্তু আমি কেমন করে তা পারব।

       তুইমি পারবে সখী, এ আমার বিশ্বাস…দেখো একদিন তুমি এদের রক্ষা করতে হয়ে উঠবে—

       কিন্তু কেমন করে সখী?

       সময়েই সব হবে—

        এমন সময় অমরেন্দ্রনাথ বিজয়দেবের কাছে সবকিছু জানতে পেরে রাজকুমারীর কক্ষে এসে দেখল রাজকুমারী বেদনার্ত মনে সুনয়নার সঙ্গে কথা বলছে। সুনয়না মহারাজকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং রাজকুমারী বিষন্ন মনে পিতার দিকে চেয়ে থাকলেন। অমরেন্দ্রনাথ কন্যার দুঃখ দেখে কিছু বুঝতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে কন্যার কাছে গিয়ে বসে চন্দ্রিমার কাঁধে হাত রেখে বলল, অস্ত্রগুরু তোমাকে পুত্রীসম স্নেহ করে সেই জন্যই তোমাকে হয়তো পুত্রী স্নেহে কিছু বলেছে তার জন্য তুমি মন খারাপ করে বসে আছ। গুরুদেব তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এস। গুরুদেব তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলবে—

        পিতা আমার ভালো লাগে না অস্ত্র শিক্ষাতে—

       এখন বলছ ভালো লাগে না কিন্তু একদিন তা আর বলবে না—

      কিন্তু পিতা—

      তোমার সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য গুরুদেব অপেক্ষা করছে, তুমি কি যাবে না গুরুদেবের কাছে—

       রাজকুমারী প্রস্তুত হয়ে সুয়নার সঙ্গে গুরুদেব বিজয়দেব যেখানে প্রতীক্ষা করছিলেন, সেই কক্ষে গেলেন। গুরুদেব রাজকুমারীকে একাই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করতে বললেন। সুনয়না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল এবং রাজকুমারীর কক্ষে প্রবেশ করল। রাজকুমারী প্রথমে নম্রতাসহ গুরুদেবকে প্রণাম করলেন। গুরুদেবও তাকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর গুরুদেব রাজকুমারীর বিষন্নতা দেখে বললেন, রাজকুমারী আমার বলাটা ঠিক হয়নি, আমি তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

         না না  গুরুদেব, আপনি একি কথা বলছেন, ক্ষমাপ্রার্থী আমি। ওভাবে চলে আসাটা আমার ঠিক হয়নি। আপনি আমার গুরু, আমি আপনার শিষ্যা—কিন্তু আমার যেন অস্ত্রশিক্ষা ভালোই লাগে না—

          ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে রাজকুমারী। তোমাকেই তো এই রাজ্যের ভার নিতে হবে একদিন—

          কিন্তু গুরুদেব আমি কেমন করে পারব—

         একমাত্র তুমিই পারবে রাজকুমারী। তোমার মধ্যে আমি সেই তেজ দেখেছি। শুধু সেই নিষ্ক্রিয় শক্তিকে জাগাতে হবে। আমি এতদিন অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে এসেছি এই রাজ্যে, তোমার মতোন আমি কাউকে দেখিনি। তোমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে থাকবে—

        সব হবে রাজকুমারী, সময়েই সব হবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে একবার আমার সঙ্গে রাজ্য পরিদর্শনে যেতে হবে।

       কবে গুরুদে? এ কথাটা বলল কিন্তু আমি তো তারই প্রতীক্ষায় আছি, একথা বলতে গিয়ে বলল না। রাজকুমারীর মন আনন্দে ভরে উঠল রাজপ্রাসাদের বাইরে যাবার কথা শুনে। কিন্তু রাজকুমারী জানত না তার আনন্দই বিষাদে পরিণত হবে।

        কালকে সকালে আমরা বেরব তুমি প্রস্তুত থেকো, সঙ্গে তোমার সখীকেও বলো।

       গুরুদেব পূর্ব থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাজাকেও এ ব্যাপারে বলে রেখেছিলেন পূর্বেই, শুধু রাজকুমারীর সম্মতির অপেক্ষায় ছিল,এখন সেটাও পূর্ণ হল। রাজা অমরেন্দ্রনাথ গুরুদেবের নির্দেশ মতো সমস্ত আয়োজন করতে লাগল।

          পরদিন প্রাতঃস্নান সেরে রাজকুমারী প্রস্তুত হতে লাগলোষ সঙ্গে সুনয়নাও। রাজগুরু আসল রথ প্রস্তুত করা হল। রাজকুমারী ও সুনয়না সেই রথে চড়ে রাজ্য পরিদর্শনে বেরলেন। সামনে গুরুদেবের রথ, স্যার পেছনে রাজকুমারীর, তার পেছনে সৈন্য সামন্ত চলছে। রাত যত চলছে রাজকুমারীর মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। কতদিন পরমুক্ত হাওয়ায় রাজকুমারী শ্বাস নিয়েছে। মুক্তির আনন্দ আজ তার মনে। গুরুদেব অগ্রে পথ প্রদর্শন করে করে চলছে, পেছনে রাজকুমারী সুনয়নার সঙ্গে গল্পে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। প্রজারা সেই এই দৃশ্য দেখছে এবং রাজকুমারী ও গুরুদেবকে নম্র মস্তকে প্রণাম করছে।

         হঠাৎ রথ চলতে চলতে গুরুদেবের নির্দেশমতো থেমে গেল। গুরুদেব রাজকুমারী ও সুনয়নাকে রথ থেকে নামতে নির্দেশ দিলেন। গুরুদেবের আদেশ মতো রাজকুমারী ও সুনয়না রথ থেকে নেমে, ছদ্মবেশে গুরুর নির্দেশে রাজ বেশ পরিত্যাগ করে সৈন্য -সামন্তদের ছেড়ে তিনজনে চলতে লাগল পদব্রজে গুরুদেবের পশ্চাতে চলতে লাগলেন। গুরুদেব এক দরিদ্র দুস্থদের গ্রামের প্রবেশ করলেন, পেছনে পেছনে রাজকুমারী ও সঙ্গে সুনয়নাও। সেখানে দারিদ্রতা দেখে রাজকুমারীর মন দয়দ্র হয়ে উঠল। সেখানে প্রজাদের উপর সৈন্য- সামন্তদের অত্যাচার, শোষণ দেখে রাজকুমারী ক্রোধে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু গুরুদেবের নির্দেশে রাজকুমারী শান্ত হলেন। রাজকুমারীর মন থেকে আনন্দ এক মুহূর্তে দুঃখে পরিণত হল। গুরুদেব শুধু প্রত্যক্ষ করতে বললেন কোনো কার্য নয়। জমিদার- সামন্তদের অত্যাচার, প্রজাদের দূর্দশা সবকিছু রাজকুমারী দেখতে থাকলেন নীরব দর্শক হয়ে। আজ প্রথম রাজকুমারীর এই দৃশ্য দেখে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। জীবনে প্রথম এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। রাজকুমারী তার নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে ফেরার পথে গুরুদেবকে বললেন, গুরুদেব এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

          এর প্রতিকার তোমাকেই করতে হবে রাজকুমারী।

         কিন্তু গুরুদেব এখানে এমন অরাজক অবস্থা কেন?

        কারণ এই অঞ্চলে তোমার পিতা শাসনব্যবস্থা ঠিক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এখানে এখনো জমিদারের শাসন চলে।

         গুরুদেবের কথা শুনে রাজকুমারী মন দুঃখে ভরে গেল এই সাধারণ, নিরীহ প্রজাদের দুঃখে। ফেরার পথে সমগ্র পথ ধরে এই প্রশ্নগুলোই রাজকুমারী গুরুদেবকে করে যাচ্ছিল একটার পর একটা।

        প্রাসাদের কক্ষে প্রবেশ করেও তার মনে নানান প্রশ্ন জাগছে। এই দৃশ্য রাজকুমারী ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নের মতোন দেখছে। রাত্রে দুচোখে ঘুম নেই, সেই দৃশ্যই চোখের সামনে ভেসে আসছে।

        সখী তোমার কি হয়েছে? এত ব্যাকুল কেন? অনেক রাত্রি হয়ে এলো তবুও তোমার দেখছি চোখে ঘুম নেই? রাজকুমারীর বিচলিত অবস্থা দেখে রাজকুমারী সুনয়নাকে এইসব প্রশ্ন করল।

       ঘুম যেন চোখে আসছে না সখী। সেই দৃশ্যই যেন চোখে ভাসছে।

     সখী এর প্রতিকার তো তোমাকেই করতে হবে। এখন তুমি ঘুমাও। কাল প্রাতঃকাল থেকে আবার অস্ত্রশিক্ষা শুরু হবে তোমার। এখন তোমার নিদ্রা প্রয়োজন।

       কিন্তু সখী এমনটা কেন হয়?

       এমনটাই হয় সখী—চারিদিকে সবলেরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করে চলছে। যেমন নারায়ানী রাজ্য তোমার রাজ্যকে দুর্বল ভেবে তার জন্য আক্রমণ করেছিল। প্রতিরোধের জন্য দরকার শক্তি—

        রাজকুমারী আর কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু মনের মধ্যে সেই কথাগুলি এবং ছবিগুলি ঘুরতে লাগলোষ চোখের চারিপাশে। সকালে রাজকুমারী আবার প্রস্তুতি শুরু করল অস্ত্র শিক্ষার জন্য। কিছুক্ষণ মনটা খারাপ হয়ে থাকল, তারপর গুরুদেবের কথামতো অস্ত্রশিক্ষায় মনোনিবেশ করল এবং তখন চন্দ্রের কথা আর মনে হল না শুধু চোখের সামনে সেই ছবি ভাসতে থাকল।

       ধীরে ধীরে অস্ত্রশিক্ষা যত এগিয়ে গেল, তত রাজকুমারী সব ভুলে অস্ত্রের প্রতি মনোযোগী হতে শুরু করল। কিন্তু প্রথম ভালবাসাকে কি আর ভোলা যায় এত সহজে? যখনই চন্দ্রকে দেখত জানালা দিয়ে তখনই মন আবার উদাস হয়ে যেত। রাজকুমারী কর্তব্যের জন্য কিছুদিন চন্দ্রকে ভুলে থাকতে চাইল কিন্তু ভুলে কি আর থাকতে পারল? যখনই প্রাসাদ কক্ষে আসত, তখনই চন্দ্রের কথা মনে হত! গুরুদেব অস্ত্রশিক্ষায় একান্ত নিষ্ঠা এবং পারদর্শিতা দেখে  একদিন বলল, আমি বলেছিলাম না, তোমার দ্বারাই সব হবে। শুধু তোমার অন্তস্থ শক্তিকে জাগাতে হবে। এবার সেই কাজ সম্পন্নতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এক ভবিষ্যৎকে দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে—

        কথা বলতে বলতে গুরুদেবের চোখের কোন দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

      যত সময় যেতে থাকলো তত রাজকুমারী অশ্ব চালনা, অসি চালনা, রথ চালনা, তীর -ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠল। গুরুদেবের যত শিষ্যা – শিষ্য ছিল সবাইকেই পারদর্শিতায় ছাড়িয়ে গেল। দেখতে রাজকুমারী চন্দ্রিমা এক বৎসরের মধ্যে সমস্ত শিক্ষা আয়ত্ত করে নিল। অস্ত্রবিদ্যা এতই পারদর্শী হয়ে উঠল যে রাজ্যের কেউ অস্ত্র বিদ্যায় রাজকুমারীর সঙ্গে পেরে উঠত না। অস্ত্রবিদ্যা সমাপনের পরে গুরুদেব রাজকুমারীকে আশীর্বাদস্বরূপ একদিন দিন অসি দান করে বললেন, এই তরবারি আমি তোমাকে দিলাম…তুমিই এর যোগ্য উত্তরাধিকারী—তোমার মধ্যে এক জ্বলন্ত ভবিষ্যৎকে আমি দেখতে পাচ্ছি—

        রাজকুমারী শিক্ষা সমাপন করে পিতার কাছে চললেন। পিতা তাকে দেখে খুব খুশি হলেন। অমরেন্দ্রনাথ আর রাজকুমারীকে কোনো কাজে বাধা দিলেন না পূর্বের কথা মতো।রাজকুমারীর ইচ্ছা মতোন সব জায়গায় বিচরণ করতে পারতেন। অস্ত্র শিক্ষা সমাপ্তির পর রাজকুমারীর মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠল। পূর্ব রাগের স্মৃতি আবার ভেসে উঠল মনে। মনের আনন্দে সখী সুনয়না সঙ্গে রাজ উদ্যানে ছুটে গেল কিন্তু সেখানে চন্দ্রকে না দেখতে পেয়ে দুঃখে মন ভরে উঠল। সখী সুনয়না মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, সখী একটু অপেক্ষা করো—এতদিন অপেক্ষা করলে আর একটুর জন্য মন ধরতে পারছ না—

         রাজকুমারীর মন যেন আর জানতে চাইছিল না। সুনয়নার কথা শুনে রাজকুমারীর চোখের কোনে জল একটু গড়িয়ে পড়ল। নিজের মনকে শান্ত না করতে পেরে রাজকুমারী বলল, সখী কেমন করে আর হৃদয় ধরব, মন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই! কতদিন এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করলাম….. আর আজকে সময় যখন আসল তখন আর তার দেখা নেই —

        যখন এরূপ কথোপকথন চলছিল, তখন চন্দ্র এসে উপস্থিত হল। সুনয়না বা রাজকুমারী কেউই তাকে লক্ষ্য করতে পারেনি। হঠাৎ যেন চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত ফল লাগে রাজকুমারী স্তম্ভিত হয়ে গেল। সুনয়নাও কিছু বুঝতে না পেরে রাজকুমারীকে বলল, তুমি উদ্যান ভ্রমণ কর আমি আসছি।


                                        ৫

  যাকে দেখার জন্য রাজকুমারীরা এত অপেক্ষা এবার তা যেন পূর্ণ হল। থেকেই সময় না তাদের মাঝে বাধা হিসেবে থাকতে না চেয়ে নিজেকে কাজের আছিলায় দূরে সরিয়ে নিল। চন্দ্র চোখের সামনে অপরিচিত এক সুন্দরী কন্যাকে দেখে কি বলবে বুঝতে না পেরে মুখমন্ডল পানে চেয়ে রইল। দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল বহুদিন পূর্বে দেখা রাজপ্রাসাদের জানালার সেই অপরিচিত চোখ দুটি আর ঠোঁটের একটু মিষ্টি হাসির কথা। রাজকুমারীর চোখের দিকে তাকিয়ে সেই চোখের কথাই মনে পড়ে গেল। মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন উঠতে লাগল, এই কি সেই মেয়ে, যাকে সে দেখেছিল? কিন্তু সেই অনেক দিনের স্মৃতি মনে যেন সম্পূর্ণ সংরক্ষিত নেই, একটু বিস্তৃতি এসেছে। কিন্তু সেই চোখের কথা চন্দ্র এক মুহূর্তও ভুলতে পারেনি। এতদিন পরে সেই স্মৃতি আবার জাগ্রত হল রাজকুমারীকে দেখে। মন যেন বলছিল এই চোখেই যেন সেই চোখ, এই মেয়েই যেন সেই মেয়ে। কিন্তু হঠাৎ সেই মেয়ে এখানে কেমন করে আসল? কে হয় এই সুন্দরী? এখানেই বা কেন আসল? কি উদ্দেশ্য তার? এইসব কথাই মনে হতে লাগল।

        কৌতূহল নিবৃত্তি করতে না পেরে চন্দ্র বলল, আপনি কে? আর কেনই বা হঠাৎ এখানে? আপনাকে তো এর পূর্বে কখনো দেখিনি?

        রাজকুমারী কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, আমি এই প্রাসাতেই থাকি। প্রতিনিয়ত তোমাকে দেখি এই উদ্যানের ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলতে। আমার ভালই লাগে দেখতে—

        এবার রাজকুমারীর কথা শুনে এতক্ষণ চন্দ্র যা মনে মনে ভাবছিল সেটাকেই সত্যি বলে মনে হল। কিন্তু সেই কথা বলবে কেমন করে। হঠাৎ রাজকুমারী আবার বলল, তুমি ফুলগুলোকে খুব ভালোবাসো না?

         হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেমন করে—

         আমি জানি—

         তাহলে আপনিই কি প্রাসাদের ত্রিতল কক্ষ থেকে আমাকে দেখতেন—

        হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে?

      আপনাকে একদিন দেখেছিলাম প্রাসাদ কক্ষের জানালায়। কিন্তু সম্পূর্ণ দেখতে পাইনি, শুধু চোখ দুটি আর ঠোঁটের একটু হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। তাহলে আপনিই সেই স্ত্রীলোক—

         আজকে বুঝতে পারলাম তাহলে তুমি আমাকে প্রাসাদের জানালা পথে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে।

       না না আপনি ভুল ভাবছেন, আমি শুধু একবারই আপনাকে দেখতে পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই—

        রাজকুমারী কৌশল খাটিয়ে চন্দ্রের কাছ থেকে তাকে দেখার কথাটা বলিয়ে নিল। রাজকুমারী আবার বললন, তাহলে তুমি আমাকে চিনলে কেমন করে?

        সেই দিন যে আপনার দুটি চোখ দেখেছিলাম, আবার আজকে আপনাকে দেখে সেই চোখের কথাই মনে হল, আবার আপনি যখন বললেন আপনি আমাকে দেখেন ফুলের সঙ্গে খেলতে—

        তাহলে তুমিও আমাকে দেখতে?

         সেই একদিন—

        তারপর আর সেই জানালার দিকে তাকাওনি একবারও—

         না, মানে —

         দেখো তুমি সত্যি করে বলো আমি সব জানি, সখী সব বলেছে আমাকে।

          সখীর কথা বলায় চন্দ্রের মনে সন্দেহ জাগল যে, এ নিশ্চয়ই রাজকুমারী হবে। চন্দ্র সখীকে দুই- একবার দূর থেকে দেখেছিল এবং শুনেছিল রাজকুমারী সম্বন্ধে অনেক কথা। এবার তার মনে হল এই মেয়েটি নিশ্চয়ই রাজকুমারী হবে।

         চন্দ্র বলল, কিন্তু আপনি কি রাজকুমারী?

         হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বলো তুমি কতবার আমাকে দেখেছ?

        সেই একবার রাজকুমার, তারপরে আর দেখতে পাইনি—

        তারপরে কেন বারেবারে দেখতে জানালার দিকে? তুমি কি ভাব আমি কি কিছুই জানিনা?

       এই অবস্থায় চন্দ্র কি বলবে, একে তো সে রাজকুমারী, আর অপরদিকে সে মালি। রাজকুমারীকে এই ভাবে দেখা রাজ অপরাধ। চন্দ্রের মনে ভয়ও হতে লাগল, রাজকুমারী যদি পিতাকে সব কথা বলে দেয়। সেজন্য চন্দ্র কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইল। চন্দ্রের এই নীরবতা দেখে রাজকুমারী আবার বলল, কি হল তুমি বলছ না যে কিছু? আমি সব জানি, তুমি যদি সত্যটা না বল, তাহলে আমি পিতাকে সব বলে দেব। আর তুমি তো জান তার ফল কি হবে।

         এবার চন্দ্র বাধ্য হয়েই বলল, কি জানি কেন যেন দেখতে ভালো লাগত—এত সুন্দর নয়ন যুগল কার, তা দেখার জন্য মন ছুটে যেত —

         শুধু কি ভালো লাগত তাই—

         হ্যাঁ ভালো লাগত। এক ঝলক দেখা দিয়ে মেঘের মধ্যে লুকিয়ে যাওয়া সেই ছটাকে দেখতে চাইত মন!

         রাজকুমারীও চন্দ্রের কাছ থেকে গোপন মনের ভাব জেনে নিল কৌশলে। এবং চন্দ্রও এতদিন ধরে মনের মধ্যে জমা ভাব, যার জন্য জমেছে এক মুহূর্তে তার কাছে ব্যক্ত করতে পেরে মনটা হালকা হল। যেই মুহূর্তে চন্দ্র রাজকুমারীতে মনের কথাগুলো বলছিল, সেই সময় রাজকুমারীর মুখে এক অপূর্ব হাসির ভাব লক্ষ্য করলে চন্দ্র। চন্দ্র ও চন্দ্রিমার মনের সেই পূর্বরাগ যেন অনুরাগের ঘনীভূত হল। কথা বলতে বলতে কখন যে রৌদ্র উঠেছে রাজকুমারী বা চন্দ্র কেউই  তা লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ চন্দ্রের খেয়াল হল রাজকুমারী রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তখন চন্দ্র রাজকুমারীকে বলল, রাজকুমারী আপনি রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন, আমি এতক্ষণ তা লক্ষ্যই করিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন রাজকুমারী আমি আপনাকে রৌদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছি—আসুন আমরা এই বটবৃক্ষের ছায়ায় বসি—

        রাস উদ্যানের পাশে ছায়ার জন্য চারিদিকে বড়ো বড়ো বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল, তার মধ্যে এই বটবৃক্ষও ছিল। কখন প্রভাত অতিক্রান্ত হয়ে প্রায় মধ্যান্য আসন্ন হয়েছে রাজকুমারী এবং চন্দ্র কেউই লক্ষ্য করতে পারেনি। চন্দ্রের কথাতে রাজকুমারীর ধ্যান ভাঙল এবং একটু মিষ্টি হেসে চন্দ্রের পেছনে পেছনে বটবৃক্ষের ছায়ায় গিয়ে বসল। সেই বৃক্ষের এক শাখায় সেই টিয়াটি বসেছিল। বৃক্ষ তলে বসে রাজকুমারী ও চন্দ্র যখন কথা বলছিল, তখন সেই টিয়াটি উপর থেকে তাদের প্রেমালাপের কথাগুলি শুনছিল। বৃক্ষের নিচে অনুরাগ ঘনীভূত হচ্ছিল আর বৃক্ষের উপরে টিয়াটি সেগুলি শুনে শুনে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছিল এবং তাদের মুখের ভঙ্গের দিকে লক্ষ্য রেখে চলছিল।

         চন্দ্র বলল, কিন্তু রাজকুমারী আপনি এখানে হঠাৎ?

         কেন? আমি কি আসতে পারি না।

         না রাজকুমারী আমি বলছিলাম আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি, শুধু আপনার কথা শুনেছি— তো আপনি হঠাৎ করে—

       কেন আমি কি উদ্যানে অসতে পারি না পরিদর্শনের জন্য।

          না রাজকুমারী, আমায় ক্ষমা করবেন এই উদ্যান তো আপনারই আপনি যখন ইচ্ছে তখন আসতে পারেন।

         এমন সময় রাজকুমারীতে বিশ্রামের জন্য সখী ডাকতে আসল। রাজকুমারীও তা খেয়াল ছিল না কখন বিশ্রামের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে রাজকুমারীর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটলে মহারাজের কোপে পড়তে হবে সুনয়নাকে। তাই সুনয়না চন্দ্রিমাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে।  সুনয়নাকে আসতে দেখে চন্দ্র ভয়াগ্ৰস্ত হয়ে পড়ে। শেষের রাজকুমারীর আশ্বস্তে তার ভয় দূর হয়।

        সুনয়না এসে বলে, সখী তোমার এখনো হয়নি, ওদিকে আবার মহারাজ তোমাকে না দেখলে আমাকেই বকবেন—

        রাজকুমারী যখন উঠে চলে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন চন্দ্র ডেকে বলল, রাজকুমারী আপনার নামটাই তো শোনা হল না —

        রাজকুমারী একটু হেসে চন্দ্রিমা বলে সখীর সঙ্গে চলে গেল। চন্দ্র বিমনা হয়ে নিজের কক্ষে বিশ্রামের জন্য চলে গেল। বিশ্রামের জন্য গেল কিন্তু কিছুতেই রাজকুমারী এবং চন্দ্রের বিশ্রাম হল না। দুজনের চোখের সামনে সেই প্রথম দেখার ছবিগুলো ভেসে আসতে থাকল চিত্রের ন্যায়।

        প্রতিদিন চন্দ্র সকালে উদ্যানের ফুল গুলির সঙ্গে খেলত এবং রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে থাকত। রাজকুমারীও দেখে দেখে হাসত। তারপর ক্রমে রাজকুমারী সুনয়নার সঙ্গে প্রতিদিন চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করল। চন্দ্রের মনেও নতুন ঢেউ লাগল। চন্দ্র আর চন্দ্রিমার প্রতিনিয়ত সেই  বটবৃক্ষের নিচে প্রেমালাপ চলতে থাকল। সেই টিয়াটিও প্রতিনিয়ত তাদের কথাগুলো শুনতে লাগল। চন্দ্র রাজকুমারীতকে চন্দ্রিমা বলে খুব কমই ডাকত, বেশিরভাগ সময়ই রাজকুমারী নামেই ডাকত। রাজকুমারী চন্দ্রকে নাম ধরে ডাকত না, নামের পরিবর্তে তুমিই বলত।

         রাজকুমারী একদিন খুব সকালে উঠেই চন্দ্রকে দেখার জন্য একাই চলে আসে সেই বটবৃক্ষে কিন্তু সেই দিন চন্দ্রের আসতে কিছুটা দেরিই হয়ে গেল। রাজকুমারী উদ্বিগ্নভাবে বসে বসে নানান কথা ভাবতে থাকল। ঠিক সেই সময় চন্দ্র আসাতে রাজকুমারী একটু অভিমানে বলল, তুমি কি করছিলে, এত দেরি হল কেন?

        কেন রাজকুমারী? আপনি এখানে হঠাৎ? মানে কি উদ্যান ভ্রমণে?

        হ্যাঁ আমি উদ্যান ভ্রমণে এসেছি, তীব্র অভিমানের সুরে বলল।

       তুমি কি ভাবলে আমি উদ্যান ভ্রমণের জন্য এখানে এসে বসে আছি? তোমার তাই মনে হল?

        চন্দ্রও এবার আর না বলে আর থাকতে পারল না। মনের কথা মুখে এবার চলেই এল, আর বাধা মানল না কোনোমতেই। আপন মনেই বলে উঠল, আমি তো বুঝতে পারলাম রাজকুমারী—আপনার মনের যে অবস্থা আমারও সেই রকম—কিন্তু কোথায় আপনি আর কোথায় আমি রাজকুমারী।

        তুমি কি আমাকে চাও না? আমি তোমাকে এক মুহূর্ত না দেখলে যেন এক যুগ বলে মনে হয়। মন আর কিছুতেই মানে না—

        রাজকুমারী আমি তো বুঝতে পারছি কিন্তু কোথায় তুমি আর কোথায় আমি। এ কেমন করে সম্ভব রাজকুমারী। মন চাইলেই কি আর সব হয়! মন তো অনেক সময় অনেক কিছু চায় কিন্তু পূর্ণ হয় আর কটা! এইবার প্রথম রাজকুমারীকে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন।

        আমি অতিশয়োক্তি জানি না। তোমাকে ছাড়া, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারব না। তুমি কি পারবে আমাকে ছাড়া থাকতে?

        হয়তো পারব না রাজকুমারী, কিন্তু এ সম্পর্ক কেমন করে সম্ভব? মহারাজা যদি জানতে পারে—

        আমি কিছু জানিনা। শুধু জানি তুমি শুধু আমার।

      রাজকুমারীর কথা শুনে চন্দ্রের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। মনের গোপন বাসনা জেগে উঠল। এতদিন তা অবদমিত ছিল, এবার তা আর বাধা মানছে না। রাজকুমারীর কথা শুনে চন্দ্র আর মনের ভাব গোপন করতে না পেরে বলে ফেলল, আমিও তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না রাজকুমারী। তুমি একমাত্র এই চন্দ্রের চন্দ্রিমা। তুমি ছাড়া আর কখনো না কেউ ছিল, আর না কেউ হবে।

        এদিকে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ভদ্রমল্ল রাজকুমারীর খোঁজে আসছিল। সখী সুনয়না হঠাৎ দেখতে পেয়ে ছুটে এসে ভদ্রমল্লের সামনে দাঁড়াল। ভদ্রমল্ল সুনয়নাকে দেখে বলল, রাজকুমারী কোথায় সুনয়না? দেখছি না রাজকুমারীকে সকাল থেকে তাই দেখতে এলাম। যাই একবার দেখে আসি।

         রাজকুমারী যেখানে থাকার সেখানে ঠিকই আছে। রাজকুমারীর জন্য আর তোমায় ভাবতে হবে না। রাজকুমারী এখন নিজের রক্ষা নিজেই করতে পারে।

        তবুও মহারাজের নির্দেশ রাজকুমারীকে রক্ষার দায়িত্ব সব আমারই উপর। রাজকুমারীর কোনো কিছু হলে মহারাজ আমায় ক্ষমা করবেন না।

       তুমি রাজকুমারীর এত চিন্তা করছ কেন? রাজকুমারী তার নিজের রক্ষা এখন নিজেই করতে এখন সক্ষম।

        কিন্তু মহারাজ—

        তোমাকে এত ভাবতে হবে না, আমি বলছি তো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। অনেকদিন ধরে ভাবছি বলব বলব কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।

       কি কথা সুনয়না?

      আগে চলো আমরা উদ্যানে ওপাশে যায়। ওখানে আমাদের মধ্যে কেউ বাধা দিতে আসবে না। এখানে হবে না। কখন মহারাজ হঠাৎ ডাকতে বসবেন আবার। তার থেকে আমরা ওপাশটাই য়াই—

        একথা শুনে ভদ্রমল্লের মনের অন্ধকারে এক তীব্র দীপ শিখায় জ্বলে উঠল দপ্ করে হঠাৎ। ভদ্রমল্ল কিছু বুঝতে না পেরে সুনয়নার কথায় রাজি হয়ে বলল, ঠিক আছে সুনয়না তাই ভালো হবে। আমরা বরং ওদিকেই যাই—


          

                                     ৬

     একজন নারী ভালো করেই জানে কি করে একজন পুরুষকে বশে আনতে হয়। সুনয়নার কথার মোহে ভদ্রমল্ল মোহিত হয়ে গেল। ভদ্রমল্লের পত্নী অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিল, সেই থেকেই নতুন করে আর বিবাহ না করে রাজ কার্যে মনোনিবেশ করে।এতদিন পরে তার সেই কামনা আবার জেগে উঠল সুনয়নার কথায়। ভদ্রমল্ল নিজের কাজ ভুলে সুনয়নার সঙ্গে প্রেমালাপে মত্ত হয়ে উঠল।

        এদিকে চন্দ্রও চন্দ্রিমার প্রেমে মত্ত। একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না এরকম প্রেমালাপ চলছে; তখন অন্যদিকে ঝাউ গাছের ছায়ায় বসে নতুন প্রেমের সূচনা হচ্ছে। একদিকে অনুরাগ পূর্ণতা পাচ্ছে, আর একদিকে পূর্ব রাগ ঘনীভূত হচ্ছে। সুনয়নার মনও নব প্রেমের অনুভূতিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। রাজ উদ্যানের দুই প্রান্তে দুই প্রেমের গল্প চলছে।

         এদিকে অনেকটা সময় হয়ে এলে রাজকুমারী উঠে যখন সবে আসতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়ই সেই বটবৃক্ষের শাখায় যে, টিয়াটি ছিল, রাজকুমারী, রাজকুমারী… বলতে বলতে রাজকুমারীর ঘাড়ে এসে পড়ল। রাজকুমারী কিছু বুঝতে না পেরে নিজের ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে টিয়াটিকে দেখতে থাকে। সেই সময় টিয়াটি আবার রাজকুমারী বলে ওঠে। রাজকুমারী খুশি হয় সেই টিয়াটিকে নিয়ে প্রাসাদ কক্ষে প্রবেশ করে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে রাজকুমারী পিতার কাছে সেই টিয়াটিকে নিয়ে ছুটে যায়।

           পিতা দেখ আমি কি পেয়েছি, বলে রাজকুমারী ছুটে গিয়ে পিতাকে দেখায়।

       অমরেন্দ্রনাথ মেয়ের খুশিতে খুশি হয় বলল, দেখি দেখি—

       রাজকুমারী তখন টিয়াটিকে বলে, বলতো আমি কে? তুমি আমাকে কি বলে ডাকলে তখন?

      তখন টিয়াটি আবার রাজকুমারী, রাজকুমারী বলে ওঠে।

       দেখে অমরেন্দ্রনাথও খুশি হয়ে বলে সত্যি তো— এই টিয়াটি তো কথা বলে! একে তুমি কোথায় পেলে?

         পিতা আমি উদ্যান থেকে আসছি তখন হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে ঘাড়ে পড়ে। পিতা তুমি এর জন্য একটা সোনার পিঞ্জর গড়ে দিও। আমি একে সেই সুবর্ণ পিঞ্জরের মধ্যে রাখব।

          তুমি যা চাও তাই হবে রাজকুমারী। আমি এক্ষুনি শ্যাকরাকে নির্দেশ দিচ্ছি সুবর্ন পিঞ্জর বানানোর জন্য।

         রাজকুমারী আনন্দে সখীকে দেখাতে নিয়ে যাবে কিন্তু প্রাসাদে দেখে সখী নেই। প্রাসাদের বাইরে উদ্যানে এসেও সখীকে দেখতে না পেয়ে রাজকুমারী বিমনা হয়ে পড়ে। তিতস্ততভাবে উদ্যানে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ভদ্রমল্লের সঙ্গে সুনয়নাকে গল্প করতে দেখে আর তাদের মাঝে বাধা না দিয়ে রাজকুমারী চলে আসে। এদিকে সখী সুনয়নাও ধ্যান হয় যে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। সময় কখন চলে গেছে সুনয়নাও বুঝতে পারেনি। হঠাৎ তার রাজকুমারীর কথা মনে পড়ায় দ্রুত সেখান থেকে রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে ছুটে আসে এবং ভদ্রমল্লও ছুটে যায় রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখে রাজকুমারী ও চন্দ্র কেউই নেই। সুনয়না ও ভদ্রমল্ল দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা দ্রুত রাজপ্রাসাদের ছুটে এসে দেখে রাজকুমারী এক টিয়াকে নিয়ে খেলছে। এবং টিয়াটি কথা বলছে। এই ঘটনায় সখী আশ্চর্য হয়ে যায়। সুনয়না আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, সখী তুমি এই টিয়াকে কোথায় পেলে? জানো একেবারে অবিকল মানুষের মতো কথা বলছে!

         আমি উদ্যান থেকে আসার সময় হঠাৎ পেছন থেকে রাজকুমারী, রাজকুমারী বলতে বলতে আমার ঘাড়ে এসে বসে। পিতা এর জন্য সুবর্ণা পিঞ্জর তৈরি করে দেবে।

         সখী তুমি খুব ভাগ্যবান। এমন একটা টিয়া তোমার নাম ধরে ঘরে এসে পড়ল।

       আর সখী তুমি কোথায় ব্যস্ত ছিলে এতক্ষন—

      কোথায় আবার উদ্যানে গিয়েছিলাম তুমি তো দেখলে।

        শুধু কি উদ্যানে, আর কোথায় গিয়েছিলে, আমি সব দেখলাম সখী—

        সুনয়না আর কিছু না বলে একটু হেসে বলল, না সখী তুমি যেটা ভাবছ সেটা না।

       হ্যাঁ সখী আমি জানি, তোমাকে আর বলতে হবে না।

       সুনয়না এবং রাজকুমারী টিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিয়াটি বারবার রাজকুমারী, রাজকুমারী বলতে থাকল। অমরেন্দ্রনাথ রাজ্যের কারিগর দিয়ে এক সুন্দর সুবর্ণ পিঞ্জর তৈরি করল। টিয়াটি রাত্রি কালে এবং বিশ্রামের সময় সেই পিঞ্জরে থাকতে লাগল। পিঞ্জরের দাড় কখনো বন্ধ করা থাকত না ফলের টিয়াটি নিজের ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারত। প্রিয়া তুই সবসময় রাজকুমারীর সঙ্গে সঙ্গেই থাকত।

        এদিকে অমরেন্দ্রনাথ নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য চন্দ্রিমার হাতে রাজ্যের ভার অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিল। সেইমতো সমস্ত ব্যবস্থা করতে লাগল। রাজগুরুর আশীর্বাদে শুভ তিথিতে কুলোদেবতার পুজো দিয়ে চন্দ্রিমার মুকুট বরণ সমারো মহা আনন্দের সহিত শেষ হল।

         রাজকুমারী রাজ্যের মহারানী পদের বসতেই প্রথমেই অমরাবতী রাজ্যের দক্ষিণ সীমানায় যে রাজনগর আছে, সেখানকার জমিদার সামন্তদের দমন করে সেই রাজনগর রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসে। সেখানকার দুস্থ প্রজাদের জমিদার ও সামন্তদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দেয়। রাজ্যের প্রজাদের প্রজা মঙ্গলকারী, প্রজাহিতৈষী হিসাবে রাজকুমারী খ্যাতি পায়। অমরেন্দ্রনাথও মেয়ের কীর্তিতে মুগ্ধ হয়ে বলে, পুত্রী তোমার দ্বারাই হবে রাজ্যের উন্নয়ন, প্রজাদের কল্যাণ। আমার এত দিনের চিন্তা এবার দূর হল। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব। যোগ্য উত্তরাধিকারের হাতেই আমি রাজ্য দিতে পেরেছি—

        পিতা তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছ কেন? তুমি না থাকলে এই রাজ্য কে চালাবে।

        এতদিন তার ভাবনাই ছিল, এখন আর নেই—

       কিন্তু পিতা আমি—

        তুমিই সব পারবে, একমাত্র তুমিই —

       তারপর দুজনেই নীরব, পিতা  পুত্রীর দিকে তাকিয়ে গর্ববোধ করতে লাগল।

       তখন সখী সুনয়না এসে রাজকুমারীকে ডেকে নিয়ে গেল। চন্দ্র এদিকে রাজকুমারীর অদর্শনে বিরহে কাতর। রাজকুমারীও যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় চন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার সময় পায়নি। সুনয়নাকে দেখতে পেয়ে রাজকুমারী তথা মহারানীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলে সুনয়না চন্দ্রের কথামতো রাজকুমারীকে ডাকতে আসে। রাজকুমারী চন্দ্রের কথা শুনে সুনয়নার সঙ্গে রাজ উদ্যানে চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

       চন্দ্র অনেকদিন পরে রাজকুমারীকে পেয়ে বলে, আজকে যেন আবার পুনরায় চন্দ্রের আকাশে চন্দ্রিমার উদয় হল।এতদিন চন্দ্র চন্দ্রিমাকে ছাড়া আলোহীন অবস্থায় ছিল, আবার যেন পুনরায় আলো ফিরে পেল চন্দ্র চন্দ্রিমার উদয়ে—বসো রাজকুমারী এই বটবৃক্ষে যেখানে আমাদের প্রথম প্রেমের সঞ্চার হয়! আজ আবার সেখানে অনেকদিন পরে যেন নতুন করে তোমাকে দেখছি। সেই যেদিন প্রথম দেখেছিলাম মুগ্ধের মতো। আজও আমার তেমনই অবস্থা মহারানী। আপনি আপনার কাজে এতই ব্যস্ত হয়েছিলেন যে, চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করেছিল! এবার আবার চন্দ্র মুক্ত হল তোমার আগমনে!

        আমার মন কি একবারও ব্যাকুল হয়নি তোমার জন্য? প্রতিমুহূর্তে মনে হতো কখন আমি এই দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরবো, যেন কারাগার বলে মনে হত! মনে হতো কারাগারে আবদ্ধ ছিলাম, এখন মুক্ত হলাম!

              না মহারানী। এখন তুমি আর সেই রাজকুমারী নেই, এখন তুমি মহারানী। এখন সমগ্র রাজ্যের দায়িত্ব তোমার উপর। তোমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তুমি তো আর এখন আমার একার না, তুমি সবার—

           চন্দ্র বিহনে এতদিন চন্দ্রিমাও যেন প্রভাহীন হয়েছিল। আজ আবার চন্দ্রিমা প্রাণ ফিরে পেল! কর্তব্যের জন্য তোমার থেকে এতদিন দূরে ছিলাম। আজকে অনেক কথা বলার ইচ্ছা, কিন্তু কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। সময় শুধু চলে যাচ্ছে, কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না! মনের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে, কিন্তু এই সময় কিছুই মাথায় আসছে না; কোথা থেকে শুরু করব, কিছু আর বলতে পারছিনা।

        মহারানী তোমাকে আর কথা বলতে হবে না। তুমি আমার সামনে দাঁড়াও, আমি দেখি দু নয়নে ভরে। কতদিন পরে দেখা! আবার কবে হবে, কবে তোমায় দেখতে পাব!

                 কেন তুমি, এরকম কথা বলছো এখন এই শুভক্ষণে।

            না জানি কেন মহারানী আমার মনে হল, তাই বললাম।

           তুমি কি আমাকে মহারানী বলেই ডাকবে?

          তুমি তো সবার মহারানী। সবার মধ্যে আমিও তো একজন। সেই মতো তুমি তো আমারও মহারানী। কিন্তু তুমি মহারানীর সঙ্গে সঙ্গে আমার চন্দ্রিমাও বটে, যা আর কারো নও, শুধু আমার—

               মহারানীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকল ছবির মতোন, আর চন্দ্র দেখতে লাগল বসে বসে। সময় যেন এমনই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন সময় চন্দ্রিমার সেই পাওয়া টিয়াটি, যাকে চন্দ্রিমা আদরে নাম দিয়েছিল সোনা, সেই সোনা, উড়তে উড়তে রাজপ্রাসাদের বাইরে চলে আসে। মহারাজ সেই টিয়াকে ধরার জন্য পিছনে পিছনে ছোটে। সোনা এসে পরে ঠিক চন্দ্রিমার গায়ে। অমরেন্দ্রনাথ এই দৃশ্য দেখে ক্ষুবুদ্ধ হয়ে চন্দ্রকে ধরে আনতে আদেশ দেয়। প্রহরী সেই মতো চন্দ্রকে ধরে আনলে, চন্দ্রিমাও কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে ছোটে। সুনয়নাও এই দৃশ্য দেখে হতবাক। কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভদ্রমল্লও কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে অমরেন্দ্রনাথ এর আদেশের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।

               রাজকুমারী পিতার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকে। অমরেন্দ্রনাথ কিছুতেই তার মত পরিবর্তন না করাতে চন্দ্রিমা শেষ পর্যন্ত বলে ওঠ, পিতা আপনি যদি চন্দ্রের সঙ্গে কোনো কিছু করেন, তবে বুঝবেন আপনার  কন্যাও আর জীবন্ত থাকবে না। আর একটি কথা আপনাকে বলতে চাই আমি চন্দ্রকে ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না।

                অমরেন্দ্রনাথও অভিমানে কিছু আর না বলে পক্ষে চলে গেল। এদিকে সখী সুনয়না চন্দ্রিমাকে নিয়ে প্রাসাদ কক্ষে প্রবেশ করে। অমরেন্দ্রনাথ এর নির্দেশে চন্দ্রকে নিজ কক্ষে আটক রাখা হয়। প্রেমের পূর্ণতার বেশে আবার বিরহের ছায়াই ঘনিয়ে আসল। চন্দ্রিমার দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য সুনয়না মহারাজকে সখীর জন্য অনেক নিবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত মহারাজ বলে, কিন্তু সুনয়না তুমি তো জানো যে মহারানী শেষ ইচ্ছা ছিল রাজকুমারীর সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার। তার সেই ইচ্ছাটা কি আমি ভুলে যাব!

           কিন্তু মহারাজ আপনি একবার চন্দ্রিমার কথাটা ভাবুন। আপনি একবার চলুন গিয়ে নিজেই দেখে আসুন। অন্ন, জল সব ত্যাগ করে বসে আছে।

                অমরেন্দ্রনাথ সুনয়নার কথা শুনে দ্রুত কন্যার কক্ষে গিয়ে দেখে চন্দ্রিমা রাজ উদ্যানের দিকে মন খারাপ করে বসে আছে। অমরেন্দ্রনাথের কথা শুনেও কোনো উত্তর না দিয়ে একবার চেয়ে আবার উদ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখে। শেষে অমরেন্দ্রনাথ কাছে বসে কন্যার জেদ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করল কিন্তু তাতেও কোনো কথা না বলে উদ্যানের দিকেই তাকিয়ে রইল। শেষে অমরেন্দ্রনাথ বললেন, চন্দ্রিমা দেখো তুমি এখন বড় হয়েছো সব বোঝো। আর তুমি এটাও জানো যে তোমার মাতার শেষ ইচ্ছে কি ছিল। তুমি কি তোমার মাতার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করবে না? আর তুমি যার কথা ভাবছ, সেই চন্দ্র তার কোনো বংশ নেই, কোনো কূল নেই, তবে কেমন করে তার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিই। তাতে কি রাজ সম্মান থাকবে?

             পিতা তুমি তোমার রাজ সম্মান নিয়ে থাক, আমি তা চাইনা। আমি শুধু চন্দ্রকেই চাই। আর কিছু না। আর মাতার কথা বলছ, মা যদি থাকত তাহলে এই সম্পর্কটি নিশ্চয়ই মেনে নিত—

               সেসব কথা এখন থাক চন্দ্রিমা। তুমি আগে খেয়ে নাও। তোমার শরীর টার দিকে তো নজর রাখ।

          শরীরের খেয়াল করে কি করব, এই শরীরের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে!

          সুনয়নাও অনেকবার অনুরোধ করল খেতে কিন্তু কোনো ফল হল না। অমরেন্দ্রনাথ রেগে চলে গেলন। দিন দিন চন্দ্রিমার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। প্রায় মাসখানেক যাবার পরে চন্দ্রিমা অসুখে পড়ল। অমরেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত কন্যার অবস্থা দেখে নিজের জেদ ছেড়ে দিয়ে চন্দ্রকে জামাতা রূপে স্বীকার করলেন।

              


                                   ৭

   সমগ্র রাজপ্রাসাদ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। চারিদিকে একেবারে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। সমগ্র নগরী জুড়ে আনন্দের ধুম লেগে উঠল। চারিদিকে গান -বাজনা, আমোদ- প্রমোদ চলতে লাগল। বিাহের একমাস আগে থেকেই নগরজুড়ে আনন্দের ধুম পড়ল, যা বিবাহের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে শেষ হল।

      বিবাহ শেষ হবার ছয় মাসের মধ্যে অমরেন্দ্রনাথ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন কিন্তু এবার আর অসুখটা সারল না, দিন দিন বেড়েই চলল। রাজ্যের যত রাজবৈদ্য এমনকি অন্য রাজ্য থেকেও ডেকে আনা হল, কিন্তু তাতেও কোনো ফল লক্ষ্য করা গেল না। শেষে সকলেই বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিল, শুধু ছাড়ল না চন্দ্রিমা। নানারকম ঔষধ এর ব্যবস্থা করল এখান থেকে ওখান থেকে কিন্তু কোনো ফল হল না। সব চেষ্টা বিফলে ফেলে অমরেন্দ্রনাথ কন্যার হাতে রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন।

         আনন্দের পরে ঠিক এক বছরের মধ্যে সমগ্র নগরী শোকের ছায়ায় ঢলে পড়ল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলের বিষণ্ণ, আনমনা, শোকাচ্ছন্ন। রাজ্যজুড়ে শোকের হাওয়া বয়ে গেল।

         বিক্রম দেব ঠিক এই সুযোগে অমরাবতী আক্রমণের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অমরাবতীকে জয় করতে হলে এটাই সঠিক সময়। এরপর আর হয়তো সুযোগ আসবে না। নারায়ণীর সেনাপতি বীর রায় সমগ্র সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বললেন মহারাজের আদেশের অপেক্ষার জন্য।

        এদিকে বিক্রম দেবের নির্দেশে বীর রায় সৈন্য সামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অমরাবতী অভিমুখে পদযাত্রা করলেন। সমগ্র আমরাবতী রাজ্যের সীমানা ঘিরে ফেলল। এদিকে চন্দ্রিমা কিছুই জানতে পারল না যে রাজ্যে কি বিপদ ঘনিয়ে আসছে ‌।

           বিক্রম দেবের নির্দেশে বীর রায় রাত্রে শেষ প্রহরে যখন গভীর ঘুমে অমরাবতী নগরী আচ্ছন্ন, তখন হঠাৎ সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অমরাবতী নগরী তীব্র কামানের শব্দে কেঁপে ওঠল। কেউ কিছু বুঝতে না পেরে চারিদিকে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে প্রজারা। নগরে হঠাৎ শোকের মধ্যে ত্রাহী ত্রাহী ভাব জেগে ওঠে। মহারানী চন্দ্রিমা কিছু বুঝতে না পেরে সেনাপতিকে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেন। সেনারা পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিল না। ফলে যে যেখানে যেটা হাতের কাছে পেল সেটা নিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে গেল। চন্দ্রিমা প্রস্তুত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যায়। যাবার সময় চন্দ্রকে শেষবারের মতো ভালো করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, অশ্রু ভরা চোখে বলে, হয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা! বিধাতার কি যে লিখন—পিতাকে হারালাম আর না জানি কি কি হারাতে হবে! আর কি দেখা হবে আমাদের—

       চন্দ্রের চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। রাজকুমারী চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, এই শেষ বিদায় দৃশ্য তুমি আমাকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় দিও না। তোমার হাসি দেখেই আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম—এই হাসি নিয়েই যেন আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি। তোমার শেষ হাসিটুকু আজ—

          বলতে বলতে মহারানীর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর বেশি কিছু বলতে পারল না। চন্দ্রও শেষবারের মতো হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু হাসির বিনিময় অশ্রুই চোখে যেন চলে আসল।

         বিদায় দৃশ্য শেষ হতে না হতেই শোক সংবাদ নিয়ে এল দূত। অস্ত্র গুরু যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এই সংবাদে চন্দ্রিমা আর সময় নষ্ট না করে সখী ও সেনার কাছে শেষ বিদায় নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করল। এদিকে রাজপ্রাসাদের দায়িত্ব ভদ্রমল্লের হস্তে অর্পণ করে সুনয়নাকে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন রাজকুমারী।

         অমরাবতীর সৈন্য সামন্তরা তীব্র কামানের আঘাতে স্থির দাঁড়াতে পারল না কিন্তু চন্দ্রিমা একাই অশ্বপৃষ্ঠে সমস্ত সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে লাগল। চন্দ্রিমার আদর্শে সকল সেনা উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে বীর রায়ের বাহিনীর উপর পাল্টা গোলাবর্ষণ করল। এতে বীর রায় প্রচন্ড ক্ষতির সম্মুখীন হল। বীর রায় আবার গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালাতে থাকল। এদিকে মুহূর্তে মুহূর্তে রাজপ্রাসাদে যুদ্ধের বার্তা আসতে লাগল। যতই সময় গড়াতে থাকল, ততোই ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ আসতে লাগল। আর এই সংবাদ শুনেই সখী ও চন্দ্রের মন মাঝে মাঝে বিচলিত হতে লাগল। আশঙ্কায় সমস্ত রাত্রি ঘুম আর আসল না সমগ্র অমরাবতীর।

        এদিকে সোনা সেও আর থাকতে না পেরে সখীর নির্দেশ অমান্য করে চন্দ্রিমাকে সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। বীর রায়ের সেনা ছাউনির সমস্ত খবর সোনা চন্দ্রিমাকে দিতে লাগল এবং চন্দ্রিমা একের পর এক আঘাত করে চলল শত্রুপক্ষের সেনাকে। বীর রায় এতে বিচলিত হয়ে উঠল। তার পরিকল্পনা যখন একে একে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক সেই সময় হারু ব্যাধ তার মুশকিল আসান করল। শিকারী শিকারকে নাগালে পেলে কি আর ছাড়ে? যার জন্য হারু রাজ্য ছাড়া হয়েছিল হঠাৎ করে আজকে তাকে পেয়ে তীর ছোড়ে। সেই তীরে সোনা প্রাণ হারিয়ে চন্দ্রিমার পদতলে পড়ে। হারু আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

         চন্দ্রিমা এক মুহূর্তে যেন হতভম্ভ হয়ে যায়। হাতে অস্ত্র যেন হাত থেকে বারবার মাটিতে পড়ে যায়। চোখ দিয়ে যেন ঝরঝর করে অশ্রুর ফোয়ারা ছুটতে থাকে।

          মহারানী এমন অবস্থার কথা শুনে চন্দ্র, সুনয়না, ভদ্রমল্লও ছুটে আসে যুদ্ধক্ষেত্রে। চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে সোনার দেহকে কোলে তুলে নিয়ে বসে থাকে। ভদ্রমল্লও যুদ্ধ করতে করতে গোলার আঘাতে মারা যায়। এদিকে চন্দ্র যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না হলেও কিছু কিছু বিদ্যা শিখেছিল। সে সেটুকু অবলমন করেই যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা তীর এসে তাকে বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে রণভূমি লুটিয়ে পড়ে। চন্দ্রিমা ছুটে যায় সোনাকে ছেড়ে। চন্দ্রের মাথাকে নিজের কোলের উপর রেখে কেঁদেই চলে। সখী তাকে নানাভাবে প্রবোধের চেষ্টা করলেও চোখের জল যেন আর থামছে না। চন্দ্র চন্দ্রিমার এই অবস্থা দেখে শেষবারের মতো বলে, কেঁদোনা চন্দ্রিমা, হয়তো ভাগ্যে এটাই ছিল! এই পর্যন্তই সঙ্গ ছিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে, এখন আবার চোখের সামনে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠছে…. কত দ্রুত চলে গেল সেই সময়! আবার একটু থেমে, তবে কেঁদো না চন্দ্রিমা, তুমিই তো আমার একমাত্র চন্দ্রিমা। আজ এই চন্দ্র চলে গেলেও তোমাকে ম্লাল হলে চলবে না। তুমি এই রাজ্যের চন্দ্রিমা! তোমার প্রভায় যেন রাজ্য আলোকিত হয়!.... আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও চন্দ্রিমা, এই এটাই তো জীবনের শেষ ইচ্ছা!

         বলতে বলতে চন্দ্রের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। চন্দ্রিমা একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু হাসির বিনিময়ে চোখে জলই চলে এল। প্রায় শেষ প্রহরের চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

       চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ মৌন থাকল, সখী শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে লাগল। শেষে অমরাবতীর বাহিনী যখন পরাস্ত হতে শুরু করল চন্দ্রিমা তখন প্রচন্ড বিক্রমে জীবন- মরণকে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে চলল। তীব্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বেজে উঠল। রাজকুমারীর বিক্রমের কাছে কোনো সৈন্যই স্থায়ী হতে পারছিল না।

        এবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং বীর রায়ের সঙ্গে চন্দ্রিমার সংঘর্ষ বাধল। বীর রায়ের অসির আঘাতে মহারানী আহত হল। কিন্তু সেই আঘাত নিয়েই চন্দ্রিমা অমরাবতীর জন্য লড়াই করতে লাগল। শেষে বীর রায়ের মৃত্যু হল মহারানীর হাতে। এতে নারায়নী সেনারা সন্ত্রস্ত ও ভীত হয়ে পলায়ন করলেন। কিন্তু তার মধ্যে এক ধূর্ত সৈনিক ছিল, যে যাবার আগে মহারানীকে উপলক্ষ করে তিনি নিক্ষেপ করে, সেই তীরে চন্দ্রিমা লুটিয়ে পড়ে। সেই সৈন্যও রাজকুমারীর তীরে নিহত হয়। দীর্ঘ চার দিন ধরে চলা যুদ্ধে অমরাবতী যুদ্ধে জয়লাভ করলেও যুদ্ধের সবকিছু শেষ হয়ে যায়। সখীও মারা যায় যুদ্ধ করতে করতে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে।

        যুদ্ধে রাজ্যতো বাঁচল, আর কিছু থাকল না।  যুদ্ধের পর থেকে রাজ্যে হাহাকার জেগে উঠল। সমগ্র রাজ্য যেন বিষাদে ডুবে গেল। মহারানী সখী ও গুরুদেবের ভবিষ্যৎ বাণীকে সম্ভব করে নিজের জীবন দিয়ে রাজ্যকে রক্ষা করল কিন্তু নিজে নিঃশেষ হয়ে গেল!

          রাজ উদ্যানে যে ভালবাসার গল্প শুরু হয়েছিল, তার একটিও পাত্র-পাত্রী আর জীবিত নেই! রাজ উদ্যান, রাজপ্রাসাদ, এখন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে রয়েছে; আর রয়েছে শতশত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ। সেই শবগুলির মধ্যে মহারানী, মহারাজ, সুনয়না, ভদ্রমল্ল ও সোনা, সকলের দেহ এখানে ওখানে ছড়ানো রয়েছে।

        এই সংঘর্ষে বিক্রমদেবেরও অনেক ক্ষতি হয়েছিল। এরপর বিক্রমদেব যুদ্ধের আশা পরিত্যাগ করলেন।

       অমরাবতী এরপর আবার হয়তো আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু সেই ক্ষত—হয়তো জেগেই থাকবে অমরাবতীর মনের কোণে!


                              _____________


Friday, August 2, 2024

জুলাই সংখ্যা ২০২৪ || July Sonkha 2024

 



সম্পাদকীয়:


যে প্রেম নদীর বুকে আঁকিবুঁকি কাটতে শেখায়, যে প্রেম মোহনার দোলনায় আপন খেয়ালে ভাসাতে চাই, যে প্রেম গাছের পাতায় পাতায় শিহরণ তোলে, যে প্রেম তারায় তারায় লিখে দেয় এক উন্মাদনার চির ইতিহাস সেই প্রেম কোনো সমুদ্রে তীরে স্থগিত হয় না, সেই প্রেম একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে, সেই প্রেম শুধু নিরন্তর ভাসতে থাকে একটা রঙিন খেয়াতরী নিয়ে অতল সমুদ্রের ঢেউ খেলা বুকে। সেই প্রেমের রঙ গাছের পাতার মত চির সবুজ।


ভালোবাসা, ভালোলাগা এই দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে প্রতি দিন লেখালেখি চলে। ভালোবাসার অতল গভীরে ডুব দিয়ে কোনো কবির কলমে নতুন ভাবে ফুটে উঠছে না এই চিরসবুজ প্রেমের মাহাত্ম্য। সবাই রেড লাইট, ডিস্কো, বারের প্রেমে মশগুল। এই নিয়ে লেখালেখি সমাজের চোখে একদিক দিয়ে যেমন ভালো, তেমন অন্যদিকে বিপজ্জনক, তাই শুধু এই আধুনিক যুগে এসবের সাথে যদি কেউ দুকলম ঐ পুরাতন চির সবুজ প্রেম নিয়ে লেখালেখিতে মন দেন, তাহলে এক নতুন দিশার জন্ম হয়।


চিন্তা নেই এবার থেকে আমরা লেখকদের পাশে আছি, আপনারা লিখুন চির সবুজ প্রেমের রঙিন বাস্তবায়নের কাহিনী। আমাদের ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা ব্লগ আপনাকে সেই সুযোগ করে দিচ্ছে। আপনারা লিখুন , পড়ুন, সাহিত্যে মশগুল থাকুন। ওয়ার্ল্ড সাহিত্য আড্ডা আপনার পাশে আছে। ধন্যবাদ, ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা নতুন করে সুদৃঢ় হোক।


___________________________________________


সূচীপত্র : 


কবিতা - 

চিরঞ্জিত ভান্ডারী, বিজন বেপারী, আবদুস সালাম, আনন্দ গোপাল গরাই।



ইংরেজি কবিতা - 

Samir Kumar Dutta, Md Mazharul Abedin ।



গল্প - 

পার্থ প্রতিম দাস, শাশ্বত বোস।



ইংরেজি গল্প - 

Bhaskar Sinha



প্রবন্ধ - শংকর ব্রহ্ম, সামসুজ জামান, সত্যেন্দ্রনাথ পাইন।



___________________________________________________


বিঃ দ্রঃ - প্রত্যেক সাহিত্যিকদের জানো যাচ্ছে আপনারা জুলাই সংখ্যার জন্য নিজের লেখা গুলো পেতে এই মেন পেজের নীচের দিকে More post এ ক্লিক করে পাবেন, কিংবা সবার উপর ডানদিকে সার্চ অপশন এ ক্লিক করুন তারপর নিজের নাম বাংলায় কিংবা ইংরেজিতে সার্চ করুন তাহলেই

 আপনারা নিজেদের লেখা পেয়ে যাবেন।


________________________________________



No one kept promises - Bhaskar Sinha || English Story || Short Story || English short story

 No one kept promises

           Bhaskar Sinha



The night was advancing alarmingly, and Ravi's worry intensified. He stepped out onto the balcony again, surveying his surroundings. All he saw was a drenched street dog lying miserably near the gate. Beyond that, the area was deserted. Rainwater pooled in the alleys, and the lampposts stood like bare masts stripped of their sails. A gust of wind shook the mango tree in the courtyard, causing a few twigs to snap and fall. In the distance, thunder rumbled ominously. Was that a soft knock at the door? He turned around swiftly... only to be greeted by a blast of cold wind.


Ravi muttered to himself in dismay. No, it couldn't be. She couldn't deceive him now, not after he had traveled so far and settled into this unremarkable guesthouse for one last attempt. He had carefully orchestrated all his plans...


Things were markedly different nearly a quarter of a century ago. Life was filled with songs, melodramas, butterflies, and flowers. Emotions ran high, encompassing sharing, caring, and even bullying, amidst other extravagances. Sonja was the queen of that era. If their lives were a deck of cards, she would undoubtedly be the 'Queen'. Who the 'King' or 'Ace' was could be debated but being the 'Jack' wasn’t desirable then. As time passed, hearts were traded for a few glittering diamonds. To escape his troubles, Ravi found solace in a job offer from a distant land, offering him a fresh start.


Fast forward to the present, a quarter of a century later, and much has changed. Now, there are platforms like Facebook and WhatsApp. It's difficult to completely disconnect from childhood sweethearts unless one chooses to be unsocial. Who could ignore the constant notifications when online, or the flurry of friend requests? Ravi believed that perhaps only a Buddha could manage such detachment. It took only a month for him to reconnect with his school friends via WhatsApp, and soon all the old gossips were rekindled with new life. The more he tried to forget the past, the more those memories flooded his thoughts, particularly those involving Sonja. Feelings of discomfort, betrayal, nonacceptance, and being the butt of jokes resurfaced. Suddenly, he felt an overwhelming thirst.


A sudden craving for a cigarette overwhelmed Ravi. He realized he didn’t have a single one with him, as Sonja disliked smoking. The urge grew intense, driving him to put on his raincoat and step outside. Descending the stairs, he noticed the front door was left open. The small kiosk at the corner, visible from the entrance of the guesthouse, was his target. He splashed through puddles, noting the overflowing drains, reminiscent of his childhood days spent searching for small fish in similar conditions. To his disappointment, the kiosk was shuttered due to the heavy rain. The nearest department store was at least a mile away. Breathing in the scent of rain-soaked kadam flowers, a smell he loved, he couldn’t help but feel it evoked the essence of a Greek tragedy.


Lijo was someone he could share everything with- his modest pocket money, his deepest fears, and even answers during exams. Those were the days of budding hormones, surrounded by an Eden-like atmosphere. Flirting with girls was a common sport among them, with the ultimate goal being the 'trophy' of attraction. Whoever succeeded in this game was celebrated by all.


The influence of novels and movies, with their stories of uniting lovebirds, had seeped into his subconscious. One day, overwhelmed by these emotions, Ravi acted impulsively. He raced to Sonja's house on his bike. Once there, he blurted out a rehearsed speech, only to turn his bike around and head home abruptly. Did she respond? He couldn't remember. Was there a pause, hesitation, acceptance, rejection? He didn't know and never sought to find out. Why hadn't he?


Then there was the time they sat together by the old town lagoon. She questioned him about the disruptive letter he had sent. Why did he have to turn their sweet relationship bitter? His attempt to tear the letter into pieces was futile; the fragments were carried away by the evening breeze, scattering over the lagoon in search of eternal peace.


Back in their college days, they were immersed in passionate activism, shouting fiery slogans and challenging the lethargic administration, only to end up cozying up with their sweethearts in secret evening hideaways. Lacking a secluded spot to discuss their revolutionary ideas, they would ride their bikes to the terminal station to play their game of 'Baghbandi'. Then, when the police arrived, Lijo and he would rush back to the hostel, often ending up laughing about the whole ordeal.


Did they truly understand what they wanted? Were they aware of what the future held for them? Why did they make all those promises? Even if not together, why did each of them vow to shoulder the entire burden? And most importantly, why did they claim they would remain friends forever?


Today was supposed to be the day. He had planned it meticulously, hoping that both Lijo and Sonja would be present. Social media had made it possible to stay connected, even from afar. Today, they were supposed to discuss why they needed the crutches of siddhi or ganja to speak their truths. Why was their so-called sobriety just a façade? Why did the truth still lie in platonic relationships, and why wasn't there a need to glorify physical intimacy?


Standing in the rain, Ravi watched as the cesspool overflowed, leading towards the town's end lagoon. Frogs were croaking in concert, while beetles and weevils sought shelter in the guesthouse, abandoning the courtyard.


PING... PING... His phone buzzed. He glanced at the screen. A message from someone named Ayush read, "Mummy is busy with grandma for a check-up." Then came a direct message from Lijo: "Going to a senior management meeting in Spain. Sorry, hope to meet you soon!" followed by a smiley emoji.


Bah! The WhatsApp group would have to suffice for now. That was it. Period.


 

মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ - শাশ্বত বোস || Mrinal o ekti Onobohito Sine Sangbad - Saswata Bose || Short Story || prose || Story || অনুগল্প || ছোট গল্প

মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ

          শাশ্বত বোস



খুব ভোরের জেদী একগুয়েঁ ধোঁয়া আর ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্স পুঁটুলি থেকে ভেসে আসা ভ্যাপসা গন্ধের মিশেলে, ভিজে যাওয়া সংস্কৃতিশূন্য সকালটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে| গরম ভাতের ফ্যান, ডাস্টবিনে ফুলে ওঠা মাছ কিংবা সারা রাত জেগে বাজারটার এক কোনায় পরে থাকা মুটে মজুরের গায়ের তেঁতো ঘামের গন্ধ, সব কিছু মিলে মিশে গিয়ে একটানা পচা একটা গন্ধ তৈরী হয় এই সকালটার গায়ে| মশলা বাজারটা খুলতে এখনো দেরী আছে, এখন শুধু মাছের বাজারটা ঘিরে শব্দের আনাগোনা| ভারী বরফের চাঁই মাটিতে আছড়ে ভাঙার শব্দ, মুটে মজুরদের লরি থেকে মাছ খালাস করার সময় দেহাতী হিন্দি আর বাংলা মেশানো খিস্তির বলিষ্ঠ বিস্ফোরণ, স্বস্তার ঠেলাঠেলি আর মাছ বাজারে দর হাঁকাহাঁকির শব্দ| হারানিধির এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে| এই শব্দটা তার কানের কাছে শ্লেষ্মা মিশ্রিত ঘড়ঘড়ে গলায় বাজে ঘন্টির মতন| একটানা বেজে চোখের বাসি ঘুমটাকে তাড়িয়ে দেয়, অ্যালার্ম ঘড়ির আর দরকার পরে না| এখন তার তক্তপোষ ছেড়ে উঠে গিয়ে লবির গায়ে ঝুলন্ত বাল্বটা নেভানোর কথা| তারপর আস্তে আস্তে হারান কে তুলে পায়খানা বাথরুম সেরে বাজারের পথ ধরতে হবে| বাজারের মধ্যেই হোটেলটা, "বেঙ্গল লজ"| একইসাথে লজ ও ভাতের হোটেল| অবশ্য হারানিধি যখন প্রথম এখানে কাজে লেগেছিল, তখন এটা শুধু ভাতের হোটেলই ছিল| এই হোটেলটার মালিক ‘শশধর গুপ্ত’, এই এলাকার ‘গুপ্ত দা’, হারানিধির হাতের ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি, হালকা হিং ফোড়ন দিয়ে, সাথে সর্ষে দিয়ে বেগুনের ঝাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে বলেছিলেন, "কাঠ বাঙাল হয়ে ঘটি বাড়ির রান্না কি করে শিখলে হে?" বাজারের মাঝখানে সদ্য খোলা ভাতের ঝুপড়িটার খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হারানিধি উত্তর দিয়েছিল, "আজ্ঞে কত্তা,মায়ের কাছে| ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন, আমরা তিন ভাই বোন, মা এদিক ওদিক করে যা পেত, রেঁধে বেড়ে খাওয়াত| মায়ের হাতের রান্না ছিল অমৃত, ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট রাঁধত ঘটি বাড়িকে হার মানিয়ে দেবে|" আশেপাশে গাছের পাতার চাপে পৃথিবীটার সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা সময়ে শশধর তাঁকে প্রস্তাব দেয়, "আমার দোকানে কাজ করবে? উড়ে বাউনটা সেই যে দেশে গেছে আর ফেরার নাম নেই| আপাতত মাস গেলে ৩০০ টাকায় ঢোক, থাকা খাওয়া সব আমার ওখানেই, পরে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া যাবে|" সেই থেকে হারানিধি, গুপ্তদার হোটেলে নোঙ্গর ফেলল| এই এতো বছরে শিয়ালদা ব্রিজের উপর দিয়ে চলা, টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার| ট্রামের ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে| রামনিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের কত্তা হয়েছে| কয়লার উনুনের গনগনে আঁচ, ছাঁকা তেলে কড়া করে ভাজা মাছ, পুইশাঁকের চচ্চড়িতে মেশানো পাঁচফোড়ন এসব ছেড়ে হারানিধি এখন খাবার সময় খদ্দেরদের দেখভাল করে| কার কি অসুবিধা, কে কি নেবেন? কার ভাত লাগবে? কার ডাল তরকারি? কে কি মাছ নেবেন, কোন টেবিলে কত হল| গুপ্তদা বাজারটা ও ছাড়া কারুর হাতে ছাড়েন না| নেহাত পড়াশোনাটা বেশীদুর শেখেনি হারানিধি, নাহলে হয়তো হিসেবের খাতাটাও ওই দেখত| আজ থেকে তিরিশ বছর আগের রানাঘাট স্টেশনের বাইরে একটা মাটির দেওয়ালের বাড়িতে, খড়ের চালায় ভাতের হোটেল খুলে বসা বছর তেইশের তরতাজা যুবক হারানিধি, কলকাতায় এসেছিল কলোনীর বিশুদার হাত ধরে| বাজারের মাঝের জামগাছটা তখন সদ্য মাথা তুলছে| ওই গাছটাই একদিন আবছা আলো-আঁধারিতে ভেবে নিয়েছিল ভবিষ্যতে সে বনবিথীকা হবে| আজ এলাকার ছেলেপুলেরা ঢিল ছুড়ে গাছটা থেকে জাম পারে, ওর শরীর জুড়ে চামড়ায় ফাট দেখা দেয়, মুছে যায় স্মৃতির জন্মদাগ| গাছটা জুড়ে কয়েকশত কাক যত্নশীল সংশয়হীনতায়, ঘিঞ্জি বাসা বেঁধেছে নির্লজ্জ বংশবিস্তারের আশায়| রোজ বিকেলে নিয়ম করে হারানিধি ওদের মুখে ছুড়ে দেয় এঁটো ডেচকির গায়ে লেগে থাকা পীতাম্বরী ভাতের দলা| কাকগুলোর মাঝে বুক চিতিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় একটা শঙ্খচিল, ঐটাই হারানিধির বাপ| বাকিগুলো হয়তো ওরই পূর্বপুরুষ সব, জন্মান্তরে অনস্তিত্ত্বের সাজা কাটছে| বাজারের মাঝখানের পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দেওয়ালে, বাড়তি চৌকাঠে আছড়ে পরে ফেটে যাওয়া রোদটার গায়ে কান পাতলে বুঝতে পারা যায় রানাঘাটের রেফিউজি কলোনীর ‘হারানিধি দাস’ এখন বেঙ্গল লজের ভরকেন্দ্র| তাকে ঘিরে হোটেলটা ফিরে পেয়েছে এক নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা, বিরামহীন আগডুম বাগডুম এর মাঝেও তার নড়েটি যাবার উপায় নেই| তিনশ টাকার মাসিক বেতন এখন প্রায় ছয় হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে| গুপ্তদা ওর ছেলের পড়ার খরচ দেন| সেরকম কোন অভাব অভিযোগ রাখেননি এককথায়| নিন্দুকেরা কিন্তু বলে হারানিধি ‘শসাবাবুর গুপ্ত কথা’ জানে| তাই বেঙ্গল লজে তার এত খাতির| হারানিধিকে গুপ্তবাবু নিধি বলেই ডাকেন| তাই গল্পের পরবর্তী সময়ে আমরাও সেই নামটিই ব্যবহার করবো|


ঘুম থেকে উঠে পরে হারানিধি| জৈষ্ঠ্যের ঝকঝকে ভোর আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সূর্য্যের তাপ গনগনে হয়ে পোড়াবে তাবৎ ব্রম্ভান্ডকে| গরমের দিনে বাজারটাও জেগে যায় একটু তাড়াতাড়ি| তোলা ঝি টা আসে, এঁটো বাসন মাজে| বাসনের ডাঁই দেখলে রাগে গজগজ করে| নিধি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে তলায় নেমে আসে| হারানটা রান্নাঘরের মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে, রাস্তার নেড়িটার মত মুখ গুঁজে| নিধি গিয়ে তার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিয়ে আলতো করে নাড়া দেয়|

“ওঠ বাবা হারান| উঠে পর বাবা| ভোর হয়ে গেছে| চট করে ঘরদোরগুলো ঝাড়পোঁছ করে দে দিকিনি| ওই দেখ, ঝি টা উঠোনটা ঝ্যাটাচ্ছে| তোকে কতদিন বলেছি ওটার পিছু পিছু থাকতে| ও বেটির হাতটান স্বভাব আছে| ওটাকে এবারে তাড়াতে হবে কত্তাকে বলে|" 

নিদ্রাবিলাসী ভোরের প্রপঞ্চময় বিরক্তি নিয়ে একটা চোখ কোনমতে খুলে হারান বলে, "তুমি আর ঘ্যাঁচাঘ্যেচি করোনি বাপু, ও মাগীকে ছাড়ায়ে দিলে ওর কাজ গুলো কে কইরবে শুনি? এই বাজারে তুমি হোটেলি কাইজ করার ঝি পাইবে? সেই তো মুর ঘাইরে এসে পুইরবে| এক পয়সা মাইনে বাড়াইবেনি ওই কিপ্টা ঢ্যামনা বুড়া!! যেতিছে যেতিছে বুড়ার যেতিছে তুমার কি খুড়া?"

কথাটা শুনে নিধি চুপ করে যায়, গুপ্তবাবুর নিন্দা শুনে সে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, কিন্তু হারানের কথাগুলোর উপর কিছু বলতে পারেনা| বেশ কিছু বছর আগে এই বৈঠকখানা বাজারে আধপাগলের মত ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরছিল ছেলেটা| নিধি তখন সবে হোটেলের দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে, সামনের সরু রাস্তাটায় একটা ঝরঝরে টুল পেতে বসেছে| এমন সময় ছেলেটা এসে খেতে চেয়েছিল| হেঁশেলে উনুনের আঁচ নিভে গেছে ততক্ষণে| এঁটো বাসনগুলো পাহাড় হয়ে পরেছিল এক কোণে| কদাকার ডেচকির তলা হাতড়ে কিছু আধপোড়া ভাত পাওয়া গেছিল, সাথে সেই ছোলা দিয়ে কুমড়োর সব্জী, ঠাকুরটা হয়তো তুলে রেখেছিল রাতের জন্য| শীতের ধুলো আর রোদ মাখা মায়াবী আলোয় ছেলেটার মেঘের মত মুখে, সেটুকু তুলে দিয়েছিল নিধি| হাপুস হুপুস বুভুক্ষুতায় থালাটা শেষ করে রাস্তার এক কোনে ছেঁড়া চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরেছিল ছেলেটা| রাতের খাবারটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে যখন ওর মুখের কাছে ধরতে গেল নিধি, ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, "না মাগনা খাবুনি, আমায় কাজ দাও"| এর আগে দেশ থেকে ওর বয়সী একটা ছেলে ধরে নিয়ে এসেছিল নিধি| ব্যাটা মহা পেছন পাকা আর ওস্তাদ গোছের ছিল| কিছুদিন পর থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করলো| কিছু করতে বললেই হাজার বায়নাক্কা| একদিন তো নিধির মুখের ওপর ছোটবড় কথা বলে, পয়সা কড়ি বুঝে নিয়ে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো| নিধি পরে শুনেছিল ব্যাটা এই বাজারেই একটা মশলার দোকানে কাজ নিয়েছে| আসা যাওয়ার পথে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখত নিধিকে| এই ছেলেটাকে দেখে বেশ মায়া হয়েছিল নিধির| গুপ্তদা কে বলে ওকে রেখে দিয়েছিল, সেই থেকে হারান এই হোটেলেই আছে|


মুখহাত ধুয়ে, চান করে, গুরুর দেওয়া কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করে নিধি| সারা হোটেল, লজে গঙ্গার জল ছেটায়| কর্পূর আর ধুনোর গন্ধে ভুরুভূর করে লজের বাতাস| এই লজে গুপ্তবাবু যাকে তাঁকে ঘর দেননা| পরশু দিনই একটা ছেলে মেয়ে এসে ঘর চাইছিল, বলে কিনা ভাইবোন! বোন কে পাশের কলেজে এডমিশন করাতে নিয়ে এসেছে! নিধির দেখেই সন্দেহ হয়েছিল| বন্ধ ম্যানহোলের ঢাকনা সরালে যেরকম গুমোট অন্ধকার, সেরকম অন্ধকার পেরিয়ে নিধি হেঁটে এসেছে অনেকটা দিনকাল| এখানকার অন্যান্য লজে কি হয়, নিধি খুব ভালোভাবেই জানে| আর বেঙ্গল লজ বাজারের অনেকখানি ভেতরে হওয়াতে, এসব তো এখানে সুবিধে! গুপ্তদা কে ও চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল ব্যাপারখানা| গুপ্তদাও তো কম দিন হোটেল চালাচ্ছেন না এখানে! শেষমেশ গুপ্তদা ওদেরকে বলে দিলেন, "না বাপু, এখানে ঘর খালি নেইকো, তোমরা আশেপাশে দেখো"| 


রেডিওতে এখন নীতিকথা বাজে| বাজারের মুখটা থেকে একটা চলতি হাওয়া, আঁশটে গন্ধ গায়ে করে নিয়ে এসে নিধিকে মনে করায়, এবার মাছ কিনতে বেরুতে হবে| এই বেলা গফুরের কাছে গেলে তাজা মাছ পাওয়া যাবে, কাতলা-রুই-পার্শে-পমফ্রেট, লাল কানকো, চকচকে গা| বেঙ্গল লজের ভাতের হোটেলে কিন্তু অন্য পাইস হোটেলের মত রোজ ২৪ রকমের মাছ পাওয়া যায় না| নিধি বাজারের ভেতর গিয়ে পকেটের রেস্ত বুঝে, ভালো মাছ বুঝে, যা নিয়ে আসে রোজ তাই রান্না হয় হেঁশেলে| বাজার চলতি মানুষজন, কলেজ পড়ুয়া, বাজারের মুটে, কাঠের দোকানে আসা বোটকা লুঙ্গির ‘পালিশের লোক’, পুরু চামড়া, গোত্রহীন চৈত্রমাস কিংবা সলজ্জ আষাঢ়, সবাই জলহীন মেঘরোদহীন দুপুরে খিদের মুখে দুটো ভাত খেতে আসে, সাথে হয়ত মুরগীর মাংসের লাল ঝোল, ইচ্ছেমতন চেয়ে নেয় বুক, পাঁজরা কিংবা লেগপিস কিংবা হয়তো কড়া করে ভাজা পোনা মাছ সর্ষে দিয়ে, কখনও বা শুধুই মাছভাজা, ডাল, ঝুরঝুরে আলু ভাজা সাথে চাটনী, পাঁপড়| অবৈতনিক অবিনশ্বর খিদে আর দু মুঠো ভাতের কোন জাত বা কর্ম-বর্ণ-গন্ধ বিচার নেই এই হোটেলে| 


বাজারের ভেতর তিনশ বছর পুরোনো কোনো কার্নিশে ওঁৎ পেতে বসে থাকা কাকটা নেমে আসে| চোখ বোজার কৌশলে সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় মাছের কাঁটাটা, পোষা মেনিটার মুখের থেকে| এখানে অন্য হোটেলের মত বিরিয়ানী বা চিকেন চাপ, টমেটো সস দিয়ে সাঁতলানো চিকেন কষা হয় না| তবে নিয়ম করে পয়লা বৈশাখে রেয়াজী খাসির মাংস হয়, নিধি নিজে হাতে রাঁধে| যে মাংসটা ও ওর মায়ের কাছে শিখেছিল| সাথে হাওয়ায় কচ্ছপের গতিতে ধুলো কালি এসে, খরচ-না-হওয়া জীবনটার ধর আর মুণ্ডুর মাঝখান দিয়ে ফস করে উড়ে গেছিল| ওর মা হয়তো সেই রান্নাটাই শিখেছিল খুলনার কোনো এক বিরামহীন ফুরিয়ে যাওয়া নদীর গা ঘেঁষে| এই রান্না শেখার গল্পটাই নিধি করে গেছে বারবার| হয়তো সেই সুদীর্ঘ্য ও একঘেঁয়ে বাক্যরাজির আড়ালে প্রতিবার একটা প্রায় অলৌকিক আন্তরিকতা মিশে থাকে| কিন্তু সেই একই সময়ে ওকে দেখলে মনে হয় যেন, মুহূর্তটায় ও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব| নির্গুণ, নির্ঘুম একটা মুখ হয়ে আশে পাশের অপরিচিত বিবর্তনকে সাক্ষী করে, উনুন ধরিয়ে কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করতে করতে, এক মুঠো চিনি ছড়িয়ে দেয় উনুনের ভেতর| 


সকালের টিফিনটায় উড়ে ঠাকুরের সাথে হারানও হাত লাগায়| কচুরী, লাল আলুর তরকারি সাথে কড়া করে চা| এই টিফিনটা মূলত কলেজের মর্নিং শিফটের ছেলেমেয়ে কিংবা সেইসব ভেন্ডরদের জন্য, যারা মাল বয়ে এনে বাজারে ঢুকেছে গত কাল রাতে| সকাল এগারোটা নাগাদ ভাত চাপে| হারান হোটেলের বাইরেটায় একটা ভিজে ফেঁসে যাওয়া গামছা পরে, থেবড়ে বসে আলুর খোসা ছাড়ায়| উড়িয়া ঠাকুর উনুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিশাল কড়া চাপায়| উনুনের গনগনে আঁচে, কলকলে ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক| কিছুক্ষন পর থেকে সেই বাতাসে পুইঁ শাক কষার সুবাস এসে মেশে| গরম তেলে পিয়াঁজ ফোড়ন সাথে গোটা ধনে, লঙ্কা ছাড়ার গন্ধ|


পৌষের কোন হিম ধরা রাতে কুয়াশার সর সরিয়ে, মৃত্যু এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছিল, কোন পা টা আগে ফেলেছিল, এখন আর মনে পরে না নিধির| শুধু মনে আছে তখন ওর বারো বছর বয়স, বয়ঃসন্ধির সবে শুরু| ওদের রানাঘাটের ক্যাম্পের টিনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে উনুনের ধোঁয়ায় নির্দোষ বিষ শরীরে নিয়ে ওর মা রান্না করছে, পিছনে দুটো বিড়াল বসে লেজ নাড়ছে, পাশের ক্যাম্পে খালি গলায় গলা সাধছে খুকিদি, লাল শাকের রংটা কমলা দেখাচ্ছে কুয়াশা কেটে গিয়ে| এখনও কয়েকটা দিন মায়ের হাতের স্পেশাল পোনা মাছের ঝোল টা রাঁধে নিধি| কড়াই তে অল্প সর্ষের তেল দিয়ে মাছগুলোকে ভেজে নিয়ে, সেই তেলেই পিয়াজ-রসুন-টমেটো-আদাবাটা দিয়ে সমানে কষতে থাকে| খুন্তি নাড়ার সাথে সাথে, ঝুল কালির মাথা থেকে চুন সুরকি খসে পরে| কয়লার ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে নিধির| রানাঘাটের বাড়ির কাঁঠালিচাঁপা গাছটা ঢলঢলে চাঁদের পাটালি গায়ে মেখে, মৃত্যুমুখী অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ফ্যাটফ্যাটে একটা ফণা তুলে এসে দাঁড়ায় নিধির সামনে|


দুপুরের খাওয়া পর্ব মিটতে মিটতে বিকেল চারটে| এর ফাঁকে গুপ্তবাবু ফিরে যান নিজের আর্মহার্স্ট স্ট্রিট এর বাড়িতে| হারান, ঠাকুর আর বাকি ছেলেপুলে এসময়টা একটু গড়িয়ে নেয়| নিধি কিন্তু দুপুরে ঘুমায় না| দুপুরবেলাটায় বাজারটার অন্য রূপ| লোকজনের আনাগোনা কমে আসে অনেক| মশলার দোকান গুলো থেকে ঠিক দুপুর দুটো বেজে সতেরো মিনিটে অচেনা একটা গন্ধ ভেসে এসে, নিধির নাক চোখ মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে সজোরে টোকা মারে| একটা চাবুক মারা বাজারী হই হল্লা বাজারের মাঝখানের পেচ্ছাপখানার গন্ধটাকে চাপা দিতে চায়, উল্টে তাতে গুড় বাজারের তাল পাটালির চাক ভেঙে আজ্ঞাবাহী ধরণের একটা অতি আলো বা অতি শব্দের মাঝে ফ্যাকাসে হয়ে যায় চড়াই পাখিটার ঘুম| এই সমস্যা কাকেরও এই সমস্যা হোটেলের কড়ি-বরগায় বাসা বাঁধা পায়রারও| গন্ধটা নিধিকে টেনে নিয়ে যায় বাজারের উত্তর দিকে| সেখানে দোকান জুড়ে ডাঁই করে রাখা শুকনো লঙ্কা, খেজুর, কাজু কিসমিস, বাতাসার স্তুপ| শব্দহীন,ক্লান্তিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো কত মানুষ আছড়ে পরে, আবার উঠে দাঁড়ায় এই দিকে| শুঁটকির একটা পচনশীল টক গন্ধ সারা গায়ে মেখে নাক খুঁটতে খুঁটতে হেটে চলে একটি শিক্ষিত ধোপ দুরস্ত উন্মাদ| আকাশের নীল রংটা গড়িয়ে পরে তার পায়ের কাছে| জিতে যাওয়া-হেরে যাওয়া জীবনটার হিসেব কষতে কষতে আপন মনে বলে চলে, "পচে যাবে, সব একদিন পচে ফুলে যাবে| ব্যাকটেরিয়াগুলো এই দোকানটা থেকে ছড়িয়ে গিয়ে, পচা শরীরগুলো খুবলে খুবলে খাবে|" উত্তরদিকের কোনো আবর্জনা স্তুপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিধির চোখদুটো বুজে আসে| এক অদৃশ্য প্রেতাত্মা এসে যেন ভড় করে তার উপর| নিধি ছাপাখানাটার পাশ দিয়ে গলির পথ ধরে, তারপর একসময় বড় রাস্তাটা পার করে এসে ‘সার্পেনটাইন লেন’ বরাবর খুঁজতে থাকে তার ছোটবেলার ভাতঘুমটা| সেটা বুঝি তখন ডুব দিয়েছে দুপাশের উঁচু উঁচু পুরোনো দিনের কলোনিয়াল বাড়িগুলোর মাঝের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা এক চিলতে আকাশের শূন্যতায়, নিশ্চিত ক্ষুধার সাথে প্যাঁচ কষতে গিয়ে ভোকাট্টা হয়ে পরে আছে পাশের ‘হুজুরীমল লেনে’| সেটাকে অক্সি অ্যাসিটিলিনের শিখায় গলিয়ে গয়না বানিয়ে ফেলছে সাতপুরোনো কোনো স্যাঁকড়ার দল|


জগৎ সিনেমায় বেশ কিছুদিন হলো শো বন্ধ যাচ্ছে| হল মালিকের সাথে স্টাফেদের আকচাআকচি চলছে কিছু নিয়ে| নিধি আজ দেখলো হলের বাইরের দেওয়ালে বিশাল বড় একটা হোর্ডিং ঝোলাচ্ছে একদল লোক| নিজেদের ভেতর খিস্তি খামারি করছে, রিকশাওয়ালা,বাসের কন্ডাকটর,বাজারের মেছুড়ে, বিহারী মুটেদের মুখের খিস্তি| নিধি দেখেছে অতি পরিচিত এই বাজারটার শরীর জুড়ে জটিলতর সমীকরণের এই যে জাল বোনে কত শত দুপুর-বিকেলহীন মানব তরঙ্গ, তাদের মুখের নিতান্ত বর্জিত অপশব্দই বলে দিতে পারে তাদের আবাস, জনপদ কিংবা কতটা ইতর অনুষঙ্গে এই দৈনিক উৎসবমুখরতার মানচিত্রে তাদের আগমন| এই চত্ত্বরে কেউ হয়তো মশলা নিয়ে এসেছে, কেউবা ত্রিপল পট্টি থেকে মাল নিয়ে গিয়ে লোকালে ব্যবসা করবে, কেউ বা এসেছে একুয়ারিয়ামের মাছ বা পাথর নিতে, আবার দু পয়সা লাভের আশায় কেউ ক্যানিং লাইন থেকে ঝুড়ি করে ফল নিয়ে এসে বসে পরেছে বাজারের বাইরেটায়| চিহ্নহারা কর্মব্যস্ত শিয়ালদহ, বাস-ট্রাম, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্টের সাউন্ডস্কেপের সাথে লোকগুলোর থেকে ভেসে আসা শব্দের টাকডুমাডুমের মাঝে পরে, এক জটিল বর্গক্ষেত্রের কোণ বরাবর বাহকহীন পালকিতে বসে দোল খেতে থাকে নিধি|

"হালায় লুঙ্গী তুইলা তর পোদ মারে নাই?", কথাটায় সম্বিৎ ফেরে নিধির| শব্দের অনুপ্রাণনে উপর দিকে তাকিয়ে দেখে, বাঁশের ভাড়ার মাথা থেকে একটা ছেলে, খৈনি-গুটখা খাওয়া কালো দাঁত বের করে হাসছে আর তলায় ওর বয়সী আরেকটা ছেলেকে কি যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে| আশেপাশের জিজীবিষু জগৎটার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এরা| বিশাল পোস্টারটার দিকে হিম হিম চোখে চেয়ে থাকে নিধি| এটা কোনো সিনেমার পোস্টার নয়| বাংলা যেটুকু পড়তে পারে তাই দিয়ে লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে| পোস্টার টার এক পাশে একটা কাঁচাপাকা চুলের লোককে দেখে চেনা চেনা ঠেকে ওর| পোস্টারটার ডান পাশে কিসের যেন একটা লিস্ট, তাতে কিছু নাম| এর মধ্যে কয়েকটা নাম আগে শুনেছে নিধি| এগুলো সিনেমার নাম, ‘খারিজ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’| ছেলেটার মুখে যেন খিস্তির ফোয়ারা| এটাই যেন ওর কাছে এখন জলভাতের মতন|শব্দগুলো বড্ডো কানে বাজতে থাকে নিধির| তলায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিধি এবার জিজ্ঞেস করে, "ও ভাই শুনছ? এদিকে শুন|"

নিধিকে দেখে ছেলেটা মুখের হাসি থামিয়ে এগিয়ে আসে,"বলেন!" 

"এইডা কি ব্যাপার কইতে পারো?" 

ছেলেটার চোখে মুখে একটা অকিঞ্চিৎকর বিরক্তি খেলে যায়,"দূর বাল, এইসব হইলো বড়োলোকগুলার ধ্যাশডামো, ওই দাদুর বুইঝলেন শত বৎসর পূর্ণ হইলো. হালায় সেঞ্চুরি মারসে| ফিলিম বানাইতো, তাকে লইয়া নাচন কোঁদন হইবো| বুইড়া ফিলিম বানাইয়া কি ছিড়সে কেডা জানে! আমাগো কনো কামে আইসে বুড়া? কইতে পারেন?" 

নিধির চোখে একটা ভুতুড়ে স্বপ্নের ঝিম ধরা ঘোর লেগে আসে| ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে নামটা পরে নিধি, ‘মৃণাল সেন’| নিধির চোখের সামনে কালো জানালাটার ওপার থেকে একটা মুখ ভেসে ওঠে, ধরহীন একটা মুখ| হালকা ফুঁ দিলে উপর থেকে ধুলোবালি সরে গিয়ে মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে| রাঙামাইমার মুখ, পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যাবাদীকে একপাশে রেখে কোনো এক অন্ধকার বিকেলে তিনি নিধিকে ডাক দিচ্ছেন, "নিধু, অ নিধু, টিভিতে সিনেমা দেখাইতেসে, দেখবা না? তর লগে মুড়ি ভাইজ্যা রাখসি, আইস চাঁদ আমার|" মা মারা যাবার পর নিধি ছোট ভাই বোনদের নিয়ে কল্যাণী সীমান্তের মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিল| মামা ওদের খুব একটা দেখতে পারতেন না| অথচ নিঃসন্তান রাঙা মাইমা বুক দিয়ে আগলাতেন, খালি বলতেন “নিধু মোর প্যাটের ছাওয়াল আছিল গত জনমে| জনম জনম ফিরিয়া আইস চাঁদ এই অভাগীর কোলে|" 

চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে নিধির| পাতলা মধুর মত টলটলে বিকেলগুলোয় কানা ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের চায়ের কাপের উপর দিয়ে পিঁপড়েটা এদিক হয়ে ওদিকে চলে যেত| পাশের কারশেড থেকে একটা মালগাড়ি চলে যেত, অনেক্ষন ধরে দীর্ঘ্য একঘেঁয়ে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে| ঐ শব্দটার পর রোদের তাঁত পরে গেলে ফিরে আসতো অনিবার্য্য রোববারের বিকেল গুলো, মস্ত একটা সোনার ডিমের ভেতর দিয়ে| টিভির পর্দা জুড়ে তখন কেবল ধোঁয়া| উনুনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, উঠতি ছেলের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া, শ্মশানের চিতার ধোঁয়া| সেই দুকূল ছাপানো ধোঁয়ার মাঝে পুরোনো লেপ কম্বলের উপর সাবানগুঁড়োর মত ধামসে পরে থাকে নিধির অন্ধকার কৈশোর| কুয়াশা খিমচে হঠাৎ সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঁকি দেয় ওদের কলোনীর গদাই দা, অল্প বয়সে যে নকশাল হয়ে গেছিল| ওকে খুঁজতে একদিন পুলিশ এলো, কলোনী টা ঘিরে ফেললো চতুর্দিক দিয়ে| প্রচন্ড জোরে একটা শব্দ, জংধরা একটা স্লোগান, আবার শব্দ| ব্যাস, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে একটা সংবেদনশীল আলো গড়িয়ে পরে নিধির চোখদুটো সাদা হয়ে গেল|  


সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর কালীমন্দিরটায় ফলাহারিণী উৎসব| সন্ধ্যে থেকেই শ্যামাসংগীত বাজছে| এবেলা তাই হোটেলও বন্ধ| হারান ব্যাটা কোথায় বসে গ্যাঁজা টানছে| নিধি মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকে জগৎ সিনেমার দিকে হাঁটতে শুরু করলো| দোকান পাট একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করেছে সবে| সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিধি সোজা জিজ্ঞেস করলো, “ইভনিং শো এর একটা টিকেট হবে?”

”আরে টিকিট লাগবে না, এটা সরকারী শো| ‘মৃণাল সেন রেট্রোস্পেক্টিভ’|” 

কথাটার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝলোনা নিধি| ফ্রীতে সিনেমা! এও আবার হয়! চুপচাপ ঢুকে অন্ধকার হলে বসে পড়লো একটা চেয়ার দখল করে| হলে সর্বসাকুল্যে পাঁচটা লোকও নেই| অনেকদিন হল টা বন্ধ হয়ে পরে আছে, সিটগুলো ধুলো পরে গিয়েছে| ফাঁকা হলের সুবিধে নিতে ছেলে মেয়ে সব হলে ঢুকে কোনের সিটগুলো দখল করে নিয়েছে| এরই মধ্যে পর্দায় সিনেমা চলছে, “খারিজ”| সিনেমাটা নিধি দেখেছিল বহু বছর আগে| নিধির তখন কাঁচা বয়স| শেষ বিকেলের অতি বেগুনী রশ্মি তখন স্পর্শ করেনি ওদের ক্যাম্পের ভেতর চৌকির তলায় উপুড় করে রাখা কাঁসার বাসনগুলোকে| ছবিটাকে তখন খুব সহজ লাগেনি নিধির| দূরদর্শনের পর্দায় সেদিনও ‘পালান’ মরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোন এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটর বিহীন মৃত্যুকূপে, একটু উষ্ণতার আশায়| পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরে, পালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য| মৃত্যুর আগের যে ব্যাথা ও বিষন্নতা, সেটা ওরা টের পায়না ঠিক করে| বড় অসাবধানী মৃত্যু| ৩০ ফুটের পর্দা জুড়ে পালান পুড়ছে, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে গোটা হলটা| সেই নামগোত্রহীন ধোঁয়াটা কুণ্ডলী পাকিয়ে এই দমবন্ধ কালো ঘরটায় কাঁদতে থাকে, পালানের বাপের মুখ হয়ে| মৃত্যুর কম্পাঙ্ক ক্রমে স্থির হয়ে এলেও মৃত্যুবোধটা আত্মগোপন করতে পারে না কোন ভাবে| বেঙ্গল লজের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় নিধির, কিংবা আরো আগের কথা, যখন ও বাজারের ভিতর দোতলা ভাঙা বাড়িটার এক কোণে পরে থেকে রাত কাটাত| কালাচ সাপের মত ঘুমহীন শীতের কোন রাতে বিহারী মুটে দুটো, মৃত্যুমুখী অন্ধকারটাকে গায়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে| এক ধাক্কায় ওদের ছিটকে ফেলে দিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও| মুহূর্তে শহরটার সব জাদুগরী উধাও হয়ে গিয়ে, নিধি ফিরে গেছিল রানাঘাট ক্যাম্পের ভিটেমাটি ফেলে আসা পোড়া লেগে যাওয়া জীবনে| গলাটেপা মধ্যরাতে বাজারের অলি গলি ঘুরে, হার ভাঙা শীতটাকে সঙ্গে করে মুখোশহীন পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল খোলা আকাশের নিচে নীল রং ধার করে| 

রাত নটায় শো শেষ হল| পুরো হল জুড়ে তখন শুধু নিধি আর তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধের শত বসন্ত পার করা একটি মানুষ ও তাঁর সৃষ্টি করা সার্বভৌম জীবন চেতনা| গত দেড় ঘন্টা ধরে যিনি চির বিচ্ছেদের দাঁড়ে নিধি কে টেনে নিয়ে গিয়ে, ওর জীবনের আকাঙ্খাকে আরো তীব্রতর করে তুলেছেন| নিধি এখন আরো তীব্র ভাবে বাঁচতে চায়, ওর বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে| ঠিক এমনি ভাবে বাঁচতে নিধি শেষ কবে চেয়েছিল?

হল থেকে বেরিয়ে নিধি হোটেলে ফেরে না| আজ রাতটা এমনিতেও ঘুম হবে না| একটু পর বাজারের ভেতর মন্দিরের কীর্তন বন্ধ হয়ে হিন্দি গান চালিয়ে মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ শুরু হবে| কখন থামবে কে জানে! অনেক রাতে ফিরে আসবে নিধি ওর চেনা জগতে| বাজার থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলো দৌড় দেবে, খেলার মাঠের গোলহীন স্টপারের মত| হোটেলের হেঁশেল জুড়ে এঁটো নিয়ে লোফালুফির প্র্যাক্টিস শুরু করে দেবে| নির্বাক দর্শক হয়ে সেই খেলা দেখবে নিধি| মনের ভেতর তপতপে একটা সেন্টিমেন্টাল মনস্তাপে, আরো ভালো দর্শক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেবে|

কাল সারারাত ধরে নিধি ভেবেছে গুপ্তদাকে বলে জগৎ সিনেমায় যদি সবকটা বই ও দেখতে পেত! পয়সা তো লাগছে না| কিন্তু কি ভীষণ একটা উত্তেজনা! যেন খামখেয়ালী মধু তামস, সংস্কারহীন যজ্ঞ চালাচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে| সেই যজ্ঞের আগুনে ওর পুড়তে ইচ্ছে করে ভীষণ| ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে| অস্বাভাবিক খিদেতে পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে| মনে হয় গায়ে চাপানো ধার করা চামড়াটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে, লালচে মাংসটাকে প্রত্যক্ষ করে| আবার একটা শব্দ হোক, হাজার মানুষের সমবেত কোরাস হয়ে সেটা রক্তারক্তি একটা কান্ড ঘটাক| ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, সব কটা সিনেমা নিধি দেখতে চায়| ওর নিশ্চল জীবনে গলগল করে প্রাণ ফিরে আসে যেন| সন্ধ্যের পরে ওর তো আর তেমন কাজ থাকে না হোটেলে, গুপ্তদা কেন ওকে ছুটি দেবেননা কদিন হাফবেলা করে! ইনসমনিয়ার রূপ ধরে এই কথাটা বার বার নৈতিকতা আর হকের সমকালীন সংঘাত হয়ে বাজারের চার দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে| জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি| ওর কণ্ঠ সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে ওর মুখে মলত্যাগ করতে করতে উড়ে গেছে সংক্রান্তির দিকে|


মেয়েটা পাশের কলেজে পড়ে| রোজ সকাল-দুপুর বেঙ্গল লজে খেতে আসে| নিধিকে ‘কাকা’ বলে| মেয়েটা খেতে এলে আবদার করে এটা সেটা| মাছের মুড়ো খাওয়ার খুব শখ মেয়েটার| একটু বড় মাছ আনলে মুড়োটা টিফিন বক্সে ভরে দেয় নিধি| মেয়েটাকে দেখে মা মরা ভাইঝিটার কথা মনে পরে নিধির, কলেরায় অকালে চলে না গেলে আজ এই বয়সেরই হত| মেয়েটার বাড়ি মছলন্দপুরে| কলকাতার কলেজে পড়বে বলে বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে এসেছে| ঠিক যেমন একদিন নিধি এসেছিল এই মায়ার শহরটায় ওর বেড়া টপকানো ইতিহাসটাকে একটা এলেবেলে ধূলিকণা দিয়ে ঢেকে ফেলে| নিধি নিজে ইস্কুলের গন্ডি পেরোয়নি হয়তো, কিন্তু পড়াশুনার বেশ কদর করে| কলেজের দিকে যেতে গিয়ে যে প্রকান্ড পুরোনো দিনের বাড়িটা, দুধারে দুটো পেল্লাই প্রাগৈতিহাসিক থামে ভর দিয়ে পার করে দিল কাগের ডিম বগের ডিম কত গ্রীষ্মকালীন সৌরঝড়, সেটা ইদানিং লেডিস পিজি হয়েছে| মেয়েটা ওখানেই থাকে| সারাদিন কলেজের পর রোজ সন্ধ্যেবেলা মেয়েটা টিউশন পড়াতে যায় রাজাবাজার, বেলেঘাটা| নিধিকে একদিন বলছিল, "ঘরে ঠিক কইরা চাল চড়ে না কাকু, বাপডা আমাগো ছাড়ি অন্য মাইয়ার লগে পলাইসে তা প্রায় এগারো বস্যর হইলো, বাকি ভাই বোনগুলা তখন খুবই ছোট আসিল| পড়ার খরচডা নিজেরেই চালাইতে হয়|" কাল রাতে মেয়েটা খেতে আসেনি, আজ সকালেও না| আজ দুপুরে শরীর-টরীর খারাপ নাকি জিজ্ঞেস করায় ওর বন্ধুটা বললো কাল রাতে নাকি পিজিতেও ফেরেনি মেয়েটা| ফোন করলে ধরছেও না| একটা মন খারাপের দুশ্চিন্তা সন্ধ্যা কিংবা মাঝরাতের হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসলো নিধির নশ্বর জীবনে| এর আগে কারো জন্য এতো ভাবনা হয়নি ওর| মেয়েটা হয়তো ওর কেউ না, আবার এই শহরটার সাথেও কোন আত্মীয়তা নেই মেয়েটার| এই শহরের রাতের আলোগুলোর বুকে গজিয়ে ওঠা অনভিপ্রেত মাংসপিন্ডের মত মেয়েটার অবস্থান| হয়তবা ওর হারিয়ে যাবার খবর, পিঠে ডানা লাগিয়ে উড়তে গিয়ে চাপা পরে যাবে, গায়ে ফোস্কা পরা আলোর কোলাহলের মাঝখানে| এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কে ওর খবর নেবে? নিধি কি একবার মুচিপাড়া থানায় যাবে? কি উত্তর দেবে যখন পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা ওর কে হয়? বাঙাল কথায় একটা প্রবাদ আছে, "আলায় বুলায় না, আমি কার মাউসা?" ভয়ানক একটা রাগ পায় নিধির| মনে হয় এই বিষণ্ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকেন্দ্রিক শহরটার মুখে গরম তেল ছুঁড়ে মারে| কিন্তু রাগটা কেন হয় ওর? প্রতিদিন এরকম কতশত মেয়েরা নিয়ম করে হারিয়ে যায়, এই শহরের পেটের ভেতর গজিয়ে ওঠা অর্ধেক আলো আর অর্ধেক অন্ধকারের ছায়াপথে| তাদের কজনকে পুলিশ খুঁজে বার করতে পারে? নচ্ছার হারানটা শুনে বলে "বুড়ো, তোমার ভীমরতি হইসে, ওই মেইয়ে কে লাগে তোমার? হাওয়ার খবর রাইখো বুড়ো? কলেজির ভিতর নেতা মন্ত্রীর ছেলেরা আইসে টপ মাগীদের লিয়ে ফুর্তি কইরে যায়| রাতেও নাকি কলেজির কমন রুম খুলি রেখি দেয় দারোয়ানডা| দেইখগে যাও এ মাগীও লাইনে নামিসে, পুলিশে ধরিসে নয়তো যমডায় ধরিসে|" হারানের হলদে দাঁতের নির্লজ্জ হাসিতে কাঠফাঁটা দুপুরে সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যায় নিধির| সজোরে এক থাবড়া কষিয়ে দেয় হারানের গালে, "মুখ সামলে কথা কইস ছ্যারা, মাইয়াদের লগে কিকইরা কথা কইতে হয় জানস না?" 

"হ্যা তুমার মাইয়াডা তো সতী লক্ষ্মী ছিল| বুড়ো তুমি বইলা কিছু বুইল্লাম না অন্য কেউ হুইলে না!"

অসংবৃত মেজাজটা লাগাম ছাড়িয়ে দেশের ভাষা মুখ দিয়ে বার করে এনেছে নিধির| কিন্তু এই অনাম্নী অঙ্গনা কৃষ্ণবেনীর জন্য কেন এত রাগ আসছে নিধির? উত্তর ওর নিজের কাছেই নেই| হয়তো অনেক দিনের জমানো অনেক না বলা ক্রোধ-হিংসা-স্বার্থপরতা জমা হয়েছিল| জীবনের আলো অন্ধকার হাতড়ানো দৌড়টা শেষ করার আগে, দশমীর বিকেলে কাঁটাতার ছিঁড়ে ওর সমগ্র জাগতিক অনুভূতিগুলোকে পিছনে ফেলে উঠে আসতে চাইছে একটা উগ্র স্ফুলিঙ্গ|


বর্ষার শুরুতে বাজারটার গায়ের কাপড় ভিজে যায় ফুটো অ্যাসবেস্টসের জলে| প্রৌঢ়ার শরীরের বাড়তি মেদের মত বাজারটার ভেতর ফুটে ওঠে বেশ কিছু আঁশটে অনুষঙ্গ| ভোরের অন্ধকার চিরে হ্যালোজেন বাল্বগুলো থরে থরে সাজানো ইলিশের রুপোলী আঁশে ধাক্কা খেয়ে, আলো করে চারিদিক| শুটকির গন্ধটা এখন হোটেলে বসেই দিব্যি টের পাওয়া যায়, পেচ্ছাপখানার গন্ধটাও আরো তীব্র হয়| মশলার গন্ধটা আরো মিশে মিশে যায়| জামগাছটার শরীরে প্যারাসাইট এর মত ছাতা ফেলা কাকগুলো হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে শুরু করে দেয় ঠুমরী-টপ্পার ধ্রুপদী কলহ| সেদিন নিধি রোজকার মতন দুপুরের খাবারের তোড়জোড় করছে| হারানটা কদিনের জন্য বেপাত্তা ছিল, আজ হঠাৎ এসে হাজির, সাথে বছর ষোলোর একটা মেয়ে| শ্যামলা গড়ন, পানপাতার মত মুখ, তাতে টানা টানা ডিঙি নৌকার মত দুটো চোখ, নিটোল স্তন, উদ্যাপী নিতম্ব| মেয়েটাকে এক ঝলক দেখে নিধির পোকায় কাটা ফুটিফাটা সাদা পাতার মত জীবনের আগু পিছু তিরিশটা বছর চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে| হারান বলে, "খুড়া বিয়া কইরা আইলাম দিশ থিকা|" হারান হাত বাড়িয়ে নিধির পা ছোয়, ইশারায় কাজল চোখের মেয়েটিকেও নিধির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে| নিধির হাতদুটো উপরের দিকে উঠে থমকে যায়|

"আজ লাল লাল করি মাগুর এর রসা রাইন্ধ খুড়া, সাথে সর্ষির তেল ছড়ায়ে আলু পোস্ত| আর খুড়া আমাদের থাইকবার ব্যাপারখানা তোমারে ম্যানেজ দিতি হবে| নতুন বৌ, বুঝই তো! এই কয়টা টাকায় কোথায় নিয়া তুলবো? লজের দ্বিতলে যে স্টোরখান খালি পইরা আসে, ঐখানেই থাইকবে লাহয়, কি কও?" ফুলকির মত হারানের কথার তোরে ভেসে যেতে থাকে নিধি, "ছ্যাড়া কয় কি? গুপ্তরে ম্যানেজ দিবে এই হারানিধি দাস? বুইড়া এককে নম্বরের কনজুস| ঘরখান স্টোর কইরা রাখসে, সিজনে কম পয়সায় ভাড়া দেওনের লগে| আর এ আপদ কয় কিনা ওই ঘরডাতে মাইয়া লইয়া থাকব!!" মনে মনে কথার জাল বোনে নিধি, সংখ্যাহীন চোখদুটো দিয়ে আপনমনে জ্যামিতিক অংক কষতে থাকে| মেয়েটার উপর মায়া লাগে তার| ইশারায় মেয়েটাকে ওর পিছু পিছু আসতে বলে, হোটেলের ভেতর ঢুকে নিধি তাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে| স্টোর টা খুলতে বলে সামনে পরে থাকা নোংরা তক্তপোশটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, "মা, এইখানে একটু বস, আমি দেখি ঘরখানা একটু সাফা করাই|" মনে মনে ভাবে "গেলো জনমে তুই আমার কেডা আছিলি রে? তোরে দেইখ্যা এতো মায়া লাগে ক্যান?" দূর থেকে ঠাকুর চাকর ঝি সব হাঁ করে দেখছিল ওদের| এর মধ্যে বাজার থেকে কেঁদো একখানা মাগুর কিনে নিয়ে এসেছে হারান| মুহূর্তে খবরটা আশেপাশের দোকান ছুঁয়ে বাজারের ঘিঞ্জি গলিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, মহাত্মা গান্ধী রোড আর বি বি গাঙ্গুলী স্ট্রিট এর ক্রসিং এ এসে থমকে দাঁড়াল| শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে স্বস্তার ছাপা শাড়ীতে করে নবদম্পতির সাথে যে হাওয়াটা হোটেল অবধি এসেছিল সেটার কাঁধে করে গিয়েই উঠলো এবার ‘শসাবাবু’র কানে| নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার পায়ের ধুলো পড়লো বেঙ্গল লজে| অন্যান্য লোকের উপর বেশ একটু চোটপাট করে উপরে উঠে গেলেন তিনি, কিছুক্ষন পর টিউবেলাইটের ফ্যাকাসে আলোতে, উপরে ডাক পড়লো হারানিধি আর হারানের| 

"এসব কি শুনছি রে হারামজাদা, মেয়েছেলে নিয়ে ঢুকেছিস লজে? এতো সাহস তোর!! নিধির ছায়ায় নিজেকে কি মহারাজা ভাবছো বাঞ্চোৎ?" আচমকা গুপ্তদার মুখে খিস্তি শুনে চমকে ওঠে নিধি, চোখ কুঁচকে তাকায়, আজ ত্রিশ বছরে এই প্রথমবার| এতদিনে হয়তো লোকটা বাজারটার উপযুক্ত রোজগেরে হল| 

"কত্তা হারান টা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে| কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবেনা| মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না| দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে| হারানটার মত ওকেও খাওয়া পরা দেবেন| মাইনে লাগবে না" 

"আমি কি ধর্মশালা খুলেছি হারানিধি? যাকে পারবে এনে ঢোকাবে একেনে? ওরা যে বিয়ে করেছে কে সাক্ষী আছে? তোমার কথায় এই রাস্কেলটাকে কাজে রেখেছিলাম, সে কাম-কাজ যাই করুক, আমি কোনোদিন কিছু বলিনিকো, আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে| তোমার লজ্জা করছে না ওটার হয়ে দালালি করতে? না না এখানে জায়গা হবে নেকো| অত দরদ থাকলে ওই বাজারের দোতলার ঘরে রাখগে যাও গে| আমার ও ঘর সিজনের জন্য রাখা|" 

গুপ্তদার কথায় পুঁজময় অন্ধকার দেখে নিধি, তার চোয়াল তখন শক্ত| হারানটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে| 

"না কত্তা ওরা ঐখানে যাইবে না|", নিধির গলায় ক্রমান্বয়ী রেণুঝড় খেলে যায়| 

"এতো দরদ যখন নিজে বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাখগে যাওনা বাপু, তোমার আদরের ধোন আর তার বৌকে| আর সাথে তুমিও বিদেয় হওনা কেন? আমার লজে এসব ছোটলোকি আমি বরদাস্ত করবো না|" 

"হ কত্তা তাই হইবো| রাস্তার কুত্তার তো আর ঘর হয়না| দেইখ্যা লইবেন, ওই মাইয়ারে আমি রাস্তায় ফেলাইয়া রাখুম না| আসি কত্তা ভালো থাইকবেন| বহুকাল আপনের নুন খাইসি, আপনের ব্যবসাডার বারোটা বাজামু না নিশ্চিন্তে থাইক্কেন| না হইলে এই হারানিধি দাস এই বেঙ্গল লজের অনেক গুপ্ত কথাই জানে|" একটি ঠান্ডা পিস্তলসম নির্জনতা তখন ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে ঘরটার সিলিং জুড়ে তারই মাঝে নিধি শুনতে পায় আশেপাশের বাড়িতে দূরদর্শনে সিনেমা হচ্ছে| ধীরগতির ইন্টারনেটের মত শব্দগুলো ওদের ওর মগজে ঢিল ছোঁড়ে, আকাশ থেকে একটা দুর্বল তীর এসে ওর পায়ের সামনে পরে| তিরটির রং নীলই থাকবে যতদিন না ওটার অন্য কোন রং কেউ খুঁজে পায়|


বর্ষাটা এখন আরো অনেক গাঢ় হয়েছে| ভিজে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে ওর সব সুখ দুঃখ| চৌকো করে মেঘ জমে বাজারটার উপর| ‘বাজারের উপর এক্ষুনি ভেঙে পড়বে’ এরকম অবস্থার দোতলার কার্ণিশটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে থাকা অশথ্বর চারাটা, একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার শপথ নেয়| তারপর হয়তো সেটা একদিন বাড়িটাকেই ফেলে দেবে| শিয়ালদাহ স্টেশনের চার নম্বর গেটের কাছে ভাতের ঝুপড়ি খুলেছে নিধি, চাইলে বেঙ্গল লজের উল্টোদিকের বাজার চত্ত্বরেও খুলতে পারতো| এই বাজারে ওটাই নিধির আঁতুরঘর| কিন্তু বেইমানি নিধির ধাতে নেই| এখানে প্রত্যেকদিন আশেপাশের বিহারী দোকানদার গুলোর সাথে বেঞ্চি পাতা নিয়ে ঝামেলা লাগে, নিধি ঠান্ডা মাথায় সবটুকু সামলায়| রোজ সকালে হারানের বৌটা গামছা উপুড় করে ভাতের ফ্যান গালে, সেই ফ্যান পিটুলিগোলা রাস্তাটার উপর ইচ্ছেমত ছড়িয়ে গিয়ে অক্ষরলিপি আঁকে, ঊর্ণ জালের যাযাবরী চরিত্র অববাহিকায়| বিহারী ছোকরাগুলো প্রথম দিকে কটু নজর দিয়েছিল, মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত| সবসময় নিধি পেছনে বটগাছের মত দাঁড়িয়েছে| কোমরে গামছা বেঁধে হারানিধি বড় কড়াইয়ে তেল ঢালে, পিঁয়াজ-রসুন-আদা ফোড়ন দিয়ে কষতে থাকে| কষে-কষার গন্ধে পথচলতি মানুষের আতশী অষ্টপ্রহর কাটে শ্রীহীন বিরিঞ্চি নগরযাপনে| হারান উবু হয়ে বসে কয়লা ভাঙে| ওরা তিনজন এখন সার্পেন্টাইন লেনের পুরোনো একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে| বাড়িটায় সব ভদ্রলোকদের বাস, বলে কয়ে স্বস্তায় সিঁড়ির নিচে পুরোনো একটা ঘর ভাড়ায় পেয়েছে নিধি| আর যাই হোক এখানে মেয়েটার উপর আর কোন শকুনছায়া পরবে না| এখান থেকে ওকে আর যোগাযোগের অজানা ক্রসিংএ হারিয়ে যেতে হবে না| আসা যাওয়ার পথে একান্নবর্তী দৃষ্টিতে রাস্তার ওপারের বাজারটাকে দেখে নিধি| দেখতে দেখতে ওর প্রতিটা রন্ধ্রে ঈশ্বর প্রকট হয়ে ওঠেন| বর্ষার নিষিদ্ধ বারবেলাটায় যোগনিদ্রার শীর্ষে উঠে, ওরা স্বপ্ন দেখে মহাজাগতিক দর্শনে ওদের হোটেল বেঙ্গল লজ হয়ে উঠেছে| বেঙ্গল লজে গ্যাসে রান্না হচ্ছে| তৎপুরুষ খুন্তি নাদে, বিবস্ত্র বেগুনের নাগরিকত্ত্বকে মেনে নিয়ে রান্নাঘরদুটো মিশে গিয়ে, ক্রমশঃ একটা উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠছে| 

জামগাছের কোটর থেকে শ্রমিক মৌমাছিটা এদিক ওদিক উড়ে যায়| সামনের শীতে গাছটার নিচে লজের মিনি বেড়ালটা পোয়াতি হবে| বাজারটা কাকে ভালোবাসবে আর কাকে অবহেলা ছুঁড়ে দেবে এই ভেবে চুপ করে থাকে|

আস্থা যখন ভাঙে - পার্থ প্রতিম দাস || Astha jokhon Vange - Partha pratim das || Short Story || prose || Story || অনুগল্প || ছোট গল্প

 আস্থা যখন ভাঙে 

     পার্থ প্রতিম দাস 




 রুক্ষ লাল মাটির দেশ হলো সতেড়গড়। আশে পাশের ছয়টি ছোটো ছোটো গ্রাম নিয়ে এই সতেড়গড় গঠিত। এই সতেড়গড়ের মধ্যে সামন্ত পরিবারের নাম ডাক সবচে বেশী। বীর সামন্তের এখন তার পাঁচ ছেলে আনন্দ, বলরাম, শ্রীদেব, অর্ণব ও ধনঞ্জয় বিয়ে করে আলাদা আছে। তবে বীর সামন্তের স্ত্রী অলকাসুন্দরী এখনও বেঁচে আছে। 

     তাদের পুরাতন ঐতিহ্যের মধ্যে পাথর বাঁধানো ঘাট আর তার পাশের প্রকান্ড বকুল গাছ। বিরাট খামারটা শূন্য পড়ে আছে। বসন্ত পূর্ণিমার দুদিন আগে। ফুটফুটে জোছনা উঠেছে। বলরাম অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে দেখে বকুল গাছ থেকে একটা সাদা জামা পরা লম্বা লোক মাটিতে নেমে ঘাটে পা ধুয়ে আবার গাছে উঠে মিলিয়ে গেল। 

     বলরাম সকালে উঠে ভয়ে ভয়ে অলকাসুন্দরীকে সবটা বলল। অলকাসুন্দরী সবটা শুনে বলল, "এতো ঘোর অমঙ্গলকর কথা। বাড়িতে অমঙ্গল দেখা দিলে এভাবে মহাপুরুষ বের হয়।"

     তখন সবাই বলল, "তাহলে উপায় কি?"

      অলকাসুন্দরী বলল, "পুজো করতে হবে ওই বকুল তলায়।"

      কথা শুনে আনন্দ বকুল তলা পাকা দিয়ে বাঁধিয়ে দিল। অর্ণব রেলে চাকরী করে, তাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাইরে থাকে। তাকেও ডাক পাঠালো। 

      বসন্ত পূর্ণিমার দিন সকাল থেকে বিরাট আয়োজন করে পুজো আরম্ভ হয়ে গেছে। সমস্ত সতেড়গড়কে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে।সমস্ত কিছু শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। আর সন্ধ্যা থেকে তুমুল ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। 

      মাঝ রাতের দিকে ঝড়ের হাওয়া সহ্য করতে না পেরে বকুল গাছটা ভেঙে পড়লো। সবাই সকালের অপেক্ষায় আছে। 

      ভোর থেকে শুরু হয়ে গেলো বকুল গাছের ভাগ নিয়ে পাঁচ ভাইর মধ্যে ভীষন ঝগড়া। অলকাসুন্দরী ঘাট থেকে বলছে, "ওরে, তোরা একটু থাম। চারপাশে সবাই দেখছে। মান সম্মান সব মাটিতে মিশিয়ে দিলি।"

     কথাটা শুনে অর্ণবের স্ত্রী রেগে গিয়ে অলকাসুন্দরীকে পাথর বাঁধানো ঘাটে ঠেলে ফেলে দিলো। 

 

তসলিমা নাসরিন - শংকর ব্রহ্ম || Taslima Nasrin - Sankar brahama || Article || Essay || প্রবন্ধ || নিবন্ধ

তসলিমা নাসরিন 

(বিতর্কিত কবি-সাহিত্যিক )

      শংকর ব্রহ্ম




                     তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ শহরে ১৯৬২ সালের ২৫শে আগস্ট তসলিমা নাসরিন জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার মা ঈদুল ওয়ারা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান গৃহিণী এবং পিতা রজব আলী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এস.এস.সি) পাস করেন। ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচ.এস.সি) পাস করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৪ সালে এম.বি.বি.এস পাস করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল তিনি সরকারী গ্রামীণ হাসপাতালে এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিভাগে ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢা.মে.ক.হা)- এ অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।



            তেরো বছর বয়স থেকে তসলিমা কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময় ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি 'সেঁজুতি' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তসলিমার কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে 'শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা' নামক তার প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে 'নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে' ও ১৯৯০ সালে 'আমার কিছু যায় আসে না' কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। এই সময় তসলিমা ঢাকা হতে প্রকাশিত নঈমুল ইসলাম খান দ্বারা সম্পাদিত খবরের কাগজ নামক রাজনৈতিক সাপ্তাহিকীতে নারী অধিকার বিষয়ে লেখা শুরু করেন। তার কাব্যগ্রন্থ ও সংবাদপত্রের কলামে নারীদের প্রতি ইসলামপন্থীদের শোষণের অভিযোগ করায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের একদল ইসলামপন্থী এই পত্রিকার অফিস ভাঙচুর করে। এই সময় নির্বাচিত কলাম নামক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৯২ সালে তসলিমা আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালের মধ্যে 'অতলে অন্তরীণ', 'বালিকার গোল্লাছুট' ও 'বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা' নামক আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। 'যাবো না কেন? যাব' ও 'নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প' নামক আরও দুইটি প্রবন্ধ-সংকলন এবং 'অপরপক্ষ', 'শোধ', 'নিমন্ত্রণ' ও 'ফেরা' নামক চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।



              ১৯৯৩ সালে লজ্জা নামক তার পঞ্চম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে বাংলাদেশের মুসলিমদের দ্বারা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা করা হয়। এই উপন্যাসটি প্রকাশের পর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় একদল ইসলামপন্থী তসলিমার ওপর শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে ও তার এই উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানায়। গ্রন্থমেলা কর্তৃপক্ষ তাকে মেলায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। এই বছর অক্টোবর মাসে কাউন্সিল অব ইসলামিক সোলজার্স নামক এক ইসলামপন্থী সংগঠন তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে।



            তসলিমা নাসরিনের সাতটি আত্মজীবনী গ্রন্থের অধিকাংশ বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়। 'আমার মেয়েবেলা' নামক তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে ইসলাম ও মুহাম্মাদের প্রতি বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হলেও ২০০০ সালে এই বইয়ের জন্য তসলিমা দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার জয় করেন। ২০০২ সালে তার দ্বিতীয় আত্মজীবনী 'উতাল হাওয়া' বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়। ২০০৩ সালে 'ক' নামক তার তৃতীয় আত্মজীবনী বাংলাদেশ উচ্চ আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই বইটি দ্বিখণ্ডিত নামে প্রকাশিত হলেও ভারতীয় মুসলিমদের একাংশের চাপে নত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে বইটি নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হলে সরকারের এই সিদ্ধান্ত লেখক মহলে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞা ২০০৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ২০০৪ সালে 'সেই সব অন্ধকার' নামক তার চতুর্থ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।



            ১৯৯৪ সালের মে মাসে 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামি ধর্মীয় আইন শরিয়া অবলুপ্তির মাধ্যমে কুরআন সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর ফলে ইসলামপন্থীরা তার ফাঁসির দাবি জানাতে শুরু করে। তিন লাখ ইসলামপন্থীদের একটি জমায়েতে তাকে ইসলামের অবমাননাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালরূপে অভিহিত করে। দেশ জুড়ে তার শাস্তির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। হাবিবুর রহমান সিলেটে একটি সমাবেশে তার মাথার দাম ৫০ লাখ টাকা ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেসময় আলোকচিত্রী শহিদুল আলম সহ বিভিন্ন জনের আশ্রয়ে তিনি দুই মাস লুকিয়ে থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার জামিন মঞ্জুর করা হয় এবং তসলিমা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।



         বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তিনি ১৯৯৪ সালে সুইডেনে ও ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে বসবাস করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সুইডেন ফিরে গেলে রাজনৈতিক নির্বাসিত হিসেবে জাতিসংঘের ভ্রমণ নথি লাভ করেন। এই সময় তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন ও সুইডিশ কর্তৃপক্ষের নিকট তার বাংলাদেশের পাসপোর্ট জমা দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এই সময় তার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট দেশে ফেরার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হলে তিনি জাতিসংঘের ভ্রমণ নথি ত্যাগ করে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের নিকট হতে তার বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত পান ও বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশ প্রবেশ করেন। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে পুনরায় জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রুজু হলে তিনি পুনরায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সে বসবাস করেন।



দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষার পর ২০০০ সালে তিনি ভারতে প্রবেশ করার ভিসা সংগ্রহ করতে সমর্থ হলে তিনি কলকাতা যাত্রা করেন। এই বছর মার্চ মাসে তিনি 'শোধ' নামক তার একটি উপন্যাসের মারাঠি ভাষায় অনুবাদকর্মের প্রচারে মুম্বই শহরে পৌঁছানোর সময় ইসলামপন্থীরা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুমকি দেন। ২০০২ সালে তসলিমার পিতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলে তসলিমার বাংলাদেশ প্রবেশে অনুরোধ করে ব্যর্থ হন। ২০০৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে অস্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হলে তসলিমা কলকাতা শহরে বসবাস শুরু করেন। ২০০৬ সালে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম সৈয়দ নূরুর রহমান বরকতি নাসরিনের মুখে কালিলেপন করলে পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল বোর্ড নামক একটি সংগঠন তার মুন্ডচ্ছেদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ঘোষণা করেন। এই বছর ৯ই আগস্ট তিনি 'শোধ' উপন্যাসের তেলুগু ভাষায় অনুবাদকর্মের প্রচারে হায়দ্রাবাদ শহরে গেলে অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় উত্তেজিত জনতা তাকে আক্রমণ করে। ১৭ই আগস্ট কলকাতা শহরের মুসলিম নেতারা তসলিমাকে হত্যা করার জন্য বিপুল অর্থ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২১শে নভেম্বর অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম নামক একটি ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী কলকাতা শহরে তাণ্ডব শুরু করলে সেনাবাহিনীকে আইন ও শান্তিরক্ষার জন্য মোতায়েন করা হয়। এই দাঙ্গার পর নাসরিনকে কলকাতা থেকে জয়পুর হয়ে নতুন দিল্লি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত সরকার তাকে পরবর্তী সাত মাস একটি অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করে রাখে। ২০০৮ সালে তাকে 'সিমোন দ্য বোভোয়ার' পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হলেও তিনি ভারতে প্রবেশে অনুমতি না পাওয়ার আশঙ্কায় ফ্রান্স যাত্রা করে পুরস্কার নিতে অসম্মত হন।এই সময় তিনি 'নেই কিছু নেই' নামক তার আত্মজীবনীর ষষ্ঠ ভাগ প্রকাশ বাতিল করেন ও কলকাতার দাঙ্গার জন্য দায়ী 'দ্বিখণ্ডিত' নামক তার বিতর্কিত বইটির কিছু অংশ অপসারণ করতে বাধ্য হন। ভারতের প্রাক্তন বিদেশসচিব মুচকন্দ দুবে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে একটি পত্রে ভারত সরকারকে চাপ দিয়ে তসলিমার গৃহবন্দী অবস্থার মুক্তির জন্য অনুরোধ করেন। ২০০৮ সালের ১৯শে মার্চ তসলিমা ভারত ছাড়তে বাধ্য হন।



               ২০১৫ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত ইসলামপন্থীরা তার প্রাণনাশের হুমকি দিলে সেন্টার ফর ইনক্যুয়ারি তাকে ঐ বছর ২৭শে মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে সহায়তা করে এবং তার খাদ্য, বাসস্থান নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।” নির্বাসিত হওয়ার পর তসলিমা নাসরিন ভারতে থাকাকালীন সময়ে প্রথম বাংলাদেশী হিসাবে জনপ্রিয় টেলিভিশন শো 'বিগ বস ৮'- এ আমন্ত্রণ পান। কিন্তু তিনি এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন।



         ১৯৮২ সালে তসলিমা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র প্রেমে পড়েন এবং গোপনে বিয়ে করেন। ১৯৮৬ সালে তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের সাথে তার বিয়ে এবং ১৯৯১ সালে বিচ্ছেদ হয়। তিনি ১৯৯১ সালে সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদকে বিয়ে করেন এবং ১৯৯২ সালে তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। তসলিমার কোন সন্তানাদি নেই।


          নানান সময়ে তসলিমা নাসরিন সমালোচিত হয়েছেন। ২০২১ সালের এপ্রিলে ইংরেজ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মঈন আলীকে নিয়ে টুইট করেন। তিনি বলেন, ‘মঈন আলী ক্রিকেট না খেললে সিরিয়াতে গিয়ে আই এস.আই.-য়ের সঙ্গে যোগ দিত।’ তার এই টুইটের ফলে আরও অনেক ক্রিকেটার এর বিরোধিতা করেন। ইংরেজ জাতীয় দলের পেসার আর্চার রি-টুইট করে লিখেছেন, "আপনি কি সুস্থ? আমার মনে হয় না।" তবে, তোপের মুখে এবং বিরোধিতার মুখে তসলিমা নাসরিন তার এই টুইট সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। এছাড়াও আরও কিছু ইংরেজ ক্রিকেটার স্যাম বিলিংস ও বেন ডাকেট টুইটারে তসলিমা নাসরিনের আইডিটিকে রিপোর্ট করার জন্য আহবান জানান। তসলিমা নাসরিন পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি মূলত মঈন আলীকে নির্দেশ করে টুইটটি করেন নি। তিনি "কট্টর ইসলাম"কে নির্দেশ করে টুইটটি করেছেন। এবং এই টুইটের কারণে তার মাঝে কোন অনুশোচনা নেই। তাকে নিয়ে ইংরেজ ক্রিকেটারদের বিরোধিতা নিয়ে তিনি বলেন, "তারা তাদের সতীর্থকে সমর্থন করছে ভালো কথা। তারা বলেছে বলে আমি টুইটটি মুছে দিয়েছি, কিন্তু তারা আমার সম্পর্কে কতদূর জানে?"



[তার গ্রন্থ তালিকা]



(কবিতা)



১). শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা, ১৯৮১ সাল


২). নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে, ১৯৮৯ সাল


৩). আমার কিছু যায় আসে না , ১৯৯০ সাল


৪). অতলে অন্তরীণ, ১৯৯১ সাল


৫). বালিকার গোল্লাছুট, ১৯৯২ সাল


৬). বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা, ১৯৯৩ সাল


৭). আয় কষ্ট ঝেঁপে, জীবন দেবো মেপে, ১৯৯৪ সাল


৮). নির্বাসিত নারীর কবিতা, ১৯৯৬ সাল


৯). জলপদ্য, ২০০০ সাল


১০). খালি খালি লাগে, ২০০৪ সাল


১১). কিছুক্ষণ থাকো, ২০০৫ সাল


১২). ভালোবাসো? ছাই বাসো!, ২০০৭ সাল


১৩). বন্দিনী, ২০০৮ সাল।



(প্রবন্ধ সংকলন)



১). নির্বাচিত কলাম, ১৯৯০ সাল


২). যাবো না কেন? যাব, ১৯৯১ সাল


৩). নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প, ১৯৯২ সাল


৪). ছোট ছোট দুঃখ কথা, ১৯৯৪ সাল


৫). নারীর কোন দেশ নেই, ২০০৭ সাল


৬). নিষিদ্ধ, ২০১৪ সাল


৭). তসলিমা নাসরিনের গদ্য পদ্য, ২০১৫ সাল।



(উপন্যাস)



১). অপরপক্ষ ১৯৯২ সাল


২). শোধ, ১৯৯২ সাল


৩). নিমন্ত্রণ, ১৯৯৩ সাল


৪). ফেরা , ১৯৯৩ সাল


৫). লজ্জা, ১৯৯৩ সাল


৬). ভ্রমর কইও গিয়া, ১৯৯৪ সাল


৭). ফরাসি প্রেমিক ,২০০২ সাল


৮). শরম,২০০৯ সাল।



(ছোট গল্প)



১). দু:খবতী মেয়ে, ১৯৯৪ সাল


২). মিনু, ২০০৭ সাল।



(আত্মজীবনী)



১). আমার মেয়েবেলা, ১৯৯৯ সাল


২). উতাল হাওয়া, ২০০২ সাল


৩). ক, ২০০৩ সাল; (পশ্চিমবঙ্গে দ্বিখণ্ডিত নামে প্রকাশিত, ২০০৩ সাল)


৪). সেই সব অন্ধকার, ২০০৪ সাল


আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ, ২০০৬ সাল


৫). নেই, কিছু নেই, ২০১০ সাল


৬). নির্বাসন, ২০১২ সাল।



(তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র)



তসলিমা নাসরিনের জীবনভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র নির্বাসিত ২০১৪ সালে মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায়।


 ২০১৫ সালে এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে ৬২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে।



[পুরস্কার ও সম্মাননা]



তসলিমা তার উদার ও মুক্তচিন্তার মতবাদ প্রকাশ করায় দেশ-বিদেশ থেকে একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। সেগুলো হলো -



১). ● আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার, ভারত, ১৯৯২ সাল


২). ● নাট্যসভা পুরস্কার, বাংলাদেশ, ১৯৯২ সাল


৩). ● ইউরোপীয় সংসদ থেকে চিন্তার স্বাধীনতার জন্য সাখারভ পুরস্কার, ১৯৯৪ সাল


৪). ● ফ্রান্স সরকার থেকে মানবাধিকার পুরস্কার, ১৯৯৪ সাল


৫). ● ফ্রান্স থেকে নান্টেস পুরস্কারের আদেশ, ১৯৯৪ সাল


৬). ● কার্ট টুচোলস্কি পুরস্কার, সুইডিশ পেন, সুইডেন, ১৯৯৪ সাল


৭). ● হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থেকে হেলম্যান-হ্যামেট গ্রান্ট, ১৯৯৪ সাল


৮). ● হিউম্যান-এটিস্ক ফরবান্ড, নরওয়ে, থেকে মানবতাবাদী পুরস্কার, ১৯৯৪ সাল


৯). ● ঘেন্ট ইউনিভার্সিটি, বেলজিয়াম, থেকে অনারারি ডক্টরেট, ১৯৯৫ সাল


১০). ● জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস, জার্মানি, থেকে বৃত্তি, ১৯৯৫ সাল


১১). ● উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন, থেকে মনিসমানিয়ান পুরস্কার,১৯৯৫ সাল


১২). ● আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী এবং নৈতিক ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেন, থেকে বিশিষ্ট মানবতাবাদী পুরস্কার, ১৯৯৬ সাল


১৩). ● ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি ফর হিউম্যানিজম, ইউএসএ, থেকে মানবতাবাদী বিজয়ী, ১৯৯৬ সাল


১৪). ● আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার, ভারত, ২০০০ সাল


১৫). ● আগামীকালের জন্য গ্লোবাল লিডার, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ১৯৯৬ সাল


১৬). ● এরউইন ফিশার পুরস্কার, অ-ধর্মীয় ও নাস্তিকদের আন্তর্জাতিক লীগ (IBKA), জার্মানি, ২০০২ সাল


১৭). ● ফ্রি থট হিরোইন অ্যাওয়ার্ড, ফ্রিডম ফ্রম রিলিজিয়ন ফাউন্ডেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০০২ সাল


১৮). ● কার সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস পলিসিতে ফেলোশিপ, জন এফ কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্ট, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০০৩ সাল


১৯). ● সহনশীলতা ও অহিংসার প্রচারের জন্য ইউনেস্কো-মদনজিৎ সিং পুরস্কার, ২০০৪ সাল


২০). ● আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস থেকে অনারারি ডক্টরেট, ২০০৫ সাল


২১). ● গ্র্যান্ড প্রিক্স ইন্টারন্যাশনাল কনডরসেট-আরন, ২০০৫ সাল


২২). ● শরৎচন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ২০০৬ সাল


২৩). ● প্যারিস, ফ্রান্স, এর সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, ২০০৮ সাল


২৪). ● সিমোন ডি বেউভোয়ার পুরস্কার, ২০০৮ সাল


২৫). ● নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেলোশিপ, ২০০৯ সাল


২৬). ● উড্রো উইলসন ফেলোশিপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০০৯ সাল


২৭). ● নারীবাদী 

প্রেস পুরস্কার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, 


২০০৯ সাল।


---------------------------------------------------------------------------------------------


[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। সূত্র - অন্তর্জাল ]





বন্ধুত্বের বন্ধনই সম্প্রীতির বীজমন্ত্র - সামসুজ জামান || Article || Essay || প্রবন্ধ || নিবন্ধ

 বন্ধুত্বের বন্ধনই সম্প্রীতির বীজমন্ত্র

    সামসুজ জামান


বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে দুকথা বলতে গিয়ে হলপ করে যে কথাটা বলতে চাই তা হল মানুষে মানুষে আজ বন্ধুত্বের বন্ধনের বড় প্রয়োজন। “বন্ধু বিনে প্রাণ বাচে না...”। কিন্তু তা কি সত্যি নাকি? দেখা যাক -- । 

একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করছি। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে আরেকটি পরিবার, যাদের বাড়িতে আম গাছে আম ফলে রয়েছে। ইতিপূর্বে দু-তিনদিন গাছের আম দিয়েছিলেন তারই সূত্র ধরে গতকাল যখন আমার স্ত্রী কিছু কলা দিতে গিয়েছিল তখন ঐ পরিবার আঁতকে উঠলেন। - না না না, আপনাদের দেওয়া ফল তো আমরা নিতে পারবো না। - কারণ কি? আসলে বাড়িতে বয়স্ক শাশুড়ি আছেন, আপনাদের ছোঁয়া নিলেই উনি খুব অসন্তুষ্ট হবেন। জিজ্ঞাসা করা হল আপনাদের ছোঁয়া মানে? আমরা মুসলিম বলে? খুব অকপটে স্বীকার করলেন ওই পক্ষ - হ্যাঁ। তারপরেও আমাদের পক্ষ থেকে বলা হল- আরে, এ তো ঘরে রান্নাকরা কোন জিনিষপত্র নয়, বাজারের কেনা ফল। এতে আবার আপত্তির কী আছে? গিন্নীর মাথায় কিছুতেই ঢুকলনা এই সাদা-মাটা ব্যাপারটা- বলল আচ্ছা, সামান্য এই ব্যপার নিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব কেন নষ্ট হবে? কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। এতদসত্ত্বেও উনি তীব্র আপত্তি করে বললেন- কিছুতেই আপনাদের দেওয়া জিনিস ঘরে ঢোকানই চলবে না। প্রবন্ধের শুরুতে কী বলেছিলাম? এখন তো দেখি উলটপুরাণ – প্রাণ থাকলেও বন্ধু বাচে না!

 আমার এই অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনার পর কবি লেখক পরমবন্ধু রাজারহাটের শংকর কুমার ঘোষ বললেন- ‘আমাদের ছোটবেলায় মুসলিম বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া নিয়ে পাড়ার লোক আপত্তি করেছিল এবং বলেছিল এই ছেলেটার জাত গেছে। কিন্তু সেই ছবি তো আমি জানতাম বহু আগেই মুছে গেছে। এখনো এই ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়? এ তো ভারি লজ্জার কথা এবং ব্যাপারটা শুনে যদিও আমি হিন্দু হিসেবে খুব লজ্জিত বোধ করছি কিন্তু তাই বলে আপনার-আমার বন্ধুত্ব যেন প্রাণ থাকতেও কোনদিন নষ্ট না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখব দুজনেই’! বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমাদের অটুট বন্ধুত্বের মাধ্যমে সৃষ্ট অনাবিল সম্প্রীতির বাতাবরণ অনেকের কাছেই ঈর্ষার বিষয়।

বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকায় আমাদের আদি নিবাস। পারিবারিক প্রয়োজনে, যখন শহরে থাকার মনস্থির করেছিলাম তখন এয়ারপোর্টের সামনেই ফ্যাট নিয়েছিলাম। যদিও দু'বছর আগে যখন ফ্ল্যাটের সন্ধান করা হচ্ছিল তখনই একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একটা ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ পছন্দ হয়ে যাওয়ার পরও ফ্লাটের মালিক হঠাৎই আমার পরিচয় পেয়ে বলেছিলেন – ‘আপনাকে তো ফ্ল্যাট দেওয়া যাবে না’। আমি বললাম – ‘কারণটা জানতে পারি’? উনি জানিয়েছিলেন –‘অসুবিধা আর কিছুই নয়, আসলে আমাদের বাড়িতে গোপাল প্রতিষ্ঠা করা আছে। আর বাড়িতে বয়স্কা মা আছেন। সুতরাং কিছুতেই দেওয়া সম্ভব নয়’। এরপর আমি পকেট থেকে যখন মোবাইল বের করে দুর্গাপূজা বিষয়ক একটা স্বরচিত কবিতা শুনিয়েছিলাম তখন হঠাৎই মত বদল হয়েছিল ভদ্রলোকের। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও দুর্গাপুজোর বিষয়ে আমার ভক্তি ও জ্ঞানের (যদিও দ্বিতীয়টি আমার অত্যন্ত নগন্য বলেই আমি মনে করি) পরিচয় পেয়ে উনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সেই ফ্ল্যাট দিতে চেয়ে ছিলেন। যদিও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই আমাকে নিরস্ত্র করেছিলেন ‘কি জানি আগামীকাল হয়তো এইরকমই অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক কারণে মতবিরোধ সৃষ্টি হবে আর ওই ফ্ল্যাট আমার বসবাসের জন্যে অনুপযুক্ত হয়ে যাবে’ – ব’লে।

আমাদের সকলের মনে থাকার মতই কথা বছর কয়েক আগে সনু নিগমের মতো এক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্যেই আপত্তি জানিয়েছিলেন যে মসজিদ থেকে দেওয়া আযান উনি কোনমতে শুনতে রাজি নন। ওনার সেই স্বাধীনতাটুকু আছে। সেই তিনিই স্বার্থের খাতিরে যখন মুসলিম দেশে ব্যক্তিগত স্বার্থে থেকেছেন তখন তাঁর উল্টো সুর। আমরা গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যেই রোগীদের জন্য হিন্দু মুসলিম আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে দেখে আশ্চর্য হয়েছি কিভাবে মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব নষ্ট করে এই মহান দেশটার ঐতিহ্য নষ্ট করার চক্রান্ত চলছে। এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কতটা ক্ষুদ্র মানসিকতার অধিকারী আমরা। আসলেই আমরা দিনে দিনে এত অসহিষ্ণুতার শিকার হয়ে যাচ্ছি যার কারণে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন টিকিয়ে রাখার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখি না, আমরা ভেবে দেখি না মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, কিংবা পূজা-অর্চনার মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ অথবা কীর্তন এর আওয়াজ শুনে যদি অন্য ধর্মের মানুষ একই রকম ভাবে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন এবং আপত্তি জানান তাহলে অবস্থাটা কিরকম সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছাতে পারে!

বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুতো আলগা হলেই জেঁকে বসবে সাম্প্রদায়িকতা। শুধু দেশে নয় বিদেশেও চর্চিত হচ্ছে ভারতে প্রচারিত এই নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি। এবং এটিই আমাদের কাছে একান্ত লজ্বার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে আমরা খুব সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এর পক্ষ থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে সুপারিশ সম্পর্কে জেনেছি ১৪ টি দেশের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে সেই দেশগুলিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির পরিবেশ তৈরি হয়ে মানুষে মানুষে স্বাভাবিক বন্ধুতার নুব্জদশা ঘনীভূত হয়েছে। এই দেশগুলো হল - ভারতবর্ষ, মায়ানমার, চীন, ইরিত্রিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, রাশিয়া, সিরিয়া, ভিয়েতনাম ও নাইজেরিয়া। এ বিষয়ে ভেবে দেখা অথবা কোন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করা বিশ্বের সামগ্রিক স্বার্থেরই জন্যে খুব জরুরী যাতে বিশ্ব-বন্ধুত্বের আবহাওয়াটা অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ্য হতে পারে।

এক সংকটজনক মুহূর্তে কবি নজরুল রচনা করেছিলেন-“ হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার”। কিন্তু আজকের এই কঠিন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও সেই কথা আমাদের বারবার ভেবে দেখার সময় এসেছে নাকি? কবি নজরুলের সেই সন্দেহ, শঙ্কা এখনো একইভাবে বর্তমান থেকে যাবে এ তো ভারী আশ্চর্য কথা! আমরা পৃথিবীতে এত অগ্রবর্তী হয়েছি বলে আস্ফালন করি। বিজয় গর্বের এই আস্ফালন দেখে বারবারই লজ্জা হয় যে আসলে আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি? সম্প্রীতির বাণী ছড়াতে যাওয়া নজরুল হিন্দু মেয়েকে ঘরণী করেছিলেন কিন্তু তাঁকে এই ঘটনা কোনদিনই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। মুসলিমরা তাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন কাফের হিসেবে। আর অনেক হিন্দুও তাকে কোনকালেই আপন করে নিতে পারেননি। এই যন্ত্রণা আর বঞ্চনার কাহিনী বন্ধুপ্রিয় নজরুল কে কুরে কুরে খেয়েছিল। 

 সুতরাং এই সম্প্রীতির বিরুদ্ধে আপস কোন ভাবে চলতে পারে না। করোনার সংকটজনক অবস্থায় সমস্ত বিশ্ব একাত্মতার বন্ধনে মিলেমিশে লড়াই করে দেখেছি আমরা কিছুটা অন্ততঃ রুখে দাঁড়াতে পারি ভেদাভেদ ভুলে সকলে একাত্ম হলে। কিন্তু সেই অবস্থায় যদি ধর্মের কারনে, রাজনীতির কারণে আমরা পারস্পরিক বিরোধ কে তীব্র করে তুলে ধরি, তাহলে সেই ইতিহাস যেমন লজ্জার একই সাথে সাথে জাতি ধ্বংসের জন্য, বিশ্ব ধ্বংশের জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষ কখনো মানুষকে এগিয়ে দিতে পারে না।

কোন অশুভ শক্তি বিভিন্ন কারণে মানুষকে বোকা বানানোর, ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেই যাবেন, কিন্তু আমরা সাদামাটা মানুষের দল সেই ধোঁকাতে বিপর্যস্ত হয়ে সম্প্রীতির এই বাণী প্রচারে কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবো? সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে সারা দেশ আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বাসীদের উপর কৃতজ্ঞ হয়েছে এক বিশেষ দলের দুর্দান্ত জয়ের কারণে নয়, কৃতজ্ঞ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অটুট সম্প্রীতির কারণে, মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের কারণে। আশ্চর্য এটাই আমাদের বিশেষত্ব। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান কোন মানুষই এখানে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সামান্যতম উস্কানিকেও মনের কোনেও ঠাঁই দেননি। এই মনোভাবকে একেবারে অন্তর থেকে প্রণাম জানাই আমরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। 

আর সেখানেই এবার জোরাল প্রশ্ন – কেন তবে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়াছুঁয়ি বর্জন করে এখনো রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাগ্রস্থ হব? এখনও কি সময় আসেনি আমাদের সহানুভূতি নিয়ে সেই ভাবনাটা গুরুত্বপূর্ণভাবে ভেবে দেখার? গান-কবিতা আমরা শুনব আর পড়ব শুধু শোনা আর পড়ার জন্যেই? তার বাস্তব উপযোগিতা থাকবে না? আজকেও আমাদের মনে পড়বেনা সেই গান- “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে।/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু”? আবার মনে পড়ছে কবি নজরুলের কথা – “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান / মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ”। কবির সেই অবিস্মরনীয় বাণী কি ব্যর্থ হয়ে মাথা কুটবে? আর মাত্র কিছু-দিন আগে অন্য লোকে পাড়ি দেওয়া প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষকে লোক দেখানি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁর কবিতার কথা – “ আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি”-র কোন মর্যাদাই থাকবে না আমাদের কাছে! তাই কখনও হয়? আমরা আশাবাদী। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। আমরা সুদিনের অপেক্ষায়। একটা ফুটন্ত সকাল দেখব বলে আমরা উন্মুখ হয়ে আছি। 

         ------------------