Wednesday, October 23, 2024

নিবারণবাবু ও পিকনিক - অভীক মুখার্জী || Nibaronbabu o picnic - avik Mukherjee || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 নিবারণবাবু ও পিকনিক

                অভীক মুখার্জী




শীতকাল এলেই নিবারণবাবু একটু আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি পিকনিকের প্ল্যান হল। কেন?  নিবারণবাবু কি পিকনিক পছ্ন্দ করেন না? নাকি উনি সোস্যালি অকওয়ার্ড? কোনোটাই নয়,উল্টে পিকনিকের হইচই নিবারণবাবু খুবই ভালোবাসেন।তাহলে আতঙ্কে ভোগেন কেন?কারণ আছে,একটা ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক আগে, আর তারপর থেকেই গুটিয়ে গেছেন নিবারণবাবু।কি ঘটনা?বলি শুনুন তাহলে।


নিবারণবাবুর একটা বন্ধুদের গ্রুপ আছে।সব একদম ছোটোবেলাকার বন্ধু,প্রায় প্রত্যেকেই একই স্কুলে পড়েছেন প্রায় বছর দশেক একসাথে।তারপর কলেজ জীবনে ছড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জায়গায়।পরবর্তীতে কর্মসূত্রে আরও দুরবর্তী জায়গায় এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে গেছেন অনেকে।কিন্তু বন্ধুত্বের সূত্র পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়নি।স্মার্টফোন আসার পর সোশ্যালমিডিয়ার দৌলতে অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আবারো যোগাযোগ হয়েছে।এই সব বন্ধুদের গ্রুপে সাধারণত কয়েকজন খুব এ্যাকটিভ থাকে। নিবারণবাবুদের গ্রুপে সুমিত সেইরকমই একজন।মূলত তার উদ্যোগেই ১৯৯৪ উচ্চমাধ্যমিক পাস ব্যাচের বন্ধুদের পিকনিক শুরু হয় ২০০৯ সালে। নিবারণবাবু তখন কর্মসূত্রে মুম্বইনিবাসী।সুমিতের কাছ থেকে জানতে পারতেন সেই সব পিকনিকের কথা আর ভাবতেন তিনিও কবে যোগ দেবেন সেই পিকনিকে। ২০১০ সালে যখন নিবারণবাবু কলকাতা ফিরলেন তখন সুমিত আবার কর্মসূত্রে গুয়াহাটিতে।সে কলকাতায় ব্যাক করার পর আবার পিকনিকের আয়োজন হল ২০১২ ডিসেম্বরে।নিবারণবাবুর আনন্দ তো আর ধরে না।কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে।কয়েকজনের সঙ্গে ফেসবুক মারফত যোগাযোগ থাকলেও বেশিরভাগের নম্বরটাও নেই নিবারণবাবুর কাছে। তাদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় উত্তেজনায় ফুটছেন নিবারণবাবু। সুমিতের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন প্রায় জনা ত্রিশ কনফার্মড আসছে। এমন অনেকের নাম রয়েছে সেই লিস্টে যাদের সঙ্গে স্কুলের শেষ দিনের পর আর দেখাই হয়নি। পিকনিক ঠিক হওয়া ইস্তক নিবারণবাবুর মুখে খালি বন্ধুদের গল্প। প্রথম প্রথম বেশ মন দিয়ে শুনলেও ওঁর স্ত্রী শেষপর্যন্ত বিরক্ত হতেই লাগলেন। কিন্তু  নিবারণবাবুর কিছু এসে যায়না তাতে।তা সেই বন্ধুদের ভালো নামগুলো আসলে কী ছিল সেগুলো আর ওনার মনে নেই।লম্বু,মোটা,কালু,রাঘো,বোদো,কি আজব নাম সব! এই সব অদ্ভুত নামগুলো শুধু বন্ধুদের মধ্যেই নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষকমহলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।এখন পিকনিকের লিস্টে ভাল নামগুলো দেখে নিবারণবাবু তাঁদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলেন। 

অবশেষে এসেই গেল সেই বহুপ্রতিক্ষিত দিন।রবিবার সকালে যেখানে নিবারণবাবু নটার আগে বিছানা ছাড়েননা , সেদিন সকাল সাতটায় চানটান করে এক্কেবারে রেডি।তর সইছেনা তাঁর আর। উত্তরপাড়ায় এক বন্ধুর কাকার একটা বাড়ি আছে অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার,সেই বাড়িতেই হবে গেটটুগেদার।আর এক বন্ধু যাকে গুন্ডা বলে ডাকতেন সকলে, তার এখন ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা। সেই কস্ট টু কস্টএ খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আর এক বন্ধু “কাগা”, যে এখন নামকরা শিশুচিকিৎসক, সে ভেনুর ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।বাকি সকলের কান্ট্রিবিউশন ধরা হয়েছে পার হেড ৩০০ টাকা করে।সকালে জলখাবার দিয়ে শুরু, দুপুরে লাঞ্চ আর বিকেলে চা এর সঙ্গে স্ন্যাকস। নিবারণবাবু অবশ্য মেনুর থেকেও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় বেশি খুশী।সকাল দশটায় সবার একসঙ্গে মিট করার কথা।জায়গাটাও নিবারণবাবুর বাড়ি থেকে মেরেকেটে পনেরো মিনিট। তবু নিবারণবাবু সকাল নটার সময়েই বেরিয়ে পড়েন।না না, নিবারণবাবুতো নন, বেরোলো তো নিবু । নিবারণবাবুকে তাঁর বন্ধুরা তো ওই নামেই ডাকত। খালি সেদিনের সেই রোগা প্যাংলা নিবু,যার মাথায় ছিল ঢেউখেলানো ঘন চুল,সময়ের অভিঘাতে সে এখন রীতিমত মোটাসোটা এক মধ্যবয়স্ক মানুষ, মাথার চুল পাতলা হতে হতে টাক দেখা দিয়েছে পরিষ্কার।নিবু সাইকেল ছাড়া এক পা বেরোত না, আর এই নিবারণবাবু রিকশা আর গাড়িতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।নিবুর সাইকেলটা তাই অযত্নে আজো পড়ে আছে সিঁড়ির তলায়।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিবারণবাবু একটা রিকশা নিয়েই নিলেন।প্রথমে ভেবেছিলেন হেঁটেই চলে যাবেন। কিন্তু তারপর আবার ভাবলেন হাঁটতে সময় লেগে যাবে বেশী। উত্তরপাড়ায় ঢোকার মুখেই সেই “ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”।স্কুল জীবনের সেই ছোট্ট দোকানটা এখন বিরাট বড় হয়ে গেছে।নিবারণবাবুর মনে পড়ে যায় নিবু এখান থেকে কত সিঙারা আর পান্তুয়া খেয়েছে তার দৈনিক হাতখরচার ২টাকা দিয়ে।নিজেকে সামলাতে পারেন না নিবারণবাবু। ঢুকেই পড়েন দোকানে।ঝাঁ চকচকে শোকেসে রকমারি মিষ্টি সাজানো থাকলেও অর্ডার দিলেন সেই সিঙারা আর পান্তুয়া।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এক প্লেট মুসেলি খাইয়ে দিয়েছেন স্ত্রী,কিন্তু আজকের দিনটাতো একটু অন্যরকম। ছোটবেলার সেই সিঙারা পান্তুয়ার স্বাদ না পেলেও নিবারণবাবুর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।

মিষ্টির দোকান থেকে পিকনিকের ভেনু কাছেই। যত কাছাকাছি পৌঁছন, নিবারণবাবুর উত্তেজনার পারদ ততই বাড়তে থাকে।ইতিউতি দেখতে থাকেন,যদি কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।ঠিক তখনই চোখে পড়ে এক ভদ্রলোক, বেশ লম্বা,এক মাথা কাঁচা পাকা চুল,তাঁর দিকে একই ভাবে দেখছেন উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে।খুব চেনা চেনা মনে হয় ভদ্রলোককে। চকিতে সব কিছু মনে পড়ে যায়।

“আরে লম্বু না ?চিনতে পারছিস?”নিবারণবাবু প্রায় চিৎকার করে ওঠেন। ‘নিবু মনে হচ্ছে। আরে। কত মুটিয়েছিস রে!’ সেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন নিবারণবাবুকে।ঠিক সেই সময় একটা বাইক এসে দাঁড়ায় তাঁদের ঠিক পাশে। বাইকারোহী হেলমেট খুলে কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে দুজনকেই।নিবারণবাবু এই বন্ধুর নামটা কিছুতেই মনে করতে পারেন না, অয়ন না সায়ন?যে হবে হোক, আজ সবাই শুধু বন্ধু, নামটা বড় কথা নয়।লম্বু পানওলাকে অর্ডার দেয়, ‘তিনটে গোল্ডফ্লেক’। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না বাকি দুজন সিগারেট খায় কিনা। তিন বন্ধু সিগারেট ধরিয়ে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই শুরু করে দেয় গল্প।বহুদিনের বহু গল্প যে জমা হয়ে রয়েছে।দেখতে দেখতে আরো দু তিন জন এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। নিবারণবাবু যথারীতি নামগুলো কিছুতেই মনে করতে পারছেন না, না চেহারাগুলো মেলাতে পারছেন ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে। গল্প করতে করতেই সবাই পৌঁছুলেন সেই বাড়িটায়।ভেতরেও অনেকে এসে গেছে ততক্ষণে।নিবারণবাবুদের ঢুকতে দেখে সবাই হই হই করে ওঠে।

‘আরে নতুন লোক এসেছে রে।কিরে ব্যাটা নিবু? যা মোটা হয়েছিস চিনতেই পারা যাচ্ছে না।’কেউ একজন নিবারণবাবুর পিঠে একটা বিশাল থাপ্পড় কষিয়ে বলে।পেছন ফিরে নিবারণবাবু নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেন না। এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড নিরুপম ওরফে মামা। সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত পাশাপাশি বসা, টিফিন শেয়ার, একসঙ্গে নীলডাউন, কত শত স্মৃতিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় নিবারণবাবুর। “কেমন আছিস মামা?” নিবারণবাবু জড়িয়ে ধরেন বন্ধুকে।আর একজন কেউ বলে ওঠে “শালা আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? ব্যাস তারপর যেটা হল সেটা আমেরিকান ফুটবলে যে হাডল হয় তার দেশি ভার্সন।এরই মাঝে কেউ একজন চিৎকার করে “থ্রি চিয়ার্স ফর নাইনটিফোর ব্যাচ।” বাকি সবাই ধুয়ো ধরে “ হিপ হিপ হুররে”। ঠিক কুড়ি বছর আগে যেমন হত।

প্রাতমিক পুনর্পরিচয়ের পালা সাঙ্গ করে সবার এবার  মনে পড়ে জলখাবারের কথা। আবার যেন স্কুলের দিনগুলো ফিরে আসে।লম্বু মামার প্লেট থেকে দুটো লুচি তুলে নিতে নিতে বলে “ তোর না পেটে গন্ডগোল? আবার লুচি খাচ্ছিস তার পরেও।” স্কুলের টিফিনের লুচি তুলে নেওয়া নিয়ে লম্বু আর মামার মারামারি ছিল নিত্যকার ঘটনা।এখন অবশ্য সে সব কিছুই হলো না।উল্টে মামা লম্বুর পাতে খানিকটা তরকারি তুলে দিয়ে বলল “গেল গেল, আরও গেল, এ্যাতো গিলিস তবু তোর গায়ে মাংস লাগে না কেন বলত?” ওদিকে দিবাকর মানে ব্যাঙ মুখে দুটো রসগোল্লা ঠুসে চোখ বুজে যেন জাবর কাটছে। নিবারণবাবুর মনে পড়ে এই ব্যাঙ মাঝে মাঝেই টিফিনের দরবেশ চুরি করত ঠিক এই ভাবেই।সময় বোধহয় সব কিছুকে চেঞ্জ করে দেয় না।

জলখাবারের লুচি আলুরদম মিষ্টি শেষ হতে নাহতেই সুমিত এককোণে রাখা একটা বড় ব্যাগ থেকে বের করে ফেলল দুটো বড় বোতল,একটা হুইস্কি অন্যটা ভদকা।তাদের বন্ধু শিবাশিষ এখন এক বিদেশি মদ কোম্পানির বড়কর্তা।সেই স্পনসর করেছে এই পানীয়।ব্যাস শুরু হয়ে যায় নরক গুলজার। নিবারণবাবুও বাদ জাননা ।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় স্ত্রী যদিও পইপই করে মদ্যপানে না করেছিলেন, কিন্তু নিবারণবাবু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না।বন্ধুদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করতে করতে উড়ে যেতে লাগল গ্লাসের পর গ্লাস।পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকল ভেজ আর চিকেন পকড়ার প্লেট।দেখতে দেখতে দু বোতল শেষ।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হলে হবে কী করে? নিমেষে হাতে হাতে বেশ মোটা চাঁদা উঠে যায়।মানস বাইকের পেছনে শান্তনুকে বসিয়ে ছুট লাগায় বটব্যালের দোকানের দিকে।দোকান বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।

এদিকে হুইস্কি আর ভদকার মিক্সচার খেয়ে নিবারণবাবু সামান্য, না না, বেশ একটু বেসামাল হয়ে পড়েছেন।কখনো মনটা ফুরফুরে লাগছে তো কখনো চাপা দুঃখগুলো গুড়গুড়িয়ে উঠছে।পাশে বসা মামার সঙ্গে সে সব কথাই চলছে।মামার অবস্থাও খুব একটা স্বাভাবিক নয়।সেও কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে।নিবারণবাবু অনেক দুঃখ নিয়ে তাঁকে বলতে গেলেন “ দ্যাখ মামা, যত দিন যাচ্ছে তত ফুলে যাচ্ছি।কোথায় মাথায় চিরুনি চলত না ! এখন দ্যাখ, টাক চকচক করছে, ছোটবেলাটাই ভালো ছিল রে , এত চিন্তা ছিল না”।ব্যাস, শোনা মাত্র মামা যেন ফেটেই পড়ে “আব্বে নিবু, তোর বুদ্ধিটা কি এখনো হাঁটুতেই আছে?এখন কি খারাপ আছিস শুনি? মদ গিলছিস, হুল্লোড় করছিস,আর কি চাই?আমায় দেখ, এমএসসি ফার্স্টক্লাস পেয়ে এখন লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। কিন্তু তোফা আছি।কম্প্রোমাইস গুরু, পুরো লাইফটাই কম্প্রোমাইস”।পাস্ থেকে ব্যাঙ ফুট কাটে “তা যাই বল ভাই, মাল খাবার ব্যাপারে কিন্তু কোন কম্প্রোমাইস নয়।” এইরকম টুকরোটকরা কথাবার্তা চলতেই থাকে। মানস ফিরে এসেছে ততক্ষণে, সঙ্গে এক ক্রেট বিয়ার। আসতে না আসতে সেগুলোও শেষ।

নিবারণবাবু পুরো আউট ততক্ষণে।একে তো এত বছর বাদে বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে দেখা, তারওপর হুইস্কি, ভদকা আর বিয়ার এর বিচিত্র ককটেল।কী বলছেন কী করছেন কোনও কিছুর ওপরেই নিবারণবাবুর আর কোনো কন্ট্রোল নেই।অন্যান্যদের অনেকের অবস্থাও প্রায় একই রকম।খালি জনা পাঁচেক যারা জলবিহার করেনি তারাই সোবার আছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে হুড়হুড় করে।দুপুরের লাঞ্চও রেডি ইতিমধ্যে। যারা স্বাভাবিক আছে তারা প্রায় ধরাধরি করে বাকি বন্ধুদের বসিয়ে দেয় খেতে।দুপুরের লাঞ্চের মেনুটাও বেশ জমকালো।পোলাও, তোপসে ফ্রাই, মাটন কষা, চাটনি, পাঁপড় আর রাজভোগ।যে টেবিলে সুশোভন মানে মোটা বসেছে তাকে ঘিরে বন্ধুদের একটা জটলা তৈরি হয়।শোনা যায় ক্লাস ১২ এ পড়ার সময় মোটা কোনো এক বন্ধুর দিদির বিয়ের নেমন্তন্নে ২১টা ফিশ ফ্রাই, এক বালতি মাটন আর ৫০টা রসগোল্লা খেয়েছিল।এত বছর পরেও সুশোভন সেই একই রকম আছে।তার বিশাল বপু বিশালতর হয়েছে।কিছুদিন আগে এক বৃষ্টির রাতে রেনকোট পরে অন্ধকার রাস্তায় বাইক চেপে আসার সময় রাস্তার ধারে কয়েকজন মহিলা তাকে নাকি অটো ভেবে ভুল করেছিল।সেটা আবার তার নিজের মুখ থেকেই শোনা।এক পেট মদ খাওয়ার পরও সুশোভন নিজের ফর্ম বজায় রাখছিল লাঞ্চের টেবিলে।সেই সুশোভনের পাশে বসে নিবারণবাবু সঙ্গ দোষে বা গুণে যাই হোকনা কেন, স্বাভাবিক দিনের প্রায় দ্বিগুণ খেয়ে ফেললেন।খেয়ে তো ফেললেন, কিন্তু উঠতে আর পারেন না।এঁটো হাতেই গুম মেরে বসে রইলেন।দেখতে দেখতে থুতনিটা প্রায় বুকে ঠেকে গেল।মাঝে হালকা করে একটু নাক ডাকার শব্দও শোনা গেল যেন।তখন বাকি বন্ধুরা খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত ছিল বলে বিশেষ নজর দিল না কেউ।

সবার যখন খাওয়া শেষ হল তখন বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।টানা গল্প করতে করতে বন্ধুরাও যেন একটু হাঁপিয়ে গেছে,বিশেষ করে হেভি লাঞ্চের পরে।সুমিত হটাৎ হাঁক পাড়ে “ওরে কেউ একটু মিউজিক চালা কেউ, নাচ না হলে পিকনিক হয় নাকি?” কেউ একটা হিন্দি গান চালিয়ে দিল মোবাইলে। শুরু হল নাচ। চটকা ভেঙ্গে নিবারণবাবুও সোজা নাচতে শুরু করেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, নিবারণবাবু নাচছেন। জীবনে নিবারণবাবু কোনওদিন নাচেন নি, এমনকি পুজোর ভাসানেও নয়। কিন্তু এখন জনা পনেরো বন্ধু মিলে এক অদ্ভুত নাচ জুড়লেন যেটাকে নাচ না বলে আবোলতাবোল লাফালাফি বলাই ভালো।এই যে নিবারণবাবু , ১০ মিনিট হাঁটতেও যাঁর প্রবল অনীহা, সেই তিনিও প্রায় আধঘণ্টা টানা নেচে নিলেন মানে লম্ফঝম্প করলেন। হচ্ছিল সবই, হটাৎ কী হল, নিবারণবাবু নাচ থামিয়ে গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে পাশে বসা মামাকে বললেন, “শোন আমি এখন আসি বুঝলি, নেশাটা একটু বেশী হয়ে গেছে, এরপর বাড়ি পৌঁছনো মুশকিল হয়ে যাবে”। ‘দাঁড়া, সুমিতকে বলছি একটা রিকশা ডেকে দিতে’, মামা বলে। “না না কোনো দরকার নেই, নিবারণ এইটুকু মাল খেয়ে টাল খায় না”, বলে নিবারণবাবু সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু কি হল? এত কল এলো কোথা থেকে? সকালবেলা তো ছিলনা। আরে দূর, এটা তো বাথরুমের দরজা, ভুল শুধরে নিবারণবাবু ঠিক দরজা খুঁজে বাইরে এলেন। ভাগ্য ভালো, একটা রিক্সা যেন তাঁর জন্যই ওয়েট করছিল।

বাড়ির দরজায় নেমে গম্ভীরভাবে বেল দিতে গেলেন নিবারণবাবু।কিন্তু কী মুশকিল, নাগাল পাচ্ছেননা কেন? এই কয়েক ঘণ্টায় দরজাটা উঁচু হয়ে গেল নাকি? আজব ব্যাপার তো? ওই যা:, দরজাটা আবার খুলেও যাচ্ছে নিজে থেকে। তিনি তো বেল দেননি।একজন বয়স্ক মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে। নাঃ, নেশাটা একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। “ সরি, ভুল বাড়িতে এসে গেছি’, বলে নিবারণবাবু পিছন ফিরে চলে যেতে চান।কিন্তু সেই বয়স্ক মানুষটি খপ করে তাঁর জামা ধরে ভিতরে টেনে নেন,“ঘরে ঢোক ড্রাঙ্কার্ড কোথাকার, বউমা, মাতালটাকে ভেতরে নিয়ে যাও”। ভদ্রলোকের গলার সঙ্গে বাবার গলার খুব মিল পান নিবারণবাবু।উনি আরও কি সব বললেন গন্ধ নিয়ে, কিন্তু নিবারণবাবু ভালো করে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বয়স্ক মানুষের কথার উত্তর না দেওয়াটা অশোভন, আন্দাজেই নিজের হাতঘড়িটা একটু শুঁকে গম্ভীরভাবে নিবারণবাবু বলেন “সরি স্যার, আপনি ভুল বলছেন, এটায় কোনো গন্ধ নেই”। এটুকু বলে নিবারণবাবু আর পারলেননা, ধপ করে বসে পড়লেন সিঁড়ির তলায়।আউট হয়ে যাবার আগে খালি কানে এল তাঁর ক্লাস টু তে পড়া মেয়ের গলা “ বাবা বড়দের কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছে, কী মজা, কী মজা”!

তারপর যা হল সেটা অন্য গল্প। নিবারণবাবু সেই থেকে পিকনিক একটু এড়িয়ে চলেন। কে জানে আবার কী হয় ।



প্রচ্ছন্ন আততায়ী - গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য || Prachanno Atotai - Gayatri Bhattacharya || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 প্রচ্ছন্ন আততায়ী 

         গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য 




জানালা খুলতেই নন্দিনী দেখলো চাপচাপ কুয়াশা গোটা আকাশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। খুব কাছাকাছি মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চললো, কিন্ত কুয়াশা আর কাটতেই চাইছে না। জানুয়ারি মাসের শেষের দিক, যেমন ঠান্ডা, তেমনই কুয়াশা। মুসৌরিতে অনেক বছর হলো নন্দিনীর বাস, তাই শীতকালে মুসৌরিতে ঠান্ডার হাল- হাকিকত তার জানা। কলকাতার ঠান্ডা এর ধারেকাছে আসতেই পারে না। এই কুয়াশার সময় জানালা খুলে রাখলে ঘরের ঠান্ডা আরও বেড়ে যাবে। এখানে তার নিজের ছোট্ট একটা বাড়ী।বছর পঞ্চাশের নন্দিনী এখানকার একটি বেসরকারী অফিসে চাকরি করে। আজ নেহাতই ছুটির দিন, তাই জানালা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো।


একটু বেলার দিকে নন্দিনীর মনে হলো কুয়াশার চাদর একটু হালকা হয়েছে, সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকি মারছেন। কি মনে হতে জানালা খুললো নন্দিনী। বাইরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে।  ঠিক তার ব্যালকনির নীচে এক ছায়া মূর্তি। ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। নন্দিনী উচ্চৈস্বরে বলে উঠলো,

“—কে! কে ওখানে?”

নাঃ,কোনো সাড়া নেই! তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখলো কেউ কোত্থাও নেই! কদিন ধরেই নন্দিনীর  যেন মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে।কিন্ত কাউকে যে দেখতে পেয়েছে এমনটা নয়। তবুও সন্দেহটা মনে খচখচ করে জানান দিচ্ছে। যদিও সে যে কোনও ঠোস প্রমাণ বা সাবুদ পেয়েছে,তা নয়। 

দূর, কি যে ভেবে চলেছে নন্দিনী।কেন কেউ তার পিছু নেবে! মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে নিশ্চিন্ত হলো।


বেশ কিছুদিন কেটে গেল নন্দিনীর নিস্তরঙ্গ জীবন। একদিন তার মনে হলো মুসৌরি লেক আর কেমপ্টি জলপ্রপাত ঘুরে আসবে। কেমপ্টি ফলসের ওখানে প্রচুর লোক আর দর্শকদের ভীড়। তার চেয়ে  মুসৌরি লেক অনেকটা বেটার, নিরিবিলি। মুসৌরি লেকের ধারে একটা জায়গায় চুপচাপ বসেছিল। আনমনে তার জীবনের পুরোনো কথাগুলো রোমন্থন করে যাচ্ছিল। যত ভাবে সেই ঘটনা মন থেকে মুছে দেবে, কিন্ত বারেবারে সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে,ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তার শরীর -মনকে। গা গুলিয়ে ওঠে নন্দিনীর। 


আনমনা মন সচেতন হয়ে পড়লো যখন নন্দিনীর দুই চোখ কিছুটা দূরে একজনকে দন্ডায়মান দেখলো। কালো ওভারকোট আর টুপি পরা একটা লোক,সে একদৃষ্টে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে! ব্যাপারটা নন্দিনীর খেয়াল হতেই তার বুকটা কেমন চ্যাঁৎ করে উঠলো। স্বগতোক্তি করে উঠলো ,

“—কে! কে ওখানে?”

কোনোরকম কাল বিলম্ব না করে সেই স্থান ত্যাগ করলো। নিজের বাড়ীতে ফিরে এসে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। সারা শরীরটা কেমন যেন করছে। একটা চাপা উত্তেজনা গোটা শরীরকে বিকল করে দিচ্ছে, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে তার মস্তিষ্কে।

সেদিনের তার ঘরের ব্যালকনির নীচে দেখা ছায়ামূর্তিটা আর আজ লেকে দেখা লোকটা হুবহ এক! সেদিনের লোকটাকে ভালোভাবে দেখতে পায় নি,চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল বলে। আজ দিনের আলোতে পরিস্কার তাকে দেখেছে। কিন্ত সে কেন হবে! তার পক্ষে এখানে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় । না না! ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না! নন্দিনীর চেয়ে আর কেউ বেশী জানে না, ‘সে’কিছুতেই নয়। ভুল,সব মনের ভুল। রাত হতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো, নাহলে তার ঘুম আসবে না।


দু- তিন দিন পর অফিসে জয়েন করল নন্দিনী। তার বস নন্দিনীকে ছুটি দেন তাই,নাহলে কি যে হতো। অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলো, পাহাড়ে মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে। ছাতা সঙ্গে রাখতেই হয়। ছাতা থাকলেও সামান্য ভিজে গেল। বাড়ী এসে সদর দরজা খুলে নিজের রুমে ঢুকতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,

“—নন্দিনী “

“—কে ! আমার ঘরে কে?” নন্দিনী জোরে বলে উঠলো।

“—আমি নন্দিনী।“ 

নন্দিনী এবার লক্ষ্য করলো তার ড্রয়িংরুমে কালো ওভারকোট, আর টুপি পরা লোকটা একটা সোফায় গা এলিয়ে বসে রয়েছে। ভয়ে আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকলো।

নন্দিনী পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই সোফায় বসা লোকটি তাকে ধরে ফেললো ,

“—সেকি নন্দিনী ! তুমি যে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলে!”

নন্দিনী একটু ধাতস্থ হতে বললো , 

“—কে আপনি ! কি প্রয়োজন আপনার!  কেনই বা এসেছেন এখানে আমার বাড়ীতে! আর কি আশ্চর্য আমি তো দরজা লক করে বেরিয়েছিলাম,  কি করে আমার ঘরে ঢুকলেন! আপনার সাহস তো কম নয়! আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি,তারপর  কি শাস্তি হয় দেখছি।“ ত্রাস মিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বললো নন্দিনী।


“—হাঃ হাঃ হাঃ, তাই নাকি!  তুমি পুলিশ ডাকবে! আমাক ধরিয়ে দেবে! পারবে পুলিশ ডাকতে! “ 

“—খুব পারবো, একজন অচেনা অজানা লোক আমার ঘরের চাবি চুরি করে কি মতলবে আমার ঘরে ঢুকেছে, সেটা পুলিশ জানতে পারলেই সোজা শ্রীঘরে।” খানিকটা জোরেই কথাগুলো বললো নন্দিনী।

লোকটি আবার হেসে উঠে বললো,

“—সে কি! তুমি জোরে কথা বলছো! ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি! এতো গলার জোর দেখিয়ে বোঝাতে চাইছো যে তুমি আমাকে চেনো না! হাঃ হাঃ ,তাই নাকি!  আমি অবাঞ্ছিত আর তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছি তাই পুলিশকে খবর দেবে!বেশ,ডাকো পুলিশ।”


নন্দিনী পুলিশ ডাকার কথা মুখে বললেও সত্যিই সে ডাকতে পারবে না,  এই কথা তার চেয়ে বেশী কেউ জানে না। কিন্ত এতদিন পর কিভাবে তার উদয় হলো! নাঃ ভুল ভাবছে নন্দিনী, এই লোক ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না।  তাকে যে নিজের হাতে  .....। কিন্ত তাই বা কি করে হয়! লোকটি অবিকল তারই মতো দেখতে! সেই লম্বা, চোখে মুখে হিংস্র কুটিলতা,যেমনটি সে ছিল। শুধুমাত্র গলার স্বরটা একটু অন্যরকম। গলার স্বরের সেই হিমশীতল  বর্বরতার ভয়ে সবসময়ই কাঁটা হয়ে থাকতো নন্দিনী, সেইটা যেন নেই !  এতোদিন পর বলে গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে হয়তো ! কিন্ত কি ভাবছে নন্দিনী! ‘সে’ হতেই পারে না! তাকে নন্দিনী নিজের হাতে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। 

“—এতক্ষণ ধরে কি এতো ভেবে চলেছো মেরে জান, আমার নন্দিনী! ভাবছো যে, এতোদিন পর আমি কিভাবে তোমার বাসায় এলাম! একজন মৃত মানুষ কি করে আসতে পারে, যে মানুষকে তুমি নিজের হাতে খুন করেছিলে! তাহলে আমি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে এলাম কি করে!” 

এই কথাগুলো কঠিন কন্ঠে বলে লোকটি ধীর পায়ে নন্দিনীর কাছে এগিয়ে এলো।

নন্দিনী আঁতকে উঠে দূরে ছিটকে সরে গিয়ে বললো ,

“—আসবে না,আসবে না তুমি আমার কাছে। তুমি একটা পিশাচ, বন্য পশুর থেকেও ভয়ঙ্কর, তোমার মতো নোংরা পাপী লোক একদম আমার কাছে আসবে না। সাবধান বলে দিচ্ছি।“

“—এই তো ম্যাডাম!যাক্ আমাকে চিনতে পারলে তাহলে! হাঃ হাঃ।”

এইরকম সাংঘাতিক নরাধমকে না চেনার উপায় কি আছে নন্দিনীর!  এই মানুষকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিল সে, সারা জীবনের মতো বাবা মাকে পর করে দিয়েছিল।নন্দিনীর বাবা- মা, দাদা কখনও চাননি, নন্দিনী পলাশের মতো বাজে  ছেলেকে বিয়ে করুক। কিন্ত প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। বয়স তখন কম ছিল নন্দিনীর। তাই প্রেমিক পলাশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল,ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সুরক্ষিত নিরাপদ আদরে ঘেরা বাবা মায়ের ভালোবাসার বন্ধনকে। সেই সময়ে পলাশকে ভেবেছিল পরম আপন, আর বাবা মা শত্রু। ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি নন্দিনীর।  কিছুদিন পরেই টের পেয়েছিল পলাশের বিকৃত মানসিকতার আচরণ, কি ভয়ানক,কি ভয়ংকর রূপ।মনে পড়তেই গোটা শরীরের তীব্র কষ্ট হতে শুরু করে নন্দিনীর। একদিন সব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নিজের হাতে পলাশকে .....

“—পলাশ! তুমি কিভাভে আবার ফিরে এলে ! না ,না, তুমি পলাশ নও,তুমি অন্য কেউ!” ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো নন্দিনী।

“—কেন বিশ্বাস হচ্ছে না ম্যাডাম, আমিই পলাশ,  আমাকে তুমি খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলে ! সেই আমি কি করে এতোদিন পর বেঁচে উঠলাম! বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার! কি বলো ?”

“—পলাশ তুমি !! কিভাবে ....! তোমাকে আমি যে যে নিজের হাতে মেরে ফেলেছিলাম! “ 

কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে বলে সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ল। হঠাৎই ঘরের চারদিকের আলোগুলো জ্বলে উঠলো। নন্দিনী  খেয়াল করলো প্রায় আলো- অন্ধকার মেশানো ঘরে পলাশের সঙ্গে কথা বলছিল।  কিন্ত এখন সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল! তার আশ্চর্য হওয়ার রেশ কেটে গেল এক গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে! পাশ থেকে কে বলে উঠলো,

“—তাহলে নন্দিনী ম্যাডাম,স্বীকার করছেন যে আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরীকে নিজে হাতে খুন করেছেন? বাই দ্য ওয়ে, আমি নির্মল বসু গোয়েন্দা বিভাগ লালবাজার, কলকাতা থেকে এই কেসের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্বে আছি। আর যাঁকে আপনি আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরী মনে করেছেন,তিনি আসলে আমার সহকারী প্রচেৎ অধিকারী।”

নন্দিনী এবার দেখলো, প্রচেৎ মাথা থেকে উইগ খুলে ফেললো, তার সঙ্গে নকল গোঁফ দাড়ি। এতক্ষণ যাকে পলাশ বলে ভুল করছিল,সে এখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।

“—ম্যাডাম আপনি বাড়ী বিক্রি করে দেওয়ার পর মুসৌরী চলে আসেন। পরে ঐ বাড়ী হাতবদল হয়ে যায় প্রায় একবছর আগে। বাড়িটি কেনেন এক পুলিশ অফিসার। নতুন নির্মাণের জন্য খনন করতেই বাগানের একপাশে মাটির তলা থেকে একটি কঙ্কাল বেরোয়। ঐ অফিসার ডি.এন. এ. টেষ্ট করাতে জানা যায় উনি পলাশ চৌধুরী। তারপর 'পলাশ চৌধুরী মিসিং' ফাইল রি – ওপেন হয়। এবার আপনি বলুন।”

কথাগুলো শোনার পর নন্দিনী কঠিন স্বরে বলে,

“—আমি পলাশ বিয়ে করার পর বুঝতে পারি সে একটা অমানুষ, সাইকো, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় নি। আমাকে অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা দিয়ে যৌনসুখ পেতো। সে কষ্ট, যন্ত্রণা আর লজ্জার কথা আপনাদের বলতে পারবো না। আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, আমি আস্তে আস্তে পঙ্গু  এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। একদিন এক দুর্যোগের রাত এলো, পুরো কলকাতাকে সুপার সাইক্লোন তছনছ করে দিচ্ছিল। প্রচন্ড ঝড়, প্রশাসন থেকে সতর্ক করে দিয়েছিল। সেই রাতে মদ্যপ পলাশকে ক্ষুর দিয়ে আক্রমণ করি ,সে মদ্যপ ছিল তাই প্রতিহত করতে পারে নি। ক্ষুর দিয়ে আমি ওর শ্বাসনালী কেটে দি। ও বুঝতে পেরেছিল আমি ওর কাছ থেকে শেষ হিসেব চেয়ে নিচ্ছি।  নরপশুটা ছটফট করতে করতে মারা যায়। তারপর বাগানে নিয়ে গিয়ে একটা গর্তের মধ্যে ওকে এবং সমস্ত প্রমাণ মাটি দিয়ে বুজিয়ে দি।ঐ গভীর গর্ত পলাশ তৈরী করেছিল বাগানে সুইমিং পুল বানানোর উদ্দেশ্যে। ঝড়ের রাতে কেউ দেখার মতো ছিল না,তাছাড়া আমাদের বাড়ীটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

দুদিন পর দুর্যোগ কমলে, থানায় গিয়ে’পলাশ চৌধুরী নিখোঁজ’ ডায়েরি করি। সাইক্লোনে গাড়ী চাপা,গাছ চাপা এইসব কারণে বহু মানুষ মারা যায়। আরও দু দিন পর থানা থেকে আমাকে ফোন করা হয়,একটি লাশকে সনাক্ত করার জন্য। একটি ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে চেনার উপায় ছিল না,আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। সেই লাশকে আমি পলাশ বলে সনাক্ত করি,তারপর নিয়ম মাফিক সৎকার করি। আরও বছরখানেক থাকার পর সমস্ত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, আর বাড়ী বিক্রির টাকা নিয়ে চলে আসি মুসৌরিতে। সে প্রায় কুড়ি বছর আগে। এতদিন পর আপনারা .....ভাবতেই পারি নি আমাকে ধরে ফেলবেন!! যাইহোক আমার কোনো আক্ষেপ নেই।  যেখানে নিয়ে যাবেন চলুন...।“


নন্দিনী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।


                

এক রাজকুমারীর কথা - সুমন্ত রবিদাস || Ek Rajkumarir kotha - Sumanta Rabi das || বড় গল্প || Story || Bengali story || Big story || Bengali audio story || Short story

  এক রাজকুমারীর কথা 

                  সুমন্ত রবিদাস

                

                     ১

ধনে জনে পরিপূর্ণ আমরাবতী নগরী, প্রাণের কেন্দ্রস্থল। রাজা অমরেন্দ্রনাথ অমরাবতীকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের পূর্ণ করেছেন। বিশাল রাজপ্রাসাদ, সামনে সরোবর এবং এক পাশে শাহী উদ্যান। এসব কিছুই রাজা অমরেন্দ্রনাথেরই কীর্তি। তিনি তার নগরীকে পরিপূর্ণ করে নির্মাণ করেছেন। অমরেন্দ্রনাথ এর পূর্বে রাজা মহেন্দ্র অমরাবতীকে সৌন্দর্যের নগর হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলেও নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অমরাবতীর শ্রী বিলুপ্ত হয়। এবং সেই সংঘর্ষে মহেন্দ্র মারা যান। মহেন্দ্র মারা যাবার পর রাজা হন অমরেন্দ্রনাথ। তিনি সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের শ্রী ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন খুব বিলাসী এবং সৌন্দর্য পিপাসু রাজা। তিনি অমরাবতী নগরীকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে মুড়ে দিলেন। বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করলেন, সঙ্গে সৈন্য- সামন্তও সংগ্রহ করেন।

      রাজপ্রাসাদের সামনে বিশাল রাজ উদ্যান নির্মাণ করলেন। উদ্যানে নানা রং- বেরং এর ফুলের চারা বসালেন। অপরাজিতা, গোলাপ, গন্ধরাজ, গাঁদা, জুঁই, দোপাটি, মালতি, টগর, সূর্যমুখী প্রভৃতি ফুলের চারা বসালেন। অমরেন্দ্রনাথ প্রত্যহই সে রাজ উদ্যান পরিদর্শন করতে লাগলেন এবং নিজে সেই রাজ উদ্যান পরিচর্যার জন্য চন্দ্র নামে এক যুবককে নিযুক্ত করলেন। চন্দ্র মনে প্রাণে যত্ন সহকারে উদ্যানের ফুল গাছগুলির পরিচর্যা করতে লাগলেন। রাজাও খুশি হয়ে চন্দ্রের পারিশ্রমিককে দ্বিগুণ করে দেন এবং রাজা খুশি হয়ে চন্দ্রকে রাজ পরিমণ্ডলের মধ্যে একটি কক্ষ্ দান করেন। সেখানে শাহী মালি হিসাবে চন্দ্র কাজ করতে লাগল। চন্দ্রের মর্যাদাও বেড়ে গেল। রাজ প্রাসাদের সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত ঘটতে লাগল। প্রহরীরা কেউই তাকে কোনো কাজে বাধা দিত না। কারণ স্বয়ং রাজা অমরেন্দ্রনাথ তাকে এই বিশেষ অধিকার দিয়েছিল। রাজ আজ্ঞাতে তার প্রভাব বেড়ে গেল। চন্দ্র প্রতিনিয়তই ফুলগুলিকে পুত্রস্নেহে পরিচর্যা করতে লাগল। চন্দ্র প্রতিদিন সূর্য ওঠার পূর্বেই উঠত এবং সূর্যের যখন একটু রশ্মি প্রকাশ হত, সূর্যের যখন প্রথম কিরণ ফুলগুলিকে স্পর্শ করত; সেই সময়ই  ফুলগুলি যে আনন্দে দুলে উঠত, সেই অপূর্ব সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করত।

          সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যমুখী ফুলের যে আনন্দে সূর্যের অভিমুখে চেয়ে থাকা, তা দেখতে দেখতে চন্দ্রের এক এক সময় মনে হতো ফুলগুলি যেন সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করছে। সূর্যের প্রথম কিরণ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রার্থনা শুরু হত, এবং শেষ হতো সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে। সূর্যের শেষ কিরণ টুকু পৃথিবীর ছেড়ে চলে যেত এবং তারা আবার একটা সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করত। রাত্রের শান্ত পরিবেশে তারাও যেন ঘুমিয়ে পড়ত‌। সূর্যমুখী ফুলের সেই চলার দৃশ্য পূর্ব হতে পশ্চিমে প্রতিনিয়ত চন্দ্র ফুলের সামনে বসে দেখত আর নানান কল্পনা তার মনের মধ্যে ভেসে আসত।

         রাজা অমরেন্দ্রনাথ প্রাতঃ ভ্রমণে বের হতেন প্রতিনিয়তই। তিনিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তার সাধের উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। তারপর তিনি রাজকার্যে মন দিতেন। রাজকার্যে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। কখনো অন্যায় বিচার তিনি করেননি। তবে তার চরিত্রে কিছু কিছু ত্রুটিও ছিল। তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী আচার-বিশ্বাসের পক্ষপাতী। রাজ মর্যাদার হানি ঘটুক এমন কার্য তিনি কখনো করেননি এবং কাউকে করতেও দেননি।

       অমরেন্দ্রনাথ একমাত্র দুর্বল ছিলেন তার মেয়ে চন্দ্রিমার প্রতি। চন্দ্রিমা জন্মের ছ’ বছর পরে তার মা মারা যায়। সেই থেকেই চন্দ্রিমা পিতার কাছেই প্রতিপালিত। খুব স্নেহে অমরেন্দ্রনাথ তাকে মানুষ করেছেন। তার মা মল্লিকার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে মস্ত বড়ো রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার। ইচ্ছা থাকলেও তার মার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হবার আগেই দুরারোগ্য রোগে মারা যান, ফলে ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে যায়। সেই অপূর্ণ ইচ্ছাকেই অমরেন্দ্রনাথ পূর্ণ করার শপথ গ্রহণ করেন। অমরেন্দ্রনাথ মেয়েকে কোনো কিছুর জন্য অভাব বোধ হতে দেননি। সবকিছু চাওয়ার আগেই চন্দ্রিমা পেয়ে যেত। কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল রাজ্যে, সেটা হল নিরাপত্তার অভাব। নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব প্রচন্ড প্রতাপশালী। অতীতেও নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে রক্তক্ষয় সংঘর্ষে অমরাবতীর শ্রী বিলুপ্তি ঘটেছিল। অমরেন্দ্রনাথ ভালোভাবেই জানতেন নারায়নী রাজ্যের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। অমরাবতীও পরিপূর্ণ সুরক্ষিত ছিল না। এইতো সবে মাস দুয়েক হবে বিক্রম দেবের গুপ্তচর ধরা পড়েছিল রাজপ্রাসাদের ফটকের বাইরে। সেই থেকে অমরেন্দ্র খুব সচেতন। তার একমাত্র মেয়ে চন্দ্রিমাকে সে কিছুতেই বিপদের মধ্যে ফেলতে চায় না। এজন্য চন্দ্রিমার আশ্রয় সব সময় রাজপ্রাসাদের ভিতরেই, বাইরে বেরোনোর তার অধিকার নেই।

          রাজকুমারীকে পাহারা দেবার জন্য ভদ্রমল্ল নামে এক প্রহরীকে নিযুক্ত করেন নিযুক্ত করেন। রাজকুমারীর প্রকৃতি ছিল চঞ্চল। সব সময়ই বাইরে যেতে চেষ্টা করতেন কিন্তু ভদ্রমল্লের কড়া পাহারা এড়িয়ে যাওয়া তার সাধ্য ছিল না। ফলে তাকে সব সময় রাজপ্রাসাদের কক্ষেই বসে থাকতে হত। কক্ষের ভেতরেই রাজা তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কক্ষের মধ্যে তার প্রধান সখী ছিল সুনয়না। সব সময় তার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু কক্ষ মধ্যে রাজকুমারীর কোনো মতে ভালো লাগত না। সব সময় মন চাইতো বাইরে যাবার কিন্তু ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না। ফলে মনে নানা প্রশ্ন জাগত। সব প্রশ্নের উত্তর সখীর কাছ থেকেই পাওয়ার চেষ্টা করত।

       সখী আমি কেন বাইরে যেতে পারি না? আমারও ইচ্ছে হয় বাইরে যেতে, এই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দিগন্তে মিশে যেতে!

      কক্ষ থেকে বাতায়ন পথে রাজ উদ্যানের ফুলগুলিকে দেখে সুনয়নার কাছে প্রতিনিয়তই এ প্রশ্ন করতেন। সুনয়না এ প্রশ্নের উত্তরে বলতেন, আমি জানিনা রাজকুমারী। হয়তো তোমার ভালোর জন্যই তোমার পিতা তোমাকে রাজপ্রাসাদের বাইরে বেরহতে দেয় না। আর তুমি বাইরে বেরিয়েই বা কি করবে তোমার যা প্রয়োজন তা তুমি আমাকে বল আমি এখানেই এনে দেব।

        প্রতিনিয়তই সুনয়নার এ উত্তর শুনে চন্দ্রিমার মন খারাপ হয়ে যেত। রাজ উদ্যানে কত রকমের ফুল ফুটেছে, সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। অলি সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর গুনগুন শব্দের গান গেয়ে গেয়ে চলছে। রাজকুমারী এইসব দৃশ্য রাজকক্ষে বসে বসে প্রতিনিয়তই বাতায়ন পথ হতে দেখত আর মনে মনে ভাবত, আমিও যদি সেই অলি হতে পারতাম তাহলে আমিও ফুলের মধু পান করে তাদের সঙ্গে গান করতাম এবং সেই ফুলের উপর শুয়ে পরতাম ক্লান্ত শরীরে। আর বসন্ত বায়ু আমার সেই ক্লান্তি মুছে দিত!

         প্রতিনিয়তই চন্দ্রিমা রাজপ্রাসাদের জানালা দিয়ে শাহী উদ্যানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখত এবং মনে মনে কি যেন ভেবে মন উদাস হয়ে যেত। প্রতিনিয়ত রাজকুমারী চন্দ্রের উদ্যান ভ্রমণ এবং ফুলের সামনে বসে যে ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলত, তাদের খেলা দেখত, তাদের আনন্দে সেও আনন্দিত হত, সেইসব দৃশ্য গুলিই দেখত আর মনে মনে হাসত। আবার মনে ইচ্ছেও হত, সেও যদি এমনই ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলতে পারত, খেলতে পারত, তাদের স্পর্শ করতে পারত! কিন্তু এসব কিছু থেকে রাজকুমারী শত যোজন দূরে। মনে কল্পনা করতে পারলেও এসব যে কোনোদিনও সম্ভব হবে তারা রাজকুমারী ভাবতে পারে না।

        প্রতিনিয়ত এই দৃশ্য দেখতে দেখতে রাজকুমারীর মনের মধ্যেও এক উন্মাদনার সৃষ্টি হতে লাগল। মনে হতে লাগল এই বন্ধন ভেঙে এক্ষুনি রাজ উদ্যানে ছুটে যেতে। এমন সময় দেখল তার পিতা রাজ উদ্যানে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। এমন সময় রাজকুমারী ছুটে বাইরে বের হতে গেল কিন্তু ভদ্রমল্ল তাকে যেতে  দিল না। ফলে রাজকুমারী রেগে গিয়ে ইতস্ততভাবে রাজপ্রাসাদের এখানে- ওখানে ছুটতে লাগল আর তার পেছনে পেছনে ভদ্রমল্ল ছুটতে লাগল। রাজকুমারী যখন যেটা পাচ্ছে সেটা ছুড়ে মারছে মল্লভদ্রকে লক্ষ্য করে। রাজকুমারীর এই গতি দেখে ভদ্রমহল্য রাজাকে খবর পাঠাল। রাজা তাড়াতাড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল। একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে অমরেন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়ে মেয়েকে বলল, রাজকুমারী এরকম আচরণ কেন করছ? তোমার যা প্রয়োজন তুমি আমাকে বল, আমি এক্ষুনি তোমাকে তা এনে দেব। তুমি যদি এই আকাশের চাঁদটাকেও চাও আমি তাকেও এক্ষুনি তোমার কাছে এনে দিচ্ছি এই মুহূর্তে।

         কিন্তু আমি তো আকাশের চাঁদটাকে চাই না বাবা! আমি চাই মুক্তি। মুক্তির দিগন্তে আমি ছুটতে চাই। আমি চাই এই বন্ধন থেকে মুক্তি।

       তুমি তো মুক্তই আছ রাজকুমারী। তোমার যা চাই আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।

       আমি রাজপ্রাসাদ থেকে মুক্তি চাই। আমি ওই রাজ উদ্যানে যেতে চাই যেখানে চন্দ্র ফুলের সঙ্গে খেলে।

        কিন্তু রাজকুমারী তুমি তো সেখানে যেতে পারবে না।

       কিন্তু কেন পিতা? আমি কেন যেতে পারব না?

        তুমি রাজকুমারী। এই রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী।

       কেন পিতা আমি কেন যেতে পারব না? আমি রাজকুমারী হয়েছি তো কি হয়েছে, আমিও তো আর পাঁচটা মানুষের মতো। চন্দ্র যেখানে বাগানে ফুলের সঙ্গে খেলে তাহলে আমি কেন পারব না?

        কারণ তুমি রাজকুমারী। এই রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। রাজ্য শাসন তোমাকেই করতে হবে। তোমার প্রাণের সংশয় রয়েছে। তুমি আর পাঁচজনের মতো নও রাজকুমারী। আর ওই চন্দ্র ওত রাজ মালি, তার ঐ কাজই।

         তাহলে আমি কেন একবারও চন্দ্রের কাছে যেতে পারব না? আমিও চন্দ্রের মতন ফুলের সঙ্গে খেলতে পারব না কেন? আমি তো এই রাজ প্রাসাদ চাই না, রাজ কার্য চাইনা। আমি চাই আমার এই বন্ধন থেকে মুক্তি। আমি চাই মুক্ত দিগন্তে ঘুরতে, মনের মতোন ছুটতে, নাচতে।

         তোমার ভালোর জন্যই আমি এ কাজ করেছি রাজকুমারী। তুমি হয়তো ভুলে গেছো বা তোমার মনে নেই তোমার জ্যেষ্ঠর সঙ্গে কি ঘটেছিল—

        বলতে বলতে চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আর কিছু বলতে পারল না। রাজকুমারীও চুপ করে গেল। অতীতের জ্বলন্ত স্মৃতি যেন আবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন রাজকুমারী ছোট ছিল প্রায় ছয় বছরের হবে। সদ্য তার মা গত হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সময় অমরাবতী শোকে মগ্ন ছিল সেই সুযোগ নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায় বিক্রমদেব। সেই আক্রমণ কোনোরকমে  অমরেন্দ্রনাথ প্রতিহত করে। এতে অমরাবতী নগরীরও ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সব থেকে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছিল সেটা হল রাজকুমার জয়ের মৃত্যু। শোকের উপরে শোক। এক শোক থেকে উঠতে না উঠতেই অকস্মাৎ আর এক শোকের ছায়া এসে পড়ল। একমাত্র রাজপ্রদীপ নির্বাপিত হল। বিক্রম দেবের ছোড়া তীরে বৃদ্ধ হয়ে রাজকুমারের প্রাণ ত্যাগের ঘটনাটা আবার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরনো এক ছবির মতোন! রাজকুমারীর চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই কৈশোরের বিষাদময় স্মৃতি ভুলে গিয়েছিল রাজকুমারী, কিন্তু আবার সেই কথা স্মরণ হয় মনটা বিষাদে ভরে গেল। সেই সময়ের অনেক কথাই তার মনে নেই, অমরেন্দ্রনাথেরও সেই স্মৃতি স্মরণ করানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না। সেই দুঃখের ছায়া কাটিয়ে উঠেছিল, রাজকুমারীও ভুলে গিয়েছিল পিতার আদর -স্নেহে। মেয়ের এই চঞ্চল অবস্থা দেখে অমরেন্দ্রনাথ না বলতে চাইলেও মুখ থেকে হঠাৎ যেন বেরিয়ে গেল কিন্তু সম্পূর্ণ বেরল না। তার আগেই চোখে জল চলে আসল, অমরেন্দ্রনাথ কাঁদো কাঁদো চোখে আর দাঁড়িয়ে না থাকতে পেরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও বিমনা হয়ে পড়ল এবং আবার জানালার কাছে বসে বাইরে চেয়ে থাকল। চেয়ে দেখতে দেখতে মন বিষাদে ভরে উঠল।

                                   

                                    ২

      প্রতিদিনের মতো চন্দ্র আজও সকালে উদ্যানে ফুল গাছগুলির পরিচর্যা করছে এবং রাজকুমারীও এই সময় কক্ষ থেকে জানালা পথে চন্দ্রের হাসির সঙ্গে ফুলের হাসি দেখছে। ফুলগুলি বাতাসে নাচছে আর হাসছে, চন্দ্রও তা দেখে হাসছে। চন্দ্রের হাসির সঙ্গে ফুলের হাসি মিলে যাচ্ছে। রাজকুমারী রাজপ্রাসাদের কক্ষ থেকে দেখছে আর মাঝে মাঝে চন্দ্রকে দেখে হাসছে।

         রাজকুমারীর কক্ষের ঠিক নিচে সামনেই রাজ উদ্যানের অবস্থান ছিল। ফলে রাজকুমারী কক্ষ থেকে বসেই সবকিছু দেখতে পেতেন। ত্রিতলের একটি কক্ষে বসে প্রতিদিন প্রাতঃকালে চন্দ্রের খেলা দেখত। রাজাও এই সময় উদ্যান ভ্রমনে বের হতেন এবং ফুলের মিষ্টি সুগন্ধি বায়ু উপভোগ করতেন। রাজকুমারী উপর থেকে সবকিছুই দেখতেন। এভাবে রাজকুমারী প্রতিদিন চন্দ্রকে দেখত মুগ্ধ নয়নে আর আপন মনেই মাঝে মাঝে কি যেন মনে করে হাসত। আজকেও রাজকুমারী সকালে উঠে চন্দ্রকে দেখে দেখে হাসছে, ঠিক সেই সময় সুনয়না প্রবেশ করল। সখী সুনয়না রাজকুমারীর এই অবস্থা দেখে বলল, সখী তোমার কি পছন্দ হয়েছে। তাহলে বল আমি তোমার পিতাকে এক্ষুনি বলি।

         সখীর এই রসিকতা রাজকুমারীর মনে আঘাত দিল। কারণ রাজকুমারীও জানত তার ইচ্ছার কোনো দাম নেই। এখানে সে একটা বন্দীর মতো আছে। যার সামান্য বাইরে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই,আর সেখানে সখীর এই রসিকতা রাজকুমারীর মনকে ব্যাথা দিল। রাজকুমারীও তার উত্তরে বলল, সখী কি আর চাইব আমি! আমি কি কোনো কিছু পাওয়ার যোগ্য! চাই তো অনেক কিছু, পাই না কিছুই!

      কিন্তু তুমি যাই বল সখী চন্দ্র কিন্তু দেখতে খারাপ না।

     আমি কি খারাপ বলেছি সখী?

      তাহলে তুমিও মানছ চন্দ্র ভালো দেখতে। অবশ্য তোমার পাশে মানাবেও ভালো।

       সখী তুমি ছাড় রসিকতা। আমার আর এসব ভালো লাগছে না।

      এই বলে রাজকুমারী আবার বিমনা হয়ে গেল। সুনয়নাও একটু হেসে আর কিছু বলল না। কিন্তু মনের মধ্যে সখীর কথাটা গভীরে দাগ কেটে গেল। সত্যিই তো রাজকুমারী এতদিন চন্দ্রকে দেখে হেসেছে গোপনে গোপনে কিন্তু কখনো এ কথাটা তো ভাবেনি। হঠাৎ সখীর মুখে এই রসিকতা শুনে তার মনের অন্ধকারে যেন এক দীপশিখা জ্বলে উঠল। মনে হতে লাগল সখী যা বলেছে তাতে তো ভুল নেই। আজ চোখের সামনে দেখা জিনিসকে আবার নতুন করে, নতুনভাবে, নতুন রঙে দেখতে পেল। এতদিন মনের মধ্যে যে অন্ধকার জমে ছিল সখীর কথায় তা দূর হল। কিন্তু এখনো ভাবনা একটাই, এখান থেকে কেমন করে সে চন্দ্রের কাছে যাবে। কারণ তার বাইরে যাওয়া তো নিষেধ। এক চোখে আনন্দ, এক চোখে বিষাদ নিয়েই আর একবার পুরনো দেখা চন্দ্রকে নতুন ভাবে দেখল। আর সখীর কথাটাই বারবার মনে হতে লাগল। চন্দ্র কিন্তু দেখতে খারাপ নয়…অবশ্য তোমার পাশে মানাবেও ভালো। এই কথাগুলোই তার মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। বিষাদের মধ্যেও মনের মধ্যে এক আনন্দের ভাব অনুভূত হতে লাগল। এই প্রথম রাজকুমারীর চোখে মুখে এক আনন্দের ভাব লক্ষ্য করা গেল। সখী সুনয়নাও তার মনের অবস্থা দেখে একবার একটু হাসল। এই হাসি বলে দিল রাজকুমারীর মনের মধ্যে পূর্ব রাগের উদয় হয়েছে।

       এদিকে নারায়নী রাজ্যের রাজা বিক্রমদেব আবার অমরাবতী জয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল গোপনে গোপনে। পুরনো আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে আবার জেগে উঠল তার। এর পূর্বে অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো সফলতা আসেনি, বারবার পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এবার বিক্রমদেব তার অপূর্ণ ইচ্ছা যে করেই হোক পূর্ণ করার শপথ গ্রহণ করল। এবং এই মর্মে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি বীরায়কে ডেকে পাঠালেন এই বিষয়ে যুক্তি -পরামর্শ করার জন্য। সিদ্ধান্ত হল গুপ্তচর ভিত্তিকে আবার সক্রিয় করতে হবে। অমরাবতীর সমস্ত গোপন অস্ত্র ভান্ডারের হদিশ আনতে হবে। এর সঙ্গে রাজ্যের কামারশালাকে নির্দেশ দেওয়া হল অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর জন্য।

         বিক্রমদেবের গুপ্তচর বৃত্তির জন্য টিয়া গুলিকে ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করলেন। এই মর্মের রাজ্যে ঘোষণা করা হল, যে ব্যাধ টিয়া ধরে রাজাকে দেবে রাজা তাকে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করবে।

        এই ঘোষণা শোনার পর রাজ্যের যত ব্যাধ ছিল সকলেই পুরস্কারের আশায় রাজ দরবারে এসে ভিড় জমালেন। বিক্রমদেব সবার বুদ্ধি বিদ্যার পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষায় হারু নামে এক ব্যাধ যায় যুক্ত হলেন। রাজা তাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে, টিয়া ধরার জন্য বিদায় দিলেন। হারু খুশি মনে স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে রাজাকে প্রণাম করে হাতে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়লেন। বিক্রমদেবও হারুর বিদ্যা- বুদ্ধি দেখে আশ্বস্ত হলেন।

        হারু রাজ্যের বনে বনে ঘুরে টিয়া গুলিকে তাড়া করতে লাগল কিন্তু কোথাও টিয়া ধরতে পারলেন না। এদিকে টিয়া না ধরতে পারলে রাজা আবার তার গর্দান নিবে। এই ভয়েই হারু সমগ্র দিনে এই বনে তো কখনো ওই বনে ঘুরতে থাকলেন কিন্তু কোথাও একসঙ্গে দু-একটির বেশি টিয়া দেখতে পেল না। হারু বিষন্ন মনে সব শেষে অমরাবতীর পার্শ্ববর্তী এক বনে প্রবেশ করে দেখল সেখানেও কোনো টিয়ার সন্ধান নেই। বিষন্ন মনে তিনি ভাবলেন, আজকে বোধ হয় রাজ্য থেকে টিয়া উধাও হয়ে গেছে। বোধহয় তারা আগেই জানতে পেরে কোথাও লুকিয়েছে। এমন অবস্থায় হারু দেখল সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে অথচ একটি টিয়ারও দেখা নেই। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝাঁকটিয়া উড়ে এসে হারু যে গাছের নিচে বসে ছিল ঠিক তার থেকে একটু দূরে বসল এক গাছের ডালে।

         এক ঝাঁক টিয়া দেখে হারু যেন প্রাণ ফিরে পেল। তৎক্ষণাৎ হারু কৌশল করে জাল পাতল এবং অদূরে ঝোপের মধ্যে বসে থাকল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও একটি টিয়াও ফাঁদে পড়ল না। এই দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন অবস্থায় কি করবে ভেবে না পেয়ে রাগের মাথায় হঠাৎ সামনে ডালে বসা একটি টিয়াকে তাক করে তীর ছুড়ল। তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গাছের ডালে লাগল। ফলে টিয়া গুলি উড়ে যেতে লাগল। এই দেখে হারু তাদের পেছন পেছন ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে অমরাবতীর সীমানায় এসে পৌঁছাল। এদিকে অমরাবতী রাজ্যের রাজা অমরেন্দ্রনাথ রাজ্যের অনেকদিন হল পশু বা পাখি শিকার করা নিষিদ্ধ করে দেয়। রাজ অনুমতি ব্যতীত কেউ পশু বা পাখি শিকার করলে রাজআজ্ঞাই তার প্রাণদণ্ড নিশ্চিত জেনে হারু আর এগোলো না। অমরাবতী রাজ্যের সীমানা থেকে ঘুরে আসল।

          এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসাতে একটি টিয়া দলছুট হয়ে রাত্রে আঁধারে পথ ভুলে অমরাবতী রাজ্যে প্রবেশ করল। কোথায় যাবে কিছু বুঝতে না পেরে রাত্রের অন্ধকারে উড়তে উড়তে প্রাণের ভয়ে রাজ উদ্যানে এসে আশ্রয় নেয়। রাজ উদ্যানে অমরেন্দ্রনাথ ছায়ার জন্য কিছু বড়ো বড়ো গাছ লাগিয়েছিলন।তার একটি গাছে এসে সেই দলছুট টিয়াটি আশ্রয় লাভ করে।

        হারু টিয়া ধরতে না পেরে মনদুঃখে সেই রাত্রেই রাজ্য ছেড়ে চলে যায়। ফলে বিক্রমদেবের ইচ্ছা অপূর্নই থেকে গেল।

        রাত্রের সেই ভয়ে টিয়াটি সেই গাছেই রাত্রি কাটানোর পর পরদিন সকালে কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে রাজ উদ্যানের এ গাছ থেকে ওগাছে উড়তে লাগল কিন্তু যাওয়ার কোথাও কূলকিনারা খুঁজে না পেয়ে উদ্যানের বাইরেও যেতে পারল না প্রাণভয়ে। ফলে রাজ উদ্যানই তার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল।



                                    ৩

        রাজকুমারী যখন চন্দ্রকে দেখছে আর হাসছে ঠিক এমন সময় চন্দ্রের দৃষ্টি রাজকুমারীর উপর পড়ল। রাজকুমারী একটু হেসে আবার লুকিয়ে গেল জানালার আড়ালে। চন্দ্র একটু হেসে পুনরায় আবার তার কাজে মন দিল। চন্দ্রও ভাবতে থাকল কার দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলিত হল, যেন মনে হল রাজকুমারী। কি অপরূপ চোখের চাহনি মিষ্টি হাসি ভরা! হাসি দেখলেই যেন সব দুঃখ ভুলে যায়, এমনই ছিল সেই হাসিটি। কিন্তু বিদ্যুতের ঝলক এর মতো একবার দেখা দিয়েই লুকিয়ে গেল! সেই কালো চোখ দুটো যেন বুকে এক জ্বালা তৈরি করছে। সেই চোখের তীরে চন্দ্রের মন যেন উদাসীন। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল কে ছিল সেই মেয়েটি? এমন চোখের চাহুনি কার এই রাজপ্রাসাদে? সে কি রাজকুমারী, না অন্য কেউ?

        মনের মধ্যে এমন অনেক শতশত প্রশ্ন উঠতে লাগল চন্দ্রের মনে। মন অশান্ত হতে শুরু করল। এতদিন ফুলগুলিকে ভালো লাগত, প্রতিনিয়ত সেই ফুলগুলির দুলে ওঠা, নেচে ওঠা, সূর্যমুখী ফুলের সেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাত্রা এগুলি দেখতে যেন আর ভালো লাগল না। কিছুক্ষণ পরে উদাসীন মন নিয়ে চন্দ্র তার কক্ষে চলে আসল। কক্ষে আসার পর থেকেই সেই চোখের চাহুনি আর ঠোঁটের হাসির ছবিটাই মনে ভেসে আসতে লাগল। ফলে কোনো কাজই তার আর ভালো লাগল না।

       চন্দ্র  এতদিন রাজকুমারীর কথা দু-তিনবার শুনেছিল, কিন্তু চোখে কখনো দেখেনি চন্দ্র। শুধু শুধুই সুনাকেই একবার দেখেছিল, সেওবা দূর থেকে। চন্দ্রিমার চাহুনির সেই তীব্র তীর হৃদয়কে যে যুদ্ধ করল তার থেকে মুক্তির উপায় কি?

       সুনয়না কক্ষে প্রবেশ করেই রসিকতার ছলে আবার বলল, সখী তোমার মন এত উতলা কেন? কার কথা ভেবে মন উদাসীন?

         কার কথাই বা ভাবব সখী। কেইবা আছে, যার কথা ভাবব।

       আছে সখী আছে তোমার মনে আছে যে।

        তুমি ছাড়া আমার মনে আর কেইবা আছে সখী।

       শুধু আমি, আর কি কেউ নেই?

        আর কেইবা আছে।

        তুমি নিজের মনে ভেবে দেখো সখী ঠিক উত্তর পাবে। যার জন্য তোমার মন খারাপ হয়, সে কি ওই চন্দ্র?

          সখী তুমি যে কি বলছ আমি তো বুঝতেই পারছি না। সে তো রাজমালি আর আমি—

          প্রেমে কোনো ভেদ হয় না সখী—

          চন্দ্রিমা বলল ঠিকই সে রাজমালী আর আমি রাজকুমারী কিন্তু মন যেন তা মানল না। মুখ দিয়ে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু মন থেকে মানাটা অনেক কঠিন। রাজকুমারীর মনও মানতে চাইছিল না মালি আর রাজকুমারীর ভেদকে। মন যেন বলছিল প্রেমে কোনো ভেদ হয় না।

          রাজকুমারীর মনে মনে এমন অনেক ভাবনা আসছে, ঠিক সেই সময় অমরেন্দ্রনাথ কক্ষে প্রবেশ করল। ফলে রাজকুমারীর ভাবনাতে ছেদ পড়ে গেল। একটু আশঙ্কার সুরেই অমরেন্দ্রনাথ বলল, রাজকুমারী এবার তোমাকে অস্ত্র শিক্ষা নিতে হবে। অস্ত্র চালনা শিখতে হবে।

         রাজকুমারী কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কিন্তু পিতা কেন? হঠাৎ কি হল যে আমাকে অস্ত্র শিক্ষা নিতে হবে?

          অমরেন্দ্রনাথ রাজকুমারীকে প্রকৃত কারণটি না বলে শুধু বলল, তুমি এখন যথাযথ বড়ো হয়েছ। এখন আমার বয়স হয়েছে, আর আমি একা কতদিন রাজ্য সামলাব। এবার থেকে তোমাকেও রাজকার্য বিষয়ে পারঙ্গম হতে হবে। আমার পরবর্তীতে তোমাকেই তো রাজ্যের ভার নিতে হবে। তার জন্য এখন থেকেই তোমাকে তৈরি হতে হবে।

          কিন্তু পিতা আমার এসব ভালো লাগে না।

        ভালো না লাগলেও কিছু কিছু কাজ আমাদের করতে হয়। আর তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। তুমি তো বুঝতে পারছ রাজকার্য তোমাকে শিখতেই হবে।

          কিন্তু পিতা—

          কোনো কিন্তু না। আমি তোমার আর কোনো কথা শুনবো না। কালকে তোমাকে রাজ মন্দিরের পূজো দিয়ে অস্ত্র গুরু বিজয় দেবের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে হবে। কাল প্রাতঃকালে স্নান সেরে প্রস্তুত থাকবে আমি তোমাকে এসে নিয়ে যাব।

         অমরেন্দ্রনাথ রাজকুমারীর কক্ষ থেকে বাইরে বের হতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় সুনয়নার প্রবেশ করতেই অমরেন্দ্রনাথ বলল, কালকে রাজকুমারীকে প্রাতঃ স্নান তৈরি রাখো, রাজকুমারীর অস্ত্র শিক্ষা শুরু হবে।

         জি মহারাজ।

        অমরেন্দ্রনাথ কি বলে গেল সুনয়না ঠিক বুঝতে পারল না। সঠিক বুঝতে না পারার জন্যই রাজকুমারীর কাছে এসে অস্ত্রশিক্ষার কথাটা জানতে চাইল। চন্দ্রিমা তাকে সব কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পিতা যা যা বলল সবগুলো সুয়নাকে বলল। কিন্তু প্রকৃত কারণটা কি সেটা না সুনয়না বুঝতে পারল, না চন্দ্রিমা। সুনয়না ভাবতে লাগল হঠাৎ রাজার এহেনও নির্দেশের কারণ কি। রাজ্যে কি কোন অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছে? কিন্তু কোনো মতেই প্রকৃত কারণ বুঝতে পারল না।

        অমরাবতীতে কয়েকদিন আগে যে গুপ্তচর ধরা পড়েছিল নারায়নী রাজ্যের সেখান থেকেই রাজা আজকে খবর পেয়েছে যে বিক্রমদেব পুনরায় অমরাবতী রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। আর কিছু খবর গুপ্তচর দিতে না পারলেও অমরেন্দ্রনাথ এর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, রাজ্যে কোনো এক অজানা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আবার রাজকুমারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও মনে নানান ভাবনা ভেসে আসতে থাকে। এক রক্তক্ষয় যুদ্ধে তার পুত্র মারা গেছে, আবার এক না জানা কি বিপদ আসছে, সেখানে আবার কি হয়। একথা ভাবতে গিয়ে প্রাণ যেন আঁকতে উঠছে। তাই সময় নষ্ট না করে রাজকুমারীর অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ভাবলেন। এই মর্মে অস্ত্রগুরু বিজয় দেবকে রাজপত্র পাঠালেন এবং রাজকুমারীকে তার জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথাও বলে এলেন। এতেও অমরেন্দ্রনাথ দুশ্চিন্তা গেল না। রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা আরো বাড়ালেন। রাজ্যের সীমানাগুলিতে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করলেন এবং রাজ্যের কামারশালা গুলিকে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। রাজ নির্দেশ পেয়ে রাজ্যের কামারশালা গুলি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল।

         পিতার নির্দেশের পর রাজকুমারীর মন আরো অশান্ত হয়ে উঠল। মনে হল সে জেলখানায় বন্দি আছে, প্রত্যেকটা নির্দেশ তাকে মানতে হবে। তার কোনো ইচ্ছার মূল্য নেই। রাজকুমারী সখীকে বলল, সখী আমি অস্ত্রশিক্ষা নিতে চাই না। অস্ত্রশিক্ষা করতে আমার ভালো লাগে না। আমি চাই এই বদ্ধ কারাগার থেকে মুক্তি।

        তুমি বুঝছো না কেন সখী। পিতা যা তোমাকে বলবেন তা তোমার ভালোর জন্যই বলবেন। আর এটা রাজপ্রাসাদ, কারাগার ন। আর এই রাজপ্রাসাদের জন্য কত কে লালায়িত হয়ে আছে তা তুমি বুঝতে পারছ না।

       আমি এই রাজপ্রাসাদ চাই না, চাই মুক্তি—

       তার জন্য তোমাকে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে হবে। অস্ত্রবিদ্যা শিখলেই তুমি পিতাকে বলতে পারবে যে, তুমি এখন নিজের রক্ষা নিজেই করতে পারবে। তখন তোমার জন্য পিতার আর কোনো ভয় থাকবে না। পিতা তোমাকে তো সেই ভয়ের জন্যই বাইরে যেতে দেয় না।

         কিন্তু পিতা তাতেও যদি বাইরে যেতে না দেয়।

        তাহলে সখী একটি উপায় আছে। তুমি তোমার পিতাকে বলবে, আমি একটি শর্তেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করব। তারপর তুমি তোমার বাইরে বেরোনোর কথাটা বলবে। তোমার পিতা তাতে নিশ্চয়ই অমত করবেন না।

         কিন্তু সখী আমাকে যে ভালই লাগেনা অস্ত্রবিদ্যাশিক্ষা করতে।

         তুমি অস্ত্র শিক্ষা না শিখলে তুমি রাজ্য শাসন করবে কেমন করে। আর তুমি বাইরেও যেতে পারবে না। তোমাকে এই রাজপ্রাসাদের ভেতরেই থাকতে হবে।

        সখীর কথা শুনে রাজকুমারীও শেষ পর্যন্ত অস্ত্র শিক্ষাতে রাজি হয়ে যায় কিন্তু একটি শর্তের বিনিময়ে। সেই শর্তের কথা সুনয়না গিয়ে রাজাকে জানায়। অমরেন্দ্রনাথ প্রথমে তা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে রাজকুমারীর জেদে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে রাজকুমারী রাজ উদ্যান পর্যন্তই যেতে পারবে এবং তার সঙ্গে দেহরক্ষ হিসাবে ভদ্রমল্ল থাকবে সব সময়। রাজকুমারী এতে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও সুনয়নার কথাতে এই শর্ত মেনে নেয়।

         রাজ নির্দেশ মতো রাজকুমারী প্রাতঃকালে স্নান সেরে সখী সুনয়নার সঙ্গে রাজ মন্দিরে পুজো দিতে প্রস্তুত হন। রাজা অমরেন্দ্রনাথ প্রস্তুত হয়ে মেয়েকে রাজ মন্দিরে বাদ্য বাজনার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। রাজকুমারী, সখী সুনয়না এবং অমরেন্দ্রনাথ মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে। রাজকুমারীর এই মন্দির যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য রাজ্যের নানাস্থান থেকে প্রজারা এসে ভিড় জমান। এরকম দৃশ্য তারা সচরাচর দেখতে পান না। অনেকদিন হল যখন রাজকুমারীর মা জীবিত ছিল, সেই সময় এইরকম মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার সময় খুব ধুম হত। তারপর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে গেল আর ধুমও বন্ধ হয়ে গেল। রাজকুমারীর আবার মন্দিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকের মনে আবার সেই পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠল। সমগ্র অমরাবতী যেন এই আনন্দে মেতে উঠল। কিন্তু কেউ জানতে পারল না এর পেছনে রাজার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল। রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ক্রোশ খানেক পথ। সমগ্রপথ জুড়ে আচার অনুষ্ঠানের ধুম চোখে পড়ার মতো। আবার রাজ মন্দিরও উৎসবে মেতে উঠেছিল। মন্দিরের বাহির ফটক থেকে শুরু করে গর্ভ গৃহ পর্যন্ত সমগ্র মন্দির যেন আলোর রোশনাই মেতে উঠেছিল। স্থানে স্থানে প্রদীপ, বিচিত্র কারুকার্য করা ঝালর, স্থানে স্থানে বাধ্য- বাজনা, নৃত্য- গীত যেন এক অপূর্ব উৎসবে মেতে উঠেছিল অমরাবতী।

        বাইরে সমগ্র সেনানী এবং দাস-দাসীদের রেখে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলো শুধু রাজা, রাজকুমারী এবং সখী সুনয়না। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র গুলি বন্ধ হল। রাজকুমারী লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে আরতী শুরু করে দিল। তারপর পূজো শুরু হল। যথাসময়ে পুজো শেষ করে রাজকুমারী মন্দিরের কুল দেবতাকে প্রণাম করে, তারপর পুরোহিতকে প্রণাম করে, আশীর্বাদ নিয়ে, মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করে আবার রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

          রাজকুমারীর এই প্রথম বাইরের জগতে তার পদার্পণ। বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখে রাজকুমারীর যেন মনটা একেবারে ভরে গেল। এই প্রথম তার প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা। তার মনে রুদ্ধ দ্বার যেন খুলে গেল প্রকৃতির সংস্পর্শে। মনে হতো লাগল আরো কিছুটা সময় যদি এভাবে সে কাটাতে পারত। কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেল আবার রাজকুমারীর দোলা রাজপ্রাসাদে এসে থামল। রাজকুমারী দোলার ভেতর থেকেই বাইরে দৃশ্য গুলি পর্দার আড়ালে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করায় আর দেখা হল না। সমগ্র রাত্রি রাজকুমারী আর সখী সুনয়না সেই মন্দিরের ঘটনাগুলিই বর্ণনা করতে লাগল।

        পরদিন সকালে রাজকুমারী তার যুদ্ধের সজ্জা পড়ে প্রস্তুত হল সুনয়নার সঙ্গে অস্ত্রগুরুর কাছে যাবার জন্য। এই সময় অমরেন্দ্রনাথ এসে রাজকুমারীকে নিয়ে গেলেন, সঙ্গে সুনয়না এবং ভদ্রমল্লও গেলেন।

       রাজ রীতি মতো প্রথমেই গুরুকে প্রণাম করে গুরুর দেওয়া অস্ত্র হাতে তুলে নিল রাজকুমারী।বিজয়দেব রাজকুমারকে অস্ত্র তুলে দিয়েই বলল, আজকে থেকে তোমার অস্ত্র শিক্ষা শুরু হল। এখন থেকে তোমার পুরো মন যেন অস্ত্র শিক্ষাতেই থাকে। এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার শিষ্যা হলে। তোমার অস্ত্র শিক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর থাকল। তোমাকে অস্ত্র শিক্ষায় পরিপূর্ণ করে রাজকার্যের উপযোগী করে তোলায় এখন আমার প্রধান লক্ষ্য। তার জন্য তোমাকেও কিছু নির্দেশ মেনে চলতে হবে।

       রাজকুমারী এতক্ষণ কি যেন ভাবছিল। বিজয়দেব কি বলল ঠিক তা বোধগময় যেন হল না রাজকুমারীর। সখী সুনয়নার একটু নাড়া দেওয়াতে হঠাৎ রাজকুমারীর সচকিত হয়ে কি বলবে ভেবে না উঠে পেরে বলল, যথা আজ্ঞা গুরুদেব।

        রাজকুমারীর অস্ত্রশিক্ষা তো শুরু হল কিন্তু তার মন অস্ত্রশিক্ষার্থী ছিল না। বিজয়দেব এই অমনোযোগী মনোভাব লক্ষ্য করতে করতে একদিন রাজকুমারীকে তিরস্কারের সুরে বলল, তোমার দ্বারা দেখছি কোনো কিছুই হবে না। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে রাজকার্যের উপযোগী করে তুলব কিন্তু দেখছি আমার ভাবনাই ভুল ছিল।



                                         ৪

         রাজকুমারীর মনে চন্দ্রকে দেখে যে পূর্ব রাগের সূচনা হয়েছিল, সেই পূর্বরাগ কখন যে অনুরাগে পরিণত হল রাজকুমারী তা বুঝতেই পারেনি। তাই তো অস্ত্রশিক্ষা করতে গিয়েও বারে বারেই মনের কোন কোনে যেন চন্দ্রের ছবিই ভেসে উঠত, আর রাজকুমারী অমনোযোগী হয়ে যেত। কিন্তু রাজকুমারীও জানতো তা, তার মাঝে মাঝে অমনোযোগের কারণ যে চন্দ্রই। রাজকুমারী চেষ্টা করেও কিছুতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারত না অস্ত্রশিক্ষাতে। রাজকুমারীর এই অমনোযোগী মনোভাব লক্ষ্য করে গুরুদেব তাকে তিরস্কার করল। তিরস্কৃত হওয়ার পর রাজকুমারী কক্ষে চলে আসলেন চোখে জল নিয়ে। কারণ জীবনে এই প্রথম তাকে তিরস্কৃত হতে হল। রাজকুমারী অভিমান ভরা চোখে চেয়ে রইলেন প্রাসাদ কক্ষ হতে বাতায়ন পথে রাজ উদ্যানের দিকে। যেখানে চন্দ্র ফুলেদের সঙ্গে খেলে। তার সেই খেলা রাজকুমারীরও ভালো লাগে। তাইতো রাজকুমারী চেয়ে চেয়ে গোপনে চন্দ্রের খেলা দেখে এবং আনন্দিত হয়। কিন্তু আজকে রাজকুমারীর মনকে ভালো করতে পারতো যে চন্দ্র সে নেই। তার  অনুপস্থিত থাকায় রাজকুমারীর মন আরো বিষন্নতার ভরে গেল। আজকে যেন রাজকুমারীর বেশি দরকার ছিল কিন্তু আজকে চন্দ্র নেই। রাজকুমারী সবকিছুর জন্য নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে শুরু করল।

         এমন সময় সুনয়না‌ এসে রাজকুমারী অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে বলল,সখী তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে কি হয়েছে তোমার? আর তোমার চোখে জল কেন? রাজ অস্ত্রগুরু কি কিছু বলেছ?

         সখী সুনয়নার কথা শুনে রাজকুমারী যেন আরো কাঁদতে শুরু করলেন। অভিমানে চোখ থেকে যেন জল আপনে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হতে লাগল। সখীর এই অবস্থা দেখে ও শুনে  দুঃখিত হয়ে বলল, সখী তুমি কাঁদো না। তোমার কান্না দেখে যে আমারও কান্না পায়।

        সখীর কথায় সুনয়না চোখে জল মুছে বলল, সখী অস্ত্রগুলো বিজয়দেব আমাকে তিরস্কার করে বলেছে, আমি নাকি কোনো কাজের যোগ্য নয়—

        সেই সামান্য কথার জন্য তুমি এত কাঁদছ সখী—

       কেন কাঁদবো না। আমাকে কেউ এমন কথা কখনো তো বলেনি।

       সখী অস্ত্রগুরু যা বলেছে, তা তোমার ভালোর জন্যই বলেছে। তার জন্য এত কাঁদতে হবে সখী। আর তোমার দ্বারা হবে না কে বলল, তুমি রাজকুমারী তোমার দ্বারাই সব হবে। রাজ্যের এতগুলো প্রজাদের দায়িত্ব তো তোমাকেই নিতে হবে।

         কিন্তু আমি পারব না সখী—

       তোমাকে যে পারতেই হবে সখী। তুমি ছাড়া এই দারিদ্র্য, দুঃস্থ প্রজাদের কে রক্ষা করবে। তুমি কি এদের শত্রুদের হাতে ছেড়ে দেবে মৃত্যুর জন্য—

        কিন্তু আমি কেমন করে তা পারব।

       তুইমি পারবে সখী, এ আমার বিশ্বাস…দেখো একদিন তুমি এদের রক্ষা করতে হয়ে উঠবে—

       কিন্তু কেমন করে সখী?

       সময়েই সব হবে—

        এমন সময় অমরেন্দ্রনাথ বিজয়দেবের কাছে সবকিছু জানতে পেরে রাজকুমারীর কক্ষে এসে দেখল রাজকুমারী বেদনার্ত মনে সুনয়নার সঙ্গে কথা বলছে। সুনয়না মহারাজকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং রাজকুমারী বিষন্ন মনে পিতার দিকে চেয়ে থাকলেন। অমরেন্দ্রনাথ কন্যার দুঃখ দেখে কিছু বুঝতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে কন্যার কাছে গিয়ে বসে চন্দ্রিমার কাঁধে হাত রেখে বলল, অস্ত্রগুরু তোমাকে পুত্রীসম স্নেহ করে সেই জন্যই তোমাকে হয়তো পুত্রী স্নেহে কিছু বলেছে তার জন্য তুমি মন খারাপ করে বসে আছ। গুরুদেব তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এস। গুরুদেব তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলবে—

        পিতা আমার ভালো লাগে না অস্ত্র শিক্ষাতে—

       এখন বলছ ভালো লাগে না কিন্তু একদিন তা আর বলবে না—

      কিন্তু পিতা—

      তোমার সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য গুরুদেব অপেক্ষা করছে, তুমি কি যাবে না গুরুদেবের কাছে—

       রাজকুমারী প্রস্তুত হয়ে সুয়নার সঙ্গে গুরুদেব বিজয়দেব যেখানে প্রতীক্ষা করছিলেন, সেই কক্ষে গেলেন। গুরুদেব রাজকুমারীকে একাই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করতে বললেন। সুনয়না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল এবং রাজকুমারীর কক্ষে প্রবেশ করল। রাজকুমারী প্রথমে নম্রতাসহ গুরুদেবকে প্রণাম করলেন। গুরুদেবও তাকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর গুরুদেব রাজকুমারীর বিষন্নতা দেখে বললেন, রাজকুমারী আমার বলাটা ঠিক হয়নি, আমি তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

         না না  গুরুদেব, আপনি একি কথা বলছেন, ক্ষমাপ্রার্থী আমি। ওভাবে চলে আসাটা আমার ঠিক হয়নি। আপনি আমার গুরু, আমি আপনার শিষ্যা—কিন্তু আমার যেন অস্ত্রশিক্ষা ভালোই লাগে না—

          ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে রাজকুমারী। তোমাকেই তো এই রাজ্যের ভার নিতে হবে একদিন—

          কিন্তু গুরুদেব আমি কেমন করে পারব—

         একমাত্র তুমিই পারবে রাজকুমারী। তোমার মধ্যে আমি সেই তেজ দেখেছি। শুধু সেই নিষ্ক্রিয় শক্তিকে জাগাতে হবে। আমি এতদিন অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে এসেছি এই রাজ্যে, তোমার মতোন আমি কাউকে দেখিনি। তোমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে থাকবে—

        সব হবে রাজকুমারী, সময়েই সব হবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে একবার আমার সঙ্গে রাজ্য পরিদর্শনে যেতে হবে।

       কবে গুরুদে? এ কথাটা বলল কিন্তু আমি তো তারই প্রতীক্ষায় আছি, একথা বলতে গিয়ে বলল না। রাজকুমারীর মন আনন্দে ভরে উঠল রাজপ্রাসাদের বাইরে যাবার কথা শুনে। কিন্তু রাজকুমারী জানত না তার আনন্দই বিষাদে পরিণত হবে।

        কালকে সকালে আমরা বেরব তুমি প্রস্তুত থেকো, সঙ্গে তোমার সখীকেও বলো।

       গুরুদেব পূর্ব থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাজাকেও এ ব্যাপারে বলে রেখেছিলেন পূর্বেই, শুধু রাজকুমারীর সম্মতির অপেক্ষায় ছিল,এখন সেটাও পূর্ণ হল। রাজা অমরেন্দ্রনাথ গুরুদেবের নির্দেশ মতো সমস্ত আয়োজন করতে লাগল।

          পরদিন প্রাতঃস্নান সেরে রাজকুমারী প্রস্তুত হতে লাগলোষ সঙ্গে সুনয়নাও। রাজগুরু আসল রথ প্রস্তুত করা হল। রাজকুমারী ও সুনয়না সেই রথে চড়ে রাজ্য পরিদর্শনে বেরলেন। সামনে গুরুদেবের রথ, স্যার পেছনে রাজকুমারীর, তার পেছনে সৈন্য সামন্ত চলছে। রাত যত চলছে রাজকুমারীর মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। কতদিন পরমুক্ত হাওয়ায় রাজকুমারী শ্বাস নিয়েছে। মুক্তির আনন্দ আজ তার মনে। গুরুদেব অগ্রে পথ প্রদর্শন করে করে চলছে, পেছনে রাজকুমারী সুনয়নার সঙ্গে গল্পে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। প্রজারা সেই এই দৃশ্য দেখছে এবং রাজকুমারী ও গুরুদেবকে নম্র মস্তকে প্রণাম করছে।

         হঠাৎ রথ চলতে চলতে গুরুদেবের নির্দেশমতো থেমে গেল। গুরুদেব রাজকুমারী ও সুনয়নাকে রথ থেকে নামতে নির্দেশ দিলেন। গুরুদেবের আদেশ মতো রাজকুমারী ও সুনয়না রথ থেকে নেমে, ছদ্মবেশে গুরুর নির্দেশে রাজ বেশ পরিত্যাগ করে সৈন্য -সামন্তদের ছেড়ে তিনজনে চলতে লাগল পদব্রজে গুরুদেবের পশ্চাতে চলতে লাগলেন। গুরুদেব এক দরিদ্র দুস্থদের গ্রামের প্রবেশ করলেন, পেছনে পেছনে রাজকুমারী ও সঙ্গে সুনয়নাও। সেখানে দারিদ্রতা দেখে রাজকুমারীর মন দয়দ্র হয়ে উঠল। সেখানে প্রজাদের উপর সৈন্য- সামন্তদের অত্যাচার, শোষণ দেখে রাজকুমারী ক্রোধে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু গুরুদেবের নির্দেশে রাজকুমারী শান্ত হলেন। রাজকুমারীর মন থেকে আনন্দ এক মুহূর্তে দুঃখে পরিণত হল। গুরুদেব শুধু প্রত্যক্ষ করতে বললেন কোনো কার্য নয়। জমিদার- সামন্তদের অত্যাচার, প্রজাদের দূর্দশা সবকিছু রাজকুমারী দেখতে থাকলেন নীরব দর্শক হয়ে। আজ প্রথম রাজকুমারীর এই দৃশ্য দেখে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। জীবনে প্রথম এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। রাজকুমারী তার নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে ফেরার পথে গুরুদেবকে বললেন, গুরুদেব এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

          এর প্রতিকার তোমাকেই করতে হবে রাজকুমারী।

         কিন্তু গুরুদেব এখানে এমন অরাজক অবস্থা কেন?

        কারণ এই অঞ্চলে তোমার পিতা শাসনব্যবস্থা ঠিক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এখানে এখনো জমিদারের শাসন চলে।

         গুরুদেবের কথা শুনে রাজকুমারী মন দুঃখে ভরে গেল এই সাধারণ, নিরীহ প্রজাদের দুঃখে। ফেরার পথে সমগ্র পথ ধরে এই প্রশ্নগুলোই রাজকুমারী গুরুদেবকে করে যাচ্ছিল একটার পর একটা।

        প্রাসাদের কক্ষে প্রবেশ করেও তার মনে নানান প্রশ্ন জাগছে। এই দৃশ্য রাজকুমারী ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নের মতোন দেখছে। রাত্রে দুচোখে ঘুম নেই, সেই দৃশ্যই চোখের সামনে ভেসে আসছে।

        সখী তোমার কি হয়েছে? এত ব্যাকুল কেন? অনেক রাত্রি হয়ে এলো তবুও তোমার দেখছি চোখে ঘুম নেই? রাজকুমারীর বিচলিত অবস্থা দেখে রাজকুমারী সুনয়নাকে এইসব প্রশ্ন করল।

       ঘুম যেন চোখে আসছে না সখী। সেই দৃশ্যই যেন চোখে ভাসছে।

     সখী এর প্রতিকার তো তোমাকেই করতে হবে। এখন তুমি ঘুমাও। কাল প্রাতঃকাল থেকে আবার অস্ত্রশিক্ষা শুরু হবে তোমার। এখন তোমার নিদ্রা প্রয়োজন।

       কিন্তু সখী এমনটা কেন হয়?

       এমনটাই হয় সখী—চারিদিকে সবলেরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করে চলছে। যেমন নারায়ানী রাজ্য তোমার রাজ্যকে দুর্বল ভেবে তার জন্য আক্রমণ করেছিল। প্রতিরোধের জন্য দরকার শক্তি—

        রাজকুমারী আর কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু মনের মধ্যে সেই কথাগুলি এবং ছবিগুলি ঘুরতে লাগলোষ চোখের চারিপাশে। সকালে রাজকুমারী আবার প্রস্তুতি শুরু করল অস্ত্র শিক্ষার জন্য। কিছুক্ষণ মনটা খারাপ হয়ে থাকল, তারপর গুরুদেবের কথামতো অস্ত্রশিক্ষায় মনোনিবেশ করল এবং তখন চন্দ্রের কথা আর মনে হল না শুধু চোখের সামনে সেই ছবি ভাসতে থাকল।

       ধীরে ধীরে অস্ত্রশিক্ষা যত এগিয়ে গেল, তত রাজকুমারী সব ভুলে অস্ত্রের প্রতি মনোযোগী হতে শুরু করল। কিন্তু প্রথম ভালবাসাকে কি আর ভোলা যায় এত সহজে? যখনই চন্দ্রকে দেখত জানালা দিয়ে তখনই মন আবার উদাস হয়ে যেত। রাজকুমারী কর্তব্যের জন্য কিছুদিন চন্দ্রকে ভুলে থাকতে চাইল কিন্তু ভুলে কি আর থাকতে পারল? যখনই প্রাসাদ কক্ষে আসত, তখনই চন্দ্রের কথা মনে হত! গুরুদেব অস্ত্রশিক্ষায় একান্ত নিষ্ঠা এবং পারদর্শিতা দেখে  একদিন বলল, আমি বলেছিলাম না, তোমার দ্বারাই সব হবে। শুধু তোমার অন্তস্থ শক্তিকে জাগাতে হবে। এবার সেই কাজ সম্পন্নতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এক ভবিষ্যৎকে দেখতে পাচ্ছি আমার চোখের সামনে—

        কথা বলতে বলতে গুরুদেবের চোখের কোন দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

      যত সময় যেতে থাকলো তত রাজকুমারী অশ্ব চালনা, অসি চালনা, রথ চালনা, তীর -ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠল। গুরুদেবের যত শিষ্যা – শিষ্য ছিল সবাইকেই পারদর্শিতায় ছাড়িয়ে গেল। দেখতে রাজকুমারী চন্দ্রিমা এক বৎসরের মধ্যে সমস্ত শিক্ষা আয়ত্ত করে নিল। অস্ত্রবিদ্যা এতই পারদর্শী হয়ে উঠল যে রাজ্যের কেউ অস্ত্র বিদ্যায় রাজকুমারীর সঙ্গে পেরে উঠত না। অস্ত্রবিদ্যা সমাপনের পরে গুরুদেব রাজকুমারীকে আশীর্বাদস্বরূপ একদিন দিন অসি দান করে বললেন, এই তরবারি আমি তোমাকে দিলাম…তুমিই এর যোগ্য উত্তরাধিকারী—তোমার মধ্যে এক জ্বলন্ত ভবিষ্যৎকে আমি দেখতে পাচ্ছি—

        রাজকুমারী শিক্ষা সমাপন করে পিতার কাছে চললেন। পিতা তাকে দেখে খুব খুশি হলেন। অমরেন্দ্রনাথ আর রাজকুমারীকে কোনো কাজে বাধা দিলেন না পূর্বের কথা মতো।রাজকুমারীর ইচ্ছা মতোন সব জায়গায় বিচরণ করতে পারতেন। অস্ত্র শিক্ষা সমাপ্তির পর রাজকুমারীর মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠল। পূর্ব রাগের স্মৃতি আবার ভেসে উঠল মনে। মনের আনন্দে সখী সুনয়না সঙ্গে রাজ উদ্যানে ছুটে গেল কিন্তু সেখানে চন্দ্রকে না দেখতে পেয়ে দুঃখে মন ভরে উঠল। সখী সুনয়না মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, সখী একটু অপেক্ষা করো—এতদিন অপেক্ষা করলে আর একটুর জন্য মন ধরতে পারছ না—

         রাজকুমারীর মন যেন আর জানতে চাইছিল না। সুনয়নার কথা শুনে রাজকুমারীর চোখের কোনে জল একটু গড়িয়ে পড়ল। নিজের মনকে শান্ত না করতে পেরে রাজকুমারী বলল, সখী কেমন করে আর হৃদয় ধরব, মন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই! কতদিন এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করলাম….. আর আজকে সময় যখন আসল তখন আর তার দেখা নেই —

        যখন এরূপ কথোপকথন চলছিল, তখন চন্দ্র এসে উপস্থিত হল। সুনয়না বা রাজকুমারী কেউই তাকে লক্ষ্য করতে পারেনি। হঠাৎ যেন চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত ফল লাগে রাজকুমারী স্তম্ভিত হয়ে গেল। সুনয়নাও কিছু বুঝতে না পেরে রাজকুমারীকে বলল, তুমি উদ্যান ভ্রমণ কর আমি আসছি।


                                        ৫

  যাকে দেখার জন্য রাজকুমারীরা এত অপেক্ষা এবার তা যেন পূর্ণ হল। থেকেই সময় না তাদের মাঝে বাধা হিসেবে থাকতে না চেয়ে নিজেকে কাজের আছিলায় দূরে সরিয়ে নিল। চন্দ্র চোখের সামনে অপরিচিত এক সুন্দরী কন্যাকে দেখে কি বলবে বুঝতে না পেরে মুখমন্ডল পানে চেয়ে রইল। দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল বহুদিন পূর্বে দেখা রাজপ্রাসাদের জানালার সেই অপরিচিত চোখ দুটি আর ঠোঁটের একটু মিষ্টি হাসির কথা। রাজকুমারীর চোখের দিকে তাকিয়ে সেই চোখের কথাই মনে পড়ে গেল। মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন উঠতে লাগল, এই কি সেই মেয়ে, যাকে সে দেখেছিল? কিন্তু সেই অনেক দিনের স্মৃতি মনে যেন সম্পূর্ণ সংরক্ষিত নেই, একটু বিস্তৃতি এসেছে। কিন্তু সেই চোখের কথা চন্দ্র এক মুহূর্তও ভুলতে পারেনি। এতদিন পরে সেই স্মৃতি আবার জাগ্রত হল রাজকুমারীকে দেখে। মন যেন বলছিল এই চোখেই যেন সেই চোখ, এই মেয়েই যেন সেই মেয়ে। কিন্তু হঠাৎ সেই মেয়ে এখানে কেমন করে আসল? কে হয় এই সুন্দরী? এখানেই বা কেন আসল? কি উদ্দেশ্য তার? এইসব কথাই মনে হতে লাগল।

        কৌতূহল নিবৃত্তি করতে না পেরে চন্দ্র বলল, আপনি কে? আর কেনই বা হঠাৎ এখানে? আপনাকে তো এর পূর্বে কখনো দেখিনি?

        রাজকুমারী কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, আমি এই প্রাসাতেই থাকি। প্রতিনিয়ত তোমাকে দেখি এই উদ্যানের ফুলগুলির সঙ্গে কথা বলতে। আমার ভালই লাগে দেখতে—

        এবার রাজকুমারীর কথা শুনে এতক্ষণ চন্দ্র যা মনে মনে ভাবছিল সেটাকেই সত্যি বলে মনে হল। কিন্তু সেই কথা বলবে কেমন করে। হঠাৎ রাজকুমারী আবার বলল, তুমি ফুলগুলোকে খুব ভালোবাসো না?

         হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেমন করে—

         আমি জানি—

         তাহলে আপনিই কি প্রাসাদের ত্রিতল কক্ষ থেকে আমাকে দেখতেন—

        হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে?

      আপনাকে একদিন দেখেছিলাম প্রাসাদ কক্ষের জানালায়। কিন্তু সম্পূর্ণ দেখতে পাইনি, শুধু চোখ দুটি আর ঠোঁটের একটু হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। তাহলে আপনিই সেই স্ত্রীলোক—

         আজকে বুঝতে পারলাম তাহলে তুমি আমাকে প্রাসাদের জানালা পথে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে।

       না না আপনি ভুল ভাবছেন, আমি শুধু একবারই আপনাকে দেখতে পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই—

        রাজকুমারী কৌশল খাটিয়ে চন্দ্রের কাছ থেকে তাকে দেখার কথাটা বলিয়ে নিল। রাজকুমারী আবার বললন, তাহলে তুমি আমাকে চিনলে কেমন করে?

        সেই দিন যে আপনার দুটি চোখ দেখেছিলাম, আবার আজকে আপনাকে দেখে সেই চোখের কথাই মনে হল, আবার আপনি যখন বললেন আপনি আমাকে দেখেন ফুলের সঙ্গে খেলতে—

        তাহলে তুমিও আমাকে দেখতে?

         সেই একদিন—

        তারপর আর সেই জানালার দিকে তাকাওনি একবারও—

         না, মানে —

         দেখো তুমি সত্যি করে বলো আমি সব জানি, সখী সব বলেছে আমাকে।

          সখীর কথা বলায় চন্দ্রের মনে সন্দেহ জাগল যে, এ নিশ্চয়ই রাজকুমারী হবে। চন্দ্র সখীকে দুই- একবার দূর থেকে দেখেছিল এবং শুনেছিল রাজকুমারী সম্বন্ধে অনেক কথা। এবার তার মনে হল এই মেয়েটি নিশ্চয়ই রাজকুমারী হবে।

         চন্দ্র বলল, কিন্তু আপনি কি রাজকুমারী?

         হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বলো তুমি কতবার আমাকে দেখেছ?

        সেই একবার রাজকুমার, তারপরে আর দেখতে পাইনি—

        তারপরে কেন বারেবারে দেখতে জানালার দিকে? তুমি কি ভাব আমি কি কিছুই জানিনা?

       এই অবস্থায় চন্দ্র কি বলবে, একে তো সে রাজকুমারী, আর অপরদিকে সে মালি। রাজকুমারীকে এই ভাবে দেখা রাজ অপরাধ। চন্দ্রের মনে ভয়ও হতে লাগল, রাজকুমারী যদি পিতাকে সব কথা বলে দেয়। সেজন্য চন্দ্র কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইল। চন্দ্রের এই নীরবতা দেখে রাজকুমারী আবার বলল, কি হল তুমি বলছ না যে কিছু? আমি সব জানি, তুমি যদি সত্যটা না বল, তাহলে আমি পিতাকে সব বলে দেব। আর তুমি তো জান তার ফল কি হবে।

         এবার চন্দ্র বাধ্য হয়েই বলল, কি জানি কেন যেন দেখতে ভালো লাগত—এত সুন্দর নয়ন যুগল কার, তা দেখার জন্য মন ছুটে যেত —

         শুধু কি ভালো লাগত তাই—

         হ্যাঁ ভালো লাগত। এক ঝলক দেখা দিয়ে মেঘের মধ্যে লুকিয়ে যাওয়া সেই ছটাকে দেখতে চাইত মন!

         রাজকুমারীও চন্দ্রের কাছ থেকে গোপন মনের ভাব জেনে নিল কৌশলে। এবং চন্দ্রও এতদিন ধরে মনের মধ্যে জমা ভাব, যার জন্য জমেছে এক মুহূর্তে তার কাছে ব্যক্ত করতে পেরে মনটা হালকা হল। যেই মুহূর্তে চন্দ্র রাজকুমারীতে মনের কথাগুলো বলছিল, সেই সময় রাজকুমারীর মুখে এক অপূর্ব হাসির ভাব লক্ষ্য করলে চন্দ্র। চন্দ্র ও চন্দ্রিমার মনের সেই পূর্বরাগ যেন অনুরাগের ঘনীভূত হল। কথা বলতে বলতে কখন যে রৌদ্র উঠেছে রাজকুমারী বা চন্দ্র কেউই  তা লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ চন্দ্রের খেয়াল হল রাজকুমারী রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তখন চন্দ্র রাজকুমারীকে বলল, রাজকুমারী আপনি রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন, আমি এতক্ষণ তা লক্ষ্যই করিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন রাজকুমারী আমি আপনাকে রৌদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছি—আসুন আমরা এই বটবৃক্ষের ছায়ায় বসি—

        রাস উদ্যানের পাশে ছায়ার জন্য চারিদিকে বড়ো বড়ো বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল, তার মধ্যে এই বটবৃক্ষও ছিল। কখন প্রভাত অতিক্রান্ত হয়ে প্রায় মধ্যান্য আসন্ন হয়েছে রাজকুমারী এবং চন্দ্র কেউই লক্ষ্য করতে পারেনি। চন্দ্রের কথাতে রাজকুমারীর ধ্যান ভাঙল এবং একটু মিষ্টি হেসে চন্দ্রের পেছনে পেছনে বটবৃক্ষের ছায়ায় গিয়ে বসল। সেই বৃক্ষের এক শাখায় সেই টিয়াটি বসেছিল। বৃক্ষ তলে বসে রাজকুমারী ও চন্দ্র যখন কথা বলছিল, তখন সেই টিয়াটি উপর থেকে তাদের প্রেমালাপের কথাগুলি শুনছিল। বৃক্ষের নিচে অনুরাগ ঘনীভূত হচ্ছিল আর বৃক্ষের উপরে টিয়াটি সেগুলি শুনে শুনে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছিল এবং তাদের মুখের ভঙ্গের দিকে লক্ষ্য রেখে চলছিল।

         চন্দ্র বলল, কিন্তু রাজকুমারী আপনি এখানে হঠাৎ?

         কেন? আমি কি আসতে পারি না।

         না রাজকুমারী আমি বলছিলাম আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি, শুধু আপনার কথা শুনেছি— তো আপনি হঠাৎ করে—

       কেন আমি কি উদ্যানে অসতে পারি না পরিদর্শনের জন্য।

          না রাজকুমারী, আমায় ক্ষমা করবেন এই উদ্যান তো আপনারই আপনি যখন ইচ্ছে তখন আসতে পারেন।

         এমন সময় রাজকুমারীতে বিশ্রামের জন্য সখী ডাকতে আসল। রাজকুমারীও তা খেয়াল ছিল না কখন বিশ্রামের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে রাজকুমারীর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটলে মহারাজের কোপে পড়তে হবে সুনয়নাকে। তাই সুনয়না চন্দ্রিমাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে।  সুনয়নাকে আসতে দেখে চন্দ্র ভয়াগ্ৰস্ত হয়ে পড়ে। শেষের রাজকুমারীর আশ্বস্তে তার ভয় দূর হয়।

        সুনয়না এসে বলে, সখী তোমার এখনো হয়নি, ওদিকে আবার মহারাজ তোমাকে না দেখলে আমাকেই বকবেন—

        রাজকুমারী যখন উঠে চলে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন চন্দ্র ডেকে বলল, রাজকুমারী আপনার নামটাই তো শোনা হল না —

        রাজকুমারী একটু হেসে চন্দ্রিমা বলে সখীর সঙ্গে চলে গেল। চন্দ্র বিমনা হয়ে নিজের কক্ষে বিশ্রামের জন্য চলে গেল। বিশ্রামের জন্য গেল কিন্তু কিছুতেই রাজকুমারী এবং চন্দ্রের বিশ্রাম হল না। দুজনের চোখের সামনে সেই প্রথম দেখার ছবিগুলো ভেসে আসতে থাকল চিত্রের ন্যায়।

        প্রতিদিন চন্দ্র সকালে উদ্যানের ফুল গুলির সঙ্গে খেলত এবং রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে থাকত। রাজকুমারীও দেখে দেখে হাসত। তারপর ক্রমে রাজকুমারী সুনয়নার সঙ্গে প্রতিদিন চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করল। চন্দ্রের মনেও নতুন ঢেউ লাগল। চন্দ্র আর চন্দ্রিমার প্রতিনিয়ত সেই  বটবৃক্ষের নিচে প্রেমালাপ চলতে থাকল। সেই টিয়াটিও প্রতিনিয়ত তাদের কথাগুলো শুনতে লাগল। চন্দ্র রাজকুমারীতকে চন্দ্রিমা বলে খুব কমই ডাকত, বেশিরভাগ সময়ই রাজকুমারী নামেই ডাকত। রাজকুমারী চন্দ্রকে নাম ধরে ডাকত না, নামের পরিবর্তে তুমিই বলত।

         রাজকুমারী একদিন খুব সকালে উঠেই চন্দ্রকে দেখার জন্য একাই চলে আসে সেই বটবৃক্ষে কিন্তু সেই দিন চন্দ্রের আসতে কিছুটা দেরিই হয়ে গেল। রাজকুমারী উদ্বিগ্নভাবে বসে বসে নানান কথা ভাবতে থাকল। ঠিক সেই সময় চন্দ্র আসাতে রাজকুমারী একটু অভিমানে বলল, তুমি কি করছিলে, এত দেরি হল কেন?

        কেন রাজকুমারী? আপনি এখানে হঠাৎ? মানে কি উদ্যান ভ্রমণে?

        হ্যাঁ আমি উদ্যান ভ্রমণে এসেছি, তীব্র অভিমানের সুরে বলল।

       তুমি কি ভাবলে আমি উদ্যান ভ্রমণের জন্য এখানে এসে বসে আছি? তোমার তাই মনে হল?

        চন্দ্রও এবার আর না বলে আর থাকতে পারল না। মনের কথা মুখে এবার চলেই এল, আর বাধা মানল না কোনোমতেই। আপন মনেই বলে উঠল, আমি তো বুঝতে পারলাম রাজকুমারী—আপনার মনের যে অবস্থা আমারও সেই রকম—কিন্তু কোথায় আপনি আর কোথায় আমি রাজকুমারী।

        তুমি কি আমাকে চাও না? আমি তোমাকে এক মুহূর্ত না দেখলে যেন এক যুগ বলে মনে হয়। মন আর কিছুতেই মানে না—

        রাজকুমারী আমি তো বুঝতে পারছি কিন্তু কোথায় তুমি আর কোথায় আমি। এ কেমন করে সম্ভব রাজকুমারী। মন চাইলেই কি আর সব হয়! মন তো অনেক সময় অনেক কিছু চায় কিন্তু পূর্ণ হয় আর কটা! এইবার প্রথম রাজকুমারীকে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন।

        আমি অতিশয়োক্তি জানি না। তোমাকে ছাড়া, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারব না। তুমি কি পারবে আমাকে ছাড়া থাকতে?

        হয়তো পারব না রাজকুমারী, কিন্তু এ সম্পর্ক কেমন করে সম্ভব? মহারাজা যদি জানতে পারে—

        আমি কিছু জানিনা। শুধু জানি তুমি শুধু আমার।

      রাজকুমারীর কথা শুনে চন্দ্রের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। মনের গোপন বাসনা জেগে উঠল। এতদিন তা অবদমিত ছিল, এবার তা আর বাধা মানছে না। রাজকুমারীর কথা শুনে চন্দ্র আর মনের ভাব গোপন করতে না পেরে বলে ফেলল, আমিও তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না রাজকুমারী। তুমি একমাত্র এই চন্দ্রের চন্দ্রিমা। তুমি ছাড়া আর কখনো না কেউ ছিল, আর না কেউ হবে।

        এদিকে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ভদ্রমল্ল রাজকুমারীর খোঁজে আসছিল। সখী সুনয়না হঠাৎ দেখতে পেয়ে ছুটে এসে ভদ্রমল্লের সামনে দাঁড়াল। ভদ্রমল্ল সুনয়নাকে দেখে বলল, রাজকুমারী কোথায় সুনয়না? দেখছি না রাজকুমারীকে সকাল থেকে তাই দেখতে এলাম। যাই একবার দেখে আসি।

         রাজকুমারী যেখানে থাকার সেখানে ঠিকই আছে। রাজকুমারীর জন্য আর তোমায় ভাবতে হবে না। রাজকুমারী এখন নিজের রক্ষা নিজেই করতে পারে।

        তবুও মহারাজের নির্দেশ রাজকুমারীকে রক্ষার দায়িত্ব সব আমারই উপর। রাজকুমারীর কোনো কিছু হলে মহারাজ আমায় ক্ষমা করবেন না।

       তুমি রাজকুমারীর এত চিন্তা করছ কেন? রাজকুমারী তার নিজের রক্ষা এখন নিজেই করতে এখন সক্ষম।

        কিন্তু মহারাজ—

        তোমাকে এত ভাবতে হবে না, আমি বলছি তো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। অনেকদিন ধরে ভাবছি বলব বলব কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।

       কি কথা সুনয়না?

      আগে চলো আমরা উদ্যানে ওপাশে যায়। ওখানে আমাদের মধ্যে কেউ বাধা দিতে আসবে না। এখানে হবে না। কখন মহারাজ হঠাৎ ডাকতে বসবেন আবার। তার থেকে আমরা ওপাশটাই য়াই—

        একথা শুনে ভদ্রমল্লের মনের অন্ধকারে এক তীব্র দীপ শিখায় জ্বলে উঠল দপ্ করে হঠাৎ। ভদ্রমল্ল কিছু বুঝতে না পেরে সুনয়নার কথায় রাজি হয়ে বলল, ঠিক আছে সুনয়না তাই ভালো হবে। আমরা বরং ওদিকেই যাই—


          

                                     ৬

     একজন নারী ভালো করেই জানে কি করে একজন পুরুষকে বশে আনতে হয়। সুনয়নার কথার মোহে ভদ্রমল্ল মোহিত হয়ে গেল। ভদ্রমল্লের পত্নী অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিল, সেই থেকেই নতুন করে আর বিবাহ না করে রাজ কার্যে মনোনিবেশ করে।এতদিন পরে তার সেই কামনা আবার জেগে উঠল সুনয়নার কথায়। ভদ্রমল্ল নিজের কাজ ভুলে সুনয়নার সঙ্গে প্রেমালাপে মত্ত হয়ে উঠল।

        এদিকে চন্দ্রও চন্দ্রিমার প্রেমে মত্ত। একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না এরকম প্রেমালাপ চলছে; তখন অন্যদিকে ঝাউ গাছের ছায়ায় বসে নতুন প্রেমের সূচনা হচ্ছে। একদিকে অনুরাগ পূর্ণতা পাচ্ছে, আর একদিকে পূর্ব রাগ ঘনীভূত হচ্ছে। সুনয়নার মনও নব প্রেমের অনুভূতিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। রাজ উদ্যানের দুই প্রান্তে দুই প্রেমের গল্প চলছে।

         এদিকে অনেকটা সময় হয়ে এলে রাজকুমারী উঠে যখন সবে আসতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়ই সেই বটবৃক্ষের শাখায় যে, টিয়াটি ছিল, রাজকুমারী, রাজকুমারী… বলতে বলতে রাজকুমারীর ঘাড়ে এসে পড়ল। রাজকুমারী কিছু বুঝতে না পেরে নিজের ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে টিয়াটিকে দেখতে থাকে। সেই সময় টিয়াটি আবার রাজকুমারী বলে ওঠে। রাজকুমারী খুশি হয় সেই টিয়াটিকে নিয়ে প্রাসাদ কক্ষে প্রবেশ করে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে রাজকুমারী পিতার কাছে সেই টিয়াটিকে নিয়ে ছুটে যায়।

           পিতা দেখ আমি কি পেয়েছি, বলে রাজকুমারী ছুটে গিয়ে পিতাকে দেখায়।

       অমরেন্দ্রনাথ মেয়ের খুশিতে খুশি হয় বলল, দেখি দেখি—

       রাজকুমারী তখন টিয়াটিকে বলে, বলতো আমি কে? তুমি আমাকে কি বলে ডাকলে তখন?

      তখন টিয়াটি আবার রাজকুমারী, রাজকুমারী বলে ওঠে।

       দেখে অমরেন্দ্রনাথও খুশি হয়ে বলে সত্যি তো— এই টিয়াটি তো কথা বলে! একে তুমি কোথায় পেলে?

         পিতা আমি উদ্যান থেকে আসছি তখন হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে ঘাড়ে পড়ে। পিতা তুমি এর জন্য একটা সোনার পিঞ্জর গড়ে দিও। আমি একে সেই সুবর্ণ পিঞ্জরের মধ্যে রাখব।

          তুমি যা চাও তাই হবে রাজকুমারী। আমি এক্ষুনি শ্যাকরাকে নির্দেশ দিচ্ছি সুবর্ন পিঞ্জর বানানোর জন্য।

         রাজকুমারী আনন্দে সখীকে দেখাতে নিয়ে যাবে কিন্তু প্রাসাদে দেখে সখী নেই। প্রাসাদের বাইরে উদ্যানে এসেও সখীকে দেখতে না পেয়ে রাজকুমারী বিমনা হয়ে পড়ে। তিতস্ততভাবে উদ্যানে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ভদ্রমল্লের সঙ্গে সুনয়নাকে গল্প করতে দেখে আর তাদের মাঝে বাধা না দিয়ে রাজকুমারী চলে আসে। এদিকে সখী সুনয়নাও ধ্যান হয় যে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। সময় কখন চলে গেছে সুনয়নাও বুঝতে পারেনি। হঠাৎ তার রাজকুমারীর কথা মনে পড়ায় দ্রুত সেখান থেকে রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে ছুটে আসে এবং ভদ্রমল্লও ছুটে যায় রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখে রাজকুমারী ও চন্দ্র কেউই নেই। সুনয়না ও ভদ্রমল্ল দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা দ্রুত রাজপ্রাসাদের ছুটে এসে দেখে রাজকুমারী এক টিয়াকে নিয়ে খেলছে। এবং টিয়াটি কথা বলছে। এই ঘটনায় সখী আশ্চর্য হয়ে যায়। সুনয়না আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, সখী তুমি এই টিয়াকে কোথায় পেলে? জানো একেবারে অবিকল মানুষের মতো কথা বলছে!

         আমি উদ্যান থেকে আসার সময় হঠাৎ পেছন থেকে রাজকুমারী, রাজকুমারী বলতে বলতে আমার ঘাড়ে এসে বসে। পিতা এর জন্য সুবর্ণা পিঞ্জর তৈরি করে দেবে।

         সখী তুমি খুব ভাগ্যবান। এমন একটা টিয়া তোমার নাম ধরে ঘরে এসে পড়ল।

       আর সখী তুমি কোথায় ব্যস্ত ছিলে এতক্ষন—

      কোথায় আবার উদ্যানে গিয়েছিলাম তুমি তো দেখলে।

        শুধু কি উদ্যানে, আর কোথায় গিয়েছিলে, আমি সব দেখলাম সখী—

        সুনয়না আর কিছু না বলে একটু হেসে বলল, না সখী তুমি যেটা ভাবছ সেটা না।

       হ্যাঁ সখী আমি জানি, তোমাকে আর বলতে হবে না।

       সুনয়না এবং রাজকুমারী টিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিয়াটি বারবার রাজকুমারী, রাজকুমারী বলতে থাকল। অমরেন্দ্রনাথ রাজ্যের কারিগর দিয়ে এক সুন্দর সুবর্ণ পিঞ্জর তৈরি করল। টিয়াটি রাত্রি কালে এবং বিশ্রামের সময় সেই পিঞ্জরে থাকতে লাগল। পিঞ্জরের দাড় কখনো বন্ধ করা থাকত না ফলের টিয়াটি নিজের ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারত। প্রিয়া তুই সবসময় রাজকুমারীর সঙ্গে সঙ্গেই থাকত।

        এদিকে অমরেন্দ্রনাথ নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য চন্দ্রিমার হাতে রাজ্যের ভার অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিল। সেইমতো সমস্ত ব্যবস্থা করতে লাগল। রাজগুরুর আশীর্বাদে শুভ তিথিতে কুলোদেবতার পুজো দিয়ে চন্দ্রিমার মুকুট বরণ সমারো মহা আনন্দের সহিত শেষ হল।

         রাজকুমারী রাজ্যের মহারানী পদের বসতেই প্রথমেই অমরাবতী রাজ্যের দক্ষিণ সীমানায় যে রাজনগর আছে, সেখানকার জমিদার সামন্তদের দমন করে সেই রাজনগর রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসে। সেখানকার দুস্থ প্রজাদের জমিদার ও সামন্তদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দেয়। রাজ্যের প্রজাদের প্রজা মঙ্গলকারী, প্রজাহিতৈষী হিসাবে রাজকুমারী খ্যাতি পায়। অমরেন্দ্রনাথও মেয়ের কীর্তিতে মুগ্ধ হয়ে বলে, পুত্রী তোমার দ্বারাই হবে রাজ্যের উন্নয়ন, প্রজাদের কল্যাণ। আমার এত দিনের চিন্তা এবার দূর হল। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব। যোগ্য উত্তরাধিকারের হাতেই আমি রাজ্য দিতে পেরেছি—

        পিতা তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছ কেন? তুমি না থাকলে এই রাজ্য কে চালাবে।

        এতদিন তার ভাবনাই ছিল, এখন আর নেই—

       কিন্তু পিতা আমি—

        তুমিই সব পারবে, একমাত্র তুমিই —

       তারপর দুজনেই নীরব, পিতা  পুত্রীর দিকে তাকিয়ে গর্ববোধ করতে লাগল।

       তখন সখী সুনয়না এসে রাজকুমারীকে ডেকে নিয়ে গেল। চন্দ্র এদিকে রাজকুমারীর অদর্শনে বিরহে কাতর। রাজকুমারীও যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় চন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার সময় পায়নি। সুনয়নাকে দেখতে পেয়ে রাজকুমারী তথা মহারানীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলে সুনয়না চন্দ্রের কথামতো রাজকুমারীকে ডাকতে আসে। রাজকুমারী চন্দ্রের কথা শুনে সুনয়নার সঙ্গে রাজ উদ্যানে চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

       চন্দ্র অনেকদিন পরে রাজকুমারীকে পেয়ে বলে, আজকে যেন আবার পুনরায় চন্দ্রের আকাশে চন্দ্রিমার উদয় হল।এতদিন চন্দ্র চন্দ্রিমাকে ছাড়া আলোহীন অবস্থায় ছিল, আবার যেন পুনরায় আলো ফিরে পেল চন্দ্র চন্দ্রিমার উদয়ে—বসো রাজকুমারী এই বটবৃক্ষে যেখানে আমাদের প্রথম প্রেমের সঞ্চার হয়! আজ আবার সেখানে অনেকদিন পরে যেন নতুন করে তোমাকে দেখছি। সেই যেদিন প্রথম দেখেছিলাম মুগ্ধের মতো। আজও আমার তেমনই অবস্থা মহারানী। আপনি আপনার কাজে এতই ব্যস্ত হয়েছিলেন যে, চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করেছিল! এবার আবার চন্দ্র মুক্ত হল তোমার আগমনে!

        আমার মন কি একবারও ব্যাকুল হয়নি তোমার জন্য? প্রতিমুহূর্তে মনে হতো কখন আমি এই দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরবো, যেন কারাগার বলে মনে হত! মনে হতো কারাগারে আবদ্ধ ছিলাম, এখন মুক্ত হলাম!

              না মহারানী। এখন তুমি আর সেই রাজকুমারী নেই, এখন তুমি মহারানী। এখন সমগ্র রাজ্যের দায়িত্ব তোমার উপর। তোমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তুমি তো আর এখন আমার একার না, তুমি সবার—

           চন্দ্র বিহনে এতদিন চন্দ্রিমাও যেন প্রভাহীন হয়েছিল। আজ আবার চন্দ্রিমা প্রাণ ফিরে পেল! কর্তব্যের জন্য তোমার থেকে এতদিন দূরে ছিলাম। আজকে অনেক কথা বলার ইচ্ছা, কিন্তু কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। সময় শুধু চলে যাচ্ছে, কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না! মনের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে, কিন্তু এই সময় কিছুই মাথায় আসছে না; কোথা থেকে শুরু করব, কিছু আর বলতে পারছিনা।

        মহারানী তোমাকে আর কথা বলতে হবে না। তুমি আমার সামনে দাঁড়াও, আমি দেখি দু নয়নে ভরে। কতদিন পরে দেখা! আবার কবে হবে, কবে তোমায় দেখতে পাব!

                 কেন তুমি, এরকম কথা বলছো এখন এই শুভক্ষণে।

            না জানি কেন মহারানী আমার মনে হল, তাই বললাম।

           তুমি কি আমাকে মহারানী বলেই ডাকবে?

          তুমি তো সবার মহারানী। সবার মধ্যে আমিও তো একজন। সেই মতো তুমি তো আমারও মহারানী। কিন্তু তুমি মহারানীর সঙ্গে সঙ্গে আমার চন্দ্রিমাও বটে, যা আর কারো নও, শুধু আমার—

               মহারানীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকল ছবির মতোন, আর চন্দ্র দেখতে লাগল বসে বসে। সময় যেন এমনই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন সময় চন্দ্রিমার সেই পাওয়া টিয়াটি, যাকে চন্দ্রিমা আদরে নাম দিয়েছিল সোনা, সেই সোনা, উড়তে উড়তে রাজপ্রাসাদের বাইরে চলে আসে। মহারাজ সেই টিয়াকে ধরার জন্য পিছনে পিছনে ছোটে। সোনা এসে পরে ঠিক চন্দ্রিমার গায়ে। অমরেন্দ্রনাথ এই দৃশ্য দেখে ক্ষুবুদ্ধ হয়ে চন্দ্রকে ধরে আনতে আদেশ দেয়। প্রহরী সেই মতো চন্দ্রকে ধরে আনলে, চন্দ্রিমাও কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে ছোটে। সুনয়নাও এই দৃশ্য দেখে হতবাক। কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভদ্রমল্লও কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে অমরেন্দ্রনাথ এর আদেশের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।

               রাজকুমারী পিতার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকে। অমরেন্দ্রনাথ কিছুতেই তার মত পরিবর্তন না করাতে চন্দ্রিমা শেষ পর্যন্ত বলে ওঠ, পিতা আপনি যদি চন্দ্রের সঙ্গে কোনো কিছু করেন, তবে বুঝবেন আপনার  কন্যাও আর জীবন্ত থাকবে না। আর একটি কথা আপনাকে বলতে চাই আমি চন্দ্রকে ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না।

                অমরেন্দ্রনাথও অভিমানে কিছু আর না বলে পক্ষে চলে গেল। এদিকে সখী সুনয়না চন্দ্রিমাকে নিয়ে প্রাসাদ কক্ষে প্রবেশ করে। অমরেন্দ্রনাথ এর নির্দেশে চন্দ্রকে নিজ কক্ষে আটক রাখা হয়। প্রেমের পূর্ণতার বেশে আবার বিরহের ছায়াই ঘনিয়ে আসল। চন্দ্রিমার দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য সুনয়না মহারাজকে সখীর জন্য অনেক নিবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত মহারাজ বলে, কিন্তু সুনয়না তুমি তো জানো যে মহারানী শেষ ইচ্ছা ছিল রাজকুমারীর সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার। তার সেই ইচ্ছাটা কি আমি ভুলে যাব!

           কিন্তু মহারাজ আপনি একবার চন্দ্রিমার কথাটা ভাবুন। আপনি একবার চলুন গিয়ে নিজেই দেখে আসুন। অন্ন, জল সব ত্যাগ করে বসে আছে।

                অমরেন্দ্রনাথ সুনয়নার কথা শুনে দ্রুত কন্যার কক্ষে গিয়ে দেখে চন্দ্রিমা রাজ উদ্যানের দিকে মন খারাপ করে বসে আছে। অমরেন্দ্রনাথের কথা শুনেও কোনো উত্তর না দিয়ে একবার চেয়ে আবার উদ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখে। শেষে অমরেন্দ্রনাথ কাছে বসে কন্যার জেদ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করল কিন্তু তাতেও কোনো কথা না বলে উদ্যানের দিকেই তাকিয়ে রইল। শেষে অমরেন্দ্রনাথ বললেন, চন্দ্রিমা দেখো তুমি এখন বড় হয়েছো সব বোঝো। আর তুমি এটাও জানো যে তোমার মাতার শেষ ইচ্ছে কি ছিল। তুমি কি তোমার মাতার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করবে না? আর তুমি যার কথা ভাবছ, সেই চন্দ্র তার কোনো বংশ নেই, কোনো কূল নেই, তবে কেমন করে তার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিই। তাতে কি রাজ সম্মান থাকবে?

             পিতা তুমি তোমার রাজ সম্মান নিয়ে থাক, আমি তা চাইনা। আমি শুধু চন্দ্রকেই চাই। আর কিছু না। আর মাতার কথা বলছ, মা যদি থাকত তাহলে এই সম্পর্কটি নিশ্চয়ই মেনে নিত—

               সেসব কথা এখন থাক চন্দ্রিমা। তুমি আগে খেয়ে নাও। তোমার শরীর টার দিকে তো নজর রাখ।

          শরীরের খেয়াল করে কি করব, এই শরীরের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে!

          সুনয়নাও অনেকবার অনুরোধ করল খেতে কিন্তু কোনো ফল হল না। অমরেন্দ্রনাথ রেগে চলে গেলন। দিন দিন চন্দ্রিমার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। প্রায় মাসখানেক যাবার পরে চন্দ্রিমা অসুখে পড়ল। অমরেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত কন্যার অবস্থা দেখে নিজের জেদ ছেড়ে দিয়ে চন্দ্রকে জামাতা রূপে স্বীকার করলেন।

              


                                   ৭

   সমগ্র রাজপ্রাসাদ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। চারিদিকে একেবারে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। সমগ্র নগরী জুড়ে আনন্দের ধুম লেগে উঠল। চারিদিকে গান -বাজনা, আমোদ- প্রমোদ চলতে লাগল। বিাহের একমাস আগে থেকেই নগরজুড়ে আনন্দের ধুম পড়ল, যা বিবাহের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে শেষ হল।

      বিবাহ শেষ হবার ছয় মাসের মধ্যে অমরেন্দ্রনাথ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন কিন্তু এবার আর অসুখটা সারল না, দিন দিন বেড়েই চলল। রাজ্যের যত রাজবৈদ্য এমনকি অন্য রাজ্য থেকেও ডেকে আনা হল, কিন্তু তাতেও কোনো ফল লক্ষ্য করা গেল না। শেষে সকলেই বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিল, শুধু ছাড়ল না চন্দ্রিমা। নানারকম ঔষধ এর ব্যবস্থা করল এখান থেকে ওখান থেকে কিন্তু কোনো ফল হল না। সব চেষ্টা বিফলে ফেলে অমরেন্দ্রনাথ কন্যার হাতে রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন।

         আনন্দের পরে ঠিক এক বছরের মধ্যে সমগ্র নগরী শোকের ছায়ায় ঢলে পড়ল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলের বিষণ্ণ, আনমনা, শোকাচ্ছন্ন। রাজ্যজুড়ে শোকের হাওয়া বয়ে গেল।

         বিক্রম দেব ঠিক এই সুযোগে অমরাবতী আক্রমণের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অমরাবতীকে জয় করতে হলে এটাই সঠিক সময়। এরপর আর হয়তো সুযোগ আসবে না। নারায়ণীর সেনাপতি বীর রায় সমগ্র সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বললেন মহারাজের আদেশের অপেক্ষার জন্য।

        এদিকে বিক্রম দেবের নির্দেশে বীর রায় সৈন্য সামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অমরাবতী অভিমুখে পদযাত্রা করলেন। সমগ্র আমরাবতী রাজ্যের সীমানা ঘিরে ফেলল। এদিকে চন্দ্রিমা কিছুই জানতে পারল না যে রাজ্যে কি বিপদ ঘনিয়ে আসছে ‌।

           বিক্রম দেবের নির্দেশে বীর রায় রাত্রে শেষ প্রহরে যখন গভীর ঘুমে অমরাবতী নগরী আচ্ছন্ন, তখন হঠাৎ সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অমরাবতী নগরী তীব্র কামানের শব্দে কেঁপে ওঠল। কেউ কিছু বুঝতে না পেরে চারিদিকে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে প্রজারা। নগরে হঠাৎ শোকের মধ্যে ত্রাহী ত্রাহী ভাব জেগে ওঠে। মহারানী চন্দ্রিমা কিছু বুঝতে না পেরে সেনাপতিকে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেন। সেনারা পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিল না। ফলে যে যেখানে যেটা হাতের কাছে পেল সেটা নিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে গেল। চন্দ্রিমা প্রস্তুত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যায়। যাবার সময় চন্দ্রকে শেষবারের মতো ভালো করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, অশ্রু ভরা চোখে বলে, হয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা! বিধাতার কি যে লিখন—পিতাকে হারালাম আর না জানি কি কি হারাতে হবে! আর কি দেখা হবে আমাদের—

       চন্দ্রের চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। রাজকুমারী চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, এই শেষ বিদায় দৃশ্য তুমি আমাকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় দিও না। তোমার হাসি দেখেই আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম—এই হাসি নিয়েই যেন আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি। তোমার শেষ হাসিটুকু আজ—

          বলতে বলতে মহারানীর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর বেশি কিছু বলতে পারল না। চন্দ্রও শেষবারের মতো হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু হাসির বিনিময় অশ্রুই চোখে যেন চলে আসল।

         বিদায় দৃশ্য শেষ হতে না হতেই শোক সংবাদ নিয়ে এল দূত। অস্ত্র গুরু যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এই সংবাদে চন্দ্রিমা আর সময় নষ্ট না করে সখী ও সেনার কাছে শেষ বিদায় নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করল। এদিকে রাজপ্রাসাদের দায়িত্ব ভদ্রমল্লের হস্তে অর্পণ করে সুনয়নাকে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন রাজকুমারী।

         অমরাবতীর সৈন্য সামন্তরা তীব্র কামানের আঘাতে স্থির দাঁড়াতে পারল না কিন্তু চন্দ্রিমা একাই অশ্বপৃষ্ঠে সমস্ত সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে লাগল। চন্দ্রিমার আদর্শে সকল সেনা উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে বীর রায়ের বাহিনীর উপর পাল্টা গোলাবর্ষণ করল। এতে বীর রায় প্রচন্ড ক্ষতির সম্মুখীন হল। বীর রায় আবার গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালাতে থাকল। এদিকে মুহূর্তে মুহূর্তে রাজপ্রাসাদে যুদ্ধের বার্তা আসতে লাগল। যতই সময় গড়াতে থাকল, ততোই ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ আসতে লাগল। আর এই সংবাদ শুনেই সখী ও চন্দ্রের মন মাঝে মাঝে বিচলিত হতে লাগল। আশঙ্কায় সমস্ত রাত্রি ঘুম আর আসল না সমগ্র অমরাবতীর।

        এদিকে সোনা সেও আর থাকতে না পেরে সখীর নির্দেশ অমান্য করে চন্দ্রিমাকে সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। বীর রায়ের সেনা ছাউনির সমস্ত খবর সোনা চন্দ্রিমাকে দিতে লাগল এবং চন্দ্রিমা একের পর এক আঘাত করে চলল শত্রুপক্ষের সেনাকে। বীর রায় এতে বিচলিত হয়ে উঠল। তার পরিকল্পনা যখন একে একে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক সেই সময় হারু ব্যাধ তার মুশকিল আসান করল। শিকারী শিকারকে নাগালে পেলে কি আর ছাড়ে? যার জন্য হারু রাজ্য ছাড়া হয়েছিল হঠাৎ করে আজকে তাকে পেয়ে তীর ছোড়ে। সেই তীরে সোনা প্রাণ হারিয়ে চন্দ্রিমার পদতলে পড়ে। হারু আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

         চন্দ্রিমা এক মুহূর্তে যেন হতভম্ভ হয়ে যায়। হাতে অস্ত্র যেন হাত থেকে বারবার মাটিতে পড়ে যায়। চোখ দিয়ে যেন ঝরঝর করে অশ্রুর ফোয়ারা ছুটতে থাকে।

          মহারানী এমন অবস্থার কথা শুনে চন্দ্র, সুনয়না, ভদ্রমল্লও ছুটে আসে যুদ্ধক্ষেত্রে। চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে সোনার দেহকে কোলে তুলে নিয়ে বসে থাকে। ভদ্রমল্লও যুদ্ধ করতে করতে গোলার আঘাতে মারা যায়। এদিকে চন্দ্র যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না হলেও কিছু কিছু বিদ্যা শিখেছিল। সে সেটুকু অবলমন করেই যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা তীর এসে তাকে বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে রণভূমি লুটিয়ে পড়ে। চন্দ্রিমা ছুটে যায় সোনাকে ছেড়ে। চন্দ্রের মাথাকে নিজের কোলের উপর রেখে কেঁদেই চলে। সখী তাকে নানাভাবে প্রবোধের চেষ্টা করলেও চোখের জল যেন আর থামছে না। চন্দ্র চন্দ্রিমার এই অবস্থা দেখে শেষবারের মতো বলে, কেঁদোনা চন্দ্রিমা, হয়তো ভাগ্যে এটাই ছিল! এই পর্যন্তই সঙ্গ ছিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে, এখন আবার চোখের সামনে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠছে…. কত দ্রুত চলে গেল সেই সময়! আবার একটু থেমে, তবে কেঁদো না চন্দ্রিমা, তুমিই তো আমার একমাত্র চন্দ্রিমা। আজ এই চন্দ্র চলে গেলেও তোমাকে ম্লাল হলে চলবে না। তুমি এই রাজ্যের চন্দ্রিমা! তোমার প্রভায় যেন রাজ্য আলোকিত হয়!.... আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও চন্দ্রিমা, এই এটাই তো জীবনের শেষ ইচ্ছা!

         বলতে বলতে চন্দ্রের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। চন্দ্রিমা একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু হাসির বিনিময়ে চোখে জলই চলে এল। প্রায় শেষ প্রহরের চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

       চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ মৌন থাকল, সখী শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে লাগল। শেষে অমরাবতীর বাহিনী যখন পরাস্ত হতে শুরু করল চন্দ্রিমা তখন প্রচন্ড বিক্রমে জীবন- মরণকে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে চলল। তীব্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বেজে উঠল। রাজকুমারীর বিক্রমের কাছে কোনো সৈন্যই স্থায়ী হতে পারছিল না।

        এবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং বীর রায়ের সঙ্গে চন্দ্রিমার সংঘর্ষ বাধল। বীর রায়ের অসির আঘাতে মহারানী আহত হল। কিন্তু সেই আঘাত নিয়েই চন্দ্রিমা অমরাবতীর জন্য লড়াই করতে লাগল। শেষে বীর রায়ের মৃত্যু হল মহারানীর হাতে। এতে নারায়নী সেনারা সন্ত্রস্ত ও ভীত হয়ে পলায়ন করলেন। কিন্তু তার মধ্যে এক ধূর্ত সৈনিক ছিল, যে যাবার আগে মহারানীকে উপলক্ষ করে তিনি নিক্ষেপ করে, সেই তীরে চন্দ্রিমা লুটিয়ে পড়ে। সেই সৈন্যও রাজকুমারীর তীরে নিহত হয়। দীর্ঘ চার দিন ধরে চলা যুদ্ধে অমরাবতী যুদ্ধে জয়লাভ করলেও যুদ্ধের সবকিছু শেষ হয়ে যায়। সখীও মারা যায় যুদ্ধ করতে করতে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে।

        যুদ্ধে রাজ্যতো বাঁচল, আর কিছু থাকল না।  যুদ্ধের পর থেকে রাজ্যে হাহাকার জেগে উঠল। সমগ্র রাজ্য যেন বিষাদে ডুবে গেল। মহারানী সখী ও গুরুদেবের ভবিষ্যৎ বাণীকে সম্ভব করে নিজের জীবন দিয়ে রাজ্যকে রক্ষা করল কিন্তু নিজে নিঃশেষ হয়ে গেল!

          রাজ উদ্যানে যে ভালবাসার গল্প শুরু হয়েছিল, তার একটিও পাত্র-পাত্রী আর জীবিত নেই! রাজ উদ্যান, রাজপ্রাসাদ, এখন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে রয়েছে; আর রয়েছে শতশত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ। সেই শবগুলির মধ্যে মহারানী, মহারাজ, সুনয়না, ভদ্রমল্ল ও সোনা, সকলের দেহ এখানে ওখানে ছড়ানো রয়েছে।

        এই সংঘর্ষে বিক্রমদেবেরও অনেক ক্ষতি হয়েছিল। এরপর বিক্রমদেব যুদ্ধের আশা পরিত্যাগ করলেন।

       অমরাবতী এরপর আবার হয়তো আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু সেই ক্ষত—হয়তো জেগেই থাকবে অমরাবতীর মনের কোণে!


                              _____________