Wednesday, October 23, 2024

টিউশন - পায়েল বিশ্বাস || Tution - Payel Biswas || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

    টিউশন

      পায়েল বিশ্বাস 



" অজয়, আরে ওই অজয়।"

নিজের নাম শুনে চমকে পিছন ফিরে দেখে তন্ময়। 

"কি হয়েছে? ডাকছিস কেন?"

"শোন না, একটা টিউশন আছে। করবি?"

এবার অজয়ের পাংশুমুখে হাজার বাতির আলো জ্বলে উঠল। এম.এ. পাশ করে দুই বছর যাবত চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে জুতোর শুকতলা খুইয়ে ফেললেও এখনো সে বেকার। বাবার সামান্য চাকরির টাকায় বাপ বেটার চললেও ওরও হাত খরচ আছে কিছু। আর কত কালই বা সে বাবার হোটেলে খাবে! এখন তো সব খরচ তারই করা উচিত। তাই যতদিন না চাকরি পায় ততদিন এই টিউশনি করে কিছু টাকা বাবার হাতে দিলে অজয়ের শান্তি। মা তো সেই ছোট্ট থাকতেই মারা গেছিলেন। অজয় মানুষ তার দিদি বিজয়ার হাতে। দিদি না, বিজয়া হল অজয়ের যশোদা মা। যতদিন অজয়ের কাছে ছিল তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখত। বিজয়ার বিয়ের পর থেকে তাই অজয় প্রতি মূহুর্তে দিদির অভাব বুঝতে পারে।



" হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই করব। কোথায় পড়াতে যেতে হবে জলদি বল।"



" আরে ওই তো ইস্ট পার্কের একদম শেষে পাঁচিল ঘেরা যে বাড়িটা আছে, ওখানে যেতে হবে। "



" তুই কি ইয়ার্কি মারছিস? ওই বাড়িটায় তো কেউ থাকে না। " এবার অজয় একটু রেগে গিয়ে বলল।



" থাকত না। কিন্তু এখন এক মহিলা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে ওখানে থাকছে। ছেলেটির কিছু সমস্যা আছে তাই সে স্কুলে যায় না। কিন্তু প্রতিটি ক্লাসের পড়া সে বাড়ির শিক্ষকের কাছে পড়ে নেয়। এই ছেলেটিকেই তোকে ক্লাস টুয়ের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াতে হবে। সপ্তাহে চারদিন পড়াবি। তিন হাজার টাকা দেবে।"



তিন হাজার দেবে শুনে অজয় সানন্দে রাজি হয়ে গেল৷ 



তন্ময়ের কথামত অজয় ইস্ট পার্কের শেষ প্রান্তের পাঁচিল ঘেরা বাড়িটায় আসল সেদিন বিকেলেই। জায়গাটি বেশ নির্জন। এখানে এসে অজয়ের মনে হল ও যেন কোনো একটা মনুষ্য বর্জিত দ্বীপে এসে গেছে। কেউ কোথাও নেই শুধু ও একা এক জীবন্ত প্রাণী। কোনো পাখির হাঁকডাকও কানে এল না। পাঁচিল লাগোয়া গেট খুলে বাড়ির চৌহিদ্দির মধ্যে প্রবেশ করল অজয়। একরাশ আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে বাড়িটার সামনের বারান্দায় উঠল সে। দরজায় ঠকঠক করল। তিন বছর আগে যখন দত্ত কাকুরা এখানে থাকতেন তখন এই বাড়ির বাগান রকমারি ফুলে ফলে ভরে থাকত। পাড়ার বাচ্চাদের অবাধ প্রবেশ ছিল এখানে। যদিও গলির একদম শেষ প্রান্তে বলে তেমন কেউ আসত না। তবে ঋতু অনুযায়ী সব ফল পাকুড় সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন দত্ত কাকুরা। মহামারীতে পর পর স্বামী স্ত্রী মারা যেতে এই বাড়িটি পরিত্যক্ত একাকী হয়ে গেল। সুন্দর বাগান আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। দত্ত কাকুরা নিঃসন্তান ছিলেন বলেই জানত অজয়। তাহলে এখন যারা এখানে বাস করে তারা দত্ত কাকুদের কে হয় কে জানে! 



কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলে তাকে দেখে অজয় স্তম্ভিত হয়ে গেল। এক মূর্তিমতী বিষাদ প্রতিমা যেন দাঁড়িয়ে। অজয়ের থেকে বড়োই হবে! বিষন্ন মুখ হলেও হালকা হলুদ শাড়িতে তার বেশ মমতাময়ী লাগছে। মহিলাটিকে দেখে অজয়ের নিজের দিদির কথা মনে পড়ল। অজয়ের দিদির মুখশ্রীও এই রকম স্নেহময়। মহিলাটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অজয়ের দিকে তাকালে অজয় তার আগমনের হেতু জানাল। ভদ্রমহিলা তখন একটু হেসে তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা নিজের নাম রিটা সেন থমাস বলল। ওরা আগে ইতালিতে থাকত। সেখানে তার স্বামীর মৃত্যুর পর এখানে এসেছে। দত্তকাকু সম্পর্কে রিটার মামা হয়। মামা মামীর মৃত্যুর পর পুরো সম্পত্তি এখন রিটার। 



এই সময় হঠাৎ পাশের ঘরের দরজার দিকে নজর গেল অজয়ের। একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে অজয়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটির নীল চোখের দিকে তাকিয়ে অজয়ের কেমন যেন অস্বস্তি হল। তাও সে একটু হেসে বাচ্চাটিকে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করল।  



" আমার নাম রবার্ট। আমায় তুমি রবি বলে ডেকো। তুমি কি আমার নতুন স্যার?"



রবির আধো আধো কথা অজয়ের খুব ভালো লাগলো। সে রিটার দিকে সম্মতির জন্য তাকালো। রিটা স্মিত হেসে রবিকে বলল," হ্যাঁ। উনি তোমায় সোমবার থেকে পড়াতে আসবেন। "



রবি প্রথম প্রথম খুব আড়ষ্ট হয়ে থাকতো। ধীরে ধীরে অজয়ের সাথে সে সহজ হয়ে গেল। তবে পড়ার থেকে ঘরের চার দেওয়ালের বাইরের জগত নিয়ে রবির খুব আগ্রহ। প্রায়ই অজয়ের কাছে বায়না করে অজয়ের বাড়ির কথা, পাড়া, বন্ধুবান্ধবদের কথা জানতে চায়। আসলে খাঁচার পাখি তো, তাই মুক্ত পরিবেশকে রবি অজয়ের চোখ দিয়ে কল্পনা করতে চায়। 



অজয় বেশ মন দিয়েই রবিকে পড়ায়। অবশ্য বইয়ের চেয়ে রিটার দিকেই তার মনোযোগ বেশি । রিটার হাঁটাচলা কথা বলার ভঙ্গিতে অজয় তার দিদিকেই যেন ফিরে পায়। তাই সে রিটাকে দিদি বলেই ডাকে। তবে কয়েকটা ব্যাপার অজয়ের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। রবিদের বাড়িতে ঢুকলে অজয়ের কেমন গা ছমছম করে। সব সময় ওর মনে হয় কেউ যেন ওর উপর নজর রাখছে। মাঝে মাঝে হুট করে এক ছায়াকে সরে যেতেও দেখে সে। এছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, রবিকে পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে অজয় শুনতে পায় রিটা কারোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। একদিন তো রবিকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল," তোমাদের বাড়িতে কি কেউ এসেছেন যার সাথে তোমার মা কথা বলছে?"



" না,না, স্যার। মা তো বাবার সাথে কথা বলছে।"



" বাবা!! তোমার বাবা তো মারা গেছেন। তাহলে? "



" মা মনে করে বাবা মরে গিয়েও এখনো আমাদের সাথেই আছে। " পাংশুমুখে রবি বলে।



অজয় বুঝল স্বামীকে এখনো রিটা খুব ভালোবাসে তাই তাকে কল্পনা করে তার সাথে কথা বলে। অজয়ের মন বিষাদের মেঘে ঢেকে গেল। অজয় ভাবল, সেও তো অনেক সময় মনে মনে দিদির সাথে কথা বলে। 



একদিন রিটার কথা ভাবতে ভাবতে যখন সে ওদের বাড়ি গেল তখন দেখল রিটা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। 



" ভালোই হল স্যার। আমি একটু বাজারে যাচ্ছি। আপনি রবিকে পড়ান। আপনার যাওয়ার আগেই আমি চলে আসব।"



ঘাড় নেড়ে ঘরে ঢুকে অজয় দেখল রবি মুখ কালো করে বসে আছে।



" আরে মন খারাপের কি আছে? আমি তো আছি। তাছাড়া মা তো কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসবে।" 



" মা, একাই গেল। আমায় নিয়ে গেল না।" গাল ফুলিয়ে রবি বলল।



" তুমি গিয়ে কি করবে? বাজার খুব নোংরা জায়গা।" অজয় রবিকে বোঝাল।



" মা, আমায় কোথাও নিয়ে যায় না। এমনকি এই ঘর থেকে বাগানে অবধি যেতে দেয় না।"



" সেকি! কেন?" এবার একটু অবাক হল অজয়।



" জানি না। ও স্যার তুমি আমায় একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে? আমার এই ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকতে ভালো লাগে না।" রবি কাতর দৃষ্টিতে অজয়ের দিকে তাকাল । 



 রবির কথা শুনে অজয় অবাক হয়ে বলল," ঠিক আছে। আমি রিটাদিকে বলব তোমায় একটু পার্কে নিয়ে যাবে।"



" মা কোনো দিনই আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে না। তুমি আমায় নিয়ে চলো।"



রবিকে না বোঝাতে পেরে শেষে অজয় নিমরাজি হল। 



রবির পড়া শেষ হওয়ার আগেই রিটা বাজার করে ফিরে এল। বাড়ি ফেরার সময় অজয় আস্তে করে রিটাকে বাইরে বাগানের দিকে আসতে বলল। রিটা একটু অবাক হলেও অজয়ের পিছু পিছু বাগানে এল।



 শুক্লপক্ষ শুরু হয়েছে। বাগানে হালকা চাঁদের আলোয় এক আলো আঁধারির রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রিটা এই কয়দিনেই বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে বিভিন্ন ফুল ফলের গাছ লাগিয়েছে। বাগানের ঠিক মাঝখানে আবার একটা দোলনাও বসিয়েছে। বাগানের চারপাশে পাঁচিল ঘেঁষে বড় বড় গাছগুলো এমন ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে যে বাইরে থেকে এখানকার অস্তিত্ব সমন্ধে কেউ অবগত হতে পারে না। এখন সবে সন্ধ্যা সাতটা। অথচ মনে হচ্ছে যে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁয়েছে। 



রিটা আর অজয় দোলনায় বসল। অজয় রবির মন খারাপের কথা সব খুলে বলল।



রিটা নত মস্তকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে তারপর মুখ তুলে অজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল," রবি ঠিকই বলেছে। আমি কোনো দিন ওকে বাইরে যেতে দেব না যত দিন না ও বড়ো হয়।"



" কেন?" অবাক হয়ে অজয় প্রশ্ন করল। 



" আমি জানি না কেন আজ আপনাকে আমার কষ্টের কথা, মনের কথা বলতে ইচ্ছা করছে। "



অজয় রিটার চোখে চোখ রেখে বলল," আপনি আমায় বিশ্বাস করে সব বলতে পারেন। " 



" সব বলব। কিন্তু কথা দাও ভাই, তুমি কাউকে বলবে না। " বলে রিটা অজয়ের হাত চেপে ধরল। 


রিটার মুখে ভাই ডাক শুনে অজয়ের মনটা খুশিতে ভরে গেল 



" রবির বাবাকে খুন করা হয়েছিল। কে বা কারা, কেন করেছিল, জানি না। আমাদেরও কয়েকবার খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই আমি ইতালি থেকে এখানে পালিয়ে আসি মামা মামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। যদি আমাদের খবর খুনীরা পেয়ে যায় তাই আমি পারতপক্ষে বেরোই না। রবিকেও তাই ঘরেই আগলে রাখি পাছে ওরা রবির অস্তিত্ব জেনে যায়৷ রবি বাচ্চা মানুষ, মানুষ চেনে না। বাইরে বেরোলে যদি ওরা ওকে অপহরণ করে, তাই আমি ওকে বেরোতে দিই না। মায়ের মন তো। তাই সর্বদা ভয়ে থাকি। রবি ছাড়া তো কেউ নেই আমার।"



" কে বলেছে কেউ নেই! আমি তো আছি, আপনার ভাই।" অজয় আবেগের সাথে বলল। 



রিটা অজয়ের কথা শুনে স্মিত হাসল।


এখন প্রায়ই নিজের দিদি বিজয়াকে স্বপ্নে দেখে অজয়। আগে দেখত না তেমন। যবে থেকে রিটাকে দেখেছে, সেইদিন থেকেই অজয় দিদিকে প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখে। কিন্তু দিদির মুখটা যে বড়ো বিষন্ন! অনেক সময় স্বপ্ন আর বাস্তবতা এমনভাবে মিলেমিশে যায় যেন অজয়ের মনে হয় এই তো দিদি তার পাশেই বসে আছে।



ইদানীং রবি বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অজয়কে পাগল করে তুলছে । পড়ায় আর তার মন নেই। সব সময় জানালা দিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ এদিকে অজয়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। দিনে দিনে কেমন যেন দূর্বল হয়ে পড়ছে।



একদিন অজয় পড়াতে গেছে। দরজায় কড়াঘাত করতে যাবে, তখন শুনতে পেল রিটা রবিকে বলছে," একদম অজয়কে নিয়ে বাইরে যাবি না। আর এই ভুল করিস না। আমি পালাতে পালাতে ক্লান্ত। নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা কর। সঠিক সময় আসুক তখনই না হয় যা ইচ্ছা তাই করিস।"



"এসব কি বলছে রিটা! কি করতে চায় রবি ওকে নিয়ে!" অজয় হতবাক হয়ে যখন ভাবল ঠিক তখনই রিটা দরজা খুলে বাইরে এসে অজয়কে দেখে এক গাল হেসে বলল," প্লিজ একটু রবিকে সামলাও ভাই। ঘরে একদম তেল নেই। তাই আমি একটু বাজার যাচ্ছি।" 



দিদির কথা কি ভাই ফেলতে পারে! অগত্যা ভাগ্নেকে সামলাতে মামা নিজেকে প্রস্তুত করল।




" কি হল, মন খারাপ আবার?"



জানালার দিকে মুখ করে রবি বলল," আমায় আজ দরজার ছিটকানিটা খুলে দিতেই হবে। আমি বাগানে যাব।" 



" একদম না। মার বারণ আছে।"



" প্লিজ স্যার। আমায় আজ বাইরে যেতেই হবে। ওই আকাশের গোল চাঁদ যে আমায় ডাকছে। "



" মানে?" অবাক হল অজয়।



" জানেন স্যার আমি না একটা ম্যাজিক জানি। আপনি চলুন আমার সাথে বাগানে। ওখানে দেখাব।"



" কেন? এখানে দেখা। " 



" এখানে হবে না স্যার। বাগানেই হবে যে ম্যাজিকটা৷ তাড়াতাড়ি চলুন। মা আসার আগেই।"



কিছুটা কৌতূহলে আর কিছুটা রবির জোরাজোরিতে, অজয় রবিকে নিয়ে বাগানে এল। সারা বাগান আসন্ন পূর্ণিমার রূপালি আলোতে তখন প্লাবিত হচ্ছে। নিস্তব্ধ নিঝুমতা চারিদিকে বিরাজমান। যদিও সবে শীতকালের শুরু, তবুও এর মধ্যেই একটা হালকা কুয়াশা বাড়িসহ বাগানটাকে যেন এক অস্পষ্ট ধোঁয়াটে আবরণে ঢেকে রেখেছে। রবি এক মনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে রবির ছোট্ট শরীরটা কাঁপতে লাগলো আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে নাকি ছোট্ট বাচ্চাটার! অজয় ছুটে রবির কাছে যাওয়ার আগেই সে মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগলো।  



" কি হয়েছে রবি? কি কষ্ট হচ্ছে?" রবির কাছে গিয়ে অজয় চমকে গেল। এক অজানা আশংকায় অজয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব! 



রবি চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুখ হাঁ করে আছে। ওর ছোট্ট ছোট্ট দন্তরাশির মধ্যে শ্ব দন্ত দুটি অস্বাভাবিক বড় ও সূচালো হয়ে উঠেছে। সেগুলো চাঁদের আলোয় ছুরির ফলার মত চকচক করছে। রবি অজয়ের দিকে তাকালো। প্রচন্ড আতংকে অজয় ছিটকে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। রবির চোখে মণি বলে কিছু নেই, পুরো কালো চোখদুটো। রবির শিশুসুলভ শরীরটার এক অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হল। সারা শরীর পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে নেকড়ের রূপ নিল। এক জান্তব গন্ধ বাতাসে ভর করে অজয়ের শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চাইল৷ অজয় এসব দেখে তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল। ওর মনে হতে লাগলো ও যা দেখছে তা সবই ওর কল্পনা। বাস্তবে এরকম হতেই পারে না। নেকড়ে -মানবরূপী রবি এবার অজয়ের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল। চরম আতংকে অজয় পিছাতে লাগলো।  



" কেন ওকে এখানে নিয়ে এলে?" 



রিটার গলার স্বরে বামদিকে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টায় অজয় রিটার কাছে দৌড়ে গেল।



" ভয় নেই। আমি তো আছি, তোমার দিদি।" বলে রিটা অজয়কে নিজের পিছনে আড়াল করল। অজয় তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। 



" রবি, আমি তোর মা। আমি বলছি তুই আর এগোবি না।"



রবি মুখ দিয়ে একটা জান্তব শব্দ বার করে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল। 



" রবি, একই ভুল বার বার করিস না। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা কর। এখনো সময় হয়নি তোর শিকারের।"



এসব রিটা কি বলছে, কিসের শিকার? 



" এসো অজয়, আমার কাছে এসো৷ আমার কাছে থাকলে রবি কিছু করতে পারবে না।" 



কিন্তু রবি তার মায়ের কথা শুনল না। এক পা এক পা করে এগোতে লাগলো। অজয়ের পুরো শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে গেল। এমন সময় একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী রিটার চারদিকে পাক খেতে লাগলো। ধীরে ধীরে সেটি পুঞ্জীভূত হয়ে একটি পুরুষের রূপ পরিগ্রহণ করলে রিটা তার দিকে তাকিয়ে বলল , " দেখো, তোমার ছেলের কান্ড। অবশ্য ওর দোষ নেই। বাচ্চা মানুষ, বায়না তো করবেই। আমি তো বার বার এই বোকা অজয়কে বারণ করেছিলাম রবিকে ঘরের বাইরে না আনতে। তোমার মৃত্যুর পর আর রবির পরিচয় জানাজানির আশংকায় আমি ওকে নিয়ে এখানে পালিয়ে আসি। চেষ্টা করে গেছি যাতে রবি ঘরের বাইরে না বেরোয়, চাঁদ না দেখে। প্রতি পূর্ণিমায় আমার ডাইনীবিদ্যার জোরে একটা না একটা শিকার রবির জন্য ঠিক এনে দিতাম। আবার ঘরে বসে মূর্খ হলেও তো চলবে না। তাই অজয়কে রেখেছিলাম ওকে পড়ানোর জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সব ভেস্তে গেল।"



তারপর রিটা অজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, " তোমায় নিয়ে আমার অনেক আশা ছিল। মৃত্যুর পর আমার স্বামীর শরীর নষ্ট হয়ে গেছিল বলে তার আত্মাকে পুনরায় তার শরীরে স্থাপন করতে পারিনি। তাই ইচ্ছা ছিল তোমার শরীরে তাকে পুনঃস্থাপিত করার। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যাতে আগামী অমাবস্যায় পুরোপুরিই আমার স্বামী তোমার শরীরের দখল নিতে পারে। কিন্তু তুমি আমার সব আশায় জল ঢেলে দিলে। নাও, এখন মরো।"


তারপর রবির দিকে তাকিয়ে বলল," একসাথে সব মাংস খাস না। কিছু ফ্রিজে রেখে দেব৷ এক সপ্তাহ ধরে খাবি। "


অজয় এবার করুণ চোখে রিটার দিকে তাকিয়ে বলল," আপনাকে আমি নিজের দিদি বলে মনে করতাম। কিন্তু সেই আপনি আমায় নিয়ে এত নৃশংস পরিকল্পনা করেছিলেন? কি করে পারলেন আপনি?"


রিটা মুখটা বিকৃত করে বলল," দিদি? আমি কেন তোর মড়া দিদি হতে যাব? তোদের মতো বোকারাই তো আমার ছেলের খাবার।" রবির দিকে তাকিয়ে রিটা তাকে তাড়া দিয়ে বলল," নে, আর দেরি করিস না। বুদ্ধুটাকে শেষ কর এবার।"


রবি এবার অজয়ের টুঁটি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। কিন্তু অজয় অবধি পৌঁছাতে পারল না। তার আগেই কিসের এক আঘাতে ছিটকে পড়ে গেল। রিটা অবাক হয়ে অজয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা হালকা সাদাটে কুয়াশার আবরণ অজয়কে ঘিরে পাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি গাঢ় হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। দুই হাত দিয়ে সে অজয়কে আড়াল করে রইল।


" দিদি" বিস্মিত অজয়ের মুখ দিয়ে এই শব্দ বেরিয়ে এল।


" আমি তোকে অনেকবার সাবধান করেছিলাম ভাই।" নারীমূর্তিটি অজয়ে দিকে ফিরে বলল।


" তোর কথা বড্ড মনে পড়ত। তাই... "


" সবাই আপন হয় না ভাই।"


" দিদি ভাইয়ের কথা শেষ হয়েছে? এবার পেত্নী দিদি সরে যা তো। আমার ছেলের খুব খিদে পেয়েছে। " রিটা বিরক্ত হয়ে বলল। 


বিজয়া কিছু না বলে অজয়কে ফিসফিস করে বলল," ভাই তুই পালা। আমি এদের ঠেকিয়ে রাখছি।" 


" তুই একটা সাধারণ পেত্নী হয়ে আমাদের ঠেকাবি? তোর এত ক্ষমতা? মানুষ হোক বা পেত্নী কেউ আমার ছেলে আর তার খাবারের মাঝে এলে, তাকে আমি নিশ্চিহ্ন করে দেব।" বলে পালাতে উদ্যত অজয়ের দিকে এগিয়ে গেল রিটা। 


" খবরদার!" বিজয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠে রিটার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে এক আছাড় মারল। তারপর অজয়কে বলল," পালা শিগগির।"


অজয় প্রাণের ভয়ে দৌড় লাগালো। বাগানের আগাছা অজয়ের পায়ে জড়িয়ে গতি রোধ করতে চাইল। কিন্তু অজয়কে থামলে চলবে না। কোনোমতে রিটাদের বাড়ির চৌহিদ্দী পেরিয়ে অন্ধকার নির্জন গলির মধ্য দিয়ে ঊর্ধশ্বাসে ছুটলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অজয় জানে না আজ ওর বাড়িও নিরাপদ কিনা এই রক্তপিশাচদের হাত থেকে। বিজয়া কি পারবে ওকে রক্ষা করতে? বিজয়া একা আর ওরা তিনজন। বাড়ির কাছাকাছি এসে কি মনে হতে একবার পিছন ফিরল অজয়, দেখল একটা কালো ধোঁয়া তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। প্রচন্ড আতংকে অজয় দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। কালো ধোঁয়া অজয়ের কাছে এগিয়ে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় অজয় দেখল কালো ধোঁয়ার মাঝে তীব্র জিঘাংসায় ভরা রিটার স্বামীর মুখ। রিটার স্বামী হাত বাড়িয়ে যেই অজয়কে ধরতে যাবে তখনই অজয়ের বাবা দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকেই সাথে সাথে অজয় দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। 


বাবার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ধীরে ধীরে সব ঘটনা অজয় খুলে বলল। বিজয়ার কথা শুনে ওর বাবার দুই চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো।  


" মেয়েটা তোকে আজও আগলে রেখেছে। মরার পরও তোর টানে রক্ষা করতে ছুটে এসেছে।"


বাবার কথায় অজয় বলল," হ্যাঁ বাবা। মৃত্যুই সব শেষ নয়। আমি বৃথাই কষ্ট পেতাম দিদি নেই বলে। হানিমুনে যাওয়ার পথে জামাইবাবুর সাথে দিদি যখন ট্রেন দূর্ঘটনায় মারা গেল, তখন বিশ্বাস করো বাবা, আমার মন বলত দিদি মরে গেলেও আমায় ছেড়ে যেতে পারে না। "


" তোর এই বিশ্বাসই ওকে বিপদে তোর কাছে পরপার থেকে টেনে এনেছে। " 


" বিপদ এখনো কাটেনি বাবা। আমাকে শিগগিরই লোকজন নিয়ে রিটাদের বাড়ি যেতে হবে। "


" খবরদার না। আজ রাতে বাড়ি থেকে বেরোবি না তুই। যা করার কাল হবে। আজ সারারাত আমরা ঠাকুরের সামনে গীতা পাঠ করব।"


সারারাত অজয় আর বাবা দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। পুরো রাত তাদের বাড়িকে ঘিরে যেন ঝড় বয়ে গেল আর তার সাথে কারো অপার্থিব গর্জন। কোনো অপশক্তি যেন প্রাণপণে ওদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে কিন্তু বার বার কিছুতে বাধা পাচ্ছে। সারারাত তান্ডব চলার পর ভোরের দিকে সব স্তিমিত হয়ে গেলে অজয় আর তার বাবা গীতা পাঠ বন্ধ করল। প্রচন্ড ক্লান্তিতে দুজনে ঠাকুরঘরেই শুয়ে পড়ল। দুই চোখের পাতা এক করার সময় অজয়ের মনে হল বিজয়া যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে," চিন্তা নেই ভাই। আমি তো আছি।" 


হঠাৎ দরজা ধাক্কার শব্দে অজয় চোখ খুলে দেখল ঘরে সূর্যের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। 


"এই অজয়, দরজা খোল।"


তন্ময়ের গলার শব্দ পেয়ে দরজা খুলল অজয়। 


" আরে, নটা বাজতে যায় এখনো ঘুমাচ্ছিস! আর এদিকে কত কান্ড হয়ে গেছে। "


" কি হয়েছে? "


" রিটাদের যে দুধ দেয় সে সকালে এসে আমায় বলল রিটাদের বাড়ি ভেঙে পড়েছে আর ওরাও বেপাত্তা। আমি যাচ্ছি ওখানে। তুইও চল।" 


তন্ময়ের কথায় অজয় বুঝল গত রাতে অজয়কে মারায় ব্যর্থ হওয়ায় এবং ধরা পড়ার ভয়ে রিটারা সব পালিয়েছে। 


" নে, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে। তুই যাবি না আমার সাথে?"


অজয় একবার ভাবল রিটাদের আসল রূপের কথা তন্ময়কে বলে দেয়। কিন্তু সেটা তন্ময় কেন কেউই বিশ্বাস করবে না। আর ওখানে গিয়েও এখন লাভ নেই। তাই সে অজয়কে জানিয়ে দিল সে যেতে পারবে না কারণ ওকে এখন ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। 


তন্ময়ের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে অজয় মনে মনে স্থির করল এবার একটা পাকা বন্দোবস্ত করতে হবে, একটা ভালো চাকরি করতেই হবে। তার বাবা, দিদির স্বপ্ন পুরণ তাকে করতেই হবে। আর তার চিন্তা কিসের! বিজয়ার স্নেহ আর আশীর্বাদ তো তার সাথেই আছে।





পরমবীর - দেবাংশু সরকার || Proambir - Debanshu Sarkar || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

                         পরমবীর

                              দেবাংশু সরকার 



      আজ হনুমান জয়ন্তী। অর্থাৎ মহাবীর বজরঙবালী শ্রী হনুমানের জন্মোৎসব। এক সময়ে এই উৎসব হিন্দি বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে সারা ভারতেই উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। আমাদের রাজ্যেও এখন হনুমান জয়ন্তী ঘটা করে পালিত হয়। মন্দিরে মন্দিরে হনুমান চালিশা পাঠ হয়। বড় বড় শোভা যাত্রা বের হয়। বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠে।


      বেশ ধুমধাম করে হনুমান জয়ন্তী পালিত হচ্ছে রাজুদের বাড়ি। রাজুর অর্থাৎ রাজেশ সিং। আমার বন্ধু। রাজুরা অবাঙালি হলেও, বহু বছর বাংলায় থাকার ফলে, বলতে গেলে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গেছে। রাজুর ঠাকুরদার বাবা কলকাতার বড় বাজারে কাজ করতে এসে কলকাতাতে বসবাস করতে শুরু করেন। বড় বাজারের কাছেই একটা ছোটো ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তারপর রাজুর ঠাকুরদা আমাদের পাড়ায় বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।  কথাবার্তা, চাল চলনে বোঝা যাবে না রাজুরা অবাঙালি। এমন কি রাজু পড়াশোনাও করেছে বাংলা মিডিয়ামে।


      রাজুদের বাড়িতে আজ আমরা কয়েকজন বন্ধু আমন্ত্রিত হয়েছি। একটা ঘরে বসে আমরা গল্প গুজব করছি, আর পুজো শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ পুজো শেষ হলেই প্লেট ভর্তি কেশর লাড্ডু, মালপোয়া  আসবে আমাদের জন্য। যদিও এর মধ্যে কোল্ড-ড্রিঙ্ক এবং সন্দেশ উদরসাৎ হয়েছে। রাজুর দাদুও আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন। 


      গল্প করতে করতে রাজুর দাদু বলতে থাকেন, "তোমরাতো জানো আমরা ইউ পির সাহজাহানপুরের  মানুষ। ইউ পিতেও খুব আড়ম্বরের সঙ্গে হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়। আমাদের সাহজাহানপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। আট বছর আগে অর্থাৎ দুহাজার ষোলো সালে আমাদের সাহজাহানপুরে হনুমানজীর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ছেলে ছোকরা থেকে বৃদ্ধ সকলের মনে কি আনন্দ! কি উদ্দীপনা!"


      কথাটা শুনে অবাক হয়ে আমি বললাম, "হনুমানজীর জন্মশত বার্ষিকী! ঠিক বুঝলাম না।"


      দাদু হেসে বললেন, "তুমি অবাক হচ্ছোতো বেটা। অবাক হওয়ারই কথা। আমাদের সাহজাহানপুরে উনিশ ষোলো সালের একুশে নভেম্বর স্বয়ং হনুমানজী অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ত্রেতা যুগে হনুমানজী যেরকম বিক্রম দেখিয়েছিলেন, এই কলি যুগের হনুমানজীও একই রকম বিক্রম দেখিয়েছিলেন উনিশ আটচল্লিশ সালে কাশ্মীরের নওশেরায়। সেই হনুমানজী আমাদের দেশের গৌরব, আমাদের জাতির গৌরব।"


      দাদুর কথা শুনে আমাদের কৌতুহল বেড়ে গেল। পুরো ঘটনাটা শোনার জন্য আমরা আগ্রহী হয়ে উঠলাম। দাদু বলতে শুরু করলেন সাহজাহানপুরের হনুমানজী অর্থাৎ যদুনাথ সিংয়ের বীরগাথা।


      উত্তর প্রদেশের সাহজাহানপুরের খাজুরি গ্রাম। চারিদিকে শষ্যক্ষেত, তার মাঝে কিছু মাটির বাড়ি। গ্রামের মানুষরা অধিকাংশই কৃষিজীবি। মহাজনের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে তারা চাষের কাজে নামে। শষ্যক্ষেতে জোয়ার, বাজরা, রাগী, বিভিন্ন প্রকার ডালশষ্য প্রভৃতি চাষ হয়। ফসল পাকলেই ফড়েরা গ্রামে হাজির হয়। অত্যন্ত কম দামে সেই ফসল কিনে নিয়ে যায়। কৃষকরা ফড়েদের কাছে স্বল্প মূল্যে সেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। গঞ্জে গিয়ে ন্যায্য দামে ফসল বিক্রি করার সুযোগ তাদের থাকে না। কারণ ফসল ফলতে শুরু করলেই মহাজনের লোকেরা এসে হাজির হয়, ধারের টাকা শোধ করার জন্য তাগাদা দিতে থাকে।


      গ্রামের মধ্যে এক মাটির বাড়িতে বাস করেন বীরবল সিং রাঠোর। পেশায় কৃষিজীবি। স্ত্রী এবং আট সন্তান নিয়ে তার বেশ বড় সংসার। একার উপার্জনে বীরবলের পক্ষে সংসার সামলানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। সংসার সামলাতে তার ছেলেরাও ক্ষেতে নামেন, হাল ধরেন। তবে তার সেজ ছেলে যদুনাথ অন্যরকম। পড়াশোনা করতে তার একটুও ভালো লাগে না। চতুর্থ শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করে স্কুলের পাট চুকিয়ে যদুনাথ নেমে পড়েন কৃষিকার্যে। সারাদিন ক্ষেতে কাজ করার পর সন্ধ্যার সময়ে যদুনাথ চলে যান মঠে, হনুমান চালিশা শুনতে। হনুমান চালিশা শুনতে তার খুব ভাল লাগে, মোহিত হয়ে যদুনাথ হনুমান চালিশা শুনতে থাকেন।  নানাজী ঠাকুরের সুরেলা কন্ঠের হনুমান চালিশা শুনে বিভোর হয়ে যান। কোথায় যেন হারিয়ে যান! মানস চক্ষে দেখতে পান, বীর হনুমান, বজ্রের ন্যায় অঙ্গ যার, তার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। রণক্ষেত্রে বিপক্ষ শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দেন হনুমানজী। যদুনাথ ভাবেন তিনিও একদিন এরকম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করবেন, বিপক্ষকে ধরাসায়ী করবেন।


      ক্ষেত থেকে ফেরার পথে কখনো কখনো যদুনাথ দাঁড়িয়ে পড়েন শের সিংয়ের আখড়ার সামনে। দেখতে থাকেন পালোয়ানদের কুস্তি। অবাক হয়ে দেখেন বিশালদেহী কুস্তিগীররা একে অপরকে অনায়াসে মাথার উপর তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলছে। যদুনাথ বোঝার চেষ্টা করেন তাদের দাঁও প্যাঁচগুলো। যদুনাথের লম্বা চওড়া সুঠাম চেহারা চোখে পড়ে শের সিংয়ের। 


      একদিন শের সিং যদুনাথকে ডেকে বলেন, "যদু তুই রোজ এখানে দাঁড়িয়ে কুস্তি দেখিস। তোর কুস্তি ভালো লাগে?"


      - "হ্যাঁ, কুস্তি আমার খুব ভালো লাগে।"


      - "শুধু কুস্তি দেখতে ভালো লাগে, নাকি কুস্তি করতে ইচ্ছা করে?"


      - "কুস্তি দেখতেও ভালো লাগে। কুস্তি লড়তেও ইচ্ছা করে। কিন্তু আমিতো দাঁও প্যাঁচ জানিনা। কি করে কুস্তি লড়বো?"


      - "যদি তোকে কুস্তির দাঁও প্যাঁচ শিখিয়ে দিই, তাহলে তুই ঐসব পালোয়ানদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে পারবি?"


      - "পারবো গুরুদেব, পারবো। এদের সবাইকে আমি একদিন হারিয়ে দেবো।"


      - "তুই যখন আমাকে গুরুদেব বললি, তখন তোকে আমি কুস্তির সব রকম দাঁও প্যাঁচ শেখাবো। এই তল্লাটের সেরা পালোয়ান করে তুলবো।"


      দুজনেই কথা রেখেছিলেন। শের সিং তার প্রিয় শিষ্য যদুনাথকে শেখাতে থাকেন কুস্তির যাবতীয় কলা কৌশল। দেখতে দেখতে যদুনাথ হয়ে উঠলেন এক কুশলী কুস্তিগীর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কেবল শক্তিই কুস্তির একমাত্র অস্ত্র নয়। ক্ষিপ্রতা এবং বুদ্ধিরও প্রয়োজন। প্রতিপক্ষের মানসিকতা, তার আক্রমণের ধরন বুঝে প্রতি আক্রমণ করলে সে সহজেই কাবু হবে। বেশ কিছু বড় মাপের কুস্তিগীরকে হারিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই যদুনাথের বেশ নাম ডাক হয়।


      সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী, সুদর্শন যদুনাথ যে কেবল শের সিংয়ের নজরে পড়েন তাই নয়, খাজুরি গ্রামের তরুণীদেরও হৃদয় হরণ করে নেন তিনি। কাঁধে হাল নিয়ে যদুনাথ যখন ক্ষেতে যান বা ঘর্মাক্ত কলেবরে আখড়া থেকে ফেরেন, গ্রামের মেয়েরা কেউ স্নানের ঘাট থেকে, কেউ বা গাছের আড়াল থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যদুনাথের দিকে। কিন্তু 'হনুমান ভকৎ বাল ব্রহ্মচারী' যদুনাথের সেসব দিকে নজর নেই। হনুমান চালিশা আর কুস্তি তার জীবনের ব্রত। অন্যদিকে বীরবল সিং তার বড় দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌমা এনেছেন। ছেলেদের সংসারী করেছেন। সেইসঙ্গে ঘরে বেশ কিছু টাকা, সোনা চাঁদি এনেছেন। ভাবছেন এবার যদুনাথের বিয়ে দেবেন। ঘটক লাগিয়েছেন। সেও কয়েকটা অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ের সন্ধান এনেছে। কিন্তু বীরবল সিং যদুনাথকে কিছুতেই বিয়ের ব্যাপারে রাজি করাতে পারছেন না। বারে বারে বোঝাচ্ছেন। যদুনাথের মাও বোঝাচ্ছেন। দাদা বৌদিরাও বোঝাচ্ছেন। না, কেউ পারছেন না যদুনাথকে ব্রহ্মচর্য ত্যাগ করে, সংসারী হওয়ার জন্য রাজি করাতে।


      অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে বীরবলের। বিয়ের ব্যাপারে যদুনাথের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ক্রমশ ঝগড়াতে পরিনত হয়। বিরক্ত হয়ে ঘর ছাড়েন যদুনাথ।  কিন্তু যাবেন কোথায়? সারাদিন খাওয়া জোটেনি। অভুক্ত শরীর ক্রমশ ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে আসছে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে যদুনাথ হাজির হলেন আখড়ায়। সেখানে তার পুরানো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। সে কিছুদিন হলো সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেই বন্ধু যদুনাথকে পরামর্শ দেয় পল্টনে ভর্তি হতে। পল্টনে ভর্তি হলে যদুনাথ পাবেন ভরপেট খাবার। সেইসঙ্গে আরো বড় মাপের কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগ। এক কথায় রাজি হয়ে যান যদুনাথ। ভালো খাবারের প্রলোভনতো আছেই, সেইসঙ্গে নিজের এলাকার কুস্তিগীরদের সঙ্গে মাসের পর মাস লড়তে লড়তে ব্যাপারটা ক্রমশ একঘেয়েমিতে দাঁড়িয়েছে। পল্টনে ঢুকলে আরও অনেক কুশলী কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগটাও তাকে প্রলোভিত করে। পল্টনে ভর্তি হলেন যদুনাথ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে চাকরি পেয়ে প্যারেড আর কুস্তি করে বেশ আনন্দেই দিন কাটতে থাকে যদুনাথের। 


      বিশ্ব জুড়ে বাজছে রণ দামামা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। বোমা বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠছে সমগ্র বিশ্ব। পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কখনো এগিয়ে যাচ্ছে মিত্র শক্তি,  কখনো আবার অক্ষ্যশক্তি। ঘনঘন পালা বদল ঘটছে যুদ্ধের। এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বযুদ্ধের আঁচ। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে কখনো মাথা তুলছে জাপান, কখনো আবার ইংল্যান্ড আমেরিকার যৌথ বাহিনী। 


      ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন যদুনাথ। যদুনাথের বন্দুকের নিখুঁত নিশানা, সেই সঙ্গে ধেয়ে আসা শত্রুদের কখনো মুষ্ঠাঘাতে, কখনো মল্লযুদ্ধ করে ধরাসায়ী করেছেন যদুনাথ। তার বিক্রমে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে শত্রু শিবিরে। যেন স্বয়ং বজরঙ বালী নেমে এসেছেন আরাকানের যুদ্ধে। যদুনাথের প্রবল প্রতাপ প্রশংসা কুড়িয়েছে ইংরেজ সেনাধক্ষদের থেকেও। 


      অবশেষে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হলো জাপান। দিকে দিকে স্তিমিত হয়ে আসতে লাগলো যুদ্ধের বাতাবরণ। বাতাস থেকে সরে গেলো বারুদের গন্ধ। থেমে গেলো গোলাগুলির শব্দ। শান্তি ফিরে এলো বিশ্বজুড়ে।


      কয়েক বছর পর স্বাধীনতা লাভ করলো ভারত বর্ষ। অবসান হলো দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের। লাল কেল্লায় উঠলো তেরঙ্গা। বেজে উঠলো জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে এলো দেশ ভাগের জ্বালা এবং আরও কিছু জটিলতা। প্রায় পাঁচশো দেশীয় রাজ্য  ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ এবং কাশ্মীর রাজি ছিল না ভারতভুক্ত হতে। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীনভাবে থাকতে চাইছিলেন। ভারত পাকিস্তান কোনো পক্ষেই যোগ দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু তার অগোচরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছিল। শুরু হলো অরাজকতা। পাকিস্তানের মদতে কিছু অনুপ্রবেশকারী হামলা শুরু করলো কাশ্মীরে। অত্যাচার, লুঠপাট, গনহত্যার মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে তুললো কাশ্মীরের অধিবাসীদের। ক্রমশ শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো সশস্ত্র হিংস্র অনুপ্রবেশকারীরা। মহারাজ হরি সিং নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ভারতের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন এবং ভারতে অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে সাক্ষর করলেন। পরের দিনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো ভারত। শ্রীনগরে নামলো ভারতীয় সেনা।


      পাকিস্তান একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্টে আক্রমণ করে। তার মধ্যে তাইন্দর ছিল নওশেরা সেক্টরের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট। পাকিস্তানের কাছে তাইন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ তাইন্দর দখল করতে পারলে শ্রীনগরের বিমান ঘাঁটি দখল নেওয়ার পথ সুগম হবে।


      উনিশশো আটচল্লিশ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি শ্রীনগরে পৌঁছে ভারতের পঞ্চাশ নম্বর প্যারা ব্রিগেড নওশেরা আক্রমণ করে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এই লড়াইতে পাকিস্তানের সেনারা ব্যাপকভাবে হতাহত হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়।


      ছয় ফেব্রুয়ারি শত্রুরা শক্তি সঞ্চয় করে আবার তাইন্দর পাহাড়ের পিকেটে গুলি চালিয়ে আক্রমণ করে। গোটা শৃঙ্গ এবং আসে পাশের এলাকা গুলি এবং মর্টারের শব্দে কেঁপে ওঠে। অন্যদিকে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শত্রুরা ভারতীয় পিকেটের দিকে এগোতে থাকে। ভোর বেলা পোষ্টটা দখলের জন্য মুহুর্মুহু আক্রমণ করতে থাকে।


      দুই নম্বর পিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েক যদুনাথ সিং। তিনি অসাধারণ বীরত্ব এবং নেতৃত্বের প্রদর্শন করে, মাত্র নয়জনকে সঙ্গে নিয়ে, শত্রুদের বিরাট বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে পশ্চাদপসারন করাতে সক্ষম হন। কিন্তু দুরদর্শী এবং অভিজ্ঞ যদুনাথ বুঝতে পারেন যে পরবর্তী আক্রমণ কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই তিনি বারে বারে আরো সেনা পাঠানোর জন্য হেড কোয়ার্টারে বার্তা পাঠাতে থাকেন। কিন্তু হেড কোয়ার্টার থেকে সেনা পাঠানোর কোনও আশা নেই দেখে তিনি পরবর্তী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হন। 


      হাতে সৈন্য সংখ্যা কম, অস্ত্র সংখ্যাও কম। এমনকি তার ব্রেন গানারও মারাত্মক ভাবে আহত, তার পক্ষে বন্দুক ধরা সম্ভব নয় দেখে যদুনাথ নিজের হাতে তুলে নেন ব্রেন গানটি এবং অপেক্ষা করতে থাকেন শত্রুদের পরবর্তী আক্রমণের জন্য।


      আবার এগিয়ে আসছে শত্রুরা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে তারা। এক, দুই, তিন যদুনাথ গুনতে থাকেন শত্রুদের সংখ্যা। ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ছে! এত সংখ্যক শত্রুর মোকাবিলা কি করে করবেন তিনি? পরাজয় অবশ্যম্ভাবি।


      এবারে সরাসরি পোষ্টের দেওয়ালে আক্রমণ করে বসে শত্রুরা। কিন্তু অসামান্য রণকুশলতা এবং বীরত্বের নমুনা রেখে, আবার নিশ্চিত পরাজয়কে জয়ে রূপান্তরিত করেন যদুনাথ সিং। কিন্তু এই লড়াইতে তার সমস্ত সেনা শহীদ হন।


      একা আহত যদুনাথ তার পোষ্ট পাহারা দিতে থাকেন। তিনি জানেন শত্রুরা আবার আসবে এবং পোষ্ট দখলের মরিয়া চেষ্টা চালাবে। সীমিত পরিমাণ গোলা বারুদ নিয়ে তিনি পোষ্ট পাহারা দিতে থাকেন। 

      আবার! আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে ওরা! যদুনাথ অপেক্ষা করতে থাকেন। শত্রুরা তার বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্রই গর্জে ওঠে তার বন্দুক। অসংখ্য শত্রুকে ধ্বংস করতে করতে এক সময়ে শেষ হয়ে যায় তার গোলা বারুদ। কিন্তু এখনও যে কয়েকজন শত্রু জীবিত আছে! তাদের শেষ করতে না পারলে এই পোষ্ট যে বেদখল হয়ে যাবে! এদিকে বন্দুকের গুলিও শেষ! এবার কি করবেন যদুনাথ? পোষ্ট বাঁচাতে মরিয়া যদুনাথ বন্দুকের মাথা থেকে বেয়নেট খুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপরে। শত্রুদের বন্দুক থেকে গুলি ছুটে আসতে থাকে তার দিকে। সে সবের পরোয়া না করে তিনি শত্রু নিধন করতে থাকেন। আচমকাই দুটো বুলেট তার মাথায় এবং বুকে বিঁধে যায়। শহীদ হন যদুনাথ। প্রাণ দিলেও তার পোষ্টকে বেদখল হতে দেননি ভারতের গর্ব যদুনাথ সিং। পরমবীর চক্র জয়ী, ভারত মাতার বীর সন্তান, অমর শহীদ যদুনাথ সিং।


      দেখলাম কথা বলতে বলতে দাদুর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রু। দুফোঁটা অশ্রু নাকি শ্রদ্ধার্ঘ?



                     

মধ্যবিত্ত প্রেম - সুতপা সোঽহং || Moddhobitto Prem - Sutapa Sohong || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 মধ্যবিত্ত প্রেম

        সুতপা সোঽহং



তানি জোর করে আমার কবিতার খাতা টেনে পড়তে শুরু করেছে। মাথা নিচু করে এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে যে ওর ওড়না যে মাটিতে গড়াচ্ছে সেদিকে নজর নেই। কচি কলাপাতা রঙের ওড়না। ওঠাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ও লজ্জা পেতে পারে। থাক। ওকে ওড়না ছাড়া দেখিনি কখনো। তাকাব না তাকাব না করেও চোখ গলা পেরিয়ে বুকের খাঁজের দিকে গেছে। তৎক্ষণাৎ শরীর যেন জানান দিল আমি বছর কুড়ির ছেলে। সামনে বৈশাখে একুশে পড়ব। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। চোখ মনের সাথে পাল্লা দিয়ে অবাধ্য হচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। মার লাগানো স্হল পদ্মের কুড়ি দু একটা করে ফুটতে শুরু করেছে। গাছটা আছে। মানুষটা নেই। থাকলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হত। এতটা উদাসীন, এতটা ছন্নছাড়া হয়তো হতাম না। কিংবা হয়তো আরো খারাপ হতাম। কে বলতে পারে! যা নেই তা নিয়ে আমাদের আফশোষ করার স্বভাব। যা আছে তার মূল্য আমরা কখনো দিই না। এই যেমন এই তানি মেয়েটা সবসময় খেয়াল রাখে কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি। কিন্তু আমি তো খবর নিই না কখনো ওর। কখনো চোখে চোখ পড়লে মনে হয় ওর কী যেন এক দাবি আছে আমার উপর। অলিখিত, অনুচ্চারিত। দরজা দিয়ে তানিকে দেখা যাচ্ছে। খাতাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এসময় ঘরে ঢোকা যাবে না। কবিতা পড়লে কী এক ঘোর, মায়া কাজ করে। এসময় মানুষ আবেগে যা খুশি করতে পারে। উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পকেট হাতড়ে একটা বিশ টাকার নোট পেলাম। আজকের মতো চলে যাবে। সিগারেটও আছে একটা। আর কি চাই! নিজেকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে। বল্টুদার চায়ের দোকানে ভিড় নেই আজকে। বসলাম। বল্টুদার বৌ চা করছে। পাশে মেয়ে বস্তা পেতে বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু মন তার পরোটার দিকে। হয়তো সকাল থেকে তার পেটে কিছু পড়ে নি। হয়তো খরচ বাঁচাতে একেবারে দুপুরে খাওয়া হয়। একদিন দুপুরের দিকে এসেছিলাম এদিকে। সে সময় বল্টুদা মেয়ে বউ নিয়ে খেতে বসেছে। বসা মানে ওই একহাতে থালা নিয়ে বেঞ্চে খাওয়া আর কি। পরোটার জন্য বানানো তরকারি আর ভাত। কিন্তু তাতে কী! খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল অমৃত বোধহয়। থালায় এক কণা ভাত তরকারিও পড়ে ছিল না। আসলে খাওয়ার জিনিসের স্বাদ কী তা না খেতে পাওয়া মানুষের কাছেই জানা যায়। মেয়েটার একমাথা তেল না দেওয়া রুক্ষ চুল। একটা নোংরা চিমড়ানো কলমের মুখটি চিবুচ্ছে থেকে থেকে।বল্টুদা দক্ষ হাতে পরোটায় মাখন লাগাচ্ছে। সে গন্ধে ম ম করছে চত্বর। চাটায় দিয়ে ঘেরা দেওয়া দোকান। ভিতরে আরেকটা চাটায় দিয়ে ঘেরা। চৌকির একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ইতস্তত নোংরা কাপড় ঝুলছে। এখানেই একটা সংসার গড়ে তুলেছে। খেতে খেতেই বিষম খায় পল্টু দা। ব‌উটি তড়িঘড়ি জল দেয়, পিঠে হাত বুলায়, কী জানি এক মন্ত্র পড়ে মাথায় ফুঁ দেয়। আমি বসে বসে দেখি। বড় ভালো লাগে।অভাবী কিন্তু ছোট্ট সুখী সংসার। এই ব‌উটির কাছেই শোনা বল্টুদা অনাথ। ভিটে টুকুও নেই। বড় কষ্ট করে এই ছোট্ট দোকান টুকু দাঁড় করিয়েছে।

আমি শুধু ভাবি এই যে এতো কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা, জীবন সংগ্রামের গল্প আলাদা। এ যেন অসীম সংখ্যা নিয়ে প্রবাবিলিটির খেলা। কোন সজ্জার সাথে কোন সজ্জার মিল নেই। অথচ উপাদান সংখ্যা গুলো একই। বল্টুদা চায়ের কাপ নিয়ে এল। পরোটার কথা জিজ্ঞেস করে না এখন আর। জানে আমি খালি চা‌ খাই। আসলে খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু টাকা থাকে না অত। পরের মাসে টিউশনের টাকাটা পেলে একদিন খাব। এই মাসের আরো তিনদিন চালাতে হবে একশো টাকায়। ঘরে চিড়া, লবন আছে। চিন্তা নেই। ঘরে ফেরা যাক। তানি এতোক্ষণে কী করছে কে জানে। ঘর পাহারা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বলেও আসি নি। পা চালালাম। এক মিষ্টির দোকানের সামনে কিছু জটলা। এক পাগলীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মিষ্টি চুরি করার নাকি তালে ছিল। এ এলাকার সে না। সমানে 'খিদা খিদা। পেট জ্বলে গেল। খেতে দে না ও বাবারা' বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠে মুখ খিস্তিও। ডানহাতে এক বড় ঘা। তাতে মাছি ভ্যানভ্যান করছে। দোকানের এক ছোকরা কী এক অশ্লীল ইঙ্গিত করল। পাশে বসা দুই কাস্টোমার হো হো করে হেসে চোখ দিয়েই পাগলীর শরীর যেন চেটে খেল। বেঁধে রাখার পিছনে কোন খারাপ মতলব নেই তো? কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু সাধারণ জনতার মতো কিছু করলে তার উল্টো ফল হতে পারে। বর্তমান সময়ে কার্যকরী শুধু টাকা আর ক্ষমতা। যেদুটোর একটাও আমার নেই। জামাটাকে যথা সম্ভব ঠিক করে একেবারে দোকানের মালিকের সামনে। হুংকার দেওয়ার গলায় বললাম 'এঁকে কে বেঁধে রেখেছে? মানবাধিকার কমিশন থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। মলয় দত্ত বলে কেউ এখান থেকে ফোন করে জানিয়েছে।' ওরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমাকে পা থেকে মাথা জরিপ করে বলল ' কী কমিশন বললেন দেখে তো মনে হচ্ছে না। আর মলয় দত্ত কে তাও জানি না। প্রমান ছাড়া তো ও মাগীকে ছাড়া যাবে না।' আমার কোঁচকানো শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। জানি বিশ্বাসযোগ্য না। তারপরেও মুখে, গলায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম 'আমি এই এলাকায় থাকি। এতো সকালে কমিশন থেকে ফোন পেয়েই এলাম। দোষ করলেও এমন‌ ধরনের মানুষের উপর শারীরিক কিংবা মানসিক অত্যাচার আইনবিরোধী। '

"Don't judge a book by it's cover"

প্রবাদটা নিজে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু ওরা তো করে না। ফোনটা বের করে মিছামিছি কারোর সাথে কথা বলার অভিনয় করছি। পুলিশ, জেল ইত্যাদি শব্দ গুলো দুতিন বার জোরে জোরে উচ্চারণ করলাম। মালিকের মুখের অভিব্যক্তি খুব একটা বদলালো না। এবার অন্য কারোর সাথে ফোন করে কথা বলছি ভাণ করে ইংলিশে কথা বলা শুরু করলাম। এবারও জেল, পুলিশ বললাম। হুম এবার ওষুধে কাজ দিয়েছে। মালিক চোখের ইশারায় দড়ি খুলতে বলল।

হায়রে ইংরেজ গেছে কবে দেশ ছেড়ে। কিন্তু দাসত্ব আর ফুরোলো না। মাতৃভাষা যা পারে নি ইংরেজি ভাষায় তা সম্ভব। তুমি ইংরেজি পারো মানে এলেমদার লোক। অফিসার কেন সবই হতে পারো যদি নাক সিটকিয়ে বলতে পারো ' shit, fuck.....' তারমানে তোমার লেবেল আছে ভাই।


যাহোক এখানে তো একটা ভালো কাজ উদ্ধার হল। পাগলী ছাড়া পেতেই দৌড়ে একটা ভাতের হোটেলে গিয়ে ঢুকলো। ও বোধহয় খেয়াল করছিল এদিকে। আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম। একশো টাকাটা বের করে পাগলীটাকে খেতে দিতে বললাম। অতো সকালে রান্না হয় নি। শুধু ভাত উপুড় দিয়েছে। বললাম 'বাসি তরকারি আছে নাকি কিছু? থাকলে তা দিয়েই দিয়ে দাও'। পাগলীর সামনে বাসি ডাল দিয়ে থালায় ভাত বেড়ে দিল। আগুনের মতো গরম ভাত। হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাগলীর যেন তর সইছে না। ওমনই গরম ভাত মুখে নিয়ে আঃ উঃ করে খেতে শুরু করল। ভীষণ কান্না পেল। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় হোটেলের মালিক টাকা ফেরত নিতে বলল। অবাক হলাম। মালিক লোকটা একটু হেসে বলল 'দাদা আমরাও গরীব মানুষ। মন চাইলেও ফ্রি তে খাওয়াতে পারি না। তবুও এটার দাম নিতে পারব না।' ভাতের দোকানটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম মিষ্টির দোকানদার এর থেকে অনেক বেশি বড়োলোক কিন্তু তাতে কী! মনের দিক দিয়ে বড় গরীব।


তানি বোধহয় রেগে গেছে এতোক্ষণে। ঘটনা শুনলে রাগ কমতে পারে কিন্তু বলার সুযোগ দিলে তো। না বলে বেরোলে রাগ করে খুব। কিন্তু আমি সে অধিকার দিতে চাই না। চাই না আমার এই রকম একটা টানাটানির সংসারে ও নিজেকে জড়াক। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসলাম। এসে দেখি তানি রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ছে। রান্নার সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। মেয়েটা করে কী! আমার পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে বলল "কিছুই খুঁজে পেলাম না। চিড়া পেলাম শুধু। তাই দিয়েই পোলাও বানাচ্ছি। বাদাম, কিশমিশ ছাড়া। জানি না খেতে পারবে কিনা। হয়ে গেছে। ঘরে যাও। দিচ্ছি।"


বিনা বাক্যব্যয়ে ঘরে আসলাম। পেটে ছুঁচোর ডন চলছে। প্লেটে করে দিয়ে গেল। কী অসাধারণ হয়েছে খেতে। ইস্ মেয়েটাকে সত্যিই যদি ঘরের বউ করে আনতে পারতাম! কিন্তু আমারই চলে না। ওর দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে পারব না।


"কী ব্যাপার চোখ মুখ বুজে তো খাচ্ছো। খুব কী অখাদ্য হয়েছে?

" না না চমৎকার হয়েছে। তুমি খাবে না? "

"না আমার পেট ভরা। খেয়েই এসেছি। তুমি খাও।"


আমি জানি ডাহা মিথ্যা কথা। ওদেরও টানাটানির সংসার। বাবা দর্জি। তিন ছেলেমেয়ে। তানিই বড়ো। টিউশন করে সারাদিন। কখন যে নিজের পড়া পড়ে কে জানে! কিন্তু খাওয়া নিয়ে জোর করে লাভ নেই। খাবে না কিছুতেই। বড্ড জেদী। বহুদিন এমন হয়েছে নিজের খাবার আমাকে এসে দিয়ে গেছে। নিজে খালি পেটে থেকেছে। কিন্তু ওকে আর এসব করতে দেওয়া যাবে না। এখন থেকে কঠোর হতে হবে। নাহলে দুজনের কষ্ট বাড়বে বই কমবে না। জিজ্ঞেস করলাম " শোনো, বাড়ি যাও। আর এভাবে হুটহাট করে এসো না। রান্না করো না। মিলির বাড়ির লোক জানলে আর আমার সাথে বিয়ে দিবে না।"


"মিলি কে?"


"বান্ধবী। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা আছে।"


"হতেই পারে না। তুমি হবে বিয়েতে রাজী!!!! তাহলেই হয়েছে! তোমাকে আমি চিনি না?"


"না রাজী হওয়ার তো কোন কারণ নেই। বিয়ে করলে ওর বাবার অর্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবে। সেই টাকায় একটা ব্যবস্যা শুরু করতে পারব।"


"টাকার জন্য বিয়ে করবে? যদি গরীব বাবার মেয়ে হয় তবে করবে না?"


"নাহ গরীব মেয়েকে বিয়ে করে কী করব? "


"যদি মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে তাহলে?"


"তাহলেও না। ভালোবাসা দিয়ে কি ব্যবসা করতে পারব? টাকা চাই টাকা। মিলিকে বিয়ে করলে যেটা পাব। যাহোক তুমি আর ঘনঘন এসো না। আমার বিরক্ত লাগে।"


"বিরক্ত লাগে?!!! এটা তো কখনো বলো নি। বেশ আর আসবো না।" অন্য দিকে তাকিয়ে কথাগুলো কোনরকমে বলে তানি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি জানি ওকে আজ জন্মের কষ্ট দিয়েছি আর সেইটার পিছনে গরীব হওয়াকেই দোষ ঠাউরেছি। অথচ এই দোষের শাস্তি বা কষ্ট চিরকাল আমিও পেয়ে আসছি। মেয়েটা বোধহয় আজ সারাদিন কাঁদবে। রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি এমন সময়ে দরজায় গুম গুম করে আওয়াজ হলো। আমার দরজায় কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই অন্তত এ সময়ে। উঠে দরজা খুলে দেখলাম তানির বোন রুপু। রীতিমত হাঁফাচ্ছে।


 'কীরে তুই এতো রাতে?'


'দা শিগগির চলো। দিদি ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই।'


আমার পায়ের নীচের মাটি দুলে উঠলো। ওকে মিথ্যা বলার পরিণাম যে এমন হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন আর ভাবার সময় নেই। দৌড়ালাম। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যখন ইমারজেন্সি থেকে বেরিয়ে এলাম মনে হলো অনেক ম্যাচিওর হয়ে গেছি এই কয়েক ঘন্টায়। এখনো বোধহয় প্রেম বলে কিছু আছে। এখনো বোধহয় সবাই শুধু টাকার পেছনে ছোটে না। এই কাঠখোট্টার শহরে এখনো কিছু মানুষ ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দিতেও পিছপা হয় না। 

সারা রাত যমে মানুষে টানাটানি। ভোরের দিকে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন রোগী বিপদমুক্ত। পূর্ব দিকে লাল সূর্য উঠছে নতুন একটা দিনের আশা নিয়ে। ঘরে গিয়েই চাকরির ব‌ই গুলো খুঁজে বের করতে হবে। হার মেনে নিলে চলবে না। জিততে আমাকে হবে আমার জন্য, তানির জন্য, আমাদের জন্য!

বিদ্রুপে - তুষার দেবনাথ || Bidrupe - Tushar Debnath || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

বিদ্রুপে                                   

   তুষার দেবনাথ 


   একটি ট্রেন এসেছিল প্লাটফর্মে, লোকজনের আনাগোনা একটু কম,শেষ ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে তার যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে,জ্যোৎস্না রাতের পর অষ্টমীর চাঁদ খানা ক্ষয়ে গেলেও তার আলোতে স্টেশনখানা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে জড়িয়ে রয়েছে। স্টেশনখানা রে বড়ো খুব এমন নয়,

মাঝারি গোছের, তবে দিনমানে লোকজন চলাচল করলেও রাতের দিকে বেশ ফাঁকা ফাঁকা।

                 

                            বছর দশেকের একটা মেয়ে, এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল কিছুক্ষন ধরে, দেখে সাধারণ বাচ্চাদের মতো হলেও তার চাহনির মধ্যে দীর্ঘ 

প্রশান্তি, মেয়েটির সামনের কোঁকড়ানো চুল কপালের দুদিকে ঝুলে রয়েছে।সরু কপালের দুপাশ দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো চোখের ওপর এসে পড়ে।

     

                                শেষ ট্রেনটা যখন স্টেশনে পৌছালে,ট্রেন থেকে নামলো ঋত্বিক, পুরো নাম ঋত্বিক চক্রবর্তী।আজ অনেকদিন পর সে ট্রেনে ভ্রমণ করেছে,

সাধারণত নিজস্ব দুটো বিলাসবহুল গাড়িতেই সে কাজে যায়‌। তাছাড়া ছয়, সাতটা শখের বাইক তো পড়েই থাকে। আজ কী হঠাৎ মনে হলো ট্রেনে করে

রশ্মিতার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলো।রশ্মিতা সদ্য কলেজে প্রবেশ করেছে, অবশ্য তার আগে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে তিনবছর, কিন্তু তার বরাবর ইচ্ছে শিক্ষিকা হবে, সমাজ সংস্কৃতি বাঁচাবে। রশ্মিতাকে বাড়িতে সবাই রাধিকা বলে ডাকে।তার সাথে ঋত্বিকের পরিচয় হয় কলেজেই, ঋত্বিক ওদের কলেজে কোনো একটা অনুষ্ঠানে গিয়েই,রশ্মিতাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু প্রথম দেখাতেই কিছু বলতে পারেনি,তারপর ফেসবুকে তার নাম খুঁজে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, অবশেষে সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব হয়, বন্ধুত্ব দৃঢ় হলে পৌছায় সম্পর্কে, অবশ্য রাধিকা মানে রশ্মিতা ঋত্বিককে প্রথমে ঠাট্টা করে ঋত্বিকদা বলেই ডাকতো।

                    

                                      "বাবু , দুটি টাকা দেন না, কিছু খাবো!",,,,,,,,

কথাটি শুনে চমকে ওঠে ঋত্বিক,তার পায়ের কাছে বসে একটা ১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটির করুণ চোখে চিত্রিত এক দীর্ঘ ক্লান্তি। ঋত্বিক সাধারণত একটু কড়া ধাঁচের,সে মনে করে সমাজে মানুষ ইচ্ছা করেই ভিক্ষা করে কাজ করার বদলে।সে এরকম অনেকেই দেখেছে,তাই সে এইসব দান ধ্যানের ব্যপারে উদাসীন।

তাই সে মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ট্রেন থেকে নামলো রশ্মিতা।সে তার ব্যাগ থেকে একপ্যাকেট বিস্কুট মেয়েটিকে খেতে দিল, তাতে ঋত্বিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই রশ্মিতার ইশারা ওর ইশারাকে গিলে নিয়ে ওকে শান্ত করে দিল। এদিক থেকে ঋত্বিক দুর্বল, আসলে তার সাধনার ফল তো,তাই। আসলে রশ্মিতার এই ভালোমানুষি গুলোই ঋত্বিককে বেশী আকর্ষণ করে,সে নিজে রুক্ষ মানুষ হলেও। আবার রশ্মিতাও জানে ঋত্বিকের এরকম হোওয়ার কারণ। আসলে যারা দরিদ্রতা স্পর্শ করে বড়ো হয়,যারা ছেলেমানুষি, খুনসুটি করার বয়সে দুবেলা অভুক্ত থেকেও বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাদের মনের বাইরে এক ঢাল তৈরী হয়ে যায়,যেই ঢাল তাদের মনের মধ্যে আর কষ্ট পৌঁছাতে দেয় না। কিন্তু ঝিনুকের শক্ত খোলশের মধ্যেই যে মুক্তোর সন্ধান মেলে, সেই মুক্তোটাই খুঁজে পেয়েছিল ঋত্বিকের মধ্যে।

                    ঋত্বিক এবার একটু শান্ত থাকে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।রশ্মিতাই কথা বলুক বরং মেয়েটির সঙ্গে।রশ্মিতা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো-"তোমার নাম কী,?"

মেয়েটি জবাব দেয় না, আবার রশ্মিতা জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি জবাব দেয়"অপরাজিতা"

মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রশ্মিতা।সে বুঝতেই পারছে মেয়েটি অনেক সময় ধরে ক্ষিদের জ্বালা সয়েছে, এবার যখন ভাগ্যবলে খাবার পেয়েছে তখন তা না খেয়ে কী অপেক্ষা করা যায়। মেয়েটি খাওয়া শেষ হলে রশ্মিতা তার জলের বোতলটা এগিয়ে দেয়, মেয়েটির দিকে, মেয়েটি ঢকঢক করে জল খায়,এক চরম প্রশান্তির ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটির চোখ যেন ঘুমে জড়িয়ে যায়।

রশ্মিতা এবার তাকে আবার প্রশ্ন করে-"তোমার বাবা মা কেও নেই"

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নটি শুনে, তারপর জবাবে সে দুদিকে ঘাড় নেড়ে জানায় নেই।

রশ্মিতা বলে "আচ্ছা তুমি খাবার না পেলে কী করতে"

প্রশ্নটি যেন আচমকা ঝটকা দেয় ঋত্বিকের মনে।

বাচ্চাটি জবাব দেয় -"ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মাকে বলতাম,মা আমার না খুব ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খেতে পাইনি মা, তারপর ওই স্টেশনের কল থেকে জল খেয়ে শুয়ে পড়তাম।"মেয়েটিকে আরো একপ্যাকেট বিস্কুট দিয়ে রশ্মিতা বলে কালকে সে তাকে নিতে আসবে,তার থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। মেয়েটি খুশিমনে বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিয়ে স্টেশনের ছাউনির তলায় শুতে যায়।

এরপর রশ্মিতা ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলে,"কী ঋত্বিক মশাই, বাড়ি যাবেন না এখানেই রাত কাটাবেন?"


       প্রশ্নটি শুনে ঋত্বিকের হুশ ফিরলে সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়‌, অন্ধকারে ঋত্বিকের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল খসে পড়ে অজান্তেই। মেয়েটির শেষের কথাগুলো যেন তার বড়োই চেনা, বড়োই চেনা।

তার বাবার মুখে সে শুনেছে,যখন তার বাবা খাবারের শেষটুকু ঋত্বিকের পাতে তুলে দিতেন, এবং ঋত্বিক তাকে খেতে বললে,তার বাবা হাসতেন,আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতেন ----

               " ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় 

                 পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি"‌।

রুদ্র গায়ত্রী কথা - মৌসুমী সরকার || Rudra Gayatri kotha - Mousumi Sarkar || বড় গল্প || Story || Bengali story || Big story || Bengali audio story || Short story

 রুদ্র গায়ত্রী কথা 

          মৌসুমী সরকার 



১ম পর্ব  


চিতোর হইতে একটি টি ঘোটক উদয়পুর যাইতেছে , অপরাহ্নের প্রখর রৌদ্র , শুস্ক , কঠিন তাপ চারিপাশে বিকীর্ণ হইতেছে , , রুদ্র নিজ গৃহে ফিরিতেছে । তাহার পিতা উদয়পুরের প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী , রুদ্রর বয়স ২২ হইবে , তাহার বাটি তে মাতা ও দুই ভ্রাতা রহিয়াছে , সে আসিয়াছে , ভগিনী কে দেখিতে । তাহার ভগিনীর চিতোরে বিবাহ হইয়াছে , নাম তারা । মহা রানা প্রতাপের কল্যানে তাহাদের রাজপুতানায় শান্তি তে দিবস কাটিয়া যায় । শত্রূ দিগের লোলুপ আঁখি রাজ পুতানার ওপর পড়িলেও , মহা রানা শক্ত হস্তে দমন করিয়াছেন, আপাতত নিরুপদ্রবে দিন কাটিয়া যাইতেছে । কিছু দিবস ভগিনী কে না দেখিয়া মাতা উতলা হইয়াছিলেন , মাতার আদেশে সে তারা কে দেখিতে আসিয়া দুই দিবস থাকিয়া ফিরিয়া যাইতেছে । তাহার ভগ্নিপতির ও চিতোরে বৃহৎ বস্ত্র বিপনী রহিয়াছে । ভগিনী ভালো আছে , স্বামী , শ্বশুর শশ্রু মাতা সবাই ভারী ভালো মানুষ , তারা সৌভাগ্য বতি । কিন্তু রুদ্র নিজে ভারী চিন্তিত ! তাহার চিন্তার কিছু কারণ রহিয়াছে ! 


২ পর্ব 

  তারা একমাত্র পুত্র বধূ , তাহার দেওর বা ননদ নাই । পারিবারিক সম্পত্তি যাহা রহিয়াছে , তাহাতে তাহার বা তাহার স্বামীর স্বচ্ছন্দে কয়েক পুরুষ চলিয়া যাইবে । এক কিশোরী আসিয়াছে তারা দের গৃহে , তাহার নাকি পরিবারে কেহ নাই , অল্প বয়সে পিতৃ মাতৃ হীনা । তারার শ্বশুর , শাশুড়ি যথেষ্ট ভালো মানুষ , তাহাকে যত্ন করিয়া আনিয়া কন্যার মতন রাখিয়াছেন । কন্যাটি র গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না বলিলেই চলে , কেহ না জানিলে মনে করিবে ও বোধ করি বোবা ! কথা জিজ্ঞেস করিলে উত্তর পাওয়া যায় , কিন্তু নিজে হইতে কোনো কথা কহে না ! এই স্বভাবের কথা তারাও তাহাকে হাসি মুখে বলিয়াছে , অর্বাচীন , প্রগলভা তারা ! পিতা , মাতা না থাকিবার বেদনা তে কিশোরী টি এরূপ , একথা সে আর ভগিনী কে বুঝাইতে যায় নাই ! এমন তো কত আছে সংসারে ,পিতা মাতা থাকে না , সাধ্য মতো সবাই সবাই কে দেখিয়া রাখে হয়তো , হয়তো বা দেখেও না ! তাহার মাতাও কত সময় উদয়পুরের পিতৃ হীন বা মাতৃ হীন বা অনাথ শিশুদিগকে সাহায্য করেন , সে জানে ! রুদ্র কে বাণিজ্য সূত্রে দিল্লি , ও উদয়পুর যাওয়া আসা করিতে হয় । তবে চিতোর সে বিশেষ আসে নাই ! সে সবার বড়ো , পিতা মাতার দুঃখ বুঝে চিরকাল , একাই যাতায়াত করে , কোনোরকম ভীতি দুশ্চিন্তা তাহার অন্তরে স্থান পায় না , তাহারা’ যে রাজ পুত ! বীরের জাত , কাহাকে ভয় ? কিসের ভয় ? পৃথিবীতে আসিয়াছি , বীরের মতো বাঁচিতে , অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করিতে , পিতা মাতা গুরুজন দিগকে শ্রদ্ধা করিতে , ভ্রাতা ভগিনী দিগকে স্নেহ করিতে , আর , আর কি ? ভাবিতে গিয়া তাহার কর্ণ মূল রক্তিম হইয়া ওঠে , কাহাকেও নিজের মতন করিয়া ভালো বাসিতে ! সেও প্রাপ্ত বয়স্ক হইয়াছে , তাহার মাতা কন্যা প্রায় স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন তাহার জন্য , উদয়পুরেই এক বৃহৎ ব্যবসায়ীর কন্যার সহিত তাহার তিলক অনুষ্ঠান হয়তো হইবে কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু এই কিশোরী গায়ত্রী কে দেখিয়া তাহার কি হইলো ? 

 

পর্ব ৩


 কিশোরী টি যে অপূর্ব সুন্দরী তাহা নহে , গাত্রবর্ণসম্পূর্ণ হরিদ্রার ন্যায় তাহা বলা যায় না , এমন কি তাহাদের রাজস্থানে , নারী রা যেরূপ সু স্বাস্থ্য বতি , তাহাও নহে , কিন্তু তাহার আঁখি ? সে যেন সমুদ্র ন্যায় গভীর , তাহাকে কিছু বুঝাইয়া বলিতে হয় না , সে আপনি বুঝিয়া লয় । রক্তিম ওষ্ঠ , সুন্দর নাসিকা , বিশাল চক্ষু লইয়া সে যেন এক স্নিগ্ধ চিত্র , কোঁকড়া কেশ রাশি বৃষ্টি স্নাত পুষ্পের ন্যায় শান্ত , মুখশ্রী কে জড়াইয়া রহিয়াছে । তাহাকে দেখিলে মনে হয় উহার যেন এই জগতের উপর আর বিশেষ কোনো দাবি দাওয়া নাই ! তাহার পিতা , মাতার সহিত সব কিছু চলিয়া গিয়াছে । উহাকে দেখিয়া রুদ্রের বুকের মধ্যে কি যে চলিতেছে , তাহা সেই জানে , না কাউকে বলিতে পারিতেছে , না পারিছে নিজে হইতে নিজে কে লুকাইতে । এক অদ্ভুত দোটানার মধ্যে পড়িয়াছে সে ! তাহার বিপণির কর্মে ভুল হইয়া যাইতেছে !! মাতার সহিত সর্বদা ই চিরকাল তাহার সব কিছু আলোচনা হয় । মাতা তাহাকে জিজ্ঞাসা ও করিয়াছেন সে এত অন্য মনা কেন ? সঠিক উত্তর কিছু দিতে পারে নাই রুদ্র ! 


পর্ব ৪

 ওদিকে গায়ত্রী ! সে তো কিশোরী , পিতৃ , মাতৃ হীনা , যে গভীর আঘাত সে অন্তরে পাইয়াছে এই স্বল্প বয়সে , তাহা যে চির দিনের ! তাহার অন্ন সংস্থান রাখিয়া পিতা মাতা অসুখে , কিছু দিবসের ব্যবধানে স্বর্গে গিয়াছেন । নিরাপত্তার কারণে তাহাকে কাকিমা , কাকাবাবু একা বাটি তে রাখেন নাই । সে তারা দিদির বাটিতে থাকে । সবাই তাহাকে ভালোবাসে । সে , তারা দিদির দাদা , , জামাই বাবু র সহিত চিতোরে ভগবানের মন্দির দর্শনে আসিয়াছিল । ছোট হই তেই সে এখানে আসে , কি অপূর্ব প্রস্তরের কারু কার্য , দেখিলে চক্ষু জুড়াইয়া যায় ! ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মন্দির , দিবারাত্র সেখানে ভগবানের ভজনা হয় , মীরা বাই যে তাহার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ! একমাত্র ভগবানের মন্দিরেই তাহার যেন একটু ভালো লাগে ! পিতা মাতা নাকি ঈশ্বরের কাছে চলিয়া গিয়াছেন , সে কবে যাইবে ? রাত্রি দিন এই কথা তাহার মনে আন্দোলিত হয় ! সে কি করিয়াছিল ঈশ্বর তাহাকে এত বড়ো শাস্তি দিলেন ! সে বিশেষ কথাও কহে না কাহারো সহিত , প্রতিদিন পিতা মাতার কথা ভাবিয়া তাহার আঁখি অশ্রুসিক্ত হইয়া যায় । নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে সে মন্দিরে চলিতেছিল , ভগবানের মন্দিরে আসিয়া সে আর অশ্রু ধরিয়া রাখিতে পারে নাই ! কেহ দেখে নাই , তারা দিদির দাদা, রুদ্র নাম 

  বোধ করি , সে দেখিয়া ফেলিয়াছে ! ছি , ছি , কি লজ্জার কথা ! সে কাহাকেও তাহার বেদনা দেখাইতে চাহে না ! এ বেদনা তাহার একান্তই নিজের , এত বড়ো পৃথিবীতে এই বেদনার সহিত ই তাহাকে থাকিতে হইবে ! মন্দিরে কত লোক পূজা দিতেছে , প্রসাদ বিতরণ হইবে একটু পরেই , প্রতিদিন কত গরিব লোকের ও অন্নভোজন হয় , মহারানার নির্দেশে , চিতোরে কেউ যেন অভুক্ত না থাকে ! চিতোর ! আহা ! তাহাদিগের স্বর্ণের ন্যায় অপরূপ চিতোর ! তাহার জন্ম ভূমি !গভীর রাত্রি তে যখন বিশ্ব চরাচর নিদ্রা যায় , সে মধ্যে মধ্যে তাহার শয়ন গৃহের বৃহৎ জানালা খুলিয়া বাহিরে তাকাইয়া দেখে , কি বৃহৎ প্রকৃতি , সব কিছু যেন একাকী , দূর দূরান্তের তারা গুলি ও একাকী শান্ত , তাহাকে যেন আকাশের চন্দ্র , এই পৃথিবীর চিতোরের মৃত্তিকা , দূর মন্দিরের চূড়া সবাই .. বলিতে থাকে … তুমি আমাদেরই কন্যা , আমাদের ছাড়িয়া কোথাও কোনো দিন যাইয়ো না । এই বিশাল নিঃসীম প্রকৃতির কাছে ই সে যেন নিজেকে সমর্পন করিতে পারে , একাত্ম করিতে পারে ! কুন্দ পুষ্পের সু ঘ্রান ভাসিয়া আসে , দূরে নীলকণ্ঠ মন্দিরের পুরোহিতের রাত্রি কালীন আরতি র শব্দ ধ্বনিত হয় , সে নিকষ অন্ধকার গগনের দিকে তাকাইয়া , তারা দের দিকে তাকাইয়া তাহার পিতা , মাতা কে খুঁজিতে থাকে , আঁখি দিয়া বারি বহিতে থাকে । তারা দিদি তাহাকে সহজ করিবার চেষ্টা করিয়াছে অনেক দিন ! কিন্তু হইতেছে না কিছুতেই , সে নিজেও বোঝে তাহার এই কঠিন মানসিক পরিস্থিতির কথা ! সে বিবাহ করিবে না , ওই মীরা বাইয়ের মতন ঈশ্বরের ভজনা করিয়া জীবন কাটাইয়া দেবে স্থির করিয়াছে !কিন্তু একটি মুশকিল হইয়াছে তাহার এই ঝড় বিধস্ত ছোট্ট জীবনে ! 


পর্ব ৫


, রুদ্র কে দেখিয়া তাহার কি যে মনে হইয়াছে , তাহা সে কাহাকেও বলিতে পারিতেছে না ! মনে হইতেছে সে যেন তাহার বহু দিনের চেনা , সব দুঃখ কষ্ট ইহাকে বলা 

 যায় ! না , না সে ইহাদের পরিবারে আসিয়াছে , অসময়ে উহাকে কাকিমা সহ সবাই আপন করিয়া লইয়াছেন ! সে কেন জানিয়া , বুঝিয়া ক্ষতি করিবে কাহারো ? সে নাকি মাঙ্গলিক কন্যা ! ইহার অর্থ সে জানিত না , পরে তাহার কিছু বিশেষ হিতাকাঙ্খী র কল্যানে সে জানিয়াছে , ইহার অর্থ ! তাহার ভাগ্য খারাপ তো বটেই , বিবাহ পূর্বেই যাহার পিতা মাতা ইহলোক ছাড়িয়া চলিয়া যায় , সে কাহার কাছে পাইবে আদর যত্ন ? বহু কাঁদিয়াছে সে , কান্নার এখনো শেষ হয় নাই তাহার , কাকা বাবু সু পাত্র খোঁজ করিতেছেন , বয়স যে বাড়িয়া যাইতেছে  

    , তাহাদের সমাজে তো বিবাহে বিশেষ দেরি হয়না ! কিন্তু , সে যে সারা জীবন অবিবাহিত থাকিবে স্থির করিয়াছে , ইহা তো সবাই এর অজানা । মন্দিরে দিদিরা একটু আগাইয়া গিয়াছিল , সে ঈশ্বরের কাছে মনে মনে দুঃখের কথা বলিতে ছিল , তাহার অশ্রু সিক্ত আঁখি দেখিয়া ফেলিয়াছে তারা দিদির দাদা ! সে দৃষ্টিতে যে কত বেদনা ছিল ! তাহার মনে হইতে লাগিল এই যেন সেই মানুষ , যাহার কাছে শান্তিতে কাঁদা যায় ! না , সে কোনো কথা ভাবিতে চাহে না আর ! সে তো মাঝে মধ্যেই কাকিমার সহিত , দিদির সহিত মন্দিরে আসিয়া বসিয়া থাকে, পুরোহিত মহাশয় তাহার চেনা, সে একদিন তাহার ইচ্ছার কথা উহাকে জানাইবে , পুরোহিত নিশ্চয়ই তাহার কথা শুনিবে , তাহাকে মন্দিরের কাজে নিযুক্ত করিয়া দিবে ! আচ্ছা ,তাহার গাত্রে কি মাঙ্গলিক লেখা ছিল জন্মের সময় ? জানিতে ইচ্ছা করে !!


পর্ব ৬

রুদ্র ভাবিতেছে কিছু কথা তাহার মাতা কে জানাইয়া দিবে ! তিলক অনুষ্ঠান করিয়া যে বিবাহ হইবার কথা তাহার , সেই বিবাহ সে করিবে না ! কন্যা কে সে দেখেও নাই , পিতা মাতা যাহা ঠিক করিবেন , সেই বিবাহই হইবে , তাহাই রীতিও বলা চলে , কিন্তু এখন তাহার মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা । বিবাহ করিলে সে গায়ত্রী কেই করিবে , নচেৎ করিবে না ! অপর কোনো রমণী কে সে ঠকাইতে পারিবে না ! তারা আবার হঠাৎ আসিয়াছে বাপের বাড়ি , এই তো সে গিয়াছিল ! প্রগলভা , নির্বোধ নারী ! বুদ্ধিহীনা চিরকালই ছিল , এখন যেন আরো হইয়াছে ! ইচ্ছা করে কেশ ধরিয়া শাসন করিতে ! কিন্তু সম্ভব হয় না যে ! ক দিন পর তারা চলিয়া গিয়াছে । রুদ্র মাতা কে বলিয়া দিয়াছে সে এখন বিবাহ করিতে পারিবে না ! পিতা হয়ত অসন্তুষ্ট হইয়াছেন , শুনিয়া মাতা কিছু বলেন নাই !


কর্মে মন বসাইতে পারে না রুদ্র ঠিক ! দিন বহিয়া যাইতেছে ! একদিন গৃহে আসিয়া শুনিতেছে তারার শশ্রু মাতার নাকি একেবারেই শরীর ভালো নহে , কে চিতোর গিয়াছিল , আসিয়া খবর দিয়াছে । চিতোর ! সেই অপরূপ নগরী . . সেই কন্যা ! যাহাকে ভুলিতে পারে নাই রুদ্র , বলিতেও পারে নাই কিছু পরিবারে ! বেশ ! পুনরায় যাইতেই হইবে ! মাতৃ আদেশ ! মাতার কথা তো আর ফেলিতে পারিবে না । সে পরের দিন আবার চিতোর পৌঁছিয়াছে ! পৌঁছিয়া দেখে কোথায় কি ? শশ্রু মাতা দিব্য আছেন ! তারাও হাসিয়া আল্হাদে গলিয়া পড়িতেছে ! একি ! তাহাকে হঠাৎ করিয়া এরূপ ভাবে চিতোর পাঠাইবার মানে কি ? রুদ্রর মাতার ওপর রাগ হইতে লাগিল খুব । শীঘ্রই সে ফিরিয়া যাইবে উদয়পুর , থাকিবে না ! প্রগলভা তারা ! কি বলিতে কি বলিয়াছে ! সন্ধ্যা কাল উপস্থিত ! একটি দুটি করিয়া নক্ষত্র ফুটিয়া উঠিতেছে গগনে । তাহার ঘরে পিদিম দিতে আসিয়াছে সেই কিশোরী ! রুদ্র র গলা কেমন শুকাইয়া উঠিয়াছে উহাকে দেখিয়া ! “আমাকে বিবাহ করিবে গায়ত্রী ? “ , মনের কথা সোজা বাহির হইয়া গিয়াছে তাহার ! “না , আপনি চলিয়া যান ! আমি 

   মাঙ্গলিক কন্যা , অমঙ্গল হইবে আপনার !” জোরে কথা বলিতে গিয়া আবার যেন কিশোরীটির আঁখিতে অশ্রু ! বেশ ! আর রুদ্র কোনো দিন কিছু বলিবে না কাহাকেও ! প্রত্যুষ হইলেই সে উদয় পুরের উদ্দেশে বাহির হইবে ! সবে সূর্যালোক ছড়াইয়া পড়িতেছে চিতোরের গগনে , মনুষ্য দিগের সাধারণ জীবন যাত্রা শুরু হইয়াছে , শুধু রুদ্রের ই মনে শান্তি নাই ! তারা তাহাকে বারংবার আরো কিছু দিবস থাকিয়া যাইতে অনুরোধ করিয়াছিল , সে কর্ণ পাত করে নাই ! সেও কাহারো জীবনে অশান্তি বহিয়া আনিতে চাহে না ! দ্রুত বেগে ঘোটক চলিতেছে তাহার , জীবনে আর হয়তো চিতোর আসিবে না সে ! এ জীবনে ভিক্ষা যাচিতে পারিবে না কোনো দিন সে কাহারো কাছে ! … কি হইবে ? সবাই কে কি গৃহী হইতেই হইবে ? সে ও পারিবে একা জীবন কাটাইতে ! পিতা হয়তো রাগ করিবেন , কিন্তু তাহার তো আরো পুত্র আছে .. দিন কাটিয়া যাইবে ! একি ! তাহার সহিত নির্দিষ্ট দূরত্বে দুই টি অশ্বারোহী কেন চলিতেছে ? সে কি দস্যুর কবলে পড়িল ? অস্ত্র আছে ঠিকই , কিন্তু ইহা তো চিন্তার বিষয় হইলো ? এক পুস্করিণী দেখা যাইতেছে , বারি গ্রহণ আবশ্যক , দূরে এক মন্দির ও দেখা যাইতেছে ! বোধ করি ভীত হইবার কারণ নাই । রুদ্র নামিল বারি গ্রহণের জন্য । মন্দির হইতে ঘন্টা ধ্বনি আসিতেছে ! কিন্তু একি ! সে বারি গ্রহণ করিয়া ফিরিতেই দস্যু গুলি তাহাকে পিছমোড়া করিয়া বাঁধিয়া ফেলিয়াছে ! কি সর্বনাশ ! কোথায় লইয়া যাইবে তাহাকে ! অস্ত্র সব কাড়িয়া লইয়াছে ! কি মুশকিল ! তাহাকে মন্দির দিকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে ! ইহা কি চিতোরের দস্যু দিগের মন্দির ?    


শেষ পর্ব  

দস্যু দুটি  

 তাহাকে ধরিয়া পার্বতী মাতার মন্দিরে হাত বাঁধিয়া বসাইয়া রাখিয়াছে , অত্যাচার কিছু করে নাই । আশ্চয তো ! কি চায় উহারা ? আর এক কান্ড দেখিতেছে , একটি কন্যা কেও উহারা পালকি করিয়া আনিয়াছে । কে কন্যাটি ? যেন গায়ত্রীর র মতন চলন ! মুখশ্রী দৃশ্য মান নহে ! মন্দিরের সাজানো উপকরণ দেখিয়া বোধ হইতেছে কন্যাটির যেন বিবাহের আয়োজন চলিতেছে বৃক্ষের সহিত ! তাহাকে লইয়া ইহারা কি করিবে ! পরিষ্কার করিয়া কেহ কিছু বলিতেছেও নহে । আরো কিছু পরে আরো একটি পালকি আসিয়াছে , দুইটি ঘোটক ও আসিয়াছে । স্বর শুনিয়া সে বুঝিতেছে তাহার মাতা , পিতা , তারারশশ্রূ মাতা , জামাই ও আসিয়াছে । জামাই তাহাকে হাসিয়া বলিতেছে , মাঙ্গলিক বলিয়া গায়ত্রীর  


র প্রথমে বৃক্ষের সহিত বিবাহ দিয়া পরে তাহার সহিত বিবাহ এখনই দেওয়া হইবে ! সব নাকি তারা পূর্বেই বুঝিয়াছিলো , বুঝিয়া মাতা কে জানাইয়াছিলো । মাতার কোনো আপত্তি হয় নাই , এমন কি পিতারও আপত্তি নাই ! জীবন ! একটি মাত্র ছোট্ট জীবন ! কয় দিনেরই বা ? কি লাভ অশান্তি করিয়া ? মাঙ্গলিক হইলো তো কি হইলো ? বাধা যেমন আসিবে জীবনে , বাধা কাটাইয়া চলিতেও হইবে ! পুরোহিত বলিয়াছেন , কোনো অসুবিধা নাই !আজ নাকি খুব ভালো তিথি ! পরে আবার উদয় পুরে বড়ো করিয়া অনুষ্ঠান হইবে । এই দস্যু দিগকে নাকি জামাইই ঠিক করিয়াছে , তারা ও তাহার পিতা মাতার অনুরোধে । বলিতে গিয়া জামাই আর হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিতেছে না ! তাহার সব আচরণ তাহা হইলে তারা সহ সবার কাছে ধরা পড়িয়া গিয়াছে ! দূর হইতে ভগিনীর ও হাসির শব্দ পাওয়া যাইতেছে ! গায়ত্রী কি চাহিল তাহার দিকে মৃদু হাসিয়া ? কে জানে ! রুদ্রর বক্ষ মধ্যে কেমন যেন আওয়াজ হইতেছে , কর্ণ দুটি কি রক্তিম হইয়া গেছে ? বোধ বুদ্ধি কেবল পুরুষ দিগেরই নহে , নারী জাতিও কিছু রাখে তাহলে ! রুদ্র কি পুস্করিণী তে যাইয়া ডুব দিবে ? নাকি গায়ত্রীর আঁখিতে তাকাইয়া থাকিবে ? নাকি প্রগলভা ভগিনীর কেশ ধরিয়া টানিয়া তাহাকে শাস্তি দিবে ? সন্ন্যাসি হইবার আশা যে একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গেল এ জীবনে !!


পাঠক, রুদ্র , গায়ত্রী এবার যাহা পারে বুঝিয়া চলুক , আমরা দূর হইতে উহাদের জীবনের মঙ্গল কামনা করিয়া নিজ কর্মে মনোনিবেশ করি !!

আদরী - দিলদার সেখ || Adari - Dildar sekh || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

         আদরী

     দিলদার সেখ 



কোনও শিশু অন্ধকারে আচমকা আমার বড়ো ফুপুকে দেখলে যে সে ভালো মতোই ভয় পেয়ে যেতে পারে, – সেকথা আমার বড়ো ফুপু নিজেও জানত। ছোটবেলায় আমরাও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সারাক্ষণ গায়ে যেমন ধপধপে সাদা শাড়ি তার, – গায়ের রং তেমনই তার বিপরীতে। যেমন লম্বা তেমনই চওড়া তার গায়ের গঠন। ছোটবেলায় ফুপু যখনই আমাদের বাড়ি আসত, তার গায়ের সেই একই সাদা শাড়ি দেখে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা, ফুপু সবসময় অমন সাদা শাড়ি পরে থাকে কেন?

     মা বলত, তুর ফুপা যে মারা গেছে। কোনও বিবাহিত মেয়ের স্বামী মারা গেলে তাকে যে অমন সাদা শাড়ি পরেই থাকতে হয় বাকিজীবন!

     মায়ের এই উত্তর শুনে মাকে আবার পাল্টা প্রশ্ন করতাম, তাহলে আদরী কেনে সাদা শাড়ি পরে না? 

     মা কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলত, অর কথা বাদ দে। খেপী ও অ্যাকটা!

     আদরী আমাদের গ্রামের এক আদ বয়স্কা বিধবা। লোকে তাকে এক ডাকে আদরী খেপী বলে চেনে। বিধবা হলেও আদরী কিন্তু আজ অব্দি একটাবারের জন্যও গায়ে সাদা শাড়ি তোলেনি। বরং উল্টে তাকে দেখা যায়, চার আঙ্গুল চ্যাপ্টা পাড়ওয়ালা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে ঘুরতে। আবার এই রং শুধুই লালেই শেষ নয়, – কখনো লাল, কখনো নীল, কখনো গোলাপী, কমলা, হলুদ! বিয়ের কয়েক বছর পর বিধবা হয়ে আদরী আজ প্রায় পনেরো কুড়ি বছর ধরে এই গ্রামেই আছে।

     আদরীর বাপের পুরনো কয়েক কাঠা খালি জায়গা পড়ে ছিল আমাদের পাড়াতে। তার ভাইরা সেখানেই আদরীকে একটা ছোট্ট খুপরি বানিয়ে দিয়েছিল থাকার জন্য। তিনটে ভাইয়ের তিন তিনটে পাকা দালানবাড়ি থাকতেও তাদের একমাত্র বিধবা বোনের জায়গা হয়নি সেখানে। মনে জায়গা ছিল কি না, সেই সন্দেহ! গ্রামের কোনও লোকে কিছু বললে তারা জবাব দেয়, ও পাগলকে কে বাড়িতে রাখবে! 

     আদরীকে যে খুপরিটা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল থাকার জন্য, – তার ছাউনী নেই বললেই চলে। আদরীর ভাইপোরা শুধু নতুন করে তালপাতা কেটে চাপিয়ে দিয়ে যায় পুরনো তালপাতাগুলো ঝড়ে উড়ে গেলে। আর তাছাড়া, ছাউনী থাকলেই বা কী, আর না থাকলেই বা কী? আদরী নিজেই তো থাকে না সে খুপরিতে। তাকে দেখা যায় কখনো মল্লিকপাড়াতে, কখনো উত্তরপাড়াতে, – কখনো তালতলাতে, কখনো বা বেলতলাতে। কখনো তার সকাল হয় আমতলায় আমগাছের গোঁড়ায় ধুলোতে শুয়ে থেকে। পুরো গ্রামের যেকোনও পাড়ার যেকোনও গলিতে যেকোনও সময়ে তার দেখা মিলে যেতে পারে। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার পেছন ধরে। ডাকতে থাকে, আদরী খেপী আদরী খেপী করে। আদরী ঘুরে দাঁড়ায় তাদের দিকে। বলে, তু খেপী। তুর মা খেপী। তুর চোদ্দগুষ্ঠী খেপী।

     বলেই আদরী ছোট ঢিল তোলে হাতে। ছেলেমেয়েগুলো অমনি ছুটে পালিয়ে যায়। লুকিয়ে পড়ে যে যেখানে। আদরী হাঁটতে শুরু করলে আবার বেরিয়ে আসে তারা। পেছন ধরে আদরীর। কোনও বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে বাড়ির মেয়েরা যদি ডাকে আদরীকে, – আদরী যায় সে বাড়ি। গিয়ে বসে। আবার হুট করে উঠে চলে আসে যেকোনও মুহূর্তেই। ডাকলেও আর রা দেয় না সে তখন। আবার কখনো কখনো সে নিজে থেকে চেনা কোনও বাড়িতে ঢুকে। বসে থাকে কিছুক্ষণ। এটা সেটা কথা তুলে নিজে হয়ে।

     আদরীর গায়ে থাকে একটা টকটকে রঙিন শাড়ি। কখনো যদি সে গ্রামের কোনও বাড়িতে ঢুকে, – সে বাড়ির কোনও বউয়ের গায়ে থাকা কোনো শাড়ি যদি তার পছন্দ হয়, – কিংবা বাড়ির আঙিনায় টানানো কোনও রঙিন শাড়ি যদি তার চোখে ধরে, – সে চেয়ে বসে শাড়িটা তখনি। বলে, ও বউ, ও বউ, তুর শাড়িটা আমাকে দিবি? অ্যাঁ? আমাকে দিবি? আমার খুব পছন্দ। আমার খুব পছন্দ। দে না, দে। আমাকে দে। 

     অনেকে বাহানা করে এটা সেটা। আবার অনেকে দিয়েও দেয় তাকে। আদরীর কথায়, গ্রামের প্রায় সকলেই তাকে খাতির করে, – শুধু তার নিজের ভাই ভাবীরা ছাড়া। আদরী ঘেঁষেও না সেদিকে। আদরীর মাথায় এক খাবল চুল। তাও তেলে চুবচুবে হয়ে থাকে সারাক্ষণ।। বিকেলে মল্লিকপাড়ার কোনও বাড়িতে ঢুকে সে আবদার করে, আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে তো বউ। দে না, দে। আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে। খারাপ হয়ে আছে চুলগুলো। দে না, দে। 

     দিয়ে দেয় তারা তার চুলে তেল। চিরুনি চালিয়ে দেয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আদরীর খুশি হয় খুব। ছুটে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে। আর এক মুহূর্ত থাকে না সেখানে।

     কোনও বাড়িতে আবার পুরুষ মানুষ থাকলে আদরী সে বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়। পুরুষ মানুষটিকে দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, মারবে না তো? আমাকে ও মারবে না তো? অ্যাঁ?

     সে বাড়ির মেয়েরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে, বসিয়ে, গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে, মারবে কেন, আদরী? কেউ মারবে না তুকে। কে মারবে? কেউ কি মেরেছে কখনও তুকে?

     আদরী তখন ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় বলে, রতন। রতন। রতন মেরেছিল আমাকে। অনেক মেরেছিল। অনেক মেরেছিল। এই দেখ, এই দেখ, আমার পিঠে দাগ দেখ। আমার হাতে দাগ দেখ। ভালো না। ভালো না। ওরা ভালো না।

     এই রতনই আদরীর মৃত স্বামী। আদরী বলে, বিয়ের পর প্রথম যেদিন সে তার শ্বশুর বাড়ি গেছিল, – প্রথম যে রাতে সে তার স্বামীর ঘরে, – যে রাতে তার সারা শরীরে ভালোবাসার ছোঁয়া নেওয়ার কথা ছিল স্বামীর থেকে, – তার স্বামী তাকে উপহার দিয়েছিল অসহ্যকর আঘাত। তার সারাশরীরে এঁকে দিয়েছিল আজকের এই মারের চিহ্ন।

     কারও হাতে হাতভর্তি চুড়ি দেখলে আদরী তার হাতকে খপ করে ধরে। ধরে বলে, আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে দিতে পারিস না, হা লো? দিস কেনে আমাকে অ্যামন সুন্দর চুড়ি কিনে! দিবি? অ্যাঁ? দিবি আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে?

     – তুর চুড়ি পড়তে ভাল্লাগে আদরী?

     – হ্যাঁ, লাগে তো। আমার অনেক ভাল্লাগে। আমা চুড়ি পরব। আমি দুইহাতে অ্যাত্ত করে চুড়ি পরব।

     – রতন বুঝি তুকে অনেক চুড়ি কিনে এনে দিত? অনেক সাজিয়ে রাখত তোকে?

     – কে? কে? রতন? না না না না..... দ্যায়নি। দ্যায়নি। সে আমাকে চুড়ি কিনে দেয়নি। একটাও চুড়ি কিনে দ্যায়নি। আমি অনেক কেন্দেছিলাম। সে আমাকে চুড়ি কিনে দ্যায়নি। মেরেছে। সে আমাকে অনেক মেরেছে।

     সেবার উরসের মেলা হচ্ছিল খুব বড়ো। আদরী তখন নতুন বউ। অনেক বায়না করে সে রতনকে রাজি করিয়েছিল তাকে নিয়ে মেলাতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রতনকে বাধ্য হয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল শেষে। মেলায় লাল হলুদ চুড়ি দেখে আদরী মেতে উঠেছিল চুড়িগুলোর জন্য। রতনকে বলেছিল কিনে দিতে। রতন কিনে দেয়নি। পরে আদরীর মান করায় তাকে মেলাভর্তি লোকের সামনে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে এসেছিল রতন। আদরীর মান তখন জল।


     পর পর তিনটি পুত্র সন্তানের পর আদরীর বাপ মা বড়ো করে আশা করছিলেন একটা কন্যা সন্তানের জন্য, – আদরীর জন্ম ঠিক সেই সময়ে। জন্মের পর পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলে তাকে দেখতে এসে বলে গেছিল, সোনা কপালী মেয়ে। বাড়িতে এই প্রথম মেয়ে সন্তান। তিন তিনটে বড়ো ভাইয়ের আদরে সোনার থালায় ভাত খাবে তাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন। ছিলও সে সবার বড়ো আদরের। সেই জন্যই কিছুটা বড়ো হলে সকলের আদরে তার নাম পড়ে গেল আদরী। আসল নাম যা রাখা হয়েছিল, তা গেল চিরকালের মতো ঘুঁচে। কিছুটা বড়ো হলে আদরীর কাজে কামে গুন দেখে অনেকে বলেছিল, বড়ো গুনবতী মেয়ে। এই মেয়ে পারবে সুখে সংসার করতে বটে। মায়ের চেয়েও কাজে কামে তার পরিপাটি বেশি। যুবতী অবস্থায় তার রূপ দেখে বলাবলি করেছিল অনেকেমিলে, মেয়ের যেমন গুন, রূপও তেমনি চোখ ধাঁধানো। বিয়ের পর এই মেয়ে স্বামীর ভালোবাসায় ডুবে থাকবে সারাক্ষণ। স্বামী ঘুরবে বউয়ের আঁচল ধরে ধরে। 

     যথা সময়ে আদরীর বিয়ে হল। খিজিরপুরের জমিদার বাপের একমাত্র ছেলে রতনচাঁদ একশোর উপরে বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে এসছিল আদরীকে। যদিও বরযাত্রী আসার কথা হয়েছিল ষাটটে। পঞ্চাশে না মানতে চায়লে আদরীর বাপ আরও দু চারজনকে বাড়িয়ে শেষে ষাটে কথা পাকা করেছিলেন। রতনচাঁদ এনেছিল একশোর বেশিজনকে। এবং সেটাই ছিল তার শেষবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে আসা। দুপুরে জোহরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছিল ঠিকঠাকভাবে। আদরীর বাপ তাঁর একমাত্র আদরের মেয়েকে সঁপে দিয়েছিলেন রতনের হাতে। গোল বেঁধেছিল খাওয়া দাওয়ার সময়। একশোটা লোক একটা জায়গায় একসাথে থাকলে সেখানে নানারকম ভালো মন্দ কথা হবে। হবেই। পাত্রপক্ষ থেকে আসা কারও কারও মুখ থেকে আদরীর বাপের ভোজ আয়োজন নিয়ে কিছু খারাপ মন্তব্য শুনে পাত্রীপক্ষের কয়েকজন উত্তর করেছিল। পাত্রপক্ষের ‘পাত্রপক্ষ’ হয়েও কেন যাচ্ছেতাই বলার অধিকার থাকবে না, – এবং পাত্রীপক্ষরা ‘পাত্রীপক্ষ’ হয়েও কেন পাত্রপক্ষের সাথে তর্ক করবে, এই ছিল পাত্রপক্ষের রাগ। রতনের রাগ। আর এই রাগ এক সময়ে হাত চালাচালিতে পরিণত হয়। অবশ্য খেতে খেতে উঠে এসে হাত উঠিয়েছিল সবার আগে রতন নিজেই। শেষে বিয়ে করা বউকে শ্বশুর বাড়িতেই ফেলে রেখেই রতন তার বরযাত্রীদের নিয়ে ফিরে গেছিল বাড়ি। তিনদিন পর রতনের বাপ লোক পাঠিয়েছিলেন পুত্রবধূকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সোহাগীর বাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোককে বড়ো খাতির যত্ন করে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে।

     আদরী বলে, তার শ্বশুরের ছয়চালা মস্ত বড় মাটির বাড়িতে থাকার লোক বলতে ছিল শুধু রতন এবং রতনের বাবা। মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগে। মা মরা ছেলে রতনের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে কখনই আদরীকে বিয়ের করার জন্য রাজি ছিল না। তবে আদরী বলে নয়, সে নাকি সেই সময়ে বিয়েই করতে রাজি ছিল না কাউকে। বিয়ের আগে রতনের নিত্য অবাধ যাতায়াত ছিল পাশের গ্রামের রঙ্গপাড়ায়। সেখানে গিয়ে রতন মদ গিলত বোতলের পর বোতল। পড়ে থাকত বেহুঁশ হয়ে কোনও কোনওদিন। রাত হয়ে গেলেও তার হুঁশ আসত না। শেষে ও পাড়ার লোকেরা তুলে ধরে দিয়ে যেত তাকে বাড়িতে। আদরী বিয়ের পর গিয়ে কত শুনেছে, কত মেয়ের সাথে ধরা পড়ে রতন কত্তবার মার খেয়েছে! রতনের বাবা কোনওদিন বাড়িতে না থাকলে, রতন সুযোগ বুঝে মেয়েদের টাকা, গয়না কিংবা ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসত। অগুণতি টাকা পয়সা খরচ করত তাদের পেছনে। রতনের বাবা ঠিকই শুনতে পেতেন সব। তবুও বহু চেষ্টা করে তিনি রতনকে এসব পথ থেকে ফেরাতে পারেননি। শেষে ভেবেছিলেন, ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে হয়ত বা ছেলে শুধরে যাবে। তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে সে রাস্তা থেকে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টে রতনের মনে হত, আদরী যেন তার পথের বাধা, – তার সমস্ত সুখ ও শান্তির বিঘ্ন শুধুমাত্র ওই আদরী। আদরীকে হয়ত সে একটা দিনের জন্যও নিজের সুখ তো দূরের কথা, – দুঃখের সঙ্গী বলেও মেনে নিতে পারেনি। আদরীর কথা তার কেবলই ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি মনে হত। সে সারাক্ষণ সমস্তরূপে বিমুখ থাকত আদরীর উপর। পরিবর্তে আদরী পেত শুধুই লাথি আর কিল, কিল আর মার। অসহ্যকর যন্ত্রনা!

     এখন গ্রামের কোনও বিধবা বুড়ি যদি আদরীকে ডাকে, – ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, এই আদরী, বিধবা মানুষকে যে অমন রঙচঙে শাড়ি পরতে হয় না লো! আমাদেরকে দ্যাখ, – আমাকে দ্যাখ, আজ ষোলো সতেরো বছর হয়েছে রাঁড় হয়েছি। একটিবারও রঙিন তেনা গায়ে ওঠাইনি। সেই যে সতেরো বছর আগে আমার সেই সোনার হরিণ শাড়িখানা খুলে ছুড়ে দিয়েছি আগুনে, – ওই শ্যাষ। রতন যে আর নাই লো। তু বিধবা মানুষ অ্যাখন। ফেলে দে ওই শাড়ি খুলে। অমন রঙচঙে শাড়ি পরিস না আর। ভেঙে দে তুর ওই হাতের চুড়ি। পরতে নেই। পরতে নেই। খুলে দে।

     আদরী সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে সেই কথায়। বলে, না না না.....! কে রতন? কে সেই ছোঁড়া? কবে কোন কালে মরে ভূত হয়ে গেছে সে। শাউনতলার মাটিতে পুঁতে দিয়েছে তাকে। আমি দেখেছি। আমি দেখেছি। মরে ভূত হয়ে গেছে সে। তার জন্য আমি কেনে সাদা শাড়ি পরব? কিসের জন্য আমি আমার অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা ফেলে দিব আগুনে? সে কি আমাকে এই শাড়ি কিনে দিয়েছে নাকি? সে কি আমাকে অ্যামন সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিল কখনও? দ্যায়নি। দ্যায়নি। আমি বলিনি? আমি কান্দিনি নতুন শাড়ির জন্য? দ্যায়নি। সে আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। এই দ্যাখ, এই শাড়িটা আমাকে ওই মল্লিকদের বউ দিয়েছে। ও মাগী খুব ভালো। আমাকে শাড়ি দিয়েছে। কত্ত সুন্দর শাড়িটা দ্যাখ। আমি কেনে পরব না অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা? আমি পরব। বেশ করব। আমি আরও করে রঙিন শাড়ি পরব। আরও করে চুড়ি পরব হাতে।

     বলতে বলতে আবার কোথায় উধাও হয়ে যায় সে, – কেউ দেখতে পায় না।

     অনেকে আদরীকে একা একা বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখেছে অনেক সময়। সে কোনও এক মোটা গাছে নিচে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকে একা একা। চোখ মুছে নিজের শাড়ির আঁচলে। পেছনদিক থেকে গিয়ে কেউ ঘাড়ে হাত রাখলে আদরী অমনি নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আদরীর মনে যে কষ্ট লুকিয়ে আছে, যে কষ্ট তাকে কাঁদায় আজও, – তা সে বলে না কাউকে। বলতে চায় না। শুধু মনে করে বসে বসে। আর কাঁদতে থাকে একা একা। 

     আদরীর মনে পড়ে, রতনের লাথি ঝাঁটা, ঘরে কুলুপ লাগিয়ে মার কিংবা পায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়াতেও কোনওদিন ততটা কষ্ট পায়নি, যতটা কষ্ট সে সেদিন রতনের না মারাতে পেয়েছিল। রতন সেদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। আদরীর শ্বশুর সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সন্ধ্যার পর রাত করে মদ গিলে রতন টলতে টলতে বাড়ি ফিরেছিল। আদরী ভেতর থেকে ঘরের দরজা খুলতেই রতন ঢলে পড়েছিল আদরীর উপরে। কাঁধে হাত দিয়ে টলমলে গলায় বলেছিল, আমি রোজ রোজ অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, ফুর্তি করি বলে তুর খুব হিংসে হয়, তাই না? খুব যে ঘ্যানঘ্যান করিস! হ্যাঁ হ্যাঁ, হিংসে হবেই তো! হিংসে হওয়ারই তো কথা! তা আজ থেকে আর হিংসে হবে না যা। আমি য্যামন অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, – তুও অন্য পুরুষের সাথে শুয়ে থাকবি সারারাত। আনন্দ করবি। ফুর্তি করবি। তাহলেই তো হল! তাহলে আর হিংসে হবে না তুর। কী রে, থাকবি না? দ্যাখ আমি কাকে নিয়ে এসেছি তুর জন্যে। ওই দেখ, ওই দেখ, – কী রে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনে? ভেতরে আই। এই এই এই দ্যাখ, – এই দ্যাখ আদরীকে – আমার বউ। যা যা। ভেতরে যা।

      বলে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারই মতো এক মদ গেলা মাতালকে আদরীর সাথে। কুলুপ এঁটে দিয়েছিল রতন বাইরে থেকে হয়ত বা সামান্য কিছু টাকার পরিবর্তে।

     হয়ত এমন আরও অনেক কথা আছে, যা আদরী বলে না কাউকে। এড়িয়ে যায়। বলতে চায় না। নিজে একা একা বসে মনে করে আর কষ্ট পেতে থাকে। কাঁদতে থাকে লুকিয়ে লুকিয়ে। কথায় কথায় যদিও বা বলে ফেলে কিছু কথা কারও কাছে, – বলতে বলতে জিব কেটে ছুটে পালায় সেখান থেকে।

     রতন কবে কিভাবে মারা গেছিল, সেকথা সকলেই জানে। তবুও যদি জিজ্ঞেসা করা হয় আদরীকে, আদরী, রতনের কী হয়েছিল রে? কী করে মারা গেছিল সে?

     আদরী এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলে, অসুখ হয়েছিল। অসুখ হয়েছিল। কঠিন অসুখ হয়েছিল তার।

     – মিছা কথা কেনে বলছিস, আদরী?

     – না না, মিছা লয়। মিছা লয়। জ্বর হয়েছিল তার। হ্যাঁ, জ্বর হয়েছিল।

     – ও মা! জ্বর হয়েছিল? কিন্তু রতন তো বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল রে! বল না, কী হয়েছিল? কেন আত্মহত্যা করেছিল সে?

     – না না না.....!

     বলতে বলতে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে সে। উঠে দৌড় মারে খোলা রাস্তাপানে। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে থাকে, আমি তাকে বিষ দিইনি। আমি তাকে বিষ দিইনি। রাত্রিবেলা আমি তার ভাতে বিষ মিশাইনি। না না, আমি তাকে বিষ খাওয়াইনি। আমি তাকে মারিনি।

     রাস্তার ধারের দুয়েকজন যারা তার এসব কথা শুনতে পায়, – কোনও গুরুত্ব না দিয়ে হেসে বলে, খেপী কোথাকার! কি সব যে মনে মনে বলতে থাকে, ওই জানে আর উপরওয়ালাই জানে! 


     

আকাশে মায়ের মুখ - সামসুজ জামান || Akashe maaer sukh - Samsuz Zaman || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 আকাশে মায়ের মুখ

              সামসুজ জামান


সাইকেলটা চালাতে চালাতে পা ধরে যাচ্ছিল নির্মলের। এমনিতে খুব একটা অভিজ্ঞ বা পরিপক্ক নয় সে সাইকেল চালানোয়। কিন্তু চাপে পড়ে তাকে সাইকেল জোগাড় করতে হয়েছিল।

মালিকের কাছে কাজ করতে করতে হঠাৎই অন্য সকলের সাথে সেও শুনল কাল থেকে সারাদেশে লকডাউন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী টিভিতে ভাষণ দিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই আদেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন যেটা অমান্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু অন্যদেরকে তার অবস্থাটা বোঝানোর মতো পরিবেশ বা ক্ষমতাও তার নেই। কাকে সে বোঝাবে আর কেমন করে বোঝাবে তার মনের অবস্থা!

এমনিতেই নির্মল বড় মা অন্ত প্রাণ। পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন দলবেঁধে হৈ-হুল্লোর, মৌজ-মস্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, তখনও কিন্তু নির্মল মায়ের কথা ভেবে বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকত না। বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতো তাকে অনেক। কিন্তু মায়ের ভালবাসার কাছে বন্ধুদের খ্যাপানোর কোন তুলনায় হয় না।

তিন দিন আগে পাশের বাড়ির ফোন পেয়ে সে জেনেছিল মায়ের সংকটজনক অবস্থার কথা। তারপরে আর কাজে মন বসে না তার। মালিকের সাথে অনেক বাদানুবাদ করেও যখন সমস্যার সমাধান হয়নি তখন অগত্যা কাজ ছেড়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। মালিক তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল – দেখ, কী ছাই লকডাউন-মাউন, এসব ব্যপার তো বাপের জন্মেও শুনি নি। এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমার হাতে দেওয়ার মত কোন টাকা-কড়িই আমার কাছে নেই। শেষে অনেক চেঁচামেচির পর অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল মালিক।

বাড়ির ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি এজেন্টের কাছে ছুটেছিল নির্মল এবং পরের দিন রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটও পেয়ে গিয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে। তাতেই তার বাড়ি ফেরার কথা। বাড়ি ফিরতে তার লাগবে সতেরো ঘন্টা। নির্মল পাগলের মত শুধু ভেবে যাচ্ছে এই সতেরো ঘণ্টা কি করে তার কাটবে? আর এমন অবস্থায় আজ হঠাৎ এই লকডাউনের ঘোষণা!

 কিন্তু বাস, ট্রেন সমস্ত কিছু যখন বন্ধ, তখন ফেরার রাস্তা তো আর নেই। অন্য অনেকের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনার পরেও ফেরার রাস্তা কিছু না পেয়ে নির্মল অগত্যা সাইকেলে চড়ে ফেরার মত সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। একমনে এই দুশ্চিন্তার কথা ভাবতে ভাবতে তার নজর পড়ে হাতের দুর্বল আংটির দিকে। কারণ সামান্য কিছু অর্থের মধ্যেও আবার যদি সে বাজে খরচ করে ফেলে এইসময়, তবে তো মায়ের অপারেশন করার খরচ ই পাবে না। তখনই মাথায় মতলব আসে অন্ততপক্ষে এই সোনার আংটিটুকু বিক্রি করলে একটা পুরনো সাইকেল কেনার মত পয়সা তার হতে পারে। আর তারপরই যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সেই টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে অনেক দরদাম করার পর সাইকেলের দোকান থেকে পুরনো সাইকেলটা কিনে তার ভরসা হয়। যখন রাস্তাঘাটের গাড়িঘোড়া সব বন্ধ তখন সাইকেলে চড়ে এই দীর্ঘ পথ ফিরতে তার অন্তত কোন অসুবিধা হবে না বলেই তার মনের জোর।

 রাস্তায় লোকজন তেমন নেই কিন্তু নির্মল সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন। নির্মলের পাখির চোখ তার মায়ের মুখ। পাশের প্রতিবেশী মারফত মাকে সে খবর পাঠিয়েছিল সে গিয়েই মায়ের অপারেশন এর যাবতীয় বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। রাস্তায় পুলিশ বারবার তাকে আটকে কত যে হয়রানি করেছে কতবার। কতভাবে পুলিশকে বলে, বুঝিয়ে, টাকা-পয়সা খরচ করে তবে সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।

 অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ওড়িশা সীমান্ত দিয়ে ঢোকার মুখেই বিপত্তি গেল বেড়ে। পুলিশ কিছুতেই তার কথা শুনবে না। অবশেষে নিজের একমাত্র সম্বল পকেটের কম দামী মোবাইলটা পুলিশকে দিতে, তবে সে মুক্তি পেল। পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্ষিদে আর তেষ্টায়। সেসবের তোয়াক্কা না করেও অন্তহীন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে নির্মল।

অবশেষে একসময় নির্মল মাতালের মত টলতে টলতে কোনরকমে সাইকেলটা নিয়ে তাদের নিজেদের গ্রামের বড় নদীর ব্রিজ পার হচ্ছিল। সকালের নতুন সূর্যটা কি সুন্দরভাবে উঠছিল আম বাগানের পাশ দিয়ে। ওপারে বড় আম বাগানের পাশেই এলাকার শ্মশান। কিন্তু শ্মশানে হঠাৎ ভিড় কেন? খুব অসহায় লাগছে তার। সাইকেলটা কোনরকমে থামিয়ে মাটিতে পা রেখেছে নির্মল আর ছুটতে ছুটতে এলো রঘু। বলল- নির্মল কাকু তুমি এলে? কিভাবে এলে? এখনতো চারিদিকে লকডাউন। তোমার মোবাইল তো সুইচড অফ বলছে। কেউ যোগাযোগ করতেই পারেনি। জানো কাকু, ঠাকুমা........ কাল সন্ধ্যেয়...... মারা গেছে পেটের যন্ত্রনায়! ভোরে ভোরে এসে সবাই এইমাত্র ঠাকুমার দাহকার্য শেষ করল।

কি বলছিস রে রঘু? তুই ঠিক বলছিস? বলতে বলতেই মাথাটা ঘুরে গেল নির্মলের।

হ্যাঁ গো কাকু, এই কথা কি আর মিথ্যে করে কেউ বলে? জবাব দিল রঘু।

 সহসা চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাটিতে পড়ে গেল নির্মল আর চিৎকার করে উঠল তীব্রভাবে -- মা! মাগো! আমি যে এসে গেছি মা, তোমার অপারেশন করাব বলে কিছু টাকাও জোগাড় করেছি।

 আমবাগানের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা এসে পড়ছিল তার মুখের উপর। নির্মলের হঠাৎ মনে হল - ওই তো? ভোরের আকাশের সূর্যের মধ্যে থেকে মা চেয়ে আছে তার পানে। দুটো হাত সূর্যের দিকে প্রসারিত করে নির্মল চিৎকার করে উঠল – মা, মাগো! দাঁড়াও মা তুমি ওইখানে। আমি আসছি তোমার দিকে, তুমি চলে যেও না মা, আমি আসছি। আমি যে এত কষ্ট করে ছুটে এলাম, সে তো তোমার অপারেশনের জন্যেই। তুমি চলে যেও না মা।

মাটিতে দু’ হাতে ভর দিয়ে নির্মল প্রাণপণ শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে চেষ্টা করল সামনের দিকে, কিন্তু পা দুটো আর তার এগোল না। দু’ পায়ে জড়িয়ে আছড়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। সামনে পড়ে থাকা ভাঙ্গা একটা ইটের উপর মুখটা লাগতেই গর গর করে রক্তস্রোত বয়ে যেতে লাগল তার জামা-কাপড় বেয়ে।

ছোট্ট রঘু এই কাণ্ড দেখে হাও মাও করে চিৎকার করতে করতে লাফালাফি করতে লাগল – ও সুদীপ জ্যেঠু, ও অমর দাদু, তোমরা শিগগির ছুটে এই দিকে এসো গো। দেখে যাও নির্মল কাকুর কি অবস্থা...

কিন্তু নির্মলের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার ছোট ব্যাগটা খুলে তার অনেক কষ্টের সঞ্চয়ের টাকাগুলো ছেলেখেলার ভঙ্গীতে বাতাসে উড়িয়ে দিতে দিতে অভিমানে বলতে লাগল – কিচ্ছু দরকার নেই এগুলো আর আমার। এ টাকা-পয়সা আমার আর কোন কাজেই লাগবে না – বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল নির্মল।