Monday, September 12, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -19




 অবশ্যই দেখুন, কিন্তু আমার অনুরোধ জুতো পরে ভেতরে প্রবেশ করবেন না । পতিতালয় হলেও আমাদের এই ভগ্ন কুটিরে দেবতা বিরাজ করেন । 


ভেরি সরি । ঠিক আছে আমি এখান থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিচ্ছি ।


 সে আপনার ইচ্ছে স্যার । অফিসার টর্চের আলোতে ভেতরটা লক্ষ্য করতেই উনি বললেন , ভেতরে একজন শুয়ে আছে উনি কে আপনার ? 


আমার পঙ্গু স্বামী , তিনি রোগ শয্যায় আছেন । প্লিজ ওকে জাগাবেন না । বহু কষ্ট করে ওকে ঘুম পাড়িয়েছি । জাগিয়ে দিলে সারারাত ঘুমাতে পারব না । 


অফিসার বললেন , ওকে জাগাবার দরকার নেই । আপনি অতি ভদ্র , আপনার ব্যবহারে অত্যন্ত খুশী । কিছুক্ষণের জন্য আপনার ঘুম নষ্ট করলাম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।


এখন আসি ওরা যাবার পর কপাটের খিল লাগিয়ে পাঞ্জাবীর কাছে এসে বলল , এবার উঠে পড়ুন দাদা । পুলিশ চলে গেছে । লোকটা তক্তাপোষের উপর বসে বলল , বহুত আচ্ছা কাম করেছিস বহেন । হামার নাম শিবাজী সিং আছে । এ এলাকার বহুত বড়া গুন্ডা আউর মাফিয়া আছি । লেকিন হামি সচকা পূজারী আছি । কোই আদমী বুরা কাম করলে বেইমানী করলে হামি তাকে বাঁচতে দেবে না । এক বড়া বেইমানি অফিসার কো জানসে মার দিয়া , ইসলিয়ে হামাকে জানসে মারনেকে অর্ডার দিয়া উঁচা মহলকা অফিসার। হামার মাথার দাম আছে পাঁচ লাখ রূপায়া । লেকিন তু এ লাইনমে ক্যায়সে আয়ে বহিন ! তু বহুত বড়া আদমীকে লেকড়ী আছিস । 


শ্যামলী বলল , আপনাকে সব কথা জানাচ্ছি । আপনি শুনুন । সংক্ষেপে প্রকাশ করল শ্যামলীদি । আমি পাশের ঘর হতে হাজির হয়েছি পুলিশরা প্রস্থান করতেই । প্রকাশ করার পর শ্যামলীদির চোখ দুটো জলে ভরে গেল । 


শিবাজী সিং শ্যামলীদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , রোনা মত্‌ বহিন এবার বোল হামার দ্বারা কুছ কাম হোবে ? শ্যামলী বলল , হ্যাঁ দাদা , এই লোকটাকে খোঁজ করে বের করতে হবে । আমি আপনাকে ওর একখানি ফটো দিচ্ছি । আপনার কাজে লাগবে । শ্যামলী ডায়রী হতে ফটোটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল , এই কুলঙ্গার আমাদের ২ জনকে এই পতিতালয়ে বিক্রি করেছে । শিবাজী সিং দাঁতপাটিকে কড় কড় করে বলল , সোচ্ ম বহিন । তোরা হামার বহিন আছিস্ । হামি তোদেরকে কথা দিলাম , এই আদমী কো জলদী সে হাজির করবো তুমলোগকা পাশ । হামারা পত্তা লিখলো । কৌন কাম কে জরুরত হোবেত হামরা পাশ চলা জানা , কৌই ডর নেহি । হাম ঐ শালাকো ফটো লিয়ে যাচ্ছি । হাম চলতা বহিন , এ জায়গা মে রহনা ঠিক হোবে না । চলে বহিন তুমলোক শো যাও ।


 শিবাজী সিং বেরিয়ে গেলো । শ্যামলীদি ওর পিছন পানে তাকিয়ে দন্তে দত্ত চেপে আপন মনে বলতে শুরু করল , এবার পল্টু বাবু আর কতদিন লুকিয়ে থাকবে মশাই । তোমাকে একটি বার কাছে পাবার জন্য অনেক সাধনা করেছি , কিন্তু বারে বারে তুমি আমার নাগালের বাইরে চলে গেছো । যে কোন উপায়ে তোমায় দর্শন এবার পাবই ।


 তারপর শ্যামলীদি দাঁতগুলো বজ্রের মত কড়মড় করতে থাকল । শিবাজী সিং এর আশ্বাসে শ্যামলীদি পল্টু কে যেন নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলল । প্লটুর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত শ্যামলীদির জীবনে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ দারুন বেড়ে গেলো । শ্যামলীদিকে শোবার জন্য অনুরোধ করলাম দুজনে পুনরায় শুয়ে পড়লাম । রাত যে কত হবে ঠিক জানা নেই । শোবার একটু পরেই ধীরে ধীরে বেহুঁশ হয়ে পড়লাম । 


পরদিন ময়নার কথা মনে পড়তেই চোখ আমার ছল্ ছল্ করতে থাকলো । আমার জীবন তো মরুভূমি । তাই এই মরুভূমির মধ্যে ময়নাকে মরূদ্যান ভেবে নিয়েছি । ময়নার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার পর থেকে এক অনাস্বাদিত পূর্ণ পলকে আমার দেহমন ভরে উঠেছে ।


 শ্যামলীদিকে বললাম ময়নাকে দেখতে যাবার জন্য । তাকে পিড়াপিড়ী করাতে সে বলল , নিশ্চয় যাবো । কেন যাবো না ? ময়না তোর গর্ভজাত সন্তান না হলেও তুই মায়ের দায়ীত্ব স্কন্ধে নিয়েছিস । সে দায়িত্ব তোকে জীবন দিয়ে পালন করতে হবে মনে রাখিস । এটাই নারী জাতীর আদর্শ ।


 আমার কাছ হতে সরে পড়লো শ্যামলীদি । তার অভিমান ও ক্ষোভের কারণ কিছুটা অনুমান করলাম । সেও তো চেয়েছিল পাঁচজন নারীর মতো মা হতে , একটা ছোট্ট সংসারে সুখের নীড় বাঁধতে । কিন্তু বিধাতা তা হতে দেয়নি । ভদ্র মানুষের সমাজ হতে আমার মতো তাকেও আবর্জনার মতো দূরে সরে যেতে হয়েছে । আর কি অতীত সে ফিরে পাবে ? 


অকস্মাৎ দেবী বাবুর ডাকে আমার চিন্তার সূত্র কেটে গেল । বললাম , ভেতরে আসুন বাইরে কেন ? আমার অভ্যর্থনায় দেবী বাবুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । একটু বসুন , চা করি । 


দেবী বাবু কোন আপত্তি করলেন না । দেবী বাবুকে ঘরের চারিপাশ দেখতে দেখে বললাম , কি দেখছেন ? আপনার বাড়ির মতো আমাদের বাড়ীতে এতো আভিজাত্যের ছড়াছড়ি আছে কি , নেই । মনে রাখবেন এটা পতিতালয় । আপনাদের বাড়ীর মতো পবিত্র পরিবেশ খুঁজলে মিলবে না । কিন্তু আমাদের এই পাপ দেহের অভ্যন্তরে চিরন্তন নারীমন সুপ্ত হয়ে আছে । অনুকূল পরিবেশ পেলেই এই শাশ্বত নারীমনের জাগরণ ঘটবে । দেবী বাবু কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন , বাধা দিয়ে বললাম একটু বসুন , চা করে আনি তারপর আপনাকে কথা শোনাব । খানিক পরে প্রবেশ করে দেখলাম তিনি কিসের চিন্তায় মগ্ন হয়েছেন । মনে হল তার অতীতের ফেলে আসা দিনগুলির কথা চিন্তা করছেন । তিনি কত উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রহীন সমাজ বিরোধী ব্যক্তি ছিলেন । এই কলঙ্কিত জীবনের পাপ অজিতাকে মর্মে মর্মে দগ্ধ করেছে । একজন পতিতা তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যেভাবে নারীত্বের গৌরব নিয়ে নিজের জীবনকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে তুলেছে তার নজির মেলে না ।


 ঈশ্বর কত রকমের মানুষ সৃষ্টি করেছেন । এই দেবীবাবুই একদিন কি ছিলেন । সেই অমানুষটার আজ কত পরিবর্তন ঘটেছে । কার জন্য এই পরিবর্তন ? নিশ্চয় এই পরিবর্তনের পিছনে কোন মহৎ প্রেরণা আছে। 


সহসা দেবীবাবুর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো । আমার পায়ের শব্দে তিনি চমকে উঠলেন । একি , কি ভাবছেন ? ভাবছেন আমি যাবো না , এই তো ? দেবীবাবুর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো । 


তিনি বললেন , না মানে ---


কোন ভয় নেই । নিন চা খান । ময়নাকে যখন মেয়ে বলে মেনে নিয়েছি ওকে না


সুস্থ করে ছাড়বো না । আপনি না এলেও যেতাম । শুধু আমি নই , শ্যামলীদিও আজ যাবে । দেবীবাবুর আনন্দ হল না তা নয় । 


কিন্তু ওর মুখ পানে তাকিয়ে থাকাতে তিনি মুখখানি নিচু করলেন । বুঝতে পারিনি । আমার চোখ দুটো কেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চেয়েছিলো । আগে কতবার তো ওকে দেখেছি , কিন্তু কিসের লালসা জানিনা । কয়েকবার ঢোক গিললাম । কেন এমন হল । বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কোন উত্তর পেলাম না । বার বার মনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মনের কপাটকে খুলতে পারলাম না । অবশ্য একথা আমি আজো বিস্মৃতি হয়নি যে আমি একজন বারবনিতা ।


 একজন ভদ্র এবং আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তির কাছে আশ্রয় পাওয়া আমার স্বপ্নের অগোচরে , লোভ আমার নেই , বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার ক্ষমতাও আমার নেই , কিন্তু এক মহান কর্তব্যের আহ্বানে ছুটে চলেছি । সেইজন্য দেবীবাবুর পরামর্শ মতো কাজ আমাকে করতেই হবে । আমার নারীমনে কখন যে প্রেমের জোয়ার এসোছিল বুঝতে পারিনি । ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলাম পতিতার জঘন্য নোংরামী , নিশি - যাপনের দুর্নিবার মোহ । আমি তখন আমার হৃদয় - মন্দিরে প্রেমের দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি । তখন আমার দেহ মন্দির পবিত্র সৌরভে সুরভিত হয়ে গেছে , আমার অন্তরে বিকশিত হয়েছে সতীত্বের শ্বেত শতদল । একসময় সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দেবীবঝুর সাথে আমরা উভয়ে বেরিয়ে পড়লাম।


                                 ক্রমশ...

Saturday, September 10, 2022

ছোট গল্প - মাসির বাড়ি || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - Masir Bari || Written by Dipankar saha


 

মাসির বাড়ি
দীপঙ্কর সাহা



-এক-
মাঝরাতে কাজলদিঘী স্টেশনে

রাত বারোটায় স্টেশনে নামতেই ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। গা টা ছমছম করে উঠলো আমার, জায়গাটা শুনেছি ভালো নয়। আগে যতবারই এসেছি, সব বারই দিনের বেলায়। কিন্তু এই বার সব কিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। 

কাজলদিঘী স্টেশন একটা অত্যন্ত ছোটো গ্রাম্য রেল স্টেশন, সারাদিনে গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার ট্রেন মাত্র দাড়ায় এখানে।

আমার ট্রেনটা ছিল সাড়ে আট ঘন্টা লেট। পথে এক জংশন স্টেশনে ট্রেনটা দাড়িয়ে আছে তো দাড়িয়েই আছে। কোন একটা ট্রেন নাকি আগে কোথাও ডিরেইলড হয়েছে, ফলে দুর্ভোগ যাত্রীদের। তার উপর আমার ট্রেনটা হলো প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অন্যান্য সব ট্রেনের শেষে ওটার গতি হলো। 

পৌছবার কথা ছিল দুপুর সাড়ে তিনটেয়, পৌছলাম রাত বারোটায়। রাত সাড়ে নটার ট্রেন ধরে আমার ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আজ সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। 

আমি যাচ্ছি রমা মাসির বাড়ি, এই কাজলদিঘী রেল স্টেশন থেকে সাত আট কিলোমিটার দূরে মাসিদের গ্রাম, নারায়ণপুর। কিন্তু এই অজ পাড়াগাঁয়ের স্টেশনে এত রাতে কি আর গাড়ি ঘোড়া কিছু পাবো! এই হতচ্ছাড়া গ্রাম্য স্টেশনে তো ওয়েটিং হল বা রুমের কোনও অস্তিত্বও নেই। 

এই নাম না জানা গ্রাম্য জায়গায় তো হোটেলও পাবো না। কি করি তাই ভাবতে ভাবতে স্টেশন থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে বার হতেই দেখি কেষ্টদা রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। 

-আরে কেষ্টদা, তুমি আজকাল রিক্সা চালাও নাকি? জানতাম না তো! 

কেষ্টদা কানে খুবই কম শোনে, ইশারায় আমায় রিক্সায় উঠে বসতে বলে। আমি আমার গন্তব্যে যাবার এক পরিচিত বাহন পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বেচেঁছি, উঠে বসতেই রিক্সা ছেড়ে দেয়। কেষ্টদা রিক্সা চালাতে থাকে হাওয়ার বেগে। 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের রাস্তায় আলোর আশা করি না। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি শুধু কিছু তাঁরা মিটমিট করে জ্বলছে, চাঁদের দেখা নেই। মনে পড়ে গেলো চার দিন আগে মায়ের একাদশী গেছে, অর্থাৎ আজ তো অমাবস্যার রাত, চাঁদের দেখা পাবো কেমন করে? এই ঘোর অন্ধকারে কেষ্টদা কেমন করে এত জোর গতিতে রিক্সা চালাচ্ছে ভগবান জানেন। 

আমার ভয়, রিক্সা উল্টে মুখ থুবড়ে না পড়ি রাস্তার ধারে। কেষ্টদাকে বললাম - একটু আস্তে চালাও। কেষ্টদা কানেই নিলো না আমার কথা, বোধহয় শুনতে পেলো না। 

-দুই-
রমা মাসির কথা 

রমা মাসি আমার মায়ের ছোটবেলার 'বকুল-ফুল' পাতানো বোন বা বন্ধু। আমার মামাবাড়ি অর্থাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশেই ছিল রমা মাসির বাপের বাড়ি। দুজনায় গলায় গলায় নাকি ভাব ছিল ছোটো বেলা থেকেই। 

তারপর দুজনের দুই জায়গায় বিয়ে হয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুজনেরই মন খারাপ, কিন্তু এমনই যোগাযোগ, বেশ কিছু বছর বাদে দুজনে আবার এক জায়গায় এসে জড় হন। একদম সেই ছোটবেলার মতোই পাশাপাশি বাড়িতে। 

আমার বাবা ছিলেন রাজগ্রাম হাইস্কুলের হেডমাস্টার, সেই স্কুলেই রণজিৎ মেসো যোগ দেন এ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হিসাবে। অনেক দিন পর মাসিকে আবার কাছে পেয়ে, মা বলে, - ছাড়াছাড়ি হলেই হলো, এর নাম হলো প্রাণের টান।

রাজগ্রাম হাইস্কুলের কাছেই থাকতাম আমরা। পায়ে হেটে যাতায়াত করেছি স্কুলে। আমাদের বাড়ি আর রণজিৎ মেসোর বাড়ি ছিল একদম পাশাপাশি। একদম শিশু বয়সে, দিনের বেশির ভাগ সময় নাকি আমি কাটাতাম রমা মাসির বাড়িতে। মাসির সন্তান হয়নি, আমাকেই মাসি ছোটো বেলা থেকে পুত্র স্নেহে মানুষ করেছেন। 

কিন্তু কয়েক বছর পর স্কুল মালিকের সাথে কি সব বিতর্ক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, মেসো চাকরি ছেড়ে দেন, বলেন - পরের গোলামী বা চাকরি আর না। এইবার গ্রামে গিয়ে ভূমিপুত্রের মতো থাকবো, চাষবাসের কাজ করবো। 

কেষ্টদা ছিল রণজিৎ মেসোর ক্ষেতে কাজকর্ম করার লোক। ছোটখাটো চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় অল্পবুদ্ধির মানুষ, কানেও একদম কম শোনে, তবে প্রচন্ড পরিশ্রমী এবং বিশ্বাসী লোক। তিন চার জনের কাজ একা হাতে করে নেয়। 

এর প্রায় এক যুগ বাদে মেসো দেহ রাখেন। মাসি নিরক্ষর মানুষ। যতদিন মেসো ছিলেন, মেসোর হাতের লেখায়, মাসির পাঠানো পোষ্টকার্ড প্রতি সপ্তাহে আসতো আমাদের বাড়ির ঠিকানায়। মা-ও চিঠির উত্তর দিতো সাথে সাথে। 

যে আমলের কথা বলছি, সে আমলে মোবাইলতো দুরের কথা, টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ছিলো না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে। 

তারপর থেকে, কয়েক মাস অন্তর আমি বাড়ি এলে মাঝে মাঝেই মা আমাকে পাঠাতো মাসির গ্রামে। মেসোর অবর্তমানে মাসির চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কয়েক মাস অন্তর মাসির খবর নিতে না যেতে পারলে মা একটু অস্থিরের মতো করতো। 

খোঁজ খবর নিতে গেলেও মাসির কাছে থেকে আসতে হতো অন্তত একবেলা। এবং অতি অবশ্যই মাসির হাতের রান্না খেয়ে আসতে হতো । মাসির রান্নার স্বাদ এবং স্নেহের স্বাদ মনটা জুড়ে থাকতো বেশ কিছু দিন। 

-তিন-
মাসির বাড়ি

এবার এসেছি বছর খানেক বাদে, এক বছর তিন চার মাস পর। অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতেও আসা হয়নি অনেক দিন। ফলে দুই এক বছরের উপর হলো, মাসির খোঁজ খবরও নেওয়া হয় নি। 

রিক্সা চলছে ঝড়ের বেগে, একদম উড়িয়ে নিয়ে কেষ্টদা পৌঁছে দিলো মাসির বাড়ি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাকে নামিয়ে দিয়ে কেষ্টদা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, মাঝরাতে গ্রামে যে অন্ধকার এত গভীর হয়, না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। 

-মাসি, ও মাসি কোথায় তুমি, কেমন আছো? আমি হাঁক পাড়তেই এক আবছা সাদা থান শাড়ির আবির্ভাব হলো, আমি প্রণাম করতে পায়ে হাত দিতে গেলাম, একটা ঠান্ডা মেঝের শীতল স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম মাত্র, আর সেই সাদা থান শাড়ি চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

এক দুর্বিষহ আতঙ্কে আমি দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড় লাগলাম পিছন দিকে, ঘণ অন্ধকারে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। 

জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে, দেখি মাঠের মধ্যে শুয়ে আছি, গা হাত পায়ে অসম্ভব ব্যথা, উঠে বসলাম খানিকটা প্রচেষ্টার পর। মাঠে শুয়ে থাকা অবস্থায়, দেখতে পাচ্ছিলাম, দু-তিনটি অচেনা মুখ ঝুঁকে আছে আমার দিকে। 

গ্রামের লোকজনদের কাছে জানতে পারলাম, মেসোর মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে জমির কাজ সেরে স্টেশনের কাছাকাছি এক রিক্সা মালিকের রিক্সা চালাবার কাজ নেয় কেষ্টদা। বছর খানেক আগে এক অমাবস্যার রাতে মালিকের রিক্সা জমা দিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরার পথে, সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় তার। 

মাসির প্রতি দিন নদীতে স্নান করার বাতিক ছিল। কেষ্টদার মৃত্যুর দিনই সকাল বেলা ভরা অমাবস্যায় নদীতে বান আসে এবং মাসি সাতার কাটতে গিয়ে ভেসে যান। তিন চার কিলোমিটার দূরে তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায় পরদিন। 

Thursday, September 8, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -7


 


১৫


পিসেমশায় বললেন, চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। 


রতন বললো, আমার বাবা বলেন এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক।


পিসেমশাই বলেন, ঠিক  পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ"।।এর তাৎপর্যঃ হলো "হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক"।


১৬ আমি বললাম আপনি আজ মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলবেন বলেছেন।


পিসেমশাই বললেন মাংসাধনা  হচ্ছে, "মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী"।মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। "গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়"।আমি বললাম, তাহলে এই সাধনায় মাছ, মাংস, নারী, মদ সবকিছুর প্রয়োজন আছে। পিসেমশায় বললেন, ধারণা আরও পরিষ্ককার করতে হবে। এই সাধনা এইরকম।"...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন"।মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা "বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন"। আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, "মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে"।যে 'সাধারণ' লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, "...সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন"। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় 'মৈথুন' কখনই 'কদর্য, কুৎসিত' বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, "...আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ 'র' এই বর্ণে আকারের সাহায্যে 'ম' এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে"।শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ - তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য, সেখানে 'তত্ত্বাদিন্যাসের' নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম 'ষড়ঙ্গসাধন' এবং শিবের ইচ্ছায় একে 'অতীব গোপন' মোহর দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া "কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে"। অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন অধরা হয়ে গেল এবং  তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত চক ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না। শুদ্রজন ও নারী এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান লাভ করত। সাধনযোগিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ  বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের  পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। এসবে মতান্তর থাকতে পারে। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্র, খর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা,  নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়।শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশু আচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু' প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম ।বিভিন্ন দেবতা এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ , কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ড এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট করেন। এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন। উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে। এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। গুরুকে সর্বশাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছেশিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।এক আধটা উদাহরণ দিই। '




১৭


পিসেমশাই বললেন এসব কথা সব জায়গায় বলতে নেই। আমি বললাম, না বললে আমরা জানব কি করে। পিসেমশাই বললেন, এখন তো জানা সহজ। গুগুল এর দয়া ছাড়া আছে কত বই।পড়তে হবে। শুনতে হবে বেশি।পিসেমশাই বললেন,   কালীবীজ' মন্ত্র, 'বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বর্ণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এইভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' 'হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।তন্ত্রসাধনে 'গ্রহণ'-এও সিদ্ধিলাভ সম্ভব। হিন্দু শাস্ত্রে 'গ্রহণ' নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে। এবার জেনে নিন, কী কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে,চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি: চাইলে গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে শ্রীযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। যন্ত্রের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন। গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পঞ্চোপচারে শ্রীযন্ত্রের পুজো করুন। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন: 'ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ'। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।মামলায় জয় লাভ: সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। একই সঙ্গে পুজোর পর একটি তিনমুখী রুদ্রাক্ষও যন্ত্রের সামনে রাখতে হবে। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: 'ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা'।তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি: পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি হলুদ, বড়ো, দাগহীন পাতিলেবু নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে লেবুটিকে চার টুকরোয় কেটে ফেলুন। এবার সেই চারটি টুকরো চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসুন।ভূ-লোকে রিদ্ধি-সিদ্ধি লাভের জন্য একটি মহাকুঞ্জিকা রচনা করেন মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গুপ্তমন্ত্র। এই মন্ত্র পাঠ করলে মারণ, মোহন, বশীকরণ এবং উচ্চাটন ইত্যাদি উদ্দেশের সিদ্ধি হয়।এই মন্ত্রটি হল-- ওম এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্বালয় জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে জ্বল হং সং লং ক্ষং ফট্ স্বাহা।নমস্তে রুদ্ররুপিণ্যৈ নমস্তে মধুমর্দিনী। নমঃ কৈটভহারিণ্যৈ নমস্তে মহিষার্দিনী।। নমস্তে শুম্ভহন্ত্রয়ৈ চ নিশুম্ভাসুরঘাতিনী।। জাগতং হি মহাদেবী জপং সিদ্ধং কুরুষ্ব মে। এংকারী সৃষ্টিরুপায়ৈ, হ্রীংকারী প্রতিপালিকা।। ক্লীংকারী কামরুপিণ্যৈ বীজরুপে নমোস্তু তে। চামুণ্ডা চণ্ডঘাতী চ য়ৈকারী বরদায়িনী। ভিচ্চে চাভ্যদা নিত্যং নমস্তে মন্ত্ররুপিণি।। ধাং ধীং ধূং ধূর্জটেঃ পত্নী বাং বীং বুং বাগদীশ্বরী। ক্রাং ক্রীং ক্রুং কালিকা দেবী শাং শীং শুং মে শুভং কুরু।। হুং হুং হুংকাররুপিণ্যৈ জং জং জং জম্ভনাদিনী। ভ্রাং ভ্রীং ভ্রুং ভৈরবী ভদ্রে ভবান্যৈ তে নমো নমঃ।। অং কং চং টং তং পং য়ং শং বীং দুং এং বীং হং ক্ষং ধিজাগ্রং ধিজাগং ত্রোটয় ত্রোটয় দীপ্তং কুরু কুরু স্বাহা।। পাং পীং পূং পার্বতী পূর্ণা খাং খীং খূং খেচরি তথা।। সাং সীং সুং সপ্তশতী দেব্যা মন্ত্রসিদ্ধিং কুরুষ্ব মেব।। ইদং তু কুংজিকায় দেবী হীনাং সপ্তশতীং পেঠত্‍‌। ন তস্য জায়তে সিদ্ধিররণ্যে রোদং যথা।।দুর্গা-মন্ত্রে দূর হবে সব বিপত্তি। রতন বললো, কেউ যদি  দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়, তার থেকে মুক্তির মন্ত্র আছে ?বা পারিবারিক কলহ রাতের ঘুম কেড়েছে ?


Wednesday, September 7, 2022

ছোট গল্প - জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Jonaki oo Dirghaswas || Written by Rokeya Islam


 

জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস 

রোকেয়া ইসলাম 




বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে তিন বছরের ছেলে হাত বাড়িয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালো। তখন সন্ধ্যা রাতের দুয়ারে জোরেশোরে  কড়া নাড়ছে। অন্য বেবিট্যাক্সি থেকে মামা ও দেবর তড়িঘড়ি করে নামলো। জোনাকির স্বামী আহাদ বেবিট্যাক্সি ভাড়া মেটাতে না মেটাতেই দরজা খুলে দিলো আহাদের চেয়ে একটু বয়েসী এক ভদ্রলোক। তার নাম আবদুল মতিন । 

জোনাকি আকাশ ছোঁয়া খুশি আর নব অঙ্কুরিত আনন্দের ডালি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। আজ থেকে এই বাড়িটা ওদের নিজেদের। কোনো ভাড়া নেই, ভাগ নেই, ভাড়া দেবার তাগাদা নেই,ভাড়াটিয়া নামক "উঠুলি" পরিচয় নেই, ওরাই মালিক। অপার আনন্দে আপ্লুত জোনাকি। 

সবাই ড্রয়িং রুমে বসে। মাঝারি ধরণের চাকুরিজীবীর ড্রইং রুম বলতে যা বোঝায় তেমনি এটা। পাঁচজনের বসার মতো ব্যাবস্থা। তবে মতিন সাহেব   ভাড়ায় বেশ কয়েকটি ফোল্ডিং চেয়ার এনে রেখেছেন। 

জোনাকি জানে ওরা ভেতরের ঘরে থাকবে। বারান্দা ধরে ভেতরের ঘরে চলে যাওয়া যায়। 

এই রুমটি বেশ বড়সড়। বসা বা শোয়ার মত কোন ফার্নিচার নেই। 

ধোয়ামোছা রুমটায় আহাদ সকালেই লেপ-তোশক চাদর-বালিশ-পাটি কিনে রেখে গিয়েছিল। 

দেবর আর ছোটমামা মিলে বিছানা বিছিয়ে দেয় পাটপাট করে। বাইরে থেকে ব্যাগ সুটকেস টেনে নিয়ে আসে। 

মোটামুটি রাত্রিযাপনের স্বাস্থ্যকর  সুব্যাবস্থা হয়ে যায়। 

পাশের ঘর থেকে ভারি ভারি কথা টাকা পয়সার আদান প্রদান সিগনেচার,  সবশেষে চা মিষ্টির শব্দ ভেসে আসে। প্রত্যেকটা শব্দকে হীরেমানিক্যের মত করে সংগ্রহ করে জোনাকি। 

দুপক্ষের লোকজন চলে গেলেও ছোটমামা আর দেবর রইলো ওদের সাথে। 

আহাদ ঘরে ঢুকে সবকিছু সুন্দর ও ঝামেলা মুক্তভাবে সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে,  নিজেও বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে।

এই ফাঁকে জোনাকি ছেলের কাপড়চোপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নিজেও সুস্থির হয়ে নেয়। 

জোনাকিকে বাথরুম থেকে বেরুতে দেখেই ওঠে পড়ে আহাদ। দেবরকে নিয়ে রাতের খাবার কিনতে বের হয়ে দরজা অবধি পৌঁছাতেই মতিন সাহেব ও তার স্ত্রী লিপি খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। 

জোনাকির সাথে লিপির পরিচয় করিয়ে দেয় মতিন সাহেব । জোনাকি লিপির রুপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঝকঝকে গায়ের রঙ থেকে হলুদ আভা বের হচ্ছে। ছিপছিপে গড়ন নাক চোখ ঠোঁটের আকৃতি অপূর্ব। 

সকাল সকাল আহাদ নাস্তা কিনে আনার সময় কাঁচা বাজারও করে নিয়ে। একটুপরে কেরোসিনের চুলা বাসন কোসন বটিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসে,  

পুরাতন সংসারি জোনাকি নতুন সংসারের আমেজে শুরু করে নতুন শহরে নব জীবনযাত্রা। 

এক সপ্তাহ পরে জোনাকির পুরাতন সংসারের জিনিসপত্র চলে আসবে। এইসময়ের মধ্যেই মতিন লিপিও চলে যাবে তাদের নতুন আবাসে। 

লিপি ওর তিনরুমের সংসারকে একরুমে গুটিয়ে বাঁধাছাঁদা করছে। 

মতিন টাকা পাইপাই করে বুঝে নিয়েছে আহাদ কাগজপত্র বুঝে নিয়েছে। 

একজন সংসার ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজন গুটিয়ে ফেলছে। এরমাঝেই একটু একটু কথায় কাছে আসে দুজন। 

চলুন ছাদে গিয়ে বসি। 

জোনাকির কথায় চমকে যায় লিপি। 

ছাদে যাবেন, ভাই জানে তো। 

আরে জানাজানি কি আছে। ছাদটা তো বাড়িরই অংশ। চলুন তো যাই আগে। আকাশ দেখি, খোলা বাতাস গায়ে মাখি। 

লিপি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জোনাকির উচ্ছ্বাস ভরা চোখের দিকে। 

ছাদে হাঁটছে জোনাকি আর লিপি। 

এই বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল বিহারি কলোনী হিসাবে।  বাড়িগুলো পৌঁনে দু'কাঠা জমির ওপর তৈরি। সরকারিভাবে একই নকশায় তৈরি, চুন শুরকির ঢালাই দেয়া লম্বা ঘরকে তিনটে রুমে বিভক্ত করা। একপাশে বাথরুম রান্নাঘর সামনে একটু খোলা জায়গা। 

এই রোডে এই বাড়িটাই একেবারে আলাদা এটা তিনতলার ফাউন্ডেশন দেয়া,  একতলা হবার পরই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। 

তখনই আঁটকে যায় বাড়ি তৈরির কাজ। 

দেশ স্বাধীন হবার পর মালিকানা বদলাতে থাকে।আহাদ তিনহাত বদলে চতুর্থ মালিক। 

নিচে চলুন তো সন্ধ্যা হয়ে এলো। 

একটু পরে যাই, এই তো সবে এলাম। 

না না চলুন তো। 


জোছনা রাতে, দুপুরের বৃষ্টিতে ছাদে আসেন তাই না। 

না কখ্খনো না কোনদিনও না। 

লিপির রুক্ষ কন্ঠস্বর ওর লাবন্যময় রুপের সাথে একেবারেই বেমানান। কোথায়  লুকিয়ে রাখে ওর এই কর্কশ স্বরের ডিপো,  কে জানে। 

জোনাকি লিপির কন্ঠস্বরকে একদম পাত্তা দেয় না, নিজের মত করেই চারপাশ দেখতে থাকে 

বড় রাস্তার উপর এই বাড়ি, রাস্তার ওপাশে মসজিদ স্কুল, হাতের নাগালে কাঁচা বাজার মার্কেট বড় ঔষধের দোকানসহ নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা, হাঁটা পথের দূরত্বে বাসস্ট্যান্ড। তাহলে মতিন সাহেবের মত ঘোরেল মানুষ তড়িঘড়ি এই বাড়িটা হাত ছাড়া করলেন কেন? তাও জলের দরে!  

সূর্য ভোরের আলোর নধর দেহটা সারাদিনের রুপালী তাপে পুড়িয়ে লাল করে অভিজ্ঞতাটুকু পৃথিবীতে রেখে ডুবছে নিশ্চিত ফিরে আসার অঙ্গীকারে। 

সন্ধ্যার মোহন রঙরুপের সবটুকু বিভা লিপির মুখে অপরুপ ছায়া ফেলে।  এক নারীকে কি অনন্য অসাধারণ লাগছে। রুপসী লিপিকে কি যে অসামান্য সুন্দর লাগছে। 

লিপির চোখে চোখ পড়ে জোনাকির,  ওর চোখের নিচে এতো কালি কেন!  মনে হয় কতরাত ঘুমায়নি ও। 

সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী স্বামী, গোল্লা গুল্লু দুই ছেলে, স্বামীর নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি নিরিবিলি সংসার, সবমিলিয়ে তো নির্ঝঞ্বাট জীবন। আর নিজের গা ভরা ঐশ্বর্যময় রুপ। তার আবার ঘুমের অসুবিধা কোথায়। 

ফুঁ দিয়ে মাইক পরীক্ষা করা হচ্ছে শুনেই লিপি বুঝে যায় মসজিদে এখনই মাগরেবের আজান হবে। 

চলুন এবার নিচে। 

জোনাকি ততোক্ষণে সন্ধ্যার অধরা  অপরুপ রূপে বিমুগ্ধ হয়ে গেছে। 

লিপি ওর হাত ধরে টান দেয়। 

চলুন তো এবার 

আজান শেষ হোক তারপর যাই

আমি কখনও আজানের সময় ছাদে থাকি না।চলুন

কন্ঠস্বর আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ। জোনাকির নিরাসক্ত দৃষ্টিতে চোখ ছুঁয়ে দুপদাপ নেমে পড়ে লিপি। 

খোলা ছাদে হাঁটছে জোনাকি। সূর্য প্রতিদিনের মতোই  চেনা অথচ  অচেনা নতুন রুপে রক্তিম পথে ছুটছে। আজানের শব্দে জেগে যায় পুরো এলাকা। 

হঠাৎ জোনাকি ঘাড়ের কাছে দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শ। লিপি ফিরে এসেছে ভেবে পেছন ফিরতেই দমকা বাতাস ওর খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে উড়িয়ে দেয়,  এবার কোনকিছু না ভেবেই সিঁড়ি ভাঙতে থাকে জোনাকি। 

দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শে জোনাকির ঘুম ভেঙে যায়। সফল সঙ্গম শেষ নিসাড়ে ঘুমাচ্ছে আহাদ। জোনাকিরও তো এখন গভীর ঘুমে থাকার কথা তাহলে কি নতুন জায়গার কারণে ওর ঘুম ভেঙে গেল ভাবতেই পাশের ঘর থেকে চাপা কন্ঠস্বর ভেসে আসে রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে। 

মহিলার সাথে তো খুব খাতির পাতিয়ে ফেলেছো।  তা তোমার নাগরের কথাও কি বলেছো নাকি ওকে। 

কি বাজে বকছো এতো রাতে। 

আমি বাজে তাই না, বাজে বকছি আর তুমি কী? ঘরে ভাতার বাইরে লাঙ্গ ছিনাল মাগী। হায়রে মাগীর রুপ, জ্বইলা গেলাম রুপের আগুনে। 

চুপ কর তুমি চুপ কর,  পাশের ঘরে ওরা আছে। 

আছে তো কী হইছে আজ না জানলেও কাল তো জানবেই। আহাদ সাহেব তো বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আমি কেন দামি জায়গা হাতছাড়া করলাম। 

মতিন সাহেব চুপ কর থাকে। নারী-পুরুষের দীর্ঘশ্বাসে রাতের প্রহর দীর্ঘ মনে হয় জোনাকির। 

ওঠে দাঁড়াতেই মতিন সাহেবের কন্ঠে নিরবে কাত হয়ে কান খাঁড়া করেশুয়ে পড়ে জোনাকি। 

কেমনে তারে বলি আমার ঘরের রুপে বাড়ি পুড়াইছে। দেহের রঙ্গে আমার কপাল পুড়ছে। বৌয়ের বিগারে নাগর উতলাইছে। খারাপ মাগী আমার ঘরে হান্দাইছে। 

এগুলো তোমার ভুল ধারণা,  বুঝবে একদিন কত বড় ভুল করলে জীবনেও শুধরাতে পারবে না তা। 

ঔ মাগী আমি ভুল করছি আর তুই কি করছোস তর নাগরের সাথে, তোর ঘাড়ে নখের দাগ, তুই দেখাস নাই আমাকে। ভুল আমি করছি। 

মতিনের উত্তেজিত কন্ঠে নরম আওয়াজ ঢালে লিপি 

আমার যা মনে হয়েছে যা অনুভব করেছি সেটাই বলেছি। বলাটা কি ভুল। 

তোর নগরকে কি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিস নতুন বাসার। আমি না থাকলে দুইজনে শুবি। 

আমি তো জানি না কোথায় যাচ্ছি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাদের। 

বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে জোনাকি। কলজে কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ওর কানে ঝাপটা মারে। 

কার মন বেশি খারাপ? মতিন সাহেবের না লিপির। 

মতিন সাহেবের কথায় বাড়ি বিক্রি করার মূল রহস্য টের পায় জোনাকি। লিপিকে উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর ভেতরটা কতটা বহির্মুখী। 

উপরে স্বামী সন্তান অন্তপ্রাণ এক নারী। যতটুকু দেখেছে এই দুদিন। লিপির অন্তঃমুখী স্বভাবটা টেনেছে জোনাকিকে। অথচ ভেতরে ভেতরে কতটা বহির্মুখী একবারও বুঝতে পারেনি জোনাকি। 

মানুষ চেনা বড় কঠিন। 

কতটুকু চিনেছে লিপিকে কতটুকু চিনেছে মতিন সাহেবকে? প্রশ্নটা রাতের ঘুমকে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেয়। 

দুপুরের রান্না শেষ করে ছেলেকে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে গল্প শোনাচ্ছে তখনই লিপি ঘরে ঢোকে। 

মেঝেতে পাতা বিছানায় দুজনে পা ছড়িয়ে বসে। জোনাকির চোখ জোড়া লিপির সুন্দর মুখের ভূগোল পরিক্রমা করতে থাকে বারবার। 

আপনারা তিনজনই থাকবেন বাসায়। 

মেয়ে, এই ছেলের ছোট। কাজকর্মের ঝামেলায় ওর অযত্ন হবে তাই মায়ের কাছে রেখে এসেছি,  তাকেও নিয়ে আসব, আর আছে শাশুড়ির আমলের একজন মহিলা। সংসারের কাজে সাহায্য করবে সেও থাকবে। স্বামীর ব্যাবসার লোকজনের আসাযাওয়া তো আছেই। আত্মীয় স্বজনরা কেউ না কেউ থাকেই। 

তাহলে সমস্যা হবে না,  আমার সাথে থাকার মত কেউ ছিল না। দুই ছেলে আর মতিন। আমার গায়ের রঙটা আরো সমস্যা। 

কন্ঠটা বুঁজে আসে লিপির। খপ করে ধরে ফেলে জোনাকি লিপির অস্পষ্ট কন্ঠস্বর।

কী ধরণের সমস্যা? 

লিপি এবার ওর ঠোঁট জোড়ায় টিপতালা মেরে দেয়।  আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জোনাকিকে দেখতে থাকে। 

জোনাকি লিপির মত টকটকে ফর্সা নয়, চেহারা সুরতও চৌকশ নয়। 

নিজের গায়ের রঙ নিয়ে আফসোস ছিল জোনাকির কিন্তু হীনমন্যতা নেই কোনকালেই। এই মূহুর্তে লিপির দৃষ্টির কাছে আফসোসটা প্রকট হয়ে ওঠে।  তিনটে ঠেলাগাড়িতে  দীর্ঘদিনপর সংসার তুলে বিদায় নিতে আসে লিপি। জোনাকিকে জড়িয়ে ধরে। এই কয়টা দিনেই কতটা কাছে এসেছে দুজন মনের অজান্তেই। আজ যাবারকালে বিষয়টা প্রকট হলো। 

চোখ মুছে দুজনই।

সাবধানে থাকবেন,  আর যখন তখন ছাদে যাবেন না। 

আরো কিছু বলার উপক্রম করতেই দেখে ঘাড়ের কাছে মতিন সাহেব দাঁড়িয়ে। জোনাকির পিঠে হাত রেখে এগুতে থাকে আস্তে হাতটা সরে যায় লিপির দেহের টানে। 

লিপির কি মায়া পড়ে গেছে জোনাকির জন্য? ওকে ছাদে যেতে বারণ করলো কেন লিপি? 

পরদিনই পুরো সংসার ট্রাকে তুলে নিয়ে আসে আহাদ সাথে শাশুড়ীর আমলের  মিনার মা। 

নতুন উদ্যমে সব গুছিয়ে নেয়। নতুন বাড়ি দেখতে আসে জোনাকির মা বাবা। ফিরে যাবার সময় কোলের মেয়েকে জোনাকির কোলে দিয়ে যায়। নতুন বাড়ি এখন ঝলমল করে ওঠে সংসার আনন্দের  আপন বিভায়। 

এতোকিছুর মধ্যে ছাদটা প্রিয় হয়ে গেছে জোনাকির কাছে। খুব ভোরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, ছাদের সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে বই পড়ে গান শোনে। বিকেলে ছেলেমেয়েসহ ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প করে। ওরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। জোছনা রাতে একাকী ছাদে হাঁটে। 

লিপির সাবধান বাণী মনেও পড়ে না জোনাকির। 

একদিন ভর সন্ধ্যায় কি কারণে যেন মেয়ে কাঁদছে তার শব্দ ভেসে আসে ছাদে। দ্রুত নামতে থাকে জোনাকি, হঠাৎ পেছনে ধাক্কা এবং ঘাড়ের কাছে  আঁচড় অনুভব করে,  তাল সামলে নিতে পাশের দেয়াল ধরতে ধরতে মনে হলো কে যেন আঁচল টেনে ওকে পড়ে যাওয়া আঁটকে দিল। পেছন ফিরে দেখে বাতাসে আঁচল উড়ছে। মেয়ের কান্নার শব্দ জোরে হতে ভেতরে চলে আসে জোনাকি। 

লিপি আর মতিন সাহেব এসেছিল ছেলের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিতে, স্কুলের কাজ সেরে মতিন সাহেব কাঁচা বাজারে ঢোকে তার আগে লিপিকে রেখে যায় জোনাকির কাছে। 

লিপি আজ সুযোগ পেয়ে খুলে দেয় ওর মনের অবরুদ্ধ জানালা। কীভাবে মতিনের মিথ্যে সন্দেহ তেতো হয়ে গিয়েছে ওর মিষ্টি জীবন। সন্দেহ মতিনকে মানসিক রোগীতে রুপান্তরিত করেছে। যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতেও প্রতিদিন স্বামীর সুস্থতা কামনা করে। সমাজের ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারে না,  এমনিতেই ঘরে দিবানিশি লাঞ্জিত হচ্ছে ঘটনার সত্যতা বিচার না করেই সমাজ ওকে লাঞ্জিত করবে। বড়বোনকে কিছুটা বলেছিল,  বড়বোনও মতিনের সাথে তাল মিলিয়েছে। হাড়ির একটা ভাতে টিপ দিয়েই পুরো সামাজিক অবস্থা বুঝে নিয়েছে লিপি। সহ্য করার নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে অসহনীয় জীবনটায়। বাড়ি বিক্রি করেছে লিপির সব গহনা বিক্রি করেছে। লিপিকে সামান্য প্রসাধনী কিনে দেয় না কোন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যায় না। সারাক্ষণ লিপিকে চোখে হারায়, সন্দেহ আর ভালবাসা এক বাড়িতে থাকে না,  নাকি থাকে বুঝতে পারে না লিপি। বুঝতে পারে না ওর রূপের কারণে না মতিনের ভালবাসার আধিক্য ওর সহজ যাপন মরণসম বাঁচা  হয়ে গেল। 

হাজারো যন্ত্রণার কথা বলতে ফুঁপিয়ে  কেঁদে ফেলে লিপি। 

মতিন ভাই কি তেমন কাউকে পেয়েছে যাকে ঘিরে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে?

মুখ ফসকে বলে ফেলে জোনাকি 

সে আরেক যন্ত্রণার ইতিহাস। সন্দেহের পোকা মাথায় ঢোকার পর থেকে নানাভাবে খুঁজতে থাকে আমাদের আশেপাশের পুরুষ মানুষের দৃষ্টি কেমন তারা কীভাবে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আরেক পন্থা অবলম্বন করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি বলে আশেপাশে লুকিয়ে থাকতো। বাড়ির চারপাশে নজর রাখতো আমি কী করি কোথাও যাই কিনা,  কেউ আসে কিনা?  একবার গোপনে ছাদে ওঠে দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা স্টেশনারি দোকানে বসে আছে এক তরুণ। লাগলো তার পেছনে। খবর নিয়ে জানলো দোকান মালিকের পুত্র স্থানীয় এক কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে বাবার কাজে সাহায্য করতে আসে। কিছুদিন তাকে নিয়ে খুব যন্ত্রণা দিতে থাকে। অথচ তরুণকে কিছুই বলে না,  একসময় তরুণ দেশের বাইরে চলে গেলে মতিন আবার আরেকজনকে আবিষ্কার করে তাকে নিয়ে যন্ত্রণা দিতে থাকে। 

রাতে ঘুম ভেঙে যায় জোনাকির।  ছাদে কারো হাঁটাচলা শব্দ রড টানাটানির প্রকট শব্দ। আহাদ আর মিনার মাকে জাগিয়ে ছাদে যায় জোনাকি। 

পুরো ছাদ থৈ থৈ করছে জোছনা। একখণ্ড রডও কোথায়ও পড়ে নেই। নিচের কলাপসিবল গেটে তালা, লোকজন আসবে কীভাবে!

আহাদ সহজ সমীকরণ দেয়,  পাশের বাসার কোন পরীক্ষার্থী রাত জেগে পড়ছে মাঝে মাঝে চেয়ার টানছে, রাতের শব্দহীন সময়ে সামান্য শব্দটাই জোরে বাজছে জোনাকির কানে। হাই তুলতে তুলতে নিচে নেমে যায় আহাদ। ঘুম ভাঙা বিরক্তি নিয়ে আগেই নেমে গেছে মিনার মা। 

মাতাল জোছনায় হাঁটছে জোনাকি। কেউ যেন পিঠে দু'হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। অনুভূতিটা প্রবল হতেই ব্লাউজের একটা অংশ ধরে টেনে ধরার অনুভব টাও টের পায়। 

থমকে দাঁড়ায় জোনাকি, ফেলতে যাওয়া পায়ের পাতাটা  যদি ফেলতো তাহলে সেটা ছাদের কংক্রিটে নয় শূন্যে ফেলতো ফলাফল হতে পায়ের টানে জোনাকির শরীরটা মাটিতে গিয়ে পড়তো। নিশ্চিত দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেল!  

একটু সুস্থির হয়ে খেয়াল করে কেমন করে এতোটা কিনারে চলে এলো,  নিজের উপর কি নিয়ন্ত্রণ নেই ওর!

ওর পেছনে কারা এই অশরীরী। একজন ধাক্কা দিতে চায় অন্যজন আঁটকে দিতে চায়। 

পড়িমরি করে নামতে থাকে জোনাকি হঠাৎ ঘাড়ের কাছে নখের আঁচড়ের স্পর্শ পায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে ওর কানের কাছে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়,  পেছন ফিরতেই মনে হয় একটা ছায়া আঁধারে মিশে গেল। এবার সমস্ত শরীর জুড়ে ভয়ের কাঁপুনি শিরদাঁড়া দিয়ে আতংকের ঢল নামে। 

দৌড়ে এসে ঘরের ছিটকিনি আঁটকে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে ভেতরে ভয় নিয়ে। 

ভোরের আলো ফুটতেই ভয় নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। জোনাকি মনের ভেতরের দ্বিধা নিয়ে তাকায় দিনের প্রথম আলোর দিকে।

ওর বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে কোনদিন কোন কথা গোপন করেনি আহাদের কাছ থেকে। এই প্রথম যতবার রাতের ঘটনা দিনে বলতে চেয়েছে ততোবারই লিপির দুঃসহ জীবন জটিল যাপনের চিত্র লিপির চোখের জলে ভেসে ওর কাছে এসেছে।

আহাদও যদি মতিনের মত ভুল বুঝে ওকে ওর সুস্থির যাপনকে অস্থির করে তোলে!

জোনাকি তো ছোটবেলা থেকেই অন্যদের তুলনায় সাহসী। এতোদিনে তো বুঝতে পারছে দীর্ঘশ্বাস আঁচড়ের বিষয়টা শুধু ওর সাথেই হচ্ছে আর কারো সাথে নয়। ছেলেমেয়েদের একা একা ছাদে না দিলেই সমস্যাটা কাটান যাবে।

একরাতে আহাদ বাসায় নেই। ওর ব্যবসায়ের দুজন লোকও বাসায় নেই। ছেলেমেয়ে দুজন পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। মিনার মা নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যাবেলায়ই।

মাথার কাছের জানালা খুলে ঘুমিয়েছে জোনাকি।

প্রবল আলোর স্রোতে ঘুম ভেঙে যায় ওর। এতো ভুলো মন ওর,  আলো জ্বেলে ঘুমিয়েছে!  ওঠে লাইট নিভিয়ে পাশ ফিরে শুতেই লাইট জ্বলে ওঠে। ওর সমস্ত শরীরের লোম কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিরাতে কলাপসিবল গেটে তালা দেয়া, ভেতরের কাঠের মূল দরজা হুড়কো টেনে বন্ধ করা, প্রত্যেক ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়া। ও নিজে করে। কখনো ভুল হয় না।আজও হয়নি। তাহলে? জোরে মিনার মাকে ডাকতে গিয়ে গলা জড়িয়ে আসে ভয়ে।

লাইট নিভে যায়।কেউ যেন পুরো ঘর জুড়ে হাঁটছে এলোপাথাড়ি। উপস্থিতি নিরব হলেও অনুভব সরব। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

ভয়ে কলজে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড তৃষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিতেও সাহস হচ্ছে না।

অশরীরী হেঁটে চলছে অবিরাম। হুট করে খুলে যায় দরজা। হু হু করে দমকা বাতাস ঘরে ঢোকে। জোনাকি বুঝতে পারে বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বইছে। ভয়ংকর কড়কড় শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অঝোর বৃষ্টি আওয়াজ বুঝতে পারে। চাদর আর বালিশে সর্বাঙ্গ মুড়ে অধমরা হয়ে পড়ে থাকে। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসও অচেনা মনে হয়।

অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারে অশরীরী আর নেই। তবুও মুখের ওপর থেকে বালিশ সরিয়ে চাদরের তলা থেকে বের হবার সাহস শক্তি কোনটাই অবশিষ্ট নেই জোনাকির। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, সাথে থাকে ভোরের প্রতীক্ষা।

দিনের সূচনা হতেই দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ায়। গতরাতের ঝড়বৃষ্টির কোন লক্ষ্মণ দেখতে পায় না জোনাকি। তবে পেছনে কারো উপস্থিতি টের পায় ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখে মিনার মা দাঁড়িয়ে আছে।

আলতো স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস আর গভীর রাতে ছাদে রড টানাটানি নিয়ে কেটে গেছে এবাড়িতে কয়েক বছর।

সরকার বিহারি কলোনীর দায়িত্ব দেয় পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর। আহাদ দৌড়াতে থাকে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দলিল নিজের নামে করার জন্য। মন্ত্রণালয়ে দৌড়াতে গিয়ে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে শালা মতিন তুই বড় ধড়িবাজরে। ফাউ ফাউ কতগুলো টাকা নিয়ে গেলি আমার কাছ থেকে।

সরকারি মূল্য পরিশোধ করেই নিঝঞ্ঝাট মালিকানা বুঝে সুস্থির নিশ্বাস ফেলে আহাদ।

আহাদের সাথে জোনাকিও দৌড়াতে থাকে বাড়ির  আদি মালিকের খোঁজে। বিজলি মহল্লার সেখানেই পায় চুন্নু বকশীকে। বয়স আশির কোটা ছুঁই ছুঁই। সহজে মুখ খোলে না। সরু দৃষ্টিতে তাকাতো জোনাকির দিকে।পরে এনজিওর লোক ভেবে অনেক তথ্য দিয়েছে।

জোনাকিদের বাড়ির মূল মালিক  ছিল আরফান খান। সে ছিল এই রোডের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী। যেমন ছিল তার টাকার অহংকার তেমনি ছিল তার সৌখিনতা আর বদমেজাজ। তার ছিল অসম্ভব সুন্দরী তিন কন্যা। বড়মেয়ে লাভলী বেগমের সাথে গোলার টেকের বাঙালি তরুণ কামালের প্রেম হয়ে যায়। কথা জানাজানি হয়। পুরো দেশ জুড়ে তখন ঊনসত্তরের উত্তাল সময়।

আরফান খান পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হলেও বিহারের জামশেদপুরের পাঁচ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসা খান বাঙালি সমাজকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম জীবনে অভিজাত স্বচ্ছল অবস্থান থেকে পরবর্তী জীবনে রিফিউজি।  এদের কোন দেশ নেই। দেশপ্রেমও নেই। থাকে না মাটির প্রতি সংযোগ।

ঊনসত্তরের উত্তাল আন্দোলন এদের পুনরায় রিফিউজি জীবনে পর্যবসিত করতে পারে, সেই শংকাও ভেতরে তীব্রভাবে কাজ করে। অন্যদিকে কামাল একজন খাঁটি বাঙালি পরিবারের সংস্কৃতিমনা সন্তান।

আরফান খান কামালের সাথে একান্তে কথা বলতে চান। শুনে আনন্দে আত্মহারা লাভলী। তার অহংকারী পিতা তার প্রেম মেনে নিয়েছে এরচেয়ে পৃথিবীতে আনন্দের আর কী আছে। লাভলী নিজেই কাবাব বানাতে বসে যায় ওর বোনেরাও দুএক পদ তৈরি করে,  বিশেষ পদ তৈরি করে আরফান খান নিজে। 

পরদিন ভোরে আশেপাশে লোকজন দেখতে পায় তুরাগে জলে কামালের দেহের নিম্মাঙ্গ এবং জলের উপর পাড়ে শুয়ে আছে উর্ধাঙ্গ। 

পরদিন বিকেলেই আরফান খানের পরিবারে  আরেকটি জানাজার আয়োজন করতে হয়। 

লাভলী ঝুলছিল তাই কামালের দেয়া মহরমের মেলা থেকে কেনা ওড়না গলায় বাঁধে। 

চলে যাবার আগে জেনে গিয়েছিল আরফানের নিষ্ঠুর চাতুর্য। 

হেরে গেল আরফানের  ভয়ংকর মানসিকতার কাছে কামাল আর লাভলীর প্রেম। 

দেশ স্বাধীন হবার পর ওরা এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। 

চুন্নু বকশী এটুকুই জানে। 

সেদিনের সেই একতলা বাড়িটা ছ'তলা হয়েছ। 

একতলা  দোকান এবং দোতলা অফিস  কমার্শিয়াল হিসাবে ভাড়া তিনতলা চারতলা জুড়ে জোনাকির ভরভরন্ত সংসার। পাঁচতলা ছতলা দু ইউনিট করে চার ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া। 

এতো বছরে কত ভাড়াটিয়া এলো গেলো,  কেউ কখন লিপির আর জোনাকির সমস্যার কথা বলেনি। 

এখন ছাদ বাগানে জোছনা রাতে হাঁটাহাঁটি করে দোলনায় দোল খায় জোনাকি। রোজ বিকেলে বাগানের যত্নআত্তি নিজেই করে। 

দীর্ঘকাল দীর্ঘশ্বাস আর আঁচড়ের স্পর্শ পায় না। 

সেদিনের সেই দোকানটাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে। ক্যাশ কাউন্টারের আরামদায়ক চেয়ারে বসে পৌঢ় ভদ্রলোক। 

তার দিকে তাকিয়েই দীর্ঘকাল পরে লিপির জলভরা চোখ জোড়া মনে পড়ে।

বুক কাঁপিয়ে বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সোনাকির।

Tuesday, September 6, 2022

ছোট গল্প - কৃষ্ণগোপাল ও অনুরাধা || লেখক - চন্দন চক্রবর্তী || Short story - Krishnagopal oo Onuradha || Written by Chandan Chakraborty


 


কৃষ্ণগোপাল ও অনুরাধা

চন্দন চক্রবর্তী



হিরন্ময়ের কাছে খবর পেলাম অনুরাধা মারা গেছে । অনুরাধা বেঁচে থেকেও তার মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছিল । অমানুষিক পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে গেছে আগেই । শেষে তিলে তিলে একাকিত্বের কষ্টে তার মনের মৃত্যু হয়ে আজ সে চিরতরে মুক্তি পেল,বলা চলে । 



মনে আছে আমার বন্ধু,বিখ্যাত সেতারী হিরন্ময় গাঙ্গুলীর বাড়িতে সেদিন বহু সম্মানে ভূষিত বিখ্যাত বাঁশি বাদক কৃষ্ণগোপালের একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল । নিমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম সেই আসরে । শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে,"সংগীত সাধনায় ফল লাভ অনেক জন্মের ফল",হিরন্ময়ের এই কথাটাকে অতিশয়োক্তি মনে হয়েছিল । আমার মনে হয় সাধনার সঙ্গে প্রতিভার মিলন হলে তার নব নব উন্মেষ ঘটে । ফলে নব নব চেতনা জাগে,যাকে আমরা নবজন্ম বলে থাকি । কৃষ্ণগোপালকে দেখে আমার ভাবনার সত্যতা খুঁজে পেয়েছিলাম । তাকে ধ্যানি ঋষির মত মনে হয়েছিল । পরে তার বাদন শুনেও আমার তাই মনে হয়েছে । 



হিরন্ময় তার কথার যুক্তির সাপেক্ষে শিল্পীর জীবনের শুরুর দিকের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের ঘটনাগুলো তুলে ধরছিল । টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো জোড়া দিলে বেশ গল্প হয় । তাই ঘরে ফিরে কৃষ্ণ গোপালের জীবনের অংশগুলো জোড়া দিয়ে গল্প লিখেছিলামও,নামগুলো পাল্টে ।



গল্পে কোন নদী ছিল । নাম দিয়েছিলাম যমুনা । নদীর পাড়ে গ্রামের রাখাল ছেলে,পিতৃ মাতৃ হারা,গোপাল প্রভাবশালী ব্রাহ্মন পরিবারে আশ্রিত । তার কাজ বাড়ির গরুগুলো নিয়ে নদীর ধারে চড়াতে নিয়ে যাওয়া । তাকেই গল্পে কৃষ্ণ ধরেছিলাম । গোপালের বাঁশি শেখা তার বাবার বাঁশি শুনেই । নদীর ধারে গাছের নিচে বসে সে সারাদিন বাঁশি বাজাতো । বাঁশিতে জাদু ছিল । যে একবার শুনেছে সেই মোহিত হয়েছে । 



বাড়ির মেয়ে অনুরাধা । গোপালের চেয়ে কিছু বড় । সে গোপালের বাজনা শুনে তার প্রেমে মজেছে । 



অনুরাধা দিদার কাছে রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা শুনেছে । সন্ধ্যাবেলা ধানের গোলার পাশে গোপাল তার ঘরে বাঁশি বাজায় । অনুরাধা অস্থির হয় । বাঁশির সুরে তার চোখে ভাসে যমুনার পাড় । সেখানে কদম গাছের নিচে গোপাল কৃষ্ণ হয়ে বাঁশি বাজায় । গাছে কদম ফোটে । ময়ূর নাচে । নদীর বুকে ঢেউ তুলে বাতাস বয়ে যায় । সে নিজেকে রাধা মনে করে মনে মনে সেখানে উপস্থিত হয় । গোপালই তার কৃষ্ণ ।



তবে সে কেন পারে না মনের মানুষের কাছাকাছি আসতে ! কানু বিনে রাধার যে,'মরনরে তুহু মম শ্যাম সমান" ! বাঁশি শুনলে তার যে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা !



মনে যখন যমুনা বয় তখন প্রেমের জোয়ারে তারা ভেসে যাবে সে আর বেশি কি ! শত বাঁধা থাকলেও তারা সুযোগ বুঝে মিলিত হত । গোপালকে সে কৃষ্ণগোপাল নাম দিয়েছিল । আর সে নিজে রাধা । 



কিছুই চাপা থাকে না । গ্রামে রটে যায় তাদের প্রেমের কথা । এই অসম প্রেমে তাদের অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে । অনুরাধাকে ঘরে আটকে থাকতে হয়েছে । গোপালকে তার আশ্রয় হারাতে হয়েছিল । তাকে চাবুক মেরে পথে শুইয়ে রেখে আসা হয়েছিল । তবুও থামানো যায় নি । 



এক ভোরে তারা ঘর ছেড়ে পালিয়ে পথে নেবেছে । 



সেবার গল্পটা নিছক কিশোর কিশোরী প্রেমের গল্প লিখেই শেষ করেছিলাম । 



সেদিনের আসরের পরে তাদের সংসারে অনেক বার গেছি । তখন দুজনের জীবনের অনেকটা খরচ হয়ে গেছে । যেটা জেনেছি, ওরাও পালিয়ে এসে শহরে ঘর বেঁধেছিল । গোপাল ফাংশনে বাঁশি বাজাত । অনুরাধার ছিল ঘরে ছেলে মেয়ে পড়িয়ে,সেলাই করে,রোজগারের চেষ্টা ।



যখনই গেছি অনুরাধা হাসি মুখে আপ্যায়ন করেছে । চা খাইয়েছে । কোন অনুযোগ ওর মুখে শুনিনি । তবে বেশি সময় দিতে পারতো না । মাফ চেয়ে নিত । আমরা কৃষ্ণগোপালের বাজনা শুনে ফিরে আসতাম । এমনও শুনেছি পাছে স্বামীর সাধনায় ক্ষতি হয়,অনুরাধা স্বামীকে শিক্ষকতা করতে দিত না ।



গল্পটা এখানে শেষ হলে মনে হবে কোন পতিব্রতা নারীর ভালোবাসার গল্প ।



না আমার তা মনে হয় নি । কৃষ্ণগোপালকে বরাবর স্বার্থপর মনে হয়েছে । কোনদিন স্ত্রীর ত্যাগের কথা তাকে বলতে শুনিনি । অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে দেখিনি । সংগীত ছাড়া তার অন্য দিকে কোন নজর ছিল না । এক কথায়,অনুরাধা অবহেলিত । অত্যাধিক খাটুনিতে সে বিছানা নিয়েছিল । কাজেই অনুরাধার মৃত্যুর পর দিন থেকে রাগ করে কৃষ্ণগোপালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি,খোঁজও করিনি ।



শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে যাবার পরে মাস ফুরোয়নি, হিরন্ময়ের ফোন পেলাম । বারবার যেতে বলছে । কারন না শুনেই ওকে আমার অনিচ্ছার কথা জানাতে,ওর কাছে ধমক খেলাম । ভালো করে এবার শুনে চমকে উঠলাম । কৃষ্ণগোপাল পাগল হয়ে গেছে !



যেতে হল । এই কদিনে কৃষ্ণগোপালের এত পরিবর্তন হয়েছে আগের থেকে চেনা না থাকলে কেউ চিনতে পারবে না । 



স্ত্রী অনুরাধার মৃত্যুর দিন থেকেই লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল । বাঁশিগুলো ভেঙে আগুনে পুড়িয়েছেa । নিজের গায়েও আগুন লাগাতে গিয়েছিল । বাড়িওলার চেষ্টায় পাড়ার ছেলেরা পাহারায় থেকে রক্ষা পেয়েছে । এখন সে কাউকে চিনতে পারে না । খায় না । পায়খানা প্রস্রাব বোঝে না । একদম বদ্ধ উন্মাদ।


ডাক্তারি পরামর্শে আমি আর হিরন্ময় কৃষ্ণগোপালকে বহরমপুর পাগলা গারদে রেখে এলাম । বিকট শব্দে করে হা হা করে তখনও হাসছে । তার হাসিতে প্রচ্ছন্ন কান্না এসে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল । কান্না সামলাতে পারলাম না । কানে তখনও হা হা শব্দ প্রকট ।



Monday, September 5, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -18


 


নিজের ভুল সংশোধন করবার পর শেষ সম্বল মা মরা মেয়েটাকে বাঁচাবার কসুর করলাম না । অনেক ডাক্তারকে চিকিৎসা করালাম কোন ফল হলো না । আমিও দু'বছর ডাক্তারি পড়েছিলাম , কিন্তু নিজের নৈতিক অধঃপতনকে ডেকে এনে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ঢেকে দিলাম ব্যাভিচারের ঘন কৃষ্ণ মেঘে।


 একদিন বিশিষ্ট অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনুরোধ করলাম যাতে মেয়েটাকে বাঁচানো যায় । সকলেই ভালোভাবে পরীক্ষা ও ব্যাক হিষ্টি শুনে সাজেশন দিলেন বা তারা একযোগে এই মত প্রকাশ করলেন যে , শিশুটি যদি কোন মেয়েকে নিজের মা বলে মেনে নিতে পারে , তাহলে শিশুটি বেঁচে যাবে । কারণ মেয়েটির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিল । আপনাকে এমন এক মহিলার সন্ধান করতে হবে যার সঙ্গে আপনার স্বর্গত পত্নীর চেহারায় অনেকটা সাদৃশ্য আছে। 


বিচিত্র আমাদের দেশ । এই দেশে বিভিন্ন চেহারার মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন । এমন কথা নয় যে ময়নার মায়ের মতো এ্যাকজাক্ট দ্বিতীয় কোন মেয়ে জন্মগ্রহণ করেনি । অনেক সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে যে একই চেহারায় অনেক নারী এবং পুরুষকে অবশ্য ওরা কেউ কারো সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্কে আবদ্ধ নয় । সুতরাং দেবীবাবু যদি একটু চেষ্টা করেন , তাহলে তার স্ত্রীর অনুরূপ চেহারার নারী পেতে পারেন।


 পদ্মাদেবী , সবই তো শুনলেন , ডাক্তারদের কথা মতো আমি বিভিন্ন স্থানে আমার স্ত্রীর মতো একটি রমনী খুঁজে বেড়াতে লাগলাম । কিন্তু কোন ফল হল না । ভাবলাম মেয়েটাকে আর ফিরে পাবো না । তাই মনের দুঃখে , অনুশোচনায় একদিন এই মহানগরীর কোন স্থানে বসে ভাবছিলাম নানান কথা , সেই অবসরে নজরে পড়লো আপনাকে , সাথে আপনার শ্যামলীদিও ছিলেন । কিন্তু তখন ব্যাভিচারিনী বলে বুঝতে পারিনি । কিছু বলার আগে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম । আপনাদের ফলো করলাম , দেখলাম এক কদর্য বঙ্গীতে গিয়ে উঠলেন । ন্যায় অন্যায়ের কোন প্রশ্ন তা তুলেই জেনে নিলাম আপনাদের কথা । আপনাদের আদরি মাসী অর্থ গৃধনু । তারপর আদরী মাসীকে বশীভূত করে আপনাকে আনার সুযোগ খুঁজছিলাম । কিন্তু আপনি ভুল বুঝে , আমাকে অবজ্ঞা করে তাড়িয়ে দিলেন । আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা । মেয়েকে আমার সুস্থ করতেই হবে এবং আপনাকে নিয়ে যেতেই হবে । আমার পত্নী চন্দ্রা ও আপনার মধ্যে চেহারায় এত বেশী সাদৃশ্য যে মনে হয় যেন আপনারা একই মায়ের দুই যমজ কন্যা।


 আপনি আমার প্রতি বিরক্ত বোধ করছিলেন বলে আদরি মাসীকে চেপে ধরেছিলাম । তিনি বলেছিলেন , শ্যামলীদিকে মত করতে । কারণ শ্যামলীর সাথে তার মেলামেশা গভীর । তাই পরদিন শ্যামলীকে সব কথা বললাম । মাতৃহারা ছোট শিশু ময়নাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আমার এই প্রচেষ্টার কথা শুনে তিনি আনন্দিত হলেন । আপনাকে ময়নার মা হয়ে পাঠাতে রাজী হলেন।


 তারপর - তারপর আপনাকে এখানে আনার সমস্ত চেষ্টা সার্থক হলো । এই মাতৃহারা শিশুটির দায়িত্ব আজ থেকে আপনার হাতেই তুলে দিলাম । কিন্তু একটু সতর্ক থাকবেন , যাতে ময়না কোন দিন আপনাকে ভুল বুঝতে না পারে । সে আপনাকে মা বলে মেনে নিয়েছে । তবে আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই । আমার ময়নার মা হয়ে , আপনি একটি ছোট্ট শিশুর জীবনকে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্য করলেন , সেজন্য আপনাকে আমি এক মহীয়সী নারী বলে মনে করি । ময়নাই আমার শেষ সম্বল।


 এই কথা বলার পর দেবীবাবুর মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো এবং চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। 


আমি কথা দিলাম ময়নার লুপ্ত মাতার দায়িত্বভার আমি নিজের হাতে তুলে নেব । তার আগে আপনাকে ক্ষমা করতে হবে এ কারণে , অজান্তে আপনাকে অনেক অপমান করেছি।


 তিনি বললেন , আপনার ব্যবহারে মোটেই রাগ করিনি । বরং আপনার এই মহৎ কাজের জন্য আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকব। 


সেদিন কোন রকম ময়নার কাছে কাটিয়ে ফিরে এলাম বিকেলে । দেবীবাবু পৌঁছে দিয়ে গেলেন । বস্তীতে এসে শ্যামলীদিকে আঁকড়ে ধরলাম । চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা উষ্ণ জল নির্গত হতে থাকল । শ্যামলীদির কাছে ময়নার কথা প্রকাশ না করে থাকতে পারলাম না । বুকের ভেতরটা যেন টন টন করে উঠল । অব্যক্ত যন্ত্রণায় নিজেকে স্থির থাকতে না পেরে বলল উঠলাম , একি করলে শ্যামলীদি , আমি এখন বিবেকের দংশন জ্বালায় ক্ষত - বিক্ষত । একজন পতিতা নারী হয়ে একটি নিষ্পাপ মেয়েকে মাতৃত্বের সোহাগ দিয়ে নিজ কন্যা বলে কিভাবে গ্রহণ করবো? 


শ্যামলীদি সান্ত্বনা দিয়ে বলল , ওরে আমরা পতিতা হলেও আমাদের অন্তরে নির্মল মাতৃত্ব ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত । উপরে আমাদের দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না । এই মাতৃস্নেহ যেন অন্তঃসলিলা । ময়নাকে গর্ভে না ধরে ওর মুখ দিয়ে যে মায়ের ডাক শুনেছিস, এজন্য তোর নারী জীবন ধন্য মনে করবি। কিন্তু সমাজের কি নিষ্ঠুর বিচার, কোনো এক বীরঙ্গনা নারী যদি সন্তান ব্রতী হয় তাহলে রেহাই নেই কুৎসা ও কলঙ্কের জালিমা তাদের ভাগ্যকে বিড়ম্বিত করে তুলবে । ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের পশরা নিয়েই আমাদের যাত্রাপথ শুরু।



 রাতে শোবার পর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না । শ্যামলীদি অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে । আমার মনে অতীতের বহু স্মৃতি আমাকে পাগল করে তুলল । সময়ে অসময়ে এবং কারণে অকারণে অতীতের বহু সুখ দুঃখের চিত্র আমার মনের আস্তিনায় ভিড় করতে লাগল । যদি আমি এই অধঃপতিত জীবনকে বেছে না নিতাম তাহলে আর পাঁচজন নারীর মতো স্বামী পুত্র নিয়ে সুখের স্বর্গ গড়ে তুলতে পারতাম । মনে হয় পূর্ব জন্মের বহু সঞ্চিত পাপের জন্য আমাকে এই ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের কলঙ্ক নিয়ে ঘর করতে হচ্ছে । বন্দিনী হয়ে দিনের পর দিন পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজে লাগছি।


 আজ না হয় পিপাসায় আকুল হয়ে এক ফোঁটা জলের আশায় শীতল সরোবরে ছুটে চলেছি । অবাক্ত পিপাসাকে মিটাতে চলেছি ময়নাকে স্নেহ করে । হঠাৎ কপাটে ধাক্কা হওয়ার জন্য বিস্মৃত হলাম । শ্যামলীদিকে উঠালাম । এই ঘটনায় একটু ভীত হলাম । শ্যামলীদি তার বিছানা হতে উঠে চোখ কচলাতে শুরু করল ।


 শুনতে পেলাম কার কণ্ঠস্বর যেন ভেসে আসছে । বহিন খিড়কী খোলে , কৌই ডর নেহি।


শ্যামলীদি চোখ রগড়ানো বন্ধ করে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে কপাট ফাঁক করতেই নজরে পড়ল এক হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ ব্যক্তিকে । পরণে চুস প্যান্ট ও গায়ে সেঁটে থাকা কালো গেঞ্জি । মাথায় কালো পাগড়ী । এক মুখ দাড়ি । দাড়িতে যেন সূক্ষ্ম কালো জালি দিয়ে দুগালকে চেপে রেখেছে । হাতে মোটা সোটা একটা বালা । লোকটা যে পাঞ্জাবী তাতে কোন সন্দেহ নেই । হাতে উদ্যত রিভলভার।


 ঐ অবস্থা দেখে শ্যামলীদি ও আমি পাষাণবত হয়ে গেছি । আমাদের অনড় অবস্থা দেখে লোকটা বলল , কৌই ডর নাই বহিন , হাম বহুত বিপদ মে পড়েছি । মুঝে কুছ জায়গাদো । হারামী বাচ্চা পুলিশ হামারা পিছা করেছে । তুম লোককা কৌই ডর নেহি । দেরী মত কর বহিন , জলদী দরজা খোল। 


শ্যামলী বুঝতে পারল কোন মানুষ বিপদে পড়েছে বা পুলিশের তাড়া খেয়েছে কারণ এই এলাকা একেবারে এক নম্বরী । আমি যে ভয় পেলাম না তা নয় , শ্যামলীদিকে কপাট খুলতে নিষেধ করলাম।


 শ্যামলী আমার কথা না শুনে কপাট খুলতেই লোকটা অর্থাৎ পাঞ্জাবী তো বটেই , আধা বাংলা মিশিয়ে বলল , হামাকে পনদেরহ মিনিট কা লিয়ে চুপনে কা জায়গা দে

জলদী কর বহেন মেরে পিছে পুলিশ হ্যায় । শ্যামলীদি দ্বিধা না করে প্রবেশ করতে বলল। 


পুনরায় কপাট লাগিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলল , এই তক্তাপোষের উপর কম্বলটা ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ুন । পাগড়ীটা খুলে ফেলুন । জলদী করুন , আর একথা মনে রাখবেন , পুলিশ এলে পর যা বলবার আমি বলব । আপনি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকুন। 


পাঞ্জাবী শ্যামলীদির নির্দেশ মতো কাজ করল । আমাকে পাশের রূমটাতে শুয়ে পড়তে বলল আলো নিভিয়ে । পাঁচ / সাত মিনিটের মধ্যে পুনরায় কপাটে ঠক্ ঠক্ শব্দ । বেশ কয়েকবার শব্দ হবার পর শ্যামলীদি ঘুমের ভাব দেখিয়ে ধরা গলায় বলল , এত রাত্রে কি দরকার ? রাত্রি দশটার পর কোন খদ্দেরকে আমি এলাউ করি না।


 কপাট খুলে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল , ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিলেন স্যার । দুই জন পুলিশ অফিসার ও তিন জন কনস্টেবল অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে বললেন , আপনাদের বাড়ীর মধ্যে কোন লোক প্রবেশ করেনি?


 শ্যামলীর উত্তর , তা জানিনে স্যার , যদি মনে করেন তল্লাশি করতে পারেন । আপনাদের সহযোগিতা করা আমার কর্তব্য মনে করি।

তাহলে ভেতরটা একটু দেখতাম।



                          ক্রমশ...

Saturday, September 3, 2022

ছোট গল্প - শৈশব || লেখক - চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি || Short story - Saisob || Written by Chandrani Gupta Bannerjee


 


শৈশব

চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি



                (১)

আজ সকালে  কাকার ফোনটা এল। বেশ অনেক দিন পর। যোগাযোগটা ক্ষীণ হয়ে গেছিল। মিথ্যে বলব না যোগাযোগটা আমার তরফ থেকেই কমে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম কাকা ফোন করত। আজকালকার এসএমএস কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও চিঠি লিখত ।ফোনেই কথা বলতাম ।চিঠির উত্তর লিখতে বসাতে আমার ভীষণ আলসেমি। তাই চিঠি লেখা থেকে যোজন খানেক দূরত্ব বজায় রাখতাম। আমার গ্রামের বাড়ির সমস্ত খবরা খবর কাকার চিঠি মারফত জানতে পারতাম ।গ্রামের বাড়িতে কাকা এখনো থাকেন ।প্রায় পঁচাত্তরের এর কাছাকাছি ওনার বয়স ।কাকিমা প্রায় সময়ই অসুখে ভোগেন। একমাত্র মেয়ে বুলির বিয়ে কাছাকাছি দিয়েছেন। বুলিকে দেখিনি আজ কত বছর হয়ে গেল। আমার সেই ছোট্ট বোনটা... নাদুস নুদুস ...গোলগাল ।ওই আমার খেলার পুতুল ছিল। বুলির কথা মনে পড়তেই নিজের অজান্তে হেসে উঠলাম। যখন আমার বিয়ে হয় তখন বুলি কত ছোট ছিল। সৌমেনও বুলিকে খুব ভালোবাসতো। একটা ছবিও বোধহয় আছে সৌমেনের কোলে বসা বুলি। ভাবতেও অবাক লাগে সেই বুলি এখন ঘোর সংসারী। দুই ছেলে-মেয়ের মা। দাপিয়ে সংসার করে বেড়াচ্ছে। কাকা চিঠি লেখে না আজ বহুদিন ।গ্রামের বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগের মাধ্যমটা ছিল কাকার লেখা চিঠিগুলো। হাতের আঙ্গুলগুলো কাকাকে আজ আর  সঙ্গ দেয় না।   অবাধ্যের মতো কাঁপতে থাকে। তাই লেখাগুলো হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্যতর। ধীরে ধীরে গ্রামের ছবিগুলো আমার দৃষ্টিপট থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। মা-বাবার থেকে কাকার আদুরে ছিলাম বেশি। যত আব্দার ছিল কাকার কাছে। কাকা ঘোড়া সাজত আর আমি হতাম  তার সওয়ারী। ভাই একটু বড় হবার পর--- সে আর  বুলিও এর আনন্দ উপভোগ করেছে। কিন্তু কাকার রাজকন্যা আমিই ছিলাম। মা কিংবা কাকিমা আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কখনো কোন তারতম্য করেননি। কাকিমা নারকেলের নাড়ু বানালে সবার আগে আমি আর ভাই পেতাম। তারপর বুলি। আবার মায়ের হাতে বোনা সবচেয়ে সুন্দর সোয়েটারটা বুলির জন্য তোলা থাকতো। আমার বাবার ছিল বিশাল ব্যবসা। নিজের পরিশ্রমের বিন্দু বিন্দু দিয়ে বাবা নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ঠাকুরদার সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ করে কাকাকে দেন ।কাকা কখনো বাবার মুখের ওপর টু শব্দটি বলেননি। বিশ্বাস করতেন দাদা যা করবেন তাতে তার মঙ্গলই হবে আর বাবাও ওনাকে কখনো নিরাশ করেননি। বাবা গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে ব্যবসার খাতিরে কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু গ্রামের বাড়ির অংশটা তিনি বিক্রি করেননি। বাকি অংশে কাকা কাকিমা এখনো থাকেন। ছেলেবেলায় আমরা পুজোর সময় কলকাতায় থাকতাম না। পঞ্চমীর দিনে একদম গ্রামের বাড়ি পৌঁছে যেতাম। তারপর লক্ষ্মী পুজো সেরে কলকাতায় ফিরতাম। চোখ বুজে সেই স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেছিলাম আমার সেই গ্রামের বাড়িতে । একটা বাক্সে জমিয়ে রেখে ছিলাম কাকার লেখা সেই পুরনো চিঠিগুলো। সেগুলি আমার পাশে রাখা ।যেই না চৌখাট পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে যাব তখনই সৌমেনের গলার আওয়াজ পেলাম।

---" কি হলো সবু?  কি ভাবছো চোখ বুজে? নতুন শাড়ি, নতুন গয়না কিনবে বুঝি ?"

 চোখ খুলতেই দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে  সৌমেন। গলার টাইটা বাঁধার চেষ্টা করছে ।সৌমেন আমায় আদর করে "সবু" ডাকে। আমার ভালো নাম সর্বানী। যাহোক আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলাম।

 বললাম ---"নতুন শাড়ি নতুন গয়নার কথা কেন ভাববো ।আমার প্রচুর আছে।"

---" তাহলে কিসের কথা চোখ বুজে ভাবা হচ্ছিল শুনি ?"

ছোট্ট করে বললাম ---"পলাশপুর।"জানি সৌমেন পলাশপুরের নাম শুনে আশ্চর্য হবে। তাই ছোট্ট জবাবেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলাম।

---" তা হঠাৎ পলাশপুর! এত বছর পর!"

---" কাকা ফোন করেছেন আজ সকালে ।"

---"কেন ?"

---"পলাশপুর যেতে বলছে।"

 ---"তুমি কি যেতে চাও সবু?"

একটু সময় নিলাম জবাব দিতে ।তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

---" তোমায় আমি কখনই কোন কিছুতে বাঁধা দিই না সবু ।শুধু একটা কথাই বলি তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্না একজন মানুষ। যা করবে, মস্তিষ্কের সাথে সাথে হৃদয়েরও সাহায্য  নিও।কবে যাবে আমায় বলে দিও টিকিট কাটতে হবে তো! "

               (২)
এবারের দুর্গাপূজা টা আমাদের, বিশেষ করে আমার পলাশপুরে কাটবে তা ভাবতেই  মনে কেমন একটা শিহরণ জাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মা তো আগেই চলে গেছিলেন ।তারপর বাবার মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন হওয়ার পর আর পলাশপুর মুখো হইনি। কাকা বহুবার অনুরোধ করেছিলেন অন্তত পুজোর দিন গুলো যেন আমরা সবাই মান অভিমান ভুলে পলাশপুরে কাটাই ।নাহ্... আমি জেদি, একগুঁয়ে। মান-অভিমান ভুলতে পারিনি ।শুধু কি আমি?  মান-অভিমান তো  অনিও ভুলতে পারেনি। ওকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা । অনি মানে আমার ছোট ভাই...  অনির্বাণ বসু ।দিল্লিতে সপরিবারে থাকে ।বেশ কয়েকটা বছর অনি আর আমি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি আমার রাগ ভুলতে পারিনা ।উল্টো প্রান্তে অনিও  হিমালয় পর্বতের মত তার সিদ্ধান্তে অটল। আমার ভাইফোঁটা ও রাখি উৎসবগুলি অনি বিহীন ভাবে কেটে গেছে বহুকাল। ভবিষ্যতেও একই রকম ভাবে কেটে যাবে ।কই অনির ওতো কখনো আমার কথা মনে পড়ে না ।আমাদের একসাথে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো... শৈশবের দিনগুলো! সৌমেন এর সাথে আমার বিয়েটা বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন। বেশ জাঁকজমক ভাবে পলাশপুরের বাড়িতেই বিয়েটা হয়েছিল। কলকাতায় ব্যবসা বিস্তার করলেও বাবা কখনোই  ওনার শেকড়টা ভুলে যাননি ।যাইহোক, আমার বিয়েতে বাবা কোনো কিছুরই কার্পণ্য করেননি। সোনার গয়নায় মুড়িয়ে দিয়েছিলেন আমায়। পাত পেড়ে লোক খেয়েছিল।  সে    স্মৃতিগুলো এখনো আমার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল ।আমায় যেমন আমার বাবা  অঢেল দিয়েছিলেন , অনির  বউ পৃথাকেও   উনি কিছু কম দেননি ।কিন্তু কোথাও অনির মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে বাবা দিদিকে পক্ষপাতিত্ব করে বেশি বেশি দিয়ে গেছেন। মা-বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন মুখে সে কথা প্রকাশ করতো না কিন্তু আচার-ব্যবহারে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত। বাবার মৃত্যুর আগে কোন  উইল করে যাননি। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার পর পলাশপুর থেকে ফিরে আসার আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা সবাই বৈঠকখানায় বসেছিলাম। কাকা কাকিমা সবাই ছিলেন ।সেখানেই সম্পত্তি নিয়ে অনি আর আমার মধ্যে প্রচন্ড ঝামেলা হয়। অনির বক্তব্য অনুযায়ী, আমি  অনিকে ঠকিয়ে বাবাকে দিয়ে অনেক ধনসম্পত্তি আমার নামে লিখে নিয়েছি ।অতএব আমার আর কোন কিছুতেই কোন অধিকার নেই ।আমিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নই ।কেনই বা লাখ লাখ টাকার বিশাল সম্পত্তি ছেড়ে দেব? দিলাম অনির নামে মামলা ঠুকে ।যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন অনি জমি-জমা ,ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কিছু বিক্রি করতে পারবে না।



                   (৩)

ট্রেনে বসে পুরনো সেই সব ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি, সৌমেন ও আমার ছেলে বাবলু পলাশপুর যাচ্ছি। কখন যে ট্রেন তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে তা বুঝতেও পারিনি ।যাত্রীদের কোলাহলে ঘোর কাটল। বাক্স-প্যাটরা নিয়ে স্টেশন চত্বরে নামলাম । পলাশপুরের বাতাসে কেমন যেন একটা মন ভালো করা গন্ধ ।কতদিন যে তার স্পর্শ পাইনি। আজ প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। স্টেশন থেকে গাড়িতে ঘন্টাখানেকের পথ কাকার বাড়ি। আমার ছোটবেলার পলাশপুর ... পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, পরতে পরতে স্মৃতির ঝাঁপি একটু একটু করে খুলছে। সময়ের সাথে সাথে পলাশপুর কিছুটা বদলেছে। গাড়ির ড্রাইভার খুব যত্ন করে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল। একটা সময় আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ আমাদের লেগেই থাকত। ঠাকুরদালানে দুর্গাপূজা হত। বাবা কলকাতায় ব্যবসার খাতিরে চলে যাওয়ায় আমাদের ভাগের দালানের ঘরগুলো আর সেভাবে ব্যবহৃত হতো না। কাকার পরিবার তাদের অংশের নিজের দালান ঘরে থাকতেন ।আজও আমাদের দালান ঘরগুলো তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়িটাতে ঢুকতেই গেটের ধারে দুটো বাঁধানো বসার জায়গা ছিল ।সেগুলো এখন আর নেই। ভগ্নপ্রায় অবস্থা তাদের পাশের বকুল ফুলের গাছটা কিন্তু একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ।কত ফুল কুড়িয়েছি , তারপর মালা গাঁথতাম। আমাদের আসার শব্দ পেয়ে কাকা শশব্যস্ত হয়ে গেটের কাছে চলে এলেন। আজ কত বছর পর কাকাকে দেখলাম। মানুষটার মুখের হাসি ও আন্তরিকতা আজও অমলিন। আমায় দু'হাতে জড়িয়ে ধরলেন। কোথাও যেন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে কাকার মাঝে ফিরে পেলাম।

                (৪)

ঘরে ঢুকতেই প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলাম । আমার চক্ষু স্থির ।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। অনিকে এখানে, পলাশপুরে দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। অনির ও হাবেভাবে স্পষ্ট যে ও আমাকে এখানে দেখবে তা আশা করেনি। বাক্যবিনিময় না হলেও হৃদয়ে যে প্রচণ্ড জোরে দামামা বাজছিল তা বুঝতে পারছিলাম। অনিও সপরিবারে পলাশপুরে এসেছে। বুঝতে পারছিলাম এসব আমার কাকার মস্তিষ্ক- প্রসূত। আমার পরিবারের সঙ্গে অনির পরিবারের টুকটাক কথাবার্তা হল। অনির মেয়ে টুবাইকে এই প্রথম দেখলাম। জড়োসড়ো হয়ে পৃথার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেনে সফর করে খুব পরিশ্রান্ত লাগছিলো। তাই কাকিমা ও বুলি আমাদের রাতের খাবারটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল ।হ্যাঁ ,বুলি ও তার ছেলে মেয়েরা আমরা আসবো জেনে কয়েকদিনের জন্য কাকার বাড়ি চলে এসেছে। কাকার ঘরে যেন চাঁদের হাট বসেছে। রান্নাঘরের পাশের বড় ঘরটায় সবাই মাটিতে খেতে বসে পড়লাম সেই ছোটবেলার মতো ।অনি খেতে খেতে আড়চোখে আমায় দেখছিল। আমিও চশমার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওর ভুড়িটা কতটা স্ফীতকায় হয়েছে ।রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার ঘরে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত হওয়ার দরুন খুব তাড়াতাড়ি ঘুম পরী দুচোখের পাতায় নেমে এলো ।

আমার আবার বরাবরই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস ।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজকার মতন প্রাতঃভ্রমণ করতে বেরিয়েছি। কাকার বাগানটায় অনেক ফুলের গাছ ।আমরা মানে... আমি ,অনি , বুলি ও আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পুজোর দিন গুলোতে ফুলবাগানে ভোর বেলায় এসে ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল তুলতাম। শিউলি ফুলের গাছের নিচে আগের দিন রাতে কাপড় বিছিয়ে রাখতাম ।পরদিন ভোর বেলায় গিয়ে দেখতাম রাশি রাশি ফুল ছেয়ে আছে ।এখনও দেখলাম ফুলে ফুলে চারিদিক ছেয়ে আছে । কিন্তু ফুল কুড়োবার বা তোলার লোক কোথায়? কাল বাদে পরশু ষষ্ঠী ।এখন আর ঠাকুরদালানে মা সপরিবারে আসেন না। শুধুমাত্র রাধাগোবিন্দর নিত্য পুজো করার জন্য ঠাকুরমশাই আসেন ।দুর্গাপুজার স্মৃতিটা শুধু মনে গেঁথে আছে ।হঠাৎ শুকনো পাতার উপর কারো হেঁটে আসার শব্দ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার পেছনে দাঁড়িয়ে অনি। আমরা দুজন দুজনকে অনেক কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না ।একটা অদৃশ্য দেয়াল আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে যে নিঃশব্দে। একসাথে দুজনে বাড়ির পেছনদিককার বাগানটায় হাঁটতে লাগলাম ।মনে হল অনন্ত কাল ।অনি ওর ভারী শরীরটা নিয়ে আর হাঁটতে পারছিল না ।চোখের ইশারায় কিছুটা এগিয়ে ঠাকুরদালানের সিড়িটায় ওকে বসতে বললাম। বহু বছর পর দুজনে পাশাপাশি বসলাম। আমি আর আমার ছোট ভাই অনি। সেই ঠাকুরদালান, সেই রাধা মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা আমাদের অহংকার, অর্থ, লোভ, প্রতিপত্তিকে চরিতার্থ করতে গিয়ে সম্পর্কের বাঁধনটাকে আলগা করে দিয়েছি।একে অপরের থেকে কত দূরে চলে গেছি । আমরা একই পিতা-মাতার সন্তান। কিন্তু আরো বেশী পাবার লোভ আমাদের সম্পর্কটায় তিক্ততা ভরে দিয়েছে।

--- "দিদি......"

আমার কানে কে যেন অমৃত সুধা ঢেলে দিল। বছরের পর বছর ওই ডাকটা শোনার জন্য অধীর হয়ে থাকতাম। ভাইফোঁটার দিন কিংবা রাখি -পূর্ণিমায় যদি আমার ভাইটা একটা ফোন করে। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠলো। অতিকষ্টে সেটাকে গিলে ফেললাম।

---" বল ভাই ।"

---"শিউলি ফুল কুড়োবি?"

---" মানে ?"

---" বাগানের শিউলি ফুলের গাছটার নিচে দেখলাম প্রচুর শিউলি ফুল ঝরে পড়ে আছে। কুড়োবি?"

---" তুই ভুঁড়ি নিয়ে পারবি ভাই?"
 আমি হেসে বললাম।

---" চল ছোটবেলার মতো রেস লাগাই দিদি।"

---" আর দরকার নেই। তুই হেরে ভূত হবি।"

---" তোরা এখানে!!! তোদের আমি কখন থেকে খুঁজছি।"
 
বুলি শশব্যস্ত হয়ে ঠাকুরদালানে আসে।

---" চলে বুলি, আমরা তিন ভাই বোনে এখন প্রাণভরে শিউলি ফুল কুড়োব। পুজোর ছোট ঝুড়িগুলো নিয়ে আয়। চল দিদি।"

 বুলি বাধ্য মেয়ের মত ঝুড়ি আনতে ছুটল লাগাল।

               (৫)

এখন প্রতিবছর আমরা সবাই মিলে পলাশপুরে যাই। আমার পরিবার, অনির পরিবার, বুলির পরিবার --- আমরা সবাই পুজোর দিনগুলোতে একত্রিত হয়ে হই হুল্লোড় করি। শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যাই। ঠাকুরদালানে মায়ের পুজো আমরা নতুন করে শুরু করেছি। কাকা কাকিমাও খুব খুশি ।আর হ্যাঁ, আমাদের বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হয়েছে ।আমি অনির নামে ঠোকা মামলা তুলে নিয়েছি ।পৈতৃক সম্পত্তির পুরোটাই আমরা আমাদের দুজনের সম্মতিতে বিক্রি করে দিয়েছি। বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গেছে তার সমস্তটাই পলাশপুরের উন্নতির কাজে ব্যয় করা হয়েছে। মা ও বাবার নামে একটি বিদ্যালয় ও হাসপাতাল খোলা হয়েছে। আর দুর্গাপুজোর কটা দিন দিন দরিদ্র মানুষদের নারায়ন সেবা ও বস্ত্র দান করা হয় ।

দিনের শেষে এসে আমরা এই উপলব্ধি করেছি যে অর্থ দিয়ে সম্পর্কের অমৃতসুধা কেনা যায় না। যতটা অর্থ প্রয়োজন ঠিক ততটাই থাকুক না আমাদের কাছে ।তার বেশি নয়।

Friday, September 2, 2022

ছোট গল্প - কাকের প্রতিশোধ || লেখক - ইমরান খান রাজ || Short story - kaker protisodh || Written by Imran khan raj


 

কাকের প্রতিশোধ 
ইমরান খান রাজ 

এক দেশে ছিল বিশাল এক বন। বনটি এতই বড় ছিল যে, তার ভিতরে কেউ ঢুকলে আর বের হতে পারতো না। হারিয়ে যেত ! সেই বনে বাস করতো এক ভয়ঙ্কর, বিশালাকৃতির হিংস্র বাঘ৷ সেখানে একমাত্র বাঘেরই রাজত্ব চলতো৷ অন্য কোন পশুপাখি তার উপরে কথা বলতো না। সবাই বাঘকে ভয় পেতো আর বাঘের থেকে সর্বদা দৌড়ে পালাতো। যেই প্রাণীটা বাঘের সামনে পরতো, হিংস্র বাঘটি তাকেই খেয়ে ফেলতো৷ বিশালাকৃতির দেহের ক্ষুধা মেটাতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে খাবার প্রয়োজন হতো তার। 

হঠাৎ একদিন বিকেলে সেই বনে শুরু হলো এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বনের প্রায় বেশিরভাগ বড় গাছগুলোই ভেঙে পরে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সেই বনটি। ঝড়ে বহু পশুপাখির বাসস্থান নষ্ট হয়ে যায় এবং ছোট-বড় অনেক প্রাণী মারা যায়। তবে বাঘের ঘর ঝড়ে কিছুই হয় না। কারণ সে তো গুহায় থাকে। 

পরদিন সকালে বাঘের ঘুম ভাঙলে, সে খাবারের উদ্দ্যশ্যে গুহা থেকে বের হয়। তবে বের হয়ে দেখে, চারিদিকে গাছপালার স্তুপ। সব ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এসব দৃশ্য দেখে সাতপাঁচ না ভেবে বাঘটি বের হয় তার খাবার খোঁজার জন্য। খাবার খুঁজতে খুঁজতে সকাল গড়িয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম হলো। কিন্তু বাঘটি কোনো খাবারই খুঁজে পেলো না। সারাদিন হাটাহাটি করার ফলে সে এখন অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে। আর এদিকে তার ক্ষুধাও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। হাটতে হাটতে হঠাৎ তার চোখে পড়লো দুটি কাকের ছানা। গতকালের ঝড়ে বাসা ভেঙে মাটিতে পরেছিল ছানা দুটো। উড়তে না পারায় মাটিতে বসেই তাদের মাকে ডাকছিল। কাকের ছানা দুটো দেখে লোভে বাঘের যেনো জিভে জল চলে এলো। সারাদিন না খাওয়ার ফলে প্রচুর ক্ষুধার্ত হয়ে পরেছিলো সে। তাই নিজের পেটের ক্ষুধা মেটাতে বাঘটি, কাকের দুটো ছানাকেই একবারে গিলে ফেললো। খাবার খেয়ে শান্ত মনে বাঘটা চলে যায় তার গুহায়। বিশ্রাম করতে। 

এদিকে 'মা' কাকটি সেই সকাল থেকেই তার বাচ্চাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা দুটো ছিল তার নয়নের মণি। খুব ভালোবাসতো তাদের। কোথাও কোন খোঁজ না পেয়ে অবশেষে কাকটি একটি ভাঙা গাছের ওপর বসে কাঁদতে লাগলো। পাশের আরেকটি গাছেই ঝুলে ছিল এক বানর। কাকের কান্না দেখে তার মায়া হয়। বানরটি কাকের কাছে এসে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে, কাকটি তার দুটো ছানা হারিয়ে যাবার সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। কাকের কথা শুনে বানর বলে, "কি বলো কাক ভাই !" ঐ দুটো ছানা তোমার ছিল ? আমি কিছুক্ষণ আগে দেখলাম, দুষ্টু বাঘটা দুটো কালো পাখির ছানাকে গিলে খেল ! তখন আমি পাশের গাছেই ছিলাম। ওপর থেকে সব দেখেছি। বানরের কথা শুনে কাক অনেক দুঃখ পেল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, দুষ্টু বাঘ তার দুটো বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে ! তাকে অবশ্যই সাজা পেতে হবে। সেই থেকে কাক বাঘের প্রতি সর্বদা নজর রাখা শুরু করলো। বাঘ'কে শায়েস্তা করার জন্য ! 

তারপর হঠাৎ একদিন খাবারের খোঁজে বাঘ তার গুহা থেকে বের হলো। ক্ষুধার জ্বালায় সারা বন হন্যে হয়ে খাবার খুঁজতে লাগলো সে৷ কিন্তু আজও কোন খাবার খুঁজে পেলো না। তাই ক্লান্ত হয়ে, বিশ্রামের জন্য দুষ্টু বাঘটি এক বিশাল আকৃতির তালগাছের নিচে বসে পড়ল। সে এতই ক্লান্ত ছিল যে, একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লো তালগাছের নিচে। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগালো কাক। সে তালগাছের একেবারে চূড়ায় বসে ছিল। তারপর তার ঠোঁট ও পায়ের ধারালো নখ দিয়ে বড় বড় তাল ছিড়তে শুরু করলো। আর সেই তাল অনেক উঁচু থেকে সোজা পড়তে লাগলো দুষ্টু বাঘটির মাথায়৷ এক এক করে সবগুলো তাল ছিড়ে বাঘের মাথায় ফেলে সে। গভীর ঘুমে থাকার ফলে বাঘটি দৌড়ে পালানোর সুযোগ পায় না। এদিকে বাঘের মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। একটা সময় বাঘটি ঐ তালগাছের নিচেই নিথর হয়ে পড়ে থাকে এবং অবশেষে মারা যায়৷ দুষ্টু বাঘের মৃত্যুতে, কাকটি যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।