Monday, September 27, 2021

গীতিকার বদরুদ্দোজা শেখু -এর একটি গান

 পাখি গেছে উড়ে



পাখি গেছে উড়ে--

তার জন্য হৃদয়ারণ্য মিছে যায় কেন পুড়ে ?।

পাখি গেছে উড়ে।।

ওরে ও পাখি কেমনে থাকি আজ এতো দূরে দূরে ??


আমার আকাশ জুড়ে ছিল যে নীলিমা

মনে হতো সে আমার মানস-প্রতিমা,

মহিমা অপার তার 

দিয়েছে এ দায়ভার 

ওই লাবণ্য হলো অনন্য আমার বিরহ-পুরে।।


আমি কাঁদি আনমনে একলা আঁধারে

মন বাঁধি বিয়াকুল বিজন বাদাড়ে ,

যতো স্মৃতিসুখভার

রয়েছে বুকে আমার, 


হয়েছি ধন্য তার প্রসন্ন গত ভালবাসা জুড়ে ।।

Photography by Moushumi chandra



Poet Amit Bid's one poem

 Father

  



My father is my super hero, my father is my charm,

He is the only person who safeguards me form harm.

He is like God to me, he inspired me the more,

I want to be like him from the heart and its core.

Sometimes he scolded me, sometimes he loved,

Sometimes he became my friend and tightly me hugged.

My success is his success, My faiture is his won,

He behaves like a king on my victory - which never be shown.

Father is not just a word, he is like a world in him.,

He is the only sun who gifts its day all his sunbeam.

Poet Sunanda Mandal's one poem

 The eyes of knowledge 

 ‎  


The sun is shining 

on my face, 

Bright sky. 

There are happy air, 

in the circle of the earth.


I'm looking for you around. 

Autumn smell in the nose, 

Advent calls for songs. 


Revealed in the light of dawn, Mahamaya's eyes. 

One or two idols will wake up! 

Just do not open the eyes of human knowledge!

Poet Soumendra Dutta Bhowmick's one poem

 A Floral DREAM



 


While flying over the white clouds

              I dreamt of an elegant fairy-queen,

She had no wavy wings but

Beauty was overwhelming,

               What’s then a charming scene!

Her close brownish were a magic,

Her silent appeal aroused a wave-

Gradually it paralysed me

With an aromatic arrow

When loneliness seemed to be blessing,

When I was free from anger, horror

And cheerfulness with its natural art

Overcast my limited sky.

Thus thy name I knew as Love—

Loving moments were the message of Life,

Speedily I woke up, I woke up

Not to be far from her tidy-tie.

নাট্যকার রাজা দেবরায় -এর একটি ছোট নাটক

সচেতনতাই আদর্শ ওষুধ!




গজাঃ এত দ্রুতবেগে কোথায় ছুটছিস ভজা? তুই তো এখন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেলি রে!


ভজাঃ টুথপেস্ট প্রায় শেষ হয়ে গেছে, টুথব্রাশও কিনতে হবে। তাই কিনতে যাচ্ছি দোকানে। তাছাড়া মোবাইল রিচার্জও করাতে হবে। এখন অমাবস্যার চাঁদ হলে নিজেরও মঙ্গল আর সমাজের জন্যও মঙ্গল!


গজাঃ আরে ভাই এত ভীতু কেনো তুই? আমাদের দ্যাখ আমরা আগের মতোই বিন্দাস আড্ডা দিচ্ছি, ঘুরছি, খাচ্ছি সব করছি। এত ভয় পেলে চলে?


ভজাঃ ব্যাপারটা ভয়ের থেকেও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সচেতন থাকাই আসল। তাহলে আমি নিজেও যেমন ভালো থাকবো, অন্যেরও ক্ষতি করবো না। আর আড্ডা, ঘোরাঘুরি ইত্যাদি তো সারাজীবনই করা যাবে। এখন একটু সবকিছুর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে আপত্তি কিসের? আর এখন সামাজিক মাধ্যমের যুগে তো বাড়ি থেকেই আড্ডার মজা নেওয়া যায়।


গজাঃ এত লিখবে কে!


ভজাঃ আর লিখতে সমস্যা হলে ভয়েস রেকর্ডিং এর সাহায্যও নেওয়া যায়। এখন অন্তত মাস দুয়েক যথাসম্ভব সচেতন হয়ে থাকাই উচিত। তাতে আখেরে আমাদেরই লাভ হবে। খুব প্রয়োজন না হলে ভিড় উপেক্ষা করাই এখন কর্তব্য। মোদ্দা কথা, যথাসম্ভব সতর্ক, সাবধান এবং সচেতন থাকাই শ্রেয়।


গজাঃ ঠিক বলেছিস রে ভাই। সামনেই পুজো। ঘোরাঘুরি করলেও খুবই সাবধানে করতে হবে।


ভজাঃ শুধুমাত্র নিজের জন্যই নয়। পরিবার এবং সমাজের জন্যও আমাদের নিয়ম মেনে এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।


গজাঃ আমি আজ থেকে তাই করবো রে ভাই। ধন্যবাদ তোকে।


ভজাঃ বন্ধুকে আবার ধন্যবাদ কিসের! পরে কথা হবে। ভালো থাকিস।


গজাঃ তুইও ভালো থাকিস বন্ধু।


ভজাঃ হুম।।

লেখক ও ডাঃ প্রভাত ভট্টাচার্য -এর একটি রোগ বিষয়ক আলোচনা

 সি আর পি

    

     

   

  এখন অনেক সময় ই রোগীদের সি আর পি (CRP) পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। আসলে এই জিনিসটা কি আর এর তাৎপর্য ই বা কি, তা নিয়ে আলোচনা করছি। 

     এটি হল একরকমের প্রোটিন যা আমাদের যকৃৎ বা লিভারে তৈরী হয়। আমাদের শরীরে যে কোন 

প্রদাহ বা inflammation হলে রক্তে এর মাত্রা বেড়ে যায়। যেমন, কোনো সংক্রমণ বা ইনফেকশন ,ক্রনিক অসুখ, যেমন এস এল ই,রিউম্যাটয়েড আরথ্ররাইটিস ,ইনফল্যআমেটরি বাওয়েল ডিজিস প্রভৃতি তে। 

      আবার হার্টের অসুখে হাইলি সেনসিটিভ সি আর পি র (hsCRP) মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এর মাত্রা বেশী থাকলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। 

        গর্ভবতী অবস্থায় পরের দিকে এবং জন্মনিরোধক ওষুধ নিলেও রক্তে সি আর পি র মাত্রা বাড়তে পারে। 

      আবার এর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে আঘাত বা পুড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

লেখক তীর্থঙ্কর সুমিত -এর গদ্য

 নদী কথায় ভেসে যায় .....

             ( ১)


কত জমানো কথা ভেসে যায় নদী বুকে।কেউ খবর রাখেনা।কোনো গল্পের শেষ হয়না। শেষ হয় কথার।ওখানেই শুরু হয় নতুন গল্পের।নতুন থেকে চিরনতুন হতে হতে আটকে যায় চোখ।সেই চোখ থেকে সৃষ্টি হয় এক একটা গঙ্গা,এক একটা পদ্মা।ভালো থাকার লড়াইয়ে জলের স্রোতে ভেসে যায় অব্যাক্ত কত কথার যন্ত্রণা।হয়তো এভাবেই সৃষ্টি হয় কয়েকটা কথা, কয়েকটা চিহ্ন আর এক একটা মরুভূমি...

                                          

                 (২)


প্রতিটা দিন কেটে যায় রাতের আঁধার বুকে নিয়ে।কবিরা জন্ম দেয় হাজারো কবিতার।সময়ের সাথে সাথে সময়কে বুকে নিয়ে ফিরে আসে ঢেউ।আজকের প্রশ্ন আগামী কাল পুরনো।নতুন থেকে চিরোনতুনের সন্ধানে আমরা সকলে । কখন যেনো একের পিঠে বহু শূন্য নিয়ে ওজন বাড়াই ।নিজের অচিরেই ফাঁকা হতে হতে কখনো আবার নদীর সাথে মিশে যাই ।গঙ্গা ,পদ্মার বুকে লিখে রাখা এক একটা যন্ত্রণা কত নষ্টা মেয়েকে সতীত্ব দিয়েছে।আর আমি নতুন হতে হতে কখন যেনো ঢেউ এর সন্ধান পেয়েছি ...




           (৩)



নদীটা রোজ দেখি বয়ে যায় নিজের মতো।

হাজার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নদী বয়ে যায় নিজের গন্তব্য স্থলে।এই গন্তব্য কোথায় আমরা কেউ জানিনা।তবুও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।তার গন্তব্যের দিকে।কিছু বোঝার আগেই শত ঢেউ ভিজিয়ে দেয় আমাদের।এভাবেই কত কথা ঢেউয়ের স্রোতে হারিয়ে যায়।কত লাল সাদা হয়ে ওঠে।ফিরে আসে তোমার আমার...

নদী স্রোতে ভেসে যায়


               (৪)



বলতে বলতে বলাটাই বাকি থেকে যায়।প্রতিদিনের আশ্চর্যতা মূলত ভাবায় না কাউকে।শুধু আঙ্গুলের পরিবর্তন। কথার সাথে বিন্দু পরিবর্তন হতে হতে কখন যে বৃত্ত ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে বহুদূর।কেউ খবর রাখেনা।খবর রাখে স্রোতস্বিনী নদী তার ঢেউ হারিয়ে চুপ করে বসে আছে।কিন্তু তা ক্ষণিকের আবার ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়েছে পাড়।এভাবেই নদী আমায় গল্প শোনায় প্রতিদিন।আমি ভেসে যাই নদী বুকে বহু বহুদূর ...



                (৫)



বহুদূর নয়।ঠিক যতটা দূর ভাবি ততটাও নয়।তবুও সবাই বলে অনেক অনেক দূর।কখনো কখনো আমিও তাই ভাবি। কিন্তু ভাবনার ইতি ঘটতে না ঘটতে,আবার নতুন সংগ্রামে ভেসে গেছে কত কথা ।হয়তো এইভাবেই এক একটা দিন কেটে হয় রাত্রি।আর রাতের অাঁধারে লুকিয়ে থাকে দিনের কাব্যকথা ।যে নদী বয়ে গেছে বহুদূর তার ঠিকানা আমরা কেউ রাখিনা।তবু প্রতিটা ঘরে তার বয়ে যাওয়ার স্মৃতি চিহ্ন লুকিয়ে থাকে।যে ভাবে নদী বয়ে যায় ঠিক সেভাবেই ফিরে আসে প্রতিদিনের অবাধ্য কিছু যন্ত্রণা ।তবে সব ই ক্ষণস্থায়ী ।

আর বেঁচে থাকার মানে ...

লেখক সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর একটি গদ্য তথা রম্য রচনা

 ঘোর কলি হে  



এখন আখের গুছোবার জমানা। ভোগকরো, আসক্তি মিটিয়ে নাও। নেতা হও। ক্ষমতা দেখাও। ল্যাং মারো। তোষামোদ করো। কেলেংকারীতে জড়িয়ে যাও। ইডি তলব করুক। দল বদলু হও। ব্রেকিং নিউজ হও। 


অনেষ্টি ইজ দ্যা বেষ্ট পলেসি। গুষ্ঠিরপিন্ডি। 

বউয়ের অচ্ছেদা, আত্মিয়ের অবহেলা, একদিন জীবন ঘড়ির টিকটিক ষ্টপ। কাঁচের গাড়িতে চিৎ হয়ে শুয়ে, মহাপ্রস্থানের পথে নিশ্চিত যাত্রা। 


মরেও কি ছাই রেহাই আছে । যে ক'টা দিন জীবিত ছিলে, তিরস্কার আর তিরস্কার। জীবন তো নয় ধিক্কারের ডাষ্টবিন। ওয়েষ্ট পেপার বক্স। ব্যর্থতার সংগ্রহশালা। সমালোচনার পাত্র। 


লাইফ টাইম পার্টনারের নিয়মিত নির্মম কথন,,,,,,,,, 

"" সারাটা জীবন শুধু ঘানি টেনে গেল। তেল বেরুলো না এক ছিটেও। বোকার হদ্দ। বুদ্ধি বলে তো ঘিলু তে কিছু ছিল না। খালি জেদ ছিল। 

কি? না , অনেষ্টি। অনেষ্টি ধুয়ে জল খাবে? দুরদুর বেঁচে থাকতে বোঝাতে পারলুম না এখন আক্ষেপ করে কি হবে। যাও, ফারনেসে ঢোকো। যতসব। 


অনেষ্টির দোহাই দিয়ে আঁটি চুষতে চুষতে লাইফ হেল হয়ে যাবে। নো রিস্ক নো গেইন। কাটমানি যদি না খেলে তবে খেলে কি, ঝিঙেপোস্তো? 

স্ক্যান্ডেলিং ছাড়া জীবনের কোনও চার্ম নেই। সমাজে যদি প্রতিষ্ঠা চাও, কেলেংকারী তে জড়াও, ফষ্টিনষ্টি করো, জীবনের সপ্ততারে বসন্তবাহারের সুর তোলো। লাইফ ইজ বেড অব রোজ। সিলভার টনিক ইজ বেষ্ট ভিটামিন টনিক। 

গায়ে পড়া কৌতুহলী প্রতিবেশীর চোখটাটানো মধুর সম্ভাষণ ,, 

"এই চেকনাই কোথায় পেলে দাদা? বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, আয়েশি গাড়ি, ককটেল পার্টি।" 

এইতো জীবন। আহা, কি সুখ কি সুখ। ঠোঁট সরু করে চোখ বুঁজে শিস দিয়ে সেক্সি গানের সুর ভাঁজো। 


চিত্রগুপ্তের জাবদা খাতায় কি ব্ল্যাক স্পট পড়ে গেল? ,,,,,,,, ড্যাম ইওর কুসংস্কার।যতসব ফালতু গপ্পো। 


তবুও মনের মাঝে থেকে থেকেই কে যেন কু গাইছে। বিবেক কাছা ধরে টানছে। 


দূর দূর,, ওসব আবেগ। গেট লস্ট আবেগ। ওসব দূর্বল ভীরুতার ভাবনা। আমি জয়ী। আমি সম্রাট। 

আরামকেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে স্মৃতি মন্থন করছে এ যুগের শাজাহান। 

কী ছিনু আর কী হনু ,,। 

প্রমোটারি জিন্দাবাদ। মস্তানবাজি যুগ যুগ জিও। 


অদূরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তার আগামী প্রজন্ম আরচোখে মিটিমিটি হাসছে আর মনের চাকুতে শান দিচ্ছে। বুড়ো টাঁসলেই সব আমার, সব আমার।

হায় রে,,,,, ঘোর কলি হে , ঘোর কলি,,। 


লেখিকা রোকেয়া ইসলাম -এর একটি গল্প

 কুকুরের কান্না 



 

ইদানীং বেশিরভাগ রাতেই এমন হচ্ছে পারভীনের। ভয়ংকর স্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নের ভয়াবহ রেশটা থেকে যায়। দুচিন্তায় আজানা আশংকায় বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। 

বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালাতে গিয়েও থেমে হাতটা নামিয়ে বাথরুমে ঢোকে। কমোডে বসে পড়ে থপ করে। অনেকক্ষণ ধরে জল বিয়োগ করে। 

বাথরুম থেকে বেরুতে গিয়েও বেশিনের কাছে যায়। হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে কলটা ছেড়ে দেয়। হাতে পানির ফোটা নিয়ে পানির কল বন্ধ করে ইচ্ছেমত ফেনা তুলে। কবজি ছাড়িয়ে কনুই অবধি ফেনা নিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলে। 

বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কাপড় শুকানোর তারে ঝুলছে তোয়ালে। হাত দুখান মুছে নেয়। 

চামড়া টান টান লাগছে। একটু লোসন বা গ্লিসারিন জাতীয় কিছু মাখতে হবে। 

আনুমানেই এতোদিনের চেনা ঘরে ঢুকে বোতল খুলে পরিমাণ মত লোসন নিয়ে হাতে মাখাতে মাখাতে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। 

এতোক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখলো। মনটা সরাতে চেষ্টা করলো। তবুও মনের ভেতরের দুচিন্তা একটুও কমে না। ভেতরের ভয় জমে শক্ত হয়ে বসে গেছে।

নিচের রাস্তার দিকে তাকাতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। মিরপুর বাজারের ব্যাস্ত রাস্তা এটা। এখন সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। নেতিয়ে পড়ে থাকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া মানুসের কথা মনে পড়ে। ডাব শুকিয়ে নারকেল হয়। মানুষের বয়স হলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে উঠে। এখন নির্জন রাস্তার অন্যরকম ধরা দিচ্ছে। 


সামনের দোকানগুলোর সাটারের খাঁজে খাঁজে পুরু ধুলোর আস্তর। দুটো টংএর দোকান নীল মোটা প্লাষ্টিকের উপরটার রঙ বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার লাইটের আলো পড়ে ভেতরের নীল রঙের হালকা আভাস বোঝা যাচ্ছে। 

সামনের সু-উচ্চু ভবনের ফাঁক ফোকর এড়িয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেয় আকাশ। ঝকঝকে আকাশে তাঁরার বাগান। দৃষ্টি ঘুরিয়ে পশ্চিম আকাশে চোখ পড়তেই সপ্তর্ষী মন্ডল তীর ধনূক উচিয়ে রাগী চোখে আকাশ পাহারা দিচ্ছে। 

আকাশ থেকে একেবারে নিষ্প্রাণ রাস্তায় চোখ যায়। ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলছে নির্বাচনি পোষ্টার। একটা শুকনো কালো বেড়াল আস্তে আস্তে হেঁটে যায় কিছু দূর গিয়েই দেখে একটা কুকুর শুয়ে আছে। বেড়ালটার দিকে তাকায়। অন্যদিনের মত ধেয়ে আসে না। পাশ দিয়ে হেঁটে যায় খদ্দেরের খোঁজে বেশ্যা। বেড়ালটা একটু এগিয়ে গেলেই কুকুরটা কাঁদতে শুরু করে। কুকুরের বিলাপ করে কান্না শুনে পারভীনের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। 

পারভীনের দাদি বলতেন "কুকুর পরিবেশর বিরুপ অবস্থা আগেই টের পায়"।কুকুর কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করে হে মানুষ তোমাদের সামনে ভয়ংকর বিপদ। 


ভয়ংকর বিপদ ধেয়ে আসছে বুঝতে পারছে বিশ্ববাসী। বাংলাদেশও সাথে আছে ঘোর বিপদের। অদৃশ্য শত্রু। সামান্য এক অনুবীজ। করোনা। 

চেনা জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে প্রতিশেবক আবিস্কৃত হয়নি। প্রতিরোধ করতে হচ্ছে। 

কাজের লোকসহ বাইরের মানুষ ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্কুল কলেজ বন্ধ। বাসার ছোটরা বাইরে যাচ্ছে না। কিন্তু পুত্র কন্যা জামাতা দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত। ওরা নিয়ম মেনেই কাজে যাচ্ছে। সারাক্ষণ মনটা কাঁটা হয়ে থাকে পারভীনের। 

সারাদিন টিভির নিউজ দেখা ছাড়াও সময় সময়ে ফেবুতে বসছে। ইনবক্স ভরে যাচ্ছে বিভিন্ন খবরে। কোনটা দেখে কোনটা দেখে না। 

এখন এই রাতে বুক ধুকপুক নিয়ে বসে আছে বারান্দায়। দেখছে মৃত এক নগরীকে। 


কুকুরটা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ মনে হয় সামনের দুতিনটা খাবারের দোকান তো দীর্ঘদিন বন্ধ। তাহলে এই কুকুর বেড়াল খাচ্ছে কোথায়!! 

ক্ষুধায় কাঁদছে না তো! পারভীন ওঠে ডাইনিং রুমে যায়। ফ্রিজ খুলে আগামীকালের জন্য তৈরি করা রুটি থেকে গোটা চারেক রুটি বের করে কিচেনে ঢুকে যায়। 


কাজের ছুটা বুয়াকে আসতে মানা করেছে। ছোট একজন মেয়ে মুন্নী আছে। ওকে নিয়েই চলতে হচ্ছে। 


মুন্নী খুব বুদ্ধিমান। সকালেই ধরে ফেলবে গোণা রুটি থেকে চারটি রুটি কম। 

সহজে আর চারটে রুটি গড়তে চাইবে না। থাক পারভীন নিজে নাস্তা সারবে অন্যকিছু দিয়ে। যাতে মুন্নীর কষ্ট না হয় 


রুটি সেঁকে বারান্দায় নিয়ে আসে। কুকুর কলজে কাঁপানো কান্না কাঁদছে। 

তিনতলা থেকে ছুঁড়ে দেয় কুকুরের মুখের কাছে। বেড়ালটাকে দেখা যাচ্ছে না। 

কুকুর কাঁদতেই থাকে। 


এবার ভয়ে পারভীনের হাত পা কাঁপতে থাকে। একটা চেয়ার টেনে বসে গ্রীলে মাথা রাখতেই চোখে পড়ে বারান্দার টবে ফুটে আছে অজস্র সন্ধ্যা মালতি। আরে আগে তো দেখা হয়নি। গতবারের লাগানো গাছের বীজ পরে এই নতুন গাছ হয়েছে। 

আগের গাছের ফুলের রঙ ছিল গাঢ় গোলাপি। আর এবারের ফুলের রঙ হলুদ 

আবাক কান্ড!!গোলাপি ফুলের রঙ গোলাপিই তো হবে। হলুদ হলো কেন। 


নিচু হয়ে বসে হাত দিয়ে ফুলগুলোতেই হাত রাখতেই খুব হালকা সুবাস নাকে লাগে। নধর সবুজ পাতাগুলো যৌবন সংগীতে রত। দূরের ডালটাতে বেশ কয়েকটি ফুল ধরে আছে। হলুদ আর গোলাপি ছিটে নিয়ে সগৌরবে হাসছে। 

আবার কুকুরের কান্নার শব্দ কানে আসে। পারভীন ওঠে দাঁড়িতেই দেখে গ্রীলে ঝুলছে বেশ কয়েকটি আর্কিড। দুটো স্পাইকে বেগুনি ফুল আপন মহিমায় সমুজ্জল। আলকানন্দার স্বাস্থ্যবান পাতার কোরক থেকে পুষ্পের সম্ভাবনা। হাত বুলাতে বুলাতে কুকুরের দিকে চোখ যায়। 


কুকুর নির্বিঘ্নে রুটিগুলো মুখের কাছে টেনে নিয়ে বারান্দায় চোখ রাখে।

লেখক রানা জামান -এর একটি গল্প

 চাল




খবরটা শুনে হতভম্ভ না হলেও চিন্তিত হলো খানিকটা জুবায়ের। একে একে পাঁচ স্থান থেকে পাঁচটি মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। ওর দলের পাঁচ সদস্যের বোন ওরা। সম্ভবত ওর দলকে বাগে নেবার জন্যই এই অপহরণ। ওর দলে মোট সদস্য নয় জন। তার মানে আরো চারজনকেও যে কোন সময় অপহরণ করা হতে পারে। অপহরণের পর এখনো কোনরকম যোগাযোগ করেনি অপহরণকারীরা ওদের পরিবারের কারো সাথে। বাকি চারজনকে অপহরণ করার আগেই কিছু একটা করতে হবে যাতে দুষ্কৃতকারীদের আড্ডাস্থান সনাক্ত করা যায়।


কী করা যায়? কী করা যায়? ধারণাটা মাথায় আসতেই খুশিতে একটা লাফ দিয়ে জিভে কামড় দিয়ে গেলো দাঁড়িয়ে। টোকা মারছে মাথায় অন্যকোন ধারণা আসে কিনা। বিকল্প কোনো ধারণা আসছে না মাথায়। বুঝতে পারলো ঐ ধারণা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে সামনে। কাঁপা হাতে স্বরের কম্পন যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে ফোন করলো সহোদরা রেবেকাকে। রেবেকা বড়ভাই-এর কথামতো কাজ করতে হয়ে গেলো রাজি।


অস্থির হয়ে নিজ অফিসকক্ষে পায়চারি করতে লাগলো জুবায়ের। কিছুক্ষণ পর সহযোগী কামাল অফিসকক্ষে ঢুকলো একটা পোটলা হাতে।


কামাল পোটলা থেকে রেবেকার পরনের কাপড় বের করে বললো, এই কাপড়-ই রেবেকার পরনে ছিলো। ও এই কাপড় ছেড়ে নাহিদার ড্রেস পরে বেরিয়ে গেছে।


এবার টাইগারকে নিয়ে এসো। রেবেকার কাপড়গুলো শুঁকিয়ে দেই।


কামাল জুবায়েরের চালটা বুঝতে পেরে প্রশ্নটা আর করলো না।

লেখক আশীষ কুণ্ডু -এর একটি গল্প

হরেনের রোজনামচা 




হরেন ঘোষ,ওরফে হরু, গলায় সুর আছে, টিকালো নাক, রং ফর্সা,তামাটে হয়ে গেছে রোদে পুড়ে জলে ভিজে। বৈশাখের সকাল।রোদ্দুর বেশ চড়া। হালকা চালে, 'এসো হে বৈশাখ,এসো, এসো,'গাইতে গাইতে খাড়া নাকের অহংকার নিয়ে বুক চিতিয়ে চলেছে হরেন।পাড়ার বখাটেরা উপেক্ষায় হরেনকে " নাকু" বলেও ডাকে। ছাতি তার চওড়া নয়,তবু ব্যক্তিত্বে মাত্রা আনতে হাত দুটো কাঁধ থেকে দূরত্বে ছড়িয়ে চলে সে। হরেন চলেছে বাজার, ঢোলাজামায় বেশ একটা বিস্তার নিয়ে ,তখনই ছন্দপতন। একেবারে নাকের ডগায় ফাজিল চড়াইয়ের পুরীষ।অগ্নিশর্মা হয়ে পক্ষীকুলের উদ্দেশ্যে গালিটা ছিটকে বেরোনোর মুহূর্তে- হরু, নিজেকে সামলে নাক পুঁছে, চরম বিরক্তিতে রুমাল ছুঁড়ে ফেললো  নালায়। 

মুখ কুঁচকে বাড়িতে ঢুকতেই,বৌয়ের খপ্পরে- "কি হোলো পাওনাদার বুঝি?”

‘ন-নাঃ’-এখন আবার ফিরিস্তি চাইবে বোসের বেটী , কি জ্বালা',মনে মনে এইসব ভাবনার মধ্যেই আড়চোখে হরেন দেখে তনিমা নজর রাখছে। এই ভঙ্গির তাৎপর্য জানে হরেন, ভয়ে পেটের ভিতর গুড়গুড়।কোনোমতে টয়লেটে ঢুকে হাঁফ ছাড়ে। বাইরে তনিমার তর্জন গর্জন শুরু হয়েছে। ভিতরে জল চালিয়ে দেয় হরেন, আর শুনতে হবে না ফাটা কাঁসরের শব্দ - বৌয়ের ! তনিমা কিছুক্ষণ লম্ফঝম্প করতে থাকে,"খুব বাড় বেড়েছে, আমার প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করে না, ভেবেছেটা কি?' শেষে তনিমা হরুকে জব্দ করার ফন্দি এঁটে,  রান্নার গ্যাস বন্ধ করে সোজা বেডরুমে ।বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে রান্নাঘরে হরেন বোঝে , 'আজ হাঁড়ি ঠেলতে হবে,"-মনে মনে বৌকে শাপ-শাপান্ত করলেও,ডাকার ইচ্ছে হোলো না ,নিজের নাক কাটা যাবার ভয়ে। ঘরে বাইরে এই নাক কাটার আতঙ্কে দিন কাটছে তার।ছেলে তপন সকাল থেকেই  হাওয়া।তড়িঘড়ি বাসি ভাত খেয়ে কি একটা পরীক্ষা দিতে গেছে। রান্না কোনোমতে শেষ করে হরেন। 

দুপুরের খাওয়া সুখকর হোলো না। অনুরোধ করতে তনিমা এসে খেতে বসলো বটে, কিন্তু হাজারো খুঁত কাটতে লাগলো, 'নুন বেশী',  'বিস্বাদ',-। 

রাগ হলেও বৌয়ের বাক্যবাণ সহ্য করে গেলো হরেন।পার্টির কাছে পেমেন্ট আনতে যাবার ছিলো, সেটা হোলো না। 

হরেন  অর্ডার সাপ্লায়ার। ইদানীং কারখানার একটা অর্ডার নিতে গিয়ে বড় লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। দেনা হয়ে গেছে বেশ খানিকটা । পাওনাদার নাকাল করছে।  নিত্যদিনের পূজোর শেষে ঠাকুরকে আকুল হয়ে ডাকে হরেন, "দিন ফেরাও ঠাকুর, একটা লটারী না হয় পাইয়ে দাও, তাহলেই ওই রক্তচোষা বজ্জাতগুলোর মুখে টাকাটা ছুঁড়ে ফেলা যায়, দেনার দায়ে চুল বিকিয়ে যাবার জোগাড়, একটু মুখ তুলে তাকাও ঠাকুর", কিন্তু ঠাকুরের কি অত সময় আছে তার কথা শোনার !নিত্যপূজো সেরে-সকালের দিকে অর্ডার নিতে যাওয়া ,কখনও মার্কেটে- কখনও কারখানায়, বিকেলটা তাগাদায় সময় কাটে। 

সেলুনে চুল  কাটছিল হরেন। চুল বড় হলে গরমে অস্থির লাগে, তাই আসা। আর তখনই 

রাজু ঢুকলো সেলুনে, দাড়ি ট্রিম করবে। এই অঞ্চলের একছত্র অধিপতি। ধপ করে ভারী হাতটা হরেন কাঁধে রেখে বলল, " কি হরু, চুল কাটতে এসেচিস -ভাল-- তা ঘনশ্যামের

পয়সা দিচ্চিস না কেন? " সেলুনের বাইরে 

কালো কুকুরটা তখনই বুক কাঁপিয়ে ভ-ভৌ- ভৌ করে ডেকে উঠলো। 

হরেন বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, "দশ পনেরো দিনের মধ্যেই দিয়ে দেবো "

--"মন্-নে থাকে যেন, না হলে- কুচ করে তোর 

নাকটা কেটে নিয়ে যাববো।"

অপমানিত হরেন বাড়ী ফিরলো আষাঢ়ে মুখ 

নিয়ে। তনিমার আজ মুড ভালো, তাই মজা 

করে বললো, " কি হোলো নাকু, মুখ হাঁড়ি কেন? "বলেই নাকটা মুলে দিলো। নাকটা বরাবরই হরেনের অহং-এর জায়গা। আর তাতেই হাত। 

রাগটা জমা ছিলোই,এবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হরেন একেবারে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে বলে উঠলো, " তোমার বাবা কি এই শিক্ষা দিয়েছেন? "

আগুনে ঘৃতাহুতি। হিংস্র বাঘিনী এরপরে ঝড় তুলতে যাচ্ছিলেন।তপন,তাদেরএকমাত্র ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলো, "বাবা,আমার এইচএসের রেজাল্ট বেরিয়েছে, "ছেলের কথায় হরেনের সম্বিত ফেরে।                     "বাবা, সাইবার কাফে চলো"- -  ডাউনলোড করে দেখা গেলো তপনের প্রাপ্ত নম্বর আটানব্বই শতাংশ। কাফে থেকে বেরিয়ে, গ্রীষ্মের শুষে নেওয়া রোদ্দুরে হরেন ছেলের হাত ধরে  চলেছে। মন খুশিতে টইটম্বুর। রাস্তা শুনশান।দুপুর বারোটা।চেনা কাউকে দেখতে পাচ্ছে না হরেন,যাকে এই খবরটা দেওয়া যায় । তখনই কে যেন পিছু ডাকে, "নাকুদা গেছিলে কোথায়? "  -খুশিতে মন ভাসছে, তাই আর রাগ করলেন না, ঘুরে তাকাতেই দেখলেন পটাদাকে। পটাদাকে দেখলেই কেন  যেন মনে হয় সন্ধ্যা আসন্ন, গায়ের রং এতটাই কালো। এই সব অদ্ভুত অনুভূতি সবসময় মনে খেলা করে হরেনের। শান্ত স্বরে বলে হরেন, "ছেলের রেজাল্ট  দেখতে ",। মনে মনে হরেন চাইছে,- 'রেজাল্ট কেমন হয়েছে ' --এই প্রশ্ন উঠুক।

কিন্তু তা হোলো না, উল্টে সংক্ষিপ্ত "ওঃ" বলে কেটে পড়ে পটাদা। 

বাড়ী ফিরতে গিন্নি একেবারে গদগদ ছেলের রেজাল্ট শুনে,একটা আস্ত রসগোল্লা ছেলেকে খাইয়ে ,তাকালেন হরেনের দিকে, "তোমার তো আবার সুগার"।যাচ্চলে, সুগার, -এই খবর তো হরেনের নিজের ও অজানা । 

যতদিন যাচ্ছে রহস্যময়ী ভয়ঙ্করী হয়ে উঠছেন। সবে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো,ছেলে সামাল দিলো, "দাও, দাও,বাবাকে মিষ্টি দাও।" 

জয়েন্টে খুব ভালো করলো ছেলে। ফলতঃ চিন্তায় পড়ে গেলেন হরেন। একে মাথায় দেনা, ছেলেকে ভর্তি করাবেন কি দিয়ে? 

রাতে চোখের দুপাতা এক করতে পারেন না।তপন জেলায় প্রথম হওয়ায় কালেক্টর সংবর্ধনা দিলেন,সাথে পঞ্চাশ হাজারের চেক। ছেলেকে নিয়ে গর্বের এই মুহুর্তে, হরেনের মনে পড়ছিল, নিজের কৈশোরের কথা। সালটা 1980।মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। তখন নেট ছিলো না। পাড়ার মোড়ের দোকানে বোর্ড থেকে আনা জোড়াশ্বথতলা স্কুলের রেজাল্ট টাঙিয়েছিল পিন্টুদা। সেবার হরেন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলো। সবাই ধন্য ধন্য করছিলো।পরের দিন বাবার বন্ধু , মৃণালকাকু কলকাতা থেকে ভীম নাগের সন্দেশ এনে খাইয়েছিলেন। সবাই বলছিলো,এ ছেলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে যায় না।কিন্তু ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে যায়!শেষে প্লেন বিএসসি, আর চাকরী না পেয়ে অর্ডার সাপ্লাই।  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তপন চমকে তাকাল, "বাবা, শরীর খারাপ নাকি! 

"নাঃ , কিছু নয়"- উত্তর হরেনের। 

বাড়িতে ফিরে দেখে, তনিমা গলদঘর্ম হয়ে বসে আছে, একটা হাত ঘটিতে ঢুকিয়ে। 

"কি, হোলো?"বলতেই রণচণ্ডী হয়ে তনিমা ঘটিসমেত হাত নিয়ে হরেনের দিকে তেড়ে আসে। "নাক ফাটাবো তোমার "

"মা ,মা" আবার পরিত্রাতার ভূমিকায় ছেলে । সাহস করে হরেন বলে, "কিন্তু  তুমি ঘটিতে হাত ঢুকিয়ে রেখেছোই বা কেন? বার করো, বক্সিং প্র্যাক্টিস করছিলে নাকি!" বারুদে আগুন লাগতে যাচ্ছিল, তপন থামালো, "মায়ের হাত ঘটিতে ফেঁসে গেছে, বুঝতে পারছো না"।

এমন সময় একটা হট্টগোল শোনা গেল বাইরে, "নাকু, বাড়িতে আছো? বাইরে এসো, -ব্যাটা হরু, --ঘোষের পো, -পয়সা আজই নেবো, না হলে তোর গুষ্টির  *** যাবো"। হরেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে, পিছন পিছন তনিমা। দেখা গেলো পাওনাদাররা একসাথে এসেছে। পিছনে দাঁড়িয়ে রাজু-রজনীকান্ত- এর স্টাইলে। বিপদ দেখে হরেন হাত কচলাতে থাকে। রাজু কলার ধরতে গেলে, রণচণ্ডী তনিমা ওই ঘটিবদ্ধ হাত ধোনির হেলিকপ্টার শটের ঢঙে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসে, "রাজু তোর একদিন কি আমার একদিন, আমার বরের গায়ে হাত"। রাজু পালাবার পথ পায় না। জনতা ছত্রভঙ্গ। আর ঘটিটাও তনিমার হস্তমুক্ত হয়ে সোজা ওপরে উঠে তালগাছের মাথায়। পাশের বাড়ির ডেঁপো ছোকরা, পকাই তাই দেখে দুহাত তুলে ছক্কার সাইন দেখিয়ে বললো," কাকিমা, পুরো ওভার বাউন্ডারি, আগে ক্রিকেট খেলতে নাকি!" এবারে তনিমা লজ্জাবতী  তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়েন। এই লজ্জারুণা রূপ কতদিন দেখেনি হরেন। মনে মনে গুনগুন করে, "রূপসী দোহাই তোমার "! তবে গাওয়ার সাহস হয় না, এই যা।পরের দিন সকাল।হরেন দেখে বৌ খুব খুশী। তনিমা বলে,"দেখেছো,আজ সারাবাংলা নিউজ , তোমার ছেলেকে দুলাখ দেবে, "প্রতিভার খোঁজ" বিভাগ ঘোষণা করেছে। মনটা খুশিতে ভরে যায়। কিন্তু ছেলেটা গেলো কোথায়? 

ছেলে ফিরলো দশটা নাগাদ। একটু গম্ভীর,  আনমনা। "কোথায় গেছিলি বাবা?" হরেন তাকিয়ে থাকে, ছেলের উত্তরের অপেক্ষায়। কথা এড়িয়ে তপন বলে," বাবা,চারটের মধ্যেই রেডি হয়ে থেকো, সারাবাংলা গাড়ী পাঠাবে"। -- জমকালো অনুষ্ঠান।মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন।পিঠ চাপড়াচ্ছেন তপনের--জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি কি করতে চাও? "তপনের সংক্ষিপ্ত উত্তর,"দেশের কাজ"! হাততালি দিচ্ছে সবাই। গর্বিত হরেনও হাততালি দিতে থাকে। গাড়ী পৌঁছে দেয় বাড়ী।রাস্তায় ছেলেটা কেন যে এত গম্ভীর হয়ে থাকলো বোঝা গেলো না।নাকে হাত বুলিয়ে মাথা উঁচু করে গাড়ী থেকে নামছে হরেন।ভাবখানা এই,মুখ্যমন্ত্রীর হাত যার ছেলের মাথায় সে অন্যকে ভয় পাবে কেন?বাড়ির সামনে বিরাট জটলা।এই একটু আগে টিভি চ্যানেলে  সবাই দেখেছে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।সবাই এমন সোনার চাঁদ ছেলেকে দেখতে চায়।  পিতা হিসাবে গর্ব অনুভব করে হরেন। 

পরের দুদিন ছেলে সকালে বেরিয়ে যায় , সন্ধ্যাবেলা মুখ শুকিয়ে ফেরে।জিজ্ঞাসা করলে বলে ,"ফর্ম ভরছিলাম।" তৃতীয় দিন , ছেলের বিছানার পাশে একটা নোট , লেখা,  " বাবা, তোমার আশা পূর্ণ করতে পারলাম না,আমি দেশের কাজে যাচ্ছি। আমি জানি তোমার অনেক দেনা। আমি ইনজিনিয়ারিং পড়লে তোমার দেনা বাড়তো। আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। তাই  মিলিটারি ট্রেনিং নিতে যাচ্ছি। দেশের সেবা সব থেকে সেরা।আমার পাওয়া টাকাগুলো তুমি নিও।টাকা বালিশের তলায় পাবে কিছুটা দেনা শোধ করো। না নিলে খুব দুঃখ পাবো।বাকিটা আমি শোধ করে দেবো ধীরে ধীরে। তুমি ও মা আমার প্রণাম নিও।আমি পোস্টিং পেলে জানাব, তার আগে খোঁজ কোরো না। "

ইতি, তপু। 

চোখে শূন্যতা-হরেনের! সামনে তনিমা কাঁদছে-ভগবানকে দোষ দেবে,না ধন্যবাদ দেবে, বুজতে পারছে না । হাতজোড় করে শূন্যের দিকে নমস্কার জানালো-- বোধহয় ছেলের উদ্দেশ্যেই হবে। 


কবি তাপস মাইতি -এর একটি কবিতা

 যে পথে

       



যে পথে হাঁটি আর এখানেই 

নিরুপম চুল 

বকের পাখনার মতো ওড়ে নিরুপমার ----

সে আমার বন্ধু ।

তারপর দুপুরের হ্রেষা রোদে 

তার ছবি এবং বোকাটে দেহ , 

মরা মেঘের ভেতর উড়তে উড়তে 

আমাকে ছোঁয় । যেখানে সুরভিত চোখ 

তার মাগুর মাছের মতো আমাকে দেখে 

আর নীলাভ শূন্যে হাসে , 

খিল খিল বাদামি ঠোঁটে ।

আমি তো পথে , তাই 

সে আজ আমার দিকে 

ভীমরুলের চোখ করে 

তার রঙিন মনের ডানা ঝাপটায় ।

কবি বন্যা গুপ্ত -এর একটি কবিতা

 আলোকবর্তিকা



মন ভিজে আছে বদ্ধ জীবনের

দায়বদ্ধতার বহনে।

হাত বাড়িয়ে আছে মনের বাহুমূল

পথের মরূদ্বানে।

দিগন্তের পটরেখা বলাকার মাঝে

ছায়া যুদ্ধ।

অবসরের কলোরব কিন্তু জীবনে ভরা

মলমাসের সমারোহ।

স্বপ্ন বোঝাই বিগত দিনের ছবিগুলো...

পাখনা মেলে ইচ্ছে ডানা অহংকারের

স্রোতে ভাসে একান্তে।

একলা খুশীর অভিযানে পাহাড়ী ঝর্ণা 

দুরন্ত বর্ষার উচ্ছ্বলতায়...

কখনো সমুদ্রের নাবিক হয়ে অজানার সন্ধান

এর মাঝে বাস্তবের অনুপ্রাসে আশার প্রদীপদানি হৃদয়ে প্রতীক্ষার তিতিক্ষায়....

কবি আবদুস সালাম -এর একটি কবিতা

 অলক্ষুণে



সম্পর্কের উঠোন আজ স্যাঁতস্যেঁতে

বিবর্ণ ঢেউ উঁকি মারে জলের ছায়ায় অসমতল স্নেহগুলো ভেজালের বারান্দায় সেঁকে নেয় ভরসা


সময়ের শ্যাওলা জমেছে নিস্তব্ধতার ঘাটে

পিচ্ছিল উপত্যকায় শুনি মৃত্যুর পদধ্বনি ব্যর্থ দহন চিত্র খুঁজে পায় খাজুরাহের গায়ে নৈরাশ্যের চরে বাসা বেঁধেছে ডাহুক


নৈঃশব্দের চিল উড়ে চলেছে স্যাঁতস্যাঁতে আকাশে

প্রচ্ছদহীন অলক্ষুণে বারান্দায় জমা হয় নৃশংস অন্ধকার

কবি তুলসীদাস বিদ -এর একটি কবিতা

 ফিরে দেখো

   



বাঙালিরা ফিরে দেখো

         বাংলার কত রূপ।

দেখে দেখে মনে রেখো

       বাঙালিরা নিশ্চুপ।

বদলের পালা গান

            উল্টিয়ে বদলা।

হাড়ে হাড়ে বুঝে যান

      বহুরূপী বাংলা।

ভুলে গেলে চলবে না

         অতীতের কটা দিন।

বাঙালিরা মানবে না

           বড় ছোট অতিদীন।

জবাবের ভাষা গুলো

   বড় এলোমেলো।

খড় কুটো দিয়ে জ্বালো

         গরিবের চুলো ।

ঝাঁটা মারো বড় মুখে

         বেকারীরা বাংলার।

অপমানে মুখ ঢেকে

             ধূলো মুছো চশমার।

বাংলার রাজ রাণী

          মিথ্যার মাষ্টার।

শ্রী ময় বাংলার

           কালিমাখা গৌরব।

চট্কানো ফুলের

           থাকে নাকি সৌরভ।

বাঙালিরা ফিরে দেখো

           চোখ খুলে বারবার।

যত দেখো ততো শেখো

      কত শ্রী বাংলার।। ফিরে দেখো

   তুলসীদাস বিদ


বাঙালিরা ফিরে দেখো

         বাংলার কত রূপ।

দেখে দেখে মনে রেখো

       বাঙালিরা নিশ্চুপ।

বদলের পালা গান

            উল্টিয়ে বদলা।

হাড়ে হাড়ে বুঝে যান

      বহুরূপী বাংলা।

ভুলে গেলে চলবে না

         অতীতের কটা দিন।

বাঙালিরা মানবে না

           বড় ছোট অতিদীন।

জবাবের ভাষা গুলো

   বড় এলোমেলো।

খড় কুটো দিয়ে জ্বালো

         গরিবের চুলো ।

ঝাঁটা মারো বড় মুখে

         বেকারীরা বাংলার।

অপমানে মুখ ঢেকে

             ধূলো মুছো চশমার।

বাংলার রাজ রাণী

          মিথ্যার মাষ্টার।

শ্রী ময় বাংলার

           কালিমাখা গৌরব।

চট্কানো ফুলের

           থাকে নাকি সৌরভ।

বাঙালিরা ফিরে দেখো

           চোখ খুলে বারবার।

যত দেখো ততো শেখো

      কত শ্রী বাংলার।।

কবি নবকুমার -এর একটি কবিতা

 ঘরের পর্দাটা দুলছে 



ঘরের পর্দাটা দুলছে---

পর্দার ওপারে কে আছে জানি না -

কোন আওয়াজও পাচ্ছি না ।


আমি দাঁড়িয়ে আছি দরোজার সামনে

একটা শালগাছের ছায়ায় 

আমার চারদিকে বেষ্টন ক'টি বাচ্চা শশক ।


একেকবার মনে হচ্ছে পর্দাটা একটু ফাঁক করে দেখি

আবার থমকে যাই ।

যাকে চেয়েছি যদি না পাই !

তাহলে এক কালো আকাশ বুকে নিয়ে 

হেঁটে যেতে হবে সারাটা জীবন ।


এখন তো চলছে ভাঙনের পালা -

রাষ্ট্র ভাঙছে,যৌথ পরিবার কবেই ছত্রাখান

ভাঙছে সমাজ ,মানুষের আচরণ,মানবিকতা 

সব--সব---

যদি সেও ভেঙে যায় অস্বাভাবিক নয় ।


তবু যে যেখানে আছে থাক

যেমনটি স্থির আমার মনে 

একথা ভেবেই সময় পেরিয়ে যাবে দু'দিনের জীবনে--

Sunday, September 26, 2021

কবি মহীতোষ গায়েন -এর একটি কবিতা

 সম্পর্ক



বয়স যত বাড়ছে বুকের উপরের পাথর

সরে যাচ্ছে,সরছে মাটি,গাছ,লতাপাতা;

আলোকবর্ষ দূরত্বে চলে যাচ্ছে সম্পর্ক।


সব সূত্র,রীতিনীতি,বোঝাপড়া ব‍্যবধানের

হিমশৈলে ধাক্কা খেয়ে সংসার-সমুদ্রে ডুবে

যাওয়ার আগেই একবার সতর্ক হয়ে যাও।


বয়স বাড়ছে লাউ ডগার মত,উপত্যকায়

বাসা বাঁধছে কামনা বাসনার ক্ষয়িষ্ণু বীজ,

সম্পর্কের সলতেগুলো পাকাচ্ছে তালগোল।

 

আকাশে চাঁদ উঠেছে,সমস্ত তারা,নক্ষত্র

সম্পর্কের ফাটল দিয়ে ঢুকে দখল নিতে

তৎপর,জীবনের রণক্ষেত্রে যুদ্ধের আবহ।


ভোরের সূর্য ঢেকে যাচ্ছে বিভেদের মেঘে;

জীবনের গাছে বাহারি ফুল,প্রচণ্ড ঝড়ের

পূর্বাভাস,শেষ হওয়ার আগে এসো আরো

একবার সম্পর্কের সাতপাকে বাঁধা পড়ি।

কবি চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী -এর একটি কবিতা

 হোক না পথ কঠিন




নৌকা চলে হেলে দুলে শ্রাবণ নদীর জলে

গান জুড়েছে ময়না টিয়ে সুরের তালে তালে।

আমন ধানে ক্ষেত ভরেছে শরৎ মেঘের ভেলা

খেলতে পুতুল উঠোন মাঝে দুপুর হলো বেলা।

আমরা কি সব পুতুল জীবন খেলছি সুতোর টানে

হাজার স্বপ্ন বুকের মাঝে চেয়ে আশার পানে।

বাঁচতে হবে বাঁচতে হবে হোক না পথ কঠিন

জীবন নৌকা বাইতে বাইতে করবো জীবন রঙিন।

কবি ইমরান শাহ্ -এর একটি কবিতা

 নীলকন্ঠ



স্মৃতির দেয়ালজুড়ে চৌমুখী বাতাস বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে অবিরত

এখন আকাশ আর শাদা হয় না কেন যেন!


শরীরসমাজ বয়ে বেড়াই আকাশলীনা পথ ধরে, কিনারা পাইনি

অক্টোপাসের মায়াবি থাবা এড়াতে পারি না সমগ্রঃ বলপ্রয়োগে।


সে যদি মিলে যায় হৃদপিণ্ড কেটে অর্ঘ্য দেবো

তবু তারে চাই, সবকিছুর বিনিময় আমৃত্যু; কিভাবে পাবো?


শ্বেতহস্তী পুষবো মনের অন্দরে তেমন গোয়ালী নই হয়তো

তাই বিড়াল পুষি, তার কাছে কিছু শিখবো বোলে। 


অমৃতের স্বাদ ভুলে গেছি, গতশোচনা করে যাই শুধু;

আমরণ তাই গিলে চলেছি বিষ ভরা আহান-রস।


 না-হয় ধরণী তুমি দ্বিধা হও, নতুবা মুক্তি দাও

এমন সোনার মনুষ্য জীবন বাঁচাতে বাতলে দাও পথ।

কবি মুহাম্মদ বায়েজিদ আলী -এর একটি কবিতা

 সংকেত



নগদ দেনমোহর;

তবু সংকেত!

উকিল বাড়ি সন্ধান...

আর ক'টা দিন। ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলো,

আগামী দিন...

হ্যালো! মুঠোফোন।


কবি অমিত পাল -এর একটি কবিতা

 তুমি পাল্টাবে না

                       


তোমরা তো দেখছি নতুন ভাবে সারি বেঁধেছ৷

পিঁপড়েরাও তোমাদের দেখে লজ্জা পাবে৷

হাতে হাতে ধর্মধ্বজা----

লাল, সবুজ, গেরুয়ার সমুদ্র সফেন৷

তোমরা নিজেদের ডিম্ব গুলি রক্ষা করতে চাও----

পিঁপড়ের বংশধর সব৷


আমি জানি একথা----

তুমি থামবে না ধমকানিতে৷

জয়গান গেয়ে যাও নিজ পেটের ভাত রক্ষার্থে----

বোকামিতে হোক বা ছলচাতুরীতে৷


আমি জানি তুমি থামবে না৷ গর্জে উঠবে বারবার৷

তোমার তো সম্পদ-প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি

একটা নিগূঢ় লালসা আছে---- একথা আমি জানি৷

তুমি চিৎকার করছ নিজের জন্য৷

কিন্তু তোমার সঙ্গীরা...

টিফিন পেলেই তৃপ্ত পাশে থাকা গিরগিটি----

একথা তুমি জানো?


আমি জানি তুমি থামবে না৷ অনশনে বসবে৷

কিন্তু তোমার সভা-সমাবেশের ভবিষ্যত কি?

সে কথা প্রত্যুত্তরে বলো আমায়...

কবি উদয়ন চক্রবর্তী -এর একটি কবিতা

 আলবিদা

  



শরীরের ঘাম যখন বৃষ্টি আবদার করে

আকাশের বাউন্ডুলে মেঘও কেঁদে 

নিজেকে হালকা করতে চায় লজ্জাহীন।

এসো এটা আমি জানি তুমিও জানো কোথায় কোন কোণায় ঘাপটি মেরে

লুকিয়ে থাকে ভালোবাসার ঘুন পোকা

যদিও সে জানাও সম্পূর্ণ নয় এ যাত্রা পথে।

কোথায় কোথায় স্পিড ব্রেকার তৈরি হয়

সময়ের অন্তরালে যাপনের ইতিহাসের পাতায় কোনো যতি চিন্হ না রেখে সে ধূসর 

রেখা চিত্র এক অতি বাস্তব ছবি এঁকে ফেলে।

আমি সেই প্রজাপ্রতি কে খুঁজে মরি যে আমাকে পৌঁছে দিতে পারে এক নৈসর্গিক 

দিগন্তের শেষ প্রান্তে যেখানে লেখা আছে আলবিদা।

কাটা ঘুড়ির গন্তব্য হীন বিষণ্ন যাত্রাপথে

বোঝা যায়না যখন উল্লাস আর উন্মাদনা 

নেচে বেড়ায় ময়ূরের মতো পেখম তুলে।

সময় যোগ বিয়োগ করে ঠিক ভাগশেষের

উত্তর মিলিয়ে দেয়।

কবি সুব্রত মিত্র -এর একটি কবিতা

 ললাট লিখন




বৃক্ষ তলে বসে আছি।চিল কাক উড়ে যায়।

তারা বাসা ছেড়ে ছুটে এসে আমাকে তারায়,

আমি নির্ভাবনায় আছি,

তবু মরি বাঁচিবার আশায়। 


পড়ে রয় মন এই বনে;নাহি যেতে চায় লোকালয়ে

আজকে লোকালয়ে নেই আর মানুষের আশ্রয়

সেথা হয় সর্বদা হিংস্রতায় রক্ত ক্ষয়, 


এই জঙ্গল হয় উৎকৃষ্ট মঙ্গল

এখানে ছদ্মের বেশ নেই

স্বভাবজাত জালিয়াতির রেশ নেই,

এখানে মুক্তির আহবানে সারা দিই দিন রাত

আহা বেশ বেশ কি চমৎকার আমার বরাত। 


অহংবোধ করিয়াছি রোধ

নিজের অজান্তে যাহা ছিল অপরাধ হয় যেন শোধ;

অক্ষর চলে গেছে বহুদূর

বাক্যের সন্ধানীরা অবাক্যের মাঝে আছে পড়ে,

বাধ্যবাধকতায় করি যাপন বেদনা মধুর মিদুর। 


শিকড় উপড়ে ফেলা যন্ত্রণার বিদ্রোহ কল্পনায়

যাতনার শিকার হয়েও, মরে গিয়েও, মরছি না।

মরে যেতে চাই, তবুও মায়া না হারাই।

পঙ্কিল চৌচিল অনাবিল তাহাদের করেছিল সবল

আমি আগেও ছিলাম আজও আছি,আমি খুব দুর্বল।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ পাইন -এর একটি কবিতা

 কিনলে একটা পাহাড়



আমি কিনবো একটা পাহাড়

শত্রুদের মুখে পড়বে ছাই। 


আমি দাঁড়াব পাহাড়ের এই পাড়ে

ওরা যাবে সেথায় হারিয়ে। 


পারবে না আমায় আটকাতে

বড় জোর ব্যঙ্গ করবে নাহয় শিস দিতে


ভাসবে ঝাউবনে সাগরের জলে

কিংবা বাধ্য হবে সব ভুলে


কত মাটি কত খাদ যাচাই করতে

 আমি কিনলে একটা পাহাড়

ওরা যাবে যেখানে বেড়াতে।

কবি তৈমুর খান -এর একটি কবিতা

 সম্পাদক 

  



পাত্তা দেবে না কেউ , কাছাকাছি গেলে 

মুখ ফিরিয়ে নেবে , কথাও বলবে না 

শুধু নীরবে বাইরে যাওয়ার ইংগিত 


পাত্তা দেবে না কেউ 

                 যে রকমই সম্পাদক হোক 


তার কাছে দেবার মতো আলো যদি নাও থাকে 

সুখ দুঃখ বাক্য বিনিময়ে কিছুই ভাগ করা যাবে না 

ডিঙানো যাবে না তার ঘরের সীমানা 


এইখানে রাত হলে রাস্তায় বসে বসে কাঁদো 


এইখানে আগুনে পুড়লে যন্ত্রণায় নিজেকে ঢাকো 


গাছের ছায়ায় বসে দ্যাখো , কত পাখি ডাকে 


ভিজে যাও বৃষ্টিতে বর্ষায় মেঘে —


এইখানে একমনে লেখা আর না - লেখার ভিড় 

পাতায় পাতায় মেঘে কল্পনার নীড় 

আনন্দে নিরানন্দে ক্রমে কথা হোক 

লেখা আর না - লেখাদের নিজেই সম্পাদক ।

১১তম সংখ্যার সম্পাদকীয়

 

   

                                   অঙ্কন শিল্পী- মৌসুমী চন্দ্র



সম্পাদকীয়



নদীর মত বয়ে যাওয়া ভাষাশৈলী কে বুঝতে হলে প্রয়োজন সমুদ্র সুলভ মন। কারণ একটাই নদীর শেষ ঠিকানা সমুদ্র। আজ এগারোতম সংখ্যা প্রকাশিত হল। এতদিন লিখছেন, পড়ছেন আমাদের ব্লগ ম্যাগাজিন। পাশে আছি আমরা পরস্পরের কাছে। ভালোবেসে পড়ুন পত্রিকা। লেখা গুলি হৃদয়ে অন্তর্নিহিত করে তাৎপর্য বুঝতে শিখুন। জানান প্রতিটি লেখার মন্তব্য। তাই আমাদের ওয়েবসাইট ম্যাগাজিনে লেখা পাঠান, অন্যের লেখাকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ুন। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। পড়তে থাকুন আমাদের পত্রিকা।

 

 

                                      ধন্যবাদান্তে

                     World sahitya adda সম্পাদকীয়


__________________________________________________


***Advertisement (বিজ্ঞাপন):




##সাঁঝের বেলা' মাসিক অনলাইন ম্যাগাজিনে যে কেউ কবিতা/গল্প পাঠান|
##'সাঁঝের বেলা' সাহিত্য সম্মান' (কবিরত্ন/সাহিত্যরত্ন/সাহিত্যজ্যোতি) পেতে যে কেউ নিজের লেখা সেরা কবিতা/গল্প/প্রবন্ধ/আঁকা ছবি/ভ্রমণ কাহিনী/রম্য রচনা/উপন্যাস/নাটক পাঠান|
##'সাঁঝের বেলা জীবনজ্যোতি সম্মান' পেতে নিজের জীবনী পাঠাতে পারেন|
লেখা পাঠাতে যোগাযোগ করুন- 9999998705

                     -সম্পাদক সাঁঝের বেলা
_______________________________________________________________

বি.দ্র-- বিজ্ঞাপনের সব দায়িত্ব বিজ্ঞাপন দাতার


Saturday, September 25, 2021

১১ তম সংখ্যার সূচিপত্র (২৭জন)

 সম্পূর্ণ সূচিপত্র



বাংলা কবিতা ও ছড়া---


তৈমুর খান, সত্যেন্দ্রনাথ পাইন, সুব্রত মিত্র, উদয়ন চক্রবর্তী, অমিত পাল, মুহাম্মদ বায়েজিদ আলী, ইমরান শাহ্, চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী, মহীতোষ গায়েন, নবকুমার, তুলসীদাস বিদ, আবদুস সালাম, বন্যা গুপ্ত, তাপস মাইতি, 



বাংলা গল্প---


আশীষ কুন্ডু, রানা জামান, রোকেয়া ইসলাম



বাংলা গদ্য তথা রম্য রচনা---

সুজিত চট্টোপাধ্যায়, তীর্থঙ্কর সুমিত



রোগ বিষয়ে আলোচনা---


প্রভাত ভট্টাচার্য



বাংলা ছোট নাটক----


রাজা দেবরায়



ইংরেজি কবিতা--


Soumendra Dutta Bhowmick, Sunanda Mandal

Amit bid.



Photography----


Moushumi chandra



গান---


বদরুদ্দোজা শেখু

Sunday, September 19, 2021

Photography by Moushumi chandra

 


গীতিকার বদরুদ্দোজা শেখু -এর একটি গান

 মনটা আমার 



মনটা আমার দুঃখী ওগো তোমার বিরহে দুখী

দূরত্বে ,তবু সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছো মুখোমুখি।।


বাড়িয়ে রয়েছি হাত 

উদাত্ত দিনরাত

প্রতীক্ষায় শুধু প্রতীক্ষায় শ্বাস প্রশ্বাস ফুঁকি।।


জানিনা কখন আসে 

আলেয়া আমার পাশে

দূরে হাসে, উড়ে যায় বেদনায় লুকোলুকি ।।


হয়তো হবেনা পাওয়া

 হাসি কান্না গান গাওয়া

এ জীবনে , সেই বিচ্ছেদ খেদ হ'য়ে মনে দ্যায় উঁকি।।

Poet Sunanda Mandal's one poem

 Lifeless

     


I'm hungry 

You are hungry 

The world too. 


The whole family in the game of Maran 

In response to the pain. 


His greedy vision 

The tip of the sharpened fruit. 

Even the mournful bullet wounds, Blooming roses.


But with the claim of love 

No one has the courage to move forward. 

Everyone in the hungry,

World is tired, lifeless.

Poet Soumendra Dutta Bhowmick's one poem

 A FORTUNATE LATE



 

Even not at all death touches the mortal body...

Such pity on me throughout the days!

It’s wonder in a motion study,

Who is the secret benign?

Despite piling of Sins in the Note-Book

Time is flowing smoothly very fine!

Somewhat may be the outcome of honest works

Or somewhat due to a holy touch,

As if death is afraid of coming nearer

Because joy overflows with the doubts much

                Likely may be the weakness

                           Kindling the Lamp,

With this light the river will flow and flow

                 Till the death kisses like the champ.

লেখক ঋদেনদিক মিত্রো এর একটি প্রবন্ধ

 ভুল অর্থনীতি, জুতোর মালা  ও এক লাখ টাকা বাজী 

 


মানুষকে নিচু চিন্তায় আটকে রেখে, তার বুদ্ধির বিনাশ ঘটিয়ে তাকে যত ডিগ্রী, পদ, টাকা ও অন্যন্য সুযোগ দেওয়া হোক না কেন, দেশের কোনো উন্নতিও হবে না, সমাজের কোনো মঙ্গল হবে না, এই সত্য যতদিন না দেশের জনগণ বুঝবে ততদিন দেশ নির্বোধ, আর এই সত্য বুঝে যতদিন না আমাদের রাষ্ট্রীয় ও রাজ্যিয় শাসন ব্যবস্থ্যা --- জনগণকে উন্নত চিন্তা ও উন্নত অভ্যেসে ও নির্লোভ জীবন যাপনে নিয়ে যাবে ততদিন দেশের কোনো উন্নতি হতে পারে না! 


কিছু সেতু, রাস্তা, বাড়ি, অফিস, যুদ্ধাস্ত্র, চাকরি, এগুলি আধুনিক করা হলো মানে দেশ উন্নত হয়নি, কারণ মানুষের মনের, স্বভাবের ও অনুভবের উত্তরণ না হলে, বাকি সব উন্নতিগুলি দেশের সম্পদ নষ্ট ও সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়! 


এই সত্যের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়ালে ও আমাকে মিথ্যে বলে প্রমাণ করলে আমি জুতোর মালা পরবো প্রকাশ্যে, ও সেটা ইউটুবে দেখানো হবে, এবং একই সাথে এক লাখ টাকা বাজী, কিন্তু যদি বিরুদ্ধ পক্ষ হেরে যায় আমার কাছে ডিবেটে, তাহলে তাদেরও এটা করতে হবে! সরকার পক্ষের যেকোনো সংস্থা হলে, তারা হেরে গেলে তখন কয়েক কোটি টাকা তারা আমাকে দেবে তারা হেরে গেলে!


আছে কেউ এই দেশে, এই বিশ্বে, এই কথাগুলিকে মিথ্যে প্রমাণ করতে? তাঁকে আমন্ত্রণ করি!


যে-জনগনের এখনো এই বিষয়ে অনুভব তৈরী হয়নি, তাদের শিক্ষা, ডিগ্রী কেড়ে নেওয়া দরকার, তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া দরকার, তাদের সন্তান জন্ম দেবার অধিকার কেড়ে নেওয়া দরকার, তাদের উৎসব অনুষ্ঠানের অধিকার কেড়ে নেওয়া দরকার, কারণ তাদের বংশধরগুলোও তাদের মত ক্ষতিকারক জীব হবে !


কারণ নির্বোধ বা সংকীর্ণ স্বার্থপরদের হাতে সম্পদ, ডিগ্রী ও পদ থাকা মানে সভ্যতার সর্বনাশ ! 


দেশ ও বিশ্বকে সুস্থ করে তোলার জন্য আমার এই প্রক্রিয়া ও চিন্তা! 


উন্নত হওয়া ও উন্নত করার উদ্দেশ্যকে যদি অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয় তাহলে যারা এটা করবে তারাই অপরাধী, আমি নই!


পৃথিবীতে এতো সমাজ চেতনার গ্রন্থ, দর্শনের গ্রন্থ সেগুলিতে কী আছে?  


উপযুক্ত অর্থে সেগুলিতে কিছুই ছিলোনা, ছিল কেবল রচনার কৌশল, আর সঠিক সত্যকে ফাঁকি দেবার পন্থা পদ্ধতি, কিংবা আবছা সত্য, তাই সভ্যতাটা ক্রমশ বর্বর হচ্ছে দিন-দিন!



লেখক তৈমুর খান -এর একটি প্রবন্ধ

 প্রেমে ব্যর্থ কবিই লেখেন সার্থক প্রেমের কবিতা






 পৃথিবীর সমস্ত কবিকেই লিখতে হয় ব্যর্থ প্রেমের কবিতা। যদি কোনো কবি প্রেমে ব্যর্থ না হন, তাহলে তিনি কবি হিসেবেও পূর্ণতার স্পর্শ লাভ করতে পারেন না। অর্থাৎ কবি হতে গেলে প্রথম শর্ত তাঁকে প্রেমে ব্যর্থ হতে হবে। কথাগুলো বলেছিলেন বর্ষিয়ান সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। কোন কবি প্রেমে ব্যর্থ হননি? আমরা একজন তরুণও খুঁজে পাইনি সেই কবির নাম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্যগুলি যেন ব্যর্থ প্রেমেরই ফসল। কোনো না কোনোভাবে কবিরা ব্যর্থ হয়েছেন। কারও প্রেম ছিল নীরব, কারও প্রেম ছিল সরব। বৈষ্ণব সাহিত্য ব্যর্থ প্রেমেরই হাহকার। কবিরা ব্যক্তিজীবনকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন রাধাভাবের আড়ালে। রবীন্দ্রনাথ তাই প্রশ্ন করেছিলেন: 

    "সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,

    কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,

    কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান

    বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান,

    রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?

    বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে

    কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,

    আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে

    রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা—

    রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা

    চুরি করি লইয়াছ কার মুখ, কার

    আঁখি হতে!" (বৈষ্ণব-কবিতা: সোনার তরী)

 বৈষ্ণব কবিরা ব্যক্তি হৃদয়ের ভাঙনকে, রক্তক্ষরণকে, যন্ত্রণা-বিচ্ছেদ-দহনকে রূপ দিয়েছিলেন বৈষ্ণব পদে। আত্মযন্ত্রণার তিল তিল উপলব্ধিকে শব্দের মারণবাণে গেঁথে ছিলেন। তাই মিলনেও ছিল বিচ্ছেদের সুর। পেয়েও হারানোর ভয়। আবার বিচ্ছেদেও ভাবসম্মেলনে পৌঁছানোর অবকাশ। কত বৈচিত্র্যময় এই যাপনের সংশ্লেষ তা প্রেমিক মাত্রই অনুভব করেন। আর এই উপলব্ধির ক্রিয়াগুলিই সৃষ্টির ক্ষেত্রকে উর্বর করে। সম্পৃক্ত হয় সৃষ্টি। জীবনানন্দ দাশ  লিখেছেন:

"জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন

তুমি আছ ব’লে প্রেম,—গানের ছন্দের মতো মন

আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!

হৃদয় গন্ধের মতো—হৃদয় ধূপের মতো জ্ব’লে

ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন !"

                            (প্রেম: ধূসর পাণ্ডুলিপি)

কবি জীবনের পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারেন শুধু প্রেমের কারণেই। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতেও পারেন প্রেমের কারণেই। প্রেম শুধু হৃদয়েই বহন করেন কবি। যে বিচ্ছেদ প্রেমকে চিরস্থায়ী করে যায়, সেই প্রেম তো অনিঃশেষ। এই প্রেমের স্ফুরণ সারাজীবন ধরে চলতে থাকে। ধূপের মতন তার দহনের গন্ধ। পুষ্পের মতন তাকে প্রস্ফুটিত করে। গানের ছন্দের মতন তাকে দোলায়। আর তার পোড়া ধোঁয়ায় বাতাস করে। সেই প্রেমই যে ব্যক্তি জীবনকে বৃহত্তর মানবিক আলোয় উদ্ভাসিত করে, একনিষ্ঠ সম্যক মূল্যবোধের নিরিখে জাগ্রত করে, স্পন্দিত বিনয়ী ও মরমি করে তোলে  তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রেমিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি কবিতায় তা উল্লেখ করেছেন:

"প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়

আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি

দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত

ছড়িয়ে যায়

আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক

অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে

হেঁটে যাই


সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না

আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই

রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট

অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে

খসে পড়ে

আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ

ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে

মনে হয় খুব আপন


আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা

প্যান্ট শার্ট পরে

আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে

আমি নিজেই আদর করি

খুব গোপনে


আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ

আমার সর্বাঙ্গে কোথাও

একটুও ময়লা নেই

অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার

মাথার পেছনে


আর কেউ দেখুক বা না দেখুক

আমি ঠিক টের পাই

অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য

আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও

আঘাত না লাগে

আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।"

  (ব্যর্থ প্রেম:দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়)

 একজন পরিপূর্ণ মানুষ, একজন পরিপূর্ণ প্রেমিক এবং একজন পরিপূর্ণ কবি হতে গেলে তো এরকমই হতে হয়। নিজেকে ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসা, দেশ ও সমাজকে ভালোবাসার এরকমই বিরাট হৃদয় লাভ করা যায়। সুতরাং কেউ ফিরিয়ে দিলেও সেই ফেরানোটাই প্রেরণা হয়ে ব্যক্তিকে দার্শনিক করে তোলে। মানবিক গুণসম্পন্ন আত্মসচেতন উদ্যমী কর্মযজ্ঞের শরিক করে তোলে। সুতরাং সৃষ্টির উৎসমূলে এই ব্যর্থতারই মূল্য অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: 'বিচ্ছেদের দুঃখে প্রেমের বেগ বাড়িয়া ওঠে।' আমরা জানি, বিবাহের থেকে 'ভালোবাসা' কথাটি অনেক বেশি জ্যান্ত। কেননা, প্রেমিক স্বামী হলে প্রেমের মৃত্যু অনিবার্য। প্রেমে যে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই তা প্রতিটি প্রেমিকই  জানে। আর তাই প্রেমকে বিসর্জন দিতে পারে না। সারাজীবন বহন করে নিয়ে যায়। কেউ নির্মাণ করে তাজমহল। কেউ রচনা করে কাব্য সাহিত্য। কেউ আঁকে ছবি। কেউ গৃহ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে। এই প্রেমই তাঁকে জীবনের পথে হাঁটায়।

       প্রেমিক কবি জন কিটস চিরন্তন বিচ্ছেদ জেনেও জীবনের পরপারে প্রেমকেই সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই প্রেমিকা ফেনী ব্রাউনকে লিখেছিলেন:

"My sweet love...Send me the words “Good night” to put under my pillow."

 প্রেমের যে অসীম শক্তি তা খুবই কম বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর সমস্ত কাব্যই হয়ে উঠেছিল প্রেমের কাব্য। প্লেটোনিক-লাবের মধ্যে এসেছিল দুঃখ যন্ত্রণা। হাহাকারের ছায়া। বিচ্ছেদের মধ্যেই, বিরহের মধ্যেই জাগরুক হয়েছিল বিরাট আত্মা। যে আত্মাকে প্রতিটি হৃদয়ই ধারণ করে। বিচ্ছেদ যে অনিবার্য তা চণ্ডীদাসও বুঝেছিলেন, বলেই লিখেছিলেন:'দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।' যাকে আমরা বিচ্ছেদ বলে ধরে নিই তার মধ্যেই থাকে 'Beauty is truth, truth beauty'. রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে পৌঁছে এই সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করেছিলেন আঘাতে আঘাতে। কী ছিল তাঁর সেই আঘাত?

     ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রেমের মধ্য দিয়েই, অথচ কোনো প্রেমই মিলনে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে ওঠেনি। যেসব নারী রবীন্দ্রজীবনে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁরা হলেন: মারাঠি কন্যা আন্না তড়খড়, কাদম্বরী বৌঠান, আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং রবীন্দ্ররচনার গুনমুগ্ধ পাঠিকা হেমন্তবালা দেবী। মুম্বাইয়ে অবস্থানকালে মারাঠি কন্যা আন্না তড়খড়ের রূপে-গুণে কবি মুগ্ধ হন। তাঁকে সারাজীবন ভুলতে পারেননি। কম বয়সে বিদুষী বুদ্ধিমতী এই মহিলা কবির কাছে একটি ডাকনাম পেয়েছিলেন 'নলিনী'। কাব্য ভাবনারই এক অনন্য ফসল এই নলিনী। কবির প্রথম জীবনে লেখা বহু কাব্য-গল্প-নাটকে এই নামটি পাওয়া যায়। কবির সঙ্গে নলিনীর দীর্ঘ পত্রবিনিময় হত। মাসাধিক প্রেমের তরঙ্গ জীবন-সমুদ্রের তীরভূমিকে যে নাড়িয়ে দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 'নলিনী' নামের একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

 "লীলাময়ী নলিনী,

 চপলিনী নলিনী,

 শুধালে আদর করে

 ভালো সে কি বাসে মোরে,

 কচি দুটি হাত দিয়ে

 ধরে গলা জড়াইয়ে,

 হেসে হেসে একেবারে

 ঢলে পড়ে পাগলিনী!

 ভালোবাসে কি না, তবু

 বলিতে চাহে না কভু

 নিরদয়া নলিনী!

 যবে হৃদি তার কাছে,

 প্রেমের নিশ্বাস যাচে

 চায় সে এমন করে

 বিপাকে ফেলিতে মোরে,

 হাসে কত, কথা তবু কয় না!

 এমন নির্দোষ ধূর্ত

 চতুর সরল,

 ঘোমটা তুলিয়া চায়

 চাহনি চপল

 উজল অসিত-তারা-নয়না!

 অমনি চকিত এক হাসির ছটায়

 ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়,

 তখনি পালায় আর রয় না!"

 কবির বয়ঃসন্ধির সংবেদনশীল দিনগুলিতে রোমান্সের তীব্র দাহ সৃষ্টি করেছিলেন কাদম্বরী বৌঠান। তিনি ছিলেন জ্যোতি দাদার সহধর্মিণী। রবীন্দ্রনাথের কাব্য জীবনের মূল ভিত্তিকেই তিনি সংগঠিত করেছিলেন। দুজনে সমবয়সী হওয়ায় খুনসুটির সঙ্গে মনের মিলও ছিল অসম্ভব। তিনি সেই সময়ই যে সাহিত্য রচনা করতেন তার মূল লক্ষ্যই ছিল এই নারীটি। তাঁকে নিয়ে 'ভারতী' পত্রিকায় লিখেছিলেন: "সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রু জলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।" বৌঠানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তাই লেখা থেকেই বোঝা যায়। মান-অভিমান থেকে লুকোচুরি খেলা সবই চলত। তাঁর বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথকে কাতর করে দেয়। এই ছাপ আমরা দেখতে পাই 'চারুলতা' এবং 'নষ্টনীড়ে'।

           হেমন্তবালা পাঠিকা হলেও হৃদয়ের উষ্ণ আদান-প্রদান ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তা অনেক চিঠিপত্রেই স্পষ্ট। একটি চিঠির কিছুটা অংশ এরকম: "আপনি আমার দেবতা, আমার কল্পলোকের রাজা। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমার পূর্ণপূজা আপনার চরণে দিতে পারছি না। আপনি কি আমার মন দেখতে পারছেন না?" রবীন্দ্রনাথ ঠিকই তাঁর মন দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু মিলনান্তক হয়ে ওঠেনি সেই সম্পর্ক বলেই তা স্মরণে জীবন্ত হয়ে গিয়েছিল।

     জীবনে প্রেম আসে বলেই ব্যর্থতাও আসে, যে ব্যর্থতা বিচ্ছেদের হাহাকারে পরিণত হয়। আর্জেন্টিনার মেয়ে ৩৪ বছর বয়স্কা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়েও তা হয়েছিল ৬৩ বছরের রবীন্দ্রনাথের। সেই  মিলন-বিরহ যাপনের নানা মুহূর্তগুলি 'পূরবী' কাব্যে গেঁথে ছিলেন। কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন 'বিজয়াকে'। এই বিজয়া আসলে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোরই নাম যা রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন। প্রথম দেখার মুগ্ধতাকে 'বিদেশী ফুল' নামে কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন। 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো মনের মন্দিরে'; নিজে কখনোই হারাতে চাননি বলেই নামটি লেখার এমন আকুলতা। শেষ পূরবীর রাগিণীর সুরে বিষাদের সুরই বেশি উঠেছে। জীবনের শেষ পর্বে পৌঁছেও তা ভুলতে পারেননি। তাই 'শেষ লেখায়' কবির আবেদন: 

"বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে

যে প্রেয়সী পেতেছে আসন

 চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া

 কানে কানে তাহারি ভাষণ।

 ভাষা যার জানা ছিল নাকো  

 আঁখি যার করেছিল কথা

 জাগায়ে রাখিবে চিরদিন

 সকরুণ তাহার বারতা।"

 এই 'সকরুণ বারতা'য় কোথাও যেন ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস লেপ্টে আছে। যেতে নাহি দিব বললেও তবু যেতে দিতে হয়। হারিয়ে যাবার বেলায় একমাত্র সান্ত্বনা হিয়ার মাঝে বেঁধে রাখার। ভালোবাসা যে কেবলই যাতনাময়!                                                                                   

    কবি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য প্রেমের ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। যে ধূমকেতুর মতন আলোকবলয় নিয়ে সাহিত্যাকাশে তিনি উদিত হয়েছিলেন তাতে চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল সবার। কিন্তু তাঁর মধ্যেও 'অশান্ত রোদন' বিরাজ করছিল। গানে কবিতায় বারবার বেজে উঠেছিল সেই যন্ত্রণার স্বরলিপি। কুমিল্লার সৈয়দা খাতুন বা নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মিলনের স্বপ্নে প্রতিটি মুহূর্ত বিভোর হয়ে যায়। কিন্তু সেই মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নজরুলকে ঘরজামাই রাখার পাকা বন্দোবস্ত করার কারণে। নজরুল বিয়ের আসর ত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হন। কিন্তু সেই নার্গিসকে কখনোই ভুলতে পারেননি। গানে কবিতায় চিঠিতে বারবার সেই প্রসঙ্গ এসেছে।  হৃদয়ে খচখচ করে বিদ্ধ হয়েছে বেদনার কাঁটা।'শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না।’ নজরুল আর কখনোই যাননি দৌলতপুরে। ১৭ বছর কবির জন্য প্রতীক্ষা করেছিলেন নার্গিস। এর মধ্যে কয়েকবার চিঠিপত্রে যোগাযোগ হয়েছিল। নার্গিসের এক অভিমানক্ষুব্ধ চিঠির উত্তরে নজরুল লিখেছিলেন: ‘'দেখা? না-ই হলো এ ধুলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধুলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমকে পায়নি।’'

নজরুলের সঙ্গে নার্গিস ছাড়াও আরও কয়েকজন নারীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। সেগুলোর কোনওটি হয়ত একপাক্ষিকও ছিল। যেমন ফজিলাতুন্নেসা। একবার নজরুল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করার নিমন্ত্রণ পান। সম্মেলনে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিতা নারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এই সম্মেলনে ফজিলাতুন্নেসা ‘নারী-জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাঁর বক্তব্য শুনে নজরুল মুগ্ধ হন এবং তাঁর প্রেমে পড়ে যান। এ প্রেমটি ছিল প্রমীলা দেবীকে বিবাহ করার পর তাঁর বিবাহত্তোর প্রথম প্রেমে পড়া। ফজিলাতুন্নেসা হয়তো একটু প্রশ্রয় দিয়ে থাকবেন কিন্তু নজরুল বিষয়টি থেকে বের হতে পারেননি। তিনি উপযাজক হিসেবে বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। যাই হোক, প্রেমটি একপাক্ষিক হবার কারণে এর শাখাপ্রশাখা বিস্তার লাভ করেনি। ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কোনো এক রাতে গলার হারের স্মৃতি নিয়ে নজরুল লিখেছিলেন:

"নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার,

তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহংকার।…

নাই বা দিলে ধরা আমার ধরার আঙ্গিনায়

তোমায় জিনে গেলাম সুরের স্বয়ম্বর সভায়।"

পরে তিনি তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন, যদিও ফজিলাতুন্নেসা সেই আগ্রহে জল ঢেলে নিজের আপত্তি দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড চলে যান ফজিলতুন্নেসা। সেখানে শামসসুজ্জোহা নামের এক উচ্চশিক্ষিত যুবকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দেশে ফিরে এসে বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। এই বিয়ের সংবাদ শুনে বিরহকাতর নজরুল লিখেছিলেন:

"বাদল বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি

তোমার ঘরে আজ  উৎসবের বাতি

তোমার আছে হাসি আমার আঁখি জল

তোমার আছে চাঁদ, আমার মেঘদল।"

আরও চারজন নারীর সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের কথা শোনা যায়, যার সবই হয়তো একপাক্ষিক ছিল। এসব প্রেমকে অবশ্য প্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত করাই যুক্তিযুক্ত হবে। এঁরা হলেন উমা মৈত্র, রাণু সোম, শামসুন্নাহার এবং জাহানারা বেগম। গানে কবিতায় এঁদের জন্যও ব্যর্থ বেহাগ বেজে উঠেছে বারবার। কবি পাননি বলেই তাঁর বাঁশিও থামেনি:

"দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!

কূল মেলে না,—তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!

তোমায় পেলে থাম্‌ত বাঁশী,

আস্‌ত মরণ সর্বনাশী।

পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।

বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।"

                                              (গোপন-প্রিয়া)

 এই না পাওয়াই স্রষ্টার উজ্জীবনকে আরও স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছে।

       মীনাক্ষী দেবীকে বিয়ে করার পরই শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন প্রেমকেই খুন করেছেন, কেননা তারপরেই তিনি লিখেছিলেন: 'সোনার মাছি খুন করেছি ভর দুপুরবেলা'। প্রেম যে সোনার মাছি তা উপলব্ধি করতে তাঁর দেরি হয়নি। কিন্তু প্রেমে পড়া তো কখনোই থেমে থাকেনি। আর যে প্রেম নিষিদ্ধ, তাকে তো পাওয়ারও আশা নেই। তবু কিছু মুগ্ধতা, কিছু আকর্ষণ, কিছু স্মরণ আর চেয়ে থাকার মধ্য দিয়েই এই শূন্যতার নিবৃত্তি। তখনই লিখলেন 'পরস্ত্রী':

"যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো

যাবো না আর ঘরে

সব শেষের তারা মিলালো

আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না

ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না

বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো

কখন যেন পরে?

সবার বয়স হয়

আমার

বালক-বয়স বাড়ে না কেন

চতুর্দিক সহজ শান্ত

 হৃদয় কেন স্রোতসফেন

মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো

অচেনা,

কিছু চেনাও চিরতরে।"

        অভিমান আর যন্ত্রণা একসঙ্গেই কবির রক্তক্ষরণকে আরও তীব্র করে দিল। কুমারী প্রেমিকা যখন কপালে সিঁদুর পরল তখনই সে হয়ে গেল পরের স্ত্রী। তারপর তার প্রতি আর কোনো অধিকার আছে? কিন্তু প্রেম তা মানতে চায় না। অভিমানে বিচ্যুত হতে চায় প্রেমিকার আকাশ থেকে। হাজার হাজার তারার মাঝে তাই তাকে আর দেখা যাবে না। আজ তাই চেনা প্রেমিকাও  অচেনা হয়ে যায়। 'চাবি' কবিতায় প্রেমিকার হারিয়ে যাওয়া চাবি কবি যত্নে তুলে রাখেন। যে তোরঙ্গ নিয়ে চলে গেছে তাতো চাবি ছাড়া খুলবে না। কিন্তু এ চাবিই তো সেই প্রেম। তা কি আর ফেরত নেবে প্রেমিকা? কবি উপলব্ধি করেন:

 "অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে

তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো

লিখিও, উহা ফিরত্‍ চাহো কি না"

   এভাবেই প্রেমিক বহন করেন স্মৃতিকে, বেদনাকে, অশ্রুময় মুখচ্ছবিকে।

       প্রেমিকা যখন অন্যের স্ত্রী, তার সঙ্গে জীবনযাপন, তার সঙ্গে আড্ডামারা গল্পগুজব, বাদাম ভাজা খাওয়া, কোলে মাথা রেখে ঘুমানো, ওড়না কিংবা বেণী ধরে টান মারা, ঘর পর্যন্ত রেখে যাওয়া যখন আর সম্ভব নয়, তখন মনে মনে স্বপ্নেই সব কাজ সারতে হয়। ব্যর্থ প্রেমিকের স্বপ্নই মাধ্যম। স্বপ্নেই যা খুশি করা যায়। আদর করা যায়, অথবা চুমু খাওয়া যায়, অথবা আরও কিছু। জয় গোস্বামী 'স্বপ্নে' নামে একটি কবিতায় লিখলেন:

"স্বপ্নে তোকে বাড়ির দিকে এগিয়ে দিতে যাই

স্বপ্নে এসে দাঁড়াই পাড়ার মোড়ে

কখন তুই ফিরবি ভেবে চারিদিকে তাকাই

টান লাগাই তোর বিনুনি ধরে।


স্বপ্নে আমি ভিক্টোরিয়ায় তোর পাশে দাঁড়াই

স্বপ্নে বসি ট্যাক্সিতে তোর পাশে

স্বপ্নে আমি তোর হাত থেকে বাদাম ভাজা খাই

কাঁধ থেকে তোর ওড়না লুটোয় ঘাসে।


তুলতে গেলি – কনুই ছুঁলো হাত

তুলতে গেলি – কাঁধে লাগলো কাঁধ

সরে বসব? আকাশভরা ছাতে

মেঘের পাশে সরে বসল চাঁদ।


ক’টা বাজলো? উঠে পড়লি তুই

সব ঘড়িকে বন্ধ করল কে?

রাগ করবি? হাতটা একটু ছুঁই?

বাড়ির দিকে এগিয়ে দিচ্ছি তোকে…


স্বপ্নে তোকে এগিয়ে দিই যদি

তোর বরের তাতে কি যায় আসে?

সত্যি বলছি, বিশ্বাস করবি না

স্বপ্নে আমার চোখেও জল আসে!"

  প্রেমিকের চোখেও জল আসে বারবার স্বপ্নে! বাস্তবের উপলব্ধি স্বপ্নেও পৌঁছে যায় এবং সেখানে তা তখন স্বপ্ন-বাস্তব। স্বপ্নে এই পাওয়া mysticism এরই এক রূপ। ঘরেতে এল না সে যে, মনে তার নিত্য যাওয়া আসা।


      ব্যর্থ প্রেম অনেক সময়ই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তবু এই মৃত্যু যে শুধু আত্মহত্যা নয়, স্বেচ্ছামৃত্যু কিংবা স্বেচ্ছা নির্বাসন তা বলাই বাহুল্য। বেঁচে থেকেও মৃত-মনকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো। এ কী কম যন্ত্রণার! কবিতাতে সেসব কথাও উঠে আসে। না, কবি কবিতার কাছে বসে ছলনা করতে জানেন না। এই সময়ের কবি শ্রীজাত 'সাঁকো' কবিতায় সে কথাই লিখলেন:


"চলে গেলে কেন?’–এ-প্রশ্ন করা সোজা।

‘থাকলেই হতো’– এ-কথা বলাও সহজ।

দূর থেকে তবু কিছুতে যায় না বোঝা,

কার বেঁচে থাকা কতখানি ভারবহ।


মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকে যতদিন,

আমরা সকলে ধরে নিই, ভাল আছে।

ভিতরে ভিতরে আয়ু হয়ে আসে ক্ষীণ…

কে আর জীবনে বাঁচার জন্য বাঁচে!


ভিড়ের মধ্যে একা হয়ে যাওয়া লোক,

চড়া আলোতেও মনখারাপের ভয়।

চশমার নীচে ঢাকা পড়ে যায় চোখ…

অবসাদ কোনও কুশলকাব্য নয়।"

      যে অবসাদ বারবার ফিরে এসেছে বাংলা কবিতায় তার মূলে যে প্রেম ছিল, প্রেম চলে যাওয়ার পর এখন শুধু শূন্যতা কিংবা একাকিত্বের ভয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবিদের লেখায়। মৃতের মতো তাঁদের বেঁচে থাকা এবং প্রতিমুহূর্তে আয়ু ক্ষয় করা এ ছাড়া আর কী আছে? অভিমান ফুঁসে ফুঁসে উঠেছে। একাকী জীবনের পথ পরিক্রমায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত পথিককেই বারবার ঘুরে ফিরে আসতে দেখেছি।বিখ্যাত কবিরাও এই পথের পথিক হয়ে উঠেছেন। এমনি তাঁদের কিছু কবিতার পংক্তি:

   

১,

যাতায়াত: হেলাল হাফিজ

"কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না

রাত কাটে তো ভোর দেখি না,কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না;কেউ জানে না।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম

পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,

কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো।

যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি

মাথার কসম আবার এসো।

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো

শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,

চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি

বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।"

 কবিতার পরতে পরতে সেই অভিমানের মেঘ ঘন হয়ে জমে গেছে। জন্মাবধি ভেতরের রঙিন পাখিটি কেবল কেদেঁই গেছে। চৈত্র মাসের আগুনে হৃদয়ের বসন্তকাল পুড়ে গেছে। কেউ শীতল কলসের প্রেম-জল দান করেনি।

২, 

একা : বীথি চট্টোপাধ্যায়

"আমার চোখে বসন্ত দারুণ চৈত্রমাস

চতুর্দিকে শিমুল-পলাশ কৃষ্ণচূড়ার ত্রাস।


ঝড় উঠেছে নিখুঁত কালো বৃষ্টি ভেজা রাত

আঁচল দিয়ে দুঃখ ঢাকি কোথায় তোমার হাত ?

স্তব্ধ যদি ভালোবাসা প্রেমের-কম্পন

ফিরিয়ে দাও কিশোরীকাল প্রথম চুম্বন।"

    প্রেম বিহনে দুর্যোগপূর্ণ বসন্তকাল চৈত্র মাসের ঝড়ঝাপটায় সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়া কেউ আর ডাকেনি। সবাই যেন ত্রাস সৃষ্টি করেছে, অবিশ্বাসের ত্রাস। প্রথম জীবনের স্পর্শ, কম্পন ও চুম্বন আজ আর কে ফিরিয়ে দেবে? অভিমানাহত প্রেমিকা আজ গভীর ব্যথাতুর।


৩,

কষ্ট : রোদয়ান মাসুদ

"আমাকে কষ্ট দিতে চাও?

দাও!

আমি কষ্ট নিতেই এসছি।

আমাকে কাঁদাতে চাও?

কাঁদাও!

আমি কাঁদতেই এসেছি।

আমাকে হারাতে চাও?

হারাও!

আমি হারতেই এসেছি।

আমাকে সাগরে ভাসাতে চাও?

ভাসাও!

আমি ভাসতেই এসেছি।

আমাকে পোড়াতে চাও?

পোড়াও!

আমি পুড়তেই এসছি।

আমাকে বুকে টেনে নাও

নিবে না?

আমি সবকিছু সয়েই এসছি।"

    সব কষ্ট, সব যাতনা, সব দাহ সহ্য করেও প্রেম-সাগরে ভেসে থাকতে চান কবি। যাকে আত্মোৎসর্গ বলি, কবির কাছে তা আত্মবিসর্জনও। প্রেমে যে জয় নেই, আত্মবিসর্জনেই তার জয়।


  ৪,

ফিরে এসো চাকা-৭২: বিনয় মজুমদার

"যাক, তবে জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।

সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।

শুধু তার যন্ত্রণায় ভ’রে থাক হৃদয় শরীর।

তার তরণির মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের

গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস।

কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন

দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা; প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া

ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা।

যাক, সব জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।"

  'তার' 'তাকে' সর্বনামগুলিই যে প্রেমিকা গায়ত্রী দেবীর তা বলাই বাহুল্য। গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি বিভাগের এক সুন্দরী ছাত্রী। প্রেমে কখনো তাঁর দিক থেকে কবি কোনো সাড়া পাননি। কিন্তু তবুও ভালোবেসে ছিলেন আর সেই একপক্ষীয় ভালোবাসা বিচ্ছেদের বহু যোজন দূরত্ব রচনা করেছিল। কিন্তু কবি সামলে উঠতে পারেননি। এই ব্যর্থতার একটি প্রেমেই কবিকে সারাজীবনই অন্ধ করে দেয়। কবি মনে মনে তাঁর সঙ্গে সংসার পেতেছেন। আকাশ বাতাস জগৎজুড়ে তাঁকেই উপলব্ধি করেছেন। অর্থ-সুখ, যশ-খ্যাতি সব ত্যাগ করে এক কৃচ্ছ্র সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। কবিতায় ঢেলে দিয়েছেন সমূহ উপলব্ধিকে। প্রেমময় জীবনবোধের তীব্র আরোকে তৈরি করেছেন শব্দের দ্রবণ। নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এই প্রেমের ব্যর্থতার আগুনের যে যজ্ঞভূমি নির্মাণ করেছেন তা চিরদিন জাজ্বল্যমান হয়ে থাকবে। নির্ঘুম প্রহর হয়ে থাকবে প্রতিটি প্রেমিক হৃদয়েরই। কবির শেষ আবেদন:

"তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে

করাঘাত ক’রে ক’রে ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে

আড়ালে যেও না ; আমি এত দিনে চিনেছি কেবল

অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি—

ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত ।"

  এর থেকে কেউ পায় কি নিস্তার কখনো? কবিও পাননি। প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমিকও  পায় না ।

      

৫,

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর : রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ


"এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,

এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ

কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।

তুমি জানো নাই— আমি তো জানি,

কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান,

এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।


 বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,

এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।


 তুমি জানো নাই- আমি তো জানি।

মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,

মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে,

যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,

করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।


 পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,

চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।

তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,

পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।


 বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,

পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-

ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?

নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন?

কতোটা জীবন!!"

কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ(১৯৫৬-১৯৯১) আশির দশকের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কবি তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ এবং করুণ পরিণতির কথা আমরা জানি। যে ভগ্ন হৃদয়ের হাহাকার তিনি কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা প্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে। প্রেমের ক্ষরণ, দীর্ঘশ্বাস, তাপন, নির্বাসন সবই ফুটে উঠেছে কবিতায়। ক্ষয়, ভুল, ক্ষরণ, সন্ত্রাস, গ্লানি নিয়ে কবি স্তব্ধ, নির্বাক। বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে ভেবেছেন জীবন এরকমই। সুনীল রাত এসে ঠোঁট ছুঁয়েছে।এও তো সেই বিষ যা মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে কবিকে। চারিদিকে অবিশ্বাসের বাতাবরণে কুচক্রী কৌশলীর চক্র। কবি একাকী প্রেমবিহীন নীলঅভিমানে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। 'খুব কাছে এসো না' কবিতায় কবির আর একটি বিখ্যাত পংক্তি স্মরণযোগ্য:

"রাত্রি বলবে নেই, নক্ষত্র বলবে নেই

শহর বলবে নেই, সাগর বলবে নেই

হৃদয় বলবে- আছে ”

 এই না থাকার মধ্যেও থাকা মিস্টিসিজম এরই গভীর উপলব্ধি। প্রেমিক হৃদয় কখনোই শূন্যতাকে শূন্য হিসেবে গ্রহণ করে না। সুফি সাধক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন রুমি তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন:

"There is a candle in your heart,

      ready to be kindled.


There is a void in your soul,

      ready to be filled.


You feel it, don’t you?

You feel the separation

      from the Beloved."

অর্থাৎ তোমার হৃদয়ে একটি মোমবাতি আছে, জ্বলতে প্রস্তুত। তোমার আত্মায় একটি শূন্যতা আছে, পূর্ণ হতে প্রস্তুত। তুমিও এটা অনুভব করছ, তাই না? তুমি প্রিয়তমের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্নতা অনুভব করছ। এই বিচ্ছিন্নতাই আশাকে জাগিয়ে রাখছে। তাই শূন্যতার মধ্যেও পূর্ণের পরশ। প্রেমের বিচ্ছেদ যে প্রেরণাও দান করে তা আগেই দেখেছি। রুদ্র মুহাম্মদের কবিতায় 'বিষণ্ণ সুন্দর' একসঙ্গেই বিরাজ করছে। এই বিষণ্ণ সুন্দরকে ধারণ করেছিলেন বিখ্যাত কবি সিলভিয়া প্লাথও। তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেন:

“Perhaps someday I’ll crawl back home, beaten, defeated. But not as long as I can make stories out of my heartbreak, beauty out of sorrow.” অর্থাৎ সম্ভবত একদিন আমি বাড়িতে ফিরে হামাগুড়ি দেব, মারধর করব, পরাজিত হব। তবে যতক্ষণ না আমি আমার হৃদয় বিদারক ঘটনাটি প্রকাশ করতে পারি, দুঃখকে সুন্দর করে তোলে না। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি যে ফার্নেসের আগুনে নিজের মুখমণ্ডলকে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করা তা বুঝতে পারা যায়। রুদ্র মুহাম্মদও কি তিল তিল করে সেই স্বাদই পেতে চেয়েছিলেন?

                এসময়ের আর এক কবি ব্যর্থ প্রেমের উপলব্ধিকে যেভাবে বহন করে চলেছেন তা সরাসরি কবিতায় উল্লেখ করলেন। ব্যর্থ প্রেম যে স্বাক্ষর রেখে যায়, একটি সংবেদনশীল হৃদয়ের কাছে তা কম নয়:

 "কিছুই দাওনি তুমি

 এমন একটা ডাহা মিথ্যা, কখনো বলবো না আমি।

 তুমি

 একাকীত্ব দিয়েছো, নির্জনতা দিয়েছো, অবসাদ দিয়েছো—

   শয়ন স্বপন ভরে, স্মৃতির একরাশ পরিহাস দিয়েছো।"

 কবির নাম অরুণ মাজী। কবিতার নাম 'প্রেমে ব্যর্থতা  বলে কিছু নেই'। এটিই চরম সত্য, বাস্তবতার নিরিখে একে অস্বীকার করা যায় না। স্বপ্নময় যে রোমান্টিক মুহূর্তগুলি জীবনে দাগ কেটে যায়, তার বিচ্ছেদের পর শুধু স্মৃতিময় এক শূন্যতার বিরাট জগৎ বিরাজ করে। আর অবসাদ, নির্জনতা, একাকিত্বের ভার বহন করতে হয় সমস্ত জীবন। হয়তো কবিতা সৃষ্টির মুহূর্ত এগুলিই। এটা উপলব্ধি করেই পার্সি বিশি শেলি 'টু এ স্কাইলার্ক' কবিতায় লিখেছিলেন: 'Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.' কবিতা যে মধুর যন্ত্রণার গান তা সকলেরই জানা।

 সাম্প্রতিককালে ব্যর্থ প্রেমিকের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে চলেছে। ইন্টারনেটের যুগে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এসএমএস, ভিডিও কল, ফোন প্রেমের কত মাধ্যম। প্রেম যেমন সহজেই পাত্র-পাত্রী খুঁজে নেয়, তেমনি সহজেই তা ভেঙেও যায়। এর মধ্যেও কিছু প্রেম তো অবশ্যই সৎ, অবশ্যই তা হৃদয়ের আবেগ থেকে সঞ্চারিত এবং স্বপ্নমুকুলে প্রস্ফুটিত। সেই প্রেমের বিচ্ছেদবেদনা মনে দাগ রেখে যায়।  ব্যক্তিহৃদয়কে খান খান করে দেয়। কবি জসীমউদ্দীনের 'নকশিকাঁথার মাঠে'র রুপাই-সাজুর মতো সেসব প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো নকশিকাঁথা বোনে না, বাঁশিতে সুরও তোলে না। নকশিকাঁথার নায়ক-নায়িকারা হয়তো লেখাপড়া জানত না বলেই তারা ওসব করেছিল। কিন্তু আজকের দিনের নায়ক-নায়িকারা লেখাপড়া জানে বলেই কবিতা লেখে। চিঠি লেখে। মেসেজ পাঠায়। ফোনকল করে। ছবি আঁকে। তাদের হৃদয়শূন্যতায় কষ্টের মাছেরা যন্ত্রণার বুদবুদ তোলে। সেইসব শব্দই কবিতা হয়ে বেজে ওঠে। আসুন দেখি কেমন লিখছে এই সময়ের কবিতায় তাঁদের ব্যর্থ প্রেমকে? বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের এক ঝাঁক তরুণ কবির সাম্প্রতিকের লেখা ব্যর্থ প্রেমের কিছু উদাহরণ:

১, শাহারিয়ার ইমন:

"আজ আমার সময় কাটে বিষণ্ণতায়,

প্রতিটি মুহূর্ত থাকে অমানিশার আঁধারে ডুবে।

না ভাল লাগে গান , না ভাল লাগে কবিতা

তোমার শূন্যতা কী দিয়ে পাবে পরিপূর্ণতা।

রাত কি থাকে ভাল চাঁদ বিহনে

পাখি কি গায় গান একাকি ভুবনে।

নদী কি সুখ পায় সাগরের মোহনায় না মিলে,

তেমনি তোমাকে ছাড়া রহিব আমি কেমনে ।"


২, শফিক তপন:

"আমি বুঝি নাতো কেন 

মনটা আমার ছুটে চলে তোমারই পিছু পিছু,

যতই ভাবি ততই দেখি 

তোমায় আমি ভালবেসে পেলামনাতো কিছু।"


৩,ফয়জুস সালেহীন:

"‘আকাশ’ তুমি জান না বিচ্ছেদের কী স্বাদ !

তোমার বুকেতো চিরদিনই থাকে চাঁদ ।

মাঝে মাঝে তোমরা খেল মান-অভিমানের খেলা আমাবস্যায় চাঁদ না উঠিলে কিঞ্চিৎ পাও বিরহের জ্বালা ।

অভিমানের পালা শেষে

পূর্ণিমায় চাঁদ আবার ফিরে আসে

আমার চাঁদ যে চলে গেছে

সাত আসমানের অন্য এক আসমানের কাছে ।

শেষ হবে না আর তার অভিমানের পালা ,

এ হৃদয়ে থাকবে শুধু বিচ্ছেদের জ্বলা ।"


৪,পিন্টু পোহান:

"আর তুই সেদিনের পর থেকে

কথা বলা বন্ধ করে দিলি

বন্ধ করে দিলি সুপ্রভাত জানানো

প্রতিদিন ইনবক্সে ঢুকে ব‍্যর্থ হতে হতে একদিন

হাল ছেড়ে দিলাম আমিও।


তারপর কেটে গেল কত না বছর

ব‍্যর্থ প্রেমের ক্ষত মুছে নিয়ে এগিয়েছে জীবন জোয়ারে।

আজ তুই...

তুই ফোন করে বললি তুই ভালো নেই।

আমার ব‍্যগ্রতা দেখে বললি, থাম! থাম!

সময় না হলে রোগ কিছুতে সারে না

তুই যে অপেক্ষাই করতে শিখলি না!

এতই অসহ‍্য তোর আমার এই গার্হস্থ্য জীবন!"


৪,শুভেন্দু বিশ্বাস: 

"তুমি কি জানো আমি কবি হয়ে গেছি ?

তোমাকে নিয়ে হাজার কবিতা লিখেছি,

যখন আমি কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করি

শুধু তোমাকেই বারবার খুঁজে পাই।"


৬, পুলক মণ্ডল:

"কখনো সখনো মনখারাপ করা সময় 

ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে নামতে থাকে হৃদয়জুড়ে—

কখনো সখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি 

পড়তে থাকে মনখারাপ করা পদ্মপাতাজুড়ে"


৭, নিলুফা জামান:

 "স্মৃতির ভেতরে জেগে আছো আজও

 ফিতে ক্যাসেটের ধুলো ঝেড়ে বুঝতে পারি

 থেকে থেকে বেজে উঠো—একাই বাজো

 হয়নি বাড়াবাড়ি, হয়নি কোনো আড়ি।"


৮, অলক জানা:

 "সচেতন অবহেলা রাত্রি চেয়ে কম কিছু নয়! সাজানো অপেক্ষার ভেতর ডানা মেলে অনন্যোপায়, অনিবার্য কিছু ঘটে যাওয়ার আগে কবি ফিরে গেছে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি ফেলে।

 আটকাতেই পারতে ভালোবেসে, নিরাময় হয়তো চাওনি বলে ছায়ার বিষে নীল হয়ে গেছে একটি আলোর মতো একজন কবি।"


৯, অনিমেষ মণ্ডল:

"তুমি আমাকে বৃষ্টি বলে ডাকার জন্যে বলেছিলে

আমি কখনো সেভাবে প্রকাশ্যে ডাকিনি বলে

        তুমি আজ মেঘনারী

         আকাশে বিস্তীর্ণ ডানা মেলে

 অন্য কোনো মেঘের সন্ধানে গেলে


এখন বাইরে প্রবল বৃষ্টি

জানালা দিয়েছি খুলে

কবিতার পাতা ভিজে যাচ্ছে ছাট্ জলে


তোমার কবিতা তুমি নাও

খাতাটুকু ভরে থাক নীরব ফসিলে।"


১০, শিশিরকুমার সামন্ত:

"আজ তোমায় নিয়ে একটি আকাশ লিখবো,

ঘাসের উপর মুক্তো ঝরা

তার উপর তোমার পায়ের স্মৃতিচিহ্ন

বলে গেছে, আরও একবার দেখা হবে সন্ধে নামার আগে।

আজ আকাশ হলো লালে লাল,

পাখির খেয়ালী দল ফিরেছে আপন ঠিকানায়,

কান্না ছড়িয়ে ক্লান্ত মেঘও ফিরে গেছে ঘরে,

অনেক দিন পর সন্ধ্যা নামলো চোখে।

আমি খুঁজলাম,

আমি দেখলাম,

শুধু বুঝলাম না এক রেখার বিন্দুও

তুমি এলে না কেন?

আজ তোমায় নিয়ে একটি আকাশ লিখবো,

তোমার নামে উড়িয়ে দেবো প্রাণবায়ুর শেষ নিঃশ্বাস ;

তুমি তখনও উড়ে যাবে দূরে...

অনেক দূরে...

অসীমের দিগন্তে...,

যেখানে আমার মৃত্যুর গন্ধ পৌঁছবে না তোমার খোলা চুলে,

আজ তোমায় নিয়ে একটি আকাশ লিখবো...।"


১১, মানস চক্রবর্তী:

 "তারপর চাঁদ মরে যায়

 রাত চলে যায়

 তবুও আমার বিবৎসা হৃদয়

 প্রতি রাতে বুড়ো বকুলের নিচে

 এসরাজ বাজায়।"


১২, শান্তনু গুড়িয়া:

 "বিবর্ণ পালক, বিবর্ণ স্মৃতি

 স্মৃতি রোমন্থনে নেই ক্ষতি

 খেলা শেষে পাখিদের যখন

 উড়ে যাওয়াটাই রীতি।


 ধুলো থেকে কুড়িয়ে আনা পালক

 যত্ন করে তুলে রাখা বুকের সিন্দুকে

 কাল ছিল গাল ভরা হাসি গান কলতান

 আজ গেছে সবকিছু চুকেবুকে।"


   প্রতিটি ব্যর্থ প্রেম কবিকে আত্মমুখী নির্বাসনে পৌঁছে দিয়েছে। উদ্দাম চঞ্চলতা কেড়ে নিয়ে স্তব্ধ নীরবতায় দার্শনিক করে তুলেছে। সৃজন বেদনার আলো-অন্ধকারে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। স্মৃতি রোমন্থনে কবিরা কোথাও আকাশ, কোথাও গাছতলা, কোথাও অন্ধকার রাত্রিতে হিসেব নিকেশে মত্ত হয়েছেন। শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন: 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।' আবার এই দূরত্বই কাছাকাছি নিয়ে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গান লেখিকা এবং সঙ্গীতজ্ঞী শিল্পী ডোনা লুইস তাঁর একটি বিখ্যাত গানে এ কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন:

"I love you, always forever

Near and far, close and together

Everywhere, I will be with you

Everything, I will do for you."

                       (Donna Lewis)

 অর্থাৎ আমি তোমাকে সবসময় ভালবাসি, কাছাকাছি এবং দূরে, কাছাকাছি এবং একসাথে সব জায়গায়, আমি তোমার সাথে সবকিছুতেই থাকব, আমি তোমার জন্য সবকিছু করব। তখনই বুঝতে পারি মান-অভিমানের ভেতরও, নিকট বা দূরের ভেতরও, গাছতলা অথবা অট্টালিকার ভেতরও, আকাশ অথবা মাটিতেও, সকাল অথবা সন্ধ্যাতেও এই প্রেমকে স্মরণ করে কবিতা লেখেন কবিরা। মৃত্যু এবং জীবনের মাঝখানে যতটুকু তাঁর সময়, যতটুকু তাঁর পথ, যতটুকু তাঁর বলা, যতটুকু তাঁর না বলা—সবই কবিতাময় হয়ে থাকে।

 শেষে একথা বলতেই হয়. সব সার্থক প্রেমের কবিতাই  ব্যর্থ প্রেমের কবিতা।সব প্রেমে ব্যর্থ কবিরাই তা লিখতে পারেন। আমরা প্রথমেই জেনেছিলাম প্রেমের প্রাণ বিরহে, বিচ্ছেদে, মৃত্যুতে। মিলনে বা বিবাহে, ভোগে বা সহবাসে প্রেম কখনো বাঁচতে পারে না। এই কথা ভেবেই বাংলাদেশের বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ঔপন্যাসিক কবি হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন:

"প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বলতে বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায়নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বলতে বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে।” এই সত্যটি মেনে নিলেই প্রকৃত প্রেমকেও আমাদের সম্মান জানানো হবে।