প্রাবন্ধিক রামপ্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ





 “পহেলা প্রহর মে সবকই জাগে

দোসরা প্রহর মে ভোগী

তিসরা প্রহর মে তস্কর জাগে

চৌঠা প্রহর মে যোগী।”

সুসাহিত‌্যিক শ্রদ্ধেয় রমাপদ চৌধুরীর ‘প্রথম প্রহর’ উপন‌্যাসটি থেকে ওপরের উদ্ধৃতিটুকু দিলাম। লেখকের শৈশব, কৈশোর যে যে রেলওয়ে শহরে কেটেছে, আমারও জন্ম, শিক্ষা সবই সেই শহরে। যেখানে আমার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা সেখানের সেই সময়ের সুখ-দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ আপনাদের শোনাবো।

আমাদের ছেলেবেলা ছিল কতশত স্বপ্নের রঙে রঙিন। দুর্গা পুজো একটা আলাদা গন্ধ, ভিন্ন মাদকতা নিয়ে আসত আমাদের কাছে। বাবা-কাকারা রেলওয়ের বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। সমাজসেবা তাঁদের জীবনের মূল মন্ত্র ছিল। বাবা-কাকা আর তাঁদের সতীর্থদের উদ‌্যোগে আমাদের রেলওয়ে কলোনীর পাড়ায় প্রথম দুর্গা পুজো শুরু হয়।

প‌্যান্ডেল বা প্রতিমার জাঁকজমকের চেয়ে পুজো-উপচারের প্রতি সবারই দৃষ্টি সজাগ থাকতো। মায়ের পুজোয় কোথাও যেন কোনও ত্রুটি না হয়। দেবীর বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত পুজো পরিচালনার ভার যাদের ওপর থাকত-তাদের সর্বদাই তটস্থ দেখতাম। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে সন্ধিপুজো, বলিদান হতো।

আজ বয়োপ্রান্তে এসেও পুজোর ক’টা দিন ভোরবেলায় ফুল তুলতে যাবার সেই পুরনো ডাক যেন শুনতে পাই। কবিগুরুর ভাষায় “পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে মোরে...।”

আমাদের ছেলেবেলায় এখনকার মতো বাজারে অঢেল ফুল কিনতে পাওয়া যেত না। তাই তো রাতের শেষ প্রহরে পুজো প‌্যান্ডেল থেকে মাইকে ঘোষণা করা হতো—

“ফুল তোলার সময় হয়ে গেছে। খোকা-খুকুরা সব চটপট উঠে পড়ো, সাজি ভর্তি করে ফুল তুলে আনো মায়ের পুজোর জন‌্যে।” মাইকে বারবার এই ঘোষণা করা হতো।

পুজোর ক’টা দিন আমরা সারারাত প্রায় জেগে কাটাতাম। ভোরবেলায় মাইকের এই ঘোষণাটুকু শোনার অপেক্ষায় থাকতাম। তখনকার দিনে ঘরে ঘরে ফুল তোলার সাজি থাকতো, এখনকার মতো পলিথিন ব‌্যাগ নয়। অন্ধকার থাকতে থাকতে আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়তাম-এ গাছ, ও গাছ, এর বাগান, তার বাগান চষে ফেলতাম ফুলের জন‌্যে।

শিউলিতলায় ফুল কুড়ানোর ধুম বেশি করে পড়তো। গাছের তলা শিউলি ফুলে ভরে থাকতো, গাছ নাড়া দিলে টুপটাপ করে শিউলি ফুল ঝরে পড়তো। আমরা আঁজলা করে সে ফুল তুলে সাজি ভরাতাম। এছাড়া টগর, জবা, কাঞ্চন, কাঠচাঁপা, স্থলপদ্ম, অপরাজিতা, দোপাটি, মাধবলীতা তো থাকতোই। পুজো প‌্যান্ডেলে মায়ের সামনে তিন-চারটে বড় বড় ঝুড়ি রাখা থাকতো। আমরা ফুলগুলো সেই ঝুড়িতে ঢেলে দিতাম। দেখতে দেখতে নানান রঙের নানান গন্ধের ফুলে ঝুড়িগুলো ভরে উঠতো। আমাদের শিশু মনে এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ এসে জাগতো।

এখানে বলে রাখা দরকার, সে সময় আমরা সমবয়সি ছেলেমেয়েরা অবাধে মেলামেশা করতাম। একে অন‌্যের বাড়ি যেতাম। মা, দিদিমা, ঠাকুমার হাতের তৈরি মোয়া, নাড়ু, পিঠে-পায়েস খেতাম। কাজেই দুর্গা পুজোর ক’টা দিন আমাদের এই মেলামেশা এক নির্মল আনন্দ এনে দিতো সবার মনে।

পুজোর সব ক’টা দিনই আমরা পুষ্পাঞ্জলি দিতাম খিদে-তেষ্টার বালাই ভুলে। পুরুত মশাইয়ের উদাত্ত কণ্ঠে সংস্কৃত ভাষায় বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ আমাদের মনে ভক্তি রসের সঞ্চার করতো। মন্ত্রের মানে হয়তো তখন বুঝতাম না, তবু সে মন্ত্রগুলো কানে আজও ভাসে-

“আয়ুদ্দেহি যশো দেহি ভাগ‌্যং ভগবতী দেহি মে

পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্বান কামাশ্চ দেহি মে...

এষ সচন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি

ওঁ শ্রীশ্রী ভগবতী দুর্গা ঐ নমঃ।”

ভলেনটিয়ারের খাতায় আমরা সবাই নাম লেখাতাম। ভোরবেলায় ফুল তুলে আনার পর আমাদের ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হতো। এভাবে শুরু হতো আমাদের দিন। তালপাতার ঠোঙা বানানো, ফল কাটা, নারকেল কোরানো, প্রসাদ বিতরণ, তিনবার প্রসাদ দেওয়া হতো। সকালে ফল প্রসাদ, দুপুরে খিঁচুড়ি ভোগ, সন্ধ‌্যেবেলায় লুচি আর মোহনভোগ প্রসাদ। এছাড়া সন্ধ‌্যেবেলায় ঠাকুর দেখতে আসা মানুষদের ভিড় সামাল দেওয়া, কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে যেতো-আমরা বুঝতে পারতাম না।


।দুই।

আমাদের সময়টা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণালী যুগ। হেমন্ত, লতা, সন্ধ‌্যা, শ‌্যামল, তরুণ, আলপনা, প্রতিমা, উৎপলা, সতীনাথ, মানবেন্দ্র, দ্বিজেন, ধনঞ্জয়, পান্নালাল, তালাদ মামুদ, সুবীর, মান্না দে-এঁদের গানে আমাদের ভুবন ভরে থাকতো। পুজো প‌্যান্ডেলে এঁদেরই গান বাজানো হতো। হিন্দি গান একটাও না।

রেডিওতে তখন শনি ও রবিবারের দুপুরে অনুরোধের আসরের দুর্নিবার আকর্ষণ চলছে। সে সময় অনুরোধের আসরের অমোঘ আহ্বানে স্কুল, কলেজ, অফিস, দোকান, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো। প্রত‌্যেকেই দুপুর ১.৪০ মিনিট থেকে ২.৩০ মিনিট এই পঞ্চাশ মিনিটের জন‌্যে রেডিওর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতো। সে সব দিন ছিল বটে।

পুজোর দিনগুলোর মাঝে শনি ও রবিবার পড়ে গেলে মজার শেষ থাকতো না। দু’দিনের অনুরোধের আসরকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা হতো। সেদিনের অনুরোধের আসরে কোন শিল্পীর কোন গান বাজানো হবে তার সম্ভাব‌্য তালিকা পুজো কমিটির কাছে জমা দিতে হতো। মাইকে অনুরোধের আসরে বাজানো গানের শিল্পীর নাম এবং গান যার পছন্দের তালিকার সঙ্গে সর্বাধিক মিলতো-তাকে প্রথম এবং একমাত্র বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হতো। তাই পুজোর মাঝেও দু’দিনের অনুরোধের আসরকে ঘিরে সে কী উৎসাহ উদ্দীপনা সবার। বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর বিজয়া সম্মেলনীতে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হতো।

আজও সেই পুরনো দিনের গানের নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি।

বিজয়া দশমীর দিন সকাল থেকে আমাদের মনে বিষাদের রাগিণী বেজে উঠতো। পুজো প‌্যান্ডেলে এসে কতোবার যে প্রতিমা দেখে যেতাম, তা গুণে শেষ করা যেতো না। আর প্রতিবারই মনে হতো মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চোখ ছলছল করতো। সন্ধ‌্যেবেলায় ঢাকের কাঠিতে যখন বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠতো, ‘ঠাকুর থাকবে কতোক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’ তখন আমরা আমাদের কান্না চেপে রাখতে পারতাম না। সত‌্যি সত‌্যিই কেঁদে ফেলতাম। কান্নাভেজা গলায় সমস্বরে বলে উঠতাম, ‘আসছে বছর আবার হবে।’


।তিন।

‘পুরনো সেই দিনের কথা’ ভাবতে গেলে আরও কতো যে স্মৃতি এসে মনের মাঝে ভিড় করে তার আর শেষ নেই।

স্কুলে গরমের ছুটি পড়লে যতো সব দস‌্যিপনা শুরু হতো আমাদের। তাতে বাবা-কাকাদের আস্কারা কম ছিল না।

দুপুর হতেই ছিপ হাতে রেলওয়ের পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়া। ছিপ দিয়ে পুঁটি, বেলে কিংবা শোল মাছ ধরা। জোড়া বড়শিতে যখন জোড়া পুঁটি মাছ ধরা পড়তো, তখন আমাদের আনন্দের ইয়ত্তা থাকতো না। আর শোল মাছ ধরার জন‌্যে কি না করেছি। বড়শির মাথায় ছোট ছোট ব‌্যাঙ ধরে গেঁথেছি। আরশোলা ধরে শিশিতে ভরে রাখতাম। তাও বড়শির মাথায় গেঁথেছি। তাছাড়া গুগলি শামুক তো ছিলই। এ সবই শোল মাছ ধরার অব‌্যর্থ খাদ‌্য যাকে বলা হয় ‘চারা’।

রঙিন কাগজ আর ঝাঁটার কাঠি দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো। ভর সন্ধ‌্যেবেলায় আমরা বন্ধুরা যে যার লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিতাম, ঘুড়ি আকাশের দিকে যতদূর যায় চলে যেতো। এক সময় ঘুড়ি ছোট হতে হতে আকাশে মিলিয়ে যেতো। আমরা কল্পনায় আকাশের তারাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করতাম।

বছরে একবার গরমের ছুটিতে কাঁসাই নদীর তীরে চড়ুইভাতি করতে যেতাম দলবেঁধে। শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে। আমরা সাইকেলে যেতাম। পিকনিকের সব সরঞ্জাম সাইকেলে বেঁধে নিয়ে যেতাম। নদীতে স্নান করা, গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরা, বালির পাহাড় তৈরি করা-চড়ুইভাতির আনন্দকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতো।

বর্ষাকালে মাঠে ময়দানে ঘুরে ‘বীরবাবটি’ ধরে আনা, সবুজ কচি ঘাসের মধ‌্যে এরা ঘুরে বেড়াতো। সিঁদুরের মতো লাল টুকটুকে আর ভেলভেটের মতো নরম ছোট ছোট পোকাগুলো দেশলাই বাক্সে পুরে রাখতাম।

সরস্বতী পুজো হয়ে গেলেই বন্ধুরা মিলে সাইকেলে বেরিয়ে পড়তাম শহর ছাড়িয়ে বনে-বাদাড়ে টোপা কুলের সন্ধানে। কোচড় ভর্তি টোপা কুল পেড়ে আনতাম। কুল গাছের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, তবু কুল পাড়ায় ক্ষান্ত দিইনি। এমন ছিল আমাদের বাল‌্যকাল।

তাই আজ বয়োপ্রান্তে এসে ফেলে আসা স্মৃতি যখন মনের মাঝে ভিড় করে, ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ মনে পড়ে যায়, তখন আপন মনে বলি—

“পড়ে আছি আমি একা

বয়সের ভারে

ফেলে আসা স্মৃতিগুলো

কাঁদায় আমারে।

তবুও চায় যে মন

ফিরে পেতে প্রতিক্ষণ

বিগত দিনের সব

মধুর স্বপন।”

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024