Tuesday, October 31, 2023

পরিমলের পরিণয় বন্ধনের পরিণতি - তপন তরফদার || Porimoler porinoy Bondhoner porinoti - Tapan Tarapdar || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 পরিমলের পরিণয় বন্ধনের পরিণতি

              তপন তরফদার

 


        পরিণয়বন্ধনে পা না গলালেই মানুষ সুখে থাকে। এই বিষয়টি পরিমল কে বোঝানো গেলোনা। বিয়ে না করলে মানুষ সুখে থাকে কথায় কথায়, এক দিন একটু অন্যভাবে কথাটা পরিমলের কাছে পারলাম। পরিমল আমাকে সেই গানের কথা বলে দিল, ‘দাদা মেলা থেকে বউ এনে দে।‘ আমরা গণেশ ত্রিপল সাপ্লাইয়ের কর্মচারী। আমার আর প্রদীপের অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তখন পরিমলকে কিছুই বলতে পারলাম না। ওর ঘটক এসে বলল, ভালো খবর আছে বাগনান থেকে একটা ভালো মেয়ের ছবি এনেছি, যাতায়াত বাবদে দুই শত টাকা দেবেন। কিছুক্ষণ আগেই খদ্দেরের সঙ্গে তর্কাতর্কি করেছে পরিমল মেজাজটা এখনো খিঁচড়ে আছে। একটু উঁচু গলাতেই বলে ওঠে ছবি পছন্দ হলে টাকা নয়তো লবডঙ্কা। আমার সঙ্গে চালাকি চলবে না। আমরা ওর দিকে তাকাতে লজ্জা পেয়ে গিয়ে আস্তে করে বলে, ছবিটা বার করুন। পরিমলকে বলতে পারলাম না পরিমল দুর্গতি আছে তোমার কপালে।   


         আজ সোমবার পরিমল ডুব মেরেছে, কাজে আসেনি। মঙ্গলবার কাজে এসে প্রথম কথা দাদা সব ঠিক করে এসেছি এই শ্রাবণ মাসের শেষ লগ্নে বিয়ে। আপনারা সবাই আমার সঙ্গে বরানুগমনকারী হবেন। আমাদের জীবনযাত্রা বর্বর জীবন-যাপনের থেকেও খারাপ। এখানে বরযাত্রীর কথা তো ভাবাই যায় না। বিয়ের নেমন্তন্ন পাড়ায় এখনো জোটে কিন্তু বরযাত্রীর নেমন্তন্ন, ভুলেই গেছি।নিজেদের বিয়ে ছাড়া খুব একটা ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ভি আই পি লোকদের সঙ্গে আমাদের নাম খুব একটা উঠে না। ঠিক করলাম খুব সাজগোজ করে বরযাত্রী যাব। আমরা আলোচনা করতে লাগলাম কতখানি গম্ভীর হয়ে থাকবো না হাসি হাসি মুখ করে বিয়ের আসরে বসে থাকব। পরিমল ফোন করে বলে আপনারা কিন্তু অতি অবশ্যই আসবেন। মেয়ের বাবার নাম বিশ্বনাথ সিং, বাগনানের পঞ্চাননতলায়। আপনারা সিধে পঞ্চাননতলায় চলে আসবেন।


 


       প্রদীপ আর আমি এক সেট ধুতি পাঞ্জাবি এনেছি ওটা পরেই বরযাত্রী যাবো অন্তত একদিনের জন্য বর্বর থেকে প্রবর হবো।


         অফিস থেকে সাজুগুজ করে বেরালাম। বাসে ভিড় নেই সব বাস ফাঁকা। বাসেরাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন। কি করা যায়, সেই এগারো নং বাসেরই শরণাপন্না হয়ে হাঁটতে লাগলাম। বড়বাজার থেকে হাওড়া ব্রিজে ওঠার মোড়টাতে বাসগুলো হঠাৎ সচল হয়ে গেল। প্রদীপ একটা বাসের হাতল ধরে ঝুলে পড়ে বলে, ভবানীদা উঠে পড়ুন। নিমাই দৌড়ে উঠে পড়ল, আমি একটু ছোটার চেষ্টা করতেই বুঝলাম কাপড়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে, কোনো উপায় না দেখে পিছনের বাসটাতেই উঠে পড়লাম। চটিটা খুলে পাদানি তে আটকে গেল। কোনোরকমে চটিটা গলিয়ে নিলাম। বাসের হাতল ধরে বাসের হেলপারের মতো হাত নাড়িয়ে সিগন্যাল দিতে লাগলাম। আগের বাস থেকে নিমাই ও পাকা ট্রাফিক পুলিশের মত ইশারা করতে লাগলো। দুটো বাসই হাওড়া ব্রিজ পার করে একসঙ্গে থামল।আমি ধপাস করে বাস থেকে লাফিয়ে নামলাম। খেয়াল করিনি ওখানে জল জমেছিল।ঝপাস করে জল চারদিকে ছিটকে গেল, চটি দুটো পুরো জলের তলায়। পাশের সহযাত্রী নিজের প্যান্টের জল ঝাড়তে ঝাড়তে এমনভাবে তাকাল তার থেকে কয়েকটা গালাগালি দিলে খুশি হতাম। নিমাই বলে তাড়াতাড়ি চলুন, মেচেদা লোকাল আর দশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে তিন জনেই দৌড়োতে লাগলাম। আমাদের দুজনেরই কোঁচা লুটোপুটি খাচ্ছে।


      টিকিট কাউন্টার না হাওড়ার হাট। টিকিট কাটতে গেলে কম করে এক ঘন্টা লাগবে। রেল কোম্পানি বেকার সমস্যা দূর করার জন্য কিছু দালাল রেখেছে কাউন্টারের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে। ওদের থেকে টিকিট নিয়েই দে দৌড়।


        ট্রেনের ভিড় দেখার মতো। ট্রেনের ভোঁ দিয়ে দিয়েছে। শেষের কামরাটায় সবাই ঝুলছে। একটু এগিয়ে আগের কামরাটা ধরবো বলে এগোতে যাব আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ধুতি পরে আছি, চটিটা পুরো ভেজা, এখনোও যেছিঁড়ে যায়নি আমার ভাগ্যি ভালো। জয় মা কালী বলে ট্রেনের হাতলটা ধরলাম। আর কিছু করতে হলো না, পিছন থেকে পর পর এমন চাপ গায়ে পরলো একদম চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি নিশ্চিত, ধুতি নিশ্চয়ই আমার কোমরে নেই। খুঁটটা কোথায় চলে গেছে কে জানে। প্রদীপ নিমাই কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। নিজের হাতও নাড়তে পারছিনা, পায়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি বরযাত্রী না হলে এমন বর্বর যাত্রা করতে হতো না। হঠাৎ খেয়াল হলো মানিব্যাগটা ঠিক আছে তো, নিজের ধুতি দেখা যাচ্ছে না গায়ের পাঞ্জাবিটা আছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মানিব্যাগটা। একটা উপায় বার করলাম পাঞ্জাবির পকেটটা কোমরের ডান দিকে আছে, পাশের যাত্রীর গায়ে চাপ দিয়ে স্পর্শ অনুভূতির দ্বারা বুঝে নেব মানিব্যাগটা আছে না গেছে। যেই একটু চাপ দিয়েছি ওমনি চিল চিৎকার, ঠিক করে দাঁড়ান মশাই। ঠিক করে যখন দাঁড়াতে পারেন না ট্রেনে কেন উঠেছেন। এই সময়ে যা বলতে হয় তাই বললাম, আমি নয় পেছনের লোক ঠেলছে। কি করি বলুন। মনে মনে ঠিক করলাম, বাগনান স্টেশনে নেমে যদি ধুতি অক্ষয় থাকে তবে আর বাঙালি স্টাইলে পড়বো না মাদ্রাজি স্টাইলে লুঙ্গির মতো পরবো ওইটিও একটা স্টাইল হবে। 


       প্রায় এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ আসলো বাগনান আসছে। আওয়াজ শুনে বাঘের নাদের কথা মনে পড়ে। এ ওকে গজরাচ্ছে, তরপাচ্ছে। কামরার সবাই এই বাগানের ফুল তুলতে এইখানেই নামবে। আমার সামনে দাঁড়ানো যাত্রী বলল কোন চিন্তা করবেননা। গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। যা করার আমরা করে দেব। আপনি স্টেশনে সেফ ল্যান্ডিং করবেন। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াবার আগেই পিছন থেকে এমন গুঁতো মারতে শুরু করলো সামনের মানুষ গুলো টুপটাপ করে পড়তে লাগলো। কেউ যদি হড়কে যায় পিছনের জনই তাকে টসকে দেবে। ভাগ্য ভাল আমি ব্যালেন্স করে সামনের দিকে প্রায় দশ কদম এগিয়ে গেলাম। ধুতির একটা খুঁট কোমরে, বাদ বাকিটা মেয়েদের ওড়নার মত দুলছে।


        তাড়াতাড়ি ধুতিটা জড়িয়ে নিলাম। প্রদীপ ডাকতে শুরু করেছে," তুমি কোথায়, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়।" আমি হাত উঁচু করে গানের সুরে বললাম, "আমি এইখানে। এইই খানে।" প্রদীপ বলল, ভবানীদা স্টেশন থেকে বেরাবার আগে ধুতিটা ভালো করে পরে নিন। আমিও পরে নিচ্ছি। প্রদীপ ধুতিটা খুলে আবার পরতে শুরু করলো। আমরা দুজনে আড়াল করে দাঁড়ালাম। পাবলিকরা যেতে যেতেই হাঁ করে দেখতে লাগলো, যেন সিনেমার দৃশ্য দেখছে। দেখুক আমাদের তো কেউ চিনতে পারছে না। মফস্বলের বিয়ে বাড়ি, নিজেদের পোশাক ঠিক রাখতেই হবে। শহুরে বাবু বলে কথা।  


         স্টেশন থেকে বেরোতেই সবাই টানাটানি করছে তাদের সওয়ারি হওয়ার জন্য। এমন ভাব করছে যেন আমারা ওদের কতদিনের চেনা। একজন রিকশাচালক কে দেখেই বুঝলাম অভিজ্ঞ রিকশাচালক। চশমার ফ্রেমটা লালকার দিয়ে শক্ত করে মাথার পিছনে গিঁট বাঁধা। চশমার কাচটা টিক যেন সোডার বোতলের নিম্নাংশ থেকে কেটে কাচটা চশমার ভিতরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। দুটো চোখই বড় হয়ে ভাসছে। একেই পছন্দ করলাম কারণ আর যাই হোক চশমাটা চোখ থেকে খুলে যাবে না। রিকশাচালক কে বললাম পঞ্চাননতলায় যাবে। রিকশাচালক বলল বড় পঞ্চাননতলা না ছোটো পঞ্চাননতলা। যাঃ বাবা, কটা পঞ্চাননতলা আছে কোনটায় যেতে হবে সেটাও তো আমরা জানিনা। কি করা যায়। নিমাই মোবাইল বার করে পরিমলকে ফোন করে, উত্তর আসে, ‘আপাতত পরিসীমার বাইরে’।


         একজন খুবই উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল ওটা বড় পঞ্চাননতলাতেই হবে। ওখানকার সবারই নাম ওই বাবা বিশ্বনাথের নাম মিলিয়ে রাখা হয়। আমরা এখন সমস্ত সীমানা, পরিষেবার বাইরে চলে এসেছি। বরযাত্রী না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া বোকামি হবে।


        আমি বলে উঠলাম বিশ্বনাথ সিং এর বাড়ি যে পঞ্চাননতলায় সেই পঞ্চানন তলায় যাব। আমাদের কথা শুনে একজন রিকশাচালক খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ওটা বড় পঞ্চাননতলাতেই হবে। ওখানকার সবারই নাম ওই পঞ্চাননের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। আমার রিকশোয় উঠুন পঞ্চাশ টাকা ভাড়া লাগবে। দরদাম ইচ্ছা করেই করতে লাগলাম কারণ দুটো রিকশোয় একশো টাকা খরচা । অনেক দরদাম করে ওকে বললাম ঠিক আছে পঞ্চাশ টাকাই দেবো। তিনজনে যাবো। নিমাই কিছুতেই তিনজনে এক রিকশায় যাবেনা। প্রদীপ বলে, ওরে বিয়েবাড়ির একটু দুরে নেমে যাব। বিয়ে বাড়ির আগেই আমরা নেমে গিয়ে পোশাক-আশাক ঠিক করে নেব। চুলটুল আঁচড়ে নেব।  


            রিকশাচালকের ধূসর লম্বা দাড়ি দেখে মনে হবে সাধক। যেকোনো মুহূর্তেই সাধনায় বসে যাবে। রিকশা চলতে শুরু করল বুঝলাম খুব ভুল হয়ে গেছে। নিমাই তো আমাদের দুজনের হাঁটুর উপর বসেছে, হাঁটুর উপরে যে এত চাপ পড়বে তা বুঝতে পারিনি। গর্তে পড়ে রিকশা যখন টাল খাচ্ছে সবাই টলছে। সবাই তখন দুলছে। হাওয়ায় দাড়ি উড়ছে একবার তো খপ করে রিকশাওয়ালার দাড়িটাই নিমাই খামচে ধরল। দাড়ির বিটকেল গন্ধ নাকে এসে লাগছে। নাক তো ঢাকার উপায় নেই। রাস্তার সব পাবলিক হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে, যেন কার্তিক ঠাকুর যাচ্ছে। অনেক কসরত করে অবশেষে রিকশা বড় পঞ্চানন তলায় হাজির।


        ছোটো একটা চা সহ মিষ্টির দোকান। টিম টিম করে হারিকেন জ্বলছে। কয়েকজন দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চে বসে বিড়ি ফুঁকছে গুলতানি মারছে। নিমাই এক লাফে নেমে জিজ্ঞাসা করলো, বিশ্বনাথ সিং এর বাড়ি কোনটা। আমরা বিয়ে বাড়িতে যাব। দোকানদার বলল বড় বিশু না ছোট বিশু। নিমাই কি বলবে ভেবে পেলনা। প্রদীপ বলে উঠলো তা জানিনা। আমরা আসছি বরযাত্রী হিসাবে, সহকর্মীর বিয়েতে। বেঞ্চির একজন বলল, যার বিয়েতে দেনা পাওনা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল। নিমাই বলে তাতো জানিনা। দোকানদার বলে ওই বাঁদিকের মোরম রাস্তা দিয়ে পাঁচ মিনিট এগোলেই বিয়ে বাড়ি পড়বে। রিকশাচালক আর যেতে চায়না, বলে পঞ্চাশ টাকায় অনেকটা এসেছি আর যাব না। বেঞ্চিতে বসে থাকা লম্বু একজন রহস্য করে বলে, সিধে গেলে ও হয়তো আরো একটু এগিয়ে দিত। টাকা নিয়েই তো ও ওই ঠেকে বসবে। আমি বললাম, কোন ঠেকে ভাই? উত্তর পেলাম, সিধে গেলে হাঁড়িয়ার ঠেক আছে, বিয়েবাড়ির নাম করে ও হাঁড়িয়ার জন্যই এদিকে এসেছে।


       নিমাই বলল বেশি জোর করে কোন লাভ নেই ভবানীদা। ও আমাদের নিয়ে যাবে না চলুন হেঁটেই যাই। বিয়ে বাড়ির ব্যাপারে নিমাই এর একটু বেশি উৎসাহ। ছেলেছোকরা মানুষ তো ইচ্ছে জাগবেই, কিছু বলার নেই। কিছুটা যাওয়ার পর নিঝুম বাঁশবন, ঝিঁঝিঁ ডাকছে, এগোবো কি এগোবো না ভাবছি। প্রদীপকে বললাম অনেক হয়েছে, আর নয় চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। নিমাই বলল চুপ করুন একটু, বলেই হাত দুটো একটা কানের পাশে লাগিয়ে হাতির কানের মত বড় করে বলল,- একটা মাইক বাজার শব্দ আসছে না? আমি কান খাড়া করে শুনলাম, কিছুই শুনতে পেলাম না



চৈতালী ভট্টাচার্য্য - উমার বিদায় || Chaitali Bhattacharya - Umar Biday || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 চৈতালী ভট্টাচার্য্য

       উমার বিদায়



    " শোনো নীল, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমি আমার ছোটবেলার বন্ধুকে কথা দিয়ে দিয়েছি। যতই তুমি বিদেশের মাটিতে অর্থাৎ আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি করো , কিন্তু ভারতের মাটিতেই রয়েছে তোমার শেকড়ের টান। ভুলে যেওনা এই দেশের মাটিতে এখনও তোমার বাবা মা দুজনেই জীবিত আছেন। এবং মুখার্জি পরিবারের তুমি আমাদের একমাত্র বংশধর। আর আমি আমার বন্ধু সুশোভন চ্যাটার্জীর একমাত্র কন্যা পিয়ালীকে আমার পুত্রবধু রূপে নির্বাচন করেছি। পিয়ালী রূপসী ,শিক্ষিতা, রুচিশীলা এবং বংশমর্যাদায় একেবারে আমাদের পাল্টি ঘর। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে তুমি তাকে বহুবার দেখেছো এবং তোমার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তাই এই বিবাহে তোমার অমত হবে বলে আমার মনে হয় না। আশা করি তুমি শীঘ্রই এদেশে এসে আমার এই কথার সফলতা প্রদান করবে। ভালো থেকো"।

 

   অকস্মাৎ বাবার এই এমারজেন্সি চিঠি পেয়ে ব্রজাঘাতের মতো বসে পড়লো নীল ওরফে জোরেনীলাঞ্জন। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে চেনে সে। অসম্ভব রাসভারী একজন মানুষ। কলেজের অধ্যাপক উচ্চশিক্ষিত তার বাবা নীলোৎপল মুখার্জীর সঙ্গে কোনোদিন পিতাপুত্রের স্বাভাবিক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাবাকে চিরকাল অন্য গ্রহের বাসিন্দা মনে করে ভয়,ভক্তিতে আচ্ছন্ন থাকতো সে। বাবার মুখের ওপর কোনো কথা বলার সাহস বা দুঃসাহস কোনোটাই তার ছিল না। আজও নেই। বাবার অসম্ভব গাম্ভীর্য , সম্পর্কের শীতলতায় কেমন একটা দমবন্ধ হয়ে আসতো তার। বন্ধুদের বাবাদের স্নেহমিশ্রিত একটা সহজাত সম্পর্ক তার মনকে খুব নাড়া দিতো। বাবা বেশীরভাগ সময় লাইব্রেরীতে কাটাতেন। যা কিছু আবদার সব ছিলো তার মায়ের কাছে। গৃহবধূ উচ্চশিক্ষিতা মাও বাবাকে খুব ভয় পেতেন। বিয়ের পর বাবার ইচ্ছানুযায়ী তাঁর প্রাইভেট ইস্কুলে পড়ানোর চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল । বাবা খুব রক্ষণশীল এবং পারিবারিক পুজাপার্বণ ও বংশ মর্যাদাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। চাকরি সূত্রে তাঁকে গ্রামের বাসস্থান ছেড়ে কলকাতা শহরে বাড়ি নিতে হলেও তিনি নিজের গ্রামের সঙ্গে একবারে একাত্ম ছিলেন। তাঁরই বদান্যতায় এতোদিন পরেও আজও বর্ধিষ্ণু মুখার্জী পরিবারের পূজামণ্ডপে প্রতিবছর পারিবারিক দূর্গা পূজা হয়ে আসছে। সময়ের কালস্রোতে মুখার্জী পরিবার ভেঙে গিয়ে দেশে বিদেশে সব আত্মীয় স্বজন ছড়িয়ে পড়লেও নীলোৎপল মুখার্জী এই দূর্গাপূজার সিংহভাগ ব্যয় বহন করে আজও এই পারিবারিক পুজোটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। দূর দূরান্ত থেকে বহু আত্মীয়স্বজন এই পূজায় উপস্থিত থাকে। তিনি নিজে কলকাতা থেকে এখানে উপস্থিত হয়ে প্রাসাদসম অট্টালিকার রক্ষণাবেক্ষণ করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবছর দুর্গা পূজা সুষ্ঠুভাবে সমাপন করছেন।

 

     কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে যখন গ্রাজুয়েশনে দূর্ধর্ষ রেজাল্ট করে নীলাঞ্জন পাশ করলো তখন সে সিদ্ধান্ত নিলো এই অসহ্য 

পরিবেশে আর সে থাকবে না। কারণ এখানে আর বেশিদিন থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। তাই যাতে বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করে পড়াশোনা করতে পারে তার জন্য সে প্রস্তুত হয়ে 

টোয়েফল,জিআরই সবেতেই পাশ করে বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য আপ্লাই করলো এবং সিলেক্ট হলো। তখন মায়ের পায়ে পড়ে বাবাকে রাজি করাতে বললো। মা প্রথমে অরাজী থাকলেও ছেলের কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে বাবাকে রাজী করাতে গেলেন। স্বামী যে এতো সহজে রাজী হয়ে ছেলেকে বিদেশে পড়ার অনুমতি দিয়ে দেবেন সেটা নীলের মায়েরও ধারণা ছিল না। যাইহোক বাবার অনুমতিতে সে শেষপর্যন্ত আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য সে যাত্রা করেছিল।

 

   এখানে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল স্টেলার সঙ্গে। স্টেলা শুধু তার সতীর্থই ছিল না সে ছিল একজন রক শিল্পী। এখানে এসে নীলাঞ্জনের রক সঙ্গীতের ওপর একটা ভালোবাসা জন্মায়। স্টেলা তার জীবনে আসার পর এই ভালোবাসা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় । স্টেলা কালো চামড়ার এবং একজন খ্রীষ্টান ‌। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ক্রমে গাঢ় ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। স্টেলা আর নীল দুজনে লিভ টুগেদার করে। ভবিষ্যতে নীল এখানের নাগরিকত্ব পেলে দুজনের স়ংসারী হবার ইচ্ছে আছে। মায়ের সঙ্গে নীলের স্টেলার বিষয়ে সামান্য কিছু কথা হয়েছে। তার মা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন তিনি বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও কিন্তু তার রক্ষণশীল বাবা কোনোদিনই স্টেলাকে মেনে নিতে পারবেন না। গোঁড়া ব্রাক্ষণ তার বাবা অন্য ধর্মাবলম্বী এবং কালো চামড়ার কাউকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবেন না। এই সম্পর্ককে অস্বীকার করতে প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবেন কিন্তু মুখার্জী পরিবারের সুনামকে কখনো হারাতে দেবেন না। তাই এই সম্পর্ক থেকে নীল যেন খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বাবার মতামতকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া পিয়ালী মেয়েটি খুব ভালো। ছোটবেলা থেকে তিনি মেয়েটিকে ও তাদের পরিবারকে দেখে আসছেন। প্রতিবছর দুর্গা পুজোয় সে এখানে তার বাবা মার সঙ্গে আসে‌। পুজোর কটা দিন এই পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম করে। এই পরিবারের সকলেই জানে যে পিয়ালী নীলের বাগদত্তা। নীল যেমন দুই তিন বছর কাজের চাপে এদেশে পুজোর সময় আসতে পারিসনি পিয়ালীও দিল্লিতে গ্রাজুয়েশন করার জন্য এই পুজোতে অ়ংশ নিতে পারে নি। এবার ওর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেছে। তাই সে এবার এই পরিবারের দুর্গা পুজোয় অ়ংশ গ্রহণ করবে বলে তার বাবা মা জানিয়েছে। তাই মাস্টার ডিগ্রী করার আগে তোর বাবা চাইছেন তোদের বিয়েটা দিয়ে তোদের দুজনকে একসঙ্গে আমেরিকা পাঠাতে। ওর পাসপোর্ট রেডি, ভিসাটাও হয়ে যাবে। তুই এমারজেন্সি ছুটি নিয়ে এবারের দুর্গাপুজোয় এখানে চলে আয়। আশা করি বাবার চিঠি তুই পেয়েছিস। সুতরাং দেরি না করে ছুটির অ্যাপ্লাই করে দে। পুজোর মধ্যে সব আত্মীয় স্বজনের সামনে তোদের রেজিস্ট্রিটা করে রাখা হবে। তারপরে একটা ভালো দিন দেখে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হবে। এবার কার্ত্তিকের একদম প্রথমে পুজো আর অগ্রহায়ণ মাসের দুতারিখে বিয়ের একটা ভালো দিন আছে। তোর তো বারবার অতোদূর থেকে আসা সম্ভব নয়। তাই একমাসের ছুটি কোনোভাবে ম্যানেজ করে চলে আয় । ঐদিন তোর বাবার ইচ্ছা তোদের চার হাত এক করার।"


নীলাঞ্জন কাজ করতে করতে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগলো। মাঝে কয়েকটা বছর না দেখা হলেও পিয়ালীকে ছোটবেলা থেকে সে অনেকবার দেখেছে। সামান্য কথাও দু একবার হয়েছে। পিয়ালী অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু পিয়ালী নিয়ে কোনো বিশেষ ভাবনা চিন্তা তার মধ্যে কোনোদিন কাজ করেনি। পিয়ালীরও কি তাকে নিয়ে কোনোরূপ চিন্তা ভাবনা ছিল কিনা তাও তার জানা নেই। আসলে তার সেই মহুর্তে দমবন্ধ এই বাড়ির পরিবেশ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে তখন সেটাই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল। পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে যেনতেন প্রকারে একটা কলারশিপ জোগাড় করে বিদেশের মাটিতে পাড়ি দেওয়ায় ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য ।

   

" একি ব্রাদার তোমার যে আজকে কাজের মন নেই দেখছি। স্টেলার সঙ্গে কি মান অভিমান?" 


আকাশের প্রশ্নে নীলাঞ্জন একটু ঘাঢ় নাড়ালো।


"তাহলে আজ আমার বন্ধু এতো অন্যমনস্ক কেন। কাজের ব্যাপারে যে প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড এ্যান্ড প্যা়ংচুয়াল। তার তাহলে কি হলো আজকে?


" নীলাঞ্জন বলে উঠলো

"আকাশ এদেশে তোমার মতো একজন বাঙালি এবং ভালো বন্ধু পেয়েছি তুমি আমার সবকিছুই জানো। কিন্তু এখন এমন একটা সমস্যায় জড়িয়ে গেছি এর থেকে বেরোবো কি করে ভেবে উঠতে পারছিনা। আমি তোমাকে সব শেয়ার করবো। তুমি বলো আমি এখন কি করবো।?"


"কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো নীলাঞ্জন।"


"তুমি তো আমার আর স্টেলার বিষয়ে সবকিছু জানো। আমরা দুজন দুজনকেই ভালোবাসি।

স্টেলা অরফ্যান ছিল। অনেক স্ট্রাগেল করে আজ মিউজিক,স্টাডি, সবেতেই একনম্বর। ভবিষ্যতে আমি ওকে বিয়ে করবো এমন কথাও দিয়েছি। ও আমাকে খুব বিশ্বাস করে। কিন্তু দেশে বাবা মা আমাকে একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি যদি এই বিয়ে না করি বাবা হয়তো আত্মহত্যা করে বসতে পারেন। আমি আমার বাবাকে চিনি এবং তোমাকেও সব আগেই বলেছি। উনি ভীষন জেদী, একগুঁয়ে এবং নিজের বংশমর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। স্টেলাকে কোনোমতেই মেনে নেবেন না। আমি এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।"


"তুমি যখন জানো নীলাঞ্জন তোমাদের পরিবার তোমাদের এই সম্পর্ককে কখনো মেনে নেবে না তখন তাহলে জেনে শুনে স্টেলার সঙ্গে একটা সম্পর্কে জড়ালে কেন। আমি বলি আমরা দুজনেই ছুটির অ্যাপ্লাই করি। আমারও দেশে যেতে বড্ড মন চাইছে। দেখি তোমার পরিবারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমার বাবামায়ের মতের কোনো পরিবর্তন করে উঠতে পারি কিনা।"


"আমি তোমাকে গ্যারিন্টি দিলাম আকাশ। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে কিন্তু আমার বাবার কথার নড়চড় হবেনা। তুমি দেখে নিও।"


"ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠেছে। নীল আকাশের বুকে পেঁজা তুলোর সমারোহ। উঠোনের প্রাঙ্গনে শিউলির চাদরের সুমধুর উপস্থিতি। মাঠে মাঠে কাশফুলের দোদুল নাচন। মা আসছেন। এবার গ্রামের মুখার্জী পরিবারের বাড়িতে আনন্দের বান ডেকেছে। কেননা বহুদিন পরে বিদেশ থেকে ছেলে এসেছে দুর্গা পুজোতে। শুধু তাই নয় এই পুজোতেই দেবীর বোধনের শুভ দিনে হবে তার পাকা দেখার লিখিত পাঠিপত্র। দুর্গা মন্ডপ, ফুল আর আলোতে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। দেবীর বোধন পর্ব সমাপ্ত হলেই শুরু হবে রেজিষ্ট্রি এবং পাঠিপত্র অনুষ্ঠান। দুই বাড়ির লোকজন এবং আত্মীয় স্বজন উপস্থিত।

সালঙ্কারা অপূর্ব রূপবতী পিয়ালীকে দেখে মুহুর্তের মধ্যে একবারে মুগ্ধ ও প্রায় পাগল হয়ে গেল আকাশ। মনের চাড়া দিয়ে উঠলো নিষিদ্ধ ইচ্ছা। এই মেয়েকে না পেলে সত্যি তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। যেমন করেই হোক নীলাঞ্জনের সাথে এই বিয়েটা তাকে আটকাতেই হবে । মেয়েটাকে জানিয়ে দিতে হবে নীলাঞ্জনের সঙ্গে স্টেলার সম্পর্কের কথা। তবেই সে পিয়ালীকে পেতে পারবে। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব। আজকেই তো রেজিষ্ট্রি হয়ে যাবে। নীলাঞ্জনেরও মনেও বেশ ঘোর লেগেছে অপূর্ব সুন্দরী যুবতী পিয়ালীকে দেখে, সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। স্টেলা মনে হচ্ছে নীলাঞ্জনের মন থেকে বিসর্জন হয়ে গেল।


 স্টেলার প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক বুঝিয়েও নীলাঞ্জনকে রেজিষ্ট্রি করা থেকে বিরত করতে পারলোনা আকাশ। সবকিছু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো। পিয়ালী এবং নীলাঞ্জনকে হাসিমুখে ঘনিষ্ঠভাবে গল্প করতে দেখা গেল। আকাশের বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলো "বাহ, নীলাঞ্জন তুমি যে এতো বড় অভিনেতা জানা ছিল না। স্টেলা আমারও বন্ধু তার সঙ্গে তুমি এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলে। এতো যে বড় বড় কথা বলেছিলে পিয়ালীকে দেখে সব ভেসে গেল। তোমার আর স্টেলার কিছু ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি আমার ফোনে আজও আছে সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে আমি কিছুতেই সুখী হতে দেবোনা ‌পিয়ালীকে আমার চাই। আর আমি স্টেলাকেও সব জানিয়ে আজকেই ইমেইল করে দেবো।

 

  আজ বিজয়া দশমী, মাকে চোখের জলে বিদায় জানানোর দিন। সকলেই গভীর ম্রিয়মান। আবার একটি বছর বাদে উমা মায়ের পদধূলি মর্তে পড়বে। সকাল থেকেই তাই দশমী পূজার বিশেষ প্রস্তুতি চলছে । ভোগ রন্ধন ও দধিকর্মা প্রস্তুতিতে সকলেই খুব ব্যস্ত। কে একজন বলে উঠলো পিয়ালীকে দেখা যাচ্ছে না। সে এই বাড়ির বউ হয়েও মায়ের বিদায় লগ্নের এতো প্রভূত কাজ থেকে কেন নিজেকে বিরত রেখেছে।


 ঢাক বেজে উঠেছে। মায়ের বিদায়ের কাল উপস্থিত। সিঁদুর সিঁদুরে রক্ত বর্ণ হয়ে উঠেছে দেবী মায়ের মুখ আর মানবী মায়ের মুখ‌ ‌। এমন সময় কে যেন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো 

পিয়ালী মা ,রে এমন করে তোর মাকে ফেলে কাঁদিয়ে চলে গেলি কেনরে? কি অপরাধ করেছিল তোর বাবা মা। রক্ত আর গ্যাজলায় ভরে আছে আর এক উমার মুখ। পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা বিষের শিশি। মা চলে যাবেন কৈলাসে। আর এক মায়ের কোল খালি হয়ে তার গৌরী হয়তো চলে যাবে কৈলাসে কে বলতে পারে।

যেওনা উৎসব - অর্পিতা বিশ্বাস || Jeuna Utsab - Arpita biswas || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

যেওনা উৎসব

অর্পিতা বিশ্বাস



         টবের গাছগুলোর পরিচর্যা করছিলেন সোমেশ্বর । বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও নিজস্ব কাজ আর লেখালেখি নিয়ে বেশ ভালো আছেন । অবশ্য জীবনভর এই ভালো থাকার চেষ্টাটাই করে গেছেন । আর এটা শিখেছিলেন মনিদার কাছ থেকে । মনিময় সেনগুপ্ত । পাড়ার সবার মনিদা । তা মনিদাকে কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে বলতেন---বেশ ভালো আছি । সেবার নীরু জ্যাঠাকে একই কথা বলতেই রেগে গিয়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর প্রশ্ন করেছিলেন --আচ্ছা মনিদা, নীরু জ্যাঠাকে তুমি মিথ্যে বললে কেন ? 

      মনিদা উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন--পুজো এসে গেছে, তাই না রে ? 

             সোমেশ্বরও একবার নীলাভ আকাশটা দেখে নিলেন । তারপর বললেন -----কথা ঘোরাবে না মনিদা । মাস আধা না পেরোলে জ্যাঠা যে টাকা হাতছাড়া করতে চায় না সেটা তুমি যেমন জানো, আমিও জানি । সময় মতো টাকা না দিলে জ্যাঠার ছেলে মেয়ে দুটোকে পড়াতে যাও কেন ? একটু হেসে মনিদা বললেন --- তোর কি মনে হয়, আমি ভালো নেই বললে নীরু জ্যাঠা পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিত ? আসলে ওটা একটা কথার কথা । যারা জিজ্ঞেস করে, তারা মোটেই 'তুই কেমন আছিস' সেটা জানতে চায় না । কিন্তু যদি সত্যি কথা বলিস, তাহলে হয় তোকে ওরা করুনা করবে নাহলে পরদিন থেকে চিনতে পারবে না ।

             কথাটা যে খুব সত্যি জীবনে তা অনেক বার টের পেয়েছেন সোমেশ্বর । যখনই কাউকে বন্ধু ভেবে, আপনজন ভেবে নিজের কষ্টটুকু শেয়ার করতে গেছেন, তক্ষুনি তাদের চোখের ভাষা পালটে যেতে দেখেছেন । একটা সময় গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে । মনিদার মতোই বলতে শিখে গেছেন, ভাল আছি -বেশ আছি ।

           তবে এ ক'দিন ধরে সত্যিই ভাল আছেন সোমেশ্বর । ছেলে পলাশ, বউ আর মেয়েকে নিয়ে পুজোর ছুটি কাটাতে বাড়িতে এসেছে । সোমেশ্বরের আনন্দ তাই আর ধরছে না । সকাল হলেই ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করছেন । আর কমলা রান্নার মেয়েটাকে নিয়ে নানান রকমের রান্না করছেন । খেতে বসে পলাশ রাগ করলেই, কমলাও মিষ্টি হেসে অভিযোগ করছেন ---তা কি করব আমরা , সারাটা বছর তো বাইরে বাইরেই কাটাস তোরা । কিছুই তো খাওয়াতে পারি না । ব্যস, চুপ করে যায় পলাশ ।

        পলাশের বউ অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । বরং নিজের সাজগোজ আর পুজোর বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকে । যদিও সোমেশ্বর জানেন, এখানকার পুজো মোটেও ভাল লাগবে না ওদের । সেদিন তো শালুক বলেই ফেলল ---- কি করে যে পুজোটা কাটবে এখানে ? ইস, বাপি যে কি করে না ! 

       পলাশ থামাবার চেষ্টা করেছে মেয়েকে । কিন্তু নন্দিনী মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলেছে --- তোমার আর কি । নিজের জায়গায় এসেছো, কত বন্ধু-বান্ধব পাবে, দিব্যি কাটবে দিনগুলো তোমার । শালুকটাই যা একা হয়ে গেল ।

সোমেশ্বর চুপ করে থেকেছেন । মুখের হাসিটুকু বজায় রেখেই । ছেলে--বউর মাঝে কোন কথা বলেননি । তবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তার মানে কমলার কান্নাকাটির জন্য, পলাশ এবার জোর করে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে । আচ্ছা নন্দিনী যদি আজ নিজের মেয়ে হত, তাহলে কি বলত এমন কথা ? বলত না । বরং শালুকের কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে ঘর - দুয়ার সাজিয়ে তুলত, মা-বাবাকে নিয়ে পুজো দেখতে বেরিয়ে পড়ত । 

     কথাগুলো মনের মাঝে উঁকি দিতেই সোমেশ্বর সামলে নিলেন নিজেকে । অথবা বলা উচিত ব্রেক কষলেন ভাবনাগুলোর । সত্যিই তো নন্দিনীর কথাও ফেলার নয় । শালুক তো কাউকেই চেনে না -জানে না এখানে । কেনই বা ভাল লাগবে ওর । শালুকের বয়সে নিজে তো পুজো-পার্বন অথবা কোন উৎসব -অনুষ্ঠান বন্ধুদের ছাড়া ভাবতেই পারতেন না । তাছাড়া ততদিনে কমলাও তো এসে গিয়েছিল জীবনে । একঢাল কালো চুলের সংগে একটু চাপা রঙের মেয়েটাকে কি মিষ্টি যে লাগত সোমেশ্বরের । এক অষ্টমীর সকালে হলুদ তাঁতের শাড়ি পড়া কমলাকে দেখে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর ওই বন্ধুদের দয়াতেই ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল । নিজের মনের কথা বলেছিলেন সোমেশ্বর । কোন কথা না বলে একছুটে পালিয়ে গিয়েছিল কমলা । তবে যাবার আগে এক ঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গিয়েছিল সোমেশ্বরকে । সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছিলেন সোমেশ্বর সেদিন কমলার ওই হাসিটুকুতে । প্রতিটা দুর্গাপুজো আজও তাই স্পেশাল সোমেশ্বরের কাছে । এসময়টায় তাই 'কোন মন খারাপ করা কথা' মনের মাঝে ঠাঁই দিতে চান না সোমেশ্বর । 

                           দুই

       আজ ক'দিন ধরে একটা কথা মনের মাঝে ঘুরছিল সোমেশ্বরের । কমলাকে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি । জানেন ঠিক বকুনি খাবেন । তবুও কেন কে জানে কথাটা ভাবলেই একরাশ খুশি লুটোপুটি খাচ্ছিল বুকের ভেতর । আর তাই সাহস করে একসময় বলেই ফেললেন ----আচ্ছা কমলা, হঠাৎ যদি দেখ তোমার ছেলে আর ছেলের বউ সব্বাই তোমার কাছে এসে থাকতে চাইছে তাহলে ? 

      সুপুরি কাটছিলেন কমলা । মুখ না তুলেই বললেন---দিবা স্বপ্ন দেখ না । এই যে ওরা পুজোর ক'দিন আগে থেকে এসে থাকছে আমাদের কাছে, নন্দিনী আমার হাতে হাতে কাজ করছে, তাই অনেক । বসতে পেলে শুতে চাইতে নেই, বোকামি করা হয় তাতে । 

      কমলার আরও একটু কাছে এসে বসলেন সোমেশ্বর । আর গোপন কিছু শেয়ার করার মতো করে বললেন----আচ্ছা, যদি শালুক এই হাউসিং কমপ্লেক্সে বউ হয়ে আসে, তাহলে ?

      তেতে উঠলেন এবার কমলা । সুপুরি কাটা বন্ধ করে বললেন ----তোমার কি মাথাটা একেবারেই গেছে? নাকি কি বলছো বুঝতেই পারছো না ? 

        সোমেশ্বর হেসে উঠলেন এবার জোরে জোরে । প্রানখোলা হাসি যাকে বলে । তারপর আস্তে করে বললেন, সুধাকরের ছেলেটা ডাক্তারি পড়ছে, জানোই তো । সেও কিন্তু আসছে এবারের পুজোতে । ছেলেটা দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম । আমাদের শালুকের নিশ্চয় অপছন্দ হবে না । আর তোমার ছেলে --ছেলের বউ ওরকম হীরের টুকরো ছেলেকে জামাই হিসেবে পেলে খুশিই হবে । মাঝখান থেকে লাভবান হব আমরা । নিজের মেয়ের টানে দেখবে তোমার ছেলে অফিসে দুদিনের ছুটি পেলেও সোজা এবাড়িতে চলে আসছে । আচ্ছা, আমরা তো ওই বয়সেই প্রেমে পড়েছিলাম, তাই না ? তুমি অবশ্য শালুকের থেকে একটু ছোটই ছিলে । সবে মাধ্যমিক দিয়েছিলে বোধহয় তখন । তা তোমার নাতনি হয়ে শালুক একটু প্রেম করতে পারবে না ? আর না পারলে আমি ঘটকালি করব । সুধাকর এককালে আমার ছাত্র ছিল । আমি বললে শালুককে ছেলের বউ করতে মোটেও অরাজি হবে না । 

ব্যাপারটা পছন্দ হলেও, নিজের কিশোরীবেলার প্রেমের কথা তুলতে একরাশ লজ্জা ছড়িয়ে পড়ল কমলার এখনও মোটামুটি সুন্দর মুখের ওপর। আর তাতে আরও রেগে গেলেন । দুপ দাপ পা ফেলে উঠে গেলেন সামনে থেকে । হা হা করে আবারও হেসে উঠলেন সোমেশ্বর ।

তা শালুক কি প্রেমে পড়েছিল ? না, ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি কর্তা-গিন্নি দুজনের কেউই । টানা চার-পাঁচটা দিন গোয়েন্দাগিরি করা সত্বেও । সপ্তমী দিন সোমেশ্বর নিজে উদ্যোগী হয়ে শালুকের সংগে সিদ্ধার্থর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । বেশ কিছুক্ষন কথা বলেছিল দুজনে । অষ্টমী দিনের জন্য তাই নতুন প্ল্যান করেছিলেন কমলা । শালুককে আরও সুন্দরী দেখাবার জন্য উপহার হিসেবে একটা মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি দিয়েছিলেন । প্রথমে রাজি না হলেও কমলার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত শাড়িটা পড়েছিল শালুক । অঞ্জলি দিতেও একসংগে গিয়েছিলেন কমলা স্রেফ সামনে থেকে সিদ্ধার্থর রিয়েকশনটুকু দেখবেন বলে। 

  বাড়ি ফিরে হাসি মুখে সোমেশ্বরকে রিপোর্ট করেছিলেন ---আমার নাতনীকে দেখে তো চোখের পলকই পড়ছিল না তোমার ওই ডাক্তার ছেলের ।

কথাটা সত্যি । খেতে বসে শালুকও বলেছিল--- ইস, শাড়িতে যে কি আছে জানি না, এত কষ্ট হয় সামলাতে, দু'পা হাঁটার পরই মনে হয় এবার নির্ঘাৎ পড়ে যাব । তাও নীচে সুজাতা আন্টি ওরা সব্বাই ডেকে ডেকে বলছিল, কি ভাল লাগছে তোমায় দেখতে শালুক, এমনকি সিদ্ধার্থও বলে কি না........ । কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে গিয়েছিল ।

সিদ্ধার্থ কি বলে সেটা জানার চেষ্টা না করে কমলা একটু হেসে বলেছিলেন --

---- সত্যি কথাই তো বলছিল সবাই । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমারও নিজেকে নিশ্চয় ভালো লাগছিল শালুক । তাই তো এতো মন দিয়ে সাজগোজ করছিলে । আর গয়নাগুলো পড়ার পর তো তোমায় মা দুর্গার মতোই সুন্দর লাগছিল । 

আহা, সেতো তুমি জেদ ধরেছিলে তোমার অর্ণামেন্টস গুলো আমায় পড়াবে বলে । তবে ...

----তবে কি ? 

----ওগুলোর ডিজাইন কিন্তু মোটেও পুরনোকালের নয় । বরং বেশ হালকা সুন্দর কাজ গয়নাগুলোর । ফ্যাশনেবল যাকে বলে ।

    এবার আর কিছু বললেন না কমলা। শেষের বাক্যদুটো শালুকের নাকি ওই ডাক্তার ছেলের সেটাও জিজ্ঞেস করলেন না । বরং আরও একপিস মাছ তুলে দিলেন নাতনীর পাতে । পলাশের মতো ওর মেয়েটাও মাছের কালিয়া খেতে খুব ভালবাসে । ছেলে, ছেলের বউ পূজো মন্ডপেই ভোগের খিচুড়ি খাবে আজ । শালুকের খিচুড়ি পছন্দ নয় আর ওদের দুজনের তো আজকাল পেটেই সহ্য হয় না । তিনজন তাই গল্প করে করে মাছ -ভাতই খেতে লাগলেন ।  

       পরদিন থেকে নজরদারি আরও বেড়ে গেল সোমেশ্বর আর কমলার । উত্তেজনায় টান টান দুজনে । উফ্ কি কঠিন কাজ ! কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না অথচ কাজটা ঠিকঠাক করতে হবে । পালা করে নজর রাখছেন দুজনে । এমনকি শালুকের ফোনেও আড়ি পেতেছেন কমলা, ব্যাপারটা এক্কেবারে দোষের জেনেও । কিন্তু খুব একটা সুবিধে হয়নি । হবেই বা কি করে ? ফোনে যা কথা বলছে শালুক সে তো বেশির ভাগই হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে । বাংলা দু চারটা শব্দ থাকলেও কমলার তাতে লাভ তেমন হয়নি। মনে মনে, দুর ছাই বলে চলে এসেছিলেন ওখান থেকে । পরে এনিয়ে নালিশ করেছিলেন সোমেশ্বরকে । মুখটা গম্ভীর করে সোমেশ্বর বলেছিলেন----- দেখলে তো পড়াশোনায় মন না থাকলে কি হয় । ছোটবেলা মন দিয়ে একটু পড়লে আজ এই অবস্থা হত না । এই জন্যই কিচ্ছু করতে পারলে না জীবনে । 

----তা বিয়েটা করেছিলে কেন ? জানতেই তো টেনেটুনে কোন রকমে মাধ্যমিকটা পাশ করে ছিলাম । তোমার তুলনায় মূর্খ ছিলাম জানতে না ? 

     ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কমলা । নিজের মানুষটার কাছে এত বছর বাদে পড়াশোনা নিয়ে এভাবে কথা শোনাটা মোটেই বরদাস্ত করতে পারলেন না । 

----আহা, যা গেছে তা নিয়ে রাগ করে লাভ কি ? তাছাড়া তুমি যে হারে আজকাল রেগে যাচ্ছ তাতে শালুকের বিয়ের ব্যবস্থা করার আগে আমাদেরই না ডিভোর্স হয়ে যায় । 

      হেসে ফেললেন এবার দুজনেই । তবে কমলা চিন্তায় পড়ে গেলেন । শালুক দিব্যি যখন-তখন ছেলেটার সংগে গল্প করছে, অথচ প্রেমে পড়ার সেরকম কোন লক্ষন নেই । গতকাল শালুকের সংগে কথা বলার সময় সুযোগ বুঝে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন ---আচ্ছা দিদিভাই, সিদ্ধার্থ ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার ? বেশ ভালো কিন্তু ছেলেটা, মানে ছোটবেলা থেকেই দেখছি তো ।

         হাতের ফোনটা ঘাটতে ঘাটতেই উত্তর দিয়েছিল শালুক --ঠিকই আছে । আমার সংগে তো বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেছে ওর । তাছাড়া ওর বন্ধুগুলোও বেশ ভালো । ইনফ্যাক্ট ওদের জন্যই ভালো কাটছে পুজোটা ।

      শালুকের কথা শুনে স্রেফ বোকা বনে গিয়েছিলেন কমলা । হচ্ছে সিদ্ধার্থর কথা, এর মাঝে ওর বন্ধুরা কোথা থেকে এল । তবু ভালো করে ওর মুখটা লক্ষ করছিলেন আর হতাশ হয়েছিলেন । না 'বন্ধুত্ব' শব্দটা উচ্চারন করার সময় চোখেমুখে এতটুকু আলো জ্বলে উঠল না । আর পাঁচটা বন্ধুর মতোই যেন সিদ্ধার্থ । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন কমলা, ছেলে মেয়েদের মাঝে আজকাল 'এই নির্ভেজাল' বন্ধুত্বটাই যত নষ্টের গোড়া। না হলে এত চেষ্টার পরও মেয়ের মন গলে না ! না আর কোন আশাই নেই । 

----কি হল চুপ করে গেলে যে ? 

-----এখনকার ছেলে--মেয়েগুলোকে না ঠিক বোঝা যায় না । কি যে চলে ওদের মনের ভেতর .......

     কথা পুরোটা শেষ করার আর ইচ্ছে হল না কমলার । শুয়ে পড়লেন । ছেলে--ছেলের বউকে কাছে পাবার আশায় এই বয়সে এসে কি না করছেন । কিন্তু আখেরে লাভ কিছু হবে কি না কে জানে ....

        পাশের ঘরে পলাশ আর নন্দিনীও কথা বলছিল । তবে শালুককে নিয়ে নয় । শালুকের ওই বন্ধু প্রীতির সংগে তারা পরিচিত । গা সওয়া হয়ে গেছে এসব তাদের । তারা কথা বলছিল নিজেদের নিয়ে । ফেসবুকে আপলোড করা এ ক'দিনের তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে পলাশ বলে উঠেছিল----- এবারের পুজোটা বেশ কাটল তাই না নন্দিনী ? ভিড় ভাট্টা নেই , কিছু নেই, মনের আনন্দে ঠাকুর দেখে, সবার সাথে বেশ হই হই করে কাটালাম পুজোটা । তাছাড়া মা-বাবাও কত খুশি হল ।

----হুম, নবমী দিন যা নাচ নাচলে । মনে যে খুব আনন্দ ছিল তা তো বোঝাই গেছে । 

----ওটাকে ধূনুচি নাচ বলে । জানো ছোটবেলায় এই আরতি প্রতিযোগিতায় সবসময় আমি ফার্স্ট হতাম ।

---আচ্ছা, হঠাৎ করে এই বুড়ো বয়সে তুমি, কি বলে ওই 'ধূনুচি নাচ' নাচতে গেলে যে ? 

----এই শোনো নন্দিনী, বুড়ো বয়স মোটেই বলবে না । আমার এজের অনেকেই তো আরতি করলো। দেখলে না ? আর আমাকে বলছো যে, ঠাকুর ভাসানে নিয়ে যাবার সময় সবার সাথে তুমিও তো নেচেছিল । তবে নাচলে কিন্তু এখনও তোমাকে দারুন লাগে ।

----‌শুধু আমাকেই দেখছিলে ? নাকি ...

      হাসতে হাসতে বলল নন্দিনী ।

-----মানে ? আর কাকে দেখব ? এই মাত্র না বললে বুড়ো বয়স আমার । তা বুড়ো বয়সে কি আর ......

ঝটপট বলল পলাশ । কথাতে নন্দিনীর কাছে হারতে রাজি নয় ও মোটেই । 

কিন্তু নন্দিনী একথার উত্তর দিল না । বরং আনমনা ভাবে বলল--- -- এসব কথা ছাড়ো, শোনো না, বাবার কথা বলছি না, বাবাতো বরাবরই অন্যরকম, কিন্তু মাও এবার কেমন পালটে গেছে জানো । সবসময় যেন কি ভাবছে । তাছাড়া রান্নাঘরে আমি কাজে উল্টোপাল্টা করলেও কিছু বলছে না । বরং হাসি মুখে নিজেই করে নিচ্ছে কাজটা । সারপ্রাইজড একেবারে আমি । আর শালুকের সংগে তো পাল্লা দিয়ে পুজো মন্ডপে বসে থেকেছে এই ক'দিন । খুব এনজয় করেছে পুজোটা এবার ওরা । 

----ঠিক বলেছো । ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি । তা তোমার তো ভালো লাগার কথা । এই পুজোতে মায়ের সংগে তোমার সম্পর্কটাও বেশ সুন্দর হয়ে গেল ।

---হুম...

----আচ্ছা নন্দিনী, সেদিন শাড়িতে কিন্তু শালুককে খুব মিষ্টি লাগছিল, বড় হয়ে গেল আমাদের মেয়েটা তাই না ? 

       এবার আর কোন উত্তর পেল না পলাশ । পাশ ফিরে তাকালো নন্দিনীর দিকে । কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঠোঁটের কোনে লেগে আছে একটুকরো হাসি । হয়তো কোন স্বপ্ন দেখছে । জাগাতে গিয়েও জাগালো না পলাশ । পাশ ফিরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল ।

          ভোর বেলা থেকেই মন খারাপ আজ সোমেশ্বরের । জোর করেও ভালো থাকতে পারছেন না কিছুতেই । পলাশের ছুটি শেষ । আজই চলে যাবে ওরা । বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন সোমেশ্বর । সামনের শিউলি গাছটার নিচে ফুল ভরা । ছোট্ট ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন সোমেশ্বর । ঘরের ভেতর থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে । কমলার টিফিন কৌটোতে খাবার প্যাক করে দেওয়া, পলাশের শেষমুহুর্তে সব ঠিক আছে কি না দেখে নেওয়া, শালুকের এত সকালে খেতে না চাওয়া, এলোমেলো করে দিচ্ছে সোমেশ্বরের মনটাকে । পছন্দ হচ্ছে না এতটুকু । কেমন বিদায়ের সুর সবটাতে । ইস্ আরও ক'টা দিন যদি বেশি থাকত ওরা । অথবা পুজোটা যদি আরও দুটো দিন বেশি হত ....

        কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে এল ওরা । ছেলে --ছেলের - বউ - নাতনি এসে একে একে প্রনাম করল । কিছু বললেন না সোমেশ্বর । আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাতটা ওদের মাথায় রাখলেন শুধু । চোখের সামনে বাদামি রঙের ট্রলি ব্যাগ দুটো নিয়ে এগিয়ে গেল শালুক আর পলাশ । একটু পিছে নন্দিনী । আজ শাড়ি নয় , লেগিংস -কুর্তিতে নিজের সাজে নন্দিনী । তবুও কি যে অপরূপা লাগছে ওকে । মুখটা যেন ঠিক দুর্গা প্রতিমার মতো । এই প্রতিমাই তো উৎসবের রূপ নিয়ে ক'দিন আগে স্বামী -কন্যা সহ সোমেশ্বরের ঘরে এসেছিল । এখন ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে । মনে মনে চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বর----যেও না নন্দিনী। তোমরা গেলে এবাড়ির উৎসবের রং যে মুছে যাবে । 

       নন্দিনীর চোখটাও কেমন ভিজে উঠল । অবাক হল একটু । আরও তো কতবার এসেছে । এমনটা তো হয়নি কখনো । পিছন ফিরে দেখল একবার, মনে হল, সোমেশ্বর আর কমলা যেন একসংগে বলে উঠলেন --নন্দিনী মানে কিন্তু কন্যা, মনে থাকবে তো ? আবার এসো কিন্তু......। অজান্তেই মাথা নাড়ল নন্দিনী ।

       গাড়িতে ওঠার আগে তিনতলার একটা নির্দিষ্ট ব্যালকনির দিকে চোখ চলে গেল শালুকেরও । সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে । হাত নাড়ছে । হাত নেড়ে বিদায় জানালো শালুকও । কিছু একটা বলছে সিদ্ধার্থ । গতকালের কথাটাই কি ? এত দুর থেকে শুনতে পেল না শালুক ।

        

       

      

বোধন - ঝুমা দত্ত || Bodhan - Jhuma Dutta || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 বোধন 

 ঝুমা দত্ত 



রামচন্দ্র চ্যাটার্জী, মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভিভাবকহীন যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে হয়। তবে ভাগ্যক্রমে অভিভাবকহীনতা সঙ্গ দেয় নি বেশিদিন। সে গ্রামের এক নিঃসন্তান কৃষক পরিবার তাকে বুকে টেনে নেয় এবং বড় স্নেহে তাকে লালন পালন করে।


 রামচন্দ্র তাঁর বাবার থেকে যেটুকু পুজোর কাজ শিখেছিল তা দিয়ে অল্প বিস্তর এখনো পূজো করে। তবে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁ হাতের একটি আঙ্গুলে খুঁত থাকার কারণে সারা বছর পুজোর কাজ খুব একটা জোটে না, তাই কৃষি কাজটাই এখন তার প্রধান জীবিকা।


 বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর যে স্নেহের বৃক্ষটুকু আঁকড়ে বড় হয়, সে গাছের ছায়াও গত বছর সরে যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া স্মৃতিচিহ্ন স্বরুপ একটি আশীর্বাদী কাস্তে বড়ই যত্নে রেখেছিল। সেই কাস্তেটা আজ রামচন্দ্র ধান ক্ষেতে হারিয়ে ফেলেছে। তাই তাঁর মনটা আজ খুব খারাপ। গালে হাত দিয়ে এক মনে তার কথাই শুধু ভেবে চলেছে। এমন সময় পাশের বাড়ির সুদক্ষের পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠা কন্যা দুর্গা এসে হাজির।


 বছর দশের দুর্গা, যেমন সাহসী, দস্যি তেমনি মনে অগাধ দয়া মায়া। রামচন্দ্র তাকে খুব স্নেহ করে, তার হাতে হাতে কত কাজ দুর্গা করে দেয়। উনান লেপা, সব্জি কাটা,দোকান সদাই আনা ইত্যাদি। 

আজ মহাষষ্ঠী, মায়ের বোধন। লাল টুকটুকে একটা জামা, মাথায় লাল ফিতে, পায়ে আলতা পরে এসেছে কাকাকে দেখাতে, কিন্তু রামচন্দ্র কাকা তো তাকে দেখতেই পেল না। বেশ কিছুক্ষণ কাকার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর কাকার হাত ধরে ডাকতে থাকে কাকা....ও.....কাকা। তারপর ছোট্ট মনের সব কৌতূহল ঢেলে দেয় কাকার উপর আর বলে,"কি গো রামচন্দ্র কাকা মুখটা এমন বেজার করে দুয়ারে বসে আছো কেন? "

 রামচন্দ্র তখন দুর্গার দিকে তাকায় এবং বলে," আর কইস না দুগ্গা, আমার সাধের কাইস্তেটা আজ হারাইয়া ফালাইসি।"

শুনেই দুর্গা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, কি বলছো কাকা,সে তো বহু পুরনো। তোমার বাবা-মার স্মৃতি, কবে থেকে তোমার হাতে দেখছি।


রামচন্দ্র একটু উচ্চস্বরে বলে, "হ.......হ.....ঐ কাইস্তেটাই। ঐডা শুধু কাইস্ততে ছিল না রে দুগ্গা, ঐডা যে আমার পূর্বপুরুষের আশীর্বাদও আছিল। কই যে হারাইলাম, আর খুঁইজ্জা পাইলাম না। কাল আবার খুঁজুম।"

--- কাকা আমি খুঁজে এনে দিচ্ছি তুমি একটুকুও চিন্তা করো না।

--- না দুগ্গা তরে এখন আর যাইতে হইব না। কইলাম ত আমি কাল আবার খুঁজুম।

 যাস না কইতাসি.....

দুর্গা ক্ষেতের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে, 

--- আমি তোমার কাস্তেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে আসব....

--- উফঃ!মাইয়াটার মাথায় ভূত চাপলে একডাও কথা শোনে না।

 রামচন্দ্র বিড়বিড় করে বলতে থাকে।

 সে আবার বলে ওঠে, যাইতাসিস যখন সাবধানে যা মা, তাড়াতাড়ি ফিরা আসিস।

--- দুর্গা আবার চিৎকার করে বলে, একদম চিন্তা করো না, কাকা, কাস্তেটা নিয়েই ফিরবো....। 


দুর্গা সারা ধানক্ষেত চষে বেড়ালো কিন্তু কাস্তেটা খুঁজে পেল না। কে যেন অদৃশ্য আঁচলে লুকিয়ে খেলা করছে। দুর্গাও সহজে হাল ছাড়বে না। সে আরও জোর দিয়ে খুঁজতে থাকলো। এদিকে বেলা শেষ হয়ে আঁধার চাদর জড়িয়ে নিল সবুজ ধানক্ষেত।

 


ওদিকে রামচন্দ্র উদগ্রীব হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠলো আর সে ঘরে বসে থাকতে পারলো না। হেরিকেন আর লাঠি নিয়ে ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায় আর বিড়বিড় করে... " কত্ত বার কইলাম সন্ধ্যে নামার আগে চইল্যা আসিস। দস্যি মাইয়্যা, একটাও কথা শোনে না,আমারই ভুল আসিল। একা ছাইড়া দিলাম কি কইরা! সন্ধ্যে নামার পর আবার ঐ...."


 ভাবতে ভাবতেই রামচন্দ্রের শ্বাস আরো দ্রুত গতিতে বইতে থাকে। মন যে তাঁর এখন আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে আর ঠাকুর কে ডাকতে ডাকতে ঝড়ের গতিতে পা চালায়।


 এদিকে শুক্ল পক্ষের ভাঙ্গা চাঁদ ও জোনাকির আলোয় চারিদিক অস্পষ্ট, দুর্গা মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে এক মনে কাস্তে খুঁজতে ব্যস্ত। 


 এমন সময় কে যেন পিছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে আর দুর্গা তখনই মাটির কোলে নুইয়ে পড়ে। শুধু শুনতে পায় কতগুলো অসুরের অট্টহাসি ও ললুপ্ত জিহ্বার লেলিহান। দুর্গা তার সমস্ত শক্তি একত্র করে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, প্রতিবাদ গড়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না।

 রক্তে স্নাত ছোট্ট দুর্গা মাটির কোলে ঢুলে পড়ল। অবনী যেন তাকে সবুজ মাটির আঁচলে আড়াল করার সমস্ত চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ...


এমন সময় অস্পষ্ট চোখে রামচন্দ্র কাকাকে দেখতে পায় দুর্গা। রামচন্দ্র যে পরিস্থিতির কল্পনা করে এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল সেই দৃশ্যই তার সামনে। ভয় না পেয়ে শক্ত করে লাঠিটা ধরে আর চিৎকার করে বলে," ওঠ আমার দস্যি দুগ্গা, ওঠ... এখন ঘুমাইবার বা দুব্বল হওয়ার সময় নাই, জাইগ্যা তরে উঠতেই হইবো মা দুগ্গা।" এই বলতে বলতে দুটোর মাথা গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। সে লড়াই বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে আর চলতে থাকে রামচন্দ্রের বোধন মন্ত্র উচ্চারণ....


রামচন্দ্র আবার চিৎকার করে বলে, "মা দুগ্গা তরে জাগতেই হইবো,আর ঘুমাইয়া থাকিস না, ওঠ মা ওঠ...তরে উঠতেই হইবো।" অনবরত দুর্গার কানে রামচন্দ্রের জাগরণ মন্ত্র ধ্বনিত হতে থাকে।দূর থেকে শঙ্খ, উলু ধ্বনি, ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে। বাতাস ও জোরে জোরে বইতে থাকে।


 দুর্গা তার ভিতরে এক অদ্ভুত নারী শক্তির অনুভব করে। সে তার সমস্ত শক্তি একত্র করে এবং মাটিতে হাত ছড়াতে থাকে, আর খুঁজে পায় সেই রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষের আশীর্বাদী কাস্তে। সেই কাস্তে নিয়ে দুর্গা তাদের সামনে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক যেন দেবী স্বয়ং, মৃন্ময়ী চিন্ময়ী রূপে সামনে দাঁড়িয়ে। শত জোনাকির মিটিমিটি আলোয় রামচন্দ্র দুর্গার রূপ দেখে হতবাক। আপাদমস্তক মাটিমাখা, রক্তে স্নাত লাল রং, দু চোখে আগুন আগুন। তার ক্রোধাগ্নি যেন শুধুই অশুভের ধ্বংস চায়।


 সেই আশীর্বাদী কাস্তেটা নিয়ে দুর্গা ধেয়ে যায় তাদের দিকে এবং শুরু হয় অসুর বধ। রামচন্দ্র জোড়হাতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। দুর্গা রাগে যেন উন্মাদ হয়ে ছুটছে আর বলছে," নারী শক্তিকে তোরা দুর্বল মনে করিস! নিরীহ মনে করিস! অসহায় মনে করিস! তোরা জানিস না এ নারী শক্তি যখন জাগে তোদের ছিঁড়ে ফেলতে পারে, ধ্বংস করে ফেলতে পারে। একে জাগাস না, জাগলে তোদেরই বিপদ। এবার দেখবি একে একে সব শক্তি জাগবে.... জাগবে সব নারী শক্তি..... জাগবে....." 

একে একে সব অসুর বধ করে, কিন্তু তবুও দুর্গার রাগ থামে না, রামচন্দ্র করজোড়ে দুর্গাকে প্রণাম করে এবং শান্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দুর্গা মাটির কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। 


গ্রামবাসীরা চিৎকার, চেঁচামেচির আওয়াজে সেই স্থানে উপস্থিত হয় এবং দুর্গা ও রামচন্দ্র কে ঘরে ফিরিয়ে এনে চিকিৎসা করায়। দুর্গা আস্তে আস্তে চোখ খোলে আর বলে রামচন্দ্র কাকা তোমার কাস্তেটা ফিরিয়ে এনেছি আমি...


ওদিকে বোধন শেষ মা আলো করে বসে আছেন আসনে।



প্রথা - তনিমা সাহা || Protha - Tonima Saha || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

প্রথা

তনিমা সাহা




সময়টা নব্বইয়ের দশক। কমলেশ মল্লিক আজ বহুবছর পর বাড়ি যাচ্ছে। এমন নয় যে বাড়ির সাথে তার কোন টান নেই। বাড়ির সাথে টান তার ষোল আনা। বাড়িতে তার বাবা, মা, ছোট বোন, ছোট ভাই, জ্যেঠু, জ্যেঠিমনি, জ্যাঠতুতো দুই যমজ দাদা এক দিদি সব মিলিয়ে জমজমাটি ব্যাপার! কিন্তু কিছু কিছু সময় ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না। ফি মাসে বাড়ি থেকে চিঠি যায় তার কাজের জায়গায়। সে চিঠির উত্তরটাও কমলেশ পাঠায়। এবার কমলেশের মা খুব করে বলেছে যে মল্লিক বাড়িতে প্রথমবার দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হবে। এবার যেন অবশ্যই বাড়ি আসে। কমলেশ যেদিন বাড়ি পৌঁছায় সেদিন ষষ্ঠীর সন্ধ্যা। একচালা ঠাকুর হয়েছে এবার। কুমোর পাড়ার চন্দ্রকাকা মায়ের চক্ষু দান করছেন। চক্ষুদানের পর চন্দ্রকাকা মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কমলেশ চন্দ্রকাকার দিকে এগিয়ে যেতেই জ্যেঠু বাধা দিয়ে বলেন, 'কাঁদতে দে তাকে। মনের ভারটা একটু হালকা করে নিক।'



কমলেশ বাড়ির বাইরে আজ প্রায় চারবছর। ভিনরাজ্যে কাজের সুবাদে বিভিন্ন লোকের সাথে মেলামেশার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। কিন্তু তার এইধরনের অভিজ্ঞতা নতুন। ছোট থাকতেই দেখেছে পাড়ার বা পাশের পাড়ার দুর্গাপুজো হতে…পঞ্চমী থেকে দশমীতে ভীষণ মজাও করেছে। কিন্তু পুজোগুলো তার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় কাঠামো তৈরিটা সেভাবে তার দেখে হয় নি। মায়ের প্রণাম সেরে ঘরে ঢুকে কমলেশ দেখে যে মা, জ্যেঠিমা, জ্যাঠতুতো দুই বৌদি, দিদি আর বোনকে সঙ্গে করে ষষ্ঠী পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কমলেশ বইয়ের তাক থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করে পড়তে লাগল। কাজের জায়গায় আর কোন অসুবিধা না থাকলেও এই বাংলা ম্যাগাজিনের আর মায়ের হাতের রান্নার ভীষণ ভাবে অভাব অনুভূত হত। 



বিছানায় আধশোয়া হয়ে কমলেশ বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে হাতের ম্যাগাজিনটা উল্টেপাল্টে দেখছিল। ঠিক সেসময় কমলেশের ছোট ভাই অমলেশ এসে বলে, দাভাই চল, মায়ের আরতি শুরু হবে।'



ম্যাগাজিনটা পাশে রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কমলেশ বলে, 'আরে অমু তোর তো পাত্তাই পাওয়া যায় না। আমি তো এসে নিয়ে তোকে দেখতে পাই নি। কোথায় ছিলিস?'



মাথাটা চুলকে অমলেশ বলে, 'ওই আর কি! একটু ব্যস্ত ছিলাম এদিক-ওদিক। ওই চ'। মা-জ্যেঠিমারা ডাকছে।'



কমলেশ ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, 'চল।'



পুজোর আরতির পর সব ভাইবোনেরা ছাদের ঘরে চা আর তেলেভাজা মুড়ির সাথে আড্ডা জমিয়েছে। কমলেশকে এতদিন পর পেয়ে তাদের গল্পের ঝুড়িই শেষ হচ্ছে না। কমলেশের জ্যাঠতুতো দাদারা অন্য শহরে থাকে। কমলেশ যেবছর চাকরি পেয়েছিল সেবছরই দুই দাদার বিয়ে হয়। ঠিক দুবছর পর জ্যাঠতুতো দিদি মল্লিকারও বিয়ে হয়। কিন্তু কিছু কারণ বশতঃ কমলেশ মল্লিকার বিয়েতে আসতে পারে নি। পুজো উপলক্ষ্যে দাদারা আসলেও দিদির বর কিছু কাজে আটকে যান। তিনি অষ্টমীর সকালে আসবেন।



কথা বলতে বলতে কমলেশ হঠাৎ বলে, 'আজ মায়ের চক্ষুদানের পর চন্দ্রকাকাকে কাঁদতে দেখলাম। কেন কাঁদল বলতো? কাকার কী আর্থিক কিছু অসুবিধা আছে নাকি! সেরকম হলে আমি কিছুটা সাহায্য করতে পারি।'



দু'বৌদি তখন বাড়ির সকলকে চা দিয়ে বাকিদের চা নিয়ে ছাদের ঘরটায় আসে। কমলেশের কথা শুনে বড়বৌদি বলে, 'চন্দ্র কাকার আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল।'



কমলেশ অবাক হয়ে বলে, 'তাহলে অতবড় মানুষটা অমন করে কেঁদে উঠল কেন?'



ছোটবৌদি ফিক করে হেসে বলে, 'আমাদের কমল এতদিন বাইরে বাইরে থেকে সব ভুলে গেছে। চন্দ্রকাকা আবেগে কেঁদেছে। ও তুমি বুঝবে না। ভেতর থেকে ওই অনুভূতি না আসলে ঠিক বোঝা যায় না।'



সেদিন আরো কিছুক্ষণ গল্প করে সবাই উঠে পড়ল। জ্যেঠিমা, মা, বৌদিদের আবার কাল ভোরে উঠতে হবে। সপ্তমীপুজোর লগ্ন আগামীকাল ভোর পাঁচটায় লেগেছে। রাতে শুয়ে কমলেশ ভাইকে বলে, 'জ্যেঠুর হঠাৎ বাড়িতে দুর্গাপুজো করার মন কি করে হল রে!'



অমলেশ বলে, 'জানি না দাভাই। তবে বাড়িতে পুজো হচ্ছে। এটা কিন্তু বেশ লাগছে।'



কমলেশ একটু চুটকি হেসে বলে, 'হমম এই বেশ লাগাটা একটু বেশিই হচ্ছে মনে হচ্ছে। তা মেয়েটা কে? আড্ডার সময় তুই তো সারাক্ষণ ওদিকেই তাকিয়ে ছিলিস।'



অমলেশ একটু লজ্জা পেয়ে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। কমলেশ মুচকি হেসে বলে, 'বল, বল বলে ফ্যাল দেখি।'



অমলেশ বলে, 'ও ছোটবৌদির মামাতো বোন। স্কুল ফাইনাল দিয়েছে।'



কমলেশ বলে, 'হমম, বিষয়টা তাহলে খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।'



'না না, দাভাই। তুমি এখনই কিছু বলো না। ওর তো ক্যারিয়ার আছে। ক'টা দিন যাক। তাছাড়া আমিও তো এখনও সেভাবে..,' অমলেশ বলে।



কমলেশ খুশি হয়ে বলে, 'ভাইটা আমার বড় হয়ে গেল। ঠিক আছে আমার কোন সাহায্য লাগলে বলিস।'



অষ্টমী পুজোর সকালে জামাইবাবু আসেন বাড়িতে। জামাইবাবুর নাম সুতনু বোস। পেশায় সরকারি কর্মচারী। বিয়ের সময় কমলেশের জামাইবাবুর সাথে আলাপ হয় নি। এই প্রথম দেখা হল। কমলেশের সাথে তিনি দুনিয়ার গল্প জুড়ে দেন। আড্ডার আসরে কমলেশের দুই দাদা অজিতেশ আর অমিতেশও এসে যোগ দেয়। বিভিন্ন গল্পে গল্পে ছোটবেলার কথা ওঠে। 



অমিতেশ হাসতে হাসতে বলে, 'জানো তো সুতনু..কমলটা ছোটতে একদম মেয়ে মেয়ে দেখতে ছিল। কাকিমা ওকে প্রায়ই মেয়েদের জামা পড়িয়ে রাখতেন। পরে অবশ্য ওই জামাগুলো বোনকেই পড়ানো হয়। আমরা যখন একটু বড় হলাম তখন সেসময় নতুন ধারা শুরু হয়েছিল। দোকান থেকে একই রঙের বা একই ডিজাইনের থান কাপড় কিনে এনে বাড়ির বাচ্চাদের জন্য জামা বানিয়ে পড়ানো। দুই বোনের জন্য জামা আর আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য শার্ট। সেই চকরা-বকরা ডিজাইন, ফুল ফুল ডিজাইন, বড় বড় ববি প্রিন্ট ডিজাইন…এমন কত যে কাপড়ের ডিজাইনের শার্ট পড়েছি। একবার কে একজন ভাইকে ক্ষেপানোর জন্য পুজোর জামাকে বলে দিয়েছিল ইউনিফর্ম। ব্যস ভাই সেই ঘরে এসে হাত পা ছড়িয়ে সে যে কী কান্না করেছিল, বাপরে বাপ! তবে ভাইয়ের সেই কান্নার জন্য পরের বছর থেকে থান কাপড় কিনে পুজোর জামা বানানোর ধারাটাও বন্ধ হল।'



সুতনু কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠল। এমনসময় মল্লিক বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যা অমলেশদের সবচেয়ে ছোট বোন চন্দ্রা এসে অভিমানী গলায় কমলেশকে বলে, 'দাভাই, আমি তোর ওপর খুব রাগ করে আছি।'



চন্দ্রা বাড়ির ছোট হওয়ায় সবার খুব আদরের। চন্দ্রার এবছর ক্লাস এইট হল। কমলেশ আদর করে বোনকে পাশে বসিয়ে বলে, 'কেন রে! কী করেছি আমি!'



চন্দ্রা অভিমানী স্বরে বলে, 'আমাকে সবাই পুজোতে গিফ্ট দিয়েছে। শুধু তুই একমাত্র দিস নি।'



কমলেশ বলে ওঠে, 'একদম ভুল হয়ে গেছে রে! এবার একদম মনেই ছিল না।'



চন্দ্রা মুখটা ফুলিয়ে বলল, 'সেই..ওই এককথা বলেই হয়ে গেল। গত চারবছরের ভাইফোঁটার গিফ্টগুলোও পাওনা আছে।'



কমলেশ চন্দ্রার গালটা টিপে বলে, 'ঠিক আছে পরের বছর থেকে পাক্কা গিফ্ট আনবো। আর এ'বছরের জন্য চিকেন রোল পার্টি হোক।'



তারপর সবার দিকে তাকিয়ে সে বলে, 'কী রাজি তো সবাই।'



বৌদিরা বলে, 'রাজি মানে…এই লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় আছে!'



কমলেশ বলে, 'তবে আগামীকাল বিকেলে হবে চিকেন রোল পার্টি।'



ঠিক এমন সময় জ্যেঠিমা এসে খবর দেয় যে কমলেশের সাথে কে একজন দেখা করতে এসেছে। নিচে নেমে কমলেশ দেখে শ্রীতমা এসেছে। শ্রীতমা কমলেশের স্কুলের বন্ধু। শ্রীতমা এখন কলেছে পড়ায়। এবছরই কলেজ সার্ভিস কমিশনে চাকরিটা হয় তার। পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে নানারকম কথা হয় দুজনের মধ্যে। আর বেশকিছু না বলা কথাও হয়। 




পরপর কয়েকটা দিন পুজোতে বেশ কাটলো কমলেশের। ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি বারবার মনের গুহরে জেগে উঠছে। ছোটবেলার বন্ধুরা এখন কোথায় আছে কে জানে! পড়াশোনার পর চাকরি করতে বাইরে গিয়ে আর সেভাবে কারোর সাথে যোগাযোগই নেই। কমলেশের বড্ড আফশোস হয়। আজ দশমী। বাড়ির মেয়ে-বৌ'রা, পাড়ার কাকিমা, মাসিমারা এসেছেন মা'কে বরণ করার জন্য। পুজোর এই ক'টা দিন বাড়িটা বেশ গমগম করছিল। এতদিন পর বাড়ি আসা। বাড়ির আদর আর এরকম একটা পুজোর আমেজ! সব মিলিয়ে দিনগুলো বেশ কাটছিল। কিন্তু আজ কেন জানি সকাল থেকেই কমলেশের মনটা খারাপ। কিন্তু ঠিক কী জন্য খারাপ তা সে বুঝতে পারল না। যথা সময়ে‌ নিয়ম মেনে মায়ের কাঠামো ওঠে ট্রাকের পেছনে। ট্রাক গিয়ে থামে বুড়িনদীর পাড়ে। এই নদীটা খুব গভীর আর চওড়া। কমলেশের জ্যেঠু, বাবা, দাদারা, জামাইবাবু, দিদি, বোন, ভাই সবাই এসেছে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে। নদীপাড়ে কিছু দূরে একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো কাঠামো টানবে! হঠাৎ সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, 'জয় দুর্গা মাই কী! আসছে বছর আবার হবে।'



শ্রীতমাও আজ বিসর্জনের সময় ছিল। বলে, 'কী চাইলি মায়ের কাছে?'



কমলেশ ভরা গলায় বলে, 'তোকে।'



কথাটা বলে নিয়েই মায়ের প্রতিমাটা নদীর জলে ফেলে দেয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের দাঁড়ানো ছেলেগুলো নদীতে ঝাঁপ দেয়। হাত দিয়ে কাঠামোটা টেনে অন্যদিকের পাড়ে ওঠে। দেবী প্রতিমাকে যখন বিসর্জন দেওয়া হচ্ছিল তখন কেন জানি কমলেশের বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। আরো কিছুক্ষণ কমলেশরা নদীপাড়ে কাটায়। এর মাঝে আরো দুটো ঠাকুরের বিসর্জন হয়। নদীপাড়ে ভীড়ের মধ্যেই কমলেশের এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে সবাই ফিরে আসে। বাড়িতে ঢুকতেই পুজোর জায়গাটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে কমলেশের। কিছুক্ষন আগের জনরব আর নেই। এক অদ্ভুত শূণ্যতা রয়েছে যেন! প্রতিমাটা যেখানে ছিল সেখানে এখন বড় একটা ঘীয়ের প্রদীপ জ্বালানো রয়েছে। পুরো পরিবেশটা কমলেশের মনে এক অজানা অনুভূতির সৃষ্টি করে। চাপা একটা কষ্ট হয় তার। কমলেশ তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসে। ঘরে তখন কেউ ছিল না। হঠাৎ কমলেশের খুব কান্না পায়। অকারণেই কেঁদে ওঠে সে। কিছুক্ষণ পর সে কাঁধে একটা স্নেহসুলভ নরম স্পর্শ অনুভব করে। চোখ মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কমলেশ দেখে ছোটবৌদি দাঁড়িয়ে আছে।



হাসি হাসি মুখে ছোটবৌদি বলে, 'কমল তাহলে উত্তরটা পেলে তো!'



কমলেশের মুখে আর কোন কথা জোটে না। 



ছোটবৌদি হাসিহাসি মুখে বলে, 'কমল আমরা আমাদের পুরোনো প্রথার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছি যে মনে হয় যেন এগুলো সব আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এই প্রথা ভিন্ন আমরা আলাদা কেউ নই। আমাদের প্রতিটি বিশ্বাসে, রীতিনীতিতে ওতপ্রত ভাবে মিশে আমাদের সভ্যতার প্রথা। তাই এই প্রথাগুলো সাথে যে আমাদের আবেগ অনুভূতি বাঁধা থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক।'



কমলেশ শুধু মাথা নাড়ে। তারপর খুব ধীর স্বরে বলে, 'চন্দ্রকাকা সেদিন খুব আবেগী হয়ে পড়েছিলেন; তাই না ছোটবৌদি।'



ছোটবৌদি কিছু না বলে মিষ্টি করে হেসে বলে, 'চলো, সবাই ও'ঘরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। চা পকোরার সংযোগে আড্ডাটা শুরু হল বলে।'



ও'ঘরে ঢুকতেই কমলেশ দেখে বড়বৌদি বিছানার এককোণে মাথায় হাত রেখে শুয়ে আছে। বাকিরাও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে।



কমলেশ বেশ চিন্তিত হয়ে মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করে, 'বড়বৌদির কী হয়েছে রে দিভাই।'



মল্লিকা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে বলে, 'জানি না ভাই। বড়বৌদি হঠাৎই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। বড়দাভাই গেছে ডাক্তার ডাকতে।'



একটু পরেই ডঃ পাল এসে বড়বৌদিকে চেক করে বললেন, 'সবই মায়ের আশির্বাদ। যেতে যেতে তোমাদেরকেও আশির্বাদ করে গেছেন। কইসব মিষ্টি খাওয়াও। ঘরে যে নতুন অতিথি আসতে চলেছে!'


আকবরের এঁটো পান - প্রীতম সরকার || Aakborer Eto pan - Pritam Sarkar || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

আকবরের এঁটো পান

     প্রীতম সরকার



বিষয়টা যে এই জায়গাতে পৌঁছে যাবে সেটা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি ভারত সম্রাট আকবর। আগ্রার কেল্লাতে রোজ যেমন খাবার তিনি খেয়ে অভ্যস্ত, আজও তেমনই খেয়েছিলেন। খাবার পরে অভ্যাস মতো সুগন্ধী মশলা দিয়ে সাজানো তাম্বুলি চিবোতে চিবোতে কেল্লার ভিতরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দুপুরে আজ যেন গরমটা বেশ ভালোই পড়েছে। বারান্দা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন সামনেই বয়ে চলেছে যমুনা নদী। কিন্তু অন্যদিনের মতো আজ যমুনার দিক থেকে যে হাওয়া আসছে, তাতে বেশ গরমের ভাব। এই গরম হাওয়ায় অস্বস্তি লাগছে সম্রাটের। মশলা যুক্ত পান এখনও মুখে রয়েছে তাঁর। মুখের ভিতরে তম্বুলির সঙ্গে মেশানো হরিনের নাভি কস্তুরির গন্ধে বেশ আরাম হচ্ছিল সম্রাটের। তম্বুলির ভিতরে অন্যান্য মশলার সঙ্গে কস্তুরি মিশিয়ে কিছুদিন থেকে রোজ খাচ্ছেন তিনি। তাঁর যে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল, রাজবৈদ্যের পরামর্শে সেটা নিয়ম করে পালন করায় অনেকটাই কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখন দুপুরের এই গরম আবহাওয়ায় থাকার চেয়ে বিশ্রাম কক্ষে চলে যাওয়া ভালো বলে মনে হলো আকবরের।


আগ্রার কেল্লার প্রাসাদের ভিতরে যে ঘরে আকবর দুপুরে বিশ্রাম করেন, সেই ঘর প্রাকৃতিক ভাবে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই গরমের দুপুরে সেই ঠান্ডা ঘরে বিশ্রাম নিতে রওনা হওয়ার সময় আধ খাওয়া তাম্বুলি মুখ থেকে বের করে বারান্দার মেঝের একধারে ফেলে দিলেন তিনি। কেল্লায় অনেক দাসী রয়েছে। তারা কেউ সম্রাটের এই উচ্ছিষ্ট আধ খাওয়া তাম্বুলি বা পান পরিস্কার করে নেবে। সেজন্য বারান্দায় উপস্থিত থাকা খোজাদের মাধ্যমে দাসীদের নির্দেশ দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন।  


আকবরের মাথায় এখন সেধরনের অন্য কোন চিন্তা নেই। সেদিক থেকে মানষিকভাবে অনেকটা হাল্কা মেজাজে রয়েছেন তিনি। এই মুহুর্তে তাঁর সাম্রাজ্যে কোথাও যুদ্ধ নেই। গুপ্তচররা এমন কোন খবর আনেনি, যে সামনে কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে। সেদিক দিয়ে এই মুহুর্তে অনেকটা নিশ্চিন্ত তিনি। যেটুকু ছোটখাটো সমস্যা রয়েছে, সেটা সেনাপতি মান সিং সামলে নিতে পারবেন এটুকু বিশ্বাস আকবরের রয়েছে।   


আকবর তাঁর আগের মোঘল সম্রাটদের মতোই খেতে ভালোবাসেন। এবিষয়ে রীতিমতো শৌখিন তিনি। আগ্রার কেল্লার প্রাসাদে আকবরের জন্য যে খাবার রান্না হয়, সেখানে সব কিছু দেখভাল করেন একজন কোষাধক্ষ্য, একজন গুদাম রক্ষক ও কয়েকজন কেরানি। রান্নার দায়িত্ব দেওয়া আছে একজন প্রধান পাচক আর চারশো জন রাঁধুনির উপরে। আকবর এই রাঁধুনিদের উত্তর ভারতের নানা জায়গা এবং পারস্য দেশ থেকে বেছে এনে পরীক্ষা নিয়েই রান্নার কাজে নিযুক্ত করেছেন। তবে সম্রাটের খাবার রান্না হয় খুব গোপনীয়তার সঙ্গে। কারন, সম্রাটের মনে সন্দেহ আছে, তাঁর খাবার বিষ মেশানো হতে পারে। আকরবের দাদু সম্রাট বাবরকে এক ভোজ সভায় খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল। বাবর প্রাসাদে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। প্রচন্ড শ্বাসকস্ট শুরু হয়েছিল বাবরের। কয়েকবার বমিও করেছিলেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরে রাজ বৈদ্য বাবরকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে তোলেন। সেকথা মাথায় রেখেই আকবর নিজের রান্না ঘরটিতে সব সময় কড়া পাহারার জন্য রক্ষীদের নিযুক্ত করেছেন। সেখানে কোন বাঁদীদের তো বটেই, রাজকর্মচারী থেকে শুরু করে রাজসভার অন্য ব্যক্তিদেরও ঢুকতে দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন সম্রাট। তারপরেও রান্না শেষ হলে, একজন প্রচন্ড বিশ্বস্ত রন্ধন পরীক্ষক প্রথমে সম্রাটের সব খাবার চেখে দেখে আরও একজন মীর বাকাওয়াল বা তত্তাবধায়ক। এরপরেই সেই রান্না করা খাবার সম্রাটের সামনে হাজির করে প্রাসাদের খোজারা। এমনকী খাবারের পরে সম্রাটকে যে তাম্বুল দেওয়া হয়, সেটাও নানা পরীক্ষার পরে সম্রাট মুখে দেন।  


গতকাল রাতে সম্রাট তাঁর নিজের হারেমের চারজন উপপত্নীর সঙ্গে কাটিয়েছেন। রাতে যোধা বাঈ এর সঙ্গে কিছুক্ষন যৌন সঙ্গম করে আকবর নিজের ঘরে ফিরে অন্য বিবাহিতা রানীদের বা কখনও তাঁর হারেমের সুন্দরী উপপত্নীদের খবর পাঠাতেন। যোধা ছাড়াও আরও রানী বা তাঁর উপপত্নী তো কম নেই! আকবরের উপপত্নী আর রক্ষিতা মিলিয়ে পাঁচশোজন রয়েছে হারেমে। কিন্তু মান সিং এর বোন যোধার সঙ্গে আকবর যৌনক্রীয়া করে যে যৌন সুখ পান, সেটা অন্য পত্নী বা উপপত্নীদের থেকে আকবর পান না। সেজন্য রোজ রাতে কিছুটা সময় তাঁর রাখা আছে যোধার জন্য।   


রাজসভার সব সভাসদরা জানেন, যে সম্রাট এই সব উপপত্নীদের ভেট পেয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যে যুদ্ধ করে সেখানকার রাজাদের হারিয়ে। অধিকাংশ রাজারাই আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে, সম্রাটকে হাতে রাখতে তাঁদের পরিবারের কোন অবিবাহিতা আত্মীয়ার সঙ্গে সম্রাটের বিয়ে দিয়েছেন। আর আকবর নিজে বুঝতে পেরেছিলেন, রাজপুতরা শত্রু হিসাবে যতটা ভয়ানক, আবার বন্ধু হিসাবে ততটাই উপকারী। সুষ্টুভাবে রাজকার্য চালাতে গেলে রাজপুতদের সঙ্গে মোঘলদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো রাখা প্রয়োজন। সেই কারনে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে আম্বর রাজ্যের রাজকন্যা, মান সিং এর বোন যোধাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি।  


আকবর সাম্রাজ্য শাসনের দৈনন্দিন কাজে এত চাপে থাকেন, রাতে বেশ কয়েকবার যোধা, অন্য রানীদের আর হেরেমের উপপত্নীদের সঙ্গে সঙ্গম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। সম্রাট যৌনক্রীয়া করেন, সেই ঘরের তাপমাত্রাও প্রাকৃতিক ভাবে ঠান্ডা করা থাকে। মোঘল সম্রাটদের নিয়ম মতোই সেই ঘরের দরজার সামনে আলাদা দেওয়াল করা আছে। রাতে যখন সম্রাট এই ঘরে থাকেন, তখন সেই ঘরের আশেপাশে কোন দাসদাসীদের থাকা সম্পুর্নভাবে নিষিদ্ধ। নরম মখমলি বিছানা, সুদৃশ্য পর্দা, হাজার মোমবাতির রঙিন ঝাড়বাতি, মৃগনাভির সুগন্ধেও সম্রাটের রমন ক্লান্তি কাটছিল না। নিজের বিবাহিতা রানীদের পরে আর কিছুতেই হারেমের দু’ চারজন উপপত্নীর বেশি রমন ক্রীয়ায় লিপ্ত হতে পারছেন না তিনি।  


এখন রাজ বৈদ্যের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলায় সেই ক্লান্তি কেটেছে। আজকের দুপুরের বারান্দার গরম থেকে আকবর ঠান্ডা ঘরে ঢুকে সেই কয়েক দিন আগের কথা মনে করছিলেন। এখন রাজ বৈদ্য তাঁকে যেন নতুন জীবনের উদ্দামতা এনে দিয়েছেন।


 


                     ।। ২ ।।


 


শেষ পর্যন্ত রাজ হেকিমকে কথাটা গোপনে খুলেই জানিয়ে ছিলেন সম্রাট আকবর। একমাত্র রাজবৈদ্যকে এই সমস্যার কথা জানালেই তার সমাধান সম্ভব, সেই বিশ্বাস আকবরের ছিল। তিনি একদিন রাজবৈদ্যকে দেওয়ান-ই-আম থেকে ঘরে ফিরে এসে ডেকে নিলেন। সম্রাটের হঠাৎ তলবে পেয়ে রাজ বৈদ্য একটু অবাক হয়েছিলেন। রাজবৈদ্য ভাবলেন, সম্রাটকে তো দেওয়ান-ই-আম এ থাকার সময় দেখে মনে হয়নি, তাঁর শরীরে কোন অসুস্থতা রয়েছে! তাহলে হঠাৎ সম্রাটের তাঁকে তলব কেন! রাজবৈদ্য সম্রাটের ঘরে প্রবেশ করা মাত্র সেখানকার সব দাসদের ঘরের বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আকবর। কথাটা অত্যন্ত গোপনে রাজবৈদ্যকে জানাতে হবে। সম্রাট চাননা তাঁর শরীরের এই গোপন কথা পাঁচ কান হোক বা গুপ্তচররা কোনভাবে খবর বাইরে পাচার করুক।  


“আমি চার, পাঁচবার সঙ্গমের পরেই কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি বৈদ্য সাহেব! আমার এই ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কি কিছু করা যায় না! না হলে, এত উপপত্নীদের সামলাবো কিভাবে! প্রতিরাতেই তো তাঁরা আমার অপেক্ষাতে শৃঙ্গার করে অপেক্ষা করেন! আমি যোধা বা অন্য রানীদের সঙ্গে কাটিয়ে, পরে দু-তিনজনের বেশি উপপত্নীদের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করতে পারছি না! খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। কিছু একটা উপায় করুন আপনি!”


রাজবৈদ্য অবশ্য সম্রাটের যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্বাভাবিক চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না। প্রতিদিনই আকবরের খাবারের মেনু ঠিক করেন রাজবৈদ্য। সম্রাটের শরীর বুঝে এবং মরশুম অনুযায়ী রাজবৈদ্যের দায়িত্ব এই মেনু তৈরি করা। অত্যন্ত গোপনে রাখা হয় সম্রাটের এই আগাম খাবারের তালিকা। আগে থেকে সম্রাটের নিজস্ব রাজবৈদ্য ছাড়া আর কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেনা সম্রাট সেদিন কি খাবার খেতে চেলেছেন। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাজবৈদ্য আগ্রা কেল্লার রন্ধনশালায় গিয়ে সম্রাটের খাবারের আলিকা অনুযায়ী রান্না করার নির্দেশ দেন। আগে থেকে যেহেতু রান্নার বিষয়ে কেউ কিছু জানতে পারে না, তাই সব ধরনের রান্নার জিনিস মজুত রাখতে হয় রান্না ঘরের গুদামে। যতক্ষন সম্রাটের জন্য রান্না হয়, রাজবৈদ্য রান্না ঘর ছেড়ে নড়েন না। সম্রাটের খাবারে পুষ্টিকর জিনিসপত্র দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা নজর রাখেন রাজবৈদ্য। রাজবৈদ্যের কথা মতোই সম্রাট আকবরের বিরিয়ানির প্রতিটি চালের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় সিলভার অয়েল। এই সিলভার অয়েল গুরুপাক বিরিয়ানি হজমে যেমন সাহায্য করে, তেমনই সম্রাটের যৌন শক্তি বাড়াতেও কাজে লাগে। তাছাড়া আফগানিস্তান থেকে যে মুরগী নিয়ে আসা হয়, সেগুলিকে কয়েক মাস ধরে কেল্লার ভিতরেই খামারে বিশেষভাবে পালন করে তবেই রান্নার উপযোগী করা হয়। এমনকী সেই মুরগীগুলোর শরীরে নানারকম তেল, চন্দন তেল মালিশ করানো হয়। সমাট্র যেন খাবার সময় কোনরকম আঁশটে গন্ধ মুরগীর মাংস থেকে না পান, সেটা রাজবৈদ্যই হুকুম দিয়েছেন খামারের কর্মীদের। এই মুরগীগুলোকে নিয়মিত হাতে করে দানা খাওয়ায় খামারের কর্মচারীরা। এই দানায় জাফরান আর গোলাপ জল মেশানো থাকে। মুরগীগুলোকে সাধারন জল খেতে দেওয়া হয় না। আলাদা পাত্রে নিয়মিত গোলাপ জল রেখে সম্রাটের জন্য রান্না হওয়ার আগে পর্যন্ত মুরগীগুলোকে খাওয়ানো হয়। রাজবৈদ্যের পরামর্শ মতো খামারের কর্মচারীরা এই কাজ করেন। এর ফলে মাংস নরম আর সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তবে সপ্তাহে দু’দিন নিরামিশ খাবার খান সম্রাট। সেটা সপ্তাহের কোন দিন হবে, সেটাও ঠিক করেন রাজ বৈদ্য। সেদিন গুলোতে সম্রাট আকবর মদ্যপান করেন না। পান করেন গঙ্গা জল। সুদুর হিমালয়ে গঙ্গার উৎসস্থল থেকে অত্যন্ত গোপনে কড়া পাহারায় নিয়ে আসা হয় সম্রাটের জন্য এই গঙ্গা জল।


আকবরের সমস্যার কথা শুনে রাজবৈদ্য সম্রাটকে বললেন, “জাঁহাপনা, আপনার জন্য তো সব ধরনের সুস্বাদু খাবার আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রন্ধন শালায় তৈরি করাই। তাতে যৌনশক্তি বাড়ার উপকরন দেওয়া হচ্ছে কি না, দেখে নিই। তারপরেও আপনার এই সমস্যা হচ্ছে, এ তো বড় চিন্তার কথা! আমি নতুন ভাবে আবার পুঁথি দেখছি। কোন উপায় খুঁজে বের করতে পারি কি না!”

“আপনি কিন্তু খুব বেশি সময় নষ্ট করবেন না বৈদ্য সাহেব! আমাকে তাড়াতাড়ি এই অবস্থা থেকে কাটিয়ে উঠতে হবে!” বললেন মোঘল সম্রাট আকবর।  


রাজবৈদ্য সম্রাটকে কুর্নিশ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আকবর আবার রাজবৈদ্যকে পিছু ডেকে বললেন, “বিষয়টা কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়। আপনি সেই কথাটা খেয়াল রাখবেন।”  


কেল্লায় নিজের ঘরে ফিরে এসে রাজবৈদ্য নিজের বানানো তালিকা বের করলেন। এই তালিকাতেই লেখা রয়েছে, আগামীকাল সম্রাটকে কি খেতে দেওয়া হবে। গভীর মনযোগ দিয়ে তালিকা পরীক্ষা করে রাজবৈদ্য দেখলেন, আগামীকালে সম্রাটের খাবার মেনুতে রয়েছে হারিষা রয়েছে। হরিষা বানানো হবে মুলতানি ভেড়ার মাংস, ভাঙ্গা গম আর এলাচ দিয়ে। আর রয়েছে ঈয়াখানি। এটা এক ধরনের মাংসের স্টু। সম্রাট আকবরের বিশেষ পছন্দের খাবার। এছাড়াও পারস্যের রেসিপিতে তৈরি করা ভেড়ার মাংসের রোস্ট। আর সঙ্গে থাকবে মটন রোগান জোস্‌। পারস্যে এই খাবারের রঙ ছিল সাদা। কিন্তু আগ্রা কেল্লায় সম্রাটের কাশ্মীরী রান্নার রাঁধুনি এই খাবারে পিঁয়াজ রসুনের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় কাশ্মীরের মোরগ চূড়া গাছের শুকনো ফুল। এইজন্য রোগান জোসের রঙ হয়ে যায় টকটকে লাল। ফলে এই খাবার থেকে দারুন গন্ধ বের হয়। সঙ্গে থাকবে কাবুলি নামের এক ধরনের বিশেষ বিরিয়ানি। ইরানি ভেড়ার মাংসের সঙ্গে বাংলার কালো ছোলা শুকনো এফ্রিকন আর আমন্ড এবং বেসিন পাতা দিয়ে বানানো হয় এই কাবুলি বিরিয়ানি।


রাজবৈদ্য দেখলেন, তার পরের দিনের সম্রাটের রেসিপির তালিকা। ওই দিন বাদশার নিরামিস খাবার খাবার পরিবেশন করা হবে। সম্রাট আকবর সপ্তাহে যেদিন গুলিতে নিরামিশ খাবার খান সেগুলোকেও দেখভাল করতে হয় রাজবৈদ্যকে। বৈদ্য দেখলেন, নিরামিশ মেনুতে সম্রাটের জন্য রয়েছে, পালং শাক। পালং শাক প্রচন্ড মিহি করে কেটে তারমধ্যে লবঙ্গ, আদা, দারুচিনি, এলাচ মিশিয়ে রান্না করে কেল্লায় থাকা সম্রাটের বিশেষ রাঁধুনিরা। এই নিরামিশ খাবারে সম্রাটের পছন্দ সবুজ আর গোলাপি রঙের সুগন্ধী মিষ্টি ভাত সঙ্গে রকমারি ফিরনি। সঙ্গে সম্রাটের প্রিয় জর্দার বিরিঞ্চো। রাজবৈদ্য জানেন এই জর্দার বিরিঞ্চো কিভাবে তৈরি করে রাঁধুনিরা। দশ সের সুগন্ধী চালের সঙ্গে পাঁচ সের মিছরি, চার সের ঘি সঙ্গে আধ সের করে কিসমিস, কাজু বাদাম, পেস্তা মিশিয়ে বানানো হয় এই বিরিঞ্চো।


সম্রাট নিজে খাদ্য রসিক হলেও এত পদের রান্নার সবটা কখনোই খান না আকবর। শুধু সব রান্নাগুলি একটু একটু করে চেখে দেখেন। এটাই সম্রাটের অভ্যাস। তবে নিরামিশ বা আমিশ, যে খাবার সম্রাটের জন্য রান্না হয়, সেগুলি সোনা, রূপা আর পাথরের পাত্রে সম্রাটকে পরিবেশন করে খোজারা। এই সময় তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এমনকী, রান্নার পরে সমস্ত খাবার পরীক্ষার পরে সেগুলি ঠিকমতো সম্রাটের সামনে পৌঁচচ্ছে কি না সেটাও দেখভাল করেন রাজবৈদ্য। মসলিন কাপড়ের বিশেষ এক ধরনের ব্যাগ তৈরি করিয়েছেন সম্রাটের খাস নিরাপত্তা রক্ষীরা। কড়া পাহারায় খাবারের এই ব্যাগ সম্রাটের খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্রাটের সামনে গিয়েই সেই ব্যাগ থেকে খাবার বাইরে বের করতে হয়।


রাজবৈদ্য নিজের ঘরে বসে নিজের তৈরি মেনু দেখতে দেখতে ভাবলেন, সম্রাট তো কথাটি গোপন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সম্রাটের রাঁধুনিরা ছাড়া অন্য কেউ তো বিস্তারিতভাবে বলতে পারবে না রান্নার পদের বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসগুলি। দু-একটা মাত্র তিনি জানেন। তিনি নিজে প্রতিদিন সম্রাটের রেসিপি দিয়ে রান্নার সময় রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকলেও, সেইভাবে কখনও খুঁটিয়ে দেখেননি রান্নায় কি মশলা ব্যবহার করা হয়। আর রাঁধুনিরা উত্তর প্রদেশ বা পারস্যের শুধু তো নয়, মোটামোটি ভারতের সব এলাকার ভালো রান্না জানা কিছু হাতে গোনা লোককেই সম্রাট নিজের রাঁধুনির কাজে রেখেছেন। নিজে খুব অল্প পরিমানে খেলেও সম্রাটের জন্য প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে রান্না করতে হয়। রাঁধুনিরা তো বটেই, অন্য কোন কর্মচারীর সম্রাটের জন্য তৈরি এই শাহী খাবারের স্বাদ নেওয়ার হুকুম নেই।


 


                     ।। ৩ ।।


 


নিজের ঘরে চিকিৎসা শাস্ত্রের নানা পুঁথি সামনে খুলে রেখে একমনে সেগুলি পড়ে চলেছেন রাজবৈদ্য। যৌনশক্তি বাড়ানোর ওষুধের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত পড়া শুরু করলেন তিনি। সম্রাটের বিরিয়ানির চালে যে সিলভার ওয়েল মেশানো হয়, তার উল্লেখ রয়েছে এখানে। এতে যৌনশক্তি বাড়ে সেকথাও লেখা রয়েছে। কিন্তু এর বেশি কিছু লেখা নেই।


তিনি চিন্তা করে রেখেছিলেন, পুঁথি দেখে যে ওষুধের ব্যবহারে সম্রাটের যৌনশক্তি বাড়ানোর উপায় পাওয়া যাবে, কেল্লার রান্না ঘরের মুল রাঁধুনিকে ডেকে নিয়ে সেই জিনিস সম্রাটের জন্য তৈরি খাবারে মেশানো বা সেই জিনিস সরাসরি রান্না করার নির্দেশ দেবেন। এই কারনে আগেই কেল্লার রাঁধুনিকে ডেকে পাঠাননি তিনি। তাঁর নিজের আগে এই বিষয়ে জেনে নিতে হবে! একটি পুঁথিতে রাজবৈদ্য দেখলেন, হিমালয়ের শীলাজিত নামে এক জিনিস মানুষের শরীরের যৌন ক্ষমতা বাড়ানো পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু জাঁহাপনার খাবারে নিয়মিত শীলাজিত ব্যবহার করা হয়। তবে কি শীলাজিতের পরিমান জাহাপনার জন্য তৈরি খাবারের সঙ্গে একটু বেশি পরিমানে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেবেন! তার আগে আরও একটু খতিয়ে দেখার জন্য অন্য একটা প্রাচীন পুঁথি টেনে নিলেন রাজবৈদ্য।


যে পুঁথিটা রাজবৈদ্য পড়ার জন্য খুলেছেন, সেটা অনেক প্রাচীন পুঁথি। খুব সাবধানে ধিরে ধিরে সেই পুঁথির প্রতিটি পাতা উল্টাতে হচ্ছে। তাল পাতার উপরে লেখা রয়েছে বিভিন্ন শারিরীক রোগের প্রয়োজনীয় প্রতিকারের উপায়।


রাজবৈদ্য খুঁজে চলেছেন, যৌনশক্তি বাড়ানো বা সেই শক্তি বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রাখার জন্য কি ওষুধের বিধান এখানে রয়েছে কি না! অনেক দিন আগের পুঁথির পাতাগুলোর অবস্থা রীতিমতো খারাপ! সেই পুঁথির মাঝ বরাবর হঠাৎ রাজ বৈদ্য দেখতে পেলেন, সেখানে হরিনের নাভি কস্তুরির বিষয়ে লেখা রয়েছে।


কস্তুরির নানা গুনাগুন পড়তে পড়তে তাঁর নজরে এলো, এতক্ষনে তিনি যেটা খুঁজছেন, সে বিষয়েই পুঁথিতে লেখা রয়েছে। বৈদ্য মনযোগ দিয়ে পড়ে দেখলেন, পুঁথিতে লেখা রয়েছে, কস্তুরি নিয়মিতভাবে খেলে মানুষের যৌন ক্ষমতা বেড়ে তো যায় বটেই, উপরন্তু যে ব্যক্তি কস্তুরি খান, সেই মুহুর্তে তাঁর যৌন কাতরতা কয়েক’শো গুন বেড়ে যায়। লেখাটা দেখেই পুঁথিটাকে রেশম কাপড়ে জড়িয়ে পুথিটাকে নিয়ে রওনা হলেন শাহেনশার প্রাসাদের দিকে।


 


                     ।। ৪ ।।


 


সম্রাট আকবর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে মরসুমি ফল খাচ্ছিলেন। এই মরসুমি ফলের তালিকাও সম্রাটকে রাজবৈদ্যই বানিয়ে দিয়েছেন। আকবরের ঘরের ভিতরে শাহেনশার হুকুম পালন করার জন্য দুজন খোজা দাঁড়িয়ে ছিল।


সম্রাটের প্রাসাদের দরজায় পাহারা দিচ্ছিল বল্লম হাতের চারজন পাহারাদার। রাজবৈদ্য পাহারাদারদের মধ্যে একজনকে দিয়ে তাঁর সম্রাটের সঙ্গে এই বিশ্রামের সময় সাক্ষাতের প্রার্থনা করে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে, তা মঞ্জুর করলেন আকবর। সম্রাটকে কুর্নিশ করে রাজবৈদ্য বললেন, “জাঁহাপনা, একটা খুব ভালো খবর আছে আপনার জন্য!”  


রাজবৈদ্যকে দেখেই সম্রাট আন্দাজ করলেন, শাহেনশাহকে গুরুত্বপূর্ন কিছু বলতে এই সময়ে এসেছেন তিনি। সাধারনত এই সময় সম্রাট বিশ্রাম করেন। সেই কথাটা জানে প্রাসাদের সব দাসদাসী থেকে রাজ কর্মচারীরা পর্যন্ত। এমনকী, আকবরের রাজসভার বিশেষ গুরুত্বপূর্ন সদস্যরা, নবরত্ন বলে যাঁদের খ্যাতি রয়েছে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে, তাঁরাও এই ব্যক্তিগত সময়ে সম্রাটকে বিরক্ত করার সাহস দেখান না! এই অসময়ে আকবরের বিশ্রামের ঘরে রাজবৈদ্যের উপস্থিতিতে সেখানে সম্রাটের হুকুম তালিমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা খোজা থেকে বাইরের দরজায় পাহারায় থাকা রক্ষীরাও অবাক হয়েছে!


রাজবৈদ্যকে দেখে আকবর সেই কর্মচারীদের ডেকে নির্দেশ দিলেন, “যতক্ষন রাজবৈদ্য আমার কাছে থাকবেন, সেই সময় এখানে যেন কেউ ঢুকতে না পারে!”


গতকালই রাজবৈদ্যকে ডেকে নিয়ে গোপনে আকবর তাঁর শারিরীক সেই সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন। এরমধ্যেই কি সেই সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজে পেয়েছেন রাজবৈদ্য!


আকবর তাঁর বিশ্রামে ঘর ফাঁকা হতেই কৌতুহল চেপে জানতে চাইলেন, “বলুন বৈদ্য মশাই, কি ভালো খবর নিয়ে এসেছেন আমার জন্য!”


রাজবৈদ্য সম্রাটের থেকে অনুমতি পেয়ে বললেন, “আপনি আদেশ দেওয়ার পর থেকেই আমি চিকিৎসা শাস্ত্রের সব পুঁথি ঘেঁটে একটা উপায় পেয়েছি, যাতে আপনার যৌন ক্ষমতার সঙ্গে যৌন শক্তিও বৃদ্ধি পেতে পারে! আপনার হুকুম হলেই আমি সেগুলো জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে পারি! সেই সঙ্গে আপনার দৈনন্দিন খাবারের সঙ্গে সেই জিনিস কিছু পরিমান খেলেই আপনি সেই শক্তি অর্জন করতে পারবেন!”


“কি সেই মহার্ঘ্য জিনিস!” জিজ্ঞাসা করলেন সম্রাট।


“আজ্ঞে সেই জিনিস হলো কস্তুরি! মানে হরিনের নাভি”, জবাব দিলেন রাজবৈদ্য।  


“আপনি বলছেন পুঁথিতে সব কথা লেখা রয়েছে! সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন সেই পুঁথি!” ফের জিজ্ঞাসা করলেন আকবর। তবে তাঁর পুঁথি দেখেও যে কোন লাভ হবে না, সেটা ভালো করেই জানেন আকবর।


ভারত সম্রাট হলেও আকবর নিজে পড়াশোনা তেমন জানেন না! আসলে তিনি অক্ষর মনে রাখতে পারেন না! সেই কারনে রাজ বৈদ্যের কাছে তিনি পুঁথির লেখা দেখার কোন ইচ্ছাই দেখালেন না। খুব ছোটবেলাতে, তাঁর বাবা হুমায়ুন মারা গিয়েছিলেন। সেসময় আকবরকে সিংহাসনে বসতে হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। সেসময় আকবরকে রাজকার্য সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সব রকম সাহায্য করেতেন বৈরাম খান। সেই ছোটবেলা থেকে রাজকার্য পরিচালনার পাশাপাশি আকবরের নারী সংসর্গ পেতে কোন বেগ পেতে হয়নি। বেশ কয়েকবার যুদ্ধ করতে হয়েছে অবশ্য তাঁকে। প্রতিদিনই যুদ্ধের শেষে নারী সম্ভোগ ছিল আকবরের সেই ছোটবেলার অভ্যাস।


এখন যখন আকরর নিজেই অনুভব করেছেন, তাঁর যৌনশক্তি কমে যাচ্ছে, তিনি আর আগের মতো নারী সম্ভোগ করতে পারছিলেন না, সেসময় সম্রাটের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, অত্যন্ত ছোট বয়স থেকে এক নাগাড়ে রোজ বহু নারী সম্ভোগের জন্য তাঁর কোন গোপন রোগ হয়েছে কি না! কিন্তু গতকাল সেই আশঙ্কার কথা তিনি জানাননি রাজবৈদ্যকে। কিন্তু রাজবৈদ্য সেধরনের কোন সম্ভাবনার কথা না শোনানোয় সম্রাট নিজের মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।


রাজ বৈদ্যের পরামর্শ শুনে আকবর বললেন, “ এ আর এমন কি বড় ব্যাপার বৈদ্য মশাই। আমি তো নিয়মিত শিকারে যাই। শিকার করতে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগে। আপনি তো জানেন, আমি হাতি পর্যন্ত শিকার করেছি। বাঘ, হরিন তো শিকারে গেলেই পাওয়া যাবে। কস্তুরি সংগ্রহ করা কোন বড় ব্যাপার হবে না! কিন্তু আপনি নিশ্চিত তো যে, কস্তুরি খেলে আমার এই যৌন সমস্যা মিটে যাবে!”


“আজ্ঞে জাঁহাপনা, চিকিৎসা শাস্ত্রের পুঁথিতে তো তাই বলছে!” জানালেন রাজবৈদ্য।  


আকবর বললেন, “বেশ! তবে আমি আগামীকালই শিকারে যাবো। এবার আমার প্রধান লক্ষ্য হবে হরিন শিকার করার। এছাড়াও আমি রাজসভাতে ঘোষনা করছি, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কস্তুরি যেন এই কেল্লায় নিয়ে আসা হয়!”


 


 


                          ।। ৫ ।।


 


সেই সময় থেকে আকবরের জন্য যে রান্না করা হতো, সেখানে আগের মতোই নিয়মিত উপস্থিত থাকেন রাজবৈদ্য। রাজবৈদ্যের পরামর্শে সম্রাটের রান্নায় নিয়মিত কস্তুরি দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা দেখভাল করছেন রাজ তিনি। সম্রাটের জন্য তৈরি বিরিয়ানিতে যেমন কস্তুরি দেওয়া হচ্ছে, তেমনই কস্তুরির ব্যবহার হচ্ছে ফিরনিতেও। ফলে সম্রাটের সমস্ত খাবার আগের থেকে সুগন্ধী হচ্ছে! কস্তুরির তো এক আলাদা সুগন্ধ রয়েছে! এই কস্তরির গন্ধে পাগল হয়ে মেয়ে হরিন তাদের সঙ্গম মরসুমে ছুটে যায় ছেলে হরিনের কাছে।  


রাজবৈদ্য পুঁথিতে দেখেছেন, বিশেষ নিয়মে এই আসল কস্তুরি শাহেনশার জন্য তৈরি করতে হবে। যে পাহাড়ি হরিনের কস্তুরি খাবারের সঙ্গে ব্যবহার করা হবে, সেই হরিনের বয়স হতে হবে কমপক্ষে দশ বছরের বেশি। হরিন মেরে সেই হরিনের থেকে কস্তুরি সহ নাভি তুলে নিয়ে এসে রোদে ভালো করে শুকোতে হচ্ছে। সেই কাজও দেখাশোনা করছেন তিনি নিজের উদ্যোগে। রোদে শুকোনোর পরে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক হরিনের থেকে পাওয়া কস্তুরির ওজন হয় ৬০ থেকে ৬৫ গ্রামের মতো। সম্রাটের খাবারের মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে কস্তুরির ব্যবহারের ফলে আকবর যে উপকার পেয়েছেন, সেটা দিন দু’য়েক আগে গোপনে রাজবৈদ্যকে ডেকে জানিয়েছেন। সম্রাটের জন্য দেওয়া তাঁর টোটকা যে কাজে লেগেছে, সেটা রাজ বৈদ্য জেনে যথেষ্ট খুশি হয়েছেন।


সম্রাট তাঁকে কয়েক দিন আগে দুপুরে বিশ্রাম ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বলেছেন, “আমি এখন সম্ভোগে আর ক্লান্ত হচ্ছি না বৈদ্যি মশাই। আপনার পরামর্শে খাবারের সঙ্গে কস্তুরি খেয়ে, তার গুন মনে হয় আমার শরীরে ভালো কাজ করছে। এক এক সময় তো কস্তুরি গ্রহনের কিছুক্ষনের মধ্যে আমি যৌন কাতর হয়ে পড়ছি!”


রাজবৈদ্য কুর্নিশ করতে আকবর তাঁর দিকে একটা মখমলি কাপড়ের তৈরি ছোট বটুয়া ছুঁড়ে দিলেন। সেটা রাজবৈদ্যের হাতে তালুতে গিয়ে পড়তে ঝনঝন শব্দ করে উঠলো। রাজবৈদ্য বুঝতে পারলেন শাহেনশাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে উপহার দিয়েছেন! মনে মনে আন্দাজ করলেন, যে বটুয়ার ভিতরে কয়েকটি মোহর রয়েছে। কিন্তু সম্রাটের সামনে সেগুলি বটুয়ার ভিতর থেকে বাইরে বের করে দেখা উচিত হবে না মনে করে বটুয়াটিকে কোমড়ে গুঁজে রাখলেন বৈদ্য সাহেব।


দুপুরের খাওয়ার পরে আকবর বিশ্রাম করেন, এটা তাঁর বরাবরের একটা অভ্যাস। বিশ্রামের জন্য কেদারার নরম গদিতে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। তখনই রাজবৈদ্য সম্রাটকে বললেন, “গুস্তাকি মাফ্‌ করবেন জঁহাপনা, আপনার কস্তুরি খাওয়ার পরিমান আরও বাড়ানো প্রয়োজন।”


“কেন, পাচক তো জানালো সব রান্নাতেই সে কস্তুরির ব্যবহার করছে!” আকবর বলে ওঠেন।


“আমার প্রস্তাব ছিল, দুপুরে খাবার খাওয়ার পরে আপনি একটা তাম্বুলি মুখে নিয়ে চিবোন। সেই তম্বুলি বা পান পাতার ভিতরে অন্যান্য মশলার সঙ্গে নিয়মিত কস্তুরি খান! এতে আপনার আরও বেশি যৌনশক্তি বাড়বে!”


“ঠিক আছে, তবে তাই হবে!” বলে সম্রাট অন্যদিকে তাকিয়ে রাজবৈদ্যকে বুঝিয়ে দিলেন, এই ঘর থেকে তাঁর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।


 


 


                     ।। ৬ ।।


 


আজ দুপুরে বাইরে যে গরম হাওয়া দিচ্ছে, তাতে সম্রাট আকবর নিজের প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা করা ঘরে বিশ্রাম করতে এসে একটু তন্দ্রাঞ্চন্ন হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর নিজস্ব খানসামা এক খোজা এসে আকবরের সামনে দাঁড়িয়েছে। শাহেনশাহকে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম করতে দেখে, তাঁকে বিরক্ত করার সাহস পাচ্ছে না! সম্রাটকে এই অবস্থায় দেখে সেই খোজা ছুটলো বীরবলের প্রাসাদের দিকে। তাঁর সঙ্গে এরমধ্যে এসে জুটেছে প্রাসাদের কয়েকজন সেপাই। তাঁরা সবাই জানে, বীরবল দুপুরে বিশ্রাম করতে করতে বই পড়েন! সুতরাং বীরবলকে সহজেই পাওয়া যাবে!


বীরবলের প্রাসাদে এসে ফটকের পাহারাদারদের মাধ্যমে বীরবলকে খবর দেওয়া হলো, “সম্রাটের দুপুরের নিজস্ব বিশ্রাম ঘরের বারান্দায় এক বাঁদী উন্মাদের আচরন করছে! সম্রাট তাঁর বিশ্রাম ঘরে রয়েছেন! সম্রাটের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটতে পারে ওই বাঁদীর উন্মাদনার কারনে! তাই এক্ষুনি কিছু করা প্রয়োজন!”


বীরবল খোজা এবং রাজরক্ষীদের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে কেল্লার বৈদ্যদের খবর দেওয়ার নির্দেশ দিলেও বিষয়টা নিজে সরজমিনে দেখার কৌতুহল সামলাতে পারলেন না! দুপুরেই ছুটে এলেন সম্রাটের প্রাসাদের বিশ্রাম ঘরের সামনে।


বীরবল এসে দেখলেন, কেল্লার কয়েকজন বৈদ্য ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁরা ওই বাঁদীর শরীর পরীক্ষা করছেন।


বীরবল উপস্থিত পাহারাদারদের কাছে জানতে চাইলেন ঘটনা ঠিক কি ঘটেছে?


সম্রাট আকবরের ঘরের বাইরে পাহারায় থাকা রক্ষীরা বীরবলকে বললো, “এই বাঁদী দুপুরের পরে বারান্দা পরিস্কার করতে এসেছিল। তারপর থেকেই এই রকম পাগলামো করছে! যেসব পুরুষকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে! সে রাজ কর্মচারী হোক বা সম্রাটের দুপুরের পাহারায় থাকা পাহারাদাররা। সম্রাটের ভয়ে সবাই বাঁদীটার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, আর বাঁদীটা অসভ্যের মতো চিৎকার করছে! আমরা তো ভয়ে রয়েছি, এই চিৎকার চেঁচামেচিতে সম্রাটের বিশ্রাম যেন ব্যাহত না হয়। সেজন্যি পরামর্শের জন্য আপনার কাছে ছুটে যাওয়া হয়েছিল!”


বীরবল সব ঘটনা শুনে তো রীতিমতো অবাক! তিনি কখনও শোনেননি কোন বাঁদীর সম্রাটের বিশ্রাম ঘরের সামনে এই ধরনের আচরন করার সাহস পেয়েছে! সম্রাট জানতে পারলে, দাঁসীর গর্দান পর্যন্ত যেতে পারে!  


বীরবল সেখানে উপস্থিত বৈদ্যদের কাছে গিয়ে যতটা আস্তে আওয়াজ সম্ভব সেই ভাবে কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে এই বাঁদীর! কিছু অসুখের কারন ধরতে পারছেন আপনারা!”


বৈদ্যরা সবাই এক যোগে দু’দিকে মাথা নেড়ে দুপাশে হেলিয়ে ‘না’ ইশারা করলো। এবার বীরবল প্রাসাদের সবচেয়ে বয়স্ক বৈদ্যকে ডেকে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। এই বয়স্ক বৈদ্য আর কেউ নন, স্বয়ং রাজ বৈদ্য! সম্রাটের দেখভাল ছাড়া তিনি আর কোন ব্যক্তির শারিরীক পরীক্ষা করেন না! তবে সম্রাটের প্রাসাদের বারান্দায় এই ঘটনা ঘটায় আর স্বয়ং বীরবলের তলব পেয়ে রাজবৈদ্য এলেন। তিনি বাঁদীকে ছুঁলেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ধরনের অসুস্থতা অনুভব করছিস্‌?”


বাঁদী যা উত্তর দিলো, সেটা শুনে রাজবৈদ্য বললেন, “কি খেয়েছিস্‌ দুপুরে!”


দুপুর শেষ হয়ে এখন সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে চলেছে। সম্রাট আকবর এক্ষুনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রাসাদের নিজের মসজিদে নমাজ পড়তে যাবেন। সবাই তটব্যস্ত হয়ে রয়েছেন কখন সম্রাট ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সেই অপেক্ষায়।


রাজবৈদ্য ফের বাঁদীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রে, দুপুরে কি খেয়েছিস্‌, বল,!”


বাঁদী এবার কাঁদতে কাঁদতে ভয়ে উত্তর দিলো, “তেমন তো কিছু নয়! খাবার খেয়ে তো সুস্থই ছিলাম। এখানে বারান্দা পরিস্কার করতে এসে দেখি, কিছুটা আধ খাওয়া চেবানো পানের টুকড়ো পড়ে রয়েছে! সেটা দিয়ে দারুন সুগন্ধ বের হচ্ছে! মনে হলো, সম্রাটের এঁটো তাম্বুল! আমরা তো শাহী খাবার খেতে পাইনা! তাই লোভ সামলাতে না পেরে সেই আধ খাওয়া পানের টুকড়ো মুখে দেওয়ার পরেই শরীর যেন কেমন গরম হয়ে উঠলো!”


এরমধ্যেই সম্রাট আকবর বিশ্রাম ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বাইরে বারান্দাতে বীরবল, রাজবৈদ্য সহ আরও লোকজন সহ বাঁদীকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন! বীরবল সম্রাটকে সমস্ত ঘটনা খুলে জানালেন।


সব শুনে সম্রাট আকবর বললেন, “ওটা তো আমিই মুখ থেকে বের করে বারান্দাতে ফেলে গিয়ে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। ওটা পরিস্কারের জন্য হুকুম দিয়ে গিয়েছিলাম তো!”


“সেই হুকুম তামিল করে পরিস্কার করতে এসেই তো এত বিপত্তি জাঁহাপনা!” উত্তর দিলেন রাজবৈদ্য। আপনি ঘরে চলুন, এর আসল কারন আমি আপনাকে খুলে বলছি!”


এবার রাজবৈদ্য সেখানে উপস্থিত খোজা আর পাহারাদারদের বললেন, “এঁকে এক্ষুনি কেল্লার ভিতরে যে কুঁয়ো রয়েছে, সেই কুঁয়োর ঠান্ডা জলে নামিয়ে কিছুক্ষন চুবিয়ে রাখো। এর অসুখ ভালো হয়ে যাবে।”


সবাই রাজবৈদ্যের কথা মতো সেই কাজে চলে যাওয়ার পরে আকবরের সঙ্গে ঘরের ভিতরে ঢুকে রাজবৈদ্য সম্রাটকে কুর্নিশ করে বললেন, “আপনার ওধুধের ফল দেখলেন জাঁহাপনা! আপনি যে তাম্বুল আধ খাওয়া অবস্থায় বাইরের বারান্দায় ফেলে এসেছিলেন, তারমধ্যে কস্তুরি মেশানো ছিল। একদিকে শাহী খাবারের লোভ, অন্যদিকে কস্তুরির সুগন্ধীতে ওই বাঁদী লোভ সামলাতে না পেরে আপনার উচ্ছিষ্ট পান খেয়ে নিয়েছে। কস্তুরি খাওয়ার ফলে বাঁদী ভীষন রকমের কামাতুড়া হয়ে পড়েছে! কস্তুরি তো এঁদের শরীরে কোনদিন যায়নি! সেই কস্তুরির কারনেই বাঁদীটি এই ধরনের কান্ড ঘটিয়েছে! যাইহোক, জাঁহাপনা, আমার চিকিৎসা আপনার জন্য যে ভুল হয়নি, সেটা আরও একবার প্রমান হয়ে গেলো!”

একটি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা - ইলা সূত্রধর || Ekti Bristi veja Sondhaya - Ila Sutradhar || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

একটি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা

ইলা সূত্রধর



আজ সারাটা সন্ধ্যা বৃষ্টিতে ভিজেছে রূপসা। নিজের মনের দ্বন্দ্বে বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে ‌। ক্লান্ত শরীর মন বিছানায় গা লাগাতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।

হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে ঘুম ভেঙ্গে যায় রূপসার। ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই চেনা সেই কন্ঠস্বর যা গত দুই দিন থেকে ফোনটা আবার আসছে।


এ যেন মনের ডাইরির পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে, এক এক করে মনে পরছে পুরোনো সব স্মৃতি।

আজ প্রায় পাঁচ বছর রূপসা মেয়েকে নিয়ে আলাদা

রয়েছে কোলকাতায়। প্রানের চেও প্রিয় মা-বাবা,ভাই বোন প্রিয় শহর সবকিছু ছেড়ে এই নির্জন বাস সে কি শুধুমাত্র মেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে। 

রূপসা খুব সুন্দরী ও শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেদি ও অভিমানী বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে কিন্তু অবজ্ঞা সহ্য করতে পারে না‌। রূপসা বিয়ের আগে থেকেই লেখালেখি করত কিন্তু রক্তিমের সেটা পছন্দ ছিল না। তাই ভালোবাসার কাছে নতজানু হয়ে একদিন তার প্রিয় কলম বাক্স বন্দী করে রেখেছিল ,


 অবজ্ঞার আগুনে দগ্ধ হয়ে বহুদিন পর আবার সেই কলম আরও দৃঢ় হাতে তুলে নিল। আজ রূপসা একজন বিশিষ্ট স্বনামধন্য লেখিকা। রপসার রূপে গুণে চারিদিকে যেন গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই গন্ধ গিয়ে হয়তো রক্তিমের নাকেও লেগেছে তাই তো এতো দিন পর আবার,,,,,

 

রক্তিম একটি সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রূপ গুন বিশেষ করে বাইরের চাকচিক্যের দিকে তার নজর বেশি। রূপ দেখেই বিয়ে করেছিল রূপসা কে। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন খুব আগলে আগলে রাখত। রূপসা ও খুব ভালোবাসত রক্তিমকে। আনন্দে আত্মহারা রূপসা ভাবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। বাধ সাজলো রূপসার মা হওয়া। ঘর সংসার , সন্তান সবকিছু একা হাতে সামলাতে গিয়ে নাজেহাল রূপসা নিজের দিকে নজর দিতে ভুলেই গেছে। দিন দিন শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তিমের সঙ্গে দূরত্ব ও বেড়ে চলেছে। কথায় কথায় আজকাল রক্তিম বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করে। রূপসা কে অবজ্ঞা করে বলে সে তার যোগ্যই নয় । অফিসের পর বাড়িতে এসে বঁকি সময়টুকু মোবাইলে মুখ গুজে থাকে। রূপসার প্রতি আর কোন আকর্ষন নেই রক্তিমের। অভিমানী রূপসা মুখে কিছু বলেনা। কিন্তু মনের ভেতর টা তুষের আগুনের মত জ্বলতে থাকে।

তারপর একদিন রূপসা দিদির কাছে জানতে পারে রক্তিমকে অফিসের তার পার্সোনাল সেক্রেটারীর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে দেখেছে। শুনে রূপসার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিছু আর বুঝতে বাকি রইল না। তবুও যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাঁর সুখের সাম্রাজ্যকে এভাবে চোখের সামনে ভাঙতে দেখে উন্মাদিনীর মতো দৌড়ে ঘরে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর মেঘের গর্জনের আড়ালে তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল।

 

রক্তিমই কায়দা করে মেয়ের পড়াশোনার বাহানায় রূপসা কে মেয়ের সঙ্গে কোলকাতায় পাঠিয়েছিল।

প্রথম প্রথম দু' একটি ফোন কখনো সখনো করত।তারপর বহু দিন কেটে গেছে রক্তিম আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু রূপসা কিছুতেই ভুলতে পারেনি। সে ভাবতো রক্তিম নিজের ভুল বুঝতে পেরে একদিন ঠিক ফিরে আসবে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন সব অভিমান ত্যাগ করে নিজেই ফোন করল রক্তিমকে। ফোন ধরে বিরোক্তির সুরে রক্তিম বলে উঠলো, আমাকে আর কোনদিন ফোন করবে না। তুমি যেমন আছো চুপচাপ তেমনি থাক। তোমার সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়, আমি এখন অন্য কাউকে ভালোবেসি। কথাগুলো যেন তীরের ফলার মতো রূপসার কোমল হৃদয়ে বিঁধে ছিল। সেদিন আর কাঁদতেও পারেনি। চুপকরে বসেছিল অনেকক্ষণ।


অভিমানী, জেদি রূপসা সবকিছু ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। বই, খাতা কলমকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলতে শুরু করল। কেটে গেল কতোগুলো বছর। আজ সে সফল। লেখিকা হিসেবে তাকে আনন্দ পুরস্কার দেয়া হবে। মঙ্চে অনেক গুনীজন বসে আছে। সবাই রূপসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কোথায় যেন রূপসার বুকের ভেতর চাপা দুঃখের চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে।

অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সামনে কিছু বক্তব্য রাখে। পাশে ছিল বন্ধুবর মনিশ রূপসা তাকে দেখিয়ে বলে উনার জন্য আজ আমার এই সাফল্য। বন্ধু মনিশের অক্লান্ত চেষ্টায় আমি আজ লেখিকা। ও পাশে না থাকলে কোনো দিনই এই সাফল্য কিছুতেই সম্ভব হতো না। আমার এই সাফল্যের সম্পূর্ণ কৃতীত্ব আমার বন্ধু মনিশকে উৎসর্গ করলাম।

তারপর মনিশ সাংবাদিকদের ভীড় কাটিয়ে রূপসাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। রূপসা তাকিয়ে দেখে রক্তিম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ভুত দেখার মত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রূপসা। দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শেষে মনিশের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো। মনিশ বলল, দেখ কে এসেছে। তাকিয়ে দেখে রূপসা বলে উঠল,,,,,, তুমি

রক্তিম বলল, "আমাকে ক্ষমা করে দাও"। রূপসা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সেদিন তুমি আমাকে ওভাবে অপমান না করলে আজকের এই রূপসার জন্ম হতো না। তোমার অপমান আর অবজ্ঞাই আমার এই সফলতার কারণ। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো

আকাশটা আবার গুমোট মেঘে ভরে আসে। ঘনকালো মেঘ যেন রূপসার বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। জেগে ওঠে পুরোনো সেই চেনা ব্যথা। রূপসা মাটিতে বসে পড়ে

দু'চোখে বন্যা নেমে আসে। আকাশ থেকে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে রূপসাকে ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ধুয়ে যায় সমস্ত রাগ অভিমান। রক্তিম হাত ধরে রূপসা কে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে বসে রূপসা আর মনিশকে দেখতে পেল না। মনিশ রূপসা ও রক্তিমকে রেখে নীরবে চলে গেল। পেছনে ফিরে রূপসা দেখে উল্টোপথে মনিশ এলোমেলো অজানা উদ্দ্যেশ্যে হেঁটে যাচ্ছে।

বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রূপসার গাড়িতে রক্তিম নিজেই ড্রাইভ করে চলেছে অন্য আর এক দিগন্তের দিকে। অথচ অনুষ্ঠানে আসার সময় মনিশ এই গাড়ি চালিয়ে এসেছিল। অথচ যার থাকার কথা সে আদৌ ছিল না। এখন সে চালকের আসনে।


তুমুল বৃষ্টিতে আর সন্ধ্যারাতের রাস্তার আলোয় কোলকাতা যেন অন্য এক মাদকতা বহন করছে, সেকি আনন্দের না দুঃখের-- মনকে প্রশ্ন করে বারবার রূপসা। মা কোনদিন মনে হয়নি আজ এই সন্ধিক্ষনে মনিশের কথা বারবার মনে পড়ছে ,"ওর জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কেন! কেন জানি না মনে হল মনিশ বুঝি অনেকটা যন্ত্রনা নিয়ে ফিরে গেল।"

এসব ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিভেজা অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। রূপসা স্মৃতির পাতাগুলো আরও একবার হাতড়ে নিল। প্রথম কবে মনিশের সাথে দেখা হয়েছিল, ও লেখালেখি নিয়ে কেন এত উৎসাহ দিত, এসব হাজার প্রশ্ন আজ মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। মুসলধারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি ছুটে চলেছে যেন ঠিকানাবিহীন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

হঠাৎ রক্তিম গাড়ি থামালো, রূপসা বলল, "কি হলো থামলে যে "। রক্তিমের মুখটা রাঙা হয়ে উঠলো। রূপসার হাত মুঠোবন্দী করে বলল, নেমে এসো, দেখ আজ প্রকৃতি অপরূপ রূপ, অঝরে বৃষ্টিধারা বয়ে যাচ্ছে, ল্যাম্পপোষ্ট থেকে অজস্র 

আলোর সাওয়ার ঝরে পড়ছে, এ যেন রাশি রাশি মুক্তো। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না রূপসা, বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো রক্তিমের আহ্বানে।

পড়নে সিল্কের শাড়ি অঝোরে বৃষ্টিতে ভিজে টইটুম্বুর। কখন খোপার চুল আলগা হয়ে গেছে টেরই পায়নি। চুল গড়িয়ে জল চুইয়ে চুইয়ে মুখে, গলায়, তারপর বুক বেয়ে পড়ছে। মনে পড়ে না শেষ কবে এরকম ভাবে ভিজেছে। বুঝতে পারেনা কেন এতো বছর পর রক্তিম তাকে নিয়ে আবার পাগলামি শুরু করেছে। রূপসার হাতের তালুতে হাত রেখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আরও চেপে ধরলো রক্তিম। শরীরময় শিরা- উপশিরায় রক্তস্রোত দ্রুত গতিতে বইতে শুরু করল। সারাপিঠে সেতারের তারের মতো রক্তিমের আঙ্গুল স্বরগমে সুর বইয়ে দিতে থাকল। রূপসা সেই সুরে সুরে বিহ্বল হয়ে পড়ল। শরীরের উন্মাদনায় চরম এ প্রাপ্তি পুরোনো ভালোবাসা আবার ফিরে পেল।

তবুও কেন মনের ভেতর এতো অস্থিরতা, কেনোই বা এতো আকুলতা। যার দেওয়া শাঁখা সিঁদুর আজও বহন করে, সেই নিজের মানুষকে আবার কাছে পেয়েছে তবু কেন রূপসার বুকের ভেতরটা অস্থির করে উঠছে, নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। 

 আজকের এই চুড়ান্ত সফলতার পেছনে ছিল একমাত্র বন্ধু মনিশ। রূপসার ইচ্ছে ছিল পুরস্কার প্রাপ্তির পর মনিশকে নিয়ে কোথাও দুদন্ড সময় কাটানোর। তা আর হয়ে উঠলনা। এখন মনিশের কথা ভেবে বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে,মনিশটা আজ ভীষণ কষ্ট পেলো। গুমের কেঁদে উঠলো রূপসা, মনিশ তুমি কোথায়? 

ওর এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কান্নায় ভেঙ্গে পরছে রূপসা। প্রবল বর্ষণে সে কান্না কেউ দেখতে পেলনা। এমনকি রক্তিমও না।