Sunday, July 25, 2021

বসন্ত পরামাণিকের একটি গান

 তুমি এলে ব'লে


তুমি এলে তাই আকাশ বাতাস খুশিতেই মেতে ওঠে,

তুমি এলে তাই শাখে শাখে এত ফুলের কুঁড়িরা ফোটে ।


ফুলেরা লিখেছে শত অক্ষরে প্রেমময় কথামালা,

পাখিরা সাজালো সুরে সুরে আজ গানের বরণডালা ।

তুমি এলে তাই নদীটার বুকে আনন্দ-ঢেউ ওঠে,

তুমি এলে তাই শাখে শাখে এত ফুলের কুঁড়িরা ফোটে ।


তুমি শাশ্বত প্রেমের পুজারী, প্রতীক ভালোবাসার,

তোমাকেই ছুঁয়ে প্রকৃতি ও প্রেম হয়ে গেছে একাকার ।


প্রজাপতি আঁকে প্রেমেরই রঙেতে মিলনের কত ছবি,

নির্জনে বসে স্বপ্ন সাজায় উদাস বাউল-কবি ।

প্রেমের সুরেই একতারাটাও খুশি মনে বেজে ওঠে,

তুমি এলে তাই শাখে শাখে এত ফুলের কুঁড়িরা ফোটে ।



বদরুদ্দোজা শেখুর একটি গান

সোনার পাখি


আমার সোনার পাখি ময়না

আজ কোনোই কথা কয়না,

                পাখি গেছে উড়ে 

                দূরে বহু দূরে ।।


পাখি তোরে দিয়েছিলাম কতোই আদর যতন

তোরে করেছিলাম আমার নয়ন- মণিরতন

               সমস্ত আজ ভুলে গেলি

               মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে গেলি

শূণ্য আমার বাগান এখন বেদনে যায় পুড়ে।।


পাখি তোরে পুষেছিলাম হৃদয়-মন দিয়ে

গেলি সে সব তুচ্ছ ক'রে অনন্তে হারিয়ে ,

               ভালবাসার মিছে মায়া

               যায় না তারে খুঁজে পাওয়া

যে দিয়েছে একবার পাড়ি ধাঁধাঁর অচিনপুরে ।।

ইউসুফ মোল্লার একটি কবিতা

 বালতিভর্তি আলো



কুয়োর মধ্যে থাকা অন্ধকারকে দেখেছো

সেও একটু আলো খুঁজতে চায়

উপর থেকে যাওয়া বালতিভর্তি আলো

সেই আলোর বিনিময়ে এক বালতি জল পাও

এভাবেই সে বেঁচে আছে চিরকাল। 


বালতিভর্তি আলো কমতে কমতে এখন নিঃস্ব

তাই সেখানে বসেছে আজ এযুগের টাইমকল

যা সময়ের আগে কখনো দেয় না জল। 


এভাবেই তুমিও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে

যদি না অন্ধকারকে ঘোচাতে পারো

সময়ে সময়ে নিজেকে ভাঙতে শেখো

তাহলে ঠিক সময়ে তুমি গড়ে উঠবে।

সুদীপ ঘোষালের উপন্যাস (দ্বিতীয় পর্ব)

 ইউরেকা ইউরেনাস



(২)

তোতন গিয়ে প্রথমে দরজা খুললন।

 তারপর বললন, কাকে চাই?


বৃদ্ধ বললেন আমি গোয়েন্দা সুমনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি


- বলুন আমাকে বলুন কি প্রয়োজন 

-আমার নাম তোতন। আমি তার সহকারি। তখন বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, আমার একটা সমস্যা হয়েছে কিছুক্ষণ বসে আলোচনা করলেই ভালো হয় তখন বললেন তোতন বলল আসুন ঘরে আসুন বসুন।


তারপর বৃদ্ধ ব্যক্তিটি চা খেয়ে গোয়েন্দা সুমনের দেখা পেলেন।

 তার সামনাসামনি বসলেন সুমন।


 বললেন, বলুন আপনার সমস্যা কি?


 বৃদ্ধ শুরু করলেন আমাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি। সেখানে হঠাৎ আমি একদিন রাতে আবিষ্কার করলাম এক প্রাণীকে সেটা পৃথিবীর প্রাণী নয় অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা হয়তো তারা মানুষের ভাষা বুঝতে পারছে। কিন্তু আমি এটা বলা মাত্র গ্রামে কোন লোক বিশ্বাস করছে না। গ্রামের লোক আমাকে পাগল বলছে। এটাকে দেখাতে না পারলে লজ্জায় আমাকে মরতে হবে। 


জীবটি লুকিয়ে পড়ে যে কোন এক জায়গায়। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।


এখন আপনার সাহায্যে প্রাণী কে আবিষ্কার করে আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করাই এখানে আসার কারণ।


 তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে আমি প্রস্তুত আছি।


গোয়েন্দা সুমন বলেন, আপনি আশ্চর্য হবেন না। আরে বাবা ভলতেয়ারের সেই বইটা পড়েন নি যে পৃথিবীতে এসেছে তার চেহারা অদ্ভুত 24,000 জ্যামিতিক অংশ দিয়ে সেই জীবের দেহ তৈরি।

 প্রতিটি অংশের দৈর্ঘ্য 5 ফুট।

 তার নাকের দৈর্ঘ্য 5714 ফুট পড়েছেন। এত বড় নাকের মালিক যিনি হন তাদের বুদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চেয়ে অনেক বেশিগুণ হয়।


বৃদ্ধ বললেন আমিতো অতশত জানিনা আমার পড়াশোনা অতদূর নয়।

 আমি তবু দেখলাম সূর্যের বিপরীতে মানুষের ছায়া যত দীর্ঘ হয়।


সেরকম দীর্ঘ চেহারার ছায়ার মত কালো চেহারার লোক।

 লোক বলাই ভাল কারণ হচ্ছে এ লোক নয় অন্য গ্রহ থেকে আসা মনে হচ্ছে।


আমাদের পৃথিবীর মানুষ নয়।


আপনি গিয়ে সেটা আবিষ্কার করতে পারলে সব থেকে ভাল হবে।

সুমন বললেন নিশ্চয়ই যাবো আমরা আপনার ওখানে যাব ঠিক আছে আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করে সমস্ত কথা বলব।


পরেরদিন গোয়েন্দার সাজে সেজেগুজে গোয়েন্দা সুমন সহকারি তোতনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সেই বৃদ্ধের বাড়ির উদ্দেশ্যে।


 ঠিক 4 ঘন্টা ট্রেন জার্নি।


 পরে তারা তার বাড়িতে পৌঁছালেন।


বৃদ্ধ তৈরি ছিলেন তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

 তিনি নিয়ে গেলেন ঘরে এবং তাদের থাকার জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন।


দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে গোয়েন্দা সুমন আর তোতন গ্রাম দেখতে বেরোলেন।

 বেশ বৈচিত্র্যে ভরা সবুজ সবুজ গাছগাছালি মন কেড়ে নেয়।পাশেই ফালি নদী। পাড়ে ফল গাছ।


 ভেতরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তোতন আর সুমন কথা বলতে বলতে চলেছেন। এক জায়গায় তারা বসে পড়লেন। জঙ্গল খুব ভালোবাসেন গোয়েন্দা সুমন।

 তিনি সবুজ একটা পাতা হাতে নিয়ে বললেন এটা কি গাছের পাতা বলতো?


 তোতন বলল, এই পাতা আপনি হাত দিয়েছেন? আপনার তালুতে আছে কোন অস্বস্তি হচ্ছে না বলছেন না তালুতে বিছুটি পাতার কোন প্রতিক্রিয়া হয় না।


কিন্তু এটা ঘষে দিলে রস যদি এদেহে লাগে তাহলে তখন জ্বলতে শুরু করে।


 বলছি, আমি চিনি এটা বিছুটি পাতা।তোতন বললেন। 


গোয়েন্দা সুমন আক্ষেপ করে বললেন এখনকার ছেলেরা এই বিছুটি পাতা, ডুমুর গাছ, নয়ন তারা গাছ, তারপর বাঁদর লাঠিগাছ এইগুলো কি আর চিনতে পারবে?

 কত বিভিন্ন রকমের প্রকৃতিতে গাছ আছে। যারা আপনাআপনি বেড়ে ওঠে। তাদের লাগাতে হয়না কদবেল গাছ বেলগাছ এগুলো আস্তে আস্তে যেন হারিয়ে যাওয়ার পথে। বিশ্বপ্রকৃতির কতটুকু চিনি আমরা ভাই।


 সুমন আর তোতনের কথা বলতে বলতে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে তারা বুঝতেই পারেনি।

 হঠাৎ বন্ধ করলো তাদের আলোচনা একটা ছায়ামূর্তি।


কে যেন আড়ালে সরে গেলো।

 তোতন ইশারা করে গোয়েন্দা সুমনকে, এগিয়ে গেলেন জঙ্গলের পাশে।

তিনি দেখতে পেলেন একটা ছায়ামূর্তি যাচ্ছে। ওরা দুজনেই পিছনে ছুটতে শুরু করলেন।


 তাড়া করতে করতে জঙ্গলে গভীরে গিয়ে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে গেল আগ্রহ ভরে।


 দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলল কেন তোমরা আমার পিছু ধাওয়া করেছ? কোন প্রয়োজন আছে।


গোয়েন্দা সুমন উত্তরে বললেন আপনি এত সুন্দর পরিষ্কার বাংলা ভাষা কি করে বলছেন?


তখন ছায়ামূর্তি উত্তর দিলো, আমাদের গ্রন্থিতে ভাষা অনুবাদের গ্রন্থি ব্রেনে সিলেক্ট করা আছে যাতে আমরা সব ভাষাই বুঝতে পারি।


 গোয়েন্দা সুমন বললেন, আপনি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন। 

ছায় বলল আমি ইউরেনাস গ্রহ থেকে এসেছি আমরা আমরা পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছি। এখানকার জীব বৈচিত্র। এখানকার সবুজ প্রকৃতি বৈচিত্র দেখতে।


আমার মত অনেকেই এখানে এসেছেন। আপনার নাম কি?


 আবার সুমন জিজ্ঞাসা করল আপনার নাম কি? 


উত্তর দিলো ছায়া আমার নাম সাইকোভেগাস।


আপনার নামের সঙ্গে সাইকো যুক্ত কেন? 


প্রশ্নের উত্তরে বলল, আমরা সব মানুষকেই সন্দেহ করি। তারপর সন্দেহের তালিকা থেকে তাঁর অন্তরের কথা বুঝতে পারি।


গোয়েন্দা সুমন বলল আপনাদের পরমায়ু কত সাইকোভেবগাস বলল, আমাদের পরমায়ু খুব কম। খুব কম।

তোতন বল্লো, কত কম বলুন না।


বলল, আমাদের পরম আয়ু মাত্র সাড়ে 600 বছর।


 আমরা মানুষরা তো 100 বছরে বুড়ো।

আমাদের চামড়া ঝুলে পড়ে।


 আশি বছর হলে আমরা হাঁটতে পারি না।



সাইকো বলল, তোমরা খাও তোমাদের খাওয়া-দাওয়া ঠিক না।


আমরা গাছের সবুজ পাতা আর সৌরশক্তি সাহায্যে বেঁচে থাকি।

 আর তোমরা খাও আর চৌদ্দবার করে মলত্যাগের জন্য যাওবাথরুমে।অই সময়টা আমাদের জীব উন্নয়নে কাজে লাগাই।কাজ করতে করতে খাই। বাকি সময় ঘুমোই। ঘুম না হলে উন্নয়ন বন্ধ।

তোতন বলল,এটা নতুন কথা। তারপর বলুন। 


 -আমরা বছরে একবার মাত্র মল ত্যাগ করি। গোয়েন্দা সুমন বললো আমাদের প্রকৃতি খুব সুন্দর। দেখে আপনার আনন্দ হবে আশা করি।


সাইকো ভেগাস বললন, আপনাদের গ্রহে আরো গাছ লাগান।

 সবুজে ভরে তুলুন। তানাহলে, 'ভেগো ভাইরাসে 'ধ্বংস হয়ে যাবে এই গ্রহ।


তোতন বলল আমরা শুনেছি ইউরেনাস এত মাটি নেই।

সাইকো বলল আপনারা শুনেন অনেক কিছু কিন্তু কোনটাই সঠিক নয়।

 স্কাইল্যাব এ চড়ে আমরা মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়াই। এই মহাবিশ্বের কতটুকু খবর রাখেন আপনারা মানুষেরা।


গোয়েন্দা সুমন বললো আমরা দুজন আপনাদের গ্রহে যেতে চাই আপনি কি নিয়ে যেতে রাজি?


সাইকো বেগাস বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই আমার সঙ্গেই আমার মহাকাশযান আছে।

আপনাদের বিশ্ব বাংলা লোগো ওই সবুজ রঙের গোল ফুটবলের মত আমাদের মহাকাশযান।


ক্রমশ...

অভিজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস (দ্বিতীয় পর্ব)

  মুকুট


(২)

অ্যানুয়েল পরীক্ষায় ভালো করল মুকুট। সুখেন্দু স্যার রেজাল্ট হাতে দিয়ে বললেন- তুই তো দারুণ করেছিস, ১ টা নম্বরের জন্য ফোর্থ হয়ে গেলি।

থার্ড হলে মন্দ হতো না বুবুনের। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানে বই দেওয়া হয়। ফার্স্ট হলে ৩টে বই, সেকেন্ড হলে ২ টো বই আর থার্ড একটা বই।

সুভাষ এসে মুকুটকে বলল- দুজনে হলে বেশ হতো। 

হাসল মুকুট। বলল-তুই বাড়ি যাবি তো!

সুভাষদের বাড়ি ত্রিপুরা রাজ্যে। টিফিনের পরে লাইব্রেরি ক্লাস থাকলে বই নেওয়ার সময় গল্প হয়। সুভাষ ত্রিপুরার গল্প বলে। পার্বত্য ত্রিপুরা খুব সুন্দর। পাহাড়, অরণ্য সব রয়েছে।

বাড়ি ফিরে মুকুট রেজাল্ট দেখাতে মায়ের মুখ উজ্বল হয়ে উঠল। মুকুট অংকে এবার ‘৮৫’ পেয়েছে।

আর ভৌতবিজ্ঞানে পেয়েছে ‘৯০’।

বাবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি-ই ফিরেছে আজ। 

মুকুট বাবা-কে প্রণাম করে রেজাল্ট দেখালো।

বাবা বলল- কোন্নগরে তোর ঠাকুরমা, থাকুর্দা-র কাছে দেখাতে হবে তো!

এখানেও নদী গঙ্গা আছে, বাড়িটাও মন্দ নয় কিন্তু কোন্নগরের বাড়ি সে তো সত্যিকারের রূপকথার জগৎ মুকুটের কাছে। দাদুর সঙ্গে বাজারে যাবে, মাছ কিনবে আর ঠাকুরমার সঙ্গে চলবে দুনিয়ার খুনসুটি। চলে আসার সময় মন খারাপ করবে। বাবা-মায়েরও করবে। বারণ শুনবে না ঠাকুরমা। রিক্সায় চড়া অবধি খালি পায়েই এগিয়ে দেবে ওদের।

এবারও সেরকম হল। বুবুনের ভালো ফলের জন্য এলো ইলিশ মাছ। সাদা ধবধবে রোদ্দুরের লুটোপুটি বেশ লাগল মুকুটে।

তবে এই রোদ্দুরে সেই ফোটন কণাদের সঙ্গে দেখা হল না।

সূর্য প্রণাম করতে বেশ লাগে মুকুটের মন্ত্র-টন্ত্র সে জানে না। তেমন পাত্তাও দেয় না কিন্তু মনে হয় অসংখ্য ফোটন কণা অগ্নির গোলা হয়ে দীপ্তি দিচ্ছে।

এবার তারা দেওঘরে চলেছে। ঠাকুরমা-দাদু তখনও বলে, পশ্চিমে যাওয়া। ঠাকুরমার যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু শেষমেশ স্কুলের পেনসনের কাগজ-পত্তর জমা দেওয়ার কারণে আটকে গেলো।

ওরা ট্রেন ধরল ব্যান্ডেল থেকে। বাঘ এক্সপ্রেস। হয়তো অন্য একটা লম্বা চওড়া নাম রয়েছে কিন্তু আপাতত রাত সাড়ে দশটায় ট্রেনে ওঠা গেলো। সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেনীর স্লিপার।

লুচি, ছোলার ডাল, মিষ্টি আর মুকুটের জন্য মুড়িঘন্ট আর ভাত রাতের খাওয়া ট্রেনে উঠেই সারতে হলো।

ওপরের বাঙ্কে শুয়েছে মুকুট। খুন আসছে না। সে পড়ছে এইচ জি ওয়েলস। কামরার আলোগুলি একের পর এক নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শেষমেশ একটা আবছায়া নীল লাইট মৃদু আলো নিয়ে জ্বালা থাকল। 

সর্বজিৎ খুব রহস্যময় ছেলে। ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসে। তাঁর হাত দুটো সব সময় ঠাণ্ডা থাকে। শেক্সপিয়রের নাটকগুলি বাংলা অনুবাদ মুকুট পড়েছে। ঠাণ্ডা হাত ভালো নয়। অন্য রকম মানুষদের লক্ষণ।

সর্বজিৎ অবশ্য খারাপ নয়। খুব কম কথা বলে। গায়ের রং চাপা অথচ চোখ দুটোর মনি নীল।

সর্বজিতের কাছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প শুনেছে। সেখানে বর্ণিত একটি সহজ তান্ত্রিক প্রক্রিয়া বুবুন করল। কানের ফুটো দুটো আঙ্গুল দিয়ে টিপে ধরে চোখ দুটো চেপে ধরল।

তার আগে কামরার নীল লাইটও নিভে গেছে। মুকুটের দুই ভুরুর মাঝখানে অশৈলি কিছু হতে থাকল। মনে হলো আকাশের চাঁদটা এসে তার কপালে ধাক্কা মারছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে শরৎচন্দ্রের মর্মর মূর্তিতে কখনও কখনও অপরাহ্ন বেলায় নাচতে থাকা ফোটন কণা দুটো ট্রেনের কামরায় মুকুটের কাছে এসে ধরা দিলো।

তারা দুজনে মিলে ডাকল- মুকুট!

মুকুট কোন অবয়ব দেখলো না। দেখলো আলোর তরঙ্গ অদ্ভুত এক নৃত্যের ভঙ্গিমায় তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। 

সে তাদের ভাষাও বুঝতে পেরে বলল, কিছু বলছ তোমরা!

আমরা কিছু বলবো না কিন্তু তোমার যদি প্রশ্ন থাকে- বলতে পারো।

মুকুট বলল- তোমরা বুঝি সব জানো!

কিছুটা জানি।

মুকুট বলল-ব্ল্যাক হোল!

ওদের মধ্যে একজন বলল- একটি তারার মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় একটি ছোট্ট ব্ল্যাক হোল।

মুকুট বলল- তারা-দেরও মৃত্যু হয়!

একজন ফোটন কণা বলল- হয় বৈকি!

তারা-র যদি ঘনত্ব বেড়ে যায় তবে তো তার হৃদরোগ হয়। মৃত্যু হলে কোন আলো আর বের হতে পারে না। ফলে ভয়ংকর মহাকর্ষীয় শক্তি তাকে টেনে নেয়।

মুকুট বলল-কৃষ্ণগহ্বর।

ঠিক বলেছ, সেখান থেকে কোন আলোর তরঙ্গ বের হতে পারে না।

আরেকজন ফোটন কণা বলল- তুমি কি খুব ‘আলো’ ভালোবাসো!

মুকুট বলল- আমার সূর্যের দিকে হেঁটে যেতে বেশ লাগে। মনে হয় আমি যেন আলোর অভিযাত্রী।

ফোটন কণারা বলল- বেশ, বেশ।

মুকুট, মুকুট- উঠে পড়। জসিডি চলে এলো। আমাদের নামতে হবে।

ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল মুকুট। শীতের কামড় বেড়েছে। ভূ-প্রকৃতি নিশ্চয় বদলে গেছে।

মুকুট বলল-মা, নদীটা চলে গেছে!

হ্যাঁ, দারোয়া নদী চলে গেছে।

আর মধুপুর! লাল মাটির স্টেশন!

হাসল দেবলীনা।

চলে গেছে। তোর বাবা স্টেশনে নেমে ‘চা’ নিলো। তোকেও তো ডাকছিল।

মুকুট বলল- ইস্‌ একদম টের পাইনি।

ভেষজ গন্ধ তখনও নাকে আসেনি। এই গন্ধটা নাকি দেওঘর জুড়েই পাওয়া যাবে।

চটপট তৈরি হয়ে, ব্রাশ করে নিলো। 

ট্রেন ঢুকে পড়ল যসিডি। প্রচুর ট্যুরিস্ট নেমেছে। সবাই প্রায় বাঙালি।

একজন বোধহয় প্রথম এসেছেন দেওঘরে।

বললেন- কি দেখার আছে!

সহযাত্রী উত্তর দিলেন- পাথর আর কি! তবে ইঁদারার জন পেটের পক্ষে ভালো। আর অনেকটা সস্তার ভ্রমণ। একসময় তো রিক্সার ভাড়া অবিশ্বাস্যভাবে কম ছিল। এখন জানি না কি হয়েছে।

দরাদরি করে অটোতে উঠতে যাবে, এইসময় একজন এগিয়ে এসে বললেন,

চিনতে পারছেন!

কাচাপাকা চুল, মধ্য-বয়স্ক একজন মানুষ। গায়ে সাদা ফতুয়া। হালকা সাদা চাদরও রয়েছে গায়ে।

মুকুটের বাবা ঋত্বিক মনে করার চেষ্টা করছেন, স্মৃতিতে ভাসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। দেবলীনা অর্থাৎ ঋত্বিকের ‘মা’ চিনতে পেরে মুচকি মুচকি হাসছেন।

ভদ্রলোক বললেন- বিশ্বজিৎ। বছর দশেক আগে এরকম সকালেই কাছে এসে বলেছিলাম মাসেকং শরণম্‌।

মনে পড়ল ঋত্বিকের।

হো হো করে হেসে উঠলেন।

দেবলীনা বললেন- বাবা-মশাই কেমন আছেন!

ভালো। মুকুট তো!

দেবলীনা বললেন – হ্যাঁ।

বাপ-রে, সেই ছোট্ট শিশুটা তো এখন কিশোর।

 মুকুট প্রণাম করল মানুষটাকে। অনেক কথা শুনেছে বাড়িটা সম্পর্কে। নাম-শাশ্বত।

বিশ্বজিৎ বললেন- বহু বছর পরে এলেন।

বাবা-মশাই আমাদের কথা বলতেন!

বিশ্বজিৎ বললেন- বহুবার বলেছেন, আজ বললেন- ওঁদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।

চোখ দুটো জলে ভরে উঠল দেবলীনার। স্নেহময় একজন বৃদ্ধের সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য মন আকুল হয়ে উঠল।

বিশ্বজিৎ টাঙা এনেছেন। টাঙায় উঠল ওরা। 

যেতে যেতে সেই মায়ের মুখ থেকে শোনা ভেষজ গন্ধটা বুক ভরে নিলো মুকুট। রোদ উঠছে, উচ্চাবচ ভূমিতে অসংখ্য, অগুণতি ফোটন কণা নৃত্য করতে করতে সঙ্গ দিচ্ছে যেন।

বিশ্বজিৎ এবার বললেন- ভাবলুম- বাবামশাই মাঠে নিয়ে লাঙল ধরিয়েছেন বলে ঋত্বিক বাবুর রাগ হয়েছে।

ঋত্বিক বললেন- ছি, ছি। চাকরি না করে যদি বুড়ো বাবার কাছে থাকতুম- জীবনটাই বদলে যেতো।

এবার থেকে থাকুন তাহলে।

ঋত্বিক বললেন- ধান ছাড়া কি চাষ হচ্ছে এবার!

বিশ্বজিৎ বললেন- পাট।

ঋত্বিক সামান্য অবাক হলেন, বললেন- কিন্তু পাট-চাষে তো জল লাগে প্রচুর।

ক্যাপসুলারিজ পাট।

ঋত্বিক বললেন- আমি তো জানি এঁটেল আর দোঁয়াশ মাটিতে পাট চাষ হয়।

বিশ্বজিৎ বললেন- পাথুরে, খরাপ্রবণ জমিতেও হয় তবে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়। ক্যাপসুলারিজ উন্নত জাতের বীজ- বাবামশাই সংগ্রহ করেছেন।

ঋত্বিক বললেন- কৃষিতে তিনি অসাধারণ।

বিশ্বজিৎ হেসে বললেন- মহাকাস, সুপারনোভা, ফোটন কণা, ব্ল্যাক হোল- এসব জানেন তিনি।

মুকুটের সঙ্গে এবার ওঁর বেশ আড্ডা হবে।

মুকুটের মন আনন্দে নেচে উঠল। অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে দাদুটাকে।

দেবলীনা বললেন- শরীর ভালো আছে তো!

বিশ্বজিৎ বললেন- শীতের শুরুতে ওঁর ফ্যানেলজাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায় কিন্তু কাজ ছাড়া তো উনি থাকতে পারেন না।

দেবলীনা বললেন- শুনেছি বাবা-মশাই রীতিমতোন বিজ্ঞান-চর্চা করেন।

হাসলেন বিশ্বজিৎ। বললেন- নিজের হাতে যখন তিনি চাষ করেন, বোঝাই যায় না তিনিই আবার E= MC2 বা কোয়ান্টাস মেকানিক্‌স অনায়াসে ব্যাখ্যা করছেন।

ঋত্বিক বললেন, আশ্চর্য তো!

দেবলীনা বললেন- আবার ধানসেদ্ধও হাতে কলমে দেখিয়ে ছিলেন আমায়।

মুকুট উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকে। এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে দেখা হবে ওর।

কি চমৎকার ভূ-প্রকৃতি। ছোট্ট, ছোট্ট টিলাগুলি তো অপূর্ব।

দেখতে দেখতে একটা সাদা রং-এর রাজপ্রাসাদের সামনে এসে থামলো টাঙা।

বৃদ্ধ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওদের জন্য যেন অপেক্ষা করছিলেন এতোক্ষণ।


ক্রমশ...

চাঁদ রায়ের একটি প্রবন্ধ

 লৌকিক ছড়া ও তার ভাষা


গ্রামবাংলার লোকজ উপাদান থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে এমন ছড়া গুলিই হল লৌকিক ছড়া। এইসব ছড়াতে রচয়িতার নাম জানা যায় না। এগুলি মুখে মুখে প্রচলিত এবং সাধারণত কোথাও লেখা থাকে না। পরে অবশ্য কেউ কেউ কিছু কিছু সংগ্রহ করে তাকে লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 

তবে সব ধরনের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত লৌকিক ছড়া গুলিকে সংগ্রহ করা হয়েছে এমন নয়। যেমন--ভাঁজেো, হাবু, ঘেঁটু বা ঠাকুমা দিদিমাদের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যক্ত অনেক ছড়া। 

লৌকিক ছড়া বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ছেলে ভুলানো ছড়া, খনার বচন, নানা ধরনের নীতি মূলক ছড়া, ধাঁধার ছড়া এবং সর্বোপরি ব্রতের ছড়া। এগুলি কে শোলোক বলা হয়। এই সব শোলোক বা ছড়া গুলি সাধারণ মানুষের জীবনের সরস কাহিনী থেকে উদ্ভূত। 

Tolstoy বলেছেন--"সাধারণ মানুষের জীবনের সরস কাহিনী কে বাদ দিয়ে অল্প কিছু মানুষের কথাকে পরিবেশন করা সাহিত্যের সামাজিক কর্তব্য পালন সঠিক নয় "। তাই Tolstoy আরও বলেছেন যে, " সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিয়ে যে শিল্প তা কৃত্রিম ও অচল"। তিনি শিল্প কে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন--1. Good art 2. Bad art. 

তাঁব মতে, মানুষের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারেFolk art. "Folk art is the best useful and helpful. So, folk art is good art".

লৌকিক ছড়া গুলির ভাষা সাধারণ মানুষের ভাষা। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন--"মানুষের স্বভাবের মধ্যে রয়েছে কাব্যের সম্ভাবনা। ছন্দ ও সুষমা বোধ মানুষের সহজাত"। তাঁর মতে কাব্যের শ্রেণী দুই প্রকার--গভীর প্রকৃতির মানুষের দ্বারা রচিত রচিত প্রার্থনা ও স্তুতি মূলক কাব্য আর লঘু প্রকৃতির মানুষের দ্বারা রচিত লঘু চরিত্রের লঘু কাব্য তথা লৌকিক ছড়া। 

আচার্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন, " ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি মূল ধারা"। সুতরাং একথা বলা যায় যে, ছড়া হল সবচেয়ে জনপ্রিয় লৌকিক সাহিত্য। সাহিত্যের অন্যতম এই প্রাচীন শাখার উৎস সাধারণ মানুষের সহ�

রামপ্রসাদ সরকারের একটি প্রবন্ধ

 আমায় যে পিছু ডাকে


বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই সংগ্রহ আমার নেশা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে শিশির চক্রবর্তী সংকলিত পাঁচ দশকের বাংলা গানের গীতবিতান ‘এ শুধু গানের দিন’ কিনে ফেললাম। বইটির ভূমিকার প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ে আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।

রবিবারের নিঝুম উদাস দুপুর। নির্দিষ্ট সময়ে সকলেই উৎকীর্ণ, রেডিওতে আধুনিক গানের অনুরোধের আসর হবে। একের পর এক প্রিয় শিল্পীর গান। শ্রোতারা হেমন্ত-মান্না-সন্ধ‌্যা-শ‌্যামল-ধনঞ্জয়-মানবেন্দ্র-সতীনাথ-প্রতিমা-উৎপলা-গীতার পাশে সমান আগ্রহে শুনছেন অখিলবন্ধু-সুবীর-মৃণাল-আল্পনা-গায়ত্রী-ইলা কিম্বা শৈলেনের গান। এসব শিল্পীর অনেক গানই মানুষের কণ্ঠস্থ, যন্ত্রায়োজন সমেত। চলে-যাওয়া শতকের পাঁচ-ছয়ের দশকে ছবিটা এমনই ছিল। তখন দূরদর্শন আসেনি, ঘরে ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারও (সে সময় শুধু রেকর্ডই বেরোত) অপ্রতুল, শিল্পী ও গান এখনকার মতো দ্রষ্টব‌্য বস্তু হয়ে ওঠেনি। তখন সাধারণ মানুষের ভালো গান শোনার জন‌্য একমাত্র রেডিওই ভরসা।’

বইটা হাতে পেয়ে, পাতা উল্টে আমি আমার ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরে গেলাম, যে সময় আমাদের দিন-রাত ভরে থাকতো স্বর্ণযুগের বিভিন্ন শিল্পীর সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া গানে। সে প্রায় পাঁচ-ছয় দশকের কথা। প্রথমেই মনের মাঝে গুঞ্জরিত হলো অন‌্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ‌্যায়ের গানের কয়েকটি কলি :

‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,

স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ের বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে.....

সত‌্যি সত‌্যি আমার মন ফিরে গেল বাল‌্য, কৈশোর ও যৌবনের সেই সব হারানো দিনে, যখন স্বর্ণযুগের শিল্পীদের কণ্ঠের সুর মাধুর্যে আমরা মগ্ন হয়ে থাকতাম।

ছোটবেলার দিনগুলোতে কিছুটা বুঝে এবং অনেকটাই না বুঝে সেই সব গান শুনতাম, যার সিংহভাগ ছিল প্রেমের গান এবং বিরহজনিত শূন‌্যতায় আচ্ছন্ন।

কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিতেই ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে সেই সব গান প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো মনের মধ‌্যে এসে পড়লো।

আজও ভুলতে পারিনি কৈশোরের সেই স্মৃতি। যখন রবিবারের ছুটির দিন নিঃঝুম উদাস দুপুরে বাবা ভাত-ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দিতেন রেডিওতে ‘অনুরোধের আসর’-এর গান শোনার জন‌্যে। গান শোনার ব‌্যাপারে বাবা তাঁর গাম্ভীর্যের মুখোশ সরিয়ে তখন আমাদের বন্ধু হয়ে যেতেন। 

আজও ভুলতে পারিনি ছেলেবেলায় শোনা আলপনা বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়ের সুরেলা কণ্ঠের সেই অবিস্মরণীয় গানগুলো-

‘হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম

তাদের খাড়া দুটো সিং

তারা হাট্টিমা টিম টিম......

অথবা

‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে

ঢাক ঢোল মাদল বাজে......’

আবার সরস্বতী পুজো এলে যতো কষ্টই হোক না কেন, উপোস করে আমাদের মধ‌্যে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ায় ধুম পড়ে যেতো। আমাদের তখন কতোই বা বয়স-ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমাদের সমবয়সী মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে, অধিকাংশের শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তখনও পুষ্পাঞ্জলি শুরু হয়নি। হঠাৎ পুজো মন্ডপের মাইকে বেজে উঠলো সনৎ সিংহের গান :

‘সরস্বতী বিদ‌্যেবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি-

একটু দয়া করো মাগো বুদ্ধি যেন হয়,

এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়.......

গানটি আমাদের মনের দরজায় কড়া নাড়তো আর ভাবতাম, আরে, গায়ক তো আমাদের মনের কথাই বলছেন। এমনই ঐ ছোট্ট বয়সে দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে সনৎ সিংহের গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এক-ছুটে পুজোমন্ডপে চলে গিয়েছিলাম। আজও এতোগুলো বছর পেরিয়ে গানের কিছু কিছু কলি মনের মাঝে যখন গুঞ্জরিত হয়, তখনই মন চলে যায় বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সেই সব সুরেলা অধ‌্যায়ে।

‘এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই-

নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে,

নন্দী-বাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে।

মন বসে কি আর?

আহা-হা চন্ডীতলায় বাদ‌্যি বাজে ঢাক গুড় গুড়.....

কে জানে এবার বোধহয় সিংহরাজের কেশর দিল জুড়ে,

অসুর বোধহয় বেরিয়ে গেছে মোষের পেটটি ফুঁড়ে-

মন মানে না আর,

আহা-হা কতক্ষণে যাবে যে সব দেখবে ঠাকুর।’

।দুই।

ছোটদের গান শুনতে শুনতে বড় হলাম। বাল‌্য পেরিয়ে কৈশোরে। তারপর একদিন হঠাৎ করে যৌবনে পা দিলাম তখন ছোটদের গান বা ছড়ার গানের চেয়ে প্রেমের গান শুনতে ভালো লাগতো। তখন যে আমাদের অনেকেরই যৌবনে প্রেমের প্রথম মুকুল দেখা দিয়েছে। আমিও এর ব‌্যতিক্রম ছিলাম না। প্রেমের প্রথম পরশবাবার পর যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবারই স্বর্ণযুগের শিল্পী মান্না দের বিষাদ মাখানো গানটি মনের মাঝে উদয় হয়েছে আর মনটা বেদনায় ভরে উঠেছে—

‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো,

কী চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজও হয়তো......’

তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের আর এক মরমী শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ‌্যায়ের কালজয়ী প্রেমের গানটি মনের গভীরে রেখাপাত করলো।

‘আমি এত যো তোমায় ভালোবেসেছি

তবু মনে হয় এ যেন গো কিছু নয়,

কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।

তোমার কাজল চোখে যে গভীর ছায়া কেঁপে ওঠে ওই,

তোমার অধরে ওগো যে হাসির মধুমায়া ফোটো ওই,

তারা এই অভিমান বোঝে না আমার

বলে, তুমি তো আমায় ভালোবেসেছে-

শুধু আমার গোপন ব‌্যথা কেঁদে কেঁদে কয়।

কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।’

জীবনের পরবর্তী অধ‌্যায়ে তাকে পেয়েও না পাবার বেদনা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তখন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ‌্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সুললিত কণ্ঠের গানটি হৃদয় বীণায় ধাক্কা মারে :

‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে আমারই এ দুয়ারে প্রান্তে,

সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারিনি তো জানতে।

...................................’

আজ কাছে তারে এত আমি ডাকি গো,

সে যে মরীচিকা হয়ে দেয় ফাঁকি গো-

ভাগ‌্যে যে আছে লেখা হায়রে

তারে চিরদিনই হবে জানি মানতে।’

১৯৬১ সালে সবে কলেজে পা ফেলেছি। সুধীন দাশগুপ্তের কথা ও সুরে শ‌্যামল মিত্র গাইলেন :

‘নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি,

হয়তো বা সেই ক্ষণেই তোমায় ভালোবেসেছি।

বনলতা কও কথা, হয়ো না গো কুন্ঠিতা-

দ্বিধা থরো থরো মনেই তাই না এসেছি।

জলভরা মেঘ ওই দু’চোখে দেখতে আমি পেয়েছি,

একলা মনে নির্জনেতো তোমার ছবি এঁকেছি।

একটি কথাই শুনব বলে তাই তো কাছে এসেছি,

বলবে কি গো, আমিও তোমায় ভালোবেসেছি।’

গানটি সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল। সকলের কণ্ঠেই তখন গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠতো। কাকতালীয় ভাবে আমার বোনের বান্ধবীর নাম ছিল ‘বনলতা’। সে তখন কিশোরী। গানটা শোনার পর সে যেন মর্মে মরে গেল। বেশ কিছুদিন ঘর থেকে বেরই হলো না সে। ছোট্ট রেলওয়ে কলোনী সবাই সবাইকে চেনে। আজকের দিনে হলে ছেলেরা হয়তো তার পিছনে লেগে পড়তো। কিন্তু আমরা একসাথে বড় হয়েছি, খেলাধূলো করেছি। কেউ কিন্তু কোনোদিন শালীনভাবে সীমা লঙ্ঘন করিনি। কিছুদিনের মধ‌্যে বনলতা আমাদের সঙ্গে আগের মতোই হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলো। জানি না, আজ সে কোথায়?

জীবনে চলার পথে একদিন মাতৃহারা হলাম। মা ছিলেন আমার জীবনের ধ্রুবতারা। তারপর কর্মজগতে প্রবেশ করে ব‌্যস্ততাময় জীবনে মায়ের স্মৃতি ক্রমশ: ফিকে হতে লাগলো। তবু অবসর সময়ে মায়ের কথা মনে পড়লে স্বর্ণযুগের গানই আমার মনে প্রশান্তি এনে দিতো। গীতিকার প্রণব রায়ের কথায় ও শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তীর নিজের সুরে গাওয়া গানটি বারবার মায়ের কথাই মনে পড়িয়ে দিতো। সবার অলক্ষ‌্যে চোখের জল ফেলতাম।

‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে-

মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।

তার মায়ায় ভরা সজল দিঠি সে কি কভু হারায়?

সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে সন্ধ‌্যারাতের তারায়-

সেই যে আমার মা।

বিশ্বভুবন মাঝে তাহার নেইকো তুলনা।

.......................................................’


।তিন।

স্বর্ণযুগের গানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে এক সময় দ্বারপরিগ্রহ করতে হলো। জীবন সঙ্গিনী হিসেবে যাকে পেলাম, তার কণ্ঠে গুনগুনিয়ে ওঠা হেমন্ত, মান্না, লতা, শ‌্যামল, সন্ধ‌্যার গান শুনে অবাক হলাম। অনুভব করলাম, তার জীবনের গানের জগতে স্বর্ণযুগের প্রায় সব শিল্পীই ভর করে আছেন। গানে গানে আমরা দু’জনার ভুবন ভরিয়ে তোলর জন‌্যে রেকর্ড প্লেয়ার কিনে আনলাম। সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ‌্যায়ের বাংলা আধুনিক গানের লং প্লেইং রেকর্ড। আর প্রতিমাসেই কোনো না কোনো শিল্পীর গানের রেকর্ড কেনা হতো। আর দুর্গাপুজোয় গ্রামোফোন কোম্পানী কোন শিল্পীর কি গান বের করে তার জন‌্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।

তার জীবনের মধ‌্যগগনে তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। এরপর শুরু হল আমার চলা-একা, একা শুধুই একা অন্তহীন পথে। মনের ভারমুক্ত করতে মাঝে মাঝে ফিরে যাই বাংলা গানের স্বর্ণযুগে। 

আজ স্বর্ণযুগের বাংলা গান দিয়ে আমার প্রিয়াকে ভালোবাসা জানাবো-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, শ‌্যামল মিত্রের কণ্ঠের গান দিয়ে। 

‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা

কে বলে আজ তুমি নাই

তুমি আছ মনে বলে তাই

তোমারই অমর নাম জয় গৌরবে

স্মরণে যে চিরদিন জানি লেখা রবে

মরমে হারায়ে তোমার খুঁজে পাই

তুমি আছে মন বলে তাই।

....................................’

একই সঙ্গে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের সেই সব অসাধারণ গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের জানাই আমার অন্তরের বিনম্র শ্রদ্ধা-যাঁরা স্বর্ণালী দিনের গানের মায়াজালে আজও আমাদের ভুবন ভরিয়ে রেখেছেন। আমরা সেই সুরেলা গানের নস্টালজিয়ায় আজও আক্রান্ত হই।

উদ্ধৃতি ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

এ শুধু গানের দিন

সংকলন : শ্রী শিশির চক্রবর্তী

লেখকের নিবেদন : যাঁরা আমার এই লেখাটি পড়বেন, তাঁরা লেখাটিতে উল্লেখিত গানগুলো যদি শোনেন, উপলব্ধি করবেন স্বর্ণযুগের আধুনিক বাংলা গান কথা ও সুরে আজও অবিস্মরণীয়, এক অনন‌্য নস্টালজিয়া। 

তৈমুর খানের একটি প্রবন্ধ

 ধর্ম যখন মানবিকতার অন্তরায় 

   


ধর্মই কি একদিন পৃথিবী ধ্বংস করিবে ? যেদিন হইতে ধর্ম আসিয়াছে সেদিন হইতে যুদ্ধও আসিয়াছে। ধর্ম যদি শান্তি লইয়া আসিত তাহা হইলে পৃথিবীতে কি এত মৃত্যু, এত রক্তপাত দেখিতে হইত ? মানবিকতা বনাম ধর্ম — কে বড়ো? ধার্মিকেরা ধর্মকেই বড়ো করিয়া তুলিয়া ধরিবেন। মানবিকতাকে ধর্মের কাছে তুচ্ছ করিয়া হীন প্রতিপন্ন করিবেন। কারণ মানবিকতায় পরকাল নাই। পরকালের মোহময় সুখের হাতছানিও নাই। ধর্ম এভাবেই যুক্তি ও সত্যকে অস্বীকার করেই তাহার সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। আমেরিকান মুক্তচিন্তাবিদ লেখক লেমুয়েল কে. ওয়াশবার্ন (১৮৪৬ ) এই জন্যই বলিয়াছেন : “Most men would kill the truth, if the truth would kill their religion.” সুতরাং ধর্ম একটি অন্ধকার অদৃশ্য রূপকথার কাল্পনিক প্রজ্ঞা মাত্র। ধর্মজীবীদের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত কাল্পনিক সত্যের উপরই ইহার ইমারত নির্মিত হয়। হয়তো এই কথা ভাবিয়াই বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছিলেন : “‘religious truth’ conveys nothing clear to me at all.” এই সত্যকে খুঁজিয়া দেখিবার প্রয়াস কাহারও নাই, অথচ এক প্রগাঢ় অন্ধ আবেগ রহিয়াছে। এই আবেগ এমনই যাহা এ বিষয়ে অধিক প্রশ্নও তুলিবে না। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাইয়া চলিতে পারিলেই নিজেকে ধন্য মনে করিবে। 


    বর্তমানে সব রাষ্ট্রই ধর্মকে রাজনীতির অংশ করিয়া তুলিয়াছে। ধর্মকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাতির আবেগ করিবার প্রয়াস দেখাইতেছে । ফলে অধিকাংশ রাষ্ট্রই একদেশদর্শী ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রে পরিণত হইবার প্রয়াস পাইতেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ধর্মীয় পন্থীরা নানাদিক দিয়া হেনস্থার শিকার হইয়া চলিয়াছে। তাহাদের খাদ্যাভ্যাস, বসবাস, ধনপ্রাণ রক্ষার নানা পরিপন্থী আইনও বিপজ্জনক হইয়া দেখা দিতেছে। ধর্মের দোহাই দিয়া মানুষ হত্যা করাও সহজ হইয়াছে। নারীদের ধর্ষণ করিবার অজুহাতও জুটিয়াছে । আবার ভোটে জিতিয়া সাম্রাজ্য লাভ করিবারও এক অনুপম পন্থা হইল এই ধর্ম। ধর্ম কী না করিতে পারে ! ফুটপাথ হইতে তুলিয়া রাজসিংহাসনে বসাইতে পারে। গুরু বানাইয়া রাজ-ঐশ্বর্য আনিয়া দিতে পারে। তাহার সহিত সুন্দরী যুবতী যাহারা গোপিণী হইয়া কামসেবনের বস্তুতে পরিণত হইতে পারে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসিয়া সেলাম ঠুকিয়া যাইতে পারে। ধর্মস্থান বা ধর্মগৃহ নির্মাণ করিয়া বাহাদুরি লইতে পারে। ধর্মমঞ্চ তৈরি করিয়া ভাষণ দিয়া, প্রলোভন দিয়া সকলকে জোটবদ্ধ করিতে পারে। সুতরাং ধর্মের অপার ও বিস্ময়কর ক্ষমতা। রাজনৈতিক ব্যবসায়, অর্থনৈতিক ব্যবসায় এবং ভণ্ডামির চূড়ান্ত অভিনয়ে ইহাকে নিপুণভাবে ব্যবহার করিতে পারিলে খুব অল্প সময়েই বিখ্যাত হইতে পারিবে। 


     এখন সারাবিশ্বময় ধর্মের বহুমুখী ক্রিয়ার প্রভাব লক্ষ করিতেছি। কোন্ রাষ্ট্রের নাম বলিব? আপনারাই দেখুন, প্রায় সব রাষ্ট্রেই কমবেশি ঘটনা ও অঘটন ঘটিয়া চলিয়াছে। ধর্মের অমানবিক আচরণের নিন্দা করিলে মানবিক ব্যক্তিটির বাঁচিবারও অধিকার কাড়িয়া লইতেছে। পিস্তলের গুলি কিংবা কাতির চোট কিংবা তরোয়ালের কোপ পড়িতেছে। ধর্মের সৈনিকেরা সর্বত্রই ঘুরিতেছে। রাষ্ট্র তাহাদের মদত দিতেও কার্পণ্য করে নাই। কোনও কোনও শাসকই স্বয়ং ধর্মের সৈনিক। তিনিই অন্যান্য সৈনিকদের পরিচালনা করিতেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া ভিন্নধর্মীয়দের বিতাড়ন, তাহাদের নারীকে হরণ ও ভোগচরিতার্থ, হত্যা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াইয়া কোণঠাসা করিবার কৌশল প্রয়োগ করিতেছেন। তাহা হইলে ধর্ম লইয়া কূটনীতি কি কম হইল ? 


       ভেক ধারণ করিয়া, নিজস্ব সততার প্রচার করিয়া, জনমোহিনী কথাবার্তা বলিয়া দুর্বল মূর্খ ধর্মভীরুদের বশীভূত করা এমন আর কী কাজ ? যেকোনও মুহূর্তে তাহা সহজেই করা সম্ভব। 


   ধর্মকে সজীবিত রাখিয়াছে ধর্মগ্রন্থগুলি । সমাজে সম্প্রদায়ে সেগুলি “ঈশ্বরের বাণী” সুতরাং অপরিবর্তনীয় বলিয়া প্রচারও পাইয়াছে। সেইসব মহালৌকিক বিষয়ে কাহারও কিছু বলিবার উপায় নাই। আর সেইসব গ্রন্থের নিয়মনীতি প্রচার করিয়া স্বর্গ ও নরকের ধারণা দান করিয়া উগ্র ধর্মবিশ্বাসী সম্প্রদায় তৈরি করিবার পথ সুগম হইয়াছে। মানবিকতাকে দূরে সরাইয়া ধর্মের মায়াজালে মনুষ্যপ্রজাতির পতঙ্গকে আটকাইয়া শোষণ করা বেশ সহজ। ধর্মীয় শোষণে মনুষ্যকুল যাতনা ভোগ করিতে পারে, নিজের ইজ্জৎটাও দান করিতে পারে। একসময় সর্বস্বও তুলে দিতে পিছ পা হয় না। ধর্মের কারণেই দেশভাগ হইয়াছে, আরও খণ্ড খণ্ড হইবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা তো নিত্যদিনের ঘটনা। গুরু হইতে গোরু, বিদ্যা হইতে বিদ্বেষ ধর্ম সকলকেই গ্রাস করিয়াছে। কোন্ রাস্তায় ধর্ম নাই? যেখানেই পথ খুঁজি, দেখি, ধর্ম রক্তচক্ষু লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। যাহা সাধারণ, যাহা সহজ সুন্দর হইত, তাহা ধর্মের কারণেই tremendous হইয়া উঠিয়াছে । এই কারণেই Absurdism - এর প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক, লেখক তথা সাংবাদিক আলবার্ট কামুজ (১৯১৩) বলিয়াছেন : “Nobody realizes that some people expend tremendous energy merely to be normal.” মানবিকতার প্রেক্ষণটি এখান হইতেই বুঝা সম্ভব। 

মানবিকতা মানবধর্মের ব্যাপ্তি লইয়া বিরাজ করিতেছে। সমাজে মানবিকতা মনুষ্য প্রজাতিকে কখনও খণ্ডিত করিতে চাহে নাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় মানবিকতার নিকটে প্রয়োজন হয় না। মানব-প্রেমের এই শিক্ষণটি প্রচলিত গ্রন্থবদ্ধ ধর্মগুলি দিতে পারে নাই। যদিও কোনও কোনও অংশে তাহা আলোকিত হইয়াছে, তথাপি ধর্মগুরুগণ ইহার বিকৃত ব্যাখ্যাদান করিয়া সমাজকে ভ্রষ্ট পথ দেখাইতেছেন। প্রতিটি মানুষই প্রেম—হৃদয় ও ধ্বংস লইয়া জন্মগ্রহণ করে। এই প্রেম তাহার ব্যক্তিগত জীবনেরই আত্মস্ফুরণে বিকশিত হইতে থাকে। যাহা “হৃদয়” নামক মনেরই সমুদ্র তরঙ্গ বিক্ষোভে উচ্ছ্বসিত। আবার চূড়ান্ত পরিণতির মধ্যেও তাহার অগ্রসর কাম্য। মানবিক সীমানার এই চিরন্তন বোধটি বব মার্লি (১৯৪৫) তাঁহার একটি গানে বলিয়াছেন : “One love, one heart, one destiny.” মানবিক পথের ব্যক্তিসীমানাকে আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। ধর্ম যেখানে উদ্দেশ্য সাধনের পথ চেনাইতে ব্যস্ত, মানবিকতা সেখানে এক সৌন্দর্যের নিবেদনে আত্মোৎসর্গের মার্জিত বিনয় দান করিতে পারে। সেখানে অহংকার থাকিতে পারে না। সপ্তদশ শতকের ইংরাজ কবি আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮) বলিয়াছেন : “To err is human, to forgive, divine.” — মনুষ্য ধর্ম এমনই যে, সেখানে ভুল হইলেও তাহার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য কিছুমাত্র কমে নাই। বরং ক্ষমা ও ভালবাসায় অমেয় স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করা যায়। আজ যে হানাহানির বর্বর যুগ চলিতেছে তাহার মূল কারণ যে ধর্ম তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। 


      “ধর্ম” কথাটির ভিতর ঈশ্বরতত্ত্বের কী ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাহা কোনওকালেই বুঝিতে পারি নাই। প্রতিটি ধর্মকেই আমার শয়তান বলিয়া বোধ হয়। এই যুগের দার্শনিক তথা সমাজতত্ত্ববিদ ভেক্সেন ক্রাবট্রি (Vexen Crabtree, 1975) এই কারণেই বলিয়াছেন : “If there is a God, it must be evil.” যাকেই ঈশ্বর বোধ হোক, তিনি যে গুরুতর একটি শয়তান পৃথিবীতে তাহার বহু প্রমাণ রহিয়াছে। যদি সত্যি সত্যি পৃথিবী ধর্মহীন শুধু মনুষ্যজাতির পৃথিবী হইতে পারিত, তাহা হইলে হয়তো কিছুটা শান্তি মিলিতে পারিত। এখন ধর্মস্রোত এতই বাড়িতেছে যে প্লাবন আসিতে খুব দেরি হইবে না। আর ধর্মই হয়তো ধ্বংস লইয়া আসিবে সভ্যতার।

সুজিত রেজের একটি গদ্য

 অন্তর-সংলাপ



সারা ঘর জুড়ে তুমি তুমি গন্ধ।জামার কলারে ঘষা খুসকির চারকোল কাঁটা।এই যে এতকাল পথহীন পথ হাঁটা,বিফল তো নয় সব।খাতাবুকে লিখে রাখো এইসব নীরব কলরব।


তোমার অগোছালো আঁচলের নভোনীলে, ক্লান্ত তারার ডুবসাঁতার।শিউলি সকাল দেয় উঁকি, এরপর আমি আর ঘুমোতে পারি কি?এসো মৃত্যু গুছিয়ে রাখি।


শুকতারার সঙ্গে আলাপন সেরে, গোবর নিকোনো উঠোনে গলে গলে পড়ে চলনবিলের ভিজে গল্প,তখনও তোমার ওষ্ঠে মোমবাতি জ্বলে,আমি তাকে নেভাই কী করে? বাইরে যেয়ো না,বাতাস বইছে জোরে।


গাছের ডালগুলো নুইয়ে পড়েছে। পাতা নেই, ফুল নেই,তবুও। কিসের ভার বহনে তার এই অনীহা?

সুমন সাহা'র একটি মুক্তগদ্য

শীতের শার্ট


আপেলের লোভ দেখানো বিকেলঘড়ি চিনে এখনো বাউন্ডারি বেড়াটার ওদিকে― যেদিকে দেড়তলা বাসার ছাদে প্রতিদিন গোলাপ ফুটে! এই ব্যাপারে জীবনদার সাথে কথা বলা যেতে পারে যে-কোনো শীতমাখা ডিসেম্বরে!


একমুঠো বিকেল নিয়ে এই শহর পেরিয়ে কবিতা কিউট কোল্ডক্রিমের গন্ধ ছড়িয়ে হারায়ে যাক― এই ব্যাপারে শ্যামলা মেয়ে ভুলে যাক গতকালের বিকেল : যেমন―কাশফুল সাদামেঘকে ভুলে গ্যাছে; সাদামেঘ কাশফুলকে ভুলে গ্যাছে। 


সুখ-দুঃখ সুবর্ণখালি ব্রিজ পাড় হয়ে হারায়ে যাক― খুঁজবোনা... আমি অনেক কিছুই খুঁচিয়ে খুঁজে বেড়াই না আর...পাখিদের ক্লাসঘরে মন খারাপের রীতি নাই বইলা এখনো আনন্দ লই, সেটা―' জীবনের আনন্দ।'

শ্রাবণী মুখার্জীর একটি গল্প

   তৃপ্তি



এলার্মের আওয়াজ টা এতো তীব্র লাগে উফ আর পারি না বাবা , সকাল বেলাতেই মুখটা বাংলার পাঁচ করে বিছানার উপর উঠে বসলো শিপ্রা । রবিবারেও একটু শান্তি নেই । মাসি আজ কাজে আসবে না বলেছে , ওর ছেলের জন্মদিন । এদিকে বিষ্ণুপুর ঘরানা তে সংগীতের ডাক পড়েছে শুভম এর , যেতে হবে।  

বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে যাবার পথে হঠাৎ দেখলো শুভম সরস্বতী ঘরে কি যেন করছে ঝুঁকে মন দিয়ে ।

'এতো সকাল বেলা শুভম সরস্বতী ঘরে কেন '?

পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েও ফিরে এলো শিপ্রা , চেয়ারে ঝুঁকে পড়া শুভম এর গায়ে হাত দিয়ে আলতো করে ঠেলতেই শুভমের দেহ এলিয়ে দিলো মেঝেতে ।

বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠেই শিপ্রার চক্ষুস্হির ।

শুভমের মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে ।

তাহলে কি তাকে সাপে কাটলো ?

কান্নায় বুকটা ফেটে চৌচির হলেও মিনিট পরেই নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব কাটিয়ে একটা নার্সিংহোমে ফোন করে এম্বুলেন্স এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । 

করোনা কালে নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া ভীষণ জটিল , যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে কি হবে ? শুভমের হলোটা কি ? একটি বড়ো সরস্বতী মায়ের মুর্তি ও একটি সরস্বতী মায়ের স্কেচ ছবি দেওয়ালে ছাড়া কিছু থাকে না এই ঘরে , এই ঘরেই শুভম সংগীতের সাধনা করে , কোনো কাজ না থাকলে ও সময় পেলে এই ঘরেই এসে বসে ,। শান্তি পায় মাতা সরস্বতী র মূর্তির দিকে তাকিয়ে থেকে ।ইদানিং একটা আরামকেদারা রেখেছে , যখন ই মন খারাপ হয় এখানে বসে কিছুটা স্বস্তি পেত সে ।

সারাদিন মেঝেতে বসেই সে সাধনা করে সংগীতের ।

   বারো বছরের দাম্পত্য জীবনের মূলমন্ত্র হলো বিশ্বাস যা রসহীন হয় নি কোনোদিন ।একটু নামডাক হয়েছিল ইদানিং , দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শুভম রায়ের সুমধুর ক্লাসিকাল কন্ঠ ,জয় করেছে সবার মন ।

শুভমের সারা শরীর উল্টেপাল্টে নিরীক্ষণ করে 

 না কোথাও তো কোনো কাটা দাগ বা ক্ষত চোখে পড়লো না ।সাপের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলো না সে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও ।

তাহলে মুখে গ্যাজলা কেন বের হলো ?


পাশের ঘরে প্রফুল্ল কে জাগিয়ে বললো "শোনো সোনা তোমার বাবার শরীর খারাপ হয়েছে , এম্বুলেন্স এলেই আমরা হাসপাতাল যাবো তুমি বাড়িতে দরজায় লক করে চুপচাপ খেয়ে শান্ত হয়ে পড়াশোনা করবে , বুঝলে" ?

 ঘুমচোখে প্রফুল্ল একনিশ্বাসে বলা কথা গুলো অর্ধেক বুঝলো অর্ধেক বোধগম্য হলো না ।

এম্বুলেন্সের শব্দে দ্রুত শিপ্রা বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে । 


ডাঃ বাবু কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে আশার আলো দেখাতে পারলেন না ।

বললেন একটা অপারেশন করে চেষ্টা করতে পারি হয়ত, তারপর ভগবানের হাতে । 

কি হয়েছে ওর ?

ওনার হার্ট ব্লক , ব্লাড সারকুলেশন বন্ধ হয়ে গেছে । ইমিডিয়েট অপারেশন করে ভেতরের জমাট বাঁধা রক্ত পরিস্কার করে পাম্পিং প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করতে হবে ।


আপনি তাড়াতাড়ি করুন ফর্ম টা ফিলাপ করে টাকা জমা করে দিন আর চার ইউনিট রক্ত লাগবে , একটু তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করুন নইলে কিছু করার থাকবে না .. বলেই ডাঃ বাবু নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন । 

 অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শিপ্রা বেরিয়ে গেলো সোজা বাইরে গাছের তলায় মাথা নীচু করে চোখের জল লুকানোর চেষ্টায় বসে পড়লো ।


 ঘন্টা খানেক পর হঠাৎ চমকে উঠলো ' শুভম কে তো কিছু খাওয়ানো হয় নি ,ও বেডে একলা পড়ে আছে হয়ত আমাকে খুঁজছে '!

হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে দেখলো শুভম ঘুমিয়ে পড়েছে ,পাশে থাকা চেয়াটায় শিপ্রা বসে পড়লো ক্লান্ত হয়ে । আজকের দিন তো পেরিয়ে গেলো , কাল যদি জোগাড় না করতে পারি তাহলে ? যতো দেরি হবে তত শুভমের জীবন সংকটে পড়বে কি করি উপায় ! ফেসবুকে অনলাইন হলো , কিছু ভালো লাগছে না ..

কোনোকিছুতেই মন বসছে না ।কী করবে সে ?

কাকে ডাকবে ? অফিসে বললে তো লোন ও এতোটাকার দেবে না একসাথে , রক্ত ই বা কোথায় পাবো ? একবোতল হয়ত নিজে দেবে কিন্তু আরো তিন টা চাই ...... উফ!! ভগবান কি শাস্তি দিলে ?

মেসেনজারে বহুলোকই মেসেজ লেখে তাদের কোনো উত্তর দেওয়া হয় না কোনোদিনই , সময়ের অভাব ইচ্ছের অভাব । আজ অলক্ষ্মে মেসেনজারে হাত দিয়ে একবন্ধুকে ভালো আছি লিখলো কাঁদতে কাঁদতে , 

 সেই বন্ধুর সাথে সাথ জবাব এলো কি ম্যাডাম একবছর পর উত্তর দিলেন যে বড়ো ??

আজ সময় আছে ??

এমনিতেই মন অশান্ত ছিলো তারপরে এর কথা ভেঙচি লাগলো ,অফ হতে যাবে সেই সময় আবার মেসেজ এলো ' সব কিছু ঠিক আছে তো ' ??

 না মানে সরি...বলছি শরীর মন সব ঠিক আছে ?

আসলে আপনি তো জবাব দেন না তাই হঠাৎ মনে হলো যেন কোনো অসুবিধা তে আছেন  

ওকে টাটা এগেন সরি ভালো থাকুন ।


শিপ্রা লিখলো হুম ঠিক ধরেছেন ..

আমি বর্তমানে আর জি কর হাসপাতালে কেবিন নং 5 এ। 

 ফোনটা অফ করে সাইডে রেখে বেডের ধারে মাথা টা ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ।


রাত দশটা বাজে মা বাবা এখনো এলো না তো ?

ভেবে মাকে ফোন করলো প্রফুল্ল । মায়ের কাছে কোথায় খাবার আছে জেনে নিয়ে বললো তুমি চিন্তা করো না মা , আমি গেটে ভালো করে চাবি দিয়ে দিয়েছি সকালেই একবারো খুলি নি তোমরা কখন আসবে মা ?

শিপ্রা কোনো উত্তর দিতে পারে নি, ফোনটা পাশে রেখে শুভমের বিছানার প্রান্তে মাথাটা নামিয়ে দিলো ।

খুব সকালে নার্স এসে জানালো আজ আপনার স্বামীর অপারেশন হবে দশটায় । তারআগে আপনি সব ফরম্যালিটি গুলো পূরণ করে দেবেন । 

অফিসে ফোন করে শিপ্রা লোনের ব্যাপারটা স্যাংকশেন হলো কিনা জানতে চাইলো , ম্যানেজার বাবু বললেন চিন্তা করবেন না ম্যাডাম সব ঠিক হয়ে গেছে , 

রিসেপশনে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করলো শিপ্রা ,তখন ই তিনটি ছেলে রিসেপশনে এসে শুভমের নাম পরিচয় দিয়ে দেখা করতে চাইলেন তার সাথে ।শিপ্রা এগিয়ে এসে জানতে চাইলো ব্যাপারটা। 

কি ব্যাপার বলুন ? আমি শুভমের স্ত্রী ।

ও নমস্কার ম্যাডাম  

আমাকে চিনতে পারেন নি ? আমি প্রকাশ 

আপনার ফেসবুক বন্ধু ।

কাল কথা হলো আপনার সাথে , আপনার স্বামীর জন্য রক্ত লাগবে বললেন ।

শিপ্রা এতক্ষণে বুঝতে পেরে বললো ও হ্যাঁ বন্ধু মনে পড়েছে , 'আপনি রক্তের ব্যবস্থা করেছেন ' ?

হ্যাঁ ম্যাডাম ।এই আমরা তিনবন্ধু রক্ত দেবো আজ কাল আরেক জন কে নিয়ে আসবো আপনার তো চার ইউনিট ব্লাড লাগবে ? 

হ্যাঁ মানে ওই আর কি ডঃ বাবু তো তাই বলেছিলেন : 

বলে ঘাড় নামিয়ে নিলো শিপ্রা ।


সিস্টার আমরা রক্ত দেবো আপনি প্লিস ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি , আমাদের কাজে যেতে হবে , আর শুভম বাবুর ও অপারেশন তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ।

বলেই শিপ্রার দিকে তাকিয়ে দেখলো উপোসী মুখে ক্লান্তির ছাপ । উস্কোখুস্কো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখে পড়ছে আবার নিজেই সরে যাচ্ছে যেন কুমির ডাঙ্গা খেলছে ।কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ি ।

আপনি এতো ঘাবড়ে আছেন কেন ম্যাডাম ? কোনো অসুবিধা হবে না আমরা এসে গেছি , এই এলাকায় যখন যার ই বিপদ হয়েছে শুধু একবার কানে শোনার অপেক্ষা , আমরা বন্ধুরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি , যতোটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করি । আপনি ভাববেন না যে আমি আপনার বন্ধু বলে এলাম । আমরা সবার জন্যই এসব টুকিটাকি কাজ করে থাকি ।

একনাগাড়ে কথা গুলো বলে প্রকাশ থামতে শিপ্রা আস্তে আস্তে মুখ তুলে দেখলো পাতলা, শীর্ণকায় , ছেঁড়া চপ্পল পায়ে, শ্যামলা বরনের তিনটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার দিকেই তাকিয়ে , চোখে মুখে বেশ তৃপ্তির ঔজ্জ্বল্য ।

মনেই হলো তারা এসব বানিয়ে বলছে না ।

চলুন তো আপনার স্বামীর সাথে পরিচয় করে আসি 

বলেই রিসেপশনে 5 নং কেবিনটা কোনদিকে জেনে নিজেরাই দুদ্দাড় করে উপরে উঠে গেলো ।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শিপ্রা ও গেলো তাদের পিছুপিছু । শুভম বিছানার উপর উঠে বসে শিপ্রাকেই খুঁজছিলো চারদিকে তাকিয়ে , দেখতে না পেয়ে আস্তে আস্তে নামতে যাবে কিনা চিন্তা করে পা টা খাটে ঝুলাতেই দরজা ঠেলে তিনজন যুবক ঘরে প্রবেশ করলো , ভয়ে শুভমের মুখ পাংশু হয়ে গেলো , এরা কারা ? কি করবে ? আমাকে মারবে ? চোর নাকি ? শিপ্রাও নেই কাছে তাহলে কি হবে ? প্রশ্নের ভিড় যখন গিজগিজ করছে মাথায় .. 

কেমন আছেন দাদা ?

আমরা আপনার সাথে পরিচিত হতে এলাম আমি প্রকাশ আর এ বিল্টু আর এই যে নীল শার্ট টা পরে আছে ও হলো শ্যামল ।

ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া শুভম কাঁপতে কাঁপতে শীর্ণ হাতদুটো তুলে নমস্কার করতেই শিপ্রা কে দেখে বুকে বল ফিরে পেলো । আলাপচারিতা সারতেই নার্স দিদির ডাক এলো , ওরা তিনজন দুদ্দাড় করে চলে গেলো আবার আসবো কাল কথা দিয়ে ।


 প্রকাশ একটা কথা বলবো ? তোমরা সবাই আজ আমার যা উপকার করলে এর ঋণ শোধ কি ভাবে করবো ?

ঋণের ব্যাপার নেই তো ম্যাডাম , আমরা সবার জন্য ই চেষ্টা করি । তাছাড়া ঋণ শোধ হলেই কি মিটে যাবে ?এই যে আপনি ব্যাংক থেকে লোন নিলেন সেই লোন হয়ত আপনি শোধ করবেন কিন্ত যে সংকটের মধ্যে আপনি এই উপকার পেয়েছেন সেই সময়টা ফেরত দিতে পারবেন ? যতোদিন আমরা পৃথিবীতে থাকবো ততদিন এই সময় টা ক্যামেরা বন্দী হয়ে গেলো । এটাই সবচেয়ে বেশী পাওনা ।

আপনি হয়ত কখনো আবার এই ঋণ শোধ করতে পারবেন আমার বা অন্য কারোর প্রয়োজনে কিন্ত এই সময় টা ফেরাতে পারবেন না ।

সুতরাং ঘোর ঘনঘটা বিপদে যে সাথে দাঁড়ায় তার ঋণ শোধ হয় না কি বুঝলেন ? এবার একটু হাসুন তো দেখি । আপনার হাসিমুখটা আমায় খুব শান্তি দেয় , ভালো লাগে ।



 সাতদিন পর বাড়িতে ফিরে এলো শুভম । ভীষণ আনন্দ লাগছে সেই চেনা গন্ধ , নিজের বাড়ির আত্মসুখ ,প্রফুল্ল র মিনিটে হাজার কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব ,পাশের গলি দিয়ে মাছমাসির মা... ছ........., আছে , বিধু গোয়ালা দুধের প্যাকেট নামিয়ে হেঁকে দিলো , সকালবেলাতে একফালি সূর্য হেসে লুটোপুটি খায় বিছানায়, তার পায়ের উপর নরম হাত বুলিয়ে দেয় , রান্নাঘরে শিপ্রার কুকারের সিটি আহা মনটা নেচে ওঠে মাঝেমাঝে ।


প্রায় দু-মাস পর আজ রেওয়াজে বসেছে শুভম , ভোরবেলা ওঠেই সরস্বতী ঘরে স্বরগম সাধছে পূরবী রাগে , বিছানায় শুয়ে শুয়েই কিছুক্ষণ শুনলো মন দিয়ে শিপ্রা , না বেশ ভালো ই গায় ও

 অফিসে সেদিনের ছুটি মঞ্জুর করার জন্য অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছে সে ,এবারের অনুষ্ঠান বেশ ভালো হবে ।ঠাকুর ওদের তুমি মঙ্গল করো ,যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিস্বার্থ দানের বিনিময়ে আজকের এই দিন , নিজেকে খুব তৃপ্ত লাগছিলো । ঈশ্বরের উদ্দেশ্য হাতজোড় করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনছিলো একমনে।

গোবিন্দ ব্যানার্জীর একটি গল্প

 ডরো মৎ


গল্পটা আমার মস্তিষ্কজাত নয়। মস্তিষ্ক আধারিত। শোনা গল্পের ভান্ডার থেকে অণুকথন বলা চলে। অবশ্য এ যাবৎ যা লিখেছি, 

সবই তাই। ছেঁড়া পেঁজা জায়গাগুলো কেবল আঠা

দিয়ে জুড়ে নিয়েছি। কত কত গল্প। কত চরিত্র।

ঠাসা হয়ে আছে দেরাজ। পাল্লা খুললেই ম-ম করে

পুরোনো গন্ধে। গত ভাদ্রের রোদ্দুরে কিছু গল্প

মড়মড়ে ক'রে শুকিয়ে নিতে গিয়ে চরিত্রগুলো এমন গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেল... দু'চারটেকে কোনোরকমে 

মিলিয়ে জুলিয়ে এ গল্পটা খাড়া করেছি... সযত্নে রেখে দিয়েছি নতুন গল্পের সংরক্ষিত দেরাজে...

              গোমুখের পথে কয়েক কিলোমিটার হাঁটার

পর, দলটার দুরন্ত পা'গুলো বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

তিন-চার পরত গরম পোশাক পরে থাকলেও বাতাসের তুষার শীতল ছোঁয়া হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সামনেই একটা বড় ধ্বস। উপর থেকে পাহাড়ের মাথাটা খসে পড়েছে।

ওটা পেরোতে হবে ভাবলেই সবার বুক অসহায় হয়ে 

উঠছে। পিসেমশাই তখন তাজা যুবক। দলপতি।

তিনি ধ্বসটা পার হবার সম্ভাব্য নানা ছক কাটছেন

কাগজে। সবাই প্রবল আশায় চেয়ে আছেন তার

মুখের দিকে...

             হঠাৎ উল্টো দিক থেকে সেই ভীষণ ভাঙনটা

অনায়াসে পেরিয়ে আসছেন এক নেংটি সর্বস্ব সাধুবাবা। সারা শরীরে, মুখে, মাথায় ছাইভষ্ম মাখা।

খালি পা। বয়েস বোঝার উপায় নেই। পিসেমশাই

সহ পুরো দলটা গোগ্রাসে দেখছেন সেই দৃশ্য। এসে

পড়েছেন কাছে। সারা মুখে নির্মল হাসি ছড়িয়ে সাধুবাবা একটু দূরের একটা পাথরে বসলেন। পিসেমশাইয়ের হাতের কাগজে আঁকিবুকি কাটা থেমে গেছে। চারিদিক স্তব্ধ। সাধুবাবা হো হো ক'রে

হেসে উঠলেন... ডরো মৎ... দিলসে চলো... বোলো..

গঙ্গা মাঈকী ... জয়....

আপ্লুত দলটার সম্মোহিত মুখে... জয়...জয়... ধ্বনি

পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে গেল...

জয়...জয়য়... ভয়য়... হয়য়....


বিশেষ জ্ঞাতার্থে...

               আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন... ট্রেক দলটা কিন্তু পেরিয়ে গিয়েছিল সেই ভীষণ ধ্বসটা। ডরো মৎ... আওড়াতে আওড়াতে। এবং আরো খানিকটা হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিল বিখ্যাত ভূর্জ গাছের জঙ্গলটার কাছে। আর সেখানেই ঘটেছিল সেই তোতা পাখির ব্যাপারটা। পাখিটা তাইই বলত... যা তাকে শোনানো হ'ত। অবিকল... 

আসল গল্পটা সম্ভবতঃ এখান থেকেই শুরু। স্মৃতির পাতা মুড়ে থাকতে থাকতে এই অংশটুকু মনে হয় ছিঁড়ে গিয়েছিল... অথবা হারিয়ে গিয়েছিল ভাদ্রের ঠা ঠা রোদ্দুরে...


আশীষ কুণ্ডুর একটি গল্প

   ছত্রধরের বিপদ


আজ ছত্রধর ভুঁড়ি সামলে সবে অটো থেকে নেমে দোকানে ঢুকতে যাবেন এমন সময়ে এক বাইক আরোহী প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো, একটা ফ্ল্যাশ হোলো, মনে হোলো পিছনে বসা একজন ফটো তুলে নিয়ে গেলো। ছত্রধর বড় চিন্তার ছাপ কপালে সেঁটে দোকানে ঢুকতেই,নীলু একেবারে গদগদ হয়ে বললো, "গুড মর্নিং স্যার!"

" ব্যাড মর্ণিং" ছত্রধরের কথায় থতমত খেয়ে নীলু বললো, "কেন স্যার, বৌদি কি ঝাড় দিয়েছে! "

"এই ডেঁপো ছোকরা, সাইটে যাওনি কেনো? "

" কোন সাইট স্যার, এই মন্দার বাজারে কাজ কোথায়?  একটা ওই বোসপাড়ার কাজ ছিলো কাল শেষ হয়ে গেছে, কি যে  হবে আপনার ? "

"আমার আবার কি হবে, তোমার কথা ভাবো, কাজ শিগগির না জোগাড় হলে হোঁচট খাবে তুমি " ছত্রধর সরাসরি বলে। 

কথা ঘুরিয়ে নীলু বলে, "স্যার, আপনি মনে হচ্ছে অন্য কিছু সমস্যার মধ্যে আছেন, শরীর ঠিক আছে তো আপনার? "

এবার যেন একটু ধাতস্থ হয়ে বলে, " শরীর ঠিক আছে, তবে আজ এই দোকানে ঢোকার সময়ে এক ছোকরা প্রায় গা ঘেঁষে ফটো তুলে চলে গেলো, তাই চিন্তা হচ্ছে "

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীলু বলে, " সে, কী! 

এতো বীভৎস সমস্যা, নীড টু বি টেকেন প্রপার এ্যাকশন! লেট আস মুভ টু পুলিস স্যার "

" এ্যাই, ইংরেজের পটি মাড়ানো ছোকরা, বাংলায় ফিরে এসো বাপধন, হাম অগর হিন্দি বোলা তো তুম কুপোকাত হো জায়েগা"

" বলছি, পুলিশকে জানানোর কথা, আমি এক কাজ করি আগেভাগে বৌদিকে জানাই, উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন--:"

" এ্যাই ব্যাটা লক্ষ্মণ দেওর, একদম নয়, একটু রোসো, দেখা যাক আগে কি হয়!" নিরস্ত করেন ছত্রধর। নীলু বলে " আপনি আমাকে নিজের ভাই ভাবেন না। "

ছত্রধর দেখলো ছোঁড়া সেন্টু খাচ্ছে, এখন বরং না চটিয়ে ওই সমস্যা, মানে,কেন ওর ফটো তুললো ওই বাইকসওয়ার ?,তার কারণটা খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। নীলুকে সেই প্রসঙ্গে আনতে, উৎসাহী নীলু বললো,

"ডোন্ট অরি, বি হ্যাপি, --আই আম সরি, স্যার, ইংলিশ বলার জন্য, আমি থাকতে কেউ আপনাকে ফুসলে নিয়ে যাবে,এটা আমি হতে দেবো না, ভাই হিসেবে আমি জীবন দিয়ে দেবো, কিন্তু আপনার গায়ে ঘাম গড়াতে দেবো না"

-"এ্যাই, চোপ, একেবারে নেতার বাচ্চা, ভাষণ দিতে পেলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না "

ছত্রধরের এহেন মন্তব্যে নীলু চোখ ছলছল করে বললো, "আপনি কি করে জানলেন স্যার, "

-"কোনটা"-

-" এই যে আমার বাবা নেতা ছিলেন এটা, আপনি সত্যিই মহান, বাবা দশবছর আগে গত,ভাল বক্তা ছিলেন, কখনো সখনো আমারও সেই ভূত চাপে, তখন বলে যাই এই আর কি! "

বাড়ি ফিরে সবে চা হাতে নিয়ে বসেছে ছত্রধর, শুরু হয়ে গেল শ্যামলীর মহাভারত, 

"তোমার মনটা কোথায় থাকে?  বলেছিলাম গ্যাসের ওষুধটা ফেরার পথে নিয়ে আসবে, তা নয়, বলি মুখটা অমন প্যাঁচার মত করে রেখেছি কেন?কতবার বলেছি ব্যবসা বাইরে

রেখে আসবে। কি হয়েছে কি বলবে তো। "

ছত্রধর বুঝতে পারছে আস্তে আস্তে শ্যামলীর কথার জালে জড়িয়ে পড়ছে,জানে এবারে একটানে মনের ভিতরে সমস্যা ঠিক বের করে আনবে। ছটফট করতে করতে কথার পৃষ্ঠা কথায়, একসময় ছত্রধর বলেই ফেললো ফটো তোলার ব্যাপারটা । প্রথম প্রতিক্রিয়া শ্যামলীর ," রুচি বলি লোকটার, তোমার ওই আলুভাতে মুখের ফটো যে তোলে,তার ওই যে বলে 'চুল্লু ভর' না, কি যেন সেই জলে ডুবে মরা উচিত,- এ্যাই-ই, সত্যি করে বলো কোথাও কিছু ঘাপলা করোনা তো, - - -" এইসব বলার ফাঁকেই ফোন এলো নীলু, মনে হোলো ভয়ে কাঁপছে,

"স্যার, আজ একটা ছোকরা এইমাত্র ফটো তুললো! "---

"কার ফটো তুললো বলবি তো হতচ্ছাড়া, টেনশন না চাপাতে পারলে, তোর ভাত হজম হয় না বোধহয় "-ছত্রধর চেঁচামেচিতে শ্যামলী শুধু বললো, " যেমন মনিব তেমন কর্মচারী, সব ফটো তুলে ফুটেজ খাওয়ার ধান্ধা! " থামিয়ে দিয়ে ছত্রধর বলে, " আমার মাথা খারাপ করে দেবে না বলছি, " আবার ফোনে মুখ লাগিয়ে, "বল্ কে ,কার ফটো  কোথায় ,কখন, কিভাবে , কেন তুললো?? "

নীলু ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, " আমার, এই দশ মিনিট আগে, মোবাইলে, কে কেন তুললো, বলি কি করে! "

" অপদার্থ কিছুই জানে না, ন্যাকা, বেশ করেছে ফটো তুলেছে, এবার নাচো ধেইধেই করে নাচো! একবার চলে আয় আমার কাছে, দেখি--- "

নীলু দশ মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির। কাঁপতে কাঁপতে ঢুকলো। ছত্রধরের মায়া হোলো, "কি হয়েছে বল, এবার! "

" আমি সবে দোকান বন্ধ করে তালা দিচ্ছি, একটা ছুঁচলো মুখে ছেলে প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে মোবাইলে আমার ফটো তুলে ঝপ করে  বাইকে চড়ে চলে গেলো, ভয়ে বুক ধড়াস ধড়াস করছিলো, কোনোমতে ফোন করি আপনাকে, আবার অটো ধরে আসার পথে লোকটা পেছন পেছন আসছিলো, আমাদের কি হবে গো দাদা"

শ্যামলী এতক্ষণ শুনছিল, এবারে বললো, "তুমি বাইকের নম্বর টা খেয়াল করেছো? "

" WB 01 2654, নম্বর, ডিস্কভার গাড়ী"

ছত্রধর হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, "তুই কার কাছে কাজ করিস, আমাকে আগে না বলে, তুই বৌদিকে আগে বললি কেন? তেরা চাগরি খতরা মে! :"

 "এ্যাই তুমি কি ভাবছো বলো তো নিজেকে, সমস্যাটা না বুঝে, খালি এদিক ওদিক, তোমার খুব বাড় বেড়েছে "

বৌয়ের ধমকানিতে কাজ হয়। ছত্রধর মাইয়া যায়। 

পুলিশ স্টেশন যাওয়া মনস্থ করে ছত্রধর।

গোগল কখন এসেছে কেউ খেয়াল করেনি। গোল গোল চোখ করে সবটা শুনছিল পেছনে বসে। গোগোল বাধা দিয়ে বললো, "পুলিশ স্টেশন গিয়ে কিস্যু হবে না, লেট মি হ্যান্ডেল দ্য সিচুয়েশন, আমি গোয়েন্দা সত্যেশের ভক্ত, দেখো সলভ করে

দিতে পারি কিনা, নীলু আঙ্কেল, তুমি একটা কাজ করো, অ্যালাও দ্য কালপ্রিট, সুযোগ পেলেই একটা ফটো তুলে নিয়ে আমায় ফরওয়ার্ড করো, বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও! " নীলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললো, " তুই কি গোয়েন্দা! " ছত্রধর চেঁচামেচি শুরু করলো, "এ্যাই ব্যাটা, তুই নিজেকে ওস্তাদ ভাবছিস, এখনো নাক টিপলে দুধ বেরোবে, আর তুই করবি সমস্যার সমাধান, পড়তে বোস শিগগির, এ্যাই শ্যামলী একে বোঝাও! "

--" তুমি থামো তো, নিজেকে কি ভগবান ভাবো, মূর্খের ডিম, আমার ছেলে জিনিয়াস, ও যখন বলেছে, ওর ওপর ছেড়ে দাও"

অগত্যা ছত্রধর মনকষ্ট নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন।

পরেরদিন সকাল দশটায় দোকান থেকে ফোন এলো নীলুর "স্যার আজ আবার লোকটা পিছু নিয়েছিলো, আমি এদিক ওদিক ঘুরেফিরে ঘুরপথে দোকান পৌঁছলাম, 

স্যার আমি বাঁচবো তো, এতো মনে হচ্ছে বেমক্কা তুলে নিয়ে যাবে! "

--"টারজেটটা (ছত্রধরের ভাষায় টারগেট পড়তে হবে) কে তুই না আমি, তাই তো সমঝ নেহি পাতা?  এই তুই লোকটার ফটো তুলতে পেরেছিস? "

- "স্যার ফটো তুলে গোগোলবাবুকে পাঠিয়ে দিয়েছি! " ছত্রধর চুপ করে যায়, ছেলের এই পাকামো, মানা যায় না,এটা ভাবতে থাকে । 

সেদিন বিকেলে চারটে নাগাদ গোগোল সরাসরি দোকানে এলো,জিজ্ঞাসা করলো, "নীলুকাকু, তুমি কোনো ফোন কল পেয়েছো? "

ছত্রধর আর চুপ থাকতে পারলো না, "এই তুই স্কুলে যাইনি? "

গোগোল একটা চাউনি দিলো, তার মানে অনেক কিছু হতে পারে, উপেক্ষাটা বেশি।

গোগল ফটো দেখে বললো, "এ্যাই উচ্চিংড়েমার্কা লোকটা তোমার আর বাবার ফটো নিয়েছে?"ছত্রধর সবে ঝুঁকে পড়ে ফটোটা দেখছিলো,গোগোল বলে বসলো, "ড্যাড্ তোমার ঘেমো বডিটা একটু সরাওতো " -ছত্রধর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে যাবে, নীলু বাধা দিলো, "স্যার ছেড়ে দিন,এখন আমাদের আসল সমস্যা লোকটা, সুতরাং আগে ওটাই সলভ করতে হবে, গোগোলকে বকবেন না প্লিজ! "  --সেদিন দোকান থেকে বেরোতেই ছুঁচোমুখো লোকটা মোড়ের কাছে পিছু নিলো ছত্রধরের ।ছত্রধর একটা সরুগলিতে ঢুকে পড়ে তস্য গলিদিয়ে শর্টকাটে মাছের বাজারে ঢুকে আবার বড় রাস্তায় এসে দেখলো লোকটা পিছু ছেড়েছে। হাঁফ ছেড়ে ধীরেসুস্থে বাড়ীর দিকে রওনা দিলো ছত্রধর। মনে মনে ঠিক করলেন গোগোলের ভরসায় না থেকে কাল সকালেই পুলিস স্টেশনে যাবেন রিপোর্ট করতে, সাথে পাড়ার বিশ্বস্ত বন্ধু সৌমেন মাস্টারকে নেবেন।রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে ফোনে বিশদে বললেন সৌমেনকে ।ছত্রধর পরেরদিন সকাল দশটায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছেন মাস্টারের জন্য , তখনই গোগোল মাটি ফুঁড়ে উদয় হোলো,"হাই ড্যাড্, কার জন্যে অপেক্ষা করছো?ডোন্ট অরি দোকানে এসো ম্যাটার সলভ হয়ে গেছে। " ছত্রধর খাবি খেতে খেতে বললো, "তার মানে?"গোগোল শুধু বললো, "সারপ্রাইজ! " বলেই হাওয়া হয়ে গেলো। সৌমেনকে নিয়েই তড়িঘড়ি দোকানে ঢুকে চমকে গেলো ছত্রধর, নীলুর সামনে চেয়ারে চেয়ারম্যান হয়ে বসে গোগোল পা দোলাচ্ছে, পাশে ছুঁচোমুখো লোকটা দাঁড়িয়ে।"ব্যাপারটা কি? "ছত্রধর বোঝার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে শ্যামলীর প্রবেশ। গোগোল বলতে শুরু করে, " কাল এনার ফটো নীলুকা দিয়েছিলো,রাইট, তারপরে আমি লুকিয়ে নীলুুকাকে ফলো করতে থাকি,- টোপকে ফলো করলে শিকারী ধরা পড়বে, এই ফর্মূলায়,ইনি কৌশিক রায়,পেশায় ঘটক রাস্তায় নীলুকাকে ফলো করছিলেন, ধরা পড়ে গেলেন আমার কাছে। একটা সম্বন্ধ এসেছে কাকুর,পাত্রীপক্ষ ডিটেল সারভে করতে বলেছে গোপনে ,পাত্র কেমন?কোথায় চাকরিরত, মালিক কে এবং কেমন? ইত্যাদি, কাল তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য পিছু নিয়েছিলো, ঠিক তো! "

কৌশিক ,হুঁ, বলে। ছত্রধরের দীর্ঘশ্বাস টপকে শ্যামলী বলে, " বলেছিলাম না, আমার ছেলে জিনিয়াস! "