আশীষ কুণ্ডুর একটি গল্প
ছত্রধরের বিপদ
আজ ছত্রধর ভুঁড়ি সামলে সবে অটো থেকে নেমে দোকানে ঢুকতে যাবেন এমন সময়ে এক বাইক আরোহী প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো, একটা ফ্ল্যাশ হোলো, মনে হোলো পিছনে বসা একজন ফটো তুলে নিয়ে গেলো। ছত্রধর বড় চিন্তার ছাপ কপালে সেঁটে দোকানে ঢুকতেই,নীলু একেবারে গদগদ হয়ে বললো, "গুড মর্নিং স্যার!"
" ব্যাড মর্ণিং" ছত্রধরের কথায় থতমত খেয়ে নীলু বললো, "কেন স্যার, বৌদি কি ঝাড় দিয়েছে! "
"এই ডেঁপো ছোকরা, সাইটে যাওনি কেনো? "
" কোন সাইট স্যার, এই মন্দার বাজারে কাজ কোথায়? একটা ওই বোসপাড়ার কাজ ছিলো কাল শেষ হয়ে গেছে, কি যে হবে আপনার ? "
"আমার আবার কি হবে, তোমার কথা ভাবো, কাজ শিগগির না জোগাড় হলে হোঁচট খাবে তুমি " ছত্রধর সরাসরি বলে।
কথা ঘুরিয়ে নীলু বলে, "স্যার, আপনি মনে হচ্ছে অন্য কিছু সমস্যার মধ্যে আছেন, শরীর ঠিক আছে তো আপনার? "
এবার যেন একটু ধাতস্থ হয়ে বলে, " শরীর ঠিক আছে, তবে আজ এই দোকানে ঢোকার সময়ে এক ছোকরা প্রায় গা ঘেঁষে ফটো তুলে চলে গেলো, তাই চিন্তা হচ্ছে "
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীলু বলে, " সে, কী!
এতো বীভৎস সমস্যা, নীড টু বি টেকেন প্রপার এ্যাকশন! লেট আস মুভ টু পুলিস স্যার "
" এ্যাই, ইংরেজের পটি মাড়ানো ছোকরা, বাংলায় ফিরে এসো বাপধন, হাম অগর হিন্দি বোলা তো তুম কুপোকাত হো জায়েগা"
" বলছি, পুলিশকে জানানোর কথা, আমি এক কাজ করি আগেভাগে বৌদিকে জানাই, উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন--:"
" এ্যাই ব্যাটা লক্ষ্মণ দেওর, একদম নয়, একটু রোসো, দেখা যাক আগে কি হয়!" নিরস্ত করেন ছত্রধর। নীলু বলে " আপনি আমাকে নিজের ভাই ভাবেন না। "
ছত্রধর দেখলো ছোঁড়া সেন্টু খাচ্ছে, এখন বরং না চটিয়ে ওই সমস্যা, মানে,কেন ওর ফটো তুললো ওই বাইকসওয়ার ?,তার কারণটা খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। নীলুকে সেই প্রসঙ্গে আনতে, উৎসাহী নীলু বললো,
"ডোন্ট অরি, বি হ্যাপি, --আই আম সরি, স্যার, ইংলিশ বলার জন্য, আমি থাকতে কেউ আপনাকে ফুসলে নিয়ে যাবে,এটা আমি হতে দেবো না, ভাই হিসেবে আমি জীবন দিয়ে দেবো, কিন্তু আপনার গায়ে ঘাম গড়াতে দেবো না"
-"এ্যাই, চোপ, একেবারে নেতার বাচ্চা, ভাষণ দিতে পেলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না "
ছত্রধরের এহেন মন্তব্যে নীলু চোখ ছলছল করে বললো, "আপনি কি করে জানলেন স্যার, "
-"কোনটা"-
-" এই যে আমার বাবা নেতা ছিলেন এটা, আপনি সত্যিই মহান, বাবা দশবছর আগে গত,ভাল বক্তা ছিলেন, কখনো সখনো আমারও সেই ভূত চাপে, তখন বলে যাই এই আর কি! "
বাড়ি ফিরে সবে চা হাতে নিয়ে বসেছে ছত্রধর, শুরু হয়ে গেল শ্যামলীর মহাভারত,
"তোমার মনটা কোথায় থাকে? বলেছিলাম গ্যাসের ওষুধটা ফেরার পথে নিয়ে আসবে, তা নয়, বলি মুখটা অমন প্যাঁচার মত করে রেখেছি কেন?কতবার বলেছি ব্যবসা বাইরে
রেখে আসবে। কি হয়েছে কি বলবে তো। "
ছত্রধর বুঝতে পারছে আস্তে আস্তে শ্যামলীর কথার জালে জড়িয়ে পড়ছে,জানে এবারে একটানে মনের ভিতরে সমস্যা ঠিক বের করে আনবে। ছটফট করতে করতে কথার পৃষ্ঠা কথায়, একসময় ছত্রধর বলেই ফেললো ফটো তোলার ব্যাপারটা । প্রথম প্রতিক্রিয়া শ্যামলীর ," রুচি বলি লোকটার, তোমার ওই আলুভাতে মুখের ফটো যে তোলে,তার ওই যে বলে 'চুল্লু ভর' না, কি যেন সেই জলে ডুবে মরা উচিত,- এ্যাই-ই, সত্যি করে বলো কোথাও কিছু ঘাপলা করোনা তো, - - -" এইসব বলার ফাঁকেই ফোন এলো নীলু, মনে হোলো ভয়ে কাঁপছে,
"স্যার, আজ একটা ছোকরা এইমাত্র ফটো তুললো! "---
"কার ফটো তুললো বলবি তো হতচ্ছাড়া, টেনশন না চাপাতে পারলে, তোর ভাত হজম হয় না বোধহয় "-ছত্রধর চেঁচামেচিতে শ্যামলী শুধু বললো, " যেমন মনিব তেমন কর্মচারী, সব ফটো তুলে ফুটেজ খাওয়ার ধান্ধা! " থামিয়ে দিয়ে ছত্রধর বলে, " আমার মাথা খারাপ করে দেবে না বলছি, " আবার ফোনে মুখ লাগিয়ে, "বল্ কে ,কার ফটো কোথায় ,কখন, কিভাবে , কেন তুললো?? "
নীলু ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, " আমার, এই দশ মিনিট আগে, মোবাইলে, কে কেন তুললো, বলি কি করে! "
" অপদার্থ কিছুই জানে না, ন্যাকা, বেশ করেছে ফটো তুলেছে, এবার নাচো ধেইধেই করে নাচো! একবার চলে আয় আমার কাছে, দেখি--- "
নীলু দশ মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির। কাঁপতে কাঁপতে ঢুকলো। ছত্রধরের মায়া হোলো, "কি হয়েছে বল, এবার! "
" আমি সবে দোকান বন্ধ করে তালা দিচ্ছি, একটা ছুঁচলো মুখে ছেলে প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে মোবাইলে আমার ফটো তুলে ঝপ করে বাইকে চড়ে চলে গেলো, ভয়ে বুক ধড়াস ধড়াস করছিলো, কোনোমতে ফোন করি আপনাকে, আবার অটো ধরে আসার পথে লোকটা পেছন পেছন আসছিলো, আমাদের কি হবে গো দাদা"
শ্যামলী এতক্ষণ শুনছিল, এবারে বললো, "তুমি বাইকের নম্বর টা খেয়াল করেছো? "
" WB 01 2654, নম্বর, ডিস্কভার গাড়ী"
ছত্রধর হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, "তুই কার কাছে কাজ করিস, আমাকে আগে না বলে, তুই বৌদিকে আগে বললি কেন? তেরা চাগরি খতরা মে! :"
"এ্যাই তুমি কি ভাবছো বলো তো নিজেকে, সমস্যাটা না বুঝে, খালি এদিক ওদিক, তোমার খুব বাড় বেড়েছে "
বৌয়ের ধমকানিতে কাজ হয়। ছত্রধর মাইয়া যায়।
পুলিশ স্টেশন যাওয়া মনস্থ করে ছত্রধর।
গোগল কখন এসেছে কেউ খেয়াল করেনি। গোল গোল চোখ করে সবটা শুনছিল পেছনে বসে। গোগোল বাধা দিয়ে বললো, "পুলিশ স্টেশন গিয়ে কিস্যু হবে না, লেট মি হ্যান্ডেল দ্য সিচুয়েশন, আমি গোয়েন্দা সত্যেশের ভক্ত, দেখো সলভ করে
দিতে পারি কিনা, নীলু আঙ্কেল, তুমি একটা কাজ করো, অ্যালাও দ্য কালপ্রিট, সুযোগ পেলেই একটা ফটো তুলে নিয়ে আমায় ফরওয়ার্ড করো, বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও! " নীলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললো, " তুই কি গোয়েন্দা! " ছত্রধর চেঁচামেচি শুরু করলো, "এ্যাই ব্যাটা, তুই নিজেকে ওস্তাদ ভাবছিস, এখনো নাক টিপলে দুধ বেরোবে, আর তুই করবি সমস্যার সমাধান, পড়তে বোস শিগগির, এ্যাই শ্যামলী একে বোঝাও! "
--" তুমি থামো তো, নিজেকে কি ভগবান ভাবো, মূর্খের ডিম, আমার ছেলে জিনিয়াস, ও যখন বলেছে, ওর ওপর ছেড়ে দাও"
অগত্যা ছত্রধর মনকষ্ট নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন।
পরেরদিন সকাল দশটায় দোকান থেকে ফোন এলো নীলুর "স্যার আজ আবার লোকটা পিছু নিয়েছিলো, আমি এদিক ওদিক ঘুরেফিরে ঘুরপথে দোকান পৌঁছলাম,
স্যার আমি বাঁচবো তো, এতো মনে হচ্ছে বেমক্কা তুলে নিয়ে যাবে! "
--"টারজেটটা (ছত্রধরের ভাষায় টারগেট পড়তে হবে) কে তুই না আমি, তাই তো সমঝ নেহি পাতা? এই তুই লোকটার ফটো তুলতে পেরেছিস? "
- "স্যার ফটো তুলে গোগোলবাবুকে পাঠিয়ে দিয়েছি! " ছত্রধর চুপ করে যায়, ছেলের এই পাকামো, মানা যায় না,এটা ভাবতে থাকে ।
সেদিন বিকেলে চারটে নাগাদ গোগোল সরাসরি দোকানে এলো,জিজ্ঞাসা করলো, "নীলুকাকু, তুমি কোনো ফোন কল পেয়েছো? "
ছত্রধর আর চুপ থাকতে পারলো না, "এই তুই স্কুলে যাইনি? "
গোগোল একটা চাউনি দিলো, তার মানে অনেক কিছু হতে পারে, উপেক্ষাটা বেশি।
গোগল ফটো দেখে বললো, "এ্যাই উচ্চিংড়েমার্কা লোকটা তোমার আর বাবার ফটো নিয়েছে?"ছত্রধর সবে ঝুঁকে পড়ে ফটোটা দেখছিলো,গোগোল বলে বসলো, "ড্যাড্ তোমার ঘেমো বডিটা একটু সরাওতো " -ছত্রধর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে যাবে, নীলু বাধা দিলো, "স্যার ছেড়ে দিন,এখন আমাদের আসল সমস্যা লোকটা, সুতরাং আগে ওটাই সলভ করতে হবে, গোগোলকে বকবেন না প্লিজ! " --সেদিন দোকান থেকে বেরোতেই ছুঁচোমুখো লোকটা মোড়ের কাছে পিছু নিলো ছত্রধরের ।ছত্রধর একটা সরুগলিতে ঢুকে পড়ে তস্য গলিদিয়ে শর্টকাটে মাছের বাজারে ঢুকে আবার বড় রাস্তায় এসে দেখলো লোকটা পিছু ছেড়েছে। হাঁফ ছেড়ে ধীরেসুস্থে বাড়ীর দিকে রওনা দিলো ছত্রধর। মনে মনে ঠিক করলেন গোগোলের ভরসায় না থেকে কাল সকালেই পুলিস স্টেশনে যাবেন রিপোর্ট করতে, সাথে পাড়ার বিশ্বস্ত বন্ধু সৌমেন মাস্টারকে নেবেন।রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে ফোনে বিশদে বললেন সৌমেনকে ।ছত্রধর পরেরদিন সকাল দশটায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছেন মাস্টারের জন্য , তখনই গোগোল মাটি ফুঁড়ে উদয় হোলো,"হাই ড্যাড্, কার জন্যে অপেক্ষা করছো?ডোন্ট অরি দোকানে এসো ম্যাটার সলভ হয়ে গেছে। " ছত্রধর খাবি খেতে খেতে বললো, "তার মানে?"গোগোল শুধু বললো, "সারপ্রাইজ! " বলেই হাওয়া হয়ে গেলো। সৌমেনকে নিয়েই তড়িঘড়ি দোকানে ঢুকে চমকে গেলো ছত্রধর, নীলুর সামনে চেয়ারে চেয়ারম্যান হয়ে বসে গোগোল পা দোলাচ্ছে, পাশে ছুঁচোমুখো লোকটা দাঁড়িয়ে।"ব্যাপারটা কি? "ছত্রধর বোঝার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে শ্যামলীর প্রবেশ। গোগোল বলতে শুরু করে, " কাল এনার ফটো নীলুকা দিয়েছিলো,রাইট, তারপরে আমি লুকিয়ে নীলুুকাকে ফলো করতে থাকি,- টোপকে ফলো করলে শিকারী ধরা পড়বে, এই ফর্মূলায়,ইনি কৌশিক রায়,পেশায় ঘটক রাস্তায় নীলুকাকে ফলো করছিলেন, ধরা পড়ে গেলেন আমার কাছে। একটা সম্বন্ধ এসেছে কাকুর,পাত্রীপক্ষ ডিটেল সারভে করতে বলেছে গোপনে ,পাত্র কেমন?কোথায় চাকরিরত, মালিক কে এবং কেমন? ইত্যাদি, কাল তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য পিছু নিয়েছিলো, ঠিক তো! "
কৌশিক ,হুঁ, বলে। ছত্রধরের দীর্ঘশ্বাস টপকে শ্যামলী বলে, " বলেছিলাম না, আমার ছেলে জিনিয়াস! "
Comments