অর্ণব মিত্রের একটি গল্প

 জন্মদিনের উপহার 


অনু আর শাক্য সেই ছেলেবেলার বন্ধু । স্কুল থেকে টিউশন, কোথাও বেড়াতে যাওয়া সবকিছু একসাথে ওদের । শাক্য আর অনুর কলেজটাই আলাদা শুধু। ওদের বাড়িও একপাড়াতে ।


শাক্য আর অনুর এই সম্পর্ক কৈশোর অব্দি 'নিখাদ বন্ধুত্ব' বলেই জানত অনু । তবে অষ্টাদশের গণ্ডি পেরোতে অনু শাক্যর জন্য ওর বিশেষ অনুভূতি আছে । এই অনুভূতির কি নাম - 'প্রেম'? তবে কি শাক্যরও এমন অনুভূতি হয়? যদি হয় তো শাক্য অনু কে বলে না কেন? অনুও মাঝে মাঝে ভাবে ওই তো প্রথম বলতে পারে, বললে কি শাক্য মুখের ওপর না করে দিতে পারবে অনু কে?


আজ অনুর জন্মদিন। অনেক দিনের পর আজ বুকে সাহস জোগাড় করেছে অনু । আজ ও শাক্য কে বলেই দেবে । ওদের বন্ধুত্বের এবার পরিণতির দরকার ।


দুপুর থেকেই লোকজন অনুদের বাড়িতে ভিড় জমাতে লাগল । এত লোকজন থাকা সত্ত্বেও অনুর খুব একলা লাগছিল। ওর দু চোখ শাক্য কে খুঁজছে। কখন আসবে ছেলেটা কে জানে?


শাক্য এল অনেক দেরিতে । অনুর কেক কাটার অনেক পর । ওকে প্রথম কেক খাওয়াবে বলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল ও । কিন্তু রাত হয়ে গেছে, গেস্টরাও সবাই বাড়ি চলে যাবে । অগত্যা কি আর করা যায়!


লোকজনের ভিড় কাটিয়ে শাক্য অনুকে বলল,

- "এই অনু, শোন না, বারান্দায় চল একটু আমার সাথে । তোকে একটা দারুণ জিনিস জানানোর আছে, পরে অবশ্য কাকু কাকিমাকে জানাব।"

তবে, শাক্য অনু কে কি এত বছর ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা কথা আজ বলবে? অনুর বুকের মধ্যে আশার বারুদ দপ দপ করে জ্বলছে । শাক্য কে নিজের করে পাওয়ার আগুন অনুর বুকে দাবানল সৃষ্টি করেছে ।


বারান্দার দুপ্রান্তে দুজনে দাড়িয়ে । কত ব্যবধানে! ওরা এই মুহূর্তে একা, নিভৃতে । এই নির্জনতাকে অনুর অন্তরঙ্গতা মনে হচ্ছে । অন্তরাঙ্গতা কি শুধু শারীরিক স্পর্শেই হয়?


শাক্য ওর হাতটা এবার ধরল হঠাৎ । এই আচমকা স্পর্শ শিহরণ জাগল অনুর মনে । অনুর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে । এই সামান্য ছোঁয়া, সামান্য শীতলতাকে আকড়েই তো অনু বাঁচতে চেয়েছে সারাজীবন। শাক্যরও কি এই অনুভূতি হচ্ছে? না কি এটা শুধুই অনুর পাগলামো !

"এই অনু, শোন না .. " শাক্য বলা শুরু করল,

"আরে আজ এত দেরি হয়ে গেল না, কিছু মনে করিস না রে। আসলে গুঞ্জাদের বাড়ি থেকে ফিরতে অনেক দেরি হল।"


এই একটা নামকে অনু চিরকাল হিংসা করে। শাক্যর কলেজে পড়ে গুঞ্জাদি। শাক্য এর থেকে এক বছর এর সিনিয়র । খুব ভালো সম্পর্ক ওদের । প্রায় এর বাড়ি ওর যাওয়া লেগেই আছে । তবে এই সুন্দর মুহূর্তে গুঞ্জা নামটা অনু একদম পছন্দ করল না এরকম মুহূর্তে। কিসের জন্যে অনু জানে না । ওর মনের ঈর্ষা প্রকাশ পেল প্রশ্নে,

- " ওর বাড়িতে আজ হঠাৎ কি করতে গিয়েছিলিস? "

-"আরে সেটাই তো বলার জন্য তোকে এখানে ডাকলাম । দেখ তোকে তো আমি সব কথাই বলি, এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বলা হয়নি । আজ তো ওদের বাড়িতে পাটিপত্র ছিল। "

-"পাটিপত্র! গুঞ্জাদিদের বাড়িতে কার আবার বিয়ে রে? "

অনু বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নগুলো করে।

-"কার আবার অনু! তুই যেন জানিস না! আমার আর গুঞ্জার বস! লাস্ট উইক আই টেক্সটেড ইউ, যে আমরা ফাইনালি বাড়ির লোকজনকে কনভিন্স করতে পেরেছি । আমাদের পাকা দেখা হয়ে গেলো আজ"


এসব শাক্য কি বলছে? শাক্যর কথা অনুকে ধীরে ধীরে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে ।

শাক্য কি কোনোদিনও অনুকে ভালোবাসেনি? সব বন্ধুদের মত অনুও ওর শুধুই চাইল্ড হুড ফ্রেন্ড ! কিন্তু অনু তো সব সময় শাক্য কে ভালোবেসছে এমন কি এই মুহূর্তটাতেও।


অনুকে অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে শাক্য এবার জিগ্যেস করে -

"কি রে অনু? থম মেরে গেলি যে ! আর তোর চোখও তো ছলছল করছে, কি হল আবার? "


সত্যিই তো অনু কাঁদছে কেন? এসব কি পাগলামো? কিসের এত কষ্ট ওর? বিরহযন্ত্রণা নাকি বিচ্ছেদের শোক? বিচ্ছেদ! অনু আর শাক্যর প্রেম ছিল যে বিচ্ছেদ হবে । অনু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে


_"এত বড় কথাটা কেউ এভাবে জানায় ! সেই নার্সারিবেলার বন্ধু তুই আমার, বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি রে তুই, ফর্ম স্কুলে যেতে দেরি টু বিয়ের পিঁড়ি! "


শাক্য আর অনু দুজনেই হেসে উঠল । এই সময় শাক্যর একটা ফোন এল , গুঞ্জা করেছে । শাক্য অনুকে না জানিয়ে ওখান দিয়ে বেড়িয়ে গেল ।


বারান্দায় একা দাড়িয়ে রইল অনু, ঠিক যেমন স্কুল বা পড়তে না গেলে অনু একা একা বাড়ি ফিরত সেরকম । অনুর ছোটোবেলার কথা মনে এল । শাক্য আর ও যখন একসাথে বাড়ি ফিরত, শাক্য ওর বাড়ি ঢুকে গেলে অনু একা একাই রাস্তায় চলত। শাক্য নিজের সংসারে ঢুকে গেলো!


অনু আর শাক্যর কি তবে কোনো কালেই সংসার ছিল না? ছিল হয়ত! ছোটবেলাতে যখন ওরা একসাথে পাহাড়ে ঘুরতে যেত, শাক্য ওকে হাত ধরে পাহাড়ে ওঠাত । তখন থেকেই তো সেই কাল্পনিক, অবাস্তব সংসার এর ব্যূহ নিজের মনে রচনা করত অনু । যে সংসারের কোনো অস্তিত্বই নেই । নাই বা থাকুক কোনো অস্তিত্ব, সেই সংসার তো অনুর ব্যক্তিগত । সেখানে শাক্য অনুর ছাড়া আর কারুর নয় । এই কাল্পনিক সংসারের মায়াজাল বুনতে বুনতেই তো অনু বড় হয়েছে । শাক্যর সাথে গুঞ্জার বিয়ের পরও সেই সংসার অক্ষতই থাকবে ।

এই কথা গুলো অনু ভাবছিলো আর চোখের জল ফেলছিল । কেন অনুর চোখে আজ জল?

সময়ের কথা তো অনু সময়ে বলে উঠতেই পারেনি । তাই আজ ও নিজেই ওর এই পরিণতির জন্য দায়ী । অনুকেই তো এই না পাওয়ার ক্ষতটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে আজীবন ।


আজ অনুর ২৪ তম জন্মদিন। শাক্যর দেওয়া উপহারটা অনুর টেবিলেই আছে মোড়ক খোলেনি ও । ওর এই উপহারটাকেই সারাজীবন বুকের মধ্যে নিয়েই বাচবে ও একা । যেমন ভাবে বেঁচে এসেছে ও এতোগুলো বছর ।


"কি রে! গিফ্টটা খুলে দেখলি না একবার? ", শাক্য জিগ্যেস করল।

" তুই আমায় যা ভারী সুন্দর উপহার দিলি আজ আর মোড়ক খুলতে ইচ্ছা করছে না রে । "


সত্যি ওর আর ওই মোড়ক খুলতে ইচ্ছা করছে না। যদি অপ্রিয় কিছু হয় ! আর ধাক্কা সামলাতে পারবে না অনু।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024