চিরঞ্জিত ভাণ্ডারীর দুটি কবিতা

 এক দশান তেল


বৃষ্টি পড়লে স্মৃতির ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসে দুঃখিনী মা

সম্বল বলতে ছিল একচিলতে উঠোন আর একটি

পূরাতন বাড়ি,সোনালি খড়ে ছাওয়া।

আমরা বেড়ে উঠছিলাম পাঁচ ভাই বোন আগামীর

স্বপ্ন নিয়ে বুকে

আর মনে মনে ভেবে আশ্চর্য হতাম কোন সাধনার জোরে

ঢেঁকির গড়ে পেষা ভাতের চালের মতো হাসির ঝিলিক খেলা করতো মায়ের দু-চোখে ভরে।

শ্রাবণমাস,খড়ের চালের ফুটো বেয়ে গড়িয়ে নামত বৃষ্টির ফোঁটা,দৈত্যের মতো গর্জে উঠত বজ্রপাত,

লম্ফের আলোটা বাতাসে কেঁপে উঠত বার বার

মা বলতো আমি থাকতে ভয় কিসের?এই দেখ

কেমন শক্ত করে ধরে আছি হাত,

আর একচিলতে আঁচলটা আকাশের মতো

আমাদের মাথার উপর ধরে কত সহজেই কাটিয়ে দিতো রাতের উপর রাত।

বৃষ্টি থামলে,আনন্দে মিষ্টি সুরে বলতো চেয়ে দেখ কি অপূর্ব সকাল নেমেছে সজনে গাছের ডালে

অমনি ধবলি গাইটা হাম্বা হাম্বা করে উঠতো ডেকে

কয়েকটা হাঁস ক্যার ক্যার করে ঘুরতো মায়ের চার পাশে

ছুটে এসে ছাগল ছানাটা টেনে ধরতো আঁচল আদুরে মুখে

পায়রা গুলো ভরে দিতো উঠোন খুশির বাতাসে।

দিন পেরিয়ে যায় পেরিয়ে যায় বছর,কৃষ্ণচুড়ার ফুলের চিবুক ছুঁয়ে শিশুটির মতো হাসে ভোরের রবি

আমরাও নিজের মত যে যার আঁকি স্বপ্নের ছবি।

এখন লক্ষ্মীদেবী সুপ্রসন্না,মায়ের দুধেভাতের আকাঙ্ক্ষা বাজায় সাধ পূরণের বাঁশি

মুখে লেগে থাকে শঙ্খসুরের মত মৃদু হাসি।

একদিন স্নেহের বোনটা আমাদের কাঁদিয়ে

চলে গেল,সিঁথিতে লালটুকটুকে সিঁদুর,হাতে রঙিন কাচের চুড়ি

এখন বলে,জানিস দাদা,জানিস মা জানিস

মনের মতো পেয়েছি ভাগ্যগুণে শ্বশুর বাড়ি।

বলতে বলতে মোবাইলে থেকে ভেস উঠে টুপটাপ টুপটাপ, ঝরে পড়ে চোখের জল

আসলে সব আঁচল আঁচল হলেও কোন আঁচল হয় না মায়ের আঁচলের মতো আঁচল।

সেদিন ঠিক দুপুরবেলা,খাওয়া দাওয়া শেষে,মা

বসল আমাদের সাথে, নাতি নাতনি ভরা আঙিনা

নথনেড়ে নেড়ে এসে বসল পাড়াতুতো মামিমা।

সে নাকি মায়ের সাথে রোজ যেতো তুলতে শাক

শুশুনি,হেঞ্চা শাকের জঙ্গলে

বেঁধে নিতো পেঁয়াজ মুড়ি লঙ্কা সুতির ছাপাশাড়ির

ছেঁড়া আঁচলে।

মা জল ভরা চোখে একটা চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে

বলে উঠল,তৃষ্ণার্তকে দিস জল,রুখু মাথায় দিস তেল

তেলে জলেই আসলে মানুষের পরমায়ু বলেই

বেঁচে থাকার বাসনায় এতো কষ্ট লুকোনোর লুকোচুরি খেল।

এমনি খেলা খেলতে খেলতে মা ঈশ্বরী হয়ে উঠেছিল ঠিকই

অথচ মাটির দেবী মাকে দিয়েছি কত থালা ভরে

ফুল ফল দল

রুখু মাথা রুখুই রয়ে গেল,তবু মায়ের চুলে দিলাম না

হায় তেল,এক দশান তেল।


______________________


একটি কন্যা শিশুর মৃত্যু


জানিস মা জানিস,আমাকে যখন ফেলে গেলি

ঐ দূরের ময়লা আবর্জনা ঝোপের ভেতর

আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম আর কেঁদে কেঁদে

বলছিলাম আমি বাঁচতে চাই আমি বাঁচতে চাই

বাঁচতে যে বড় ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি।

জানো বাবা,আমার কান্না শুনে ছুটে আসছিল কুকুর,শুকুন এমন কি লালপিঁপড়েরাও ছাড়েনি

ছাঁড়েনি খুবলে নিতে কাক তুলতুলে নরম মাংশ

অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার করে বলে ছিলাম

আমি বাঁচতে চাই আমি বাঁচতে চাই

বাঁচতে যে বড়ই ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি।

আমি যেদিন আমি গর্ভে এলাম

আমাকে নিয়ে মায়ের সে কি আদুরে খেয়াল,

ঠাকুমা ডেকে বলতো সাবধানে বউমা খুব সাবধানে হাঁট চলা করবে,গৃহকর্মে হাত দেবার নেই দরকার

খেয়ে দেখ তোমার জন্য বানিয়েছি আমের আচার।

ভূমিষ্ঠ হবার আগে বাবার নাম রাখা দেখে

আমি ঈশ্বরকে বলেছিলাম জানো ঈশ্বর জানো

আমাদের পৃথিবীতেও স্বর্গ আছে একটা সুখের স্বর্গ আছে স্বর্গ আছে

আসলে ভেবেছিলাম মেয়েদেরকেই বুঝি কাজল

নামে ডাকে।

যে দিন আমি ভূমিষ্ঠ হলাম,মা গালে চুমুর উপর চুমু দিতে দিতে বলছিল,ও রে যাদু নয়ন মণি তুই যে আমার জীয়ন কাঠি

তোর আসাতেই ফুটল আমার স্বপ্ন গাছের হাজার কলি।

পরের দিন ফোলাও করে বেরোল দাদু দিদা কাকুমণির মিষ্টি বিলোনোর খবর মুখ হাসি হাসি

শিরোনামে উজ্জ্বল অক্ষরে শীতের রোদের মতো

চমকালো এ মেয়ে শুধু মেয়ে নয় সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী।

আমি সেদিন ভোরের কুসুমের মতো খিলখিল হেঁসে ছিলাম খুব

আর গাছ পাখি আকাশ সূর্যকে ডেকে ডেকে বলে ছিলাম এ মাটি শুধু মাটি নয় এযে স্বর্গ ভূমি

মানুষ হাতে হাত রেখে বাজায় প্রতিনিয়ত প্রেমের ঝুমঝুমি।

এই সুন্দর পৃথিবীর মাটি চুমে বাঁচতে চাই বাঁচতে চাই বাঁচতে যে বড়ই ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি।

পাঁচদিন পর স্নেহময়ী দিদিমণি ঘোষণা করলেন ছুটির, মিষ্টি একটা চুমু দিয়ে গালের উপর

যাও সোনা যাও নার্সিংহোম থেকে ফিরে যাও আপনার ঘর।

গাড়ি ছাড়লো,ছুটছে ছুটছে গাড়ি দূরন্ত সে গতি

চিরবসন্তের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে খেলছে আবীর

রাজপথের যতসব রঙিন বাতি।

কিছু দূর যেতে নেশা নেশা ঘুম ঘুম সবুজ গ্রামগুলি

ভিজছে নরম জোছনায় একে অপরের কোলাকলি।

মা বলে উঠে,চেয়ে দেখ সোনা চেয়ে দেখ

ঐ যে দূরে দেখা যায় ক্ষীণ নদীর পারে ছোট্ট শহর

পশ্চিমে গীর্জার ঘন্টা ধ্বনি,দক্ষিণি আজান শুনি

পূর্বে দুর্গামন্দির, মুখোমুখি সুখীগৃহকোন আমাদের

স্বপ্ন সুখের তিনতলা বাড়ি ভালোবাসায় জড়াজড়ি।

বাঁচতে চাই বাঁচতে চাই বাঁচতে যে ভীষণ ভালোবাসি।

ভাঙা ভাঙা মেঘ থেকে দেখি জবাকুসুমের ভোর

গাছে গাছে ফুলে ফুলে কত না খুশির মনোরমা সুর

ময়ূরের মতো পেখম মেলে নেচে উঠেল আমার মন

ঠিক যেন শ্রাবণ বৃষ্টির সোহাগে

কিশোরী আমনের আলতা পায়ে পায়ে বেজে ওঠা

সবুজ ঘুঙুর।

ওরাও বলছে এই সুন্দর পৃথিবীর চুমে মধুর কলসি

বাঁচতে চাই বাঁচতে চাই বাঁচতে যে ভীষণ ভালোবাসি।

হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি,খুলে গেল কপাট

আমাকে ছুড়ে দিল, ভরা

পলকে আছড়ে পড়লাম নিষ্প্রাণ পাথরের উপর

বাঘের মতো উর্ধ্বাশে ছুটে এলো ক্ষুধার্ত কুকুর।

নারীদের কাঁদতে মানা,সিঁথির সিঁদুরটুকু সম্বল

নির্বাক মায়ের চোখ থেকে শুধু গড়িয়ে পড়ল ফোঁটা ফোঁটা বেদনার জল।

শোকে দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল ক্রন্দসী

আমি আর্ত চিৎকারে বলছিলাম আমি বাঁচতে চাই

আমি বাঁচতে চাই বাঁচতে যে বড়ই ভালোবাসি।

হ্যা আধুণিক সভ্যসমাজের মানুষ,তোমাদের ধিক্কার শতত ধিক্কার

ইয়া দেবী সর্ব ভূতেষূ মাতৃ রূপেণ সংস্থিতা

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নম মন্ত্রে

মা বল মাটির প্রতিমার

আর কসাই বেশে হত্যা করো জ্যান্ত দুর্গার

ধিক্কার শুধু ধিক্কার তোমাদের শতত ধিক্কার।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024