অঞ্জলি দে নন্দীর একটি গল্প

 বিকালবেলা


বঙ্গের হুগলীর চৈতন্যবাটী গ্রামের মেয়ে আমি। বিকালবেলা গা ধুয়ে, শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে পেতলের পিলসুজ ও প্রদীপ তেঁতুল দিয়ে মেজে, খিরকি ঘাটে ধুতাম। তারপর শেতলা মায়ের ঘরের পাশে বসে বসে বসে অনেক নন্দী বাড়ির মেয়ে ও বউ দূরের দামোদরের বাঁধে যাওয়া আসা দেখতাম। একজন লোক বা মহিলা হাতে লাঠি নিয়ে সামনে চলেছে আর তার পেছনে পেছনে পেছনে পালখানেক গরু চলেছে অথবা ছাগলের পাল। এরকম অনেক জন অনেক পশু নিয়ে বিকালবেলা নিজেদের বাড়ি ফিরত রোজ। গরুগুলির মুখে জালি বাঁধা যাতে রাস্তার ধারের জমির ফসল খেতে না পারে। আর ছাগোলগুলো তো তারস্বরে ব্যা ব্যা ব্যা করে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটত। গরুগুলিও মাঝে মাঝেই লেজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগতো। ঘরে ফেরার এমনই টান। এসময় মা শেতলার সামনের বাঁশ বাগানে অগণিত শালিক এতো চেঁচামেচি করত যে কান একেবারে ঝালাপালা হত। সারাটা দিনের পর ওরা যে আবার বাসায় ফিরে এসে একত্রিত হয়েছে। কত জমানো পরানের কথা! 

এবার আমি উঠে গিয়ে ঘরের হারিকেনগুলি, দেশলাই দিয়ে জ্বালাতাম। লম্প ও লণ্ঠন ও জ্বালাতুম। এবার তুলো পাকিয়ে ওই প্রদীপের পোলতে বানাতুম। যোগ চিহ্নের মত করে প্রদীপের বুকে দিতুম। এরপর প্রদীপে সর্ষের তেল ঢালতুম। লম্প থেকে প্রদীপ জ্বালাতাম। ওটি তুলসী তলায় দেখিয়ে নিজেদের ঘরের ঠাকুরের সামনে রাখতাম। এরপর কমুণ্ডুল থেকে গঙ্গা জল ডান হাতের তেলোয় ঢেলে তা কৌকাঠে ছড়াতাম। ঠাকুরের পাশে রাখা পিঁড়েতে এবার কমুন্ডুলটা রাখতাম। আর তার পাশে থাকা শাঁখটা নিয়ে দুহাতে ধরে অনেকক্ষণ ধরে টেনে রেখে রেখে রেখে তিনবার বাজাতুম। এবার এই শাঁখের মুখটা কমুন্ডুলের জল ঢেলে ধুয়ে, কমুণ্ডুল ও শাঁখ দুটোই আবার পিঁড়েতে রেখে দিতুম। ওখানেই ও দুটি থাকে তো। এবার হাঁটু গেড়ে মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কর্তুম। আর বলতাম, " ঠাকুর তুমি যা ভালো বোঝো তা-ই কোরো! " পিলসুজের ওপরে তখন প্রদীপটি স্থির, স্নিগ্ধ, ধ্যানস্থ আলো দিত আমাকে ও সিঙ্গাসনে থাকা দেবদেবীদের। এরপর ওই ঠাকুর ঘরের সামনের জলদাওয়ায় মাদুর পেতে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তাম। আমি প্রতি বছর ফার্স্ট হয়ে নতুন ক্লাসে উঠতাম। 

আজ পৌঢ়ত্বে - জীবনের বিকালবেলায় এসে স্মৃতির জাবর কাটছি। বিজলিহীন গাঁকে তো আভি ভি আমি স্বপ্নে দেখি - দিল্লীতে রাত্রে এয়ারকন্ডিশন রুমে বন্ধ, ঘুমন্ত চোখে আর এখনের প্রৌঢ় নিজেকে নিজেই দেখি সেই সে বালিকা, অঞ্জু, অঞ্জলি নন্দী, স্কুলের ছাত্রী। সময় পিছনে যেতে না পারলেও স্বপ্ন কিন্তু পারদর্শী..............

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024