অভিজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস (প্রথম পর্ব)

          মুকুট


(১)

মুকুট এসেছিল ২ বছর বয়সে। মায়ের মুখে শুনেছিল সেবার হঠাৎ দেওঘরে এসে ঘর পাচ্ছিল না। তারা তখন ছিল নিন্ম মধ্যবিত্ত। এখন অবশ্য অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। নিম্ন বোধহয় আর নেই। যেমন বুবুন আর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে পড়ে না।

স্কুলের নাম হুগলি ব্রাঞ্চ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মর্মর-মূর্তি রয়েছে। সাদা। শরৎচন্দ্র একসময় এই স্কুলে পড়তেন।

বোধহয় ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিলেন। তারপর অভাবের তাড়নায় ভাগলপুর চলে যান। পরীক্ষা দেওয়া হয়নি এরকম কিছু গল্প রয়েছে।

কিছুদিন ধরে সেই মর্মর মূর্তিতে দুটো আলো খেলে বেড়ায়। রোদ্দুরের আলো ম্লান হলে সেই আলোর টুকরো দুটো স্পষ্ট দেখা যায়।

মুকুট ক্লাস এইটে উঠেছে সবে। পদার্থ বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে।

তবে ফিজিক্সের স্যার পাগলাটে গোছের, মনে মনে কি-সব বিড়বিড় করেন।

আলো মরে এসেছে সেদিন। পুজোর ছুটি হুট করে চলে যাওয়ায় মনটা বেশ খারাপ। চন্দননগরে জগদ্ধার্থী পুজোর স্কুলে কোন ছুটি নেই। সপ্তমীর দিন তাও গেছিল চন্দননগর মোগলাই খেয়েছিল।

অসীম, বৈদ্যনাথ ট্রেনে ওঠার সময় আলাদা হয়ে গেছিল। ওদের মুখে সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিল বুবুন। যদিও কাউকে বলেনি।

সেবার ২ বছর বয়সে মুকুট তখন দেওঘরে গেছিল এক বৃদ্ধের খুব ন্যাওটা হয়েছিল কয়েক দিনেই। তাঁর একটি আশ্চর্য বাড়ি ‘শাশ্বত’ ছিল ওরা। বাবাকে চাষ করতে হয়েছিল আর মা-কে ধানসেদ্ধ করতে হয়েছিল কিন্তু থাকাটা হয়েছিল চমৎকার। বড় বড় জানলা, দারজা, ইঁদারা – স্বপ্নেও দেখেছে মুকুট।

অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর ‘দেওঘর’ আবার যাবে সকলে মিলে। তবে তার আগে পরীক্ষার চিন্তায় কাবু হয়ে পড়ছে ‘মুকুট’।

স্যারের সঙ্গে আরেকটু হলে ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল মুকুটের। কোনক্রমে স্যার দেখতে পেয়ে সরে গেলেন। মুকুট স্যারকে প্রণাম করলে, স্যার খুব খুশী হলেন।

স্যার হঠাৎ বললেন, মুকুট- তুই রূপকথা পড়িস! 

মুকুট বলল, হ্যাঁ স্যার।

ফোটন কণা কাকে বলে জানিস!

মুকুট ভাবলো, সর্বনাশ। স্যারের নিক নেম- ‘আইনস্টাইন’। এক্ষুণি হয়তো পড়া বোঝাবেন। খুব শক্ত শক্ত পদার্থ বিজ্ঞানের থিওরি- যা তাদের সিলেবাসে নেই।

উড়াসিমা ত্যারোর রূপকথা পড়েছিস! 

মুকুট বলল- না, স্যার। আমি অবন ঠাকুরের ভোঁদড় বাহাদুর পড়েছি।

স্যার বললেন- ধুস্‌।

তারপর আবার শুধরে নিয়ে বললেন- অবন ঠাকুর ভালো কিন্তু সেই রূপকথায় কোন ফিজিক্স নেই।

মুকুট এবার বলল- স্যার, সন্ধে হয়ে গেছে- বাড়ি যাবো।

তখন তারা হাঁদুদার দোকানের সামনে এসেছে। 

স্যার দুটো বাপুজি কেক নিলেন। মুকুটকে একটা হাতে দিয়ে বললেন, খেয়ে নে। তোকে আজকে বইয়ের বাইরের ফিজিক্সের গল্প বলব।

বুবুন প্রায় আঁতকে উঠল। কিন্তু যতোই হোক স্যার তো!

‘বাপুজি’ কেক মুখে দিয়ে মুকুট খুবই বিরস বদলে স্যারের সঙ্গে বটতলার মোড়ে বসল। 

তখন সবে বাজার বসেছে। হাঁক-ডাক শুরু হয়েছে।

শীতের ফুলকপি, টমেটো, বাঁধাকপি আর পেঁয়াজ কলিতে বাজার ভরে উঠছে।

মুকুট এবার আত্ম-সমর্পন করল।

বলল- স্যার, ফিজিক্স-টা তেমন পড়া হয়নি।

স্যার বললেন- তোর মুখ দেখেই বুঝেছি।

তারপর বললেন- আইনস্টাইনের আগে সময়কে ‘Absolute’ ধরা হতো।

মুকুট বুঝতে পারলো উঁচু ক্লাসের দাদা-রা কেন স্যারকে আড়ালে ‘আইনস্টাইন’ ডাকে।

মুকুট বলল- স্যার, আমার মাত্র ক্লাস ‘এইট’।

স্যার বললেন- বই আছে সঙ্গে!

মুকুট নিভু নিভু কণ্ঠে বলল- হ্যাঁ।

স্যার মুকুটকে বইগুলি ইশারায় বের করতে বললেন। বুবুন ভৌত বিজ্ঞানের বইটা স্যারের হাতে দিলো।

কলম আছে!

মুকুট বলল- আছে স্যার।

স্যার বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি কলম দিয়ে কাটতে কাটতে বললেন- সব ভুল লেখা আছে।

বুবুনের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। বিজন স্যারকে এসব বললে বকা দেবেন।

স্যার এবার বললেন- চাঁদের কি অভিকর্ষ বল রয়েছে।

মুকুট আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো গোল চাঁদ উঠেছে।

সে বলল- স্যার জানি না।

স্যার বললেন- অনুমান করে বলো, বুদ্ধি খাটিয়ে বলো।

মুকুট বলল- নেই স্যার।

স্যার বেশ পুলকিত হলেন। বললেন- Not Zero. আছে, আছে, তবে পৃথিবীর চেয়ে কম।

মুকুট এবার বলল- স্যার, ছেড়ে দিন। বাড়ি যাবো। না-হলে বাড়িতে মার খাবো।

জাপানি রূপকথাটা তো শুনলি না!

আগামীকাল শুনবো স্যার।

স্যার বললেন- অবশ্য এর জন্য ফোটন কণাকে। জানতে হবে। টাইম মেসিনে করে কচ্ছপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ফোটন কণাকে খুঁজে বের করার কাহিনিটা দীর্ঘ।

মুকুট একবার মনে হয়েছিল বলবে যে সে ফোটন কণা বা আলোর তরঙ্গকে দেখেছে শরৎচন্দ্রের মার্বেল-মূর্তির গায়ে।

তবে এসব বললে স্যার হয়তো রাত কাবার করে দেবে।

স্যার নিজের মনে মনে কথা বলতে শুরু করেছেন – Or can we say, space is timeless or space less!

এই সুযোগ মুকুট গঙ্গার ধার দিয়ে দৌড়ুতে শুরু করল। একসময় সে দেখলো বাড়িতে চলে এসেছে।


ক্রমশ..


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024