Friday, June 3, 2022

ছোট গল্প - হীরা রহস্য || লেখক - আশিস চক্রবর্তী || Short story - Hira Rahasya || Written by Ashis Chakrabarti


 


হীরা রহস্য 

           আশিস চক্রবর্তী





গাড়িতে উঠতে উঠতে পঞ্চানন আমাকে জিজ্ঞাসা করল , " স্যার ! আমরা এই নতুন পোশাক পরে যাচ্ছি কোথায় ? আর এই গাড়িটা কার ? "
আমি বললাম , " এ ভাড়ার গাড়ি পঞ্চানন !নতুন পোশাক,  সাজগোজ, এসব কোনো তদন্তের কারণে আমাদের ছদ্মবেশ , একথা  ভেবো না। আজ তুমি আমি ছুটির মেজাজে যাচ্ছি একটা নিমন্ত্রণ এটেন্ড করতে ! "
" নিমন্ত্রণ ! কার বাড়ি স্যার ? "  
" আমার ছেলে বেলার বন্ধু বটুকেশ্বর এর বাড়ি । মস্ত বড়লোক বাড়ি ছেলে। কাজ কর্ম তেমন করে না। বাপ ঠাকুর দার অঢেল সম্পত্তি ওতেই ওর চলে যায়। আর বাকি সময় টা শখের থিয়েটার করে। দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদ। এখন কলকাতায় বাড়ি কিনে একাই থাকে। কাল রাত্রে আমাকে ফোন করে আসতে বলল। এও বলল একটা নাকি সারপ্রাইজ আছে ! ভাবলাম , আমার সকল কর্মের সঙ্গী তুমি , তাই ওখানে তোমাকে ছেড়ে একা যায় কি করে বলো পঞ্চানন !"
" তা স্যার ভালোই করেছেন । সারা দিন চোর খুনি বদমাইশ ঘেঁটে ঘেঁটে মাথায় কেমন চড়া পড়ে গেছে। আজকে একটু  রিলাক্সসেশন হবে। "

সময় টা  সন্ধ্যে। বটুকেশ্বর এর বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমাদের পূর্বে আরো চার জন এসে উপস্থিত। বটুকেশ্বর একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। চার জনই বটুকেশ্বর এর বর্তমান বন্ধু। একজনের নাম  নীলাদ্রি শেখর । ওঁ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার । লম্বা চওড়া সুপুরুষ। পার্ক স্ট্রিটে নাকি একটা চেম্বার আছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন পরেশ চন্দ্র বড়াল। বড় বাজারের সোনা ব্যবসায়ী।বেঁটে খাটো গোলগাল মানুষ। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন শম্ভু নাথ প্রধান । কাপড় কোম্পানি তে চাকরি করেন। লোকটার কপাল থেকে গাল অব্দি একটা কাটা দাগ থাকার জন্য ভদ্রলোকের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। এবং সর্বশেষ ব্যক্তিটি হলেন নিলোৎপল স্যানাল। এঁর পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক আর্থিক ভাবে দারুন অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কাজ কর্ম তেমন নেই। বটুকেশ্বর সকলের সামনে আমাদের প্রকৃত  পরিচয় টা গোপন রাখল। এর কারণ জানবার জন্য আমি ভুরু কুঁচকে ফেললে, বটুকেশ্বর আমার কানের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল , " ক্রমশ প্রকাশ্য !" 
বটুকেশ্বর এর বলা পরিচয় অনুযায়ী এখন আমার পেশা স্টিল ফ্যাক্টরির মালিক এবং পঞ্চানন আমার সেক্রেটারি। প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা শুরু হলো। হালকা মেজাজে খাওয়া দাওয়া কথাবার্তা চললো। খাওয়া শেষ হলে  বটুকেশ্বর বলল , " সাইলেন্স প্রত্যেকে !"
তারপর আমার দিকে চেয়ে ও পুনরায় বলল , "ঋষিকেশ ! তোকে আমি বলে ছিলাম আজকে আমাদের সকলের এই দেখা সাক্ষাৎ শুধু মাত্র  খাওয়া দাওয়ার কারণের জন্য নয় । এর মাঝে   একটা সারপ্রাইজ আছে । যেটা এই মুহূর্তে আমি তোকে জানাবো। সেটা হলো আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটা করে অতীব মূল্য বান বস্তু রয়েছে। সেগুলোর আজকে প্রদর্শনী হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে থাকা মূল্যবান বস্তু গুলি একে অপরকে দেখাবো। এই অভিনব প্রপোজাল টা অবশ্য আমিই ওদের কে দিই ।  আর সকলেই তাতে রাজি হয় । "
পঞ্চানন বেশ উৎসাহ পেয়ে বলল , " মূল্য বান বস্তু ! আবার প্রত্যেকের কাছে ? গ্রেট ! এতো সারপ্রাইজ নয় মশায় ! পুরো সারপ্রাইজ বৃষ্টি !  কই সেসব ? "
বটুকেশ্বর এবার দেরি না করে পাশের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে এলো। তারপর সেটা খুলতেই লাল মখমলের কাপড়ের ভেতর থেকে আলোর ঝলকানি চোখে এসে ধাক্কা দিল। এরপর লাল কাপড় টা সম্পুর্ন ভাবে সরাতেই আলোর বিচ্ছুরণের যেন বন্যা নামলো। উপস্থিত  সকলের চোখে মুখে বিস্ময় ! একটা নীল হীরক। সোনা ব্যবসায়ী  পরেশ বাবু যেন লাফিয়ে উঠলেন। তারপর সেটা হতে তুলে নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখে বললেন , " ম্যাগনিফিসেন্ট ! এ তুমি কোথায় পেলে বটুক ? "
" এ কি আজকের জিনিস ! কে কবে কোথা থেকে এটিকে আমদানি করে ছিল , কেউ জানে না ! আমরা বংশ পরম্পরায় একে ধারণ করে চলেছি। মার মুখে শুনেছিলাম এ খুব লাকি জিনিস ! আজকের বাজারে এর মূল্য কয়েক কোটি তো বটেই ! " 
হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নীলাদ্রি বাবু বললেন , " জিনিস টা দেখতে সুন্দর ! তবে এর দাম নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেললে বটুক ভাই ! হীরা টার যা সাইজ তাতে মেরে কেটে লাখ পাঁচেকের বেশি হবে না ! কি বলো পরেশ ? "
" এর সঠিক ধারণা আমার নেই ! কারণ এ জিনিস আমি আগে কখনও দেখিনি ! " জবাব দিলেন পরেশ বাবু। 
নিলোৎপল স্যানাল কে দেখলাম এক দৃষ্টে হীরাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তিনি কোনো কথা বললেন না । শম্ভু নাথ বাবু বললেন , " বটুক ! এমন মূল্যবান বস্তু তুমি বাড়িতে রেখে বুদ্ধিমান এর কাজ করোনি।  একা এ বাড়িতে থাকো। এদিকে কলকাতায় যা চুরি ডাকাতি বেড়েছে , তাতে এ জিনিস ব্যাংকের লকারে রাখায় ঠিক ! "
এবারে বটুকেশ্বর হীরা খানি পুনরায় আলমারীতে রেখে এসে বলল , " কই হে ডাক্তার তোমার বস্তুটি কই ? "
ডাক্তার নীলাদ্রি শেখর নিজের ফুলহাতা শার্টের অস্তীন গুটিয়ে হাত টা বললেন , " এই দেখো ! "
সকলেই ওর হাতের দিকে চেয়ে দেখলাম , একটা রূপালী বর্ণের হাত ঘড়ি যার সমস্ত যন্ত্রাংশ দৃশ্য মান আর সেগুলি স্বর্ণ বর্ণের। নীলাদ্রি শেখর এবারে বললেন , " আমার এক ধনী পেশেন্ট দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগে বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিল। আলোপ্যাথি , কবিরাজী , ঝাড়ফুঁক কিছুই সে বাকি রাখেনি। শেষ মেশ আমার কাছে টানা কিছু বছর চিকিৎসা করে সুফল পেয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে এই ঘড়িখানি আনিয়ে আমাকে উপহার দেয়। এর সঠিক মূল্য আমি জানি না। " 
পরেশ বাবু গলা ঝেড়ে বললেন , " এ সোনার ঘড়ি ? কাল একবার দোকানে এনো তো নীলাদ্রি ! দেখবো! রাতে ঠিক ধরা যায় না ! "
" ওকে ! তবে এ শুধু সোনার ঘড়ি নয় ! বডি টা প্লাটিনামের ! এবং যন্ত্রাংশ গুলি  পিওর গোল্ড !  সন্দেহ থাকলে দেখবেন কষ্টি পাথরে ঘষে ! তবে এ ঘড়ি কলকাতার বাজারে কেউ খুলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে ! " বললেন নীলাদ্রি শেখর ।
 শম্ভু বাবু বললেন , " সোনার ঘড়ি এখন আকছাড় এর ওর হাতে দেখা যায় ! এ বহু মূল্যবান কোনো বস্তু নয় । খুব মামুলী একটা ব্যাপার ! তবে প্লাটিনামের সাথে আমি তেমন ভাবে পরিচিত নয় ! "
নীলাদ্রি বাবুর এ কথাটি পছন্দ না হওয়ায় ওঁ বললেন , " এই ঘড়ি আকছার দেখা যায় ? বেশ ! তো তোমার কাছে কি জিনিস আছে দেখি ? " 
শম্ভু বাবু ওনার কোর্টের পকেট থেকে একটা কাপড়ে জড়ানো বস্তু বার করল তারপর সেই কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে একটা চামড়ার পুঁথি মেলে ধরে বললেন , " এই পুঁথি টি আমার ঠাকুরদার বাবা তিব্বত থেকে আনিয়ে ছিলেন। কোনো এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর লেখা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের খণ্ডিত পুঁথি ! এ বস্তুটি যেমন দুষ্প্রাপ্য তেমন মূল্যবান ! " 
পঞ্চানন পুঁথিটি হাতে তুলে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো। ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। জেনুইন জিনিস। এই বস্তুর মূল্য টাকার মাধ্যমে ঠিক করা যায় না। একে একে সকলেই পুঁথি টি ছুঁয়ে দেখে আশ্চর্য হলো।
পরেশ চন্দ্র বড়াল পকেট থেকে বার করলেন একটা রুপোর খঞ্জর। আকারে বেশ ছোট । তবে আকর্ষণীয় এবং ওর গায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিহ্ন আঁকা রয়েছে । বস্তু টি সর্ব সম্মুখে দেখিয়ে বললেন , " একবার এক বে আইনি কাজ করে ফেলেছিলাম। এ কথা আজ অব্দি কাউকে বলিনি। এই খঞ্জর টির প্রকৃত মালিক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ! গোপনে এক নিলামী তে হাজির হয়ে এটা আমি কিনে ফেলি। পরে অবশ্য জানতে পারি যে জিনিসটি মিউজিয়াম থেকে চুরি করে বিক্রি করা হয়েছিল। " 
আশ্চর্য সুন্দর  খঞ্জর টি। আবার কুৎসিত ও বটে। কারণ কত মানুষ এই অস্ত্রে খুন হয়েছিল তার ঠিকনেই । ওটা দেখে এক প্রকার ঘৃণার সঞ্চার হলো আমার শরীরে।   এরপর এলো নিলোৎপল স্যানাল এর পালা। ভদ্রলোক প্রথমেই আমতা আমতা করে বললেন , " হাজার চেষ্টা করে আমি মূল্যবান কিছু জোগাড় করতে পারিনি। কারণ আমার কাছে বহু মূল্যবান কিছু নেই । এখানে আসার মুহূর্তে মনে পড়ল আমার ঠাকুরদার কথা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পুলিশের গুলিতে মারা যান। মৃত্যুর সময় ওনার জামার বুক পকেটে ছিল এই কলম টা ! "

বলে , নিলোৎপল কলমটা বার করে দেখালেন। কলমটার প্রতি দেখলাম কারো যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কেও বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে কলমটার প্রতি দেখল না। আমি কলমটা  হাতে ধরে নিয়ে দেখলাম ওটা একটা কাঠের কলম যাতে নক্সা কাটা রয়েছে। কলমের একদিকে ঘষে খানিকটা ভেঙে গিয়েছে। এটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে ব্রিটিশ সৈনিকের নিক্ষিপ্ত বুলেট নিলোৎপল এর দাদুর দেহে ঢোকার সময় কলম টিতে প্রথমে আঘাত করেছিল। আমি ভক্তি ভরে কলম টাকে মাথায় ছুঁইয়ে ফেরত দিয়ে বললাম , " এর মূল্য বোঝবার মতো ক্ষমতা আমাদের কারো নেই । একে সঙ্গ ছাড়া হতে দেবেন  না। " 

এরপর নীলাদ্রি শেখর সোফা থেকে উঠে বাথরুম এর দিকে গেলেন ।  বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে লম্বা বারান্দা ধরে হেঁটে বাথরুম যাবার পথ।মিনিট দশ পর বাথরুমে যাবার পথে নীলাদ্রি শেখর এর আর্তনাদ শুনে আমরা অবাক হয়ে ছুটে গিয়ে  দেখলাম নীলাদ্রি শেখরের কপাল ফেঁটে রক্ত ঝরছে আর ওঁ কপালে হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছটকাচ্ছে আর বলছেন , "  আমার ঘড়ি ! আমার ঘড়ি নেই ! ছিনতাই হয়ে গেছে ! " 
নীলাদ্রি শেখর এর হাতে ঘড়ি নেই। আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন তুমি বাড়ির পিছন দিকটা যাও ! আমি সামনে যাচ্ছি ! আর  আপনারা কেউ একজন নীলাদ্রি বাবুর কাছে থেকে বাকি জন সমস্ত ঘর খুঁজে দেখুন অপরাধী ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে। ছিনতাই কারী বেশি দূর যেতে পারিনি। " 
আমরা ছুটে যেতে যেতে শুনলাম শম্ভু নাথ প্রধান বলছেন , " ফাস্টটেড বক্স নিয়ে এসো বটুক তাড়াতাড়ি ! মাথায় ব্যান্ডেজ না করলে রক্ত থামবে না !" 
প্রায় আধ ঘন্টা সকলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও অপরাধী কে পাওয়া গেল না। ফিরে এসে দেখলাম ঘরে খাটের ওপর নীলাদ্রি বাবু শুয়ে রয়েছেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। বটুকেশ্বর ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশ করছে। 
" আমার জন্যই এটা হলো! আমি কেন যে সবাই কে মূল্যবান বস্তু গুলি আনতে বললাম ! ছি ! ছি ! নীলাদ্রির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। "
নীলাদ্রি শেখর হা হতাশ করছে। আর বলছেন , "আমি এখুনি গিয়ে থানায় কমপ্লেন লেখাবো ! আমার সাধের মূল্যবান ঘড়ি ! ওহ ! বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল আমার ! "
  সকলের মুখ থমথমে। আমি কোনো উপায়ন্তর না দেখে  নিজের খোলস ছেড়ে বললাম , " আপনার শরীর অসুস্থ্য ! এখন একটু রেস্ট নিন। আর আপনার ঘড়ি খোঁজার দায়িত্ব আপনি আমাকে দিন। আসলে বটুক আমার আসল পরিচয়  গোপন করেছে। আমার নাম ঋষিকেশ রক্ষিত !  লাল বাজার হেড কোয়ার্টার এর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর আমি একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার। আর ও হলো ইন্সপেক্টর পঞ্চানন চক্রবর্তী ! আমার সহযোগী । "
এ কথা শোনার পর এক মুহূর্তেই সকলের মুখে আলো খেলে গেল। পরেশ বাবু বললেন , " তাহলে তো কোনো সমস্যায় নেই ! কিন্তু এতো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা ! আপনার মতো একটি সরকারি গোয়েন্দা বাড়িতে থাকতে এই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেল ? "
আমি বললাম , " এর জন্য আমি ভীষণ দুঃখিত ! কিন্তু এর সুরাহা না করে আমি যাচ্ছি না ! নীলাদ্রি বাবু আপনি বলুন তো আপনার সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিল ? "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " আমি বাথরুম থেকে ফেরার পথে মাথায় তীব্র আঘাত অনুভব করি। সঙ্গে সঙ্গে চোখটা অন্ধকার হয়ে যায় আর আমি মাটিতে পড়ে যায় !কিছু ক্ষনের জন্য আমার সেন্স চলে যায়। এরপর লক্ষ্য করি আমার হাতে ঘড়ি নেই। "
আমি কথা টা শোনার পর বটুকেশ্বর কে বললাম , " তুই একবার তোর হীরা টা দেখে আয় তো ঠিক আছে কিনা ? "
বটুক আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র চিন্তিত মুখে ছুটে গেল পাশের ঘরে আলমারীর দিকে । তারপর উপস্থিত সকলের কানে এলো বটুকের কন্ঠ স্বর , " সর্বনাশ ! " 
সে ঘরে পঞ্চানন আর আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম আলমারীর দরজা খোলা হীরার ফাঁকা  বাক্স টি পরে রয়েছে । পঞ্চানন বলল , "  অর্থাৎ চোর প্রথমে হীরা চুরি করে নীলাদ্রি বাবুকে ঘায়েল করে পালিয়েছে প্লাটিনামের ঘড়ি নিয়ে পালিয়েছে ! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কাজ টা করল কিভাবে ?  স্যার আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন ? " 
আমি কোনো জবাব না দিয়ে বললাম , " সকলে একবার এক ঘরে এসে বসুন তো ! আর বটুক তোর বাড়ির কাজের লোক দের একবার ডেকে পাঠা ! "

কথামত সকলে হাজির হল ঘরে।  নীলাদ্রি বাবু যন্ত্রনায় কাতর হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। প্রথমেই বাড়ির কাজের লোক দের জিজ্ঞাসা বাদ শুরু করলাম। বাড়িতে মাত্র দুটি কাজের লোক । একজন আজকের জন্য নিযুক্ত রান্নার ঠাকুর আর অন্য জন ঘোর দোর পরিষ্কার রাখবার জন্য বারো মাসের কাজের লোক। পঞ্চানন বলল , " স্যার আমার মনে হচ্ছে মূল্যবান বস্তু গুলোর প্রদর্শন চলা কালীন এদের মধ্যে কেউ লুকিয়ে সমস্ত কথা শুনেছিল। তারপর সুযোগ বুঝে সরিয়েছে। এক্ষুনি কয়েক ঘা চাপিয়ে ,  সার্চ করলে বেরিয়ে পড়বে ! " 
দুজনেই ভয়ে গুটিয়ে রয়েছে আর বার বার বলছে , " আমরা কিছু জানি না স্যার ! এঘরে আসিনি একবার ও ! "
আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন দুটোকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুব ভালো মতো জিজ্ঞাসা করো আর সার্চ করে দেখো কিছু পাও কিনা ! কিছু না বললে থানায় নিয়ে যাবে ! "
পঞ্চানন ওকে স্যার  বলে কাজে লেগে পড়ল ! আমি বটুকেশ্বর কে বললাম , " ভাই ! বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তবুও বলছি ,  আমার যা মনে হচ্ছে  কাজ বাইরের কারোর পক্ষে সম্ভব না ! এখানে যারা উপস্থিত আছে তাদের মধ্যে কেউ একজন করেছে ! "
একথা শোনার পর আমন্ত্রিত সকলের মুখটা কেমন বিরক্তি আর অপমানে লাল হলে গেল। আমি ফের বললাম , " প্রয়োজনে বটুক তুই আমাকে আর পঞ্চানন কেউ জিজ্ঞাসাবাদ বা সার্চ করতে পারিস তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই ! যেহেতু ঘটনা স্থলে আমরা ছিলাম তাই আমরাও সন্দেহর তালিকায় থাকাটা স্বাভাবিক ! " 
আমার কথা শুনে বটুক বলল , " কি যা তা বলছিস হৃষিকেশ ! তোরা এসবে জড়াবি কেন ? যা হয়েছে যাক ! সবই আমার কপালে ছিল ! কিন্তু এর জন্য আমি আমার বন্ধুদের এ ভাবে বাড়িতে ডেকে অপমানিত করতে পারবো না  ! শুধু তো আমার জিনিস নয় ! নীলাদ্রির ঘড়িটা আমার কারণে গেল বলে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে !" 
পরেশ চন্দ্র বড়াল বললেন , " মান সম্মানের আর বাকি থাকলো কি বটুক ? তোমার পুলিশ বন্ধু আমাদের চোর ভাবছেন ! নাও জেরা শুরু করো আর আমাদের সার্চ করে দেখো। "
বটুক লজ্জায় মুখ লুকালো। নিলোৎপল কিছু বললেন না। শম্ভুনাথ প্রধান চিৎকার করে বললেন , " ছি ছি ছি ! শেষে বন্ধুর আমন্ত্রনে এসে চোর সাজতে হলো ! "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " যা করবার তাড়াতাড়ি করুন আমার শরীর খারাপ করছে ! মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ! " 
ইতিমধ্যে পঞ্চানন পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বলল , " স্যার ! ওরা মুখ খুলছে না ! সব জায়গা সার্চ করেও কিছু পাইনি। জিনিস গুলো নিশ্চয় আলাদা কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখেছে ! থানায় নিয়ে গিয়ে চাপ দিলেই সব বের করে দেবে। "
আমি বললাম , " নাও পঞ্চানন এক এক করে আমাদের সার্চ করো। প্রথমে আমাকে দিয়ে শুরু করো। " 
পঞ্চানন আমার কথা শুনে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ,আমি পুনরায় বললাম , " দাঁড়িয়ে থেকো না ! কাজ শুরু করে দাও। তোমাকে আমি সার্চ করবো ! "
ওকে স্যার বলে পঞ্চানন একে একে সকলকে সার্চ করা শুরু করল । ওকেও সার্চ করলাম আমি। কারো কাছে কিছু মিললো না। এবার পঞ্চানন আমার দিকে তাকিয়ে বলল , "মিথ্যে  স্যার সময় নষ্ট করছেন। বরং ওদের দুটোকে থানায় নিয়ে গিয়ে টর্চার করলে মাল বেরিয়ে যেত। "
আমি বললাম , " পঞ্চানন ! সার্চ করা তোমার ঠিক মতো হয়নি ! "
পঞ্চানন বলল , " মানে স্যার !  "
"মানে টা শম্ভুনাথ বাবু বলবেন !"  বললাম আমি।
শম্ভুনাথ বাবু বললেন , " আপনি কি বলতে চাইছেন ? আমি চুরি করেছি ? আমাকে সার্চ করলেন ! কিছুই পেলেন না!মান হানি করেও আপনার শান্তি নেই ! এবার কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আমি কোর্টে যাবো ! "
" উঁহু ! চটে যাচ্ছেন কেন ? আপনি চুরি করেছেন একথা আমি তো আপনাকে বলিনি ! তবে চোরের সঙ্গ দিয়েছেন  ! "
" এসব কথার অর্থ কি ? আপনি কিন্তু যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছেন ! "
" বাড়াবাড়ির আর দেখলেন কত টুকু ! এবার দেখাচ্ছি বাড়াবাড়ি কাকে বলে ! পঞ্চানন ডাক্তার বাবুর মাথার ব্যান্ডেজ টা খোলো তো ! "
পঞ্চানন বলল , " কেন স্যার ! "
" আহা ! বড্ড প্রশ্ন করো তুমি ! যা বলছি তাই করো ! "
ডাক্তার নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন , " এসব কি হচ্ছে এখানে ? "
" আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি অসুস্থ্য ! বসে পড়ুন ! "
এরপর পঞ্চানন নীলাদ্রি বাবুর ব্যান্ডেজ খুলতেই সেখান থেকে রক্তমাখা  হীরাক খন্ড মেঝেতে পড়ল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে সকলে চমকে উঠল নীলাদ্রি ও শম্ভুনাথ প্রধান বাদে। পঞ্চানন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে আমি বললাম , " তোমার সব প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি পঞ্চানন! মূল্যবান বস্তুর প্রদর্শন এর আমন্ত্রণ পেয়ে  নীলাদ্রি শেখর ও শম্ভুনাথ বাবুর মাথায় এই প্ল্যানটা আসে। নীলাদ্রি পরিকল্পনা মাফিক টয়লেট যাবার পথেই পাশের ঘর থেকে হীরা টা চুরি করে নেয়। তারপর ওঁর নকল সোনার ঘড়িটা টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে নিজের মাথায় নিজে আঘাত করে বাথরুমের বাইরে আসে।তারপর নাটক শুরু করে । তখন হীরা ওর কাছেই ছিল। এরপর মাথায় আঘাত লাগা এবং ঘড়ি চুরির খবর পেয়ে  আমরা সকলে যে যেদিকে পেরে ছিলাম ছুটে গিয়েছিলাম চোরের খোঁজে। খুব সম্ভবত বটুকও সেই সময় ফাস্টেড বক্স এনে দিয়ে চোর খুঁজতে ছুটে ছিল। আর সেই সময় আহত নীলাদ্রি শেখর এর সঙ্গে ছিলেন একমাত্র শম্ভুনাথ প্রধান । তিনিই নীলাদ্রি শেখর এর চুরি করা হীরাক খন্ড টি ওঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিতে সাহায্য করেন । আঘাতের ব্যান্ডেজ এর সঙ্গে হীরা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন নির্বিঘ্নে। প্ল্যান টা ভালোই ছিল দুজনের । কারো সন্দেহ হবার কথা নয়। তবে ঋষিকেশ রক্ষিত এসে পড়ায় প্ল্যান টা সাকসেস হলো না। আমার সন্দেহ টা জাগলো দুটো কারণে । এক মাথার সামনে আঘাত লাগা , এবং নীলাদ্রি বাবুর চোর বা আঘাত কারী কে না দেখতে পাওয়া এই দুটি বিষয়ে। কারণ সত্যি সত্যি চোর সামনে থেকে আঘাত করলে নীলাদ্রি বাবু দেখতে পাবেন। আর পেছন থেকে আঘাত করলে মাথার সামনে আঘাত করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে নিজে নিজে আঘাত করলে একজন ডাক্তার হিসেবে নীলাদ্রি বাবু মাথার সামনেই আঘাত করবেন । কারণ পিছন দিকে আঘাত করার সাহস তিনি পাবেন না , ওখানে ব্রেন এর গুরুত্ব পূর্ণ অংশ থাকে। আঘাতটা খুব সামান্যই চেয়ে ছিলেন নীলাদ্রি বাবু। কারণ হীরা লুকোনোর জন্য ব্যান্ডেজ করাটা জরুরী ছিল। আমি দুঃখিত নীলাদ্রি এবং শম্ভুনাথ প্রধান বাবু আমার জন্য আপনাদের এতো সুন্দর প্ল্যানটা সাকসেস হলো না। পঞ্চানন এদের দুজন কে থানায় নিয়ে চলো। "
বটুক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল , " দারুন উপকার করলি ভাই ! এটা আমার খুব লাকি ! "
আমি ওকে একটা প্রশ্ন না করে পারলামনা , " আচ্ছা প্রথম দিকে তুই আমার আর পঞ্চানন এর পরিচয় সবার কাছে গোপন রেখেছিলি কেন ? "
বটুক মাথা নামিয়ে বলল , " আমাদের মধ্যে নিলোৎপল এর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় ! তাই এরম একটা অবস্থা হবার আশঙ্কা করে ছিলাম। তাই হাতে নাতে চোর ধরবার জন্য তোর পরিচয় গোপন করে ছিলাম। "
বটুকেশ্বর এর এই কারণ টা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওর এই কাজের জন্য আসল চোর ধরাপড়ার কারণে ওকে আর কিছু বললাম না। 





Thursday, June 2, 2022

ছোট গল্প - অরূপ রূপকথা || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Arup Rupkotha || Written by Rokeya Islam


 

অরূপ রূপকথা

     রোকেয়া ইসলাম





আজান শেষ হতেই দরজা খুলে উঠোনে নামে মেঘবতী। কলপাড়ে গিয়ে বুঝতে পারে চায়না ঘুম থেকে ওঠেছে বেশ আগেই, ওর ফরজ গোসল সারা হয়ে গেছে। ভেজা কাপড় বালতিতে করে এককোণায় রেখে দিয়েছে যাতে কারো নজরে না আসে যে ও স্বামী সহবাস করেছে মেয়েটার লাজলজ্জা, আক্কেল বেশ টনটনে। ওজু সেরে ঘরের পৌটায় পা রাখতেই কল চাপ দেবার দেবার শব্দে পেছন ফিরে দেখে চায়না কল চেপে বালতি ভরছে।

মতিমিয়া ঘর থেকে দ্রুত উঠোনে নেমে কলপাড়ে গিয়ে অজু করে মসজিদের পথ ধরে। মেঘাবতী স্বস্তির মনে জায়নামাজ পেতে নামাজে দাঁড়ায়।

চায়না বাঁসি কাজ সেরে গোয়াল থেকে গরু বের করবে খোপ খুলে মুরগী বের করে কুঁড়া মাখিয়ে মুরগীগুলোকে খেতে দেবে, তই তই করে হাঁসগুলো আলাদা করে তাদের খেতে দেবে। গরুর চাড়িতে পানি দেবে, খড় কেটে গরুকে খেতে দিয়েই, বাড়ির মানুষের জন্য সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করবে একা হাতে।

মসজিদে নামাজ শেষে দোয়া কালাম পড়ে বাজারে গিয়ে বসে চা পান করে মতিমিয়া। আগে এই চায়ের অভ্যাস ছিল না। শুধু চা কেন অনেককিছুরই অভ্যাস ছিল না। এই যে এখন চা পানের পর হেঁটে হেঁটে বাজারের এমাথা ওমাথা ঘুরে মাছ তরকারি কিনবে। প্রতিদিন দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস এটাও ছিল না ওদের পরিবারে।

গাছের পাকা দিয়ে গাইয়ের দুধ দিয়ে রাতে ভাত খায়, ঘরে কলা শেষ হলেই বাজার থেকে কিনে আনবে গাছপাকা কলা।

ভাল কলা না পেলে গুড় কিনবে।

গুড় আবার এই বাজারে পাওয়া যায় না। এই বাজারটা হলো প্রতিদিন বেলা ওঠার আগে থেকে বসে আবার সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়তেই শেষ হয়ে যায়।

আশেপাশের নদীপাড়ের মানুষেরা সারারাত মাছ ধরে বেশিরভাগই আড়তে চলে যায় খুচরোগুলো এই বাজারে তোলে। জাংলার লাউ ঝিঙে কুমড়া সিম জাতীয় তরতাজা সবজি।

ভুঞাপুরে কোন কাজে গেলে সুবাসিত সাবান ডিটারজেন্ট পাউডার নারকেল তেল পোয়াটাক আঙুল আপেল পাউরুটিও কিনে আনে। আগে এগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতো, আর এখন দরদাম করে ধোয়াকাঁচা পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা বের করে সওদা নিয়ে হৃষ্টমনে মাথা উঁচু করে বের হয়।

আজ গ্রামের বাজার থেকে কিনেছে নধর দেখে একমুঠো ডাটা এক কেজি বেগুন আর এক ভাগা চেলা মাছ।

হাঁটতে হাঁটতে নধর ডাটাগুলোর দিকে তাকায়, তাজা মাছ দিয়ে রান্না করা তরকারি স্বাদ কেমন হবে, ভাবতেই পথ শেষ হয়ে যায়।

বাড়িতে ঢুকে শ্যাফালী বলে ডাক দেয়। ছোটমেয়ে এসে সদাই-পাতি বাবার হাত থেকে নিজের হাতে নেয়।

মতিমিয়া কলপাড়ে গিয়ে দেখতে পায় পানি ভরা বালতিতে লাল প্লাস্টিকের মগ ভাসছে। কাছেই প্লাস্টিকের নীলরঙা টুল।

ভেতর থেকে তৃপ্তির নিঃশ্বাস বের হতেই কপালে একটা ভাঁজ ভেসে ওঠে।

ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে খারমানের পাতা আর কালিজিরার ভর্তা দিয়ে এক থালা বৌখুঁদা এগিয়ে দেয় চায়না, মেঘাবতী একগ্লাস পানি নিয়ে সামনে বসে। সাথে সাথেই দুই ছেলে এসে বসে তাদের সামনেও ভরা থালা এগিয়ে দেয় চায়না,

শ্যাফালী ও শ্যাফালী তুইও খাইয়া ল, আবার তো স্কুলে যাওন লাগব।

ননদ আর শাশুড়ীর খাবারের থালাও দিয়েই, উঠোনে ধান শুকোতে দেয় চায়না।

ওদের খাওয়া শেষ হতেই এঁটো বাসন গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে কলপাড়ে নিয়ে ধুয়ে উঠানের কোনায় ছোট্ট মাচায় উপুর করে দেয়, রোদে শুকোবে এগুলো। 

স্বামী আর দেবর বের হয়ে যায়, শেফালীও স্কুলে যায়।

মাছগুলো কুঁটে ধুয়ে ছিঁকায় তুলে রাখে।

ও বউ তুমি খাইলা না, খাইয়া লও। বাইড়া থুইছি তো তুমার খাওন। লও খাইয়া লও।

হাতের কামডি সাইরা লই

এতোক্ষণে চায়নার গলার আওয়াজ শোনা গেল । মুখ বন্ধ করে সংসারের সব কাজ করে যায় অবশ্য কেই বা ওর সাথে কথা বলে । ওর স্বামীও দিনে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ। বলবে কেন প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কি শুধু প্রয়োজনীয় কথাই থাকে , কত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে হাসি কথা তো থাকতে পারে।

কথা হাসি তো দূরে থাক ওকে সাথে নিয়ে কখনও বাবার বাড়িতে পর্যন্ত যায় না।

এই যে এখন বাড়ীতে শুধু বউ শাশুড়ী, তাও তো তেমন কথা হবে না দুজনের। একটু পরে উঠোনের কোনে খোলা চুলার পাড়ে গিয়ে কি দিয়ে কি রান্না হবে সেটুকু বলবে, সাথে আরো কোন কাজের কথা থাকলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলবে।

মতিমিয়া ভুঞাপুর থেকে ফিরলো, উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়

শ্যাফালি ও শ্যাফালি কোনে গেলি

চায়না ঘোমটা তুলে দৌড়ে গিয়ে শুশুরের পাশে দাঁড়ায়

শ্যাফালি স্কুল থন আহে নাই অহনতরি, দেইন আমার থন দেইন।

চায়নার শব্দ শুনে মুখটা বিরক্তিতে অন্যদিকে ঘুরাতে গিয়ে চোখ আঁটকে যায় বড় ঘরের টিনের চালে কালো রঙের দুটো কবুতর খুনসুটি করছে, ধারেকাছে ডাকছে কুটুম পক্ষী, । আস্তে করে ব্যাগটা চায়নার হাতে তুলে দিয়ে দ্বিধান্বিত মনে কলতলায় যায়।

বারান্দায় পাটি পেতে খাবারের আয়োজন করেছে চায়না । শাশুড়ী পিঁড়ি পেতে বসে সবাইকে খেতে দেয়।

চায়নার হাতের রান্না খুব স্বাদের। ওর মায়ের কাছ থেকে এই গুণ ও পেয়েছে , খাবারের স্বাদ বুঝিয়ে দেয় ধনী খানেয়ালা ঘরের মেয়ে চায়না।

এতো পদ দিয়ে আগে কখনও ভাত খেতো না ওরা। তিনবেলা গরম খাওয়াই তো জুটতো না। মাসুমের বিয়ের পর মেঘাবতীর সংসারের চাকা ঘুরে গেছে। যদিও সবাই পরিশ্রম করছে, আগেও তো পরিশ্রম করতো তখন তো অন্ধকারই থাকতো সংসারের চৌহদ্দি জুড়ে।

চার ছেলে দুইমেয়ে আর স্বামী স্ত্রী দুজন এই আটজনের সংসারে জমি ছাড়া আর কোন আয়ের পথ ছিল না, বড় ছেলে আই এ পাশ করে চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে ধাক্কা খায়, বিরাট অংকের ঘুষ ছাড়া তো চাকরির পথ আঁধারে ঢাকা। ওদের কোন বড় চাকুরীওয়ালা আত্মীয় স্বজনও নেই।

টাকা কোথায় পাবে মতিমিয়া। বড়মেয়েটাও বিয়ের লায়েক হয়ে যায় মেঝ ছেলেও মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। দিকদিশা হারিয়ে মতিমিয়া কিছু ধানীজমি বিক্রি করে দিয়ে বড়মেয়ের বিয়ে দেয়,

গ্রামের একজন শহরে ছোট চাকরি করে কিন্তু তার ক্ষমতাবান বড়সড় বসের সাথে দহরমমহরম আছে, সেই বেশ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পিয়নের চাকরিতে বহাল করে বড়জনকে।

মেঝছেলেও বড়টার পথ ধরে। মুটামুটি ধানীজমি শেষের পথে নিয়েই তাদের চাকুরী যাত্রা।

শেষ সম্বল যেটুকু ছিল তাও নদী নিয়ে নেয়।

শহরে চাকরিওয়ালা দুছেলে মতিমিয়ার সংসারে কোন টাকাপয়সা দিতে পারে না, তাদের সংসার নিয়েই দুর্মূল্যের বাজারে হিমসিম অবস্থা।

মাসুমও লেখাপড়ায় তেমন ভাল নয়, আর ভাল হলেই কি চাকরি তো টাকা ছাড়া হবে না। নতুন করে টাকার সংস্থান করা অসম্ভব।

অভাবে ভিটামাটি আঁকড়ে ধরে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে কর্মের অনিশ্চয়তায় দিনগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে জীবন নামক অচেনা কঠিন পথে।

ইব্রাহিম ঘটক তালতলা গ্রাম থেকে মাসুমের বিয়ের প্রস্তাব আনে।

চায়নার বাবা কুইট্ঠাল ধনী। দুই ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। মেয়েদেরও ভাল ভাল বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে বড় বড় ডোঁয়া পাকা টিনের ঘর, গোয়াল ভরা গরু, বাইরে পেল্লাই খড়ের পালা।

এ বাড়ির মেয়েদের ভদ্র নম্র হিসাবে নাম আছে।

এখানে বিয়ে করালে বেশকিছু নগদ টাকা যৌতুক পাওয়া যাবে, তা দিয়ে মাসুম ব্যাবসা শুরু করতে পারবে, বাবার বাড়ির সম্পত্তির ভাগও কম পাবেনা ছোটমেয়ে।

সব শুনে প্রস্তাবটা লুফে নেয়।

ইব্রাহিম ঘটকের সাথে কন্যা দেখতে তালতলা গ্রামে যায় মতিমিয়া।

দুইবার কয়েক পদের পিঠা সেমাই ক্ষীর ঢাকাইয়া বিস্কুট কাপে করে চা, তারপর রোষ্ট ঝাল গোশত দিয়ে কড়ির প্লেটে সুবাসিত ধোয়া ওঠা পোলাওয়ের পর মেয়ে দেখে সব খাবার গলা দিয়ে ওঠার উপক্রম হয়।

কোনমতে ছাতা বগলে ফেলে রওনা হয় বাড়ির পথে।

সাতদিন পর ইব্রাহিম ঘটক বোঝায়" রুপ ধুইয়া কি পানি খাইবা মিয়া, রুপ দেখবা একদিন আর নগদ যা পাইবা হেডা নাড়াচাড়া কইরা চলতে পারবা হারাজীবন। ভাইরাও চাকরি করে ভাইগনা ভাগনি অইলে হ্যারাই চাকরির ব্যাবস্থা করব, মোটের উপর তুমি মিয়া নিচন্তা অইলা।

বড় দুইডা বিয়া করাইছো কি পাইছো বউ ছাড়া।

নগদ আরো একলাখ, দুই ভরির গহনা বাড়াইয়া মুখের মধ্যে "কইষট্রা বরুই "পুরে বিয়ে করায়।

বউ দেখে গ্রামের মানুষ আড়ালে বলে, বউ না মতিমিয়া ট্যাহার বস্তা বিয়া করাইছে।

মুখফোঁড়া কেউ কেউ সামনেই বলে ফেলে

কি গো মতিমিয়া পোলা কি ট্যাহার লগে হুইব না বউর লগে হুইব। মুহের দিকে চাইলে তো জিনিস খাঁড়াইব না।

মতিমিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে আসে, উত্তর দিতে পারে না। সংসারের অর্থনৈতিক দুর্গতি, দুই ছেলে তাদের সংসার নিয়ে হিমসিম, এটা তাদের কাছে বাপের সংসার, এটা চালাবার দায় তাদের নয়। ঘাড়ের উপর বেকার দুই ছেলে ছোটমেয়েও হাত পা ঝাড়া দিয়ে ওঠছে। জমি বিক্রি করে শেষ, বাকিটুকু যমুনার অতলে।

মাসুমকে বিয়ে করিয়ে নগদে কিছু পাওয়া গেল।

শরীককের বড়ভাবী তো মুখের উপর বলেই ফেললো

মতিভাই পুলাডারে জব দিলা নিজের আতে। ঘরে যুদি সুখ না পায় ট্যাহা দিয়া কি অইব।

ভাবী ট্যাহাই অইলো আসল সুখ, ট্যাহা গুননের সুখের লগে জগতের আর কুনু সুখ মিলে না।

বলে আর দাঁড়ায় না, হনহন করে সড়কে ওঠে নদীর দিকে হেঁটে যায়।

মতিমিয়া কি আউস কইরা পুলার ঘরে পেত্নী হান্দাইয়া দিছে। বড় দুই পুলার বৌ ধলার কাছাকাছি গায়ের রঙ নাক মুখ চোখের ডিল গঠন ভাল। হেডায় অইছে কি? চেহারা ছবি ভালা অইলে

হেই বালা দিয়া কি করুম, গরম ভাতের লগে সেদ্ধু দিয়া নুন মরিচ দিয়া ডইলা ভর্তা কইরা খামু "

বিয়ের পরদিন সকালে মাসুমকে নদী থেকে গোসল করে আসতে দেখে মনের ভেতরে গেঁথে রাখা পাথরটা নেমে গেছে।

বিয়ের আগেরদিন মেঘাবতী ফিসফিস করে বলছিল মাসুম বড়মেয়ের কাছে বলেছে" বাবা আমারে কুরবানির ষাড় পাইছে আর কেরু নগে পারলো না আমারে হাটে তুললো, আমার মনডা বাপে বুঝলো না।

তারপর থেকেই মনটার ভেতর পাথর ছিল।

যাক শরীরের সাথে শরীর তো মিলছে এই মিলেই সব মিলিয়ে দেবে।

বিয়ের পরদিন থেকেই বুঝতে পারে বৌটা অন্য দুই বৌয়ের মত না এ একেবারেই আলাদা ।

বিয়ের কাজকর্ম মিটে গেলে তিন বাপবেটায় মিলে বুদ্ধি করে সড়কের কোণায় ঔষধের দোকান দেয়। গ্রামের একজন স্কয়ার ফার্মাসিস্টের ম্যাডিকেল রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ হিসাবে আছে, সে মাসুমকে একটা ঔষধ বিষয়ক বই দেয়, কোন ঔষধের কি কাজ।

কয়েক মাসের মধ্যে কিছুটা সচল হয় সংসারের চাকা।

চায়নাও বাড়ির আশেপাশে সবজির গাছ লাগায়, মতিমিয়া জাংলা তুলে দেয়, হাঁস মুরগী পালতে শুরু করে। চায়না ওর বাবার কাছ থেকে দুধ খাবে বলে দুধেল গাই নিয়ে আসে।

মোটামুটি বছরখানেকের মধ্যে সংসারের অভাবের চাকা ঘুরে সচ্ছলের পথ ধরে, মতিমিয়া ধোয়া লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে আসরের নামাজ শেষ করে সড়কের চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খায়, টিভিতে খবর শোনে নায়ক মান্নার ছবি দেখতে দেখতে মাসুমের দোকানে চোখ রাখে, মাসুমের দোকানটা বড় করা খুব দরকার, সেটাও হয়ে যায়।

মাসুম ছয়মাস ট্রেনিং নিয়ে এসে এলাকায় মাসুম ডাক্তার নামে পরিচিত।

মাসুম ডাক্তারের বাবা মতিমিয়া ধানী জমির পরিমান বাড়াচ্ছে, বাড়িতে মাসুমের ঘরটার মেঝে পাকা করা হয়েছে ফ্রিজ কেনা হয়েছে।

মোটামুটি টাকার বাদ্যটা বাজছে। মসজিদ কমিটিতে স্থান পেয়েছে, মুরুব্বি হিসাবে বিচার শালিসে ডাক পায়।

ঢাকায় বসবাসরত ছেলেরাও মাঝেমাঝে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসে। বড়মেয়েটাকে মাসে একবার নাইওর আনে। চায়না বছরে একবারও বাবার বাড়িতে যেতে চায় না। ওর বাবা জোর করে বছর একবার নিয়ে যায়।

চায়নার কোল আলো করে একছেলে এক মেয়ে আসে সংসারে।

সব চলছে নির্বিঘ্নে তবুও যেন কিছুই চলছে না। চায়না সব জায়গায় আছে তবুও কোথায়ও ও নেই।

রান্না করলেও সামনে বসে বেড়ে খাওয়ায় না। সবার সাথে বসে খায় না,সংসারের সব কাজকর্ম একা করলেও সামনে আসে না কখনো, সবসময় আড়ালে থাকে।

এটাই যেন অলিখিত নিয়ম।


চায়না মাঝে মাঝে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে ভুঞাপুর বাজার থেকে নিজের একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে। মাসুম ব্যাস্ততায় চায়নার জন্য কিছু কিনতে পারে না।


মাসুম শরীকের ভাবীদের জন্য চানাচুর বাদামটানা মুরলি নিমকি জিলাপি কিনে আনে, ভাবীরা ওর ভাগেরটুকু দিয়ে যাবার সময় রসালো মন্তব্য ছেড়ে যায়। চুপচাপ শুনে যায়। চায়না জানে ওরা ওর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলছে।

খাবারগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না চায়না।


আগে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারে শুধু স্খলনের জন্য সঙ্গম হয় মাঝেমধ্যে রাতে। কোনরকম আদর স্পর্শ পায়নি কোনদিন মাসুমের কাছ থেকে চায়না। কথাও তো হয় না।

শুধু ওর প্রভাবশালী বাবার অর্থ এবং আর্মির চাকুরে ভাইদের ভয়ে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি কিন্তু চায়না নিজ থেকে যেন চলে যায়, তার সব ব্যাবস্থা করেছে।

চায়না দাঁতে দাঁত ঘষে পড়ে আছে এ বাড়িতে।

শশুর শাশুড়ী ভাসুর জা ননদ ননাস কে না ওকে শুনিয়ে রুপের খোটা দিয়েছে, চায়না কারো কোন কথার জবাব দেয়নি কোনদিন।

এবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের আর কিছু থাকুক না থাকুক গা ভরা রুপের জৌলুশ আছে,

নিজের বাবাকেও কোনদিন বলে নি ওকে চায় না বলেই কি ওর নাম চায়না রেখেছে। মায়ের পেটের সুন্দর মুখশ্রীর ভাই বোনরাও কোনদিন ওর সাথে ভাল করে কোন কথা বলেনি, সবসময়ই দূরত্ব রেখেছে।

ও বুঝতে পারে সব, নিজের মত করে উত্তরও তৈরি করে নেয় ভেতরে।

কঠিন পথ ওর একার, চলতে হবে একা। এই বোধ ওকে সোজা রাখে সমাজের বিরুদ্ধে সংসারের বিরুদ্ধে আপনজনের বিরুদ্ধে। রুপের বিরুদ্ধে।

তাই তো

শুধু সংসারের আয় বাড়িয়ে গেছে। নিজের জমার অংকটিও কম নয় আজ।

ওর আয়ের উৎস ওর পায়েরতলের শক্ত মাটিটা চেনে, মাসুম, মতিমিয়া মেঘাবতী তাই হয়তো বিষ হজমের মত করে ওকে মেনে নিয়েছে।

ছোটখাট গড়নের শ্যামলারঙের চায়নার দুচোখের নিচ থেকে চিবুক অবধি মিশমিশে কালো রঙের জন্ম জরুল। চোখ দুটো কুতকুতে, চওড়া কপালে বসে আছে কুচকুচে ভ্রমর ভ্রু হয়ে, গোয়াথুবি চুল।

ওকে ভয় হয় ঘৃণা হয়। ভালবাসা উবে যায় করুণাও হয় না

চায়নার মেয়েটা কোনদিন ওর গলা জড়িয়ে ঘুমায়নি। শেফালী ফুফুর সাথে ঘুমায় সারাদিন দাদির সাথে থাকে, ছেলেটাকে মায়ায় কাছে টানতে গেলে ভয়ে দূরে সরে যায়।

ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল চায়নার বিছানায়, প্রচন্ড গরম পরেছে, গ্রামের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় বিদ্যুৎ চলে যাওয়া।

গরমে হাত পা নাড়ছিল।

শুকনো কাপড় তুলে ঘরে রাখতে গিয়ে চোখে পরে ছেলেটা ঘামছে, গরমে এখুনি জেগে যাবে। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে ছেলেটাকে।

চায়নার নিজেও কাজে করতে করতে ক্লান্ত, চোখ বুজে আসে, ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে ওকে বাতাস করতে থাকে, 

আহা বড় আদরের সন্তান ওরা চায়নার।মমতার হাত বুলিয়ে দেয় তার নাড়িছেঁড়া ধনের গায়ে।

জেগে যায়, চায়নার চোখে চোখ রাখে, হেসে চায়না ওকে জড়িয়ে ধরতেই আত্মা ছিঁড়ে চিৎকার করতে থাকে ভয় পাই ভয় পাই বলে। শাশুড়ী দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিতেই কান্না বন্ধ হয় ছেলের।



আয়নার সাথে ওর কোনদিন সখ্য ছিল না, আজ সারাদিন আয়নায় সাথে কাটিয়ে দেয় চায়না।

আয়নায় ভেসে ওঠে আশ্চর্য অরুপ - রুপকথার সংসার।



সকালে মেঘাবতী দেখে সমস্ত মুখমন্ডল ওড়নায় ঢেকে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে চায়না।

আর কোনদিন মুখের আবরণ খুলেনি....

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -4


 

চার


ট্রেনে উঠেই কণিকার মোবাইল থেকে সাকিলকে ফোন করল ঋজু— সাকিল, দশটা পাঁচের লোকালটা ধরতে পারিনি। এগারোটা সতেরোটা ধরলাম। এখন পার্ক সার্কাস ক্রশ করছে। তুই তো জানিস যেতে কতক্ষণ লাগবে, হিসেব করে সেই মতো তুই কিন্তু স্টেশনে থাকিস। না হলে সমস্যায় পড়ে যাব। 

সাকিল ওর বন্ধু। আজকালে কাজ করে। থাকে ডায়মন্ড হারবারে। পুলিশ মহলে খুব খাতির। মগরাহাট থানার ওসি অরিন্দম আচার্য কী ভাবে মাছওয়ালাদের সঙ্গে জেলে সেজে ওখানকার কুখ্যাত ডাকাতকে ধরেছিল, সে খবর ফলাও করে ছেপে সবার নজর করেছে। ওর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কুসুমের ফেরা’-র তরফ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠান করে। এ বছর করেছিল ডায়মন্ড হারবার থানার নীচে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একশো জনেরও বেশি গুণিজনকে ও সংবর্ধনা দিয়েছিল। তাতে যেমন ছিল নাট্যকর্মী, গায়ক, সমাজসেবী, উপন্যাসিক থেকে শুরু করে ওর বস্‌ কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, তেমনি সংবর্ধিত হয়েছিল আর পাঁচ-ছ’জন কবির সঙ্গে ঋজুও।

সেখানেই ঋজু দেখেছিল, পুলিশরা কী ভাবে ওকে খাতির করে। স্থানীয় হোটেল-রিসর্টের মালিকরা প্রায় সকলেই সেখানে হাজির। তাদের কেউ স্পনসর করেছে স্মারক, কেউ ফুলের তোড়া, কেউ আবার উত্তরীয়।

সেই অনুষ্ঠানেই সাকিল ঘোষণা করেছিল, খুব তাড়াতাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাংবাদিকদের জন্য একটা প্রেস ক্লাব তৈরি করতে যাচ্ছে তারা। জমি পাওয়া গেছে। কিছু আর্থিক সাহায্যও এসে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।

সে দিন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঋজু আর ফিরতে পারেনি। শুধু ঋজু নয়, কলকাতার আরও কয়েক জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ফোনেই করে ফেলেছিল সাকিল। তাই, তার দু’দিন পরেই সাকিলকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, তোর তো ওখানে খুব দাপট দেখলাম। শোন না, বলছিলাম কি, ওখানকার কোনও একটা হোটেলে ব্যবস্থা করে দে না, কয়েক ঘণ্টার জন্য।

— ব্যবস্থা করার কিছু নেই। যে দিন খুশি চলে আয়।

— না, আগে থেকে না বললে...

— ধুর, চলে আয় না।

— না, মানে, আমি একজনকে নিয়ে যাব তো, তাই বলছিলাম...

— যখনই হোটেলের কথা বলেছিস, তখনই বুঝে গেছি। কত লোক আসে। তোর কোনও চিন্তা নেই। চলে আয়।

— বলছিলাম কি, পুলিশের কোনও ঝামেলা-টামেলা হবে না তো?

— আমি তো আছি, না কি? চলে আয়।

— কী রকম নেয়-টেয় রে?

— তোকে ও সব ভাবতে হবে না। যে দিন আসবি, তার আগের দিন শুধু একটা ফোন করে দিবি, ব্যাস। আমি স্টেশনে থাকব।


ঋজু এর আগে কখনও কোনও মেয়েকে নিয়ে শহরের বাইরে যায়নি। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে শুধু এক বার হেদুয়ার কাছে সান ফ্লাওয়ার নার্সিংহোমের সামনে দেখা করেছিল শালিনীর সঙ্গে। তাকে দেখে ওর একদম পছন্দ হয়নি। যেমনি গায়ের রং, তেমনি দেখতে। তেমনি তার পোশাক-আশাক। ওই রকম একটা ছেঁড়া ছেঁড়া রং-চটা স্যান্ডেল পরে কেউ প্রেম করতে আসে? ছিঃ। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। গিয়ে, হুট করে চলেও আসা যায় না। তাই ট্যাক্সিতে নয়, সেখান থেকে ওকে নিয়ে বাসে করে দেশবন্ধু পার্কে গিয়েছিল ও। ইচ্ছে না থাকলেও শালিনীর সঙ্গে একটা গাছের তলায় বসেছিল। শালিনীই আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, কিছু দিন আগে ওই ঝোঁপের আড়ালে কারা খুব খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছিল। বলেছিল, এই, জানো তো, কলেজ স্ট্রিটের কাছে বাটা আছে না, তার পাশ দিয়ে রাজাবাজারের দিকে খানিকটা গেলেই ডান হাতে একটা সিনেমা হল আছে— জহর। চেনো?

ঋজু ‘না’ বলাতে ও বলেছিল, ওখানে না, এ মার্কা বই দেখানো হয়। আমি কোনও দিন দেখিনি। যাবে?

— মেয়েটির কথা শুনে বড় অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। প্রথম সাক্ষাতেই কোনও মেয়ে এ রকম কথা বলতে পারে! ভরদুপুরে শুনশান পার্কে চারপাশ ফাঁকা পেয়েও চুমু তো দূরের কথা, তার হাতটাও ছুঁতে ইচ্ছে করেনি ওর। বসার খানিকক্ষণের মধ্যেই ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে’ বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়েছিল সে।

তার পর দিনই ছিল বিধানদার অনুষ্ঠান। মহাজাতি সদনে। আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত বারবার ফোন করেও না পেয়ে, পর দিন সকালেই অফিসের ফোনে কণিকাকে ধরেছিল ঋজু। ওখানে কবিতা পাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সাড়ে পাঁচটায়। বিধানদা ওকে বলে দিয়েছিল সাড়ে চারটের মধ্যে হলে ঢুকে পড়তে। প্রচুর কাজ আছে।

ঋজু এসে দেখে, বিধানদারা তারও আগে চলে এসেছেন। মঞ্চে চেয়ার পাতা হচ্ছে অতিথিদের জন্য। ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে টেবিল। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল শ্বেতার দিকে। ও আজ হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। এ শাড়িতে ও এর আগেও ওকে দেখেছে। ময়দানের বঙ্গ-সংস্কৃতি মেলায়। সেখানে ও শুধু একা নয়, ও যেখানে গান শেখে, সেই স্কুলের এক ঝাঁক মেয়ে এই রকম শাড়ি পরে গান গেয়েছিল, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে...

মাথার উপরে তখন গনগন করছে সূর্য। দর্শক বলতে যারা গান গাইছে তাদের অভিভাবক আর উদ্যোক্তাদের কয়েক জন। সঙ্গে বিধানদা ছিলেন। তাই, সুন্দরবনের ভ্যানরিকশায় অমন নিবিড় একটা ঘটনার পরেও ‘কী, কেমন আছ’, ‘ভাল তো?’, ‘তোমার তো দারুণ গলা’ ছাড়া তার সঙ্গে আর কোনও কথা হয়নি ঋজুর।

আজ তৃতীয় বার, তার সঙ্গে ওর দেখা হল। হল চোখাচোখিও। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পরেই একটু লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল শ্বেতা।

কিন্তু শ্বেতা নয়, ঋজুর তখন মন ছটফট করছে কণিকার জন্য। ও আসবে তো! একে একে তখন অনেকেই এসে গেছে। এসে গেছে তারাও, ও যাদের কবিতা পড়ার জন্য আসতে বলেছে।

ওকে উদ্বিগ্ন দেখে গণেশ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মিহির বলল, একটু ধীরস্থির হয়ে বসো। অত টেনশন করার কিছু নেই। রিনা বলল, শুনলাম, কণিকাকেও ফোন করেছিলেন?

ও বলল, হ্যাঁ। তার পরেই জানতে চাইল, আশিস আসেনি?

রিনা বলল, এসে যাবে। মহাদেববাবুকে বলেছেন নাকি?

— মহাদেববাবুকে? কই, না তো। যাঃ, একদম ভুলে গেছি। দেখেছেন... মুখে এ কথা বলল ঠিকই, আসলে ও ইচ্ছে করেই মহাদেববাবুকে বলেনি।

ঋজু যেন কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছে না। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, পরমার্থ ওর পেছন পেছন এসে বলল, কণিকা তো? ঠিক আসবে। তুমি যাও, আমি দেখছি।

ঋজু হলে চলে এল। এল ঠিকই, তবে ও নয়, ওর দেহ। সিটে বসে ছটফট করছে আর ঘনঘন দরজার দিকে তাকাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর দেখে কণিকাকে নিয়ে পরমার্থ ঢুকছে। ও উঠে দাঁড়াতেই, দূরে থেকেই পরমার্থ হাত দেখাল। বসো। ঋজু যে রো-য়ে বসে ছিল, তার ডাঁয়ে-বাঁয়ে পর পর কয়েকটা সিট খালি। ওরা ওর পাশে এসে বসে পড়ল।

ও যাদের যাদের বলেছিল, তারা সবাই এল। কিন্তু পুরস্কার-পর্বটা এতক্ষণ ধরে চলল এবং অতিথিরা প্রত্যেকেই এতক্ষণ ধরে বক্তব্য রাখলেন, আর বিধানদা সম্পর্কে এত মধুর মধুর কথা বললেন, এত ভূয়সী প্রশংসা করলেন যে, প্রায় ন’টা বেজে গেল। কবিতা পাঠের আসর আর করা গেল না।

বেরিয়েই, সি আর এভিনিউ আর মহাত্মা গান্ধী রোডের ক্রশিংয়ে আসতেই ২৩৯/এ বাস পেয়ে রিনা আর আশিস উঠে পড়ল। এই বাসটা একদম ওদের বাড়ির কাছে যায়। সেক্টর ফাইভের পেছনে, মহিষবাথানে। ওরা কণিকাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই ঋজু ওকে ইশারা করে বারণ করে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে যেতে। রিনাদের বাস চলে যেতেই কণিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঋজু বলল, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।

বাকিরা সবাই যখন যে যার মতো চলে গেল, তখন ওখানে দাঁড়িয়ে ও, কণিকা আর বোধিসত্ত্বদা। বোধিসত্ত্বদাই বলল, কোথায় যাবে?

ঋজু বলল, সল্টলেকে।

— সল্টলেকে কোথায়?

— কণিকা বলল, ভারতীয় বিদ্যাভবনের কাছে।

— এখান থেকে কত নম্বর যায়?

কণিকা বলল, এখান থেকে তো কোনও দিন যাইনি। আমি ঠিক জানি না। তবে কলেজ স্ট্রিট থেকে নাকি অটো যায়।

— তা হলে চলো কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাই। বোধিসত্ত্বদা বলতেই কণিকা বলল, কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয় না, ফুলবাগানের অটোগুলো কোত্থেকে ছাড়ে।

— ফুলবাগান?

— হ্যাঁ, এখান থেকে ফুলবাগান। ফুলবাগান থেকে আবার তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের অটো। ওখান থেকে একটুখানি।

ওরা মহাত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের পাশ থেকে অটোয় উঠে পড়ল। পেছনের সিটের ও দিকে বোধিসত্ত্বদা, তার পরে ঋজু আর একদম এ দিকে কণিকা। চতুর্থ জন আসছে না দেখে, বোধিসত্ত্বদাই বলল, একজনের ভাড়া না-হয় আমরা দিয়ে দেব, চলুন।

অটো চলতে শুরু করল। রাজাবাজার ছাড়িয়ে মানিকতলার ব্রিজ পেরিয়ে যখন অটো ছুটছে, তখন লোডশেডিং। এতক্ষণ ঋজু ওর পায়ে পা ঘষছিল। পিঠের পেছন দিক থেকে হাত নিয়ে ওর কাঁধ ছুঁচছিল। ওর কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিল কণিকা। ও-ও মুচকে মুচকে হাসছিল। এ বার কণিকার ডান হাতটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে এসে ঝপ করে একটা চুমু খেয়ে নিল ও।

কণিকা ইশারা করল, পাশে উনি আছেন। ঋজু বলল, আরে বোধিসত্ত্বদা আমাদের লোক। উনি কিছু মনে করবেন না।

কথাটা শুনে বোধিসত্ত্বদাও বলল, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও। এই তো বয়স।

শুনে কণিকা মুখ টিপে হাসল। ঋজু ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল, দেখলে তো... তার পরেই চকাস করে ওর গালে একটা চুমু খেয়ে নিল।


তার দু’দিন পরেই রবিবার। ওরা দেখা করল রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনের সামনে। একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। ও তখনও আসেনি। তাই, ও আদৌ আসবে কি আসবে না সে নিয়ে শংসয়ে ছিল। সেই উদ্বেগ থেকে দুটি লাইন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতেই, ওর পকেটে যে ছোট্ট ডায়রিটা থাকে, সেটা বার করে লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে হঠাত্‌ দেখে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। ও কাছে গিয়ে বলল, কখন এসেছ?

কণিকা বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগে। দেখলাম তুমি লিখছ, তাই ডিসটার্ব করিনি। কী লিখছিলে?

— কবিতা।

— কী নিয়ে?

— তোমাকে নিয়ে।

— তাই? দেখি, কী লিখেছ?

— ছাপা হোক, তার পর দেখো।

— কী নাম দিলে?

— এখনও কোনও নাম দিইনি। দেখি, কী দেওয়া যায়!


সে দিনই রাত্রে কণিকাকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রোজ যদি তোমার সঙ্গে এই ভাবে দেখা করা যেত!

— ইচ্ছে করলেই দেখা করা যায়। ও বলেছিল।

— কী ভাবে?

— আমার তো ছুটি হয় পাঁচটায়। তোমার তো ছ’টায় ঢুকলেও চলে। এক ঘণ্টা আমরা একসঙ্গে কাটাতেই পারি।

— ঠিক বলেছ তো! ঠিক আছে, কাল ঠিক পাঁচটার সময় আমি তোমার অফিসের গেটে চলে যাব। কেমন?

— না না না না। অফিসের গেটে না। আমাদের অফিসের সবাই তখন বেরোয় তো। কে কী ভাববে। কী দরকার? তার চে’ বরং ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের কাছে থেকো। আর তুমি যদি পাঁচ-দশ মিনিট আগে চলে আসো। তা হলে নীচ থেকে একটা ফোন কোরো। আমি নেমে আসব।


সেই রাতে কিছুক্ষণ পর পর আরও তিন-চার বার ফোন করেছিল ও। এমনকী, অফিস থেকে বেরোবার সময়ও। তাই মাথার মধ্যে নম্বরটা একদম গেঁথে গিয়েছিল। ফলে, পর দিন ও যখন টেলিফোন ভবনের সামনে ফোন করার গুমটি থেকে এক টাকার কয়েন ফেলে নম্বর টিপল, সেটা চলে গেল কণিকার বাড়িতে। যে মেয়েটি ধরল, সে বলল, মা তো অফিসে।


শুধু সে দিনই নয়, তার পরেও বেশ কয়েক দিন ওর এই একই ভুল হয়েছিল। আর এই ভুলের জন্যই ঋজুকে খুব ভাল ভাবে চিনে গিয়েছিল কণিকার দুই যমজ মেয়ে। ছোট বাবি আর বড় বাবি।

প্রথম যে দিন ওদের নাম শোনে, ঋজু একেবারে চমকে উঠেছিল। ছোট বাবি! বড় বাবি! তার ছেলের নামও তো বাবি। সত্যিই, কী কাকতালীয় মিল, না! একেই বোধহয় বলে প্রেম! তার পরেই মনে হল, কিন্তু কোথায়, সে দিন যখন কথায় কথায় কণিকাকে ও বলেছিল, তার ছেলের নাম বাবি। ও তো এক বারও বলেনি, আমার মেয়েদের নামও বাবি। বড় বাবি, ছোট বাবি। নাকি সে সময় প্রেমে এত মশগুল ছিল যে, ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। কে জানে!

ঋজুরা বুধবার-বুধবার আড্ডা মারত রবীন্দ্রসদন চত্বরে। কখনও বাংলা আকাদেমির সামনে। কখনও আপনজন-এর সামনে জলের ফোয়ারা ঘেরা বাঁধানো বেদিতে। আসত মিহির, গণেশ, দিশা, রফিক, বোধিসত্ত্ব। আসত বড়রাও। রানা চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। আসত নানান লিটিল ম্যাগাজিনের লোকেরা। আবৃত্তিকারেরা। কণিকাও সেখানে আসা শুরু করল।

সে দিন একটি আবৃত্তি সংস্থার প্রোগ্রাম চলছিল জীবনানন্দ সভাঘরে। সেখানে কয়েক মিনিট কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কণিকা আর ঋজু। সামনেই পর পর সিমেন্টে বাঁধানো দুটো বেঞ্চ। তার পেছনে, ঘেরা-জলাশয়ের মধ্যে নন্দন প্রেক্ষাগৃহ।

সে রকম একটা বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল ওরা। একটু ঘনিষ্ঠ হয়েই। কে কী বলবে? ওখান দিয়ে যারা যাতায়াত করে, তারা প্রায় সবাই ঋজুকে চেনে। ঋজুও তাদের চেনে। হঠাৎই একটু সরে গেল কণিকা। — কী হল?

জিজ্ঞেস করতেই কণিকা বলল, ওই যে মেয়েটা আসছে, ও মহাদেববাবুর ছাত্রী। আমাদের বাড়িতে পড়তে যেত।

ঋজুর কেমন যেন খটকা লাগল। কেউ যে তার স্বামীকে এই ভাবে বাবু হিসেবে সম্বোধন করে, সেটা ঋজু এই প্রথম দেখল। সে দিন দাঁতন যাওয়ার পথে আশিস তাকে বলেছিল, ওরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু কেন জানি ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, ওরা সত্যি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী।

তারা যে সে দিন জীবনানন্দ সভাঘরের সামনে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল, তার পর দিনই কী করে যেন সে খবর পৌঁছে গেল মহাদেববাবুর কাছে। কণিকাকে নাকি উনি বলেছেন, কী হচ্ছে এ সব? কী শুনছি?

ঋজু শুনে বলল, উনি জানলেন কী করে?

কণিকা বলল, আমার মনে হয়, ওই মেয়েটাই বলেছে। সে দিন দেখালাম না, ওই যে গো, ওই মেয়েটাকে...


এর ক’দিন পরেই আশিসের ফোন। কী খবর? কোনও ফোন-টোন নেই কেন? ভুলে গেলেন নাকি? একদিন আসুন।

— যাব। এর মধ্যেই যাব।

এর মধ্যে কেন আবার? কালই আসুন না... আসার সময় আপনার লাস্ট যে কবিতার বইটা বেরিয়েছে, তার একটা কপি নিয়ে আসবেন তো...


পরমার্থ শুনে বলল, আমার সঙ্গে সেই কবে থেকে আলাপ, আমাকে তো কোনও দিন কবিতা পাঠের কথা বলল না!

— আরে বাবা, কবিতার জন্য না। আমাকে এমনিই যেতে বলেছে।

— এমনি বললে, কবিতার বই নিয়ে যেতে বলত না।

— কী জানি, কিছু তো বলল না। দেখি, কাল গিয়ে।


ঋজু গিয়ে দেখে, আশিসের সামনে মহাদেববাবু বসে আছেন। ও যেতেই ওরা নীচে নেমে এল। ‘আমি একটু আসছি’ বলেই আশিস যেন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। আকাশবাণীর বাইরে, গেটের সামনে ঋজু আর মহাদেববাবু। তিনি বললেন, এ সব কী শুনছি? তোমাকে আর ওকে নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলছে। বাড়িতে ফোন করে পর্যন্ত বলছে। ওকে আমি কিছু বলব না। আমি জানি,ওর একটু ছেলেদের গায়ে-পড়া স্বভাব আছে। আমি তোমাকে বলছি। তুমি তো জানো, আমাকে কত লোক চেনে। তোমাদের মধ্যে যদি কোনও সম্পর্ক হয়েই থাকে, আমি বাধা দেব না। কিন্তু... 

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছলছল চোখে আচমকা মহাদেববাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরল ঋজু— কী করব মহাদেবদা, আমি যে ওকে ভালবেসে ফেলেছি।

ঋজুর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে উনি বললেন, আমি তোমাকে কিছু বলছি না। শুধু বলছি, যা করবে, একটু দেখেশুনে করবে। আমার ছাত্রছাত্রীরা যেন জানতে না পারে।


তাই ক’দিন ধরে কণিকার অফিস ছুটির পরে ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের সামনে ছাড়া ঋজু আর কোথাও কণিকার সঙ্গে দেখা করছে না। বুধবার-বুধবার রবীন্দ্রসদন চত্বরেও আসতে বারণ করে দিয়েছে ওকে।


হঠাৎ এই সুযোগ। একেবারে আচমকা। ঋজুর বউ ভারতী। বিয়ের পর থেকে ঋজু তাকে রতি বলেই ডাকে। সে জানে, প্রত্যেক বছর বইমেলার এই প্রথম রবিবারে কলকাতার পুস্তক মেলার গিল্ড কর্তৃপক্ষ যে ‘বইয়ের জন্য হাঁটুন’ পদযাত্রার আয়োজন করে, সেখানে ঋজুও যায়। উত্তর কলকাতার লোকেরা কলেজ স্ট্রিট থেকে আসে। আর দক্ষিণের লোকেরা দেশপ্রিয় পার্ক থেকে যায়। মিলিত হয় পার্ক স্ট্রিটের মুখে। এমন টাইমিং যে দুটো মিছিলই প্রায় একই সঙ্গে বইমেলায় ঢোকে। সে-ই যে ঋজু ঢোকে, ফেরে অনেক রাতে।

রতিকে ‘ওখানে যাচ্ছি’ বলে, সকালেই বেরিয়ে পড়ল ঋজু। তার পর সোজা শিয়ালদা। এখন শহরের সবার নজর এড়িয়ে ডায়মন্ড হারবারে। স্টেশনে নেমেই একটা কালো গগল্‌স পরে নিল কণিকা। স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল সাকিল। সে ওদের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঋজু দেখে, সামনেই একটা পুলিশের কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। সাকিল ওদের সেটায় উঠতে বলল। তার পরে নিয়ে গেল হংসরাজে। বিশাল একটা লাকজারিয়াস হোটেল। কাউন্টারের লোকটাকে সাকিল কী বলতেই, লোকটা একজন বেয়ারাকে ডেকে বলল, উপরে নিয়ে যা। বেয়ারাটা ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটা ঘর খুলে দিল। টিপটপ এসি রুম। সাকিল চলে গেল।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয় একদম অভিজ্ঞতা নেই ঋজুর। একেবারে আনকোরা। দরজায় ছিটকিনি তুলে পেছন ঘুরে দেখে কণিকা ততক্ষণে গগল্‌স, কানের দুল, গলার হার, খোপার ক্লিপ খুলে ফেলেছে। শাড়ি খুলছে।

ঋজু খাটের ধারে বসে কণিকাকে দেখছিল। কণিকা শুধু ব্রেসিয়ার আর শায়া পরে খাটে উঠেতেই ও-ও জামাপ্যান্ট খুলে বিছানায় উঠে পড়ল।

তার পর মহাপ্রলয়। ঘুমন্ত ময়াল জেগে উঠল। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল বারবার।

হঠাৎ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। কণিকার মোবাইল বেজে উঠল। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে কণিকার দিকে এগিয়ে দিল ও। স্কিনে নম্বরটা দেখে নিয়ে বিছানার পাশে রেখে দিল কণিকা। বলল, কে না কে, থাক। ফোন করার আর সময় পায় না। যত্তসব। কিন্তু ফোনটা ঘনঘন বাজতেই লাগল।

_______________________


                                       ক্রমশ...



তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন -

Click here 🔴



পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--

Click here 🔴


Wednesday, June 1, 2022

ছোট গল্প - জীবনাঞ্জলি || লেখক - চন্দন চক্রবর্তী || Short story - Jibonanjali || Written by Chandan Chakraborty


 

 


ভ্যাটের গাড়ির ছেলেটার মনটা ভালো । সামনের ফাঁকা জায়গায় করপোরেশন ভ্যাট ফেলা বন্ধের নোটিশ দিয়েছে । গতকাল গাড়ি আসে নি । আদরী উপবাসী থেকেছে । ছেলেটা এই পথেই যাচ্ছিল । আদরীর কষ্ট সে বুঝতে পেরেছে । গাড়িতে তুলে অনেকটা পথ এসে একটা নতুন জায়গায় নাবিয়ে দিয়ে গেল । 


সামনে একটা ভ্যাট ফেলার জায়গা আছে । গাড়ি এখন ওই রাস্তায় যাবে না । নো এন্ট্রি চলছে । কিন্তু ওরা যে ভাবে বলে গেল সব যে ঘুলিয়ে গেছে ! 


বেলা চড়ে মাথার ওপর রোদ । হাঁটতে হাঁটতে আদরী সামনে একটা পার্ক দেখতে পেল । পার্কের মাঝে বিরাট পূজার প্যান্ডেল । ঢাক বাজছে । অনেক লোকের সমাগম ।   


শরীর আর দিচ্ছে না । মাজা ভেঙে আসছে । লাঠিতে ভর দিয়ে সে আর কত দূর যেতে পারে ! গতকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি । মায়ের ওপর ভরসা রেখে সে সেখানে বসে পড়ল । 


সেই কবে বাপের ঘর তাকে ছাড়তে হল । তখন আদরী সবে বারোয় পড়েছে । সেই থেকে তার চলার শুরু । আজ আশি ছুঁই ছুঁই । তার জীবনে আর নিশ্চিত ঠিকানা হল কই ! 


আদরীর ছোট থেকেই মা নেই । বাপ লোকের জমিতে জন খাটতো । অভাব ছিল বারো মাস । তবু আধপেটা খেয়ে,বনে বাদাড়ে ঘুরে, এটা ওটা এনে,তাদের চলছিল । কিন্তু যেবার খরা হল । বাপটা শহরে এলো । এখানে এসে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হল । 

আদরী তখন নয় কি দশ । 


বাপটা এদিক ওদিক ঘুরে তেমন সুবিধা করতে পারতো না । আদরী বস্তির আর সব কচিকাঁচাদের সাথে ডাস্টবিন থেকে পচা গলা খাবার কুড়িয়ে আনতো । তবু যা হোক চলছিল ।  শেষে বাপটা হাঁপের রুগী হয়ে কাজে বেরনো বন্ধ করল । ঘরে বসে আর কদিন চলে । একদিন দালাল এসে আদরীকে কিনে নিয়ে গেল । 


দালালের গোপন আস্তানায় আদরীকে কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছর । বদ্ধ ঘরে তার দম আটকে আসতো । তিন বেলা যা খাওয়া দিত,ভালো করে পেট ভরতো না । তার মধ্যেই,সে ভালো করে ফোটার আগেই, রাতে তাকে দালালের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে । কোন কোন দিন,দিনের বেলাও বাদ যেতো না । আদরীর কান্না ঠেলে আসতো । এক একবার মনে হয়েছে পালিয়ে যাবে । কিন্তু তেমন কোন সুবিধা সেই ঘরে ছিল না । সে মৃত্যুর কথাও ভেবেছে । কিন্তু পেরে ওঠে নি । 



আদরীকে এবার আনা হল এক মাসির ডেরায় । মাসি তাকে ঘর দিল । তার নতুন নাম হল । যে মাটি না হলে উমার পূজো হয় না সেখানে সে কমল হয়ে ফুটল । 


কমল হয়েই সে রোজ রাতে সেজে রাস্তায় দাঁড়াতো । চল্লিশটা বছর সে সেখানে কাটিয়ে যখন বেরিয়ে এলো তখন শরীর জুড়ে তার জরা । খদ্দের আসা আগেই বন্ধ হয়েছে,তার দাম ফুরিয়েছে । 


শরীরে যখন প্রথম প্রেমের সাড়া পেল তখনও নিবেদন করার মত মানুষ পেল কোথায় ! কথাটা মাথায় এলেই নগেন ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে । টানা তিন বছর নগেন রাতে একবার আসতোই । একবার তিনদিন তিনরাত তার ঘরে কাটিয়ে গেছে । আদরীর সেবার গায়ে ধুম জ্বর । নগেন তাকে ওষুধ এনে দিয়েছিল । বাইরে থেকে রান্না খাবার এনেছিল । জ্বরের মধ্যেও আদরী নগেনকে আসন পেতে শাল পাতায় খাবার বেড়ে যত্ন করে নিজ হাতে খাইয়েছিল । তারপর থেকে নগেন এলে আদরী সেদিন ঘরে অন্য খদ্দের ঢোকাত না । 


রাতে নগেন,সে,পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটিয়েছে । দুপুরে চান করে নগেনকে স্মরণ করে,সিঁদুর পরে আয়নায় নিজের মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতো । এই নিয়ে মাসির কাছে কথা শুনতে হয়েছে । সবার ওপরে যেটা,সে নগেনের সন্তানকে পেটে ধরেছে ।

তারজন্য তাকে যে অমানুষিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে,তা ভোলার নয় । তার শরীর নষ্ট হয়েছে,রোজগার নষ্ট হয়েছে,অনেক খদ্দের কমেছে । তবু সে মা ডাক শুনেছে । ছেলেকে সে ঠিক মত আদর যত্ন করতে পারে নি । খদ্দের ঘরে এলে ছেলেকে মাসির কাছে রেখে আসতে হত । সে মাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে চাইতো না । মা মা করে  চিৎকার করতো । মায়ের মনে উথাল পাথাল ঢেউ উঠতো । হায় ভগবান,আদারী তখন চোখ মুছে খদ্দের বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ! তাই বুঝি ছেলেটা একটু বড় হতেই মায়ের ধার ঘেঁষতো না !


হঠাৎ সেই নগেনও কোথায় হারিয়ে গেল ! অনেকগুলো রাত বিনিদ্র থেকে সে খবর পেয়েছিল নগেন গাড়ি একসিডেন্টে মারা গেছে । রাতে শুয়ে সে চোখের জল ফেলেছে । 


তার জীবনে সেই শেষ বসন্ত এসেছিল ।

অনেকগুলো বছর গড়িয়ে শরীরের ঘ্রাণ হারিয়ে সে তখন সর্বশান্ত । ব্রার্ত্য হিসাবে তার নাম উঠল খাতায় । শেষে বীরেনবাবুর চেষ্টায় তার বাড়ি গিয়ে তার ঠাঁই মিলল । লোকটা তার ঘরে যৌবনকালে বার কয়েক অতিথি হয়েছিল । কদিন অন্তর ঘর পাল্টাতো ।  বীরেনবাবুকে তখন তার খারাপ মানুষ মনে হত । সেই লোকটাই তাকে বাড়িতে ঠাঁই দিল । সারাজীবন লোকটা বিয়ে না করে তাদের ওখানে যাতায়াত করে কাটিয়েছে । 


বাগান বাড়ির এক কোনে তার টিনের চালা । তার কাজ ছিল বিরাট বাড়িটা ধোয়া পোছা করা ।  

বছর দশেক কাটার পর শরিকী বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল । বীরেনবাবু ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেলেন । 


আদরীকে এবার পায়ের তলার মাটি হারিয়ে পথে নামতে হল । সারাদিন ভিক্ষা করে অনেকগুলো বছর চলার পর আর পারছিল না । অবশেষে ময়লা ফেলার স্থানে কোন ঠিকানা বানিয়ে তার চলতে লাগলো । মাঝে মাঝেই তাকে তার জন্য ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে । 


আজ যখন সে ঠিকানা হারালো শরীর একেবারেই পড়ে গেছে । আদরী ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল । হাতে পায়ে ঝি ঝি ধরেছে । মাথা ঝিমঝিম করছে । সে বেশ বুঝতে পারছে তার যাবার সময় হয়েছে ।


এ জীবনে তার কোন অনুযোগ নেই । বাপের ঘরের দেওয়া আদরী নাম তার শৈশবেই ঘুঁচেছে । পরবর্তীতে যে দোরের মাটি নিয়ে মায়ের পূজার শুরু,আদরী সেই মাটিতে কমল হয়ে ফুটেছে । তার দেহ মধুকরের পায়ে ক্ষত বিক্ষত হলেও তার মন আজো সদ্য প্রস্ফুটিত কমলের মত পবিত্র ।  


আদরী মন কমলকে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে চিরকালের মত চোখ বুজল ।

Monday, May 30, 2022

টাটা কোম্পানিতে নিয়োগ হবে 1 লক্ষ পদে || Tata consultancy Recruitment 2022 || TCS Recruitment 2022

 





আবার নতুন কর্মী নিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। টানা দু'বছর করোনা পরিস্থিতির জন্য অনেক কোম্পানি বা সংস্থা থেকে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এবার নতুন সুযোগ এসেছে টাটা কোম্পানির হাত ধরে। সমগ্র দেশে এই সংস্থার নিয়োগে সুযোগ রয়েছে। নিয়োগ টি হবে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস (TCS) এর কর্মী হিসেবে। আমাদের রাজ্যের পুরুষ ও মহিলা সকলেই এখানে আবেদন করার সুযোগ পাবেন। সব থেকে বড় সুযোগ এখানে কাজ করতে হতে কোনো রকম কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতার দরকার নেই। বেতন পাবেন অনেক। নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-


বিশ্বের একটি বৃহৎ সংস্থা হল টাটা। আমারা জানি ভারতেও এর থেকে বড় সংস্থা তেমন নেই। এই টাটা কোম্পানির একটি বৃহত্তম সংস্থা TCS অর্থাৎ কনসালটেন্সি সার্ভিস। এই সংস্থায় প্রায় অনেক সময় ধরে কর্মী নিয়োগ হয়। অধিকাংশ চাকরি অফিসিয়াল।   
সম্পূর্ণ ফ্রেশাররা আবেদন করতে পারবেন।

বয়স:  18 থেকে 45 বছরের মধ্যে আপনার বয়স হলেই আপনি এখানে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।

আমাদের দেশে তথা আমাদের রাজ্যে এই সংস্থার অনেক কার্যালয় রয়েছে বিভিন্ন শহরে। এইসব সংস্থাগুলো পরিচালনা করার জন্য প্রচুর পরিমাণে কর্মী নিয়োগ করা হয় ভারতের প্রতিটি রাজ্য থেকে।

গত বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা জেনেছি এই সংস্থায় 40000 নতুন কর্মী নিয়োগ হয়েছে ।  আবার নতুন এক লক্ষ কর্মী নিয়োগ করা হবে, যা সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারি। সব থেকে বড় ব্যাপার তারা এখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন তাদের লাইফ পুরো সরকারি চাকুরিজীবী দের মত হবে।এখানে সমস্ত ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা খাওয়া ও অন্যান্য ভাতা পাবেন‌



মোট শূন্যপদ: এই বছর এক লাখ কর্মী নিয়োগ হতে চলেছে।

প্রথমার্ধে ৪৩০০০ ফ্রেশার নিয়োগ।

তারপর অক্টোবর-ডিসেম্বরের প্রান্তিকে ৩৪০০০ ফ্রেশার নিয়োগ।

তৃতীয় প্রান্তিকে ২০০০০ অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

চতুর্থ প্রান্তিকে ৩০০০০ নিয়োগ।

এই ভাবে সব মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষের বেশি কর্মী নিয়োগ হতে চলেছে। 


যোগ্যতা:- 
 সমস্ত চাকরি প্রার্থীকে অবশ্যই উচ্চমাধ্যমিক অথবা স্নাতক পাস করে থাকতে হবে। তবে এখানে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।



আপনি যদি আরও বিস্তারিত জানতে চান এবং এখানে আবেদন করতে চান তাহলে নীচে দেওয়া TCS এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে  ভিসিট করুন। 

Official website:-


Sunday, May 29, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -4


 


সুরজিৎ বাবু অতি আনন্দিত হলেন। সুমন্ত গ্রামের গৌরব। সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছে। প্রতিটি সাবজেক্টে ৯৩ পারসেন্ট নাম্বার আছে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সমুন্তকে যাতে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।


  তিনি বললেন, সুমন্তর কাছে মত নিতে। কারণ সংসার যদি বিচ্ছিন্ন না হতো তাহলে গলা হাঁকিয়ে বলতে পারতেন। বাবা, সুরজিৎ বাবুকে বলেছিলেন, সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াতে হলে যদি পথে বসতে হয় তাতেও তিনি রাজী আছেন। স্বপ্ন পূরণ করা তার কর্তব্য। তাই অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করেও পিছু হটবেন না। সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াবেন এ তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।


 দাদাকে ডাকা হলো, দাদা বলতে সুমন্তদা একাই। দ্বিতীয় কোন ভাই ও বোন ছিল না আমার। দুই ভাই বোনকে জন্ম দিয়ে মা পৃথিবী হতে চিরবিদায় গ্রহণ করছিলেন অনেক আগে। মা বিদায় নিয়ে ভালই করেছিলেন। নতুবা পরিনতি ভয়াবহ হতো তা অজানা নয়। এখন ও পরের কথা। 


সুমন্তদা বাবার কাছে হাজির হতে বাবা খোলাখুলি আলোচনা করলেন। সে সময় সুরজিৎ বাবু উপস্থিত ছিলেন। দাদা কোন মতেই রাজী হতে চাইলেন না। বারবার এক কথা ও স্বপ্ন দেখে কি লাভ। একান্নবর্তী পরিবারে থাকলে তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করা যেত। এখন তাদের ছন্নছাড়া জীবন। অভাব অনটন ও দারিদ্রই তাদের জীবনের নিত্য সহচর। ডাক্তারী পড়তে হলে কত টাকা যে খরচ হবে তার হিসেব নেই। শেষ কালে কি পথে বসবে তারা?  


সুরজিৎ বাবু বুঝিয়ে বললেন। যদি বা বাবার কথা কাটতে পারতো বিশেষ করে সুরজিৎ বাবুর কথা কাটতে পারলেন না। তিনি বললেন, শুধু তোমার বাবার স্বপ্ন নয় সুমন্ত, প্রতিটি গ্রামবাসীর ইচ্ছা তুমি ডাক্তারী পাস করে গ্রামবাসীদের মৃত্যুর কবল হতে রক্ষে করবে। জানতো, কোন ডাক্তার এই পল্লী অঞ্চলে আসতে চায় না। কারণ ডাক্তারী পাশ করার সময় শহরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে পল্লী অঞ্চলে চেম্বার করতে তাদের অত্যন্ত অনীহা থাকে। আমরা তোমাকে কোলে - পিঠে মানুষ করেছি। যদি শহর হতে আসতে ইচ্ছে না করে জোরপূর্ব্বক গ্রামে আনার ক্ষমতা আমাদের আছে। তবে গ্রামে যদি আশানুরূপ রোজগার না হয় তাহলে শহরে সপ্তাহে চারদিন থাকলে, গ্রামে হয়তো তিন দিন এসে চেম্বারে বসলে গ্রামের অনেক উপকার হবে। 


তারপর কি জানো তোমার ঠাকুরদা স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রেমাংশুকে ডাক্তার করে গ্রামের অভাব পূরণ করবেন। কিন্তু ভাগ্যচক্রে এ রকম যে বিপর্যয় হবে কেও কি কোনদিন কল্পনা করেছিলো? 


সুমন্ত মাষ্টার মশায়ের সব কথা শুনে বললো, তা না হয় হলো, কিন্তু বাবার যে সম্পত্তি আছে ওতে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে পারবেন কি?


সুরজিৎ বাবু বললেন, কোন ভয় নেই তোমার। তোমার বাবা যদি শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে না পারেন, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সেজন্য তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।  


সুমন্তদা আরো কিছু বলার জন্য সচেষ্ট হতে থাকে। কিন্তু বিরুদ্ধ অন্তরের কথাকে কোন প্রকারে বাঙ্ময় করতে পরলো না। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। 


  সুরজিৎ বাবু বললেন পুনরায়, সুমন্ত, তুমি আর বিলম্ব করো না। আগামীকাল আমার কাছে যাবে, নীহার বাবুর সাথে আলোচনা করে ওর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দেব।


 সেদিন আর আলোচনা না করে সুরজিৎ বাবু আপনি বাড়ি পানে পা বাড়ালেন। দাদার ডাক্তারী পড়ার সব রকম আয়োজন হলো। বাবা গ্রামীণ মানুষ, দিনক্ষণকে ভীষণ মানেন। তাই পাড়ারই একজন এ্যাস্ট্রোলজারকে দিয়ে ভালো দিন দেখিয়ে পাড়ারই বিশিষ্ট ব্যক্তি নীহার বাবুর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি হতে কোন বাধা হলো না।


 তিনি বলেছিলেন, সমুন্তর ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন। ডাক্তারী পাশ করার জন্য কোন বাধা বিঘ্ন নেই। সে সুন্দরভাবে ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে ফিরে আসবে। সেই এ্যাস্ট্রোলজারের কথা মনে ছিলো বলে বার বার তার চরণে প্রণাম জানিয়ে ইচ্ছে করছিল। এ জন্য যে, দাদা সুস্থ সকল শরীরে ডাক্তারী পাশ করে বাড়ীতে এসেছিলো বলে। একটু ধৈর্য্য ধরুন পরের পর সবই জানতে পারবেন। কারণ আমি মনযোগে লিখে চলেছি। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি পরের পর ঘটনাকে কেন্দ্র করে।


 দাদা শুভ দিনে কলকাতায় ভর্তি হলো। বাবা ও সুরজিৎ বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কারণ দাদার মোটেই ইচ্ছে ছিলো না ডাক্তারী পড়বার। তাকে জোর পূর্ব্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারী পেশায় যেন নামানো হলো। এ কথা শুনে মেজকাকা জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কেন যে আমাদের প্রতি এতো হিংসে হয়েছিলো তা বুঝতে পারিনি। বাবা জমিদার পরিবারের আভিজাত্যকে পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের পথ বেছে নিলেন।

 

সেই সময় ভাবতে বড় আশ্চর্য লাগছিলো, যে মানুষটা চব্বিশ ঘন্টা জঙ্গলে পড়ে থাকতেন, বন্য জন্তুর পিছনে সর্বদাই ছোটাছুটি করতেন। সে মানুষটা যে এরূপ পাল্টে যাবে কোন দিন ভাবতে পারিনি। 


আমাকে পড়াশুনা ছাড়তে হলো। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর এগোতে পারলাম না। বাবার পরিশ্রমের পয়সাতে সুন্দরভাবে সংসার চালাতে চেষ্টা করলাম। একদিন কোথা হতে ছোট কাকা উদয় হলেন; প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে। তিনি যে এতো রোগা হয়ে যাবেন কল্পনা করিনি। কাকা ছিলেন সুপুরুষ, তেজদীপ্ত চেহারা ও দেহে আভিজাত্যের ছাপ। গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছোট কাকার চেহারা নিয়ে প্রশংসা করতেন। কিন্তু ছোটকাকার ঐ রূপ রোগা শরীর দেখে চোখ দুটো যেন গাম আঠা দিয়ে চিটিয়ে রেখেছিলেন। 


ছোটকাকা এসেই বললেন, কিরে রমা আমায় চিনতে পারছিস না? কি করে পারবি বল, আমি যে তোদের বংশের নাগাল হতে অনেক দূরে সরে গেছি। দুর্ভাবনায়, দারিদ্রতায় নিজেকে তিলে তিলে দগ্দ করছি। ভগবান যে আমাকে এতো কঠোর নির্যাতন দেবেন তা কোন দিনই মনে আনিনি। সবই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছু নয়রে। 


ছোট কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন, জানি না জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করে কি পাপ করেছি। সেই পাপের যন্ত্রণা প্রতিটি শিরা , উপশিরায় প্রবেশ করে আমাকে মৃত্যুমুখী করে তুলেছে।


 আমি ছোট কাকার কথাগুলো শুনে শোকাহত যে হলাম না তা নয়। আমাকে মনমরা হতে দেখে তার দুঃখের কাহিনীকে অন্তরালে চাপা দিয়ে বললেন , তা হ্যাঁরে তোর বাবা কোথায়?


বললাম, বাবা উপার্জনে গেছেন। 


কি বলছিস তুই ? তবে কি মেজদা, বড়দাকেও ফাঁকি দিয়েছেন? 


আমি নীরব ছিলাম। মেজকাকাকে নিয়ে নানা কটু কথা বললেন তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য। যদি কোন দিন সবল হতে পারেন তাহলে একদিন বদলা নেবেন। এখন ছোট কাকা ভাগ্যের বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত পরে যেদিন ঈশ্বর ওর মুখপানে তাকাবেন সেদিন, এদিন তার থাকবে না। বাবা একটু পর বাড়িতে এলেন। কাকার দূরাবস্থার কথা শুনে প্রচুর দুঃখ পেলেন। কাকার আগমন বার্তা শুনলেন। বাবা যদি কিছু আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য না করেন তাহলে কাকা অসহায়ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।


 কাকার দুঃখে বাবা কাতর হয়ে পড়লেও সাহায্যের উদার হস্ত প্রসারিত করলেন। যেটুকু দিয়ে সাহায্য করলেন তা বহু কষ্টের উপার্জিত অর্থ। দাদার ডাক্তারী পড়ার ব্যবস্থা না করে বাবা আরো আর্থিক সাহায্য দিয়ে প্রকৃত ভ্রাতৃ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন।


 দাদার ডাক্তারী পড়া কথা শুনে ছোট কাকা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিশেষ করে আনন্দিত হয়েছিলেন এ কারণে, ঠাকুর্দার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে বলে তিনি আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়তেই বললাম, ছোট কাকা একটু দাঁড়াও আমি আসছি। 


দ্রুত বেগে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাক্স হতে এক জোড়া কানের দুল বের করে তার হাতে দিলাম। ছোট কাকার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হলে আমাকে শান্ত স্বরে

বললেন, আমার অবস্থা এখন চরম সীমানায় উপস্থিত হয়েছে। তবুও তোর কানের দুল দুটো নেবার কোন স্পৃহা আমার নেই। তুই রেখে দে রমা, একদিন দারুন কাজে লাগবে। আমি জানি এই দুটো নিলে আমার অভাব মিটবে না। কিন্তু তোরা যে শপথ নিয়ে যে পথের যাত্রী হয়েছিস আমারও কর্তব্য ছিলো তোদেরকে সাহায্য করা। দুল দুটো রেখে দে মা।


 আমি বললাম, আমরা ঠিকই এগিয়ে যাবো ছোট কাকা তোমাদের আশীর্বাদে এ দুটো নাও, এ সময় টাকার প্রয়োজন তোমার। খোকনকে বাঁচাতেই হবে । সেও তো আমার ভাই। তোমাকে নিতেই হবে এ দুল দুটো।


 বার বার অনুরোধে আমার কথা কাটতে পারলেন না। শুধু ঠোঁটে হাত দিয়ে আমাকে বললেন, তুই আমার মায়ের কাজ করলি রমা। তবে এই চন্দ্র সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে শপথ করে বলছি, ঈশ্বর যদি কোন দিন আমার প্রতি সদয় হয়ে থাকেন, তাহলে আমার মায়ের ঋণ শোধ করবই। এই ঔ


 ছোট কাকা আর দাঁড়াননি ওখানে। ছল ছল চোখে স্থান ত্যাগ করলেন। তিনি স্থান ত্যাগ করতে আমারও চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো ও বার বার তার মলিন মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওকে অনুসরণ করে দাদুর স্মৃতি মনে উদিত হয়ে আমাকে ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কি ছিলো আমাদের অবস্থা আর কি হয়েছে। এখন কোন অপরিচিত লোকদের যদি বলে থাকি, আমি জমিদারের নাতনী, কেউ বিশ্বাস করবে না! সকলে হেসে উড়িয়ে দেবেন। সেদিন কি আর ফিরে আসবে । জানি না এরপর ঈশ্বর আর কোন ভাগ্যবিপর্যয়ের জাল ফেলবেন। অতীত মনে পড়লে কিছুক্ষণ মনকে উতলা করে একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তির আস্বাদ মিটিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমাদের অভাবের সংসার এগিয়ে চললো।



                                                ক্রমশ...


তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-

Click here 🔴



পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--

Click here 🔴

Friday, May 27, 2022

দুয়ারে সরকার প্রকল্পে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর কাজে নতুন কর্মী নিয়োগ || Data Entry oparator Recruitment 2022 || WB government jobs news


 



পশ্চিমবঙ্গে চাকরি প্রার্থীদের জন্য নতুন সুখবর। প্রতিটি বেকার চাকরি প্রার্থীদের জন্য নতুন আশা দেখাচ্ছে দুয়ারে সরকার। রাজ্যে চালু হওয়া দুয়ারে সরকার প্রকল্পে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্লকে ব্লকে প্রচুর ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নতুন কর্মী নিয়োগ করা হবে। চাকরি সংক্রান্ত সম্পূর্ণ বিবরণ নীচে দেওয়া হল-




পদের নাম - ডেটা এন্ট্রি অপারেটর।


কি কি কাজ করতে হবে-


রাজ্যে চলছে 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্প। তাই ব্লকে ব্লকে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প বসছে। দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে স্বাস্থ্য সাথী, লক্ষী ভান্ডার ও আরও বহু প্রকল্পের ফর্ম গুলি রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। সেখানে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর এর কাজের জন্য লোক নেওয়া হচ্ছে।



বেতন-

এখানে মোটা টাকার দৈনিক মজুরি দেওয়া হবে। দৈনিক 500 টাকা দেওয়া হবে। 



কি কি যোগ্যতা লাগবে-

তেমন কোনো উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু ডেটা এন্ট্রি জ্ঞান, সামান্য ইন্টারনেট সম্পর্কে জ্ঞান এবং স্বচ্ছ বানান লেখার ক্ষমতা থাকলেই হবে। এই কাজের আপনার অবশ্যই laptop থাকতে হবে।



 আবেদন পদ্ধতি---

এখানে অফলাইন ও অনলাইন কোনো রকম আবেদন পত্র জমা করতে হবে না। সরাসরি নিজের নিজের ব্লক অফিসে গিয়ে ডাটা এন্ট্রির কাজের আধিকারিকে এর সাথে যোগাযোগ করুন।  যদি বর্তমানে আপনার এলাকায় ডেটা এন্ট্রি লোক লাগে এবং আপনি যদি এই কাজের উপযুক্ত হোন তাহলে আপনাকে কাজ দেওয়া হবে এবং সম্পূর্ণ কাজের তথ্য আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।


বি.দ্র- এই নিয়োগ টি কোনো সরকারি নোটিশ এ বের হয় না। নিয়মিত খোঁজ রাখুন আপনার ব্লকে। যদি লোক প্রয়োজন হয় তাহলে আপনার সুযোগ আসতে চলেছে।

জয় হিন্দ। জয় ভারত।🙏🙏🙏



 

Thursday, May 26, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -3


 

তিন


কয়েক সপ্তাহ আগে বিধান দত্তের সঙ্গে সুন্দরবন গিয়েছিল ঋজু। বিধানদা কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন। ফিচার লেখেন। বিখ্যাত লেখকের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে দেখানোর জন্য অনেকে যেমন এক-দেড়শো বছর আগেকার কোনও বিখ্যাত লেখকের মেয়ের দিকের অমুক ঘরের তমুক হিসেবে নিজের মিথ্যে মিথ্যে পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেন, কেউ কেউ আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে, নমস্য কোনও লেখকের চোদ্দোতম বা ষোড়শতম বংশধর হিসেবে নিজেকে দেখিয়ে একটা ভুয়ো বংশ তালিকা তৈরি করে ফেলেন। ঠিক তেমনি, উনি কোন ঘরানার লেখক, তা বোঝানোর জন্য, দু’-চার পুরুষ আগের তেমন কোনও বিখ্যাত কবি বা লেখক না পেয়ে, শুধুমাত্র পদবির মিল দেখেই উনি আকড়ে ধরেছেন স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। তাঁর নামে একটা আকাদেমিও ফেঁদে বসেছেন। সেই আকাদেমি থেকে প্রতি বছর এক ঝাঁক কবি-লেখক-সাংবাদিককে পুরস্কার দেওয়া হয়। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তেমন লোককেই বাছা হয়, যার যোগাযোগ খুব ভাল। তার যোগাযোগের সূত্র ধরেই যাতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওই অনুষ্ঠানের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ারা আসে। 
গত বছর যখন এই অনুষ্ঠান হয়, তার কিছু দিন আগে বিধানদা ঋজুকে বলেছিলেন, কয়েকটা পার্টি জোগাড় করে দাও না।
ঋজু অবাক। — পার্টি মানে?
উনি বলেছিলেন, তোমার তো বহু লোকের সঙ্গে জানাশোনা আছে। একটু বলেকয়ে দেখো না, কেউ যদি রাজি হয়।
তখনই ঋজু জেনেছিল, মাইকেল মধুসূদন আকাদেমি থেকে প্রতি বছর মহাধুমধাম করে কখনও গ্রেট ইস্টার্নে, কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ শতবাষির্কী ভবনে, আবার কখনও টাউন হলে যে অনুষ্ঠান হয়, সেখানে প্রচুর টাকা খরচ হয়। বিদেশ থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। কাউকে কাউকে তো যাতায়াতের বিমান ভাড়াও দিতে হয়। তার উপর আছে হল ভাড়া। অনুষ্ঠানের দিন অত লোকের জন্য খাবারের প্যাকেট। আমন্ত্রিতদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেট। কিন্তু আকাদেমির তো অত টাকা নেই। তাই, উনি যাঁদের পুরস্কার দেবেন বলে ভাবেন, তাঁদের সঙ্গে আরও কিছু লোককে উনি পুরস্কার দেন। অবশ্যই একেবারে এলেবেলে লোককে নয়, যাঁর কিছু অবদান আছে, এবং আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট স্বচ্ছল, তেমন লোককে। তাঁদের সঙ্গে আগেই উনি কথা বলে নেন, আপনাকে আমরা পুরস্কার দিচ্ছি, কিন্তু এই অনুষ্ঠানের যে বিপুল খরচ, তার অন্তত কিছুটা আপনাকে ডোনেট করতে হবে। এই শর্তে নাকি বহু লোকই রাজি হয়ে যায়।
দু’-এক দিন পর পরই বিধানদা ফোন করেন, কাউকে পেলে? ঋজুর ভাল লাগে না। ভাবে, কাকে বলব! কী ভাবে বলব! এমন সময় মনে পড়ে গেল গৌর মিত্রের কথা।
ঋজু এক দিন কথায় কথায় ওর অফিসের দেবদূতদাকে বলেছিল, ওর বউয়ের অর্থপেডিক সমস্যার কথা। সেই কবে, বিয়েরও আগে, বড় নালা টপকাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল সে। গোড়ালি থেকে সরে গিয়েছিল হাড়। তিন-চার বার প্লাস্টার করা হয়েছে। বহু ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এখনও রাতের দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। পেন কিলার খেয়ে দিন কাটায়।
দেবদূত কোনও কথা বলেননি। খসখস করে দু’লাইন চিঠি লিখে দিয়েছিলেন এনআরএসের সুপারিনটেন্ডকে। বলেছিলেন, কালই চলে যাস। ও সব ব্যবস্থা করে দেবে।
বউকে নিয়ে পর দিনই ও গিয়েছিল হাসপাতালে। সুপারিনটেন্ড তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙে ব্যস্ত। কখন ফাঁকা হবে কেউ বলতে পারছে না। ঋজু তাই বেয়ারাকে দিয়ে দেবদূতের লেখা চিঠিটা সুপারিনটেন্ডের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। ওখানকারই একজনকে সঙ্গে দিয়ে বলেছিলেন, আমি এখন একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। কিছু মনে করবেন না। ইনি হচ্ছেন গৌরবাবু। আপনাকে নিয়ে যাচ্ছেন। উনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। দেবদূতবাবু ভাল আছেন তো?
করিডর দিয়ে যেতে যেতে গৌরবাবু নানান প্রশ্ন করছিলেন। কী নাম? কোথায় থাকেন? সুপারকে চিনলেন কী করে? কী করেন?
যে-ই শুনলেন, ঋজু আনন্দবাজারের লোক, অমনি তাঁর চেহারা পাল্টে গেল। কাঁচুমাচু হয়ে বলতে লাগলেন, আচ্ছা, আপনাদের রবিবারের পাতায় গল্প দিতে গেলে কী করতে হয়?
তার পর থেকে আর সঙ্গ ছাড়েননি উনি। ডাক্তার দেখানোর পর নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের। চা খাইয়েছিলেন। উনি নাকি বহু দিন ধরে গল্প লিখছেন। উপন্যাসও লিখেছেন। দশ-বারো বছর আগে তাঁর একটা বই বেরিয়েছিল। এ বছর বইমেলাতেও একটা বই বেরিয়েছে। লাস্ট বইটার একটা কপিও তিনি সে দিন ওদের উপহার দিয়েছিলেন। বইটার মলাটে লেখকের নাম দেখেই ঋজু জেনেছিল, লোকটার পদবি মিত্র। গৌর মিত্র। বাসে ফেরার সময় উল্টেপাল্টে দেখেওছিল বইটা। না। আহামরি নয়। তবে খুব একটা খারাপও নয়।
এ দিকে বিধানদা বারবার তাকে তাগাদা দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এসেছে। হাতে আর সময় নেই। যে যা দেয়, দেখো না... ঋজু বুঝতে পারছে, যতক্ষণ না ও কাউকে জোগাড় করে দিচ্ছে, এই লোকটা ততক্ষণ ওকে জ্বালাবে। অথচ তাঁকে কিছু বলতেও পারছে না ও। তাই একদিন গৌরবাবুকে ফোন করে ওই বইটার ভূয়সী প্রশংসা করল সে—  খুব ভাল বই। এই বইটার একটা পুরস্কার পাওয়া উচিত।
গৌরবাবু তো খুশিতে ডগমগ। তিনি বলতে লাগলেন, আমি ভাই নিজেকে একদম নিংড়ে দিয়েছি। আমার লেখায় কোনও ফাঁকি পাবেন না। কিন্তু জানেনই তো, পুরস্কার-টুরস্কার সব লবির ব্যাপার। ও সব আমি করতেও পারি না। যোগাযোগও নেই। চাইও না।
কিন্তু ঋজু যে-ই মধুসূদন আকাদেমির কথা বলল এবং পুরস্কার পাওয়ার শর্তের কিছুটা আভাস দিল, গৌরবাবু যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। নিজে থেকেই বললেন, দেখুন না যদি হয়, যা লাগে দেব। জীবনে তো কিছুই পাইনি। শেষ বয়সে যদি কিছু পাই।
ও বিধানদার সঙ্গে গৌরবাবুর আলাপ করিয়ে দিল। অনেক দর কষাকষির পর দু’হাজার টাকায় রফা হয়ে গেল মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কারের।
না। আর কোনও পার্টি জোগাড় করে দিতে পারেনি ও। তবে তার পর থেকেই, বয়সের বিস্তর ফারাক থাকলেও বিধানদার সঙ্গে ওর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই সখ্যতার সূত্র ধরেই ঋজুকে সুন্দরবন যাওয়ার কথা বলেছিলেন বিধানদা। যদিও এর আগে ঋজু এক বার সুন্দরবন গিয়েছিল। ওর বন্ধু হাননান আহসান একটা মেডিকেল টিম নিয়ে এক বার কুমিরমারি যাচ্ছিল। সুন্দরবনের নাম শুনেই আগ্রহ দেখিয়েছিল ঋজু। হাননান বলেছিল, তা হলে চলুন না আমাদের সঙ্গে।
সে বার সুন্দরবনে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুই দেখা হয়নি তার। ট্রেনে করে ক্যানিং। তার পর মাতলা নদী পেরিয়ে ডকঘাট। সেখান থেকে ট্রেকারে করে সোনাখালি। সোনাখালি থেকে ভটভটি চেপে সোজা কুমিরমারি। খুব ভোরে রওনা হয়েও পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল ওদের। রোগী দেখতে দেখতে রাত। রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে পর দিন ভোর বেলাতেই কলকাতার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। তাই বিধানদা যখন বললেন, উদ্যোক্তারা সুন্দরবনটা ঘুরিয়ে দেখাবে বলেছে, তখন এক কথায় রাজি হয়ে গেল ও।
শ্যামবাজারের মেট্রো স্টেশনের কাছে অপেক্ষা করছিল উদ্যোক্তাদের পাঠানো সাদা আম্বাসাডর। ঋজু গিয়ে দেখে, শুধু বিধানদাই নয়, বিধানদার সঙ্গে তাঁর মেয়েও আচ্ছে। বছর তেইশ-চব্বিশ বয়স। গোলগাল চেহারা। ফর্সা। গড়পরতা বাঙালি মেয়েদের মতোই হাইট। ও যেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
চুটিয়ে ঘুরেছিল ওরা। বিধানদা ওর দাদার মতো। তাই তাঁর মেয়ে শ্বেতাকে ও আর আপনি-আজ্ঞে করেনি। আলাপের সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে তুমি দিয়েই শুরু করেছিল কথাবার্তা। তখনও বাসন্তীর ওই ব্রিজটা হয়নি। গাড়ি নিয়ে ও পারে যাওয়া যেত না। তাই নৌকো করে ও পারে গিয়েই সারা দিনের জন্য ওরা একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে নিয়েছিল। যিনি ওদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তিনি আর বিধানদা বসেছিলেন সামনে। ঋজু আর শ্বেতা বসেছিল রিকশার পেছনে পা ঝুলিয়ে, পাশাপাশি। উল্টো দিকে মুখ করে।
সন্ধ্যা নামছিল। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল। ঋজু হঠাত্‌ শ্বেতাকে বলল, এখন যদি আচমকা একটা বাঘ সামনে এসে পড়ে, কী করবে?
একটু ঘাবড়ে গিয়ে সে বলল, এই, সন্ধেবেলায় একদম এই সব কথা বলবেন না।
— কেন?
— এটা সুন্দরবন না! জানেন না, এখানে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির।
— জানি। সেই জন্যই তো বললাম।
ওরা যখন কথা বলছে, ও দিকে বিধানদা আর ওই সঙ্গী ভদ্রলোক একনাগাড়ে কী সব বকর বকর করে যাচ্ছেন। কিছু একটা আলোচনা করছেন ঠিকই, কিন্তু কী যে আলোচনা করছেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দমকা বাতাস হঠাৎ হঠাৎই কানের কাছে ফরফর করে কানের লতি শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে।
সুনসান সরু রাস্তা। বেশ অন্ধকার-অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশ। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ বাঘের গর্জন। ঋজুর পাশে বসেছিল শ্বেতা। সে ওকে জাপটে ধরল। ঋজু বলল, ভয় পেয়ে গেলে?
— সত্যি, আপনি না, উফ্, এই ভাবে কেউ ভয় দেখায়?
— আবার দেখাব?
— কেন?
— তা হলে আবার এই ভাবে আমাকে...
— ধ্যাত্‌, আপনি না...
বিধানদা আর ওই লোকটা তখন হো হো করে হাসছেন। কেন হাসছেন, ওরা বুঝতে পারল না। এর মধ্যেই এত ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে এসেছে যে, নিজেদের হাত পা-ই দেখা যাচ্ছে না। সেখানে উল্টো দিকে মুখ করে বসা, বিধানদারা নিশ্চয়ই এক মুহূর্ত আগে ঘটে যাওয়া ওদের এই ব্যাপারটা দেখতে পাননি। কী ঘটেছে বুঝতেও পারেননি। নাক দিয়ে তার বাঘের গর্জন করাটা হয়তো শুনলেও, শুনে থাকতে পারেন!
অন্ধকারের মধ্যে চালক হয়তো খেয়াল করেনি। যেতে যেতে ভ্যানরিকশার চাকাটা হঠাৎ গর্তে পড়ে গেল। ভ্যানরিকশাটা ঝাঁকুনি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। অতশত না ভেবে ঝপ করে পেছন থেকে শ্বেতার কাঁধটা চেপে ধরল ঋজু। যাতে পড়ে না যায়।
— এই ছাড়ুন। পিছনে বাবা আছে। খুব চাপা গলায় বলল শ্বেতা। ঋজু বলল, উনি এখন গল্পে মশগুল। আমরা যে এখানে আছি, উনি হয়তো ভুলেই গেছেন।
— যদি পেছনে তাকায়?
— তা হলেও দেখতে পাবে না। এত অন্ধকার...
— আপনি না...
— হ্যাঁ আমি। বলে, ওকে আরও কাছে টেনে নিল ঋজু।

যখন হোগল নদী পার হবার জন্য ভ্যানরিকশা থেকে নেমে ওরা খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছে, ও দিক থেকে একটা লোক ঋজুর সামনে এসে দাঁড়াল, আপনি এখানে?
— ও পারে, ওই কুলতলিতে, নারায়ণতলা রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। তা, এই দ্বীপটাও একটু ঘুরে গেলাম।
— আমাকে চিনতে পেরেছেন?
— না, ঠিক, আসলে...
— আমি প্রভুদান হালদার। ব-দ্বীপ বার্তায় লিখি। বাংলা আকাদেমিতে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল...
— ও, আচ্ছা আচ্ছা। তাই বুঝি? আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন বিধান দত্ত...
— আপনি বিধান দত্ত? আরিব্বাশ। আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। লাফিয়ে উঠল সে। মুখের মধ্যে ঝলমল করে উঠল এক ঝলক আলো। বিধানদার হাত দুটো ধরে সে বলতে লাগল, আমি ভাবতেই পারছি না, আপনার মতো একজন লোকের সঙ্গে এখানে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে। আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। আপনার নাম তো গত বছর নোবেল প্রাইজে উঠেছিল, তাই না?
বিধানদা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এক বার ঋজুর দিকে তাকাচ্ছেন আর এক বার লোকটার দিকে। তার পরেই লোকটাকে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল। একটু কথা বলতে পারলে আরও ভাল লাগত। কিন্তু আমাদের আবার তাড়া আছে। অনেকটা যেতে হবে তো... ও পারে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। আপনার সঙ্গে পরে আবার কথা হবে, কেমন?
লোকটার চোখমুখ পাল্টে গেছে। আনন্দে আপ্লুত। যে-কোনও দিন নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন, এমন একটা লোকের সঙ্গে যে এই জায়গায়, এই ভাবে তার দেখা হবে যাবে, তা বুঝি সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই, যাবার জন্য বিধানদা উসখুশ করলেও লোকটা কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে চাইছিল না। ঠিকানা নিল। ফোন নম্বর নিল। তার পর কোনও রকমে রেহাই দিল।

পর দিন কলকাতায় ফেরার সময় গাড়িতে আসতে আসতে ঋজুকে বিধানদা বললেন, কলকাতায় গিয়ে কিন্তু কালকের রাতের ব্যাপারটা আবার কাউকে বলে দিও না। যা সব লোকজন। এই নিয়ে আবার হাসাহাসি করবে। ও, ভাল কথা। সামনেই তো আমাদের অনুষ্ঠান। হাতে আর সময় নেই। ম্যামেনটো-ফ্যামেনটো সব হয়ে গেছে। না হলে কবিতার জন্য এ বারই তোমাকে একটা পুরস্কার দিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু কী করব! তুমি বরং একটা কাজ করো, অনুষ্ঠানের দিন পুরস্কার পর্ব মিটে যাওয়ার পরে তুমি তোমার পছন্দের লোকজন নিয়ে একটা কবিতা পাঠের আসর করে দাও। কী, কেমন হবে?

বিধানদা বলে দিয়েছেন। আর কোনও চিন্তা নেই। ঋজু উঠে পড়ে লেগেছে। একে ফোন করছে। তাকে ফোন করছে। কে কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, কার সঙ্গে কার গাঁটছড়া, কাকে নিলে আখেরে তার লাভ, এই সব সাত-পাঁচ ভেবে, হিসেব-নিকেশ করে সে তালিকা তৈরি করছে। কাকে নেওয়া যায়! কাকে নেওয়া যায়! কাকে নেওয়া যায়!
তালিকা তৈরি। কিন্তু আজ সকালে কণিকার অমন একটা ফোন পাওয়ার পর তাকে না রাখলে হয়! তাই, সেই তালিকার প্রথমেই লেখা হয়ে গেল কণিকার নাম। পরমার্থকে এক বার দেখিয়েও নিল সে, কোনও অসুবিধে নেই তো? এক ঘণ্টার ওপর সময়। সাতাশ জন কবি। তিন মিনিট করে এক-একজন পড়লেও, সবাই তো আর ঘড়ি দেখে পুরো তিন মিনিট করে পড়বে না। কেউ কেউ ছোট কবিতাও পড়বে। আবার দু’-একজন নাও আসতে পারে। হয়ে যাবে না?

ফোন করে কবিদের তালিকাটা শুনিয়েও দিল বিধানদাকে। তিনি কোনও উচ্চবাচ্চ্য করলেন না। শুধু বললেন, এত জন! অত সময় হবে! সবাইকে একদম ছোট্ট ছোট্ট কবিতা পড়তে বলবে, কেমন? না হলে কিন্তু সময়ে কুলোবে না। সাড়ে ন’টার মধ্যে হল ছেড়ে দিতে হবে। না হলে কিন্তু কশন মানি থেকে ওরা পাঁচশো টাকা কেটে নেবে।
ঋজু বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। সব হয়ে যাবে। বলেই, ফোন করল কণিকাকে। একটা বাচ্চা মেয়ের গলা, মা এখনও আসেননি।
— এখনও আসেননি! দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল ঋজু। আটটা বেজে গেছে। ঠিক আছে, পরে করব, বলেই, তালিকায় নাম লেখা কবিদের একটার পর একটা ফোন করতে লাগল সে। আর কথা হওয়ামাত্রই সেই নামের পাশে বসিয়ে দিতে লাগল একটা করে টিক চিহ্ন।
পরে, মেলাতে গিয়ে দেখে সবাইকেই ফোন করা হয়েছে। শুধু কণিকাকে ছাড়া। রাত তখন এগারোটা বেজে গেছে। ও মনে মনে ভাবল, এত রাতে ফোন করাটা কি ঠিক হবে! তার পরেই মনে পড়ল, ও তো বলেছিল, যখন খুশি ফোন করতে পারেন। একটা, দুটো, তিনটে। সেই তুলনায় তো এখন সবে সন্ধে।
ও ফোন করল। দেখল, এনগেজড। খানিকক্ষণ পর আবার করল। তখনও তাই। তার আধ ঘণ্টা পরেও, ওই একই। শুধু এনগেজড আর এনগেজড। আর একটা নম্বর ছিল। মোবাইলের। সেখানেও করল। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রেকর্ডেট গলা, আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি এখন পরিষেবা সীমার বাইরে।
দু’মিনিট পর আবার করল। এ বার ভেসে এল— এই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। ঋজু অবাক। একটু আগেই বলল, পরিষেবা সীমার বাইরে, এখন আবার বলছে এই ফোনের কোনও অস্তিত্ব নেই! এই নম্বরটা তো ও-ই দিয়েছিল। তা হলে কি ও ভুল নম্বর দিল! কিন্তু খামোকা ভুল নম্বর দিতে যাবে কেন! তা হলে কি আমিই টুকতে ভুল করেছিলাম! আর এক বার দেখি তো, ফের ফোন করল ও। শুনতে পেল সেই একই কথা। তার পরেও বেশ কয়েক বার ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছে ও। এমনকী, অফিস থেকে যখন বেরোয়, সেই রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ, তখনও তার ফোন ব্যস্ত।



                                   ক্রমশ...





দ্বিতীয় পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন- 



চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-