Friday, June 3, 2022
ছোট গল্প - হীরা রহস্য || লেখক - আশিস চক্রবর্তী || Short story - Hira Rahasya || Written by Ashis Chakrabarti
Thursday, June 2, 2022
ছোট গল্প - অরূপ রূপকথা || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Arup Rupkotha || Written by Rokeya Islam
অরূপ রূপকথা
রোকেয়া ইসলাম
আজান শেষ হতেই দরজা খুলে উঠোনে নামে মেঘবতী। কলপাড়ে গিয়ে বুঝতে পারে চায়না ঘুম থেকে ওঠেছে বেশ আগেই, ওর ফরজ গোসল সারা হয়ে গেছে। ভেজা কাপড় বালতিতে করে এককোণায় রেখে দিয়েছে যাতে কারো নজরে না আসে যে ও স্বামী সহবাস করেছে মেয়েটার লাজলজ্জা, আক্কেল বেশ টনটনে। ওজু সেরে ঘরের পৌটায় পা রাখতেই কল চাপ দেবার দেবার শব্দে পেছন ফিরে দেখে চায়না কল চেপে বালতি ভরছে।
মতিমিয়া ঘর থেকে দ্রুত উঠোনে নেমে কলপাড়ে গিয়ে অজু করে মসজিদের পথ ধরে। মেঘাবতী স্বস্তির মনে জায়নামাজ পেতে নামাজে দাঁড়ায়।
চায়না বাঁসি কাজ সেরে গোয়াল থেকে গরু বের করবে খোপ খুলে মুরগী বের করে কুঁড়া মাখিয়ে মুরগীগুলোকে খেতে দেবে, তই তই করে হাঁসগুলো আলাদা করে তাদের খেতে দেবে। গরুর চাড়িতে পানি দেবে, খড় কেটে গরুকে খেতে দিয়েই, বাড়ির মানুষের জন্য সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করবে একা হাতে।
মসজিদে নামাজ শেষে দোয়া কালাম পড়ে বাজারে গিয়ে বসে চা পান করে মতিমিয়া। আগে এই চায়ের অভ্যাস ছিল না। শুধু চা কেন অনেককিছুরই অভ্যাস ছিল না। এই যে এখন চা পানের পর হেঁটে হেঁটে বাজারের এমাথা ওমাথা ঘুরে মাছ তরকারি কিনবে। প্রতিদিন দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস এটাও ছিল না ওদের পরিবারে।
গাছের পাকা দিয়ে গাইয়ের দুধ দিয়ে রাতে ভাত খায়, ঘরে কলা শেষ হলেই বাজার থেকে কিনে আনবে গাছপাকা কলা।
ভাল কলা না পেলে গুড় কিনবে।
গুড় আবার এই বাজারে পাওয়া যায় না। এই বাজারটা হলো প্রতিদিন বেলা ওঠার আগে থেকে বসে আবার সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়তেই শেষ হয়ে যায়।
আশেপাশের নদীপাড়ের মানুষেরা সারারাত মাছ ধরে বেশিরভাগই আড়তে চলে যায় খুচরোগুলো এই বাজারে তোলে। জাংলার লাউ ঝিঙে কুমড়া সিম জাতীয় তরতাজা সবজি।
ভুঞাপুরে কোন কাজে গেলে সুবাসিত সাবান ডিটারজেন্ট পাউডার নারকেল তেল পোয়াটাক আঙুল আপেল পাউরুটিও কিনে আনে। আগে এগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতো, আর এখন দরদাম করে ধোয়াকাঁচা পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা বের করে সওদা নিয়ে হৃষ্টমনে মাথা উঁচু করে বের হয়।
আজ গ্রামের বাজার থেকে কিনেছে নধর দেখে একমুঠো ডাটা এক কেজি বেগুন আর এক ভাগা চেলা মাছ।
হাঁটতে হাঁটতে নধর ডাটাগুলোর দিকে তাকায়, তাজা মাছ দিয়ে রান্না করা তরকারি স্বাদ কেমন হবে, ভাবতেই পথ শেষ হয়ে যায়।
বাড়িতে ঢুকে শ্যাফালী বলে ডাক দেয়। ছোটমেয়ে এসে সদাই-পাতি বাবার হাত থেকে নিজের হাতে নেয়।
মতিমিয়া কলপাড়ে গিয়ে দেখতে পায় পানি ভরা বালতিতে লাল প্লাস্টিকের মগ ভাসছে। কাছেই প্লাস্টিকের নীলরঙা টুল।
ভেতর থেকে তৃপ্তির নিঃশ্বাস বের হতেই কপালে একটা ভাঁজ ভেসে ওঠে।
ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে খারমানের পাতা আর কালিজিরার ভর্তা দিয়ে এক থালা বৌখুঁদা এগিয়ে দেয় চায়না, মেঘাবতী একগ্লাস পানি নিয়ে সামনে বসে। সাথে সাথেই দুই ছেলে এসে বসে তাদের সামনেও ভরা থালা এগিয়ে দেয় চায়না,
শ্যাফালী ও শ্যাফালী তুইও খাইয়া ল, আবার তো স্কুলে যাওন লাগব।
ননদ আর শাশুড়ীর খাবারের থালাও দিয়েই, উঠোনে ধান শুকোতে দেয় চায়না।
ওদের খাওয়া শেষ হতেই এঁটো বাসন গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে কলপাড়ে নিয়ে ধুয়ে উঠানের কোনায় ছোট্ট মাচায় উপুর করে দেয়, রোদে শুকোবে এগুলো।
স্বামী আর দেবর বের হয়ে যায়, শেফালীও স্কুলে যায়।
মাছগুলো কুঁটে ধুয়ে ছিঁকায় তুলে রাখে।
ও বউ তুমি খাইলা না, খাইয়া লও। বাইড়া থুইছি তো তুমার খাওন। লও খাইয়া লও।
হাতের কামডি সাইরা লই
এতোক্ষণে চায়নার গলার আওয়াজ শোনা গেল । মুখ বন্ধ করে সংসারের সব কাজ করে যায় অবশ্য কেই বা ওর সাথে কথা বলে । ওর স্বামীও দিনে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ। বলবে কেন প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কি শুধু প্রয়োজনীয় কথাই থাকে , কত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে হাসি কথা তো থাকতে পারে।
কথা হাসি তো দূরে থাক ওকে সাথে নিয়ে কখনও বাবার বাড়িতে পর্যন্ত যায় না।
এই যে এখন বাড়ীতে শুধু বউ শাশুড়ী, তাও তো তেমন কথা হবে না দুজনের। একটু পরে উঠোনের কোনে খোলা চুলার পাড়ে গিয়ে কি দিয়ে কি রান্না হবে সেটুকু বলবে, সাথে আরো কোন কাজের কথা থাকলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলবে।
মতিমিয়া ভুঞাপুর থেকে ফিরলো, উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়
শ্যাফালি ও শ্যাফালি কোনে গেলি
চায়না ঘোমটা তুলে দৌড়ে গিয়ে শুশুরের পাশে দাঁড়ায়
শ্যাফালি স্কুল থন আহে নাই অহনতরি, দেইন আমার থন দেইন।
চায়নার শব্দ শুনে মুখটা বিরক্তিতে অন্যদিকে ঘুরাতে গিয়ে চোখ আঁটকে যায় বড় ঘরের টিনের চালে কালো রঙের দুটো কবুতর খুনসুটি করছে, ধারেকাছে ডাকছে কুটুম পক্ষী, । আস্তে করে ব্যাগটা চায়নার হাতে তুলে দিয়ে দ্বিধান্বিত মনে কলতলায় যায়।
বারান্দায় পাটি পেতে খাবারের আয়োজন করেছে চায়না । শাশুড়ী পিঁড়ি পেতে বসে সবাইকে খেতে দেয়।
চায়নার হাতের রান্না খুব স্বাদের। ওর মায়ের কাছ থেকে এই গুণ ও পেয়েছে , খাবারের স্বাদ বুঝিয়ে দেয় ধনী খানেয়ালা ঘরের মেয়ে চায়না।
এতো পদ দিয়ে আগে কখনও ভাত খেতো না ওরা। তিনবেলা গরম খাওয়াই তো জুটতো না। মাসুমের বিয়ের পর মেঘাবতীর সংসারের চাকা ঘুরে গেছে। যদিও সবাই পরিশ্রম করছে, আগেও তো পরিশ্রম করতো তখন তো অন্ধকারই থাকতো সংসারের চৌহদ্দি জুড়ে।
চার ছেলে দুইমেয়ে আর স্বামী স্ত্রী দুজন এই আটজনের সংসারে জমি ছাড়া আর কোন আয়ের পথ ছিল না, বড় ছেলে আই এ পাশ করে চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে ধাক্কা খায়, বিরাট অংকের ঘুষ ছাড়া তো চাকরির পথ আঁধারে ঢাকা। ওদের কোন বড় চাকুরীওয়ালা আত্মীয় স্বজনও নেই।
টাকা কোথায় পাবে মতিমিয়া। বড়মেয়েটাও বিয়ের লায়েক হয়ে যায় মেঝ ছেলেও মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। দিকদিশা হারিয়ে মতিমিয়া কিছু ধানীজমি বিক্রি করে দিয়ে বড়মেয়ের বিয়ে দেয়,
গ্রামের একজন শহরে ছোট চাকরি করে কিন্তু তার ক্ষমতাবান বড়সড় বসের সাথে দহরমমহরম আছে, সেই বেশ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পিয়নের চাকরিতে বহাল করে বড়জনকে।
মেঝছেলেও বড়টার পথ ধরে। মুটামুটি ধানীজমি শেষের পথে নিয়েই তাদের চাকুরী যাত্রা।
শেষ সম্বল যেটুকু ছিল তাও নদী নিয়ে নেয়।
শহরে চাকরিওয়ালা দুছেলে মতিমিয়ার সংসারে কোন টাকাপয়সা দিতে পারে না, তাদের সংসার নিয়েই দুর্মূল্যের বাজারে হিমসিম অবস্থা।
মাসুমও লেখাপড়ায় তেমন ভাল নয়, আর ভাল হলেই কি চাকরি তো টাকা ছাড়া হবে না। নতুন করে টাকার সংস্থান করা অসম্ভব।
অভাবে ভিটামাটি আঁকড়ে ধরে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে কর্মের অনিশ্চয়তায় দিনগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে জীবন নামক অচেনা কঠিন পথে।
ইব্রাহিম ঘটক তালতলা গ্রাম থেকে মাসুমের বিয়ের প্রস্তাব আনে।
চায়নার বাবা কুইট্ঠাল ধনী। দুই ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। মেয়েদেরও ভাল ভাল বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে বড় বড় ডোঁয়া পাকা টিনের ঘর, গোয়াল ভরা গরু, বাইরে পেল্লাই খড়ের পালা।
এ বাড়ির মেয়েদের ভদ্র নম্র হিসাবে নাম আছে।
এখানে বিয়ে করালে বেশকিছু নগদ টাকা যৌতুক পাওয়া যাবে, তা দিয়ে মাসুম ব্যাবসা শুরু করতে পারবে, বাবার বাড়ির সম্পত্তির ভাগও কম পাবেনা ছোটমেয়ে।
সব শুনে প্রস্তাবটা লুফে নেয়।
ইব্রাহিম ঘটকের সাথে কন্যা দেখতে তালতলা গ্রামে যায় মতিমিয়া।
দুইবার কয়েক পদের পিঠা সেমাই ক্ষীর ঢাকাইয়া বিস্কুট কাপে করে চা, তারপর রোষ্ট ঝাল গোশত দিয়ে কড়ির প্লেটে সুবাসিত ধোয়া ওঠা পোলাওয়ের পর মেয়ে দেখে সব খাবার গলা দিয়ে ওঠার উপক্রম হয়।
কোনমতে ছাতা বগলে ফেলে রওনা হয় বাড়ির পথে।
সাতদিন পর ইব্রাহিম ঘটক বোঝায়" রুপ ধুইয়া কি পানি খাইবা মিয়া, রুপ দেখবা একদিন আর নগদ যা পাইবা হেডা নাড়াচাড়া কইরা চলতে পারবা হারাজীবন। ভাইরাও চাকরি করে ভাইগনা ভাগনি অইলে হ্যারাই চাকরির ব্যাবস্থা করব, মোটের উপর তুমি মিয়া নিচন্তা অইলা।
বড় দুইডা বিয়া করাইছো কি পাইছো বউ ছাড়া।
নগদ আরো একলাখ, দুই ভরির গহনা বাড়াইয়া মুখের মধ্যে "কইষট্রা বরুই "পুরে বিয়ে করায়।
বউ দেখে গ্রামের মানুষ আড়ালে বলে, বউ না মতিমিয়া ট্যাহার বস্তা বিয়া করাইছে।
মুখফোঁড়া কেউ কেউ সামনেই বলে ফেলে
কি গো মতিমিয়া পোলা কি ট্যাহার লগে হুইব না বউর লগে হুইব। মুহের দিকে চাইলে তো জিনিস খাঁড়াইব না।
মতিমিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে আসে, উত্তর দিতে পারে না। সংসারের অর্থনৈতিক দুর্গতি, দুই ছেলে তাদের সংসার নিয়ে হিমসিম, এটা তাদের কাছে বাপের সংসার, এটা চালাবার দায় তাদের নয়। ঘাড়ের উপর বেকার দুই ছেলে ছোটমেয়েও হাত পা ঝাড়া দিয়ে ওঠছে। জমি বিক্রি করে শেষ, বাকিটুকু যমুনার অতলে।
মাসুমকে বিয়ে করিয়ে নগদে কিছু পাওয়া গেল।
শরীককের বড়ভাবী তো মুখের উপর বলেই ফেললো
মতিভাই পুলাডারে জব দিলা নিজের আতে। ঘরে যুদি সুখ না পায় ট্যাহা দিয়া কি অইব।
ভাবী ট্যাহাই অইলো আসল সুখ, ট্যাহা গুননের সুখের লগে জগতের আর কুনু সুখ মিলে না।
বলে আর দাঁড়ায় না, হনহন করে সড়কে ওঠে নদীর দিকে হেঁটে যায়।
মতিমিয়া কি আউস কইরা পুলার ঘরে পেত্নী হান্দাইয়া দিছে। বড় দুই পুলার বৌ ধলার কাছাকাছি গায়ের রঙ নাক মুখ চোখের ডিল গঠন ভাল। হেডায় অইছে কি? চেহারা ছবি ভালা অইলে
হেই বালা দিয়া কি করুম, গরম ভাতের লগে সেদ্ধু দিয়া নুন মরিচ দিয়া ডইলা ভর্তা কইরা খামু "
বিয়ের পরদিন সকালে মাসুমকে নদী থেকে গোসল করে আসতে দেখে মনের ভেতরে গেঁথে রাখা পাথরটা নেমে গেছে।
বিয়ের আগেরদিন মেঘাবতী ফিসফিস করে বলছিল মাসুম বড়মেয়ের কাছে বলেছে" বাবা আমারে কুরবানির ষাড় পাইছে আর কেরু নগে পারলো না আমারে হাটে তুললো, আমার মনডা বাপে বুঝলো না।
তারপর থেকেই মনটার ভেতর পাথর ছিল।
যাক শরীরের সাথে শরীর তো মিলছে এই মিলেই সব মিলিয়ে দেবে।
বিয়ের পরদিন থেকেই বুঝতে পারে বৌটা অন্য দুই বৌয়ের মত না এ একেবারেই আলাদা ।
বিয়ের কাজকর্ম মিটে গেলে তিন বাপবেটায় মিলে বুদ্ধি করে সড়কের কোণায় ঔষধের দোকান দেয়। গ্রামের একজন স্কয়ার ফার্মাসিস্টের ম্যাডিকেল রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ হিসাবে আছে, সে মাসুমকে একটা ঔষধ বিষয়ক বই দেয়, কোন ঔষধের কি কাজ।
কয়েক মাসের মধ্যে কিছুটা সচল হয় সংসারের চাকা।
চায়নাও বাড়ির আশেপাশে সবজির গাছ লাগায়, মতিমিয়া জাংলা তুলে দেয়, হাঁস মুরগী পালতে শুরু করে। চায়না ওর বাবার কাছ থেকে দুধ খাবে বলে দুধেল গাই নিয়ে আসে।
মোটামুটি বছরখানেকের মধ্যে সংসারের অভাবের চাকা ঘুরে সচ্ছলের পথ ধরে, মতিমিয়া ধোয়া লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে আসরের নামাজ শেষ করে সড়কের চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খায়, টিভিতে খবর শোনে নায়ক মান্নার ছবি দেখতে দেখতে মাসুমের দোকানে চোখ রাখে, মাসুমের দোকানটা বড় করা খুব দরকার, সেটাও হয়ে যায়।
মাসুম ছয়মাস ট্রেনিং নিয়ে এসে এলাকায় মাসুম ডাক্তার নামে পরিচিত।
মাসুম ডাক্তারের বাবা মতিমিয়া ধানী জমির পরিমান বাড়াচ্ছে, বাড়িতে মাসুমের ঘরটার মেঝে পাকা করা হয়েছে ফ্রিজ কেনা হয়েছে।
মোটামুটি টাকার বাদ্যটা বাজছে। মসজিদ কমিটিতে স্থান পেয়েছে, মুরুব্বি হিসাবে বিচার শালিসে ডাক পায়।
ঢাকায় বসবাসরত ছেলেরাও মাঝেমাঝে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসে। বড়মেয়েটাকে মাসে একবার নাইওর আনে। চায়না বছরে একবারও বাবার বাড়িতে যেতে চায় না। ওর বাবা জোর করে বছর একবার নিয়ে যায়।
চায়নার কোল আলো করে একছেলে এক মেয়ে আসে সংসারে।
সব চলছে নির্বিঘ্নে তবুও যেন কিছুই চলছে না। চায়না সব জায়গায় আছে তবুও কোথায়ও ও নেই।
রান্না করলেও সামনে বসে বেড়ে খাওয়ায় না। সবার সাথে বসে খায় না,সংসারের সব কাজকর্ম একা করলেও সামনে আসে না কখনো, সবসময় আড়ালে থাকে।
এটাই যেন অলিখিত নিয়ম।
চায়না মাঝে মাঝে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে ভুঞাপুর বাজার থেকে নিজের একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে। মাসুম ব্যাস্ততায় চায়নার জন্য কিছু কিনতে পারে না।
মাসুম শরীকের ভাবীদের জন্য চানাচুর বাদামটানা মুরলি নিমকি জিলাপি কিনে আনে, ভাবীরা ওর ভাগেরটুকু দিয়ে যাবার সময় রসালো মন্তব্য ছেড়ে যায়। চুপচাপ শুনে যায়। চায়না জানে ওরা ওর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলছে।
খাবারগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না চায়না।
আগে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারে শুধু স্খলনের জন্য সঙ্গম হয় মাঝেমধ্যে রাতে। কোনরকম আদর স্পর্শ পায়নি কোনদিন মাসুমের কাছ থেকে চায়না। কথাও তো হয় না।
শুধু ওর প্রভাবশালী বাবার অর্থ এবং আর্মির চাকুরে ভাইদের ভয়ে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি কিন্তু চায়না নিজ থেকে যেন চলে যায়, তার সব ব্যাবস্থা করেছে।
চায়না দাঁতে দাঁত ঘষে পড়ে আছে এ বাড়িতে।
শশুর শাশুড়ী ভাসুর জা ননদ ননাস কে না ওকে শুনিয়ে রুপের খোটা দিয়েছে, চায়না কারো কোন কথার জবাব দেয়নি কোনদিন।
এবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের আর কিছু থাকুক না থাকুক গা ভরা রুপের জৌলুশ আছে,
নিজের বাবাকেও কোনদিন বলে নি ওকে চায় না বলেই কি ওর নাম চায়না রেখেছে। মায়ের পেটের সুন্দর মুখশ্রীর ভাই বোনরাও কোনদিন ওর সাথে ভাল করে কোন কথা বলেনি, সবসময়ই দূরত্ব রেখেছে।
ও বুঝতে পারে সব, নিজের মত করে উত্তরও তৈরি করে নেয় ভেতরে।
কঠিন পথ ওর একার, চলতে হবে একা। এই বোধ ওকে সোজা রাখে সমাজের বিরুদ্ধে সংসারের বিরুদ্ধে আপনজনের বিরুদ্ধে। রুপের বিরুদ্ধে।
তাই তো
শুধু সংসারের আয় বাড়িয়ে গেছে। নিজের জমার অংকটিও কম নয় আজ।
ওর আয়ের উৎস ওর পায়েরতলের শক্ত মাটিটা চেনে, মাসুম, মতিমিয়া মেঘাবতী তাই হয়তো বিষ হজমের মত করে ওকে মেনে নিয়েছে।
ছোটখাট গড়নের শ্যামলারঙের চায়নার দুচোখের নিচ থেকে চিবুক অবধি মিশমিশে কালো রঙের জন্ম জরুল। চোখ দুটো কুতকুতে, চওড়া কপালে বসে আছে কুচকুচে ভ্রমর ভ্রু হয়ে, গোয়াথুবি চুল।
ওকে ভয় হয় ঘৃণা হয়। ভালবাসা উবে যায় করুণাও হয় না
চায়নার মেয়েটা কোনদিন ওর গলা জড়িয়ে ঘুমায়নি। শেফালী ফুফুর সাথে ঘুমায় সারাদিন দাদির সাথে থাকে, ছেলেটাকে মায়ায় কাছে টানতে গেলে ভয়ে দূরে সরে যায়।
ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল চায়নার বিছানায়, প্রচন্ড গরম পরেছে, গ্রামের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় বিদ্যুৎ চলে যাওয়া।
গরমে হাত পা নাড়ছিল।
শুকনো কাপড় তুলে ঘরে রাখতে গিয়ে চোখে পরে ছেলেটা ঘামছে, গরমে এখুনি জেগে যাবে। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে ছেলেটাকে।
চায়নার নিজেও কাজে করতে করতে ক্লান্ত, চোখ বুজে আসে, ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে ওকে বাতাস করতে থাকে,
আহা বড় আদরের সন্তান ওরা চায়নার।মমতার হাত বুলিয়ে দেয় তার নাড়িছেঁড়া ধনের গায়ে।
জেগে যায়, চায়নার চোখে চোখ রাখে, হেসে চায়না ওকে জড়িয়ে ধরতেই আত্মা ছিঁড়ে চিৎকার করতে থাকে ভয় পাই ভয় পাই বলে। শাশুড়ী দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিতেই কান্না বন্ধ হয় ছেলের।
আয়নার সাথে ওর কোনদিন সখ্য ছিল না, আজ সারাদিন আয়নায় সাথে কাটিয়ে দেয় চায়না।
আয়নায় ভেসে ওঠে আশ্চর্য অরুপ - রুপকথার সংসার।
সকালে মেঘাবতী দেখে সমস্ত মুখমন্ডল ওড়নায় ঢেকে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে চায়না।
আর কোনদিন মুখের আবরণ খুলেনি....
উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -4
চার
ট্রেনে উঠেই কণিকার মোবাইল থেকে সাকিলকে ফোন করল ঋজু— সাকিল, দশটা পাঁচের লোকালটা ধরতে পারিনি। এগারোটা সতেরোটা ধরলাম। এখন পার্ক সার্কাস ক্রশ করছে। তুই তো জানিস যেতে কতক্ষণ লাগবে, হিসেব করে সেই মতো তুই কিন্তু স্টেশনে থাকিস। না হলে সমস্যায় পড়ে যাব।
সাকিল ওর বন্ধু। আজকালে কাজ করে। থাকে ডায়মন্ড হারবারে। পুলিশ মহলে খুব খাতির। মগরাহাট থানার ওসি অরিন্দম আচার্য কী ভাবে মাছওয়ালাদের সঙ্গে জেলে সেজে ওখানকার কুখ্যাত ডাকাতকে ধরেছিল, সে খবর ফলাও করে ছেপে সবার নজর করেছে। ওর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কুসুমের ফেরা’-র তরফ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠান করে। এ বছর করেছিল ডায়মন্ড হারবার থানার নীচে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একশো জনেরও বেশি গুণিজনকে ও সংবর্ধনা দিয়েছিল। তাতে যেমন ছিল নাট্যকর্মী, গায়ক, সমাজসেবী, উপন্যাসিক থেকে শুরু করে ওর বস্ কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, তেমনি সংবর্ধিত হয়েছিল আর পাঁচ-ছ’জন কবির সঙ্গে ঋজুও।
সেখানেই ঋজু দেখেছিল, পুলিশরা কী ভাবে ওকে খাতির করে। স্থানীয় হোটেল-রিসর্টের মালিকরা প্রায় সকলেই সেখানে হাজির। তাদের কেউ স্পনসর করেছে স্মারক, কেউ ফুলের তোড়া, কেউ আবার উত্তরীয়।
সেই অনুষ্ঠানেই সাকিল ঘোষণা করেছিল, খুব তাড়াতাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাংবাদিকদের জন্য একটা প্রেস ক্লাব তৈরি করতে যাচ্ছে তারা। জমি পাওয়া গেছে। কিছু আর্থিক সাহায্যও এসে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।
সে দিন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঋজু আর ফিরতে পারেনি। শুধু ঋজু নয়, কলকাতার আরও কয়েক জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ফোনেই করে ফেলেছিল সাকিল। তাই, তার দু’দিন পরেই সাকিলকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, তোর তো ওখানে খুব দাপট দেখলাম। শোন না, বলছিলাম কি, ওখানকার কোনও একটা হোটেলে ব্যবস্থা করে দে না, কয়েক ঘণ্টার জন্য।
— ব্যবস্থা করার কিছু নেই। যে দিন খুশি চলে আয়।
— না, আগে থেকে না বললে...
— ধুর, চলে আয় না।
— না, মানে, আমি একজনকে নিয়ে যাব তো, তাই বলছিলাম...
— যখনই হোটেলের কথা বলেছিস, তখনই বুঝে গেছি। কত লোক আসে। তোর কোনও চিন্তা নেই। চলে আয়।
— বলছিলাম কি, পুলিশের কোনও ঝামেলা-টামেলা হবে না তো?
— আমি তো আছি, না কি? চলে আয়।
— কী রকম নেয়-টেয় রে?
— তোকে ও সব ভাবতে হবে না। যে দিন আসবি, তার আগের দিন শুধু একটা ফোন করে দিবি, ব্যাস। আমি স্টেশনে থাকব।
ঋজু এর আগে কখনও কোনও মেয়েকে নিয়ে শহরের বাইরে যায়নি। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে শুধু এক বার হেদুয়ার কাছে সান ফ্লাওয়ার নার্সিংহোমের সামনে দেখা করেছিল শালিনীর সঙ্গে। তাকে দেখে ওর একদম পছন্দ হয়নি। যেমনি গায়ের রং, তেমনি দেখতে। তেমনি তার পোশাক-আশাক। ওই রকম একটা ছেঁড়া ছেঁড়া রং-চটা স্যান্ডেল পরে কেউ প্রেম করতে আসে? ছিঃ। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। গিয়ে, হুট করে চলেও আসা যায় না। তাই ট্যাক্সিতে নয়, সেখান থেকে ওকে নিয়ে বাসে করে দেশবন্ধু পার্কে গিয়েছিল ও। ইচ্ছে না থাকলেও শালিনীর সঙ্গে একটা গাছের তলায় বসেছিল। শালিনীই আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, কিছু দিন আগে ওই ঝোঁপের আড়ালে কারা খুব খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছিল। বলেছিল, এই, জানো তো, কলেজ স্ট্রিটের কাছে বাটা আছে না, তার পাশ দিয়ে রাজাবাজারের দিকে খানিকটা গেলেই ডান হাতে একটা সিনেমা হল আছে— জহর। চেনো?
ঋজু ‘না’ বলাতে ও বলেছিল, ওখানে না, এ মার্কা বই দেখানো হয়। আমি কোনও দিন দেখিনি। যাবে?
— মেয়েটির কথা শুনে বড় অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। প্রথম সাক্ষাতেই কোনও মেয়ে এ রকম কথা বলতে পারে! ভরদুপুরে শুনশান পার্কে চারপাশ ফাঁকা পেয়েও চুমু তো দূরের কথা, তার হাতটাও ছুঁতে ইচ্ছে করেনি ওর। বসার খানিকক্ষণের মধ্যেই ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে’ বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়েছিল সে।
তার পর দিনই ছিল বিধানদার অনুষ্ঠান। মহাজাতি সদনে। আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত বারবার ফোন করেও না পেয়ে, পর দিন সকালেই অফিসের ফোনে কণিকাকে ধরেছিল ঋজু। ওখানে কবিতা পাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সাড়ে পাঁচটায়। বিধানদা ওকে বলে দিয়েছিল সাড়ে চারটের মধ্যে হলে ঢুকে পড়তে। প্রচুর কাজ আছে।
ঋজু এসে দেখে, বিধানদারা তারও আগে চলে এসেছেন। মঞ্চে চেয়ার পাতা হচ্ছে অতিথিদের জন্য। ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে টেবিল। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল শ্বেতার দিকে। ও আজ হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। এ শাড়িতে ও এর আগেও ওকে দেখেছে। ময়দানের বঙ্গ-সংস্কৃতি মেলায়। সেখানে ও শুধু একা নয়, ও যেখানে গান শেখে, সেই স্কুলের এক ঝাঁক মেয়ে এই রকম শাড়ি পরে গান গেয়েছিল, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে...
মাথার উপরে তখন গনগন করছে সূর্য। দর্শক বলতে যারা গান গাইছে তাদের অভিভাবক আর উদ্যোক্তাদের কয়েক জন। সঙ্গে বিধানদা ছিলেন। তাই, সুন্দরবনের ভ্যানরিকশায় অমন নিবিড় একটা ঘটনার পরেও ‘কী, কেমন আছ’, ‘ভাল তো?’, ‘তোমার তো দারুণ গলা’ ছাড়া তার সঙ্গে আর কোনও কথা হয়নি ঋজুর।
আজ তৃতীয় বার, তার সঙ্গে ওর দেখা হল। হল চোখাচোখিও। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পরেই একটু লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল শ্বেতা।
কিন্তু শ্বেতা নয়, ঋজুর তখন মন ছটফট করছে কণিকার জন্য। ও আসবে তো! একে একে তখন অনেকেই এসে গেছে। এসে গেছে তারাও, ও যাদের কবিতা পড়ার জন্য আসতে বলেছে।
ওকে উদ্বিগ্ন দেখে গণেশ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মিহির বলল, একটু ধীরস্থির হয়ে বসো। অত টেনশন করার কিছু নেই। রিনা বলল, শুনলাম, কণিকাকেও ফোন করেছিলেন?
ও বলল, হ্যাঁ। তার পরেই জানতে চাইল, আশিস আসেনি?
রিনা বলল, এসে যাবে। মহাদেববাবুকে বলেছেন নাকি?
— মহাদেববাবুকে? কই, না তো। যাঃ, একদম ভুলে গেছি। দেখেছেন... মুখে এ কথা বলল ঠিকই, আসলে ও ইচ্ছে করেই মহাদেববাবুকে বলেনি।
ঋজু যেন কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছে না। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, পরমার্থ ওর পেছন পেছন এসে বলল, কণিকা তো? ঠিক আসবে। তুমি যাও, আমি দেখছি।
ঋজু হলে চলে এল। এল ঠিকই, তবে ও নয়, ওর দেহ। সিটে বসে ছটফট করছে আর ঘনঘন দরজার দিকে তাকাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর দেখে কণিকাকে নিয়ে পরমার্থ ঢুকছে। ও উঠে দাঁড়াতেই, দূরে থেকেই পরমার্থ হাত দেখাল। বসো। ঋজু যে রো-য়ে বসে ছিল, তার ডাঁয়ে-বাঁয়ে পর পর কয়েকটা সিট খালি। ওরা ওর পাশে এসে বসে পড়ল।
ও যাদের যাদের বলেছিল, তারা সবাই এল। কিন্তু পুরস্কার-পর্বটা এতক্ষণ ধরে চলল এবং অতিথিরা প্রত্যেকেই এতক্ষণ ধরে বক্তব্য রাখলেন, আর বিধানদা সম্পর্কে এত মধুর মধুর কথা বললেন, এত ভূয়সী প্রশংসা করলেন যে, প্রায় ন’টা বেজে গেল। কবিতা পাঠের আসর আর করা গেল না।
বেরিয়েই, সি আর এভিনিউ আর মহাত্মা গান্ধী রোডের ক্রশিংয়ে আসতেই ২৩৯/এ বাস পেয়ে রিনা আর আশিস উঠে পড়ল। এই বাসটা একদম ওদের বাড়ির কাছে যায়। সেক্টর ফাইভের পেছনে, মহিষবাথানে। ওরা কণিকাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই ঋজু ওকে ইশারা করে বারণ করে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে যেতে। রিনাদের বাস চলে যেতেই কণিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঋজু বলল, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।
বাকিরা সবাই যখন যে যার মতো চলে গেল, তখন ওখানে দাঁড়িয়ে ও, কণিকা আর বোধিসত্ত্বদা। বোধিসত্ত্বদাই বলল, কোথায় যাবে?
ঋজু বলল, সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— কণিকা বলল, ভারতীয় বিদ্যাভবনের কাছে।
— এখান থেকে কত নম্বর যায়?
কণিকা বলল, এখান থেকে তো কোনও দিন যাইনি। আমি ঠিক জানি না। তবে কলেজ স্ট্রিট থেকে নাকি অটো যায়।
— তা হলে চলো কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাই। বোধিসত্ত্বদা বলতেই কণিকা বলল, কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয় না, ফুলবাগানের অটোগুলো কোত্থেকে ছাড়ে।
— ফুলবাগান?
— হ্যাঁ, এখান থেকে ফুলবাগান। ফুলবাগান থেকে আবার তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের অটো। ওখান থেকে একটুখানি।
ওরা মহাত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের পাশ থেকে অটোয় উঠে পড়ল। পেছনের সিটের ও দিকে বোধিসত্ত্বদা, তার পরে ঋজু আর একদম এ দিকে কণিকা। চতুর্থ জন আসছে না দেখে, বোধিসত্ত্বদাই বলল, একজনের ভাড়া না-হয় আমরা দিয়ে দেব, চলুন।
অটো চলতে শুরু করল। রাজাবাজার ছাড়িয়ে মানিকতলার ব্রিজ পেরিয়ে যখন অটো ছুটছে, তখন লোডশেডিং। এতক্ষণ ঋজু ওর পায়ে পা ঘষছিল। পিঠের পেছন দিক থেকে হাত নিয়ে ওর কাঁধ ছুঁচছিল। ওর কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিল কণিকা। ও-ও মুচকে মুচকে হাসছিল। এ বার কণিকার ডান হাতটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে এসে ঝপ করে একটা চুমু খেয়ে নিল ও।
কণিকা ইশারা করল, পাশে উনি আছেন। ঋজু বলল, আরে বোধিসত্ত্বদা আমাদের লোক। উনি কিছু মনে করবেন না।
কথাটা শুনে বোধিসত্ত্বদাও বলল, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও। এই তো বয়স।
শুনে কণিকা মুখ টিপে হাসল। ঋজু ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল, দেখলে তো... তার পরেই চকাস করে ওর গালে একটা চুমু খেয়ে নিল।
তার দু’দিন পরেই রবিবার। ওরা দেখা করল রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনের সামনে। একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। ও তখনও আসেনি। তাই, ও আদৌ আসবে কি আসবে না সে নিয়ে শংসয়ে ছিল। সেই উদ্বেগ থেকে দুটি লাইন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতেই, ওর পকেটে যে ছোট্ট ডায়রিটা থাকে, সেটা বার করে লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে হঠাত্ দেখে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। ও কাছে গিয়ে বলল, কখন এসেছ?
কণিকা বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগে। দেখলাম তুমি লিখছ, তাই ডিসটার্ব করিনি। কী লিখছিলে?
— কবিতা।
— কী নিয়ে?
— তোমাকে নিয়ে।
— তাই? দেখি, কী লিখেছ?
— ছাপা হোক, তার পর দেখো।
— কী নাম দিলে?
— এখনও কোনও নাম দিইনি। দেখি, কী দেওয়া যায়!
সে দিনই রাত্রে কণিকাকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রোজ যদি তোমার সঙ্গে এই ভাবে দেখা করা যেত!
— ইচ্ছে করলেই দেখা করা যায়। ও বলেছিল।
— কী ভাবে?
— আমার তো ছুটি হয় পাঁচটায়। তোমার তো ছ’টায় ঢুকলেও চলে। এক ঘণ্টা আমরা একসঙ্গে কাটাতেই পারি।
— ঠিক বলেছ তো! ঠিক আছে, কাল ঠিক পাঁচটার সময় আমি তোমার অফিসের গেটে চলে যাব। কেমন?
— না না না না। অফিসের গেটে না। আমাদের অফিসের সবাই তখন বেরোয় তো। কে কী ভাববে। কী দরকার? তার চে’ বরং ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের কাছে থেকো। আর তুমি যদি পাঁচ-দশ মিনিট আগে চলে আসো। তা হলে নীচ থেকে একটা ফোন কোরো। আমি নেমে আসব।
সেই রাতে কিছুক্ষণ পর পর আরও তিন-চার বার ফোন করেছিল ও। এমনকী, অফিস থেকে বেরোবার সময়ও। তাই মাথার মধ্যে নম্বরটা একদম গেঁথে গিয়েছিল। ফলে, পর দিন ও যখন টেলিফোন ভবনের সামনে ফোন করার গুমটি থেকে এক টাকার কয়েন ফেলে নম্বর টিপল, সেটা চলে গেল কণিকার বাড়িতে। যে মেয়েটি ধরল, সে বলল, মা তো অফিসে।
শুধু সে দিনই নয়, তার পরেও বেশ কয়েক দিন ওর এই একই ভুল হয়েছিল। আর এই ভুলের জন্যই ঋজুকে খুব ভাল ভাবে চিনে গিয়েছিল কণিকার দুই যমজ মেয়ে। ছোট বাবি আর বড় বাবি।
প্রথম যে দিন ওদের নাম শোনে, ঋজু একেবারে চমকে উঠেছিল। ছোট বাবি! বড় বাবি! তার ছেলের নামও তো বাবি। সত্যিই, কী কাকতালীয় মিল, না! একেই বোধহয় বলে প্রেম! তার পরেই মনে হল, কিন্তু কোথায়, সে দিন যখন কথায় কথায় কণিকাকে ও বলেছিল, তার ছেলের নাম বাবি। ও তো এক বারও বলেনি, আমার মেয়েদের নামও বাবি। বড় বাবি, ছোট বাবি। নাকি সে সময় প্রেমে এত মশগুল ছিল যে, ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। কে জানে!
ঋজুরা বুধবার-বুধবার আড্ডা মারত রবীন্দ্রসদন চত্বরে। কখনও বাংলা আকাদেমির সামনে। কখনও আপনজন-এর সামনে জলের ফোয়ারা ঘেরা বাঁধানো বেদিতে। আসত মিহির, গণেশ, দিশা, রফিক, বোধিসত্ত্ব। আসত বড়রাও। রানা চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। আসত নানান লিটিল ম্যাগাজিনের লোকেরা। আবৃত্তিকারেরা। কণিকাও সেখানে আসা শুরু করল।
সে দিন একটি আবৃত্তি সংস্থার প্রোগ্রাম চলছিল জীবনানন্দ সভাঘরে। সেখানে কয়েক মিনিট কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কণিকা আর ঋজু। সামনেই পর পর সিমেন্টে বাঁধানো দুটো বেঞ্চ। তার পেছনে, ঘেরা-জলাশয়ের মধ্যে নন্দন প্রেক্ষাগৃহ।
সে রকম একটা বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল ওরা। একটু ঘনিষ্ঠ হয়েই। কে কী বলবে? ওখান দিয়ে যারা যাতায়াত করে, তারা প্রায় সবাই ঋজুকে চেনে। ঋজুও তাদের চেনে। হঠাৎই একটু সরে গেল কণিকা। — কী হল?
জিজ্ঞেস করতেই কণিকা বলল, ওই যে মেয়েটা আসছে, ও মহাদেববাবুর ছাত্রী। আমাদের বাড়িতে পড়তে যেত।
ঋজুর কেমন যেন খটকা লাগল। কেউ যে তার স্বামীকে এই ভাবে বাবু হিসেবে সম্বোধন করে, সেটা ঋজু এই প্রথম দেখল। সে দিন দাঁতন যাওয়ার পথে আশিস তাকে বলেছিল, ওরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু কেন জানি ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, ওরা সত্যি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী।
তারা যে সে দিন জীবনানন্দ সভাঘরের সামনে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল, তার পর দিনই কী করে যেন সে খবর পৌঁছে গেল মহাদেববাবুর কাছে। কণিকাকে নাকি উনি বলেছেন, কী হচ্ছে এ সব? কী শুনছি?
ঋজু শুনে বলল, উনি জানলেন কী করে?
কণিকা বলল, আমার মনে হয়, ওই মেয়েটাই বলেছে। সে দিন দেখালাম না, ওই যে গো, ওই মেয়েটাকে...
এর ক’দিন পরেই আশিসের ফোন। কী খবর? কোনও ফোন-টোন নেই কেন? ভুলে গেলেন নাকি? একদিন আসুন।
— যাব। এর মধ্যেই যাব।
এর মধ্যে কেন আবার? কালই আসুন না... আসার সময় আপনার লাস্ট যে কবিতার বইটা বেরিয়েছে, তার একটা কপি নিয়ে আসবেন তো...
পরমার্থ শুনে বলল, আমার সঙ্গে সেই কবে থেকে আলাপ, আমাকে তো কোনও দিন কবিতা পাঠের কথা বলল না!
— আরে বাবা, কবিতার জন্য না। আমাকে এমনিই যেতে বলেছে।
— এমনি বললে, কবিতার বই নিয়ে যেতে বলত না।
— কী জানি, কিছু তো বলল না। দেখি, কাল গিয়ে।
ঋজু গিয়ে দেখে, আশিসের সামনে মহাদেববাবু বসে আছেন। ও যেতেই ওরা নীচে নেমে এল। ‘আমি একটু আসছি’ বলেই আশিস যেন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। আকাশবাণীর বাইরে, গেটের সামনে ঋজু আর মহাদেববাবু। তিনি বললেন, এ সব কী শুনছি? তোমাকে আর ওকে নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলছে। বাড়িতে ফোন করে পর্যন্ত বলছে। ওকে আমি কিছু বলব না। আমি জানি,ওর একটু ছেলেদের গায়ে-পড়া স্বভাব আছে। আমি তোমাকে বলছি। তুমি তো জানো, আমাকে কত লোক চেনে। তোমাদের মধ্যে যদি কোনও সম্পর্ক হয়েই থাকে, আমি বাধা দেব না। কিন্তু...
কথা শেষ হওয়ার আগেই ছলছল চোখে আচমকা মহাদেববাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরল ঋজু— কী করব মহাদেবদা, আমি যে ওকে ভালবেসে ফেলেছি।
ঋজুর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে উনি বললেন, আমি তোমাকে কিছু বলছি না। শুধু বলছি, যা করবে, একটু দেখেশুনে করবে। আমার ছাত্রছাত্রীরা যেন জানতে না পারে।
তাই ক’দিন ধরে কণিকার অফিস ছুটির পরে ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের সামনে ছাড়া ঋজু আর কোথাও কণিকার সঙ্গে দেখা করছে না। বুধবার-বুধবার রবীন্দ্রসদন চত্বরেও আসতে বারণ করে দিয়েছে ওকে।
হঠাৎ এই সুযোগ। একেবারে আচমকা। ঋজুর বউ ভারতী। বিয়ের পর থেকে ঋজু তাকে রতি বলেই ডাকে। সে জানে, প্রত্যেক বছর বইমেলার এই প্রথম রবিবারে কলকাতার পুস্তক মেলার গিল্ড কর্তৃপক্ষ যে ‘বইয়ের জন্য হাঁটুন’ পদযাত্রার আয়োজন করে, সেখানে ঋজুও যায়। উত্তর কলকাতার লোকেরা কলেজ স্ট্রিট থেকে আসে। আর দক্ষিণের লোকেরা দেশপ্রিয় পার্ক থেকে যায়। মিলিত হয় পার্ক স্ট্রিটের মুখে। এমন টাইমিং যে দুটো মিছিলই প্রায় একই সঙ্গে বইমেলায় ঢোকে। সে-ই যে ঋজু ঢোকে, ফেরে অনেক রাতে।
রতিকে ‘ওখানে যাচ্ছি’ বলে, সকালেই বেরিয়ে পড়ল ঋজু। তার পর সোজা শিয়ালদা। এখন শহরের সবার নজর এড়িয়ে ডায়মন্ড হারবারে। স্টেশনে নেমেই একটা কালো গগল্স পরে নিল কণিকা। স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল সাকিল। সে ওদের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঋজু দেখে, সামনেই একটা পুলিশের কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। সাকিল ওদের সেটায় উঠতে বলল। তার পরে নিয়ে গেল হংসরাজে। বিশাল একটা লাকজারিয়াস হোটেল। কাউন্টারের লোকটাকে সাকিল কী বলতেই, লোকটা একজন বেয়ারাকে ডেকে বলল, উপরে নিয়ে যা। বেয়ারাটা ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটা ঘর খুলে দিল। টিপটপ এসি রুম। সাকিল চলে গেল।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয় একদম অভিজ্ঞতা নেই ঋজুর। একেবারে আনকোরা। দরজায় ছিটকিনি তুলে পেছন ঘুরে দেখে কণিকা ততক্ষণে গগল্স, কানের দুল, গলার হার, খোপার ক্লিপ খুলে ফেলেছে। শাড়ি খুলছে।
ঋজু খাটের ধারে বসে কণিকাকে দেখছিল। কণিকা শুধু ব্রেসিয়ার আর শায়া পরে খাটে উঠেতেই ও-ও জামাপ্যান্ট খুলে বিছানায় উঠে পড়ল।
তার পর মহাপ্রলয়। ঘুমন্ত ময়াল জেগে উঠল। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল বারবার।
হঠাৎ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। কণিকার মোবাইল বেজে উঠল। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে কণিকার দিকে এগিয়ে দিল ও। স্কিনে নম্বরটা দেখে নিয়ে বিছানার পাশে রেখে দিল কণিকা। বলল, কে না কে, থাক। ফোন করার আর সময় পায় না। যত্তসব। কিন্তু ফোনটা ঘনঘন বাজতেই লাগল।
_______________________
ক্রমশ...
তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন -
পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--
Wednesday, June 1, 2022
ছোট গল্প - জীবনাঞ্জলি || লেখক - চন্দন চক্রবর্তী || Short story - Jibonanjali || Written by Chandan Chakraborty
ভ্যাটের গাড়ির ছেলেটার মনটা ভালো । সামনের ফাঁকা জায়গায় করপোরেশন ভ্যাট ফেলা বন্ধের নোটিশ দিয়েছে । গতকাল গাড়ি আসে নি । আদরী উপবাসী থেকেছে । ছেলেটা এই পথেই যাচ্ছিল । আদরীর কষ্ট সে বুঝতে পেরেছে । গাড়িতে তুলে অনেকটা পথ এসে একটা নতুন জায়গায় নাবিয়ে দিয়ে গেল ।
সামনে একটা ভ্যাট ফেলার জায়গা আছে । গাড়ি এখন ওই রাস্তায় যাবে না । নো এন্ট্রি চলছে । কিন্তু ওরা যে ভাবে বলে গেল সব যে ঘুলিয়ে গেছে !
বেলা চড়ে মাথার ওপর রোদ । হাঁটতে হাঁটতে আদরী সামনে একটা পার্ক দেখতে পেল । পার্কের মাঝে বিরাট পূজার প্যান্ডেল । ঢাক বাজছে । অনেক লোকের সমাগম ।
শরীর আর দিচ্ছে না । মাজা ভেঙে আসছে । লাঠিতে ভর দিয়ে সে আর কত দূর যেতে পারে ! গতকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি । মায়ের ওপর ভরসা রেখে সে সেখানে বসে পড়ল ।
সেই কবে বাপের ঘর তাকে ছাড়তে হল । তখন আদরী সবে বারোয় পড়েছে । সেই থেকে তার চলার শুরু । আজ আশি ছুঁই ছুঁই । তার জীবনে আর নিশ্চিত ঠিকানা হল কই !
আদরীর ছোট থেকেই মা নেই । বাপ লোকের জমিতে জন খাটতো । অভাব ছিল বারো মাস । তবু আধপেটা খেয়ে,বনে বাদাড়ে ঘুরে, এটা ওটা এনে,তাদের চলছিল । কিন্তু যেবার খরা হল । বাপটা শহরে এলো । এখানে এসে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হল ।
আদরী তখন নয় কি দশ ।
বাপটা এদিক ওদিক ঘুরে তেমন সুবিধা করতে পারতো না । আদরী বস্তির আর সব কচিকাঁচাদের সাথে ডাস্টবিন থেকে পচা গলা খাবার কুড়িয়ে আনতো । তবু যা হোক চলছিল । শেষে বাপটা হাঁপের রুগী হয়ে কাজে বেরনো বন্ধ করল । ঘরে বসে আর কদিন চলে । একদিন দালাল এসে আদরীকে কিনে নিয়ে গেল ।
দালালের গোপন আস্তানায় আদরীকে কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছর । বদ্ধ ঘরে তার দম আটকে আসতো । তিন বেলা যা খাওয়া দিত,ভালো করে পেট ভরতো না । তার মধ্যেই,সে ভালো করে ফোটার আগেই, রাতে তাকে দালালের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে । কোন কোন দিন,দিনের বেলাও বাদ যেতো না । আদরীর কান্না ঠেলে আসতো । এক একবার মনে হয়েছে পালিয়ে যাবে । কিন্তু তেমন কোন সুবিধা সেই ঘরে ছিল না । সে মৃত্যুর কথাও ভেবেছে । কিন্তু পেরে ওঠে নি ।
আদরীকে এবার আনা হল এক মাসির ডেরায় । মাসি তাকে ঘর দিল । তার নতুন নাম হল । যে মাটি না হলে উমার পূজো হয় না সেখানে সে কমল হয়ে ফুটল ।
কমল হয়েই সে রোজ রাতে সেজে রাস্তায় দাঁড়াতো । চল্লিশটা বছর সে সেখানে কাটিয়ে যখন বেরিয়ে এলো তখন শরীর জুড়ে তার জরা । খদ্দের আসা আগেই বন্ধ হয়েছে,তার দাম ফুরিয়েছে ।
শরীরে যখন প্রথম প্রেমের সাড়া পেল তখনও নিবেদন করার মত মানুষ পেল কোথায় ! কথাটা মাথায় এলেই নগেন ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে । টানা তিন বছর নগেন রাতে একবার আসতোই । একবার তিনদিন তিনরাত তার ঘরে কাটিয়ে গেছে । আদরীর সেবার গায়ে ধুম জ্বর । নগেন তাকে ওষুধ এনে দিয়েছিল । বাইরে থেকে রান্না খাবার এনেছিল । জ্বরের মধ্যেও আদরী নগেনকে আসন পেতে শাল পাতায় খাবার বেড়ে যত্ন করে নিজ হাতে খাইয়েছিল । তারপর থেকে নগেন এলে আদরী সেদিন ঘরে অন্য খদ্দের ঢোকাত না ।
রাতে নগেন,সে,পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটিয়েছে । দুপুরে চান করে নগেনকে স্মরণ করে,সিঁদুর পরে আয়নায় নিজের মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতো । এই নিয়ে মাসির কাছে কথা শুনতে হয়েছে । সবার ওপরে যেটা,সে নগেনের সন্তানকে পেটে ধরেছে ।
তারজন্য তাকে যে অমানুষিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে,তা ভোলার নয় । তার শরীর নষ্ট হয়েছে,রোজগার নষ্ট হয়েছে,অনেক খদ্দের কমেছে । তবু সে মা ডাক শুনেছে । ছেলেকে সে ঠিক মত আদর যত্ন করতে পারে নি । খদ্দের ঘরে এলে ছেলেকে মাসির কাছে রেখে আসতে হত । সে মাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে চাইতো না । মা মা করে চিৎকার করতো । মায়ের মনে উথাল পাথাল ঢেউ উঠতো । হায় ভগবান,আদারী তখন চোখ মুছে খদ্দের বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ! তাই বুঝি ছেলেটা একটু বড় হতেই মায়ের ধার ঘেঁষতো না !
হঠাৎ সেই নগেনও কোথায় হারিয়ে গেল ! অনেকগুলো রাত বিনিদ্র থেকে সে খবর পেয়েছিল নগেন গাড়ি একসিডেন্টে মারা গেছে । রাতে শুয়ে সে চোখের জল ফেলেছে ।
তার জীবনে সেই শেষ বসন্ত এসেছিল ।
অনেকগুলো বছর গড়িয়ে শরীরের ঘ্রাণ হারিয়ে সে তখন সর্বশান্ত । ব্রার্ত্য হিসাবে তার নাম উঠল খাতায় । শেষে বীরেনবাবুর চেষ্টায় তার বাড়ি গিয়ে তার ঠাঁই মিলল । লোকটা তার ঘরে যৌবনকালে বার কয়েক অতিথি হয়েছিল । কদিন অন্তর ঘর পাল্টাতো । বীরেনবাবুকে তখন তার খারাপ মানুষ মনে হত । সেই লোকটাই তাকে বাড়িতে ঠাঁই দিল । সারাজীবন লোকটা বিয়ে না করে তাদের ওখানে যাতায়াত করে কাটিয়েছে ।
বাগান বাড়ির এক কোনে তার টিনের চালা । তার কাজ ছিল বিরাট বাড়িটা ধোয়া পোছা করা ।
বছর দশেক কাটার পর শরিকী বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল । বীরেনবাবু ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেলেন ।
আদরীকে এবার পায়ের তলার মাটি হারিয়ে পথে নামতে হল । সারাদিন ভিক্ষা করে অনেকগুলো বছর চলার পর আর পারছিল না । অবশেষে ময়লা ফেলার স্থানে কোন ঠিকানা বানিয়ে তার চলতে লাগলো । মাঝে মাঝেই তাকে তার জন্য ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে ।
আজ যখন সে ঠিকানা হারালো শরীর একেবারেই পড়ে গেছে । আদরী ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল । হাতে পায়ে ঝি ঝি ধরেছে । মাথা ঝিমঝিম করছে । সে বেশ বুঝতে পারছে তার যাবার সময় হয়েছে ।
এ জীবনে তার কোন অনুযোগ নেই । বাপের ঘরের দেওয়া আদরী নাম তার শৈশবেই ঘুঁচেছে । পরবর্তীতে যে দোরের মাটি নিয়ে মায়ের পূজার শুরু,আদরী সেই মাটিতে কমল হয়ে ফুটেছে । তার দেহ মধুকরের পায়ে ক্ষত বিক্ষত হলেও তার মন আজো সদ্য প্রস্ফুটিত কমলের মত পবিত্র ।
আদরী মন কমলকে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে চিরকালের মত চোখ বুজল ।
Monday, May 30, 2022
টাটা কোম্পানিতে নিয়োগ হবে 1 লক্ষ পদে || Tata consultancy Recruitment 2022 || TCS Recruitment 2022
Sunday, May 29, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -4
সুরজিৎ বাবু অতি আনন্দিত হলেন। সুমন্ত গ্রামের গৌরব। সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছে। প্রতিটি সাবজেক্টে ৯৩ পারসেন্ট নাম্বার আছে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সমুন্তকে যাতে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।
তিনি বললেন, সুমন্তর কাছে মত নিতে। কারণ সংসার যদি বিচ্ছিন্ন না হতো তাহলে গলা হাঁকিয়ে বলতে পারতেন। বাবা, সুরজিৎ বাবুকে বলেছিলেন, সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াতে হলে যদি পথে বসতে হয় তাতেও তিনি রাজী আছেন। স্বপ্ন পূরণ করা তার কর্তব্য। তাই অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করেও পিছু হটবেন না। সুমন্তকে ডাক্তারী পড়াবেন এ তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
দাদাকে ডাকা হলো, দাদা বলতে সুমন্তদা একাই। দ্বিতীয় কোন ভাই ও বোন ছিল না আমার। দুই ভাই বোনকে জন্ম দিয়ে মা পৃথিবী হতে চিরবিদায় গ্রহণ করছিলেন অনেক আগে। মা বিদায় নিয়ে ভালই করেছিলেন। নতুবা পরিনতি ভয়াবহ হতো তা অজানা নয়। এখন ও পরের কথা।
সুমন্তদা বাবার কাছে হাজির হতে বাবা খোলাখুলি আলোচনা করলেন। সে সময় সুরজিৎ বাবু উপস্থিত ছিলেন। দাদা কোন মতেই রাজী হতে চাইলেন না। বারবার এক কথা ও স্বপ্ন দেখে কি লাভ। একান্নবর্তী পরিবারে থাকলে তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করা যেত। এখন তাদের ছন্নছাড়া জীবন। অভাব অনটন ও দারিদ্রই তাদের জীবনের নিত্য সহচর। ডাক্তারী পড়তে হলে কত টাকা যে খরচ হবে তার হিসেব নেই। শেষ কালে কি পথে বসবে তারা?
সুরজিৎ বাবু বুঝিয়ে বললেন। যদি বা বাবার কথা কাটতে পারতো বিশেষ করে সুরজিৎ বাবুর কথা কাটতে পারলেন না। তিনি বললেন, শুধু তোমার বাবার স্বপ্ন নয় সুমন্ত, প্রতিটি গ্রামবাসীর ইচ্ছা তুমি ডাক্তারী পাস করে গ্রামবাসীদের মৃত্যুর কবল হতে রক্ষে করবে। জানতো, কোন ডাক্তার এই পল্লী অঞ্চলে আসতে চায় না। কারণ ডাক্তারী পাশ করার সময় শহরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে পল্লী অঞ্চলে চেম্বার করতে তাদের অত্যন্ত অনীহা থাকে। আমরা তোমাকে কোলে - পিঠে মানুষ করেছি। যদি শহর হতে আসতে ইচ্ছে না করে জোরপূর্ব্বক গ্রামে আনার ক্ষমতা আমাদের আছে। তবে গ্রামে যদি আশানুরূপ রোজগার না হয় তাহলে শহরে সপ্তাহে চারদিন থাকলে, গ্রামে হয়তো তিন দিন এসে চেম্বারে বসলে গ্রামের অনেক উপকার হবে।
তারপর কি জানো তোমার ঠাকুরদা স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রেমাংশুকে ডাক্তার করে গ্রামের অভাব পূরণ করবেন। কিন্তু ভাগ্যচক্রে এ রকম যে বিপর্যয় হবে কেও কি কোনদিন কল্পনা করেছিলো?
সুমন্ত মাষ্টার মশায়ের সব কথা শুনে বললো, তা না হয় হলো, কিন্তু বাবার যে সম্পত্তি আছে ওতে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে পারবেন কি?
সুরজিৎ বাবু বললেন, কোন ভয় নেই তোমার। তোমার বাবা যদি শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে না পারেন, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সেজন্য তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
সুমন্তদা আরো কিছু বলার জন্য সচেষ্ট হতে থাকে। কিন্তু বিরুদ্ধ অন্তরের কথাকে কোন প্রকারে বাঙ্ময় করতে পরলো না। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
সুরজিৎ বাবু বললেন পুনরায়, সুমন্ত, তুমি আর বিলম্ব করো না। আগামীকাল আমার কাছে যাবে, নীহার বাবুর সাথে আলোচনা করে ওর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দেব।
সেদিন আর আলোচনা না করে সুরজিৎ বাবু আপনি বাড়ি পানে পা বাড়ালেন। দাদার ডাক্তারী পড়ার সব রকম আয়োজন হলো। বাবা গ্রামীণ মানুষ, দিনক্ষণকে ভীষণ মানেন। তাই পাড়ারই একজন এ্যাস্ট্রোলজারকে দিয়ে ভালো দিন দেখিয়ে পাড়ারই বিশিষ্ট ব্যক্তি নীহার বাবুর সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি হতে কোন বাধা হলো না।
তিনি বলেছিলেন, সমুন্তর ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন। ডাক্তারী পাশ করার জন্য কোন বাধা বিঘ্ন নেই। সে সুন্দরভাবে ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে ফিরে আসবে। সেই এ্যাস্ট্রোলজারের কথা মনে ছিলো বলে বার বার তার চরণে প্রণাম জানিয়ে ইচ্ছে করছিল। এ জন্য যে, দাদা সুস্থ সকল শরীরে ডাক্তারী পাশ করে বাড়ীতে এসেছিলো বলে। একটু ধৈর্য্য ধরুন পরের পর সবই জানতে পারবেন। কারণ আমি মনযোগে লিখে চলেছি। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি পরের পর ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
দাদা শুভ দিনে কলকাতায় ভর্তি হলো। বাবা ও সুরজিৎ বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কারণ দাদার মোটেই ইচ্ছে ছিলো না ডাক্তারী পড়বার। তাকে জোর পূর্ব্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারী পেশায় যেন নামানো হলো। এ কথা শুনে মেজকাকা জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কেন যে আমাদের প্রতি এতো হিংসে হয়েছিলো তা বুঝতে পারিনি। বাবা জমিদার পরিবারের আভিজাত্যকে পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের পথ বেছে নিলেন।
সেই সময় ভাবতে বড় আশ্চর্য লাগছিলো, যে মানুষটা চব্বিশ ঘন্টা জঙ্গলে পড়ে থাকতেন, বন্য জন্তুর পিছনে সর্বদাই ছোটাছুটি করতেন। সে মানুষটা যে এরূপ পাল্টে যাবে কোন দিন ভাবতে পারিনি।
আমাকে পড়াশুনা ছাড়তে হলো। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর এগোতে পারলাম না। বাবার পরিশ্রমের পয়সাতে সুন্দরভাবে সংসার চালাতে চেষ্টা করলাম। একদিন কোথা হতে ছোট কাকা উদয় হলেন; প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে। তিনি যে এতো রোগা হয়ে যাবেন কল্পনা করিনি। কাকা ছিলেন সুপুরুষ, তেজদীপ্ত চেহারা ও দেহে আভিজাত্যের ছাপ। গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছোট কাকার চেহারা নিয়ে প্রশংসা করতেন। কিন্তু ছোটকাকার ঐ রূপ রোগা শরীর দেখে চোখ দুটো যেন গাম আঠা দিয়ে চিটিয়ে রেখেছিলেন।
ছোটকাকা এসেই বললেন, কিরে রমা আমায় চিনতে পারছিস না? কি করে পারবি বল, আমি যে তোদের বংশের নাগাল হতে অনেক দূরে সরে গেছি। দুর্ভাবনায়, দারিদ্রতায় নিজেকে তিলে তিলে দগ্দ করছি। ভগবান যে আমাকে এতো কঠোর নির্যাতন দেবেন তা কোন দিনই মনে আনিনি। সবই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছু নয়রে।
ছোট কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন, জানি না জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করে কি পাপ করেছি। সেই পাপের যন্ত্রণা প্রতিটি শিরা , উপশিরায় প্রবেশ করে আমাকে মৃত্যুমুখী করে তুলেছে।
আমি ছোট কাকার কথাগুলো শুনে শোকাহত যে হলাম না তা নয়। আমাকে মনমরা হতে দেখে তার দুঃখের কাহিনীকে অন্তরালে চাপা দিয়ে বললেন , তা হ্যাঁরে তোর বাবা কোথায়?
বললাম, বাবা উপার্জনে গেছেন।
কি বলছিস তুই ? তবে কি মেজদা, বড়দাকেও ফাঁকি দিয়েছেন?
আমি নীরব ছিলাম। মেজকাকাকে নিয়ে নানা কটু কথা বললেন তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য। যদি কোন দিন সবল হতে পারেন তাহলে একদিন বদলা নেবেন। এখন ছোট কাকা ভাগ্যের বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত পরে যেদিন ঈশ্বর ওর মুখপানে তাকাবেন সেদিন, এদিন তার থাকবে না। বাবা একটু পর বাড়িতে এলেন। কাকার দূরাবস্থার কথা শুনে প্রচুর দুঃখ পেলেন। কাকার আগমন বার্তা শুনলেন। বাবা যদি কিছু আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য না করেন তাহলে কাকা অসহায়ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।
কাকার দুঃখে বাবা কাতর হয়ে পড়লেও সাহায্যের উদার হস্ত প্রসারিত করলেন। যেটুকু দিয়ে সাহায্য করলেন তা বহু কষ্টের উপার্জিত অর্থ। দাদার ডাক্তারী পড়ার ব্যবস্থা না করে বাবা আরো আর্থিক সাহায্য দিয়ে প্রকৃত ভ্রাতৃ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন।
দাদার ডাক্তারী পড়া কথা শুনে ছোট কাকা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিশেষ করে আনন্দিত হয়েছিলেন এ কারণে, ঠাকুর্দার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে বলে তিনি আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়তেই বললাম, ছোট কাকা একটু দাঁড়াও আমি আসছি।
দ্রুত বেগে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাক্স হতে এক জোড়া কানের দুল বের করে তার হাতে দিলাম। ছোট কাকার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হলে আমাকে শান্ত স্বরে
বললেন, আমার অবস্থা এখন চরম সীমানায় উপস্থিত হয়েছে। তবুও তোর কানের দুল দুটো নেবার কোন স্পৃহা আমার নেই। তুই রেখে দে রমা, একদিন দারুন কাজে লাগবে। আমি জানি এই দুটো নিলে আমার অভাব মিটবে না। কিন্তু তোরা যে শপথ নিয়ে যে পথের যাত্রী হয়েছিস আমারও কর্তব্য ছিলো তোদেরকে সাহায্য করা। দুল দুটো রেখে দে মা।
আমি বললাম, আমরা ঠিকই এগিয়ে যাবো ছোট কাকা তোমাদের আশীর্বাদে এ দুটো নাও, এ সময় টাকার প্রয়োজন তোমার। খোকনকে বাঁচাতেই হবে । সেও তো আমার ভাই। তোমাকে নিতেই হবে এ দুল দুটো।
বার বার অনুরোধে আমার কথা কাটতে পারলেন না। শুধু ঠোঁটে হাত দিয়ে আমাকে বললেন, তুই আমার মায়ের কাজ করলি রমা। তবে এই চন্দ্র সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে শপথ করে বলছি, ঈশ্বর যদি কোন দিন আমার প্রতি সদয় হয়ে থাকেন, তাহলে আমার মায়ের ঋণ শোধ করবই। এই ঔ
ছোট কাকা আর দাঁড়াননি ওখানে। ছল ছল চোখে স্থান ত্যাগ করলেন। তিনি স্থান ত্যাগ করতে আমারও চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো ও বার বার তার মলিন মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওকে অনুসরণ করে দাদুর স্মৃতি মনে উদিত হয়ে আমাকে ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কি ছিলো আমাদের অবস্থা আর কি হয়েছে। এখন কোন অপরিচিত লোকদের যদি বলে থাকি, আমি জমিদারের নাতনী, কেউ বিশ্বাস করবে না! সকলে হেসে উড়িয়ে দেবেন। সেদিন কি আর ফিরে আসবে । জানি না এরপর ঈশ্বর আর কোন ভাগ্যবিপর্যয়ের জাল ফেলবেন। অতীত মনে পড়লে কিছুক্ষণ মনকে উতলা করে একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তির আস্বাদ মিটিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমাদের অভাবের সংসার এগিয়ে চললো।
ক্রমশ...
তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-
পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--







