Thursday, July 14, 2022
উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -10 ||অন্তিম পর্ব
Wednesday, July 13, 2022
ছোট গল্প - আয়না || লেখক - রোহিত দাস || Short story - Aayna || Written by Rohit das
আয়না
রোহিত দাস
বৃষ্টি পড়ছিল চরম। তারপর তখন আবার রাত। বান্ধবী রীতু র
এই ধারণা আমার জন্মেছে চেয়ে গত ছ'মাস আগে। সব ঠিক ছিল কিন্তু জামাই লিপস্টিক এর দাগ বেশ কয়েকদিন ধরে দেখার পর আর কাজের মেয়ের সাথে কথায় আমাকে এসব..।এসব কথা ভাবতে কখন যে হারিয়ে গেছি জানিনা হুশ ফিরতেই দেখি আমরা একটা পুরনো বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি গাড়ি থেকে নামতে রাজিব নামলো। বাড়িটার দিকে তাকালেই যেন মনে হবে কোন এক ভয়ঙ্কর কান্ডকারখানায় জ্বলে পুড়ে গেছে। রাজিব বাড়িটার দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই আমি বলে উঠলাম কার বাড়ি জানিনা, কেউ থাকে কিনা জানিনা,কি আছে এখন ভেতরে তাও জানি না ঢুকলেই হলো নাকি ? রাজিব দরজাটা ঠেলেতে লাগলো।হালকা চাপ দিতেই খুলে গেল। রাজিব ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আমিও ভেতরে ঢুকলাম।মোবাইলের টর্চ জ্বেলে এদিকে ওদিকে দেখার চেষ্টা করলাম কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না আমার কাঁধের ব্যাগে একটা বড়ো টর্চ পড়ছিল সেটা বের করে জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে থাকলাম। সামনের জায়গাটা বিশাল।মেঝেতে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ধুলো পড়ে আছে সামনের দিকে চলে গেছে দোতলার সিঁড়ি।বারান্দায় একটা আয়না আর পাশেই একটা টেবিল।এতক্ষণে ভয় কাটিয়ে বললাম বাহ!! চমৎকার বেশ ভালোই হলো ভেতরে এলাম।এখানে বসেই রাতটা পার হয়ে যাবে, কাল সকালে বাড়ির জন্য রওনা দেওয়া যাবে। রাজিব গাড়িটা বাড়ীর ভেতরে নিয়ে চলে এল।আর একটা পুরনো কাপড় দিয়ে বেশ কিছুটা জায়গা ঝেড়ে ঝুড়ে বসার মত উপযোগী করে তুলল। গাড়ির সিটের নিজ থেকে দেড় হাত লম্বা একটা ট্রিপল বের করে সেটা মেঝেতে পেতে নিজে বসে আমায় বলল "কি বসবে না।" আমিও গিয়ে বসে পড়লাম রাজিব রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে লাগলো। জামা কাপড় একেবারে প্রায় ভিজে গেছে। কি আর করব এখানে শুকনো জামাকাপড় পাওয়া যাবে না সেগুলো পড়েই বসে থাকলাম। রাজিব জামাটা খুলে খালি গেঞ্জি পড়ে বসে আছে। ইতিমধ্যে ঝড়ের আর জলের বেগ আরো বেড়েছে। দরজা দিয়ে জলের ছিটে ক্রমশ ভেতরে আসছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া শরীরের প্রত্যেকটা হারকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজিব আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ও ভিষন ঘুমকাতুরে। 10 মিনিটের মধ্যেই দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার ঘুম এলো না। দু চোখ যেন অজানা ভয় বন্ধ হতে চাইছিল না।যত সময় কাটতে লাগলো ঝি ঝি পোকার ডাক আর ঠান্ডা কনকনে হাওয়ায় পরিবেশটা ভীষণ ভয়ংকর হতে লাগল। গাড়ির হেডলাইটের আলোই একমাত্র সম্বল তাও কিছুটা জায়গায় আলো করে রেখেছে, বাকি চারপাশ ভীষণ অন্ধকার। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় দরজাটা বিকট আওয়াজ করে একবার খুলে গিয়ে আবার কিছুটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বসে থাকতে পারছিলাম না। কোল থেকে রাজিবের মাথাটা নামিয়ে উঠে পরলাম মোবাইলের লাইট আর টর্চ লাইট নিয়ে এদিক-ওদিক টা একটু ঘুরে দেখবো ভাবলাম।
বারান্দায় আসবাবপত্র কিছুই নেই শুধু হয়ে আয়না আর টেবিল টা আমি আস্তে আস্তে সে দিকেই এগিয়ে গেলাম। আয়নাটা বেশ পুরনো ধুলো জমেছে অনেক তবে দেখে বোঝা যায় এটা বেশ সুন্দর দেখতে। টেবিল টা মোটা মেহগনি কাঠের। আয়নাটা খুব লম্বা নয়, আমার হাটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে হাত দিয়ে আয়নাটার ধুলোগুলো একটু পরিষ্কার করলাম। এবার আয়নাটার দিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।আয়নাটা আমায় দেখাচ্ছেনা ,দেখাচ্ছে অন্য কিছু। আমি যা দেখলাম তার বর্ণনায় নিজের মুখে কতটা ঠিক করে দিতে পারব জানি না। হতবুদ্ধি সম্পূর্ণ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা শুধুই দেখেই গেলাম। দেখলাম একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ি যেখানে থাকেন এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও তার ছেলে। বেশ ভালই চলছিল তাদের সংসার। কিন্ত তাদের সাংসারিক জীবনে যেন শনির দৃষ্টি হঠাৎই পড়ে গেল। ঘটনাটা যেন একটু তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছিলো কোন মোর ঘোরানোর চেষ্টায়।একদিন হঠাৎ ছেলেকে স্কুলে থেকে আনার সময় স্ত্রীটি দেখল তার স্বামী একটা বছর তিরিশের নারীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সে ভাবল তার স্বামী দিনমজুরের কাজ করে এখানে কি করছে। এভাবেই সপ্তাহ দুয়েক ধরে মাঝেমধ্যেই সে দেখতে পেত তার স্বামীকে সেই জায়গায় সেই মহিলাটির সাথে। কিন্তু ঘরে ফিরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেও সে কোন উত্তর দিতো না। এমনই একদিন সে হাতেনাতে ধরবে বলে স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন দেখতে পেল না সে খুব হতাশ হয়েছিল। বাড়ির দিকে আসতেই সে দেখতে পেল সেই মহিলাটি তার বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। সে দেখল তার স্বামীর জামার নিচের দিকের কয়েকটা বোতাম খোলা। এভাবেও বেশ কিছুদিন পর আবারো একই ঘটনা। ইতিমধ্যে একটা অশান্তি ঘটেছিল তাদের মধ্যে। স্বামীটাকে জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কোন কিছুই বলতে রাজি ছিল না সে। এভাবে দ্বিতীয় দিন দেখার পর সে আর সহ্য করতে পারছিল না স্বামীকে। তার পাশে শুতে যেন তারা ঘিন্না করছিল তার।সামনে দাড়াতে তার ঘেন্না করছিল। সে ঠিক করল তাকে এভাবে ঠকানোর বদলা সে নেবে। তাকে এভাবে অপমান করার বদলা সে ঠিক নেবে। তাই ঠিক করল সে তার স্বামীকে খুন করবে। সেদিন স্কুলে ফেরার পথে তাদের দেখে সে সত্যিই খুব রেগে গেছিল। হয়তো স্বামী তাকে দেখেছে। কিন্তু কোনো কথা বলেনি। সারা দুপুরটা যেন ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থার মধ্যে কেটে গেল। স্বামী ভাবল যেন কোন কিছুই হয়নি। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে ছেলেকে অন্য ঘরে শুইয়ে রেখে। স্বামীর গলায় সে নরম ছুরির ফলা টেনে দিল। রক্তবন্যা বয়ে গেল সারা বিছানা জুড়ে। মেয়েটির বুকের জ্বালা এতটাই ছিল যে সে চিৎকার করে বলতে লাগল "আর যাবি সেই মেয়ে ছেলেটার কাছে যা চলে যা।" পরদিন পুলিশ এসে যখন মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য রওনা হচ্ছে,তখন সেই মেয়েটা স্ত্রীটি সামনে এসে দাড়াল।সে বললো আপনার স্বামী বড়ই ভালো মানুষ ছিলেন।আপনি এভাবে তাকে কেন মারলেন?স্ত্রীটি ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো চরিত্রহীন তুই আমার জীবনটা নষ্ট করেছিস।তোর রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমার স্বামী আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো তাই আমি তাকেই মেরে ফেলেছি। মেয়েটি অবাক হয়ে বললো "কি বলছেন??আমার সাথে আপনার স্বামীর কোন সম্পর্কই ছিলনা। আপনি ভুল ভাবছেন আপনি যেটা ভাবছেন সেটা হয়নি। আসলে আমার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছিল। স্বামীও নিজের চাকরিটা হারিয়েছিলেন। কিভাবে সংসার চালাবে ভেবে না পেয়ে আমার খবর পেয়ে আমার সাথে দেখা করেন। আমারও কিডনির প্রয়োজন ছিল আপনার স্বামী তার একটা কিডনি আমাকে দেওয়ার জন্য রাজি হয়। আমি তাকে নগদ এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলাম। এমন একটা সময় আপনার স্বামী আমার এত উপকার করেছিলেন।প্রথম দিন আপনার বাড়ি আসার কারণ এটাই ছিল। আপনার স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম তিনি আগের দিনই হাসপাতালে কিডনি ডোনেট করেছিলেন। গত 26 তারিখে আমার অপারেশন হয়। তার আগের দিনও আপনার স্বামীর সাথে আমি দেখা করি। হয়তো জামার বোতাম খোলা দেখলেই আপনি ভেবেছিলেন আপনার স্বামী পরকীয়ায় জড়িত।আসলে আপনার স্বামী সেলাইয়ের জায়গাটা আমি দেখে গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে উনার মত স্বামী বা আপনার ভাগ্যে ছিল না তাই হয়তো আপনি আজ হারিয়ে বসেলেন। কথাগুলো শোনা মাত্রই স্ত্রী মেয়েটা পুলিশের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে একছুটে ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করে করে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নিল। পুলিশও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে।তারাও এই বিষয়টায় অবাক। হতভম্ব পুলিশের সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো সেই স্ত্রীটির দেহ খানি মায়ের দেহকে পড়তে দেখে ছেলেটিও মাকে জড়িয়ে ধর, আগুন লাগল তার গায়ে। আগুনের জ্বালায় ঘরে চারদিকে ছুটতে লাগল, ধরিয়ে দিলোআগুন সারা ঘরে।পুলিশ অবাক হয়ে ছুটে ঘর থেকে পালিয়ে গেল। সেই মহিলাটি ইতিমধ্যে চলে গেছে। দেখতে দেখতেই গোটা ঘরটা গেল পুড়ে।
পুরোটা দেখা মাত্রই আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছিল।রাত এখনো অনেক বাকি। বৃষ্টিটাও একটু ধরেছে। আমি এক ধাক্কায় রাজীবকে তুলে বলতে লাগলাম "রাজিব রাজিব বৃষ্টি থেমেছে চলো আমরা এখনই এখান থেকে চলে যায়..রাজিব চলো...আমার এইখানটা ভালো লাগছেনা।চলো রাজিব।" রাজিব আমার কথা শোনা মাত্রই সে ট্রিপল গুটিয়ে গাড়ি বের করে আমায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
এরপর ছয় মাস কেটে গেছে।সেই ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। তবে তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি । রাজীবের মেয়ের দোষ নেই সে নিজেই আমাকে একথা বলেছে। স্বীকার করেছে যে তাকে জ্বালানোর জন্য সেই কাজগুলো করেছে।আমার সুখী পরিবার আবার সুখে ভরে গেছে কিন্তু সেই দিনের শেখার জিনিস চিরতরে থেকে গেছে।
Monday, July 11, 2022
ছোট গল্প - ভিখারী || লেখক - তনিমা সাহা || Short story - Vikari || Written by Tanima Saha
ভিখারী
তনিমা সাহা
মনু রোজ ভিখারীটিকে দেখে বাড়ির উল্টো দিকে গাছটির নিচে বসে থাকতে। সবসময় কিছু যেন আড়াল করে রাখে সে। মনুকে দেখলেই সেই জিনিসটা লুকিয়ে ফেলে। মনুর বাবা-মা নেই। সে তার দাদু-দিদার সঙ্গে থাকে। দাদু বলে মনুর বাবা শিলাদিত্য একজন সামরিক বাহিনীর পদাতিক সৈনিক ছিলেন। মনুর মা বসুন্ধরা একটি আঞ্চলিক খবরের চ্যানেলে কাজ করতেন। 'সীমান্তে সৈন্য সৈকত' নামে অনুষ্ঠানের জন্য বসুন্ধরা যখন কাজ করছিলেন তখন তার শিলাদিত্যের সাথে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়টা প্রথমে প্রণয় এবং পরে পরিণয়ে পরিনত হতে খুব বেশি একটা সময় নেয়নি। বছরখানেক বেশ ভালভাবেই কাটে ওদের। বছরখানেক পর পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছিল শিলাদিত্য। শিলাদিত্য অনাথ আশ্রমে মানুষ। তাই বসুন্ধরার বাড়িতেই সে থাকতো। ছুটিতে এসে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, বসুন্ধরার পরিবারকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে বেশ ভাল সময় কাটছিল। কিন্তু হঠাৎই সেসময় সীমান্ত পাড়ে কোন একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় শিলাদিত্যকে অতিসত্ত্বর ছুটি বাতিল করে ফ্রন্টে ছুটে যেতে হয়। কিন্তু তারপর থেকে শিলাদিত্যের কোন খবর নেই। ততদিনে বসুন্ধরার ঔরসে চলে এসেছে বসুন্ধরা ও শিলাদিত্যের ভালবাসার চিহ্ন মণীশ মানে মনু। পাগলের মতো শিলাদিত্যের দেওয়া নম্বরে ফোন করতো বসুন্ধরা। কিন্তু কেউ ফোন ধরতো না। বসুন্ধরার বাবা অর্থাৎ মনুর দাদু তা-ও চেষ্টা করেছিলেন সীমান্ত পাড়ের সেনাবাহিনী থেকে শিলাদিত্যের খোঁজ নেওয়ার। কিন্তু নাহ্! সব চেষ্টাই যেন বিফল হয়ে গেল। একটা জলজ্যান্ত মানুষ যেন হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে গেল। বসুন্ধরাও আস্তে আস্তে কেমন যেন চুপ মেরে গেল। মনুকে জন্ম দিতে গিয়ে ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। যখন মনুর ছয় বছর বয়েস তখন বসুন্ধরা ইহলোকের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেল সেই না ফেরার দেশে।
এই সবকিছুই মনু তার দাদু-দিদা থেকে শুনেছে। এমনিতে দাদু-দিদা মনুকে ভীষণ ভালবাসে। তার কোনরকম প্রয়োজন কখনও অপূর্ণ রাখেন না। কিন্তু তবুও যখন মনু দেখে যে স্কুলে স্পোর্টস-ডে বা প্যারেন্ট-টিচার মিটিংয়ে সবার বাবা-মা আসে তখন তার খুউউব কষ্ট হয়। কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দেয় না। শুধু বাড়ি ফিরে বাবা-মায়ের ছবিটা নিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। দাদু-দিদা যদি জানতে পারে যে মনুর মনে এত কষ্ট জমা আছে তাহলে তো ওরাও খুব কষ্ট পাবে! মনু ওদের খুব ভালবাসে। তাই নিজের কষ্টটাকে লুকিয়ে রাখে।
আজ মনুর রেজাল্ট বেরোবে। মনু অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠবে। রেজাল্ট নিয়ে মনুর মনে কোন ভয় নেই। সে মোটামুটি ভালই রেজাল্ট করে। কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। আজকাল স্কুলে যাওয়ার পথে কিছু ছেলে তাকে বেশ বিরক্ত করে। ছেলেগুলো বিজাপুর বস্তির। মনু দেখেছে ওই ছেলেগুলো সিগারেট খায়। ওদের হাতে সবসময় একটা ছোট আকারের বোতল থাকে। ওইসব বোতলে সাদা সাদা কী যেন ভরা থাকে সেগুলোও খায়। বড়ো দুর্গন্ধ বেরোয় তা থেকে! মনুর ওদেরকে খুব ভয় করে। অন্য কোন ঘুরপথে যে সে স্কুলে যাবে তারও উপায় নেই। স্কুলে যাওয়ার এই একটাই রাস্তা। স্কুলের সবাই মনুকে 'ভীতু, ভীতু' বলে প্রচণ্ড খ্যাপায়! আসলে মনু ভয়টা একটু বেশীই পায়। এখনও রাতে দাদু-দিদার সঙ্গেই ঘুমোয়। দাদু-দিদা এমনিতেই তাকে নিয়ে যথেষ্ঠ চিন্তায় থাকেন। এই নতুন উৎপন্ন উপদ্রবটির কথা বলে মনু ওদেরকে আর ব্যতিব্যস্ত করতে চায়নি। আর তাছাড়া আরেকটি কারণও আছে। মনু আসলে চায় যে তার নাম থেকে এই 'ভীতু'র তকমাটা মুছে যাক। তাই আরকি….।
অষ্টম শ্রেণীর রেজাল্টও বেশ ভাল হয়েছে। রেজাল্ট নিয়ে মনু বেশ ভয় ভয় মনে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। রাস্তায় সেই মোড়ে যেখানে ছেলেগুলো আড্ডা দেয় সেখান মনু যাওয়ার আগে মোড়ের কোনাটা থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখলো যে ছেলেগুলো নেই। মনু নিশ্চিন্তে মোড়ের দিকে পা বাড়ায়। মোড়ের রাস্তাটা যেমাত্র পেরোতে যাবে ঠিক সেইসময়ই কোত্থেকে যেন ভুঁইফোড়ের মতো ওরা সামনে চলে এল। মনু বেশ জোরে আঁতকে উঠল! ওর ভয় পাওয়া মুখটা দেখে বস্তির ছেলেগুলো জোরে জোরে হাসতে লাগল।
ওদের একজন বলল, 'দেখ, দেখ নামটা হেব্বি দিয়েছে, এক্কেবারে ম্যাচিং...কী 'ভীতু'... ভীতু কী ভয় খেল নাকি।' বলে ছেলেগুলো হাসতে লাগল।
মনু এবার সত্যিই চমকে গেল। 'ভীতু' নামে তো তাকে স্কুলে ডাকা হয়। এই নামটা ওরা কিভাবে জানলো? ঠিক তখনই ওদের পেছন থেকে শয়তানের মতো হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এল রাতুল।
মনুর ক্লাসের সবচেয়ে বখে যাওয়া ছেলে রাতুল তাকে প্রথম 'ভীতু' নামটা ধরে খ্যাপাতো। তারপর রাতুলই ক্লাসে ছড়িয়ে দেয় এই 'ভীতু' নামটা। রাতুল পরপর দুবছর ফেল করে এবার মনুদের ক্লাসে আছে। হেডস্যার যদিও রাতুলকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন যে এবারও যদি সে ফেল করে তাহলে তাকে স্কুল থেকে রাস্টিগেট করে দেওয়া হবে। যদিও রাতুলের সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই! সে অকারণে মনুকে বিরক্ত করেও বেশ মজা পায়। যেমন ক্লাস ফাঁকা থাকলে বিকট আওয়াজ করে মনুকে চমকে দিয়ে বা গলার আওয়াজ বিকৃত করে ভয় পাইয়ে খুব মজা পায়। তাছাড়া স্কুলে ঢোকার মুখে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া বা ক্লাসে মনুর বসার জায়গায় চুইংগাম চিবিয়ে চিটকে দেওয়া বা অফপিরিওডে মনুর ঠিক পেছনের বেঞ্চে বসে কলম দিয়ে ক্রমাগত খোঁচা দিতে থাকা। রাতুলের বিরুদ্ধে একবার শিক্ষকের কাছে নালিশ জানিয়েছিল মনু। ওই এক/দুদিন ঠিক ছিল। আবার যেই কে সেই! কিন্তু এবার মনু ভেবেছিল এসবের প্রতিবাদ সে করবে। এই তো সেদিনের কথা। টিফিন পিরিয়ডে মনু সবেমাত্র টিফিনবক্সটা খুলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে রাতুল ছোঁ মেরে অর্ধেকটা টিফিনটা তুলে নিলো। এটাও প্রায় রোজেরই ঘটনা। কিন্তু এবার মনু করল কী, টিফিন বক্সের ঢাকনাটা দিয়ে রাতুলের হাতের উপর জোরে চেপে ধরল। এদিকে টিফিনবক্সের মধ্যে রাতুলের হাত এবং ওই অবস্থায় ঢাকনাটা দিয়ে মনু এতো জোরে চাপা দিয়ে আছে যে হাতটা বেশ ব্যথা করছে। এরকম বেকায়দায় রাতুল কখনও পড়েনি। মনুর দিকে তাকাতেই দেখে সে মিটিমিটি হাসছে।
দাঁতখিঁচিয়ে রাতুল বলল, 'কাজটা ভাল করলি না মনু। এর ফল একদিন তোকে ভুগতে হবে।'
এরপর রাতুল আর মনুকে বিরক্ত করতো না। মনুও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। এরই মাঝে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় মনুও পড়াশোনা আর প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আজ এই বস্তির ছেলেগুলোর সাথে রাতুলকে দেখে মনুর মনে এক অশনি সংকেত দেখা দিলো।
মনুকে দেখে রাতুল বলল, 'কি রে সেদিন তো খুব হম্বিতম্বি করছিলি! আজ হঠাৎ চুপসে গেলি কেন, অ্যাঁ?'
বস্তির ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বললো, 'এএ, সুনলাম নাকি এই হেঁদোটার মা-বাপ নাকি ফুঁকে গেছে,অ্যাঁ, ঠিক।'
দ্বিতীয়জন বলল, 'শাল্লা! অনাথের বাচ্চা হয়ে বসের সঙ্গে মাতব্বরি করছি্স।'
এবার মনু মুখ খুলল।
বলল, 'মুখ সামলে কথা বলো। অনাথ কাকে বলছো তোমরা।'
দ্বিতীয় ছেলেটি রাতুলকে বলল, 'বস! বাচ্চার মুখে দেখি কথা ফুটেছে।'
রাতুল ফস করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল, 'তবে আর বলছিলাম কি! এইজন্যই তোদেরকে এর পেছনে লাগিয়েছিলাম।'
মনুর কাছে এবার ধীরে ধীরে সবকিছু পরিস্কার হতে শুরু হল যে, কেন এই বিজাপুর বস্তির বখাটে ছেলেগুলো অকারণে তাকে যাতায়াতের পথে বিরক্ত করতো। মনু দেখলো রাতুলসহ ছেলেগুলো হাতে মোটা লাঠি নিয়ে তার দিকে এগোচ্ছে। মনু বিপদের গন্ধ পেয়ে একপা দুপা করে পিছিয়ে ছুট লাগাল। ছুটতে ছুটতে মোড়ের রাস্তাটা প্রায় পেরিয়ে আসায় ছোটার গতি কমিয়ে দিল মনু। আর সেখানেই হল বিপত্তি! রাস্তায় আড়াআড়িভাবে রাখা একটা ইটের উপর হোঁচট খেয়ে মনু পড়ে গেল রাস্তায়। হোঁচট খেয়ে পড়ায় মনু দু'হাটুঁতেই বেশ চোট পেল! একটু সামলে উঠতেই দেখে সবকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
রাতুল একটি চুকচুক শব্দ করে বলল, 'এখন কোথায় পালাবি রে ভীতু! এখন তোকে বাঁচাবে রে ভীতু।'
বলেই লাঠি উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, 'মার শালাকে ধরে।'
মনু আগাম ভবিষ্যতে কথা ভেবে হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পরও যেমনটা ভেবেছিল তেমন কিছুই হল না। শুধু 'উহঃ', 'আহঃ', 'স্যাত', 'ধুপ্' এই জাতীয় কিছু শব্দ ভেসে আসতে লাগল কানে। মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে মনু মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে দেখে যে, মনুদের বাড়ির সামনের সেই ভিখারীটি কোথা থেকে এসে ওদের লাঠি দিয়েই ওদেরকে মারছে। মার খেয়ে ওরা সবাই রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
হাতের লাঠিটা রাস্তায় ঠুকে ভিখারীটি রাগতঃ দৃষ্টিতে মনুর দিকে তাকিয়ে বলল, 'পেত্তিবাদ কইরতে পারিস না? নিজের জন্য এখন পেত্তিবাদ যদি কইরতে না পারিস তবে কবে আর পারবি? আমার পোলাটাও তোর মতোই হ্যাদাব্যাদাই ছিল। পড়াশুনাটা জানতো ভাল। তাই তো গতর খেটে পোলাটাকে বড়ো ইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়েছিলাম। কিন্তু কী লাভ হল! ওই বড়োলোকের পোলাগুলো অন্যায়ভাবে মেরে ফেলল আমার পোলাটাকে। ওর মা তো সঙ্গে সঙ্গে শেষ। এই আমিই শুধু তার কাছে যেতে পারিনি। এই দুনিয়াটা বড্ড নিষ্ঠুর রে বাপ। নিজের ঘাড় শক্ত করে মাথা উঁচু করে যদি চলতে না পারিস তবে এই দুনিয়া তোকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দিতে সময় নেবে না।'
মনুর চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পরছে তখন। এদিকে হয়েছে কি রাস্তার উপর এতো আওয়াজ শুনে বিশেষ করে মনুকে রাস্তায় পরে থাকতে দেখে আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এল।
একজন বললেন, 'কী হয়েছে মনু? এরা কারা?'
মনু মাথা ঘুরিয়ে ভিখারীটিকে কোথাও দেখতে পেল না। মনুকে ওরা ধীরে ধীরে উঠিয়ে দাঁড় করালে সে একে এক সব বলল।
অন্য একজন বলল, 'আরে এরা তো সেই বস্তির ছেলেগুলো। কদিন ধরেই দেখছি এদের এই পাড়ায় আনাগোনা বেড়েছে। আর এ তো বিশ্বাস ব্যবসায়ীর ছেলে। আমার ছেলেমেয়েকেও সে প্রচণ্ড বিরক্ত করে। আজ এর হচ্ছে! একে আজ ছাড়বো না আমি।'
এরমধ্যে কেউ পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশকে দেখে ছেলেগুলোর মুখ পাংসুবর্নের হয়ে গেল। এতদূর যে ব্যাপারটা গড়াবে ওরা ভাবতে পারেনি। মনুকে পাড়ার লোকেরাই ফার্স্টএইড করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। ওদিকে বিশ্বাস ব্যবসায়ী পাড়ার লোকের কাছে প্রায় হাতেপায়ে ধরে ছেলের তরফ থেকে ক্ষমা চাইলেন। বাড়িতে বসে গরম গরম হলদি-দুধ খেতে খেতে মনু তার দাদু-দিদাকে রাস্তায় এবং স্কুলে ঘটা সমস্তকিছু খুলে বলল। ভিখারীর কথা শুনে মনুর দিদা বললেন, 'কয়েকমাস আগে খবরের কাগজে পড়েছিলাম বটে এমন একটা ঘটনার কথা। কলেজের প্রথম বর্ষের একটি ছাত্রকে তৃতীয় বর্ষের দুজন ছাত্র শুধু গায়ের জোর দেখাতে গিয়ে মেরে ফেলেছিল। ওই দুজন খুব বড়োলোকের ছেলে ছিল। তাই কেসটা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।'
প্রায় এক সপ্তাহের পর আজ মনু স্কুলে এসেছে। বাড়ি থেকে বেড়োনোর সময় সে ওই ভিখারীটিকে অনেক খুঁজেছিল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়নি তাকে। যেই গাছের তলায় ভিখারীটি বসতো সেখানে গিয়ে একটু খুঁজতেই মনু একটা খবরের কাগজের কাটিং দেখতে পেল যাতে লেখা ছিল 'মেধাবী ছাত্রের নৃসংশ হত্যা। টাকার জোরে পেল অপরাধীরা ছাড়া'। শিরোনামটির নিচে একটি বছর কুড়ির ছেলের ছবি। মনু বুঝতে পারল এইটাই ছিল সেই ভিখারীটির ছেলে। ছেলেটির কথা ভেবে মনুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে মনু একটি সিদ্ধান্ত নিলো।
স্কুলে এসে জানতে পারল রাতুলকে তার বাবা টি.সি. দিয়ে নিয়ে চলে গেছে। তাকে নাকি কোন একটা বোর্ডিং স্কুলে দেবে। ক্লাসের সবাই তাই বেশ স্বস্থিতে আছে। আজ প্রথমদিনের ক্লাস বেশ ভাল হল। বাড়ি ফিরে মনু তার দাদুকে বললো, 'দাদু আমি ভেবেছি আর ভয় পেয়ে আমি চলবো না। তোমরাও আমার জন্য এতো চিন্তা করো না। যার বাবা-মা ফাইটার ছিল সে কী আর দুর্বল হতে পারে।'
মনুর কথা শুনে উঁনার বুকটা আজ বহুবছর পর আবার গর্বে ফুলে উঠল।
Sunday, July 10, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -10
চার
পরদিন অশ্রুসিক্ত অবস্থায় ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা মহানগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। করার জন্য বাবার কাছে সাশ্রু নয়নে বিদায় নিতে এলাম। বিদায় নেবার আগে পাড়ারই। এক পিসিমার উপর ভার দিলাম বাবাকে পরিচর্যা করার জন্য। তথাপি বাবাকে ছেড়ে যাবার আগে কি দারুন মর্মপীড়া পেয়েছিলাম তা বর্ণনাতীত। তবুও সেদিন ভবিষ্যতের রঙ্গীন আশায় ও নারীজীবনের বিপদ আপদ অগ্রাহ্য করে রন্টুদার সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
Thursday, July 7, 2022
উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -9
Wednesday, July 6, 2022
ছোট গল্প - আজব নগরের কথা || লেখক - মিঠুন মুখার্জী || Short story - Ajob Nagorer Kotha || Written by Mithun Mukherjee
আজব নগরের কথা
মিঠুন মুখার্জী
আজ থেকে কয়েক শ' বছর আগে আজব নগর নামক একটা জায়গা ছিল। সেখানে সব আজব আজব ঘটনা ঘটত। এই দেশের সকল মানুষ চাইলেই সব চাওয়া পুরন করতে পারতেন। তার জন্য রাজ্যের রাজার কাছে দরবার করতে হতো। রাজা প্রজাদের সমস্ত মনোবাসনা পূরণ করতেন। রাজা অজয় বর্মা খুব দান-ধ্যান করতেন। তাঁর তিন রানী ছিল। তিনজনই খুব সুন্দরী, ফর্সা এবং জ্ঞানী ছিলেন। প্রত্যেক পত্নীর সঙ্গে রাজা আলাদা আলাদা ভাবে সময় দিতেন। তাঁদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর ছিল। বড় রানীর নাম রজনী। ফুলের মতো সুন্দর ইনি। স্বভাবেও খুব কোমল প্রকৃতির। এই রানীর এক পুত্র সন্তান ছিল। নাম রবি বর্মা। মেজো রানীর নাম সুদর্শনা। যেমন দেখতে, তেমন গুন ছিল এই রানির। এই রানির একটি মেয়ে ছিল--- নাম রুপা বর্মা। আর ছোট রানীর নাম ছিল গান্ধারী। এই রানীকে দেখতে সুন্দর হলেও মন তেমন সুন্দর ছিল না। তাছাড়া এর কোন সন্তান হয়নি। রাজা অজয় বর্মা এই রানীকে বিবাহ করেছেন মাত্র দুই বছর। এই রানী কালাবিদ্যা জানতেন। তাছাড়া তাঁর বাবা একজন মুনি ছিলেন এবং মা একজন রাক্ষসী। এই খবর কেউ জানত না। গান্ধারীর মা মানুষের রূপ ধরে থাকতেন। একমাত্র গান্ধারী ও ওর বাবা বিষয়টা জানতেন। গান্ধারীর মধ্যে দুটি সত্তা লুকিয়ে ছিল। সে যেমন মানুষ, তেমনি রাক্ষসীও ছিল বটে। বড় রানী ও মেজোরানীর প্রতি অন্তরে তার বড়ই ঈর্ষা ছিল। তাদের সামনে ভালো ভাব বজায় রেখে চলতেন। অথচ ভিতরে ভিতরে ক্ষতি চাইতেন।
ছোটরাণীর জন্মানোর পর বড় হওয়ার কাহিনী সবার অজানা ছিল। ছোট বেলায় একবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। মাথায় চোট পেয়ে রক্ত বেরিয়েছিল। তাঁর মা সুহাসি রাক্ষসী রেগে গিয়ে নিজের শরীর থেকে ছুরি দিয়ে কেটে, রক্ত বের করে, সেই রক্ত গান্ধারীর বুকে ও কপালে ধরে মন্ত্র পড়েছিল। মিনিটখানেকের মধ্যে গান্ধারী বড় হয়ে শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন। তাঁর রাক্ষসীর মতো দাঁত ও হাতে-পায়ে নখ আছে। কিন্তু কালা শক্তির বলে সে সেগুলিকে বস করে রেখেছেন।
রাজা অজয় বর্মা কোনদিন গান্ধারীর আসল রূপ দেখেন নি। একবার একটা ছাগল এক নিশ্বাসে মুখের মধ্যে টেনে নেওয়ার সময় হঠাৎ পিছন থেকে রাজা তাঁকে ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সে ছাগলটাকে উদরস্ত করে নেয় এবং তারপর মানুষের রূপে ফিরে আসেন। রাজা ঠোঁটের উপরে একটু রক্ত দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন হয়তো কেঁটে গেছে। তিনি বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দেননি।
প্রত্যেক বছর ছেলে রবি বর্মা ও মেয়ে রুপা বর্মার জন্মদিন রাজা অজয় বর্মা খুব আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করেন। রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের ঐদিন দুপুরবেলা পেট ভরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেন তিনি। তাছাড়া তাঁর রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের চাহিদা ও অভাব তিনি ওই দিন মেটান। কারোর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কারোর চাষের জন্য বলদ প্রয়োজন, কারো শরীর খারাপের পথ্য কেনার প্রয়োজন, কারো খাজনা দিতে পারছে না তা মুকুবের আবেদন, কারো সাংসারিক ঝামেলা মেটানোর আর্জি। সব সমস্যা নির্দ্বিধায় মেটাতেন তিনি। সকল প্রজারা রাজা অজয় বর্মার ধন্য ধন্য করত। বড় ও মেজোরানী মনে মনে খুব খুশি হলেও ছোটরানী তা কোন মতে মেনে নিতে পারতেন না। তিনি চাইতেন, সুযোগ বুঝে দুই রাণী ও তাঁদের সন্তানদের হত্যা করে অজয় বর্মার একমাত্র রানী হয়ে থাকবেন। তিনি তাঁর জন্য যা করার প্রয়োজন তাই করবেন বলে মনে মনে সংকল্প করেন। রাজবাড়ীতে ছোট রানীর বাবা-মা তেমন আসেন না। যদি রাজার কাছে ধরা পড়ে যান।
জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রাজা অজয় বর্মা প্রজাদের বস্ত্র-চালও বিতরণ করতেন। তাছাড়া ছাগল ও গরু দান করতেন। সেই সব নিয়ে প্রজারা মহানন্দে বাড়ি ফেরার সময় কারও কারও আর কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না। প্রজাদের প্রাপ্ত গরু ও ছাগল তো ছোটরাণী খেতই, সাথে সাথে প্রজাদেরও ভক্ষণ করতেন---যাতে তার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্য দিতে না পারে।
একদিন রাজা অজয় বর্মা পার্শ্ববর্তী বিদিশার রাজার আমন্ত্রণ রক্ষার্থে সৈন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে মন্ত্রীর হাতে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ছোট রানী সেই সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় বড় রানী তাঁর ঘরে পূজো করছিলেন ও রবি বর্মা ঘরের মধ্যে খেলছিলেন। তখন ছোট রানী গান্ধারী একজন সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করে বড় রাণীর ঘরের সামনে এসে ভিক্ষা চাইলেন। বড় রানী পুজো করতে করতে হঠাৎই বাইরে এসে সন্ন্যাসীকে দেখে দান স্বরূপ কিছু ফল দিতে গেলেন। হঠাৎ সন্ন্যাসী তাঁর হাত ধরে মহাশূন্যে উড়ে গেলেন। এই দৃশ্য দেখে বড় রানী জ্ঞান হারালেন। এদিকে রবি বর্মা মাকে না দেখে মেজ মাকে গিয়ে জানান। তার মাকে সে কোথাও দেখতে পারছে না। তখন মেজোরানী মন্ত্রীকে খবর দেন। সমস্ত প্রাসাদময় বড় রানীর খোঁজ চলে। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। রবি বর্মা মাকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই খবর পাশের দেশে দূত মারফত পেয়ে রাজা অজয় বর্মা সেইদিনই নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন। রাজপ্রাসাদে এসে বড়রাণীর জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। কে এই কাজ করল, কোথায় গেল সে--- নানান প্রশ্ন তাঁর মনে উঁকি দিতে লাগল। তিনি রাজসেনাপতিকে ডেকে বললেন---"আশেপাশের রাজ্যে এবং নিজেদের রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সৈন্য পাঠিয়ে রানীর খোঁজ করুন। যেখান থেকে হোক বড় রানীকে খুঁজে আনতে হবে।" রাজার আদেশ মতো সেনাপতি কিছু সৈন্যদেরকে রাজ্যের পূর্বে ও দক্ষিণে বিদিশা ও কৃষ্ণনগরে পাঠিয়ে দিলেন এবং তিনি নিজে কিছু সৈন্য নিয়ে আজব নগরের আনাচে-কানাচে রানীর খোঁজ করতে চলে গেলেন।
এদিকে বড় রানীকে এক গুহার মধ্যে এনে একটা বোতলের মধ্যে বন্দি করে রাখেন ছোট রানী গান্ধারী। তাঁর আসল রূপ বড় রানীকে সে দেখায় না। তাঁর মা ও কিছু সাধারন রাক্ষসের উপর বড় রানীর দায়িত্ব দিয়ে ছোট রানী রাজ্যের ফিরে আসেন। বড় রানী বুঝতে পারেন, তিনি রাক্ষসদের খপ্পরে পড়েছেন। তবে এই সন্ন্যাসী আসলে যে কে এবং তাকে এখানে কোন স্বার্থে তুলে নিয়ে এসেছেন---তা তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ছোটরাণীর মার কাছে বারবার তাঁকে তুলে আনার কারণ বিভিন্ন কৌশলে বড় রানী জানার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।
এদিকে সেনাপতিরা বড় রানীর খোঁজে গেলে রাজা মেজোরানী ও ছোটরাণীকে রাজপ্রাসাদে ডেকে আনার জন্য দাসীদের আদেশ দিলেন। ছোটরাণীর ঘরে তাঁর প্রিয় দাসি তাকে ডাকতে গিয়ে আসল রূপ দেখে ফেলে। তখন সে চিৎকার করে পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ছোট রানীর চোখের আকর্ষণে দাসি নিজের থেকেই ছোটরাণীর কাছে ধরা দেয় এবং সে তাকে হত্যা করে পুড়িয়ে দেয়। ছোট রানী বুঝতে পারেন, রাজা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন নিশ্চয়ই। তারপর তিনি রাজপ্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করেন। এদিকে মেজোরানীও অনেক আগেই রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হন। রাজা তাদের দুজনকে জিজ্ঞাসা করেন---তাদের দিদিকে দেখেছেন কিনা। তাঁরা জানান--- "তাঁরা তখন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা কারকে প্রাসাদে আসতেও দেখেন নি।" ছোট বউ রাজার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসছিলেন। এরপর রাজা খোদাবক্স নামের একজন আল্লার বান্দাকে ডেকে আনার জন্য মন্ত্রীকে বলেন। মন্ত্রী লোক পাঠিয়ে খোদাবক্সকে ডাকতে পাঠান। এই খোদাবক্সের ছিল আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতা। এক গামলা জলে মন্ত্র পড়ে যা চাইতেন তাই দেখতে পারতেন। তার একটি জাদুর চাটাই ছিল। সে সেই চাটাই করে যেখানে খুশি যেতে পারতেন। এমনকি শত্রুকে আঘাত না করে মন্ত্রের দ্বারা অকেজো বানিয়ে দিতে পারতেন।
খোদা বক্সের কথা শুনে রাক্ষসী গান্ধারী ভয় পেয়ে যান। তিনি ভাবলেন--- 'ও আসলে তাঁর সমস্ত রহস্য উন্মোচন হয়ে যাবে।' তখন তিনি রাজাকে বললেন--- "খোদা বক্সের কি দরকার? দিদি হয়তো আশেপাশের কোথাও গেছেন। সমস্যায় পড়েছেন বলে আসতে পারছেন না। এসে পড়বেন। চিন্তা করবেন না। খোদা বক্সের কোন দরকার নেই।" রাজা অজয় বর্মার ছোটরাণীর কথায় সন্দেহ লাগে। মনে মনে ভাবেন--- "ছোটরাণী এভাবে বাঁধা দিচ্ছেন কেন? তাহলে ও কিছু করেনি তো!" পরক্ষণেই আবার মনে হয়--- "না, না। আমার ভুল হচ্ছে। ও কি করবে? ওদের বড় রানী এত ভালবাসেন।"
ঘন্টা দুয়েক পরে খোদাবক্স রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হন। সমস্ত ঘটনাটা রাজার মুখে শুনে তিনি এক গামলা জল আনতে বললেন। একদাসি তাড়াতাড়ি গিয়ে এক গামলা জল এনে খোদাবক্সের কাছে দিলেন। খোদাবক্স সেই জল মন্ত্রপূতঃ করে দেখলেন এক সন্ন্যাসীকে, যে বড় রানীকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন। কিছুতেই সে সন্ন্যাসীর মুখ দেখতে পেলেন না। তারপর দেখলেন, এক গুহার মধ্যে বড় রানী একটি বোতলের মধ্যে বন্দি রয়েছেন। আশেপাশে রাক্ষস-রাক্ষসীর দল। তিনি রাজা অজয় বর্মাকে জানান --- "রানীকে রাক্ষসেরা ধরে নিয়ে গেছে। তাকে এক গুহায় বোতলের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে।" কিন্তু তিনি যে সন্ন্যাসীর মুখ দেখতে পারছেন না সেকথাও জানান রাজাকে। এরপর ছোট রানী ভয় পেয়ে যান। এদিকে রবি বর্মা মাকে না পেয়ে খাওয়া-ঘুম বন্ধ করে দেন। শুধু কান্না করেন। তার মুখের দিকে তাকানো যায়না। নিষ্ঠুর ছোটরাণীর তাঁদের কষ্ট পেতে দেখে আনন্দ হয়। কিন্তু তিনি ভুলে যান, ধরা তাকে একদিন পড়তেই হবে। সেটি সময়ের অপেক্ষা। খোদাবক্স জায়গাটার নাম বলতে পারেন না। কিন্তু দিক নির্দেশ করে বলে দেন---এই প্রাসাদের উত্তর দিকে সমুদ্রের মাঝে একটা পাহাড়বেষ্টিত দ্বীপ আছে, সেখানে গুহার মধ্যে রাণীমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। রাজার একান্ত অনুরোধে খোদাবক্স তার জাদুর চাটাইতে করে রাজা, সেনাপতি, মন্ত্রী ও দশ জন সৈন্য নিয়ে সেই দ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
এদিকে রাজারা রওনা হওয়ার পর বালক রবি বর্মাকে ছোট রানী গান্ধারী তুলে নিয়ে যান। রানীর আসল রূপ দেখে বালক রবি বর্মা চৈতন্য হারান। খোদাবক্স তার চাটাইয়ের সাহায্যে সমুদ্র পার হয়ে, গাছপালা পার হয়ে অবশেষে সেই গুহার কিছুটা দূরে এসে নামেন। সৈন্যরা দেখেন--- গুহার প্রবেশ পথে একজন রাক্ষস সৈন্য হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজা তাঁর মন্ত্রীকে ও সৈন্যদের নিয়ে গুহায় প্রবেশ করেন। গুহায় প্রবেশ করার সময় তাদের যে সমস্ত রাক্ষস-রাক্ষসীরা বাঁধা দেন, তাদের হত্যা করেন। অবশেষে দেখেন চুল ঝাঁকড়া এক রাক্ষসীর হাতে একটা বোতল। তার মধ্যে বড় রানী বন্দি। রাজা ওই রাক্ষসীর কাছে এগোতেই সে মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ে দেয়। খোদাবক্স রাক্ষসীকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্র পড়ে। ফলে রাক্ষসীর মুখ দিয়ে আগুন বের করার শক্তি চলে যায়। এরপর রাক্ষসী বড়রাণীকে নিয়ে সেখান থেকে উড়ে যায়। জাদুর চাটাইতে করে খোদাবক্স সবাইকে নিয়ে পিছু নেয়। উড়তে উড়তে রাক্ষসী আজব নগরে এসে উপস্থিত হয়। রাক্ষসী মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশাল আকার ধারণ করে এবং উপর থেকে বড় রানীকে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখায়। সে বলে--- "কেউ যদি আমার দিকে আর এক পাও এগোয়, তাহলে রানীকে মেরে ফেলবো।" রাজার নির্দেশে আর কেউ এগোয় না। খোদাবক্স জাদু শক্তির দ্বারা ছোটরাণীর মাকে বন্দি করে ফেলেন। সে শত চেষ্টায় এ বাঁধন ছিড়তে পারে না। চাঁটাইতে উড়ে গিয়ে রাক্ষসীর হাত থেকে বোতলটি উদ্ধার করেন। তারপর মন্ত্রের দ্বারা বোতল ভেঙে বড় রানীকে বের করেন এবং রানীকে আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। এমন সময় গান্ধারী রাক্ষসী তাঁর আসল রূপ নিয়ে সকলের সামনে আসেন ও সঙ্গে অসাঢ় রবি বর্মাকে নিয়ে আসেন। রাজাকে বলেন--- "আমার মাকে ছেড়ে দিতে বল রাজা। নতুবা তোর ছেলেকে হত্যা করব।" রাজা খোদাবক্সকে সুহাসি রাক্ষসীর বাঁধন খুলে দিতে বলেন। খোদাবক্স গান্ধারীর ডান হাতে ছয়টা আঙ্গুল দেখে চিন্তা করেন এবং বুঝতে পারেন। তিনি রাজাকে বলেন--- "এই রাক্ষসী সেই সন্ন্যাসি, যে বড়রাণীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ওকে ওর ছয়টা আঙ্গুল দেখে চিনতে পেরেছি।" খোদাবক্সের কথা শুনে রাজাও মনে মনে চিন্তা করলেন---তাঁর ছোট রানীরও ডান হাতে ছটি আঙ্গুল। তাহলে ছোট রানীই কি!! এরপর রাজা গান্ধারীকে জিজ্ঞাসা করলেন---"কে তুই? কি চাস?" তখন গান্ধারী বিকট হাসি হেসে ছোটরাণীর রূপে ফিরে আসেন। রাজা তাকে দেখে বিস্মিত হন। তিনি ছোটরাণীকে বলেন---"তুমি একজন রাক্ষসী! আমার সাথে এতদিন ছলনা করছিলে!! কেন তুমি বড় রানীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলে?" এরপর ছোট রানী তাঁর উদ্দেশ্যের কথা সকলের সামনে বলে ফেললেন। রাজা ছোট রানী গান্ধারী রাক্ষসীর উপর প্রচন্ড রেগে গেলেন।
এরপর মুহূর্তের মধ্যে খোদাবক্স গান্ধারীকেও বন্দি করে ফেললেন। তারপর গান্ধারীর হাত থেকে রবি বর্মাকে উদ্ধার করলেন। রাজ সৈন্যরা সুহাসি ও গান্ধারী কে তলোয়ার দিয়ে রাজার আদেশে মারার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের দুজনের কেউই মরলো না। তাঁরা বিকট হাসতে লাগলো। বলল--- "আমাদের মারার ক্ষমতা তোদের নেই। আমরা অমর।" এমন সময় খোদাবক্স চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়ে জানতে পারলেন আজব নগরের পশ্চিমে একটি বট গাছের কোটরে দুটি পায়রা আছে। সেই পায়রার মধ্যে সুহাসি ও গান্ধারীর প্রাণ লুকানো আছে। সেই পায়রা দুটোকে মারতে পারলে তবেই এরা মারা যাবে।
খোদাবক্স রাজাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এসে সমস্ত বিষয়টি জানালেন। তারপর জাদু চাটাইতে খোদাবক্স রাজাকে নিয়ে সেই বটগাছের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এদিকে সেনাপতি, মন্ত্রী ও সৈন্যরা রাক্ষসী দুজনের সাথে লড়াই করতে থাকে। বট গাছের সামনে এসে রাজা ও খোদাবক্স দেখেন, সেই পায়রা দুটোকে পাহারা দিচ্ছে দুটি বিষধর সাপ। খোদাবক্স তার জাদু শক্তির দ্বারা সাপ দুটিকে পরাস্ত করে পায়রা দুটিকে ধরে। রাজা ও খোদাবক্স এক একটি পায়রার ধর থেকে গলা আলাদা করে দেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা দেখেন রাক্ষসী দুজন চিৎকার করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং মারা যান। তারপর আগুন ধরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান।
এরপর খোদাবক্স ও রাজা অজয় বর্মা আজব নগরে ফিরে আসেন। রাজা খোদাবক্সের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মুক্তোর মালা, স্বর্ণমুদ্রা ও পাঁচ বিঘা জমি দান করেন। খোদাবক্স মহানন্দে বাড়ি ফিরে যান। রাজা তাঁর দুই রাণী ও ছেলে মেয়েকে নিয়ে সুখে বসবাস করেন। কোন অশুভ শক্তি তাদের জীবনে আর প্রবেশ করে না।
Monday, July 4, 2022
ছোট গল্প - চোরের ভয়ে || লেখক - কল্যাণ সেনগুপ্ত || Short story - Chorer Bhoie || Written by Kalyan sengupta
চোরের ভয়ে
কল্যাণ সেনগুপ্ত
আলো দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দরজা খুলে দাড়ালে।উত্তেজনায় মুখ লাল।গলা নামিয়ে বললে " দাদা আজ বিকেলে ডিভোস হবে"।
মাথার মধ্যে তখনও গোলটা কেন খেলাম সেটাই ঘুরছে ।তারমধ্যে আলো র এরকম বদখত খেলার নমুনা শুনে পিলে চমকে গেল "সেটা কি?"
"তুই জানিস না? ঐ যে রে টিভি তে দেখায় সেই ডিভোস হবে"। আলো বললে " আমি দেখব দাদা ।কি মজা ।টিভির মত হবে, দেখব। আমি ডিভোস দেখিনি"।
কী বলে ? ঠিক বুঝতে পারছিনা ব্যাপারটা। কার সাথে কার হবে? আলো বললে" দুর!তুই কিসসু জানিস না"।
আমার মাথায় সেই গোল টা। বললাম "তা জানিনা, এখন সর আমি বাথরুমে যাবো হাত পা ধুতে"।আলো ছাড়বার পাত্রী নয়। বলেই চলে
"শোন , বড় কাকা একদিকে আর কাকিমার দুই ভাই হারু কাকা, নাড়ু কাকা মনেহয় আরেক দিকে । খুব সম্ভব ওরাই ডিভোস করবে"। বিকেলে আবার মাঠে কদমতলায় সঙ্গে ম্যাচ ওখানে তো না গেলেই নয়। প্রেস্টিজের ব্যাপার। এরমধ্যে বাড়িতে যদি ডিভোস হয় তবে কি হবে যে জানে। সিঙ্গারা, মিষ্টি তো আমাকেই আনতে হবে। মা কে বললাম " কি ডিভোস না কি হবে তার জন্যে মিষ্টি আনতে হলে আগেই বল এনে রেখে যাব"।
মা কথা বাড়ালে না । বললে" যা , যা, তোর কোথায় বনে বাদাড়ে ম্যাচ আছে ।পারলে আলোকেও নিয়ে যা। মায়ের মুখ বেশ গম্ভীর। জ্যাঠামশাই কে বাবা ডাকিয়ে এনেছে। তার মানে একটা জোর যুদ্ধ হবে নিশ্চই।
বাবা আটকে দিলে । ওনারা আসবেন ।যদি ট্যাক্সি ডেকে দিতে হয়। আজ বাবারা চার ভাই বাড়িতে। দুদিন আগে বড় কাকিমা আমাদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই নিজের বাড়ি চলে গেছে। বড় কাকা এত কথা বলে, কিন্তু দুদিন যাবদ মুখে কুলুপ এঁটেছে।
বাবা বলেছে "সেজ একটা খারাপ কিছু করেছে নিশ্চই। কিরে, ভুল করে গলার হার টার ছিনতাই করেছিলি নাকি?"
ছোটকা বললে" মেজদা তুমি যে কি বল। মোশন এ না থাকলে ছিনতাই বলে না। আর সেজদা কেন ছিনতাই করবে? দিব্যি সুস্থ লোক। রোজ কলেজ যাচ্ছে,পড়াচ্ছে। শুনেছি নেশাটেশা করলে ছিনতাই টা করতেই হয়। ওটা আপনাআপনি এসে যায়"।
বাবা বললে "নীচে চল, একবার দাদার সাথে বসে কথা বলা দরকার। কী বিশ্রী ব্যাপার সেজ করল।"
ছোটকা বলেই চলে "কিছু না ,মনে হয় সেজ বৌদি মোহনবাগান নিয়ে কিছু বলেছে"।
জ্যাঠা মশাই বললে " অনিমা তো আবার কট্টর ইস্ট বেঙ্গল"।
বাবা বললে ছোটকাকে " এটা আবার নতুন দিক খুলে দিচ্ছিস দেখছি।এই দিক টা তো ভাবিনি।"
জ্যাঠামশাই বাবা ,কাকাদের ডেকেছেন নীচের ঘরে। বেশ জমজমাট কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে দেখে আমি আর আলো পর্দার পিছনে জায়গা নিয়েছি। রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মনেহয় যুদ্ধের পরিকল্পনা হবে।মাঠে নামার আগে যেমন গোল হয়ে পরস্পরকে কাঁধে হাত রেখে মাথা নীচু করে শপথ নেয় অনেকটা সেই রকম। মা কে বলা হয়েছে সকালের লুচি, আর কালো জিরা ছড়ানো সাদা আলুর দম টা নীচে ই সব ভাই কে দিতে। সঙ্গে চা। ওফ! লুচি খেতে খেতে পরিকল্পনা হবে।
জ্যাঠা মশাই সবাইকে গম্ভীর দেখে উজ্জীবিত করতে বললেন" ব্রাদার্স , এটা যেন তেন লড়াই নয়। এটা হচ্ছে আমাদের প্রেস্টিজ কা"।বলে ছোট কার দিকে চাইলেন। ছোটকা ধরিয়ে দিলে " সওয়াল".। আবার শুরু করলেন "অনিমা কে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে ছিনিয়ে আনতে হবে"। এরপর স্বভাব সিদ্ধ ভাবে গলা নামিয়ে বললে " সেজ তুই ঘোড়া চড়তে পারিস?" বলে মিচকি মিচকি হাসলে।ছোট কা উচ্চ স্বরে হেসে বললে " দারুন বলেছ। ঘোড়ায় করে গিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে আসবে?
বড় কাকা যথারীতি চুপ। মাথা নিচু। কাগজ ওলটাচ্ছে। বাবা বললে " দাদা তুমি কি জান কেন অনিমা চলে গেছে ? আমাদের আগে কারণটা জানা দরকার। অনিমা সেজ কাকিমার নাম।
জ্যাঠা মশাই বললেন " সেজ, ছোট বেলা থেকেই ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। দোষের মধ্যে সময় পেলেই আমার একটু পা টানে।কী ঠিক বলেছি তো সেজ?"
বড় কাকা তেমন সাড়া দিলে না।
ছোট কা বললে " পা টানে মানে? হাত টান শুনেছি কিন্তু পা টান টা কি?
বাবা হেসে বললে " লেগ পুলিং"।
বড়কাকা ম্লান হাসলে।
আলো ফিসফিস করে বললে " দাদা এটা কি নতুন খেলা? তুই খেলেছিস?
আলো বড্ড কথা বলে ।বললাম " চুপ কর"।
ছোটকা বললে " সেজ বৌদি নিশ্চই দেশ তুলে কথা বলেছে।তাই মাথা গরম হয়ে গেছিল"।
জ্যাঠা মশাই বললেন" সেজ কিছু বল। তোর কথা তো আগে শোনা দরকার। আমি তো ভাবতেই পারছিনা আমার বিপ্লবী ভাই মালিক পক্ষ কে না ঠেঙ্গিয়ে, বাড়িতে বউ ঠেঙ্গাচ্ছে। ছি, ছি। লজ্জায় মাথা হেঁট। তোর ওপর আমার অনেক আশা ছিল।"
মা আর ছোট কাকী মা লুচি নিয়ে এল।টেবিলে রেখে মা বললে " বড় ঠাকুর পো, তুমি না বললে আমরা তো কোন দিশা পাচ্ছিনা। কিছু তো বল। দোষে গুনে মানুষ আমরা" ।
বাবা হাত তুলে থামিয়ে দেয় মা কে। আহা!" এমন করছ কেন? আগেই কত কিছু ধরে নিচ্ছ তোমরা" । তারপর উঠে বড় কাকা কে লুচির প্লেট টা এগিয়ে বলে " বলে ফ্যাল। আমরা আছি তোকে জান দিতে বাঁচাবো। সেই ছোট বেলায় দিপুদের বাড়ি থেকে আম চুরি করে আনার পর যেমন বাঁচিয়ে ছিলাম"।
বড় কাকা এবার মুখ খুললে ।বাবা কে বললে " বলছি, আগে ফুলকো গুলো খেয়ে নেই। জ্যাঠামশাই ভয় দেখিয়ে বললেন " ঠিক আছে চলবে। কিন্তু এর পর ও যদি না বলিস তাহলে কিন্তু আমি আবার গল্পের ঝাঁপি খুলে বসব। তখন কিন্তু শুনতে হবে"।
বাবা ছোট কা হেসে উঠলে। বড় কাকা সেই কুঁথে কুঁথে কাষ্ঠ হাসি দিলে।
লুচি শেষ হবার পর বড় কাকা বললে " দাদা তুমি তো এখন প্রায়ই থাকনা। অ্যাক্সিডেন্টের পর পায়ে র সেই যে অপারেশন করে প্লেট বসালো তারপর থেকে আমি নীচেই শুচ্ছি কারণ তোমার অনিমার ঘুমের মধ্যে বড় এপাশ ওপাশ করে ,যদি ঘুমের মধ্যে পা চালায় আর লেগে যায় তখন খুব কষ্ট হবে।
জ্যাঠামশাই বললেন " হ্যা , তো কি? ।তাহলে তো এরকম হবার কথা নয়"।
বড় কাকা বললে " ইদানিং খুব এলার্জি তে নিশ্বাসের কষ্টে ভুগছি। দিনের বেলা সব ঠিক আছে রাত্রে শুলেই দম নিতে কষ্ট। কোন খাবারের থেকে হচ্ছে।ডাক্তার এলার্জি টেস্ট করতে বলেছে" ।
বাবা বললে " তুই তো ট্রাকের বাইরে চলে যাচ্ছিস। কী হয়েছিল বল সেদিন রাত্রে? চোর বা ভূতের কোনো উপদ্রব নয় তো?"
জ্যাঠা মশাই হেসে উঠলেন ।বললেন"নিশ্চই ভুত দেখেছিল ছোট বেলার মত। সেজ র বরাবর ভুত আর চোর দের ফাজলামি পছন্দ নয়। ওদের কোনো ক্লাস ও নেই। মোস্ট সুবিধা বাদী। সাহসী লোকেদের ধরে না। যতসব হাবাগোবা, আগে থেকেই ভয় পেয়েই আছে তাদের কাছে যায়"।
ছোটকা অবাক "এরকম ত কোনদিন শুনিনি।চোর আর ভূতের ক্লাস?"
"সেজ তাই এদের একেবারেই পছন্দ করে না।"
বড় কাকা বললে " তোমার মনে আছে গ্রামের বাড়িতে ছোট বেলায় যখন বাইরের বাথরুমে যেতে হত রাত্রে তখন তোমায় ডাকতাম ?
জ্যাঠা মশাই বললে " সেতো স্পষ্টই মনে আছে। আমি ভুত তাড়াতাম আর তুই বাথরুম কর তিস। তোর সেই থেকেই চোর আর ভূতের প্রতি অসন্তোষ।" বড় কাকা এবার মুখ খুললে " তখন আসলে দু একবার দেখেছিলাম।"
"বলিস কি ? আগেতো বলিস নি? "
"একবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম পাশের আম গাছের নীচে একটা সাদা শাড়ি পড়া কে দাড়িয়ে আছে"।
"দ্যাখ , আমি ছিলাম না তখন তাই দেখতে পেয়েছিলি"।
"আর সেবার যখন নবরুপা অপেরা এসেছিল সেবার তোরা গেলি যাত্রা দেখতে। জ্বরের জন্যে আমি আর মা ছিলাম বাড়িতে ।সেদিন জানিস আমার জামা জানলা দিয়ে আকসি দিয়ে টানছিল জানলা দিয়ে"।
"কে?"
"চোর।"
ছোট কা অধৈর্য্য হয়ে বললে " বৌদির সাথে কি করেছিলি? সময় তো চলে যাচ্ছে। ওরা চলে আসবে মনে আছে? ওরা কিন্তু তোকে জেলের ঘানি টানিয়ে দিতে পারে"।
বড় কাকা বললে " ইদানিং মাঝে মাঝেই নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। রাত্রে ঘুম টাও কম হচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে । আর ঘুম ভেঙে গেলেই খালি মনে হয় নিচে আমি একা আজ ঠিক চোর আসবে"।
জ্যাঠা মশাই বললেন " কেন তোর এরকম মনে হয়? এসেছে নাকি?"
"না, ঘুম ভাঙলেই পাশের জানলার বাইরে ফিসফিস করে কথা শুনতে পাই। কেউ যেন প্ল্যান করছে । ঘুম না ভাঙলে কোন অসুবিধা নেই। নো চোর, নো ভুত। এই জন্যেই এই দেখো" বলে খাটের তলা থেকে বার করে একটা এক ফুটের একটা কাপড়ে জড়ানো লাঠি।
"এটা কি? এক ফুটিয়া দিয়ে কি হবে? কী করিস এটা দিয়ে? "
বড় কাকা বললে" খাটের পাশে এটা নিয়ে শুলে ঘুম টা গভীর হয়"।
"এ্যা? এটা কি ঘুমের ওষুধ? জ্যাঠা মশাই বলেনন " তোর তো মাথা টা দেখানো দরকার। যাইহোক তাড়া আছে বলে যা"।
ছোট কা বললে " তাহলে কাপড় জড়িয়েছিস কেন? কুশন ইফেক্ট? না ওর শীত করে মাটিতে শুলে?"
বড় কাকা এবার হেসে ফেললে বললে " আমি কোন প্রমাণ রাখতে রাজি নই।"
জ্যাঠামশাই হুঙ্কার দিলেন " প্রমাণ? কিসের প্রমাণ? এটাকি কোনো খুনের গল্প হচ্ছে নাকি? তবে প্রমাণ যদি বলিস তাহলে আমার সেই জাম্বিয়ার সেই খুনের ঘটনা বলতে হয়।"
ব্যস। ছোটকা শঙ্কিত হয়ে বলে উঠলে " ওরা কিন্তু এসে পড়বে দাদা। আগে ব্যাপারটা জানা দরকার না?"
জ্যাঠা মশাই ঈষৎ মনক্ষুন্ন হয়ে বললেন " হ্যা, সেতো বটেই। বল তারপর কি হল? লাঠি অবধি এসেছিলি।
"নিশ্বাসের কষ্টের জন্যে আজকাল ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে ।রাতবিরেতে ঘুম ভেঙে গেলে ব্যস, এরপর অসস্তি, এপাশ ওপাশ তারপর আবার নিশ্বাসের অসুবিধায় উঠে বালিস কাত করে শোয়া।"
"সেতো বুঝলাম , তারপর?"
"এখন মুশকিল হচ্ছে রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে ই মাঝে মাঝে ফিসফাস কথা শুনি জানলার পাশে"।
ছোট কা বললে" আরে পাশে তো মাটির রাস্তা পুনুদের বাড়ি যাওয়ার জন্যে। ওদের কেউ হবে, ওদের কেউ কথা বললে বাইরে তো শোনা যাবেই"।
"না না, তাহলে ফিসফিস কেন হবে।ওরা ঠিক চোর, বাইরে দাড়িয়ে প্ল্যান করছে। দুদিন এরকম আমি তোর কাকিমা কে শুনিয়েছি"।
"সেকি? কাকিমা তো ওপরের তলায়"।
বড় কাকা মাথা নাড়ল, "ওই তো কাকিমা মাঝে মাঝে এসে দেখে যায় আমি ঘুমাচ্ছি কিনা। নিশ্বাসের অসুবিধা বাড়ল কিনা"।
"তারপর?"
"আমার মাথার সামনে বাইরে যাবার দরজা।রোজ দরজা ,সামনের গ্রিলের দরজা দেখে শুই, খাটের তলা ও দেখে নেই। কিন্তু জানো, শুয়ে আছি, শুয়ে আছি , ঘুম প্রায় চলে এসেছে এমন সময় মনেহল দরজা টা বন্ধ করতে ভুলে যায়নি তো? আবার উঠে দেখি, তারপর শুই। কিন্তু সেদিন এক কান্ড হল"।
জ্যাঠা মশাই এর আর তোর সইছে না ।বললে " আসল ঘটনায় আয়, কুইক।"
হঠাৎ রাত্রে ঘুম টা ভেঙে গেল অস্বস্তি তে। মশারির বাইরে দরজার কাছে দেখি একটা ছায়া মূর্তি"।
"কেন সেদিন দরজা বন্ধ হয়নি?"
"কী জানি মনে নেই।কিন্তু জানো তো আমি ভয় পাই নি। ঠাণ্ডা মাথায় একটু সরে গিয়ে মশারীর পাশ দিয়ে হাত নামিয়ে রড টা খুঁজছি। এদিক ওদিক করে পেয়ে আসতে আসতে তুলে ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে আছি। চোখ অর্ধেক বুজে। এরপর দেখি ছায়া মূর্তি একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। যেই পায়ের কাছে এসে গেছে ব্যস হুস করে মশারী সরিয়ে রড নিয়ে দাড়িয়ে পড়েছি"।
"তারপর?"
"জানি একবারই সুযোগ পাবো।কোনো সুযোগ দেইনি তাকে। সোজা রডটা দিয়ে পিঠে প্রাণপণ এক ঘা।
জ্যাঠা মশাই ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন " দুর বাবা, কি আলতু ফালতু চোরের গল্প বলছিস। সেজ বৌমার সাথে কি হল সেটা বল।"
বড় কাকার মুখটা কেমন ঝুলে গেল। এত করুন অপরাধী মুখ কখনও দেখিনি। বললে" মারতেই তুমুল চিৎকার তোমার সেজ বৌমার।
"এ্যাঁ, কি বলছিস? অনিমা কোথা থেকে এল?" "ঠিক বলছিস? কেন এসেছিল সেজ বৌমা ওখানে?"
আফসোসের শেষ নেই ।বড় কাকা মিউ মিউ করে বললে " ও রাত্রে উঠে বাথরুমে গেছিল আর তখন মনে হয়েছিল আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা দেখে যাবে।"
ছোট কা মুখ গম্ভীর করে বললে" তুমি ওই লোহার রড দিয়ে বৌদি কে মেরেছ? চোর আর বৌদি এক হয়ে গেল? হায়, হায়। ভগবান। তুমি এটা পারলে করতে?"
কাঁচুমাচু হয়ে বড় কাকা বললে" কি করব বল? চোখে চশমা নেই, ঘর অন্ধকার, তার ওপর চোর এই আসে এই আসে অবস্থা ।আমার তখন কি তাল জ্ঞান আছে? বড্ড ভুল হয়ে "
একদম সরল স্বীকারোক্তি।
বাবা এই অবস্থায় ও আর গম্ভীর থাকতে পারলে না। মুচকি হেসে বললে " অনিমা যদি বউ পেটানোর কেস দেয়।তাহলে কিন্তু তোকে জেলের হাত থেকে বাঁচানো মুশকিল হবে। তুই আলো জ্বেলে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলি?"
"বলব কখন ? ওরে বাবারে, মেরে ফেলল রে, ।সে এমন কান্না জুড়ে দিল যে আমি ভ্যবাচাকা খেয়ে গেলাম। এমন উথাল পাতাল ব্যথা হচ্ছে যে কিছু বলতেই পারলাম না । ওর চোখ মুখ দেখে মনে হল আমি বোধ হয় খুন করতেই গেছি ওকে।"
জ্যাঠা মশাই বেশ গম্ভীর হয়ে বাবা কে বললেন " মেজ,ছোট কে নিয়ে এখুনি চল সেজ বৌমার বাড়ি। এটা যে ইচ্ছাকৃত ফাউল নয় সেটা তো বুঝিয়ে বলতে হবে। ওতো চোর ভেবে ব্যাপারটা করে ফেলেছে । বাবা আমতা আমতা করে বললে " বউ কে চোর ভাবা ব্যাপারটাও কি ঠিক হল? জ্যাঠা মশাই যথা সম্ভব হাসি চেপে বললেন " তোরা কিছু বলিস না ,আমিই কথা বলব ।তাড়াতাড়ি জামা প্যান্ট পড়"।
তিনজনে হন্তদন্ত করে বেড়িয়ে গেল। দেখলাম আপাতত খেলা শেষ। এখন বেড়িয়ে গেলেই হয়। দুপুর হয়ে গেল বড় কাকা খালি ঘর আর বার করছে।কেউ ফিরছে না দেখে মা বাবা কে ফোন করলে। দেখলাম কথা বলতে বলতে মার মুখ নির্মল হাসিতে ভরে গেছে। শুধু শোনা গেল " আমরা তাহলে খেয়ে নিচ্ছি"
ফোন রাখার পর বড় কাকা উদ্বিগ্ন হয়ে মা কে জিজ্ঞাসা করলে " মেজবৌদি কি হল? ওরা কি পুলিশে যাবে?
মা প্রথমটা না শুনে উত্তর না দিয়েই চলে যাচ্ছিল। বড় কাকা উদ্বিগ্ন মুখেভআবার বললে " কি হল বৌদি? ওরা যে আসছে না । কী হবে? পুলিশ আসবে বাড়িতে ?
মা হাসতে হাসতে বললে " তুমি, ছোট ঠাকুর পো, পিকু, আলো খেয়ে নাও।ওরা সবাই খেয়েদেয়ে আসবে।অনিমার বাবা ছাড়ছে না। আসবে তোমার বউ কে নিয়ে"।
মুখে আলো উদ্ভাসিত হয় বড় কাকার " যাক, তাহলে জেলে যেতে হচ্ছে এইবার , কি বল?মা বললে " দাদা তার সেজ ভাইয়ের চোরের আর ভূতের ভয়টা খুলে বলেছেন।কাকিমার বাবা খুব হেসেছেন ।ওনারা বুঝেছেন। খুব জোর হাসাহাসি হয়েছে ওখানে"।
স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বড় কাকা বললে " অনিমা কি বলল?"
"অনিমা বলেছে নীচে শুলেই তোমাদের চোর আসছে,আসছে হচ্ছে তাই আর নীচে শুতে হবে না।"
Sunday, July 3, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -9
বাবা অনেকখানি শান্ত হয়ে চোখের জল মুছে খাবারে মন বসালো। কোন প্রকারে দুপুরের খাবার খেয়ে রন্টুদা ও বাবা পৃথক পৃথক বিশ্রাম করতে থাকলো। আমি কোন প্রকারে খাবার খেয়ে জিনিষপত্র বাগিয়ে দেওয়াল ঠেস দিয়ে উদাস হয়ে অতীতের কথাকে চোখের সামনে টেনে এনে কোন রাজ্যে যে চলে গিয়েছিলাম জানি নে। এ এক কঠিন প্রতিযোগিতা, এই দৈন্য দারিদ্র্যতার প্রতিযোগিতায় জিততে কি পারবো?
মাথার কোষে কোষে চিন্তা, বাবার যে অবস্থা তার পক্ষে উপার্জন করা কোন মতেই সম্ভব নয়। আর্থিক অন্বেষণের কোন পথ খোলা নেই। কে আমাকে কাজ দেবে। কার কাছে গেলে দুমুঠো অন্ন যোগাড় করতে পারবো। এই চিন্তায় আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আমি জানি আমাদের গ্রামে যে সব নিম্ন জাতির মেয়েরা কাজ কর্ম করে, সেটা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। ওরা কেউ আমাকে সাথে নেবে না। হঠাৎ রন্টুদার ডাকে আমার তন্দ্রা কাটলো, আমাকে কাছে ডাকলো। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
রন্টুদা বলল, আমি জানি তুই কিসের জন্য মন মরা হচ্ছিস। শোন রমা, তোর মতো হাজার হাজার মেয়ে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে। বিভিন্ন ফার্মে, কারখানায় দিন মজুরী করে বাঁচার জন্য লড়াই করছে। সেই সুযোগ গ্রাম গঞ্জে নেই। আমাদের কলকাতায় প্রচুর মেয়ে বিভিন্ন কর্ম করছে, বিভিন্ন অফিস, আদালতে ও নানা প্রতিষ্ঠানে কর্ম করে, এমনকি লটারির টিকিট বিক্রি করে বাঁচার চেষ্টা করছে। তবে এই গ্রামে পড়ে থাকলে তোদেরকে তিলে তিলে মরতে হবে। এর কোন ব্যতিক্রম নেই। একমাত্র উপায় হলো আমার সাথে কলকাতায় চল কাজের যোগাড় করে দেব। আমার বাড়ীতে থাকার কোন অসুবিধা হবে না। তারপর নিজেকে স্বাবলম্বী করে মেসোমশায়কেও কলকাতায় নিয়ে যাবি। আশাকরি কোন অভাব থাকবে না। বিশেষ করে কলকাতা গেলে মনে হয়। মেসোমশায় ও পুত্রশোক ভুল যাবেন।
মনে রাখবি আমি যখন আছি তোদের কারো অসুবিধা হতে দেব না। তোরা আমার অতি আপন তাই তোদের কাছে ছুটে এসেছি। সুমন্তর সাথে এসে তোদের অবস্থা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
রমা কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, তুমি যে প্রস্তাব দিচ্ছো আমার মনপুতঃ হলেও বাবা কি রাজী হবেন? কলকাতার নাম শুনলেই তিনি ক্ষেপে উঠবেন। তাছাড়া বাবার অবস্থা ভালো নয়। গভীর শোকাহত।
রন্টুদা বলল, একেবারে সত্য কথা বলেছিস। কিন্তু রমা, এছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। তাছাড়া দুটো প্রাণীকে অনাহারে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মেসোমশায়ের যে অবস্থা আমি ভালো বুঝছি না। কোন পথে তিনি পা বাড়াবেন বুঝতে পারছি না। তোকে বোঝাতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে না। তুই মেসোমশায়কে ভালো করে বুঝিয়ে রাজী করা। আমার বিশ্বাস দুই / তিন মাসের মধ্যেই মেসোমহাশয়কেও কলকাতায় নিয়ে যেতে পারবি। রাত্রে মেসোমশায়কে বুঝিয়ে রাজী করিয়ে আমরা আগামী পরশুদিন রওনা হবো।
আমি রন্টুদার কথায় রাজী হলাম বহু চিন্তা ভাবনা করে।
রাত্রে খাবার খেয়ে বাবার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। কলকাতার নাম শুনে বাবা চিৎকার করে উঠলেন। এই বিষয়ে তিনি দৃঢ় স্বরে অসম্মতি জানালেন। কুচক্রী, লোলুপ, বিশ্বাসঘাতক কলকাতায় তিনি তার মেয়েকে কিছুতেই পাঠাবেন না।
বাবাকে আমি অনেক করে বোঝালাম, এছাড়া আর আমাদের গত্যন্তর নেই। আমি বাবাকে আরো বললাম, তুমি তো জানো বাবা, দারিদ্রের জন্য আমরা উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত। যখন বিধাতার নিষ্করুণ অভিশাপ আমাদের সংসারটিকে ছারখার করে দিয়ে গেল তখন হিংস্র মানুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আমরাও রেহাই পাবো না। মানুষের রক্ত মাংসের হাত, মানুষ এর হাতকেই বাধা দিতে পারে না। অন্য শক্তিকে কি করে বাধা দেবে। আমাদের অভাবের সুযোগ নিয়ে বর্বর মানুষ আমাকে নারীত্বের চরম অবমাননার পথে ঠেলে দেবে।
বাবার মুখাখানি ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠলো। সেই প্রসঙ্গে রন্টুদা বলল, আপনি কি চান মেসোমশায় অভাবের তাড়নায় রমার জীবনের পঙ্কিলতার আবর্তে ঘুরপাক থাক? জানেন এই বর্তমান যুগে মানুষ বড় জঘন্য হয়ে গেছে। সর্ব বিষাক্ত নিঃশ্বাস সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মানুষকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। আপনাদের পাড়ারই ছেলে বোদা কেন রমাকে অপমানিত করবে।
আমি অবাক হলাম বোদার প্রসঙ্গ রন্টুদা কিভাবে জানলো। বোদা চরিদ্রহীন ছেলে কি করেই বা জানলো। এখানে মানুষের মূল্যবোধ নেই। নারীত্বের চরম অপমান নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বোদা আমাকে তার কারবারে টেনে নিতে চেয়েছিলো। তিনি চান আমাকে ঘরে রেখে আমার জীবন সংগ্রামে তিনি নেমে পড়বেন। সমস্ত শোক দূর করে কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আবার নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু করবেন। বাবা শক্ত হবেন, কোমর বাঁধবেন, মেরুদন্ডকে সোজা করবেন।
বাধা দিয়ে রন্টুদা বলল, এই দুর্বল শরীর নিয়ে পরিশ্রম করা চলবে না আপনার। কখন কি বিপদ হবে বলা যায় না। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন রমার যেমন করে হোক
চাকুরী করে দেবো। আমি আপনার ছেলের মতো, রমা যেমন আমার বোন আমারতো কর্তব্য আছে। হয়তো অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করতে পারবো না সত্য, কিন্তু রমার উপার্জনের পথ নিশ্চয় করতে পারবো। আপনার আশীর্বাদে আমি যেন নিশ্চয়ই এই ঝঞ্ঝা বিধস্ত পরিবারটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে পারি। আপনার যখন ইচ্ছে হবে দেখার জন্য আমাকে পত্র দিয়ে জানাবেন আমি যথা সময়ে পৌঁছে দেব। “মৌনং সম্মতি লক্ষনম ”।
মনে হলো বাবা রাজী হয়েছেন। বাবাকে আর বিশেষ কিছু বলতে হলো না। রন্টুদা বাবার হাতে কয়েকটা একশো টাকার নোট দিয়ে প্রণাম করে বললো, আমাকে যখন পুত্রসম ভালোবেসেছেন তখন আমি আজীবন আমার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু দিয়ে সুমন্তের বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করব।
কলকাতায় ফিরে যখন সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে বড় মর্মাহত হয়েছিলাম তখন আমার চোখের সম্মুখে তৎক্ষণাৎ আপনার ও রমার মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছিলো। কিভাবে আপনারা বেঁচে আছেন। কেউ না জানুক আমি তো জানতাম কিভাবে দুঃখ - যন্ত্রণাকে জান নিত্য সাথী করে সুমন্তকে মানুষ করছিলেন। আপনার জীবনের এই নিষ্করুন ব্যর্থতায আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। তাই ছুটে এলাম আপনাদের সাহায্য করতে। আমার উপর আপনি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেন আমার দ্বারা কোন ক্ষতি হবে না।







