Monday, August 22, 2022

ছোট গল্প - তৃতীয় কৌরব || লেখক - দীপক কুমার মাইতি || Short story - Tritiyo Kourav || Written by Dipak Kumar Mayti

 




 তৃতীয় কৌরব

দীপক কুমার মাইতি 

 


সভাকক্ষ


তখনও তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে রয়েছে কর্ণ ,দুর্যোধন প্রভৃতির মুখে। একটু আগে দুঃশাসন রজস্বলা, একটি মাত্র বস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদীর কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশ মুঠিতে ধরে টানতে টানতে ‘এই দাসী, দাসী’ বলতে বলতে সভায় নিয়ে এসেছে। দ্রৌপদী চিৎকার করে তাঁকে হেনস্থার বিচার চাইছিলেন। তখন দুর্যোধন অট্টহাসি হাসছেন – তোমার স্বামী তোমাকে পাশায় পণ রেখে হেরে গিয়েছেন। এখন আমি তোমার প্রভু। সভাসদের কী বলবেন?


      দ্রৌপদী পুনরায় বলেন – সভায় উপস্থিত কুরুরাজ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ ভীষ্ম, মহামন্ত্রী বিদুর, মহাগুরু দ্রোণ, পুজ্যপাদ কৃপাচার্য প্রভৃতির কাছে প্রশ্ন, এই কপটচারী,ধূর্ত-পাপাত্মারা ভাবে ছলে-কৌশলে ধর্মরাজকে পাশা খেলতে রাজি করিয়েছে। কপটভাবে তাঁর সর্বস্ব জিতে নিয়েছে। তিনি প্রথমে ভাইদের, পরে নিজেকে বাজি রেখে হেরে গিয়েছেন। তারপর আমাকে বাজি রেখে হেরেছেন। আমি জানতে চাই, নিজে হেরে যাওয়ার পর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের আমাকে পণ রাখার অধিকার কী তাঁর ছিল? এই পণ রাখা ধর্মানুসারে কী অনুমোদিত?


      সবাই চিন্তিত। মহামতী ভীষ্ম বললেন – ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ্য। তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।”


      অন্যরা নীরব। সেই মুহূর্তে কৌরবদের বিরুদ্ধাচর্ণ করার মতো কোন সাহসী সভায় ছিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন ধৃতরাষ্ট্র নন্দন তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ – সভাসদগণ! আমাদের সকলের বিচার বিবেচনা করে পূন্যাত্মা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত। কুরুকুল রক্ষাকারী পিতামহ ভীষ্ম আপনি দায় এড়াতে পারেন না। পিতা, কুরু-মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও মহামন্ত্রী বিদুর আপনারা কেন কোন উত্তর দিচ্ছেন না? মহাগুরু দ্রোণ ও কুরু বংশের প্রধান উপদেষ্টা কৃপাচার্য আপনারাও চুপ কেন? উপস্থিত রাজন্যরা আসক্তি পরিত্যাগ করে এই প্রশ্নের বিচার করুণ। পতিব্রতা রমণী দ্রৌপদীর প্রশ্নের পৃথকভাবে যথাযথ উত্তর দিন। আপনাদের সুচিন্তিত উত্তরই একমাত্র কুরুবংশকে তার পতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।”


      বিকর্ণ বারবার আবেদন করলেও সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলেন। বিকর্ণ ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। রাগে হাতে হাত ঘসতে থাকেন – হে কৌরব সভাসদগণ আমি এ ব্যাপারে যা ন্যায়সঙ্গত মনে করি, তা না বলে থাকতে পারছি না। মৃগয়া, মদ্যপান, পাশাখেলা ও স্ত্রীসংসর্গ এই চারটেই রাজাদের কামজ বাসনা। এগুলিতে আসক্ত হলে মানুষের নীতি-ধর্মের সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় মত্ত মানুষেরা যে কাজ করে বা যে কথা বলে সেই সব কাজ বা কথা অকৃত বলেই ধরে নেন বুদ্ধিমান ও ধীমান ব্যক্তিরা। মহামতি যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় আসক্ত। তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধূর্ত পাশাড়েরা তাঁকে খেলায় প্রবৃত্ত করেছে। যুধিষ্ঠির পণ ধরেছিলেন প্রমত্ত অবস্থায়। তাই তিনি যে সমস্ত পণ ধরেছেন তা ধর্মানুসারে গণ্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তিনি বা তাঁর ভ্রাতারা বা পতিব্রতা দ্রৌপদী কারো বিজিত সম্পদ হতে পারেন না।


      তবুও সভাসদেরা চুপ। বিকর্ণ প্রশ্ন তুললেন – মহারানী দ্রৌপদী কেবল মাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পত্নী নন। তাঁর অন্য চার পাণ্ডবভ্রাতাও দ্রৌপদীর স্বামী। তাঁদেরও দ্রৌপদীর উপর সমান অধিকার। তাঁদের অনুমতি ছাড়া দ্রৌপদীকে পণ রাখা যায়? এছাড়া মনে রাখবেন যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় নয়, কপট শকুনির প্ররোচনায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। তাই এই ঘটনা কী ধর্মসম্মত? দ্রৌপদী জুয়াতে হারেননি। তিনি দাসী নন। রজস্বলা একবস্ত্রা মহান সতী দ্রৌপদীকে সভায় অপমান করা ধর্ম বিরোধী, অন্যায়, পাপকর্ম। সভায় উপস্থিত যাঁরা এই পাপকর্মকে সমর্থন করেন তাঁরা ক্ষত্রধর্ম বিরোধী। সকলেই মহাপাতকী হবেন।


      সভায় আলোড়ন শুরু হল। সকলে বিকর্ণের কথা সমর্থন করে তাঁর প্রসংশা করতে লাগলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি সহ সকলের নিন্দা করতেও লাগলেন। নিজের অনুগত সভাসদের আচরণে হতবাক হলেন দুর্যোধন। কর্ণ বুঝলেন হাওয়া বেগতিক। দ্রৌপদী তাঁকে সুতপুত্র বলে স্বয়ংবর সভায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্রৌপদীকে হেনস্থা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। কর্ণ ক্রোধ ভরে বিকর্ণের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন — সভায় তোমার অনেক গুরুজন রয়েছেন। ধর্ম ও অধর্ম ব্যাপারে তাঁরা তোমার থেকেও বিজ্ঞ। তাঁদের নীরবতার অর্থ, যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরে কোন ভুল করেননি। তুমি নিতান্ত বালক। সভায় তোমার কথা বলার কোন অধিকার নেই। তুমি চুপকর। নীরব থাক।


      বিকর্ণ কর্ণের থেকে হাত মুক্ত করলেন। তাঁর কন্ঠস্বর শান্ত ও ধীর – ধিক আপনাকে অঙ্গরাজ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বয়সের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সাহসের। সেই সাহস আপনাদের নেই। আপনারা রাজানুগ্রহের আশায় অধর্মের কাছে বিক্রিত। আপনাদের হত বুদ্ধির জন্য কৌরব বংশ ধ্বংস হবে। আপনি পরম ধার্মিক ও দাতা কর্ণ বলে পরিচিত। আপনি কী এই নীতিশিক্ষা আমাকে দিতে চান যে অধর্ম জেনেও চুপ থাকব?


কর্ণের ধমকে ওঠেন – তুমি ধর্মের কী বোঝ? যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করে হেরেছেন। পত্নী স্বামীর সম্পদ, তাহলে দ্রৌপদীকে পণ রাখা অন্যায় কেন? যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন তখন অন্য পাণ্ডবেরা নীরব ছিলেন কেন? তাদের নীরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ। শাস্ত্রে পাঁচ পতির বিধান নেই। পাঁচপতির স্ত্রী দ্রৌপদী বহুগামী। দ্রৌপদী একজন বেশ্যা। বেশ্যা রজস্বলা না একবস্ত্রা তার গুরুত্ব নেই সমাজে। তোমার এতই যদি দরদ তবে অন্দরে গিয়ে রোদন কর।   


বিকর্ণকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে – কী হল দুঃসাশন! যাও দাস পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ


      থাকতে পারলেন না বিকর্ণ। মুহূর্তে সভাকক্ষ ত্যাগ করে ছুটে গেলেন মাতা গান্ধারীর কাছে। তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। বিকর্ণকে বক্ষে তুলে বললেন – কী হয়েছে পুত্র! বিচলিত কেন?”


      বিকর্ণ মাতাকে পাশা খেলার সভাগৃহে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দেন – মাতা আপনার মতে মহারানি দ্রৌপদী মাতালক্ষ্মীর অংশজাত । যেদিন পাণ্ডব ভ্রাতারা দ্রৌপদীকে বিয়ে করে ফিরেছিলেন, সেদিন আপনার নির্দ্দেশে আমি ও চিত্রসেনা তাঁদের সসম্মানে বরণ করে রাজপুরীতে নিয়ে এসেছিলাম। শুধু তাই নয় আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘দ্রৌপদী যেন কোনদিন অসম্মানিত না হোন তার দিকে লক্ষ্য রাখবে।’ কিন্তু মাতা আজ কৌরবভ্রাতাদের হাতে কুরু-কুললক্ষ্মীর সম্মান লুন্ঠিত। মাতা ঘোর অমঙ্গল নিশ্চিত। কৌরব বংশের ধ্বংস অনিবার্য।


      ঠিক সেই সময় চারিদিকে নানা কুলক্ষণ দেখা দিল। গান্ধারী ভীত হয়ে পড়লেন। এমন সময় বিদুর গান্ধারীর কাছে ছুটে আসেন। দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে গিয়ে দুঃসাশন ব্যর্থতার কথা জানান। ভীমসেন ও দ্রৌপদী কি কি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন তা নিবেদন করেন। তিনি গান্ধারীকে বলেন – এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীকে তুষ্ট না করলে কৌরব বংশের বিনাশ অনিবার্য।


সব শুনে বিচলিত গান্ধারী বিদুরকে আজ্ঞা করেন— মহামন্ত্রী , আপনি মহারাজকে গিয়ে আমার বিনীত নিবেদন জানান। পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে তাদের ইন্দ্রপ্রস্থে সসম্মানে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করেন।


      বিকর্ণ মাতাকে নতজানু হয়ে প্রণাম করে। কিছুপরেই উদ্বিগ্ন বিদুর ফিরে আসেন। চিন্তিত বিদুরের দিকে তাকান গান্ধারী।


      বিদুর বলেন – মহারানি, পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ। তাঁরাও হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিয়েছেন। পুনরায় অনর্থ ঘটেছে। মন্ত্রণাদাতা শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বুঝিয়েছে যে সুযোগের অপব্যবহার করা উচিত নয়। পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানাতে। দুর্যোধন পিতাকে সেই অনুরোধ জানায়। পুত্রস্নেহে অন্ধ মহারাজ পিতামহ ভীষ্ম, অস্ত্রগুরু দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রভৃতির পরামর্শ অগ্রাহ্য করে, পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনতে প্রতিহারী পাঠিয়েছেন।


      গান্ধারী হাতে হাত ঘষতে ঘষতে পায়চারি করতে লাগলেন। বিকর্ণ মাতার অনুমতি নিয়ে রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাণ্ডবদের গতি রোধ করে পুনরায় পাশা না খেলে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বিকর্ণ জানান এটাই মাতা গান্ধারীরও আদেশ। পাণ্ডবভ্রাতারা রাজি হলেও রাজি হলেন না যুধিষ্ঠির — আবার যদি পাশা খেলতে হয়, তাই খেলব। জানি, এতে বংশনাশ হবে। কিন্তু ভ্রাতা, মাতা গান্ধারীকে জানিও, বৃদ্ধ জ্যেষ্ঠতাত ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ উলঙ্ঘন করে অধর্ম করতে পারি না। মাতা যেন আমাকে ক্ষমা করেন।


 মহাবীর ভ্রাতাদের ও লক্ষ্মীস্বরূপা পত্নী দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠীর চলেছেন। হতাশ বিকর্ণ দাঁড়িয়ে শুনছেন কুরুবংশের ধ্বংসের পদধ্বনি। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে তাঁর।


 


 


মন্ত্রণাকক্ষ


     


কুরক্ষেত্র মহাযুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধের শেষ। অভিমন্যু নিহত। পাণ্ডব শিবির শোকে মুহ্যমান। কৌরব শিবিরে উল্লাস। কর্ণ, শকুনি, জয়দ্রথ, দ্রোণ ও দুর্যোধন বসেছেন গোপন শলাপরামর্শে। চতুর্দশ দিনে শোকাকুল পাণ্ডবদের পরাভূত করার ব্যূহ রচনার কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে। গুপ্তচর নীলভদ্র মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করে। নীলভদ্রকে দেখে দুর্যোধন বলেন – কী খবর নীলভদ্র? পাণ্ডবরা কী সন্ধির প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে?


      মাথা নিচু করে নীলভদ্র – না যুবরাজ, শোক কাটিয়ে পাণ্ডবেরা ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন। অভিমন্যুর হত্যার জন্য সৌবীরাজ জয়দ্রথকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে মহাবীর জয়দ্রথকে হত্যা করবেন। ব্যর্থ হলে তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জন দেবেন।


      মন্ত্রণা কক্ষে নীরবতা নেমে আসে। সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। জয়দ্রথের ভীত কন্ঠস্বর – কুন্তীর গর্ভে কামুক ইন্দ্রের ঔরষে জন্ম অর্জুনের। অর্জুন আমাকে যমালয়ে পাঠাতে চায়! তোমাদের মঙ্গল হোক। আমি ফিরে যাচ্ছি নিজ রাজ্যে। সেখানেই আত্মগোপন করব। যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলে আমাকে অর্জুন বধ করতে পারবে না। তাছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা কাউকে হত্যা করার অধর্ম পান্ডবেরা করবে না। যুবরাজ ও সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণের কাছে আমার আবেদন আপনারা আমাকে অনুমতি দিন। আমি নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।”


      দুর্যোধন বলেন — তুমি ক্ষত্রিয় নরব্যাঘ্র। ভয় পেয়ে ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে চাও?”


      না ভ্রাতাশ্রী, আমি কোন হটকারিতা করতে রাজি নই। কৃষ্ণসখা অর্জুন। কৃষ্ণের সহায়তায় ছলে বলে কৌশলে আমাকে হত্যা করবেই। তোমরা অনুমতি দাও। আমি আত্মগোপন করি।


      তুমি আমাদের একমাত্র ভগ্নীর স্বামী। ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ বীরগণের মাঝে তুমি থাকবে। কে তোমাকে আক্রমণ করবে? আমরা সসৈন্যে তোমাকে রক্ষা করব। আমি স্বয়ং রথীশ্রেষ্ঠ মহাবীর, তবুও তুমি পাণ্ডবদের ভয় করছো?


      শকুনি পুলকিত হন – এত আনন্দের সংবাদ। আমাদের যুদ্ধ জয় নিশ্চিত। কাল আমরা সর্বশক্তি দিয়ে জামাতা জয়দ্রথকে রক্ষা করব সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ব্যস তারপরই অর্জুন প্রাণ বিসর্জন দেবে। তোমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অর্জুনহীন পাণ্ডবেরা এক লহমায় পরাজিত হবে বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।”


      উরুতে হাত চাপড়ে অট্টহাসি হাসেন দুর্যোধন — মামাশ্রী আপনি ঠিক বলেছেন। সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণাচার্য আপনার অভিমত কী?”


দ্রোণ বলেন – আমি তোমাদের সমভাবেই শিক্ষা দিয়েছি। যোগাভ্যাসে ও কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অর্জুন আধিকতর শক্তিশালী। তবুও আমি কথা দিচ্ছি আমি জয়দ্রথকে রক্ষা করবই। আমার সৃষ্ট অনেক ব্যূহ ভেদ করার কৌশল এখনও অর্জুন জানে না। আমি চক্রশকট ব্যূহ রচনা করব। ব্যূহের মুখ থেকে দুই ক্রোশ দূর পশ্চাতে পদ্মনাভ নামের এক গর্ভব্যূহ রচনা করা হবে। পদ্মনাভের মধ্যে থাকবে এক সূচিব্যূহ। যার মধ্যে জয়দ্রথ অবস্থান করবেন। পদ্মনাভের মুখে পাণ্ডবদের আক্রমণ প্রতিহত করবেন কর্ণ, শল্য, বৃষসেন ও কৃপাচার্য। দুঃশাসনসহ অন্য কৌরবভ্রাতারা সূচিব্যূহের মুখে থেকে সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করবেন। আমি নিজে শকটব্যূহের মুখে থাকব। অর্জুন এই ব্যূহ কিছুতেই ভেদ করতে পারবে না।


      দুর্যোধন বলেন — সৌবীরাজ তুমি এবার তো নিশ্চিন্ত? সেনাপতি দ্রোণাচার্যের কৌশলে তুমি নিরাপদ।


     


  দ্রোণের চিন্তিত কন্ঠস্বর – আমার ভয় শুধু একজনকেই। তিনি হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। একদিনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের বরে জয়দ্রথ অর্জুন ভিন্ন অন্য পাণ্ডবদের জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জয়দ্রথের এখন সে ক্ষমতা নেই। মায়াসুর প্রদত্ত বৃগোধন গদাধারী ভীমের কাছে সমস্ত ব্যূহ প্রাচীর নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাবে। সমস্ত মহারথেরা অর্জুনকে রুখতে ব্যস্ত থাকলে ভীমসেনকে প্রতিহত করবেন কে?”


      কর্ণ বলেন – আছেন একজন মহারথ। তিনি ভীমের ন্যায় গদা যুদ্ধে সমান পারদর্শী। তিনি তৃতীয় কৌরব, মহারথ বিকর্ণ। তিনি পারবেন ভীমকে সহজে প্রতিহত করতে।


      হেসে ওঠেন দুর্যোধন – তুমি হাসালে সখা। বিকর্ণ প্রতিহত করবে ভীমসেনকে! যে কিনা চিরকাল পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট। ভীমের কাছেই গদা যুদ্ধের কৌশলের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে। মাতা গান্ধারীর নির্দেশে বিকর্ণ কৌরব পক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছে। বিকর্ণ করবে দ্বিতীয় পাণ্ডবকে প্রতিহত!


      কর্ণ বলেন – একথা ঠিক। এই ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ হয়েছে। দুই যোদ্ধা পরস্পরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। মনে করে দেখুন, পঞ্চম দিনে ভয়ঙ্কর ভীমকে বাণে বিধ্বস্ত করে বিকর্ণ আপনার পাঁচ ভ্রাতাকে রক্ষা করেছিলেন। দশম দিনে পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন ও শিখণ্ডীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করছিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে দ্রুপদ বিকর্ণকে আক্রমণ করে অন্য দিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমরা পিতামহকে হারিয়েছি। সেদিন বিকর্ণের হাতে পাণ্ডব পক্ষের এক অক্ষৌহিনী সেনাসহ বহু বীরের পতন হয়েছিল। মাতা গান্ধারীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিকর্ণ আপনার আদেশ অমান্য করতে পারবে না।     


শকুনি বলেন – ভাগ্নে তোমার ভ্রাতাদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণকেই ভীমসেন বেশি স্নেহ করেন। তিনি ভীমের কাছে গদা যুদ্ধের কৌশল শিখেছিলেন। গুরু শিষ্যের পরস্পরের দুর্বলতার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করবেন না ঠিক। সেটাই আমাদের লাভ। বিকর্ণ ভীমকে অন্যত্র সরিয়ে রাখলে অর্জুন একা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হবে না। কী মহাগুরু দ্রোণাচার্য আমি কী ভুল বললাম?


       দ্রোণ বললেন – আমরা বিকর্ণের উপর আস্থা রাখতে পারি।


 


দুর্যোধনের আহ্বানে বিকর্ণ মন্ত্রণা কক্ষে আসেন। যথাযথ সম্মান জানিয়ে তাঁকে বসতে দেওয়া হয়। বিকর্ণ জানতে চান তাঁকে কেন তলব করা হয়েছে। দুর্যোধন যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন – বীরশ্রেষ্ঠ মহারথ বিকর্ণ আমরা কালকের যুদ্ধে তোমার শক্তির উপর নির্ভরশীল । কালকের যুদ্ধে তুমি আমাদের সবার প্রিয় একমাত্র ভগ্নী দুঃশলাকে চরম দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে পার। আমরা সবাই সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করব। কিন্তু তোমাকে কালকের যুদ্ধে ভীমসেনকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দিতে চাই। তোমার রণকৌশল আমাদের কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে পারে। তোমার মতামত জানতে চাই।


বিকর্ণ একবার সভা কক্ষের সকলকে দেখলেন। কোনদিন তাঁকে কোন মন্ত্রণা সভায় ডাকা হয়নি। প্রতিহারি মারফত তাঁকে যুদ্ধের ভূমিকা জানান হত। এতক্ষণে তাঁকে ডাকার কারণ অনুধাবন করতে পারলেন। মুখে তাঁর তাচ্ছিল্যের হাসি – অগ্রজ, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। তবু আপনি আমার মত যখন জানতে চেয়েছেন, অনুরোধ করব জ্ঞাতিবিদ্বেষী এই অধর্ম যুদ্ধ আপনি বন্ধ করুন। এতে কৌরব-পাণ্ডব বংশের লাভ হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব পক্ষে। তিনি ধর্মের পক্ষে। তাঁর স্মরণ নিলে কৌরব বংশ বিনাশের হাত থেকে রক্ষা পাবে।


অট্টহাসি হেসে ওঠেন কর্ণ – তৃতীয় কৌরব কোনটিকে তুমি অধর্ম বলছ? নিজ বিজিত রাজ্য রক্ষা করাই ক্ষত্রধর্ম। পাণ্ডবেরা পাশা খেলায় হেরে গিয়ে রাজত্ব হারিয়েছিল। এখন তারা রাজ্যের দাবী করছে? ওরাই তো হানাদার। মহারাজ দুর্যোধন জয় করা রাজত্ব রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন। একে তুমি অধর্ম বলতে চাও?


বিদ্রুপের হাসি হাসেন বিকর্ণ – কপট পাশা খেলা, ভরা রাজসভায় কুলবধূকে বস্ত্রহরণের চেষ্টা অধর্ম নয়! শর্ত ছিল বনবাস ও অজ্ঞাতবাস সঠিক পালন করে ফিরে এলে পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। শর্ত লঙ্ঘন করা কী অধর্ম নয়?


শকুনি বলেন – প্রিয় ভাগিনেয়, বলবন, সুশাসক ও যে কোন যোদ্ধার থেকে ক্ষমতাবান তোমার পিতাকে কেবলমাত্র অন্ধত্বের কারণে সিংহাসন চ্যূত করা হয়েছিল, আমার ভগ্নী তোমাদের মাতা গান্ধারী কুন্তীর আগে গর্ভবতী হয়েও দৈব চক্রান্তে কুন্তীর আগে সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। শুধু তাই নয় পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন কোন ধর্ম পালন করে পরাজিত করেছিলেন?


তাই কী আপনারা সপ্তরথী ঘিরে নিরস্ত্র অভিমন্যুকে বধ করেছিলেন?


কর্ণ বলে ওঠেন – তুমি ক্লীবের মত কথা বলছ তৃতীয় কৌরব। কোন যুক্তিতে কপট পাশা খেলা বলছো? সেদিন দক্ষ দ্যূতক্রীড়ক মামা শকুনির হাতে পরাজিত হয়েছিল অদক্ষ দ্যূতক্রীড়াপ্রিয় যুধিষ্ঠির। তুমি পাণ্ডব প্রীতিতে অন্ধ, তাই তুমি তেমনভাবে পাণ্ডবদেরকে আক্রমণ করনি। ভীমকে এড়িয়ে গেছ। ইতিমধ্যে তোমার বারজন ভ্রাতা ভীমের হাতে নিহত হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতককে হত্যা করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভীমসেনকে আক্রমণ করছো না, এটা কোন ক্ষত্রধর্মের নিদর্শন?


দুর্যোধন বলেন – বৃথা তর্ক করে কালক্ষেপের কারণ দেখছি না। এক রাজা তার সমকক্ষ শত্রুকে পরাজিত করার কৌশল করবে, এটাই রাজধর্ম। আমি তাই করে চলেছি। এখন তোমার ধর্ম তুমি রাজাদেশ মান্য করবে কিনা জানাও।


সভাকক্ষ নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি বিকর্ণের উপর। উঠে দাঁড়ান বিকর্ণ। দুর্যোধনের চোখে চোখ রেখেন – রাজাদেশ পালন করা ক্ষত্রধর্ম। ধর্ম ও অধর্ম এক সুক্ষ্ম ভেদের উপর দাঁড়িয়ে। তাই আমিও তর্ক করতে চাই না। শুধু আমার উপলব্ধি আপনাকে জানিয়েছি। যুদ্ধের পূর্বে মাতার কাছে আমরা সকল ভাই শপথ করেছিলাম, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করব। তাই মাতার নামে প্রতিজ্ঞা করছি, কালকের রণের শেষে আমার ও ভীমসেনের মধ্যে একজন জীবিত থাকবেন। দ্বিতীয় পাণ্ডবকে হত্যা না করে জীবিত অবস্থা শিবিরে ফিরব না।”


 সবাইকে অভিবাদন করে বীরদর্পে বিকর্ণ সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মন্ত্রণা কক্ষের সকলে বিকর্ণের প্রতিজ্ঞা শুনে উল্লসিত হয়ে পড়েন।


 


গান্ধারী সমীপে


রাজমাতা গান্ধারী একা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। বিকর্ণ কক্ষে প্রবেশ করে মাতার পদস্পর্শ করে প্রণাম করেন। গান্ধারী তাঁকে দুহাতে তুলে আলিঙ্গন বিকর্ণকে পাশে বসালেন – পুত্র তুমি কী কোন ব্যপারে চিন্তিত? কোন অশুভ সংবাদ আছে?


না মাতা, শেষবারের মত আপনার চরণ স্পর্শ করে বিদায় নিতে এলাম।


অজানা আশঙ্কায় চমকে ওঠেন গান্ধারী – কেন পুত্র, এমন আশঙ্কা করছো কেন?


যুবরাজের আদেশে কাল আমাকে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনকে প্রতিহত করতে হবে। এ যাবত বারজন কৌরব ভ্রাতা তাঁর হাতে নিহত হয়েছেন। তিনি তো শত কৌরব বধের প্রতিজ্ঞা করেছেন। তাঁর ক্ষমতার কথা আপনার জানা। তাই কালকের মহারণের ফলাফল নিয়ে কোন চিন্তার অবকাশ আছে কী মাতা?


পুত্র তুমি একজন মহারথ। আমার কথা নয়। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম কর্ণকে অধিরথ বলেছিলেন। কিন্তু তোমায় মহারথ বলেছিলেন, তুমি ক্ষত্রিয়, মহান কুরুবংশের রাজপুত্র। তোমার মুখে হতাশা মানায় না। তুমি কী ভীত পুত্র?


আমি মহারাজ শান্তনু ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বংশধর। আমি ভীত নই মাতা। শেষবারের মতো আপনাকে অনুরোধ জানাতে এসেছি, অগ্রজ দুর্যোধনকে সংযত করুন। তাঁকে অধর্মের পথ থেকে সরে আসতে বলুন।


পুত্র ধনুক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাকে কী তূণে ফিরিয়ে আনা যায়? আমার গর্ব ছিল আমি শতপুত্রের জননী। আমি পুত্র স্নেহে অন্ধ ছিলাম।কুন্তীকে হিংসে করতাম। পাণ্ডবদের শক্তিকে হেয় করেছি। ভাবতাম, আমার শতপুত্র মাত্র পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করবেই। মহারাজকে যেমন বোঝাতে পারিনি তেমনি দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার কোন চেষ্টা করিনি।


পাণ্ডবদের বারাণবতে পাঠানোর উদ্দেশ্য আপনাকে জানিয়েছিলাম। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে সতী দ্রৌপদীরর হেনস্থা রুখতে না পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। আপনি চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। মাতা, শ্রীকৃষ্ণ সহায় পাণ্ডবরা অপরাজেয়। মাতা, ধর্মের পথে সকলকে ফিরাতে বাধ্য করুন।


তুমি তো ন্যায় ও ধর্মের পথে রয়েছো। তোমার তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।


ম্লান হাসেন বিকর্ণ – ন্যায়ের পথে আছি। অন্যায় বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। আবার অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করছি। তাই জয় সম্ভব নয়।


গান্ধারীর দৃঢ় কন্ঠস্বর – সম্ভব পুত্র। আঠারো বার জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণকে পরাজিত করেছিলেন। ভীষ্ম তো চিরকাল ন্যায় বা ধর্মের পথে ছিলেন। তাঁদের দুজনকেই অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করা হয়েছে। তোমাকেও অন্যায় যুদ্ধে যাতে পরাজিত করতে পারে কৃষ্ণ ও তার সহায় পাণ্ডবরা। শুধু এই ভয় করছি। নয়ত তুমি বিজয়ী হবেই।


সে ভয় করি না। ভীমসেন কোন অধর্ম করবেন না। রণক্ষেত্রে ভীম-অর্জুন ছাড়া আমায় পরাজিত করার ক্ষমতাধারী কেউ নেই। নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না। চিন্তা কৌরব বংশের বিনাশ নিয়ে। চিন্তা যুদ্ধ শেষে স্বজনহারা পৃথিবীতে আপনার ও পিতার জীবনের দুর্দশাকে নিয়ে।


বিকর্ণের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন গান্ধারী – যাও পুত্র ক্ষত্রধর্ম পালন কর। আশীর্বাদ করি কালকের রণে তোমার বীরগাথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বিকর্ণ মায়ের পদধূলি নিয়ে বীরদর্পে কক্ষ ত্যাগ করেন।


 


যুদ্ধক্ষেত্র


 


শকট ব্যূহ রচনা করে এগিয়ে চলেছে কৌরব সেনা। ব্যূহ মুখে রয়েছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব সেনাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে চলেছেন অর্জুন। ব্যূহ মুখে দুই মহারথের সাক্ষাত হয়। গুরু-শিষ্যের তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। বৃথা কালক্ষেপ হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দেন— সখা, ব্যূহের দক্ষিণ পার্শ্বে গজ সৈন্য নিয়ে কৌরব ভ্রাতা দুর্মর্ষন রয়েছেন। আমরা ঐ দিক দিয়ে ব্যূহ আক্রমণ করলে দ্রুত সফল হব।


তাঁরা দুর্মর্ষনকে পরাজিত করে এগোতে গেলে দুঃশাসনের মুখোমুখি হন। কিন্তু সহজে দুঃশাসন পরাজিত ও আহত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন। মহাদেবকে তুষ্ট করে দুর্যোধন পেয়েছিলেন কাঞ্চনময় কবজ। এই কবজ ধারন করলে তিনি একদিনের জন্য একজন পাণ্ডবকে সহজে প্রতিহত করতে পারবেন। তাই দুর্যোধন কবজ ধারণ করে অর্জুনকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। দুজনের প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে। কৃষ্ণ কবজের গুণ বুঝতে পেরে, অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য ভীমকে আহ্বান করেন। অর্জুন ও ভীম একযোগে যুদ্ধ করে ব্যূহ ভেদ করে এগোতে চেষ্টা করেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে কৌরব ভ্রাতা বিন্দ, অনুবিন্দ,সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হন। ভীম ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে অর্জুনের সাথে এগোতে লাগলেন। কর্ণ উপলব্ধি করেন দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। না করলে সহজে অর্জুন জয়দ্রথের সম্মুখীন হয়ে যাবেন। তাই তিনি অর্জুনকে আক্রমণ করেন। তাঁর নির্দেশে বিকর্ণ ভীমকে আক্রমণ করেন। বিকর্ণ ভীমের মুখোমুখি হয়ে প্রবল শর নিক্ষেপ করে তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। ভীম চিৎকার করেন – প্রিয় বিকর্ণ ! আমার সম্মুখ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না। তুমি ধার্মিক, তুমি চিরকাল তোমার অধার্মিক অগ্রজকে ধিক্কার দিয়েছো। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে একমাত্র তুমি আমাদের সমর্থন করেছিলে। সেই তুমি ধর্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে পাপাত্মা দুর্যোধনের হাত শক্ত করছো?


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, আমি ধর্ম অধর্ম বুঝি না। সেদিন যা করেছিলাম আমার কর্তব্য ভেবে করেছিলাম। আজ়ও কৌরব পক্ষে অস্ত্রধারণ করে আমার কর্তব্য পালন করছি।


নীতিহীনতার পক্ষে অস্ত্র ধারণ করা তোমার কর্তব্য!


হাসেন বিকর্ণ – আপনিও তো সব বিষয়ে আপনার অগ্রজের সাথে সহমত ছিলেন না। তবুও আপনি তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেননি। কারণ সেটাই আপনার কর্তব্য ছিল, তাই না?


বিকর্ণ আমি তোমায় মিনতি করছি তুমি আমার পথ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে বধ করতে চাই না।


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, ক্ষত্রিয় কখনও রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে না। আমাকে যদি এতই ভয়, তবে অস্ত্র ত্যাগ করে পরাজয় মেনে নেন। আজকের যুদ্ধে আমাদের একজন জীবিত থাকবে। হয় আমাকে পরাজিত করুন নয় নিজে পরাজয় বরণ করুন।


বলেই বিকর্ণ বাণ নিক্ষেপ করে ভীমের বাম হাতে আঘাত করেন। ভীমের রথ ভেঙে পড়ে ও অশ্বসকল নিহত হয়। ভীম গদা হাতে ‘তবে তাই হোক’ বলে বিকর্ণকে আক্রমণ করেন। দুই মহা যোদ্ধার ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হতে থাকে। একসময় ভীমের গদার আঘাতে বিকর্ণের গদা ছিটকে পড়ে। ভীম বিকর্ণের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। বিকর্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ভীমের হাত থেকে গদা খসে পড়ে। তিনি ছুটে চলে যান বিকর্ণের পাশে। কোলে তুলে নেন বিকর্ণের মাথা। পরম স্নেহে তাঁকে আদর করতে থাকেন। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু।


বিকর্ণ চোখ খোলেন – ক্ষত্রিয়ের চোখে অশ্রু মানায় না অগ্রজ। এখন শোকের সময় নয়। এগিয়ে যান ভ্রাতা। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন বিপদে। তাঁকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আপনি।


কাঁদতে কাঁদতে ভীম বলেন – হায় রে বিকর্ণ, তুমি ঠিক জানো ধর্ম কি। আনুগত্য ও মাতৃ-আজ্ঞায় বিবশ হয়ে আমরা লড়াই করছি। এই যুদ্ধ আমাদের জন্য অভিশাপ। যেখানে তোমার মত ধার্মিক এক পুরুষকে বধ করতে হল। হে আমার প্রিয় অনুজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।


মৃদু হাসেন বিকর্ণ – হে আমার প্রিয় পুরুষ, এখন শোকের সময় নয়। আমরা মাতৃ আদেশে বিবশ। আমার কাজ শেষ। আপনি এগিয়ে যান। প্রিয় অনুজ অর্জুন বিপদগ্রস্থ। তাকে যে রক্ষা করতে হবে আপনাকে। মৃত্যুর পূর্বে আপনার স্নেহের স্পর্শ আমার সব কষ্ট লাঘব করেছে। আমার শেষ ইচ্ছে – আমার মৃত দেহের সৎকার যেন আপনার হাতে হয়।


ভীমের পদস্পর্শ করেই একট রুধির বমন করে মহাবীর ধার্মিক বিকর্ণ ঢলে পড়েন ভীমের কোলে। বুকফাটা আর্তনাদে চিৎকার করে ওঠেন ভীম। দুহাতে জড়িয়ে ধরেন বিকর্ণের দেহ।


সহসা পাঞ্চজন্যের আওয়াজ ও কৌরবদের সিংহনাদ শুনে ভীম বুঝতে পারেন অর্জুন বিপদগ্রস্থ। ধীরে ধীরে বিকর্ণের দেহ মাটিতে নামিয়ে ওঠে দাঁড়ান ভীমসেন। বাম হাতে চোখের অশ্রু মোছেন ও ডান হাতে গদা ধারণ করে এগিয়ে চলেন রণক্ষেত্রের দিকে। শেষবারের মত একবার ফিরে তাকান বিকর্ণের দেহের দিকে। দেখেন রণক্ষেত্রে পরম শান্তিতে শায়িত মহাবীর তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ। ভীমসেনের বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, কৌরবপক্ষের এক ধার্মিক, সত্যাশ্রয়ী পরম প্রিয় অনুজ ভ্রাতা তৃতীয় কৌরব – বিকর্ণের জন্য।


 



উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -16


 

ছয়


মনের দুঃখকে লাঘব করার জন্য গঙ্গার ধারে এসে হাজির হলাম । গঙ্গার ধারে বসে আমার জীবনের অতীত ও ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা চিন্তা করছি , তখন পশ্চিম আকাশের আবির ছড়িয়ে গঙ্গা বক্ষে সূর্যাস্ত হল । আমি তখন চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেছি । চারদিকে গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে এলো , দূরে দূরে গাছে গাছে জোনাকির আলো এবং শিল্প নগরীর উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোগুলি আমাকে এক মায়াময় জগতের দিকে নিয়ে চলল।



হঠাৎ গঙ্গার বক্ষ হতে একফালি চাঁদ ভেসে উঠল , আমি আর বিলম্ব না করে । আমার পরিত্যক্ত কুঞ্জের দিকে এগিয়ে চললাম । এসেই শ্যামলীদির বাসাতে গিয়ে । শ্যামলীদিকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকলাম শ্যামলীদি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করায় , আমি কোন রকমে মুখ তুলে বাবার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারলাম না , কারণ ঐ সময় শ্যামলীদির এক প্রণয়ী শ্যামলীদিকে কক্ষান্তরে নিয়ে গেলেন । 

লালসার বহ্নি — দ্যুতি তখন সেই অপরিচিত পুরুষের চোখে মুখে দেখতে পেলাম । শ্যামলীদির নিকট আমার মনের কথা খুলে বলতে না পারায় আমি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম । শ্যামলীদি অধিক রাত্রে এই নবাগত ভদ্রলোককে যৌবন রসে আপ্যায়িত করে ফিরে এলেন ।

 শ্যামলীদি বাবার দুরাবস্থার কথা শুনে নানান উপদেশ দিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিল ও বলল বিধাতা পুরুষের ভাগ্যচক্র আবর্তনের ফলশ্রুতি মানুষ আগে হতে ধারণা করতে পারে নারে । এর জন্য আফশোষ করে কি হবে বলতে পারিস ? তোর বাবা ধনী পুত্র বলে অন্ধ হয়ে পথে পথে ভিক্ষে করবে বলে কি ভগবানের উপর দোষ দিবি ? কারো দোষ নয়রে , এর জন্য আমরা সম্পূর্ণ ভাগ্যের নিকট । সহায় । চিন্তা করিস না , যদি তিনি কলকাতা শহরে এসে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই কোন জায়গায় আশ্রয় পাবেন । আর তোর সাথে দেখাও হতে পারে । আমি একটু পরেই আসছি । 

একাকি বসে থাকলাম । বাবার আকস্মিক আত্মগোপনের জন্য আমার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরতে লাগলো । 

পরদিন সকালে শ্যামলীদির অর্ডার মতো পেটে দেবার অন্য একটা বস্তীর দোকানে ডিম সেদ্ধ ও পাউরুটি আনার জন্য বাউন্ডারীর শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি , ঠিক সেই সময় আগের দিনের ভদ্রলোকের পরিচিত মুখ দেখে একটু স্তম্ভিত হলাম । কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পর , ধীরে ধীরে ভদ্রলোক তার মুখখানি নত করে আমার নিকট উপস্থিত হলেন । তিনি উপস্থিত হতে আমার সর্বশরীর সংকুচিত হল । 

তিনি অতি নম্র কণ্ঠে বললেন , কোথাও যাচ্ছেন বুঝি ?

 বললাম , হ্যাঁ । তা এই প্রাতঃকালে আগমন কেন ? তিনি থতমত করতে থাকেন । তার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল । বহু কষ্টে বললেন , আপনাকে একবার দেখতে এলাম।

 ও , আমার প্রতি দরদ যে কম নয় আপনার । আমি মরে গেছি না বেঁচে আছি দেখতে এসেছেন ?

 তিনি বললেন , ন - না আমি ঠিক-
ঠিক আছে বাসাতে গিয়ে বসবেন চলুন । আপনার সাথে একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে । মনে মনে বললাম ওর চালাকি বের করে দেবো । আপন মনে গজগজ করতে করতে দোকানে এসে উপস্থিত হলাম । ফিরে গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক শ্যামলীদির সাথে গল্পে মজে গেছে।

 শ্যামলীদি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে , আপনি এজন্যে নার্ভাস হবেন না । আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ।

 শ্যামলীদির কথা শুনে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখপানে । তবে কি শ্যামলীদি ওর কাছ হতে কিছু রসদ পেয়েছে ! না না , শ্যামলীদি আমার প্রতি কোন দিন অসৎ ব্যবহার করবে না । সে আমাকে সর্বনাশের পথে কোন দিন এগিয়ে দেবে না।

আমাকে খেলনা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদুরে গলায় বলল , কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন , কাছে আসতে কি ইচ্ছে করছে না ? 

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম । শোন্ এখুনি এই দেবীবাবুর সাথে তোকে যেতে হবে । মনের মধ্যে কোন সংকোচ আনবি না । তোকে নিয়ে যাবার জন্য ইনি আদরি মাসীর কাছে পারমিশন নিয়েছেন । দেবীবাবু আপনি আদরি মাসীর সাথে কথা বলুন , কোন চিন্তা করবেন না , পদ্মা যাবে আমি কথা দিলাম । 

দেবীবাবু শ্যামলীদিকে নমস্কার করে আমাদের কুঞ্জ হতে আদরি মাসীর বাসায় চলে যাবার পর শ্যামলীদিকে বললাম , একি করলে দিদি , আমাকে ঐ লম্পটটার সাথে । ভিড়িয়ে দিয়ে আমার সর্বনাশ ডেকে আনলে ?

 শ্যামলীদি বলল , পদ্মা একটা কথা মনে রাখবি , সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে । তুই লক্ষ্য করেছিস ওর চোখে কামনার নেশা ? আমরা বেশ্যা , সতুরাং ওর তৃপ্তি লাভের নেশাকে সহজেই চিনতে পারতাম । ওরে দেবীবাবু সে ধরনের নয় । ওর সাথে গিয়ে বুঝতে পারবি।

আমি নীরব থাকলাম। 

আমার প্রতি বিশ্বাস রাখ ঠকবি না । আমি তোর রন্টুদা নই রে , তোর আপন দিদি শ্যামলী । যা , তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরী হয়ে নে , ঘন্টা তিন পরেই পুনরায় এখানে পৌঁছে দেবেন । বিলম্ব করিস না।

 দ্বিতীয় কথা না বলে কোন প্রকারে উদরে কিছু দিয়ে একটা সাধারণ কাপড় পরে শ্যামলীদির কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম । মিনিট কয়েক পরেই শ্যামলীদির কাছে অনুমতি চাইলেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য । শ্যামলীদি বার বার দেবীবাবুকে বলে দিল তিনি যেন আমাকে অবিলম্বে এখানে পৌঁছে দিয়ে যান।

দেবীবাবু ঘাড় নেড়ে জানালেন অক্ষরে অক্ষরে তার কথা পালন করবেন।


                       
                           ক্রমশ...

Friday, August 19, 2022

ছোট গল্প - এখনও সময় আছে || লেখক - সুমিত রায় || Short story - Ekhono Somoy Ache || Written by Sumit Roy

 



এখনও সময় আছে
সুমিত রায়



         কয়েকদিন ধরেই বিক্রম ক্লাসে উপস্থিত নেই।  অমিতাভ স্যারের নজরে এসেছে এটা।পড়াশোনায় ভালো যারা, তাদের উপর তিনি যেমন নজর রাখেন, তেমনি নজর রাখেন অন্যান্য ছেলেমেয়েদের উপরও। ক্লাসে অন্যান্য ছেলেদের দ্বারা বিক্রমের না আসার কারণ জানার চেষ্টা করেও, কোনো সদুত্তর পাননি-অমিতাভ স্যার।
       ছাত্রদের দ্বারা অনেক জমাটবাঁধা ইচ্ছা পূরণ করার কথা ভাবতে ভাবতে অমিতাভ স্যার বাড়ি ফিরছেন মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তা ব্যবহার করলে অনেকটাই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছান অমিতাভ স্যার। মাটির রাস্তা বলে,সেই রাস্তা অনেকেই এড়িয়ে চলেন। লোকের চলাচল খুব একটা হয়না দেখে, রাস্তার ধারেই আড্ডা বসে এলাকার  নেশাগ্রস্ত ছেলেদের। অমিতাভ স্যারের সাইকেল কাদায় আটকে যায়। তিনি নেমে পড়েন। পাশে তাকাতেই, নজরে পড়ে কতগুলো ছেলের সাথে বিক্রম বসে আছে, খারাপ আড্ডায়। তিনি বিক্রমকে ডাকলেন। স্যারকে দেখে সে ভয়ে তটস্থ। অমিতাভ স্যার ছাত্রদের যেমন ভালবাসেন, তেমনি শাসনও করেন। এই কারণেই ভয়ে জড়োসড়ো বিক্রম স্যারের ডাকে কাছে আসতে চাইছে না। স্যারের  বারবার ডাকার ফলে একসময়  স্যারের সামনে এলো- বিক্রম। কাছে না আসার কারণ স্যার বুঝতে পারলেন- যখন সামনে এসে সে দাঁড়ালো। মুখ থেকে তখনো গাঁজার গন্ধ যায়নি। প্যান্টের পকেট উঁচু হয়ে আছে সিগারেটের প্যাকেটে। নেশায় টইটুম্বুর। চোখ লাল। ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। বিক্রম দুষ্টু হলেও পড়াশোনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। খারাপ সঙ্গ থেকে বিক্রমের আজ এই দশা। স্যার বললেন,-"তুমি স্কুলে আসো না কেন? কয়েকদিন পর তো তোমাদের ফাইনাল পরীক্ষা।"
        বিক্রম ক্লাস নাইনে পড়ে। ক্লাস ফাইভ থেকে অমিতাভ স্যার পড়িয়ে আসছেন তাকে। কাজেই তিনি বিক্রমের মেধা ভালোভাবেই জানেন।
        অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিক্রম। কোন জবাব দিচ্ছিল না। বারবার করতে থাকা স্যারের প্রশ্নে একসময় বলে উঠলো,-"বাবা পড়াশোনা করতে বারণ করেছে, বই খাতা সব পুড়িয়ে দিয়েছে!"
        কথাটা শুনে বিক্রমের বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হল স্যারের। তিনি বিক্রমকে আগামীকাল থেকে বিদ্যালয়ে আসতে বললেন, আর বললেন বাবা যেন স্যারের সাথে দেখা করে।
       স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়েছে। অমিতাভ স্যার তার পুরনো সাইকেলে চেপে স্কুল গেট পেরোতেই লক্ষ্য করলেন, এক ভদ্রলোক তার কাছে এগিয়ে আসছে। সাইকেল থামালেন। ভদ্রলোক বললেন,-"স্যার, আমি বিক্রমের বাবা, নিলয় দাস। আমাকে, আপনার সাথে দেখা করতে বলেছেন। আবার কী করেছে বিক্রম আপনার? কোন খারাপ আচরণ করেছে, নাকি কোন চুরি করেছে?"
কথাগুলো স্যারের কাছে একটু আশ্চর্য মনে হল।  -"চুরির কথা বলছে কেন?" স্বগতোক্তি করল স্যার।
নিলয় বাবুকে বললেন,-"আপনি এই  কথাগুলো বলছেন কেন? আমি আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে। বিক্রম বেশ কিছুদিন ধরে স্কুলে আসছে না, তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম- আপনি তাকে স্কুলে আসতে বারণ করেছেন। এর কারণ কী?
অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে থেকে, মাথা নিচু করে বললেন,-"স্যার, কি বলব আমার দুঃখের কথা। ছেলেটা আমার খারাপ সঙ্গ পেয়ে এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, সে বাড়ির অনেক জিনিস চুপ করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে সেই টাকার নেশা করেছে। এমনকি এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে একটি মোবাইল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। সেদিন খুব অপমানিত হই আমি। পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম, সে নেশায় আসক্ত হয়েছে। নেশার তাগিদে সে চুরি করা শুরু করেছে। একদিন খুব রাগারাগি করি। বিক্রমের মারও খুব কষ্ট, ছেলেটির এই অবস্থা দেখে। আমরা নিজেরাই ঠিক থাকতে পারিনি। ছেলেটি দেখলাম আমাদের হাতছাড়া হয়ে একেবারে বেলাইনে চলে গেছে। তাই একদিন রাগ করে নিজের বুকে পাথর চেপে  বলে ফেললাম,-"তোকে আর পড়াশোনা করতে হবে না, স্কুলে যেতে হবে না, তোর জীবন তুই বেছে নে।"
অমিতাভ স্যার শক্ত ভাবে বললেন,-"খুব অন্যায় করেছেন সেদিন। ' পড়াশোনা করতে হবে না,স্কুল যেতে হবে না।'- এই কথাগুলো খুব ভুল বলেছেন। আপনার এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এর ফল খুব খারাপ হতে বসেছে।"
      স্যার লক্ষ্য করলেন, ভদ্রলোকের চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মুখের কথা ভার হয়ে আসছে। তিনি নিলয় বাবুকে বললেন,-"দেখুন, এখনো সময় আছে আপনার ছেলেকে ঠিক করার। তার ভবিষ্যৎ এখনো অনেক বাকি। আপনি তার অতীত পরিবর্তন করতে পারবেন না, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ তো আপনার হাতেই রয়েছে। আপনি মনে করলে তার ভবিষ্যৎ  খুব ভালো বানাতে পারবেন। আপনি তাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিন।"
       স্যারের কথাগুলি শুনে নিলয় বাবু সাইকেলে না চেপেই হেঁটে হেঁটে সামনের রাস্তার দিকে এগোচ্ছেন। ভেতরে নানান সম্ভাবনা উঁকি দিতে লাগল। অনিমেষ স্যার অনেকক্ষণ স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে নিলয় বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর নিজের সাইকেলের পেটেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে চললেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। 
       বিকাল পাঁচটা। বাড়িতে এসে বিক্রমের বাবা নিলয় বাবু চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকলেন চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর বললেন,-"বিক্রম বাড়িতে আসেনি?"
বিক্রমের খোঁজ করতে দেখে, স্ত্রী অনিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,-"কেন? আবার কোথাও কিছু কুকীর্তি করেছে নাকি ?"
       সব সময় বিক্রমকে নিয়ে বাবা-মা'র মধ্যে একটা ভয় কাজ করে চলত।
 "না না, সেরকম কিছু না। তবে জানো অনিমা-বিক্রম খুব খারাপ পথে চলে যাচ্ছে। তাকে সঠিক লাইনে আনতেই হবে। আজকে বিক্রম বাড়িতে এলে, আমি ঘুমিয়ে পড়লেও আমাকে ডেকে দিও, আমি তার সাথে কথা বলব।"
         বিকেল শেষে বিক্রম বাড়ি ফিরল। মা ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছে। বাবা তখনো চেয়ারে বসা। ছেলেকে দেখে বলে উঠলো,-"কোথায় গিয়েছিলি, বাবা? এত দেরি করে বাড়ি ফিরলি, দুপুরে কোথায় খেয়েছিস, বাবা?"
"তোমরা খেয়েছো তো.... আমার খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না।"-অন্যান্য দিনের মতোই কথাটা বলে ফেললো, বিক্রম।
"বিক্রম, তুই রাগ করছিস কেন? আমি তোর বাবা, আমি কখনোই তোর খারাপ চাইবো না। শোন বাবা- কাল থেকে তুই পড়াশোনা করবি, স্কুলে যাবি।"
কথাগুলো শুনে বিক্রম আকাশ থেকে পড়ল। "কি, আমি কাল থেকে স্কুলে যাব।"
"হ্যাঁ বাবা, তুই আগে কী করেছিস সব ভুলে যা। নতুন করে তুই জীবন শুরু কর- ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে।
"ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে"- শব্দদুটোতে বিক্রম থমকে যায়। অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা ভাবতে লাগলো। ''অমিতাভ স্যার স্কুলে যেতে বলছেন, আজকে বাবাও স্কুলে যেতে বলছে। সত্যি তো আমার একটা ভবিষ্যৎ আছে।''- স্বগতোক্তি করল বিক্রম।
       ছায়া  বদলে যাচ্ছে। আকাশে রংয়ের পরিবর্তন ঘটছে। বিক্রম বন্ধুদের ডাকে আজ সাড়া দিল না। তৈরি হল স্কুলের জন্য। মা বিক্রমের মধ্যে কয়েক মাস আগের বিক্রমকে দেখতে পেল। সে যেন বদলে যাচ্ছে। বইয়ের ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে স্কুলে রওনা হল বিক্রম।
       অমিতাভ স্যার বিক্রমকে ক্লাসে দেখলেন। কাছে গিয়ে বললেন,-"গত অনেকদিনের পড়া থেকে তুমি অনেকটাই পিছিয়ে গেছো বিক্রম। এখন তোমাকে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। তুমি টিফিন পিরিয়ডে আমার সাথে দেখা করবে। আমি আগের হয়ে যাওয়াতে অধ্যায়গুলো বুঝিয়ে দেবো।"
        স্যারের  কথানুযায়ী বিক্রম, টিফিনের সময় বন্ধুদের সাথে না থেকে স্যারের কাছে চলে যেত। স্যার বুঝাতেন, একের পরে এক- আগের হয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলো। বিক্রমের মধ্যে স্যার ভালো রেজাল্ট করার প্রবণতা দেখতে পেলেন। বিক্রমকে বললেন,-"বিক্রম,তুমি তোমার অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবে না,কিন্তু ভবিষ্যৎকে ভালো করার চাবিকাঠি তোমার হাতে রয়েছে। তাই তুমি জোর দিয়ে পড়াশোনা করো। এটাই তোমার উপযুক্ত সময়। আমি তোমার সাথে আছি।"
স্যারের এই কথাগুলোতে বিক্রম অনেক প্রেরনা পেল। অনেক ভরসাও পেল।বাড়িতে এসে বিক্রম পড়ার পেছনে অনেকটা সময় দিল। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো বিক্রম। আগের দুঃস্বপ্নগুলো সে ভুলে যেতে লাগলো। বাবা-মা অবাক হলেন- বিক্রমের একাগ্রতায়। নবম শ্রেণিতে বিক্রম খুব ভালো রেজাল্ট করে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হল।
     আগামী বছর বিক্রম মাধ্যমিক দেবে। অমিতাভ স্যার এবং স্কুলের অন্যান্য স্যারের চেষ্টায় বিক্রম এগিয়ে চলছে-ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে। ইতিমধ্যে ক্লাসের ভালো ছেলেদের দলে, স্যারদের নজরের খাতায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে বিক্রম। মাধ্যমিকে যাতে ভালো ফল হয় সেই দিকে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লক্ষ্য তার উপর। অমিতাভ স্যার, বিক্রমের মধ্যে দেখতে পেলেন মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েই চলছে।
        মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিক্রম মনোযোগের সাথে পরীক্ষা দিয়ে চলছে। অবশেষে ফল প্রকাশের সময় জানা গেল-বিক্রম মাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করেছে। খুশিতে অমিতাভ স্যার চোখের জল আটকাতে পারলেল না। তিনি প্রমাণ করতে পারলেন-অতীত পরিবর্তন কেউ পারেনা ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা করলে ভবিষ্যৎ খুব ভালো করে গড়ে তুলতে পারে-যে কেউ।
      বিক্রম, অমিতাভ স্যারকে প্রণাম করে বলল,-"স্যার, আমি খুব খারাপ সঙ্গ পেয়ে খুব খারাপ পথে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনার কথায় আমি ফিরে আসতে পেরেছি। আপনার যে কথাটা আজও আমার বুকে গেঁথে আছে, সেটি হলো -"অতীত পরিবর্তন করা যায় না কিন্তু ভবিষ্যৎ ইচ্ছামতন গড়ে তোলা যায়।
         অমিতাভ স্যার, বিক্রমের পিঠে হাত রেখে বললেন,-"তাহলে বিক্রম ,এখন তোমার ভবিষ্যতের লক্ষ্য কী?"
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথা উঁচু করে বিক্রম বলল,-"ভবিষ্যতে, আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই। আপনার মত মানুষ গড়ার কারিগর হতে চাই। আমি এগিয়ে যেতে চাই ভবিষ্যৎ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। স্যার আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন।"

Thursday, August 18, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -4


 



পিসেমশাই  বলছেন, নাতি বয়স বাড়লেই পাবে তিনপুরুষের পরশ...।তারপরেই হয়ত মনোজের মত হবে তার অবস্থা।মনোজ ভাবে, তখন আমার আস্তানা নদীর ধারের বাংলোয়। ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে বসেছিলাম বারান্দা। সব কিছুর  মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি।  সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই।  তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর  আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে।  সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। এইসব চিন্তা করছি এমন সময়ে  হঠাৎ আমার কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল সশব্দে এক গুলি। আমি অবাক। জঙ্গলের ভিতর আমার বাংলোর হদিশ কেউ জানে না নিজের লোক ছাড়া। তাহলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার লোক কে?  পেশায় আমি গোয়েন্দা। শত্রুর অভাব নেই। কিন্তু আমার এই গোপন বাংলোর খবর পাঁচজন জানে। তারা সকলেই আমার নিকট আত্মীয়। আমার বৌ, ছেলে, রমেন, পিয়ু আর শ্যামল। বৌ, ছেলেকে সন্দেহ তালিকায় রাখি কি করে?  তবু...আর রমেন, পিয়ু আর শ্যামল তিনজনই আমার খুব ভাল বন্ধু। তাহলে কে?  কে? কে? এই রহস্যে মোড়া ব্যক্তি।তারপরদিন সকালে অফিসে গেলাম। হাসিমুখে সকলের সঙ্গে কথা বললাম। বুঝতে কেউ যাতে না পারে তার জন্য অনেক অভিনয় করলাম। কোন হদিস পেলাম না।খুব কঠিন এক পরীক্ষায় আমাকে সফল হতেই হবে। ছেলে, বৌ কাউকে বললাম না কথাটা।প্রায় একমাস পর বাংলোয় বসে আছি অন্ধকারে। একটা কালো মূর্তি মনে হল সামনে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। অমাবস্যার রাতে অন্ধকারের সুযোগ নিতে চায় খুনী। আমি পাশ থেকে দেখলাম চেয়ারে বসানো বড় পুতুলটার উপর পরপর তিনটে গুলি করে খুনী পালাচ্ছে। ও বুঝতেই পারে নি আমার সাজানো নাটক। আন্দাজ করেছিলাম ঠিক। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছুটতে লাগলাম মুখোশধারীর পিছনে পিছনে। শেষে ধরে ফেললাম বাম হাতে কলার চেপে। ডান হাতে আমার সার্ভিস রিভলবর। মুখোশ টেনে খুললাম। তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।অনেকদিন থেকে শ্যামল আর পিউয়ের একটা পরকিয়া সম্পর্ক চলছিল। পিউ শ্যামলকে পছন্দ করত না। সে বারবার সেকথা আমাকে বলেছে। পিউ বলত শ্যামল কবি । ওসব কবিত্ব আমার ভাল লাগে না। শালা ভিখারি, ভ্যাগাবন্ড। বেশ পয়সাওয়ালা এক রসিকের খোঁজে আমি আছি। দুদিন শালা আমার সঙ্গে বিছানায় শুয়েছে। একদম বিনা পয়সায়। বিয়ে করা বৌ নয় আমি। ওকে বারণ করে দিবি। আমি বলেছিলাম, ও তোকে ভালবাসে। ওরকম বলিস না। টাকাপয়সার সঙ্গে প্রেমের তুলনা করিস না।পিউ বলেছিল, আমি তোকে ভালবাসি। ওর কাছে আমি যাব না।আমি রেগে বলেছিলাম, পিউ আমার সংসার আছে। ছেলে আছে। আর শ্যামল বিয়ে করেনি আর তুই বিধবা। তোরা বিয়ে করে নে। সুখে থাকবি দুজনে।পিউ জেদ করে বলল, আমি তোকেই চাই। আর যদি না পাই আমি সব শেষ করে দেব।আমি বলেছিলাম, কি শেষ করবি।

--- আমি নিজেকে শেষ করে দেব।


তারপর হয়ত চিন্তাভাবনা পাল্টে পিউ প্ল্যান পাল্টেছিল। আমি বিষয়টা গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু পিউ শ্যামলের পোশাক পরে ছেলের সাজে কালো কাপড় ঢাকা দিয়ে আজ আমাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার প্ল্যান করেছিল।


একটুর জন্য আমি বেঁচে গেছি...


পিউ বলল, তাহলে আমি কাকে গুলি করে মারলাম।

আমি বললাম, সব কথা থানায় হবে। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।

মনোজ ভাবে, অতি সুক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে  অপরূপ প্রকৃতির, কোলে আশ্রয় নিতে চাই।চাওয়া,পাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হোক নশ্বর দেহের অহংকার।


স্থূল  পদার্থ নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না।অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত।তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।

আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খন্ড খন্ড করেছি।এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখন্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই।আকাশ চিরদিন অখন্ডই থাকে।তাকে খন্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো।তবু কাঁটাতার হয়,সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল।আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, 'অনন্ত নাদ' এর ভেরী।সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব,ভুলে যায় তার  অবস্থান। এ অনুভূতি ঝর্ণার মত,কবিতার মত,ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না। সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে।পৃথিবী ঘোরে ভয়ে,তা না হলে সে ধ্বংস হবে। সূর্য তাপ দেয় ভয়ে, তা না হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস,স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ ,প্রলয় মানুষের নিশ্বাস।আলোর অনুসন্ধানীর  ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই।  লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই।অকাল বার্ধক্য নেই।

 আছে শুধু আনন্দ,ছেলেমানুষি,বোকামি,সরলতা,সোজা পথে হাঁটার সোজা রাস্তা...বন্ধু, জাতপাত নির্বিশেষে অখন্ডতার অসীম ভালোলাগায়  মনসায়রে আপনি ডুব  দিতেই পারে।মনোজ জানত,অভিনবকে সবাই নার্ভলেস বয় বলেই ডাকে।



 ছোটো থেকেই সে প্রচন্ড সাহসী। নদীতে সাঁতার কাটা কিংবা উঁচু গাছ থেকে লাফিয়ে পুকুরের জলে ঝাঁপ দেওয়া তার কাছে জলভাতের মত সহজ। তার বন্ধু চিনু বলছে বন্ধুদের আড্ডায় আত্মার অবস্থানের কথা।  দ্বিতীয় স্তরে কেউ যদি দেহ ত্যাগ করেন এবং তাঁর মৃত্যু হয়, তিনি সেই ফেজ-এ প্রবেশ করেন, যেখানে চৈতন্য মন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়। মনের প্রকাশ চিন্তায়। চিন্তাই আমাদের জগৎকে তৈরি করে। এই পর্যায়ে চৈতন্য সেই জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং নিজেকে বিযুক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এই স্তরে আরও একটা ঘটনা ঘটে, যিনি যে ধর্মের মানুষ, যে বিশ্বাসের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন, তিনি সেই বিশ্বাস অনুযায়ী অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হবেন। খ্রিষ্ট-বিশ্বাসী জিশুকে, কৃষ্ণ-বিশ্বাসী কৃষ্ণকে দেখতে পাবেন। স্বর্গ বা নরকের যে ধারণা তাঁরা পোষণ করে এসেছেন, তেমন স্বর্গ বা নরক তাঁদের সামনে প্রতীয়মান হবে। যিনি নাস্তিক, তাঁর কাছে এই স্তরটি একটি পাসিং ফেজ হিসেবেই থাকবে। তিনি পরবর্তী স্তরের দিকে এগিয়ে যাবেন।এই দুই স্তরের সমান্তরালে আসবে তৃতীয় স্তর। মনে রাখতে হবে, এই স্তরগুলি ‘পর পর’ ঘটে না। এগুলি সমান্তরাল। কারণ ‘সময়’ বলে কিছুই হয় না। কোনও ঘটনা আগে বা পরে ঘটে না। আমরা জীবদ্দশায় ঘটনা দিয়ে সময়ের ক্রমিকতা তৈরি করি। সেটা একেবারেই ইলিউশন। মৃত্যু-পরবর্তী তৃতীয় স্তরে এক আলোকসম্ভব অস্তিত্বের মুখোমুখি হই আমরা। এই অস্তিত্বই মহাচৈতন্য। আমরা বুঝতে পারি, আমদের আত্মা বলে যে বিষয়কে আমরা লালন করে এসেছি, তা-ও ‘আমার’ নয়। সে সেই আলোকসম্ভব মহাঅস্তিত্বেরই অংশ। আমাদের আত্মা বলে আলাদা কিছু হয় না। তা বিশ্বাত্মা। তার আমি-তুমি-সে-তাহারা ভেদ নেই। তার ক্ষয় নেই, নাশ নেই।এর একটু পরেই চলে এল নার্ভলেস বয় অভিনব। সে এসেই বসল বন্ধুদের মাঝে। বন্ধুদের বড় প্রিয় এই নার্ভলেস। সে এলেই বন্ধুদের আড্ডায় চারটে চাঁদ নেমে আসে। আলোচনা আরও জমে ওঠে। নার্ভলেস শুরু করে তার পাহাড়ে ওঠার গল্প।একবার মটর সাইকেলে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়েছিল নার্ভলেস বয়। উত্তর ভারত ঘুরতে তার সময় লেগেছিল একমাস। সব জায়গা ঘোরা না হলেও বেশির ভাগ স্থান ঘোরা হয়েছিল। স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন, কবিতা। মনে পরতো ফুলশয্যা,  আদর।   কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে । কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আশি। একদিন সবাই দেখলো, বুড়ি ফুলশয্যার রথে শ্মশানে গেলো বোধহয় স্বামীর কাছে। ঘুঘু পাখিটা ডেকে চলেছে তখনও,, ঘুঘুর ঘু... দাদুর বাবার লাঠি। যত্ন করে তুলে রাখা আছে বাঙ্কে। কার জন্য?  বৃদ্ধ আমার জন্য। কত সুখস্মৃতি জড়িয়ে লাঠির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। দাদামশাই লাঠি ধরে পথ চলতেন। লাঠিকে বলতেন, বাবা ভাল করে ধরে রাখিস। ফেলে দিস না এই বুড়ো বয়সে। কোমর ভেঙ্গে যাবে তাহলে। বিশ্বস্ত লাঠি তার দায়ীত্ব পালন করেছে পলে পলে। এবার তার নাতির পালা।স্মৃতিকন্ঠ গ্রামের মান্যগণ্য লোক। বংশগত একটা বিরাট আভিজাত্য তার চলনে বলনে প্রস্ফুটিত। স্বভাবতই সবাই তাকে সমীহ করে চলেন। তার একটিমাত্র পুত্র সন্তান। তার পড়াশোনার জন্য গ্রামের স্কুলে নিজের অর্থে সাজিয়ে তুলেছেন লাইব্রেরী রুম। যতরকমভাবে  স্কুলকে সাহায্য করা যায় তিনি করেন। তার ছেলের নাম রতন। স্কুলে ছেলে মেয়ে একসঙ্গেই পড়াশুনা করে। রতন পড়ে এখন ক্লাস নাইনে। আর শুভ বাবুর মেয়ে পড়ে ক্লাস সেভেনে। গ্রাম্য রাজনীতিতে রেষারেষি লেগেই আছে এই গ্রামের তিনটি পাড়ার লোকজন স্বচ্ছল। টাকা পয়সার অভাব নেই। স্মৃতিকন্ঠবাবুর পাড়ায় আভিজাত্যের লড়াই লেগেই আছে। এক বাড়িতে গাজনে একটা পাঁঠা থাকলে অন্য বাড়িতে বাঁধে দুটো। পাঁঠার ঝোল আর মদ। একদম কম্পিটিশন। প্রয়োজনে চার পাঁচটা পাঁঠা এনেও বড়লোকি দেখানোর ব্যাপারটা লেগেই থাকে। বাকি গ্রামবাসীদের ভুরিভোজ ভালোই হয়। তারা মজামারা দল। একজনকে বাহাদুরি দিয়ে তাতিয়ে দেয় তো অন্য বাবুর জেদ বেড়ে যায়। ব্যবসায়ী যারা তারা এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। এক গানের দল হঠাৎ একদিন শুভ বাবুর নাটমন্দিরে ডেরা বাঁধল। তারা ধর্মিয় নানা গানের মধ্য দিয়ে পালাগান শোনায়। রামায়ণ, মহাভারতের ঘটনা, যীশুখ্রীষ্টের ঘটনা গান আর নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে। 


মনোজ জীবনের কথা ভুলতে পারে না মরে গিয়েও। কত জীবনের কথকথা তার মনে পড়ছে তৃতীয় স্তরের আত্মা হয়ে। হয়ত কোনদিন প্রথম স্তরের আত্মা তাকে টেনে নেবে স্বর্গদ্বারে। তাদের গ্রামে

রাত বাড়লে নাট মন্দির লোকের ভিড়ে ভরে যায়। শুরু হয় নাটক। দেবতার গলায় গাঁদা ফুলের মালা।অভিনয় দেখে সকলেই মোহিত হয়ে যায়। নাটকের শেষে দেবতার গলায় থাকা মালা নিয়ে দরাদরি শুরু হয়। স্মৃতিকন্ঠ হাঁকেন, আমি মালার দাম দশ হাজার দিলাম। শুভবাবু পারিষদদল নিয়ে বসে আছেন। তিনি ভাবলেন,এ মালা আমাকেই নিতে হবে। তা না হলে মান সম্মান থাকবে না। তিনি মালার দর হাঁকলেন কুড়িহাজার টাকা।এইভাবে চলতে থাকল নীলামের খেলা। এদিকে নাটকের দলের মহিলা একজন বলছেন, আপনাদের গ্রামের লোক এত কৃপণ কেন। এই তো পাশের গ্রামে মালার দর পেয়েছি এক লক্ষ টাকা।শুনে মালার দর আরও বেড়ে গেল। এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকায় নীলামে একটা গাঁদার মালা কিনল গাধার দল।মুচকি হাসি আগত অভিনেত্রীর চোখেমুখে। তিনি সফল আপন কারবারে।এইভাবে  বেশ কয়েকদিন টাকা কামিয়ে নাটকের দল চলে যেত আরও মুরগির সন্ধানে....



---ওরে যাস না ওদিকে, পুকুর আছে ডুবে যাবি

----- না মা, কিছু হবে না


ছোট থেকে চিনু দুরন্ত, একরোখা ছেলে। ভয় কাকে বলে সে জানে না। এই নিয়ে তার পরিবারের চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মনোজের বন্ধু চিনু। মনোজ জানে এই চিনুর আত্মা তাকে উদ্ধার করবে মরার পরে। 

এইভাবে প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে যায় মানুষ । কত কি শেখার আছে প্রকৃতির কাছে। কিন্তু কজনে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু চিনু সেই শিক্ষা নিয়েছিল। গ্রামের সকলে তাকে একটা আলাদা চোখে দেখত।বেশ সম্ভ্রমের চোখে। পরিবারের সকলে জানে না, কি করে চিনু শিক্ষা পেল। প্রথাগত শিক্ষা সে পায় নি। তবু বাড়িতে দাদুর কাছে লেখাপড়া শিখেছে। বই পড়া শিখেছে। চিনু বলত, দাদু কি করে তুমি বই পড়। আমি পারি না কেন?  দাদু বলতেন, নিশ্চয় পারবি। মনে মনে  বানান করে পড়বি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি বইপড়া শিখে যাবি।হয়েছিল তাই। দুমাসের মধ্যে চিনু গড়গড় করে বই পড়ত।কোনো উচ্চারণ ভুল থাকত না।দুপুরবেলা হলেই চিনু বন্ধুদের নিয়ে কদতলা, বেলতলা, আমতলা, জামতলা দৌড়ে বেড়াত। কাঁচা কদ কড়মড় করে চিবিয়ে খেত। লাঠিখেলা,কবাডি সব খেলাতেই তার অদম্য উৎসাহ। গ্রামের লোকের উপকারে তার দল আগে যায়।এই দাপুটে ছেলে চিনু একদিন এক সাধুর সঙ্গে ঘরছাড়া  হল। বাড়ির সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। কিন্তু চিনুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন গ্রামের একজন গিয়ে দেখল, সাধুর আশ্রমে সবুজ গাছ যত্নের, কাজ করছে চিনু.

 ভূত বলে কিছু হয় না জানি। তবু  ভূতের প্রতি আমার ছোট থেকেই দূর্বলতা আছে। বিশ্বাস করি। ভগবান আছেন ভূতও আছে। আমার এক বন্ধু মাঠে খেলতে গিয়ে আমাকে বললো, আমার দাদু এসেছিলেন এখনি। হয়ত তিনি মরে গেলেন। দুজনেই বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখলাম কথাটা একদম সত্যি। দাদু বলেছিলেন মরার পরে তোকে একবার দেখা দেব। এই ঘটনাকে আপনি কি বলবেন বলুন? আর তাছাড়া ভূত সমাজে ভাল, মন্দ সব রকমের ভূত আছে। আমার দাদু বলতেন, একবার চাষের জমিতে জল লাগবে। টাকা পয়সার অভাবে জল দিতে পারি নি। রাতে শুয়ে ভাবছি, আমি রোগী আবার সত্তর বছরের বুড়ো। এ ঘোড়া আর ঘুরে ঘাস খাবে না।চাঁদের আলোয় বসে আছি জেগে। কি সুন্দর পৃথিবীর রঙ। সকলের যদি আহারের ব্যবস্থা থাকত তাহল দুঃখ থাকত না। আর তারজন্য চাষের জমির পরিমাণ বাড়াতে হবে। জলের ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব ভাবছি, এমন সময়ে দরজায় টোকা। আমি বললাম, কে?


  বাইরে থেকে আওয়াজ এল, চলে আয় বাইরে।


 মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে  চলে গেলাম বাইরে, তারপর মাঠে। সে আমাকে বলল, তুই বসে থাক। এখানকার সব জমিতে জল দেব। একটু দূরে বড় পুকুর ছিল। ওই পুকুরে ভয়ে আমরা যেতাম না। দিনের বেলায় পর্যন্ত ওখানে হাসির শব্দ পেত সবাই। হি হি হি করে কারা যেন হাসত ব্যঙ্গ করে। শুনলাম ভয়ংকর হাসি। বার বার পাঁচবার। ভয় পেলাম প্রচন্ড। 

তারপর আর কিছু মনে নেই। 

পরের দিন মাঠে গিয়ে দেখি, ভালোই হয়েছে। জলে জলময় সব মাঠ। এই খরার সময় এত জল দেখে সবাই অবাক। লোকে বলল,এ তো একদম ম্যাজিক। চাষিরা বলল, এই ম্যাজিক যেন বার বার প্রতিবার হয়। 




                           ক্রমশ...

Monday, August 15, 2022

ছোট গল্প - সম্পর্ক || লেখক - অরুণোদয় ভট্টাচার্য || Short story - Somporko || Written by Arunodoy Bhattacharya


 

সম্পর্ক

                     অরুণোদয় ভট্টাচার্য


সুরঞ্জনের অতটা বিহ্বল হবার কথা নয় ।হোতও না যদি খানিকটা কাকতালীয় বা ইংরিজিতে যাকে স্ট্রেঞ্জ কোয়েনসিডেন্স বলে, সেরকম একটা না ঘটত ।নিজের ছাত্রজীবনে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ চৌকস যুবকদের সারিতেই সে ছিল ।মাঝে মাঝে নাটক আবৃত্তিতে অংশ নিয়ে প্রশংসা পেয়েছে ।অধ্যাপক-জীবনে নবীনবরণ ও শিক্ষক বিশেষের বিদায় সম্বর্ধনা সভায় অনেক বক্তৃতা দিয়েছে ।সহকর্মী ও কর্মিনীরা তাকে যথেষ্ট স্মার্টই ভাবে ।এমন কি ইতিহাসের কাকলী দত্ত একদিন বলেছিল, প্রফেসর মুখার্জী, আপনি কিন্তু ভারি ঠোঁঠকাটা ।

আসল ব্যাপারটা হল, প্রচুর উপন্যাস ও প্রেমের কবিতা পড়লেও মেয়ে-ঘটিত দুর্বলতা সুরঞ্জন কখনো অনুভব করে নি ।অনেক অল্প বয়সেই মেয়েদের কলেজে অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছে ।প্রথম প্রথম অনেক মেয়েই ওকে যাচাই করতে চেয়েছে ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে ।চিঠি দিয়ে, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে, এমন কি ‘স্যার, আই লাভ ইউ!’ বলে ।কিন্তু সুরঞ্জন মোটামুটি নির্বিকার ভাব বজায় রাখতে পেরেছে ।অথচ আজ, পনের বছর অধ্যাপনার পর, ঘরে বৌ ও তার বন্ধুনিদের দল এবং কলেজে সহকর্মিনী ও অজস্র ছাত্র্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করার পরও, সে কিনা হঠাৎ একটি ছাত্রীর একটি কথায় এমন বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে গেল!

আর কথাটাই বা কি?অতি সাধারণ ভদ্রতা-সূচক একটা প্রশ্ন ।কিন্তু ঠিক তার আধ ঘন্টা আগে কলেজের টিচার্স রুমে যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিল সুরঞ্জন নিজেই, সেই প্রেক্ষিতে এই সামান্য কথাটা অসামান্য, প্রায় অলৌকিক হয়ে উঠল ।

থার্ড ইয়ার অনার্স ক্লাসে একটা দুরূহ টপিক ডায়াগ্রাম এঁকে মেহনত করে বুঝিয়ে আসার পর ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নিজের চেয়ারটায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সুরঞ্জন ।বাংলার তরুণ অধ্যাপক অনিকেত লাগোয়া টয়লেট থেকে হাল্কা হয়ে বেরল; ধীরে-সুস্থে এসে বসল পাশের চেয়ারটায় ।এদিক-ওদিক আরো দু’চার জন ছিল ইংরিজি, বটানি, কমার্শিয়াল ল’য়ের ।

সুরঞ্জন বলল, ‘দেখ,অনিকেত, তুমি তো নামকরা কাগজের নামকরা কবি ।ব্যথা বোঝ? ছোটখাট আক্ষেপ?’

অনিকেত বলল, ‘দেখুন আপনি এত হেঁয়ালি করছেন, তবু আধুনিক কবিতাকে দুর্বোধ্য বলেন!’ তারপর সুরঞ্জনের দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে যোগ করল, ‘কি হয়েছে দাদা? আপনাকে আবার কে দাগা দিল?’

সুরঞ্জন বলল, আচ্ছা প্রাঞ্জল করেই বলি ।আমার একটা বিশেষ আক্ষেপ আছে ।বিষয়টা সামান্য, কিন্তু প্রায়ই খোঁচা দেয় ।এত বছর কাজ করছি এই মেয়ে-কলেজে, এতো গাড়িবতীর ভিড় এখানে ।কিন্তু কেউ একদিনও লিফ্ট অফার করল না!

বিমল ভঞ্জ তার স্বভাবসিদ্ধ চ্যাংড়ামির ভঙ্গিতে লিফ্ট কথাটার কু-অর্থ করে এক চোখ বুজিয়ে বলল, এই বয়সে কলেজের মেয়েদের কাছে লিফ্ট চাও?শুনলে ঘরওয়ালি ক্যা কহেঙ্গি? মেয়েদের আজকাল দাবায়ে রাখতে পারবা না!

তন্বী পূরবী সেন এডুকেশানের অধ্যাপিকা ।ঠোঁঠে আঙুল ঠেকিয়ে বলল-সসস্!ভবানী দি শুনতে পাবে!ভবানী দি মানে ভবানী বটব্যাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল ।চিরকুমারী ।

বিমলের মন্তব্যটাকে অগ্রাহ্য করে সুরঞ্জন তার খেদের কথাটা সম্পূর্ণ করে –‘অথচ প্রচুর পয়সাঅলা লোকের মেয়ে এখানেপড়ে ।আমার বাড়ি থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বাড়ি যাতায়াতের পথে অন্তত ডজন খানেক ডিফারেন্ট মডেলের গাড়ি এখানকার মেয়েদের নিয়ে রোজ আনাগোনা করছে ।কলেজের সামনে এসে তারা হর্ন দিয়ে চমকে দিচ্ছে ।ধুলো উড়িয়ে পোড়া পেট্রলের ধোঁয়া নাকেমুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ।অথচ মিনিমাম ভদ্রতা করে কেউ একদিন লিফ্ট দেয় না!’

‘আমার অবস্থায় পড়লে আপনি আর লিফ্ট চাইতেন না’-পূরবী সচেতন ন্যাকামিতে চোখ বিস্ফারিত করে- ‘সেদিন এক সফিস্টিকেটেড ছাত্রী তার আদুরে ডোবারম্যানের পাশে বসিয়ে দিয়েছিল আমায় ।উঃ মা!লয়েডস্ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত সারা রাস্তা ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি কুকুরটার গায়ে গা ঠেকিয়ে!’

বিমলের আগের কথায় পাত্তা দেয়া হয় নি বলে এবার সে সুরঞ্জনের কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বলে, ‘ব্রাদার, কেন বুঝতে পারছ না, মেয়েরা তোমার রাশভারি ভাব পছন্দ করে না?’

তার খানিক পরেই, একটা সিগারেটের আধখানা শেষ করে সুরঞ্জন পথে পা বাড়িয়েছিল ।বাসস্টপে এসে হাত থেকে সিগারেটের অংশটা ফেলে দিয়ে ঠাহর করতে চেষ্টা করছিল আগতপ্রায় মিনিটা ঢাকুরিয়া-র কিনা...এমন সময় হঠাৎ শুনল-

‘প্লীজ, মে আই গিভ ইউ আ লিফ্ট,স্যার?’

হাঁ, সুরঞ্জনকেই বলছে ।তার সামনেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে!যেমন তেমন গাড়ি নয়, একেবারে ঝকঝকে জাপানি টয়োটা!

মেয়েটা নিশ্চয়ই তার কলেজের;কিন্তু ইকনমিক্সের নয়, তাহলে একটু চেনা লাগত ।

ওকে নীরব এবং কিঞ্চিৎ বিমূঢ় দেখে মেয়েটি এবার বলল, ‘আপনি বাড়ি যাবেন তো? আমি ঐ দিকেই যাব...’

ঘটনার অদ্ভুত যোগাযোগ সুরঞ্জনকে হতচকিত করে ফেলেছিল ।কিন্তু সে অনুভব করল অনেক জোড়া ছাত্রী ও পথচারীর চোখ বাসস্টপ ও ফুটপাত থেকে গাড়ির দিকে নিবদ্ধ হয়েছে কৌতূহলী হয়ে ।বিব্রত মুখে সে উঠে বসল মেয়েটির পাশে ।গাড়ি ছেড়ে দিল ।

গলা ঝেড়ে অস্বস্তি কাটিয়ে সহজ হতে চাইল সুরঞ্জন ।বলল, তুমি কোন্ ইয়ারে পড়?অনার্স আছে?

-‘ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি এ বছর ।আমরা আগে দিল্লি ছিলাম ।ড্যাডি এক ইন্দোজাপানিজ্ কোম্পানির ডিরেক্টর ।আমি ভেবেছিলাম ইকনমিকস্ অনার্স করব ।কিন্তু এ্যাডমিশনের সময় এখানকার প্রফেসররা বললেন হিস্ট্রিতে লেটার মার্কস্ পেয়েছ,ঐটাতেই অনার্স নাও ।সো...’

মেয়েটির গলা বেশ মিষ্টি ।কথার ভঙ্গিতে অনায়াস অন্তরঙ্গতা ।সুরঞ্জন ভাবছিল কি বলবে ।মেয়েটিই আবার কথা বলল-

আপনি আমাদের ফ্রেশার্স ওয়েলকামে এ্যাড্রেস করেছিলেন ।আমি ভীষণ ইমপ্রেসড্ হয়েছিলাম...আই মীন্ অল অব আস্...

মেয়েটির সারল্যে খুশি হল সুরঞ্জন ।নিজের প্রশংসা শুনে আত্মবিশ্বাসওএকটু বাড়ল ।পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখ নিরীক্ষণ করে বলল, তোমার নাম কি?

-‘শম্পা বসু ।রোল নাম্বার সেভেন্টি-নাইন ।’

ওর ফর্সা বাঁ গাল, ঈষৎ চাপা নাক, আর রক্তিম ঠোঁঠের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক লক্ষ করল সুরঞ্জন ।আপন মনেই ভাবল,কোঁকড়া চুলটা এই মুখশ্রীর সঙ্গে একটু বেমানান...কিন্তু ভাসাভাসা চোখ দুটো সহজেই অচেনাকে আপন করে নিতে পারে...

শম্পা বলল, স্যর, আপনি কি কোন ব্যাপারে ওরিড্?...আই মীন্ কেমন যেন এ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড্...

-‘না,না, ও কিছু নয় ।ইটস্ অলরাইট ।আমি জাস্ট ভাবছিলাম হাউ গুড ইউ আর!তোমাদের বাড়ি কোথায়,শম্পা?’

‘যোধপুর পার্ক ।আপনাকে দু’তিন দিন মিনি থেকে নামতে দেখেছি ।’

‘তাই নাকি? হ্যাঁ আমি ভবানীপুরে বিজলি সিনেমা হাউসের কাছে থাকি ।’

‘রফিক, ভবানীপুর চলো!’

সুরঞ্জন একবার ভাবল, শিখা আবার যদি কিছু মনে করে বসে এ নতুন ঘটনায় ।মজাও লাগল,ভাবে তো ভাবুক!জীবনটা বড্ড স্তিমিত, একঘেঁয়ে, ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে ।ক্লাস,টুইশান, লাইব্রেরি, খাতা দেখা আর টিভি দেখা ।ভেবেই আবার হাসি পেল ।একটা কার-লিফ্ট তার নিস্তরঙ্গ জীবনে কি ঢেউ তুলবে!...বাচ্চা মেয়ে, টিপিক্যাল বাঙালি মেয়েদের মত প্যাঁচ নেই মনে...বোধ হয় বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান...তাছাড়া শম্পা থোড়াই রোজ লিফ্ট দেবে ।ওর ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয় ।কারণ ওর আর এস.এম.-এর রুটিনের মধ্যে অনেক ফারাক আছে ।...

বিজলি সিনেমা এসে গেল ।সুরঞ্জনের নির্দেশ অনুসারে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল ।সুরঞ্জন নামল ।শম্পাকে বলল, টপ ফ্লোরে ডান দিকের ফ্ল্যাটটা আমার ।কোন ছুটির দিনে চলে এসো, ভাল করে দিল্লির গল্প শুনব ।সো সুইট অব ইউ টু অফার মী দ্য লিফ্ট!

শম্পাও নেমে পড়েছিল গাড়ি থেকে ।বলল, ‘আসব স্যার, অব কোর্স!আয়্যাম সো হ্যাপি টুডে ।আজ আমার বার্থ ডে ।মা বলে, আজ তেমন কাজ করা উচিত, যা করলে মন ভাল থাকে ।’

হঠাৎ নীচু হয়ে সে প্রণাম করল সুরঞ্জনকে ।সুরঞ্জনও স্বতস্ফূর্ত ভাবে তাকে তুলে ধরল ।

শম্পা ওর চোখেমুখ তুলে বলল, ব্লেস্ মী স্যার!

-হ্যাঁ, আশীর্বাদ করি জীবনে সব বিষয়ে সফল হও!...তুমি এস কিন্তু ঠিক সানডে বা যে কোন হলিডেতে ।আমি বাড়িতেই থাকি ।

                        (২)

তারপর শম্পা সত্যিই এসেছে সুরঞ্জনের ফ্ল্যাটে ।একবার নয়, বারবার ।শিখাকে অসংকোচে আন্টি ডেকে ঘনিষ্ঠ আলাপ জমিয়ে নিয়েছে ।সঙ্গে নিয়ে এসেছে কখনো মিষ্টির বাক্স, কখনো নামী রেস্তোরাঁর ফিশফ্রাই, কখনো বা চকোলেট-কেক ।সুরঞ্জন বিব্রত হয়ে বলেছে, ‘তুমি সবসময়খাবার আন কেন? আমাদের কি লৌকিকতার সম্পর্ক? তাছাড়া আমরা বুড়োবুড়ি কি এত খেতে পারি? দেখছ তো বাচ্চাকাচ্চার পাট নেই, আমাদের বাড়ি বড্ড শুকনো!’

শম্পা প্রথমটা থতমত খেলেও নিরস্ত হয়নি ।বলেছে ‘আপনারা মোটেই বুড়ো নন ।তবু যদি আমার আনা খাবার খেতে আপনার আপত্তি থাকে, আমিই এখানে বসে খাব ।নাকি, আপনি আমায় খাবার জন্য দোকানে পাঠাবেন?’

প্রথম দর্শনেই মেয়েটার ওপর শিখারও বেশ মায়া পড়ে গেছে ।সেও একদিন সুরঞ্জনকে ঠেস দিয়ে বলল, ‘আমরা মা-মেয়ে ভালমন্দ খাই বলে তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি?’ উল্টে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ‘শ্রীহরি’ থেকে গরম সিঙ্গাড়া আর সন্দেশ আনিয়ে বসল শিখা ।আর শম্পা নিজের হাতে সুরঞ্জনের মুখে পুরে দিল একটা দেলখোস!

খেতে খেতে সুরঞ্জন ভাবতে লাগল...মা-মেয়ে...কথাটা তার মনের তারে অনুরণিত হতে থাকল ।

সত্যি!যে জিনিসটা ফোটার আগেই জীবন থেকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত বলে ভাবা গিয়েছিল, শম্পাকে কাছ থেকে দেখে সেই অপত্য স্নেহ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ঝরে পড়ল মনের শুষ্ক কন্দরে ।ঠিক শম্পার বয়সী হোত না তাদের মেয়ে থাকলে, কারণ সুরঞ্জন-শিখার দাম্পত্য জীবনের আয়ু এখনো ষোল বছর পেরোয় নি ।কিন্তু শিখা ঠিকই বলেছে, মেয়ে মনে করতে কোন অসুবিধে নেই ।ওর সঙ্গে যোগাযোগটা যেন বিধাতার তরফ থেকে খানিকটা ক্ষতিপূরণ বা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো!***

তাদের বিবাহিত জীবন তিন বছর নিঃসন্তান কাটার পর দুপক্ষের আত্মীয় আর বন্ধুদের অনুরোধ ও গঞ্জনায় পিষ্ট হয়ে সুরঞ্জন ও শিখা দুজনেই যথারীতি ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছিল ।তাতে জানা গিয়েছিল দুর্বলতাটা সুরঞ্জনেরই ।তার শুক্রকীটগুলো প্রজননে অক্ষম ।অথচ সুরঞ্জনের আকৃতি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যলক্ষণ অনেকেরই ঈর্ষার বস্তু ।

সুরঞ্জন বলেছিল, ‘তোমার দুর্ভাগ্য, শিখা, আমার সঙ্গে গাঁটছড় বেঁধেছ ।কিন্তু আমি তোমাকে বেঁধে রাখব না ।...এ আঘাতের ক্ষতিপূরণ হয় না, তবু তোমার জীবন তুমি নতুন সঙ্গী নিয়ে সুরু করতে পার। সারা জীবন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে কেন বঞ্চিত থাকবে?’

শিখা ওর কপালে বুকে হাত বুলিয়েছে ।ইতিহাস প্রসিদ্ধ অনেক বীরপুরুষও যে পিতৃত্বের অধিকারী ছিলেন না, এ কথা উল্লেখ করেছে সান্ত্বনা হিসাবে ।শেষে বলেছে ‘তুমি তো আমায় ঠকাও নি, ভগবানই তোমায় ঠকিয়েছেন ।তোমার সমস্ত ভালবাসা প্রতিনিয়ত উজাড় করে দিয়েছ আমাকে ।এতো নিয়েছি, আর এই দুঃখটুকু ভাগ করে নিতে পারব না?’বন্ধু আর আত্মীয়দের বাচ্চা সম্পর্কে ওদের দুজনেরই হীনমন্যতা 

ছিল ।শিখা বড্ড বেশি আদর নিয়ে হামলে পড়ত; নিজের সন্তানের অভাবজনিত শূন্যতা লোকের চোখে পরিস্কার ধরা পড়ত ।তারা ভাবত করুণার পাত্রী ।ওদিকে সুরঞ্জন একটা আক্রোশ পোষন করত বাচ্চা-সমাজের প্রতি ।কেউ এসে তার ঘর নোংরা অগোছালো করলে তার বাপ-মা’র সামনেই ঝাঁঝিয়ে উঠত । একটা নার্সারি রাইম বলার জন্য সবাই যখন কোন বাচ্চাকে তোষামোদ করত, ওর গা জ্বলে যেত বিরক্তিতে ।নিজেকে বোঝাতে চেষটা করত এটা এক ধরণের বিকৃতি ।কিন্তু মানসিক ক্ষোভ তাতে শান্ত হোত না!

ক্রমে বহতা সময়ের প্রভাবে সে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে প্রায় মিলিয়ে গেছে ।অবসর সময়টা বেহালা বাজিয়ে কেটে গেছে একরকম ।শিখারও অন্যের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা ক্রমে নিবৃত্ত হয়েছে ।সে আছে একটা গানের স্কুল নিয়ে ।কিন্তু দুজনের মন হয়ে গেছে দ্বিধাবিভক্ত স্রোতের মত ।মাঝে বালির চড়া পড়েছে ।

                        (৩)

দু’বছরের ঘনিষ্ঠতায় শম্পা এখন সুরঞ্জনদের বাড়ি-তথা-জীবনের মূল কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে নিজেকে ।ওকে ঘিরে দু’জনের ব্যর্থ সন্তানাকাঙ্ক্ষার ফল্গুধারা প্রকাশ্য স্রোতের আকার ধারণ করেছে ।

ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে শম্পা ইকনমিকস্ নিয়েছে ।প্রায়ই সুরঞ্জনের কাছে বসে বইখাতা নিয়ে ।দাবিটা আগেই জানিয়ে দেয়—সিম্পল এ্যাণ্ড ক্লিয়ার করে বুঝিয়ে দিতে হবে ।

এখন শিখার শপিংয়েরও নিয়মিত সঙ্গিনী সে ।তার কাছে দু’এক পদ রান্নাও শিখেছে ।সিনেমা দেখতেও যায়, কখনো দুজনে, কখনো তিন জনে ।কোন কোন দিন হয়তো বা রবীন্দ্র সঙ্গীতের মহলা বসল।বেহালায় সঙ্গত করল সুরঞ্জন ।

গত পুজোর ছুটিতে শম্পার বাবা-মা-ভাই, অর্থাৎ, পুরো পরিবারের সঙ্গে সুরঞ্জনরা হাজারিবাগ কাটিয়ে এলো চার দিন ।ফটো তোলা হয়েছে অনেক ।গ্রুপ ফটো, একক ফটো, সুরঞ্জন আর শিখার সঙ্গে শম্পা ।এরকম একটা ফটো বাঁধিয়ে শিখা রেখে দিয়েছে ড্রইংরুমে ।

সপ্তাহে দু’দিন অন্তত কলেজ যাতায়াত শম্পাদের গাড়িতে করতে হয় সুরঞ্জনকে ।এ ছাড়াও মাঝেমধ্যে লিফ্ট জুটে যায় ।হয়তো আমেরিকান লাইব্রেরি থেকে জওহরলাল নেহরু রোডে পড়তেই চৌরঙ্গীর কোন সিনেমা হল থেকে ম্যাটিনি শো ফেরৎ শম্পা ওকে দেখতে পেয়ে থামল এসে পায়ের কাছে ।বলে উঠল,কাম ইন, কাকু, ইউ আর আণ্ডার এ্যারেস্ট!ইদানিং ‘কাকু’ই বলে সে ।সুরঞ্জন হাসিমুখে বলে, ‘এ যে দেখছি এস্ ফোর্টিনের বদলে এস শম্পা ।সকালে উঠে কার মুখ দেখেছিলাম!’ শম্পা জবাব দেয় ‘মনে হচ্ছে আমারই।’ দুজনেই হেসে ওঠে ।***

ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সরোদ ।কলামন্দির বেসমেন্ট হলে ।সুরঞ্জন দুটো টিকিট পেয়েছে ।শম্পাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে ।বাজনা শুনতে শুনতে রাগটার আরোহ-অবরোহ জানতে চায় শম্পা ।সুরঞ্জন নীচু স্বরে বলে দেয় ।অনেকক্ষণ রেষারেষির পর সরোদী আর তবলচি যখন একই সঙ্গে সম-এ পড়ে সন্ধি করল,শম্পা জিগ্যেস করল, ‘তাল ঠিক আছে? না, তুমি যেমন আমার সাথে এ্যাডজাস্ট করে নাও, ওরাও তেমনি শো-টা ঠিক রাখছে?’ সুরঞ্জন চাপা গলায় বলে, ‘চুপ,চুপ!আমজাদ শুনতে পেলে ঘাড় ধরে বসিয়ে হাতে কাউন্ট করাবে!’...ঠুংরি স্টাইলে পেশ-করাখাম্বাজ একেবারে বিভোর হয়ে উপভোগ করছিল সুরঞ্জন ।প্রতিটি মীড়ের কাকুতি যেন খানিকটা করে অনুরাগ চলকে তুলে প্রিয়র উদ্দেশে নিবেদন...।হঠাৎ তাকে পাশ ফিরে তাকাতে হোল ।তন্ময় হয়ে সরোদ শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে শম্পা একহাতে খামছে ধরেছে তার পাঞ্জাবির কাঁধ!...

মাঝে মাঝে শব্দ-জব্দও এনে হাজির করে শম্পা ।সমাধানের জন্য সুরঞ্জনের সাহায্য চায় ।একদিন মেলাতে গিয়ে একটা গোলমেলে কথা এসে পড়েছিল ।শম্পা পরম সারল্যভরে জিগ্যস করেছিল, ‘আসঙ্গ’ কথাটার মানে কি?সুরঞ্জন এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল,এটা তোমার আন্টি ভাল বলতে পারবে!

আজকাল প্রায়ই সুরঞ্জন অবাক হয়ে ভাবে, শম্পাকে একদিন না দেখলে কেন মনে হয়,মনের মুখশুদ্ধি হয় নি?...লোকের বাৎসল্য কি এই জিনিস?...অবশ্য নিজের সন্তান হলে যে অধিকার-জাত নিস্পৃহতা থাকে, পরের মেয়ে, পরের বোন ইত্যাদিকে আপন করে নেওয়ার মধ্য তার বদলে একটা আকর্ষক অনুভূতি থাকে ।টমাস হার্ডির নভেল ‘দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ’-এ হেনচার্ড ও এলিজাবেথ-জেন-এর কথা মনে হল সুরঞ্জনের ।সেই পেয়ে হারানোর ভয়...

তারপর সেদিনের ছাত্র-ধর্মঘট...কিছু উটকো ছেলে কলেজের গেট টপকে ভিতরে ঢুকেছিল ।সুরঞ্জন স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এসেচড়া গলায় প্রতিবাদ করেছিল ।অতর্কিতে একটা ইট এসে লাগল তার কপালে।...শম্পার গাড়িতেই সেদিন স্টিচ করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল ।অনেক রাত পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ-করা মাথায় হাত বুলিয়ে তবে বাড়ি গিয়েছিল মেয়েটা ।বলে গিয়েছিল, ‘কাকু, সাতদিন কমপ্লিট রেস্ট ।খবরদার কলেজ যাবে না!’

                         (৪)

শম্পার কথা রেখেছে সুরঞ্জন ।সাত দিন ছুটির পর আজ তার কলেজ জয়েন করার কথা ।গেলেই এরিয়ার ডি.এ. বেশ কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে ।সুরঞ্জন ভেবেই রেখেছে শম্পাকে লেটেস্ট টেকনোলজি-যুক্ত দামি একটা মোবাইল ফোন দেবে আজ ।সেই সঙ্গে ওর পছন্দমত কিছু ফিল্মের ডিভিডি-ও ।

শম্পাদের মোটর এসে থামল সুরঞ্জনের বাড়ির সামনে ।কিন্তু গাড়ি থেকে বরলেন শুধু শম্পার বাবা । সুরঞ্জন আপ্যায়ন করে বসাতেই তার হাতে তুলে দিলেন একটা জমকালো বিয়ের কার্ড ।সুরঞ্জন সবিস্ময়ে তাকাতে বললেন, ‘যোগাযোগ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎই হয়েছে ।আপনাদের আগে কিছু জানাতে পারিনি... ছেলেটি রিয়েল জেম্ ।সাতাশ বছর বয়সেই বিরাট বিজনেস এক্সিকিউটিভ ।ওরা থাকে বেঙ্গালুরু ।’

সুরঞ্জন চুপ করে রইল ।মিঃ বাসু আবার বললেন, ‘শম্পা আপনার কথা খুব শোনে ।কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে বলে কান্নাকাটি করছে ।আজ নাকি ওদের পার্ট টু-এর রেজাল্ট বেরবে? কিছুতেই কলেজ যাবে না বলছে ।ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, কেমন?...আমি চলি, অফিসের দেরি হচ্ছে...আপনি কি এখন কলেজ যাবেন? তাহলে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি...’

সুরঞ্জনের কানে আর শেষ কথাগুলো ঢুকল না ।সে শুধু ভাবতে লাগল, আমি বুঝিয়ে বলব শম্পাকে,,, আমি?...আমাকে কে বোঝাবে?...

কোন জবাব না পেয়ে মিঃ বাসু কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন অধ্যাপকের দিকে । তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগলেন ।

শিখা ধীর পায়ে ঘরে এসে ‘শুভ বিবাহ’ লেখা খামটা খুলে পড়ল । তারপর সুরঞ্জনের কাঁধে আলতো হাত রাখল ।

একটু চমকে উঠল সুরঞ্জন ।মুখ তুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল । মুখ দিয়ে বেরল, ‘হঠাৎ এসেছিল, হঠাৎই চলে যাচ্ছে!’

শিখা বলল, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি ।আমাদের শম্পি নিশ্চয়ই সুখী হবে!’

সুরঞ্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখ দুটো লক্ষ্য করল ।হাঁ, সে দুটো রীতিমত সজল ।

তবে কিনা, মানুষ সুখ-দুঃখ দুটোতেই চোখের জল ফেলে!


Sunday, August 14, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -15


 


ব্যাস আর যায় কোথা , আমার মুখ দিয়ে বাবা উচ্চারণ হতেই মনটাকে আর স্থির রাখতে পারলাম না । বাবার স্মৃতি আমাকে উতলা করে তুলল । এতদিন ভুলেছিলাম । বাবাকে , ভুলেছিলাম অতীতকে । কোন দিন আমর মনকে জিজ্ঞাসা করিনি , আমার অসহায় , দৈন্য পীড়িত বাবা কেমন আছেন । আমি বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি । এ পথের যাত্রী হয়ে বাবার কথা প্রায় ভুলতে চলেছিলাম । আজ বাবার কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই মনটা বড় কেঁদে উঠল ।


 তাই আদরী মাসীকে তাচ্ছিল্য করে শ্যামলীদি আমার মুখপানে তাকিয়ে বলল , আয় বোস এই কাজটা শেষ করে তোর সাথে কথা বলছি ।

 দেখলাম শ্যামলীদি ওর ডায়েরীতে লিখছে , অদ্যাবধি দুটো বছর কেটে গেলো , তবুও আমার হিতৈষী বন্ধুকে পেলাম না । তবে তুমি ভেবো না বন্ধু , যেখানে যেভাবে নিজেকে আত্মগোপন করে থাক না কেন , একদিন তোমার দেখা পাবই । তোমার অন্বেষণে সর্বদাই সজাগ আছি । তোমার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমার তৃষ্ণা কোনদিনই মিটবে না । আমার ক্লেদাক্ত জীবনে আমি শান্তি পাবো না । 

লেখা শেষ হতেই বলল , এই ডায়েরী লেখা দ্যাখ , আমার জীবনের জ্যোতির্ময় দেবতার অদৃশ্য সংকেত দেখতে পাবি । যার সঙ্গে আমার জীবন ছিলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত । যাকে নিয়ে আমি জীবনে একটা সুখের নীড় বাঁধতে চেয়েছিলাম । 

শ্যামলীদি আমার হাতে একটা ছবি দিলো । ওতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমার চোখ দুটো পদ্মফুলে আবদ্ধ ভ্রমরের মতো হয়ে গেল । ততক্ষণাৎ বলে উঠলাম , একি ! এযে আমার পূজনীয় রন্টুদা ? 

কি বললি ? শ্যামলীদি বিদ্যুৎ বেগে উত্তর দিলো ও কৌতুহলী হয়ে বলল , এই জানোয়ারটাই তোকে এই পথে নামিয়েছে ? 

আমি সম্মতি জানালাম । দন্তে দন্ত চেপে শ্যামলীদি হিংস্র পশুর মতো গর্জন করতে লাগলো । 

ওর অবস্থা দেখে মনে হল , রন্টুকে সম্মুখে পেলে সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে ।

 খোলা জানালা পানে তাকিয়ে শ্যামলীদি দৃঢ় কণ্ঠে বলল , প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে পদ্মা । এই সব উন্মার্গগামী অধঃপতিত লোকটাকে চরম শিক্ষা দিতে হবে । নতুবা আরো বহু নারীর ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ নেমে আসবে ।

 শ্যামলীদির মুখপানে তাকিয়ে বললাম , কিন্তু ওর নাম তো পল্টু নয় দিদি ?

 সব অভিনয় ওরা নানান নামে মিশতে পারে । নানান ছদ্মবেশ ধরতে পারে । তবে বড় আফশোষ , এতো কাছে পেয়ে ওকে ধরতে পারলাম না । আফশোষে মাথার চুলগুলো ছিঁড়তে থাকল । শ্যামলীদি সখেদে বলল , ওকে কাছে পেতে আর বেশী বিলম্ব হবে নারে । সে আমার হাতের নাগালের মধ্যে আছে । তারপর - তারপর হবে আমার প্রতিশোধের পালা । শ্যামলীদি এবার শান্ত হল । ধীর ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এসে ছবিটা ছিনিয়ে নিয়ে ডারৌতে আঁঠা দিয়ে চিটিয়ে রাখলো । শ্যামলীদির রুদ্রমূর্তি দেখে কোন কথা বলার সাহস পেলাম না । 

মনের কথা চাপা রেখে বাইরে বেরুতেই আমাকে বলল , চলে যাচ্ছিস কেন , কি প্রয়োজনে এসেছিলি বল ।

 ধীরে ধীরে শান্ত কণ্ঠে বাবার কথা বললাম । বাবার কাছে যেতে মন চাইছে দিদি।তার কতদিন বাবাকে দেখিনি । তাই চঞ্চল মনকে কোন প্রকারে শান্ত রাখতে পারছি না । আমার কথা শুনে শ্যামলীদি স্থানুর মতো হয়ে গেল । অবোধ বোনকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে তার ভাষা পাচ্ছে না ।

 ওকে নীরব থাকতে দেখে পুনরায় বললাম , আমার বাবাকে শুধু একটি বারের মতোও দেখতে পাবো না শ্যামলীদি ? বেদনা বিদ্ধ হয়ে হেঁট মুখে তক্তাপোষে বসে রইলাম । ক্রমশঃ চোখ ফেটে দরদর ধারায় জল বেরুতে শুরু করল । তবুও নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম , দিদি একটিবার বাবাকে দেখার সুযোগ করে দাও । 

শ্যামলীদি বলল , সে সুযোগ হবে না পদ্মা । ক্রীতদাসের প্রথা এখানে । শুধু এইটুকু পার্থক্য ওদের মতো অনাহারে , অনিদ্রায় মরতে হয় না । কোন প্রকারে এই পিঞ্জর হতে মুক্ত বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারবি না । যেখানে যাবি ছায়ার মতো অনুসরণ করবে এখানকার পোষাগুন্ডারা । বললাম , তবে কি একটি বারও বাবাকে দেখবার সুযোগ পাবে না ? 

না । 

একি হল দিদি । এই মরুময় জীবনে কি কোনদিন শান্তির বারিধারা বইবে না ? বাবাকে এতোদিন ভুলেই ছিলাম । বাবার কথা যদি না মনে পড়তো , তার করুণ মুখখানি আয়নার মতো ভেসে না উঠতো , তাহলে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না শ্যামলীদি । আর আর দাঁড়াইনি এখানে । বুকে পুঞ্জীভূত বেদনা নিয়ে দ্রুত গতিবেগে বাসার দিকে এগিয়ে গেলাম এবং রুদ্ধদ্বার গৃহাভ্যন্তরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম । কতক্ষণ যে তপ্ত অশ্রু নির্ঝরের মতো চক্ষু দিয়ে বয়ে গেছিল তা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি ।

 হঠাৎ শ্যামলীদির কণ্ঠস্বরে নিজের সম্বিৎকে ফিরে পেলাম । শ্যামলীদি বলল , তোর বাবার ব্যবস্থা করলাম পদ্মা । তবে এক শর্তে দুদিনের মধ্যে এখানে হাজির হতে হবে । ধড়মড় করে উঠে শ্যামলীদিকে জাপটে ধরে বললাম , এই পঙ্কিলময় ভোগসুখাসক্ত জীবন আকাশে তুমি আমার ধ্রুবতারা । তোমাকে লক্ষ্য করেই আমি আমার জীবনের চলার পথ বেছে দেব দিদি । তার কাঁধে বারবার মুখ ঘষতে থাকলাম ।

 একটু পর ধীরে ধীরে ওর কাঁধ হতে মুখ তুলে কথা দিলাম , যদি মরে না যাই


তাহলে এখানে এসে আমার যৌবন গাঙে আবার তরণী ভাসাবো দিদি এখানে ফিরে না এলে তোমার প্রতি কি অত্যাচার হবে তা আমার অজনা নয় । আমি অবশ্যই আসবো । এই তীর্থ স্থানই সে আমার যৌবনের উপবন আর বার্দ্ধক্যের বারানসী । চোখ দুটো ছল ছল্ করে উঠলো । 

পরদিন সকালে শ্যামলীদিকে প্রণাম করে বদ্ধ পিঞ্জর হতে মুক্ত পক্ষী বিহঙ্গমের মতো অসীম নীলাকাশে পাখা মেলে দিলাম । পুতিগন্ধময় নরকের কলুষিত পরিবেশ হতে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম । আজ বড় সৌভাগ্য যে আমার বাবুকে একটিবার দেখার সুযোগ পাব । আকাশের শ্যামলীমা , পাতার মর্মর ধ্বনি , বাতাসের স্নিগ্ধতা , বিহঙ্গের কলগীতি - এতদিন আমার প্রাণে স্বর্গীয় আনন্দেয় শিহরণ আনতে পারিনি । আর আজ আমি মুক্ত প্রাণের নির্ঝর যেন এক সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ হতে বেরিয়ে ছুটে চলেছি অসীম বারিধিপানে । মোড়ে এসে ট্রাম ধরে হাওড়া ষ্টেশনে এসে হাজির হলাম।

যখন চণ্ডীপুরে পৌঁছলাম , অনেকখানি বেলা গড়িয়ে গেছে । গ্রীষ্মের দাবাদাহে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে গেলাম । কিন্তু পল্লী পরিবেশে সোনালী রোদ্দুরকে স্নেহ পূর্ণ বক্ষে আলিঙ্গন করলাম । গ্রামের মোড়ে আসতেই কৌতুহলী নরনারী অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাতে লাগলো । বিশেষ করে আমার জমকালো সাজসজ্জা ও সারা শরীরের আভিজাত্যের ছাপ দেখে ওরা আমাকে ধনাঢ্য রমনী বলে ভেবেছিলেন । সীমন্তে সিঁদুর যদি থাকতো , ভাবতো আমি কোন ধনী ব্যক্তির গৃহনী । ওদের ওভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল । 

তবে ওরা আমার রহস্যাবৃত জীবনের ইতিবৃত্ত জানলে কি দৃষ্টিতে দেখতো তা ভালো ভাবেই জানি । ওসব ভাবনাকে উপেক্ষা করে দ্রুতপদে বাড়ীর দিকে এগিয়ে চললাম । সহসা তার কণ্ঠস্বরে যেন চমকে উঠলাম । পিছু ফিরতেই দেখলাম দেবাশীষদা ডাকছেন , এতোদিন কোথায় ছিলে রমা ?

 রমা নামে আমাকে ডাকতেই আমার বলতে ইচ্ছে হলো তোমার রমার অপমৃত্যু ঘটেছে , আমি সেই রমার প্রেতাত্মা । মুহুর্তে নিজেকে বদলে গিয়ে বললাম , কেমন আছো দেবাশীষ দা ?

 দেবাশীষদা বললেন , ভালো ।

 বাবা কেমন আছেন ? 

সেই জন্যইতো তোমার খোঁজে কলকাতা গিয়েছিলাম।

 উৎকণ্ঠার সহিত জিজ্ঞাসা করলাম , বাবার কিছু হয়েছে নাকি ? 

দিন দশ বারো হলো কাকাবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না ।

একথা শুনে আমি যেন ব্রজাহত হয়ে পড়লাম ।

 হ্যাঁ রমা , বিশেষ করে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছি । তুমি কলকাতা যাবার কয়েক মাস পরেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেন।

 ধীরে ধীরে আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো , মনে হলো আমি আর সেস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না ।

 দেবাশীষদা বলে চলেছেন , আমরা তাকে সুস্থ করবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম , কিন্তু কোন ফল হয়নি । কেবল তোমার কথাই বারবার বলছিলেন । তোমাকে দেখার জন্য বড় ছটপট করছিলেন , তাই কাকাবাবুর বিচলিত মন দেখে তোমার খোঁজে কলকাতা গিয়েছিলাম কিন্তু পাইনি । আমরা নিরাশ হয়ে ফিরে আসার পর তার অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ল ।

 শুধু বলেছিলেন তোমরা কেউই আমার রমাকে আনতে পারবে না । আমি নিজেই ওকে খুঁজে বের করবো । আজই আমি কলকাতা যাবো । 

কোন প্রকারে সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছিলাম । কিন্তু কখন যে বেরিয়ে গেছেন বাড়ী হতে তা বুঝতে পারিনি । মনে হয় তোমার খোঁজে কলকাতা গেছেন । রমা , বাবাকে কি একটা পত্রও দিতে নেই ? 

কোন কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারলাম না , শুধু মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদছিলাম । একি করলে ঠাকুর , একথা শোনার আগে কেন আমার মৃত্যু দিলে না । গোপনে বারবার ডেকেও কোন ফল হল না । শুধু তীরবিদ্ধ পাখীর মতো যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকলাম।


 কি করব , কি করে বাবার দেখা পাবো । বাবার সঙ্গে দেখা করার অন্য দুস্তর বাবা ঠেলে বহু আশা নিয়ে বেে
বেড়িয়ে পড়েছিলাম । ফল যে এই হবে , আমি কল্পনা করতে পারিনি । এরপর আমার করনীয় কি – তাই ভাবছিলাম । আবার যথাস্থানে ফিরে যাবার সংকল্প নিয়ে অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পা বাড়ালাম ।


                        ক্রমশ...