প্রাবন্ধিক রামপ্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ




রমাপদ চৌধুরী 

(জন্ম ১৯২২, প্রয়াণ ২০১৮)

(বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক প্রয়াত রামপাদ চৌধুরী গত মাসের ২৯ জুলাই, ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে পদার্পণ করেছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে) 




প্রথম উপন্যাস পড়ার অনুভূতি





রেলওয়ে শহর খড়গপুরে স্কুল-জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে তাঁর। পিতার কর্মসূত্রে খড়গপুরে থাকা। আমারও জন্ম, শিক্ষাদীক্ষা সবই সেই রেলওয়ে শহরে। রেলওয়ে কলোনিতে যে বাংলোয় (তখন ওঁদের বাংলোটিই একমাত্র দোতলা ছিল) ওঁরা থাকতেন তার ক’টা বাড়ির পরেই ছিল আমাদের রেলওয়ে কোয়ার্টার। উনি যে রেলওয়ে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন— আমার অগ্রজ, আমিও সেই স্কুলে পড়াশোনা করেছি।

তখন আমাদের যৌবনের সন্ধিক্ষণ। হাতে এলো তাঁর প্রথম উপন‌্যাস ‘প্রথম প্রহর’। বইটি পেয়ে সে কী উন্মাদনা। পাতা উল্টে দেখি এ যে আমাদেরই নিয়ে লেখা— রেলওয়ে শহর খড়গপুরের একটা ছোটখাটো ইতিহাস। তারপর সে বই পড়ে দু’-তিন রাত ঘুমোতে পারিনি। আনন্দ-বেদনার আতিশয‌্যে ছটফট করেছি। এক অনন‌্য অনুভূতিতে মন ভরে উঠেছে।


।।দুই।।

রমাপদ চৌধুরী তাঁর প্রথম উপন‌্যাস “প্রথম প্রহর” লেখেন ১৯৫৪ সালে। সেটি আমি পড়ার সুযোগ পাই ১৯৫৮ সালে, সবে স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছি। সেই আমার উপন‌্যাস পড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা যার অনুভূতির রেশ আজও আমার মণিকোঠায় জাজ্বল‌্যমান। তার কিছু স্মৃতিচারণ করব। সেদিন বইটা হাতে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে রোমাঞ্চিত, শিহরিত হয়েছিলাম। এক অনাস্বাদিত প্রাপ্তিতে মনটা ভরে উঠছিল। উপন‌্যাসটির শুরু সেদিন আমার কিশোর মনে দোলা এনে দিয়েছিল।

লেখকের কথায়— “আলো-ঝলমল স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। পানিপাঁড়েটা বোধহ চিৎকার করে স্টেশনের নাম ঘোষণা করলো। সেই অনেক-চেনা নাম।”

সুদীর্ঘ একটি যুগ পার হয়ে গেছে, এ নাম শুনিনি বহুদিন, এ বাতাসে নিঃশ্বাস নিইনি কতকাল। জানালায় মুখ বাড়িয়ে যেন শৈশবের, প্রথম যৌবনের স্পর্শ নিতে চাইলো মন। তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজলাম। না, সব বদলে গেছে। পুরোনো দিনের স্মৃতিকে বিদায় দিয়ে যেন নতুন ফুল ফোটাতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে সেই ছোট্ট শহর। সেই ছোট্ট শহরটির নাম খড়গপুর—লেখকের জন্মভূমি, আমারও। আবাল‌্যের স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে শহরের অলিতিগলিতে। স্টেশনে ট্রেনের কামরায় লেখকের সঙ্গে, এক সুবেশা সৌন্দর্যময়ীর দেখা। তাকে তিনি চিনেও চিনতে পারেন নি। অথচ নারীটি অনায়াসে লেখকের ডাক নাম ধরে ডেকে বলল, “তিমুদা না?” হঠাৎ দেখা নারীটি লেখকের কাছে অপরিচিতাই রয়ে গেলেন, বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা সেদিন আমার কিশোর মনে ঔৎসুক‌্যের ছায়া ফেলেছিল।


।।তিন।।

লেখকের ব‌্যর্থ প্রেম সেদিন আমার কিশোর মনে জ্বালা ধরিয়েছিল। লেখক পান্নাকে ভালবেসেছিলেন। তার প্রকাশ ঘটলো লেখকের কথায়—“পূজোর সময় রাত জেগে যাত্রা দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ‌্য করলাম, পান্না ডাকছে। কাছে যেতেই বললে, আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে?

—চলো।

নির্জন রাস্তায় বেরিয়ে চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে চলেছিল.....

দেওদার গাছের নির্জন অন্ধকারটুকু পার হয়েই পান্নাদের বাড়ি, প্রায় পৌঁছে গেছি তখন।

তারপর হঠাৎ ফিরে দাঁড়ালো।

সমস্ত শরীরে কি এক উষ্ণতা বোধ করলাম।

কি এক অদৃশ‌্য প্রবৃত্তি। উন্মাদের মতো কাছে টেনে নিলাম, বুকে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। —ছাড়ো তিমুদা, ছেড়ে দাও। ফিসফিস করে পান্না বললে। তবু সে কথা যেন স্পর্শ করলো না আমাকে।

চুম্বনের মধ‌্যে যে এমন এক অদ্ভুত আনন্দ, এমন এক বিচিত্র অনুভূতি, কে জানতো। কে জানতো নারীবক্ষের কোমল স্পর্শে এমন বিচিত্র উন্মাদনা জাগে।

আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পেয়েই ছুটে পালালো পান্না।’

লেখকের শীতের রাতে ভীরু অভিসারের কথা পড়ে আমার কিশোর মনে এক অজানা অনুভূতির ছোঁয়া লেগেছিল। লেখকের বর্ণনায়—

“একে একে সব আলো নিভে যেতো। কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হতো। তারপর একসময় টের পেতাম, মা, বাবা, সেজদি সকলে শুয়ে পড়েছে। চারদিক নিঃশব্দ আর অন্ধকার।

প্রচণ্ড শীতে গরম চাদরটা গায়ে জড়িয়ে এসে অপেক্ষা করতাম বাগানের এক কোণে, শিউলি গাছটার তলায়।

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। আর ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। 

প্রতীক্ষার কাল গুণে গুণে হয়তো অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। পায়চারি করতে করতে কেবলই তাকাচ্ছিলাম পান্নাদের বাড়িটার দিকে।

হঠাৎ নিঃশব্দে কপাট খুললো। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো পান্না।

কাছে আসতেই বিস্মিত হলাম।

—এ কি? গরম জামা গায়ে দাওনি? চাদর নাওনি কেন?

পান্না শীতে কাঁপতে কাঁপতে বললে, গরম জামা চাদর সব মা-র ঘরে। আনতে গেলেই ঘুম ভেঙে যাবে।

বললাম, তবে চলো আমার ঘরে।

না, না। প্রতিবাদ করে উঠলো পান্না।

হাসলাম—এত অবিশ্বাস?

কৌতুকের চোখ তুলে তাকালো ও মৃদু হেসে বললে, অবিশ্বাস তোমাকে নয়।

বলেই আমার চাদরের আধখানা টেনে নিয়ে গায়ে জড়ালে।

বুকের আরো কাছে পেলাম। এত কাছে বোধহয় আর কোনদিন পাইনি।

অথচ কতো স্বপ্নই না বুনতাম ওকে ঘিরে। কল্পনার রঙ ওরও মনে কম ছিল না।

তারপর হঠাৎ একদিন কান্নায় ভেঙে পড়লো। কোনো কথা বললে না, কোনো কারণ জানালো না, শুধু কাঁদলো আর কাঁদলো।”

অনুসন্ধান করে লেখক জানতে পারলেন, পান্নার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে উপাধ‌্যায়ের ছেলে অজয়ের সঙ্গে। লেখকদের বাগানেই বিয়ের মেরাপ বাঁধা হবে। লেখক কোনো কথা বলতে পারেননি। তাঁর সমস্ত বুক যেন ব‌্যথায় ভেঙে পড়েছিল।

বিয়ের দিন আলো ঝলমল করে উঠেছিল চারিদিক। লাল সামিয়ানার গায়ে যেন সলমা-চুমকির চমক। সমস্ত পৃথিবী যেন খুশিতে উছলে উঠেছিল। লেখকের চোখে শুধু কান্না আর কান্না।

লেখকের ভাষায়—

“আর আমার চোখে শুধু কান্না। এ এক অবাধ‌্য ব‌্যথা। ব‌্যর্থতার বেদনা, অভিমানের পাথর যেন চেপে বসেছিল বুকের ওপর।” লেখকের পান্নাকে না পাবার বেদনা, ব‌্যর্থতার গ্লানি, অভিমানের বোঝা সেদিন আমার কিশোর মনেও বিষাদের ছায়া ফেলেছিল।


।।চার।।

সেই বয়সে লেখকের চুরি করে বিলাইতির স্নানের দৃশ‌্য দেখার যে বর্ণনা বইটিতে তুলে ধরেছেন তা পড়ে আমার কিশোর মন রোমাঞ্চিত হয়েছিল।

তাহলে লেখকের কথায় আসি—

“— শালাই আছে বাবুজী?

কথাটা স্পষ্ট মনে আছে আজও। দেশলাই চেয়েছিল বিলাইতি, আর ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলাম।

ভোর বেলায় ঘুম ভাঙতেই নীচে নেমে এসে উঠোনের কলে মুখে-চোখে জল দিচ্ছিলাম।

পাশে কে বাসন মাজছে লক্ষ‌্য‌ করিনি।

......পুরোনো রাউতানিটা যে চলে গেছে, নতুন কেউ এসেছে, তা জানতাম না।

উনোন ধরাবার জন‌্যেই হয়তো দেশলাই চেয়েছিল সে।

বাবার পকেট থেকে দেশলাইটা এনে দিলাম।

দেশলাইটা হাত পেতে নেবার সময় কেমন এক রহস‌্যের চোখে তাকালো বিলাইতি। তারপর ঠোঁটের হাসি চেপে রেখে উনোন ধরাতে চলে গেল। 

নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেল আমার মনে।

স্বপ্ন বুনতাম মনে মনে কখনো পান্নাকে ঘিরে, কখনো বিলাইতিকে ঘিরে।

মনে আছে, সকালের কাজ শেষ করে চলে যাবার আগে উঠোনের কলে স্নান করতো বিলাইতি। আর সেই সময়টুকুর জন‌্যে দোতলার জাফরির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি।

লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম বিলাইতির যৌবন জোয়ারের ছন্দ। নিটোল দুটি স্তনের মধ‌্যে পৃথিবীর রহস‌্য অনুভব করতাম।

যৌবনে এমন এক নির্বোধ মুহূর্ত আসে, যখন নিজের হাত রুচির বশ‌্যতা স্বীকার করে না।

তেমনি এক নির্বোধ মুহূর্তের অসংযমকে খিলখিল করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল বিলাইতি।

এ যেন অতি তুচ্ছ নগণ‌্য এক পাগলামি। হেসে উড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নয়, এমনি ভাবেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল বিলাইতি।

লজ্জায় আত্মধিক্কারে পালিয়ে এসেছিলাম।

লেখকের এই স্বীকারোক্তি পড়ে সদ‌্য যৌবনের চৌকাঠে পা দেওয়া আমি সেদিন রাতে ঘুমুতে পারিনি।


।।পাঁচ।।

আজ বয়সের প্রান্ত-সীমায় এসে ভাবি, যৌবনের সেই উন্মাদনা আজ আর নেই ঠিকই, তবু আজও তাঁর লেখা “প্রথম প্রহর” পড়লে বাতাসটা বড্ড ভারি ভারি লাগে, বুকের ভেতরটা ব‌্যথায় চিনচিন করে ওঠে, হয়তো বা পান্নার কথা ভেবে, নতুবা যেসব চরিত্রের কথা আমি এ লেখায় তুলে ধরিনি তাদের অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে বলে। লেখক যেসব চরিত্র চিত্রিত করেছেন, বাস্তবে তাঁরা ছিলেন ঠিকই,লেখক তাঁর কলমের জাদুতে তাঁদের গ্রহণীয় ও বরণীয় করে তুলছেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমার কাকা খড়গপুরে গোলবাজারে বাঙালি দুর্গা মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গোড়াপত্তনের দিন থেকে। কোনো এক বছর দুর্গা মন্দিরে ইলেকট্রিক আলো লাগাতে গিয়ে তড়িতাহত হন, তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আরো দু-তিনজন। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কেউ একজন এসে সুইচ বন্ধ করে দেয়। কাকারা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু কাকার ডান হাতটা চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। এই ঘটনা লেখক “নিমাইদা”র চরিত্রের মাধ‌্যমে তুলে ধরেছেন। এই রকম আরও উদাহরণ আছে যা লিখে বোঝা ভারি করতে চাই না।

লেখক বয়োপ্রান্তে এসে স্মৃতিচারণ মূলক রচনা “হারানো খাতা” ধারাবাহিক ভেবে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। লেখাটি আবার আমায় খড়গপুরে ফেলে আসা দিনগুলোয় নিয়ে যায়। তাঁর এই লেখাটি পড়ে এতো বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ি যে ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা না বলে পারিনি। ফোন করার আগে মনে দ্বিধা ও সংকোচ ছিল, অত বড় মাপের মানুষ ফোনে যদি কথা না বলেন। উনিই ফোনটা ধরেছিলেন। পরিচয় দিতে খড়গপুরের কতো কথাই না জিজ্ঞেস করলেন। আমার কাকার খবরও নিলেন। বুঝলাম তাঁর হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে খড়গপুরের স্মৃতি এখনও জাজ্বল‌্যমান।


।।ছয়।।

দীর্ঘ দিন আমি খড়গপুর ছাড়া হলেও আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি এখনও মানসপটে ভেসে ওঠে। কার্যকারণে খড়গপুরে গেলে স্মৃতির সরণি বেয়ে হারানো দিনগুলোকে খুঁজে ফিরি।

গোলাবাজারে বাঙালি দুর্গা মন্দিরে এসে কি যেন তন্ন তন্ন করে খুঁজি। পেছন দিকের কুয়োর পাড়ে যখন আসি, তখনই মনে হয় সদাশিব জ‌্যাঠা তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে তুলসীদাস রামায়ণ থেকে পাঠ করছেন—

পহেলা প্রহরমে সবকোই জাগে

দোসরা প্রহরমে ভোগী।

তিসরা প্রহরমে তস্কর জাগে

চৌঠা প্রহরমে যোগী।।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024