প্রাবন্ধিক রামপ্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ
সুন্দরের পূজারী
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই.....”
কবিগুরুর এই আর্তি আমাদের সবার। কারই বা মন চায় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। তাই গানের মাঝেও ব্যাকুলতা ধ্বনিত হয়।
“এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
মন যেতে নাহি চায়.....
না না না যাবো না.....।”
মানুষ মাত্রেই সুন্দরের পূজারী। আমাদের চারপাশের অনেক কিছুই সুন্দর-যেমন মানবদেহ, মানবমন, গাছপালা, চন্দ্র-সূর্য, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-সাগর। এ সবের মাঝেই তো মানুষ বেঁচে থাকতে চায়।
সুন্দরের সঠিক ব্যাখ্যা কি- যুগযুগান্ত ধরে মানুষ তার উত্তর খুঁজে চলেছে। অসুন্দরের সঙ্গে মানুষের সংঘাত বা পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্ন জড়িত থাকলেও অনেক মানুষ অসুন্দরের মাঝে সুন্দরকে খুঁজে পায় তার নিজস্ব রুচি, ব্যক্তিগত বোধশক্তি বা অনুভূতির নিরিখে। তাই সুন্দরের পুজো থেমে নেই। সুন্দরের পূজারী আমরা সবাই। রাজারাজরা থেকে শুরু করে পথের ভিখারী পর্যন্ত। কেউ রূপের পূজারী, কেউ সুন্দর মনের, কেউ বা গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-সাগর এ সবের বুকে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের পূজারী। ভাবতে অবাক লাগে, রুক্ষ্মশুক্ষ্ম মরুভূমির মাঝে যখন মরুদ্যানের খোঁজ মেলে, তৃষ্ণার্ত পথিক মরুদ্যানের জলাশয়ের জলে তৃষ্ণা নিবারণ করে, জলাশয় ঘিরে খেজুর গাছের সারি- এ সৌন্দর্যের তো কোনও তুলনা হয় না। আর সুন্দরকে ভালবাসি বলেই আমরা যারা ভ্রমণার্থী- এই অপার সৌন্দর্যকে ক্যামেরায় বন্দী করে নিয়ে আসি।
মানুষ সুন্দরের উপাসক। বিচিত্র তার উপকরণ। যুগে যুগে মানুষ দেবতাকে আপন বলে মনে করেছে। তার পাপ-পুণ্যের বোঝা দেবতার পায়ে সমর্পণ করে নিজেকে ভারমুক্ত করেছে। দেবতাকে সে সুন্দরের প্রতিভূ মেনেছে বলেই তার এই আত্মনিবেদন।
এখানে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-সব ধর্মের মানুষ সুন্দরের উপাসনয়া গড়ে তুলেছে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা। সুপ্রাচীন মন্দির, মসজিদ, গীর্জার অপরূপ অলঙ্করণ-মানুষ যে সুন্দরের পূজারী তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গৌতম বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ, যীশুর ক্ষমাসুন্দর চোখ মানুষকে হিন্দোলিত করেছে বারবার, জয় করেছে মানুষের মন। জাতি ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে এঁদের পায়ে মানুষ মাথা ঠুকেছে শান্তিলাভের আশায়।
মানুষ শিল্পকর্মের মধ্যে সৌন্দর্যের পরশ খুঁজে পেয়েছে বলে সৃষ্টি হয়েছে কোণারক, খাজুরাহ, অজন্তা-ইলোরার মতো শিল্পসৃষ্টি। শিল্পকলার প্রতি মানুষের অনুরাগের ফলেই আমরা পেয়েছি অতীতের মাইকেলাঞ্জোলো, দা-ভিঞ্চি, যামিনী রায়, বর্তমানের মকবুল ফিদা হুসেন, গণেশ পাইনের মতো শিল্পীকে।
ভালবাসা মানেই সৌন্দর্য। আর সেই সৌন্দর্যের ফলশ্রুতি হিসাবে আমরা পেয়েছি প্রেমের সমাধি তাজমহল। অপার বিস্ময়ে এই সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এই সৌন্দর্যের অপার আকর্ষণ আপনা আপনি মানুষের মনে পুজোর আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
চির সৌন্দর্যের উপাসক মানুষ যুগ যুগ ধরে সাহিত্য সৃষ্টির মাঝে সুন্দরকে খুঁজে পেয়েছে। সুন্দরের প্রতি মানুষের বাঁধনহীন ভালবাসা হৃদয় উজার করা আবেগের টানে রচিত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসির মতো মহাকাব্য। এইসব মহাকাব্যের অন্তর্নিহিত রসাস্বাদনে মানুষ সুন্দরকে খুঁজে পেয়েছে। পেয়েছে সত্যের সন্ধান, মুক্তির স্বাদ।
কবির কল্পনায় যা ফুটে ওঠে তা কাব্যের রূপ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে গীতগোবিন্দ রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস, সাধক রামপ্রসাদ লিখিত ও গীত রামপ্রসাদী সংগীত, শ্যামাসংগীত- এ সবের ছন্দ, মূর্চ্ছনা আজও মানুষকে উদাস করে তোলে। পরমেশ্বরকে এক পরম সুন্দর রূপে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে।
প্রেম প্রীতি ভালবাসা মানুষের মনের এক সুন্দর অনুভূতি। সুন্দরকে ভালবেসে তাকে আপন মনে করে বরণ করে নিতে মানুষ কখনও কুণ্ঠা বোধ করেনি। তাইতো বিশ্বকবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে-
“ওহে সুন্দর মরি মরি
তোমায় কি দিয়ে বরণ করি.....।”
Comments