লেখক ডঃ রমলা মুখার্জী -এর একটি গল্প

  মা ভূতনী



দস্যি অর্কের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে ওর স্কুলের ম্যাডামরা তো একেবারে হতবাক। যে ছেলে মোটেই বই ছুঁতো না, একটুও পড়া বলতে পারতো না, সে কিনা সব পড়া একদম বলতে পারছে, বই নিয়ে সবসময় পড়ছে! কি আশ্চর্য কান্ড!

       অর্কের মা তমা মাসদুয়েক হল গত হয়েছেন, তার প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ কারণ বলা যায় অর্ক। অর্কের অতিরিক্ত দুরন্তপনা আর পড়াশোনা না করার জন্যে অর্কের মা খুবই চিন্তা করত। স্কুলবাসেও অর্ক অন্য বন্ধুদের পেছনে লাগত, ভীষণ দুষ্টুমি করত। ইদানিং তো ইচ্ছে করে দেরি করে ঘুম থেকে উঠত, বেশিরভাগ দিনই স্কুলবাস মিস হয়ে যেত। তাই অগত্যা তমা বাইক চড়া শিখে অর্ককে রোজ বাইকে করে স্কুলে দিয়ে আসত, আবার নিয়েও যেত। অর্কর বাবা সুমন তো অফিস নিয়েই ব্যস্ত- তার মোটেই সময় নেই। অর্কের সব দায়িত্বই তাই তমাকেই পালন করতে হত। কিন্তু অর্ক তো মোটেই পড়াশোনা করে না। তাই এবারের সেমিস্টারেও খুব খারাপ রেজাল্ট করেছে। তমাকে সেদিন অর্কর ম্যাডামরা বলেই দিয়েছেন আর অর্ককে স্কুলে রাখা যাবে না কারণ তার পড়াশোনার বুদ্ধি মাথায় না থাকলে কি হবে দুষ্টবুদ্ধিতে মগজ পুরো ঠাসা। অন্য বন্ধুদের টিফিন খেয়ে নেওয়া, বই লুকিয়ে রাখা থেকে মারামারিও করে অর্ক। অর্কর চিন্তাতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল তমা। অর্ককে স্কুলে দিয়ে, স্কুলের মিটিং সেরে অসতর্ক হয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল সে। তাই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। একটা ইলেকট্রিক পোলে সজোরে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল তমার।  

      তমার মৃত্যুর পর থেকে অর্কের এই আকস্মিক পরিবর্তনে সুমনও কম অবাক হয়নি। অর্ক তো খুব ছোট, তার তো অনুশোচনা করার বয়স এখনও হয়নি। সবসময় অর্ক ম্রিয়মাণ হয়ে থাকে, মুখে হাসি নেই, দুরন্তপনা নেই। এ যেন অন্য অর্ক। একা থাকতে ভয় পায়, সবসময় মা’কে নাকি দেখতে পায়। খুব চিন্তায় পড়ল সুমন, অফিস কামাই হয়ে যাচ্ছে, চাকরিই না চলে যায় তার। অগত্যা আত্মীয়স্বজনদের পরামর্শে বাধ্য হয়েই সুমন অর্কের নতুন মায়ের জন্য পাপিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু কি কেলেঙ্কারী, বাড়ির চৌকাঠ যেই পাপিয়া পেরিয়েছে অমনি সে হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়ল। কি করে যে পড়ে গেল বোঝাই গেল না, কিন্তু অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, “মা, মা, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল নতুন মাকে, আমি স্পষ্ট দেখলাম।” কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার অর্ক ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ বিশ্বাসই করল না।

     এরপরের কাহিনী আরও দুঃখের। পাপিয়াও মাঝে মধ্যে তারপর থেকে অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল। সেও যেন কিসের একটা ভয়ে সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকে। সুমনের তো খুব মুস্কিল হল। অর্ককে দেখভাল করার জন্যই সুমন বিয়ে করল, কিন্তু লাভ তো কিছুই হলনা, উল্টে অর্কর সাথে পাপিয়াকেও দেখাশোনা করতে হচ্ছে সুমনকে- না চাকরিটা এবার আর থাকবে না সুমনের। সুমন কাছে থাকলে ওদের কোন ভয় নেই, সুমন চলে গেলেই যত ভয় ওদের গ্রাস করে।  

     অর্কের আবদারে পাপিয়া একদিন বিরিয়ানি রান্না করেছে। কিছুই তো অর্ক খেতে পারে না, পাপিয়ার তৈরি বিরিয়ানি কিন্তু অর্ক তৃপ্তি করে খেল। সেদিন স্কুল নেই, স্কুলের ফাউন্ডেশন ডে উপলক্ষে ছুটি ছিল অর্কের। অর্ককে খাইয়ে যেই বিরিয়ানি নিয়ে পাপিয়া খেতে বসেছে অমনি মুরগীর ঠ্যাংটা থালা থেকে উঠে হাওয়ায় ভেসে উঠল আর কে যেন খপ করে ধরে নিল। আবার খেতে যাবে আবার আর একটা ঠ্যাং যেই উঠেছে পাপিয়া খপ করে ঠ্যাংটা ধরে সাহস করে বলল, “কে তুমি? কি চাও? সবসময় আমায় এমন করে জ্বালাও কেন?”

- “আঁমি অঁর্কের আঁসল মাঁ। তুঁমি আঁমার ঁসংসারে ঢুঁকে পঁড়লে জোঁর কঁরে। প্রঁথম দিঁন তোঁমায় ধাঁক্কা মেঁরে ফেঁলে দিঁয়েছিলাম মঁনে আঁছে?”

- মনে আছে। তাহলে সেই ধাক্কা মারা, মাঝে মধ্যেই ছায়ামূর্তির মত ঘুরে বেড়ানো সেসবই কি তোমার কাজ?

- হ্যাঁ আঁমি। আঁমি দেঁখি, পাঁহারা দিঁঁই অঁর্ককে। পঁড়াশোনা কঁরছে কিঁনা? ঠিঁকমতো খাঁচ্ছে কিঁনা? আঁজ তুঁমি অঁর্ককে ছোঁট ছোঁট ঁমাংসগুলো দিঁলে আঁর তুঁমি বিঁরিয়ানির বঁড় বঁড় ঁমাংসের টুঁকরোগুলো নিঁলে, তাঁই আঁমি সঁহ্য কঁরতে পাঁরলাম নাঁ।

- কিন্তু এসব করে তো তুমি অর্কের ক্ষতিই করছ? দেখছ না অর্ক কেমন চুপচাপ থাকে, ভাল করে খায় না, কেবল পড়াশোনাই সব, কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না?

- তুঁমি ঠিঁক বঁলছো?

- হ্যাঁ আমি ঠিক বলছি।

- তুঁমি অঁর্ককে যঁদি খুঁব ভাঁলবাস, ওঁর সঁবকিছু খুঁব ভাঁল কঁরে দেঁখভাল কঁর, ওঁকে ভাঁল ভাঁল রাঁন্না কঁরে খাঁওয়াও তোঁ আঁমি শাঁন্তি পাঁব। তুঁমি কঁথা দাঁও অঁর্ককে তুঁমি আঁরও বেঁশী কঁরে যঁত্ন কঁরবে তাঁহলে আঁমি আঁর কঁখনও তোঁমাদের জ্বাঁলাতন কঁরতে আঁসব নাঁ। আঁমি এঁখান থেঁকে নিঁশ্চিন্ত মঁনে চঁলে যাঁব। আঁমার আঁত্মা মুঁক্ত হঁয়ে হাঁওয়ায় মিঁশে যাঁবে। পঁরে আঁবার অঁন্য কোঁথাও নঁবরূপে জঁন্মলাভ কঁরবে।

- ঠিক আছে আমি কথা দিলাম দিদি তোমার ছেলে অর্ককে আমি আমার নিজের ছেলের মতই ভালবাসবো, আদর-যত্ন করব। ওকে ভাল ভাল রান্না করে খাওয়াব, ওকে পড়াবো। তুমি একদম চিন্তা কোরো না।

- প্রঁমিস

- প্রমিস

তারপরই একটা দমকা হাওয়ার ঝড় উঠল আর পাপিয়া দেখল উঠানের আমগাছের পাতাগুলো প্রচন্ড কেঁপে উঠল। বেশ কিছু কাঁচা আম উঠানে পড়ল আছড়ে। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনদিন তমা আসে নি অর্ক বাঁ পাপিয়াকে জ্বালাতে।

     সুমন এখন নিশ্চিন্ত মনে অফিসে যেতে পারছে। পাপিয়ার আদরে অর্ক আবার আগের মত হাসছে, খেলছে, তবে পড়াশোনাও সে তার সাথে সমান তালে করছে।  

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024