প্রাবন্ধিক রাম প্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ

 



হারিয়ে গেছে

                          

                                              

ভ্রমণ প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে ছোটদের জন‌্যে অথবা ছোটদের নিয়ে অনেক দিন কিছু লিখিনি। তাই আজ লিখতে বসে বারবার মনে হচ্ছে আমাদের ছোটবেলা আর আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের ছেলেবেলার মধ‌্যে কতো তফাৎ। আমরা অধিকাংশ জন্মেছিলাম, বড় হয়ে উঠেছিলাম গাছগাছালি, নদী-নালা, সোনার ফসল ভরা মাঠ, ডাহুক ডাকা দুপুর, জোনাকি জ্বলা রাত— এই রকম একটা মায়াবী পরিবেশে। ঠাকুমার কোল ঘেঁষে ভূত-পেত্নী, দৈত‌্য-দানোর গল্প শুনেছিলাম। শীতের রাতে লেপ-কাঁথার তলায় শুয়ে ঠাকুমার কাছেই শুনেছিলাম দুয়োরানি-শুয়োরানির কথা। পরীক্ষাজ ঘোড়া, রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প। গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজনায়, ভয়ে, শিহরণে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম বুঝতে পারতাম না। সন্ধ‌্যেবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ দিতে গিয়ে মায়ের কণ্ঠে গুণগুনিয়ে ওঠা ভক্তিগীতি, শঙ্খধ্বনি, তারাভরা আকাশে সপ্তর্ষীমণ্ডলকে চিনে নেওয়া। কোনটি ধ্রুবতারা তার হদিশ করা, চাঁদের দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে চাঁদের বুড়ি সত‌্যিই চরকা কাটছে কিনা দেখা— সে এক মায়াময় জগৎ ছিল আমাদের। একটু বড় হতে খোলামাঠে খালি পায়ে ছুটে বেড়ানো, পুকুরে সাঁতার কাটা, নৌকা বওয়া, হাত ছিপ নিয়ে পুঁটি মাছ ধরা। জোড়া বঁড়শিতে যখন জোড়া পুঁটি মাছ উঠতো, তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাছের মুখ থেকে সযত্নে বঁড়শি খুলে মাছের মুখে ফু দিয়ে জলে ছেড়ে দেওয়া।

ঘন বর্ষায় পুকুরের জল যখন টইটুম্বুর করতো তখন শোল মাছের ডিম ফুটে বাচ্চা হতো। অসংখ‌্য ছোট ছোট বাচ্চা মাছ দল বেঁধে জলে ঘুরে বেড়াতো। তাদের বাবা-মা কাছাকাছি থাকতো। বাচ্চাদের পাহারা দেবার জন‌্যে। আমরা সে সুযোগের সদ্বব‌্যবহার করতাম। বড় বঁড়শিতে ঘুরঘুরে পোকা, আরশোলা অথবা ব‌্যাঙাচি গেঁথে ছোট শোল মাছের ঝাকের মাঝে ফেলে দিতাম। বড় শোল মাছটি খপ করে সে টোপ গিলে ধরে ফেলতো। সঙ্গে সঙ্গে ছিপে টান পড়তো। তারপর মাছটিকে টেনে ডাঙায় তুলতাম। আমাদের শিশুমনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। বিকেল হলেই মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়ানো, রঙিন প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করা, গঙ্গা ফড়িংয়ের লেজে সুতো বেঁধে বাতাসে ওড়ানো, বর্ষার ভিজে ঘাসে বিরবারটি খুঁজতে যাওয়া। (শ্রদ্ধেয় সাহিত‌্যিক শ্রীরমাপদ চৌধুরীর ‘প্রথম প্রহর’ বইটিতে বিরবারটি উল্লেখ পাওয়া যায়)। ভেলভেট রঙের ছোট ছোট পোকা, কোনো কিছুর স্পর্শ পেলেই পাগুলো গুটিয়ে নেয়। সেগুলো ধরে ধরে আমরা খালি দেশলাই বাক্সে ভরে রাখতাম। ঘরে এনে মেঝেতে ছেড়ে দিতাম। কেমন গুটি গুটি পায়ে চলতো। আর যেই হাতের স্পর্শ পেতো অমনি গুটিয়ে যেত। আমরা তখন সুর করে বলতাম—

বিরবারটি চটিমটি লাল দরওয়াজা খোল দে

তেরে মামা লাড্ডু লায়া লাল দরওয়াজা খোল দে।

কিছুক্ষণ বাদে ওরা সত‌্যি সত‌্যিই চলতে শুরু করতো। আর আমরা আনন্দে ফেটে পড়তাম। এ সব নিয়ে এক ভিন্ন জগতের মানুষ ছিলাম আমরা।


।। দুই ।।

সব আনন্দ ছাপিয়ে পুজোর আনন্দ বড় হয়ে উঠতো। তখন আমাদের কতোই বা বয়স। বন্ধুরা সবাই প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। পাড়ার বারোয়ারি দুর্গা পুজো। এখনও মনে পড়ে, প্রতি বছর চৈত্রের গাজন হয়ে গেলে প্রতিমা গড়ার শিল্পী আসতো। নাম ছিল কালী পাল। পুজো মন্ডপে ঠাকুরের আটচালা আগে থেকে রাখা থাকতো। কালী পাল প্রথমে এসে খড় দিয়ে প্রতিমা বানিয়ে চলে যেত। তারপর মাস দেড়েক ওর পাত্তা পাওয়া যেত না। আমরা ছটফট করতাম, তার আগমন প্রতীক্ষায়। রথের পরপর ও আসতো। সঙ্গে করে গঙ্গার পলি মাটি নিয়ে আসতো। এবার খড়ের ওপর মাটি দিয়ে প্রতিমা মূর্তি গড়তো। তিন চার দিন লেগে যেত। অবার কালী পাল চলে যেত। এদিকে মাটির প্রতিমাগুলো শুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরত। আবার বিশ্বকর্মা পুজোর পরপরই ও আসতো। এবার মাটি দিয়ে প্রতিমার ফাটল মেরামত করে গোলা মাটি দিয়ে প্রতিমা মসৃণ করতো। আমরা একে দোমেটে বলতাম। এই ভাবেই প্রতিমা আমাদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে রূপ নিত। আর আমরা উত্তেজনায় ছটফট করতাম। এ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিন সকাল বিকেল আমরা প্রতিমা দেখে আসতাম। আর পুজোর দু’-তিন দিন আগে কালী পাল আসতো প্রতিমা রং করতে। সঙ্গে নানান সাইজের তুলি, রং, আঠা ও ছোট ছোট মাটির পাত্র। এবার আমরা আর মন্ডপ ছেড়ে নড়তাম না। আমাদের চোখের সামনে মাটির প্রতিমা রূপ নিত। ঠাকুরের চোখ আঁকার সময় কালী পাল মৌনব্রত অবলম্বন করতো। আমাদের বলতো চোখ বন্ধ করে থাকতে, ঠাকুরের চোখ আঁকা দেখতে নেই। সব ঠাকুরের চোখ আঁকা হয়ে গেলে আমাদের চোখ খুলতে বলতো। চোখ খুলে দেখতাম মৃন্ময়ী মূর্তি জগন্ময়ী হয়ে উঠেছে, সে অনুভূতি লিখে বোঝানো যাবে না। পুজোর পাঁচটা দিন কী নিষ্ঠার সঙ্গে বারোয়ারি দুর্গাপুজো হতো যা আজ কল্পনা করা যায় না। সন্ধিপুজো ও বলিদান ঘড়ির সঙ্গে পল অনুপল মিলিয়ে সঠিক সময় করা হত। পাড়ার যত ছেলেমেয়ে সবাই প্রায় আমাদের বয়সি, ভোর না ভোর হতে ফুল তুলতে যেতাম। দেখতে দেখতে পুজোর আঙিনায় রাখা ঝুড়ি ফুলে ভরে উঠতো। শিউলি, টগর, স্থলপদ্ম, গন্ধরাজ, জবা, অপরাজিতা, করবী— নানান রকমের ফুল। আমাদের তোলা ফুলেই পুজো হত।

পুজোর পাঁচটা দিন দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে কেটে যেত বুঝতে পারতাম না। মন খারাপ হত বিজয়া দশমীর দিন। বারবার গিয়ে প্রতিমা দেখে আসতাম আমরা। সে বয়সে দুর্গা ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাবে ভেবে আমরা সত‌্যি সত‌্যিই কাঁদতাম আর প্রতিমার চোখেও জল দেখতাম। বয়সটা বোধহয় সেই অনুভূতিতে ভরা ছিল। প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আনন্দের জোয়ারে কিন্তু ভাঁটা পড়তো না। বাড়ি, বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা, সেই সঙ্গে নাড়ু, মোয়া, ঘুগনী খাওয়া— সে এক ভিন্ন স্বাদের জগৎ ছিল।

পুজোর আনন্দ-আমরা যে ভাবে উপভোগ করেছি, আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা তার এক কণাও উপলব্ধি করতে পারে না, এখন বারোয়ারি পুজোয় বাহ‌্যাড়ম্বর বেশি। নিয়ম নিষ্ঠা নেই বললেই চলে। চোখের সামনে প্রতিমা গড়ে উঠত, পুজো থেকে বিসর্জন পর্যন্ত— আজকের প্রজন্মের কতজন দেখতে পায়। রঙ্গীন স্বপ্নে ভরপুর উত্তেজনা উদ্দীপনায় ছাপিয়ে যাওয়া সে সব দিনগুলো আমাদের জীবন থেকে যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি বর্তমান প্রজন্ম আজ সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত।


।। তিন।।

আজকাল কেউ আর রূপকথার গল্প শুনতে চায় না। জন্মনোর পর একটু বুঝতে শিখলে সে টিভি-র পর্দায় কার্টুন দেখছে, সে সোনার পালঙ্ক খাটে শুয়ে থাকা রাজকুমারী বা দৈত‌্যরাজ অথবা পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প শুনবে কেন। আজ কেউ আর কল্পনার জগতে বিচরণ করে না। সবাই বাস্তববাদী বা সম্ভাবনাময় হতে চায়। আমরা কল্পনার জগতটাকে আঁকড়ে ধরে রেখে বড় হয়েছি। হারায়নি কিছু, পেয়েছি অনেক কিছুই, অনেক বেশি। কল্পনাই কিন্তু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বেড়ে ওঠার সহায়ক হয়। একটা তরুলতা যেমন গাছকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে ওঠে, কচি ডগা মাথা উঁচু করে সূর্যালোককে স্পর্শ করার চেষ্টা করে তেমনি কল্পনাকে কেন্দ্র করে ছোট্ট শিশুর জগৎটা গড়ে ওঠে ভবিষ‌্যতের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বলতর করতে। কিন্তু মনের কল্পনা আজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে আমাদের সেই সব স্বপ্ন রঙিন দিন। যুগ পাল্টাচ্ছে সেই সঙ্গে মানসিকতা। আমরা যারা প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধের দল তারা হয়তো এই পরিবর্তনটাকে মেনে নিতে পারছি না। তাই নিজের অজান্তে লিখে ফেলি —

“হারিয়ে গেছে ছেলেবেলার 

স্বপ্নরঙ্গীন দিন

রাজকুমার আর পক্ষীরাজে 

ফিরবে না কোনোদিন

ফুলপরীরা ঘুমিয়ে গেছে

দূষণ পরিবেশে

দিঘীর ঘাটে স্নান করতে 

আসবে না রাত শেষে

ভূতপেত্নী দৈত‌্যদানো পালিয়েছে 

সব ছেড়ে

বিজ্ঞান আজ সবার কাঁধে

ভর করেছে এসে।

ঘুমপাড়ানী মাসিপিসি

গ‌্যাছে ঘুমের দেশে

ফিরবে না আর কোনোদিনও

শব্দবাজীর দেশে।

সোনার কাঠি রূপোর কাঠি

সোনার পালঙ্ক খাট

রাজকুমারী নেই কো শুয়ে

নেই কো দৈত‌্যরাজ। 

বিজ্ঞান আজ হাতের কাছে

এনেছে সব কিছু

তারই সাথে রূপকথাকে

হারিয়েছে সব শিশু।”

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024