ক্ষয়ে গেছে শিকড়
হাসিব দৌড়াচ্ছে উর্ধশ্বাসে। ওকে তাড়া করছে ওর অতীত ওর ভবিষ্যত-বর্তমান ওকে দিতে পারছে না স্থিতাবস্থা। স্কুলে কলেজে দৌড়ের গতি এমন থাকলে বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় অন্যকোনো ইভেন্টে না হলেও দৌড়ে হতে পারতো প্রথম!দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো এক পাহাড়ে।
পাহাড়ের কিনারে এসেও পেছনে তাকাবার সাহস পেলো না ও। নিচে পানি দেখে কোনো কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নাকেমুখে পানির ঝাপটা খেয়ে ঘুম ভাংলো হাসিবের। মগ হাতে মা আয়েশা সামনে দাঁড়িয়ে। আয়েশা বললেন, দৈনিক কী স্বপ্ন দেখিস রে তুই? মনে হয় কারো সাথে মারামারি করিস!
হাসিব বিছানায় বসে দুই হাতে মুখমণ্ডলের পানি মুছে বললো, প্রত্যেকদিন একই স্বপ্ন দেখছি মা। কে যেনো আমাকে তাড়া করতে থাকে।ভয়ে পেছনে তাকাতেই সাহস পাই না মা! আমার কোনো দরবেশ কবিরাজের কাছে যাওয়া দরকার!
আয়েশা বললেন, তুই-ই বলতি তাবিজ কবজ দরবেশে বিশ্বাস ছিলো প্রাগৈতিহাসিক কালে। আধুনিক যুগে সাইন্স! এখন দরবেশের কাছে যেতে যাচ্ছিস কেনো?
আমার যে সমস্যা তা কোনো ডাক্তার ভালো করতে পারবে না।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই?
সাইকিয়াট্রিস্ট মনের অস্থিরতা দূর করতে পারে, দুঃস্বপ্ন না মা!
ঠিক আছে! আমি আগে একজন সাচ্চা দরবেশের খোঁজ করি!
হাসিব ফের শুয়ে পড়লে আয়েশা বললেন, শুইলি কেনো? ঘুমালে ফের দুঃস্বপ্ন দেখবি। তার চেয়ে ভালো হবে বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আয়। ইন দা মিন টাইম আমি দরবেশের খোঁজ করে রাখি।
তখন হাসিবের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। হাসিব জিন্সের প্যান্টের সামনের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে অজানা নম্বর দেখে ওভাবেই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ওর মতো বেকার বন্ধুরা এসময় পার্টি অফিসে ক্যারম বা তাস খেলে থাকে। নির্বাচনের সময় পার্টি অফিস সরগরম থাকে; অন্য সময় এরা বানিয়ে রাখে ক্লাবঘর! পার্টি অফিসে আসা পর্যন্ত আর কোনো কল আসেনি। পার্টি অফিসে ঢোকার সাথে সাথে ম্যাসেজ টোন এলে মোবাইল ফোনটা বের করে ম্যাসেজটা পড়লো:
- এই কল ধরলে আপনার ভাগ্য ফিরে যেতে পারে!
ঠকবাজের যুগে এসব ম্যাসেজ বা কলের কোনো মূল্য নেই! যে দাম দিয়েছে, সে-ই ঠকেছে।
হাসিব ডানে-বায়ে মাথা নাড়তে থাকলে সাহেদ জিজ্ঞেস করলো, কিরে, তোর পাগল হতে আর কত কাল বাকি!
হাসিব বললো, বেশি দিন না!
ঠাট্টা রাখ! কী দেখে মাথা নাড়ছিস?
এই দ্যাখ।
বলে হাসিব মোবাইল ফোনটা বাড়িয়ে দিলো সাহেদের দিকে। ম্যাসেজটা পড়ে কিছুই বুঝতে না পেরে সাহেদ বললো,কিছুই বুঝলাম না!
তবে শোন্!
ঘটনা শুনে সাহেদ বললো, নম্বরটা নিয়ে গেলাম। আমি কথা বলবো।
হাসিব সাহেদকে মোবাইল ফোন নম্বরটা দিয়ে লেগে গেলো ক্যারম খেলায়। ওর সহযোগী রিফাত বললো, এতোদিন আমরা শুধু শুধু ক্যারম খেলে সময় নষ্ট করেছি। একটা টিপস ধরে খেললে কেমন হয় ফ্রেন্ডস?
রমেশ স্ট্রাইকারটা হাতে নিয়ে বললো, টিপস মানে?
টিপস মানে প্রতি বোর্ডে কুড়ি পঞ্চাশ ধরে যদি খেলি, তাহলে খেলাটা জমবে ভালো এবং চা'র খরচটাও উঠে যেতো।
অপর তিনজন তিন রকম মতামত দিতে থাকলো। তর্কাতর্কি শেষে দেখা গেলো তিনজন জুয়া খেলার পক্ষে; হাসিব বিপক্ষে। সেদিন ওদের মাঝে আর ক্যারম খেলা হলো না। চারজন বসে চা পান করছে। চারজনের মুখই থমথমে।
চা-দোকানদার ওদের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাদের জীবন কি ক্যারাম খেইলাই যাইবো? বিয়া-শাদি করতে হইবো না? আর এর জন্য কামাই করা লাগবো!
রমেশ চা-দোকানির দিকে তাকালেও কিছু বললো না।
সাহেদ বললো, তোমার কাছে চাকরি আছে চাচা? দেও! তোমার চাকরিটা নিয়ে তোমার চার মেয়েকে আমরা বিয়ে করে ফেলি!
চা-দোকানি না রেগে ঠাণ্ডা স্বরে বললো, ঠাট্টা করতাছো! জাইন্যা রাইক্খো তোমরা, আমার মাইয়াগো তোমাগো মতন বাদাইম্মা পোলাগো কাছে বিয়া দিমু না!
হাসিব শূন্য চায়ের কাপটা দোকানির হাতে দিয়ে বললো, সাধে কী আর এখানে এসে বসে থাকি চাচা। ডিগৃ পাশ করেও কোনো চাকরি পাচ্ছি না। ব্যবসা করতেও পুঁজিপাট্টা লাগে। তুমি রাগ করো না চাচা।
সেদিন হতে সাহেদ হয়ে গেলো লাপাত্তা। ওর মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেলো। হাসিব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো।একদিন খুব সকালেও সাহেদের বাড়ি গিয়ে বন্ধুকে পেলো না হাসিব। সাহেদের বাবা জানালেন: খুব ভোরে উঠে চলে যায়, আর ফিরে রাত বারোটার পরে। কোথায় যায় কী করে কিচ্ছু বলে না!
সাতদিন পর সেই চা-স্টলে মোটরবাইকের বিকট শব্দে ওদের ক্যারম খেলায় বিঘ্ন হলে ওরা বাইরে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো। নতুন মোটরবাইক নিয়ে সাহেদ। ওর চোখে কালো সানগ্লাস।
হাসিব বেরিয়ে এলো প্রথমে। সাহেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,এতোদিন কোথায় ছিলি?
সাহেদ সানগ্লাসটা খুলে ফের পরে বললো, কাজ পেয়েছি! তোর ঐ মোবাইল ফোন নম্বরটা আমাকে কাজ দিয়েছে। আমার আর কোনো চিন্তা নাই। তুই বড় ভুল করলি মোবাইল ফোনটা এটেন্ড না করে!
কী কাজ?
এখন বলা যাবে না। তোদের ব্যাপারেও কথা হয়েছে।
আগে বল্ কে তোকে কাজ দিয়েছে! কে ও? কিসের ব্যবসা ওর?
সময় আসলে সব জানতে পারবি। আমি এখন গেলাম।
সাহেদ মোটরবাইক হাকিয়ে চলে যাবার পর বাকি তিনজন হাসিবকে ঘিরে ধরলো। হাসিব সবাইকে একে একে দেখে বললো, ওর পথে চললে তোমরাও ওর মতো বাইক চালাতে পারবে।
রমেশ বললো, কী করে ও?
সময় এলে বলবে। আমি বাড়ি গেলাম। তোরাও বাড়ি যেতে পারিস।
রাতে খাবার টেবিলে বাবার মুখোমুখি হলো হাসিব। বাবা বললেন, সাহেদ মোটরসাইকেল নিয়া ঘুরছে। মনে হয় ভালো কামাই করছে। কী করছে ও?
বিজনেস!
বিজনেসে এতো লাভ!
পাওয়ার পার্টির সাথে বিজনেসে অনেক লাভ! তোমকে কতবার বলেছি বাবা পাওয়ার পার্টির স্টুডেন্ট ইউনিটে যোগ দেই। কিন্তু তোমরা রাজি হলে না। দুই বছর হলো বেকার বসে আছি। শুধু ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী আমলা ধরলেও ঘুষ দিতে হবে।
বাবা বললেন, আমার মন পাল্টেছে। ঘুষের টাকা জোগাড় করার জন্য জমি বিক্রির ব্যবস্থা করো।
মা বললেন, জমি বিক্রি না করে আমার গয়না বিক্রি করে দাও! আমি এখন আর গয়না পরি না। ওগুলা ঘরেই পড়ে আছে।
খাওয়া শেষ হলে হাসিব হাত ধূয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ওর। ও হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো পুকুরপাড়ে। মাচায় বসে উদ্দেশ্যহীন তাকাচ্ছে এদিকওদিক। অনেকটা দূরে দক্ষিণপাড়ার জঙ্গলের পেছনে টর্চলাইটের আলো পড়তে দেখে উৎসুক হয়ে উঠলো। নিজেকে আড়ালে রেখে এগিয়ে গেলো সেদিকে। একদম কাছাকাছি গিয়ে টর্চের পেছনের লোকটাকে দেখে চমকে উঠলো হাসিব। সাহেদ! রাতের আঁধারে চুপিচুপি হাসিব কী করছে? ওর পেছনে আরো তিনজন লোক। সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।
অনন্যোপায় হয়ে চারজন ভিড়ে গেলো সাহেদের দলে।
এক সপ্তাহ পরে হাসিব বাবার হাতে টাকা দিলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এতো টাকা কোথায় পেয়েছো হাসিব?
হাসিব বললো, ব্যবসা শুরু করেছি বাবা।
মা জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ব্যবসা?
হাসিব বললো, এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট।
চাকরি খোঁজা বাদ দিয়া ব্যবসা শুরু করলি কেনো?
এতো টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলে আমারও ঘুষ খেতে৷ হবে। এর চেয়ে ব্যবসা করা ভালো।
বাবা বললেন, যা ভালো বুঝো করো।
সেদিন হতে হাসিব আর ঐ দুঃস্বপ্ন দেখে না। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়, যা এখনো বলা হয়নি। সব যুবক-যুবতীর যেমন প্রেম থাকে, তেমন হাসিবেরও একটা প্রেম আছে। ওর প্রেমিকার নাম হাস্নুহেনা রাস্না। হাসিব ওকে রাস্না ডাকে। রাস্না বিয়ের চাপ দিচ্ছে।বাবা-মা অন্যত্র বিয়ে দেবার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এখন ওরা কথা বলছে হাসিবদের পুকুরপাড়ের মাচাটায় বসে। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গেছে।
হাসিব রাস্নার একটা ডান ধরে রেখে বললো, আমি চাকরি না করলেও টাকা কামাই করছি এখন।
রাস্না বললো, চাকরির চেষ্টা করছো না কেনো?
এতোদিন ইন্টারভিউ দিয়েছি;কিন্তু বাবা ঘুষের টাকা না দেয়ায় চাকরি হয় নাই। এখন বাবা ঘুষের টাকা দিতে রাজি হয়েছে; কিন্তু আমার আর ইন্টারভিউ দিতে ইচ্ছে করছে না।
রাস্না নিজের হাত ছাড়িয়ে হাসিবের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ব্যবসা করছো? কিসের ব্যবসা?
এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট।
কারঙ্কা গ্রামে থেকে কিসের এক্সপার্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা করছো তুমি?
স্মাগলিং, মানে চোরাচালান।
রাস্না আলগোছে হাসিবের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাচা থেকে নেমে একবারও পেছনে না তাকিয়ে হারিয়ে গেলো অন্ধকারে। হাসিব হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকতে গিয়েও মুচকি হেসে ফিরিয়ে নিলো হাতটা।
কষ্টটা হজম করার প্রচেষ্টা হিসেবে হাসিব ধরে ফেললো বাংলা মদ। বাড়ির লোকদের বিশেষ করে মা-বাবাকে এড়িয়ে মদ্যপান করার জন্য গ্রামের নারায়ণ জমিদারের পোড়োবাড়িটাকে বেছে নিয়েছে। প্রচলিত আছে যে এই পোড়োবাড়িটা ভূতের গাড্ডাখানা হওয়ায় দিনের বেলায়ও এখানে কেউ আসে না। এক গভীর রাতে মদ খেয়ে পোড়োবাড়ি থেকে বের হয়ে হাসিব মুখোমুখি হয়ে গেলো সাহেদের।
সাহেদ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে বললো, তুই আজো বাংলা মদ খেয়েছিস? আগামীকাল থেকে তোকে আমি বিদেশি মদ এনে দেবো।
হাসিব জড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তুই কই যাচ্ছিস এতো রাতে?
একটা লিভিং ডল ডেলিভারি দিতে যাচ্ছি।
লিভিং ডলটা কে?
তোর এক কালের প্রেমিকা হাস্নুহেনা ওরফে রাস্না।
কী বলছিস তুই! এটা হতে দেবো না সাহেদ!
মাল উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। সামনেই এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে।
হাসিব সাহেদের পথরোধ করে বললো, মানুষ বিশেষ করে মেয়ে মানুষ পাচার করতে দেবো না আমি!
কিভাবে ঠেকাবি তুই আমাকে? গুলি করবি?
প্রয়োজনে তাই করবো!
একটা মেয়ে যে তোকে ছ্যাকা দিয়েছে ওর জন্য আমার সাথে শত্রুতা করবি।
ও বলে কথা না, কোনো মেয়ে মানুষ পাচার করতে আমি দেবো না!
দু'জনের হাতে পিস্তল। হাসিব সাহেদের এবং সাহেদ হাসিবের কপালের দিকে তাক করে রেখেছে।
দু'জনের পিস্তল থেকে একসাথে গুলি বের হবে কি? আগে পরে বের হলে কে আগে মারা যাবে? হাসিব আগে মারা গেলে রাস্নার জীবনে শনি শুরু। আর সাহেদ আগে মারা গেলে রাস্নার মান-সম্মান রক্ষা পেয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাস্না কি স্মাগলার হাসিবকে ফের কাছে টেনে নেবে?
No comments:
Post a Comment