গদ্য || জীবন কাহিনী || সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

 জীবন কাহিনী 





    অস্বীকার করার জায়গা নেই। অস্বীকার করছিও না। 

পুরোনো ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে দেশের বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে-- দু'ভায়ে বাবার কঠিন আদেশে১৯৭৩ সালে। পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। যেখানে একলা একলা থেকে নিজে রান্না খাওয়া করে পড়াশোনা করেছি। থেকেছি। খেলেছি। মনের মতো বন্ধুত্বও গড়েছি। দেয়াল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হয়েছি। ফুটবলের স্টপারের জায়গায় (প্রথম( ডিভিশনে)অভিষিক্ত হয়েছি।

কিন্তু বাবার মনে যে সেই স্যাঁতসেঁতে ধারনার জায়গায় কংক্রিট গড়ে উঠেছিল-- "আমি একটি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি- উচ্ছন্নে যাচ্ছি"। হয়তো সেই মেয়েটা আমার সমস্তকিছু গোল্লায় দিচ্ছে। তাই চুপচাপ বাড়ি ফিরছি। বাসে করে। কেননা আর কোনও মাধ্যম ছিল না তখন সেসময়। আবার কিছু বছর পরে যোগ দেয়া ভাইটাও যাচ্ছে আমার সাথে।সে পড়তো গোয়েঙ্কা কলেজে কমার্স নিয়ে আর আমি ইকনমিক অনার্সের ছাত্র হিসেবে সেন্ট পলসে। কেউ কারোর সাথে কথা বলছি না সেসময়। যেন-- নিজেদের মৃতদেহটাকে নিজেরাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি কোনো শয়তানের কারখানার দিকে। তাই সেসময় নীরবতা পালনের জরুরি মাধ্যম হয়েছি। আর-- সেই নীরবতাই প্রমাণ করে দিচ্ছে সেই দিকটাই। দু'জনের বিশ্বভুবন যদিও বিভিন্ন। রং চটা ফানুষের আলো ঠিকরে পড়ছে মনের গভীরে। অবশ্য সেই মেয়েটির মনে এটা কতটা রেখাপাত ঘটবে জানিনা। তবু যেতে যে হবেই। 

    বাবার হুকুম অমান্য করার সাহস ও শক্তি আমার নেই। অবশ্য কোনও দিন ছিলও না। শহরের শিক্ষা গ্রামের আদিমতায় মিশে আমাকে এবার কী রকম জঞ্জালের স্তুপে নিক্ষেপ করে সেটাই দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হবে বাকি জীবনটায় । যদিও মেয়েটি আমার জন্য বেশ কিছু দিন হয়তো এরপর মানসিক উপবাস যাপন করবে । তারপর সে নিশ্চয়ই পারবে ভুলে যেতে কঠিন বাস্তবায়নে।  কিন্তু আমি পারছি না কেন! কেন? 

    আমি একা। একা আমি। জীবনের কঠিনতম বাস্তবের মুখে এক খড়কুটো সমান যেন। হ্যাঁ,মেয়েটির সাথে প্রেম হয়েছিল ঠিকই -- তবে সে প্রেমে নগ্নতা ছিল না। বা বলা যেতে পারে মেয়েটিই নগ্ন হতে দেয়নি কোনও সময়। বরং স্থির বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত করছিল আমাকে।। তবে আগুনের সামনে "ঘি"থাকলে গলবেই-- এই তত্ত্বটিই বা বাবা হয়ে অস্বীকার করেন কি করে! তাই ডেকে এনে মেয়েটির সঙ্গ ছাড়ানোর ইচ্ছা আর কী!? 

   তবু আজও মনে পড়ে সেই পুরোনো ঘর,। আর মনের মধ্যে বাসা বাঁধা চেনা জানা কিছু মানুষের বিরল অভাব। 

     সেই ড্যাম্পের ঘর একচিলতে। একদিকে বিহারী গয়লাদের খড় ভুষি রাখার গোডাউন। দু দিকের ঘরের মাঝখানে দরজা ছিল যদিও। কিন্তু সেটা এমনিই যে সেটা গলে সবকিছুই ঘরে ঢুকতো অনায়াসেই আরশোলার পরিবারদের সঙ্গে নিয়ে। দরজা বন্ধই থাকতো যদিও সবসময়ই। তারই মধ্যে একখানা তক্তোপোষ পাতা একদিকে। দুদিকে দরজা। মেঝেতে কালো কালো ছোপ -- সুন্দরী রমনীর শরীরের বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ যেমন। একদিকে রান্নার জন্যে জনতা আর ইকমিক কুকারের আঁটোসাঁটো বিভিন্নতা। সামান্য কিছু ষ্টীলের থালা বাসন। জলের বালতি, কালো রঙের কুঁজো এককোনে বসানো। সামনে জানলা গলে চোখে পড়ে হ্যান্ড পাম্পের জলের ঢেউয়ে বাড়ির আর সকলের হাবভাব। বেশ খানিকটা দূরে বাথরুম। জলের কলের লাইনে দাঁড়িয়ে জল তোলা। ঘরের ভিতর একখানা পাখা সেই রবী ঠাকুরের আমলের (ডিসি কারেন্টের )ঝুলছে। যার হাওয়া বেশি না হলেও আওয়াজ যার মহারাজারঞ্জিত বেদুইন সমান। মেয়েটা আসতো রোজই প্রায় দুপুরে। কী জানি কেমনভাবে যে তারপর সময়টা চলে যেতো বোঝাই যেতো না। রাত ন'টার বেশ কিছু আগেই অবশ্য বিচ্ছিন্ন প্রাসাদের হাতছানি দিতো তাকে। এখন সেই ঘর অন্য কারোর দখলে ভাবতেই মনে ভীষণ কষ্ট হয়। যখনই তার পাশ দিয়ে কোথাও যাই মনে পড়ে তার নির্ভেজাল ছবি খানা। অথচ সেটাকে ত্যাগ করে এলাম কী করে বলুন তো! কিন্তু এটাই তো কালের বিধান। তাই না! কাকে বোঝাই আমার ব্যক্তিগত সঙ্কটের কথা! তারপর---!! 

   আবার নতুন সকাল। কলেজ, শর্টহ্যান্ড ক্লাস। বিকেল হলে ঘোরাঘুরি। যদিও ইংরেজি মাধ্যম মিশনারি কলেজ। তবুও বাবার বজ্র কঠিন নিয়মে পড়ে প্যান্ট শার্ট ভুলে ধুতি পাঞ্জাবি পরে কলেজে যাওয়া। বয়সটা যদিও তখন মাত্র ষোল ছুঁই ছুঁই। একেবারে বোকা বোকা গ্রামের ছেলে। তাই রাগিং করার চেষ্টায় অনেকেই চেষ্টা করে ছিল সেসময়। যদিও সাপের মুখে পড়েও বেঁচে গেছি বলতে পারি। কিন্তু কলেজ অধ্যক্ষের কাছে নানান বাজে কথা শুনতে হয়েছে। নাহলে তিনি কলেজ থেকে বার করে দেবেন বলে হুমকিও দিয়েছেন। অজুহাত ছিল আমি নাকি বন্ধুদের সাথে বিশ্রী ব্যবহার করি এবং অশ্লীল কথা বলি। যার জন্য "বাড়িতে মা বোন নেই" (!)বলে হুমকিও দিয়েছেন। যেটা শুনে বাকি ছাত্র ছাত্রীরা অবশ্য বলেছিল-- কাকে কী বলেছেন এ্যাঁ! চলো ঐ প্রিন্সিপালের ঘর ভেঙে এখনই গুঁড়িয়ে দিই। বাধা দিয়েছি। তাই বন্ধু বান্ধবীরা পিছু হটেছে। এও হয়তো কপালে লেখা ছিল ভেবেছি। নকশাল আন্দোলনের সময় আমাকে ভুল করে কলেজ বন্ধুদের দ্বারা নকশাল সাজানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। এরকম কত কিছুতেই ঐ মেয়েটা আমাকে রক্ষা করেছে মায়ের মতো। তবু সে বাড়িতে এলে --চলতো পৃথিবীর বুকে নানান আঁকিবুকি কাটা। বারবারই সেই মেয়েটির মুখে এটাও শুনেছি-- কী অসম্ভব "স্বীকারোক্তি" তোমার ! দ্যা গ্রেট। "এমন ছেলে বর্তমানে "বিরল"। তারপর, তারই হাত ধরে অবশ্য সিনেমা দেখা শুরু। সমরেশ বসুর লেখা কোনও বইয়ের নায়ক ভেবে "ভূবন সোম "দেখিয়েছেন। 

   সে সবই বন্ধ এখন। বিদ্যাসাগর মহাশয় মাতৃ আদেশে খরস্রোতা দামোদর সাঁতরে পার হয়েছিলেন। আর আমি পিতৃ আদেশে জীবনতরী পার করে চলেছি সেই কবে থেকে আজও। জানি না আর কতদিন! 

    সরকারি চাকরি পেয়েও ( বি, ই কলেজ অধ্যক্ষের পি, এ) চাকরি করিনি। সেও পিতৃ আদেশে। তারপর বিয়ে হয়েছে-- একটা নারী শরীরের তাপমাত্রা মেপে যৌনতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে রাজি হতে হয়েছে। 

       সন্তান লাভ করেছি। কিন্তু। সেই আগের রূপ, গন্ধ আর নেই। সবই ধুলোয় মলিন। অবশ্য এর পরেও অনেক নারী শরীরের তাপমাত্রা মাপার সুযোগ ঘটেছে আমার জীবনে। সহধর্মিনী হিসেবে তার অপব্যবহার করতে দেননি যিনি সেই অসামান্যা নারী সহধর্মিনী চরিত্রবতী হলেও ছিটিয়াল এবং যৎপরোনাস্তি কুঁড়ে ও অলস মস্তিষ্কের। পাবলিক যাত্রা মঞ্চে অভিনয় করেছি চুটিয়ে (অপেশাদার)। প্রত্যেক ( প্রায় ১০০) অভিনয়েই নায়কের ভূমিকায ছিলাম অবশ্য সফল। শুধু সফল হইনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করা কোনও মেয়ের জীবনসঙ্গী হতে। মানে অসফল বা সফল হইনি।। 

  অবশ্য তারপর পরই আমার সমস্ত শখ আহ্লাদ এক নিমেষে উধাও। শুধু ব্যবসা, আর টাকার পেছনে দৌড়োনো এক বলিষ্ঠ যন্ত্র বনে গেলাম। আমার পুরোনো ঘরের পড়ার জায়গায় এক মন ধুলো পড়েছে ততদিনে। লেখালেখির সুযোগ নেই। তাতেই চলেছে খাতাপত্র নিয়ে কলমের কেদ্দানি। অসংখ্য লেখা বেরিয়েছে। কিন্ত কোনটাই বেশি দূর পৌঁছায় নি। কত খাবারের উচ্ছ্বিষ্ট গুলো লেগে আছে সেই ঘরের মেঝেতে। কেউ পরিষ্কার করেনি এতদিন। শুধু আমার যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনে গেছে তারা। গানের হারমনিয়ামটাতে, তবলায় ধুলো জমেছে। কেউ, কেউ সাফ করেনি। করবেই বা কেন! গলার কন্ঠনালীতে টান ধরার জন্যে গান বন্ধ করতে হয়েছে। গানের আসরে কত্ত জন আমন্ত্রণ জানিয়ে তাই ফেরত করেছে বোধহয়। তারপরেও সংগীতের সুর মূর্ছনায় বেশ কয়েক বছর এদিক ওদিক ঘুরেছি। তবলা (বাঁ হাতি) বাজিয়ে নামযশ কুড়িয়েছি। সেখানে এখন শুধুই বঞ্চনা আর বিদ্রুপ! অর্থাৎ "কোটা" কমপ্লিট হয়ে গেছে। সবাই তাই কেমন যেন বাঁকা বাঁকা। বাঃ, বা। কাদের জন্যে এই সততা, কাদের জন্যে এত সরলতা। কেউ বললো না -- "রাজা তোর কাপড় কোথায়"!? ছোটছেলে বারবারই বলছে-- আর কাজ করতে হবে না। কিন্তু--! 

     একমাত্র মেয়েই শুধু কাঁদে। বাবা যেন তার চির অমর রহে এই আশায়। সে তার শ্বশুরের দাঁত খিঁচুনি শুনেও বাবার জন্যে নিত্যদিন কাঁদে আর প্রার্থনা করে-- "ঈশ্বর বাবাকে বাঁচাও।" বাবা যেন সৎ হয়েই মরতে পারে। কত্ত জন - জ্ঞাতি, আত্মীয় পরিজন, আম পাবলিক কতভাবে বাবাকে চিটিং করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবুও বাবা অচল অটল!! তার বাবার যে সব থেকেও নেই এমন কালের যাঁতাকলে"! দেখবো এরপর নিয়তি শেষপর্যন্ত কী বলে! আর তাইতো আমি ভাবি--- বলি-- দাও ফিরিয়ে আমার পুরোনো সেই দিন গুলি।। আমার পুরোনোই বোধহয় ছিল ভালো।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024