বিদ্রোহী কবি নজরুল - সামসুজ জামান || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

           বিদ্রোহী কবি নজরুল

                  সামসুজ জামান


২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একবার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল জানতে যাওয়া হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? ৩০ দিনের উপর চালানো পরিসংখ্যানে দেখা যায় শ্রোতাদের মনোনীত শ্রেষ্ঠ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় তৃতীয় স্থানে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার কবি এবং অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবাংলার সংযুক্ত বর্ধমান জেলার আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে। বাংলা হিসেবে ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ , মঙ্গলবার আর ইংরেজি ২৪ শে মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম এবং একটি মাজারের খাদেম ছিলেন। খুবই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ হয়েছিল মাদ্রাসায়। কষ্টের হাত ধরে জন্ম বলে তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়াঁ। আর খুব ছোটবেলায় বাবার মৃত্যু হয় বলে ছোটবেলা থেকেই অর্থের রোজগারের ব্যবস্থা তাকে করতে হয়েছে। তাই বেশি পড়াশোনা সম্ভব হয়নি। জীবিকার কারণে চায়ের দোকানে রুটির কারখানায় বা কারো বাড়ির খানসামা হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। তবে নিজের লেখনী শক্তি থাকায় গ্রামবাংলায় ঘুরতে থাকা নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবিতা, নাটক, লেটোগান রচয়িতা করে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

একেবারে তরুণ বয়সে নজরুল যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভিতরে ছিল তাই তিনি ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে করাচিতে গিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। সশস্ত্র আন্দোলন হবে এবং তার মধ্যে দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে হবে এটাই ছিল তাঁর মনের ভাবনা। সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈনিক হয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পর সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। এই সময় ‘ধুমকেতু-’র মত পত্রিকা জনসমাজে খুব সাড়া জাগিয়েছিল। তার “বিদ্রোহী” কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে।  'ভাঙার গান' ইত্যাদি রচনা একেবারে মানুষকে উত্তাল করে দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা করা নজরুলের জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে ছিল। তিনি কখনো এই সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নেন নি। তার গানের ভাষা – “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন / কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার” – অপূর্ব সুন্দর ভাবনার পরিচায়ক। তিনি অন্য কবিতায় বলেছেন- “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত- জালিয়াত খেলছো জুয়া”। আসলে তিনি ছিলেন মানবতার কবি। তাই জাত ধর্মের বন্ধনে তাঁকে কেউ কখনো বন্দী করে রাখতে পারেনি।

নজরুল তাঁর দেশপ্রেমমূলক লেখা লিখে ইংরেজ রাজশক্তির বিষ নজরে পড়েছিলেন। যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ নজরুলের লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে “বসন্ত” গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কে জোড়াসাঁকো ডেকে পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল, তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি”। তাঁর আরও বক্তব্য ছিল – “তাকে বোলো আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না ব’লে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকন্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই”। 

ইংরেজরা তো নানাভাবেই ভারতীয়দের, বিশেষ করে নজরুলের মত লেখনি ধারণ করে যারা দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলছে তাদেরকে নানাভাবেই ঘৃণা করতেন। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবার কথা সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার অবাক হয়েছিলেন যে – “টেগোর ওই ‘প্রিজনার’-কে বই ডেডিকেট করেছেন”!! আর তারপর নজরুল সেই কথা শুনে “বসন্ত” বইখানা তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে, বুকে চেপে ধরেছিলেন আনন্দে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায়! তিনি আসলে আজন্ম প্রতিবাদী তাই জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে রাজবন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে নজরুল অনশন শুরু করেছিলেন। জেলের বাইরে সে খবর ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত মানুষ উত্তেজিত হয়েছিল প্রচন্ড পরিমাণে। রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাঁকে অনশন তুলে নিতে বলেছিলেন। শরৎচন্দ্র উত্তেজিত হয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অনুমতি পান নি। আর নজরুলের বন্ধু-বান্ধব বহু কবি-সাহিত্যিক সাধারণ মানুষ সকলেই নানাভাবে নজরুলের সমব্যথী হয়েছিলেন। অনশনে মরার মত হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল শরীর তা সত্ত্বেও তিনি জেদ ধরে বসে ছিলেন- তিনি খাবেন না। এরপর ৩৯ দিনে অনশন ভঙ্গ করানো হয় অনেক চেষ্টা চরিত্র করে। এভাবেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা নজরুলের একেবার মনোধর্মের মধ্যেই ছিল।

আমাদের দুর্ভাগ্য নজরুল সুস্থ অবস্থায় মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক, শিল্পী-জীবন পেয়েছিলেন। যার মধ্যে ৫০০ রচনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। এখানে ছিল ২৮৫ টি কবিতা, ১৫৭ টি গান, ৪৩ টি প্রবন্ধ ও ভাষণ, ১৪ টি গল্প, তিনটি ধারাবাহিক উপন্যাস। সুস্থ অবস্থায় নজরুলের প্রকাশিত গ্রন্থ ৪৯ টি। অসুস্থতার পরে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে ৯৭৪ টি গান, ৬৫৩ টি কবিতা, ৭৬ টি প্রবন্ধ, ১৮ টি গল্প, ৯টি নাটক-নাটিকা, তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদিতে প্রকাশিত রচনা হিসেব করলে গান পাওয়া যাবে আড়াই হাজারেরও বেশি, কবিতা ৬৮টি-র বেশি, প্রবন্ধ আলোচনা একশোটির ও বেশি, গল্প ১৮ টি,  নাটক গীতি বিচিত্রা ইত্যাদি মিলিয়ে ২৫ টি আর উপন্যাস ৩ টি। এর বাইরে নজরুলের কত লেখা যে এখানে ওখানে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে তার হিসেব পাওয়া মুশকিল।

আমাদের দেশ বিভাগের পর নানাভাবে নজরুলকে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে চিরস্থায়ীভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু মন থেকে তিনি সেদিকে সাড়া দেন নি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এবং আমাদের পক্ষে এটা খুব লজ্জ্বার কথা যে নজরুল যখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন আমাদের দেশের পক্ষ থেকে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে নজরুলের চিকিৎসার সুব্যবস্থার কথা ভেবে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে এই কবিকে বাংলাদেশের নেবার অনুমতি চেয়ে নেয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মে বাংলাদেশ বিমানে কবিকে সপরিবারে ঢাকা আনা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের একুশে পদকে ভূষিত করেন এবং তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু সে দেশেই তিনি ১৯৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ শে অগাস্ট সকাল দশটা দশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যথাযোগ্য ভাবেই বলেছিলেন – “তাঁর সক্রিয় জীবনে কবি যা লিখেছেন তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। তাঁর মৃত্যু ভারত ও বাংলাদেশকে রিক্ত করে দিয়েছে”। তাঁর স্বভাব ছিল সহজ, সরল। হৈ হৈ করে সকলকে নিয়ে আনন্দ-হাসি-গানের মধ্যে দিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র কবি হিসেবে তাঁকে ধরে রাখা যায় না, তিনি বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, গল্পকার হিসেবেই সব সময় কাজের মধ্যে মানুষকে নিয়ে বেঁচে থাকতে এবং মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। একেবারে ছোট থেকে এত রকমের অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, ঝড়-ঝঞ্ঝা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নজরুল কাটিয়েছেন যে তাঁর কবি-সাহিত্যিক হিসেবে এত বড় হওয়া অনেকের কাছেই খুব আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হয়। যত রকমের প্রতিকূল পরিবেশ অর্থাৎ বাধাবিঘ্ন তাঁকে চেপে ধরেছে, তিনি যেন ভিতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তত বেশি উচ্ছল হয়ে মানুষের মাঝে তাঁর সাহিত্য, গান, কবিতাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। জেলখানায় বন্দি থেকেও নজরুলকে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন রচনা থেকে দূরে সরানো যায় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি নজরুলকে ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। আজও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মত লেখনি দিয়ে তিনি নিজে সবার কাছে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে  বেঁচে আছেন। কবির  মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এই কবিকে সমাধিস্ত করা হলেও পরে তাঁর সমাধিস্থলের মাটি নিজের জন্মভূমি চুরুলিয়া তে এনে কবি পত্নী প্রমিলা ইসলামের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। চুরুলিয়ার সেই পবিত্র মাটিতে সেই সমাধির পাশে দাড়ালে আজও আমরা যেন শুনতে পাই তিনি বলছেন- “ মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু- মুসলমান/ মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ” কিংবা “রক্ত ঝরাতে পারিনা তো একা/ তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা”। মনে হয় তিনি যেন বলছেন তার চিরস্মরণীয় বাণী – “বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না.........”!!!

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024