সহচরী - সঙ্ঘমিত্রা রায় || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story
সহচরী
সঙ্ঘমিত্রা রায়
এক
শ্বশুরবাড়ীতে এসেই মধুরিমা বুঝতে পারে তার পিসিশাশুড়ী বসুধার ভূমিকা এখানে কাজের লোকের মতো ! বসুধা সারাক্ষণ সবার ফাই -ফরমাশ খাটে মন জুগিয়ে চলে ।
একুশ বছরে একবছরের মেয়ে বাসবীকে নিয়ে বিধবা হওয়া বসুধাকে যখন শশুর বাড়ীর লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন বাপের বাড়ীতে আসে বসুধা । বাবা তখন নেই তার মা বাসনা দেবীর সংসারে কোন আধিপত্য নেই সংসার তখন ভাইয়ের বৌদের দখলে । বড় বৌদি আল্পনা বলেছিলেন ,” দেখ ঠাকুরঝি তোমাদের দুজনকে রাখতে অনেক খরচ লাগবে ।তুমি তো কানাকড়িও নিয়ে আসনি ।তবে এখানে থাকতে হলে তোমাকে খেটে পুষিয়ে দিতে হবে নইলে তোমাকে রাখা সম্ভব নয় তুমি অন্য কোথাও চলে যাও !”
“ না না বড় বৌদি বল আমাকে কি করতে হবে আমি করব ।তবু তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিও না।“
“ বেশ আমি কাজের লোককে ছেড়ে দিচ্ছি তুমি এখন থেকে ঘরের সব কাজ করবে দুজন মানুষের খরচা নেহাত কম নয় ।“
“ ঠিক আছে বৌদি আমি এখন থেকে ঘরের সব কাজ করব । “
সেই থেকে বসুধা সংসারের সব কাজ করে আসছে । বসুধার বাবা অমিয় বসাকের ভালো ব্যবসা ছিল । তিনি খুব লোভী প্রকৃতির ছিলেন। চন্দননগরে উনার বড় বাড়ী আছে। বসুধার বড় দুইভাই অনিরুদ্ধ বড় আর অনির্বাণ ছোট। অনির্বাণ থেকে বসুধা প্রায় চোদ্দ বছরের ছোট। বলতে গেলে এতবছর পর বসুধার জন্ম তার ভাইরা ,বাবা কেউ ভালোভাবে নেয়নি । অমিয়বাবু বাসনা দেবীকে বলেছিলেন ,” এতদিন পর তোমার বাচ্চা হবে লোকে কি বলবে ! তুমি বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও ।“
“ লোকে যা বলার বলুক আমাদের মেয়ে নেই যদি এবার ঘরে লক্ষ্মী আসে ।“
“ তোমাদের যত কথা মেয়েরা নাকি লক্ষ্মী ! ওকে বড় করে বিয়ে দিতে কত টাকা লাগবে ভেবে দেখেছ ।লক্ষ্মী চলে যাবে আসবে না ।বরং ছেলে বিয়ে দেওয়ার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসবে ঘরে । কত লাভ হবে বলতো !”
“ বেশ তাহলে বাচ্চাটা নষ্ট করার দরকার নেই যদি আরেকটা ছেলে হয় তাহলে আমাদেরই লাভ হবে ।“
“ ঠিক আছে তাহলে থাক ।“
কিন্তু ছেলে হয়নি হয়েছিল মেয়ে । এমনিতে মেয়েরা বাপ সোহাগী হলেও বসুধা বাপের আদর ভালোবাসা খুব একটা পায়নি ।বসাক বাড়ীতে ছেলেদের মূল্য বেশী । বসুধা যা আদর ভালোবাসা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে । এরজন্য বাসনা দেবীকে কথা শুনাতেন অমিয়বাবু। বলতেন , “একে বেশী লাই দিয়ে মাথায় তুলো না ।ঘরের কাজকর্ম শেখাও যত তাড়াতাড়ি পারি বিয়ে দিয়ে দেব ।“
“ একটু লেখাপড়া না করলে ওর জন্য কি ভালো বর পাওয়া যাবে ।“
“ সরকারী স্কুলে যতটুকু হয় হবে ।“
বসুধার দুই ভাই ভালো স্কুলে পড়েছে আর বসুধা সরকারী স্কুলে ক্লাস নাইন অবধি পড়াশোনা কড়েছে। অবশ্য সে পড়াশোনায় ততটা ভালো ছিল না ।তবে বাসনা দেবী তাকে ঘরের কাজ আর খুব সুন্দর সেলাই শিখিয়েছিলেন ।বসুধার হাতের কাজ খুব সুন্দর । বাড়ি থেকে খুব একটা বের হত না । অবসর সময়ে বাড়ীতে বসে নানা ধরনের সেলাই করত। বসুধার সতেরো বছর বয়সের সময় অমিয়বাবু মারা যান। দুই ভাইয়েরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে । অনিরুদ্ধ বাবার ব্যবসা দেখছে তার স্ত্রী আল্পনা চাকরী করে ।অনির্বাণ চাকরী করে তার অফিস কলিগ সুচাতাকে বিয়ে করেছে । সবাই নিজের মতো করে আছে ওদের বাড়িতে অবাঞ্ছিত দুটি মানুষ বসুধা আর বাসনা দেবী । কোনরকমে বাড়ীর এককোনে পড়ে আছে দুজনে । সংসারের সব কাজ তারাই করে। বাসনা দেবীর অনুরোধে ভাইয়েরা বসুধাকে আঠারো বছর বয়সে চল্লিশ বছরের একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় ।লোকটার কোন আয় ছিল না তার উপর অসুস্থ ছিল , ভাইদের সংসারে থাকত । স্বামীর রোজগার না থাকায় বসুধা সারাদিন সংসারের সব কাজ করত । এভাবেই বসুধার মেয়ে হয় আর মেয়ের একবছরের সময় ওর বর মারা যায় তারপর থেকে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে কাজের লোকের মতোই আছে বসুধা ।
দুই
কেটে গেছে অনেক বছর ।বাসবী এখন কলেজে পড়ে , বাসনা দেবী এখন আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না সারাক্ষণ বসেই থাকেন। অনিরুদ্ধবাবুর ছেলে আকাশের বউ হয়ে মধুরিমা বসাক বাড়ীতে এসেছে । তার বাপের বাড়ি বহরমপুরে ।আকাশ ভালো সরকারী চাকরী করে মধুরিমা বাংলায় এম , এ চাকরী পায়নি তবে তার বুটীক খুলার ইচ্ছে অনেকদিনের । সেও ভালো সেলাই জানে । বুটীক নিয়ে কোর্স করেছিল তারপরই ভালো পাত্র পেয়ে ওকে বিয়ে দিয়ে দেন তার বাবা –মা। কথা হল চাকরী যদি না পায় বিয়ের পর বুটীক খুলবে সে ।এতে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কোন অমত নেই।
মধুরিমা বুটীক খুলার প্লেন করছে মনে মনে কিন্তু একা একা তো আর বুটীক খুলা যায় না । চন্দননগরে সে তেমন কাউকে চেনে না ।
দুপুরবেলা বাড়ীতে বাসনা দেবী , বসুধা আর মধুরিমা থাকেন । মধুরিমা তার ঘরে একাই বন্ধুদের সঙ্গে ফোন কথা বলে, চ্যাট করে । বাসনাদেবী , বসুধা এদিকে আসেন না পাছে তার ছেলে বৌমারা রাগ করে ।
কিন্তু মধুরিমার এভাবে থাকতে ভালো লাগে না । সে বরাবরই মিশুকে আগে সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকত । মনে মনে ভাবল ঠাম্মী , পিসি এদিকে না আসলেও আমি তো তাদের কাছে যেতে পারি ,গল্প করতে পারি ।
বসাক বাড়িটা বেশ বড় । রান্নাঘরের পাশে একটা ঘরে বাসনাদেবী, বসুধা ,বাসবী থাকেন । মধুরিমা ওদের ঘরে গেল তাকে দেখে চমকে উঠলেন দুজনে । সব কাজ শেষ করে দুজনে বসে কথা বলছিলেন ।
“ তুমি এখানে কেন এলে নাতবৌ ?”
“ কেন ঠাম্মী আমি তোমাদের কাছে আসতে পারি না ।“
“ তুমি চলে যাও মধুরিমা আর এসো না দাদা বৌদি জানতে পারলে রাগ করবে ।“
“ কেউ রাগ করবে না ।আমি তোমাদের সঙ্গে গল্প করব , আমাকে কি তোমরা তাড়িয়ে দেবে ।“
“ না রে বোন তাড়িয়ে দেব কেন ! তুমি আমাদের ঘরে এসেছ নাতবৌ আমাদের সৌভাগ্য ।বস চা খাবে বসুধা চা করে নিয়ে আয় ।“
“ খাব পিসিমনি তুমি নিয়ে আস । “
বসুধা চলে যায় ।বাসনা দেবী নানা গল্প করতে থাকেন ।মধুরিমা দেখতে থাকে এদের ঘরে কি সুন্দর সুন্দর হাতের কাজ । টেবিলে, চেয়ারে, দেওয়ালে , বিছানায় যাই পাতা আছে সবকিছু কারো সুন্দর হাতের কাজ ।আরও ফেলে দেওয়া জিনিষ দিয়ে ছোট ছোট জিনিষ বানিয়ে রাখা ।
“ঠাম্মী এসব কে বানিয়েছে ?”
“ বসুধা বানিয়েছে। ও বেশ ভালো সেলাই জানে ।বিয়ের আগে খুব করত এখন সংসারের সব কাজ করে সময় পায় না ।তবুও নেশা ছাড়তে পারেনি ।যখন সময় পায় একটু আধটু সেলাই করে ।তা এসব করতে টাকাও লাগে কোথায় পাবে বেচারি টাকা !দুটো মানুষ ভাইয়ের সংসারে পড়ে আছে । এখন ওর একটাই চিন্তা কিভাবে বাসবীকে পাত্রস্থ করবে।“
বসুধা চা নিয়ে এল । বাসনা দেবীকে বলল ,” মা তুমি ওর সঙ্গে আমাদের কষ্টের কথা বলছ কেন । ওদের জগত আর আমাদের জগত আলাদা !“
মধুরিমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেসে বলল ,” এভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না পিসিমনি । কি সুন্দর তোমার হাতের কাজ তুমি চাইলে এসব দিয়ে অনেক দূর এগোতে পার । তোমার সব সমস্যার সমাধান হতে পারে !”
“ কি বলছ তুমি আমার সমস্যার কক্ষনো হবে না !”
“ হবে তার আগে বল তুমি আমার সহচরী হবে কিনা !”
“ আমি তোমার সহচরী কি করে হব তোমার আমার বয়সের কত ফারাক!”
“ তা হোক আমি তোমাকে আমার সহচরী মেনে নিলাম ঠাম্মী তুমি সাক্ষী থেকো । আমি সহচরীকে নিয়ে একটা বুটীক খুলতে চাই ।“
“ তোমার বুটীকে আমি কি করতে পারি বল !”
“ যার এতো সুন্দর হাতের কাজ তাকে নিয়ে বুটীক শুরু করলে বুটীকের নাম অনেক দূর ছড়িয়ে যাবে এটা আমার বিশ্বাস !”
“ আমিও চেয়েছিলাম সেলাই নিয়ে জীবনে কিছু করব আমি তো আর লেখাপড়া বেশী করিনি । কিন্তু কিছুই হল না জীবনে ।“
“ এখন হবে আমরা দুজনে মিলে একটা বুটীক খুলি দেখি কি হয় !”
“ কিন্তু দাদা বৌদিরা হয়তো আমার তোমার সঙ্গে কাজ করাটা মেনে নেবে না ।“
“ ওসব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও ওরা যখন বাড়ীতে থাকে না তখন তুমি কাজ করবে।“
“ যা বসুধা নাতবৌ যখন সুযোগ করে দিচ্ছে তাহলে লেগে পড় দুপুরে তো এমনিই বসে থাকিস ।“
“ ঠাম্মী তুমি আমাদের আশীর্বাদ কর যাতে আমরা সফল হতে পারি ।“
“ তোরা দুই সহচরী সফল হবি ।আমি প্রাণভরে তোদের আশীর্বাদ করছি।“
সেই শুরু ।মধুরিমা বু্টীকের নাম রাখে” সহচরী” বুটিক । ওদের বাড়ীর নিচতলায় দুটো ঘর খালি ছিল । মধুরিমা সবার অনুমতি নিয়ে সেখানেই বুটীক শুরু করেছে । বসুধার হাতের কাথা সেলাই , নানা রকম এমব্রয়ডারি সেইসঙ্গে মধুরিমার চেষ্টায় সহচরী বুটিকের শাড়ী , কুর্তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ নামডাক করে ফেলে । মধুরিমা প্রচারের জন্য ফেসবুকে পেজ খুলেছে এতে ওদের অনলাইনে বিক্রি ভালোই হচ্ছে । বাসবীও সময় পেলে ওদের বুটীকে এসে সাহায্য করে । মাকে দেখে ,মধুরিমাকে দেখে ওর খুব আগ্রহ বেড়েছে । ওর সঙ্গের কয়েকটা মেয়ে এসে সহচরী বুটিকে কাজ করছে ।
দেখতে দেখতে চার বছর চলে গেল । সহচরী বুটীকের অনেক নামডাক হয়েছে । বাসবী এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে । মধুরিমা বুটীকের লাভের দুভাগ করে একভাগ বসুধাকে দেয় ।তা নিজেই ব্যাঙ্কে রেখে আসে বাসবীকে সঙ্গে নিয়ে । বাসনাদেবী ,বসুধা , বাসবী খুব খুশী মধুরিমার এই সাহায্যের জন্য । কিন্তু বসুধা এখনও আড়ালেই থেকে গেছে বাড়ীর কেউ জানে না বসুধার কাজের কথা , রোজগারের কথা। তবে আকাশকে বলেছে মধুরিমা । যারা ওখানে কাজ করতে আসে তাদের কাছে বসুধার একটাই শর্ত তার নাম যেন তার ভাই ,ভাইয়ের বউরা জানতে না পারে । ওরা তাদের কথা রেখেছে ।
সারা রাজ্যে অনেকগুলো বুটীক মিলে একটা প্রতিযোগিতা হয়েছে তাতে ’ সহচরী’ বুটীক প্রথম পুরস্কার পেয়েছে । দুলক্ষ টাকা আর মানপত্র , কাপ পাবে তারা । সবাই খুব খুশী । পুরস্কার প্রদান সভায় বসুধা ,বাসনাদেবী ,বাসবীকে নিয়ে গেছে মধুরিমা । বাড়ির কারো বারণ সে শুনেনি । পুরস্কার নেবার জন্য যখন মধুরিমাকে মঞ্চে ডাকা হয় তখন সে বসুধাকে টেনে নিয়ে যায় মঞ্চে । বাড়ীর সবাই কানাঘুষো করে বলতে থাকেন “ এটা মধুরিমার একটু বেশী বাড়াবাড়ি !”
কিন্তু মধুরিমা মঞ্চে উঠে বসুধার কাজ করার ভিডিও দেখায় সবাইকে । আগেই সে সবকিছু ভিডিও করে রেখেছিল । সবাই অবাক বসুধার কাজ দেখে । পুরস্কার নেওয়ার সময় মধুরিমা বলল,” বুটীকটা আমরা দুই সহচরীর তাই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আমরা দুজনেই ।“
বিচারক হেসে দুজনের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন ।
Comments