উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -35


 

সেদিন মঙ্গলবার, ময়নাকে সাথে নিয়ে জগৎ জননী মায়ের পূজা দিতে গিয়ে মা, যে এক সৌভাগ্যবতী রমনীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে তা আমার অবিদিত ছিল না। তার দিন কয়েক পর ভদ্র রমনীর আমন্ত্রণ রক্ষার্থে তার বাড়ীতে উপস্থিত হলাম ময়নাকে সাথে নিয়ে।


ভদ্র রমনী অর্থাৎ গায়ত্রী দেবী যে দেবীদাসের পাশের বাড়ীতে থাকেন জানতাম না। ওর বাড়ীখানা দেখে বড় অবাক হলাম। এতো বড়ো বাড়ী যখন নিশ্চয় গাড়ীও আছে তাদের। কিন্তু গায়ত্রীদেবীকে দেখে মনে হয়েছে তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ভীষণ কাতরাচ্ছেন ও নিজেকে তিলে তিলে দগ্ধ করছেন। তবে কি তিনি স্বামীর ভালোবাসা হতে বঞ্চিত।

এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ওদের বাড়ীর বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়েছি খেয়াল ছিলো না। আমাকে দেখতে পেয়ে গায়ত্রী দেবীর বড় ছেলে মিন্টু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওর মাকে ডাকতে শুরু করল। মা দেখবে এসো কে এসেছে।

গায়ত্রীদেবী কৌতুহলের সঙ্গে বেরিয়ে এসে আমার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই বলে উঠল, কে, ও রমা? এসো বোন, ভেতরে এসো। একলা বসে থাকতে মন চায় না। এখানে এসে বড় অতীষ্ঠ হয়ে গেছি। যখন জামসেদপুরে ছিলাম, তোমার মতো অনেক সই পেয়ে ছিলাম। একি দাঁড়িয়ে রইলে যে, ভেতরে এসো।

ময়নাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। গায়ত্রীদেবী আমাকে বিশ্রাম ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্পে মশগুল থাকবে তার মনোভাব দেখে বুঝতে পারলাম। কিন্তু বিধাতা আমার শরীরে দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। মনে হলো ধীরে ধীরে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বো। আমার দেহ যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এলো। এ কোন বাড়ীতে এলাম।

এ যে কল্পনার বাইরে। কেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো শ্যামলীদির ছবি? তবে কি শ্যামলীদির সাথে গায়ত্রীদির কোন সম্পর্ক আছে।

 দেবীদাসের কাছে আশ্রয় পেয়ে স্বার্থপরের মতো শ্যামলীদিকে ভুলে গেছি। কোন দিনের জন্য শ্যামলীদির কথা আমার মনের মধ্যে ঠাঁই পায় নি। কত বড় স্বার্থপর আমি। শ্যামলীদির কথা মনে পড়তে কোন রকমে অশ্রু সংবরণ করে ওখান হতে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। জানি না গায়ত্রীদির বিশ্রাম ঘরে কতক্ষণ শ্যামলীদির টাঙানো ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

 ধরা যে পড়বো তা জানতাম। হয়তো একটুখানি নিজেকে চেপে রাখতে পারলে ধরা পড়তাম না, কিন্তু পারলাম না আমার প্রণম্য শ্যামলীদির প্রতিমূর্তি আমার চোখের সামনে হঠাৎ উদ্ভাসিত হওয়ায়। খুনের দায়ে সে আজ কারারুদ্ধ। হয়তো কারাগারের মধ্যে এক কোণে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছে।

 বাড়ীতে এসে বিছানার উপর উপুড় হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। ময়না

 মা মা বলে ডাকা সত্বেও কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সহসা গায়ত্রীদির কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে উঠলাম। ভাবলাম নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে ওর কাছে অভিনয় করবো। কিন্তু পারলাম না গায়ত্রীদির এজহারে দূর্বল হয়ে পড়লাম।

 গায়ত্রীদি বললেন, তুমি শ্যামলীর ছবি দেখে ওভাবে ব্যাকুল হয়ে কেন চলে এলে

 বোন ?

 আমি সরলভাবে বললাম, ও কিছু না গায়ত্রীদি, মানে শ্যামলীদির ছবি দেখে

 আমার মনটা বড় খারাপ হলো তাই -

 তুমি শ্যামলীকে চেনো ?

 কই না তো?

 কেন লুকোচ্ছ বোন। শ্যামলীকে যে চেনো তা আগেই বুঝতে পেরেছি নইলে তোমার মুখ দিয়ে শ্যামলীদি উচ্চারণ হতো না। কোথায় আছে সে বলতে পারো ? আমি ভীত হয়ে বললাম, বিশ্বাস করুন আমি ওকে চিনি না।

 আমি জানি তুমি শ্যামলীকে চেনো। কেন তার কথা বলতে চাইছো না। গায়ত্রীদি গভীর শ্বাস নিয়ে পুনরায় বললেন, আমি ও শ্যামলীর জামাইবাবু খবর পেয়েছি, শ্যামলী যাকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলো সে বেইমানী করে তাকে নোংরা পথে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে ওকে খোঁজ করার জন্য ওর জামাইবাবুকে কলকাতায় বদলি নিতে বললাম। সন্ধান তোমারই কাছে পাবো এর কোন ব্যতিক্রম নেই। দয়া করে তার সন্ধানের পথ বলে দাও বোন। শ্যামলীর জন্য মা, বাবা কতখানি যে শোকে দূর্বল হয়েছেন তা প্রত্যক্ষ করলে তুমিও চোখের জলে ভাসবে।
গায়ত্রীদির চোখ দুটো জলে ভরে এলো দেখলাম। শ্যামলীদি যে গায়ত্রীদির অতি আদুরে বোন তা ওর কাছে বারবার শুনেছি কিন্তু ভাবলাম এই পরিস্থিতিতে বা এই পর্যায়ে কোন প্রকারে বলা সম্ভব নয় সে কোথায় আছে। যখন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাওয়া গেছে তখন শ্যামলীদির অতীত জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদঘাটন করে দিয়ে আর নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবো না। বিলম্ব না করে ময়নাকে টেনে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো পাশের ঘরের খিল এঁটে কাঁদতে থাকলাম।

 গায়ত্রীদি বদ্ধদ্বারে করাঘাত করতে থাকল। ওভাবে কিছুক্ষণ আঘাত করার পর এক সময় দেবীদাস এসে গায়ত্রীদিকে ও অবস্থায় দেখে অবাক যে হলো না তা নয় । দেবীদাস হকচকিয়ে গিয়ে মুহুর্তের মধ্যে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, কি ব্যাপার, ওভাবে আঘাত করছেন কেন?

 গায়ত্রীদি ধীরে ধীরে মুখ তুলে দেবীদাসের চোখে চোখ রাখতেই বিস্ময়ে পাষাণ প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সহসা দেবীদাসের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, গায়ত্রীদি তুমি এখানে?

 গায়ত্রীদি ভাবতে পারেনি এ বাড়ী দেবীদাসের। দেবীদাসকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসেন, কারণ সুভাষের বন্ধু সে। একই সাথে পড়াশুনা করেছে। কিন্তু ও কথা থাক। গায়ত্রীদি ধীরে ধীরে নম্র কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাকে এখানে দেখবো ভাবতে পারিনি। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো, নতুবা আমি ভীষণ ভেঙ্গে পড়তাম। এখন তোমার সহযোগিতা আমার বিশেষ প্রয়োজন গায়ত্রীদির চোখ দুটো পুনরায় ছলছল করে উঠলো।

 দেবীদাসের মন বড় চঞ্চল ও কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার বলতো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আর এতো ব্যাকুল হবার কারণই বা কি।

 আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না ভাই। শুধু আমি নই ;শ্যামলীর জন্য বাবা, মা, সুভাষ সকলেই মন মরা হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। তুমি আমাদের বাঁচাও দেবীদাস। শ্যামলীর খোঁজ তোমাকে করতেই হবে।

 কোন শ্যামলীর কথা বলছো? তুমি পরিস্কার করে আমার কাছে ব্যক্ত করো। আমি জানি না শ্যামলী কোথায় আছে। আমার অনুমান রমা জানে।

 রমা জানে। রমার নাম শুনে দেবীর হৃৎপিন্ড কাঁপতে থাকলো তবে কি রমার সহচরী সেই শ্যামলী। দেবীদাস দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো, তুমি কি করে জানলে রমা শ্যামলীর খবর জানে?

 গায়ত্রীদি সংক্ষেপে প্রকাশ করলেন আমি শ্যামলীদির খবর জানি। দেবীদাস তাঁর কথার ছলে বুঝতে বারলো গায়ত্রীদির অনুমান অসত্য নয়। দ্বিতীয়তঃ

রমা যে শ্যামলীর কথা গোপন রাখতে চায় এও বিশ্বাস করল। রমা তার অতীতকে যে গায়ত্রীদির কাছে প্রকাশে অনিচ্ছুক। বুঝতে পারলো দেবীদাস কি করবে কিছুক্ষণের মধ্যে স্থির করে তাকে কথা দিলো, রমার মারফৎ শ্যামলীর সংবাদ নিয়ে আজই সন্ধ্যায় ওদের বাড়ীতে গিয়ে প্রকাশ করবে।

গায়ত্রীদি নিজেকে সংযত করে কোন প্রকারে বাড়ী মুখে পা বাড়ালেন। শত চিন্তাকে স্তুপীকৃত করে দরজার কাছে এসে অতি নম্রকণ্ঠে ডাক দিলো দেবী, রমা, দরজা খোল।

দরজা খুলে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম, আমাকে রক্ষে করো। দেবীদাস সান্ত্বনা দিলো। সেই সময় মনে হয়েছিলো আমার হৃৎপিণ্ড যেন শতাধিক বিদীর্ণ হয়ে যাবে। বার বার মনের দরজায় করাঘাত করতে লাগলো।

শ্রীরামচন্দ্রের পাদস্পর্শে পাষানী অহল্যা যেমন মানুষ হয়ে ছিলেন, আমারও কি দেবীদাসের স্পর্শে পরিবর্তন ঘটবে না?

দেবীদাসের উক্তি, কোন ভয় নেই রমা। আমি তো জেনে গায়ত্রীদিকে বিদায় করলাম। তবে এ আমার বড় আশ্চর্য লাগছে বা আমি ভেবে পাচ্ছি না, শ্যামলী কি সুভাষের বোন? সুভাষের বাড়ী আমার যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। তথাপি শ্যামলীর সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। তবে শুনেছিলাম ওদের বংশের একজন মেয়ে মামাবাড়ী থেকে পড়াশুনা করছে। শ্যামলীর কথা সুভাষ মাঝে মাঝে বলতো, কিন্তু চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেনি। তখনকার মতো নিজেকে সংযত করে শ্যামলীদি যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তা বিস্তারে প্রকাশ করলাম। তারপর আমাদের দুজনের পতিতা বৃত্তির জন্য ঘৃণ্য পথে নেমে আসার কথা গোপন রাখলাম না।

আমার কথা শুনে দেবীদাস গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। ঈশ্বরের নিকটে শ্যামলীদির সহজ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করলাম। এই বর্তমান যুগে অর্থবল থাকলে নিশ্চয় খুনীকে বাঁচাতে পারা যায়। সঠিক প্রমাণ হলেও কেস হালকা করা যায় যদি উকিল ঠিক মতো প্রমাণ করতে পারেন। শ্যামলীদি খুন করলেও সেই খুনের পিছনে যুক্তিপূর্ণ কারণ আছে। যেহেতু সমাজ বিরোধীদের প্রশ্রয় দিলে সমাজে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। এ প্রসঙ্গে দেবীদাসকেও নির্দোষী বলা চলে না। তবুও ওর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা আমার সাধ্যাতীত।

কারণ পাঠক / পাঠিকার নিশ্চয় অভিজ্ঞ যে, কি কারণে দেবীদাসকে আমি শত্ৰু বলে অভিযুক্ত করতে পারিনি।

সহস্র বেদনা দুঃখকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকার পর বিকেলে দেবীদাসের সাথে শ্যামলীদির কারাকক্ষের কাছে উপস্থিত হলাম। ভাবতে পারিনি শ্যামলীদিকে এতোখানি হর্ষোৎফুল্ল দেখবো। তার মানসিক দূর্বলতার কোন চিহ্ন লক্ষ্য করলাম না। অসীম ধৈর্য্য ও দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে সে কারাবাস করছে।

এইরূপ মানসিক স্থৈর্য সাধারণতঃ লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু আমি নিজের চোখকে সংযত করতে পারলাম না। আমার এ অবস্থা দেখে শ্যামলীদি হাসি মুখে বলল, এতে কাঁদবার কি আছে? তুই বিশ্বাস কর পদ্মা আমি খুব সুখে আছি। ঐ বারাঙ্গনার প্রাসাদের চেয়ে কারাকক্ষে অনেকখানি শান্তির পরিবেশ বিরাজ করে। অতি সুন্দরভাবে আমার দিন কেটে যাচ্ছে। মনে কোন গ্লানি বা সংশয় আসেনি। এখানকার বিষাক্ত নিঃশ্বাস আমার মনকে কলুষিত করেনি। এখন কোথায় আছিস ?

দেবীদাসের পানে তাকিয়ে জানিয়ে দিলাম তার আশ্রয়ে আছি বাকি কথা আর বলতে হলো না, আভাসেই বুঝে নিলো। শ্যামলীদি দেবীকে কাছে ডেকে ওর হাত দুটো ধরে কাতর অনুরোধ করল, আমার মতো হতভাগিনী পদ্মাকে ও যেন দূরে সরিয়ে না দেয়।

দেবীদাস ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলো সে তার কথা রাখবে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024