স্বাধীনতার নব- উদযাপন - দেবপ্রিয় দাশ || গল্প - Story || ছোটগল্প - Short story

 

স্বাধীনতার নব- উদযাপন


দেবপ্রিয় দাশ



রনীতা সিদ্ধান্ত নিল যে তার নিজের দেওয়া শর্তে রাজি হলে তার ফ্ল্যাট নিতে কোন আপত্তি নেই। দু কামরার ফ্ল্যাট, যার একটা ঘরে গড়ে উঠবে দাদুর স্মৃতিবিজড়িত এক অসাধারণ মিউজিয়াম। প্রমোটার অভিষেক প্রামানিককে প্রস্তাব দিতেই সে একবাক্যে সম্মতি দিল। আর কোন সমস্যা রইল না।

     রনীতাদের দীর্ঘদিনের পুরনো বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর শহরের উপকন্ঠে। বাড়ির বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে চলল। রনীতার দাদু ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী তৈরি করেন এই বাড়ি। প্রশস্ত স্থানে যা প্রায় অট্টালিকার মত। প্রথম থেকেই আদি জমিদার বংশের বাড়িতে রনীতারা জয়েন্ট ফ্যামিলির মধ্যেই ছিল। একাধিকবার মেরামতিও হয়েছে এই বাড়ি। দাদুকে নিয়েই যথেষ্ট গর্ব ছিল রনিতার। তিনি ছিলেন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি ছিলেন নাতনি অন্ত প্রাণ। রনীতাও দাদু বলতে অজ্ঞান। তিনি উদ্বুদ্ধ হন বিপ্লবের মন্ত্রে। ঋষি অরবিন্দের বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে অরবিন্দ ঘোষকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। ধরা পড়ে কারাবরণও করেন। ব্রিটিশরা জেলে তার উপর নির্মম অত্যাচার করলেও তিনি সবকিছুর স্বীকারোক্তি করেন নি।

      স্বাধীনতার কয়েক বছর পর দাদু এই বাড়ি বানান । পুরনো পেশা বইয়ের ব্যবসায় আবার ফিরে আসেন। এছাড়া হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারিও করতেন। পরে রনিতার বাবা তিনতলাটা বানান। এই বাড়ির প্রতি আত্মিক টান তাই খুব বেশি অনুভব করে রনীতা। ছোটবেলায় কয়েক বছর সে দেখেছে যে দাদু বছরের দুই দিন 15 ই আগস্ট ও 26 শে জানুয়ারি বাড়ির ছাদে পতাকা তুলতেন। এক বিশেষ পরিকল্পনা নিতেন দাদু। পাড়ায় সবার বাড়ি গিয়ে বলে আসতেন যে তারাও যেন সকাল সাড়ে এগারোটায় যে যার ছাদে ওঠে। দাদু নিজের ছাদে পতাকা তুলে গর্জে উঠতেন 'জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম' ধ্বনি দিয়ে। সেই ধ্বনি শোনার পরই এলাকার সব বাড়ির বাসিন্দারা তাদের ছাদ থেকে একই ধ্বনিতে সমস্বরে গর্জে উঠত। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে দাদুকে সবাই শ্রদ্ধা করত। পাশের পাড়াও যোগ দিত এই ভারত বন্দনায়।

     দাদু মারা যাবার কয়েক বছর পর থেকেই পরিবারে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিল। রনিতার কাকা বাইরে চলে গেলেন। তার দুই ছেলেরা ব্যাঙ্গালোর ও হায়দ্রাবাদে সেটল করে গেল। রনিতার বাবাও মারা গেছেন, মায়ের আগেই অকালমৃত্যু হয়। এক বিধবা পিসির সাথে রনীতা থাকত এ বাড়িতে। তিনিও সম্প্রতি গত হলেন। রনীতা বর্তমানে বিবাহিতা তবে চাকরির সূত্রে এখানে থাকে ও মাঝেমধ্যে তার বরের সাথে আসানসোলে কাটায়। রনীতা নিজে একটা কলেজের নন টিচিং স্টাফ। বর্তমানে পিসির ছেলেও বদলি হয়ে ঝাড়খণ্ডে গেছে। রনিতার একার পক্ষে এত বড় বাড়ি সামলানো সম্ভব নয়। একা থাকা নিরাপদও নয়। দাদারা প্রস্তাব দিয়েছে বাড়ি দিয়ে দেবে প্রমোটারকে। ফ্ল্যাট হলে নিজেরা একটা নেবে। পিসির ছেলেও সস্তায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিতে চায়। রনীতা বুঝেছে এটাই বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত কিন্তু তার অন্তর এতে সায় দিচ্ছে না। দাদু বা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর সাধের বাড়ি গুঁড়িয়ে ফ্ল্যাট উঠবে এটা তার কাছে বেদনাদায়ক মনে হচ্ছে ! সোজা কথায় হাজারো মধুর স্মৃতিতে ভরা এই বাড়ির চিন্হ মুছে যাক এটা সে মানতে পারছিল না।

    এমতাবস্থায় রনিতার স্বামী স্বপন একটা প্রস্তাব দিল - বলল -"একটা কাজ করো, ফ্ল্যাট তৈরি হোক। হলে বরং আমাদের নিজেদের একটা ভাগ হবেই, সেখানে একটা বড় ঘরে দাদুর সব ব্যবহৃত জিনিসপত্র সাজিয়ে আমরা বরং একটা মিউজিয়াম গড়ে তুলব। দাদুর স্মৃতিবিজড়িত সেই যাদুঘর আমাদের প্রতিবেশী ও পরিচিতরা আমাদের উপস্থিতিতে দেখতে পারবে। মিডিয়াকেও জানানো যাবে। " রনিতার মনে অবশ্য এই প্রস্তাব নাড়া দিল। বলল -" তা অবশ্য করাই যায়। এতে আমার আপত্তি নেই।" স্বপন বলল - 'প্রমোটারকে ফোনে জানাও, রাজি হবেই।'

     দুর্গাপুর শহরে বছর দশেক আগেও প্রমোটারির এত রমরমা ছিলই না। পরে মানুষের চাহিদা বাড়ায় এই ব্যবসা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রমোটার অভিষেক প্রামানিক রনিতাদের পাড়ারই ছেলে। রনিতার চেয়ে তিন বছরের বড়। এ লাইনে কয়েক বছর হল এসে সুনাম পেয়েছে। সবার পূর্বপরিচিত, তাই ধরে নেওয়া যায় কাজটা ভাল করবে। রনীতা অভিষেককে ফোনে এই পরিকল্পনা জানাতেই সে একেবারে লুফে নিল। বলল --' আরে তুমি তো একেবারে কারেক্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছ। মিউজিয়াম করলে তো খুবই ভাল হয়। চিন্তা নেই, দাদুর জন্য একটা ঘরে মিউজিয়ামের মত স্ট্যান্ড, শেলফ, গ্যালারি সবকিছুই বানিয়ে দেব। যেমন চাইবে তেমনি হবে।" রনিতা বলল - " বেশ তাহলে আমাদের ফ্ল্যাট নিতে কোন আপত্তি নেই। আমাদের রান্নাঘর দরকার নেই , প্রয়োজনে বাইরের খাবার কিনে খাব। বরং একটা ঘর বড় মাপে বানিয়ে তাতে গড়ে তুলব মিউজিয়াম"। অভিষেক খুশি হয়ে বলল-" ভেরী গুড, বিশিষ্ট কাউকে এনে উদ্বোধনও করাতে পারি যদি তুমি চাও। "-- "ওকে থ্যাংকস।" - দরকারে তাই করা যাবে।" জবাব দিল রনীতা।

     দাদাদের এ সুখবরটা দিল রনীতা। দাদারাও ফ্ল্যাট পাবে বলে খুশি। বাকি ফ্ল্যাটগুলো প্রমোটার নিজের মত বেচবে। কোন সমস্যা নেই। যথারীতি আয়োজন শুরু হল। সামনের মাসেই বাড়ি ভাঙা শুরু হবে। জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলার মূল দায়িত্ব রনিতারই। অভিষেক একটা বাড়ি ভাড়া করে দিল। সেখানে রনীতা আর স্বপন মাঝেমধ্যে থাকবে। মালপত্র গোছগাছ শুরু হয়েছে। সব ভাড়া বাড়িতেই শিফট হবে । অভিষেক ফোন করে জানতে চাইল - 'কবে সম্পূর্ণ প্যাকিং করতে পারবে ?" রনিতা উত্তর দিল -" সামনের মাসের সেকেন্ড উইকে। মাল উঠিয়ে নেবার সময় একটা লরি ও লোকলস্কর পাঠিয়ে দিও"। -- "নিশ্চই, সে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। মাল খালাসের লোক রেডি আছে। পাঠাবার দুদিন আগে ফোনে জানাব।" -- "ওকে থ্যাংকস"

    দাদারা বাড়ি ভাঙার পর ভিতপুজোর দিন আসবে। তাদের বাকি মালপত্র রনিতার তত্বাবধানেই খালি হবে। রনিতা প্যাকিং শুরু করে দিল। স্বপন দুদিন তাকে হেল্প করে গেল। টুকটাক হাবিজাবি মাল বেচেই দিল।

      নিজের ঘর সেরে ঢুকল দাদুর ঘরে। এখানকার প্রায় সব জিনিস মিউজিয়ামের জন্য ভালভাবে প্যাক করতে হবে। কাজের চাপে ক্লান্ত অবসন্ন হয়েও সেকাজ করতে লাগল রনীতা। প্রথমেই দাদুর কাঁচের আলমারি থেকে পুরনো বইপত্র ও জামাকাপড় বের করে বস্তাবন্দী করল। এরপর কলম, ছাইদানি, লাঠি, ছুরি, চিরুনি, টুপি ইত্যাদি আলাদা ব্যাগে ভরল। এরপর দাদুর খাট থেকে বালিশ, তোষক, কাঁথা বের করে মেঝেতে নামাল। ভালভাবে খাটের কাঠের পাটাতনের উপর তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হল। খাটের বাম ও ডান পাশে তো দুটো গোল রিং বা আংটা লাগানো আছে। দুটো পৃথক অংশ পাশাপাশি আছে।

      সে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝল যে এটা তো আদতে box খাট। কিন্তু সেযুগে বক্স খাটের তো কোন অস্তিত্বই ছিল না। আজকের দিনে ঘর ছোট থাকলে বক্স খাট করে তাতে জিনিসপত্র রাখতে হয় লোককে। দাদুর বিছানায় এই ব্যবস্থা তো অবিশ্বাস্য ! সে বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝল এ আসলে বিশেষভাবে তৈরি করা খাট যাতে ব্রিটিশদের নজর এড়াতেই গোপনীয় মালপত্র লুকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে। বাড়িতে পুলিশের রেড হলে যাতে জানা না যায় তাই এই আয়োজন। জরুরি কাগজপত্র বা অস্ত্রশস্ত্র লুকনো থাকত। ডানদিকের পাটাতনের আংটা তুলে সেটা দাঁড় করল দেয়ালে ঠেকিয়ে। এতে অবশ্য মামুলি ব্যাগ ও দড়ি ছাড়া কিছুই মিলল না। এবার বামদিকেরটা তুলতেই চোখে পড়ল কিছু অমূল্য সম্পদ। একটা ভগবদগীতা, একটা ফটো এলবাম আর ওনার নিজের হাতে লেখা একটা ডাইরি। একইসঙ্গে ভারতের এক জাতীয় পতাকা। পতাকাতে মাঝে চরকার ছবি রয়েছে। এর নিচের ডান দিকের কোনে লেখা 1947। অর্থাৎ স্বাধীনতার বছরেই। তখনও চরকাই ছিল পতাকায়। রনীতা অবাক হয়ে ভাবল এই সম্পদের অস্তিত্বের কথা দাদু একবারও তাকে জানায়নি কেন ? গোপন করে গেছেন। এলব্যাম খুলে দেখল বেশ কিছু পুরনো সাদা কালো ফটোগ্রাফ। চার পাঁচটা ফটোতে দাদুর সঙ্গে ঋষি অরবিন্দকে দেখা যাচ্ছে। অরবিন্দ সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পাবার পরই হয়ত এগুলো তোলা হয়েছিল। জীবনের শেষ লগ্নে তো তিনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। ডায়েরির পাতা ওল্টাতে গিয়ে সে হারানিধির সন্ধান পেল। দেখল দাদুর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আছে। তাঁর বৈপ্লবিক কাজকর্মের ইতিহাসের টুকরো কথা লেখা রয়েছে। গোপন মিটিং, একে অপরকে খবর পৌঁছে দেয়া, গোপনে ব্রিটিশদের উপর নজরদারি ইত্যাদি এতে লিপিবদ্ধ। এই মহামূল্যবান সম্পদ মিউজিয়ামে রাখার পক্ষে একেবারে আদর্শ ! একটা দূরবীনও পাওয়া গেল।

      ডায়েরির শেষ পাতায় কয়েকটি কথা লিখেছেন দাদু। এর তারিখ দেখা গেল 2010 সালের মে মাসে। অর্থাৎ এটাই একমাত্র সাম্প্রতিক কালে লেখা। বাকি সব পুরনো। এতে লিখেছেন -- "এই খাটের গোপন কুঠুরিতে যা আছে তা আমি কাউকে জানাইনি। জানাজানি হলে বহু লোক দেখার আবদার করবে, হারাবারও ভয় আছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি আমি আমার নাতনি রনীতাকে সব জানিয়ে যাব। বয়স হয়েছে, আর বেশিদিন বাঁচব না। রনীতাকে বলব ও যদি এইসব অমূল্য ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত জিনিস দিয়ে কোন মিউজিয়াম করে তাহলে তা হবে সর্বোত্তম। স্বাধীনতার 75 বছর পূর্ণ হবার পর যদি তা সম্ভব হয় তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে বেশি। পরিচিতরা এ মিউজিয়ামের দর্শন করবে, মিডিয়াও খবর কভার করবে। সামনের বছরই আমার নিজের জন্মদিনে নাতনিকে সব জানাব।"

       আনন্দে চিকচিক করে উঠল রনিতার দুই চোখ, দাদুরও একই স্বপ্ন ছিল। এখুনি স্বপনকে খবরটা জানাতে হবে কারন ওই তো জাদুঘরের প্রস্তাব দিয়েছিল। সে বুঝল দাদু ঠিকই জানাতেন সবকিছু কিন্তু আকস্মিক হার্ট এট্যাক হওয়ায় পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হলেন নিজের পরবর্তী জন্মদিনের আগেই। সব দ্রুত প্যাকিং করল রনীতা।

      অবশেষে ফ্ল্যাট উঠল মাথা উঁচু করে। প্রায় দু বছর লাগল। স্বাধীনতার 75 বছর পূর্ণ হয়ে গেল। পরিবারের সব সদস্যরা মিলে সাজিয়ে তুলল মিউজিয়াম, নেতৃত্বে রনীতা। সে আর বর স্বপন সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এল যে এই ফ্ল্যাটে এবার থেকে স্বাধীনতার নব- উদযাপন হবে। দাদুর মতনই ছাদে উড়বে জাতীয় পতাকা। জয়ধ্বনি উঠবে - 'জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম'। গোটা পাড়াও একই সময়ে যে যার ছাদে উঠে তুলবে সেই জয়ধ্বনি। মিউজিয়ামের উদ্বোধন হয়ে যাবে আগেই। সবাই রনিতার উপস্থিতিতে দর্শন করতে পারবে দাদুর অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ- সংগ্রহ। বছরে 15 ই আগস্ট ও 26 শে জানুয়ারি ছাড়াও বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা যাবে জাদুঘর। মিডিয়াও ডাক পাবে।

     কালজয়ী হয়ে উঠবে দাদুর অবদান ও স্বপ্ন। স্বাধীনতার নব - উদযাপনে সবই হবে মুখরিত।

 


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024