Sunday, September 5, 2021

Poet Soumendra Dutta Bhowmick's one poem

 SOME CHIC BIRTH



Superfluous prettiness places an erotic weather

Escapism is not facile for the cavemen.

Rather that raffish attraction accompanies like

A faithful crane!

In the vastness I’m hanging like a bat,

A delicious recipe comes in intimate passion,

In a few moments the entity gets lost.

The tasty preparation in oneness then prefers

Nothing except a Golden Opportunity for bravado.

Such reticent occurrence is no doubt prevalent

In the creative world under an eternal shadow!

প্রাবন্ধিক তৈমুর খান -এর একটি প্রবন্ধ

 জসীমউদ্দীনের কবিতা: হৃদয়বেদ্য মানবপরিধির আবেগভাষ্য




 জসীমউদ্দীনের প্রতিভা এই বাংলার এই বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে আবেগ নিয়ে বাঙালি জন্মায়, যে আবেগ নিয়ে তার জীবনযাপন করে—সেই আবেগকেই জসীমউদ্দীন কবিতায় রূপ দিয়েছেন। তাই তাঁর কবিতার মধ্যে বাঙালির প্রেম, বাঙালির বিরহ, বাঙালির স্বপ্ন, বাঙালির অভিমান, বাঙালির ক্রোধ সবমিলিয়ে বিছানো আছে বাঙালিরই হৃদয় প্রপাত। বাঙালিরই ঘর-সংসার। তবু সমস্ত বাঙালির সুখের আয়োজনেই এক করুণ সুর শুনতে পাই—যা প্রচন্ড মর্ম বিদারক। কখনও আমজনতার ভেতর কারও কারও চোখে জল এনে দেয়। যে বাস্তব বিষয়গুলি আমরা লক্ষ করি না, যে সব দুঃখ প্রাত্যহিকতার ধূলামলিনে চাপা পড়ে যায়, যে তুচ্ছ ঘটনার ভেতর আমরা দীর্ঘশ্বাস শুনেও শুনি না— জসীমউদ্দীন সেসবই আমাদের কাছে তুলে ধরেন। ঘাসের ডগায় শিশির চিরন্তন সৌন্দর্যে ঝলকিত হয় ঠিকই, কিন্তু তা বহু দৃষ্ট, বহু ব্যবহৃত। তেমনি মানব সমাজে নর-নারীর আকর্ষণ, প্রেম-বিরহ বহু লিখিত, বহু পঠিত। রাধাকৃষ্ণের ধারায় আমরা চিরকাল স্নাত। তবু সেইসব বিষয়, স্বপ্ন-মধুর-হাহারোল জসীমউদ্দীনের কাছে এসে ভালো লাগে। আরও সহজ ও সুন্দর মনে হয়। আবেগ যে পুরনো হয় না এবং প্রাণ প্রয়োগে যে সমৃদ্ধ তা তিনি দেখিয়েছেন। এর মূলে আছে মানবজীবন সম্পর্কে এক অতি সূক্ষ্ম অথচ গভীর দৃষ্টি। অতি সাধারণ গ্রাম্য কথার ভেতর দিয়ে কাহিনি বলার ভঙ্গি। তার সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংশ্লেষণ। মানব জীবনের কতকগুলি মৌলিক প্রবৃত্তিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তা যতই প্রাচীন হোক, তা যতই স্থূল হোক। কিন্তু তা-ই নতুন করে আসে নতুন জীবনে। 'রাখালী' কবিতায় গাঁয়ের রাখালেরও তাই হয়েছে। গাঁয়ের মেয়ের প্রেমে পড়ে তার অনুরাগ:


 'রাঙা দুখান পা ফেলে যাও এই যে তুমি কঠিন পথে,


 পথের কাঁটা কতকিছু ফুটতে পারে কোনোমতে।'


আবার বিরহও শুনতে পাই:


 'কোথায় জাগো বিরহিনী ত্যাজি বিরল কুটিরখানি,


 বাঁশির ভরে এসো এসো ব্যথায় ব্যথায় পরান হানি।'


    এই অনুরাগ, এই বিরহের লৌকিক কাহিনি নিয়ে তাঁর 'নকসী কাঁথার মাঠ', 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' বিখ্যাত প্রণয় উপাখ্যান। সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরতে, প্রণয়লীলার ক্রমবিকাশকে মননশীলভাবে গতিময় করে তুলতে, সেইসঙ্গে এক বৃহৎ ট্রাজেডির মধ্যে টেনে নিয়ে যেতেও কবি সক্ষম হয়েছেন। চেতন মনের বিবৃতিধর্মী কাহিনির ভেতর দিয়েই তিনি পাঠককে পৌঁছে দিয়েছেন হৃদয়ের রাজ্যে, অশ্রুজলের রাজ্যে। বাংলার করুণ পাড়াগাঁয়ের রূপ-মাধুর্যের এক অকৃত্রিম ছবি, সেই সঙ্গে মানুষও। হয় তারা রাখাল, নয়তো চাষি, নয়তো নিরক্ষর নর-নারী। তারা চাষ করতে জানে, ফসল কাটতে জানে, ফসলের বোঝা বয়ে আনতে জানে। আবার বাঁশিও বাজাতে জানে, কাঁথায় ফুলও তুলতে জানে, গানও গাইতে জানে। কাজকর্মে তাদের দিন যায়। আরাম বিলাস বলে কিছু নেই:


 'খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা,


 সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিইনেক' বসা।'


                               (রাখাল ছেলে)


 গ্রামের মানুষের কাছে যেমন কাজ-কর্ম সত্য, জীবনের রোমান্স মধুর গান গাওয়াও সত্য। ঠিক তেমনিভাবে বুকের গোপন ব্যথা লুকিয়ে ফেলে কান্নাও সত্য। তারা যেমন ঈশ্বর বিশ্বাসী তেমনি ধর্মভীরু। তেমনি স্নেহ-মমতায় অভিষিক্ত। আমাদেরই কেউ তারা। তাদের আমরা ভালো করেই চিনি, ভালো করেই জানি। একদিন স্নেহ-মমতার টানে সংসারে আপনজনদের তারা আঁকড় ধরে রাখতে চায়। ভালোবাসতে চায়। রবীন্দ্রনাথের 'যেতে নাহি দিব' কবিতার মতোই তাদেরও ইচ্ছে জাগে:


 'যেতে আমি দিব না তোমায়'


 তারপরও পরাজয় মানতে হয়:


 'তবু যেতে দিতে হয়'


 'কবর' কবিতায় দাদু নাতির কাছে সে কথাই ব্যক্ত করেছেে। একে একে স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ, নাতনি, কন্যা সবাইকে কবরস্থ করার কারণে:


 'তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি,


 যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।'


      এই বেদনার রাগিনী জসীমউদ্দীনের অধিকাংশ কবিতারই স্বরলিপি। কিন্তু একটা কথা ভুললে চলবে না—তিনি এইসব লৌকিক জীবনের ব্যথা-বেদনার অন্তরালে মাটি-মা-মানুষের গান গেয়েছেন। কবির কাছে জন্মভূমি বারবার বড় হয়ে উঠেছে। জন্মভূমির মাটি কবির প্রাণ। জন্মভূমি কবির মা। তাই তাঁর কাব্যের সকল চরিত্রই বড় সাধাসিধে। মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের রক্তে-ঘামে-মেধায়-মননে মাটির রস প্রবাহিত। তারা দেশকে ভালোবাসতে জানে। দেশের প্রতিটি বস্তুতে নিজেকে খুঁজে পায়। ধানগাছ, লাউ-কুমড়ো, শিম, মটরশুঁটি, নাড়া, মাঠের ফুল, কলমিলতা, পুঁইশাক, বেগুন, কিংশুককলি, কুসুমফুল, মটরশাক, শাপলাফুল, শালুক-পদ্ম, বাঁশঝাড়, ঘাস তাঁর কাব্যের উপাদান হয়। কখনও এগুলি উপমা হিসেবে আসে নায়ক-নায়িকার রূপ বর্ণনায়:


 'বাঁশি বাজে আর নোলক যে দোলে বউ কহে আর বার,


 আচ্ছা আমার বাহুটি নাকি গো সোনালী লতার হার?'


 অথবা


 'ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল,


 সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল।'


                        (নকসী কাঁথার মাঠ)


    পল্লিজীবনের গাথাকাহিনি 'নকসী কাঁথার মাঠে' একদিকে আছে প্রেমিক রূপাই এবং অন্যদিকে যোদ্ধা রূপাই। তবু জুজুর ভয়ে সে দেশছাড়া হয়েছে, আত্মগোপন করেছে। তার ফলেই উভয়ের জীবনে নেমে এসেছে বিচ্ছেদ কিন্তু প্রেমের জয়ই সেখানে ঘোষিত হয়েছে। কারণ রূপার হাতের লাঠি মারাত্মকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে শুধু প্রেমের কারণেই। কাব্যের শেষে রূপার মৃত্যুতেও আছে প্রেমের ঘোষণা। সুচারু শিল্পবোধের সঙ্গে যন্ত্রণার রূপকার কবি বেশি মরমী হয়ে উঠেছেন। 'সোজন বাদিয়ার ঘাটে'ও এ চিত্র দেখতে পাই। দুলি ও সোজনের প্রেম। ভিন্ন জাত, ভিন্ন সম্প্রদায় হয়েও তারা সমাজ-ধর্মের তোয়াক্কা করেনি। এমনকী কঠিন কঠোর শাস্তি মৃত্যুকে উপেক্ষা করেছে। তারা এক বাস্তব জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে পৌঁছেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুলির জীবনেও নেমে এসেছে বিরহ। সে সাজুর মতো নকসী বোনেনি, ছবি এঁকেছে। প্রকৃতির ছবি। সোজন জেল খেটে ফিরে এসে তাকে পায়নি। পরে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পূর্ণতায় পৌঁছে গেছে। নিতান্ত মানবিকতা বোধেই কবি চালিত হয়েছেন। কোনও তত্ত্ব নেই, তথ্য নেই। জীবনের ক্ষুৎপিপাসা। স্বপ্ন। ভাঙচুর। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দলাদলি। প্রেম, মন নিয়ে খুব সাধারণ আর বাস্তবমুখী ঘটনার সন্নিবেশে কবি জীবনকেই বড় করে দেখেছেন। যৌনতা নয়, কোনো রাজনৈতিক মতবাদ নয়—আবহমান কালস্রোতের মানবচরিত্রের কথাই তাঁর কাব্যের উৎসভূমি। মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়ই সেখানে প্রধান। যুক্তি নয়, আবেগই সেখানে সম্বল। 'কবিতা'য় কবি বলেছেন:


 'হৃদয়ের ফুল আপনি যে ফোটে কথার কলিকা ভরি,


 ইচ্ছা করিলে পারিনে ফোটাতে অনেক চেষ্টা করি।


 অনেক ব্যথার অনেক সহার, অতল গভীর হতে,


 কবিতার ফুল ভাসিয়া যে ওঠে হৃদয় সাগর স্রোতে।'


      অতএব তাঁর কবিতায় মানবিক আবেদনটাই মুখ্য। হৃদয়ের পরিধিতেই তাঁর অনুভূতিকে সীমাবদ্ধ করা যায়। জটিল জীবনদর্শনের কোনও শাশ্বত প্রশ্নের অনুসন্ধান তিনি করেননি। তিনি জীবনের ভাসান দেখেছেন, জীবন-অন্ধকারের ভেতর ডুব মারেননি। সুতরাং লোকসাধারণের কাছ থেকে তিনি অবশ্যই আদরণীয়, কিন্তু গভীর ও গম্ভীর পাঠকের কাছে তিনি ততটা প্রেরণার উৎস নন। পল্লিকবি, পল্লিপ্রেমিক হিসেবে তিনি নিজের আসনটি দখল করেই রয়ে গেছেন। উত্তরণের কোনও পর্যায় সৃষ্টি করে যাবার চেষ্টা করেননি।

প্রাবন্ধিক রামপ্রসাদ সরকার -এর একটি প্রবন্ধ





 “পহেলা প্রহর মে সবকই জাগে

দোসরা প্রহর মে ভোগী

তিসরা প্রহর মে তস্কর জাগে

চৌঠা প্রহর মে যোগী।”

সুসাহিত‌্যিক শ্রদ্ধেয় রমাপদ চৌধুরীর ‘প্রথম প্রহর’ উপন‌্যাসটি থেকে ওপরের উদ্ধৃতিটুকু দিলাম। লেখকের শৈশব, কৈশোর যে যে রেলওয়ে শহরে কেটেছে, আমারও জন্ম, শিক্ষা সবই সেই শহরে। যেখানে আমার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা সেখানের সেই সময়ের সুখ-দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ আপনাদের শোনাবো।

আমাদের ছেলেবেলা ছিল কতশত স্বপ্নের রঙে রঙিন। দুর্গা পুজো একটা আলাদা গন্ধ, ভিন্ন মাদকতা নিয়ে আসত আমাদের কাছে। বাবা-কাকারা রেলওয়ের বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। সমাজসেবা তাঁদের জীবনের মূল মন্ত্র ছিল। বাবা-কাকা আর তাঁদের সতীর্থদের উদ‌্যোগে আমাদের রেলওয়ে কলোনীর পাড়ায় প্রথম দুর্গা পুজো শুরু হয়।

প‌্যান্ডেল বা প্রতিমার জাঁকজমকের চেয়ে পুজো-উপচারের প্রতি সবারই দৃষ্টি সজাগ থাকতো। মায়ের পুজোয় কোথাও যেন কোনও ত্রুটি না হয়। দেবীর বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত পুজো পরিচালনার ভার যাদের ওপর থাকত-তাদের সর্বদাই তটস্থ দেখতাম। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে সন্ধিপুজো, বলিদান হতো।

আজ বয়োপ্রান্তে এসেও পুজোর ক’টা দিন ভোরবেলায় ফুল তুলতে যাবার সেই পুরনো ডাক যেন শুনতে পাই। কবিগুরুর ভাষায় “পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে মোরে...।”

আমাদের ছেলেবেলায় এখনকার মতো বাজারে অঢেল ফুল কিনতে পাওয়া যেত না। তাই তো রাতের শেষ প্রহরে পুজো প‌্যান্ডেল থেকে মাইকে ঘোষণা করা হতো—

“ফুল তোলার সময় হয়ে গেছে। খোকা-খুকুরা সব চটপট উঠে পড়ো, সাজি ভর্তি করে ফুল তুলে আনো মায়ের পুজোর জন‌্যে।” মাইকে বারবার এই ঘোষণা করা হতো।

পুজোর ক’টা দিন আমরা সারারাত প্রায় জেগে কাটাতাম। ভোরবেলায় মাইকের এই ঘোষণাটুকু শোনার অপেক্ষায় থাকতাম। তখনকার দিনে ঘরে ঘরে ফুল তোলার সাজি থাকতো, এখনকার মতো পলিথিন ব‌্যাগ নয়। অন্ধকার থাকতে থাকতে আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়তাম-এ গাছ, ও গাছ, এর বাগান, তার বাগান চষে ফেলতাম ফুলের জন‌্যে।

শিউলিতলায় ফুল কুড়ানোর ধুম বেশি করে পড়তো। গাছের তলা শিউলি ফুলে ভরে থাকতো, গাছ নাড়া দিলে টুপটাপ করে শিউলি ফুল ঝরে পড়তো। আমরা আঁজলা করে সে ফুল তুলে সাজি ভরাতাম। এছাড়া টগর, জবা, কাঞ্চন, কাঠচাঁপা, স্থলপদ্ম, অপরাজিতা, দোপাটি, মাধবলীতা তো থাকতোই। পুজো প‌্যান্ডেলে মায়ের সামনে তিন-চারটে বড় বড় ঝুড়ি রাখা থাকতো। আমরা ফুলগুলো সেই ঝুড়িতে ঢেলে দিতাম। দেখতে দেখতে নানান রঙের নানান গন্ধের ফুলে ঝুড়িগুলো ভরে উঠতো। আমাদের শিশু মনে এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ এসে জাগতো।

এখানে বলে রাখা দরকার, সে সময় আমরা সমবয়সি ছেলেমেয়েরা অবাধে মেলামেশা করতাম। একে অন‌্যের বাড়ি যেতাম। মা, দিদিমা, ঠাকুমার হাতের তৈরি মোয়া, নাড়ু, পিঠে-পায়েস খেতাম। কাজেই দুর্গা পুজোর ক’টা দিন আমাদের এই মেলামেশা এক নির্মল আনন্দ এনে দিতো সবার মনে।

পুজোর সব ক’টা দিনই আমরা পুষ্পাঞ্জলি দিতাম খিদে-তেষ্টার বালাই ভুলে। পুরুত মশাইয়ের উদাত্ত কণ্ঠে সংস্কৃত ভাষায় বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ আমাদের মনে ভক্তি রসের সঞ্চার করতো। মন্ত্রের মানে হয়তো তখন বুঝতাম না, তবু সে মন্ত্রগুলো কানে আজও ভাসে-

“আয়ুদ্দেহি যশো দেহি ভাগ‌্যং ভগবতী দেহি মে

পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্বান কামাশ্চ দেহি মে...

এষ সচন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি

ওঁ শ্রীশ্রী ভগবতী দুর্গা ঐ নমঃ।”

ভলেনটিয়ারের খাতায় আমরা সবাই নাম লেখাতাম। ভোরবেলায় ফুল তুলে আনার পর আমাদের ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হতো। এভাবে শুরু হতো আমাদের দিন। তালপাতার ঠোঙা বানানো, ফল কাটা, নারকেল কোরানো, প্রসাদ বিতরণ, তিনবার প্রসাদ দেওয়া হতো। সকালে ফল প্রসাদ, দুপুরে খিঁচুড়ি ভোগ, সন্ধ‌্যেবেলায় লুচি আর মোহনভোগ প্রসাদ। এছাড়া সন্ধ‌্যেবেলায় ঠাকুর দেখতে আসা মানুষদের ভিড় সামাল দেওয়া, কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে যেতো-আমরা বুঝতে পারতাম না।


।দুই।

আমাদের সময়টা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণালী যুগ। হেমন্ত, লতা, সন্ধ‌্যা, শ‌্যামল, তরুণ, আলপনা, প্রতিমা, উৎপলা, সতীনাথ, মানবেন্দ্র, দ্বিজেন, ধনঞ্জয়, পান্নালাল, তালাদ মামুদ, সুবীর, মান্না দে-এঁদের গানে আমাদের ভুবন ভরে থাকতো। পুজো প‌্যান্ডেলে এঁদেরই গান বাজানো হতো। হিন্দি গান একটাও না।

রেডিওতে তখন শনি ও রবিবারের দুপুরে অনুরোধের আসরের দুর্নিবার আকর্ষণ চলছে। সে সময় অনুরোধের আসরের অমোঘ আহ্বানে স্কুল, কলেজ, অফিস, দোকান, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো। প্রত‌্যেকেই দুপুর ১.৪০ মিনিট থেকে ২.৩০ মিনিট এই পঞ্চাশ মিনিটের জন‌্যে রেডিওর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতো। সে সব দিন ছিল বটে।

পুজোর দিনগুলোর মাঝে শনি ও রবিবার পড়ে গেলে মজার শেষ থাকতো না। দু’দিনের অনুরোধের আসরকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা হতো। সেদিনের অনুরোধের আসরে কোন শিল্পীর কোন গান বাজানো হবে তার সম্ভাব‌্য তালিকা পুজো কমিটির কাছে জমা দিতে হতো। মাইকে অনুরোধের আসরে বাজানো গানের শিল্পীর নাম এবং গান যার পছন্দের তালিকার সঙ্গে সর্বাধিক মিলতো-তাকে প্রথম এবং একমাত্র বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হতো। তাই পুজোর মাঝেও দু’দিনের অনুরোধের আসরকে ঘিরে সে কী উৎসাহ উদ্দীপনা সবার। বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর বিজয়া সম্মেলনীতে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হতো।

আজও সেই পুরনো দিনের গানের নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি।

বিজয়া দশমীর দিন সকাল থেকে আমাদের মনে বিষাদের রাগিণী বেজে উঠতো। পুজো প‌্যান্ডেলে এসে কতোবার যে প্রতিমা দেখে যেতাম, তা গুণে শেষ করা যেতো না। আর প্রতিবারই মনে হতো মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চোখ ছলছল করতো। সন্ধ‌্যেবেলায় ঢাকের কাঠিতে যখন বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠতো, ‘ঠাকুর থাকবে কতোক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’ তখন আমরা আমাদের কান্না চেপে রাখতে পারতাম না। সত‌্যি সত‌্যিই কেঁদে ফেলতাম। কান্নাভেজা গলায় সমস্বরে বলে উঠতাম, ‘আসছে বছর আবার হবে।’


।তিন।

‘পুরনো সেই দিনের কথা’ ভাবতে গেলে আরও কতো যে স্মৃতি এসে মনের মাঝে ভিড় করে তার আর শেষ নেই।

স্কুলে গরমের ছুটি পড়লে যতো সব দস‌্যিপনা শুরু হতো আমাদের। তাতে বাবা-কাকাদের আস্কারা কম ছিল না।

দুপুর হতেই ছিপ হাতে রেলওয়ের পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়া। ছিপ দিয়ে পুঁটি, বেলে কিংবা শোল মাছ ধরা। জোড়া বড়শিতে যখন জোড়া পুঁটি মাছ ধরা পড়তো, তখন আমাদের আনন্দের ইয়ত্তা থাকতো না। আর শোল মাছ ধরার জন‌্যে কি না করেছি। বড়শির মাথায় ছোট ছোট ব‌্যাঙ ধরে গেঁথেছি। আরশোলা ধরে শিশিতে ভরে রাখতাম। তাও বড়শির মাথায় গেঁথেছি। তাছাড়া গুগলি শামুক তো ছিলই। এ সবই শোল মাছ ধরার অব‌্যর্থ খাদ‌্য যাকে বলা হয় ‘চারা’।

রঙিন কাগজ আর ঝাঁটার কাঠি দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো। ভর সন্ধ‌্যেবেলায় আমরা বন্ধুরা যে যার লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিতাম, ঘুড়ি আকাশের দিকে যতদূর যায় চলে যেতো। এক সময় ঘুড়ি ছোট হতে হতে আকাশে মিলিয়ে যেতো। আমরা কল্পনায় আকাশের তারাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করতাম।

বছরে একবার গরমের ছুটিতে কাঁসাই নদীর তীরে চড়ুইভাতি করতে যেতাম দলবেঁধে। শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে। আমরা সাইকেলে যেতাম। পিকনিকের সব সরঞ্জাম সাইকেলে বেঁধে নিয়ে যেতাম। নদীতে স্নান করা, গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরা, বালির পাহাড় তৈরি করা-চড়ুইভাতির আনন্দকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতো।

বর্ষাকালে মাঠে ময়দানে ঘুরে ‘বীরবাবটি’ ধরে আনা, সবুজ কচি ঘাসের মধ‌্যে এরা ঘুরে বেড়াতো। সিঁদুরের মতো লাল টুকটুকে আর ভেলভেটের মতো নরম ছোট ছোট পোকাগুলো দেশলাই বাক্সে পুরে রাখতাম।

সরস্বতী পুজো হয়ে গেলেই বন্ধুরা মিলে সাইকেলে বেরিয়ে পড়তাম শহর ছাড়িয়ে বনে-বাদাড়ে টোপা কুলের সন্ধানে। কোচড় ভর্তি টোপা কুল পেড়ে আনতাম। কুল গাছের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, তবু কুল পাড়ায় ক্ষান্ত দিইনি। এমন ছিল আমাদের বাল‌্যকাল।

তাই আজ বয়োপ্রান্তে এসে ফেলে আসা স্মৃতি যখন মনের মাঝে ভিড় করে, ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ মনে পড়ে যায়, তখন আপন মনে বলি—

“পড়ে আছি আমি একা

বয়সের ভারে

ফেলে আসা স্মৃতিগুলো

কাঁদায় আমারে।

তবুও চায় যে মন

ফিরে পেতে প্রতিক্ষণ

বিগত দিনের সব

মধুর স্বপন।”

লেখক আশীষ কুন্ডু -এর একটি গল্প

 অশরীরী রহস্য



সত্যেশ আজকে মর্ণিংওয়াকে বেরিয়েছিলো একটু দেরীতে, রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো বিলুর বাবার সাথে। সত্যেশকে দেখতে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলেন। 

এই যে গোয়েন্দা প্রবর , শুনুন মশায়,একটু কথা ছিল ’-বিলুর বাবা মানে মনোহর বাবুকে একটু বিব্রত লাগে। 

বলে ফেলুন ,মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা জিনিসে ভয় পেয়েছেন’সত্যেশ হালকা ভাবে বলতেই হাত ধরে ফেললেন মনোহর বাবু।

‘আমার ভাইয়ের বাড়ীতে ভূতের উৎপাতে সকলে একদম তটস্থ হয়ে আছে, আপনি এর একটা প্রতিকার করুন । ’কাতরস্বরে আবেদন জানান মনোহর। 

“আমি তো ওঝা নই,- সত্যেশ বলে। 

নাছোড়বান্দা মনোহর বলে“ একটিবার আসুন আমার ভাইয়ের বাড়ী, তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেবেন। 

 তা মোটামুটি একটা রফা হোলো মনোহর বাবুর সাথে,সন্ধ্যাবেলায় ওনার ভাই অপরেশের ডেরায় উপস্থিত থাকবেন সত্যেশ। 

যা কথা তাই কাজ সহকারী প্রত্যুষকে নিয়ে বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর লেনের ৪নম্বর বাড়ীতে পৌছলেন সত্যেশ,সঙ্গে মনোহর । বাড়ীর সামনের লন পেরিয়ে বেল টিপতে একজন টাকমাথা দোহারা চেহারার ভদ্রলোক দরজা খুললেন। 

‘ ইনিই আমার ভাই’- পাশ থেকেমনোহর বলে উঠলেন। 


আসুন, আসুন- ভদ্রলোকের মুখে আশার আলো। 

ঢুকেই বৈঠকখানা ঘর চোদ্দ বাই বারোর। সুসজ্জিত । বসার অব্যবহিত পরেই এক ভদ্রমহিলা হাতে একটা ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। অপরেশ পরিচয় করিয়ে দেয়‘আমার স্ত্রী সুনেহা’ì

চা পর্ব মিটে যাবার পর অপরেশ শুরু করে“ আমি কোনো দিনই ভূত প্রেতে বিশ্বাসী নই,কিন্তু সম্প্রতি আমাদের বাড়ীতে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে , যার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই,”

কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে সত্যেশ বলে

“আপনি সরাসরি ঘটনাগুলো বলুন, ভূমিকা বাদ দিয়ে ”

একটু চুপ করে থেকে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বলতে থাকে ,“মাসখানেক আগের কথা ,অমাবস্যার এক রাত,রাত দশটা হবে,হঠাৎ করে লোডশেডিং হোলো, সুনেহা রান্নাঘরে খাবার গরম করছিলো। ইনভার্টারটা কদিন আগেই খারাপ হয়েছে। সারানো হয়নি। আসলে ইদানিং আমাদের এদিকে লোডশেডিং হোতো না। তাই তাগিদটা অনুভব করিনি। গিন্নি একটু ভীতু প্রকৃতির। জোরে চেঁচিয়ে ,রান্নাঘরে একটা মোমবাতি আর দেশলাই দিয়ে যেতে বললেন। আমি সেই মতো মোবাইলের টর্চের সাহায্যে একটা মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেখি রান্নাঘরে আগে থেকেই মোমবাতি জ্বলছে। একটু অবাক হয়ে গিন্নিকে বললাম, মোমবাতি এখানে আছে দেখছি, তবে শুধু শুধু আমাকে ডাকলে কেন?

 আমাকে হতচকিত করে আমার স্ত্রী ঝাঁঝের স্বরে বলে “তুমিই তো এখুনি মোমবাতি দিয়ে গেলে,আবারও একটা মোমবাতি এনে আমার সাথে কি হেঁয়ালি করছো ”। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে আমি বলি কি যা তা বলছ? আমি তো এই প্রথমবার এলাম। দুজনেই শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম নিশ্চয়ই বাড়ীতে চোর ডাকাত ঢুকে পড়েছে। হাতের কাছে টর্চ ছিলো, গিন্নি আবার একটা খুন্তি নিয়ে আমার সঙ্গে এগোলো। সদর দরজা দেখলাম ভিতর থেকে বন্ধ । তবে কি চোর ঘরের ভিতরে লুকিয়ে ?সবে দরজার দিক থেকে ঘুরে ড্রয়িংরুমের দিকে টর্চ্লাইটের আলোটা ঘুরিয়েছি, ওমনি ড্রয়িংরুমের ঘড়িটা মাটিতে খসে পড়লো ঝনঝন করে। ভয়ে জিভ শুকিয়ে গেছে,কানের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে,সুনেহার হাত থেকে খুন্তি পড়ার ধাতব শব্দ আমার যেন বুকে এসে বাজলো। এই সময় হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে। তন্ন তন্ন করে সব কটা ঘর খুঁজেও, কেউ আমার বাড়ীতে ঢুকেছিলো এমন প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গেলো না সেদিন। ” এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক থামলেন। 


“তারপর” - মূল প্রসঙ্গে ফিরতে চায় সত্যেশ। 

“রাতটা ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে সকালে ছাতে গেলাম, দেখি ছাতের একটা জায়গা একটু খোঁড়া মতো, আর একটু রক্তের ছিটে মতো পরে আছে। এই প্রসঙগে বলা ভালো রাত আড়াইটের পর ছাতের শব্দটা বন্দ হয়ে গেছিলো। ”

 কেউ বাড়ীতে ঢুকে পড়েছিলো এমন প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যায়নি ”এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক থামলেন। সত্যেশ ধৈর্য্য রাখতে পারে না“থামলেন কেনো , তারপরে কি হোলো?”

“ সেদিন উৎকণ্ঠায় রাতে ঘুম আসছিলো না, রাত দুটো হবে , শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, গিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ছাতের উপর একটা গুম্ গুম্ করে আওয়াজ হওয়া শুরু হয়ে গেলো,সেদিন বাড়ীতে ভাগ্নেও ছিলো না। বলা হয়নি ভাগনে রতীন আমার সাথেই থাকে। ও সেদিন ব্যবসার কাজে কুচবিহার গেছিলো। সাথে আমাদের পুরোনো চাকর নবীনকেও নিয়ে গেছে। 

 সত্যেশ প্রশ্ন করে, “এই বাড়ীতে আর কে কে থাকে?”উত্তরে অপরেশ বলে-


তলার ভাড়াটে , ফ্যামিলি মেম্বার চারজন,দু ভাই ,বাবা মা গত হয়েছেন। বড় বিবাহিত,স্বামী স্ত্রী, ছেলেপিলে হয়নি এখনো। আমার ভাই মনোহরকে তো আপনি জানেন, এখানে থাকে না, কিন্তু নিয়মিতভাবে আমার কাছে আসা যাওয়া করে। 

 অপরেশ বলে‘ আমার আর এক ভাই সমরেশ অনেকদিন আগেই গৃহত্যাগী হয়ে গেরুয়া ধারণ করেছিলো, সম্প্রতি কিছুদিনের জন্য বাড়ী এসেছিলো। ’

সত্যেশ জিজ্ঞাসা করে,‘আর কি কি ঘটেছে বলুন?’

অপরেশ বলে,‘এর দুদিন পরের ঘটনা -রাত দুটোর সময় ঘুমটা ভেঙে গেলো, নাইট বাল্ব জ্বলছিলো, ছাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ,একটা মুখ ছাত থেকে ঝুলে আমার দিকে তাকিয়ে , ভয়ংকর তার দৃষ্টি । গলা শুকিয়ে কাঠ। স্বর বেরোচ্ছে না। ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছি। 

 সত্যেশ বলে, আমি আপনার ভাগ্নের সঙ্গে কথা বলতে চাই। 

রতীন বাড়ীতে নেই, তবে কল করে দিচ্ছি,এসে যাবে। 

এমন সময় ঘরে ঢুকতে ঢুকতে এক যুবক বলে,‘মামা কি জন্য আমায় খুঁজছো?’

সত্যেশ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রতীনের দিকে,বেশ শক্তপোক্ত চেহারা ,ফরসা রং, চোখ দুটো বেশ সুন্দর , কিন্তু কোথাও একটা চালবাজের ছাপ স্পষ্ট । 

 তারপরের দিন রাত্রে আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো। রাত নটা হবে রাতের খাবার খাওয়ার তোড়জোড় চলছে। আমি আর ভাগনে কথা বলছি। লোডশেডিং হয়ে গেলো। অন্ধকারে চোখ সইয়ে ভাগনেকে আলো আনার কথা বলতে যাবো, এমন সময় কানের পাশে একটা বরফশীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত বইতে লাগলো। দূরে একটা পেঁচা কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো। চোখের সামনে অন্ধকার ,কানের পাশে কারা যেন ফিস্ ফিস্ করে কথা বলছে। দূর থেকে জল পড়ার আওয়াজ আসছে টুপ্ টাপ টুপ টাপ্। আমি কঁকিয়ে উঠে ডাকলাম ‘রতীন্-ন্’,ফ্যাসফেসে স্বরে ,নিজের গলা নিজেই চিনতে পারছি না। একটা নীল আলোর বলয় এগিয়ে আসতে থাকে ক্রমশঃ আমার দিকে। আমি জ্ঞান হারাই। 

 ভদ্রলোক বলে চলেছেন, এই তো কাল রাতে সবে শুয়েছি আমার গিন্নি দেখি গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে , নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখি খোলা জানলা দিয়ে কালো লোমশ একটা হাত বউয়ের গলা টিপে ধরেছে। মরিয়া হয়ে বালিশের পাশে থাকা টর্চ দিয়ে আঘাত করতেই হাত উধাত্ত । অথচ শোওয়ার আগে বেড সাইড জানলার ছিটকিনি আটকে শুয়েছি। কে খুললো আর কি করেই বা খুললো। 

 রতীন এবারে তাকায সত্যেশের দিকে। ‘এনাদের তো চিনতে পারলাম না। মডার্ন ওঝা বোধ হয়। ’ ব্যঙ্গের ছোঁয়া স্পষ্ট কথাতে। 

কথা ঘোরাতে অপরেশ বলে, ‘না, না ইনি একজন গোয়েন্দা ’। 

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে রতীন বলে, ‘গোয়েন্দা কি আজকাল ভূতও ধরছে। ’

 এবারে সত্যেশ বলে,‘ আগে তো এটা ঠিক হোক যে এটা ভূতের কারবার না মানুষের কারবার, তারপর না হয় দেখা যাবে। এবারে অন সীরিয়াস নোট রতীন বাবু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। ’

অপরেশের ইশারায় রতীনকে সংযত দেখায়। 

বলুন,কি জানতে চান?’

সরাসরি প্রসঙ্গে আসেন সত্যেশ-

আপনি কি এই বাড়ীতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন। প্লিজ শেয়ার মি। ’

হ্যাঁ দেখেছি আমি,একটা ছায়া মানে একটা চেহারাগতকাল রাতে আমার ঘরের আয়নায়। তার আগে একদিন মামার ঘরে আমি আর মামা কথা বলছি,’এই ঘটনাটা আমি বলেছি,বাধা দিয়ে অপরেশ বলে। 


 সত্যেশ বলে ওঠে,‘অপরেশ বাবুর অংশটা শুনেছি, কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতা উনি বলেননি,কারণ উনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। ’উত্তরে রতীন বলে-

‘আমি দেখলাম নীল আলোর বলয় আমাকে ঘিরে ফেলেছে,একটা অদ্ভূত বিটকেল গন্ধ নাকে লাগছিল,হাত পা শিথিল হয়ে এসেছিলো। মনে হতে লাগলো আমি শূন্যে ভাসছি। কারা সব নাকি সুরে বলছিলো,কেউ বাঁচবে না। কখন জ্ঞান হারাল জানতে পারিনি। 

 সুনেহা ওর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে একটা নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে আসে, বলে, যেদিন যেদিন এই ভূতুড়ে কান্ডগুলো ঘটে, সেদিনগুলোতে অপরেশবাবুর বাবার ফটোতে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। ফটোর মালা খসে পড়ে। ফটো একদিকে ঝুঁকে পড়ে। পরশুদিনের ঘটনা , সুনেহা রান্নাঘরে ,হঠাৎ একটা খট্ খট্ করে শব্দ শুনে বেরিয়ে দেখে ড্রয়িংরুমে শ্বশুর মশায়ের ব্যবহৃত খড়ম, যেটা বহুদিন ধরে স্টোররুমে রাখা ছিলো। 

 অথচ সেই মুহূর্তে বাড়ীতে কেউ ছিলেন না, সব চেয়ে বড় প্রশ্ন যে খড়মটা প্রায় ধূলিমলিন হয়ে স্টোরে ছিলো তাকে চকচকে করে রেখে গেলো সেদিন। এরপরে ডাক পড়লো নবীনের। সে নতুন কিছু তথ্য দিতে পারলো না। কিন্তু একথা জোর দিয়ে বললো এ বাড়ীতে ভূত আছে। 

 আচ্ছা মনোহর বাবু আপনি কিছু বলুন।”মনোহরের দিকে ঘুরে বলে সত্যেশ।


আমি আসি যাই এই পর্যন্ত ,আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয় কারণ ওইটুকু অল্পসময়ে কিছু ঘটেনি। ” মনোহর বলে। 

সত্যেশ প্রসঙ্গে ফিরতে চায়,“ অপরেশ বাবু আমাকে একটু বলুন তো এই ভূতুড়ে কান্ডগুলো কোনো বিশেষ দিন বা বারে হয়!”

চিন্তামগ্ন দেখায় অপরেশকে, তারপরে বলে ওঠে ,“শেষ তিনটে অমাবস্যার রাতে কিছু না কিছু ঘটেছে। তাছাড়াও অন্যান্য দিনেও ঘটেছে। ”এসব কথা যখন চলছিলো তখনই ঘটলো ঘটনাটা। 


  রান্নাঘরে সশব্দে থালা-বাসন পড়ার সাথে সাথে সুনেহার প্রবল চিৎকার শোনা গেলো“ বাঁচাও,মেরে ফেললো”

সব কিছু ছেড়ে সবাই মিলে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ালো রান্নাঘরে । গিয়ে দেখা গেলো সুনেহা ভিরমি খেয়ে পড়ে আছেন। সত্যেশও সেখানে পৌঁছে তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি চারিদিকে বোলাতে বোলাতে বলে, ওনার জ্ঞান ফেরানোর বন্দোবস্ত করুন। এরই ফাঁকে সত্যেশের দৃষ্টি আটকায় একটি জায়গায় । রান্নাঘরে এক্সহস্ট ফ্যানের পাশে একটা সাদা রংয়ের কিছু একটা ঝুলছিলো। সবার অলক্ষ্যে সত্যেশ সেটা সংগ্রহ করে নিজের পকেটে রেখে দেয়। জ্ঞান ফিরে এলে সুনেহা জানায়,রান্নাঘরে ঢোকার প্রায় সাথে সাথে সে দেখতে পায় স্ল্যাবের ওপর দাঁড়িয়ে এক কঙ্কাল । 

 সেই কঙ্কাল তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে দেখে ভয়ে সুনেহা জ্ঞান হারান । ততক্ষণে কঙ্কাল গায়েব। সব শুনে সত্যেশ একটু যেন চিন্তায় পড়ে যায়। অপরেশ জিজ্ঞাসা করে,‘কি বুঝছেন সত্যেশবাবু’। 

‘উঁ, বোঝার চেষ্টা করছি’-উত্তর সত্যেশের। “অপরেশ বাবু অমাবস্যা যেন কবে, পড়ছে ? আমি সেই রাতটা এই বাড়ীতে কাটাতে চাই। ”

মনোহর পাশ থেকে রলে“সে তো খুব ভাল কথা,চোখে দেখলে ,আপনি বুদ্ধিমান মানুষ কিছু না কিছু উপায় নিশ্চয়ই করতে পারবেন। ”

সেইমতো ঠিক হোলো আগামী শনিবার ৫মে অমানিশার দিন সত্যেশ সারারাত এই বাড়ীতে কাটাবে। এখনও একটা প্রাথমিক কাজ আছে, সেটা হোলো ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলা। নীচে নেমে কলিং বেল টিপতেই দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ভয়ংকর মুখ উঁকি মারলো। 

 প্রথমে চমকালেও অচিরেই সত্যেশ বুঝতে পারে এটা একটি শিশুর দুষ্টুমি , মুখোস পরে ভয় দেখাতে চাইছে সে। 

তোমার নাম কি? তোমার মুখোশটাতো দারুণ , মুখোশ পরে আছো কেন?

ছোটো শিশু উত্তর দেয়,’ভূতকে ভয় দেখাতে,আমার নাম সোহম’

তোমার বাড়ীতে বড় কে আছেন ডেকে দাও’- এমন সময় ভেতরের দিক থেকে মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসে,‘কে রে সমু?’

 এক সুন্দরী মহিলা এসে দাঁড়ান দরজার সামনে‘বলুন কাকে চান’। 

সত্যেশ বলে ,‘আমার নাম সত্যেশ, আমি একজন অনুসন্ধিৎসু ,মানে বিভিন্ন ধরনের রহস্য উন্মোচন করে থাকি’। 

সন্দেহের বিভিন্ন রেখা খেলা করে ভদ্রমহিলার মুখের পটভূমিতে। কিছুটা দ্বিধাজড়িত স্বরে বলেন,‘কিন্তু আমাদের তো সেইরকম কিছু ’--কথা শেষ করতে দিয়ে অপরেশ বলে,‘ না ম্যাডাম, ওপরে আমাদের ঘরে যেসব অদ্ভুত ভৌতিক ঘটনা ঘটছে সেই ব্যাপারে উনি একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান, উনি এর সমাধান করার দায়িত্ব নিয়েছেন,তাই আর কি!’

দরজা ছেড়ে এবার ভদ্রমহিলা বলেন,‘আচ্ছা ভিতরে আসুন’। 

 ঢুকেই ড্রয়িংরুম, বেশ ছিমছাম । ভদ্রমহিলা ওদেরকে বসতে বলে ভিতরে অদৃশ্য হলেন। অব্যবহিত পরে এক বছর পঁয়ত্রিশের ভদ্রলোক পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সরাসরি সত্যেশকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ‘বলুন কি জানতে চান, আমি সোমেশ ,এই বাড়ীর টেনান্ট। ’ তার পিছনে সোহম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। 

সত্যেশ সাবধানী ভাবে জিজ্ঞাসা করে,‘আপনি কি এই ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারেন?’ ভদ্রলোকের চোয়াল শক্ত হয়,কিন্তু সামলে নিয়ে বলেন,‘কি ব্যাপারে ?’ 

অপরেশ তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ‘ মানে আপনি এই বাড়ীতে ভূত টূত দেখেছেন কিনা বা কোনো অবিশ্বাস্য ঘটনার শিকার হয়েছেন কিনা ,এটাই জানতে এসেছেন উনি!’

‘ সরি, এরকম কিছু দেখিনি আমরা’-ভদ্রলোকের সপাট উত্তর। এমন সময় পাশ থেকে সোহম বলে ওঠে,‘আঙ্কেল আমি ভূত দেখেছি। ’

 সত্যেশ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সোহমের মা এসে তাকে কার্যত টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়। 

সত্যেশ মরিয়া হয়ে বলে, ‘দেখুন, আমি সোহমের সঙ্গে কথা বলতে চাই’ 

সোমেশ বেশ কঠোর ভাবে বলে, আমাদের যা বলার বলে দিয়েছি, আপনি এবার আসুন। 

সোহমকে যেমন করে হোক ধরতে হবে, এসব ভাবতে ভাবতে কখন সত্যেশ কখন বাড়ী ফিরে এসেছে খেয়াল করেননি। সংবিত ফেরে মনোহরবাবুর কথায় , ‘শনিবার আমি বিকেল বিকেল আপনাকে এসে নিয়ে যাব’। 

নিশ্চয়ই -সত্যেশের উত্তর। 

 সেদিন সন্ধ্যায় প্রত্যুষকে ডেকে পাঠায় সত্যেশ। ঘটনাটা পুরোটা বলার পরে প্রত্যুষকে দুটো দায়িত্ব দেয়-

১) প্রত্যুষ ছদ্মবেশে ওই বাড়ীর ওপর নজর রাখবে। বিশেষ করে রাত্রে । 

২) যেমন করে হোক তলার ভাড়াটের সাথে আলাপ জমাবে এবং সোহমের ভূতের গল্পটা শোনার চেষ্টা করবে। 

পরের দিন সকাল সাতটা। সুতপা সবে বাজারের ফর্দটা চা দিয়ে গেছে,এমন সময় বেলটা বেজে উঠলো টিং টিং টং,একটু বেসুরো শোনায়,বিরক্ত হয়ে ভাবে বেলটা বোধহয় খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকতে হবে। এসব ভাবনার মধ্যেই একজন মাঝবয়সী লোককে দেখতে পায় ঘরের মাঝে। 

 ভদ্রলোককে দেখে একটু অবাক্ হয়ে সত্যেশ বলে,“ আপনি কে?ভেতরে এলেন কি করে?দরজা তো বন্ধ ছিলো ”

“দরজাতে বেল বাজালাম, দরজা খুলে গেলো, তাই ভিতরে চলে এলাম,আমার সময় কম, যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। ”

একটু থেমে বলতে থাকে‘ আমি অপরেশবাবুর ছোটোভাই সমরেশ ,মনোহর আমাদের বড়দা, বাবা বেঁচে থাকার সময়ে তাকে একটা বাড়ী দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিলেন, এই বাড়ীটা ,যেটায় মেজদা থাকে , আমার আর মেজদার ভাগাভাগি হয়নি। আমি ব্যাচেলাার, তাই প্রপার্টির ব্যাপারে আগ্রহ কম ছিলো। মেজদা এই সুযোগটা নিলো। আমাকে নিয়মিত ভাবে হয়রান করতে থাকলো,যাতে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। অবশেষে একটা কাজের মেয়েকে জড়িয়ে এমন একটা কুৎসা রটনোর চেষ্টা করা হোলো যে আমি বাড়ী ছেড়ে নেপালে এক বন্ধুর কাছে চলে গেলাম সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে। ওখানকারই এক হোটেলের ম্যানেজার ছিলাম। বাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ছিলো না। হঠাৎ এক বন্ধুর মারফৎ খবর পেলাম বাড়ীর ওপর প্রোমোটারের নজর পড়েছে। ভাবলাম একবার ঘুরে আসি, না হয় মান অপমান সইতে হবে। তবুত্ত বাড়ীটা বেহাত হোক চাইছিলাম না। গিয়ে প্রোমোটার মেজদার সঙ্গে গলায় গলায় বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছে। 

 আমি মেজদাকে ওই প্রোমোটার মানে সুনীল আগরওযালের বিষয়ে সাবধান করার চেষ্টা করলাম। তাতে হিতে বিপরীত হোলো। মেজদা অগ্নিশর্মা হয়ে অামাকে যৎপরোনাস্তি অপমান করলেন এবং তার বন্ধু সুনীলকেও জানালেন। আমি কার্যত বহিষ্কৃত হলাম। আমার কাছে খবর আছে সুনীল অগরওয়াল বাড়ীটা ছলেবলে হস্তগত করতে চাইছে। দাদাকে রাজি করাতে পারেনি এবং আমি নিশ্চিত সে মেজদার ক্ষতি করবেই। আপনি মেজদাকে বাঁচান। আমার আর সময় নেই,”বলে ,সত্যেশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমরেশ বিদায় নেয়। 

 সমরেশের কথাগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তার মধ্যেই প্রত্যুষ হাজির । প্রত্যুষ এক কাপ চা খেয়ে দায়িত্ব বুঝে প্রস্থান করতেই , সমরেশের কথাগুলো মগজে সাপলুডো খেলা শুরু করে । সমরেশকে মনে হচ্ছে বিশ্বাস করা যায়। কিন্ত ওর স্বভাবে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। 

সেদিন বিকেলের মধ্যে প্রত্যুষ দুটো তথ্য দিলো, এক সে সোহমের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে,এবং জানতে পেরেছে সোহম একটা ভূতকে বাড়ীর পিছনের দিকের প্রাচীর দিয়ে যেতে আসতে দেখেছে। দ্বিতীয়ত সোহম তলার ভাড়াটের ভাগ্নে, বসিরহাটে থাকে, ছুটিতে মামার বাড়ীতে এসেছে। 

 প্রত্যুষকে আরও একটা দায়িত্ব দেওয়া হোলো , সুনীল আগরওয়াল নামক প্রোমোটারের খোঁজখবর নেওয়া। সেই সাথে কোলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা শাখার তরুন তুর্কী অমিতেশকে জানিয়ে রাখলেন সত্যেশ। সমরেশের সম্বন্ধে খোঁডখবর নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে বলা হোলো অমিতেশকে। 

 সেদিন রাত আটটায় সুনেহার ফোন এলো,প্রচন্ড ভয়ার্ত সে স্বর,আকুল কন্ঠে বলেন,“ আপনি একটিবার এখুনই আসুন, অপরেশকে পাওয়া যাচ্ছে না“

উত্তরে সত্যেশ বলে“ আমি যাচ্ছি, আপনি থানায় একটা খবর দিয়ে রাখুন”। 

সত্যেশ সেখানে পৌঁছে দেখে পুলিশের জীপ বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। ভিতরের ঢোকার সময়ে সোমেশকে খুব দ্রুত ঘরে ঢুকে যেতে দেখে সত্যেশ। 

 সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাবার সময় সত্যেশ যখন হাফ ল্যান্ডিং-এ তখন তার সামনে একটা বড়সড় পাথরকুচি এসে পড়ে, প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে লক্ষ্য করে তার সাথে জড়ানো কাগজটা। কুড়িয়ে-পাওয়া কাগজটা খুলে দেখে তাতে লাল কালিতে একটা কঙ্কালের ছবি আঁকা আর তার তলায় কালো কালিতে লেখা ’সাবধান’ì


উপরে ঘরের দরজা খোলা , প্রথমেই এক পুলিশকর্মী দরজার সামনেই সত্যেশকে আটকানোর চেষ্টা করলে, সুনেহা বলে ওঠেন, “ওনাকে ছাড়ুন, আমি ডেকেছি”ì

 ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই চোখে পড়ে সামনের সোফায় বিধ্বস্ত অবস্থায় অর্ধশায়িত অপরেশবাবুর অবয়ব। অপরেশবাবু উঠে বসার চেষ্টা করতেই,সত্যেশ তাকে বারণ করে। ‘আপনার যা বলার শুয়ে শুয়েই বলুন’’। 

 সত্যেশ জিজ্ঞাসা করে‘আপনার কি হয়েছিলো?’অপরেশের মুখে কালো ছায়া। দেখে মনে হয় ভদ্রলোক একটা আতঙ্কের শিকার । 

অতি ক্ষীণ স্বরে বলেন‘‘রাত আটটা হবে আমি সদ্য বাইরে কাজ সেরে এসে সোফায় বসে জিরোচ্ছি, গিন্নিকে বললাম ‘এক কাপ চা হবে’, গিন্নি চা করতে চলে গেলেন, আমি বসে আছি, লাইন চলে গেলো, ভয় করতে শুরু করলো, চারিদিকে ফিস্ ফাস্ ,কারা যেন কথা বলছে মনে হোলো। এমন সময়,“ ---অপরেশের গলা কাঁপতে থাকে--

সত্যেশ কথার খেই ধরানোর চেষ্টা করে“এমন সময় , কি হোলো বলুন অপরেশবাবু!”

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলেন অপরেশ বলে ‘‘একটা শীতল হাত আমার মুখ চেপে ধরে, কানের কাছে কেউ একটা নাকি সুরে বলে’ছাঁতে চঁল চাঁ খাঁবি না’ বলতে বলতে কিছু ঠাহর করার আগেই কেউ বা কারা আমার মুখ বেঁধে চ্যাংদোলা করে ছাতে নিয়ে ফেলে, রাতের অস্পষ্ট আলোয় তিন চারটে কঙ্কাল আমায় ঘিরে রাখে, একজন আবার ছাতের কিনারায় গিয়ে কি সব যেন দেখছিলো, এমন সময় একটা টর্চের তীব্র আলো এসে পড়ে ছাত থেকে ঝুঁকে থাকা ভূতের মুখে , সে বলতে থাকে ‘ আলো, আলো’, সবাই আমাকে ছেড়ে পালায়। কিছুক্ষণ পরো তলার ভাড়াটে এসে আমায় ছাত থেকে উদ্ধার করে”। 

 সত্যেশ বলে ,“আমি একটু তলার ভাড়াটে সোমেশ ও তার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাই এখুনি”। 

সোমেশ রমেশ অনতিবিলম্বে হাজির পুলিশের লোক গিয়ে ডাকাতে। ততক্ষণে পুলিশ অফিসার সৌগত সত্যেশের পরিচয় পেয়ে গেছেন। 

সোমেশকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলে,“আমি ওপরের মাসিমার চেঁচামেচিতে উপরে উঠে আসি তারপর খুঁজতে খুঁজতে ছাতে গিয়ে মেসোমশাইকে দেখতে পাই”

সত্যেশে তৎপরতার সঙ্গে সোমেশের ভাইকে জিজ্ঞাসা করে , ‘তোমার নাম কি? তোমাদের মধ্যে কে টর্চ্ ফেলেছিলো ছাতের দিকে বলে ফেলো,এবং তোমরা কি ভূতেদের দেখেছো, সেটাও বলে ফেলো। ’


 উত্তরে বছর ছাব্বিশের লম্বাটে মুখের স্পাইক কাট চুলের অধিকারী যুবক তার মুখে বিসদৃশ ফ্রেন্চকাট দাড়ি নিয়ে তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলে ‘মাই নেম ইজ রমেশ। আমি জাস্ট ঢুকলাম আড্ডা সেরে, সো আই হ্যাভ নো আইডিয়া’। সোমেশও প্রায় সেই সুর ধরে বলে হঠাৎ টর্চ ফেলবো কেন? আমি শুধু হইচই শুনে এসেছি, ভূত ধরতে আসিনি। ”

‘আচ্ছা বেশ, চলুন অফিসার একবার ছাতে যাওয়া যাক, সবাই চলুন , একজন কনস্টেবল খালি তলায় থাকবে আর ম্যডাম সুনেহার যাবার দরকার নেই। ’

এবারে অপরেশ বেঁকে বসে,‘ আমি যাবো না’

সত্যেশ আস্বস্ত করে ,‘আমরা সবাই আছি,ভয়ের কি আছে?ভূত বা মানুষ কেউই ক্ষতি করতে পারবে না। “

অপরেশ বলে‘ সুনেহাকে একা ছেড়ে গেলে যদি বিপদ হয়। ’

 শেষমেষ কনস্টেবল হরিহরকে দোতলায় রেখে সবাই হাজির হলো ছাতে। ছাতের আলো জ্বেলে সত্যেশ অপরেশকে জিজ্ঞাসা করে ‘আপনাকে ঠিক কোন জায়গায় ওরা টেনে এনে ফেলেছিলো, ’ জায়গাটা চিহ্নিত করার পর টর্চ্লাইটের আলোয় সত্যেশ কি সব যেন খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন করে অপরেশকে,‘ভূতগুলো পালালো কোন দিক দিয়ে?“

অপরেশ ক্লান্তস্বরে বলে ‘পূর্ব দিকের প্যারাপেট দিয়ে’। 

 এবারে প্যারাপেটের পূর্ব- প্রান্ত বরাবর সত্যেশ টর্চ্লাইট্ জ্বেলে অনেকটা সময় নিয়ে ওই জায়গাটা নিরীক্ষণ করতে থাকে এবং পকেট থেকে ছুরি বার করে কিছু একটা কুরে নেয় এবং প্লাস্টিকে মুড়ে ব্যাগে চালান করে। হাত ঝেড়ে বলে “ আমার যা দেখার দেখে নিয়েছি,এবার নিচে যাওয়া যাক। ”

এমন সময়ে কনস্টেবল হরিহর দুড়দাড় করে উপরে উঠে আসে আর্তনাদ করতে করতে-মার দিয়ারে ভূতোঁনে। 

 সত্যেশ খপ্ করে হরিহরের হাতটা ধরে নিয়ে বলে,‘কেয়া হুয়া বাতাও তানিক। ততক্ষণে ধাতস্থ হয়ে বাংলায় ফিরে এসে হরিহর বলে, ‘দুটো ভূত পিছন থেকে এসে আমার। মাথায় গাঁট্টা মারলো। তাই প্রাণ বাঁচাতে উপরে চলে এলাম, বাঁচান স্যার”

-ঠিক আছে , ঠিক আছে, আমরা আছি তো ভয়ের কিছু নেই’-সত্যেশ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। 

ইনস্পেক্টারের সঙ্গে আলোচনা করে সত্যেশ সিদ্ধান্ত নেয় সেই রাতটা অপরেশের সঙ্গেই কাটাবে। দুজন পুলিস বাড়ীর বাইরে পেট্রোলিং করবে। 

 সেইমত বন্দোবস্ত হোলো। সত্যেশ সারারাত অবশ্য ঘুমোলেন না,কখনও পায়চারি করলেন ঘরের ভিতর কখনও ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলেন, একটা সিগারেট জ্বালিয়ে একটাসময় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন বাড়ীর বাগানে। হাতে টর্চ্ নিয়ে চারিদিকে কি যেন একটা খুঁজতে থাকেন। নিশুতি রাত , তারাময় আকাশের দিকে তাকালেন একবার,সেখানে কত অর্বুদ অবুঝ রহস্য পৃথিবীর পানে চেয়ে । কত ক্ষুদ্র লাগে নিজেকে,এই সামান্য সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত।দূরে রাতজাগা শারমেয়কুলের ঘৌ ঘৌ শব্দ সজাগ করে দেয় সত্যেশকে। তখনই নজর পড়ে সামনে সিমেণ্ট বাঁধানো বেঞ্চের উপর বসে থাকা লোকটার উপর। কে সে?


টর্চ্টাও নিভে গেলো। লোকটা কে?-এই চিন্তা মাথায় ঘাই মারছে?চোর ডাকাত নয় তো?তারার আলোয় মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে,পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। সত্যেশ ডাকে,“শুনছেন!কে আপনি ?” বোধহয় চোখের পলক পড়ার কারণে এক মূহুর্তের জন্য পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী থেকে নজরচ্যুত হয়েছিলেন সত্যেশ,তারই ফাঁকে ছায়ামূর্তি তড়িৎগতিতে একেবারে সামনে, “ সত্যেশবাবু আমি সমরেশ, বিশেষ কারণে আমাকে আসতেই হোলো। ”

 সত্যেশ একটু হতবাক হয়ে বলে,“ আপনি কখন এলেন?,সন্ধে থেকে এত কিছু ঘটলো কই আপনাকে তো দেখলাম না। ”

“ আমিতো এই সবে এলাম”-সমরেশের উত্তর । 

আবার অবাক হবার পালা সত্যেশের,“তা বেশ, তাহলে আপনি ভেতরে এলেন কি ভাবে?আর ঘরের ভিতর না ঢুকে এই বেঞ্চে কেনো বসে, আমার মাথায় ঢুকছে না। ”


 “আমাকে তো বাড়ীর থেকে বের করে দেওযা হয়েছে তাই ভিতরে যাবার প্রশ্ন ওঠে না”-সমরেশ বলে।“ আপনি বরং দাদাকে কি ভাবে সেভ করা যায় দেখুন”। 

এমন সময় বাড়ীর ভিতরে একটা হইচই শুরু হয়ে যায়-“কেউ যেন ডাকতে থাকে“সত্যেশবাবু কোথায় আপনি?”

 সত্যেশ পিছনে ঘুরে উত্তর দেয়“ আমি লনে। ” এবং সামনে ঘুরে সমরেশকে কিছু বলতে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে সেই জায়গাটা ফাঁকা । সমরেশ চলে গেছে। 


 সত্যেশবাবু আপনি এখানে?”-অপরেশ প্রায় হাঁপাতে এসে হাজির হয়, “আমরা আসলে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম, বাইরে আসতে আসতে মনে হোলো কারুর সঙ্গে কথা বলছেন আপনি । ”

সত্যেশ সমরেশের প্রসঙ্গ চেপে গিয়ে বলে,“না,না আমি বাইরেটা একটু ঘুরে দেখছিলাম যদি ভূতের দেখা পাওয়া যায়। ”

 সেই রাতে অবশ্য আর নতুন কোনো ঘটনা ঘটলো না ওই বাড়ীতে । সকালে বাড়ী ফিরে তলব করলেন প্রত্যুষকে। সুনীল অগরওয়াল সম্বন্ধে যা যা তথ্য সমরেশ দিয়েছিলো তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে প্রর্ত্যুষের কথাগুলো। সমরেশকেও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। 

 অমিতেশকে যোগাযোগ করে যা জানা গেলো তা এইরকম-সমরেশ নেপালে কাঠমান্ডুর ,‘শিবা’হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন। তিনমাস আগে সে ছুটি নিয়ে ভারতে আসে,কলকাতায় দুমাস আগে সে তার বন্ধু সৌভিকের বাড়ীতে আসে, তার আগের কয়েকদিন সে নিজের বাড়ীতে ছিলো। তারপর থেকে সে বেপাত্তা । পুলিশ তার হদিশ খোঁজার চেষ্টা করছে। 

 সত্যেশ পুলিশের মদতে প্রায় সব তথ্যই আদায় করতে পারলেন ওপাড়ার তোলাবাজ গুন্ডা ,এদের সম্বন্ধে । বাড়ীর আশেপাশে কারা আনাগোনা করছে সেই সম্বন্ধে একটা সম্যক্ ধারণা তৈরী হোলো দু-তিনদিনের মধ্যে। উল্টোদিকের একটা বাড়ীর ছাতে সিসিটিভি বসানো হোলো নজরদারি করার জন্য। সমরেশকে খুঁজে পাওয়াটাও জরুরী। এই অবস্থায় সত্যেশের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে যেন বারবার বলতে থাকলো আজ রাতেই বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। 

 আজ বৃহস্পতিবার ,শনিবার আসতে দুদিন বাকী,এর ফাঁকে যদি কিছু দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তখন কি উত্তর দেবেন সত্যেশ, এই ভাবনাপ্রসূত হয়ে সৌগতর শরণাপন্ন হলেন সত্যেশ। অবশেষে অপরেশের উল্টোদিকের বাড়ীতে একটা ঠাঁই যোগাড় করে দিলেন সৌগত , গোপনীয়তার শর্তাদি আরোপ করে সেই বাড়িতে পৌঁছেদিলেন সৌগত। ফ্ল্যাটের মালিক সাউথ ইন্ডিয়ান। রামস্বামী ভদ্রলোকের নাম, বাংলা বোঝেন মোটামুটি , বলতে পারেন না। 

 সত্যেশ সন্ধ্যা সাতটাতেই ডিনার সেরে গন্তব্যস্থলে পৌছে গেলেন। একটু হালকা ছদ্মবেশ নিলেন সত্যেশ পরিচয় গোপন করার জন্য। মাথায় পাগড়ি,গোঁফদাড়ি আর চশমার আড়ালে মুখ চেনা দায় সত্যেশকে। রামস্বামীকে নাম ও পরিচয় বলা হোলো গুরমিত সিং,সিবিআই অফিসার । রামস্বামী জানলেন ,বিশেষ তদন্তের খাতিরে সিবিআই অফিসারের আগমন। কথা বাড়াননি রামস্বামী। শুধু জলের জগ আর কফি ভর্তি ফ্লাস্ক দিয়ে গেলেন নিঃশব্দ ভঙ্গিতে। 

 এদিকে সত্যেশের নির্দেশমতো অপরেশের হাতঘড়িতে অ্যালার্ম চিপ বসিয়ে প্রত্যুষ গোপনে অপরেশকে দিয়ে এসেছে। সার্টে গোপন ক্যামেরা লাগানো হয়েছে অপরেশের। অমিতেশ কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলো, সমরেশ সম্পর্কিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে ,যা সত্যেশকে হতবাক করে দিয়েছে। 

 সত্যেশ এখন বরাদ্দ করা ঘরে সিসিটিভি সামনে বসে। রাত প্রায় দুটো। ঘুম কাটানোর জন্য বার দুয়েক কফি খাওয়া হয়ে গেছে। প্রত্যুষ পাশের সোফায় বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন। জানলাতে লাগানো দূরবীন তখনই কাজে লাগবে ,যখনই কেউ অপরেশের বাড়ীতে অনুপ্রবেশ করবে। দূরে পুলিশের গাড়ী অপেক্ষা করছে। এই ঘরটা অপরেশের বেডরুমের ঠিক উল্টোদিকের বাড়িতে। এত রাত হোলো শুধু অনুমানের ভিত্তিতে পুলিশ-বাহিনী ডাকা না ব্যর্থ হয়ে যায়। হঠাৎ অ্যালার্ম বিপ্ বিপ্ করে বাজতেই সত্যেশ ঘর ছেড়ে ছুটে বেরোয়।


পুলিশের লোকেরা আশেপাশে ছিলো। অ্যালার্ম বাজতেই বাড়ীর চারপাশে ঘিরে ফেলেছে। প্রত্যুষকে সিসিটিভির দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছে। বাড়ীর ভিতরে দেখা গেলো অপরেশ ঠক্ঠক্ করে কাঁপছেন সুনেহা সংজ্ঞাহীন আর ভাগনে রতীন জলের গ্লাস নিয়ে মামীর শুশ্রুষায় ব্যস্ত। 

 প্রত্যুষকে মোবাইলে জিজ্ঞাসা করা হোলো সিসিটিভি কোনো স্ট্রেন্জার দেখা গেছে কি না?

উত্তর এলো-না। 

সত্যেশ পুলিশ অফিসারকে বলে“আপনি এই বাড়ীর সব জায়গায় সার্চ করুন,ভূত,আই মীন অপরাধী ধরা পড়বেই। ”


বাড়ীর উপর নীচ তন্নতন্ন করে খুঁজে এসে পুলিসবািহনী গলদঘর্ম হয়ে ঘোষণা করলো,“নাঃ কাউকে পাওয়া গেলো না”। 

ইতিমধ্যে অমিতেশও এসে হাজির । সত্যেশ অমিতেশকেই বললো,“চলুন, ছাতে যাই”। পুলিশের একজন বলতে গেলেন-“ছাতে কিছু নেই স্যার”। অমিতেশ দাবড়ানি দিলো,“লেট সত্যেশবাবু ডু হিজ্ পার্ট। ”

ছাতে আর একপ্রস্থ খোঁজার পালা চললো,যখন সব্বাই ধরে নিয়েছে সেখানে কেউ নেই,তখনই মটররুমের পাশে রাখা একটা টিনের আড়াল থেকে চাদর মুড়ি দেওয়া ভূতের মুখোশ আঁটা একজনকে টেনে বার করে আনলেন। “এই নিন আপনাদের বাস্তু ভূত”। 

 সত্যেশের নির্দেশ অনুযায়ী ভূতের মুখোশ টেনে খুলতেই যার চেহারা প্রকট হোলো,তাই দেখে সবাই হতবাক্ হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত সবাই নির্বাক। অবশেষে নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন সত্যেশ‘ , মনোহরবাবু আমি গোয়েন্দাগিরি শুধু রোজগার করার জন্যে করি না, মাঝেসাঝে আমার বুদ্ধাস্ত্রতে মরচে পরেছে কিনা পরখ করার জন্যেও করি, এনি ওয়ে মনোহর ইজ্ দ্য কালপ্রিট,”- একটু থেমে সত্যেশ বলতে থাকে ব্লু প্রিনটা মনোহরবাবুর, কারণটা আমি বলবো না আপনি বলবেন ,মনোহরবাবু। ”


 সত্যেশ বলতে থাকে ,‘কারণটা আর কিছুই নয়, লোভ,মনোহরবাবু তার পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ হিসেবে একটা বাড়ী আগেই আদায় করে নিয়েছেন ,তারপরে নজর পড়লো ওনার বাবার করা দ্বিতীয় বাড়ীর উপর,যার অংশীদার অপরেশবাবু আর সমরেশ বাবু। তাই প্রথমে অপরেশকে সমরেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে বিষিয়ে দেয়। 

 সবাই চুপ করে শুনছে,সত্যেশ বলে চলে,“সমরেশ পুনরায় গৃহতাড়িত হলেন। একটা জেদের বশবর্তী হয়ে সমরেশ এক বন্ধুর বাড়ি ডেরা বাঁধলেন , মনোহরবাবু দেখলেন, এতো বড় বিপদ, তখন ভূতের নাটক শুরু করলেন। সমরেশ বাইরে থেকে সবকিছু লক্ষ্য রাখছিলো। তারপরে সমরেশকে একদিন আর পাওয়া গেলো না। মিঃ অমিতেশ প্লিজ আপডেট আস্ এ্যাবাউট সমরেশ। “

 অপরেশ সমরেশকে বাড়ী ছাড়া করে। এতে হয়তো অপরেশবাবু ভেবেছিলেন, বাড়ীটা তিনি একাই ভোগদখল করবেন, কিন্তু বিধি বাদ সাধলো। মনোহর ভাবলেন এই মওকা ,এবারে বাড়ীতে একবার যদি অপরেশকে বুঝিয়ে যদি সিন্ডিকেটের কাছে বাড়ীর প্রোমোটিং-এর ব্যাপারটা ফেলা যায় তাহলে একটা মোটা দাঁও মারা যায়,যা ভাবা তাই কাজ, কিন্তু অপরেশ বেঁকে বসলেন,তিনি পৈতৃক বাড়ী কাউকে দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। এদিকে এক লোকাল প্রোমোটারের , আই মীন সুনীল আগরওয়ালের নজর ছিলো এই প্রপার্টির উপর। সুনীল যথেষ্ট ভদ্র ও বুদ্ধিমান । সে প্রথমে অপরেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালো। এই ব্যাপারটা মনোহর ভাল চোখে দেখলেন না। মনোহর কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্যই সমরেশের কাছে খবরটা পৌঁছে দিলেন। সমরেশ ফিরে এলেন, দাদার সঙ্গে অনেক বাক-বিতন্ডা হোলো

 সমরেশ শব্দটা উচ্চারিত হতেই মনোহরবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ফেলেন,“সমরেশের আবার কি হোলো, ওতো নেপালে, আপনারা তখন থেকে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প শুনিয়েছেন, আর নয়,”

এবারে রগচটা অমিতেশ বলেন,“আর একটাও কথা বলবেন না,আমরা গল্প বলছি,আর আপনি কি ভূত সেজে এখানে নাটক করছিললেন, ধরা পড়েও কি লজ্জায় কথা বলছেন মশায়”

সত্যেশ তাকে থামতে বলে। বলে‘আপনি আসল কথাটা বলুন অমিতেশ’

 অমিতেশ বলেন ,‘সমরেশের নিরুদ্দেশের খবর জানিয়ে ওনার বন্ধু স্থানীয় থানার এফ আই আর করেছিলেন দিন দশেক আগে এবং সেই ইনফরমেশনের ভিত্তিতে পরে জানা যায় এক রোড এ্যাক্সিডেন্টের শিকার হয়ে পিজিতে ভর্তি হয়েছিলেন সমরেশ এবং সেইখানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আপনাদের ভাই। ”

আর্তনাদ করে ওঠেন মনোহর ,“সমু আর নেই, ” অপরেশ শুধু ‘উফ্’ শব্দ করে সোফায় বসে পড়েন। 

এবারে অমিতেশের শীতল কঠিন স্বর শোনা যায়“ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সমরেশের বন্ধুর তথ্য অনুযায়ী মনোহরবাবুকে জানিয়েছিলেন, তার উত্তরে আপনি জানান যে আপনার ছোট ভাই উনি নন্। ”

এবারে সত্যেশ হাল ধরে,“আপনি এই কথা অপরেশের কাছেও চেপে যান,শুধু তাই নয় ভূতের থিয়োরি খাড়া করার জন্য আপনি সমরেশের মত দেখতে আর একজনকে,যার নাম পিটার, আমার বাড়ি পাঠিয়েছিলেন,যাতে পরবর্তীকালে যখন সবাই জানবে সমরেশ মৃত,তখন এটাই প্রমাণিত হবে মৃত সমরেশই আমার বাড়ি ভূত হয়ে গেছিল। আরও একটা উদ্দেশ্য ছিলো ,মৃত আত্মা মিথ্যে বলে না, তাই তাকে দিয়ে সন্দেহের একটা তির সুনীল আগরওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। ”

 সত্যেশ বলে চলে“আপনি জানতেন যে সমরেশকে আমি দেখিনি, তাই ভ্রান্তির শিকার ঘটানো সম্ভব । আর একবার যদি আমি বলি এইসব ভৌতিক ঘটনা সত্যিই ঘটছে তখন তো পোয়া বারো। তখন মনোহরবাবুর ঝুলি থেকে বেড়াল থুড়ি প্রোমোটার অর্জুন বেরিয়ে পড়তো, আর লাভের গুড় মনোহরের কব্জায়। ” 

এতক্ষনে রতীন কথা বলে,“সে নাহয় বোঝা গেলো, কিন্তু ভুতুড়ে ব্যাপারগুলো ঘটানো হোতো কেমন করে?”

সত্যেশ হেসে ফ্যালে ,“বলে এই ইলেকট্রনিক যুগে এটা করার জন্য কোনো রকেটবিজ্ঞান দরকার হয় কি?”

এতক্ষণে সুনেহা বলে,“এতদিন যা ঘটছিলো তা সব সাজানো!”

- -Φ“হ্যাঁ ”

সত্যেশ বলে ,“হয়তো আপনারা লক্ষ্য করেননি যে ভূতের উপদ্রবে যে কটা জানলা দরজা খোলা বন্ধ হোতো , সেগুলো সম্প্রতি নতুন লাগানো হয়েছে বা মেরামত করা হয়েছে, সেইগুলোতে এক ধরনের চিপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে রিমোট কন্ট্রোলে ওগুলো খোলা বা বন্ধ করা যায়। ”

 “ আর ওই যে রান্নাঘরে ভূত নাচানো,”-তির্যক প্রশ্ন অপরেশের,

উত্তর দেয় সত্যেশ ,“ রান্নাঘরে এক্সহস্টের ফাঁক দিয়ে একটা ফানুস বেলুন ঢুকিয়ে জানলার সানসেডের উপর বসে থেকে তাকে ফুলিয়ে দেওয়া ,এ আর এমন কি? কি বলেন মিঃ রমেশ?”

কখন যে রমেশরা নিঃশব্দে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়াল না করলেও সত্যেশ করেছে,একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলেন,“আবার আমাকে জড়াচ্ছেন কেন?”

“আপনি মনোহরের ডান হাত, আপনাকে বলবো না, আপনিতো অনেক খেলাই খেলেছেন, মনে করিয়ে দিই সেদিন ছাতে ভূত সেজে অপরেশবাবুকে আপনি নিয়ে গেছিলেন। ”

-রাবিশ’ রমেশ রেগে উত্তর দেয়। 

হেসে পকেট থেকে একটা রিস্টওয়াচের ব্যান্ড বার করেন,“এটা আপনার , অস্বীকার করতে পারেন”


এটা তো অন্য করোর হতে পারে”-সহজে হারার পাত্র নয় রমেশ। 

তা পারে, কিন্তু প্যারাপেট বেয়ে নামার সময় আপনার হাত ছড়ে যায় ,রিস্টের ক্ষত লুকোনো সম্ভব হয়নি, আর ওখানে যে রক্ত লেগেছে, তার নমুনা আমি সংগ্রহ করেছি,প্রমাণ করা অসুবিধে হবে না,যে সেদিন ছাতে ভূতবেশে এসেছিলেন আপনিই ,আর আপনার ভাগনে আপনাকে ভূত সাজতে দেখেছে, তার বাড়ীতে গিয়ে আমার লোক এই তথ্য যোগাড় করেছে,শিশু কেন মামার বিপক্ষে বলবে বলতে পারেন। এইবার রইলো প্রথম দিনের কথা। 

মনোহরবাবু আপনার টাক মাথা,আপনার ভাইয়ের নেই, কিন্ত যদি আপনার মাথায় চুল গজিয়ে দেওয়া যায়, আই মিন পরচুলো তখন আপনাকে অপরেশের মত দেখতে লাগবে, এই ট্রিকস্ দিয়েই আপনি ম্যাডাম সুনেহাকে কনফিউস করেছিলেন,সেইজন্যই সুনেহাদেবী অপরেশবাবুকে বলেছিলেন যে উনি আলো নিয়ে আগেই দিয়ে এসেছেন তবুত্ত দ্বিতীয়বার কেন মোমবাতি নিয়ে এসেছেন, আসলে মনোহর আগেভাগেই বাড়ীতে প্রবেশ করেছিলেন এবং মেনসুইচ অফ করে নকল চুল লাগিয়ে প্রহেলিকার সৃষ্টি করেন। আর ভৌতিক পরিবেশ লেজার এফেক্ট । এই হোলো গল্প। অমিতেশ আমার সন্দেহ সমরেশকে মারা হয়েছে,আপনি নতুন করে ইনভেস্টিগেট করুন। ”

বেরোনোর আগে ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখতে চায় সত্যেশ। অ্যালবাম দেখতে দেখতে একটু যেন চমকান। হঠাৎ করে কিছু না বলে বাইরে লনে বেঞ্চে এসে বসেন সত্যেশ। আকাশের দিকে তাকান। এখন সত্যেশ বুঝতে পারেন সেদিন যখন রাত্রে এইখানে এসেছিলেন তখন সত্যিই সমরেশ এসেছিলো, কিন্তু হিসাব বলছে তখন সমরেশ মৃত,তাহলে সে ঠিক কি জানাতে এসেছিলো, এই প্রশ্ন বোধহয় আজীবন তাকে তাড়া করে বেড়াবে। তাহলে কি সত্যি আত্মা ফিরে আসে? চোখটা বুঁজে ভাবছিলেন। কখন যেন প্রত্যুষ এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। “ চলুন দাদা বাড়ি চলুন। ”

লেখক রানা জামান -এর একটি গল্প

 কিংকর্তব্যবিমূঢ়


 


এক রাতে অচেনা নম্বর থেকে একটা কল এলো। সাধারণত অচেনা নম্বরের কল ধরি না। পরপর চারবার কলটা এলে ধরলাম।


আসালামু আলাইকুম। কে বলছেন প্লিজ!


একটা ফ্যাসফ্যাস পুরুষকণ্ঠ বললো, আপনি এতো চমৎকার থৃ লাইনার লিখেন। তাই আপনাকে ফোন দিলাম।


ধন্যবাদ। কিন্তু নম্বর পেলেন কিভাবে এবং আরো কিছু কি বলবেন?


আসলে একজন অচেনা পুরুষের সাথে ঘুমুতে যাবার সময় কথা বলতে আমার ভাল্লাগছিলো না।


পুরুষকণ্ঠ বললো, আমি আপনার কাছ থেকে থৃ লাইনার লেখা শিখতে চাই।


আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কী আশ্চর্য! আমি আপনাকে থৃ লাইনার লেখা শিখাবো কেন?


আমি আপনার থৃ লাইনার বই প্রকাশে সাহায্য করবো।


এবার আমি দুর্বল হলাম। বিনা পয়সায় একটা বই প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়া মানে বিরাট কিছু একটা পাওয়া। বললাম, বেশ। কিন্তু সেজন্য আমাদের দেখা হওয়া প্রয়োজন। কোথায় দেখা হতে পারে আপনার সাথে? কিভাবে?


ফ্যাসফ্যাস পুরুষ কণ্ঠ বললো, আপনি আগামীকাল বিকাল চারটায় হাতিরঝিল চলে আসেন।


আমি দ্বিধা নিয়ে বললাম, কিন্তু আমরা একে অপরকে চিনবো কিভাবে?


আমরা ঝিলের উত্তরপাশে থাকবো। বাকিটা সাহায্য করবে এই ফোন।


পরদিন বিকেল চারটা। ঝিলের উত্তর পাশ। অনেক মানুষ গা ছেড়ে দিয়ে আপনজন সাথে বেড়াচ্ছে। ফোনের সাহায্যে কথা বলে মুখোমুখি হয়ে আমি হতবাক। পুরুষকণ্ঠে কথা বললেও ও যথেষ্ট সুন্দরী এক কিশোরী।


আগন্তুক কিশোরী বললো, কেমন চমকে দিলাম?


আমি শুধু মাথা নেড়ে ইতিবাচক সায় দিতে পারলাম।


ও ফের বললো, চলুন পাশের বেঞ্চটায় বসি। আলাপচারিতায় দুজনের নাম দুজনের কাছে জানা হয়ে গেলো। ওর নাম অঞ্চিতা। বেশ ব্যতিক্রম নাম। পূর্বে সঞ্চিতা নামের মেয়ে বা ভদ্রমহিলা দেখেছি।


সেই থেকে অঞ্চিতার সাথে এখানে সেখানে বসা শুরু। ও শুধু আমার থৃ লাইনার শুনে বিমুগ্ধ শ্রোতার মতো।

একদিন ওকে বললাম, তুমি বলেছিলে বই প্রকাশের কথা। তোমার কি কোন প্রকাশকের সাথে পরিচয় আছে?

অঞ্চিতা বললো, আমার বাবাই প্রকাশক।


আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কী বলছো তুমি অঞ্চিতা!


অঞ্চিতা ফের বললো, আমার বাবাও তোমার থৃ লাইনারের বেশ ভক্ত। কিন্তু শুধু শুধু আমি তোমার বই প্রকাশের জন্য বাবাকে বলবো কেনো!


বিনিময়ে কী চাও তুমি?


অকপটে অঞ্চিতা বলে দিলো, তোমার ভালোবাসা চাই!


আমি বিষম খেয়ে কাশতে লাগলাম। কাশি থামিয়ে বললাম, আমাকে কতটুকু জানো তুমি?


ও বললো, ফেসবুকে প্রোফাইল থেকে যা জেনেছি, তাতেই আমার চলবে।


বললাম, তা হয় না অঞ্চিতা। আমি দুই সন্তানের বাবা।


সাথে সাথে সে দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। আমি বোবা হয়ে ওর পাশে বসে রইলাম। একসময় সে কিছু না বলেই চলে গেলো।


আমিও ফিরে এলাম বাসায়। থৃ লাইনার লিখে পোস্ট দেই; কিন্ত অঞ্চিতার কোন লাইক বা কমেন্ট পাই না। তৃতীয় দিন ওর নম্বরে একটা পুরুষকণ্ঠ ফোন করে হাউমাউ কান্না শুরু করলো। সব শুনে আমি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলাম বাইরে। উবারে চলে এলাম গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। কব্জি কেটে অঞ্চিতা আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। অনেক রক্তপাত হয়েছে। এখন আইসিইউ-তে লাইফসাপোর্টে আছে।


ঘটনা শুনে আমি বিমূঢ়। ওর জীবন কামনা করবো না মৃত্যু কামনা করবো-সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

কবি অমিত পাল -এর একটি কবিতা

 সাধারণ মানুষ

               


বলি, আমি বামপন্থী নই---

নইকো আমি কংগ্রেসী।

আরে, আমি কোনো রাজনীতিবিদ নই

আমি মানুষ। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক নাবিক।


অন্যায় দেখি প্রতিদিন

কিন্তু প্রতিবাদে ভয় পাই,

পা বাড়াই গোপন পথে।

শুধু একার দ্বারা জয় সম্ভব নয়।

আমি চাকুরিহীন সাধারণ মানুষ,

নই কোনো অভিলাষী মন্ত্রী।

কবি উদয়ন চক্রবর্তী -এর একটি কবিতা

 ব্যর্থতার শূন্যতা বুকে নিয়ে 





আমি ভেবে ছিলাম আর বলব না

কোনও কথা যেখানে ধূসর বালুকনা

মিশে আছে শব্দের সাথে --

যেখানে সাগর নদীও পাল্টে নিয়েছে 

নিজের অস্তিত্বের অহংকার --

যেখানে তুমি কতটা ঝুঁকিয়েছ মাথা

সেটাই তোমার বরাদ্দ স্বাধীনতা।

নিয়তী ভাগ্য অদৃষ্ট সবই অলীক শব্দ 

আকাশে হাহাকার ভেসে বেড়ায় 

হতভাগ্যের হাহুতাশে নিরন্তর --

এ সূর্য সংসারে প্রতিদিন উল্লাস আর

বিষাদ আচারের মতো চুষে খায় অতৃপ্তি মাখা 

মানুষের দল তৃপ্তি আর ব্যর্থতার শূন্যতা বুকে নিয়ে।

কবি চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী -এর একটি কবিতা

 পুঁইলতা



সে যদি,না

থাকতো,মাটির কাছাকাছি

কি করেই বা হরিৎ ক্ষেতের,অক্ষর

তুলে সাজাতাম কবিতার খোঁপা!

একটুকু তৃষ্ণার,জল

পেলে মরো মরো লতা থেকে

গুঁটি ভাঙে লাল-নীল-সবুজ প্রজাপতি,

ঠিক যেন,অভাবি উঠোন জুড়ে,হাসা

কুমড়ো-করলা-ঝিঙের জালি।

দরিদ্র আর পুঁইশাক,বসত পাশাপাশি

খড়েরচাল ছাড়া পুঁইলতা,আজও

ঢুকতে পেলো না রাজার বাড়ি।

কবি কাজী রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ -এর একটি কবিতা

 কিন্তু



আজ আমি তোমারি প্রথীহ্মায়। 

সেদিন শ্রাবন-সন্ধায়

আমি তোমার হ্নদয়-কমলের ঘ্রাণ পেয়েছি।

পেয়েছি আমার হ্নদয়ে তোমার রক্তের স্পন্দন।

দেখেছি তব নয়ন যুগলে নিবীড় বন‍্যার ছায়া।

যেন বসন্ত এলো ফিরে নিয়ে নব উচ্ছাস।

আমার হ্নদয়ে তোমার করুণ দৃষ্টির আঘাত হেনেছিলে;যদি প্রত‍্যাখ‍্যান করি তব প্রেম,

ভাসায়েছি তরণী তব প্রণয়-পাথারে।

তাই পৃথিবীর ধূসর সন্ধায়

সেখানে দাঁড়িয়ে আছি তোমারি প্রতীহ্মায়;

কিন্তু তুমি ত এলেনা,

আজও এলেনা!!

কবি মিলি দাস -এর একটি কবিতা

 এশিয়া মহাদেশের বুকে



তোমাকে পাবার জন্য

আর কতবার জন্ম নিতে হবে!

জানি না,কিছুই জানি না।

দাপর ত্রেতা কলি যুগ এ পুনর্বার

জন্মেছি নতুন নতুন রূপে।

পৌঁছতে পারিনি,

শোনাতে পারিনি এক ভালোবাসার

গল্পকথাকাহিনী,

পৃথিবী ধ্বংসের দামামা বাজছে ,

পশুপাখিরা বিলীন হচ্ছে,

অরণ্যভূমি হচ্ছে কংক্রিট ক্ষেত্র।

বিশুদ্ধতা হারিয়েছে বাতাসেরা ,

এখনো মৌসুমী বায়ু বয়ে গেলে মনে হয়-

এ জন্মেই বলে দেবো সেসব গোপন কথা,

প্রশান্ত মহাসাগরের স্ফীত জলে প্লাবিত হতে হতে বলেছিলাম-

এই ছেলেটা শুনছো

হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে বলছি তোমাকে

আমি বহু মৃতমুখ পাল্টে হাজার হাজার বছর ধরে নক্ষত্রের সাথে কাটিয়েছি ঝলমলে আশ্চর্য রাত।

শিরীষের নীচে ঘুমিয়েছি কয়েকশো বছর,

বোষ্টমী সেজে আম্রকুঞ্জে কাঁচামিঠে আম কুঁড়িয়েছি অসংখ্যবার,

নদীতে বাঁধ দিয়েছি, ভেসে গেলেও ধরতে পারবো জেনে,

দেখে গেছি শুধু দূর থেকে দূরে 

তবুও বলতে পারিনি।

এই ছেলেটা শুনছো-

এই রূপসী বাংলায় জন্ম নিয়েছি

সেই কথাটি বলার জন্য।

কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে রাস্তায়,

আমি চিৎকার করে বলবো

এশিয়া মহাদেশের বুকে জন্মেছি

শুধু তোমাকে পাবার জন্য

তোমাকে কিছু বলার জন্য

তোমাকে ভালোবাসার জন্য।

কবি ক্ষুদিরাম নস্কর -এর একটি কবিতা

 প্রতিরোধ



চলুক লাঠি,চলুক গুলি, 

তবু চলো প্রতিরোধ গড়ে তুলি।


ঝড়ে নুয়ে পড়া গাছের মত 

আর কতদিন ! কতবার ! 

মাটির সঙ্গে মিশে যাবে ?


শরীরে শক্তি আনো,

মহীরুহ হও।


ভাঙ্গ,তবু মচকিও না।

তাতে,মরার আগে মনে হবে হারিনি।


চলুক লাঠি,চলুক গুলি, 

তবু চলো প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

কবি মায়া বিদ -এর একটি কবিতা

 পরখ

    

ইলেকট্রিকের সুইচ টিপলে

 চলে আলো ফ্যান।

হাত দিয়ে কপাল টিপলে

বিশাল আরাম পান।

বন্দুকের ট্রিগার টিপলে

মরে অনেক প্রাণ।

ডাক্তারেরা নাড়ি ধরলে

    জীবনের হদিশ পান।

কবি আশীষ কুন্ডু -এর একটি কবিতা

 আকাশ দেখতে চাই 



আকাশ দেখতে শিখেছিলাম -

তোমার দু চোখে বাজি রেখে! 

মেঘ করতো, বৃষ্টি হতো-

বাজ, বিদ্যুৎ, ঝড় সব দেখেছি!

আজ আকাশ দেখতে গিয়ে -

দেখলাম বেবাক ফাঁকা সমুদ্র। 

শুধু সফেদ লবণ পাহাড়, 

পাহাড়ের চূড়ায় দু একটা হাত-

বাড়িয়ে আছে, আকাশ ধরার চেষ্টায়!

আকাশ বেয়ে মরচে রঙ,

ঝরছে ইউক্যালিপটাস বনে! 

আমার পা ডুবে যাচ্ছিল, 

ত্বরাবালির রাশি -

আমায় ক্ষতবিক্ষত করছিলো! 

আমি আকাশ দেখতে চাইছিলাম

আমি তোমার দুচোখে হারাতে চাই।