Thursday, June 9, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -5


 


পাঁচ


ঋজুর ছেলে বাবি ক্লাস ফোরে পড়ে। নবনালন্দা স্কুলে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে সে যাতে খুব সহজেই ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে পারে, সে জন্য কাকে না ধরেছে ঋজু? রমাপদ চৌধুরী থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শেষে নীরেনবাবুর জামাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এ ডি এম আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্যন্ত। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টা করবেন। তবে ওখানে ভর্তির জন্য মিশনের উল্টো দিকে যে সব কোচিং সেন্টার আছে, সে রকম কোনও কোচিং সেন্টারে ছেলেকে ভর্তি করে দিতে বলেছিলেন তিনি। তিনিই দিয়ে দিয়েছিলেন এক মাস্টারের খোঁজ। ইনি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনেরই শিক্ষক। থাকেন মিশনের মেন গেটের উল্টো দিকে। বাড়িতেই কোচিং করান।
গত দু’বছর ধরে ঋজু ওর ছেলেকে প্রত্যেক রবিবার এখানে নিয়ে আসে। এখানে যারা পড়ে, তাদের বেশির ভাগ ছাত্রই নাকি মিশনে চান্স পায়। তাই দক্ষিণাও কিঞ্চিত বেশি। যে মাসে চারটে রবিবার সে মাসে দিতে হয় আটশো টাকা। আর যে মাসে পাঁচটা রবিবার, সে মাসে হাজার টাকা। মানে ক্লাস পিছু দুশো টাকা। সকাল সাতটা থেকে ক্লাস। সাড়ে ন’টার সময় মিনিট পনেরোর জন্য বিরতি। সে সময় বাইরে অপেক্ষা করা বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের মুখে ঠেসেঠুসে খাবার ঢুকিয়ে দেন। তার পর আবার ক্লাস। চলে এগারোটা, সাড়ে এগারোটা আবার কোনও কোনও দিন বারোটা অবধি।
তা, এত দিন এই শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের কী শিখিয়েছেন, আজ তার চূড়ান্ত পরীক্ষা। মিশনে সিট মাত্র ষাটটা। তিরিশটা বাংলা মাধ্যমের। তিরিশটা ইংরাজি মিডিয়ামের। অথচ পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় হাজার সাতেক ছাত্র।
শুধু ঋজু নয়, ছেলের পরীক্ষা, তাই ওর বউ ভারতীও সঙ্গে এসেছে। বাবি পরীক্ষা দিতে ঢুকে যেতেই ভারতীকে ‘একটু আসছি’ বলে ঋজু মিশন চত্বর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। আজ রবিবার। ছুটির দিনে কণিকা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। এতক্ষণে মনে হয় ও উঠে গেছে। না উঠলেও, ফোন করলে নিশ্চয়ই উঠে যাবে। ওকে বলে দেওয়া দরকার, বাবি পরীক্ষার হলে ঢুকে গেছে।
ফর্ম ফিল-আপের সময় নানান খুঁটিনাটি তথ্যের সঙ্গে, যদি থাকে, একটা মোবাইল নম্বর দিতে বলেছিল ওরা। ঋজুর নিজের কোনও মোবাইল নেই দেখে কণিকার নম্বরটাই দিয়েছে। ওকে না জানালে হয়!
বুথ থেকে ফোন করতেই ওর মেয়ে ধরল। ছোট বাবি না বড় বাবি ও বুঝতে পারল না। সামনাসামনি দেখলেও প্রথম প্রথম ও বুঝতে পারত না, কোনটা ছোট আর কোনটা বড়। দু’জনেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। লোকে বলে, ছোটবেলায় যতই একই রকম দেখতে থাকুক না কেন, যমজ বাচ্চারা যত বড় হয়, ততই নাকি তাদের মধ্যে পার্থক্য ফুটে উঠতে থাকে। কিন্তু ছোট বাবি আর বড় বাবির মধ্যে ও কোনও পার্থক্যই খুঁজে পেত না। তখন কণিকাই এক দিন বলে দিয়েছিল, যার চুল বফ বফ করে কাটা, সে ছোট। কিন্তু ফোনে গলার স্বর শুনে ঋজু বুঝবে কী করে, বফ বফ চুল ধরেছে না লম্বা চুল! ও বলল, মা উঠেছে?
— কখন...
— মাকে দাও।
— মা তো নেই আঙ্কেল।
— কোথায় গেছে?
— বেলুড়ে।
— বেলুড়ে?
— হ্যাঁ। কাল রাতে দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। ফোন পেয়ে মা কাল রাতেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অত রাতে তো গাড়িটারি কিছু পাবে না। তাই যায়নি। আজ সক্কালবেলায় উঠেই মা চলে গেছে।
— কখন আসবে কিছু বলেছে?
— কই, না তো।
ফোনটা কেটেই ফের টপাটপ বোতাম টিপল ওর মোবাইলের। আবার মেয়ের গলা— হ্যালো?
— মা মোবাইল নিয়ে যায়নি?
— না গো। এই তো ড্রেসিং টেবিলের ওপরে পড়ে আছে দেখছি। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেছে তো, হয়তো নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।
— একা গেছে?
— হ্যাঁ।
— একটু দরকার ছিল... দাদুর বাড়ির নম্বরটা দেবে?
— দাদুর বাড়ির নম্বর! একটুখানি কী যেন ভাবল মনে হয়, তার পরে বলল, দাদুর বাড়িতে তো ফোন নেই।
— দাদুর বাড়িতে ফোন নেই! খুব অবাক হল ঋজু। কই, কাল অত রাতে যখন কথা হল, তখনও তো ও কিছু বলল না! এমনিতে রবিবার রবিবার মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন না। চলে যান ক্লাইভ হাউস। সেখানে ওঁর একটা ফ্ল্যাট আছে। ওঁর মানে, ওঁর কেনা নয়। ওঁর কোন এক ছাত্রের ফ্ল্যাট। ফাঁকা পড়ে ছিল। উনি সেটা নিয়েছিলেন। যে ক’মাস থাকবেন, সে ক’মাসের ভাড়াও দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, উনি নাকি কোনও দিন এক পয়সাও দেননি। বহু দিন হয়ে গেছে ফ্ল্যাটটা আটকে রেখে দিয়েছেন। যার ফ্ল্যাট সেই ছাত্রটা ফোন করলে, উনি এখন তার ফোনটাও ধরেন না। সেই ফ্ল্যাটে উনি মাঝে মাঝে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। যারা পি এইচ ডি বা ডক্টরেট করছে, তাদের গাইড করেন। তাই রবিবার হলেই কণিকার বাড়ি চলে যায় ঋজু। ওখানেই খাওয়াদাওয়া করে। সারা দিন থাকে। কণিকার লেখা কবিতাগুলি ঠিকঠাক করে দেয়। কী করলে গল্পটা আরও ভাল হবে, কী ধরনের বিষয় নিয়ে লিখলে লোকে নেবে, বুঝিয়ে দেয়। কখনও সখনও নিজেও লিখে দেয়। নিজে যেখানে যেখানে লেখা পাঠায়, তার সঙ্গে ওর লেখাও দিয়ে দেয়।
কিন্তু এগুলি সবই হয় বিকেলের পরে। তার আগে খাওয়াদাওয়া। ঘুম। দু’মেয়ে চলে যায় পাশের ঘরে। বড় ঘরে ওরা দু’জন। যাওয়ার সময় মেয়েরাই দরজা টেনে দিয়ে যায়। কচিৎ-কদাচিৎ যখন মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন, ডাইনিং টেবিলে বইপত্র ছড়িয়ে এ ঘরের দিকে পিঠ দিয়ে লেখালিখি করেন, তখনও এ ঘরে ওদের মা আর ঋজু থাকলে, ওরা দু’বোন ও ঘরে পড়তে যাবার সময় ফালতু ফালতু কারেন্ট পুড়ছে বলে, এ ঘরের লাইট নিবিয়ে টান-টান করে পর্দা টেনে দিয়ে যায়।
বিকেল বা সন্ধের দিকে ঋজু কফি খেতে চাইলে অনেক সময় কণিকাই কোনও মেয়েকে ডেকে বলে, মহাদেববাবুকে বল তো একটু কফি বানাতে।
ঋজু এ ঘর থেকেই শুনতে পায়, ওরা তাদের বাবাকে বলছে, এই যে মহাদেববাবু, মা আপনাকে কফি করতে বলছে, শুনতে পেয়েছেন তো? পরে আবার বলবেন না, শুনতে পাইনি।
ও বহু ফ্যামিলি দেখেছে, কিন্তু এ রকম ফ্যামিলি এর আগে ও কখনও দেখেনি।
ওনার সঙ্গে তোমাদের এ রকম সম্পর্ক কেন? একদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছিল ও। তখন কণিকা অনেক কথা বলেছিল। তার মধ্যে যেমন ছিল, মহাদেববাবু কোনও পে রোলে নেই। উনি কোনও স্টাফ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রোজেক্টে কাজ করেন মাত্র। সামান্য মাইনে পান। তাও ঠিক মতো নয়। মিথ্যে কথা বলে উনি ওকে বিয়ে করেছেন। এক বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার দায়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। এক সময় খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় ভাষা পরিষদের স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যে দিন দুই মেয়ে জন্মাল, সে দিন হাসপাতাল থেকে ওষুধের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে যাবার নাম করে বেরিয়ে, সেই যে উনি উধাও হন, টানা তিন বছর তাঁর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। এখনও বাজার করতে হলে তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন তিনি। এই যে তার অফিসের ফ্ল্যাট উনি ভোগ করছেন, লাইট জ্বালাচ্ছেন, ফ্যানের হাওয়া খাচ্ছেন, যখন তখন ফোন করছেন, তার জন্যও কোনও দিন একটা পয়সাও তিনি দেন না। তাই নাকি ও মেয়েদের স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছে, ওর অবর্তমানে, টিউশুনি নিতে যাবার সময় ওরা যদি দেখে, বাড়িতে উনি আছেন, তা হলে যেন ফোনটা লক করে দিয়ে যায়। মেয়েদের যাবতীয় খরচখরচা নাকি কণিকাই চালায়।
ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রচুর কষ্ট দেখেছে ওরা। বাবার সঙ্গে তাদের মায়ের কী সম্পর্ক, ওরা তা জানে। তাই অন্য কারও সঙ্গে মাকে খুশিতে থাকতে দেখলে, ওরা তা হাসি মুখেই মেনে নেয়।
কিন্তু তা বলে এতটা! সে দিন যখন পিঠের নীচে দু’-তিনটে বালিশ দিয়ে খাটের ওপর আধ শোয়া অবস্থায় চায়ে চুমুক দিচ্ছিল ঋজু, তখন বড় বাবি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চোখ নাচিয়ে বলেছিল, আঙ্কেল আজ ক’বার হল?
ও কী বলতে চাইছে, বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখে আঙুল দেখিয়ে ও বলছিল, এক বার।
— উহু। মিথ্যে কথা। দু’বার। পাশের ঘর থেকে আমি শুনেছি।
— ধ্যাৎ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না ঋজুর কাছে।

আলাপের কয়েক দিনের মধ্যে কণিকা বলে দিয়েছিল, আমাকে পেতে গেলে কিন্তু আগে আমার মেয়েদের মন জয় করতে হবে। ঋজু তাই-ই করেছিল। ফোন করলে আগে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। তার পরে কণিকার সঙ্গে। প্রথম যে দিন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, সে দিন প্রচণ্ড গরম। ওদের জন্য ক্যাডবেরি আর দু’লিটারের একটা থামস আপ-এর বোতল নিয়ে গিয়েছিল ও। ছোট জন ওটা দেখে বলেছিল, অন্য কোনও রঙের পেলেন না!
তার পর থেকে ওদের জন্য ও আর কোনও দিনই ওই রঙের সফ্‌ট ড্রিংস নিয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে এ ফল ও ফল নিয়ে গেলেও ভুল করেও কখনও কালোজাম বা কালো আঙুর নিয়ে যায়নি।
দ্বিতীয় দিন যখন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, চা দিতে এসে ছোট বাবি ওর সামনেই দুম করে ওর মাকে বলেছিল, মা, আমি কিন্তু তোমার কাছে তিনশো টাকা পাই। মনে আছে? কাল কিন্তু দিয়ে দিও।
চায়ের প্লেট বিছানার পাশে রেখে সঙ্গে সঙ্গে পার্স থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বার করে ছোট বাবির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল ও। মেয়ে যখন কিছুতেই নিতে চাইছে না, ও তখন বলেছিল, এটা তোমার মায়েরই টাকা। আমার কাছে রাখা ছিল। নাও, নাও। যদি না নাও, তা হলে ভাবব, তোমরা আমাকে নিজের লোক মনে করো না।
কণিকাও বলেছিল, নে না। এত করে বলছে। একই তো। আঙ্কেল কি বাইরের লোক নাকি?
ধীরে ধীরে ঘরেরই লোক হয়ে উঠেছিল ও। যে সপ্তাহে রাত আটটা থেকে ডিউটি থাকত, ও কণিকাকে অফিস থেকে নিয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিত। খানিকক্ষণ কাটাত। তার পর অফিসে যেত। যে দিন কণিকা বলত, আজকে একটু তেরো নম্বরে নামব। ঋজু বুঝে যেত, ও আজ বাজার করবে। মাছ মাংস সবজি যা কিনত, ঋজু দাম দিয়ে দিত। প্রথম প্রথম কণিকা মৃদু আপত্তি করত ঠিকই, পরের দিকে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার দোকানদাররা পর্যন্ত ঋজুকে চিনে গিয়েছিল।

সব ঠিকই আছে। কিন্তু ও হঠাত্‌ বেলুড়ে গেল কেন! আর গেলই যদি, ফোনটা নিয়ে গেল না কেন! কাল রাতে ও যখন অফিস থেকে বেরোয়, তখনও কণিকার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। ‘কাল দুপুরে যাচ্ছি’ বলাতে কণিকা ওকে বলেছিল, এটা কোরো না গো। কাল তো তোমার ছেলের পরীক্ষা। তুমি তো বাবা। তোমার থাকা দরকার। একদম পাগলামো কোরো না। আমি তো আছিই। কোত্থাও যাব না। দরকার হলে ফোন করে নিও।
শেষ কথাটার মধ্যে, ঋজু যে ওকে সন্দেহ করে, সেই সন্দেহটা দূর করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রলেপ দেখতে পেয়েছিল ঋজু। তাই আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এটা কী হল! কোনও ফোন নেই, কিচ্ছু নেই, দুম করে চলে গেল! ওর বাবা কি কাল রাতে সত্যিই ফোন করেছিল! কখন!

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দোলের দিন ওরা রিনাদের বাড়ি যাবে। সেই মতো সকাল সাতটার মধ্যে ভারতীয় বিদ্যাভবনের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। কণিকা রেডিই ছিল। চার তলার জানালা দিয়ে ওকে দেখেই মিনিট কয়েকের মধ্যে নেমে এসেছিল। এমনি দিনেই অত দূরে সরাসরি কোনও অটো পাওয়া যায় না। তার ওপর সে দিন আবার দোল। অগত্যা একটা অটো রিজার্ভ করে ওরা রওনা হয়ে গেল সল্টলেক সেক্টর ফাইভ ছাড়িয়ে সোজা মহিষবাথানের দিকে। আগে নাকি গোয়ালারা ওখানে মহিষদের স্নান করাতে নিয়ে যেত। তার থেকেই এই নাম। ২৩৯/এ বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে অটোচালক বলল, ব্যাস। এ বার আপনাদের একটু হেঁটে যেতে হবে।
ওরা হাঁটা দিয়েছিল। এখানে পর পর অনেকগুলি ভেড়ি। টলটল করছে জল। হুহু করে হাওয়া বইছে। কণিকার শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। রিনাদের ‘আমরা এসে গেছি’ জানিয়ে দেবার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বার করেও ফোন না করে, ফোনটা টেপাটেপি করতে লাগল কণিকা।
ঋজু বলল, কী হল?
— বাইশখানা মিসড কল। আমরা কথার মধ্যে এত বিভোর হয়ে ছিলাম, শুনতেই পাইনি।
— একেই বলে প্রেম। কার নম্বর দেখো।
— কে জানে! চেনা নম্বর না। কয়েকটা নম্বর আবার বুথের। এত সকালে বুথ থেকে কে করল!
— কী করে বুঝলে বুথ থেকে?
— আট দেখে।
তখনই আবার ফোন। ঋজু বলল, ধরো। যে করেছিল, সে-ই হয়তো আবার করেছে।
ফোনটা অন করে কণিকা খুব নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল। একদম পাশে পাশেই হাঁটছিল ঋজু। কিন্তু ও যে কী বলছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না সে। ফোন ছাড়তেই ও জিজ্ঞেস করল, কে?
কণিকা বলল, ছোটকু।
— ছোটকুটা আবার কে?
— লোপার।
— লোফার?
— আরে বাবা, লোফার না। লোপার, লোপার। আমাদের অফিসে লোপা আছে না, ওর সঙ্গে ওর।
— ও-ও প্রেম করে?
— না। তুমি শুধু একাই করো। এই জানো কী হয়েছে, সে দিন ওর শাশুড়িকে অফিস যাচ্ছি বলে বেরিয়ে ছোটকুর সঙ্গে ও গড়চুমুক গিয়েছিল। ওহ্‌, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি, ওর কথা বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল। এর মধ্যে একটা কাণ্ড হয়েছে। লোপা তো ওর বরের সঙ্গে রোজ মর্নিং ওয়াক করতে যায়। এই ক’দিন আগে ও রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে ওর দুদু টিপে দে ছুট।
— সে কী? ওর বর ছিল না সঙ্গে?
— না। ওর বর একটু এগিয়ে গিয়েছিল।
— কথা বলতে বলতে রিনাদের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল ওরা। আবার ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ঋজু বলল, তোমার ফোন বাজছে।
কণিকা বলল, বাজুক, ধরলেই বকবক করতে হবে।

ঋজু আবিরের একটা প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল। ওটা খোলাই হল না। খোলা হল মদের বোতল। চিপসের প্যাকেট। রিনা আর আশিসের সঙ্গে পরামর্শ করে কণিকা নাকি গত কালই এগুলি কিনে রেখেছিল। ঋজুকে চমকে দেওয়ার জন্য।
গ্লাসে ঢালামাত্র ঢগঢগ করে খেয়ে নিল আশিস। রিনাও তাই। ওদের দেখাদেখি কণিকাও এক চুমুকে শেষ করে দিল গ্লাস।
ঋজুর মনে পড়ে গেল রাধানাথ মন্ডলের কথা। ওর একটা প্রকাশনা সংস্থা ছিল— সংবাদ। ও লোককে বলত, এটা একটা শিক্ষিত প্রকাশন সংস্থা। যেন বাকি প্রকাশকেরা সব মুখ্যু। পরে সেটা সমর নাগ কিনে নেন। এখন তো তাঁর বিশাল ব্যাপার। বেঙ্গল শেল্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে ফেলেছেন। কলেজ স্ট্রিট মার্কেট ভেঙে নতুন ভাবে বানাচ্ছেন।
সেই সংবাদ থেকে গল্পপত্র নামে একটি পত্রিকা বের হত। অনেক তরুণ লেখকেরা সেখানে আসতেন। আসতেন নবকুমার বসু, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, অমর মিত্র। কে নয়? আড্ডা হত। মাঝে মাঝেই মদের আসর বসত। সেই সংবাদে কাজের জন্য একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। রাধানাথ তাকে চাকরি দেয়নি। কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেবে বলে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ দিকে ও দিকে কাটাত।
রাধানাথ চাকরি করত। ফলে সংবাদে সময় দিতে পারত না। একটা ছেলে রেখেছিল। সে-ই দোকান খুলত। দেখাশোনা করত। হিসেবপত্র রাখত। একদিন সেই মেয়েটির সামনেই রাধানাথ তাকে বলল, আমি থাকি না-থাকি, ও যখন আসবে, যা টাকা-পয়সা চাইবে, ক্যাশ থেকে দিয়ে দিবি, কেমন?
ছেলেটি অবাক। তার মাইনেটা পর্যন্ত যে ঠিক সময়ে দেয় না, চাইলে, আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে সারা মাস ধরে কিছু কিছু করে দেয়, সে বলছে এই কথা! না। বেশিক্ষণ ধন্ধে থাকতে হয়নি তাকে। খানিকক্ষণ পরেই, ওই মেয়েটিকে বাসে তুলে দিয়ে এসে রাধানাথ বলল— ওর সামনে তোকে যে কথাটা বললাম, সেটাকে আবার সত্যি ভেবে নিস না।
ছেলেটি বলল, তা হলে? উনি যদি বলেন, তোমার সামনেই তো উনি সে দিন বলে গেছেন, তখন?
— বলে দিবি, আজ খুব খারাপ অবস্থা। কোনও বিক্রিবাট্টা হয়নি। ক্যাশে টাকা নেই, ব্যাস।
সেই মেয়েটি আবার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করত। দু’-এক বার তাকে নিয়েও সংবাদে এসেছিল সে। এক বার এমন দিনে এল, সে দিন ও রকমই এক মদের আসর বসেছিল। গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢালার সময় রাধানাথ ওই ছেলেটিকে বলেছিল, চলবে নাকি?
ছেলেটি মাথা কাত করেছিল। তাকে গ্লাস দিতেই, সে এক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে দিয়েছিল। তখন ওই মেয়েটি বলেছিল, দেখলেন তো, একেবারে চোস্ত্‌।
রাধানাথ বলেছিল, ও কোনও দিন মদ খায়নি।
— কী করে বুঝলেন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল।
রাধানাথ বলেছিল, যারা মদ খায়, তারা কখনও এ ভাবে খায় না। তারিয়ে তারিয়ে, রেলিশ করে খায়। চোখ দিয়ে ছেলেটিকে দেখিয়ে বলেছিল, গ্লাসে ওর চুমুক দেওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি, এ ব্যাপারে ও একেবারেই নবীশ।

এখন আশিস, রিনা আর কণিকার মদ খাওয়া দেখে ঋজুরও মনে হল, এর আগে এরা কখনও মদ খায়নি। এই প্রথম খাচ্ছে। যখন মদ খাওয়া চলছে, আবার ফোন বেজে উঠল কণিকার। তার পর আবার। আবার। দু’মিনিট ছাড়া ছাড়া ফোন। অথচ প্রতি বারই স্কিনে নম্বর দেখেই ও আর ফোনটা ধরছে না। একটু নেশা-নেশা মতো হয়ে গিয়েছিল সবারই। ঋজু হঠাত্‌ জানতে চাইল, কার ফোন? ধরছ না কেন? দেখি নম্বরটা? ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিল ঋজু। কিন্তু তার আগেই ঝট করে ফোনটা তুলে নিল কণিকা। ঋজুও ছাড়বার পাত্র নয়। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার পরে ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জোর জবরদস্তি। শেষে কণিকা বলল, দিতে পারি, কিন্তু তার আগে কথা দাও, ফোনটা তুমি ধরবে না।
ফোনটা নিয়ে ঋজু দেখল, একটা নম্বর থেকেই বারবার ফোন আসছে। যখন দেখছে, ঠিক তখনই আবার বেজে উঠল সেটা। অথচ কণিকাকে কথা দিয়েছে দেখে ও ফোনটা ধরল না। কণিকার কাছে দিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পরে নেশাটা একটু চড়তেই ও বলেছিল, যে ফোন করছে, তাকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো। কে করছে বলো? তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
বারবার জেরায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল কণিকা। কোনও রকমে উঠে, ঋজুর হাত ধরে টানতে টানতে ঝুল বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ও আর তুমি একই সঙ্গে আমার জীবনে এসেছ।
— তার মানে?
— ও আমাদের অফিসেই কাজ করে।
— কী নাম?
— এ কে পাল, অরুণকুমার পাল।
— কোথায় থাকে?
— কাঁচরাপাড়ায়।
— তুমি তো আমাকে এ সব কথা কখনও বলোনি।
— বহু বার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি।
— ঠিক আছে। এখন তো বলেছ। এ বার আমি বলি? তুমি আমাদের মধ্যে থেকে যে কোনও একজনকে বেছে নাও। একসঙ্গে দু’জনকে নিয়ে খেলা কোরো না।
কণিকা বলেছিল, আমাকে একটু ভাববার সময় দাও। কথাটা শুনে এক ঝটকায় নেশাটা কেটে গিয়েছিল ঋজুর। তখনই ও বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু আশিস আর রিনা ওকে আটকায়। কণিকাও এমন ভাবে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় যে, পুরো পরিবেশটাই পাল্টে যায়।
সে দিন রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি ঋজু। কী বলতে কী বলে ফেলবে, কিংবা কথা বলতে বলতে যদি কথা জড়িয়ে যায়, সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে, কারণ ও তো মদ-টদ খায় না। ওর বউ আবার কী ভাববে, হয়তো ভাববে এই বয়সে আবার কার পাল্লায় পড়ল! তাই আশিসই ফোন করে ভারতীকে জানিয়ে দিয়েছিল, আজকে একটু উল্টোপাল্টা খাওয়া হয়েছে তো,,, ও দু’-তিন বার বমিটমি করেছে। একটু কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে, না-হলে কথা বলিয়ে দিতাম। আজ তো দোলের জন্য গাড়িটারিও কম। এত রাতে ওকে একলা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছি না। আজকের রাতটা এখানে থাক। আমার মনে হয়, একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালে ওকে পাঠিয়ে দেব। আপনি আবার চিন্তা করবেন, তাই ফোন করলাম।
কণিকাও ফোন করল বাড়িতে। মেয়েকে বলে দিল, মহাদেববাবু যদি জিজ্ঞেস করে আমি কোথায়, তা হলে বলবি, আমি রিনাদের বাড়িতে আছি। রাতে এখানেই থাকব। কাল সকালে ফিরব। আর আঙ্কেল ফোন করলে বলবি, দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। মা বেলুড়ে গেছে। মোবাইলটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।

ঝট করে শক খেল ঋজু। ভুলে গেল, ছেলে এখন পরীক্ষা দিচ্ছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। ভুলে গেল, বউকে একটা গাছের তলায় বসিয়ে, ও বলে এসেছে ‘তুমি এখানে থাকো, আমি একটু আসছি’। একটু মানে কতক্ষণ? ওর মাথা আর কাজ করছে না। ওর মনে হল, ও যা শুনল, সেটা আসলে সে দিনের সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। তার মানে, কণিকা যা শিখিয়ে দেয়, ওর মেয়েরা তাই বলে। তা হলে কি ও আজ অন্য কারও সঙ্গে আছে! কিন্তু কার সঙ্গে! সে দিন যে নম্বর থেকে ঘনঘন ফোন আসছিল, তাঁর সঙ্গে কি? সেই নম্বরটা ওর মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। ও চটপট সেই নম্বরে ফোন করল— কণিকা আছে?
— এটা তো কণিকার নম্বর নয়। কে বলছেন? ও প্রান্ত থেকে এক গুরুগম্ভীর পুরুষ-কণ্ঠ।
ও বলল, আমি, আমি ঋজু। কণিকার বন্ধু।
— এই নম্বরটা পেলেন কোত্থেকে?
— না, আসলে দোলের দিন এই নম্বর থেকে ওর মোবাইলে বারবার ফোন আসছিল তো, তাই এই নম্বরে করলাম।
— দোলের দিন? আপনি জানলেন কী করে?
— আমি ওর সঙ্গে ছিলাম।
— ও, আপনি সে দিন ওর সঙ্গে বেলুড়ে গিয়েছিলেন?
— বেলুড়ে নয়। অন্য জায়গায়। ও আমার বিশেষ বন্ধু।
— বিশেষ বন্ধু মানে? একদম বাজে কথা বলবেন না। ও সে দিন বেলুড়ে গিয়েছিল। ওর মা ভীষণ অসুস্থ। ও এত টেনশনে ছিল যে মোবাইলটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। টিনা-মিনা আমাকে বলেছে।
— টিনা-মিনা! ঋজু ওর ভাই-বোন, তাদের ছেলেমেয়ে, এমনকী ওর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেরই নামধাম জানে। কিন্তু ওর মুখে কোনও দিন এই নাম তো ও শোনেনি! ও বলল, কে টিনা-মিনা?
— সে কী, আপনি বলছেন ওর বন্ধু, বিশেষ বন্ধু, আর ওর মেয়েদের নামটাও জানেন না? রাখুন। যত্তসব। বলে ফোনটা কেটে দিল। ঋজু স্তম্ভিত। ওর মেয়েদের নাম টিনা-মিনা! ওদের নাম তো বড় বাবি, ছোট বাবি! আমি কি কোথাও ভুল করছি! আচ্ছা, লোকটা কেমন যেন কেটে কেটে কথা বলছিলেন, না! তা হলে কি কণিকা ওঁর সঙ্গেই আছে! লোকটা ওর ইশারা অনুযায়ী কথা বলছিলেন! হতে পারে! খানিক পরে আবার ফোন করল ওই নম্বরে।
ফোনটা ধরেই লোকটা বললেন, কী হল?
— বিশ্বাস করুন, সে দিন ও আর আমি রিনাদের বাড়িতে ছিলাম। সারা রাত আমরা দু’জন একসঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছি।
— একদম বাজে কথা বলবেন না। ও যখন চাইছে না, কেন ওকে বিরক্ত করছেন? জানেন, ওর সঙ্গে আমার চার বছরের সম্পর্ক। কোনও ছাত্র যে কোনও শিক্ষকের বউকে এই ভাবে বিরক্ত করতে পারে, তা আপনাকেই প্রথম দেখলাম।
ছাত্র! আমি তো কখনও মহাদেববাবুর ছাত্র ছিলাম না! তা হলে কি ও ওর মতো করে ওনাকে সাত-পাঁচ বুঝিয়েছে! ও বলল, বিশ্বাস করুন, আমি এতটুকুও মিথ্যে বলছি না। দরকার হলে আপনি রিনাদের বাড়িতে ফোন করে জেনে নিতে পারেন।
— ওদের নম্বর কত?
কাঁধের ঝোলা হাতড়ে ছোট্ট ডায়েরিটা বার করে রিনাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা ও দিয়ে দিল। নম্বরটা নিয়েই ফোনটা কেটে দিলেন তিনি।

রিনাদের নম্বরটা বার করাই ছিল। দোলের দিন তারা যে ওদের বাড়িতে ছিল, কেউ ফোন করে জানতে চাইলে, তাকে যাতে রিনারা সত্যি কথাটা বলে দেয়, সেটা বলার জন্যই ও ফোন করল ওদের। কিন্তু যত বারই ফোন করল, শুধু এনগেজড আর এনগেজড।
উনি যত বারই ফোন করুন না কেন, এখন তো এনগেজড, পাবেন না। পরে যেন করেন। বলার জন্য লোকটাকে ফোন করতেই তিনি ধমকে উঠল,কী ব্যাপার? এত জ্বালাচ্ছেন কেন বলুন তো? কী চাই?
— না, বলছিলাম কি, রিনাদের ফোনটা এনগেজড, এখন হয়তো পাবেন না। পরে করলে নিশ্চয়ই পাবেন। সেটা বলার জন্যই...
— ওদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওরা তো ডিনাই করল।
— ডিনাই করেছে!
কথা শেষ হবার আগেই লোকটা লাইন কেটে দিলেন। তা হলে কি এতক্ষণ ওদের সঙ্গেই উনি কথা বলছিলেন! তা হলে তো ওদের নম্বরটা এখন ফাঁকা। ও ফের রিনাদের নম্বরে ডায়াল করল। রিনাই ধরল।
ঋজু বলল, আপনাদের কেউ ফোন করেছিল নাকি?
রিনা বলল, হ্যাঁ।
— দোলের দিন আমরা যে আপনাদের বাড়িতে ছিলাম, আপনি কি সেটা অস্বীকার করেছেন?
ঢোক গিলে রিনা বলল, আসলে, আমাদের বাড়িতে আপনারা রাত কাটিয়েছেন, এটা জানাজানি হলে আমাদের সম্পর্কে লোকে কী ভাববে বলুন তো... তা ছাড়া কণিকারও মান-সম্মানের ব্যাপার আছে। যতই হোক, মেয়ে তো, ওর কথা ভেবেই...
— ও।
আর একটা কথাও বলেনি ঋজু। হাঁটতে হাঁটতে যখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ঢুকল, বুঝতে পারল, অনেকক্ষণ আগেই পরীক্ষার পাট চুকে গেছে। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুটিকতক মাত্র লোক। বাঁ দিকের বিল্ডিংয়ের চাতালে ওর বউ আর ছেলে বসে আছে। কী ভাবে যে ও বাড়ি ফিরেছে, ও-ই জানে। সারা দিন শুধু ছটফট করেছে। সন্ধের দিকে ল্যান্ড ফোনে ফোন করতেই কণিকার গলা— হ্যালো?
— কোথায় গিয়েছিলে?
এক মুহূর্ত চুপ। তার পরেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল— কে বলছ? হঠাত্‌ গলার স্বর পাল্টে গেল। মহাদেববাবুর গলা ও চেনে। এটা তার গলা। তবে কি ওর গলা শুনেই রিসিভারটা মহাদেববাবুর হাতে দিয়ে দিল কণিকা!— একটু কণিকাকে দিন না।
— কণিকা! এ কী! তুমি বউদির নাম ধরে কথা বলছ কেন?
— না মানে, দিন না ওকে...
— ও সেই সক্কালবেলায় বেলুড়ে গিয়েছিল তো, ওর মায়ের কাছে। ওর মা খুব অসুস্থ। সারা দিন খুব ধকল গেছে। এখন একটু শুয়েছে। কাল কোরো। ভাল আছ?
আর ভাল! ও আর কোনও কথা বলতে পারল না। শুধু মনে মনে বলল, বুঝেছি, সারা দিন কোন ধকল গেছে।


                                              ক্রমশ...

__________________________________________________

চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-


ষষ্ঠ পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন --

Wednesday, June 8, 2022

ছোট গল্প - আমি তো জারজ || লেখক - অষ্ট দেয়াশী || Short story - Ami to jaraj || Written by Asto deasi


 আমি তো জারজ

অষ্ট দেয়াশী




আমাদের দেশে এখন ও একটি শিশু তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হয়। এটা আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা। কেন একটি শিশু তার মায়ের পরিচয়ে বাঁচতে পারেনা। 
মীরা একটি গরীব ঘরের মেয়ে পড়াশোনা কি জানেনা। 
ছোট বেলায় বাবা মা মারা যাওয়ার জন্য সে স্কুলে ভর্তি হয়নি। জেঠা জেঠি তাকে মানুষ করেছে। সারাদিন গাধার মতো খাটুনি খাটতে হয় তাকে জেঠি তাকে একদম দেখতে পারেনা। কথায় কথায় খাওয়ার খোটা দেয়। সব মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো তাকে। কোথায় যাওয়ার জায়গা নেই যে তার। 
এদিকে গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের মীরার দিকে নজর ছিল। এদের মধ্যে মাধব নামে একটি ছেলের নজর বেশি ছিল মীরার দিকে কিন্তু মীরার আবার মানবকে খুব বিশ্বাস করতো। এই বিশ্বাস এনে দিল তার জীবনে সর্বনাশ। 
একদিন কথার ছলে মীরাকে ডেকে নিয়ে গেলো কাজ দেবে বলে। মাধব তাকে রেফ করে এবং বলে যদি কাউকে বলে তাহলে তাকে মেরে ফেলবে। তাই মীরা কাউকে সেই কথা বললো না। 
মাধব ছিল গ্রামের মোড়লের ছেলে। একদিন মীরা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। জেঠা ডাক্তার বলে মীরা মা হতে চলেছে। শুনে জেঠা জেঠির মাথায় হাত কি করবে মীরাকে বলে তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। মীরা সব কথা বলে জেঠা মীরা কে নিয়ে মোড়লের বাড়ি যায় মোড়ল কথা শুনে মীরা কে তার জেঠা কে মারে। লোক ডেকে বলে এই মেয়ে দুচরিত্রা তাই একে গ্রামে রাখা যাবেনা। গ্রামের অন্য মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে তাই গ্রাম থেকে মীরাকে তাড়িয়ে দিলো। 
মীরা কোথায় যাবে কে তাকে আশ্রয় দেবে। 
মীরা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলো সে  ট্রেনে মাথা দিতে গেলো এক বৃদ্ধা মীরা কে তাদের বস্তিতে নিয়ে গেলো। মীরা কে সে তার বোনের মেয়ের পরিচয় দিলো। 
কিছু মাস পর বস্তিতে মীরা ছেলে হলো। হঠাৎ একদিন সেই বৃদ্ধা মারা গেলো। মীরার জীবনে আবার দুঃখ নেমে এলো কী দোষ করে ছিল মীরাকে ঈশ্বর বার বার তাকে কষ্ট দিচ্ছে। বস্তির সকলে তাকে তার মাসীর কাঁচা আনাজের ব্যবসা করতে বললো। ছেলেকে মানুষ করার জন্য মীরা তাই করলো। 
দেখতে দেখতে মীরার ছেলে ছয় বছরের হয়ে গেলো রকি দেখে কতো ছেলে মেয়েরা তার বয়সি রোজ স্কুলে যায় তাহলে সে কেন স্কুলে যাবে না। সে মায়ের কাছে স্কুলে যাবার জন্য বায়না করলো। 
পরের দিন মীরা রকিকে নিয়ে স্কুলে গেলো হেডমাস্টার মীরা কে রকির বাবার নাম জানতে চাইলো কিন্তু মীরা নাম বলতে পারলো না তাই রকি কে স্কুলে ভর্তি করাতে পারলোনা। তিরস্কার হয়ে তারা স্কুলে থেকে চলে এলো। সারাদিন ধরে রকি স্কুলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে যদি দয়া করে তাকে ভর্তি করে বাচ্চা ছেলে মন সে জানে না এই সমাজে নিয়ম। 
বস্তিতে সকলে তাকে বে জন্ম বলে ডাকে একদিন রকি একটি ছেলের মাথা ফাটিয়ে দেয়। বস্তিতে সকলে তাকে অপমান করতে লাগলো রোজ অপমানের লজ্জা মীরা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মা হত্যা করলো। 
পরের দিন রকি দেখলো তার মায়ের ঝুলন্ত দেহ টা মায়ের পা ধরে চিৎকার করতে লাগলো বস্তির সকলে ছুটে এলো। থানা থেকে পুলিশ এলো মীরা কে নিয়ে চলে গেলো 
কে দেখবে রকি কে খিদের জ্বালায় রকি একটি বাড়িতে রুটি চাইতে গেলো বেজন্মা বলে তাকে তাড়িয়ে দিলো। 
বেশ কয়েক বছর কেটে গেলো রকি এখন মস্ত গুন্ডা অনাহাসে সে মানুষ খুন করতে পারে। দিনের পর দিন শহরের ডাকাতি বাড়তে লাগল। কিন্তু পুলিশ ধরতে পারলো না। 
একদিন রকি এক নেতাকে মারার সুপারি নিলো একজনের থেকে দশ লক্ষ টাকা। প্রতিটি ছেলের ব্যাঙ্ক কে সেই টাকা জমা করে দিলো কারণ সে জানতো যদি সে ধরা পরে আর দশটি ছেলে বেঁচে যাবে তাদের ভবিষ্যৎ। 
একটি পিছিলে রকি ঢুকে নেতার মাথায় গুলি করে দিলো নেতা সেখানে মরে গেলো। পালাতে গিয়ে রকি ধরা পড়লো। ২২ শে জানুয়ারি রকি বিচার রকি কে বিচার কিছু বলার সুযোগ দিলো রকি চিৎকার করে বলে কোথায় ছিল সেই দিন যেদিন তাকে তার মা স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়ে ছিল বাবার পরিচয় দিতে পারেননি বলে স্কুলে থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সে আইন মানেনা আদালত মানেনা। তার একটি পরিচয় সে জারজ সন্তান। 
বিচারে তাঁর ফাঁসি হলো। সে হাসতে লাগলো আর চিৎকার করে বলে এ সমাজে কোন সন্তান যেন রকি মতো না হয় রকি হারিয়ে গেলো। 

Monday, June 6, 2022

ছোট গল্প - শত্রু-মিত্র || লেখক - সামসুজ জামান || Short story - Satru Mitra || Written by SAMSUZ ZAMAN

 



শত্রু-মিত্র

       সামসুজ জামান



 ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এর বাইরে থেকে কাঁচ ঘেরা কেবিনের দুটো বেডের দিকে ক্রমাগত চোখ রাখছিলো জনার্দন। দুটো বেডের একটাতে তার ছেলে যতীন এবং অন্যটাতে ছোট ভাই বলরাম। চোখ থেকে টস টস করে জল পড়ছিল জনার্দনের। ভাবছিল কি করে এমন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল?

দুটো পরিবারের মধ্যে ইদানিং কালের সম্পর্কটা খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছে ছিল। কিন্তু এমন সম্পর্ক তাদের মধ্যে আগে কোন দিনই ছিল না। বরং সকলেই পাড়ার মধ্যে এই দাদা ভাইয়ের একেবারে হরিহর আত্মার সম্পর্কের কথা জানত। তবে সব বদলে গেল একটা রাজনৈতিক কারণ থেকে। বলরাম, সাগর বাবুর রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর পর থেকেই। জনার্দন চিরকালই দীপেশ বাবুর পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী। পার্টির একজন নামকরা জান লড়িয়ে দেওয়া কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল দীপেশ রায়ের পার্টিতে, তার ডানহাত বাঁহাত বলা হত।   

বলরাম ছেলেটা সমাজকর্মী হিসেবেই পরিচিত কিন্তু সে যখন সাগর বাবুর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে কাজকর্ম করা শুরু করল তখন থেকেই নানাভাবে তার উপর চাপ এল। সে যেন ওই পার্টির সমস্ত কাজ থেকে নিজের নামটা তুলে নেয়। বলরাম জানতো দুর্নীতির সঙ্গে তার কোনো আপস নেই। আর সে পার্টির কাজ করবে গরিব দুঃখী জনগণের স্বার্থেই, রাজনৈতিক ধামাধরা কোন কাজ কর্মের জন্য সে পার্টিতে নাম লেখায়নি।

এক রাতে সে যখন ঘুমোচ্ছে, কেউ এসে তার নাম ধরে ডাকতেই কিছু না ভেবে সে দরজা খুলে দিয়েছিল। দীপেশ রায়ের পার্টির লোকজনরা মুখে মুখোশ পড়ে তার ঘরে এসে আক্রমণ চালাল। মোটামুটি ভাবে হুমকি দেয়া হয়েছিল,তবে মুখোশের আড়াল থেকে দু-একজন যে দুটো থাপ্পর দেয়নি তা নয়। বলরামের সেদিন থেকে যেন জেদ আরো বেশি চড়ে গেল এবং সে প্রতিজ্ঞা করল কোনভাবেই পার্টি থেকে নাম তুলে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

  জনার্দন বেশ হাসি খুশির সঙ্গেই বাড়িতে ফিরল তবে ছোট ছেলেটার কান্না শুনতে শুনতে। তার বউ তারামণি জানাল ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছে, বারবার পেটে হাত রাখছে কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারছে না কি তার অসুবিধা। তার বউ আরও বলল- দেওর কে জানাব? ওদের তো এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে রয়েছে। হয়তো ছেলেটার কোন ভাল ব্যবস্থা হতে পারে চিকিৎসার। কথাটা শুনেই চিৎকার শুরু করে দিলো জনার্দন। তারামণি চুপ করে গেল ভয়ে।

এখন কেউ বলরাম কে দল থেকে দূরে রাখার কথা ভাবতেই পারেনা। ছেলেটা ইতিমধ্যেই যেভাবে নাম কামিয়েছে, বিশেষ করে গরীবগুর্বো মানুষেরা বলরামদা বলতে যেন অজ্ঞান। যেকোনো ধরনের ঝামেলা, অশান্তি , অভাব-অভিযোগ, সমস্যা যাই ঘটুক না, বলরাম এক পায়ে খাড়া। আর তার বাড়ি থেকে সাহায্য সহযোগিতা ও প্রচুর মাত্রায়। বলরাম পার্টিতে নাম লেখানোর আগে ভাবেনি কিন্তু পিছন থেকে যদি স্ত্রী সুনন্দা সাহায্য সহযোগিতা না করলে সে একজন সফল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এভাবে বিবেচিত হতো না।

সমস্যাটা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। জনার্দন কোনমতেই সহ্য করতে পারছিল না বলরামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। গোপনে গোপনে গ্রামের ধান্দাবাজ ছেলেদের লড়িয়ে দিয়ে নানাভাবেই অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিল সে। আর গত পঞ্চায়েত ভোটে সাগর বাবুর রাজনৈতিক দল জয়লাভ করার পর থেকেই জনার্দন আর বলরাম একেবারে সাপে-নেউলে। অবশ্য সেটা মূলতঃ জনার্দনের দিক থেকেই। তারা একই জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কিন্তু এখন তাদের দুটো পরিবারকে দেখলে কেউ অন্তত একথা বলবে না। 

 বলরাম সেদিন আসছিল রাস্তা দিয়ে বৌদি ছুটে এসে বলল- ভাই, একটা কথা বলব,রাখবে? একটু অবাক হয়ে বলরাম বলল - বৌদি ওই ভাবে বলছ কেন? কি দরকার বল না?

- বলতে পারি কিন্তু দাদা জানলে আমার আর কিছু বাকি রাখবে না।

- তুমি নির্ভয় বলো। - উত্তর দিল বলরাম।

- ছেলেটার কি যে হচ্ছে পেটের মধ্যে, খুব অসুবিধা, অস্বস্তি, কষ্ট পায়, যন্ত্রণা ভোগ করে। তোমার দাদা তো নজরই রাখে না। অনন্ত বাবুর হোমিওপ্যাথিই ভরসা। তবে দিন দিন বাড়ছে, আমি তো মা, তাই বুঝি- বলতে বলতে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল বউদি। - একটু ব্যবস্থা করে দাও না ভাই যেমন করে হোক।

 বলরাম ডক্টর সিকদার কে ফোন করে ঘটনাটা জানালো। বৌদিকে বলল তুমি যেভাবে হোক ডঃ শিকদারের কাছে নিয়ে যাও ওনার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। উনি চিকিৎসা করাবেন কিন্তু দাদাকে আমার নাম জানিও না তাহলে চিকিৎসা করাতে দেবে বলে মনে হয় না। বউদি ওই অবস্থায়ও একটু হাসল, বলল – সে আর আমি জানি না!

 বৃষ্টি হচ্ছিল কদিন থেকে প্রচুর মাত্রায়। তার মাঝেই ময়ূরাক্ষী যেন একেবারে নিজের স্রোত উজাড় করে দিল। বন্যায় গ্রামকে গ্রাম তলিয়ে যাবার জোগাড়। এমনিতেই নন্দপুরের সাধারণ মানুষের বড় বেহাল অবস্থা। এরপর থেকে গ্রামীণ মানুষগুলোর সর্বাঙ্গীণ অবস্থা খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছলো। প্রথম দু-চারদিন তারা কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে চালিয়েছিল। নিজেদের ঘরের লাউ, কুমড়ো, এঁচোড়, ইত্যাদি নিয়ে ভাগ-যোগ করে দুটো ভাত কোনরকমে তারা গিলতে পারছিল। কিন্তু ঘরের অবস্থা সবারই খারাপ। তাই বেশিদিন চালানোর মত সামর্থ্য ছিল না।

 খুব তৎপর হয়ে বলরাম, সাগরবাবুর মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের জন্য অনেক ত্রাণসামগ্রী জোগাড় করেছিল। বরাবরই সাগর বাবুর তার উপর খুবই ভরসা। বলরাম নিজের বাড়ির একটা ঘরে সেসব সামগ্রী যত্ন করে রেখে দিচ্ছিল অসহায় মানুষদের মুখের গ্রাস। মাথায় তুলে রাখার মত সম্পদ এগুলো তার কাছে। একটু একটু করে এসব তার সঙ্গী সাথী নিয়ে সে গরিবদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল।

সেদিন সকালবেলায় তার বাড়ির সামনের দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুনে বলরাম ছুটে বেরোতেই, মানিক বলল- দাদা, দেখেছো, তোমার ঘরের পিছন দিকের দরজা ভাঙ্গা। শুনে আঁতকে উঠল বলরাম। সে কিরে! বলিস কি? বন্যার ত্রাণসামগ্রী সব তো ওঘরেই রাখা আছে! দ্রুত সবাই মিলে ছুটল সে ঘরের দিকে। যা ভাবা তাই! ত্রাণ সামগ্রীর ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই।

 গ্রামে উত্তেজনা বাড়লো। বিরোধী দল থেকে বলাবলি শুরু হল-প্রথম প্রথম ভালো কাজ দেখিয়ে বলরাম সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু আসলে সে একটা ফেরেববাজ, শয়তান। গোপনে এই ত্রাণের সামগ্রী বিক্রি করে তার পকেটস্থ করেছে সে।

 থানা পুলিশ হল। আত্মপক্ষ সমর্থনের তেমন কোন সুযোগ তার সামনে ছিল না। সুতরাং গ্রেফতার হল বলরাম। কেস চলতে থাকলো তবে সাময়িকভাবে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হল। আরো কিছুদিন যেতে না যেতে উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণের অভাবে বলরাম নির্দোষ প্রমাণিত হলো। সদর থেকে গ্রামে ফিরতেই বলরাম শুনল ভাইপো যতীন কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। তার কিডনির অবস্থা খুব খারাপ। কদিন ধরেই ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। সময়ে সময়ে বলরাম ডঃ; শিকদারের কাছ থেকে সব খবরই পাচ্ছিল। রোগীর খুব অবস্থা খারাপ হওয়ায় শিকদার স্যর তাকে পাঠিয়েছেন সদর হাসপাতালে।

 তার দুটো কিডনিই একেবারে অচল। খুব কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা। জনার্দন এসে ভাইয়ের হাত দুটো ধরে বলল- কিছু ব্যবস্থা কর। ভাইপো টা যে মরে যাবে! ভাইপোর খবর শুনেছিস? তার কিডনির খুব সমস্যা। আমার মত মানুষ পয়সা কড়ি কোথায় পাবো বলতো? কিডনি জোগাড় করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! 

অনেক দৌড়ঝাপ করে বলরাম কলকাতা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাইপো কে স্থানান্তরিত করল। দুটো কিডনিই তার অচল। সুতরাং কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর ব্যবস্থা না করলে এই ছেলের বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই। দাদা তার হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলল- আমার মত মানুষের পক্ষে কি করে সম্ভব বলতো কিডনির আমি কি ব্যবস্থা করব? বলরাম বলল তুমি ভাবছো কেন তোমার ছোট ভাই তো বেঁচে আছে এখনো। এরপরের কাহিনী ইতিহাস।

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এর ভিতর এখন সেই দুটি প্রাণী। একটি বেডে বলরাম, অন্য বেডে ভাইপো যতীন। বলরাম খুব সানন্দে ভাইপো যতীনকে তার একটা কিডনি দানের অঙ্গীকার করেছে। সবকিছু মিলে যাওয়ায় চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেও কোন অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে দু'ঘণ্টা কিভাবে অতিবাহিত হয়েছে তা বলে বোঝানো মুশকিল। তিনটি প্রাণী বাইরে দাঁড়ানো - দুই ভাইয়ের স্ত্রী এবং জনার্দন। একটু দূরে গ্রামের অগনিত লোকজন। সাগর বাবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না, দশ বার আসা-যাওয়া করছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে নির্বিঘ্নে বলরাম এবং যতীনকে বের করে আনা হয়েছে। তারপর থেকেই আই সি ইউ এর কেবিনে বাইরে থেকে তারা নিষ্পলক চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অক্সিজেন, রক্ত, স্যালাইন, কি না কি চলছে! দুটো দেহ পাশাপাশি বেডে - একজন দাতা অন্যজন গ্রহীতা।

একসময় ভিতর থেকে কাঁচের দরজা খুলে নার্স একটু উঁকি দিতেই তৎপর হয়ে দৌড়ে গেল সুনন্দা আর তারামণি - কি হয়েছে, কেমন আছে? – উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল ওরা দুজন। নার্স জানাল- কিডনি গ্রহণ করে ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠছে বেশ,তবে অজ্ঞান অবস্থায় থাকবে আরও দশ বার ঘন্টা। কিন্তু কিডনিদাতার এখনো বিপদ কাটেনি, ঠিকভাবে জানতে সময় লাগবে আরও চব্বিশ ঘন্টা। -ঠাকুর, রক্ষে কর আমার ভাইকে- আর্তনাদ করে উঠল তারামণি। আর অধরটা দাঁতে কামড়ে ধরে থর থর করে কেঁপে উঠল সুনন্দা।

চোখের পলক পড়ে না দু-তিনটি প্রাণী একভাবে হাসপাতালের দরজার বাইরে অপেক্ষমান। কখন ভালো খবর আসে এই অপেক্ষায়। 

– একটু জল খাও তো বোন, বলে তারামণি জলের বোতলটা জোর করেই সুনন্দার হাতে গুঁজে দিয়েছে। আর ঠিক সে সময় হঠাৎই- সরে যান, সরে যান, বলতে বলতে দু-তিন জন ডাক্তার ছুটে গেলেন ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের ভিতরে। মুহূর্তেই যেন হাসপাতাল চত্বর টা অন্য রূপ পেল। ডাক্তার নার্সদের তড়িঘড়ি ছোটাছুটি, মুহুর্তের মধ্যে যেন পরিস্থিতি টাকে একটা উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে দিল।

 -কি হয়েছে, কাঁচের দরজার কাছে বিস্ময়ে ছুটে গেল সুনন্দা। - আরে সরে যান তো! কাজের ডিস্টার্ব করবেন না - বলতে বলতে একজন নার্স সুনন্দাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকে গেল। কেবিনের গ্লাসে চোখ রেখে সুনন্দা আর তারামণি দেখছিল ভিতরে কি কান্ড ঘটছে। কিন্তু হঠাৎ স্ট্যান্ড দেওয়া পর্দা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলো বলরামের বেড টা। ভিতরে ডাক্তার নার্সদের ছুটোছুটি বাইরে থেকে দেখার আর উপায় রইল না ! এক-একটা মুহূর্ত যেন এক-একটা দিন-রাত্রি সমান। 

বড় জা ছোট কে সান্তনা দিচ্ছিল - ভয় পেয়ো না বোন, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো ....... আরো কি কি বলতে যাচ্ছিল। ভিতর থেকে একজন সিস্টার বেরিয়ে এসে খবর দিলেন- কিডনি নিয়ে বাচ্ছাটা তো বেশ ভাল, খুব ভালভাবেই কিডনি নেওয়া-দেওয়া হয়েছে। তবে কিডনি দাতার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছিল আর দুর্ভাগ্য যে আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওনাকে বাঁচাতে পারলাম না! কথাগুলো শোনা মাত্রই সুনন্দা এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল- সে কি ঠিক কথা শুনল? তার স্বামী সত্যি বেঁচে নেই? তারপরেই পাগলের মত চিৎকার করে উঠল- এই ডাইনি চুপ কর, বাজে কথা বলার জায়গা পাস নে! 

    বাইরে বেরিয়ে আসা এক ডাক্তারবাবুর পা দুটো ধরে জনার্দন তখন পাগলের মত চিৎকার করছে- আমার ভাইকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, আমার ভাইকে বাঁচান! ওর মতো মানুষ দুটো হয় না। ওকে যা হোক করে ফিরিয়ে দিন, আমি ওর সাথে কোনদিন আর দুর্ব্যবহার করব না, আপনি যা হোক করে ওকে ফেরান ডাক্তারবাবু। ডাক্তারবাবু সান্ত্বনা দিলেন- তা কি আর হয় ভাই, যে যাবার সে চলে গেছে। তাকে ফেরানো কি আর আমাদের হাতে?

 কোন কথাই শুনতে চাইছিল না জনার্দন – চিৎকার করে বলল -জানেন ডাক্তারবাবু, আমার ভাই আসলে দেবতার মত। ডাক্তার বাবু, আপনারা চেষ্টা করে ওকে ফিরিয়ে দিন যেমন করেই হোক। ডাক্তার বাবু জনার্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বাবা যা হবার হয়েছে আর তো আমাদের কিছু করার নেই। তুমি ঘরে ফিরে যাও। ভাইয়ের দেহ সৎকার করার ব্যবস্থা করো। 

সাগর বাবু আর তার লোকজন সবাই তখন ভীড় করে এসে দাঁড়িয়েছে। জনার্দন ডাক্তারবাবুকে ছেড়ে ছুটে গিয়ে বৌমার পা দুটো চেপে ধরল - জানো বৌমা একদিন তোমাদের ঘর ভেঙে বন্যা ত্রাণের সামগ্রীগুলো লোকজন নিয়ে আমরা চুরি করেছিলাম, অকারনে ওকে কলঙ্কিত করতে। সে কথা বুঝতে পেরেছিল বলরাম কিন্তু প্রতিশোধ নেয়নি, এমনই দেবতার মত মানুষ আমার ভাই। তার বদলে ও নিজের কিডনি দিয়ে আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে আজ নিজে নিজে চলে গেল। বৌমা বলতো এই শাস্তি আমি কি করে মাথা পেতে নিই? কি করে সহ্য করি? 

সুনন্দা তখন পাথরের মত মুখ করে ভাসুরের দিকে তাকিয়ে। ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না সে রক্তমাংসে গড়া কোন মানুষ, নাকি পাথরে গড়া কোন প্রতিমা!

Sunday, June 5, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -5


 


দুই 

দাদার পত্র এলো, এ বছর পূজোতে সে বাড়ী আসবে ও সাথে একজন বন্ধু আসবে। জগৎ আলো করে মা দশভূজা আসছেন দিন সাত/ আট পরে। পর পর দু'বছর দাদা পূজোতে বাড়ী আসেনি। আমাদের অভাবের দিন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। বাবার শরীর ভেঙ্গে গেছে। তবুও সমানভাবে উপার্জন করে চলেছেন। বাবার সেই আশা, দাদাকে ডাক্তারী পাশ করাতে হবে। তাই ভালো পুষ্টিকর খাবারের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। সাধারণ দুস্থ পরিবার যেমনভাবে বেঁচে থাকে আমাদের অবস্থা সেই রকম। শুধু এ চিন্তা করতাম, এদিন আমাদের থাকবে না। মানুষ অনেক কষ্টের পর সুখ পায়।

সেই আশাতে তাকিয়ে থাকলাম, সেই দিনটা কবে হবে। দাদার বন্ধু আসবে শুনে একটু ভয় পেলাম। কারণ আমাদের দারিদ্রের মধ্যে কি করে তাকে আপ্যায়িত করবো। চিন্তাকুল মনেও বাবা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সুমন্ত ও তার বন্ধু আসছে , এতো বড় আনন্দের কথা। সে জন্য চিন্তা করার কি আছে। ওরে যে আসবে সেও মানুষ, হয়তো দুটো দিন আমাদের কষ্ট হবে। তুই বড় সংসারী হয়ে গেছিস দেখছি। সংসারের হাল হাতে নিয়েছিস বলে এতা চিন্তা কেন ? আমি তো আছি। 

শুধু সংসারের কথা ভাবছিলাম না , ভাবছিলাম আসন্ন দুর্গা উৎসবে মধুময় দিনগুলোতে সাজ পোষাকের অনটনে কিভাবে অন্যান্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবো। 

বাবা একদিন বলে ছিলেন জানিস মা আমাদের এখনো পর পর তিন বছর এই দারিদ্রের মধ্যে দিন যাপন করতে হবে। পরিবারে বস্ত্রের অভাব ছিলো যথেষ্ট, কিন্তু সংসারের কথা চিন্তা করে বস্ত্রের অভাব মেটাতে পারিনি। 

স্থির করলাম, দাদার বন্ধু এলে পর পাশের বাড়ী হতে আতিথ্যের যাবতীয় ব্যবস্থা করবো। তাছাড়া গরীবের কি উপায় থাকতে পারে। 

সপ্তমীর আগের দিন পশ্চিম দিগন্তে সূর্য্যের ম্লান রশ্মি মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন দাদা ও তাঁর বন্ধু রন্টু উপস্থিত হলেন সমভিব্যাহারে। দাদার বন্ধু রন্টুদার চেহারা দেখে আমি বিরামাবিষ্ট হলাম। গৌরবর্ণ চেহারা, পাতলা মুখ , কোকড়ান মাথা ভর্তি চুল। চোখের দৃষ্টিও তীক্ষ্ম। ভ্রু দুটো যেন কোন শিল্পী এঁকে দিয়েছেন, পরিধানে আভিজাত্যের ছাপ। বিশেষ করে ওর নয়ন ভুলানো রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আমি এ পোষাকে তার সামনে থেকে সংকুচিত হয়েছিলাম। এমন সময় দাদার ডাক শুনতে পেলাম। 

দাদা ও রন্টুদার যথাচিত আদর আপ্যায়ণ করলাম। এই ভাবে সেইদিনের রাতটা কেটে গেলো। বারবার সেসময় মনে উদয় হয়েছিলো, ঐ মানুষ আমাদের এই দীন অবস্থার মধ্যে থাকতে পারবেন কি না। বড়লোকের ছেলে পালঙ্গের উপর শুয়ে নিশিযাপন করেছেন। এই বাড়ীতে অসুবিধাতো হবেই। ওকে ঠিক মতো আপ্যায়িত করতে পারবো কিনা সেজন্য দাদার উপর ভীষণ রাগ হয়েছিলো কেন জেনে শুনে এখানে তাকে উপস্থিত করলো। নানান চিন্তার মধ্যে রাত কাটালাম। 

পরদিন সকালে উঠে সংসারের কাজে লিপ্ত হলাম, বাড়ীর চারিপাশে ঝাড়ু দিচ্ছিলাম রন্টুটা কখন হতে যে আমার মুখপানে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ পিছন ফিরতেই চোখে চোখ পড়তেই আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বাড়ীর ভেতরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিলো! তবে কি সে আমার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিলো? 

ভুল ভাঙ্গলো ঘন্টা তিন পর। যখন ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে বলল, কি রে রমা, আমায় দেখে ভীষণ লজ্জা পেলি।


একজন প্রবাসী অপরিচিতের মুখে জীবনে প্রথম পরিচয়ে এরকম কথা শুনব কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুতে চাইছিলো না। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আমার চিন্তা মুক্ত করে বলল, কি ব্যাপার এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? তোর নিকট তোর সুমন্তদা যেমন আমাকেও সেরূপ ভাবিস।

 আমি আরো চমকে উঠলাম। আমি আজ পর্যন্ত কোন ছেলের নিকট হতে এরূপ সৌজন্যমূলক আচরণ পাইনি। পাড়ার অনেক যুবক আমাকে উত্যক্ত করেছে, আমার প্রতি কটাক্ষপাত করেছে। সে সময় নিজেকে আমি অসহায় বোধ করেছি। আমি ওদের আচরণ দেখে প্রতিবাদ করতে পারিনি। শুধু মনে পড়তো ঠাকুরদার কথা। যদি ঠাকুরদা বেঁচে থাকতেন বা আমাদের পূর্বের অবস্থা বজায় থাকতো তাহলে কোন প্রকারে একথা বলার দুঃসাহস পেতো না। আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলার জন্য অনেকেই হীন ষড়যন্ত্র করেছিলো। 

রন্টুদার কথাতে আমার ঘোর কাটলো। সে বলল, চল এই মহাপুজার দিনে আমরা সকলে সেজেগুজে প্রতিমা দর্শন করে আসি। ওকথা বলে রন্টুদা ভেতরে গিয়ে তার এটাচি হতে ভালো প্রিন্টের একটা শাড়ী বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, শোন এবার বাড়ীর কাজকর্ম বন্ধ করে আমাদের সাথে মেলা দেখতে যাবি। দুর্গাপূজায় মেলা বসতো আমাদের পুরানো বাড়ীর সামনে। ধূমধাম কম হতো না। ঠাকুরদার আমলে পূজোর চারদিন গ্রামবাসীদের উনুনে আঁচাদিতে হতো না। কারণ মহাভোজের ব্যবস্থা করতেন! এখন সব মুছে গেছে। মেজকাকা কোন প্রকারে পূজো চালাচ্ছেন। যদি বাবা পূজোতে কিছু সাহায্য করতেন, মেজকাকা অমানুষিকতার জন্য মন চাইতো না।

 আমি শাড়ীটা হাতে নিতে লজ্জা করছিলাম, কিন্তু দাদার কথায় লজ্জা বিসর্জন দিতো হলো। কোন প্রকারে শাড়ীটা হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

 সকাল হতেই পুরানো বাড়ীতে সানাই বেজে চলেছে। সানাই এর সুর কানে আসতেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। কি আনন্দই না ছিলো ঠাকুদার আমলে। পূজোর চারদিন দশ ভূজার আগমনে মহাসমারোহে, উৎসব প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠতো। সেই সময় ঠাকুরদার নিকট হতে চরম স্নেহ ও ভালোবাসা লাভ করেছি। এখন ঐ পূজা মণ্ডপে প্রবেশাধিকার আছে কিন্তু আগের মতো অধিকার নেই। 

তাই বাবা বারবার বলেছেন, যদি দশভূজাকে প্রণাম করার ইচ্ছা থাকে তাহলে। যেও, তবে বেশী বিলম্ব করা চলবে না। দাদা, আমি ও রন্টুদা প্রতিমা প্রণাম করতে গেলাম। রন্টুদার স্বভাব ও আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করে তুললো। সেই জন্য রন্টুদার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়ে উঠলো। আমি সত্যিই আনন্দিত হলাম আরেক দাদাকে পেয়ে।


                                       
                                                ক্রমশ...


_______________________________________________

চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--


Saturday, June 4, 2022

ছোট গল্প - পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - pen o phire paouar golpo || Written by Dipankar saha


 

পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু

দীপঙ্কর সাহা


-এক-


শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল বুলু (হেমন্ত দত্ত)। আমাদের পাশের পাশের বাড়ি থাকতো। এক সাথে স্কুলে যাওয়া ও স্কুল থেকে ফেরা, অবসর সময়ে এক সাথে খেলা ধুলো, সবকিছুতেই বুলু ছিল আমার একমাত্র সাথি। 


আমার শৈশব ও কৈশোরের সোনালী দিনগুলো কেটেছে যশোর শহরে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যা এখনকার বাংলাদেশ। 


যতদূর মনে পড়ে, যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি, তখন বুলুরা সপরিবারে পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে আসে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁতে বসবাস করতে শুরু করে। 


তার অনেক পরে, ক্লাশ টেনের ফাইনাল পরীক্ষা (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট) দিয়ে আমিও চলে আসি কলকাতায়। এত বছর পরেও বুলু কে আমি খুব মিস করতাম। 


ইচ্ছে থাকলেও বুলুর সাথে দেখা করার বা বনগাঁ যাবার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া ওদের বাড়ি চিনি না, বনগাঁ অনেক বড় জায়গা, কোথায় খুঁজবো বুলু কে বনগাঁ গিয়ে! 


এর বছর চারেক বাদে আচমকা এক সুযোগ এসে গেল বনগাঁ যাবার। বড়দা একদিন একবেলার জন্য কি একটা কাজে বনগাঁ গিয়ে ফিরলো না। মা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে, পরদিনই সকালে, আমাকে বনগাঁ গিয়ে খোঁজ খবর করতে পাঠিয়ে দিল। 


গেলাম। এই ভরসায় গেলাম যে, বুলুদের একটা দোকান ছিল বা আছে বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও, এইটুকু শুধু জানতাম। 


তাছাড়া বুলুর এক কাকা ছিলেন বড়দার বন্ধু। হয়তো কোনও খবর পেলেও পেয়ে যেতে পারি, ওদের বাড়ি গেলে। 


বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়ে, বুলুর বাবার নাম করে দোকানের খোঁজ করতে পেয়েও গেলাম। দোকানে বুলুর বাবা ছিলেন, আর বুলুর ছোটভাই খোকা। 


খোকা আমাকে চিনতে না পারলেও, বুলুর বাবা এতো বছর পরেও আমাকে এক নজরে চিনতে পেরে মহা উৎসাহে হৈচৈ বাঁধিয়ে সমস্ত খোজ খবর নিতে শুরু করলেন বাড়ির সবার। 


বললাম সব, কিন্তু জানতে পারলাম বড়দা ওদের বাড়ি বা দোকানে আসে নি বা যোগাযোগও করে নি। কি করি, কথাবার্তার শেষে আমি চলে আসতে চাইলাম। 


-চলে যাবি মানে? দাড়া আমি ব্যাবস্থা করছি। 


নিজের চেনা এক রিকশা ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমি তো এটাই চাইছিলাম। বনগাঁ গিয়েও বুলুর সাথে দেখা না হলে, সারা জীবন আফসোস থেকে যেতো যে! 


-বাড়ি যা, সারাদিন থাকবি, খাবি। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি যাবি। তোর বন্ধু বুলু বাড়িতেই আছে। 


ছুটির দিন ছিল, বোধহয় রবিবার। বুলুর তো বাড়ি থাকারই কথা! বাড়ি ঢোকার মুখে বুলুর দাদা সুশান্তদার সাথে দেখা, মুখটা কাচুমাচু, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে অনেক দিন বসে আছে বলে বাড়িতে একচোট বকাবকি হয়েছে, আমাকে বললো, -তুই ভিতরে যা, বুলু আছে। 


বুলু তো আমায় জড়িয়ে ধরলো, দেখলাম আমার মতোই ওরও আমার প্রতি মনের টানটা এতদিন পরেও আছে! 


বুলুও আমার মতোই পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই বি এস সি পড়ছে। কথা শুরু হলো, তো শেষ আর হয় না! ছোটবেলার নানান কথা, স্মৃতিচারণ এইসব হতে হতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। 


একসাথে বুলু কে আর আমাকে খেতে দিয়ে, বুলুর মা ও বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। 


খাওয়া হতেই বুলু বলে, - চল একটু ঘুরে আসি। আমি তো বুঝে গেছি, কেন বলছে। দেখলাম পাড়া ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে, তারপর বুলু সিগারেট কিনলো! 


দেখে খুশি হলাম, আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটই কিনলো বুলু, উইলস্ ফিল্টার। গল্প করতে করতে সিগারেট শেষ করে তারপর পাড়ায় ঢোকা হলো। 


গল্পে আর কথায় কথায় কখন বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই। হঠাৎ উঠোনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আলো কমে এসেছে, শীতের বেলা! অগত্যা উঠতেই হলো। 


বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে মনটা খারাপ হয়ে গেল, মা তো বসে আছে বড়দার খবরের প্রতীক্ষায়, মা কে বাড়ি গিয়ে কি বলবো? 


বুলুর বাবা যা বলেছিলেন, তাই বললাম। উনি খোঁজ খবর নেবেন, বনগাঁয় এবং জানাবেন খবর পেলে। 


অবশ্য তার আর দরকার পড়েনি, বড়দার সেই রাতেই ফিরে এসেছিল। 


-দুই-


ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় জিনিসের মধ্যে অন্যতম হলো পেন। তখন তো বল পয়েন্ট পেন ওঠে নি, চল ছিল ফাউন্টেন পেনের। আমার খুব প্রিয় একটা পেন ছিল কালো আর সোনালী রঙের। বিদেশি জিনিস, যতদুর মনে আছে জার্মানির তৈরি। 


আমি জানতাম বুলুর ওই রকম একটা পেনের খুব শখ। কিন্তু সেটা আমার এতো প্রিয় ছিল যে, কোনও সময় ওটা হাতছাড়া করতাম না। 


আসলে ছোটবেলায় ওই রকমই একটা কালো সোনালী প্রিয় পেন আমার হারিয়ে যায়, তাই এই পেনটার প্রতি আমার টান টা একটু বেশিই ছিল। 


তখন আমি থ্রি তে পড়ি। বড়দা, মেজদারা কলকাতায় পড়াশোনা করে। শীতের শেষে স্কুল ছুটি, যশোরে বাড়ি এসেছে। 


তখনো বড়দির বিয়ে হয়নি। বড়দা মেজদারা এসেছে মানে বাড়িতে আনন্দের হাঁট । হঠাৎ বড়দির চিকেন পক্স হয়ে পড়লো । মা বলতো মায়ের দয়া। 


তারপর একে একে অন্যদের হতে শুরু করলো। এক এক জনের হয়, আর তার জন্যে ঘর আলাদা করে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত দাদার ও হলো, সব কটা ঘর ওদের দখলে চলে গেল। 


আমি একা মার সাথে ঠাকুর ঘরে শুই আর মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই, প্রাণপনে মনে মনে চাইছি আমার কেন হচ্ছে না !!!


রোজ সকালে মাকে ডেকে দেখাই - দ্যাখো তো মা আমার বোধহয় গুটি বেড়িয়েছে, মা না করলেই আরো মন খারাপ !! শেষ পর্যন্ত এক দিন মা বললো গুটি তো বেড়িয়েছে, ঠাকুমার ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। সেদিন কি আনন্দ !! 


মনে আছে, ঠাকুমার ঘরে ঢুকে, আনন্দের আতিশয্যে, প্রথম কথা বলেছিলাম, অসুখ সারলেই এই পেনটা বুলুকে দিয়ে দেবো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিতে হয়নি। কারণ আমার অসুখ ছাড়ার আগেই ওরা যশোর ছেড়ে বনগাঁ চলে যায়। 

 

-তিন-


যশোরে আমাদের বাড়ি ছিল শহরের একদম জমজমাট অঞ্চলে, বাড়ির সামনে বড় রাস্তা, কিন্তু পিছন দিকে বাড়ির গা বেয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদ। বাড়ির ঘাটে নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে একজোড়া তক্তা পাতা। তাতে বসে শুধুমাত্র বাসন মাজা হয়। 


নদীতে নামা আমাদের বারণ ছিল। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসে যেতাম কখনো সখনো।


তখন আমার বয়স হবে ছয় কি সাত। স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে পড়ি, তবে পড়ার চেয়ে খেলার দিকে মন বেশী। গত বছর ইনফ্যান্ট ক্লাশ থেকে ওয়ানে ওঠার পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়ায় বাড়িতে একটু প্রশ্রয়ও পাচ্ছি। 


আগেই বলেছি পাশের পাশের বাড়িতে থাকে আমার প্রিয়তম বন্ধু বুলু। ছুটির দিনগুলোতে সারাদিনই হয় বুলুর বাড়িতে আমি, না হয় আমার বাড়িতে বুলু। একমাত্র বুলুর সাথেই আমার কখনও আড়ি হয়নি। 


গতবছর পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় কেউ একজন উপহার দিয়েছিলেন একটা সোনালী ফাউন্টেন পেন। বিদেশি জিনিস, তার চমকই আলাদা। 


পেনটি ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। সেটি দিয়ে যত না লিখতাম, তারচেয়েও বেশি সেটা হাতে নিয়ে খেলতাম। 


একদিন হয়েছে কি, আমি আর বুলু বাড়ির ঘাটে, কলাগাছের ঝাড়ের আড়ালে বসে মাছ ধরতে গেছি। বুলুর হাতে ছিপ, আমার হাতে যথারীতি সেই পেন। 


হঠাৎ ফাৎনায় টান পড়তেই বুলু এক ঝটকায় ছিপ টেনে তুলেছে, চমকে গিয়ে আমার হাত থেকে পেনটি একদম জলে। মূহুর্তে সেটি এক বুদবুদ তুলে জলে ডুবে গেল। 


আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখেই বোধহয় বুলু থাকতে পারেনি, এক ঝটকায় জামা খুলে আমার দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জলে ঝাপিয়ে পড়লো। 


জলে ডুবে দিয়ে বুলু আর তো ওঠেনা। সময় বয়ে যেতে থাকে, আমার উৎকন্ঠা বেড়ে চলে তার দ্বিগুণ বেগে। 


আমরা দুজনই সাঁতার জানিনা। তাহলে কি বুলু আর উঠবে না? আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি করবো বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ পরে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা হাত ভেসে উঠলো জলের মধ্যে। 


হাতটা আমার নাগালের মধ্যেই ছিল, অনেক কষ্টে টেনে তুললাম আমার প্রিয়তম বন্ধুকে। 


বললো, -পেনটাতো পেয়েছিলাম, কিন্তু শ্যাওলায় পা জড়িয়ে ধরেছিল। শ্যাওলা থেকে পা ছাড়াতে গিয়ে পেনটা গেল পড়ে। পেন খুঁজতে গিয়ে শ্যাওলায় আবার জড়িয়ে গেলাম, এদিকে দম ফুরিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে শ্যাওলা ছাড়িয়ে উঠে আসতে পারলাম। 


আমি তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। আশ্চার্য কান্ড, বুলু উল্লেখ করা সত্বেও, পেনটার কথা আমার মাথায়ই আসে নি। 

Friday, June 3, 2022

ছোট গল্প - হীরা রহস্য || লেখক - আশিস চক্রবর্তী || Short story - Hira Rahasya || Written by Ashis Chakrabarti


 


হীরা রহস্য 

           আশিস চক্রবর্তী





গাড়িতে উঠতে উঠতে পঞ্চানন আমাকে জিজ্ঞাসা করল , " স্যার ! আমরা এই নতুন পোশাক পরে যাচ্ছি কোথায় ? আর এই গাড়িটা কার ? "
আমি বললাম , " এ ভাড়ার গাড়ি পঞ্চানন !নতুন পোশাক,  সাজগোজ, এসব কোনো তদন্তের কারণে আমাদের ছদ্মবেশ , একথা  ভেবো না। আজ তুমি আমি ছুটির মেজাজে যাচ্ছি একটা নিমন্ত্রণ এটেন্ড করতে ! "
" নিমন্ত্রণ ! কার বাড়ি স্যার ? "  
" আমার ছেলে বেলার বন্ধু বটুকেশ্বর এর বাড়ি । মস্ত বড়লোক বাড়ি ছেলে। কাজ কর্ম তেমন করে না। বাপ ঠাকুর দার অঢেল সম্পত্তি ওতেই ওর চলে যায়। আর বাকি সময় টা শখের থিয়েটার করে। দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদ। এখন কলকাতায় বাড়ি কিনে একাই থাকে। কাল রাত্রে আমাকে ফোন করে আসতে বলল। এও বলল একটা নাকি সারপ্রাইজ আছে ! ভাবলাম , আমার সকল কর্মের সঙ্গী তুমি , তাই ওখানে তোমাকে ছেড়ে একা যায় কি করে বলো পঞ্চানন !"
" তা স্যার ভালোই করেছেন । সারা দিন চোর খুনি বদমাইশ ঘেঁটে ঘেঁটে মাথায় কেমন চড়া পড়ে গেছে। আজকে একটু  রিলাক্সসেশন হবে। "

সময় টা  সন্ধ্যে। বটুকেশ্বর এর বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমাদের পূর্বে আরো চার জন এসে উপস্থিত। বটুকেশ্বর একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। চার জনই বটুকেশ্বর এর বর্তমান বন্ধু। একজনের নাম  নীলাদ্রি শেখর । ওঁ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার । লম্বা চওড়া সুপুরুষ। পার্ক স্ট্রিটে নাকি একটা চেম্বার আছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন পরেশ চন্দ্র বড়াল। বড় বাজারের সোনা ব্যবসায়ী।বেঁটে খাটো গোলগাল মানুষ। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন শম্ভু নাথ প্রধান । কাপড় কোম্পানি তে চাকরি করেন। লোকটার কপাল থেকে গাল অব্দি একটা কাটা দাগ থাকার জন্য ভদ্রলোকের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। এবং সর্বশেষ ব্যক্তিটি হলেন নিলোৎপল স্যানাল। এঁর পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক আর্থিক ভাবে দারুন অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কাজ কর্ম তেমন নেই। বটুকেশ্বর সকলের সামনে আমাদের প্রকৃত  পরিচয় টা গোপন রাখল। এর কারণ জানবার জন্য আমি ভুরু কুঁচকে ফেললে, বটুকেশ্বর আমার কানের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল , " ক্রমশ প্রকাশ্য !" 
বটুকেশ্বর এর বলা পরিচয় অনুযায়ী এখন আমার পেশা স্টিল ফ্যাক্টরির মালিক এবং পঞ্চানন আমার সেক্রেটারি। প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা শুরু হলো। হালকা মেজাজে খাওয়া দাওয়া কথাবার্তা চললো। খাওয়া শেষ হলে  বটুকেশ্বর বলল , " সাইলেন্স প্রত্যেকে !"
তারপর আমার দিকে চেয়ে ও পুনরায় বলল , "ঋষিকেশ ! তোকে আমি বলে ছিলাম আজকে আমাদের সকলের এই দেখা সাক্ষাৎ শুধু মাত্র  খাওয়া দাওয়ার কারণের জন্য নয় । এর মাঝে   একটা সারপ্রাইজ আছে । যেটা এই মুহূর্তে আমি তোকে জানাবো। সেটা হলো আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটা করে অতীব মূল্য বান বস্তু রয়েছে। সেগুলোর আজকে প্রদর্শনী হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে থাকা মূল্যবান বস্তু গুলি একে অপরকে দেখাবো। এই অভিনব প্রপোজাল টা অবশ্য আমিই ওদের কে দিই ।  আর সকলেই তাতে রাজি হয় । "
পঞ্চানন বেশ উৎসাহ পেয়ে বলল , " মূল্য বান বস্তু ! আবার প্রত্যেকের কাছে ? গ্রেট ! এতো সারপ্রাইজ নয় মশায় ! পুরো সারপ্রাইজ বৃষ্টি !  কই সেসব ? "
বটুকেশ্বর এবার দেরি না করে পাশের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে এলো। তারপর সেটা খুলতেই লাল মখমলের কাপড়ের ভেতর থেকে আলোর ঝলকানি চোখে এসে ধাক্কা দিল। এরপর লাল কাপড় টা সম্পুর্ন ভাবে সরাতেই আলোর বিচ্ছুরণের যেন বন্যা নামলো। উপস্থিত  সকলের চোখে মুখে বিস্ময় ! একটা নীল হীরক। সোনা ব্যবসায়ী  পরেশ বাবু যেন লাফিয়ে উঠলেন। তারপর সেটা হতে তুলে নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখে বললেন , " ম্যাগনিফিসেন্ট ! এ তুমি কোথায় পেলে বটুক ? "
" এ কি আজকের জিনিস ! কে কবে কোথা থেকে এটিকে আমদানি করে ছিল , কেউ জানে না ! আমরা বংশ পরম্পরায় একে ধারণ করে চলেছি। মার মুখে শুনেছিলাম এ খুব লাকি জিনিস ! আজকের বাজারে এর মূল্য কয়েক কোটি তো বটেই ! " 
হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নীলাদ্রি বাবু বললেন , " জিনিস টা দেখতে সুন্দর ! তবে এর দাম নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেললে বটুক ভাই ! হীরা টার যা সাইজ তাতে মেরে কেটে লাখ পাঁচেকের বেশি হবে না ! কি বলো পরেশ ? "
" এর সঠিক ধারণা আমার নেই ! কারণ এ জিনিস আমি আগে কখনও দেখিনি ! " জবাব দিলেন পরেশ বাবু। 
নিলোৎপল স্যানাল কে দেখলাম এক দৃষ্টে হীরাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তিনি কোনো কথা বললেন না । শম্ভু নাথ বাবু বললেন , " বটুক ! এমন মূল্যবান বস্তু তুমি বাড়িতে রেখে বুদ্ধিমান এর কাজ করোনি।  একা এ বাড়িতে থাকো। এদিকে কলকাতায় যা চুরি ডাকাতি বেড়েছে , তাতে এ জিনিস ব্যাংকের লকারে রাখায় ঠিক ! "
এবারে বটুকেশ্বর হীরা খানি পুনরায় আলমারীতে রেখে এসে বলল , " কই হে ডাক্তার তোমার বস্তুটি কই ? "
ডাক্তার নীলাদ্রি শেখর নিজের ফুলহাতা শার্টের অস্তীন গুটিয়ে হাত টা বললেন , " এই দেখো ! "
সকলেই ওর হাতের দিকে চেয়ে দেখলাম , একটা রূপালী বর্ণের হাত ঘড়ি যার সমস্ত যন্ত্রাংশ দৃশ্য মান আর সেগুলি স্বর্ণ বর্ণের। নীলাদ্রি শেখর এবারে বললেন , " আমার এক ধনী পেশেন্ট দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগে বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিল। আলোপ্যাথি , কবিরাজী , ঝাড়ফুঁক কিছুই সে বাকি রাখেনি। শেষ মেশ আমার কাছে টানা কিছু বছর চিকিৎসা করে সুফল পেয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে এই ঘড়িখানি আনিয়ে আমাকে উপহার দেয়। এর সঠিক মূল্য আমি জানি না। " 
পরেশ বাবু গলা ঝেড়ে বললেন , " এ সোনার ঘড়ি ? কাল একবার দোকানে এনো তো নীলাদ্রি ! দেখবো! রাতে ঠিক ধরা যায় না ! "
" ওকে ! তবে এ শুধু সোনার ঘড়ি নয় ! বডি টা প্লাটিনামের ! এবং যন্ত্রাংশ গুলি  পিওর গোল্ড !  সন্দেহ থাকলে দেখবেন কষ্টি পাথরে ঘষে ! তবে এ ঘড়ি কলকাতার বাজারে কেউ খুলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে ! " বললেন নীলাদ্রি শেখর ।
 শম্ভু বাবু বললেন , " সোনার ঘড়ি এখন আকছাড় এর ওর হাতে দেখা যায় ! এ বহু মূল্যবান কোনো বস্তু নয় । খুব মামুলী একটা ব্যাপার ! তবে প্লাটিনামের সাথে আমি তেমন ভাবে পরিচিত নয় ! "
নীলাদ্রি বাবুর এ কথাটি পছন্দ না হওয়ায় ওঁ বললেন , " এই ঘড়ি আকছার দেখা যায় ? বেশ ! তো তোমার কাছে কি জিনিস আছে দেখি ? " 
শম্ভু বাবু ওনার কোর্টের পকেট থেকে একটা কাপড়ে জড়ানো বস্তু বার করল তারপর সেই কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে একটা চামড়ার পুঁথি মেলে ধরে বললেন , " এই পুঁথি টি আমার ঠাকুরদার বাবা তিব্বত থেকে আনিয়ে ছিলেন। কোনো এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর লেখা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের খণ্ডিত পুঁথি ! এ বস্তুটি যেমন দুষ্প্রাপ্য তেমন মূল্যবান ! " 
পঞ্চানন পুঁথিটি হাতে তুলে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো। ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। জেনুইন জিনিস। এই বস্তুর মূল্য টাকার মাধ্যমে ঠিক করা যায় না। একে একে সকলেই পুঁথি টি ছুঁয়ে দেখে আশ্চর্য হলো।
পরেশ চন্দ্র বড়াল পকেট থেকে বার করলেন একটা রুপোর খঞ্জর। আকারে বেশ ছোট । তবে আকর্ষণীয় এবং ওর গায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিহ্ন আঁকা রয়েছে । বস্তু টি সর্ব সম্মুখে দেখিয়ে বললেন , " একবার এক বে আইনি কাজ করে ফেলেছিলাম। এ কথা আজ অব্দি কাউকে বলিনি। এই খঞ্জর টির প্রকৃত মালিক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ! গোপনে এক নিলামী তে হাজির হয়ে এটা আমি কিনে ফেলি। পরে অবশ্য জানতে পারি যে জিনিসটি মিউজিয়াম থেকে চুরি করে বিক্রি করা হয়েছিল। " 
আশ্চর্য সুন্দর  খঞ্জর টি। আবার কুৎসিত ও বটে। কারণ কত মানুষ এই অস্ত্রে খুন হয়েছিল তার ঠিকনেই । ওটা দেখে এক প্রকার ঘৃণার সঞ্চার হলো আমার শরীরে।   এরপর এলো নিলোৎপল স্যানাল এর পালা। ভদ্রলোক প্রথমেই আমতা আমতা করে বললেন , " হাজার চেষ্টা করে আমি মূল্যবান কিছু জোগাড় করতে পারিনি। কারণ আমার কাছে বহু মূল্যবান কিছু নেই । এখানে আসার মুহূর্তে মনে পড়ল আমার ঠাকুরদার কথা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পুলিশের গুলিতে মারা যান। মৃত্যুর সময় ওনার জামার বুক পকেটে ছিল এই কলম টা ! "

বলে , নিলোৎপল কলমটা বার করে দেখালেন। কলমটার প্রতি দেখলাম কারো যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কেও বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে কলমটার প্রতি দেখল না। আমি কলমটা  হাতে ধরে নিয়ে দেখলাম ওটা একটা কাঠের কলম যাতে নক্সা কাটা রয়েছে। কলমের একদিকে ঘষে খানিকটা ভেঙে গিয়েছে। এটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে ব্রিটিশ সৈনিকের নিক্ষিপ্ত বুলেট নিলোৎপল এর দাদুর দেহে ঢোকার সময় কলম টিতে প্রথমে আঘাত করেছিল। আমি ভক্তি ভরে কলম টাকে মাথায় ছুঁইয়ে ফেরত দিয়ে বললাম , " এর মূল্য বোঝবার মতো ক্ষমতা আমাদের কারো নেই । একে সঙ্গ ছাড়া হতে দেবেন  না। " 

এরপর নীলাদ্রি শেখর সোফা থেকে উঠে বাথরুম এর দিকে গেলেন ।  বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে লম্বা বারান্দা ধরে হেঁটে বাথরুম যাবার পথ।মিনিট দশ পর বাথরুমে যাবার পথে নীলাদ্রি শেখর এর আর্তনাদ শুনে আমরা অবাক হয়ে ছুটে গিয়ে  দেখলাম নীলাদ্রি শেখরের কপাল ফেঁটে রক্ত ঝরছে আর ওঁ কপালে হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছটকাচ্ছে আর বলছেন , "  আমার ঘড়ি ! আমার ঘড়ি নেই ! ছিনতাই হয়ে গেছে ! " 
নীলাদ্রি শেখর এর হাতে ঘড়ি নেই। আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন তুমি বাড়ির পিছন দিকটা যাও ! আমি সামনে যাচ্ছি ! আর  আপনারা কেউ একজন নীলাদ্রি বাবুর কাছে থেকে বাকি জন সমস্ত ঘর খুঁজে দেখুন অপরাধী ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে। ছিনতাই কারী বেশি দূর যেতে পারিনি। " 
আমরা ছুটে যেতে যেতে শুনলাম শম্ভু নাথ প্রধান বলছেন , " ফাস্টটেড বক্স নিয়ে এসো বটুক তাড়াতাড়ি ! মাথায় ব্যান্ডেজ না করলে রক্ত থামবে না !" 
প্রায় আধ ঘন্টা সকলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও অপরাধী কে পাওয়া গেল না। ফিরে এসে দেখলাম ঘরে খাটের ওপর নীলাদ্রি বাবু শুয়ে রয়েছেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। বটুকেশ্বর ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশ করছে। 
" আমার জন্যই এটা হলো! আমি কেন যে সবাই কে মূল্যবান বস্তু গুলি আনতে বললাম ! ছি ! ছি ! নীলাদ্রির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। "
নীলাদ্রি শেখর হা হতাশ করছে। আর বলছেন , "আমি এখুনি গিয়ে থানায় কমপ্লেন লেখাবো ! আমার সাধের মূল্যবান ঘড়ি ! ওহ ! বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল আমার ! "
  সকলের মুখ থমথমে। আমি কোনো উপায়ন্তর না দেখে  নিজের খোলস ছেড়ে বললাম , " আপনার শরীর অসুস্থ্য ! এখন একটু রেস্ট নিন। আর আপনার ঘড়ি খোঁজার দায়িত্ব আপনি আমাকে দিন। আসলে বটুক আমার আসল পরিচয়  গোপন করেছে। আমার নাম ঋষিকেশ রক্ষিত !  লাল বাজার হেড কোয়ার্টার এর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর আমি একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার। আর ও হলো ইন্সপেক্টর পঞ্চানন চক্রবর্তী ! আমার সহযোগী । "
এ কথা শোনার পর এক মুহূর্তেই সকলের মুখে আলো খেলে গেল। পরেশ বাবু বললেন , " তাহলে তো কোনো সমস্যায় নেই ! কিন্তু এতো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা ! আপনার মতো একটি সরকারি গোয়েন্দা বাড়িতে থাকতে এই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেল ? "
আমি বললাম , " এর জন্য আমি ভীষণ দুঃখিত ! কিন্তু এর সুরাহা না করে আমি যাচ্ছি না ! নীলাদ্রি বাবু আপনি বলুন তো আপনার সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিল ? "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " আমি বাথরুম থেকে ফেরার পথে মাথায় তীব্র আঘাত অনুভব করি। সঙ্গে সঙ্গে চোখটা অন্ধকার হয়ে যায় আর আমি মাটিতে পড়ে যায় !কিছু ক্ষনের জন্য আমার সেন্স চলে যায়। এরপর লক্ষ্য করি আমার হাতে ঘড়ি নেই। "
আমি কথা টা শোনার পর বটুকেশ্বর কে বললাম , " তুই একবার তোর হীরা টা দেখে আয় তো ঠিক আছে কিনা ? "
বটুক আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র চিন্তিত মুখে ছুটে গেল পাশের ঘরে আলমারীর দিকে । তারপর উপস্থিত সকলের কানে এলো বটুকের কন্ঠ স্বর , " সর্বনাশ ! " 
সে ঘরে পঞ্চানন আর আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম আলমারীর দরজা খোলা হীরার ফাঁকা  বাক্স টি পরে রয়েছে । পঞ্চানন বলল , "  অর্থাৎ চোর প্রথমে হীরা চুরি করে নীলাদ্রি বাবুকে ঘায়েল করে পালিয়েছে প্লাটিনামের ঘড়ি নিয়ে পালিয়েছে ! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কাজ টা করল কিভাবে ?  স্যার আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন ? " 
আমি কোনো জবাব না দিয়ে বললাম , " সকলে একবার এক ঘরে এসে বসুন তো ! আর বটুক তোর বাড়ির কাজের লোক দের একবার ডেকে পাঠা ! "

কথামত সকলে হাজির হল ঘরে।  নীলাদ্রি বাবু যন্ত্রনায় কাতর হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। প্রথমেই বাড়ির কাজের লোক দের জিজ্ঞাসা বাদ শুরু করলাম। বাড়িতে মাত্র দুটি কাজের লোক । একজন আজকের জন্য নিযুক্ত রান্নার ঠাকুর আর অন্য জন ঘোর দোর পরিষ্কার রাখবার জন্য বারো মাসের কাজের লোক। পঞ্চানন বলল , " স্যার আমার মনে হচ্ছে মূল্যবান বস্তু গুলোর প্রদর্শন চলা কালীন এদের মধ্যে কেউ লুকিয়ে সমস্ত কথা শুনেছিল। তারপর সুযোগ বুঝে সরিয়েছে। এক্ষুনি কয়েক ঘা চাপিয়ে ,  সার্চ করলে বেরিয়ে পড়বে ! " 
দুজনেই ভয়ে গুটিয়ে রয়েছে আর বার বার বলছে , " আমরা কিছু জানি না স্যার ! এঘরে আসিনি একবার ও ! "
আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন দুটোকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুব ভালো মতো জিজ্ঞাসা করো আর সার্চ করে দেখো কিছু পাও কিনা ! কিছু না বললে থানায় নিয়ে যাবে ! "
পঞ্চানন ওকে স্যার  বলে কাজে লেগে পড়ল ! আমি বটুকেশ্বর কে বললাম , " ভাই ! বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তবুও বলছি ,  আমার যা মনে হচ্ছে  কাজ বাইরের কারোর পক্ষে সম্ভব না ! এখানে যারা উপস্থিত আছে তাদের মধ্যে কেউ একজন করেছে ! "
একথা শোনার পর আমন্ত্রিত সকলের মুখটা কেমন বিরক্তি আর অপমানে লাল হলে গেল। আমি ফের বললাম , " প্রয়োজনে বটুক তুই আমাকে আর পঞ্চানন কেউ জিজ্ঞাসাবাদ বা সার্চ করতে পারিস তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই ! যেহেতু ঘটনা স্থলে আমরা ছিলাম তাই আমরাও সন্দেহর তালিকায় থাকাটা স্বাভাবিক ! " 
আমার কথা শুনে বটুক বলল , " কি যা তা বলছিস হৃষিকেশ ! তোরা এসবে জড়াবি কেন ? যা হয়েছে যাক ! সবই আমার কপালে ছিল ! কিন্তু এর জন্য আমি আমার বন্ধুদের এ ভাবে বাড়িতে ডেকে অপমানিত করতে পারবো না  ! শুধু তো আমার জিনিস নয় ! নীলাদ্রির ঘড়িটা আমার কারণে গেল বলে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে !" 
পরেশ চন্দ্র বড়াল বললেন , " মান সম্মানের আর বাকি থাকলো কি বটুক ? তোমার পুলিশ বন্ধু আমাদের চোর ভাবছেন ! নাও জেরা শুরু করো আর আমাদের সার্চ করে দেখো। "
বটুক লজ্জায় মুখ লুকালো। নিলোৎপল কিছু বললেন না। শম্ভুনাথ প্রধান চিৎকার করে বললেন , " ছি ছি ছি ! শেষে বন্ধুর আমন্ত্রনে এসে চোর সাজতে হলো ! "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " যা করবার তাড়াতাড়ি করুন আমার শরীর খারাপ করছে ! মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ! " 
ইতিমধ্যে পঞ্চানন পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বলল , " স্যার ! ওরা মুখ খুলছে না ! সব জায়গা সার্চ করেও কিছু পাইনি। জিনিস গুলো নিশ্চয় আলাদা কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখেছে ! থানায় নিয়ে গিয়ে চাপ দিলেই সব বের করে দেবে। "
আমি বললাম , " নাও পঞ্চানন এক এক করে আমাদের সার্চ করো। প্রথমে আমাকে দিয়ে শুরু করো। " 
পঞ্চানন আমার কথা শুনে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ,আমি পুনরায় বললাম , " দাঁড়িয়ে থেকো না ! কাজ শুরু করে দাও। তোমাকে আমি সার্চ করবো ! "
ওকে স্যার বলে পঞ্চানন একে একে সকলকে সার্চ করা শুরু করল । ওকেও সার্চ করলাম আমি। কারো কাছে কিছু মিললো না। এবার পঞ্চানন আমার দিকে তাকিয়ে বলল , "মিথ্যে  স্যার সময় নষ্ট করছেন। বরং ওদের দুটোকে থানায় নিয়ে গিয়ে টর্চার করলে মাল বেরিয়ে যেত। "
আমি বললাম , " পঞ্চানন ! সার্চ করা তোমার ঠিক মতো হয়নি ! "
পঞ্চানন বলল , " মানে স্যার !  "
"মানে টা শম্ভুনাথ বাবু বলবেন !"  বললাম আমি।
শম্ভুনাথ বাবু বললেন , " আপনি কি বলতে চাইছেন ? আমি চুরি করেছি ? আমাকে সার্চ করলেন ! কিছুই পেলেন না!মান হানি করেও আপনার শান্তি নেই ! এবার কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আমি কোর্টে যাবো ! "
" উঁহু ! চটে যাচ্ছেন কেন ? আপনি চুরি করেছেন একথা আমি তো আপনাকে বলিনি ! তবে চোরের সঙ্গ দিয়েছেন  ! "
" এসব কথার অর্থ কি ? আপনি কিন্তু যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছেন ! "
" বাড়াবাড়ির আর দেখলেন কত টুকু ! এবার দেখাচ্ছি বাড়াবাড়ি কাকে বলে ! পঞ্চানন ডাক্তার বাবুর মাথার ব্যান্ডেজ টা খোলো তো ! "
পঞ্চানন বলল , " কেন স্যার ! "
" আহা ! বড্ড প্রশ্ন করো তুমি ! যা বলছি তাই করো ! "
ডাক্তার নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন , " এসব কি হচ্ছে এখানে ? "
" আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি অসুস্থ্য ! বসে পড়ুন ! "
এরপর পঞ্চানন নীলাদ্রি বাবুর ব্যান্ডেজ খুলতেই সেখান থেকে রক্তমাখা  হীরাক খন্ড মেঝেতে পড়ল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে সকলে চমকে উঠল নীলাদ্রি ও শম্ভুনাথ প্রধান বাদে। পঞ্চানন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে আমি বললাম , " তোমার সব প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি পঞ্চানন! মূল্যবান বস্তুর প্রদর্শন এর আমন্ত্রণ পেয়ে  নীলাদ্রি শেখর ও শম্ভুনাথ বাবুর মাথায় এই প্ল্যানটা আসে। নীলাদ্রি পরিকল্পনা মাফিক টয়লেট যাবার পথেই পাশের ঘর থেকে হীরা টা চুরি করে নেয়। তারপর ওঁর নকল সোনার ঘড়িটা টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে নিজের মাথায় নিজে আঘাত করে বাথরুমের বাইরে আসে।তারপর নাটক শুরু করে । তখন হীরা ওর কাছেই ছিল। এরপর মাথায় আঘাত লাগা এবং ঘড়ি চুরির খবর পেয়ে  আমরা সকলে যে যেদিকে পেরে ছিলাম ছুটে গিয়েছিলাম চোরের খোঁজে। খুব সম্ভবত বটুকও সেই সময় ফাস্টেড বক্স এনে দিয়ে চোর খুঁজতে ছুটে ছিল। আর সেই সময় আহত নীলাদ্রি শেখর এর সঙ্গে ছিলেন একমাত্র শম্ভুনাথ প্রধান । তিনিই নীলাদ্রি শেখর এর চুরি করা হীরাক খন্ড টি ওঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিতে সাহায্য করেন । আঘাতের ব্যান্ডেজ এর সঙ্গে হীরা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন নির্বিঘ্নে। প্ল্যান টা ভালোই ছিল দুজনের । কারো সন্দেহ হবার কথা নয়। তবে ঋষিকেশ রক্ষিত এসে পড়ায় প্ল্যান টা সাকসেস হলো না। আমার সন্দেহ টা জাগলো দুটো কারণে । এক মাথার সামনে আঘাত লাগা , এবং নীলাদ্রি বাবুর চোর বা আঘাত কারী কে না দেখতে পাওয়া এই দুটি বিষয়ে। কারণ সত্যি সত্যি চোর সামনে থেকে আঘাত করলে নীলাদ্রি বাবু দেখতে পাবেন। আর পেছন থেকে আঘাত করলে মাথার সামনে আঘাত করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে নিজে নিজে আঘাত করলে একজন ডাক্তার হিসেবে নীলাদ্রি বাবু মাথার সামনেই আঘাত করবেন । কারণ পিছন দিকে আঘাত করার সাহস তিনি পাবেন না , ওখানে ব্রেন এর গুরুত্ব পূর্ণ অংশ থাকে। আঘাতটা খুব সামান্যই চেয়ে ছিলেন নীলাদ্রি বাবু। কারণ হীরা লুকোনোর জন্য ব্যান্ডেজ করাটা জরুরী ছিল। আমি দুঃখিত নীলাদ্রি এবং শম্ভুনাথ প্রধান বাবু আমার জন্য আপনাদের এতো সুন্দর প্ল্যানটা সাকসেস হলো না। পঞ্চানন এদের দুজন কে থানায় নিয়ে চলো। "
বটুক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল , " দারুন উপকার করলি ভাই ! এটা আমার খুব লাকি ! "
আমি ওকে একটা প্রশ্ন না করে পারলামনা , " আচ্ছা প্রথম দিকে তুই আমার আর পঞ্চানন এর পরিচয় সবার কাছে গোপন রেখেছিলি কেন ? "
বটুক মাথা নামিয়ে বলল , " আমাদের মধ্যে নিলোৎপল এর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় ! তাই এরম একটা অবস্থা হবার আশঙ্কা করে ছিলাম। তাই হাতে নাতে চোর ধরবার জন্য তোর পরিচয় গোপন করে ছিলাম। "
বটুকেশ্বর এর এই কারণ টা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওর এই কাজের জন্য আসল চোর ধরাপড়ার কারণে ওকে আর কিছু বললাম না। 





Thursday, June 2, 2022

ছোট গল্প - অরূপ রূপকথা || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Arup Rupkotha || Written by Rokeya Islam


 

অরূপ রূপকথা

     রোকেয়া ইসলাম





আজান শেষ হতেই দরজা খুলে উঠোনে নামে মেঘবতী। কলপাড়ে গিয়ে বুঝতে পারে চায়না ঘুম থেকে ওঠেছে বেশ আগেই, ওর ফরজ গোসল সারা হয়ে গেছে। ভেজা কাপড় বালতিতে করে এককোণায় রেখে দিয়েছে যাতে কারো নজরে না আসে যে ও স্বামী সহবাস করেছে মেয়েটার লাজলজ্জা, আক্কেল বেশ টনটনে। ওজু সেরে ঘরের পৌটায় পা রাখতেই কল চাপ দেবার দেবার শব্দে পেছন ফিরে দেখে চায়না কল চেপে বালতি ভরছে।

মতিমিয়া ঘর থেকে দ্রুত উঠোনে নেমে কলপাড়ে গিয়ে অজু করে মসজিদের পথ ধরে। মেঘাবতী স্বস্তির মনে জায়নামাজ পেতে নামাজে দাঁড়ায়।

চায়না বাঁসি কাজ সেরে গোয়াল থেকে গরু বের করবে খোপ খুলে মুরগী বের করে কুঁড়া মাখিয়ে মুরগীগুলোকে খেতে দেবে, তই তই করে হাঁসগুলো আলাদা করে তাদের খেতে দেবে। গরুর চাড়িতে পানি দেবে, খড় কেটে গরুকে খেতে দিয়েই, বাড়ির মানুষের জন্য সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করবে একা হাতে।

মসজিদে নামাজ শেষে দোয়া কালাম পড়ে বাজারে গিয়ে বসে চা পান করে মতিমিয়া। আগে এই চায়ের অভ্যাস ছিল না। শুধু চা কেন অনেককিছুরই অভ্যাস ছিল না। এই যে এখন চা পানের পর হেঁটে হেঁটে বাজারের এমাথা ওমাথা ঘুরে মাছ তরকারি কিনবে। প্রতিদিন দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস এটাও ছিল না ওদের পরিবারে।

গাছের পাকা দিয়ে গাইয়ের দুধ দিয়ে রাতে ভাত খায়, ঘরে কলা শেষ হলেই বাজার থেকে কিনে আনবে গাছপাকা কলা।

ভাল কলা না পেলে গুড় কিনবে।

গুড় আবার এই বাজারে পাওয়া যায় না। এই বাজারটা হলো প্রতিদিন বেলা ওঠার আগে থেকে বসে আবার সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়তেই শেষ হয়ে যায়।

আশেপাশের নদীপাড়ের মানুষেরা সারারাত মাছ ধরে বেশিরভাগই আড়তে চলে যায় খুচরোগুলো এই বাজারে তোলে। জাংলার লাউ ঝিঙে কুমড়া সিম জাতীয় তরতাজা সবজি।

ভুঞাপুরে কোন কাজে গেলে সুবাসিত সাবান ডিটারজেন্ট পাউডার নারকেল তেল পোয়াটাক আঙুল আপেল পাউরুটিও কিনে আনে। আগে এগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতো, আর এখন দরদাম করে ধোয়াকাঁচা পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা বের করে সওদা নিয়ে হৃষ্টমনে মাথা উঁচু করে বের হয়।

আজ গ্রামের বাজার থেকে কিনেছে নধর দেখে একমুঠো ডাটা এক কেজি বেগুন আর এক ভাগা চেলা মাছ।

হাঁটতে হাঁটতে নধর ডাটাগুলোর দিকে তাকায়, তাজা মাছ দিয়ে রান্না করা তরকারি স্বাদ কেমন হবে, ভাবতেই পথ শেষ হয়ে যায়।

বাড়িতে ঢুকে শ্যাফালী বলে ডাক দেয়। ছোটমেয়ে এসে সদাই-পাতি বাবার হাত থেকে নিজের হাতে নেয়।

মতিমিয়া কলপাড়ে গিয়ে দেখতে পায় পানি ভরা বালতিতে লাল প্লাস্টিকের মগ ভাসছে। কাছেই প্লাস্টিকের নীলরঙা টুল।

ভেতর থেকে তৃপ্তির নিঃশ্বাস বের হতেই কপালে একটা ভাঁজ ভেসে ওঠে।

ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে খারমানের পাতা আর কালিজিরার ভর্তা দিয়ে এক থালা বৌখুঁদা এগিয়ে দেয় চায়না, মেঘাবতী একগ্লাস পানি নিয়ে সামনে বসে। সাথে সাথেই দুই ছেলে এসে বসে তাদের সামনেও ভরা থালা এগিয়ে দেয় চায়না,

শ্যাফালী ও শ্যাফালী তুইও খাইয়া ল, আবার তো স্কুলে যাওন লাগব।

ননদ আর শাশুড়ীর খাবারের থালাও দিয়েই, উঠোনে ধান শুকোতে দেয় চায়না।

ওদের খাওয়া শেষ হতেই এঁটো বাসন গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে কলপাড়ে নিয়ে ধুয়ে উঠানের কোনায় ছোট্ট মাচায় উপুর করে দেয়, রোদে শুকোবে এগুলো। 

স্বামী আর দেবর বের হয়ে যায়, শেফালীও স্কুলে যায়।

মাছগুলো কুঁটে ধুয়ে ছিঁকায় তুলে রাখে।

ও বউ তুমি খাইলা না, খাইয়া লও। বাইড়া থুইছি তো তুমার খাওন। লও খাইয়া লও।

হাতের কামডি সাইরা লই

এতোক্ষণে চায়নার গলার আওয়াজ শোনা গেল । মুখ বন্ধ করে সংসারের সব কাজ করে যায় অবশ্য কেই বা ওর সাথে কথা বলে । ওর স্বামীও দিনে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ। বলবে কেন প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কি শুধু প্রয়োজনীয় কথাই থাকে , কত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে হাসি কথা তো থাকতে পারে।

কথা হাসি তো দূরে থাক ওকে সাথে নিয়ে কখনও বাবার বাড়িতে পর্যন্ত যায় না।

এই যে এখন বাড়ীতে শুধু বউ শাশুড়ী, তাও তো তেমন কথা হবে না দুজনের। একটু পরে উঠোনের কোনে খোলা চুলার পাড়ে গিয়ে কি দিয়ে কি রান্না হবে সেটুকু বলবে, সাথে আরো কোন কাজের কথা থাকলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলবে।

মতিমিয়া ভুঞাপুর থেকে ফিরলো, উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়

শ্যাফালি ও শ্যাফালি কোনে গেলি

চায়না ঘোমটা তুলে দৌড়ে গিয়ে শুশুরের পাশে দাঁড়ায়

শ্যাফালি স্কুল থন আহে নাই অহনতরি, দেইন আমার থন দেইন।

চায়নার শব্দ শুনে মুখটা বিরক্তিতে অন্যদিকে ঘুরাতে গিয়ে চোখ আঁটকে যায় বড় ঘরের টিনের চালে কালো রঙের দুটো কবুতর খুনসুটি করছে, ধারেকাছে ডাকছে কুটুম পক্ষী, । আস্তে করে ব্যাগটা চায়নার হাতে তুলে দিয়ে দ্বিধান্বিত মনে কলতলায় যায়।

বারান্দায় পাটি পেতে খাবারের আয়োজন করেছে চায়না । শাশুড়ী পিঁড়ি পেতে বসে সবাইকে খেতে দেয়।

চায়নার হাতের রান্না খুব স্বাদের। ওর মায়ের কাছ থেকে এই গুণ ও পেয়েছে , খাবারের স্বাদ বুঝিয়ে দেয় ধনী খানেয়ালা ঘরের মেয়ে চায়না।

এতো পদ দিয়ে আগে কখনও ভাত খেতো না ওরা। তিনবেলা গরম খাওয়াই তো জুটতো না। মাসুমের বিয়ের পর মেঘাবতীর সংসারের চাকা ঘুরে গেছে। যদিও সবাই পরিশ্রম করছে, আগেও তো পরিশ্রম করতো তখন তো অন্ধকারই থাকতো সংসারের চৌহদ্দি জুড়ে।

চার ছেলে দুইমেয়ে আর স্বামী স্ত্রী দুজন এই আটজনের সংসারে জমি ছাড়া আর কোন আয়ের পথ ছিল না, বড় ছেলে আই এ পাশ করে চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে ধাক্কা খায়, বিরাট অংকের ঘুষ ছাড়া তো চাকরির পথ আঁধারে ঢাকা। ওদের কোন বড় চাকুরীওয়ালা আত্মীয় স্বজনও নেই।

টাকা কোথায় পাবে মতিমিয়া। বড়মেয়েটাও বিয়ের লায়েক হয়ে যায় মেঝ ছেলেও মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। দিকদিশা হারিয়ে মতিমিয়া কিছু ধানীজমি বিক্রি করে দিয়ে বড়মেয়ের বিয়ে দেয়,

গ্রামের একজন শহরে ছোট চাকরি করে কিন্তু তার ক্ষমতাবান বড়সড় বসের সাথে দহরমমহরম আছে, সেই বেশ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পিয়নের চাকরিতে বহাল করে বড়জনকে।

মেঝছেলেও বড়টার পথ ধরে। মুটামুটি ধানীজমি শেষের পথে নিয়েই তাদের চাকুরী যাত্রা।

শেষ সম্বল যেটুকু ছিল তাও নদী নিয়ে নেয়।

শহরে চাকরিওয়ালা দুছেলে মতিমিয়ার সংসারে কোন টাকাপয়সা দিতে পারে না, তাদের সংসার নিয়েই দুর্মূল্যের বাজারে হিমসিম অবস্থা।

মাসুমও লেখাপড়ায় তেমন ভাল নয়, আর ভাল হলেই কি চাকরি তো টাকা ছাড়া হবে না। নতুন করে টাকার সংস্থান করা অসম্ভব।

অভাবে ভিটামাটি আঁকড়ে ধরে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে কর্মের অনিশ্চয়তায় দিনগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে জীবন নামক অচেনা কঠিন পথে।

ইব্রাহিম ঘটক তালতলা গ্রাম থেকে মাসুমের বিয়ের প্রস্তাব আনে।

চায়নার বাবা কুইট্ঠাল ধনী। দুই ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। মেয়েদেরও ভাল ভাল বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে বড় বড় ডোঁয়া পাকা টিনের ঘর, গোয়াল ভরা গরু, বাইরে পেল্লাই খড়ের পালা।

এ বাড়ির মেয়েদের ভদ্র নম্র হিসাবে নাম আছে।

এখানে বিয়ে করালে বেশকিছু নগদ টাকা যৌতুক পাওয়া যাবে, তা দিয়ে মাসুম ব্যাবসা শুরু করতে পারবে, বাবার বাড়ির সম্পত্তির ভাগও কম পাবেনা ছোটমেয়ে।

সব শুনে প্রস্তাবটা লুফে নেয়।

ইব্রাহিম ঘটকের সাথে কন্যা দেখতে তালতলা গ্রামে যায় মতিমিয়া।

দুইবার কয়েক পদের পিঠা সেমাই ক্ষীর ঢাকাইয়া বিস্কুট কাপে করে চা, তারপর রোষ্ট ঝাল গোশত দিয়ে কড়ির প্লেটে সুবাসিত ধোয়া ওঠা পোলাওয়ের পর মেয়ে দেখে সব খাবার গলা দিয়ে ওঠার উপক্রম হয়।

কোনমতে ছাতা বগলে ফেলে রওনা হয় বাড়ির পথে।

সাতদিন পর ইব্রাহিম ঘটক বোঝায়" রুপ ধুইয়া কি পানি খাইবা মিয়া, রুপ দেখবা একদিন আর নগদ যা পাইবা হেডা নাড়াচাড়া কইরা চলতে পারবা হারাজীবন। ভাইরাও চাকরি করে ভাইগনা ভাগনি অইলে হ্যারাই চাকরির ব্যাবস্থা করব, মোটের উপর তুমি মিয়া নিচন্তা অইলা।

বড় দুইডা বিয়া করাইছো কি পাইছো বউ ছাড়া।

নগদ আরো একলাখ, দুই ভরির গহনা বাড়াইয়া মুখের মধ্যে "কইষট্রা বরুই "পুরে বিয়ে করায়।

বউ দেখে গ্রামের মানুষ আড়ালে বলে, বউ না মতিমিয়া ট্যাহার বস্তা বিয়া করাইছে।

মুখফোঁড়া কেউ কেউ সামনেই বলে ফেলে

কি গো মতিমিয়া পোলা কি ট্যাহার লগে হুইব না বউর লগে হুইব। মুহের দিকে চাইলে তো জিনিস খাঁড়াইব না।

মতিমিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে আসে, উত্তর দিতে পারে না। সংসারের অর্থনৈতিক দুর্গতি, দুই ছেলে তাদের সংসার নিয়ে হিমসিম, এটা তাদের কাছে বাপের সংসার, এটা চালাবার দায় তাদের নয়। ঘাড়ের উপর বেকার দুই ছেলে ছোটমেয়েও হাত পা ঝাড়া দিয়ে ওঠছে। জমি বিক্রি করে শেষ, বাকিটুকু যমুনার অতলে।

মাসুমকে বিয়ে করিয়ে নগদে কিছু পাওয়া গেল।

শরীককের বড়ভাবী তো মুখের উপর বলেই ফেললো

মতিভাই পুলাডারে জব দিলা নিজের আতে। ঘরে যুদি সুখ না পায় ট্যাহা দিয়া কি অইব।

ভাবী ট্যাহাই অইলো আসল সুখ, ট্যাহা গুননের সুখের লগে জগতের আর কুনু সুখ মিলে না।

বলে আর দাঁড়ায় না, হনহন করে সড়কে ওঠে নদীর দিকে হেঁটে যায়।

মতিমিয়া কি আউস কইরা পুলার ঘরে পেত্নী হান্দাইয়া দিছে। বড় দুই পুলার বৌ ধলার কাছাকাছি গায়ের রঙ নাক মুখ চোখের ডিল গঠন ভাল। হেডায় অইছে কি? চেহারা ছবি ভালা অইলে

হেই বালা দিয়া কি করুম, গরম ভাতের লগে সেদ্ধু দিয়া নুন মরিচ দিয়া ডইলা ভর্তা কইরা খামু "

বিয়ের পরদিন সকালে মাসুমকে নদী থেকে গোসল করে আসতে দেখে মনের ভেতরে গেঁথে রাখা পাথরটা নেমে গেছে।

বিয়ের আগেরদিন মেঘাবতী ফিসফিস করে বলছিল মাসুম বড়মেয়ের কাছে বলেছে" বাবা আমারে কুরবানির ষাড় পাইছে আর কেরু নগে পারলো না আমারে হাটে তুললো, আমার মনডা বাপে বুঝলো না।

তারপর থেকেই মনটার ভেতর পাথর ছিল।

যাক শরীরের সাথে শরীর তো মিলছে এই মিলেই সব মিলিয়ে দেবে।

বিয়ের পরদিন থেকেই বুঝতে পারে বৌটা অন্য দুই বৌয়ের মত না এ একেবারেই আলাদা ।

বিয়ের কাজকর্ম মিটে গেলে তিন বাপবেটায় মিলে বুদ্ধি করে সড়কের কোণায় ঔষধের দোকান দেয়। গ্রামের একজন স্কয়ার ফার্মাসিস্টের ম্যাডিকেল রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ হিসাবে আছে, সে মাসুমকে একটা ঔষধ বিষয়ক বই দেয়, কোন ঔষধের কি কাজ।

কয়েক মাসের মধ্যে কিছুটা সচল হয় সংসারের চাকা।

চায়নাও বাড়ির আশেপাশে সবজির গাছ লাগায়, মতিমিয়া জাংলা তুলে দেয়, হাঁস মুরগী পালতে শুরু করে। চায়না ওর বাবার কাছ থেকে দুধ খাবে বলে দুধেল গাই নিয়ে আসে।

মোটামুটি বছরখানেকের মধ্যে সংসারের অভাবের চাকা ঘুরে সচ্ছলের পথ ধরে, মতিমিয়া ধোয়া লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে আসরের নামাজ শেষ করে সড়কের চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খায়, টিভিতে খবর শোনে নায়ক মান্নার ছবি দেখতে দেখতে মাসুমের দোকানে চোখ রাখে, মাসুমের দোকানটা বড় করা খুব দরকার, সেটাও হয়ে যায়।

মাসুম ছয়মাস ট্রেনিং নিয়ে এসে এলাকায় মাসুম ডাক্তার নামে পরিচিত।

মাসুম ডাক্তারের বাবা মতিমিয়া ধানী জমির পরিমান বাড়াচ্ছে, বাড়িতে মাসুমের ঘরটার মেঝে পাকা করা হয়েছে ফ্রিজ কেনা হয়েছে।

মোটামুটি টাকার বাদ্যটা বাজছে। মসজিদ কমিটিতে স্থান পেয়েছে, মুরুব্বি হিসাবে বিচার শালিসে ডাক পায়।

ঢাকায় বসবাসরত ছেলেরাও মাঝেমাঝে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসে। বড়মেয়েটাকে মাসে একবার নাইওর আনে। চায়না বছরে একবারও বাবার বাড়িতে যেতে চায় না। ওর বাবা জোর করে বছর একবার নিয়ে যায়।

চায়নার কোল আলো করে একছেলে এক মেয়ে আসে সংসারে।

সব চলছে নির্বিঘ্নে তবুও যেন কিছুই চলছে না। চায়না সব জায়গায় আছে তবুও কোথায়ও ও নেই।

রান্না করলেও সামনে বসে বেড়ে খাওয়ায় না। সবার সাথে বসে খায় না,সংসারের সব কাজকর্ম একা করলেও সামনে আসে না কখনো, সবসময় আড়ালে থাকে।

এটাই যেন অলিখিত নিয়ম।


চায়না মাঝে মাঝে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে ভুঞাপুর বাজার থেকে নিজের একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে। মাসুম ব্যাস্ততায় চায়নার জন্য কিছু কিনতে পারে না।


মাসুম শরীকের ভাবীদের জন্য চানাচুর বাদামটানা মুরলি নিমকি জিলাপি কিনে আনে, ভাবীরা ওর ভাগেরটুকু দিয়ে যাবার সময় রসালো মন্তব্য ছেড়ে যায়। চুপচাপ শুনে যায়। চায়না জানে ওরা ওর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলছে।

খাবারগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না চায়না।


আগে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারে শুধু স্খলনের জন্য সঙ্গম হয় মাঝেমধ্যে রাতে। কোনরকম আদর স্পর্শ পায়নি কোনদিন মাসুমের কাছ থেকে চায়না। কথাও তো হয় না।

শুধু ওর প্রভাবশালী বাবার অর্থ এবং আর্মির চাকুরে ভাইদের ভয়ে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি কিন্তু চায়না নিজ থেকে যেন চলে যায়, তার সব ব্যাবস্থা করেছে।

চায়না দাঁতে দাঁত ঘষে পড়ে আছে এ বাড়িতে।

শশুর শাশুড়ী ভাসুর জা ননদ ননাস কে না ওকে শুনিয়ে রুপের খোটা দিয়েছে, চায়না কারো কোন কথার জবাব দেয়নি কোনদিন।

এবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের আর কিছু থাকুক না থাকুক গা ভরা রুপের জৌলুশ আছে,

নিজের বাবাকেও কোনদিন বলে নি ওকে চায় না বলেই কি ওর নাম চায়না রেখেছে। মায়ের পেটের সুন্দর মুখশ্রীর ভাই বোনরাও কোনদিন ওর সাথে ভাল করে কোন কথা বলেনি, সবসময়ই দূরত্ব রেখেছে।

ও বুঝতে পারে সব, নিজের মত করে উত্তরও তৈরি করে নেয় ভেতরে।

কঠিন পথ ওর একার, চলতে হবে একা। এই বোধ ওকে সোজা রাখে সমাজের বিরুদ্ধে সংসারের বিরুদ্ধে আপনজনের বিরুদ্ধে। রুপের বিরুদ্ধে।

তাই তো

শুধু সংসারের আয় বাড়িয়ে গেছে। নিজের জমার অংকটিও কম নয় আজ।

ওর আয়ের উৎস ওর পায়েরতলের শক্ত মাটিটা চেনে, মাসুম, মতিমিয়া মেঘাবতী তাই হয়তো বিষ হজমের মত করে ওকে মেনে নিয়েছে।

ছোটখাট গড়নের শ্যামলারঙের চায়নার দুচোখের নিচ থেকে চিবুক অবধি মিশমিশে কালো রঙের জন্ম জরুল। চোখ দুটো কুতকুতে, চওড়া কপালে বসে আছে কুচকুচে ভ্রমর ভ্রু হয়ে, গোয়াথুবি চুল।

ওকে ভয় হয় ঘৃণা হয়। ভালবাসা উবে যায় করুণাও হয় না

চায়নার মেয়েটা কোনদিন ওর গলা জড়িয়ে ঘুমায়নি। শেফালী ফুফুর সাথে ঘুমায় সারাদিন দাদির সাথে থাকে, ছেলেটাকে মায়ায় কাছে টানতে গেলে ভয়ে দূরে সরে যায়।

ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল চায়নার বিছানায়, প্রচন্ড গরম পরেছে, গ্রামের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় বিদ্যুৎ চলে যাওয়া।

গরমে হাত পা নাড়ছিল।

শুকনো কাপড় তুলে ঘরে রাখতে গিয়ে চোখে পরে ছেলেটা ঘামছে, গরমে এখুনি জেগে যাবে। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে ছেলেটাকে।

চায়নার নিজেও কাজে করতে করতে ক্লান্ত, চোখ বুজে আসে, ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে ওকে বাতাস করতে থাকে, 

আহা বড় আদরের সন্তান ওরা চায়নার।মমতার হাত বুলিয়ে দেয় তার নাড়িছেঁড়া ধনের গায়ে।

জেগে যায়, চায়নার চোখে চোখ রাখে, হেসে চায়না ওকে জড়িয়ে ধরতেই আত্মা ছিঁড়ে চিৎকার করতে থাকে ভয় পাই ভয় পাই বলে। শাশুড়ী দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিতেই কান্না বন্ধ হয় ছেলের।



আয়নার সাথে ওর কোনদিন সখ্য ছিল না, আজ সারাদিন আয়নায় সাথে কাটিয়ে দেয় চায়না।

আয়নায় ভেসে ওঠে আশ্চর্য অরুপ - রুপকথার সংসার।



সকালে মেঘাবতী দেখে সমস্ত মুখমন্ডল ওড়নায় ঢেকে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে চায়না।

আর কোনদিন মুখের আবরণ খুলেনি....

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -4


 

চার


ট্রেনে উঠেই কণিকার মোবাইল থেকে সাকিলকে ফোন করল ঋজু— সাকিল, দশটা পাঁচের লোকালটা ধরতে পারিনি। এগারোটা সতেরোটা ধরলাম। এখন পার্ক সার্কাস ক্রশ করছে। তুই তো জানিস যেতে কতক্ষণ লাগবে, হিসেব করে সেই মতো তুই কিন্তু স্টেশনে থাকিস। না হলে সমস্যায় পড়ে যাব। 

সাকিল ওর বন্ধু। আজকালে কাজ করে। থাকে ডায়মন্ড হারবারে। পুলিশ মহলে খুব খাতির। মগরাহাট থানার ওসি অরিন্দম আচার্য কী ভাবে মাছওয়ালাদের সঙ্গে জেলে সেজে ওখানকার কুখ্যাত ডাকাতকে ধরেছিল, সে খবর ফলাও করে ছেপে সবার নজর করেছে। ওর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কুসুমের ফেরা’-র তরফ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠান করে। এ বছর করেছিল ডায়মন্ড হারবার থানার নীচে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একশো জনেরও বেশি গুণিজনকে ও সংবর্ধনা দিয়েছিল। তাতে যেমন ছিল নাট্যকর্মী, গায়ক, সমাজসেবী, উপন্যাসিক থেকে শুরু করে ওর বস্‌ কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, তেমনি সংবর্ধিত হয়েছিল আর পাঁচ-ছ’জন কবির সঙ্গে ঋজুও।

সেখানেই ঋজু দেখেছিল, পুলিশরা কী ভাবে ওকে খাতির করে। স্থানীয় হোটেল-রিসর্টের মালিকরা প্রায় সকলেই সেখানে হাজির। তাদের কেউ স্পনসর করেছে স্মারক, কেউ ফুলের তোড়া, কেউ আবার উত্তরীয়।

সেই অনুষ্ঠানেই সাকিল ঘোষণা করেছিল, খুব তাড়াতাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাংবাদিকদের জন্য একটা প্রেস ক্লাব তৈরি করতে যাচ্ছে তারা। জমি পাওয়া গেছে। কিছু আর্থিক সাহায্যও এসে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।

সে দিন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঋজু আর ফিরতে পারেনি। শুধু ঋজু নয়, কলকাতার আরও কয়েক জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ফোনেই করে ফেলেছিল সাকিল। তাই, তার দু’দিন পরেই সাকিলকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, তোর তো ওখানে খুব দাপট দেখলাম। শোন না, বলছিলাম কি, ওখানকার কোনও একটা হোটেলে ব্যবস্থা করে দে না, কয়েক ঘণ্টার জন্য।

— ব্যবস্থা করার কিছু নেই। যে দিন খুশি চলে আয়।

— না, আগে থেকে না বললে...

— ধুর, চলে আয় না।

— না, মানে, আমি একজনকে নিয়ে যাব তো, তাই বলছিলাম...

— যখনই হোটেলের কথা বলেছিস, তখনই বুঝে গেছি। কত লোক আসে। তোর কোনও চিন্তা নেই। চলে আয়।

— বলছিলাম কি, পুলিশের কোনও ঝামেলা-টামেলা হবে না তো?

— আমি তো আছি, না কি? চলে আয়।

— কী রকম নেয়-টেয় রে?

— তোকে ও সব ভাবতে হবে না। যে দিন আসবি, তার আগের দিন শুধু একটা ফোন করে দিবি, ব্যাস। আমি স্টেশনে থাকব।


ঋজু এর আগে কখনও কোনও মেয়েকে নিয়ে শহরের বাইরে যায়নি। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে শুধু এক বার হেদুয়ার কাছে সান ফ্লাওয়ার নার্সিংহোমের সামনে দেখা করেছিল শালিনীর সঙ্গে। তাকে দেখে ওর একদম পছন্দ হয়নি। যেমনি গায়ের রং, তেমনি দেখতে। তেমনি তার পোশাক-আশাক। ওই রকম একটা ছেঁড়া ছেঁড়া রং-চটা স্যান্ডেল পরে কেউ প্রেম করতে আসে? ছিঃ। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। গিয়ে, হুট করে চলেও আসা যায় না। তাই ট্যাক্সিতে নয়, সেখান থেকে ওকে নিয়ে বাসে করে দেশবন্ধু পার্কে গিয়েছিল ও। ইচ্ছে না থাকলেও শালিনীর সঙ্গে একটা গাছের তলায় বসেছিল। শালিনীই আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, কিছু দিন আগে ওই ঝোঁপের আড়ালে কারা খুব খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছিল। বলেছিল, এই, জানো তো, কলেজ স্ট্রিটের কাছে বাটা আছে না, তার পাশ দিয়ে রাজাবাজারের দিকে খানিকটা গেলেই ডান হাতে একটা সিনেমা হল আছে— জহর। চেনো?

ঋজু ‘না’ বলাতে ও বলেছিল, ওখানে না, এ মার্কা বই দেখানো হয়। আমি কোনও দিন দেখিনি। যাবে?

— মেয়েটির কথা শুনে বড় অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। প্রথম সাক্ষাতেই কোনও মেয়ে এ রকম কথা বলতে পারে! ভরদুপুরে শুনশান পার্কে চারপাশ ফাঁকা পেয়েও চুমু তো দূরের কথা, তার হাতটাও ছুঁতে ইচ্ছে করেনি ওর। বসার খানিকক্ষণের মধ্যেই ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে’ বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়েছিল সে।

তার পর দিনই ছিল বিধানদার অনুষ্ঠান। মহাজাতি সদনে। আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত বারবার ফোন করেও না পেয়ে, পর দিন সকালেই অফিসের ফোনে কণিকাকে ধরেছিল ঋজু। ওখানে কবিতা পাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সাড়ে পাঁচটায়। বিধানদা ওকে বলে দিয়েছিল সাড়ে চারটের মধ্যে হলে ঢুকে পড়তে। প্রচুর কাজ আছে।

ঋজু এসে দেখে, বিধানদারা তারও আগে চলে এসেছেন। মঞ্চে চেয়ার পাতা হচ্ছে অতিথিদের জন্য। ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে টেবিল। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল শ্বেতার দিকে। ও আজ হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। এ শাড়িতে ও এর আগেও ওকে দেখেছে। ময়দানের বঙ্গ-সংস্কৃতি মেলায়। সেখানে ও শুধু একা নয়, ও যেখানে গান শেখে, সেই স্কুলের এক ঝাঁক মেয়ে এই রকম শাড়ি পরে গান গেয়েছিল, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে...

মাথার উপরে তখন গনগন করছে সূর্য। দর্শক বলতে যারা গান গাইছে তাদের অভিভাবক আর উদ্যোক্তাদের কয়েক জন। সঙ্গে বিধানদা ছিলেন। তাই, সুন্দরবনের ভ্যানরিকশায় অমন নিবিড় একটা ঘটনার পরেও ‘কী, কেমন আছ’, ‘ভাল তো?’, ‘তোমার তো দারুণ গলা’ ছাড়া তার সঙ্গে আর কোনও কথা হয়নি ঋজুর।

আজ তৃতীয় বার, তার সঙ্গে ওর দেখা হল। হল চোখাচোখিও। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পরেই একটু লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল শ্বেতা।

কিন্তু শ্বেতা নয়, ঋজুর তখন মন ছটফট করছে কণিকার জন্য। ও আসবে তো! একে একে তখন অনেকেই এসে গেছে। এসে গেছে তারাও, ও যাদের কবিতা পড়ার জন্য আসতে বলেছে।

ওকে উদ্বিগ্ন দেখে গণেশ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মিহির বলল, একটু ধীরস্থির হয়ে বসো। অত টেনশন করার কিছু নেই। রিনা বলল, শুনলাম, কণিকাকেও ফোন করেছিলেন?

ও বলল, হ্যাঁ। তার পরেই জানতে চাইল, আশিস আসেনি?

রিনা বলল, এসে যাবে। মহাদেববাবুকে বলেছেন নাকি?

— মহাদেববাবুকে? কই, না তো। যাঃ, একদম ভুলে গেছি। দেখেছেন... মুখে এ কথা বলল ঠিকই, আসলে ও ইচ্ছে করেই মহাদেববাবুকে বলেনি।

ঋজু যেন কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছে না। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, পরমার্থ ওর পেছন পেছন এসে বলল, কণিকা তো? ঠিক আসবে। তুমি যাও, আমি দেখছি।

ঋজু হলে চলে এল। এল ঠিকই, তবে ও নয়, ওর দেহ। সিটে বসে ছটফট করছে আর ঘনঘন দরজার দিকে তাকাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর দেখে কণিকাকে নিয়ে পরমার্থ ঢুকছে। ও উঠে দাঁড়াতেই, দূরে থেকেই পরমার্থ হাত দেখাল। বসো। ঋজু যে রো-য়ে বসে ছিল, তার ডাঁয়ে-বাঁয়ে পর পর কয়েকটা সিট খালি। ওরা ওর পাশে এসে বসে পড়ল।

ও যাদের যাদের বলেছিল, তারা সবাই এল। কিন্তু পুরস্কার-পর্বটা এতক্ষণ ধরে চলল এবং অতিথিরা প্রত্যেকেই এতক্ষণ ধরে বক্তব্য রাখলেন, আর বিধানদা সম্পর্কে এত মধুর মধুর কথা বললেন, এত ভূয়সী প্রশংসা করলেন যে, প্রায় ন’টা বেজে গেল। কবিতা পাঠের আসর আর করা গেল না।

বেরিয়েই, সি আর এভিনিউ আর মহাত্মা গান্ধী রোডের ক্রশিংয়ে আসতেই ২৩৯/এ বাস পেয়ে রিনা আর আশিস উঠে পড়ল। এই বাসটা একদম ওদের বাড়ির কাছে যায়। সেক্টর ফাইভের পেছনে, মহিষবাথানে। ওরা কণিকাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই ঋজু ওকে ইশারা করে বারণ করে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে যেতে। রিনাদের বাস চলে যেতেই কণিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঋজু বলল, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।

বাকিরা সবাই যখন যে যার মতো চলে গেল, তখন ওখানে দাঁড়িয়ে ও, কণিকা আর বোধিসত্ত্বদা। বোধিসত্ত্বদাই বলল, কোথায় যাবে?

ঋজু বলল, সল্টলেকে।

— সল্টলেকে কোথায়?

— কণিকা বলল, ভারতীয় বিদ্যাভবনের কাছে।

— এখান থেকে কত নম্বর যায়?

কণিকা বলল, এখান থেকে তো কোনও দিন যাইনি। আমি ঠিক জানি না। তবে কলেজ স্ট্রিট থেকে নাকি অটো যায়।

— তা হলে চলো কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাই। বোধিসত্ত্বদা বলতেই কণিকা বলল, কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয় না, ফুলবাগানের অটোগুলো কোত্থেকে ছাড়ে।

— ফুলবাগান?

— হ্যাঁ, এখান থেকে ফুলবাগান। ফুলবাগান থেকে আবার তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের অটো। ওখান থেকে একটুখানি।

ওরা মহাত্মা গান্ধী মেট্রো স্টেশনের পাশ থেকে অটোয় উঠে পড়ল। পেছনের সিটের ও দিকে বোধিসত্ত্বদা, তার পরে ঋজু আর একদম এ দিকে কণিকা। চতুর্থ জন আসছে না দেখে, বোধিসত্ত্বদাই বলল, একজনের ভাড়া না-হয় আমরা দিয়ে দেব, চলুন।

অটো চলতে শুরু করল। রাজাবাজার ছাড়িয়ে মানিকতলার ব্রিজ পেরিয়ে যখন অটো ছুটছে, তখন লোডশেডিং। এতক্ষণ ঋজু ওর পায়ে পা ঘষছিল। পিঠের পেছন দিক থেকে হাত নিয়ে ওর কাঁধ ছুঁচছিল। ওর কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিল কণিকা। ও-ও মুচকে মুচকে হাসছিল। এ বার কণিকার ডান হাতটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে এসে ঝপ করে একটা চুমু খেয়ে নিল ও।

কণিকা ইশারা করল, পাশে উনি আছেন। ঋজু বলল, আরে বোধিসত্ত্বদা আমাদের লোক। উনি কিছু মনে করবেন না।

কথাটা শুনে বোধিসত্ত্বদাও বলল, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও। এই তো বয়স।

শুনে কণিকা মুখ টিপে হাসল। ঋজু ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল, দেখলে তো... তার পরেই চকাস করে ওর গালে একটা চুমু খেয়ে নিল।


তার দু’দিন পরেই রবিবার। ওরা দেখা করল রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনের সামনে। একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। ও তখনও আসেনি। তাই, ও আদৌ আসবে কি আসবে না সে নিয়ে শংসয়ে ছিল। সেই উদ্বেগ থেকে দুটি লাইন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতেই, ওর পকেটে যে ছোট্ট ডায়রিটা থাকে, সেটা বার করে লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে হঠাত্‌ দেখে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। ও কাছে গিয়ে বলল, কখন এসেছ?

কণিকা বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগে। দেখলাম তুমি লিখছ, তাই ডিসটার্ব করিনি। কী লিখছিলে?

— কবিতা।

— কী নিয়ে?

— তোমাকে নিয়ে।

— তাই? দেখি, কী লিখেছ?

— ছাপা হোক, তার পর দেখো।

— কী নাম দিলে?

— এখনও কোনও নাম দিইনি। দেখি, কী দেওয়া যায়!


সে দিনই রাত্রে কণিকাকে ফোন করে ঋজু বলেছিল, আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রোজ যদি তোমার সঙ্গে এই ভাবে দেখা করা যেত!

— ইচ্ছে করলেই দেখা করা যায়। ও বলেছিল।

— কী ভাবে?

— আমার তো ছুটি হয় পাঁচটায়। তোমার তো ছ’টায় ঢুকলেও চলে। এক ঘণ্টা আমরা একসঙ্গে কাটাতেই পারি।

— ঠিক বলেছ তো! ঠিক আছে, কাল ঠিক পাঁচটার সময় আমি তোমার অফিসের গেটে চলে যাব। কেমন?

— না না না না। অফিসের গেটে না। আমাদের অফিসের সবাই তখন বেরোয় তো। কে কী ভাববে। কী দরকার? তার চে’ বরং ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের কাছে থেকো। আর তুমি যদি পাঁচ-দশ মিনিট আগে চলে আসো। তা হলে নীচ থেকে একটা ফোন কোরো। আমি নেমে আসব।


সেই রাতে কিছুক্ষণ পর পর আরও তিন-চার বার ফোন করেছিল ও। এমনকী, অফিস থেকে বেরোবার সময়ও। তাই মাথার মধ্যে নম্বরটা একদম গেঁথে গিয়েছিল। ফলে, পর দিন ও যখন টেলিফোন ভবনের সামনে ফোন করার গুমটি থেকে এক টাকার কয়েন ফেলে নম্বর টিপল, সেটা চলে গেল কণিকার বাড়িতে। যে মেয়েটি ধরল, সে বলল, মা তো অফিসে।


শুধু সে দিনই নয়, তার পরেও বেশ কয়েক দিন ওর এই একই ভুল হয়েছিল। আর এই ভুলের জন্যই ঋজুকে খুব ভাল ভাবে চিনে গিয়েছিল কণিকার দুই যমজ মেয়ে। ছোট বাবি আর বড় বাবি।

প্রথম যে দিন ওদের নাম শোনে, ঋজু একেবারে চমকে উঠেছিল। ছোট বাবি! বড় বাবি! তার ছেলের নামও তো বাবি। সত্যিই, কী কাকতালীয় মিল, না! একেই বোধহয় বলে প্রেম! তার পরেই মনে হল, কিন্তু কোথায়, সে দিন যখন কথায় কথায় কণিকাকে ও বলেছিল, তার ছেলের নাম বাবি। ও তো এক বারও বলেনি, আমার মেয়েদের নামও বাবি। বড় বাবি, ছোট বাবি। নাকি সে সময় প্রেমে এত মশগুল ছিল যে, ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। কে জানে!

ঋজুরা বুধবার-বুধবার আড্ডা মারত রবীন্দ্রসদন চত্বরে। কখনও বাংলা আকাদেমির সামনে। কখনও আপনজন-এর সামনে জলের ফোয়ারা ঘেরা বাঁধানো বেদিতে। আসত মিহির, গণেশ, দিশা, রফিক, বোধিসত্ত্ব। আসত বড়রাও। রানা চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। আসত নানান লিটিল ম্যাগাজিনের লোকেরা। আবৃত্তিকারেরা। কণিকাও সেখানে আসা শুরু করল।

সে দিন একটি আবৃত্তি সংস্থার প্রোগ্রাম চলছিল জীবনানন্দ সভাঘরে। সেখানে কয়েক মিনিট কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কণিকা আর ঋজু। সামনেই পর পর সিমেন্টে বাঁধানো দুটো বেঞ্চ। তার পেছনে, ঘেরা-জলাশয়ের মধ্যে নন্দন প্রেক্ষাগৃহ।

সে রকম একটা বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল ওরা। একটু ঘনিষ্ঠ হয়েই। কে কী বলবে? ওখান দিয়ে যারা যাতায়াত করে, তারা প্রায় সবাই ঋজুকে চেনে। ঋজুও তাদের চেনে। হঠাৎই একটু সরে গেল কণিকা। — কী হল?

জিজ্ঞেস করতেই কণিকা বলল, ওই যে মেয়েটা আসছে, ও মহাদেববাবুর ছাত্রী। আমাদের বাড়িতে পড়তে যেত।

ঋজুর কেমন যেন খটকা লাগল। কেউ যে তার স্বামীকে এই ভাবে বাবু হিসেবে সম্বোধন করে, সেটা ঋজু এই প্রথম দেখল। সে দিন দাঁতন যাওয়ার পথে আশিস তাকে বলেছিল, ওরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু কেন জানি ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, ওরা সত্যি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী।

তারা যে সে দিন জীবনানন্দ সভাঘরের সামনে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল, তার পর দিনই কী করে যেন সে খবর পৌঁছে গেল মহাদেববাবুর কাছে। কণিকাকে নাকি উনি বলেছেন, কী হচ্ছে এ সব? কী শুনছি?

ঋজু শুনে বলল, উনি জানলেন কী করে?

কণিকা বলল, আমার মনে হয়, ওই মেয়েটাই বলেছে। সে দিন দেখালাম না, ওই যে গো, ওই মেয়েটাকে...


এর ক’দিন পরেই আশিসের ফোন। কী খবর? কোনও ফোন-টোন নেই কেন? ভুলে গেলেন নাকি? একদিন আসুন।

— যাব। এর মধ্যেই যাব।

এর মধ্যে কেন আবার? কালই আসুন না... আসার সময় আপনার লাস্ট যে কবিতার বইটা বেরিয়েছে, তার একটা কপি নিয়ে আসবেন তো...


পরমার্থ শুনে বলল, আমার সঙ্গে সেই কবে থেকে আলাপ, আমাকে তো কোনও দিন কবিতা পাঠের কথা বলল না!

— আরে বাবা, কবিতার জন্য না। আমাকে এমনিই যেতে বলেছে।

— এমনি বললে, কবিতার বই নিয়ে যেতে বলত না।

— কী জানি, কিছু তো বলল না। দেখি, কাল গিয়ে।


ঋজু গিয়ে দেখে, আশিসের সামনে মহাদেববাবু বসে আছেন। ও যেতেই ওরা নীচে নেমে এল। ‘আমি একটু আসছি’ বলেই আশিস যেন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। আকাশবাণীর বাইরে, গেটের সামনে ঋজু আর মহাদেববাবু। তিনি বললেন, এ সব কী শুনছি? তোমাকে আর ওকে নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলছে। বাড়িতে ফোন করে পর্যন্ত বলছে। ওকে আমি কিছু বলব না। আমি জানি,ওর একটু ছেলেদের গায়ে-পড়া স্বভাব আছে। আমি তোমাকে বলছি। তুমি তো জানো, আমাকে কত লোক চেনে। তোমাদের মধ্যে যদি কোনও সম্পর্ক হয়েই থাকে, আমি বাধা দেব না। কিন্তু... 

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছলছল চোখে আচমকা মহাদেববাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরল ঋজু— কী করব মহাদেবদা, আমি যে ওকে ভালবেসে ফেলেছি।

ঋজুর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে উনি বললেন, আমি তোমাকে কিছু বলছি না। শুধু বলছি, যা করবে, একটু দেখেশুনে করবে। আমার ছাত্রছাত্রীরা যেন জানতে না পারে।


তাই ক’দিন ধরে কণিকার অফিস ছুটির পরে ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ডের সামনে ছাড়া ঋজু আর কোথাও কণিকার সঙ্গে দেখা করছে না। বুধবার-বুধবার রবীন্দ্রসদন চত্বরেও আসতে বারণ করে দিয়েছে ওকে।


হঠাৎ এই সুযোগ। একেবারে আচমকা। ঋজুর বউ ভারতী। বিয়ের পর থেকে ঋজু তাকে রতি বলেই ডাকে। সে জানে, প্রত্যেক বছর বইমেলার এই প্রথম রবিবারে কলকাতার পুস্তক মেলার গিল্ড কর্তৃপক্ষ যে ‘বইয়ের জন্য হাঁটুন’ পদযাত্রার আয়োজন করে, সেখানে ঋজুও যায়। উত্তর কলকাতার লোকেরা কলেজ স্ট্রিট থেকে আসে। আর দক্ষিণের লোকেরা দেশপ্রিয় পার্ক থেকে যায়। মিলিত হয় পার্ক স্ট্রিটের মুখে। এমন টাইমিং যে দুটো মিছিলই প্রায় একই সঙ্গে বইমেলায় ঢোকে। সে-ই যে ঋজু ঢোকে, ফেরে অনেক রাতে।

রতিকে ‘ওখানে যাচ্ছি’ বলে, সকালেই বেরিয়ে পড়ল ঋজু। তার পর সোজা শিয়ালদা। এখন শহরের সবার নজর এড়িয়ে ডায়মন্ড হারবারে। স্টেশনে নেমেই একটা কালো গগল্‌স পরে নিল কণিকা। স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল সাকিল। সে ওদের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঋজু দেখে, সামনেই একটা পুলিশের কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। সাকিল ওদের সেটায় উঠতে বলল। তার পরে নিয়ে গেল হংসরাজে। বিশাল একটা লাকজারিয়াস হোটেল। কাউন্টারের লোকটাকে সাকিল কী বলতেই, লোকটা একজন বেয়ারাকে ডেকে বলল, উপরে নিয়ে যা। বেয়ারাটা ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটা ঘর খুলে দিল। টিপটপ এসি রুম। সাকিল চলে গেল।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয় একদম অভিজ্ঞতা নেই ঋজুর। একেবারে আনকোরা। দরজায় ছিটকিনি তুলে পেছন ঘুরে দেখে কণিকা ততক্ষণে গগল্‌স, কানের দুল, গলার হার, খোপার ক্লিপ খুলে ফেলেছে। শাড়ি খুলছে।

ঋজু খাটের ধারে বসে কণিকাকে দেখছিল। কণিকা শুধু ব্রেসিয়ার আর শায়া পরে খাটে উঠেতেই ও-ও জামাপ্যান্ট খুলে বিছানায় উঠে পড়ল।

তার পর মহাপ্রলয়। ঘুমন্ত ময়াল জেগে উঠল। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল বারবার।

হঠাৎ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। কণিকার মোবাইল বেজে উঠল। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে কণিকার দিকে এগিয়ে দিল ও। স্কিনে নম্বরটা দেখে নিয়ে বিছানার পাশে রেখে দিল কণিকা। বলল, কে না কে, থাক। ফোন করার আর সময় পায় না। যত্তসব। কিন্তু ফোনটা ঘনঘন বাজতেই লাগল।

_______________________


                                       ক্রমশ...



তৃতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন -

Click here 🔴



পঞ্চম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--

Click here 🔴