Sunday, June 12, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -6


 

রন্টুনা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আমায় বলল, জানিস রমা অনেক দিন পর গ্রামে এজুম পূজো দেখতে। তোদের অবস্থা সুমন্তর কাছে শুনেছিলুম প্রথমত আমি বিশ্বাস। করতে পারিনি ওর কথা। কোন মানুষ যে এই অবস্থায় পড়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন। জামার কল্পনাতীত। তোর বাবার মতো ব্যক্তি এদেশে বিরল। শত কষ্ট স্বীকার করে। ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন। বলতো রমা এইরূপ ত্যাগ স্বীকার। করে ক'জনই করতে পারেন। তোদের এইরূপ অবস্থা দেখে সংকল্প করেছি তোদের এই দুঃখের আমি অংশীদার হতে চাই। এই মায়ের মন্দিরে শপথ করছি তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখবো। রন্টুদার চোখের সামনে করুণ ছায়া নেমে এলো। পুনরায় আর্দ্র গলায় বলতে শুরু করলো, তোর দাদার সাথে মাত্র একটি বছর ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলুম, কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য সব কিছু হারিয়ে ফেললুম, অর্থাৎ নিজস্ব অর্থ না থাকলে এই বর্তমান যুগে কোন কাজেই সম্ভব নয়। মাসীমার অপার করুণায় ডাক্তারী পড়লুম। তাও কপালে সইলো না। এক বৎসর পরেই ডাক্তারী পড়ায় ইস্তফা দিতেও হলো। 


রন্টুদা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, সে অনেকবারে। তবে তোর মতো বোনকে লাভ করে আমি ধন্য হয়েছি। কারণ, দেখলাম রন্টুদার চোখ দুটো বাষ্পাকূল হয়ে গেলো। বার কয়েক ঢোক গিলে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ওর ঐরূপ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কেমন যেন হয়ে গেলাম। মনটা বড় আকূল হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, হঠাৎ রন্টুদার এ অবস্থা হবার কারণ কি! 


আমি জিজ্ঞাসা করার আগে বলল, আজ বহুদিন পর আমার হারানো বোনকে ফিরে পেলাম। 


ওকথা শুনে আরো কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি।


 বলল, জানিস রমা, দেখতে সে তোর মতই ছিলো। তোর চেহারার মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য ছিলো। ওকে বড় ভালোবাসতাম রে। কিন্তু হতভাগী যে অকালেই চলে যাবে ভাবতে পারিনি। তার অকাল বিয়োগ আমাকে পাগল করে তুলেছিলো ও বিধাতার এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহী হয়েছিলুম। 


স্থির হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। দাদা অনেক আগে আমাদের কাছ হতে সরে গিয়ে পাড়ারই এক ছেলের সাথে গল্পে মেতেছিলো। আমার তার দিকে মোটেই খেয়াল ছিল না। রন্টুদার মলিন মুখ দেখে বেদনায় আকূল হয়েছিলাম। রন্টুদা বলে চলেছে। তখন হতে কোন পল্লী অঞ্চলে যেতে চাই না। কারণ পল্লী অঞ্চলেই হারিয়েছিলুম বোনকে। এখানে না আছে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র না আছে কোন চিকিৎসার সুব্যবস্থা। এমনকি একটা ডাক্তার পর্যন্ত থাকে না। যদি সে ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে মনে হয় বোনকে হারাতাম না। তোর বাবা উপযুক্ত কাজ করেছেন। সুমন্ত ডাক্তারী পড়ার কারণ আমি সব শুনেছি। সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করলে তোদের গ্রামে অনেক উপকার হবে। পল্লী গ্রামের চিকিৎসা অপ্রতুলতায় আমার বোনের জীবনদ্বীপ যে অকালে নির্বাপিত করে দিয়েছে। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমার, 


কি করে হারালো রন্টুদা? 


সে অনেক কথা রমা। শুনবি? 


শুনবো রন্টুদা। 


রন্টুদা মুখটাকে রুমাল দিয়ে মুছে বলতে শুরু করলো। গোল বেঁধে ছিলো ওখানে যদি মামার দেওয়া জিলিপিগুলো না খেতো তাহলে মনে হয় পুনরায় মুখটা মুছলো। দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। বেশ কিছু দিন আগে আমার মেজমামা আমাদের আনতে গিয়েছিলেন গ্রামের কীর্ত্তন উপলক্ষ্যে। আমার মামাবাড়ী পল্লী অঞ্চলে। যেখানে শুধু সবুজের সমারোহ। তাকাচ্ছে চারিদিকে আড়াল করে থাকে পুকুরকে। ভোরে কোকিলের কণ্ঠস্বর মনকে বড় মাতোয়ারা করে দেয়।


 সেই পল্লী গ্রামেই ছিলো আমার মামা বাড়ী। মা'র সাথে আমিও আমার বোন, হাজির হলুম মামা বাড়ীতে। বেশ ভালো লাগছিলো গ্রামখানিকে। বহুদিন পর মামাবাড়ীতে এলুম। ছোটবেলাতে কয়েকবারই এসে ছিলুম। তারপর বয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামাবাড়ীর আকর্ষণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছিলো। কিন্তু মা'র কথা কাটতে পারলাম না। কীর্ত্তন মোটেই ভালো লাগতো না। মামাতো ভাই সুব্রতর সাথে নানান জায়গায় আড্ডা দিতাম। পর পর দুটো দিন নানা রঙে ঢঙে তামাসায় কেটে গেলো। ভাবতে পারিনি কিভাবে সময় কাটছিলো। তৃতীয় দিন আমাদের সকলের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে আসবে কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। মামা বাড়ীতে যে বোনটার উজ্জ্বল শিখা নিভে যাবে তা বুঝতে পারিনি।


 ঐদিন কীর্তনের শেষে আমরা সকলেই উঠানে বসে আছি। একটু পরে গ্রামের বুকে অন্ধকার নেমে এলো। মামা একসময় বড় প্যাকেটে কিছু গরম জিলাপী নিয়ে এলেন। সকলের হাতে কিছু কিছু দিলেন। বেশ হৈ হুল্লোড়ে সকলেই কিছু কিছু খেয়ে ফেললুম। ঘন্টাখানেক পর শুরু হলো এক করুণ দৃশ্য। সে দৃশ্য আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খাদ্যে বিষক্রিয়া শুরু হলো। বুঝতে পারলাম, এটা নিশ্চয়ই ফুড পয়েজিং এর কেস। যারা শক্তিশালী তারা সহ্য করতে পারল কিন্তু আমার বোন বীনা ও মামাতো বোন গোপা বিষক্রিয়ায় শিকার হয়ে উঠলো। আমি পাগলের মতো ডাক্তার ডাকার জন্য চিৎকার করতে থাকলাম। কি করবো অরণ্যের রোদন করে। ঐ এলাকায় কোন ডাক্তার নেই তো গ্রামের লোকেরা কি করবে। 


বীনার শেষ অবস্থা ঘনিয়ে এলো। গরুর গাড়ীতে করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার ব্যবস্থা করলাম। গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে হাসপাতাল। গোপা ও বীনাকে হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই বীনার জীবন দ্বীপ নিভে গেলো। সে চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে পরম শান্তি লাভ করলো।


রন্টুদা চুপ করলো। ওর চোখ দিয়ে গরম জল নির্গত হলো। লোমশ বুকের মধ্যে। হাত রেখে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, ওর মৃত্যুতে বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিলুম। বিশেষ করে মা ওর শোক সহ্য করতে না পেরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সেই রোগ শয্যা হতে তিনি আজও পর্যন্ত উঠতে পারেননি। মনে হয় আর বাঁচবেন না। বীনার মতো উনারও আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।


 রন্টুদার দীর্ঘশ্বাস পড়লো, সে অপলক নেত্রে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে হয় সেই শোকাবহ ঘটনা তার স্মৃতিপটে উদিত হওয়ায় সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। পর পর দুবার ডাক দেওয়ার পর আমার কথায় সাড়া দিলো। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অতীতকে মনে এনে নিজেকে দুর্বল কোরো না রন্টুদা। ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শুধু তোমার বোন বীনা কেন, ঐ বয়সর কত কত মেয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে বলে কি বিধাতার উপর দোষারূপ করবো? নিয়তিকে কেউ বাধা দিতে পারে না। জানবে আমার মধ্যে তোমার হারানো বোন ফিরে পেয়েছো। দাদা কতক্ষণ আগে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে তা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।


 দাদা বলল, তোদের এই স্নেহের বন্ধন আমার মনে এক অপার্থিব আনন্দের স্পর্শ এনে দিয়েছে। রন্টু আশাহত ছেলে। ও জীবনে অনেক কিছু করবে ভেবেছিলো কিন্তু এ সমাজের নিষ্ঠুরতার ওকে বলি হতে হয়েছে। সে অনেক কথা, ওর জীবনী নিয়ে একদিন বলবো তোকে। তবে মনে রাখিস ওকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করে যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিস।


 বললাম, রন্টুদা আমার আপন দাদা, তাই চিরদিনই ওকে মনে রাখবো।


 কি রে রন্টু, রমাকে পেয়ে তোর জীবনের ভগ্নি হারানোর শূন্যতার স্থান পূরণ করলি তো?


 রন্টু ঘাড়টা নাড়লো। মিনিট খানেক পরে নীরব থাকার পর আমরা সকলে বাড়ী যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রন্টুদা বাক্যালাপ না করে আমাদের পিছনে হাঁটতে থাকলো। বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে রন্টুদার বোনের নিয়ে কথা বললে প্রথমতঃ তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।


 এমনি আনন্দের মাঝে শারদীয়া পূজো কেটে গিয়ে ওদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ওদের বিদায় দিতে হবে শুনে মনটা বড় কেঁদে উঠলো। মনে হলো ওদের যেন হারিয়ে ফেলছি। মন চাইছিলো ওরা যেন আজীবন আমাদের কাছে থাকে। কিন্তু কর্তব্যের অনুরোধে তাদের ছাড়তে বাধ্য হলাম। ওদের কর্তব্যে বাধা দেওয়া আমার কাম্য নয়।


রন্টুদাকে প্রণাম করে বার বার আসতে বললাম। সে সম্মতি জানালো নিশ্চয়ই আসবে দাদা বিদায়ের আগে বলল টাকা পাঠাবার জন্য। বাবা কথা দিলেন যথা সময়ে ওর নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন ওরা বিদায় নিলো। আমি ও বাবা কিছু দূরে এগিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফিরে এলাম।


                               ক্রমশ...

Saturday, June 11, 2022

ছোট গল্প - প্রায়শ্চিত্ত || লেখক - তপন তরফদার || Short story - Praichitto || Written by Tapan Kumar Tarafdar


 


        প্রায়শ্চিত্ত

                         তপন  তরফদার 



         মানুষ প্রেম করে, মানুষই ভালোবাসে, আবার মানুষই প্রায়শ্চিত্ত করে।  নিউ র্নমাল যুগের অনেক আগের ঘটনা। তখনও অনেক কালজয়ী প্রেম ঘটিত ঘটনা সমাজে দাগ কেটেছিল। আবার এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য আলোকিত হয়নি।দেশের রাজধানী,বা বড়ো শহরের ঘটনায়   যেমন আলোচিত ও আলোকিত হয় মফস্বল, এক অনামী গ্রামের ঘটনা বা রটনা বাতাসে ভেসে  থাকতে পারেনা। কিন্তু  ঘটনার মশলা অনেক অনেক প্রেমগাথার থেকেও ঝাঁঝালো। প্রায়শ্চিত্ত ও দাগা দিয়ে যায়। যুগের  পরিবর্তন হয়েছে, প্রেমের ও পরিবর্তন হয়েছে। চণ্ডীদাস কত কষ্ট ও কসরত করে প্রেম করেছিল সবাই  জানে। কেষ্টকে কত কষ্ট করে শরীরের সব দম বাঁশির পিছনে ফুঁকে রাধিকার মান ভঞ্জন করতে হয়েছিল।
         উত্তর বঙ্গের অনেক চা বাগান আছে। প্রত্যেক চা বাগানের কুলি কামিনদের নিজের গল্পকথন থাকে। ঠিক মত প্রচার পেলে লায়লা  মজনুর কাহিনী ম্লান হয়ে যেত।  মথুরা চা বাগানের ঘটনা। সিমলাবাড়ি থেকে  আরও চার মাইল খাড়াই পথের দূরত্বে মথুরা টি এস্টেট। সিমলাবাড়ি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্কুল,গ্রামীন হাসপাতাল, কিছু দোকান। আশেপাশের পয়সাওলা লোকেদের বিনোদনের জন্য  হোটেল কাম বার। হোটেলের নাম ব্লু হেভেন। সিমলাবাড়ির মুকুটে নতুন পালক যোগ হয়েছে ভানু ভক্ত স্কুল উচ্চমাধ্যমিকে উন্নত হয়েছে। আগে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য সদর শহরে যেতে হত, এখন আশেপাশের ধামগুজারি, চিলপাতা,চকোযা,কুর্মাই বাঁশবাড়ির  ছেলে মেয়েরা এখানেই পড়ছে। সিমলাবাড়ি আরও জমজমাট হচ্ছে।
             মথুরা চা বাগানের ক্লার্ক পরেশ চক্রবর্তী চুটিয়ে সংসার করছে। এখানে ব্রাম্ভনের বড়ই  অভাব। পরেশবাবু ও নিজের জাত নিয়ে গর্বিত। চা বাগানের কুলি কামিনরা উঁচু  জাতের মানুষকে সমীহ করে। পরেশ চক্রবর্তীর মেয়ে ওই ভানু ভক্ত স্কুলের ছাত্রী। কোদাল বস্তি হয়ে মালাঙ্গি পেরিয়ে হাইওয়ের পাশে বাঁশবাড়ি থেকে হাজিরা বাবু কদম ছেত্রীর দুর সম্পর্কের ভাগ্নে দেবেশ রায়,ভানু ভক্ত বিদ্যালয়ে বিঞ্জান নিয়ে  পড়বার জন্যে ভর্তি হয়েছে।
        গায়ত্রী  সেজেগুজে স্কুলে এসেছে। সরস্বতী  পুজোয়,প্রথম শাড়ি পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছে আর বলছে এই আমি  কি সেই আমি। সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। গায়ত্রী পড়েছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।শাড়িতে কাঠগোলাপ ফুলের নকশা। ফুল হাতা গোলাপি ব্লাউজ। মাথার্ভতি ঢেউ খেলানো চুল। চুলের রঙের সাথে মিশে যাওয়া কালো ক্লিপ দিয়ে মাথায় লাগিয়েছে কাঠগোলাপ ফুল। গায়ত্রীর উজ্জ্বল ত্বক,সুন্দর গড়ন। পেলব ঠোঁট, হাসলে গালে টোল পড়ে । গায়ত্রী সাইকেলই স্কুলে যায়। গায়ত্রী আজ উপোস করে আছে। স্কুলে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। স্কুলেই খিচুড়ি খাবে।
               পুষ্পাঞ্জলির “কুচ যুগল শোভিত” উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আলোড়ন ওঠে। গায়ত্রীর মুখে রক্তিম ছোপ। আবার মোচড়। এবার  বুঝতে পারে মেয়েদের প্রতি মাসের সেই সঙ্গী  মোচড়। দিশাহারা হয়ে যায়। গায়ত্রী কাউকেই কিছুই না বলে পাঁই পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফিরতে চায়। সোনপুর পেরিয়ে ঢালু বাঁকটা নামতে গিয়ে ধাক্কা মারে এক  মাউন্টেন সাইকেল চালককে। মাউন্টেন সাইকেলের চাকা চওড়া এবং পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তা কামড়ে চলে,সহজে পিছলে যায়না। গায়ত্রীর কমফর্ট সাইকেল যা পাহাড়ি রাস্তার উপযুক্ত নয়, অনেকটা ঝুঁকে চালাতে হয়। ছিটকে পড়ে গায়ত্রী। সাইকেল চালক দেবেশ গায়ত্রীকে শক্ত হাতে তুলে ধরে। দুজনের চোখ দুজনের চোখে। “বধূ কোন আলো লাগলো চোখে”। দেবেশ এক সুপুরুষ যুবক। গ্রীক ভাস্কর্যের প্রতিরূপ। টিকালো নাক। ধারালো মুখ। উজ্জ্বল দুটি চোখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। সব মেয়েরা শিব পুজো করে এরকমই শিবের জন্য। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে গায়ত্রী বলে আমার শরীরটা খারাপ  লাগছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাব। দেবেশের ঘোর কাটেনি। মনে হচ্ছে কোন পরি যেন তার কোলে ধরা দিয়েছে। দেবেশ বলে আমি বাড়িতে পৌঁছে দেবো। গায়ত্রী বলে, না না দরকার নেই। পরে কথা হবে। দেবেশ বলে, একই স্কুলের আমরা। নিশ্চয়ই দেখা হবে। গায়ত্রীর যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখেও এক তাৎপর্য পূর্ণ হাসি।
                ওদের  স্কুলের  যাতায়াতের পথে চিলপাথা ফরেস্ট গেটের ডান দিক দিয়ে সরু পাথরের রাস্তা মিশেছে বানিয়া নদীর কিনারায়। প্রত্যেক অঞ্চলেই একটা স্থান থাকে যেখানে কপোত-কপোতীরা বক-বকমের জন্য মিলিত হয়। এইসব স্থানে প্রেমিক -প্রেমিকারা তাদের প্রেমকে অমর করে রাখতে  গাছের কাণ্ডে কিংবা পাথরে নাম খোদাই করে রাখে। বানিয়া নদীর  পাথরের বুকেও তার  নিদর্শন আছে। একদিন গায়ত্রী বলে আমারা একটা ঝোপের আড়ালের পাথরে আমাদের  নাম খোদাই করি। দেবেশ পড়াশোনায় ভালো,খোঁজ খবর ও রাখে। দেবেশ বলে পৃথিবীতে প্রাচীনতম প্রেম পত্রটি পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়ার ক্যালডিয়া অঞ্চলে।  ২২০০খ্রিঃপূঃতে ব্যাবিলনের একটি ছেলে   এক খন্ড পাথুরে মাটির ফলকে  ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিপারাবাসী তার প্রেমিকাকে হিব্রু,আরবি,আরমিক ভাষা মিশিয়ে  প্রেমগাথা  লিখেছিল।    
               দেখতে দেখতে দু বছর কেটে গেল। গায়ত্রী ক্লাস ইলেভেন উঠলো। দুজনের বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। গায়ত্রীর মা বলে  দেবেশ ছেলেটা  ভালো  ওরা দুজনে  দুজনকে ভালোবাসে। ওদের পরে বিয়ে দেবো।। পরেশবাবু শুনেই  বলে কখনো না। আমরা ব্রাম্ভন।মেয়েকে প্রাণপণ ভালোবাসি। ওই নিচু জাতের বখাটে ছেলের সঙ্গে  বিয়ে কিছুতেই নয়। ভগবান পরেশবাবুর কথা শুনতে পায়। মালিঙ্গী চা বাগানের  ম্যানেজার মোনোজ মুখার্জ্জীর ছেলের সঙ্গে  বিয়ের ঠিক করে।
            গায়ত্রীকে ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। প্রেম যারা করে তারা ঠিক কোনো না কোন  উপায় বার করে। দেবেশ গায়ত্রীদের বাড়িতে ঠিকে ঝি বাসবীর মাধ্যমে চিঠি চালা চালি শুরু  করলো। সিদ্ধান্ত হলো বিয়ের দিন রাত্রে  পালিয়ে যাবে নয়তো বিষ খেয়ে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।
            “ স্টুপ টু কনকার।“ দেবেশ গায়ত্রীর বাড়িতে গিয়ে পরেশবাবু কে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে,বলে আমার বাড়ির লোকজনেরও এই বিয়েতে মত নেই। আমি ও চাই  ওর ভালো জায়গায় বিয়ে হোক। মেসোমশাই বিয়েতে খাটা খাটনির জন্য আমি আছি। দেবেশ ঘরের ছেলের মতোই বিশ্বাসী হয়ে গেল। সব কাজ  হাসিমুখে করছে। এমন কি সবার সামনেই গায়ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। বিয়ের ভোজের জন্য বাছাই করে পাঁঠা কেনা হয়েছে। পাঁঠারা পাতা চিবাচ্ছেই আর ব্যাঁ ব্যাঁ করে ডাক ছাড়ছে।  দেবেশ সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করে -এই বিয়েতে কত পাঁঠা  বলি হবে। যে যার মতোই অঙ্ক কষে উত্তর দেয়। গায়ত্রীর মনের কাঁটা খচখচ করে উঠে। তবে কি দেবেশদা ধরে নিচ্ছে ওর জীবন বলি হয়ে গেল। বিয়ের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ খবর এলো দেবেশের কোন কাকার স্ট্রোক হয়েছে  কলকাতা যেতে হবে। গায়ত্রী খবরটা শুনেও মনেমনে বলে,সন্ধ্যায় নিশ্চিত ও আসবেই।
              ম্যানেজারের ছেলের বিয়ে। বিয়েতে জমকালো কিছু  করতেই হবে। সাদরি মেয়েদের নাচের ট্রুপ এসেছে । ঝুরানি নাচ, একতার নাচ,মাছ ধরার নাচ সর্বপোরি জোৎস্না রাতের সেই মায়াবী ভালোবাসার নাচ। সঙ্গতে সেই লম্বা লম্বা কাল বাঁশি, ঢোল, ,ফ্লুট যোগে নাচ। সারা মহল্লায় সাড়া পরে যায়। ম্যানেজারের ছেলে মোনজিৎ মন জয় করতে বন্ধুদের আকন্ঠ দারু খেয়েছে ও খাইয়েছে। গায়ত্রী কনের সাজে বসে আছে,মনে মনে আশঙ্কা, দেবেশ এখনো কেন এলোনা।  কনেকে পিঁড়িতে করে বিয়ের আসরে নিয়ে  আসা হলো তবু  দেবেশের দেখা  নেই। বর মালা বদল করার জন্য দাঁড়াতে গেলে টলে পড়ে যায়।  গায়ত্রী সাহস করে বলে উঠে ওই মদমাতাল ছেলেকে বিয়ে  করবো না।  মা ও বলে এই বাজে ছেলের সঙ্গে  আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা। হৈচৈ বেঁধে যায়। বিয়ে বন্ধ ।
          গায়ত্রীর যে বিয়ে হল না এই খবরটা দেবেশ জানে কিনা তাও জানা গেল না। আবার বিয়ের ব্যবস্থা করতে গেলে গায়ত্রী জেদ করে বলে “বিয়ে করবে না।“ গায়ত্রীর মা স্বর্গবাসী হল। গায়ত্রী নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়ে মানুষের সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেবে। সময়ই সব দুঃখ কষ্টকে খেয়ে নেয়। কিছু  কষ্টের দাগ ছুরিকাঘাতের দাগের মতোই থেকে যায়। গায়ত্রীর মন থেকে দেবেশ মুছে যায়নি। প্রথম এবং শেষ প্রেম।
          বিলাসপুরের আমব্দেকার  মেমোরিয়ল হাসপাতালের নার্স গায়ত্রী। বাবাকে নিয়ে কোয়ার্টারেই থাকে। রবিবার রাতে  অ্যক্সিডেন্টে গুরুতর আহত  এক রুগি ভর্তি  হয়েছে। মাথায় সেলাই করে রক্ত বন্ধ করা গেছে,কিন্ত রোগি চোখে দেখতে পাচ্ছেনা। ডাক্তার চৌরাশিয়া বলেন,দৃষ্টি শক্তি হারানো, বিরল ঘটনা। বৃহস্পতিবারে ডিউটিতে গিয়ে শোনে সেই রুগিকে বাইশ নম্বরে আনা হয়েছে। রুগিকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। দেবেশ। দেবেশ এখানে কি করে আসলো। গায়ত্রী কোনো কথা না বলে রুগিকে পরম মমতায় শুশ্রূষা করে। সেবা আশ্রমের ম্যানেজার এসে বলে, উনার নাম ডাক্তার দেবেশ রায়। গত দশ বছর ধরে  আমাদের সেবা কেন্দ্রের ডাক্তার।ওনার দুকুলে কেউ নেই। রুগীই ওর আপন জন। উনি ডাক্তারি না করতে পারলে বাঁচবেন কি করে।
            গায়ত্রী অসতর্ক  মুহূর্তে কথা বলে ফেলে। দেবেশ কন্ঠস্বর শুনেই বলে গায়ত্রী কেমন আছো। এ জীবনে তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। সেদিন যেতে পারেনি। তুমি সুখে সংসার করো। গায়ত্রী বিয়ের দিনের সব ঘটনা বলে। দেবেশদা আমি  তোমাকে  ছাড়া কারও সঙ্গে ঘর বাঁধবোনা। আমি আমার একটা চোখ তোমাকে দেবো। দেবেশ বলে পাগলামি করোনা।  গায়ত্রী বাবাকে বলে দেবেশেকে ও ওর একটা  চোখ  দেবে। আগামী  রবিবার  দিন অপারেশন হবে। রবিবার  ভোরবেলায় দেখা যায় পরেশবাবু গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। বুকে বড়ো অক্ষরে লেখা, “আমার চোখ দুটো  দেবেশকে দিয়ে অমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।“

Friday, June 10, 2022

ছোট গল্প - হানাবাড়ি || লেখক - সন্দীপ কুমার পণ্ডা || Short story - Hanabari || Written by Sandip Kumar Panda


 

     হানাবাড়ি

                সন্দীপ কুমার পণ্ডা




                 আমি ভূতে মোটেই বিশ্বাস করি না ভূত হল মানুষের মনের দুর্বলতার স্বরূপ মাত্র যা আমরা কল্পনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলি।মানুষ যেখানে ভূতও সেখানে , যেখানে মানুষ নেই সেখানে ভূতও নেই এটাই আমার আদর্শ। অনেক বন্ধু -বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় ভূতের প্রসঙ্গে কথা হলে আমি বিপক্ষে সোয়াল করি সেজন্য আমাকে অনেকে 'ভূতনাস্তিক ' বলেও বাঁকে। আমি বহু পোড়ো বাড়ি,শ্মশানে ঘুরে বেরিয়েছি তবে ভূত দেখবার জন্য নয় ভূত দেখাবার জন্য মানে আমার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে 'ভূতান্বেষী' নামে যেখানে রাত ১২টায় কিম্বা ১টায়  আমি পোড়ো বাড়িতে ,শ্মশানে গিয়ে মানুষকে ভূত দেখাই তবে সত্যি কারের নয় আমার চ্যানেলে একটি মেয়ে আছে কোকড়ানো চুলওয়ালা ওকে সাজিয়ে বা অন্য সময় অন্য কাওকে সাজিয়ে দর্শকদের ভূত দর্শন করাই।তাহলে বোঝাই যায় আমি নিজেই একটা আস্ত ভূত।
বেশ ভালো চলে চ্যানেলটি অল্প রোজকারও হয়।এমনি করে দিন চলে যায় একদিন খবর পেলাম বাবুইপুরে একখানা পুরোনো বাড়ি আছে যেখানে নাকি ভূত আছে বলে এলাকার লোক। আমি গেলাম বারুইপুরে তবে ভূত দেখার জন্য নয় এখানে ভূতের ভিডিও করলে কেমন হয় সেজন্য গিয়েছিলাম। দেখলাম বেশ মনের মতো বাড়িখানা  একদিকটা ভেঙ্গে পড়েছে,সিড়িতে শেওলা জমেছে ঝুল তো আছেয়। বাড়ির পিছনে মোটা মোটা আমি জাম তেঁতুলের বাগান অন্ধকারছন্ন করে তুলেছে।মনে মনে খুব পছন্দ হল বাড়িখানা ঠিক করলাম সামনের অমাবস্যা পড়েছে ২৮ তারিখ সেইদিনই এখানে সুটিং করব।


                       বিকেলে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারুইপুরের দিকে। সন্ধের সময় পোঁছে গেলাম বারুইপুরের বাড়িতে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই বুকটা কেঁপে উঠলো মনে হলো সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সবাইকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিলাম আর পাপিয়াকে মেকাপের জন্য তৈরি হতে বললাম।মেকাপের পর ওকে বাড়ির একটা ঘরে বসে থাকতে বললাম ওকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম কীরকম আজকে সুটিং করব,ওর কীরকম অংশগ্ৰহন করবে?তাও আর একবার বুঝিয়ে দিলাম। নকল রক্ত,হাঁড় ও মানুষের খুলি আগেই তৈরি ছিল। আকাশ বেশ অন্ধকার চারপাশ ছমছমে  ভাব আর আমার মনে কেমন একটা অসস্তিকর অবস্থা অন্য কোথাও শুটিং এর সময় এমন অসস্তি বোধ করিনি। মনের চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লাম। সবাইকে ডেকে বললাম "প্রথমে বাড়ির চারপাশ দেখিয়ে ঘরে ঢ়ুকব সেখানে পাপিয়া আছে সে সেখানে ভূতুড়ে কান্না কাঁদবে আর আমাদের দেখে বাগানের দিকে ছুঁটে পালাবে"। তার একটু বাদে তখন ঘড়ির  কাঁটায় ১২টা তখন শুরু হল লাইভ ।ক্যামেরায় আছে রাজু , কথাবার্তায় দীপ, বিভিন্ন শব্দ কৌশলে রেখেছি সমু‌কে কৃত্রিম রঙ্গিন আলো ও ধোঁয়ার জন্য আছে সায়ন , সবাই কাজ করছে। ক্যামেরায় প্রথমে  বাড়িটার চারপাশটা দেখিয়ে তখন সিড়ি দিয়ে ঢ়ুকছি তক্ষুনি কতগুলো চামচিকা শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এলো আমি তো অবাক হয়ে গেলাম  চামচিকের কোনো অস্তিত্ব ছিল না হয়তো দিনের বেলার জন্যই ছিল না কিংবা দেখতে পাইনি কিন্তু  দিনের বেলাতেও চামচিকে দেখা যায় অন্ধকার ঘরে।এরপর যখন বাড়িতে ঢ়ুকতে যাচ্ছি ঝমঝমে ভাবটা মনে হলো বেড়ে গেছে আর কেন জানি না মনটাও সায় দিচ্ছল না এই ভুতুড়ে বাড়িতে থাকতে। যেহেতু সবাই ঠিকঠাক নিজ দায়িত্ব পালন করছিল সেজন্য আমার আর কিছুই করার ছিল না কেবল মাত্র দেখে যাওয়া ছাড়া।তারপর যে ঘরে পাপিয়া আছে সে ঘরে আমাদের নিজস্ব কৃত্রিম আলো,রং, হাঁড়, রক্ত দিয়ে সজ্জিত ঘর খানা ও দূর থেকে পাপিয়ার নাকি কান্না দেখাতে লাগলাম । পাপিয়ার অভিনয় আজ সত্যিই অবাক করার মতো অন্য দিনের চেয়ে অনেক ভালো যেন সতিই পাপিয়া ভূত হয়ে গেছে।ঝুলে ভর্তি দেওয়ালে পলেস্তার খসে পড়েছে আগাছা জন্মেছে ঘরের ভিতর আর ছাদ খসে  খসে পড়ছে।তারপর পাপিয়া বাগান দিকে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল আর আমরা বাগান দিকে ছুটলাম দর্শকদের আমারা  ভূত অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা দেখাব বলে।সবাই  সেদিকে গেল আমি আর গেলাম না। একটু বাদেই দেখি পাপিয়া ঘরের দিক থেকে ছুটে আসছে কিন্তু পাপিয়ার তো বাগানের দিকে থেকে আসা উচিত সেদিকেই পাপিয়া আর ইউনিটের সবাই গেছে আর বাড়ির পিছনে দিকে তো বাগান তাই ওকে জিজ্ঞাসা করতে ওর দিকে আমি এগিয়ে যেতেই ও হাঁপিয়ে বলতে লাগল "আমার ভুল হয়ে গেছে সচীনদা , আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে  আর কোনো দিন এমন হবে না।"
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম বলে কী মেয়ে টা।তারপর হেসে বললাম " তুই আজ অসাধারণ অভিনয় করেছিস খুব ভালো হয়েছে" ।
পাপিয়া অবাক হয়ে গিয়ে বলল "আমি তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম  এই বাড়িতে  তুমি যখন আমাকে রেখে এলে, বুঝতে পারিনি কিন্তু হঠাৎ চোখ লেগে গেল।"

আমি তো বিস্ময়ে , ভয়ে ,অবাকে  হতবুদ্ধি হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম আর শুনতে পেলাম কেও যেন আমার কানে বলছে " আমরা আছি......আমরা আছি....আমরা আছি...... আমরা চিরন্তন সত্য...... আমরা বাস্তব"।

Thursday, June 9, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -5


 


পাঁচ


ঋজুর ছেলে বাবি ক্লাস ফোরে পড়ে। নবনালন্দা স্কুলে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে সে যাতে খুব সহজেই ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে পারে, সে জন্য কাকে না ধরেছে ঋজু? রমাপদ চৌধুরী থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শেষে নীরেনবাবুর জামাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এ ডি এম আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্যন্ত। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টা করবেন। তবে ওখানে ভর্তির জন্য মিশনের উল্টো দিকে যে সব কোচিং সেন্টার আছে, সে রকম কোনও কোচিং সেন্টারে ছেলেকে ভর্তি করে দিতে বলেছিলেন তিনি। তিনিই দিয়ে দিয়েছিলেন এক মাস্টারের খোঁজ। ইনি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনেরই শিক্ষক। থাকেন মিশনের মেন গেটের উল্টো দিকে। বাড়িতেই কোচিং করান।
গত দু’বছর ধরে ঋজু ওর ছেলেকে প্রত্যেক রবিবার এখানে নিয়ে আসে। এখানে যারা পড়ে, তাদের বেশির ভাগ ছাত্রই নাকি মিশনে চান্স পায়। তাই দক্ষিণাও কিঞ্চিত বেশি। যে মাসে চারটে রবিবার সে মাসে দিতে হয় আটশো টাকা। আর যে মাসে পাঁচটা রবিবার, সে মাসে হাজার টাকা। মানে ক্লাস পিছু দুশো টাকা। সকাল সাতটা থেকে ক্লাস। সাড়ে ন’টার সময় মিনিট পনেরোর জন্য বিরতি। সে সময় বাইরে অপেক্ষা করা বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের মুখে ঠেসেঠুসে খাবার ঢুকিয়ে দেন। তার পর আবার ক্লাস। চলে এগারোটা, সাড়ে এগারোটা আবার কোনও কোনও দিন বারোটা অবধি।
তা, এত দিন এই শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের কী শিখিয়েছেন, আজ তার চূড়ান্ত পরীক্ষা। মিশনে সিট মাত্র ষাটটা। তিরিশটা বাংলা মাধ্যমের। তিরিশটা ইংরাজি মিডিয়ামের। অথচ পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় হাজার সাতেক ছাত্র।
শুধু ঋজু নয়, ছেলের পরীক্ষা, তাই ওর বউ ভারতীও সঙ্গে এসেছে। বাবি পরীক্ষা দিতে ঢুকে যেতেই ভারতীকে ‘একটু আসছি’ বলে ঋজু মিশন চত্বর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। আজ রবিবার। ছুটির দিনে কণিকা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। এতক্ষণে মনে হয় ও উঠে গেছে। না উঠলেও, ফোন করলে নিশ্চয়ই উঠে যাবে। ওকে বলে দেওয়া দরকার, বাবি পরীক্ষার হলে ঢুকে গেছে।
ফর্ম ফিল-আপের সময় নানান খুঁটিনাটি তথ্যের সঙ্গে, যদি থাকে, একটা মোবাইল নম্বর দিতে বলেছিল ওরা। ঋজুর নিজের কোনও মোবাইল নেই দেখে কণিকার নম্বরটাই দিয়েছে। ওকে না জানালে হয়!
বুথ থেকে ফোন করতেই ওর মেয়ে ধরল। ছোট বাবি না বড় বাবি ও বুঝতে পারল না। সামনাসামনি দেখলেও প্রথম প্রথম ও বুঝতে পারত না, কোনটা ছোট আর কোনটা বড়। দু’জনেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। লোকে বলে, ছোটবেলায় যতই একই রকম দেখতে থাকুক না কেন, যমজ বাচ্চারা যত বড় হয়, ততই নাকি তাদের মধ্যে পার্থক্য ফুটে উঠতে থাকে। কিন্তু ছোট বাবি আর বড় বাবির মধ্যে ও কোনও পার্থক্যই খুঁজে পেত না। তখন কণিকাই এক দিন বলে দিয়েছিল, যার চুল বফ বফ করে কাটা, সে ছোট। কিন্তু ফোনে গলার স্বর শুনে ঋজু বুঝবে কী করে, বফ বফ চুল ধরেছে না লম্বা চুল! ও বলল, মা উঠেছে?
— কখন...
— মাকে দাও।
— মা তো নেই আঙ্কেল।
— কোথায় গেছে?
— বেলুড়ে।
— বেলুড়ে?
— হ্যাঁ। কাল রাতে দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। ফোন পেয়ে মা কাল রাতেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অত রাতে তো গাড়িটারি কিছু পাবে না। তাই যায়নি। আজ সক্কালবেলায় উঠেই মা চলে গেছে।
— কখন আসবে কিছু বলেছে?
— কই, না তো।
ফোনটা কেটেই ফের টপাটপ বোতাম টিপল ওর মোবাইলের। আবার মেয়ের গলা— হ্যালো?
— মা মোবাইল নিয়ে যায়নি?
— না গো। এই তো ড্রেসিং টেবিলের ওপরে পড়ে আছে দেখছি। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেছে তো, হয়তো নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।
— একা গেছে?
— হ্যাঁ।
— একটু দরকার ছিল... দাদুর বাড়ির নম্বরটা দেবে?
— দাদুর বাড়ির নম্বর! একটুখানি কী যেন ভাবল মনে হয়, তার পরে বলল, দাদুর বাড়িতে তো ফোন নেই।
— দাদুর বাড়িতে ফোন নেই! খুব অবাক হল ঋজু। কই, কাল অত রাতে যখন কথা হল, তখনও তো ও কিছু বলল না! এমনিতে রবিবার রবিবার মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন না। চলে যান ক্লাইভ হাউস। সেখানে ওঁর একটা ফ্ল্যাট আছে। ওঁর মানে, ওঁর কেনা নয়। ওঁর কোন এক ছাত্রের ফ্ল্যাট। ফাঁকা পড়ে ছিল। উনি সেটা নিয়েছিলেন। যে ক’মাস থাকবেন, সে ক’মাসের ভাড়াও দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, উনি নাকি কোনও দিন এক পয়সাও দেননি। বহু দিন হয়ে গেছে ফ্ল্যাটটা আটকে রেখে দিয়েছেন। যার ফ্ল্যাট সেই ছাত্রটা ফোন করলে, উনি এখন তার ফোনটাও ধরেন না। সেই ফ্ল্যাটে উনি মাঝে মাঝে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। যারা পি এইচ ডি বা ডক্টরেট করছে, তাদের গাইড করেন। তাই রবিবার হলেই কণিকার বাড়ি চলে যায় ঋজু। ওখানেই খাওয়াদাওয়া করে। সারা দিন থাকে। কণিকার লেখা কবিতাগুলি ঠিকঠাক করে দেয়। কী করলে গল্পটা আরও ভাল হবে, কী ধরনের বিষয় নিয়ে লিখলে লোকে নেবে, বুঝিয়ে দেয়। কখনও সখনও নিজেও লিখে দেয়। নিজে যেখানে যেখানে লেখা পাঠায়, তার সঙ্গে ওর লেখাও দিয়ে দেয়।
কিন্তু এগুলি সবই হয় বিকেলের পরে। তার আগে খাওয়াদাওয়া। ঘুম। দু’মেয়ে চলে যায় পাশের ঘরে। বড় ঘরে ওরা দু’জন। যাওয়ার সময় মেয়েরাই দরজা টেনে দিয়ে যায়। কচিৎ-কদাচিৎ যখন মহাদেববাবু বাড়ি থাকেন, ডাইনিং টেবিলে বইপত্র ছড়িয়ে এ ঘরের দিকে পিঠ দিয়ে লেখালিখি করেন, তখনও এ ঘরে ওদের মা আর ঋজু থাকলে, ওরা দু’বোন ও ঘরে পড়তে যাবার সময় ফালতু ফালতু কারেন্ট পুড়ছে বলে, এ ঘরের লাইট নিবিয়ে টান-টান করে পর্দা টেনে দিয়ে যায়।
বিকেল বা সন্ধের দিকে ঋজু কফি খেতে চাইলে অনেক সময় কণিকাই কোনও মেয়েকে ডেকে বলে, মহাদেববাবুকে বল তো একটু কফি বানাতে।
ঋজু এ ঘর থেকেই শুনতে পায়, ওরা তাদের বাবাকে বলছে, এই যে মহাদেববাবু, মা আপনাকে কফি করতে বলছে, শুনতে পেয়েছেন তো? পরে আবার বলবেন না, শুনতে পাইনি।
ও বহু ফ্যামিলি দেখেছে, কিন্তু এ রকম ফ্যামিলি এর আগে ও কখনও দেখেনি।
ওনার সঙ্গে তোমাদের এ রকম সম্পর্ক কেন? একদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছিল ও। তখন কণিকা অনেক কথা বলেছিল। তার মধ্যে যেমন ছিল, মহাদেববাবু কোনও পে রোলে নেই। উনি কোনও স্টাফ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রোজেক্টে কাজ করেন মাত্র। সামান্য মাইনে পান। তাও ঠিক মতো নয়। মিথ্যে কথা বলে উনি ওকে বিয়ে করেছেন। এক বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার দায়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। এক সময় খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় ভাষা পরিষদের স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যে দিন দুই মেয়ে জন্মাল, সে দিন হাসপাতাল থেকে ওষুধের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে যাবার নাম করে বেরিয়ে, সেই যে উনি উধাও হন, টানা তিন বছর তাঁর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। এখনও বাজার করতে হলে তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন তিনি। এই যে তার অফিসের ফ্ল্যাট উনি ভোগ করছেন, লাইট জ্বালাচ্ছেন, ফ্যানের হাওয়া খাচ্ছেন, যখন তখন ফোন করছেন, তার জন্যও কোনও দিন একটা পয়সাও তিনি দেন না। তাই নাকি ও মেয়েদের স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছে, ওর অবর্তমানে, টিউশুনি নিতে যাবার সময় ওরা যদি দেখে, বাড়িতে উনি আছেন, তা হলে যেন ফোনটা লক করে দিয়ে যায়। মেয়েদের যাবতীয় খরচখরচা নাকি কণিকাই চালায়।
ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রচুর কষ্ট দেখেছে ওরা। বাবার সঙ্গে তাদের মায়ের কী সম্পর্ক, ওরা তা জানে। তাই অন্য কারও সঙ্গে মাকে খুশিতে থাকতে দেখলে, ওরা তা হাসি মুখেই মেনে নেয়।
কিন্তু তা বলে এতটা! সে দিন যখন পিঠের নীচে দু’-তিনটে বালিশ দিয়ে খাটের ওপর আধ শোয়া অবস্থায় চায়ে চুমুক দিচ্ছিল ঋজু, তখন বড় বাবি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চোখ নাচিয়ে বলেছিল, আঙ্কেল আজ ক’বার হল?
ও কী বলতে চাইছে, বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখে আঙুল দেখিয়ে ও বলছিল, এক বার।
— উহু। মিথ্যে কথা। দু’বার। পাশের ঘর থেকে আমি শুনেছি।
— ধ্যাৎ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না ঋজুর কাছে।

আলাপের কয়েক দিনের মধ্যে কণিকা বলে দিয়েছিল, আমাকে পেতে গেলে কিন্তু আগে আমার মেয়েদের মন জয় করতে হবে। ঋজু তাই-ই করেছিল। ফোন করলে আগে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। তার পরে কণিকার সঙ্গে। প্রথম যে দিন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, সে দিন প্রচণ্ড গরম। ওদের জন্য ক্যাডবেরি আর দু’লিটারের একটা থামস আপ-এর বোতল নিয়ে গিয়েছিল ও। ছোট জন ওটা দেখে বলেছিল, অন্য কোনও রঙের পেলেন না!
তার পর থেকে ওদের জন্য ও আর কোনও দিনই ওই রঙের সফ্‌ট ড্রিংস নিয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে এ ফল ও ফল নিয়ে গেলেও ভুল করেও কখনও কালোজাম বা কালো আঙুর নিয়ে যায়নি।
দ্বিতীয় দিন যখন ওদের বাড়ি গিয়েছিল, চা দিতে এসে ছোট বাবি ওর সামনেই দুম করে ওর মাকে বলেছিল, মা, আমি কিন্তু তোমার কাছে তিনশো টাকা পাই। মনে আছে? কাল কিন্তু দিয়ে দিও।
চায়ের প্লেট বিছানার পাশে রেখে সঙ্গে সঙ্গে পার্স থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বার করে ছোট বাবির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল ও। মেয়ে যখন কিছুতেই নিতে চাইছে না, ও তখন বলেছিল, এটা তোমার মায়েরই টাকা। আমার কাছে রাখা ছিল। নাও, নাও। যদি না নাও, তা হলে ভাবব, তোমরা আমাকে নিজের লোক মনে করো না।
কণিকাও বলেছিল, নে না। এত করে বলছে। একই তো। আঙ্কেল কি বাইরের লোক নাকি?
ধীরে ধীরে ঘরেরই লোক হয়ে উঠেছিল ও। যে সপ্তাহে রাত আটটা থেকে ডিউটি থাকত, ও কণিকাকে অফিস থেকে নিয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিত। খানিকক্ষণ কাটাত। তার পর অফিসে যেত। যে দিন কণিকা বলত, আজকে একটু তেরো নম্বরে নামব। ঋজু বুঝে যেত, ও আজ বাজার করবে। মাছ মাংস সবজি যা কিনত, ঋজু দাম দিয়ে দিত। প্রথম প্রথম কণিকা মৃদু আপত্তি করত ঠিকই, পরের দিকে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার দোকানদাররা পর্যন্ত ঋজুকে চিনে গিয়েছিল।

সব ঠিকই আছে। কিন্তু ও হঠাত্‌ বেলুড়ে গেল কেন! আর গেলই যদি, ফোনটা নিয়ে গেল না কেন! কাল রাতে ও যখন অফিস থেকে বেরোয়, তখনও কণিকার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। ‘কাল দুপুরে যাচ্ছি’ বলাতে কণিকা ওকে বলেছিল, এটা কোরো না গো। কাল তো তোমার ছেলের পরীক্ষা। তুমি তো বাবা। তোমার থাকা দরকার। একদম পাগলামো কোরো না। আমি তো আছিই। কোত্থাও যাব না। দরকার হলে ফোন করে নিও।
শেষ কথাটার মধ্যে, ঋজু যে ওকে সন্দেহ করে, সেই সন্দেহটা দূর করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রলেপ দেখতে পেয়েছিল ঋজু। তাই আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এটা কী হল! কোনও ফোন নেই, কিচ্ছু নেই, দুম করে চলে গেল! ওর বাবা কি কাল রাতে সত্যিই ফোন করেছিল! কখন!

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দোলের দিন ওরা রিনাদের বাড়ি যাবে। সেই মতো সকাল সাতটার মধ্যে ভারতীয় বিদ্যাভবনের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল ঋজু। কণিকা রেডিই ছিল। চার তলার জানালা দিয়ে ওকে দেখেই মিনিট কয়েকের মধ্যে নেমে এসেছিল। এমনি দিনেই অত দূরে সরাসরি কোনও অটো পাওয়া যায় না। তার ওপর সে দিন আবার দোল। অগত্যা একটা অটো রিজার্ভ করে ওরা রওনা হয়ে গেল সল্টলেক সেক্টর ফাইভ ছাড়িয়ে সোজা মহিষবাথানের দিকে। আগে নাকি গোয়ালারা ওখানে মহিষদের স্নান করাতে নিয়ে যেত। তার থেকেই এই নাম। ২৩৯/এ বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে অটোচালক বলল, ব্যাস। এ বার আপনাদের একটু হেঁটে যেতে হবে।
ওরা হাঁটা দিয়েছিল। এখানে পর পর অনেকগুলি ভেড়ি। টলটল করছে জল। হুহু করে হাওয়া বইছে। কণিকার শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। রিনাদের ‘আমরা এসে গেছি’ জানিয়ে দেবার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বার করেও ফোন না করে, ফোনটা টেপাটেপি করতে লাগল কণিকা।
ঋজু বলল, কী হল?
— বাইশখানা মিসড কল। আমরা কথার মধ্যে এত বিভোর হয়ে ছিলাম, শুনতেই পাইনি।
— একেই বলে প্রেম। কার নম্বর দেখো।
— কে জানে! চেনা নম্বর না। কয়েকটা নম্বর আবার বুথের। এত সকালে বুথ থেকে কে করল!
— কী করে বুঝলে বুথ থেকে?
— আট দেখে।
তখনই আবার ফোন। ঋজু বলল, ধরো। যে করেছিল, সে-ই হয়তো আবার করেছে।
ফোনটা অন করে কণিকা খুব নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল। একদম পাশে পাশেই হাঁটছিল ঋজু। কিন্তু ও যে কী বলছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না সে। ফোন ছাড়তেই ও জিজ্ঞেস করল, কে?
কণিকা বলল, ছোটকু।
— ছোটকুটা আবার কে?
— লোপার।
— লোফার?
— আরে বাবা, লোফার না। লোপার, লোপার। আমাদের অফিসে লোপা আছে না, ওর সঙ্গে ওর।
— ও-ও প্রেম করে?
— না। তুমি শুধু একাই করো। এই জানো কী হয়েছে, সে দিন ওর শাশুড়িকে অফিস যাচ্ছি বলে বেরিয়ে ছোটকুর সঙ্গে ও গড়চুমুক গিয়েছিল। ওহ্‌, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি, ওর কথা বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল। এর মধ্যে একটা কাণ্ড হয়েছে। লোপা তো ওর বরের সঙ্গে রোজ মর্নিং ওয়াক করতে যায়। এই ক’দিন আগে ও রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে ওর দুদু টিপে দে ছুট।
— সে কী? ওর বর ছিল না সঙ্গে?
— না। ওর বর একটু এগিয়ে গিয়েছিল।
— কথা বলতে বলতে রিনাদের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল ওরা। আবার ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ঋজু বলল, তোমার ফোন বাজছে।
কণিকা বলল, বাজুক, ধরলেই বকবক করতে হবে।

ঋজু আবিরের একটা প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিল। ওটা খোলাই হল না। খোলা হল মদের বোতল। চিপসের প্যাকেট। রিনা আর আশিসের সঙ্গে পরামর্শ করে কণিকা নাকি গত কালই এগুলি কিনে রেখেছিল। ঋজুকে চমকে দেওয়ার জন্য।
গ্লাসে ঢালামাত্র ঢগঢগ করে খেয়ে নিল আশিস। রিনাও তাই। ওদের দেখাদেখি কণিকাও এক চুমুকে শেষ করে দিল গ্লাস।
ঋজুর মনে পড়ে গেল রাধানাথ মন্ডলের কথা। ওর একটা প্রকাশনা সংস্থা ছিল— সংবাদ। ও লোককে বলত, এটা একটা শিক্ষিত প্রকাশন সংস্থা। যেন বাকি প্রকাশকেরা সব মুখ্যু। পরে সেটা সমর নাগ কিনে নেন। এখন তো তাঁর বিশাল ব্যাপার। বেঙ্গল শেল্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে ফেলেছেন। কলেজ স্ট্রিট মার্কেট ভেঙে নতুন ভাবে বানাচ্ছেন।
সেই সংবাদ থেকে গল্পপত্র নামে একটি পত্রিকা বের হত। অনেক তরুণ লেখকেরা সেখানে আসতেন। আসতেন নবকুমার বসু, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, অমর মিত্র। কে নয়? আড্ডা হত। মাঝে মাঝেই মদের আসর বসত। সেই সংবাদে কাজের জন্য একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। রাধানাথ তাকে চাকরি দেয়নি। কিন্তু একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেবে বলে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ দিকে ও দিকে কাটাত।
রাধানাথ চাকরি করত। ফলে সংবাদে সময় দিতে পারত না। একটা ছেলে রেখেছিল। সে-ই দোকান খুলত। দেখাশোনা করত। হিসেবপত্র রাখত। একদিন সেই মেয়েটির সামনেই রাধানাথ তাকে বলল, আমি থাকি না-থাকি, ও যখন আসবে, যা টাকা-পয়সা চাইবে, ক্যাশ থেকে দিয়ে দিবি, কেমন?
ছেলেটি অবাক। তার মাইনেটা পর্যন্ত যে ঠিক সময়ে দেয় না, চাইলে, আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে সারা মাস ধরে কিছু কিছু করে দেয়, সে বলছে এই কথা! না। বেশিক্ষণ ধন্ধে থাকতে হয়নি তাকে। খানিকক্ষণ পরেই, ওই মেয়েটিকে বাসে তুলে দিয়ে এসে রাধানাথ বলল— ওর সামনে তোকে যে কথাটা বললাম, সেটাকে আবার সত্যি ভেবে নিস না।
ছেলেটি বলল, তা হলে? উনি যদি বলেন, তোমার সামনেই তো উনি সে দিন বলে গেছেন, তখন?
— বলে দিবি, আজ খুব খারাপ অবস্থা। কোনও বিক্রিবাট্টা হয়নি। ক্যাশে টাকা নেই, ব্যাস।
সেই মেয়েটি আবার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করত। দু’-এক বার তাকে নিয়েও সংবাদে এসেছিল সে। এক বার এমন দিনে এল, সে দিন ও রকমই এক মদের আসর বসেছিল। গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢালার সময় রাধানাথ ওই ছেলেটিকে বলেছিল, চলবে নাকি?
ছেলেটি মাথা কাত করেছিল। তাকে গ্লাস দিতেই, সে এক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে দিয়েছিল। তখন ওই মেয়েটি বলেছিল, দেখলেন তো, একেবারে চোস্ত্‌।
রাধানাথ বলেছিল, ও কোনও দিন মদ খায়নি।
— কী করে বুঝলেন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল।
রাধানাথ বলেছিল, যারা মদ খায়, তারা কখনও এ ভাবে খায় না। তারিয়ে তারিয়ে, রেলিশ করে খায়। চোখ দিয়ে ছেলেটিকে দেখিয়ে বলেছিল, গ্লাসে ওর চুমুক দেওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি, এ ব্যাপারে ও একেবারেই নবীশ।

এখন আশিস, রিনা আর কণিকার মদ খাওয়া দেখে ঋজুরও মনে হল, এর আগে এরা কখনও মদ খায়নি। এই প্রথম খাচ্ছে। যখন মদ খাওয়া চলছে, আবার ফোন বেজে উঠল কণিকার। তার পর আবার। আবার। দু’মিনিট ছাড়া ছাড়া ফোন। অথচ প্রতি বারই স্কিনে নম্বর দেখেই ও আর ফোনটা ধরছে না। একটু নেশা-নেশা মতো হয়ে গিয়েছিল সবারই। ঋজু হঠাত্‌ জানতে চাইল, কার ফোন? ধরছ না কেন? দেখি নম্বরটা? ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিল ঋজু। কিন্তু তার আগেই ঝট করে ফোনটা তুলে নিল কণিকা। ঋজুও ছাড়বার পাত্র নয়। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার পরে ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জোর জবরদস্তি। শেষে কণিকা বলল, দিতে পারি, কিন্তু তার আগে কথা দাও, ফোনটা তুমি ধরবে না।
ফোনটা নিয়ে ঋজু দেখল, একটা নম্বর থেকেই বারবার ফোন আসছে। যখন দেখছে, ঠিক তখনই আবার বেজে উঠল সেটা। অথচ কণিকাকে কথা দিয়েছে দেখে ও ফোনটা ধরল না। কণিকার কাছে দিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পরে নেশাটা একটু চড়তেই ও বলেছিল, যে ফোন করছে, তাকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো। কে করছে বলো? তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
বারবার জেরায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল কণিকা। কোনও রকমে উঠে, ঋজুর হাত ধরে টানতে টানতে ঝুল বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ও আর তুমি একই সঙ্গে আমার জীবনে এসেছ।
— তার মানে?
— ও আমাদের অফিসেই কাজ করে।
— কী নাম?
— এ কে পাল, অরুণকুমার পাল।
— কোথায় থাকে?
— কাঁচরাপাড়ায়।
— তুমি তো আমাকে এ সব কথা কখনও বলোনি।
— বহু বার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি।
— ঠিক আছে। এখন তো বলেছ। এ বার আমি বলি? তুমি আমাদের মধ্যে থেকে যে কোনও একজনকে বেছে নাও। একসঙ্গে দু’জনকে নিয়ে খেলা কোরো না।
কণিকা বলেছিল, আমাকে একটু ভাববার সময় দাও। কথাটা শুনে এক ঝটকায় নেশাটা কেটে গিয়েছিল ঋজুর। তখনই ও বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু আশিস আর রিনা ওকে আটকায়। কণিকাও এমন ভাবে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় যে, পুরো পরিবেশটাই পাল্টে যায়।
সে দিন রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি ঋজু। কী বলতে কী বলে ফেলবে, কিংবা কথা বলতে বলতে যদি কথা জড়িয়ে যায়, সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে, কারণ ও তো মদ-টদ খায় না। ওর বউ আবার কী ভাববে, হয়তো ভাববে এই বয়সে আবার কার পাল্লায় পড়ল! তাই আশিসই ফোন করে ভারতীকে জানিয়ে দিয়েছিল, আজকে একটু উল্টোপাল্টা খাওয়া হয়েছে তো,,, ও দু’-তিন বার বমিটমি করেছে। একটু কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে, না-হলে কথা বলিয়ে দিতাম। আজ তো দোলের জন্য গাড়িটারিও কম। এত রাতে ওকে একলা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছি না। আজকের রাতটা এখানে থাক। আমার মনে হয়, একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালে ওকে পাঠিয়ে দেব। আপনি আবার চিন্তা করবেন, তাই ফোন করলাম।
কণিকাও ফোন করল বাড়িতে। মেয়েকে বলে দিল, মহাদেববাবু যদি জিজ্ঞেস করে আমি কোথায়, তা হলে বলবি, আমি রিনাদের বাড়িতে আছি। রাতে এখানেই থাকব। কাল সকালে ফিরব। আর আঙ্কেল ফোন করলে বলবি, দাদু ফোন করেছিল। দিদুনের শরীর খুব খারাপ। মা বেলুড়ে গেছে। মোবাইলটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।

ঝট করে শক খেল ঋজু। ভুলে গেল, ছেলে এখন পরীক্ষা দিচ্ছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। ভুলে গেল, বউকে একটা গাছের তলায় বসিয়ে, ও বলে এসেছে ‘তুমি এখানে থাকো, আমি একটু আসছি’। একটু মানে কতক্ষণ? ওর মাথা আর কাজ করছে না। ওর মনে হল, ও যা শুনল, সেটা আসলে সে দিনের সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। তার মানে, কণিকা যা শিখিয়ে দেয়, ওর মেয়েরা তাই বলে। তা হলে কি ও আজ অন্য কারও সঙ্গে আছে! কিন্তু কার সঙ্গে! সে দিন যে নম্বর থেকে ঘনঘন ফোন আসছিল, তাঁর সঙ্গে কি? সেই নম্বরটা ওর মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। ও চটপট সেই নম্বরে ফোন করল— কণিকা আছে?
— এটা তো কণিকার নম্বর নয়। কে বলছেন? ও প্রান্ত থেকে এক গুরুগম্ভীর পুরুষ-কণ্ঠ।
ও বলল, আমি, আমি ঋজু। কণিকার বন্ধু।
— এই নম্বরটা পেলেন কোত্থেকে?
— না, আসলে দোলের দিন এই নম্বর থেকে ওর মোবাইলে বারবার ফোন আসছিল তো, তাই এই নম্বরে করলাম।
— দোলের দিন? আপনি জানলেন কী করে?
— আমি ওর সঙ্গে ছিলাম।
— ও, আপনি সে দিন ওর সঙ্গে বেলুড়ে গিয়েছিলেন?
— বেলুড়ে নয়। অন্য জায়গায়। ও আমার বিশেষ বন্ধু।
— বিশেষ বন্ধু মানে? একদম বাজে কথা বলবেন না। ও সে দিন বেলুড়ে গিয়েছিল। ওর মা ভীষণ অসুস্থ। ও এত টেনশনে ছিল যে মোবাইলটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। টিনা-মিনা আমাকে বলেছে।
— টিনা-মিনা! ঋজু ওর ভাই-বোন, তাদের ছেলেমেয়ে, এমনকী ওর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেরই নামধাম জানে। কিন্তু ওর মুখে কোনও দিন এই নাম তো ও শোনেনি! ও বলল, কে টিনা-মিনা?
— সে কী, আপনি বলছেন ওর বন্ধু, বিশেষ বন্ধু, আর ওর মেয়েদের নামটাও জানেন না? রাখুন। যত্তসব। বলে ফোনটা কেটে দিল। ঋজু স্তম্ভিত। ওর মেয়েদের নাম টিনা-মিনা! ওদের নাম তো বড় বাবি, ছোট বাবি! আমি কি কোথাও ভুল করছি! আচ্ছা, লোকটা কেমন যেন কেটে কেটে কথা বলছিলেন, না! তা হলে কি কণিকা ওঁর সঙ্গেই আছে! লোকটা ওর ইশারা অনুযায়ী কথা বলছিলেন! হতে পারে! খানিক পরে আবার ফোন করল ওই নম্বরে।
ফোনটা ধরেই লোকটা বললেন, কী হল?
— বিশ্বাস করুন, সে দিন ও আর আমি রিনাদের বাড়িতে ছিলাম। সারা রাত আমরা দু’জন একসঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছি।
— একদম বাজে কথা বলবেন না। ও যখন চাইছে না, কেন ওকে বিরক্ত করছেন? জানেন, ওর সঙ্গে আমার চার বছরের সম্পর্ক। কোনও ছাত্র যে কোনও শিক্ষকের বউকে এই ভাবে বিরক্ত করতে পারে, তা আপনাকেই প্রথম দেখলাম।
ছাত্র! আমি তো কখনও মহাদেববাবুর ছাত্র ছিলাম না! তা হলে কি ও ওর মতো করে ওনাকে সাত-পাঁচ বুঝিয়েছে! ও বলল, বিশ্বাস করুন, আমি এতটুকুও মিথ্যে বলছি না। দরকার হলে আপনি রিনাদের বাড়িতে ফোন করে জেনে নিতে পারেন।
— ওদের নম্বর কত?
কাঁধের ঝোলা হাতড়ে ছোট্ট ডায়েরিটা বার করে রিনাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা ও দিয়ে দিল। নম্বরটা নিয়েই ফোনটা কেটে দিলেন তিনি।

রিনাদের নম্বরটা বার করাই ছিল। দোলের দিন তারা যে ওদের বাড়িতে ছিল, কেউ ফোন করে জানতে চাইলে, তাকে যাতে রিনারা সত্যি কথাটা বলে দেয়, সেটা বলার জন্যই ও ফোন করল ওদের। কিন্তু যত বারই ফোন করল, শুধু এনগেজড আর এনগেজড।
উনি যত বারই ফোন করুন না কেন, এখন তো এনগেজড, পাবেন না। পরে যেন করেন। বলার জন্য লোকটাকে ফোন করতেই তিনি ধমকে উঠল,কী ব্যাপার? এত জ্বালাচ্ছেন কেন বলুন তো? কী চাই?
— না, বলছিলাম কি, রিনাদের ফোনটা এনগেজড, এখন হয়তো পাবেন না। পরে করলে নিশ্চয়ই পাবেন। সেটা বলার জন্যই...
— ওদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওরা তো ডিনাই করল।
— ডিনাই করেছে!
কথা শেষ হবার আগেই লোকটা লাইন কেটে দিলেন। তা হলে কি এতক্ষণ ওদের সঙ্গেই উনি কথা বলছিলেন! তা হলে তো ওদের নম্বরটা এখন ফাঁকা। ও ফের রিনাদের নম্বরে ডায়াল করল। রিনাই ধরল।
ঋজু বলল, আপনাদের কেউ ফোন করেছিল নাকি?
রিনা বলল, হ্যাঁ।
— দোলের দিন আমরা যে আপনাদের বাড়িতে ছিলাম, আপনি কি সেটা অস্বীকার করেছেন?
ঢোক গিলে রিনা বলল, আসলে, আমাদের বাড়িতে আপনারা রাত কাটিয়েছেন, এটা জানাজানি হলে আমাদের সম্পর্কে লোকে কী ভাববে বলুন তো... তা ছাড়া কণিকারও মান-সম্মানের ব্যাপার আছে। যতই হোক, মেয়ে তো, ওর কথা ভেবেই...
— ও।
আর একটা কথাও বলেনি ঋজু। হাঁটতে হাঁটতে যখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ঢুকল, বুঝতে পারল, অনেকক্ষণ আগেই পরীক্ষার পাট চুকে গেছে। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুটিকতক মাত্র লোক। বাঁ দিকের বিল্ডিংয়ের চাতালে ওর বউ আর ছেলে বসে আছে। কী ভাবে যে ও বাড়ি ফিরেছে, ও-ই জানে। সারা দিন শুধু ছটফট করেছে। সন্ধের দিকে ল্যান্ড ফোনে ফোন করতেই কণিকার গলা— হ্যালো?
— কোথায় গিয়েছিলে?
এক মুহূর্ত চুপ। তার পরেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল— কে বলছ? হঠাত্‌ গলার স্বর পাল্টে গেল। মহাদেববাবুর গলা ও চেনে। এটা তার গলা। তবে কি ওর গলা শুনেই রিসিভারটা মহাদেববাবুর হাতে দিয়ে দিল কণিকা!— একটু কণিকাকে দিন না।
— কণিকা! এ কী! তুমি বউদির নাম ধরে কথা বলছ কেন?
— না মানে, দিন না ওকে...
— ও সেই সক্কালবেলায় বেলুড়ে গিয়েছিল তো, ওর মায়ের কাছে। ওর মা খুব অসুস্থ। সারা দিন খুব ধকল গেছে। এখন একটু শুয়েছে। কাল কোরো। ভাল আছ?
আর ভাল! ও আর কোনও কথা বলতে পারল না। শুধু মনে মনে বলল, বুঝেছি, সারা দিন কোন ধকল গেছে।


                                              ক্রমশ...

__________________________________________________

চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-


ষষ্ঠ পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন --

Wednesday, June 8, 2022

ছোট গল্প - আমি তো জারজ || লেখক - অষ্ট দেয়াশী || Short story - Ami to jaraj || Written by Asto deasi


 আমি তো জারজ

অষ্ট দেয়াশী




আমাদের দেশে এখন ও একটি শিশু তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হয়। এটা আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা। কেন একটি শিশু তার মায়ের পরিচয়ে বাঁচতে পারেনা। 
মীরা একটি গরীব ঘরের মেয়ে পড়াশোনা কি জানেনা। 
ছোট বেলায় বাবা মা মারা যাওয়ার জন্য সে স্কুলে ভর্তি হয়নি। জেঠা জেঠি তাকে মানুষ করেছে। সারাদিন গাধার মতো খাটুনি খাটতে হয় তাকে জেঠি তাকে একদম দেখতে পারেনা। কথায় কথায় খাওয়ার খোটা দেয়। সব মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো তাকে। কোথায় যাওয়ার জায়গা নেই যে তার। 
এদিকে গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের মীরার দিকে নজর ছিল। এদের মধ্যে মাধব নামে একটি ছেলের নজর বেশি ছিল মীরার দিকে কিন্তু মীরার আবার মানবকে খুব বিশ্বাস করতো। এই বিশ্বাস এনে দিল তার জীবনে সর্বনাশ। 
একদিন কথার ছলে মীরাকে ডেকে নিয়ে গেলো কাজ দেবে বলে। মাধব তাকে রেফ করে এবং বলে যদি কাউকে বলে তাহলে তাকে মেরে ফেলবে। তাই মীরা কাউকে সেই কথা বললো না। 
মাধব ছিল গ্রামের মোড়লের ছেলে। একদিন মীরা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। জেঠা ডাক্তার বলে মীরা মা হতে চলেছে। শুনে জেঠা জেঠির মাথায় হাত কি করবে মীরাকে বলে তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। মীরা সব কথা বলে জেঠা মীরা কে নিয়ে মোড়লের বাড়ি যায় মোড়ল কথা শুনে মীরা কে তার জেঠা কে মারে। লোক ডেকে বলে এই মেয়ে দুচরিত্রা তাই একে গ্রামে রাখা যাবেনা। গ্রামের অন্য মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে তাই গ্রাম থেকে মীরাকে তাড়িয়ে দিলো। 
মীরা কোথায় যাবে কে তাকে আশ্রয় দেবে। 
মীরা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলো সে  ট্রেনে মাথা দিতে গেলো এক বৃদ্ধা মীরা কে তাদের বস্তিতে নিয়ে গেলো। মীরা কে সে তার বোনের মেয়ের পরিচয় দিলো। 
কিছু মাস পর বস্তিতে মীরা ছেলে হলো। হঠাৎ একদিন সেই বৃদ্ধা মারা গেলো। মীরার জীবনে আবার দুঃখ নেমে এলো কী দোষ করে ছিল মীরাকে ঈশ্বর বার বার তাকে কষ্ট দিচ্ছে। বস্তির সকলে তাকে তার মাসীর কাঁচা আনাজের ব্যবসা করতে বললো। ছেলেকে মানুষ করার জন্য মীরা তাই করলো। 
দেখতে দেখতে মীরার ছেলে ছয় বছরের হয়ে গেলো রকি দেখে কতো ছেলে মেয়েরা তার বয়সি রোজ স্কুলে যায় তাহলে সে কেন স্কুলে যাবে না। সে মায়ের কাছে স্কুলে যাবার জন্য বায়না করলো। 
পরের দিন মীরা রকিকে নিয়ে স্কুলে গেলো হেডমাস্টার মীরা কে রকির বাবার নাম জানতে চাইলো কিন্তু মীরা নাম বলতে পারলো না তাই রকি কে স্কুলে ভর্তি করাতে পারলোনা। তিরস্কার হয়ে তারা স্কুলে থেকে চলে এলো। সারাদিন ধরে রকি স্কুলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে যদি দয়া করে তাকে ভর্তি করে বাচ্চা ছেলে মন সে জানে না এই সমাজে নিয়ম। 
বস্তিতে সকলে তাকে বে জন্ম বলে ডাকে একদিন রকি একটি ছেলের মাথা ফাটিয়ে দেয়। বস্তিতে সকলে তাকে অপমান করতে লাগলো রোজ অপমানের লজ্জা মীরা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মা হত্যা করলো। 
পরের দিন রকি দেখলো তার মায়ের ঝুলন্ত দেহ টা মায়ের পা ধরে চিৎকার করতে লাগলো বস্তির সকলে ছুটে এলো। থানা থেকে পুলিশ এলো মীরা কে নিয়ে চলে গেলো 
কে দেখবে রকি কে খিদের জ্বালায় রকি একটি বাড়িতে রুটি চাইতে গেলো বেজন্মা বলে তাকে তাড়িয়ে দিলো। 
বেশ কয়েক বছর কেটে গেলো রকি এখন মস্ত গুন্ডা অনাহাসে সে মানুষ খুন করতে পারে। দিনের পর দিন শহরের ডাকাতি বাড়তে লাগল। কিন্তু পুলিশ ধরতে পারলো না। 
একদিন রকি এক নেতাকে মারার সুপারি নিলো একজনের থেকে দশ লক্ষ টাকা। প্রতিটি ছেলের ব্যাঙ্ক কে সেই টাকা জমা করে দিলো কারণ সে জানতো যদি সে ধরা পরে আর দশটি ছেলে বেঁচে যাবে তাদের ভবিষ্যৎ। 
একটি পিছিলে রকি ঢুকে নেতার মাথায় গুলি করে দিলো নেতা সেখানে মরে গেলো। পালাতে গিয়ে রকি ধরা পড়লো। ২২ শে জানুয়ারি রকি বিচার রকি কে বিচার কিছু বলার সুযোগ দিলো রকি চিৎকার করে বলে কোথায় ছিল সেই দিন যেদিন তাকে তার মা স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়ে ছিল বাবার পরিচয় দিতে পারেননি বলে স্কুলে থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সে আইন মানেনা আদালত মানেনা। তার একটি পরিচয় সে জারজ সন্তান। 
বিচারে তাঁর ফাঁসি হলো। সে হাসতে লাগলো আর চিৎকার করে বলে এ সমাজে কোন সন্তান যেন রকি মতো না হয় রকি হারিয়ে গেলো। 

Monday, June 6, 2022

ছোট গল্প - শত্রু-মিত্র || লেখক - সামসুজ জামান || Short story - Satru Mitra || Written by SAMSUZ ZAMAN

 



শত্রু-মিত্র

       সামসুজ জামান



 ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এর বাইরে থেকে কাঁচ ঘেরা কেবিনের দুটো বেডের দিকে ক্রমাগত চোখ রাখছিলো জনার্দন। দুটো বেডের একটাতে তার ছেলে যতীন এবং অন্যটাতে ছোট ভাই বলরাম। চোখ থেকে টস টস করে জল পড়ছিল জনার্দনের। ভাবছিল কি করে এমন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল?

দুটো পরিবারের মধ্যে ইদানিং কালের সম্পর্কটা খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছে ছিল। কিন্তু এমন সম্পর্ক তাদের মধ্যে আগে কোন দিনই ছিল না। বরং সকলেই পাড়ার মধ্যে এই দাদা ভাইয়ের একেবারে হরিহর আত্মার সম্পর্কের কথা জানত। তবে সব বদলে গেল একটা রাজনৈতিক কারণ থেকে। বলরাম, সাগর বাবুর রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর পর থেকেই। জনার্দন চিরকালই দীপেশ বাবুর পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী। পার্টির একজন নামকরা জান লড়িয়ে দেওয়া কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল দীপেশ রায়ের পার্টিতে, তার ডানহাত বাঁহাত বলা হত।   

বলরাম ছেলেটা সমাজকর্মী হিসেবেই পরিচিত কিন্তু সে যখন সাগর বাবুর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে কাজকর্ম করা শুরু করল তখন থেকেই নানাভাবে তার উপর চাপ এল। সে যেন ওই পার্টির সমস্ত কাজ থেকে নিজের নামটা তুলে নেয়। বলরাম জানতো দুর্নীতির সঙ্গে তার কোনো আপস নেই। আর সে পার্টির কাজ করবে গরিব দুঃখী জনগণের স্বার্থেই, রাজনৈতিক ধামাধরা কোন কাজ কর্মের জন্য সে পার্টিতে নাম লেখায়নি।

এক রাতে সে যখন ঘুমোচ্ছে, কেউ এসে তার নাম ধরে ডাকতেই কিছু না ভেবে সে দরজা খুলে দিয়েছিল। দীপেশ রায়ের পার্টির লোকজনরা মুখে মুখোশ পড়ে তার ঘরে এসে আক্রমণ চালাল। মোটামুটি ভাবে হুমকি দেয়া হয়েছিল,তবে মুখোশের আড়াল থেকে দু-একজন যে দুটো থাপ্পর দেয়নি তা নয়। বলরামের সেদিন থেকে যেন জেদ আরো বেশি চড়ে গেল এবং সে প্রতিজ্ঞা করল কোনভাবেই পার্টি থেকে নাম তুলে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

  জনার্দন বেশ হাসি খুশির সঙ্গেই বাড়িতে ফিরল তবে ছোট ছেলেটার কান্না শুনতে শুনতে। তার বউ তারামণি জানাল ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছে, বারবার পেটে হাত রাখছে কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারছে না কি তার অসুবিধা। তার বউ আরও বলল- দেওর কে জানাব? ওদের তো এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে রয়েছে। হয়তো ছেলেটার কোন ভাল ব্যবস্থা হতে পারে চিকিৎসার। কথাটা শুনেই চিৎকার শুরু করে দিলো জনার্দন। তারামণি চুপ করে গেল ভয়ে।

এখন কেউ বলরাম কে দল থেকে দূরে রাখার কথা ভাবতেই পারেনা। ছেলেটা ইতিমধ্যেই যেভাবে নাম কামিয়েছে, বিশেষ করে গরীবগুর্বো মানুষেরা বলরামদা বলতে যেন অজ্ঞান। যেকোনো ধরনের ঝামেলা, অশান্তি , অভাব-অভিযোগ, সমস্যা যাই ঘটুক না, বলরাম এক পায়ে খাড়া। আর তার বাড়ি থেকে সাহায্য সহযোগিতা ও প্রচুর মাত্রায়। বলরাম পার্টিতে নাম লেখানোর আগে ভাবেনি কিন্তু পিছন থেকে যদি স্ত্রী সুনন্দা সাহায্য সহযোগিতা না করলে সে একজন সফল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এভাবে বিবেচিত হতো না।

সমস্যাটা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। জনার্দন কোনমতেই সহ্য করতে পারছিল না বলরামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। গোপনে গোপনে গ্রামের ধান্দাবাজ ছেলেদের লড়িয়ে দিয়ে নানাভাবেই অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিল সে। আর গত পঞ্চায়েত ভোটে সাগর বাবুর রাজনৈতিক দল জয়লাভ করার পর থেকেই জনার্দন আর বলরাম একেবারে সাপে-নেউলে। অবশ্য সেটা মূলতঃ জনার্দনের দিক থেকেই। তারা একই জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কিন্তু এখন তাদের দুটো পরিবারকে দেখলে কেউ অন্তত একথা বলবে না। 

 বলরাম সেদিন আসছিল রাস্তা দিয়ে বৌদি ছুটে এসে বলল- ভাই, একটা কথা বলব,রাখবে? একটু অবাক হয়ে বলরাম বলল - বৌদি ওই ভাবে বলছ কেন? কি দরকার বল না?

- বলতে পারি কিন্তু দাদা জানলে আমার আর কিছু বাকি রাখবে না।

- তুমি নির্ভয় বলো। - উত্তর দিল বলরাম।

- ছেলেটার কি যে হচ্ছে পেটের মধ্যে, খুব অসুবিধা, অস্বস্তি, কষ্ট পায়, যন্ত্রণা ভোগ করে। তোমার দাদা তো নজরই রাখে না। অনন্ত বাবুর হোমিওপ্যাথিই ভরসা। তবে দিন দিন বাড়ছে, আমি তো মা, তাই বুঝি- বলতে বলতে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল বউদি। - একটু ব্যবস্থা করে দাও না ভাই যেমন করে হোক।

 বলরাম ডক্টর সিকদার কে ফোন করে ঘটনাটা জানালো। বৌদিকে বলল তুমি যেভাবে হোক ডঃ শিকদারের কাছে নিয়ে যাও ওনার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। উনি চিকিৎসা করাবেন কিন্তু দাদাকে আমার নাম জানিও না তাহলে চিকিৎসা করাতে দেবে বলে মনে হয় না। বউদি ওই অবস্থায়ও একটু হাসল, বলল – সে আর আমি জানি না!

 বৃষ্টি হচ্ছিল কদিন থেকে প্রচুর মাত্রায়। তার মাঝেই ময়ূরাক্ষী যেন একেবারে নিজের স্রোত উজাড় করে দিল। বন্যায় গ্রামকে গ্রাম তলিয়ে যাবার জোগাড়। এমনিতেই নন্দপুরের সাধারণ মানুষের বড় বেহাল অবস্থা। এরপর থেকে গ্রামীণ মানুষগুলোর সর্বাঙ্গীণ অবস্থা খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছলো। প্রথম দু-চারদিন তারা কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে চালিয়েছিল। নিজেদের ঘরের লাউ, কুমড়ো, এঁচোড়, ইত্যাদি নিয়ে ভাগ-যোগ করে দুটো ভাত কোনরকমে তারা গিলতে পারছিল। কিন্তু ঘরের অবস্থা সবারই খারাপ। তাই বেশিদিন চালানোর মত সামর্থ্য ছিল না।

 খুব তৎপর হয়ে বলরাম, সাগরবাবুর মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের জন্য অনেক ত্রাণসামগ্রী জোগাড় করেছিল। বরাবরই সাগর বাবুর তার উপর খুবই ভরসা। বলরাম নিজের বাড়ির একটা ঘরে সেসব সামগ্রী যত্ন করে রেখে দিচ্ছিল অসহায় মানুষদের মুখের গ্রাস। মাথায় তুলে রাখার মত সম্পদ এগুলো তার কাছে। একটু একটু করে এসব তার সঙ্গী সাথী নিয়ে সে গরিবদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল।

সেদিন সকালবেলায় তার বাড়ির সামনের দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুনে বলরাম ছুটে বেরোতেই, মানিক বলল- দাদা, দেখেছো, তোমার ঘরের পিছন দিকের দরজা ভাঙ্গা। শুনে আঁতকে উঠল বলরাম। সে কিরে! বলিস কি? বন্যার ত্রাণসামগ্রী সব তো ওঘরেই রাখা আছে! দ্রুত সবাই মিলে ছুটল সে ঘরের দিকে। যা ভাবা তাই! ত্রাণ সামগ্রীর ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই।

 গ্রামে উত্তেজনা বাড়লো। বিরোধী দল থেকে বলাবলি শুরু হল-প্রথম প্রথম ভালো কাজ দেখিয়ে বলরাম সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু আসলে সে একটা ফেরেববাজ, শয়তান। গোপনে এই ত্রাণের সামগ্রী বিক্রি করে তার পকেটস্থ করেছে সে।

 থানা পুলিশ হল। আত্মপক্ষ সমর্থনের তেমন কোন সুযোগ তার সামনে ছিল না। সুতরাং গ্রেফতার হল বলরাম। কেস চলতে থাকলো তবে সাময়িকভাবে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হল। আরো কিছুদিন যেতে না যেতে উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণের অভাবে বলরাম নির্দোষ প্রমাণিত হলো। সদর থেকে গ্রামে ফিরতেই বলরাম শুনল ভাইপো যতীন কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। তার কিডনির অবস্থা খুব খারাপ। কদিন ধরেই ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। সময়ে সময়ে বলরাম ডঃ; শিকদারের কাছ থেকে সব খবরই পাচ্ছিল। রোগীর খুব অবস্থা খারাপ হওয়ায় শিকদার স্যর তাকে পাঠিয়েছেন সদর হাসপাতালে।

 তার দুটো কিডনিই একেবারে অচল। খুব কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা। জনার্দন এসে ভাইয়ের হাত দুটো ধরে বলল- কিছু ব্যবস্থা কর। ভাইপো টা যে মরে যাবে! ভাইপোর খবর শুনেছিস? তার কিডনির খুব সমস্যা। আমার মত মানুষ পয়সা কড়ি কোথায় পাবো বলতো? কিডনি জোগাড় করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! 

অনেক দৌড়ঝাপ করে বলরাম কলকাতা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাইপো কে স্থানান্তরিত করল। দুটো কিডনিই তার অচল। সুতরাং কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর ব্যবস্থা না করলে এই ছেলের বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই। দাদা তার হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলল- আমার মত মানুষের পক্ষে কি করে সম্ভব বলতো কিডনির আমি কি ব্যবস্থা করব? বলরাম বলল তুমি ভাবছো কেন তোমার ছোট ভাই তো বেঁচে আছে এখনো। এরপরের কাহিনী ইতিহাস।

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এর ভিতর এখন সেই দুটি প্রাণী। একটি বেডে বলরাম, অন্য বেডে ভাইপো যতীন। বলরাম খুব সানন্দে ভাইপো যতীনকে তার একটা কিডনি দানের অঙ্গীকার করেছে। সবকিছু মিলে যাওয়ায় চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেও কোন অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে দু'ঘণ্টা কিভাবে অতিবাহিত হয়েছে তা বলে বোঝানো মুশকিল। তিনটি প্রাণী বাইরে দাঁড়ানো - দুই ভাইয়ের স্ত্রী এবং জনার্দন। একটু দূরে গ্রামের অগনিত লোকজন। সাগর বাবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না, দশ বার আসা-যাওয়া করছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে নির্বিঘ্নে বলরাম এবং যতীনকে বের করে আনা হয়েছে। তারপর থেকেই আই সি ইউ এর কেবিনে বাইরে থেকে তারা নিষ্পলক চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অক্সিজেন, রক্ত, স্যালাইন, কি না কি চলছে! দুটো দেহ পাশাপাশি বেডে - একজন দাতা অন্যজন গ্রহীতা।

একসময় ভিতর থেকে কাঁচের দরজা খুলে নার্স একটু উঁকি দিতেই তৎপর হয়ে দৌড়ে গেল সুনন্দা আর তারামণি - কি হয়েছে, কেমন আছে? – উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল ওরা দুজন। নার্স জানাল- কিডনি গ্রহণ করে ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠছে বেশ,তবে অজ্ঞান অবস্থায় থাকবে আরও দশ বার ঘন্টা। কিন্তু কিডনিদাতার এখনো বিপদ কাটেনি, ঠিকভাবে জানতে সময় লাগবে আরও চব্বিশ ঘন্টা। -ঠাকুর, রক্ষে কর আমার ভাইকে- আর্তনাদ করে উঠল তারামণি। আর অধরটা দাঁতে কামড়ে ধরে থর থর করে কেঁপে উঠল সুনন্দা।

চোখের পলক পড়ে না দু-তিনটি প্রাণী একভাবে হাসপাতালের দরজার বাইরে অপেক্ষমান। কখন ভালো খবর আসে এই অপেক্ষায়। 

– একটু জল খাও তো বোন, বলে তারামণি জলের বোতলটা জোর করেই সুনন্দার হাতে গুঁজে দিয়েছে। আর ঠিক সে সময় হঠাৎই- সরে যান, সরে যান, বলতে বলতে দু-তিন জন ডাক্তার ছুটে গেলেন ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের ভিতরে। মুহূর্তেই যেন হাসপাতাল চত্বর টা অন্য রূপ পেল। ডাক্তার নার্সদের তড়িঘড়ি ছোটাছুটি, মুহুর্তের মধ্যে যেন পরিস্থিতি টাকে একটা উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে দিল।

 -কি হয়েছে, কাঁচের দরজার কাছে বিস্ময়ে ছুটে গেল সুনন্দা। - আরে সরে যান তো! কাজের ডিস্টার্ব করবেন না - বলতে বলতে একজন নার্স সুনন্দাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকে গেল। কেবিনের গ্লাসে চোখ রেখে সুনন্দা আর তারামণি দেখছিল ভিতরে কি কান্ড ঘটছে। কিন্তু হঠাৎ স্ট্যান্ড দেওয়া পর্দা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলো বলরামের বেড টা। ভিতরে ডাক্তার নার্সদের ছুটোছুটি বাইরে থেকে দেখার আর উপায় রইল না ! এক-একটা মুহূর্ত যেন এক-একটা দিন-রাত্রি সমান। 

বড় জা ছোট কে সান্তনা দিচ্ছিল - ভয় পেয়ো না বোন, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো ....... আরো কি কি বলতে যাচ্ছিল। ভিতর থেকে একজন সিস্টার বেরিয়ে এসে খবর দিলেন- কিডনি নিয়ে বাচ্ছাটা তো বেশ ভাল, খুব ভালভাবেই কিডনি নেওয়া-দেওয়া হয়েছে। তবে কিডনি দাতার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছিল আর দুর্ভাগ্য যে আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওনাকে বাঁচাতে পারলাম না! কথাগুলো শোনা মাত্রই সুনন্দা এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল- সে কি ঠিক কথা শুনল? তার স্বামী সত্যি বেঁচে নেই? তারপরেই পাগলের মত চিৎকার করে উঠল- এই ডাইনি চুপ কর, বাজে কথা বলার জায়গা পাস নে! 

    বাইরে বেরিয়ে আসা এক ডাক্তারবাবুর পা দুটো ধরে জনার্দন তখন পাগলের মত চিৎকার করছে- আমার ভাইকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, আমার ভাইকে বাঁচান! ওর মতো মানুষ দুটো হয় না। ওকে যা হোক করে ফিরিয়ে দিন, আমি ওর সাথে কোনদিন আর দুর্ব্যবহার করব না, আপনি যা হোক করে ওকে ফেরান ডাক্তারবাবু। ডাক্তারবাবু সান্ত্বনা দিলেন- তা কি আর হয় ভাই, যে যাবার সে চলে গেছে। তাকে ফেরানো কি আর আমাদের হাতে?

 কোন কথাই শুনতে চাইছিল না জনার্দন – চিৎকার করে বলল -জানেন ডাক্তারবাবু, আমার ভাই আসলে দেবতার মত। ডাক্তার বাবু, আপনারা চেষ্টা করে ওকে ফিরিয়ে দিন যেমন করেই হোক। ডাক্তার বাবু জনার্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বাবা যা হবার হয়েছে আর তো আমাদের কিছু করার নেই। তুমি ঘরে ফিরে যাও। ভাইয়ের দেহ সৎকার করার ব্যবস্থা করো। 

সাগর বাবু আর তার লোকজন সবাই তখন ভীড় করে এসে দাঁড়িয়েছে। জনার্দন ডাক্তারবাবুকে ছেড়ে ছুটে গিয়ে বৌমার পা দুটো চেপে ধরল - জানো বৌমা একদিন তোমাদের ঘর ভেঙে বন্যা ত্রাণের সামগ্রীগুলো লোকজন নিয়ে আমরা চুরি করেছিলাম, অকারনে ওকে কলঙ্কিত করতে। সে কথা বুঝতে পেরেছিল বলরাম কিন্তু প্রতিশোধ নেয়নি, এমনই দেবতার মত মানুষ আমার ভাই। তার বদলে ও নিজের কিডনি দিয়ে আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে আজ নিজে নিজে চলে গেল। বৌমা বলতো এই শাস্তি আমি কি করে মাথা পেতে নিই? কি করে সহ্য করি? 

সুনন্দা তখন পাথরের মত মুখ করে ভাসুরের দিকে তাকিয়ে। ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না সে রক্তমাংসে গড়া কোন মানুষ, নাকি পাথরে গড়া কোন প্রতিমা!

Sunday, June 5, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -5


 


দুই 

দাদার পত্র এলো, এ বছর পূজোতে সে বাড়ী আসবে ও সাথে একজন বন্ধু আসবে। জগৎ আলো করে মা দশভূজা আসছেন দিন সাত/ আট পরে। পর পর দু'বছর দাদা পূজোতে বাড়ী আসেনি। আমাদের অভাবের দিন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। বাবার শরীর ভেঙ্গে গেছে। তবুও সমানভাবে উপার্জন করে চলেছেন। বাবার সেই আশা, দাদাকে ডাক্তারী পাশ করাতে হবে। তাই ভালো পুষ্টিকর খাবারের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। সাধারণ দুস্থ পরিবার যেমনভাবে বেঁচে থাকে আমাদের অবস্থা সেই রকম। শুধু এ চিন্তা করতাম, এদিন আমাদের থাকবে না। মানুষ অনেক কষ্টের পর সুখ পায়।

সেই আশাতে তাকিয়ে থাকলাম, সেই দিনটা কবে হবে। দাদার বন্ধু আসবে শুনে একটু ভয় পেলাম। কারণ আমাদের দারিদ্রের মধ্যে কি করে তাকে আপ্যায়িত করবো। চিন্তাকুল মনেও বাবা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সুমন্ত ও তার বন্ধু আসছে , এতো বড় আনন্দের কথা। সে জন্য চিন্তা করার কি আছে। ওরে যে আসবে সেও মানুষ, হয়তো দুটো দিন আমাদের কষ্ট হবে। তুই বড় সংসারী হয়ে গেছিস দেখছি। সংসারের হাল হাতে নিয়েছিস বলে এতা চিন্তা কেন ? আমি তো আছি। 

শুধু সংসারের কথা ভাবছিলাম না , ভাবছিলাম আসন্ন দুর্গা উৎসবে মধুময় দিনগুলোতে সাজ পোষাকের অনটনে কিভাবে অন্যান্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবো। 

বাবা একদিন বলে ছিলেন জানিস মা আমাদের এখনো পর পর তিন বছর এই দারিদ্রের মধ্যে দিন যাপন করতে হবে। পরিবারে বস্ত্রের অভাব ছিলো যথেষ্ট, কিন্তু সংসারের কথা চিন্তা করে বস্ত্রের অভাব মেটাতে পারিনি। 

স্থির করলাম, দাদার বন্ধু এলে পর পাশের বাড়ী হতে আতিথ্যের যাবতীয় ব্যবস্থা করবো। তাছাড়া গরীবের কি উপায় থাকতে পারে। 

সপ্তমীর আগের দিন পশ্চিম দিগন্তে সূর্য্যের ম্লান রশ্মি মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন দাদা ও তাঁর বন্ধু রন্টু উপস্থিত হলেন সমভিব্যাহারে। দাদার বন্ধু রন্টুদার চেহারা দেখে আমি বিরামাবিষ্ট হলাম। গৌরবর্ণ চেহারা, পাতলা মুখ , কোকড়ান মাথা ভর্তি চুল। চোখের দৃষ্টিও তীক্ষ্ম। ভ্রু দুটো যেন কোন শিল্পী এঁকে দিয়েছেন, পরিধানে আভিজাত্যের ছাপ। বিশেষ করে ওর নয়ন ভুলানো রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আমি এ পোষাকে তার সামনে থেকে সংকুচিত হয়েছিলাম। এমন সময় দাদার ডাক শুনতে পেলাম। 

দাদা ও রন্টুদার যথাচিত আদর আপ্যায়ণ করলাম। এই ভাবে সেইদিনের রাতটা কেটে গেলো। বারবার সেসময় মনে উদয় হয়েছিলো, ঐ মানুষ আমাদের এই দীন অবস্থার মধ্যে থাকতে পারবেন কি না। বড়লোকের ছেলে পালঙ্গের উপর শুয়ে নিশিযাপন করেছেন। এই বাড়ীতে অসুবিধাতো হবেই। ওকে ঠিক মতো আপ্যায়িত করতে পারবো কিনা সেজন্য দাদার উপর ভীষণ রাগ হয়েছিলো কেন জেনে শুনে এখানে তাকে উপস্থিত করলো। নানান চিন্তার মধ্যে রাত কাটালাম। 

পরদিন সকালে উঠে সংসারের কাজে লিপ্ত হলাম, বাড়ীর চারিপাশে ঝাড়ু দিচ্ছিলাম রন্টুটা কখন হতে যে আমার মুখপানে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ পিছন ফিরতেই চোখে চোখ পড়তেই আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বাড়ীর ভেতরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিলো! তবে কি সে আমার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিলো? 

ভুল ভাঙ্গলো ঘন্টা তিন পর। যখন ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে বলল, কি রে রমা, আমায় দেখে ভীষণ লজ্জা পেলি।


একজন প্রবাসী অপরিচিতের মুখে জীবনে প্রথম পরিচয়ে এরকম কথা শুনব কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুতে চাইছিলো না। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আমার চিন্তা মুক্ত করে বলল, কি ব্যাপার এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? তোর নিকট তোর সুমন্তদা যেমন আমাকেও সেরূপ ভাবিস।

 আমি আরো চমকে উঠলাম। আমি আজ পর্যন্ত কোন ছেলের নিকট হতে এরূপ সৌজন্যমূলক আচরণ পাইনি। পাড়ার অনেক যুবক আমাকে উত্যক্ত করেছে, আমার প্রতি কটাক্ষপাত করেছে। সে সময় নিজেকে আমি অসহায় বোধ করেছি। আমি ওদের আচরণ দেখে প্রতিবাদ করতে পারিনি। শুধু মনে পড়তো ঠাকুরদার কথা। যদি ঠাকুরদা বেঁচে থাকতেন বা আমাদের পূর্বের অবস্থা বজায় থাকতো তাহলে কোন প্রকারে একথা বলার দুঃসাহস পেতো না। আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলার জন্য অনেকেই হীন ষড়যন্ত্র করেছিলো। 

রন্টুদার কথাতে আমার ঘোর কাটলো। সে বলল, চল এই মহাপুজার দিনে আমরা সকলে সেজেগুজে প্রতিমা দর্শন করে আসি। ওকথা বলে রন্টুদা ভেতরে গিয়ে তার এটাচি হতে ভালো প্রিন্টের একটা শাড়ী বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, শোন এবার বাড়ীর কাজকর্ম বন্ধ করে আমাদের সাথে মেলা দেখতে যাবি। দুর্গাপূজায় মেলা বসতো আমাদের পুরানো বাড়ীর সামনে। ধূমধাম কম হতো না। ঠাকুরদার আমলে পূজোর চারদিন গ্রামবাসীদের উনুনে আঁচাদিতে হতো না। কারণ মহাভোজের ব্যবস্থা করতেন! এখন সব মুছে গেছে। মেজকাকা কোন প্রকারে পূজো চালাচ্ছেন। যদি বাবা পূজোতে কিছু সাহায্য করতেন, মেজকাকা অমানুষিকতার জন্য মন চাইতো না।

 আমি শাড়ীটা হাতে নিতে লজ্জা করছিলাম, কিন্তু দাদার কথায় লজ্জা বিসর্জন দিতো হলো। কোন প্রকারে শাড়ীটা হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

 সকাল হতেই পুরানো বাড়ীতে সানাই বেজে চলেছে। সানাই এর সুর কানে আসতেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। কি আনন্দই না ছিলো ঠাকুদার আমলে। পূজোর চারদিন দশ ভূজার আগমনে মহাসমারোহে, উৎসব প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠতো। সেই সময় ঠাকুরদার নিকট হতে চরম স্নেহ ও ভালোবাসা লাভ করেছি। এখন ঐ পূজা মণ্ডপে প্রবেশাধিকার আছে কিন্তু আগের মতো অধিকার নেই। 

তাই বাবা বারবার বলেছেন, যদি দশভূজাকে প্রণাম করার ইচ্ছা থাকে তাহলে। যেও, তবে বেশী বিলম্ব করা চলবে না। দাদা, আমি ও রন্টুদা প্রতিমা প্রণাম করতে গেলাম। রন্টুদার স্বভাব ও আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করে তুললো। সেই জন্য রন্টুদার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়ে উঠলো। আমি সত্যিই আনন্দিত হলাম আরেক দাদাকে পেয়ে।


                                       
                                                ক্রমশ...


_______________________________________________

চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--


Saturday, June 4, 2022

ছোট গল্প - পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - pen o phire paouar golpo || Written by Dipankar saha


 

পেন ও ফিরে পাওয়া বন্ধু

দীপঙ্কর সাহা


-এক-


শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল বুলু (হেমন্ত দত্ত)। আমাদের পাশের পাশের বাড়ি থাকতো। এক সাথে স্কুলে যাওয়া ও স্কুল থেকে ফেরা, অবসর সময়ে এক সাথে খেলা ধুলো, সবকিছুতেই বুলু ছিল আমার একমাত্র সাথি। 


আমার শৈশব ও কৈশোরের সোনালী দিনগুলো কেটেছে যশোর শহরে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যা এখনকার বাংলাদেশ। 


যতদূর মনে পড়ে, যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি, তখন বুলুরা সপরিবারে পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে আসে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁতে বসবাস করতে শুরু করে। 


তার অনেক পরে, ক্লাশ টেনের ফাইনাল পরীক্ষা (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট) দিয়ে আমিও চলে আসি কলকাতায়। এত বছর পরেও বুলু কে আমি খুব মিস করতাম। 


ইচ্ছে থাকলেও বুলুর সাথে দেখা করার বা বনগাঁ যাবার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া ওদের বাড়ি চিনি না, বনগাঁ অনেক বড় জায়গা, কোথায় খুঁজবো বুলু কে বনগাঁ গিয়ে! 


এর বছর চারেক বাদে আচমকা এক সুযোগ এসে গেল বনগাঁ যাবার। বড়দা একদিন একবেলার জন্য কি একটা কাজে বনগাঁ গিয়ে ফিরলো না। মা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে, পরদিনই সকালে, আমাকে বনগাঁ গিয়ে খোঁজ খবর করতে পাঠিয়ে দিল। 


গেলাম। এই ভরসায় গেলাম যে, বুলুদের একটা দোকান ছিল বা আছে বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও, এইটুকু শুধু জানতাম। 


তাছাড়া বুলুর এক কাকা ছিলেন বড়দার বন্ধু। হয়তো কোনও খবর পেলেও পেয়ে যেতে পারি, ওদের বাড়ি গেলে। 


বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়ে, বুলুর বাবার নাম করে দোকানের খোঁজ করতে পেয়েও গেলাম। দোকানে বুলুর বাবা ছিলেন, আর বুলুর ছোটভাই খোকা। 


খোকা আমাকে চিনতে না পারলেও, বুলুর বাবা এতো বছর পরেও আমাকে এক নজরে চিনতে পেরে মহা উৎসাহে হৈচৈ বাঁধিয়ে সমস্ত খোজ খবর নিতে শুরু করলেন বাড়ির সবার। 


বললাম সব, কিন্তু জানতে পারলাম বড়দা ওদের বাড়ি বা দোকানে আসে নি বা যোগাযোগও করে নি। কি করি, কথাবার্তার শেষে আমি চলে আসতে চাইলাম। 


-চলে যাবি মানে? দাড়া আমি ব্যাবস্থা করছি। 


নিজের চেনা এক রিকশা ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমি তো এটাই চাইছিলাম। বনগাঁ গিয়েও বুলুর সাথে দেখা না হলে, সারা জীবন আফসোস থেকে যেতো যে! 


-বাড়ি যা, সারাদিন থাকবি, খাবি। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি যাবি। তোর বন্ধু বুলু বাড়িতেই আছে। 


ছুটির দিন ছিল, বোধহয় রবিবার। বুলুর তো বাড়ি থাকারই কথা! বাড়ি ঢোকার মুখে বুলুর দাদা সুশান্তদার সাথে দেখা, মুখটা কাচুমাচু, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে অনেক দিন বসে আছে বলে বাড়িতে একচোট বকাবকি হয়েছে, আমাকে বললো, -তুই ভিতরে যা, বুলু আছে। 


বুলু তো আমায় জড়িয়ে ধরলো, দেখলাম আমার মতোই ওরও আমার প্রতি মনের টানটা এতদিন পরেও আছে! 


বুলুও আমার মতোই পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই বি এস সি পড়ছে। কথা শুরু হলো, তো শেষ আর হয় না! ছোটবেলার নানান কথা, স্মৃতিচারণ এইসব হতে হতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। 


একসাথে বুলু কে আর আমাকে খেতে দিয়ে, বুলুর মা ও বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। 


খাওয়া হতেই বুলু বলে, - চল একটু ঘুরে আসি। আমি তো বুঝে গেছি, কেন বলছে। দেখলাম পাড়া ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে, তারপর বুলু সিগারেট কিনলো! 


দেখে খুশি হলাম, আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটই কিনলো বুলু, উইলস্ ফিল্টার। গল্প করতে করতে সিগারেট শেষ করে তারপর পাড়ায় ঢোকা হলো। 


গল্পে আর কথায় কথায় কখন বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই। হঠাৎ উঠোনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আলো কমে এসেছে, শীতের বেলা! অগত্যা উঠতেই হলো। 


বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে মনটা খারাপ হয়ে গেল, মা তো বসে আছে বড়দার খবরের প্রতীক্ষায়, মা কে বাড়ি গিয়ে কি বলবো? 


বুলুর বাবা যা বলেছিলেন, তাই বললাম। উনি খোঁজ খবর নেবেন, বনগাঁয় এবং জানাবেন খবর পেলে। 


অবশ্য তার আর দরকার পড়েনি, বড়দার সেই রাতেই ফিরে এসেছিল। 


-দুই-


ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় জিনিসের মধ্যে অন্যতম হলো পেন। তখন তো বল পয়েন্ট পেন ওঠে নি, চল ছিল ফাউন্টেন পেনের। আমার খুব প্রিয় একটা পেন ছিল কালো আর সোনালী রঙের। বিদেশি জিনিস, যতদুর মনে আছে জার্মানির তৈরি। 


আমি জানতাম বুলুর ওই রকম একটা পেনের খুব শখ। কিন্তু সেটা আমার এতো প্রিয় ছিল যে, কোনও সময় ওটা হাতছাড়া করতাম না। 


আসলে ছোটবেলায় ওই রকমই একটা কালো সোনালী প্রিয় পেন আমার হারিয়ে যায়, তাই এই পেনটার প্রতি আমার টান টা একটু বেশিই ছিল। 


তখন আমি থ্রি তে পড়ি। বড়দা, মেজদারা কলকাতায় পড়াশোনা করে। শীতের শেষে স্কুল ছুটি, যশোরে বাড়ি এসেছে। 


তখনো বড়দির বিয়ে হয়নি। বড়দা মেজদারা এসেছে মানে বাড়িতে আনন্দের হাঁট । হঠাৎ বড়দির চিকেন পক্স হয়ে পড়লো । মা বলতো মায়ের দয়া। 


তারপর একে একে অন্যদের হতে শুরু করলো। এক এক জনের হয়, আর তার জন্যে ঘর আলাদা করে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত দাদার ও হলো, সব কটা ঘর ওদের দখলে চলে গেল। 


আমি একা মার সাথে ঠাকুর ঘরে শুই আর মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই, প্রাণপনে মনে মনে চাইছি আমার কেন হচ্ছে না !!!


রোজ সকালে মাকে ডেকে দেখাই - দ্যাখো তো মা আমার বোধহয় গুটি বেড়িয়েছে, মা না করলেই আরো মন খারাপ !! শেষ পর্যন্ত এক দিন মা বললো গুটি তো বেড়িয়েছে, ঠাকুমার ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। সেদিন কি আনন্দ !! 


মনে আছে, ঠাকুমার ঘরে ঢুকে, আনন্দের আতিশয্যে, প্রথম কথা বলেছিলাম, অসুখ সারলেই এই পেনটা বুলুকে দিয়ে দেবো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিতে হয়নি। কারণ আমার অসুখ ছাড়ার আগেই ওরা যশোর ছেড়ে বনগাঁ চলে যায়। 

 

-তিন-


যশোরে আমাদের বাড়ি ছিল শহরের একদম জমজমাট অঞ্চলে, বাড়ির সামনে বড় রাস্তা, কিন্তু পিছন দিকে বাড়ির গা বেয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদ। বাড়ির ঘাটে নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে একজোড়া তক্তা পাতা। তাতে বসে শুধুমাত্র বাসন মাজা হয়। 


নদীতে নামা আমাদের বারণ ছিল। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসে যেতাম কখনো সখনো।


তখন আমার বয়স হবে ছয় কি সাত। স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে পড়ি, তবে পড়ার চেয়ে খেলার দিকে মন বেশী। গত বছর ইনফ্যান্ট ক্লাশ থেকে ওয়ানে ওঠার পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়ায় বাড়িতে একটু প্রশ্রয়ও পাচ্ছি। 


আগেই বলেছি পাশের পাশের বাড়িতে থাকে আমার প্রিয়তম বন্ধু বুলু। ছুটির দিনগুলোতে সারাদিনই হয় বুলুর বাড়িতে আমি, না হয় আমার বাড়িতে বুলু। একমাত্র বুলুর সাথেই আমার কখনও আড়ি হয়নি। 


গতবছর পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় কেউ একজন উপহার দিয়েছিলেন একটা সোনালী ফাউন্টেন পেন। বিদেশি জিনিস, তার চমকই আলাদা। 


পেনটি ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। সেটি দিয়ে যত না লিখতাম, তারচেয়েও বেশি সেটা হাতে নিয়ে খেলতাম। 


একদিন হয়েছে কি, আমি আর বুলু বাড়ির ঘাটে, কলাগাছের ঝাড়ের আড়ালে বসে মাছ ধরতে গেছি। বুলুর হাতে ছিপ, আমার হাতে যথারীতি সেই পেন। 


হঠাৎ ফাৎনায় টান পড়তেই বুলু এক ঝটকায় ছিপ টেনে তুলেছে, চমকে গিয়ে আমার হাত থেকে পেনটি একদম জলে। মূহুর্তে সেটি এক বুদবুদ তুলে জলে ডুবে গেল। 


আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখেই বোধহয় বুলু থাকতে পারেনি, এক ঝটকায় জামা খুলে আমার দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জলে ঝাপিয়ে পড়লো। 


জলে ডুবে দিয়ে বুলু আর তো ওঠেনা। সময় বয়ে যেতে থাকে, আমার উৎকন্ঠা বেড়ে চলে তার দ্বিগুণ বেগে। 


আমরা দুজনই সাঁতার জানিনা। তাহলে কি বুলু আর উঠবে না? আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি করবো বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ পরে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা হাত ভেসে উঠলো জলের মধ্যে। 


হাতটা আমার নাগালের মধ্যেই ছিল, অনেক কষ্টে টেনে তুললাম আমার প্রিয়তম বন্ধুকে। 


বললো, -পেনটাতো পেয়েছিলাম, কিন্তু শ্যাওলায় পা জড়িয়ে ধরেছিল। শ্যাওলা থেকে পা ছাড়াতে গিয়ে পেনটা গেল পড়ে। পেন খুঁজতে গিয়ে শ্যাওলায় আবার জড়িয়ে গেলাম, এদিকে দম ফুরিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে শ্যাওলা ছাড়িয়ে উঠে আসতে পারলাম। 


আমি তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। আশ্চার্য কান্ড, বুলু উল্লেখ করা সত্বেও, পেনটার কথা আমার মাথায়ই আসে নি।