Saturday, August 13, 2022

ছোট গল্প - সুজাতা ম্যাম || লেখক - আভা সরকার মন্ডল || Short story - Sujata mam || Written by Ava sarkar mandal


 

সুজাতা ম্যাম

    আভা সরকার মন্ডল

 

 

                আমেরিকা থেকে পাঁচ বছর  পর দেশে ফিরল তিতলি। এয়ারপোর্টে পা রেখেই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আপন মনে বলল ---- আহ্ শান্তি !

নিলয় হাসছে--

 ----শান্তির হাওয়া বেশি করে খাও ।দু 'সপ্তাহ মাত্র ।এবার গেলে পাঁচ বছরের আগে আর আসা হবে না ।

--- তিতলির মুখ কালো হয়ে যায়।ভালো লাগে না তার আমেরিকা। নেহায়েত নিলয় তার প্রেমে হাবুডুবু আর সেও ভালবাসে নিলয় কে তাই ....

         গাড়ি থেকে বড় রাস্তায় নেমে সরু গলির ভেতর তাদের বাড়ি ।গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না। বড়ো বড়ো দুটো ট্রলি ব্যাগ এবং হাতেও ছোটো বড়ো চারখানা ব্যাগ সহ গাড়ি থেকে নামল তারা।সবার জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে কিনতে বোঝাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তবু তিতলির মন ভরেনি । প্লেনে উঠতে দেবে না বলে,নিলয় ভয় না দেখালে সে আরও একটু কেনাকাটা করত!

বাবা আর ভাই গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা একহাতে নিলয় অন্য হাতে তিতলিকে জড়িয়ে নিলেন।

... রাস্তায় কষ্ট হয়নি তো মা তোদের?

----একদমই না তিতলি বলল।

... এমা! দিদি,তুই কত রোগা হয়ে গেছিস ।ভিডিও কলে তো এতটা রোগা মনে হয় না।

..... আর তুইও তো ফুটবল হয়ে গেছিস । তোকেও তো এত মোটা মনে হয় না--- তিতলি ভাইয়ের কথার জবাবে তার চুল টেনে আদর করে বলল।

ভাই আর বাবার হাতে ব্যাগগুলো ছেড়ে দিয়ে সে এগিয়ে গেল তাড়াতাড়ি । দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে মাকে।সবাইকে ফেলে ছুটে গেল সে মায়ের দিকে।  জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। কারো মুখে কথা নেই ।দুজনের চোখেই জল। মা, বাবা, ভাইকে ছেড়ে থাকতে হয় বলেই বিদেশ তিতলির একদম ভালো লাগে না।

 

          তিতলির শ্বশুরমশাই বেঁচে নেই। শাশুড়ি মা আমেরিকায় তাদের সঙ্গেই থাকেন।তিনিই তিতলি আর নিলয় কে পাঠিয়েছেন বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। নিলয় তাঁর একমাত্র সন্তান।দেশে তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই তাঁর ।সর্বোপরি দেশের প্রতি তেমন কোনো মোহও কেন যেন তাঁর নেই । তিতলি অনেক বলাতেও তিনি রাজি হয়নি, তাদের সঙ্গে আসতে।

              একটু বিশ্রাম নিয়ে তিতলি ছুটল টিনার বাড়ি ।পাশের গলিতেই। সে আসছে জেনে টিনা শ্বশুর বাড়ি বর্ধমান থেকে ছুটে দমদম এসেছে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কালকেই চলে যাবে সে।তাই আজকেই তার সঙ্গে দেখা করা জরুরি।

টিনাদের বাড়ি ঢুকতেই ডান হাতে একটা বিশাল বটগাছ।তার চারিদিকে বাঁধানো বেদী।পাড়ার ছেলে ,মেয়ে, বউ এমনকি বুড়ো-বুড়িরাও এই বেদিতে বসে আড্ডা দিত এক সময়।বউমারা বেশিরভাগ সময় দুপুরবেলাটাকেই বেছে নিত গল্প করার জন্য।  সকালটা থাকত বয়োজ্যেষ্ঠ দের দখলে। বাজার বা মর্নিং ওয়াক সেরে থলে হাতে দু'দন্ড বসে  রাজনীতি বিষয়ক আলাপ-আলোচনা চলত তখন। বিকেল বেলায় থাকত উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের ভীড় । বিশাল গাছের চারদিকটা বাঁধানো। সবসময় সরগরম থাকত জায়গাটা। তিতলি আর টিনার কত গোপন কথার সাক্ষী এই বটগাছ !

--এখন কেউ আর সেভাবে গল্প গুজব করে বলে মনে হচ্ছে ‌ না---- শূন্য বটতলা দেখে তিতলি ভাবল।

 

             সে বটগাছটা পার হতে গিয়ে দেখলো মাঝ বয়সী একজন মহিলা দু পায়ে জলের বোতল আঁকড়ে, হাত দিয়ে টেনে ছিপি খোলার চেষ্টা করছে নোংরা কাপড় চোপড় চুলগুলো জটপাকানো ।সে এগিয়ে গেল। বোতলটা খুলে দেবে বলে হাত বাড়াতেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন সেই মহিলা । তাঁকে ঠিক সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। কি গভীর দৃষ্টি !কোথায় যেন দেখেছে একে, ভাবছিল তিতলি---- ঠিক তখনই হঠাৎ উঠে তিনি টেনে এক থাপ্পর কষালেন  তিতলির গালে।

টিনা ছুটতে ছুটতে এসেও রক্ষা করতে পারলো না তিতলি কে। সে বারান্দা থেকেই দেখেছিল তিতলি রাস্তা ছেড়ে গাছতলার দিকে এগোচ্ছে। তখনি ছুট লাগিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ভ্যাবাচাকা মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিতলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টিনা তাকে হাত ধরে টানতে টানতে  নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। ঘরে ঢুকে এসি চালিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল তিতলির দিকে ।বিনা বাক্যব্যয়ে তিতলি ঢকঢক করে জল খেতে লাগলো।.

----- চিনতে পারলি ?.... সুজাতা ম্যামকে?

টিয়ার প্রশ্নে তিতলি বিষম খেলো জোরে। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল মুখ থেকে ছিটকে পড়া জল।

..... সরি!সরি!সরি! কি যে বলি তোকে? ঠান্ডা হয়ে বসতো আগে----

টিনা তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ।

ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল তার । টিনার মা বাবা ভাই সবাই অফিসে। ফাঁকা বাড়ি কতদিন পরে দেখা দুই বন্ধুর। কত গল্প করবে বলে ছুটে এসেছে দুজন দুদিক থেকে।কিন্তু হাওয়া অন্য পথে বইছে। সুজাতা ম্যামের কাহিনী দিয়েই শুরু হল কথা, যিনি বদ্ধ উন্মাদ এখন।

       তিতলির মনে পরল সুজাতা ম্যামের ক্লাসে পিন পতনের শব্দ ও শোনা যেত।তার ব্যক্তিত্ব আর অন্তরভেদী দৃষ্টির গভীরতা কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাসে অমনোযোগী হতে দিত না। আর সঙ্গে ছিল তাঁর অতুলনীয় সৌন্দর্য ।তা যেন বশ করে রাখত সবাইকে । সুজাতা ম্যামকে ভালোবেসেই অংক ভালোবাসা তিতলির। ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি, তিতলি ও টিনাকে।পাশের বাড়িতে থাকার সুবাদে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছিল সেই সম্পর্ক। কোন প্রবলেম সলভ করতে না পারলে তিতলি যখন-তখন পাশের গলি থেকে ছুটে যেত সুজাতা ম্যাম এর কাছে। বাড়িতে গেলে তিনি শুধুই মা। মায়ের মতই ছিল তাঁর আদর যত্ন ভালোবাসা। তাঁর হাতে তৈরি নাড়ু খেতে পুজোর সময় গুলোতে প্রায় রোজই তারা ম্যামের বাড়ি হানা দিত। সাত বছরের ছোট্ট একটা ফুটফুটে ছেলে ছিল ম্যামের।তার গাল টিপে আদর করে তাকে মাঝে মাঝে মাঠে ঘোরাতেও নিয়ে যেত দুজনে । দুটো সিনেমার পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন ম্যাম।সেজন্য আশে পাশের লোকে তাঁকে আরও বেশি ভালো ভাবে চিনতো। এবং সবাই বিশ্বাস করত অভিনয়ের লাইনে গেলে সুজাতা ম্যাম এর নায়িকা হওয়া কেউ আটকাতে পারত না।

           ওই বটতলাতে কতদিন অংক খাতা মিলিয়েছে তিতলি আর টিনা।তিতলির চোখ ফেটে জল এল ! সেটা থাপ্পড়ের ব্যথা, না সুজাতা ম্যামের দুর্দশা--- কি কারণে,  সে নিজেও বুঝতে পারল না। সে টিনা কে বলল সব ঘটনা খুলে বলতে।

           সুজাতা ম্যাম ছিলে তাদের স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত উকিলকে,দুই বাড়ির মত নিয়েই।ফুটফুটে একটা বাচ্চাও আছে তাদের ।সুন্দর সাজানো সুখের সংসার । জিতেন বাবু প্রচন্ড ভালবাসতেন সুজাতা ম্যাম কে --- এই পর্যন্তই তিতলি জানত ।       


            পরের ঘটনা ঘটেছে তিতলি যখন আমেরিকায় ছিল। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যেহেতু চাকরি করেন, ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করার ইচ্ছেতে পাহাড়ের একটা কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করে দেন সুজাতা ম্যাম। একমাত্র ছেলে--- প্রচন্ড আদুরে ।বাবা মা দুজনেই পালা করে প্রতিমাসে তাকে দেখতে যান ।তার যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি তাঁদের। সেবার গরমের ছুটি পড়তেই সুজাতা ম্যাম ছুটলেন ছেলের কাছে । শিলিগুড়িতে পৌঁছে গিয়ে ফোন করেছিলেন ম্যাম।পাহাড়ের পথে যেতে যেতে জানিয়েছিলেন ধ্বস নেমেছে, সেখানে দুর্যোগ চলছে। তারপর থেকেই বন্ধ তাঁর ফোন। জিতেন বাবু খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছু সময় পর যদিও রাস্তা খুলে গেছে কিন্তু ফোনে আর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন নি তিনি ।   


 


          পরদিনই তিনি রওনা হয়েছিলেন পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন হাদিস করতে পারেন নি সুজাতা ম্যামের। ছেলের হোস্টেলেও পৌঁছাননি তিনি ।থানা পুলিশ সব হলো কিন্তু সুজাতা ম্যামের কোন খবর পাওয়া গেল না। কলকাতায় ফিরে এসে জিতেন বাবু সেখানেও খোঁজাখুঁজি করলেন কিন্তু কোনো খবর পেলেন না। ছেলেকে প্রথমে কিছুই জানানো হয়নি । থানা পুলিশ আত্মীয়-স্বজন কেউ কোনো রকম খবর দিতে পারল না। উদভ্রান্তের মতন ছুটে বেড়ালেন জিতেন বাবু এদিক থেকে ওদিক। কোথা দিয়ে যেন দশ দিন কেটে গেল।


 


ঘটনার দিন সন্ধ্যায় পুলিশের কাছ থেকে একটা ফোন এলো-- ভিআইপি রোডে অচৈতন্য অবস্থায় একজন ভদ্রমহিলাকে কে বা কারা গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে গেছে জানিয়ে । পুলিশ তুলে নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। তাঁর চেহারার সাথে সুজাতা ম্যামের নাকি মিল পাওয়া গেছে । জিতেন বাবু ছুটে গেলেন ।হাসপাতালের বিছানায় সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন সুজাতাকে । ডাক্তারবাবু বললেন অন্তত সাত দিন ধরে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছে তাঁর ওপর। গ্যাং রেপ। জিতেন বাবু ভেঙে পড়লেন। বোবা হয়ে বসে রইলেন বহুক্ষণ। চিকিৎসা চলতে থাকলো। তিন মাস কোমা তে থেকে সুজাতা ম্যাম এর হুশ ফিরল। তিনি বাড়ি এলেন জ্যান্ত লাশ হয়ে ।কাউকে চিনতেও পারেন না ।মাঝে মাঝে চিৎকার করেন। মুখের সামনে মিছিমিছি হাতটাকে ফোন বানিয়ে হ্যালো হ্যালো করতে থাকেন। যাকে সামনে পান চড় থাপ্পড় মারেন ।ইতিমধ্যে ছেলেকেও জানানো হয়েছে সবকিছু। তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে । পাহাড়ের স্কুল ছাড়িয়ে কলকাতাতেই ভর্তি করে দেয়া হয়েছে আবার। জিতেন বাবু ভাবলেন ---- ছেলেকে দেখে যদি একটু সুস্থ হয়ে ওঠে সুজাতা, কিন্তু হলো না । এক বছরে এ ভাবেই কাটল ।


ছেলেটাও মায়ের এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সুজাতা ম্যাম ছেলেকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শেকল টেনে দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ান রাস্তায় রাস্তায়। যখন খুশি ঘরে ফেরেন । কখনো কখনো ধরে আনতে হয় তাঁকে, বাইরে থেকে! দুর্বিষহ সে অবস্থা !


 


        এই ঘটনার আগে, সুজাতা ম্যামের একতলা বাড়িটা,দোতলা করার কাজ চলছিল। ছাদের ওপর আধা দেয়াল তোলা। পিলারের উপর আধা আধা রডগুলো বেরিয়ে আছে। ছাদে ছড়িয়ে আছে ইট, বালি, সিমেন্ট। প্রচন্ড রকম পরিপাটি এবং গোছানো ছিলেন সুজাতা ম্যাম। তাঁরই বাড়ির ছাদের অর্ধেক তোলা দেয়ালগুলোতে আগাছায় ভরে গেছে এখন। শ্যাওলা ধরা দেয়াল ফেটে গজিয়েছে বটের চারা-- তার শেকড় দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে শক্ত জালের মত। মাঝে মাঝেই সাপ খোপ দেখা যায়।তবে সেগুলো জিতেন বাবুর মতো বিষধর নয়। তারা মিলেমিশেই থাকে সুজাতা ম্যামের সঙ্গে ! জিতেন বাবুকে মানুষ যা ভাবত তিনি আদৌ সে রকম ছিলেন না ! দুঃসময়ে তাঁকে নতুন করে চিনেছিল সকলে।


মানুষের চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন।এই বিপদের সময়েই জিতেন বাবু বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলেন নতুন বৌ।ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন হোস্টেলে।তিনিও নিজের বাড়ি ফেলে, পাড়া ছেড়ে অন্য জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিলেন,সুজাতা ম্যাম কে অসহায় অবস্থার মধ্যে একা ছেড়ে ।বাড়িতে কাজের লোক অবশ্য একটা রেখে দিলেন । সে-ই সুজাতা ম্যামের দেখাশুনা করত। জিতেন বাবু মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিতেন কিছুদিন পরে সেটাও বন্ধ করে দিলেন..


 


বাড়িটাও আর কমপ্লিট করা হয়ে ওঠেনি। ঝকঝকে বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন।সামনের অত সূন্দর ফুল বাগানে একটাও ফুল নেই, শুধুই জঙ্গল। কোনদিন যে এ বাড়িতে মানুষ থাকত সেটা ভেবেই এখন বিস্মিত হয় মানুষ।


সুজাতা ম্যাম থাকেন বটে,তবে তিনি তো আর মানুষ নন---পাগলী ! অদ্ভুত ভাবে সমাজ সংসার থেকে কবে যেন তিনি ঝরে পড়েছেন। কেউ খোঁজ রাখে না তাঁর।


         সুজাতা ম্যাম এর মুখে অকাল বলিরেখা। খুব কাছের মানুষ তাকে দেখলে শুধু চিনবে তার ঐ গভীর দৃষ্টি দেখে। বাকিদের কাছে সে ভবঘুরের এক পাগলী! মাঝে মাঝে বাড়িতে ঢোকেন,না হলে এই বট তলাই তাঁর আস্তানা।


           টিনা আরও বলল,তার বাবা সেই সময়ে জিতেন বাবুর সঙ্গে হাসপাতালে দিনের পর দিন রাতের পর রাত থেকেছেন। জিতেন বাবুর চোখ ভরা ভালোবাসা নয়, ঘৃনা দেখেছেন তিনি। নিজের হাতটাও ভালোবেসে তিনি কখনও রাখেনি স্ত্রীর কপালে ।বাবাকে তিনি একবার বলেছিলেন, সুজাতা ম্যামকে ছোঁয়া তাঁর পক্ষে নাকি আর সম্ভব নয় ।বাবা অনেক বুঝিয়েছিল তাঁকে কিন্তু কিছুতেই পথে আনতে পারেন নি। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন ভালোবাসা, পেলে আদর ,যত্ন আর চিকিৎসায় সেরে উঠবেন সুজাতা ম্যাম।যার ভালোবাসা পেলে হয়ত চিকিৎসারও প্রয়োজন হত না--- তার ভালোবাসা পাননি তিনি।


কাজেই ওষুধ পত্রে কোন কাজ হয়নি।




 ম্যামের বাবার বাড়ির দিকেও এমন কেউ ছিল না যে তাঁর দায়িত্ব নেবে। জিতেন বাবুর ঘৃণা আর অবহেলা সয়ে শুধু একফোঁটা ভালোবাসা আর যত্নের অভাবে শেষ হয়ে গেল একটা জীবন! পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলেন সুজাতা ম্যাম।


টিনার কথা শুনে থ হয়ে বসে রইল তিতলি ।


সে শুনেছিল বেশিরভাগ পুরুষই নাকি জন্মগতভাবে বহুগামী।সবকিছু জেনে-শুনেও তাদের নিয়েই ঘর করে অনেক মেয়েরা--- নিরুপায় হয়েই। যাতে ঘর ভেঙে না যায়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে তাঁরা---


নিজের জীবনের জটিলতা ছেড়ে ভাবে সন্তান দের কথা‌।


শুধু মেয়েরাই কি ঘরলোভী ? তা নিশ্চয়ই নয়।অনেক পুরুষমানুষ ও আছেন যারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সহ্য করেন স্ত্রীদের অনৈতিক কার্যকলাপ।


কিন্তু ধর্ষণের মত ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর উল্টে ধর্ষিতার প্রতিই যে সমস্ত পুরুষের মনে সহমর্মিতার বদলে ঘৃণার উদ্রেক হয় জিতেন বাবু সেই ধরনের অমানুষ পুরুষ ছিলেন।


তিতলি অবাক হয়ে ভাবছে এই ধরনের পুরুষদের কাছে সংসারের মানে কি? তাদের ভালোবাসা কি শুধু শরীর? একদিন যাকে ভালোবেসেই ঘরে এনেছিল, সেটা তবে কি ধরনের ভালোবাসা ছিল? কিছু দুর্বৃত্ত তার, যে ভালোবাসার মানুষকে পাশবিক অত্যাচারে এভাবে ক্ষত-বিক্ষত করল, তাতে মেয়েটির কি দোষ ছিল ? স্ত্রীর প্রতি তাঁর কোন মায়া জন্মালো না ! ঘৃণা জন্মালো? সে অশুচি হয়ে গেল?


তিতলি নিজের মনকেই প্রশ্ন করল--- যে মেয়েটা অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হলো তার সেই মুহূর্তের ভয়ংকর অবস্থার কথা স্বামী নামক পুরুষটি ভাবলো না একবার ? সাত দিন ধরে একটা মেয়ে কিভাবে ওই কুকুর গুলোর অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে ছিল সেটা ভেবে তার চোখে এক ফোঁটা জলও এলো না ? এই বুঝি ভালোবাসা?একটা পরিপূর্ণ সংসার টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে গেল, তার হৃদয়ে একটা আঁচড় না কেটেই ? ছেলেটার ভবিষ্যতের কথাও ভাবলো না আর !


        পুরুষের কাছে নারী শুধুই ভোগের বস্তু !জিতেন বাবুর হাতের স্পর্শে আবেগ থাকলে, ভালোবাসা থাকলে সুজাতা ম্যাম পাগল হয়ে যেতেন না। তাঁর দৃষ্টির গভীরতা দেখেছে,জিতেন বাবুর দূরে সরে যাওয়া । চার দেয়ালের ভেতর জিতেন বাবু কি আচরণ করতেন স্ত্রীর সঙ্গে সে কথা বাড়ির কাজের লোকেরাও বাইরে আলোচনা করত। দিনের পর দিন কাজের লোকেরাই তাঁকে খেতে দিত তাঁর সঙ্গে বসে একটা দুটো কথা বলার চেষ্টা করত।জিতেন বাবুকে ওই দুর্ঘটনার পরে কখনও তারা সুজাতা ম্যাম এর ধারে-কাছে যেতে দেখেন নি , গল্প করা তো দূরের কথা ! সে কথাও জানাল টিনা ।


তিতলি বুঝল ,বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাননি সুজাতা ম্যাম।বাঁচার জন্য ভরসার একটা কাঁধ প্রয়োজন ছিল , ছিল শক্ত করে জড়িয়ে রাখার জন্য সবল দুটো বাহু। বিনা দোষে একটা জীবন শেষ হয়ে গেল! এই পৃথিবীর পুরুষ মানুষগুলো এতটাই স্বার্থপর? ছিঃ !


            তিতলি টিনাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে। সুজাতা ম্যাম বড় প্রিয় ছিল তার ।

Friday, August 12, 2022

ছোট গল্প - মোহর আলির ছায়া বেগম || লেখক - ঋভু চট্টোপাধ্যায় || Short story - Mohor alir Chaya Begam || Written by Rivu Chottopaddhay


 

মোহর আলির ছায়া বেগম

                ঋভু চট্টোপাধ্যায় 

                     


দুহাতে লুঙ্গিটা গোটাতে গোটাতে দোকানের সিঁড়িতে পাদুটো রাখতেই দিলিপ দে জিজ্ঞেস করে উঠলেন, ‘কি রে মোহর আজ এত তাড়াতাড়ি দোকানে এলি, খদ্দের নাই?’ 

–না এই যে আপনি আসবেন তার জন্যেই সব বন্ধ রেখেছি।

আগুনে ঘি পড়বার মতই দপ্ করে জ্বলে উঠলেন দিলিপ দে, ‘মুখ সামলে কথা বল, আমি যাবো তোদের ঐ বেশ্যা ঘরে?’ তারপরে দোকানির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবু, এই সব লোককে দোকানে উঠতে দিবি না, তাহলে কিন্তু তোর দোকানে আর পা মাড়াবো না।’ 

–সে আপনার মন দিলিপদা। কিন্তু আপনারই বা এত প্রশ্নের কি আছে ?

-বটে এখন আমার এত প্রশ্নের কি আছে। বেশ আমিও দেখব কি ভাবে এই মোড়ে তোর দোকান থাকে আর কিভাবে ঐ শালার কাড্ডু ঐ সব নোংরামো করে। 

শেষের কথাগুলো বলেই দিলিপ দে একরকম ঝাঁপিয়ে দাশ কাকিমার বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোহর সেই দিকে একবার চোখ দুটো রেখে আস্তে নিজের মনেই বলে উঠল, ‘বাল ছিঁড়বি।’ তারপর দোকানি বাবুদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শালার পিড়িত আবার আরম্ভ হয়ে গেছে?’ 

–হ্যাঁ হ্যাঁ, কদিন একটু বন্ধ ছিল, দাশের ছোট ছেলের বউ নাকি কি সব অপমান করেছিল।এই ব্যাটা দিলিপ বলেছিল, ‘তোমার ঘরে মুততেও আসব না।’, আবার এখন যেতে আরম্ভ করছে।শালা ঢ্যামনা লোকের কোন মান সম্মান বোধ আছে নাকি, কুকুরের অধম, রুটিনও এক্কেবারে বাঁধা।সকালে ঐ সাহার বাড়ি, জল খাবার খেয়ে দাশের বাড়ি, আর সন্ধের দিকে দে বাবুর বিধবা বউটার ঘরে বসে থাকা।

– বউ কিছু বলে না ?

-বলে হয়ত, আমরা তো আর দেখতে যায় না।এই কয়েকদিন আগে স্ট্রোক হয়েছিল।ছেলেটাও তো বাইরে কাজ করে।শুনেছি বউটাকে বাইরে বেরোতেই দেয় না।

–আরে আমার সাথে দেখা হলেই  জিজ্ঞেস করে, ‘নতুন মাল এল নাকি?’ আজ ঐ জন্যে দিলাম।তারপর জানো গেল মাসে কারা কোন অফিসারকে চিঠি করে এসেছিল। দাদা ফোন করে জানল, কয়েকজন নাকি এদের পার্টিকে বলে এই সব করিয়েছে।তার মধ্যে এই শালাও ছিল।কিন্তু তাতে দাদার কি ছেঁড়া গেল? বিরাট ঢেমনা লোক, তুমিও সাবধানে থাকবে।

-আমাকেও একবার বলেছে, ‘কাড্ডুর ওখানে যা দুটো মাল এসেছে, এক্কেবারে তরমুজ।’ আমি বলেও দিয়েছিলাম, ‘একবার ঘুরে আসুন।’ শুনে জিব বের করে বলে, ‘আমার এই ঠিক আছে।’

একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।বাইরে লোকজনও একটু কম।মোহর আলি অন্য দিনের থেকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে।এমনিতে প্রতিদিন সকাল মানেই দশটার কম না।আর উঠবেই বা কি করে প্রতিরাতে শুতে শুতে খুব কম করে তিনটে হয়।এই কোয়ার্টারে যত কাজ সব তো রাতেই।সকালের কাজ বলতে, এই একটু বাজার করা, একটু রান্নাতে সাহায্য করে দেওয়া, আর মেয়েগুলোর কিছু কাজ করে দেওয়া।এখানেই সময়টা মারায়।মাগীগুলোর কাজ আর শেষ হয় না, তাদের কাপড় কেচে দেওয়ার থেকে আরম্ভ করে প্রতিদিনের চাদর কাচা।কয়েকমাস আগে কাড্ডুদা একটা কাচার মেশিন কিনলেও তাতে সব কাচা হয় না।জিজ্ঞেস করলে বলে,‘কারেন্টটা কোথা থেকে আসবে?’মোহর গাল দিলেও কাচাগুলো নিয়ে বাইরে বসে।ঘরের তো অনেকগুলো চাদর।সব ভালো তবে মেয়েগুলোর কাপড় কাচতে খুব খারাপ লাগে, ঘেন্না করে।কত দিন সায়া বা প্যান্টে কত কিছু লেগে থাকে।তিনটে ঘরের বিছানার চাদরও প্রতিদিন কাচতে হয়।শালাদের কোন ইয়ে নাই, চাদরেই সব ফেলে রাখে।কোন দিন ঘরের বেগমটার কোন কিছু কাচল না, এখানে ঐ সব কাচা। কোন কোন দিন আবার  বাথরুমের ভিতর ঢুকে মাগীগুলোর পিঠের ময়লা তুলতে হয়। মোহরের এই কাজটা ভালো লাগলেও বেশি ক্ষণের সুযোগ পায় না।আবার একটু এদিক ওদিক হাত গেলেই ওরা বলে ওঠে,‘ওরে শালা, মাগনাতে পাবি নাকি?’  মোহর হাসে। বলে, ‘তোমাদের কত কাজ করে দি বল তো।’ 

–কাজ করিস মাইনে পাস।তার ওপর উপরি তো আছেই।

তবে বাজারটা বেশ কয়েকবারেই যেতে হয়। সেটা মোড় মাথার ছোট বাজার হোক বা একটু দূরে বড় বাজার। বাজারে বার বার যেতে যেতেই মোহরের সবার সাথে একটা জানা শোনা হয়ে গেছে, গল্প করে।পাড়ার লোকের সাথে দেখা হলে কথাবার্তা বলে।মোড় মাথাতে বিল্টু মাস্টারের বাড়ি।কোথাকার এক সরকারি স্কুলের মাস্টার। দেখা হলেই মোহর তার সাথে কথা বলে। দু’এক বার তার সাথে বাজার থেকে বাইকে চেপে ফিরেছে।কিছু জিজ্ঞেস না করলেও মাঝে মাঝে বলে, ‘পাড়ার মাঝে এটা ভালো দেখায় না, কিন্তু আমার কি বল। পার্টির লোক নেতা, বা সরকারি কোন লোক কেউ তো কিছু বলে না, আমার কি বল।’ মোহর অবশ্য কাড্ডুদাকে এই কথাগুলো বলে নি। 

সারাটা দিন মোহরের খুব পরিশ্রম হলেও রাতে বেরোনোর সময় সব কাস্টমারই কিছু না কিছু দিয়ে যায়।ভালো লাগা বলতে এটাই।এমনি তো কাড্ডুদা লোকটা ভালোই।মাসের প্রথমে পেমেন্ট দিয়ে দেয়।দোকান বাজার থেকেও টুকটাক ভালোই হয়।খরচাও তো কিছু নেই খাবার দাবার সবটাই ফিরি।দু’ এক গ্লাসও সন্ধের দিকে জুটে যায়।এই নিয়ে অবশ্য তার নিজের গ্রামের লোকের রাগ আছে।গ্রামে কয়েকমাস আগেই বড় মসজিদে এক সন্ধের দিকে খেপ বসেছিল।কে নাকি গাঁয়ে মোহরের কথাগুলো রটিয়ে দিয়েছিল।অবশ্য শুধু সে জন্যি নয়, তাও মোহরের কথাটা আলোচনা হল।এখন আর সবার সব কথা শুনতে ভালো লাগে না।কাছে গাঁ হলেও সপ্তাহে একবারই যায়। আব্বা আম্মি নাই, এখানে কাজ করতে ঢোকার পরে ভাই বোনেরাও আর যোগাযোগ রাখে না।শুধু  ডালিয়া বেগম তার জন্যেই সপ্তাহে একবার সকালের দিকে যেতে হয়।বিয়ের চার বছরেও ছেলে মেয়ে হয়নি বলে গাঁয়ের সবাই বলে, ডালিয়াও বলে। মোহর রাতে থাকতে পারে না। রাতে থাকবার কথা শুনলেই কাড্ডুদা রেগে যায়।বলে, ‘কাস্টমার এলে কে দেখবে আমি? তুই ভোরের আলো ফুটলে প্রতিদিন যা, বিবির পোঁদে মাথা রেখে ঘুমা, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।আমার লক্ষ্মীরা উঠে গেলে তোর কাজ শুরু।’ সারাটা রাত জেগে এমন ভাবে সকালে যাওয়া যায়?

কথাগুলো শুনলে আবার ডালিয়া রেগে যায়।বলে, ‘তোমার আমাকে কেন ভালো লাগবে, ঐ সব বেবুশ্যে মাগীদের সঙ্গে থাকলেই তো সব পাবো।ঘরের বউকে তখন কি আর মনে লাগে?’ 

মোহর ডালিয়াকে বলতে পারে না সেই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।তবে মোহরের ডালিয়াকে নিয়ে খুব গর্ব।এখনো গাঁয়ে ঘরে এমন বউ সবার ঘরকে দেখা যায় না, নামটাও বেশ।কিন্তু কাড্ডুদার জায়গাতে তো কোনদিন কারোর সাথে কিছু করে নি।শুধু তাদের খোলা পিঠে ব্যাথার মলম লাগিয়ে দিয়েছে, সাবান লাগিয়ে ময়লা ঘষে পরিষ্কার করে দিয়েছে।পাঁচজনের শরীরে কার কোথায় কি আছে দেখলেও কারোর শরীরের ভিতরে ঢোকার সাহস হয় নি। বলা যায় না কাড্ডুদা জানতে পারলে মাইনের অর্ধেকটাই না কেটে নেয়।যে লোকটা থানার বড়বাবুর কাছ থেকে পয়সা নেয় তার কাছে আশ্চর্যের কিছু নেই।মুসকিল হল কাড্ডুদার বাকি কোন কথা শোনা যাচ্ছে না।কবে থেকে বলছে, ‘শালা মোহর নতুন মালের সন্ধান কর, পুরানো এই সব বুড়ি মাগীদের দিয়ে আর কত দিন চালাবো বলতো?’ 

–দাদা মাল তো আসছে।ঐ যে দুটো বৌদি আসছে, তাদের দিয়ে তো....

-ওরা তো সন্ধে বেলায় আসে।রাতের বেলাতেই তো বেশি লোক আসে।তাদের জন্যেও তো ভাবতে হবে।তুই এক কাজ কর, ঐ কুঞ্জবতি কমপ্লেক্সের তপন স্যারের বাড়িতে একবার যা।ঐ শালীকে ফোনে পাচ্ছি না।কিছু কলেজের মালের কথা বলছিল, বলবি আমি লক্ষ্মীশ্রী গেস্ট হাউসে কথা বলে রেখেছি। মালের কথা বললেই ফোন নম্বর দিয়ে দেব। আর ঐ মুচিদের বাড়ি যাচ্ছিস? ছোট বউটার সাথে কথা বল। তোর গাঁয়ে গেলেও মাথায় রাখিস। 

মোহর সব কথাগুলো শোনে।তপন স্যারের বাড়ি এর আগে কোন দিন যায় নি। শুনেছে কোন এক সরকারি ইস্কুলের মাস্টার বটে।তবে ওর বউটার হাতে অনেক মাগী।এখানকার অনকেগুলো কলেজের মেয়ে ওর হাতে।মোহর কুড়োঝোর মোড়ের মদের দোকানে অনেকবার মেয়েগুলোকে মদ কিনতে দেখেছ।শালিদের কুনু লজ্জা নাই।যা ডেরেস পরে দেখেই মোহরের টনটন করে ওঠে, পেলে চটকে খাল বানিয়ে দেবে।কয়েকদিন আগেই বাজারের একটা সব্জির দোকানে কয়েকজন বলাবলি করছিল,‘বাপেরা পড়তে পাঠায়, আর ওরা এখানে এসে ফস্টি নষ্টি করছে।’ তাতে অবশ্য মোহরের কোন দরকার নেই, দুএকটা এখানে এলে সবার সাথে ওর নিজেরও লাভ।

ঘরে ঢুকে দোকানের ব্যাগটা নামাতেই একটা ঘরের ভিতর থেকে গলা ভেসে আসে, ‘কিরে মোহর এলি? একবার এঘরে আসবি।’ মোহর বুঝতে পারে সুলেখাদি ডাকছে।এখানকার সব থেকে সুন্দরী, সেরকম দেমাক। প্রতিদিন তিনজনের বেশি কাউকে ঘরে নেয় না। রেটও বেশি।কাড্ডুদা বেশ তোয়াজ করে।চেনা কাস্টমাররা এসেই তাকে খোঁজে, না পেলে অনেকে বসেও থাকে।তবে খুব কিপটে, কিছু কিনতে দিলে সব পয়সার হিসাব নেয়। মোহর বুঝতে পারে এখন ডাকা মানেই কিছু আনতে বলবে। ইচ্ছে না থাকলেও মোহর  ঘরে ঢুকে বলে, ‘কিছু আনতে হবে নাকি?’ 

–হ্যাঁরে। মোড় মাথায় তপুদার দোকান খুলেছে? দুটো প্যাড আনতে হবে।

–প্যাড! কাড্ডুদা জানে?

-বালের বকিস না মোহর, আমার মাসিক কি কাড্ডুদাকে জিজ্ঞেস করে আসবে?

-তুমি আনতে বলছ এনে দিচ্ছি, আজ কিন্তু শনিবার। তুমি ওষুধ খেতে পারতে, আগের মাসেও ঝামেলা হয়েছিল।

সুলেখাদি শেষের কথাগুলো শুনে কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠল, ‘আমি  সন্ধে থেকে ওপরের  কোয়ার্টারে চলে যাবো, আজ দুটো বৌদি আসে না? ফোন করে ওদের একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল, তাতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। আর কাড্ডুদাকে বলবি, আমার খুব জ্বর।’

-সে তোমরা যা খুশি করগে, আমাকে যেন কিছু না শুনতে হয়।

–তোকে কি শুনতে হবে রে বোকাচ্চোদা? কিছু কি শুনতে হয় ? গেঁড়ে বেশি ফ্যাচফ্যাচানি করিস না। 

কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাশের কোর্য়াটার থেকে চট্টরাজ কাকুর গলা কানে এল।মোহর এবার বাইরের বাগানে বেরিয়ে আসতেই কাকু তাকে দেখে খুব রেগে বলে উঠলেন, ‘কাড্ডু কইরে?’

–দাদা তো এই সময় থাকে না।

–কতবার বলব, বাইরে একটা সব সময়ের জন্য লোক রাখ। কালও সন্ধেবেলাতে আমার কোয়ার্টারে তোদের লোক  চলে এসেছিল। আমার বাড়িতে ছেলের বৌমা আছে, নাতনীরা আছে। এরকম করে তো থাকা যাবে না।

-কিন্তু কাকা সন্ধেবেলাতে তো আমি বাইরেই ছিলাম। 

-তাহলে কি আমি মিথ্যে বলছি ? 

–না কাকা, তা কেন হবে? হয়ত আমি সেই সময়টাতে দোকানে গিয়েছিলাম। ঠিক আছে আমি দাদাকে বলে দেব।

মোহরেরও মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।যত সব উটকো ঝামেলা।কাড্ডুদাও এই সময় থাকে না, মাগীগুলোতো কেউ বেরোবে না, দাদা বারণও করে গেছে।মোহর কখনো কারোর সাথে খারাপ কথা বলে না, খারাপ ব্যবহার করে না। কাড্ডুদা এক্কেবারে বারণ করে দিয়ে বলেছে, ‘শোন, ব্যবসা করতে গেলে লোকাল লোকদের এক্কেবারে ঘাঁটাবি না। মনে রাখবি টাউনসিপে এই রকম একটা ব্যবসা করা খুব কিচাইন কাজ, আমি যতই টাকা ছড়াই, একটু এদিক ওদিক করলেই পিছনটা মারিয়ে যাবে।’ 

মোহর এই ব্যাপারটা ভালোই শিখে নিয়েছে, ঠিক দাদার মতই।দাদা এই ঘরের ভিতরে যতই সবাইকে খিস্তি মেরে কথা বলুক, বাইরে সবার সাথে এত ভালো ব্যবহার করে যেন ওর থেকে ভালো লোক আর কেউ নেই। মোহরও কাড্ডুদা না থাকলে এই সব ব্যাপার গুলো বেশ ভালোই সামাল দেয়।কাড্ডুদাকে আরেক জনকে কাজে নিতে বলতে হবে।ও ব্যাটা সব সময় বাইরে থাকবে, কিছুতেই ঘরের ভিতরে কোন কাজে আনা যাবে না।সব ব্যাটা বদমাইস ঘরের ভিতর এলেও আবার অন্য ধান্দা করবে। কিন্তু বিশ্বাসি লোক কোথায়, গাঁয়ের কাউকে বলবে?   না, উপরিগুলোও তো দুভাগ করতে হবে। পরে সব ভাবা যাবে। 

একটা ভাঙা ছাতা নিয়ে তপন স্যারের বাড়ির দিকে যাবার রাস্তায় পিছন থেকে তার নাম শুনে থমকে দাঁড়াতে হয়। ঘাড় ঘোরায়, দেখে কবির চাচা ডাকছে।একটা কোয়ার্টারের বাগানের কাজ করছে। মোহর কাছে যেতেই বলে, ‘তুই এই কাজ ছেড়ে কি করছিস বলতো? গাঁয়ে কিন্তু কথা হচে।তুর বউটকে সবাই বলছে।’ 

সেই সময় চাচার কথাগুলো ভালো না লাগলেও রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো মনে আসে।সত্যিই তো এই টাউনসিপে বাগানের কাজ করতেই আসা।কোথা থেকে কিভাবে যে জড়িয়ে গেল কে জানে?এখন আর বাগানের কাজ করতেও ভালো লাগে না।এই রকম পয়সাও তো নাই। 


                                                 ২

  


কয়েকমাস ধরেই কাড্ডুর মটকা গরম।কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে। ব্যবসাটা আগের মত আর চলছে না। মোহরের প্রথম দিন গুলোর কথা মনে পড়ে। প্রতিমাসে একটা কোয়ার্টারে বাগান পরিষ্কার করত মোহর। সেখানেই যাতায়াত ছিল কাড্ডুদার।একদিন নিজের থেকে  বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে। দিনে কত রোজগার হয়, বাড়িতে কে কে আছে এই সব। সব শুনে দেখা করতে বলে। তারপরেই এই কাজে ঢুকতে বলে।মোহর প্রথমটাতে রাজি ছিল না।ঘরে কেউ নাই, কাউকে জিজ্ঞেস করবারও কিছু নেই, তাও গাঁয়ের লোক কাজের কথা শুনেই বলে,‘শেষে বেশ্যাবাড়ির কেয়ারটেকার! এটা আবার কাজ হল?’

ডালিয়াও রাজি হয় না,বলে,‘না না, এমন কাজ করতে হবে না।তার থেকে গাঁয়ে থাকো, মাঠের কাজ কর, টাউনশিপে বাগানের কাজ কর, একশ দিনের কাজ তো থাকলই।’ 

কাড্ডুদা লোভ দেখায়,‘বাগানে কত টাকা পাবি?এখানে মাইনে পাবি।প্রতিরাতে উপরি পাবি, বাবুদের পান সিগারেট এনে দিবি, বাবুরা কি টাকা ফেরত নেবে? সেই সব তো তোর। আর গাঁয়ে তুর বউ থাক, এই তো রাস্তা, একফাঁকে গিয়ে দেখে আসবি।’মোহর কাজে ঢোকে।সেই সময় সন্ধে থেকেই সারি সারি গাড়ি এসে কোয়ার্টারের সামনে ছোট্ট ফাঁকা জায়গাতে দাঁড়াতো।শনি বা রবিবার গাড়ি বাড়ত।অনেক লাল বাতি মাথার গাড়িও থাকত।মোহর গাড়িগুলো রাখার ব্যবস্থা করে দিত, সিগারেট, পান এনে দিত। বোতল কাড্ডুদা এনেই রাখত। তাও বিশেষ প্রয়োজনে রাতের দিকে তপুদার দোকানে বোতল আনতে যেতে হত। তপুদা দিনের বেলা বোতল না দিলেও অনেক রাত অবধি দোকান খোলা রাখত।তখন কাড্ডুদা ব্যবসাও চলছে রমরম করে।মোহর কাজে ঢোকার পরে ভাইবোনেরা পরিষ্কার বলে দেয়,‘এক্কেবারে বাড়ির দিকে আসবি নাই।বেশ্যা ঘরের দালাল, তুর নজর সব সময় মাগীদের দিকেই থাকবেক, আমাদেরও বউ বাচ্চা আছে।’ দাদা দিদিদের সাথে না যোগাযোগ থাকলেও মোহর ডালিয়েকে ভুলিয়ে দেয়।প্রতিদিনই গাঁয়ে যাবার সময় স্নো, পাউডার শাড়ি, ব্লাউজ, বা কোন গয়না, বা খাবার কিছু না কিছু কিনে নিয়ে  যায়।ডালিয়া খুশি হয়, শুধু বেগমকে কাছে টেনে আদর করবার সময় হাঁপিয়ে যায়। ডালিয়া বলে ওঠে, ‘তুমার জানে আর তাগদ নাই, তুমি ঐ বেশ্যা বাড়ির কেয়ারটেকার হয়েই থাকবে।’ মোহরের কথাগুলো ভালো লাগে না, জানে লাগে। কিন্তু করবার কিছু নাই। দুপুরের আগে আস্তে আস্তে কাড্ডুদার কোয়ার্টারে ফিরে আসতে হয়।ডালিয়া রাগে, বলে ওঠে,‘এই রকম ভাবে রাতের পর রাত একা ভালো লাগে না, তুমি অন্য কাজ দেখো।’

-অন্য কাজ কোথায় পাবো ?

-কেন গাঁয়ের বাকি সবাই কি করছে ? তারা কি সবাই বেশ্যা বাড়িতে কাপড় কাচার কাজ করে।তোমার অন্য ধান্দা আছে, সেটা বল। তোমাকে বললাম শুনলে ভালো না হলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

রেগে ওঠে মোহর। অন্য ধান্দা! থাকলে আরো দুতিনটে বিয়ে খুব সহজেই করতে পারত। মোল্লা পাড়ার আসমিনার এখনো নিকা হয় নাই, রাস্তায় দেখলেই কথা বলে, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে।কয়েকমাস আগেই একটা জলসা শুনতে গিয়ে এক্কেবারে পাশেই বসে ছিল। গান শুনে এক্কেবারে গায়ে পড়ে যাচ্ছিল, বললে, ‘আমার একটা কাজ দেখে দাও না গো, খুব অসুবিধা, ভাইট পালাইছে, একা আব্বু আর পারে না।’ কাজ তো আছে, কিন্তু সে কি তুর জন্য আসমিনা। কথাগুলো বলতে পারে না। যেমন ডালিয়াকে আসমিনার কথা বলতে পারে না। তবে ডালিয়া কয়েকবার আসমিনার কথা বলেছে। মোহর অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে নি। আরো অনেক কিছুই তো জিজ্ঞেস করতে পারেনি, করলে এক্ষুণি ঘরে চলে আসবে।ডালিয়ার সেটাই ভালো হবে, থাক সতিনের সাথে।মোহর আস্তে আস্তে কাড্ডুর বাড়ির  দিকে পা বাড়ায়। 

                                             

                                                ৩ 


কাড্ডু এখন প্রতিদিন সন্ধেবেলা এই কোয়ার্টারে এসে যায়।কিছু দিন আগে পর্যন্ত সকালে সব কিছু দেখবার জন্য একবার আসত, আর শনি রবিবার সন্ধেবেলাটাতে থাকত।এখন প্রতি সন্ধেয় আসতে দেখে মোহরের একটু সন্দেহ হয়।এক সন্ধেয় কাড্ডুর কাছে দাঁড়াতেই দাদা বলে ওঠে, ‘দিন ভালো নয় মোহর, ব্যবসা ভালো হচ্ছে না।ঐ শালা তপন স্যারের বউ খুব বাওয়াল দিচ্ছে, কোথা থেকে নতুন নতুন মেয়ে আনছে কে জানে, রেট কম দিচ্ছে, শালা বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তার উপর চারদিকে বিউটি পার্লার গুলো তো আছেই।’

মোহর তপন স্যারের বউএর সাথে একবার দেখা করতে গেছিল।দেখে বুঝতেই পারেনি এই মাগী এত বড় ব্যবসা চালায়।কি সুন্দর বাবু বাবু বলে কথা বলে।মোহর যখন বাড়িতে পৌঁছালো তখনই স্নান করে বাগানে কাপড় মেলছিলেন। মোহরকে বাড়িতে বসিয়ে চা খাওয়ানোর পর কাজের কথা শুনে বললেন,‘বাবুরে সবই তো বুঝলাম, তুই কাড্ডুকে একবার আসতে বলিস, আমি কথা বলবো।’ 

মোহর একটু অবাক হয়।কাড্ডুদাকে ফিরে সব কথাগুলো বলতেই কাড্ডুদা উত্তর দেয়, ‘মাগী মহা ঘোরেল মাল, এক হাটে কিনে বিক্রি করে দেবে, অথচ কাউকে বুঝতেই দেবে না, তুই এক কাজ কর, মাল জোগাড় কর, আরো এক্সট্রা পাবি। বাড়ির বৌ, মেয়ে কেউ বাদ নয়, যত মাল আনবি, তুই তত মাল পাবি।’ 

মোহর এবার ছুটে বেড়াতে আরম্ভ করে। আশে পাশে অনেকগুলো গার্লস হোস্টেল আছে।মোহরে সেখানে যাওয়া আরম্ভ করে, তাদের গেটে দারোয়ানদের সাথে আলাপ করে।তার নিজের গ্রামের কয়েকজন লোককে পায়। কিন্তু সেই রকম সুবিধা করতে পারেনা। তাদের মাধ্যমে প্রতিটা হোস্টেলের কয়েকজনের সাথে কথাও হয়। আস্তে আস্তে সব দিক দেখতে পায়, ফোন নম্বর জোগাড় করে কাড্ডুদাকে দেয়।এদিকে শহরের বেশ কয়েকটা ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।কাড্ডুদার কথা মত মোহর কয়েকজনের বাড়িতে যোগাযোগ আরম্ভ করে।আরো কয়েকজন বৌদি নিয়মিত ভাবে আসতে আরম্ভ করলেও কাড্ডুদার পছন্দের কলেজের মেয়েরা আসে না। কথায় কথায় মোহরকে বলে, ‘খানকির ছেলে সেই ঝোলাবুড়িদেরকেই পেলি, এবার সারারাত তুই মারা।’ রাত নামলে  কোয়ার্টারের সামনের ভিড়টা না বাড়লে কাড্ডুদা আরো রেগে যায়। খিস্তি করে।

                                              

                                              ৪  


 মোহরের এখন কাজের খুব চাপ। অনেক জায়গা ঘুরতে হয়।এক মাস গাঁয়ে যেতেই পারে নি।মাঝে একদিন কবির চাচার সাথে দেখা হতেই চাচা অনেক কথার মাঝে বলে, ‘তুর বৌটাকে এবার সামলা, তুই তো  যাওয়া বন্ধ করেছিস, কিন্তু ও বেটি দুপুর দুপুর কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছ, সঙ্গে ঐ মুল্লা পাড়ার আসমিনাও থাকছে।’ 

–টাকা পাঠাচ্ছি তো চাচা।

-আরে টাকাতেই কি সব হয়? 

–ঠিক আছে আজ ফুলু বেটিদের একবার ফোন করব।

মাথাটা গরম হয়ে যায় মোহরের। কাড্ডুদাকে বলতেই দাদা অবশ্য হেসে বলে, ‘ভালোই তো এবার এখানে নিয়ে চলে আয়।দুজন মিলে রোজগার করবি।তোর বউ তোর কাছেই থাকবে।’

কথাগুলো মোহরের ভালো লাগেনা। কাড্ডুদা এখন আর মানুষ নাই।প্রতিটা মেয়ের মধ্যেই ব্যাবসা দেখছে। দু’জন আগের মাসে অন্য জায়গায় চলে গেল। কাড্ডুদা তারপরের দিনেই আরো দুজন নতুন মেয়েকে নিয়ে এসে বলে, ‘বুঝলি মোহর, আমার নাম কাড্ডু মজুমদার, এখানকার ওপর থেকে নিচ সব আমার কেনা, না হলে এই টাউনশিপে এই রকম ব্যবসা করতে পারি। দুটো মাগী আমাকে বলে কিনা আরো বেশি টাকা নেবে। আমি কিছু বলিনি, সোজা রাস্তা দেখিয়ে দিলাম। এবার চরে খা।এখানে আর কোনদিন মালের অভাব হবে না রে, ব্যবস্থা করে নিয়েছি, অনেকে বসে আছে, শুধু জানতে হবে।’

 মোহর এই সব জানে, কিন্তু সত্যিই কি মালের অভাব নেই? তাহলে এমন অবস্থা কেন হচ্ছে? আশে পাশে অনেক পুজো, অনুষ্ঠান, ব্লাড ডোনেশন, সবে কাড্ডুদা আগের থেকে বেশি করে টাকা দিচ্ছে।সব পার্টি খেয়ে আছে, কোয়ার্টারে অনেকে চাঁদার নামে টাকা নিতে আসে, মোহর তাদের হাতে টাকা তুলে দেয়, সব জানে। কারোর মুখে কোন শব্দ নেই। কোন পার্টি কিছু ঝামেলা করছে সে খবর দাদার কানে খবর যেতেই বড় পার্টি অফিসে ফোন করে সব গুছিয়ে নেয়।সব ঠিক আছে কিন্তু এখানে মাল নেই।তবে দাদা কয়েকদিন আগেই বলছিল, ‘এমনি ভাবে হবে না মোহর, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’ মোহর অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল,‘অন্য ব্যবস্থা কি?’

-এই শহরের চারদিক অনেক বিউটি পার্লার হয়েছে।বাইরে টাটকা মেয়ে ঘুরছে।এদের ধরলে মাল আর মাল।মোড় মাথার ওষুধের দোকানের বাবুদা বলছিল, পিলের নাকি এখন দারুন বিক্রি বেড়েছে।আর এই কলেজের মালগুলোর খরচাও খুব।এত টাকা কিভাবে আসবে বলতো? সব কামাচ্ছে।তুই একটা ভেড়া।একটাও ভালো মাল আনতে পারিস না।লোকে কত আর এই ধ্যাবড়া মাগীগুলোর জন্য আসবে বলতো? আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। 

মোহর একভাবে সব কথা শুনে যাচ্ছিল।কি বলবে? মনে হচ্ছে আবার সেই বাগানের কাজেই ফিরে যেতে হবে।গাঁয়ে যেতে হবে একবার।অনেকদিন ডালিয়াকে চটকানো হয় নি, আসমিনার কাছেও যেতে হবে, ওর আব্বার শরীরটাও ভালো নেই।তাছাড়া কবির চাচার কথাগুলোও শুনতে হবে।

কাড্ডুদাকে একবার ছুটির জন্য বলতে যাবে এমন সময় কাড্ডুদা মোহরের দিকে তাকিয়ে বলে,‘এই শোন তোদের গাঁ থেকে দুটো মাল ঐ তপনার বউ এর খাতায় নাম তুলেছে, এক্কেবারে নতুন মাল।দুপুর দুপুর বিউটি পার্লারে যায়। খুব চলছে এখন।তুই একটু এখানে আনা যায় কিনা দেখ। ’ 

–না দাদা, গাঁয়ের কাউকে কিছু বলিনা, একেই আমাকে লিয়ে সব কত কি কথা বলে। 

-আরে মাল ফেললে কোন মাল কোন কথা বলে না। তুইও গাঁয়ে মাল ছড়া, দেখবি সব শালা চুপ হয়ে গেছে। নে ফটো দুটো দ্যাখ।  

                                           ৫ 


দিন দুপুরে এ’পাড়াতে এর আগে এত পুলিশ কখনও আসেনি।পাড়ার লোকেও সব বাইরে বেরিয়ে দেখছে। কাড্ডুর কোয়ার্টার থেকে লাইন দিয়ে মুখ ঢেকে সব মেয়ে বেরোচ্ছে।কাড্ডুকে একটা বড় জিপে তুলেছে, পাশে আরেক ভদ্রমহিলাও আছেন।এপাড়াতে এই মহিলাকে কয়েকজন চেনে। তাদের থেকে সবাই জানতে পারে। ‘ইনি  এখানকার এক সরকারি স্কুলের তপন মাস্টারের বউ।’ 

শুধু ধরা পড়েনি মোহর আলি।কয়েকমাস আগেই ও কাজ ছেড়ে এখন গাঁয়ে থাকে।ডালিয়াকে ছেড়ে এখন অন্য আরেকজনকে নিকা করেছে। নাম রেশমা।আশমিনার আব্বু মারা যাওয়ার পর এখন তাকে আর গাঁয়ে থাকতে দেয় না, গাঁয়ে থাকে না ডালিয়াও। মোহর প্রতিদিন সকালে টাউনশিপে কোয়ার্টারে বাগানে কাজ করতে এসে কাড্ডুদার বন্ধ হয়ে থাকা কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে বার বার পেরিয়ে গেলেও ঘাড় তুলে তাকায় না।ভয় লাগে যদি কাড্ডুদা বুঝে ফেলে বিল্টু মাস্টারের চিঠির মাধ্যমে উপর মহলের সবাই সব কিছু জানতে পারলেও আসল কলকাঠি তো মোহর আলির হাতেই ছিল।অবশ্য কাড্ডুও কোন দোষ নেই।ও কি করে জানবে ছবি দুটো ডালিয়া, আর আসমিনার ছিল। 


উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -3


 



পিসেমশাই বললেন, এই লকডাউনে রাতের কলকাতায় হেনস্থার শিকার এক রুপান্তরকামী। অভিযোগ, একা পেয়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে তাঁর গায়ে। পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আক্রান্ত। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তে নেমে এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে ফুলবাগান থানার পুলিশ।কাঁকুড়গাছির সেকেন্ড লেনের বাসিন্দা বছর ২০–এর ওই রুপান্তরকামী শুক্রবার রাতে ওষুধ কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। সেই সময় এলাকাতেই আড্ডা দিচ্ছিল কয়েকজন যুবক। অভিযোগ, রুপান্তরকামীকে দেখতেই কটুক্তি শুরু করে তারা। এরপর আচমকা পিছন দিক থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে ওই যুবকেরা কেরোসিন ছুঁড়ে দেয় বলে অভিযোগ। এমনকী সেই সঙ্গে লাগাতার তাঁকে পুড়িয়ে মারার হুমকিও দেয় বলে জানা গিয়েছে। এরপর বাড়ি ফিরে গোটা ঘটনাটি জানানোর পর পরিবারের সঙ্গে ফুলবাগান থানার দ্বারস্থ হন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মেরে দিল রূপান্তরকামিকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে।এলাকার কয়েকজন যুবকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে ফুলবাগান থানা। শুক্রবার রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় এক যুবককে। যুবক সব দোষ স্বীকার করে তারা হয়তো ভবিষ্যতে ফাসি হবে কিন্তু মিনার কি হলো সংসার ভেসে গেল সে তার গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে আজ মৃত্যুর কোলে। মিনার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগলো। আর সেই রূপান্তরকামী রাস্তায় ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলো তাদের দেখা হল দুজনের তারা ঠিক করল এদের সর্বনাশ করবে।রূপান্তরকামী বলল আমাকে যে হত্যা করেছে তাদের সংসারের সবকটাকে আমি একা একা মারব আর এই মিনার আত্মা বলল আমাকে যে পুড়িয়ে মেরেছে একজন ধরা পড়েছে কিন্তু আরও পাঁচজন ছিল সবকটাকে আমি মারবো ।তারা কিন্তু কথা রেখেছিলো। পিসেমশায়,মানে তান্ত্রিক বললেন, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী,   ভূত হল মৃত ব্যক্তির আত্মা যা জীবিত ব্যক্তিদের সামনে দৃশ্য, আকার গ্রহণ বা অন্য কোনো উপায়ে আত্মপ্রকাশ গল্প প্রায়শই শোনা যায়। এই সকল বিবরণীতে ভূতকে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: কখন অদৃশ্য বা অস্বচ্ছ বায়বীয় সত্ত্বায়, কখনও বা বাস্তবসম্মত সপ্রাণ মানুষ বা জীবের আকারে। প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যদ্বাণী করার বিদ্যাকে  কালা জাদু বলা হয়ে থাকে।প্রাক-শিক্ষিত সংস্কৃতিগুলোর  মধ্যে ভূতের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়। সেযুগে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রথা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, ভূত-তাড়ানো অনুষ্ঠান ও জাদু অনুষ্ঠান আয়োজিত হত মৃতের আত্মাকে তুষ্ট করার জন্য। প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী, ভূতেরা একা থাকে, তারা নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, জীবদ্দশায় যেসকল বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল সেগুলিকে বা তাদের তাড়া করে ফেরে। তবে ভূত বাহিনী,এমনকি ভৌতিক জীবজন্তুর কথাও শোনা যায়।মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মা দেহত্যাগ করে। জীবাত্মা অবিনশ্বর। তবে কখনো কখনো জীবিত সামনে আকার ধারন করে। এটি পূরাণভিত্তিক একটি আধিভৌতিক বা অতিলৌকিক জনবিশ্বাস। প্রেতাত্মা বলতে মৃত ব্যক্তির প্রেরিত আত্মাকে বোঝায় ।সাধারণের বিশ্বাস কোনো ব্যক্তির যদি খুন বা অপমৃত্যু হয় তবে মৃত্যুর পরে তার হত্যার প্রতিশোধের জন্য প্রেতাত্মা প্রেরিত হয় । বিভিন্ন ধরনের কাহিনী ও রয়েছে এ সম্পর্কে । বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ভূতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করা হয়। আবার কিছু ধর্মে করা হয় না, যেমন ইসলাম বা ইহুদী ধর্মে। এসব ধর্মাবলম্বীদের মতে মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা চিরস্থায়ীভাবে পরলোকগমন করে আর ইহলোকে ফিরে আসে না। মিনার  খুনিরা একটা বাড়ি ভাড়া করে বাসায় এল মালপত্তর নিয়ে। তারা বড়লোকের ছেলে। ফুর্তি করে আর ধর্ষণ করে মারে মেয়েদের। পিসেমশায় বলছেন গল্প।তারা  নাকি পুরনো বাড়ি কিনে রিনোভেট করে বাস করছেন,অথবা নতুন ফ্ল্যাটে মুভ করেছেন। যা-ই করে থাকুন, মোদ্দা কথায়, নতুন বাসস্থানটিতে এসে স্বস্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। কেন জানা নেই, বার বার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ছন্দপতন রয়েছে। তালে মিলছে না সব কিছু। প্যারানর্মাল বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ব্যাপারটা মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। আপনার আবাসটিতে ‘তেনা’দের আনাগোনা থাকতেই পারে।ভূতে বিশ্বাস করুন বা না-করুন, এমন কিছু অস্বস্তি রয়েছে, যার সর্বদা চটজলদি ব্যাখ্যা হয় না। তেমন কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করেছেন জন এল টেনি-র মতো খ্যাতনামা অতিলৌকিক বিশেষজ্ঞ। টেনি জানাচ্ছেন, কয়েকটি বিশেষ দিকে নজর রাখাটা জরুরি এমন ক্ষেত্রে। তাঁর বক্তব্য থেকে পাঁচটি বিষয় তুলে দেওয়া হল—হঠাৎই আপনার মনে হল, পিছন থেকে কেউ আপনার কাঁধ বা পিঠ স্পর্শ করল। ফিরে দেখলেন, কেউ নেই। তন্ত্রমতে, এমন ক্ষেত্রে সাবধান। স্পর্শকারী রক্তমাংসের জীব না-ও হতে পারেন। যদি মনে হয় ঘরের আসবাবপত্র নিজে থেকেই স্থান পরিবর্তন করছে, তা হলে খামোখা ভয় পাবেন না। তিনি জানাচ্ছেন, এমন ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভৌতিক না-ও হতে পারে। নিজেই হয়তো সরিয়েছেন সেন্টার টেবল  তার পরে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু যদি খাটখানাই টোটাল ঘুরে যায় অথবা চেয়ার উল্টো হয়ে বিরাজ করে, তবে ভাবার অবকাশ রয়েছে।আবার নতুন বাসায় পা রেখে যদি শোনো সেখানে কেউ আগে মারা গিয়েছেন অথবা যে জমিতে বাড়ি করেছে কেউ সেটি আগে কবরখানা ছিল, তা হলে ভয় আছে।  পুত্রহারা গৌতমীকে তথাগত বলেছিলেন এমন কোনও বাড়ি থেকে একমুঠো সরষে নিয়ে আসতে, যেখানে মৃত্যু বা শোক প্রবেশ করেনি। তার বক্তব্যও একই প্রকারের। মৃত্যু একটা সাধারণ বিষয়। তা কোথাও ঘটে থাকলেই যে প্রেত কিলবিল করবে তার কোন কথা নেই। 


পিসেমশাই  আজ নতুন একটা গল্প শুরু করলেন। সেদিন ছিল ভীষণ কুয়াশা। শীতকালের পৌষ মাসের সকাল। যথারীতি ভোর পাঁচটার ট্রেন ধরে হাওড়া যাবে বলে লাইন পার হচ্ছিল মনোজ। আর ঠিক সেই সময়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছিল গ্যালোপিং ট্রেন। তাকে পিষে দিয়ে চলে গেল নিমেষে।একটু পরেই মনোজের শরীর বেশ হালকা লাগছে। সে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করলো। কিন্তু দেখলো সে হাওয়ায় ভাসছে কেন? আর তার শরীরটা পড়ে আছে লাইনের উপর।শরীর ছাড়া হয়ে মনোজ বেশ উপরে উঠে উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগল। তারপর দুপুর গড়িয়ে রাত নামলো রাতে আরো অনেকে শরীর ছাড়া। শরীর ছাড়া আত্মা উড়ে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে তার কাছে এলো। সকলের সাথে পরিচয় হলো। সে দেখল সে একা নয় তাদের একটা দল আছে। মনোজের আত্মা দেখছে,  আজ সুপার মার্কেটের পুরো গাছগাছালির আড়াল ঘিরে শুরু হয়েছে পৌষ পিঠের মেলা। এই মেলার সামনের পাড়ায় বস্তি এলাকায় কিছু গরীব সংসারের আবাস। তারা সুপার মার্কেটের সামনে থাকে এই নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। কারণ এই মার্কেট জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় মেলা,সার্কাস আর বাজার। আর সেখানে কাজ করে তাদের ভালমন্দ খাবার জুটে যায়। শুধু বর্ষাকালে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তখন ঝড়ে ডালপালা ভাঙ্গে আর সেই ডালপালা নিয়ে এসে তারা বাড়িতে ফুটিয়ে নেয় দুমুঠো চাল। পুকুরের গেঁড়ি, গুগুলি তখন তাদের একমাত্র ভরসা। শরীরবিহীন মনোজ দেখছে,  আজ পৌষ পিঠের মেলা। দুটি বছর দশেকের শিশু চলে এসেছে মেলায়। তাদের টাকা পয়সা নেই। ঘুরে বেড়ায় উল্লাসে। তারপর বেলা বাড়ে আর তাদের খিদে বাড়ে সমানুপাতিক হারে। খিদে নেই ওদের যারা ঘুরে ঘুরে পিঠে খায়। ফেলে দেয় অর্ধভুক্ত পিঠের শালপাতার থালা। ডাষ্টবিন ভরে  যায় খাবারসহ শালপাতায়। শিশু দুটি লোভাতুর হয়ে ওঠে। পাশে আলো মুখে একজন মহিলা এগিয়ে আসে। সে বলে, তোদের বাড়ি কোথায়। শিশু দুটি দেখিয়ে দেয় তাদের পাড়া। মহিলা বলে, আমাকে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবি?  শিশু দুটি হাত ধরে নিয়ে আসে তাকে। পথে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাটি বল, আমি তোদের দিদি। আমাকে দিদি বলে ডাকবি।বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শিশু দুটি বলে, মা মা দেখ দিদি এসেছে আমাদের বাড়ি। মা তো অবাক। তারপর জানতে পারে সব। পেতে দেয় তালপাতার চটাই। একগ্লাস জল খেয়ে দিদি ব্যাগ থেকে বের করে পিঠের প্যাকেট। সকলে একসাথে বসে খায়।দিদি বলে শিশু দুটির মা কে,  আমার ছেলেপুলে হয় নি। তোমার বাচ্চাদের দেখে চলে এলাম তোমাকে দেখতে। জানো ভগবান, সকলকে সবকিছু দেয় না। তোমাকে যেমন টাকা পয়সা দেয় নি আর আমাকে আবার সন্তান দেয় নি। তোমার পুত্রসন্তানদের আমি আজ থেকে দেখাশোনা করব। তুমি অনুমতি দাও    ।


 ৬


মনোজ মরে গিয়েও পৃথিবীর মায়া ছাড়তে পারে নি। আকাশে ওড়ে আর মানুষের সুখ দূঃখ দেখে। হাওয়াতে ভেসে চলেছেন সুদর্শন বাবু । ফুরফুরে মেজাজে তার নিত্য আসা যাওয়া   কলেজের পথে ।একজন ছাত্রী তার নিত্য সাথী । ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা, কলিগরা অন্য চোখে দেখে । বাঙালি একটি যন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করে ।সেটি হলো ষড়যন্ত্র । হাসতে হাসতে বলেন কলিগদের ।উত্তরে তারা বলেন ,সত্য উদ্ঘাটিত হোক । বেশ কয়েক মাস পরে একদিন কলেজ ছুটির পর পিছু পিছু কলিগরা তাদের অনুসরণ করলো । সুদর্শন বাবু ছাত্রীদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কলেজ ছুটির পরে। কলিগরা বাইরে থেকে দেখলো শিক্ষক ও ছাত্রীরা পড়াশুনোয় ব্যস্ত।  তারা শিক্ষার  আলোর সাধনায় নিবিষ্ট ।অব্শ্য সঠিক সময়ে ছাত্রীটির অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য কলেজের সকল অধ্যাপকদের  পুরস্কৃত করা হলো । মনোজের দাদু বলতেন, প্রথম স্তরে মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হই। এবং দেহের কিছুটা উপরে ভাসমান অবস্থায় বিরাজ করি। এই অবস্থায় এই বোধ জন্মায় যে, আমাদের দেহ আর ‘আমি’ এক জিনিস নয়। কোনো দুর্ঘটনায় চৈতন্য হারিয়ে অথবা কোনও কোনও অনেকই এই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছেন। এই জাতীয় অভিজ্ঞতা সব সময়েই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় না।এখন মনোজ দেখছে সত্যি তাই। মনোজের দাদুর বাবার লাঠি। যত্ন করে তুলে রাখা আছে বাঙ্কে। কার জন্য?  বৃদ্ধ আমার জন্য। কত সুখস্মৃতি জড়িয়ে লাঠির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। দাদামশাই লাঠি ধরে পথ চলতেন। লাঠিকে বলতেন, বাবা ভাল করে ধরে রাখিস। ফেলে দিস না এই বুড়ো বয়সে। কোমর ভেঙ্গে যাবে তাহলে। বিশ্বস্ত লাঠি তার দায়ীত্ব পালন করেছে পলে পলে। এবার তার নাতির পালা। পিসেমশাই মজার হিন্দী বললেন, লে আও চায়ে। তারপর গল্প হবে। 



                     ক্রমশ...


Monday, August 8, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -14


 


বিধাতার নির্মম পরিহাস মানুষের জীবনকে মরুময় করে তোলে । শত চেষ্টা করেও কোন উগ্র পুরুষাকার ভাগ্য বিড়ম্বনার করাল কবল হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না । আমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি । হারানো সলিলকে Medical Repre sentative পি . বিশ্বাসের মধ্যে খুঁজে পেলও তার প্রেমের নৈবিদ্য নতুন করে সাজালো । দিন দিন পি.বিশ্বাসের প্রতি শ্যামলী আকৃষ্ট হয়ে পড়ল । তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে তার জীবনের শ্রেয় ও প্রিয় বলে মনে হল।


 কি যে দৈব্যগুণে কারেন্টের মতো টানত ওর দিকে বুঝতে পারত না । এমনকি অভিসারিকা হয়ে পল্টু বিশ্বাসের কুঞ্জেও তার অবাধ যাওয়া আসা শুরু হল । ঐ ভাবে কয়েক মাস তাদের গোপন প্রেমের লীলা চাপল্য একদিন শ্যামলীর বাবার চোখে ধরা পড়ল । তিনি তাকে পি.বিশ্বাসের সঙ্গে এই মেলামেশার হেতু জিজুাসা করায় শ্যামলী অকপটে সত্য ঘটনা প্রকাশ করল।

কোন মতে রাজী হলেন না তিনি একজন Medical Representative এর সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে । নিজের আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য তিনি সুপাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন । তার বাবার এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে ছুটে গেল পল্টুর কাছে । তাকে সকাতরে জানালো , পল্টু যদি তাকে সত্য সত্যই জীবন সাথী রূপে নির্বাচিত করতে চায় , তাহলে অবিলম্বে সে যেন কালীঘাটে কিংবা অন্যত্র দেবমন্দিরে গিয়ে শুভ কার্য সম্পন্ন করে।

 ঐ দিন কালীঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে বজায় রেখে শ্যামলী তৈরী হতে গেল বাড়ীতে । দ্রব্য সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে পরদিন পল্টুর বাসাতে এসে উপস্থিত হল । আনন্দ উল্লাসে নৈশ ভোজন করার পর কখন যে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ছিল তা জানে না । যখন জ্ঞান ফিরল , দেখল এক বারাঙ্গনালয়ে । পল্টু বিশ্বাসের প্রবঞ্চনা চিত্র তার চোখের সম্মুখে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । জানতে পারল পল্টু তাকে এখানে ৫০ হাজার টাকার বিক্রি করে গেছে।

এরপর থেকে তার জীবনের মেঘমুক্ত শারদ আকাশ আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হতে থাকল । এই ঘটনা বলার পর শ্যামলীদি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । অনেক চেষ্টা করেছিলাম এই কলুষিত জীবনের পরিবেশ হতে নিজেকে মুক্ত করার । সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলো । কিন্তু কেন জানিনা , আমি অনিচ্ছা সত্বেও যৌবন ভাসতে ভাসতে এক অন্ধকারময় পরিণামের দিকে এগিয়ে চললাম।

সেই দিনটাকে কোন মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারিনি । শুধু দুঃখে অভিমানে মাথার চুল ছিঁড়েছি । কি ভুল করেছি আমি ! কেন বাবার কথা শুনিনি ? কেন শয়তানটাকে চিনতে পারিনি ? শ্যামলীদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

 ওকে কি বলে সান্ত্বনা দেব তার ভাষা পাচ্ছিলাম না । শুধু বললাম , আমিও তো তোমার দলভুক্ত হলাম দিদি । হঠাৎ মুখ দিয়ে তুমি বেরিয়ে এলো।

এরপর আমার পঙ্কিলময় জীবনের অধ্যায় হল শুরু । বিধাতার অভিশাপে এই সংসার বারবণিতা রূপে পরিগণিত হলাম । রমা নামের পরিবর্তে পদ্মা নামে আমি এই ক্লেদাক্ত জীবনের বোঝা বইতে শুরু করলাম । এক ধনী পুত্রের কন্যা হয়ে অকুণ্ঠ চিত্তে কখন যে পুরুষদের লালসার শিকার হলাম তা নিজেও বুঝতে পারিনি । ভাগ্য - বিড়ম্বনার কি নিদারুন পরিণতি !

 এবার অভিজ্ঞ পাঠকদের নিকট প্রশ্ন রাখি , যারা আমাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন , আমাদের অন্তরে যে ব্যথা , যে অতৃপ্ত কামনা , যে নৈরাশ্য লুকিয়ে আছে , যাদের হৃদয়ের সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের বিনিময় চলে সেই সমস্ত মধুকর পুরুষগণ আমাদের অন্তরকে উৎঘাটন করেন এর সত্য স্বরূপটি জানতে চান কি ? জানতে চান না , ক্ষণিকের অতিথি হয়ে তারা অপাতত মধুর সুখের স্পর্শ লাভ করে ধন্য হন , কিন্তু যাবার সময় এমন কি আমাদিগকে শুস্ক ফুলের মালার মতো অবজ্ঞার স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে যান । এই তো আমাদের মধুময় জীবন ।

 তবে একথা অস্বীকার করব না , আমাদের পৃষ্ঠপোষকগণের বহুমূল্য উপহার সামগ্রী জীবনের কলঙ্ককে ঢেকে দিয়েছে , বিস্মৃত করে দিয়েছে আমাদের অতীত জীবনের আভিজাত্যকে । কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে নিত্য নতুন জীবনের আস্বাদনে তখন আমরা মত্ত হয়ে ছুটে চলেছি । তখন আমাদের জীবনের আদর্শ , নীতিবোধ ও মানবিকতা ধূলায় লুণ্ঠিত ।

  Eat drink and be merry . এটাই ছিলো আমাদের জীবনের চরম কামনা । বেশ আনন্দেই আছি । সব লজ্জা , ঘেন্না কোথায় লুকিয়ে গেছে জানি না । এখন পুরোপুরি দেহপসারিনী হয়ে গেছি , পুরুষদের সাথে আমোদ করতে কোন কষ্ট হয় না । আমার সৌরভের গন্ধে পালে পালে পুরুষেরা এসে মাতোয়ারা হচ্ছে । মাঝে মাঝে পুরুষদের কথার ছলে খিলখিল করে হেসে উঠতাম । অনেকে আভার ভীষণ অশ্লীল কথা বলত , কিন্তু বস্তীর মাসিমা আদরিনী নারীদেহের ব্যবসায় যাতে ভাঁটা না পড়ে সেই সময় বহু পুরুষের অপমান ও বাড়াবাড়ি বিনা প্রতিবাদে নীরবে সহ্য করতাম । নিজের জীবনকে পণ্য সামগ্রী বা পুরুষের ভোগ্যবস্তু রূপে বিলিয়ে দিয়েছি । গভীর চিন্তা করার সময় পেতাম না , কেন এই পথ বেছে নিলাম । 

একদিন এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক এলেন । তার গায়ের রং ভীষণ ফর্সা , বেশ সুপুরুষ ।


পরেন দামী শার্ট ও ফুল প্যান্ট , হাতে গোটা তিন সোনার আংটি , দাড়ি - গোঁফ কামানো মসৃণ গাল ,  ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি । 

ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম , তিনি আদরি মাসীকে কি যেন বলছিলেন শুনতে পেলাম । একটু পরে ধীরে ধীরে তিনি আদরী মাসীর সঙ্গে আমার কাছে এলেন ভাবলাম নবাগতের আগমনে আমার উদ্দেশ্য অনেকটা সিদ্ধ হবে । আদরী মাসীর ইচ্ছা ভদ্রলোকটির রুচিমত আমি যেন কাজ করি । ভদ্রলোককে গৃহাভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য আতিথ্যে আপ্যায়িত করলাম । কিন্তু তিনি কুরুচি পূর্ণ ভদ্রলোক ছিলেন না । আমার আপ্যায়নে বাধা দিলেন । নিজের কাজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন ।

 ভদ্রলোক বললেন , যদি আপনি আমার প্রতি সহৃদয় হয়ে থাকেন , তাহলে আমার অনেক উপকার হবে ।

 আমি সাগ্রহে বললাম , কি করতে হবে বলুন ?

 তখন ভদ্রলোক আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার আপাদমস্তক সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন । মনে হল , আমি যেন তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া প্রেমাস্পদ — যাকে তিনি যুগ যুগান্তর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন , এমনি তার মনোভাব । তার নীরবতায় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম , কি মশাই , আমাকে নিয়ে আবার নতুন স্বর্গ রচনা করবেন বুঝি ? আপনার জীবনের অতৃপ্ত কামনাকে তৃপ্ত করার জন্য বুঝি এখানে এসেছেন? না। আমাকে কৌশলে এখান থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য এসেছেন?

 কিন্তু তার প্রসন্ন দৃষ্টি , নিষ্কলুষ মনের উদারতা করুণ চাহনি দেখে তাকে ঠক প্রবঞ্চক বলে মনে হলো না । কিন্তু তিনি আমার নিকট মনের গোপনীয়তা সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করলেন না । বাধ্য হয়ে সেদিন তাকে বিদায় দিয়েছিলাম । এই উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে মানুষের আসঙ্গলিপ্সা আমাকে শান্তি দিতে পারেনি । ভদ্রলোক সেদিনের মতো গুপ্ত মনের রহস্য নিয়েই বিদায় নিয়েছিলেন। 

এই ঘটনার পর আমার আদরী মাসী হাজির হলেন । জন্মের কয়েক বছর পর মাকে হারিয়েছিলাম । মনে হয় ভগবান আমার দুঃখময় জীবনের কথা চিন্তা করে এই আদরী মাসীকে দিয়ে মায়ের স্থান পূরণ করছেন । তিনি কাছে এসে সস্নেহে বললেন , পদ্মা ঐ ভদ্রলোকটিকে বিদায় করে খুব অবিবেচনার কাজ করলি । ধীরে ধীরে আদরী মাসীর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ও গাম্ভীর্য্য দেখা দিল।

 আমি নাকি তার কামনার বাধার সৃষ্টি করলাম । ওর চড়া মেজাজ দেখে আর থাকতে না পেরে মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত আমার জ্বলে উঠল । সমস্ত দেহটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো । আর টাল সামলাতে না পেরে বলে উঠলাম , তোমার ক্ষতি হল তো আমার বাপের কি?





                             ক্রমশ...

Thursday, August 4, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -2




রতন বলে নারীপিশাচ কেমন হয়?  -্প্রাচীনতম সভ্যতা বিশ্লেষণ  করলে দেখি, কৃষিকেন্দ্রিক প্রাচীন সমাজে তাই নারীরাই ছিল অধিপতি। নব্যযুগে থেকে চলে আসা রীতি অনুযায়ী  ফসল কাটার পরে অপদেবী তার পুরুষ সঙ্গীকে বলি দিয়ে অপদেবতার পুজা করত।  এই আধিপত্য  ধর্মের প্রসার কালে এসে কমতে  শুরু করে। কৃষিকাজ যেহেতু মেয়েদের হাতে প্রথম হয়।  সেহেতু বাংলায় এই আধিপত্য বিলোপ  সহজ ছিল না। বরেন্দ্র অঞ্চলের অপদেবীর পুরুষ সঙ্গীরা আর সহজে বলি হতে চাচ্ছিল না। এ বিষয়ের   নারীদের দেশে বন্দী  উদ্ধার করে তারা।   এরা ওঝা হলো। নারীওঝা যারা বাণ মেরে মানুষকে মারতে পারত আবার তার ভালোও করতে পারত। এরা মরে গিয়ে নারীপিশাচ হয়।আমি বললাম, ফালতু সব কথা। তান্ত্রিক হয়ে আপনি অলৌকিক কিছু করে দেখান দেখি। পিসেমশায় বললেন, বেশ পাঁচমিনিট পরে তুই এখান থেকে উঠতেও পারবি না নড়তে চড়তেও পারবি না।রতন বললো, আমিও দেখবো। দুজনকেই সম্মোহন করুন।পিসেমশায় বললেন, বেশি পাকামি মারতা হ্যায়। শালা বিপদে পরেগা। তারপর পিসেমশায়  বসলেন এবং আবার সাধনা করতে শুরু করলেন। পাঁচ মিনিট পরে ঠিক আমাদের বললেন, ওঠ এবার।তারপর তাকালেন আমাদের দিকে  । আমি আর রতন চেষ্টা করলাম অনেক চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। ওঠা তো দূরের কথা। নড়াচড়া করতে পারলাম না। চুপ করে বসে আছি। কথা বলতে পারছি না।  পিসেমশায় সত্যিই  নড়াচড়া করতে পারছি না আমরা চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। কি হবে পিসেমশায়। ক্ষমা করে দাও। এবার মতো ক্ষমা করে দাও। আমাদের ঠিক করে দাও। আমাদের দুজনের আর্তচিৎকারে পিসেমশায় বলল ভয় নেই আমি আছি । তারপর পিসেমশায় আবার পাঁচ মিনিট সময় সাধনা করলেন। চুপচাপ বসে থাকলেন আমাদের দিকে তাকিয়ে। তারপর 5 মিনিট পর আমাদের বললেন এবার ওঠ। রতন আর আমি এবার উঠে পড়লাম উঠে নাড়াচাড়া করে দেখলাম না সব ঠিক আছে।কি সমস্যা বললেন না জেনে কারো সঙ্গে তর্ক করতে নেই। কম জ্ঞান হলো বিপদের লক্ষণ জানবি পড়বি পড়াশোনা করবি, তারপর তর্ক করবি। মানুষকে মারণ, উচাটনের দ্বারা  অতিষ্ঠ করে দেওয়া যায়। তাকে এমনকি মেরে ফেলাও যায়। তারপর থেকে আমরা পিসেমশায় সঙ্গে তর্ক করতাম না।






 ৩
রতন বলল,পিসেমশাই তান্ত্রিকরা অনেক বছর বেঁচে থাকেন। যেমন তৈলঙ্গস্বামী,বাবা লোকনাথ সকলে অনেকবছর বেঁচে থেকেছেন। অলৌকিক কাজ করেছেন কত। কি করে সম্ভব এটা?
পিসেমশাই বললেন,ওনারা বলেন, কচ্ছপের মতো বসে থাকুন, কবুতরের মতো হাঁটুন আর কুকুরের মতো ঘুমান। এর সঙ্গে দে’হ-মন-প্রাণের অভ্যন্তরের শান্তির জন্য তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস সং’ক্রান্ত কিছু কৌশলের চর্চা চালাতেন। এসব করেই তিনি শিখেছিলেন দী’র্ঘ জীবন লাভের সত্যিকার কৌশল। বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন পশ্চিমে মানুষের গড় জীবনকাল ৭০-৮৫ বছরের মধ্যেই থাকে। কেউ শত বছর বেঁ’চে আছেন শুনলে বেশ অবাক লাগে।অথচ এনারা চারশ পাঁচশ বছরও বাঁচেন। সংযমী আর শান্ত স্বভাবের মানুষ দীর্ঘজীবন লাভ করেন। আর অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে সাধনার প্রয়োজন। বাবা লোকনাথ তো বাঘ, কুকুরের রূপ ধরতে পারতেন। 



কোনো বিষয়ে যা বলতেন আমরা শুনতাম। আমরা তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম তার পিছনে পিছনে ঘুরতাম যদি কিছু জানা যায় যদি কিছু শেখা যায় । একবার রতন আর আমাকে নিয়ে পিসেমশাই গেছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে একটা বাড়িতে বন্ধুর বাড়িতে তিনি ঢুকেছিলেন এবং বন্ধুটার সঙ্গে তার  অনেক দিন পর দেখা। সেই বন্ধুটাও তান্ত্রিক ছিল।পিসেমশায় বললেন, এখানে এসে তোদের পাহাড়টা দেখাবো বলে এই বন্ধুর বাড়ি এলাম এই বন্ধুটা মোটেও আমাকে পছন্দ করে না আমাকে হিংসা করে। তবু বাধ্য হয়ে এলাম। খুব সাবধানে থাকবি।পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে পিসেমশায় একটা সত্যি ঘটনা বললেন, গর্ভবতী মিনার বাচ্চা হবে।  সমস্যা হল এখন লকডাউন চলছে। বাইরে বেরোনো যাবে না। বেরোলেও সব হাসপাতালে করোনা রোগীর ভিড়। চিকিৎসক ডেট দিয়েছিলেন ৮ই এপ্রিল, কিন্তু তিন তারিখ রাত্রেই প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বছর ২৭এর গর্ভবতী মেয়েটির । তারপর ১২ ঘণ্টা ছাঁট লোহার ছোট কারবারি তাঁর স্বামী অসুস্থ মেয়েটিকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে দৌড়ে বেরিয়েছেন। মুম্বইয়ের উত্তর শহরতলির নালাসোপারা থেকে মুম্বইয়ের মধ্যে ৭০ কিলোমিটারে চারটি হাসপাতাল পড়েছিল। তার একটিতেও ভর্তি করতে না পেরে পরের দিন বিকেলে  স্ত্রীকে মরতে দেখল যুবকটি। বাঁচানো যায়নি গর্ভস্থ সন্তানটিকেও। তাঁর মৃত্যুর পরেই সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন হয়ে যায় নালাসোপারার ধানেব বস্তি এলাকায়। এই মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা ওই এলাকায় কনট্যাক্ট ট্রেসিং করতে গিয়ে পড়েছেন আর এক বিপদে। লোকজন বলতে শুরু করেছে এঁরা এনপিআরের তথ্য সংগ্রহ করতে গেছেন। একদিকে করোনার আতঙ্ক , এনপিআর-এর ভয়, অন্যদিকে হাজার পঁচিশেক বাসিন্দার খাবার ফুরিয়ে আসছে, পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট- সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা।মিনা মারা গেল , সে আর তাঁর স্বামী উত্তরপ্রদেশ থেকে এই বস্তিতে আট মাস আগে আসে। থাকতে শুরু করে দশ ফুট বাই দশ ফুট একটি গ্যারেজে। রাতে যখন মেয়েটির দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকে , তাঁর স্বামী দুই আত্মীয়কে নিয়ে একটি অটোরিক্শা ভাড়া করে নিউ আয়ুশ নার্সিংহোমে যায়। করোনা ভাইরাস সন্দেহে সেখানকার ডাক্তার মেয়েটিকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে, তখন তাঁরা দৌড়য় সরকারি সর্বোদয় মেটারনিটি হোমে। সোখানকার ডাক্তার বলেন তাঁর চিকিৎসা করার ব্যবস্থা ওই হাসপাতালে নেই। সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এঁরা যখন ৪০ কিলোমিটার দূরে কান্ডিভেলির শতাব্দী হাসপাতালে পৌঁছয়, ততক্ষণে রাত আড়াইটে বেজে গেছে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায় মেয়েটির ফুসফুসে জল জমে গেছে, তখন তাঁকে রেফার করা হয় নায়ার হাসপাতালে , যেটা আরও ৩০ কিলোমিটার দূরে। সেখানেই তাঁর গলা থেকে লালারস নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে মেয়েটি মারা যায়। পরীক্ষার ফল আসে কোভিড-১৯ পজিটিভ। এই ঘটনার পরে ওই বস্তিতে যখনই তথ্য সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা গিয়েছেন, তাঁরা কোনও সাহায্য পাননি। কেউ কোনও বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে এই মৃত্যুর পরে মেয়েটির স্বামী ছাড়াও আশপাশের পাঁচটি পরিবারের ৩২ জনকে স্থানীয় একটি স্কুলে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় সাড়ে ছ হাজার মানুষের ওই বস্তিকে কন্টেইনমেন্ট জোন বলে ঘোষণা করে চারদিকে কড়া পাহারা বসানো হয়েছে, যাতে কেউ যথেচ্ছ ঢুকতে বেরতে না পারে।



                            ক্রমশ...

Wednesday, August 3, 2022

ছোট গল্প - নষ্ট মেয়ের সাত কাহন || লেখক - সুব্রত নন্দী মজুমদার || Short story - Nosto Meyer Satkahon || Written by Subrata Nandi Majumdar




 নষ্ট মেয়ের সাত কাহন 


            সুব্রত নন্দী মজুমদার 




আমি মোটেও জন্মেই নষ্ট মেয়ে হয়ে যাই নি, আমার মাও নষ্ট মেয়ে ছিল না। শুনেছি আমি খালাস হতেই আমার বাবাটা নাকি আর এক মেয়েছেলের হাত ধরে চলে গিয়েছিল কোথায়। আর ফিরে আসেনি। সেই বাপটাকে আমি কোনদিন চোখেই দেখি নি। 

রেল কলোনীর বস্তির একটা ঝুপড়িতে আমরা থাকতাম। মায়ের কাছে শুনেছি আমার বাপটা রেলস্টেশনেই কি সব কাজ করে যা রোজগার করত তাতে আমাদের দু’বেলার খাওয়া হয়ে যেত। কিন্তু বাপ রোজ সন্ধ্যেবেলা চুল্লু খেয়ে বাড়ি এসে মাকে পেটাত। আমি মায়ের পেটে এসে যাবার পর সে কিছুদিন শান্ত ছিল, তারপর আমি খালাস হতেই একদিন আরেকটা মেয়েছেলেকে নিয়ে সেই যে উধাও হয়ে গেল আর পাত্তা নেই। 

মা আগে কোন কাজ করত না। বাপের রোজগারেই আমাদের পেট চলত। বাপ চলে যেতে মা পড়ল অথৈ জলে, দেড়খানা পেটের সংস্থান চাই তো। রেল কলোনির এক বাবুর বাড়িতে মা রান্নার কাজ পেয়ে যাওয়াতে আমাদের চলে যেত। তা ছাড়া মাকে ওদের বাড়ি থেকে কিছু খাবার ও দিত। তাই পেটের ভাবনা আমাদের ছিল না। 

মা আমাকে কোলে নিয়ে বাবুদের বাড়ি যেত আর পাশে বসিয়ে নিজের কাজ করত। এমনি করে দিন চলতে লাগল বটে, কিন্তু বয়সটা তো চুপচাপ বসে থাকে না? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমি ও গায়ে গতরে বাড়তে লাগলাম। 

কিন্তু ঐ গতরটাই হল আমার কাল। তাছাড়া আমি দেখতেও সুন্দরী, বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতই ফর্সা গায়ের রঙ। এই নিয়েও পাড়া পড়শিদের মধ্যে ফিসফিসানি চলত। মায়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলত রেল কলোনীর বাবুদের কারো সঙ্গে মা হয়তো লটর ফটর করত। তাই বাপটা পালিয়ে গেছে। আমার কিশোর বয়সে আমি যখন গায়ে গতরে লোকের চোখে পড়ার মত, তখন ঐসব কথা শুনতাম, কিন্তু ভাল করে বুঝতে পারতাম না। 

বড় হয়ে আমি বাবুদের বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করতাম। বাবু যে যখন তখন রান্নাঘরে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলার ছলে চেখে চেখে আমার বাড়ন্ত শরীরটাকে খেত, আমি না বুঝলেও মা সেটা বুঝতে পেরেছিল। 

বাড়ন্ত গড়নটাই আমার কাল হল। আমার বয়স সবে তেরো পেরিয়েছে। তখনি পুরন্ত আপেলের মত গোল গোল স্তন দুটো যেন গায়ের জামা ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। সব বয়সের পুরুষরা জুল জুল করে আমার গোল স্তনের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন বুঝবার মত বয়স আমার হয় নি। মা আমায় সেটা বুঝিয়ে দিল আর বাবুর বাড়িতে না যেতে বলে।  

যেদিন মা আমাকে বাবুর বাড়ি যেতে বারণ করল, সেদিনই বাড়ি ফিরে মা আমাকে প্রায় চ্যালাকাঠ দিয়ে মারতে আসে, ‘হতভাগীটা মরে গেলে আমার জ্বালা জুড়োত। একদিন না দেখেই বুড়ো হামড়া বাবুটা ছুক ছুক করতে থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, ‘কই গো, তোমার মেয়েকে দেখছি না আজ।‘ হতভাগী, গা টা একটু ঢাকা দিয়ে রাখবি তো?’ 

মায়ের কথা বুঝতে না পেরে আমি হা করে থাকি, তারপর নিজের বুকে হাত বুলিয়ে দেখি আপেলের মত গোলগাল বুকে স্তনবৃন্তের উপর হাত পড়তে গাটা কি রকম শির শির করে ওঠে। মা অবশ্য চ্যালা কাঠের সৎব্যবহার করে আমার বাড়ন্ত গড়নের ব্যাপারটা বোঝায় নি, কিন্তু বুঝতে আমি পারলাম পরের দিনই। 

বাবুর বাড়ি যাবার আগে সেদিন মা আমাকে পই পই করে বারণ করে গেল আমি যেন একদম বাড়ি থেকে না বেরোই। মা রোজ সকাল আটটায় বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে দুপুর দু’টোয়। বাড়িতে অবশ্য ঘড়ি নেই, সময় ঠিক করি আসা যাওয়া ট্রেনের হুইসেল শুনে। সেদিন মা বেরিয়ে যাবার পর আমি দরজা ভেজিয়ে ঘর গোছ গাছ করছিলাম। একটু পরে মা যেভাবে বলে গেছে রান্নার ব্যবস্থা করব। 

এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বাবু মানে যাদের বাড়িতে মা কাজ করে, দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে। আমি চমকে গিয়ে মায়ের কথামত শাড়ির আঁচল ঠিক করে আমার পুরন্ত বুকদুটো ঢাকা দিই। বাবু ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিতে আমি মৃদুস্বরে বলি, ‘দরজা বন্ধ করছেন কেন?’ 

তিনি তেমনি হাসিমুখে আমার কাছে আরও এগিয়ে এসে আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেন, ‘দুদিন যাস নি, তাই ভাবলাম দেখে আসি শরীর টরীর খারাপ হয় নি তো।‘ 

আমি আমার পিঠ থেকে তাঁর হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে তিনি আমাকে আরো কাছে টেনে এনে গালে একটা চুমু খেয়ে বলেন, ‘আহা, ফুলের মত মেয়েটা, আর একটু যত্ন পেলে একেবারে পরীর মত দেখতে হত। ‘ 

আমি কি রকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। বাবু আমাকে টেনে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে একেবারে আমার গা ঘেঁসে নিজে বসে একহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরেন। আমার কি রকম অস্বস্তি হতে থাকে। তিনি বলেন, ‘ভয় কিসের? কেউ আসবে না, দরজা বন্ধ আছে।‘ বলে বাবু আমার ব্লাউজ খুলে দিয়ে আমার স্তনের চুচিতে মুখ দিয়ে কামড়ে ধরেন। আমি এই প্রথম বুঝতে পারলাম আমার বাড়ন্ত গড়নের জন্য মায়ের এত চিন্তা কেন। আমার বুকে শির শিরানি আর সেই সঙ্গে একটা ভাল লাগার অনুভূতি দেখা দিল। 

বাবু আমার সায়ার দড়ি খুলে দিতে আমি প্রথম আমার কুমারীত্ব হারালাম। যোনিতে সামান্য ব্যথা অনুভব করলেও একটা আনন্দের শির শিরানি আমার সমস্ত অঙ্গে ছড়িয়ে গেল। জোরে জোরে আমার নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। বাবু আমার দু’টো স্তন আঁকড়ে ধরে কামড়ে খিচরে রক্ত বের করে দিলেন।  

আমি কোনমতে উঠে বসে ব্লাউসের বোতাম আটকাই। বাবু আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেন, ‘ভয় 

পাচ্ছিস কেন, কিচ্ছু হবেনা, ‘ বলে তিনি পকেট থেকে একশ টাকা বের করে আমার হাতে দেন। তিনি বলেন, ‘রাখ, তোর যা ইচ্ছে কিনিস, মাকে কিছু বলিস না, আমি যে এসেছিলাম একথা ও না। দেখবি আমি তোকে কত কিছু দিই। মা যেন কিছু জানতে না পারে।‘  

সেদিন আমি বুঝতে পারলাম কিছু কথা আছে যা গোপন রাখতে হয়।  

কিন্তু কাউকে কি কিছু বলতে হয়? ধরা একদিন পড়ে গেলাম প্রথমে মায়ের কাছে তারপর রতনের কাছে। বাবু এর মধ্যে আরও দু’তিন দিন এসেছিলেন, আমাকে অনেক আদর আহ্লাদ করলেন, আঁচড় কামড় ও দিলেন। তারপর যাবার আগে বেশ কিছু টাকা আমার ব্লাউজের ফাঁকে বুকের মধ্যে গুঁজে দেন। মা যাতে দেখতে না পায়, আমি টাকাগুলো লুকিয়ে রাখি কুলুঙ্গিতে। মাঝে মধ্যে কিছু কিনে খাই। আমার কৈশোরুত্তীর্ণ মন এর মধ্যে খারাপ কিছু দেখতে পায় না। 

একদিন মা কুলুঙ্গিতে রাখা টাকা দেখতে পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এ টাকা কোথা থেকে এল?’ 

আমি বেমালুম বলে দিলাম ’কই, জানি নাতো। ‘ 

মা আমার চুলের মুঠি ধরে বলেন, ‘ বল শীগগিরই, নয়তো মেরে আমি তোর হাড় মাস এক করে দেব।‘ এই কথা বলে মা আমাকে একটা হ্যাঁচকা টান দিতে আমার গায়ের আঁচল সরে গিয়ে বুকেতে বাবুর কামড় ও আঁচড়ের দাগ বেরিয়ে পড়ে। দেখে মা থ’ হয়ে যায়। গায়ের কাপড় সরিয়ে গায়ে পিঠে সব দাগ দেখে বলে, ‘ হারামজাদী, কাকে ঘরে ঢুকিয়েছিস বল।‘ 

মার খেয়ে খেয়ে আর না পেরে আমি মাকে সব বলে দিলাম। মা রেগে উনুন থেকে চ্যালাকাঠ তুলে আনে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু হল উল্টোটা। মা নিজেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মরে গেল। বস্তির লোক সবাই ছুটে এল। আমি কিছু বুঝতেই পারলাম না। রতন গিয়ে রেল কলোনীর সেই বাবুকে ডেকে নিয়ে এল।  

বাবু আমাকে খুব সাহায্য করলেন। মায়ের কাজ করা থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুর ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। কাজ কম্ম শেষ হয়ে যেতে বাবু আমাকে আদর করে বলেন, ‘ কিচ্ছু ভাবিস না, আমি আছি। যখন যা দরকার হবে আমায় বলবি। আমি ও রোজ একবার তোর খোঁজ নিয়ে যাব।‘ ‘ 

তখন থেকেই আমি পুরোপুরি নষ্ট মেয়েমানুষ হয়ে গেলাম। বাবু আমাকে দখল করে নিলেন, আমাকে মানে আমার শরীরটাকে। 

ও, হ্যাঁ, রতনের কথা বলছিলাম না। ছেলেটা আমাদের পাড়ায় থাকে। ছোটবেলা থেকেই আমরা একসঙ্গে খেলাধূলা করেছি। মা চলে যাবার পর সে একদিন আমার কাছে এসে বলে, ‘স্বপ্না, ও বলতেই ভুলে গেছি, যদিও মা আমাকে হতচ্ছারী, পোড়ারমুখী এইসব নামে ডাকত, আমার একটা সুন্দর পোষাকী নাম ছিল,স্বপ্না আর মায়ের নাম ছিল সীমা। । ভুলেই গেছি সেটা। রতন এসে বলে, ‘স্বপ্না, তোকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব ভাবছি। তোর মায়ের সামনে বলতে ভরসা পাই নি। এখন তো তোর মা নেই, তাই বলছি।‘   

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কি কথা রে?’ 

সে একটা ঢোঁক গিলে বলে, ‘ বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি, রেল কলোনীর সেই বাবুটা তোর বাড়িতে খুব যাতায়াত করে।‘ 

আমি ‘ ও কিছুনা’ এইরকম ভাব দেখিয়ে বলি, ‘হ্যাঁ, বাবু মায়ের খোঁজ নিতে আসত।‘ 

‘দেখ, আমি বোকা নই,’ রতন বলে, ‘সব বুঝি। তোর মা নেই, এখন তোকে রোজগার করতে হবে। শুধু একটা বাবুতে চলবে কেন, আমি তোকে অনেক বাবু জোগাড় করে দেব। প্রচুর টাকা পাবি। আমি সামান্য কমিশন নেব। ‘  

আমি বুঝলাম ধরা পড়ে গেছি, তাও বলি,’ তুই কি বলছিস আমি বুঝতে পারছি না। বাবু একটু খোঁজ খবর নিয়ে যান, এতে কি হয়েছে। ‘     

রতন বলে, ‘দেখ আমাকে এইসব বলে ভোলাতে পারবি না। আমাদের বস্তিতে আরও দু’চারজন তোর মত মেয়ে আছে আছে যারা এই ব্যবসা করে ভাল কামায়। তুই আমাকে সঙ্গে রাখলে তোর লাভ হবে। ‘

আমি ততদিনে বুঝতে পেরে গেছি যে আমি কোথাও শরীর না বেচে কাজ করতে পারব না। তাছাড়া রতনের মত কেউ থাকলে সুরক্ষাও হবে। আমি চুপ করে আছি দেখে রতন বুঝতে পারে আমি রাজি। সে উঠে চলে যাবার আগে বলে, ‘বিকেলের দিকে একটু সেজে গুজে থাকবি, আমি আসব। একটা ভাল দেখে গন্ধ কিনে দেব, গায়ে মাখবি, বাবুরা গন্ধ খুব পছন্দ করে।‘ 

আম রতনকে বলেছিলাম যে আমি রোজ একজনের বেশি বাবু নেব না। আমার শরীরটা দেখেই বাবুরা হামলে পড়ে, সেই গতরটাই আজ আমার রোজগারের উপায়। রেল কলোনীর সেই বাবু ও মাঝে মাঝে আমার জন্য শাড়ি, ব্লাউস সাবান, স্নো, পাউডার গন্ধ নিয়ে আসেন। তারপর আমার শরীরটাকে উপভোগ করে চলে যান। 

আমার নষ্ট হওয়ার পথ মসৃন হয়ে গেল। বুঝতে পেরে গেছি, আমি শুধু একা নই, এরকম অনেক মেয়েই আছে শরীর বেচে খায়। একটু সমস্যা হত যারা প্রচুর মদ খেয়ে আসত। তারা শরীরটাকে খাবলে খুবলে শেষ করে দিত। অবশ্য তারা যেমন ভোগ করত তেমনি আদায় ও করে নিতাম সেই রকম। কেউ যদি হোটেলে নিয়ে যেত, টাকা অনেক বেশি দিত। অনেকে আবার অন্ধকারে গাড়ির মধ্যে বসে কাজ সেরে নিত। বেশির ভাগই আমার ঘরে আসত। 

ভেবেছিলাম এইভাবে গতর দেখিয়ে দিন গুজরান করব, কিন্তু আমার কপালে লেখা ছিল অন্য রকম। একদিন সন্ধ্যেবেলা রতন এক শাঁসালো খদ্দের পাকড়াও করে আমাকে ডেকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে এল। বাবুটি মনে হল প্রচুর মদ খেয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার হাত ধরে প্রথমেই আমার বুকে একটা চুমু খেয়ে নিজের আঙ্গুল থেকে একটা আংগটি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলে, ‘চল তোর ঘরে যাব।‘ 

রতন তার হাত ধরে এগিয়ে যায় আর আমি আস্তে আস্তে পেছনে আসতে থাকি। আমার ঘরের কাছাকাছি আসতে রতন হাত দেখিয়ে আমাকে থামতে বলে। আমি দাঁড়িয়ে আবছা অন্ধকারে দেখি কে একটা লোক আমার ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। রতন কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে কি চাই।‘ 

লোকটা মুখ তুলতে দেখি বয়স্ক মত লোক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ময়লা পোষাক রতনকে বলে, ‘আমি সীমার কাছে এসেছি।‘ 

‘সীমা?’ রতন বলে, ‘সেতো নেই’। 

‘কোথায় গেছে?’ 

‘সে মারা গেছে।‘ 

শুনে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, ‘মারা গেছে? তার কোন ছেলে বা মেয়ে নেই?’ রতন আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি দরকার আপনার?’ 

কৌতুহলবশে আমি এগিয়ে আসি। বুড়ো লোকটা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ভাবলাম বুড়ো বয়সে শরীর চাখবার শখ হয়েছে । আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার সীমার সঙ্গে কি দরকার ছিল? ‘ 

‘সীমার কোন ছেলে মেয়ে নেই?’ সে আবার জিজ্ঞেস করে। 

‘আমি সীমার মেয়ে,” আমি বলি।  

‘তুমি সীমার মেয়ে?’ বলে লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। রতন গিয়ে তার মাথাটা তুলে বলে, ‘কি হয়েছে? আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে এক গ্লাস জল নিয়ে আসি। সেই বাবুটা গতিক বুঝে চলে যায়। আমি লোকটার চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দিতে সে চোখ খুলে আমার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আমি তোমার বাবা।‘    


Monday, August 1, 2022

ছোট গল্প - কবিতার দেশে || লেখক - বৈদূর্য্য সরকার || Short story - Kobitar dese || Written by Boidurya Sarkar


 


কবিতার দেশে

বৈদূর্য্য সরকার



মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নীলাঞ্জন । শুক্রবার সন্ধে সাড়ে সাতটা । এই সময় রিয়া ফিরবে গানের ক্লাস থাকে । এখনও রিয়া যে নিয়ম করে গানের ক্লাসে যায় সেটাই আশ্চর্য ।  নীলাঞ্জন নিজে তো পারেনি ।  স্বীকৃতি নেই, কতদিন শিল্পচর্চার উৎসাহ ধরে রাখা যায় !

নীলাঞ্জন খেয়াল করেনি – আশপাশ কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছে । অসময়ের বৃষ্টিতে এমন হয়। সবকিছু থম মেরে থাকে । লোকজন নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেও একজন অশক্ত চেহারার লোক সামনে এসে পড়েছে । আশ্রয় পাওয়ার ভঙ্গিতে ওর বাঁ হাতের কবজি চেপে ধরল । মুখটা চেনা ঠেকছে বলেই বিরক্তি প্রকাশ করল না নীলাঞ্জন। লক্ষ্য করল, লোকটার বুড়ো আঙুলটা কেমন যেন বিকৃত । হাতুড়ে চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের ফল বলে মনে হয়।

লোকটার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধে ঝোলা । কোথায় যাবে ? বুঝতে পারল না নীলাঞ্জন । তবে তার পক্ষে হাত ছাড়িয়ে নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না এই মুহূর্তে । ভাবল, কাছেই হয়ত বাড়ি । একটু এগিয়ে দিলে ক্ষতি কি ! রিয়ার আসতে এখনও খানিকটা দেরি আছে । অফিস থেকে বাড়ি না ফিরে একেবারে রিয়ার সাথে ফিরবে বলে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে । দেখে সন্দেহ করার কিছু নেই, মধ্যত্রিশের ছাপোষা একটা লোকের জীবনে আর কোন গল্প বাকি থাকতে পারে ! সেই একইভাবে অফিসের কাজ, ঘর সংসার বাজার দোকান । উন্নতির আশা নেই। দেশবিদেশের গপ্পো নেই, কবিতার খাতা ফুরিয়ে গেছে । দু’চারটে বইপত্র বেরিয়েছিল বটে, তা কে আর মনে রেখেছে ! বড় প্রকাশনার দরজা খোলেনি তার জন্যে, উৎসবেও কেউ কবিতা পড়তে ডাকেনি । বিশ তিরিশ হাজার খরচ করে বই ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিতদের অনুচর হয়নি সে । আজকাল দেখছে শিল্পসাহিত্যের জগতে পয়সাওলা লোকেদেরই কদর । অবশ্য মহিলাদের খানিক সুযোগসুবিধে আছে ।

নীলাঞ্জনের খেয়াল পড়ল, কতদূর হাঁটছে তারা ! কোথাকার রাস্তা ? ভাল ঠাওর করতে পারছে না ।  রাস্তাঘাট বেশ শুনশান । যেন ছবির মতো শহর একটা । বাড়িঘরের চেহারাও পালটেছে । তাকে দাঁড় করিয়ে বুড়ো লোকটা কোথায় যে গেল !

নীলাঞ্জন দেখল, একটা বড় নীল দরজা । এগোতে কোথা থেকে ভেসে এল – পাসওয়ার্ড ? ঘাবড়ে গিয়ে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড বলতেই হড়াস করে খুলে গেল দরজা । 

প্যারালাল দুনিয়া । অনেকটা উন্নত । বেশ এডিট করা সব চেহারা । রাস্তাঘাট বাড়িঘরে বেশ ছিরিছাঁদ আছে । তবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, সব একরকম । অনুকরণের দুনিয়া যেন । এখানে বেশ একটা হেমন্তের আবহাওয়া । নীলাঞ্জন বেশ খুশি মনেই ঘোরাঘুরি করছিল । লোকজন, চায়ের দোকান নেই বলে যে বিরক্ত লাগছিল না তা নয় ।  রাস্তায় সব গাড়িগুলো সটাসট চলে যাচ্ছে । বাসের দেখা পায়নি । কিন্তু যাবে কোথায় ! বের করে দেখল ফোনটাও বিগড়েছে । টাওয়ার নেই ।

একজনকে দেখে চমকে উঠল নীলাঞ্জন । কলেজের একটা ছেলে। আজকাল খুব মাতব্বর হয়েছে দেখতে পায়। সবটাই যে জনসংযোগ, ওকে দেখেই বুঝে গেছে নীলাঞ্জন । এখানে কোথায় যাচ্ছে ? ওর যাওয়ার ভঙ্গিটায় যে বেশ একটা গোপনীয়তা আছে, ভালই বুঝেছে নীলাঞ্জন । কিছু না ভেবেই ওকে ফলো করতে লাগল নীলাঞ্জন । খানিকটা গিয়ে একটা বড় সাদা বাড়ির সামনে এসে থামল । কায়দা করে ‘কবিতার দেশ’ লেখা আছে দরজার মাথায় । খানিকটা কৌতূহলবশত ঢুকে পড়ল বাড়িটায় । বোঝা যাচ্ছে, এখানে অনেক লোকের জমায়েত।

একটা মিশ্র ধ্বনির মধ্যে ঢুকে পড়েছে নীলাঞ্জন । বহু ছেলে বহু মেয়ে । যদিও অনেকের ভালই বয়স হয়েছে । তবে সবার ভাবভঙ্গিতে কচি সাজার চেষ্টা । সাজপোশাক দেখেই বোঝা যায়, সবাই বেশ বড়লোক । আড়ালে বসে সব লক্ষ্য করছিল নীলাঞ্জন । বুঝতে পারলো এ সভার আরাধ্য সরকারি কবি । সবাই তার অনুসারী । ভিড়ের মধ্যে পরিচিত মেয়েদের চোখে পড়ল । তারা এখন ওকে পাত্তা দেয় না । সবাই পুরস্কার পেয়েছে গুরুঠাকুর ধরে। শোনা যায়, আগের শাসকের হয়ে কবি লড়াই শুরু করেছিলেন । তারপর এই শাসকের জন্যে ব্যবহার করছেন তার দলবল । শেষপর্যন্ত উপহার পেয়েছেন এই কবিতার দেশ ।

তাকে সর্বদা ঘিরে থাকে একদঙ্গল মেয়ে । তাদের টানে আসে একদল ছেলে । আবার তাদের পেছনে অনেক ছেলেমেয়ে। নরক গুলজার একবারে । দেওয়ালে টাঙানো আছে বিখ্যাত সব ছবি ।

এখানে এসে নীলাঞ্জন বুঝতে পারছে, ওর দেখা সভাগুলোর মতো এখানেও যারা কবিতা পড়ার তারা পড়ছে আর বাকিরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব খুনসুটি করছে । সে স্বগতোক্তি করল- সব জায়গায় একই অবস্থা ।

ওর পাশের ছেলেটার সাথে টুকরোটাকরা কথাবার্তা হচ্ছিল নীলাঞ্জনের । ছেলেটাকে অবশ্য একটু বিক্ষুব্ধ বলে মনে হল । কচি অবোধদের পেয়ে এখন তাদের আলো খেতে দিচ্ছে না দাদা। সে ফিসফিস করে নীলাঞ্জনকে জানালো, তারাও দলবদল করতে জানে... শিখেছে কবিবরের থেকেই ।

হঠাৎ দেখা গেল, সভা একদম শান্ত হয়ে এল । কবি স্বয়ং পড়বেন । তার আগে বেশ খানিক প্রশস্তি । পড়াটুকুর অপেক্ষা, তারপর আবার সমস্বরে উচ্ছ্বাস । যদিও নীলাঞ্জনের মনে হল – এ যেন কবিতা নয় বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া । কিন্তু সেসব ভাবার অবসর নেই । নানারকম হইচইয়ের মধ্যে ছেলেটির সাথে উঠে পড়ল নীলাঞ্জন। ছেলেটা বেশ ঘোড়েল, এবার উল্টোদিকের আসরে যাবে । নীলাঞ্জনের আপত্তি নেই কিছু । তার তো যাওয়ার কোনও জায়গা নেই ।

বুঝতে পারল, একই বিল্ডিংয়ের দু’টো দিকে দু’দলের আস্তানা । নীলাঞ্জনের মনে হল, সব বিরোধিতাই প্রতিষ্ঠানের গায়ে গায়ে থাকে ।  তবে এখানে ভিড় অপেক্ষকৃত কম । কোথাও যেন একটা অশ্রুত সঙ্গীত বাজছে বলে মনে হল নীলাঞ্জনের । লোকজনের কথাবার্তায় সের’ম একটা ভঙ্গি । সমে এসে সব থমকে যাচ্ছে । ছেলেটাকে বেশ হেঁহেঁ করতে দেখল নীলাঞ্জন । 

এ হচ্ছে গোঁসাইয়ের আখড়া । কোমলরসের কারবার সব । শোনা গেল, নতুন রানি আর পুরনো রাজার বিরহকাব্য লিখে কবি নাম করেছিলেন । এখন হয়েছে সমস্যা । দুই কবি অনুগতদের নিয়ে এমন প্রশস্তি শুরু করেছে, দু’জনকেই সৌখিন দু’টো পদে বসিয়েছেন রানি। একই জায়গায় পাশাপাশি দু’টো আখড়া ।  

তবে একটা ভাল ব্যাপার, নীলাঞ্জনকে কেউ খেয়াল করেনি । এক অর্থে ভালই হয়েছে । খানিকটা আশাহত ভঙ্গিতে মন্থর পায়ে একা নীলাঞ্জন বেরিয়ে এল বাড়িটা থেকে । রাস্তায় নেমে এলোমেলো একা হাঁটতে লাগল । 

হঠাৎ ওর মনে হল, এতক্ষণ হয়ে গেছে তবু তো খিদে তেষ্টায় অনুভূতি হচ্ছে না বিশেষ । এ আবার কীর’ম জায়গা রে বাবা ! একটু পরে খেয়াল করে দেখল, শীত গরমের বিশেষ কোনও তফাত নেই এখানে । এতক্ষনে বেশ ঘাবড়ে গেছে নীলাঞ্জন । সত্যিই তো, এ কোন দুনিয়ায় এসে পড়ল ? এসে পড়লই বা কি করে ! সবই তার চেনা দুনিয়ার মতোই কিন্তু যেন একটু আলাদা । 

এখানে সবাই কি এসব নিয়েই মেতে থাকে সর্বদা ? অন্য কাজকর্ম না করে পেট চলে কেমন করে ! বাজারের অবস্থা তো এমনিতে তো ভাল নয় । চাকরিবাকরি করেই নুন আনতে পান্তা ফোরায়... না করলে কী হবে তা কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখেনি নীলাঞ্জন । 

-চলো, আর কতক্ষণ তোমার জন্যে দাঁড়াবো !

একটা বেশ আরামদায়ক আবহাওয়ায় পার্কের বেঞ্চিতে বসে নীলাঞ্জনের একটু তন্দ্রা মতো চলে এসেছিল । ঠিক তখনই চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখল, সেই বুড়ো কোথা থেকে হাজির হয়েছে । নীলাঞ্জন খানিকটা অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছিলেন আমাকে ফেলে ! লোকটা বৃদ্ধ ঠাকুরদার মতো মমতায় বলে উঠল, তোমার মতো ছেলেছোকরাদের জড়ো করে এনে সব জোগাড়যন্ত্র করতে দেরি হয়ে গেল । আমি একা আর কতদিক সামলাবো ! তারপরেই কথা থামিয়ে উনি তাড়া দিয়ে নীলাঞ্জনকে নিয়ে চললেন । সামনের একটা ভাঙাচোরা দরজা দিয়ে ঢুকতে যেন বদলে গেল সবকিছু ।

আকাশে মেঘ করেছে । গুমোট একটা অবস্থা । এতক্ষণের অনাহারের পর এবার শরীর যেন কিছু চাইছে । ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, বুড়ো মানুষটা । বলল, একটু জিরিয়ে কিছু মুখে দেবে চল । ওরা গিয়ে পৌঁছোল, একটা পুরনো সরাইখানার মতো একটা জায়গায় । সেখানে বেশ ভিড় । হৈহল্লা করছে লোকজন । অনেক বেঞ্চ পাতা, সামনে লম্বা টেবিল । মাথার ওপর বিরাট একটা টিনের শেড । আবছা অন্ধকার ।

খিদের মুখে ভাত ডাল পোস্ত দিয়ে দিব্যি কাজ চলে যায় । টিনের শেডে ততক্ষণে জলতরঙ্গ বাজছে । চারদিকে গান পান মিলিয়ে যেন একটা উৎসব । নীলাঞ্জনের মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল, অনেকদিন পর । অন্ধকার চোখ সয়ে এলে নীলাঞ্জন দেখল, পরমপিতার একটা ধূসর ছবি । একদিকে নিঃশব্দে বসে আছে বাবরি বাগিয়ে একজন, একজন তিমিরে । একজন ফরসা চেহারার লোক তার দিকে হেসে বলল, আমাকে লতিয়ে ধরবে না ! আরও কত ভাঙাচোরা চেহারার লোক কত কী বলছিল, তাদের গুঞ্জন থামল যখন প্রবল দাপট নিয়ে এসে দাঁড়ালেন টলটলায়মান প্রধান কবি... বাকি সব ৎ। তার পাশে সেই বুড়ো লোকটা । আরও অনেক লোকজন । একজন আন্তর্জাতিক, একজন দার্শনিক, একজন রঘু ডাকাত, আরেকজন বসন্ত মস্তান । সবাই বেশ রোগাভোগা হলেও একরোখা চোখমুখ ।

বোঝা গেল, প্রধান খুব রেগেছে নকল কবিতার দেশের ওপর । পাশের লোকটাকে বলছে, তোমার জন্যেই আজ এতো কবি ! সেজন্যেই এতো দলাদলি গলাগলি । সবাই সমস্বরে সমর্থন করল । বুড়ো লোকটা বিড়বিড় করে বলছিল, আমার মতোই সব গরীব ঘরের ছেলে, তাই জায়গা করে দিয়েছিলাম । লিখছে, খারাপ কাজ তো কিছু করছে না ! তাতে প্রধান ধমক দিল । সেই তিমিরে বসা লোকটা বলে উঠল, কাপালিকের মতো জীবন না কাটালে লেখা হয় না । কাব্যের দাবানলে আহুতি দিতে হয় সবকিছু, সুন্দর দেখতে বাবরি বলে উঠল ।

নীলাঞ্জনের মনে হল, সে অনেকদিনের পুরনো হারানো সভায় এসে পড়েছে । এবার দল বেঁধে যাওয়া হবে রাত্রি শাসন করতে । নেতৃত্ব দিলেন প্রধান কবি । সবাই উচ্চারণ করছে বীজমন্ত্র, আমি স্বেচ্ছাচারী !

সাজানো রাজপথ দিয়ে সদর্পে যেতে লাগল উলোঝুলো দলটা । ক্রমে সেই দল কিছুটা পথ পেরিয়ে এসে থমকালো সেই সাদা বাড়ির সামনে । দৃশ্য দেখে ভেতরের লোকজনের ভয়ার্ত চিৎকার বেশ শোনা যাচ্ছে । একদল ভাঙাচোরা লোকের কলমের জোর এতদিনে বুঝেছে তারা । নীলাঞ্জনের বুকের ভেতরটা যেন বেশ শান্ত হয়ে এসেছে, ধনুকের ছিলা শেষবারের জন্যে যেমন থমকে যায় ।

তারপর উড়তে লাগল শব্দবাণ । শুরু করলেন প্রধান স্বয়ং । একে একে সবাই । তীব্র শব্দের আঘাতে কাঁপতে লাগল সাদা প্রাসাদ । চারিদিকে যেন আগুনের হলকা । সেখান থেকে নীলাঞ্জন কুড়িয়ে পেল, আধপোড়া একটা পাণ্ডুলিপি – তাতে তার নাম লেখা ।

 


ঠিক তখনই নীলাঞ্জনের ফোনটা বেজে উঠল । নীলাঞ্জন চমকে উঠে ফোনটা ধরতে একটা রিনরিনে মহিলা কণ্ঠ । তিনি জানাচ্ছেন, তেরো বছর সাত মাস ন’দিন আগে জমা দেওয়া তার পাণ্ডুলিপিটি মনোনীত হয়েছে । প্রকাশ পাবে মেলায় । তখনই নীলাঞ্জন দেখতে পেল রিয়া আসছে রাস্তা পেরিয়ে ।

তাকে কাছে আসতে দেখে দীর্ঘদিন বাদে নীলাঞ্জনের মুখে সম্মতিসূচক হাসি ফুটে উঠল । রিয়া নিশ্চিন্ত হল। ভাবল, নতুন ওষুধটা তাহলে কাজ করছে ।