Sunday, November 27, 2022

ছোট গল্প - অভদ্র || লেখক - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Written by Sawntana Banerjee || Short story - Aovdro


 

অভদ্র
 সান্ত্বনা ব্যানার্জী


      
              কি বাজে জায়গায় বাড়িটা নেওয়া হয়েছে বাবা! ঘরে বসে থেকেই যত সব বাজে
লোকের মুখ খারাপ শুনতে হয়!.....খুব বিরক্ত
গলায় বলে রিমি।অফিস যাওয়া আসার পথে
বাবা মাকে দেখাশোনার সুবিধের জন্যই এখানে
বাড়িটা নেওয়া হয়েছে সেটা ভুলে যায়।আর অবাক হয়ে দেখে যে লোকটার বিরুদ্ধে ওর এতো অভিযোগ সেই লোকটাই তরতর করে
বাবার ঘরে ঢুকে এলো!.....এই জাম কয়টা রাখেন কাকা, এই মাত্র বাজারে দেখতি পেয়ে
কিনে নিলাম।সেদিন খুঁজছিলেন না!বহুত ভালো
জেতের জাম গুলো,খুব মিষ্টি!....বলেই জামের
ঠোঙা টা বাবার সামনে নামিয়ে দিয়ে আবার তেমনই তরবর করে চলে গেলো। রাস্তার উল্টো
দিকেই ওর মনোহারী জিনিসের দোকান।বাবা
আমতা আমতা করে বলে......নারে,একটু মুখ
খারাপ করে বটে,তবে মনটা ভালো,খুব উপকার
করে,খোঁজ খবর নেয়।এটা ওটা বাজার থেকে
এনে দেয়।.....আরও রেগে যায় রিমি......তবু একটা ক্লাস নেই!ওই ধরনের লোক যখন তখন
বাড়ির মধ্যে চলে আসবে!..... গজ গজ করতে
থাকে রিমি।বাবা ওকে থামানোর চেষ্টা করে.....যাক গে, ছাড়, চা খাবি তো?তোর মা চা করছে। বিস্কুটের কৌটো টা বাড়িয়ে ধরে সামনে।
আপাতত থেমে যায় রিমি,কিন্তু মন থেকে সরাতে
পারেনা একটা চাপা অস্বস্তি।তারা শিক্ষিত পরিবার,এখানে সবাই তাদের চেনে,কত নামী দামী মানুষ বাবার কাছে আসে,গল্প করে,গান শোনে।মাঝে মাঝেই গানের আসর বসে বাড়ীতে।
এর মাঝে ওই লোকটা বড়ো বেমানান! কথায় কথায় ব কারান্ত, শ কারান্ত ওর চলতেই থাকে।
  কোনদিন বাড়ীর মধ্যেই বলে দেবে তার ঠিক নেই।না,না,একটু আধটু উপকার করে বলে এই সব লোককে বাড়ীতে আসতে দেওয়া মোটেই 
ঠিক নয়।....নে চা খা,কি।ভাবছিস এত?.....মায়ের কথায় চমক ভাঙে রিমির।চা খেতে খেতে বলে.....না গো,ওই দোকানের লোকটা ,কি মুখ খারাপ করে কথা বলে,তাকে
তোমরা এত পাত্তা দাও কেন বুঝিনা!মা বলে.....
ও অজিত? তা কি করবো বল,সামনেই থাকে,দোকান ফাঁকা থাকলে আসে,একটু চা খায়,তোর বাবার কিছু দরকার পড়লে এনে দেয়,বাড়ী থেকেও এটা ওটা এনে খাওয়ায়।এখানে কোনো খারাপ কথা বলেনা,তবে দোকানে বলে, শুনতে পাওয়া যায়।......তবে আর কি!শোনো বসে বসে।....গজ গজ করতে করতে ব্যাগ কাঁধে তুলে  বেরিয়ে পড়ে রিমি।স্টেশনের পথে হাঁটতে থাকে। বড়ো অসহায় লাগে। নিজের বাড়িতে এনে রাখার উপায় নেই,
একখানা ঘর,আর এক চিলতে বারান্দা ঘিরে ওদের দুজনের মত ছোটো করে সাজানো সংসার ওখানে......।আবার ওই পরিবেশে বাবা
মাকে রাখতেও বড়ো খারাপ লাগে,অকালে চলে যাওয়া ভাইয়ের কথা বড্ড মনে পড়ে! ও বেঁচে থাকলে বাবা মা কে এভাবে ভেসে ভেসে বেড়াতে
হতো না।তবুও এই ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।বাড়িটার পজিশন খুব ভাল,স্টেশন, ব্যাংক,পোস্ট অফিস ডাক্তার ,সব কাছাকাছি।
আর অফিস যাতায়াতের পথে দেখাশোনা ও
করা যায় সাধ্য মত।ওদের বাড়ির পজিশন
সে দিক থেকে মোটেও সুবিধের নয়।সব কিছুই
দূরে দূরে,মোটর সাইকেলে যেতে হয়।তাই বাইরের সব কাজই করতে হয় অনিন্দ্য কে।এমন
কি রিমিকে স্টেশনে দিয়ে আসা,নিয়ে আসা পর্য্যন্ত।আজ অনিন্দ্য না থাকায় ওকে স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে ই আসতে হলো।ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেক টা জল খেয়ে ফেলে রিমি। তার পরই শুরু হয়ে যায় কাজ।ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো নামিয়ে রাখে সিংকে,এখুনি বন্দনা এসে
পড়বে আর ঝড় এর বেগে কাজ শুরু করে দেবে।কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে টিভিটা খুলে একটু
গা এলিয়ে দিয়ে বসে ডিভান টায়।অনিন্দ্য ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বসে ওর পাশে।দুজনকে দু কাপ
চা দিয়ে যায় বন্দনা।এই সময় টুকু বিশ্রাম নিতে নিতে একটু টিভি দেখে দুজনে।কিন্তু দেখবেই
বা কি!একটা ভালো কোনো প্রোগ্রাম আছে! সিরিয়াল গুলো তো.... শুধু দল বাঁধা বাঁধি,চক্রান্ত,সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ,বিষ খাওয়ানো,
এই সব। একটু যা ভালো লাগে রাসমণি ,বড়ো
ভালো করছে রাসমণি আর রামকৃষ্ণ!  আর সকালের গানের অনুষ্ঠান।তাও বিজ্ঞাপনের ঘটা!ক,টা গান ই বা শোনা হয়!আট টা তেই রান্নাঘরে
ঢুকে পড়ে রিমি। রাতের রুটি আর তরকারি করে
নেয়।তারপর সকালের রান্নার যোগাড় করে রাখে।ক,দিন থেকেই বাবা মায়ের জন্য একটু
রাইস আর পনীর করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে, হয়ে আর উটছে না।কালকে সকাল সকাল উঠে করতেই হবে।কিচেনে দেরাদুন রাইস, কাজু,কিসমিস, ঘী,গরম মশলা সব গুছিয়ে রাখে। বিনস,গাজর সরু সরু করে কেটে
ট্যাপার এ ভরে ফ্রিজে ভরে রাখে। পনীর সবজি
হালকা করে ভেজে রেখে দেয়,সকালে সুবিধে হবে।রাতের খাবার টেবিলে নিয়ে খেতে বসে দুজনে।আরও সব টুকি টাকি কাজ সেরে হাত মুখ ধুয়ে টানটান করে চুল বেঁধে মুখে ক্রিম ঘষতে থাকে রিমি।এই টুকু বিলাসিতা না করে
ও ঘুমোতে পারে না।আর সারাদিনের পর নরম
পাফ দিয়ে ওর পিঠে পাউডার মাখিয়ে দেয় অনিন্দ্য।এই আদর টুকু বড়ো উপভোগ করে
রিমি,সারাদিনের সব ক্লান্তি যেন.......,ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় নিশ্চিন্তে!
            সকালেই আবার কাজ শুরু। নিজেদের
জন্য মাছের ঝোল ভাত করে নিয়ে বাবা মায়ের জন্য রান্না করতে লেগে যায় দ্রুত হাতে। হট পটে
ভরে নেয়,রাইস,পনীর। আগের দিন করে রাখা পায়েস আর চাটনী টাও ভরে নেয় ব্যাগে।.....
কি গো তাড়া তাড়াতাড়ি করো, ট্রেন পাবে না কিন্তু।.....মোটর সাইকেল বার করতে করতে
বলে অনিন্দ্য। সব গুছিয়ে গেট এ চাবি দিয়ে
বেরিয়ে আসে রিমি,মোটর সাইকেলের পিছনে
বসতে বসতে বলে...... দেখো,আবার সে বারের
মত আমাকে না নিয়েই স্টেশনে চলে যেও না।....
মুচকি হেসে গাড়িতে স্টার্ট দেয় অনিন্দ্য।বাড়তি
ব্যাগটা নিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে
রিমি,দুটো তো মাত্র স্টেশন।প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে
পাশের সরু গলি পথ টা ধরে হাঁটতে শুরু করে ও।গরম গরম রাইস আর পনীর পেয়ে বাবার
মুখটা কেমন খুশিতে ভরে উঠবে এটা ভেবেই
বড়ো আনন্দ হয় রিমির।গলির শেষ প্রান্তে এসে
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রিমি!ওকি!বাবার বাড়ির
সামনে অত চিৎকার করছে কে!দ্রুত পা চালিয়ে
এগিয়ে যায় রিমি। দেখে পাশের বাড়ির অরুণ
বাবু চিৎকার করে বাবাকে কি যেন বলছে!
বাবা কেমন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।মা 
ভয়ে ভয়ে বলল....দেখনা,ওই ডাবের খোলা গুলো কারা অরুণ দের নাচে ফেলে গেছে আর
ও তোর বাবাকে দোষারোপ করে শুধু শুধু অপমান করছে। চারি দিকে তাকিয়ে কেমন
হতবাক হয়ে যায় রিমি!রাস্তার দু ধারে মানুষ জন
দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মত!একজন প্রবীণ মানুষকে এভাবে অপমান করছে কারও কোনো
প্রতিবাদ নেই!হটাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখে
মনোহারী দোকানের সেই মুখ খারাপ করা অজিত বীর বিক্রমে এগিয়ে আসছে!কিছু বুঝে
ওঠার আগেই বাবাকে ঘরে ঢুকিয়ে খাটের ওপর
বসিয়ে দিয়ে তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় অরুনের ঘাড় ধরে ওরই দরজায় চেপে ধরে আর চিৎকার
করতে থাকে......আর একবার ওই বুড়ো মানুষটার ওপর হম্বি তম্বী করে দেখ,তোকে কি
করি আমি!ভেবেছিস পিতিবাদ করার কেউ নেই!শা.........।কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকে
যায় অরুণ।আর হতবাক রিমিকে হাত নেড়ে
বলে অজিত......আপনি যান দিদি অপিস পানে,
নিছিন্তে,আমি আচি,কুনো ভয় নাইকো। ও কাকীমা দুকাপ চা করি দ্যান দিকি,আমি আর
কাকা খাই।......আবার গলা উচিয়ে বলে.....আর
এদিক পানে এলি ঠ্যাং খোঁড়া করি দিবো!ভেবেছো বুড়ো মানুষ কে যা খুশি বলা যায় লয়!
.....এতক্ষনে সম্বিত ফিরল রিমির। মায়ের হাতে 
খাবার দাবারের ব্যাগটা দিয়ে অস্ফুটে বলে....
সব গরম আছে,এখনই খেয়ে নাও,আর অজিত
দাদাকে দিও!

ছোট গল্প - রিকভারি স্টেজ || লেখক - ডা: অরুণিমা দাস || Written by Arunima Das || Short story - Recovery stage


 

রিকভারি স্টেজ

ডা: অরুণিমা দাস



ডা: রায় নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্ট প্রোফাইল গুলো চেক করছিলেন। পেশায় একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: সুশান্ত রায়। রোগীদের মানসিক স্বাস্থের প্রতি খুবই যত্নবান তিনি।খুব মন দিয়েই ফাইল গুলো দেখছিলেন।


হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলো,


মে আই কাম ইন ডক্টর।


ফাইল থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিস্টার অহনা চেম্বারে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছেন। একগাল হেসে ডা: রায় বললেন ইয়েস,প্লীজ কাম ইন অহনা।


অহনা এগিয়ে গিয়ে একটা ফাইল তুলে দেয় ডা: রায়ের হাতে, আর বলে স্যার এটা মোনালিসার ফাইল, ও এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছে। মেডিসিন গুলোও সময় মত খাওয়াচ্ছি। স্যার ওকে কবে নিয়ে যেতে পারবো বাড়ী, সময় এলেই নিয়ে যেতে পারবেন,বললেন ডা: রায়। বলেই চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ফাইলটাতে। হেসে বললেন অহনা ইট ওয়াস নট পসিবল উইদাউট ইউ। অহনা বলল স্যার আমি তো শুধু কেয়ার নিয়েছি ওর, আর আপনি তো ওকে অ্যাসাইলামে আনা থেকে শুরু করে প্রপার মেডিসিন আর রেগুলার কাউন্সেলিং করে রিকভারি স্টেজে নিয়ে এসেছেন। ডা: রায় হেসে বললেন এটাই তো আমার কাজ সিস্টার। আর এই কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। একগাল হেসে অহনা বলে জানিতো স্যার,আপনি রোগীদের কতো টা ভালোবাসেন। আপনি তাহলে ফাইলটা চেক করুন স্যার, আমি একটু পরে আসছি। মোনালিসার লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে, বললো অহনা।


ও শিওর, প্লীজ গো। অহনা বেরিয়ে গেলো।


মোনালিসার ফাইলটা দেখতে দেখতে ডা: রায় ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে লাগলেন অতীতের দিনে,মনে পড়ে গেলো বছর দুই আগেকার কথা। এক ঝড় বৃষ্টির দিন হসপিটাল থেকে রাউন্ড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ গাড়ীর সামনে এসে পড়ে একটি মেয়ে। গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। অত রাতে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন উনি। জ্ঞান ফিরলেও নিজের নাম বলতে পারেনি সেই মেয়েটি। কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি আর এলোমেলো চুলে তাকিয়েছিল সে। সেই রাতে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি ডা: রায়। পরদিন সকালে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে ডা: রায় কিছু লোকজনকে মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন মেয়েটি মানসিক ভারাম্যহীন,নাম মোনালিসা,থাকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের এক ঝুপড়িতে। ওর বাড়ি কোথায় আর কেনোই বা ও এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে এসব জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে ডা: রায় অনেক কিছু জানতে পারেন। একটি ছেলেকে ভালোবাসতো মোনালিসা, কিন্তু বাড়ির কেউ সেটা মেনে নেয়নি। পালাবার প্ল্যান করেছিল ছেলেটির সাথে। ধরা পড়ে যায় দাদার হাতে আর বেধড়ক মার খেয়ে ছেলেটির মৃত্যু হয় সেদিন। এই নৃশংস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে মোনালিসা পাগলের মত হয়ে যায়, নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে। দাদারা ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে আটকে রাখে। চেঁচামেচি করলেই জুটতো মারধর আর অকথ্য গালাগাল। খেতেও দিতো না ঠিক করে। একদিন দাদারাই বোনের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসে। ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের ছেলেরা ওকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের কুঁড়েতে রেখে আসে। খাওয়াদাওয়া কিছু করেনা, সারাদিন রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। শুনতে শুনতে ডা: রায়ের মনটা ভার হয়ে ওঠে। উনি বলেন আজ থেকে ওর চিকিৎসার দায়িত্ত্ব আমার। ওকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখবো,দেখি কতটা সুস্থ করে তুলতে পারি ওকে। সবাই বললো, চেষ্টা করে দেখুন স্যার। সেইদিন থেকে মোনালিসা কে সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেন ডা: রায়।


প্রথম প্রথম একটা ঘরে বেঁধে রাখা হতো মোনালিসা কে। ইলেকট্রিক শক থেরাপি থেকে শুরু করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি সব কিছু চলতো। আর সাথে অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন এবং সিস্টার অহনার রুটিন কেয়ার। এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রয়াসে আজ মোনালিসার হাত পায়ের বাঁধন খুলে গেছে, মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে সক্ষম। সময় ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কঠিন বাস্তবের প্রেক্ষাপট তার মানসিক কাঠিন্য আরো সুদৃঢ় করে তুলেছে। আত্মনির্ভর হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। আর যাইহোক,বাড়িতে কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নয় মোনালিসা। বাড়ির লোকেদের নির্মম অত্যাচার কিছুতেই ভোলেনি সে। সিস্টার অহনা ঠিক করেছে মোনালিসা কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে,অনাথ জীবনে বোনের অভাব দূর হবে। ডা: রায় ও পারমিশন দিয়েছেন। মোনালিসাও অহনাকে দিদির মতোই ভালোবাসে।

স্মৃতির পাতা থেকে চোখ তুলে মোনালিসার ফাইলে নতুন মেডিসিন গুলো লিখতে লাগলেন ডা: রায়। কল করে অহনাকে ডাকলেন তিনি। অহনা এলে বললেন জাস্ট দুটো মেডিসিন দেওয়া আছে, লো ডোজ, উদ্বেগ কমাবে আর মন শান্ত রাখবে। এগুলোই এখন থেকে খাবে মোনালিসা। আর ওষুধের থেকেও ওর দরকার এখন ভালোবাসা,সহমর্মিতা যেটা ওকে রিকভারি স্টেজ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবে। অহনা বলল আমি সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো স্যার। ডা: রায় বললেন আমি জানি আপনিই পারবেন একমাত্র,তাই আপনাকে পারমিশন দিয়েছি। ফর্মালিটি গুলো পূরণ করে আপনি আগামী সপ্তাহেই আপনার নতুন বোনকে নিজের বাড়ী নিয়ে যেতে পারবেন। অহনা ধন্যবাদ জানিয়ে একছুটে মোনালিসার কেবিনে গিয়ে বললো আমার সাথে যাবি তো নাকি। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মোনালিসা বললো হ্যা দিদি, তোমার আর ডা: রায়ের হাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে, নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। তোমাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকবো আমি। কোথাও যাবো না তোমায় ছেড়ে।কেবিনে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না ডা: রায়। দিদি আর বোনের ভালোবাসার কথোপকথন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন এই বন্ধন যেনো অটুট থাকে চিরকাল আর মোনালিসার নতুন জীবন যেনো সবসময় খুশি আর আনন্দে ভরপুর থাকে। কোনো দুঃখ যেনো ওর মনকে ছুঁতে না পারে কোনোদিন। কেবিনের দরজা বন্ধ করে ডা: রায় হাঁটা দিলেন অন্য পেশেন্ট গুলো দেখবেন বলে। আরও কেউ হয়তো রিকভারি স্টেজ থেকে সুস্থ জীবনে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করছে যে দুটোর মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে দিতেই তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।



Friday, November 25, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -28


 


দেবীদাসের সাক্ষাৎ ডায়েরীতে ভদ্রলোকের নামতো নেই-ই, এই প্রথম দেখল ভদ্রলোককে। তবে কি তার বাবার সাথে পরিচয় আছে! হতে পারে, বাবার সাথে বহুজনের পরিচয় আছে যেহেতু তিনি একজন বিগ ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিষ্ট।


 ওর পরিচয় জানতে চাইলে পর প্রথম প্রশ্নের উত্তর চাইলেন ড্রাইভার। উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে দেবী রায়, বাবাকে আপনি চেনেন? না। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি।

 ব্যাকগ্রাউন্ডের তথ্য? চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। দেবীদাসের অতীত নোংরামীতে পরিপূর্ণ তার অজানা নয় ।

 মুকুলকে জানতেন ?

 মুকুল অর্থাৎ মুকুল বক্সী এই শহরের খ্যাতনামা এ্যাডভোকেট তারাপদ বক্সীর একমাত্র আদুরে কন্যা। কি মনে পড়েছে?

 ট্যারা চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলেন, গভীর ভালোবেসে কেনই বা আপনাকে ত্যাগ করল।

 অন্তর্যামী ভদ্রলোকের কথা গুলো শুনেই ঘামতে শুরু করলো। ও মনে মনে চিন্তা করতে থাকলো মুকুলের কথা কোন দিন কোন মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সে। ওর সাথে কি করে ভালোবাসা হয়েছিলো তা আজ অবধি মনে আছে। সে একজন এমন স্মার্ট মেয়ে ছিলো যে কোন ইয়ং ছেলে ওর কাছে ঘেঁসতে পারতো না। মেলামেশা তো দূরের কথা, ওর সংস্পর্শে আসা ছিলো অত্যন্ত দুঃসাধ্য। বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী রতন মজুমদারের একমাত্র ছেলে স্বপন তাদের পাঁচ বন্ধুর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছিলো, যদি মুকুলকে কেউ নিজেদের আয়ত্বে অর্থাৎ ওর সাথে প্রণয় লীলা শুরু করতে পারে, তাকে পরীক্ষার পর পুরী নিয়ে যাবে। যাতায়াতের ভাড়া ও অন্যান্য যাবতীয় খরচা সে বহন করবে।

 ধীরে ধীরে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। কেউ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারল না। এবার দেবীর পালা। একে যে জয়ী হতে পারবে এর কোন গ্যারেন্টি নেই। তবুও প্রতিযোগিতায় সামিল হতে হলো কারণ ওদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হবে।

 কিন্তু প্রতিযোগিতায় সে যখন সামিল হচ্ছে তাকে পরাজিত হলে চলবে না। তিন দিন পর পাড়ারই এক মস্তান বাচ্চুদার কাছে শলা পরামর্শ করে তাকে পথ বাতলে দিলো। অবশ্য কার্য হাসিল হলে পর সেলামী স্বরূপ কিছু টাকা ওকে বকশিশ দিতে হবে।

সেদিন বিকেল। সূর্যের রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। শহরের এক কোণে থালার মতো সূর্যটা সারাদিন ক্লান্তির অবসাদে তাড়াতাড়ি বিদায় নেবার জন্য ব্যস্ত। মুকুল তার প্রিয় আদুরে সাদা ধবধবে এ্যালসিসিয়ান ডগটা নিয়ে নিজের বাড়ীর অভিমুখে দ্রুত পা বাড়িয়েছে। প্রতিদিন স্কুল হতে বাড়ীতে ফেরার কিছু পরেই নিকট পার্কে। বেড়াতে আসে। ওর নিত্য অভ্যাস বেড়ানো। আজকের মতো অন্য দিন এতো লেট করে না বাড়ী ফিরতে। একটু পরে শহরের বুকে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই দ্রুত গতিতে পা দুটো চালাচ্ছিল। পথি মধ্যে দুর্ধর্ষ বেশ লম্বা চওড়া লোকটা আটক করবে কল্পনা করেনি। একটু দূরে একটা কালো রঙের এ্যামবাসাডার দাঁড়িয়ে ছিল।

লোকটা মুকুলের পথ রোধ করে বলল, এই রকম মেয়েটিকেই নিশিবন্ধু করতে চাইছিলাম। কোন ভয় নেই ডারলিং, মাত্র কয়েক ঘন্টা থাকবে কাছে, তারপর এইখানেই পৌঁছে দেবো। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার ন্যায় এক সুন্দরী রাজকন্যাকে কি সহজে কেউ ছাড়তে চায় ? হাতে বেশী সময় নেই, ভদ্রমেয়ের মতো চটপট ট্যাক্সিতে উঠে পড়ো, নতুবা -

মুকুল ভয়ে কাঁপতে থাকল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারল না। চোখের সামনে ভেসে উঠল গতকাল পেপারের মধ্যখানের পৃষ্ঠা। বড় বড় হরফে লেখা ছিল, “এই বর্তমান যুগে কি নারী ধর্ষণের পালা কমবে না? গতকাল অমুক জায়গায় অমুক এক গলির মধ্যে এক আঠার / উনিশ বৎসরের অবিবাহিত মেয়েকে একা পেয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে, ফলে সেই মেয়েটির অবস্থা এমন শোচনীয় যে,...

মুকুল চিৎকার করে উঠে। মুকুল চিৎকার করে উঠতেই লোকটা মুকুলের মুখটাতে রূমাল চাপা দিয়ে ট্যাক্সির ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল, ঠিক সেই সময় মটর সাইকেলে চড়ে বীর পুরুষের মতো ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো দেবীদাস। হাতে রিভলভার, অবশ্য ওটা নকল। রিভলভারটা হাতে শক্ত করে ধরে নবাবী কায়দায় বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ওকে ছেড়ে দিন বন্ধু, নতুবা ছয়টা গুলি বুকের মধ্যে ভেদ করবে। আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট কোনদিন হয়নি।

লোকটা ভদ্র সন্তানের মতো ছেড়ে দিল। মুকুল মুক্তি পেয়ে দেবীর কাছে এসে হাঁপাতে শুরু করল। সত্যিই একটা রোমান্টিক ঘটনা ঘটে গেল যেন। লোকটা ভয় পেয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। অর্থাৎ দেবীদাসের কথা মত কাজ করল। এবার না জানার কোন প্রশ্নই উঠে না। বন্ধুদের কাছে প্রতিযোগিতায় জিততে গিয়ে সে সত্যিই মুকুলের প্রেমে পড়বে দেবী, মনে হয় জীবন অভিধানে কোন জায়গাতে লেখাছিল বলে মনে হয় না। ভালোবাসা যে কি জিনিষ জানতো না অনেক সাহিত্যিকের প্রেমের গল্প / উপন্যাস পড়েছে সে, তখন হয়তো বই এর মধ্যে নায়ক / নায়িকার প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুভূতি বা শিহরণ জানত না সত্য কিন্তু বাস্তবে যে এর মূল্য বা তাৎপর্য কতখানি তা প্রেমে না পড়লে বোঝা যায় না। বিশেষ করে ঐ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কয়েকদিন পরে যখন দেবীদাসের জন্ম দিনে মুকুলের বাবা নিমন্ত্রিত হয়ে এসে ছিলেন তাদের বাড়ী, সাথে মুকুল ও ছিল। সে কখনো জানতো না মুকুলের বাবা ছিলেন তার বাবার হিতৈষী বন্ধু।

দিন কয়েক পর বন্ধু মহলে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হলো। তার বলার প্রয়োজন হলো না মুকুল তার আয়ত্বে এসেছে কিনা। তার সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ চাইল সকলে মিলে একদিন পিকনিকে যাবে এবং মুকুলও তাদের সাথে যোগ দেবে। পিকনিক হতে ফেরার সময় তারা তার বুদ্ধির তারিফ করল এবং দেবীকে বিজয়ী সম্মানে ভূষিত করল।

এরপর তাদের প্রণয়লীলা বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। তাদের ভাব ভালোবাসার লীলা কিভাবে নিজেদের মধ্যে বিস্তার করতে হয় কেউ জানিয়ে দিলো না। তারা দুই লীলা সহচরী যত্র তত্র একই সঙ্গে যাওয়া আসা ও প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতো। এমন কি উভয়ে স্থির করেছিলো, পড়াশেষে হলে তারা দুজনে কপোত কপোতীর ন্যায় সুখের নীড় বাঁধবে।

অবশ্য বন্ধু মহলে এই গুঞ্জন অনেক আগেই উঠেছিল। এইভাবে আননন্দ উল্লাসে পর পর তিন বছর কেটে গেলো। কখন যে দিন গুলো নদীর স্রোতের মত পেরিয়ে যাচ্ছিল জানতেই পারল না। বন্ধুদের মধ্যে অনেককে ত্যাগ করতে হল দেবীদাসকে। নিজের জীবনের লক্ষ্যকে অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। সে ও মুকুল একই পথের যাত্রী, ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের জীবন সঙ্গী নির্বাচনের অন্তিম লগ্নের দিকে।

কিন্তু কোনদিন কল্পনা করেনি দেবী, তারা দুজনে যে প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিল। তা ঝটিকাঘাতে শেষ স্নিগ্ধ দীপশিখা একদিন হঠাৎ নিভে যাবে। কোন দিন বন্ধু মহলে। কেউ কল্পনা করতে পারেনি মুকুল ও দেবীর মধ্যে প্রেমের বন্ধন রজ্জু একদিন ছিন্ন হয়ে যাবে। শুধু ওরা কেন, যে কেউ তাদের প্রণয় ইতিহাস শুনে থাকলে বিশ্বাস করবে না। তাদের বিচ্ছেদকে। কারণ অবশ্য ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। প্রেমের খেলায় পরাজিত তো হল, কিন্তু পরাজিতের যে এতো জ্বালা তা তার জানা ছিল না।

বানবিদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ছটপট করতে থাকল মুকুলের সাথে বিচ্ছেদের পর। সমস্ত শরীরের দংশনের জ্বালা অনুভব করতে লাগলো। অতীত কাহিনী তার স্মৃতিপটে ভেসে যেতে লাগলো। সেই বিকাল, সেই পার্ক, সিনেমা ও পাশাপাশি বসে গল্প করা। কিন্তু কেন এমন হলো ?

 তবে কি দেবীদাস বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে বারাঙ্গনালয়ে হাজির হয়েছিল বলে ? তাই যদি হয় ও জন্য মুকুলই দায়ী, হ্যাঁ-হ্যাঁ দেবী কর্কশ কণ্ঠে বলবে, এর জন্য মুকুলই দায়ী। কেন সে তার প্রতি অবিচার করল। সে তো তার কাছে স্বীকারই করেছিল ভুলবশতঃ এক চরিত্রহীন লম্পট বন্ধুর পাল্লায় পড়ে পতিতালয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ওর পরে দ্বিতীয় বার সে স্থানে যাবার চেষ্টা করেনি। তবে কি সুমন্তই তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াল ?

 দেবী সেদিন মুকুলের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে আসছিল, সেদিন সুমন্তকে দেখেছিল ওদের বাড়ীতে। না-না সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। এ ভুল ধারণা। দেবীদাসের ও মুকুলের বিচ্ছেদের জন্য কেউ দায়ী নয়। এমন কি তার লম্পট বন্ধু রন্টুকেও দায়ী করে না। দায়ী তার ভাগ্য। নইলে কেনই বা রন্টুর সাথে পতিতালয়ে হাজির হবে সে। সেদিনের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

Thursday, November 17, 2022

ছোট গল্প - বদ || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Written by Alabhya Ghosh || Short story - Bod


 

    বদ 

অলভ্য ঘোষ 


আমি তখন স্কুলে পড়ি একটি ছেলে বখে গিয়েছিল।লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট খেত কেবল না গঞ্জিকা সেবন ও করতো।আমাকে অনেকে বারণ করতো ও খারাপ ছেলে তুই ভালো ছেলে ওর সাথে মিশিস কেনো।খারাপ হয়ে যাবি।আমার ভালো ভালো ছেলে গুলোর চাইতে খারাপ ছেলেটাকেই বেশি ভালো মনে হতো।কারণ তার ভালো সাজার কোন দায় ছিলনা।কে তাকে খারাপ বলবে তাতে তার কিছুই যেত আসতো না।আর আতু আতু পাতু পাতু ভালো ছেলে গুলোর ছিল সর্বদা লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা।গজ-দম্ভ মিনারে বাস!আমার মনে হত একটা খারাপ ছেলে যদি একটা ভালো ছেলেকে খারাপ করেদিতে পারে তবে একটা ভালো ছেলে একটা খারাপ ছেলেকে কেন ভালো করতে পারবে না।যদি সে সত্যিই ভালো হয়।যদি ভালো ছেলেটা খারাপ ছেলেটার ভালো না করতে পারে তবে ভালো ছেলেটার ভালো গুণে খামতি আছে।অমন ভালো হওয়ার চাইতে না হওয়া ভালো। আমি ছেলেটার সাথে স্কুলে যেতাম।ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ,নেতাজি সুভাষ-চন্দ্র বসু,মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা, রবিনহুড প্রতিদিনই এক একটা গল্প শোনাতাম।


"উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, 

তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে !"


ছেলেটা আমাকে একদিন একটা মাঠের মাঝে নিয়ে গিয়ে বলল;

-তুই তোর জ্ঞানের কথা রাখ।কত বড় হিম্মত আছে বিড়ি খেয়ে দেখা।


আমি বললাম;

- বিড়ি খেতে আবার হিম্মত লাগে নাকি।


ছেলেটা বলল;

-মুখে বললে হবে কেন খেয়ে দেখা।


ওর হাত থেকে একটা বিড়ি নিয়ে মুখে ধরলাম।দেশলাই কাঠি জ্বেলে ও আমার মুখাগ্নি করার সাথে সাথে ওর মুখটা যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো আনন্দে। বিড়িটা ঠিকমতো জ্বলেনি তখনো ফিরিয়ে দিতেই সে ফুরফুর টান দিতে লাগলো আমার মুখের বিড়িটা আনন্দের চোটে।এ আনন্দ কিসের আনন্দ আমি আন্দাজ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রকাশও পেলাম।ছেলেটা জনে জনে স্কুলে সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো আমাকে সে বিড়ি খাওয়াতে পেরেছে।কেউ কেউ বিশ্বাস করলো ছিঃ ছিঃ করে বলল আমি উচ্ছন্নে গেলাম।কেউ কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না।আমার মত ভালো ছেলে তেমন কোন কাজ কখনোই করতে পারে না।বরং ছেলেটার ওপর তাদের বিশ্বাস ছিল না।


আমি ছেলেটার সাথে পরের দিনও প্রস্তুত হলাম স্কুলে আসতে নতুন একটা গল্প শোনাতে।ছেলেটা তখন আমায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে ভাবটা এমন তার আর আমার মধ্যে এখন কোন ফারাক নেই।তবে কেন বাপু জ্ঞানের কথা অতো।


আমার খুব হাসি পেয়েছিল।আমি বিড়িটা মুখে ধরেছিলাম কিন্তু ধোঁয়াটা কখনোই মুখের ভিতর টানিনি।ছেলেটাকে বলেছিলাম শোন কে আমাকে ভাল-বলবে তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি নিজের কাছে নিজে কতটা ভাল।আমার পথ যদি তোর পথের থেকে উৎকৃষ্ট হয় তোকে আমার পথে আসতেই হবে। তোর পথ যদি আমার পথের থেকে ভালো হয় আমি তোকে কথা-দিলাম নির্দ্বিধায় তোর পথে হাঁটব।


ছেলেটাকে আমি সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বলেছিলাম পথ হাঁটতে হাঁটতে।


সময় টা বর্ষাকাল জঙ্গলের মধ্যে সিক্ত বুদ্ধদেব তখন ধ্যানে মগ্ন থাকেন সারাদিন।কর্দমাক্ত পথে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না জঙ্গল সন্নিকট নগর থেকে ভিক্ষানুসন্ধানে বেড়য় শিষ্যগণ।কোনদিন ভিক্ষা জোটে কোনদিন ভিক্ষা জোটে না।যেদিন জোটে সেদিন আহার্য গ্রহণ করে।যেদিন জোটে না খেতে পায় না।খাদ্যের চেয়েও অন্তরায় প্রকৃতি বর্ষা মুখর দিনে জঙ্গলে থাকা দুরূহ।একটা ছাউনি খুব প্রয়োজন।


বুদ্ধ শিষ্যদের বলেন;

- যাও দেখো নগরে একটি ছাউনি মেলে নাকি।


কিন্তু নগরে কিছু লোক তাদের ভিক্ষা দিতে সম্মত হলেও ছাউনি দিতে কেউয়ই চায় না।অবশেষে এক পতিতা তাদের ভিক্ষা ও ছাউনি উভয় দিতে সম্মত হয়।


শিষ্যরা ফিরে এসে গুরুকে জানাল;

- ছাউনি পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিন্তু......


বুদ্ধ বলেন;

-কিন্তু কি?


শিষ্যরা সংশয়ের সাথে বলেন;

-কিন্তু গুরুদেব তা বেশ্যালয়।


বুদ্ধ বললেন;

-আমরা সন্ন্যাসী ভিক্ষুক।আমাদের কাছে বেশ্যালয় আর দেবালয়ের মধ্যে কোন ফারাক নেই।চলো সেই উত্তম স্থানে আমাকে নিয়ে চলো।


শিষ্যরা বুদ্ধকে সেই বেশ্যালয়ে আতিথেয়তার জন্য নিয়ে গেলত বটে কিন্তু মনের মধ্যে সংশয়ে দোদুল্যমান রইলো এই ভেবে যে তাদের সন্ন্যাস ব্রত থেকে স্খলন ঘটতে আর বেশি দেরি নেই।এদিকে বুদ্ধকে অতিথি হিসেবে পেয়ে লাস্যময়ী বারবনিতা টি কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না।কিভাবে কতটা সেবা করলে প্রভু পরিতৃপ্ত হবেন।বুদ্ধের সিক্ত বস্ত্রের বদলে তিনি তাকে রেশমের কোমল গরম কাপড় পরিধান করতে দিলেন।সুগন্ধি খাদ্য পানীয় আহার করতে দিলেন; এমনকি তার মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্যও পরিবেশন করতে লাগলেন।আর এই প্রতিটি পদক্ষেপে শিষ্যরা আঁতকে উঠতে লাগলেন তবেকি তাদের গুরুদেব বশীভূত হয়েছেন এই সামান্য কয়েক কড়ির বেশ্যার!


বুদ্ধ শিষ্যদের ডেকে বলেন;

-শোন বাইরের কোন কিছুতেই মানুষের স্খলন ঘটে না।মানুষের স্খলন ঘটে ভেতরের দ্বিচারিতায়!


আমি থেমে বলেছিলাম;

- তারপর কি হয়েছিল জানিস?


ছেলেটা বোকার মত বলেছিল;

-কি?


আমি বলে ছিলাম;

-বুদ্ধদেব যখন সেই বেশ্যাখানা ছেড়ে চলে গেলেন।সেই বেশ্যাও তার পিছু নেয় সন্ন্যাস গ্রহণ করে।


ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।

-এসব ঢপের গল্প।শোন নগরের পথে ওই ভিখারি আর খানকি টা যদি এক সাথে বেড়য় লোকে ভিখারি কে ছেড়ে খানকির পেছনে ছুটবে কারণ সে বেশি আকর্ষণীয়।


কয়েক দিনের মধ্যেই আমি স্কুলে পেট ধরে বাবাগো মাগো করে উঠলাম।সর্বাগ্রে যে এগিয়ে এল সে ওই বিড়ি খাওয়া ছেলে টা।ওই টিচার্স রুমে গিয়ে শিক্ষকদের খবর দিল কেবল নয়।রিকশা ডেকে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।শিক্ষক মহাশয় রা জরুরি অবস্থার জন্য স্কুলে সংরক্ষিত সাধারণ পেট ব্যথার ট্যাবলেট দিয়ে ছেলেটাকে আমার বাড়িতে পাঠাল খবর দিতে।


মায়ের কাছে কোন কিছু লুকানোর সাধ্য আমার নেই।তড়িঘড়ি আমার মা খবর পেয়ে ছুটে গেল স্কুলে এবং আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে প্রথম যে কথাটি বলেছিল সেটি হল;

- তোমার কিছুই হয় নি।


আমি মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিলাম।


মা কেবল বলেছিল;

- আর যেন এমন করোনা।


মা আমাকে জানতে চায়নি কেন আমি পেট ব্যাথার অভিনয় করেছিলাম।আমার স্কুল কখনো কামাই হতো না স্কুল থেকে পালিয়ে আসাত দূর।মা ভালকরেই জানতো এর পেছনে আমার কোন স্কুলের চাইতেও বড় কোন জীবন পাঠ লুকিয়ে রয়েছে।পাঠটি ছিল; আমি কি ঠিক না ভুল?Am I right or wrong?সমগ্র জীবনটা তো একটা পাঠশালা।


বহুদিন বাদে সেই ছেলেটি পথে আমায় ধরে বলল গল্প বলেবলে তুই আমার মাথাটা বিগরেদিলিরে।


আমি বললাম;

-যে মানুষ তার বদ বুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে সেই বুদ্ধ।আর যে মানুষ তার বদ বুদ্ধির নিচে চাপা পড়ে থাকে তারা বুদ্ধু।


Wednesday, November 16, 2022

ছোট গল্প - যমজ || লেখক - অমিত কুমার জানা || Written by Amit Kumar jana || Short story - Jomoj


 


  যমজ
অমিত কুমার জানা


অনুপ এবং অজিত দুই যমজ ভাই। দুজনকে দেখতে হুবহু একই রকম এবং হাঁটা চলার ধরনও প্রায়ই একই। তবে ছোটবেলা থেকে পাঁচ মিনিটের ছোট  অজিত অনুপের চেয়ে বেশ দুষ্টু। অজিতের এই দুষ্টুমি বড় হওয়ার সাথে সাথে কমলো না,বরং বদমায়েশিতে পরিণত হলো। সে বিভিন্ন ধরনের অকাজ কুকাজ করে আনন্দ পেতে শুরু করলো। এদিকে অনুপ কলেজের পড়াশোনা শেষ করে পুলিশের চাকরি পেল। অবশ্য এর জন্য তাকে নিয়মিত অনেক পরিশ্রম এবং পড়াশোনা করতে হয়েছে। 
অজিত কলকাতার একটা কলসেন্টারে কাজ করতো। এতেও তার ধৈর্য্য ছিল না। মাঝেমধ্যেই কারণে অকারণে বাড়ি চলে আসতো। ইতিমধ্যে কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সংকট রেখা অতিক্রম করলো। কলকাতায় শয়ে শয়ে মানুষ সংক্রামিত হলো এবং মারা যেতে লাগলো। করোনার ভয়ে অজিত বাড়ি ফিরে এলো, মেদিনীপুর শহরে। এদিকে অনুপ করোনা আক্রান্ত হয়ে নিজ গৃহে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে। সে বাড়ির বাইরে সচরাচর বেরোয় না। অনেক দিন পর অজিতকে দেখে মা উলপীদেবী ভালো মন্দ রান্না করে খাওলেন এবং তাকে সাবধানে থাকতে বললেন। কারণ ভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার না করলে নির্ঘাত করোনা আক্রান্ত হতে হবে। কিন্তু অজিতের অনুপকে দেখেও শিক্ষা হলো না,সে ইচ্ছাখুশি এদিক ওদিক বেড়াতে লাগলো।  অজিতের বেপরোয়া ব্যবহার ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। পাড়ার অনেকেই তার দিকে আঙুল তুলে অভিযোগ করলো যে সে কলকাতা থেকে এসে টেস্ট, আইসোলেশন এইসব কিছু না মেনে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? অজিত এসব কথায় তোয়াক্কা না করেই বললো যে তার যা মন চায় তাই করবে। শুধু তাই নয় সে এই ভয় দেখায় যে তার দাদা অনুপ পুলিশ, বেশি ঝামেলা করলে দাদাকে দিয়ে লক্ আপে ঢুকিয়ে দেবে।

এদিকে অসুস্থ অনুপ বাড়িতে আইসোলেশনে সময় কাটাচ্ছে। যদিও সে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। বাড়িতে সব্জি ছিল না। মা অজিতকে বাজার যেতে বলে বাথরুমে চলে গেলেন। অজিতের মাথায় একটা বদমায়েশি বুদ্ধি খেলে গেল। সে তার দাদার পুলিশ ইউনিফর্ম এবং ক্যাপটা পরে নিল। তারপর মুখে মাস্কটা লাগিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাজার করতে। শহরেরের প্রান্তের হাইরোডে যেখানে তুলনামূলক জনসমাগম বেশ সেখানে দাঁড়িয়ে রুললাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর সে ঘুষখোর পুলিশি স্টাইলে তোলাবাজি শুরু করলো।  বাইক আরোহী যারা যারা হেলমেট এবং মাস্ক পরেনি তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা নিতে লাগলো। মাস্কহীন ফোরহুইলারের ড্রাইভারও রেহাই পেলো না। এক দু ঘন্টায় অজিতের দু পকেট টাকায় ভরে গেল। এরপর অজিত মহানন্দে বাজারে গিয়ে বাজার সেরে পান সিগারেট খেয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।

এর পরদিনের ঘটনা। অজিত মাস্ক পরে বাইক নিয়ে দিব্যি বাজারে বেরিয়ে পড়ল। পঞ্চুর চকে চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। যদিও এই সংক্রমনের সময়ে চা পানের দোকান খোলা সরকার কার্যত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শোনে আর কয়জন?
এক যুবক চা পান খেয়ে  দোকান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ।দোকানি তাকে বললেন যে এই সাতসকালে খুচরো নেই তাই বাকি দুশো  টাকা একটু পরে এসে যেন সে নিয়ে যায়। যুবকটি মাথা নেড়ে বাইক নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। ঠিক এই সময়ে চায়ের দোকানের দিকে বাইক নিয়ে এলো অজিত। উক্ত যুবকের জামা প্যান্টের কালার হুবহু অজিতের মতোই ছিল। এবার অজিতের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। সে বাইক নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। দশ পনের মিনিট পর অজিত মাস্ক পরে আবার ওই চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে চা দোকানীকে বলল যে আমার পাওনা দুশো টাকা দিন। দোকানদার অজিতকে উক্ত যুবক ভেবে অজিতকে দুশো টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।

এর কিছুক্ষণ পর উক্ত যুবকটি চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে দোকানীকে বললো, " আমার পাওনা দুশো টাকা দিন।"
দোকানী অবাক হয়ে বললো, "তুমি তো এখনই দুশো টাকা নিয়ে গেলে! মাস্ক পরে টাকা মারার ভালোই সুযোগ পেয়েছো।"
যুবকটি রেগে ফেটে পড়লো এবং বললো, " এখনই আমার টাকা দিন নইলে পুলিশ ডাকবো। আমার পাওনা আমি নিয়েই ছাড়বো। ভালো চান তো দিয়ে দিন।"
এইভাবে তর্কাতর্কি হতে হতে দোকানদারের সাথে যুবকটির তুমুল বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অনেক লোক জড়ো হলো। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ হাজির হলো।
পুলিশের এসেই প্রথমে চায়ের দোকানিকে গালিগালাজ শুরু করলো। পুলিশ বলল যে আপনি কি জানেন না এই লকডাউনে চা পানের দোকান খোলা নিষিদ্ধ। দোকানদার কাঁচুমাচু হয়ে হাত জোড় করে পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এরপর পুলিশ এই ঝামেলার কারণ শুনে হেসে ফেলল। ঠিক এই সময় উপস্থিত একজন ছেলে পুলিশকে বলল, "যে দুশো টাকা যে নিয়ে গেছে তাকে দেখতে অনেকাংশে অনুপদার মতো।"

পুলিশ ঐ ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে অনুপের বাড়িতে চললো। অনুপের মা উলপীদেবী দরজা খুললেন। পুলিশ দেখতে পেল অনুপ একটা আলাদা রুমে কোয়ারেন্টাইনে আছে, সে করোনা আক্রান্ত। উলপীদেবী বললেন যে অনুপ দশ বারো দিন বাড়ি থেকেই বেরোয় নি।  ঠিক এইসময় বাথ‍রুম থেকে বেরিয়ে এলো অজিত। পুলিশ একবার অনুপ একবার অজিতের দিকে তাকিয়ে উলপীদেবীর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। দুজনকে একেবারে একইরকম দেখতে। উলপীদেবী বললেন, "এ হলো অজিত,অনুপের যমজ ভাই। এবার পুলিশের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে চায়ের দোকানীকে বোকা বানিয়ে এই অজিতই দুশো টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
পুলিশ এবার ডাইরেক্ট অজিতকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি তোমার দোষ এখানেই স্বীকার করবে নাকি থানায় নিয়ে গিয়ে বাধ্য করাবো।" পুলিশের চোখরাঙানিতে অজিত থতমত খেয়ে গেল এবং শেষমেশ নিজের দোষ স্বীকার করলো। উলপীদেবী বললেন, "ছেলেটার জন্য আর কত নীচে নামতে হবে আমাদের কে জানে!" অনুপ করজোড়ে বললো বললো,  "স্যার ভাইকে এবারের মতো মাপ করে দিন। আমিও একজন পুলিশ, আমি নতমস্তকে ওর দোষ স্বীকার করছি।"
অনুপের বিনম্র ব্যবহার দেখে পুলিশ মোহিত হয়ে অজিতকে মাপ করলো এবং বললো যে এবারের মতো ছাড়া পেয়ে গেলে নেক্সট টাইম এরকম বেয়াদবি করলে সোজা লক্ আপে পুরে দেবো। এ যাত্রায় অজিত দাদার দৌলতে নিষ্কৃতি পেলো।
তা সত্ত্বেও অনুপের প্রতি অজিতের বিন্দুমাত্র সৌজন্য দেখা গেল না। অজিতের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো ও কিছুই করেনি। যাইহোক পুলিশের নির্দেশে অজিত চা দোকানীকে দুশো টাকা ফেরত দিলো।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা। অজিত তার কলেজের এক বান্ধবী তনুজাকে দেখতে পেল হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে শহরের চৌরাস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। অজিত খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে তনুজা তার মামার বাড়িতে এসেছে। কলেজে পড়াকালীন অনুপ এবং তনুজা পরস্পরকে ভালবাসতো। কিন্তু অজিতও তনুজাকে ভালবাসতো। তনুজার পক্ষে অজিতের প্রপোজাল একসেপ্ট করা সম্ভব হয় নি। সেদিন থেকে অজিতের মনে তনুজার প্রতি যে প্রতিহিংসার আগুন জমে ছিল তা আজ যেন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। অজিত তনুজাকে শায়েস্তা করতে যেন শিকারীর মতো ওত্ পেতে বসে থাকলো। মানে প্রতিদিন নিয়ম করে ঐ চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকলো যাতে সুযোগ পেলেই কার্যসিদ্ধ করতে পারে।

পরদিন সকাল দশটার ঘটনা। মাস্ক এবং হলুদ সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে চৌরাস্তার মোড়ের ওষুধের দোকানের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছিল। এইসময় উল্টোদিকের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিল অজিত। অজিত ধীরে ধীরে ওষুধ দোকানের দিকে হাঁটতে লাগলো। তার পকেটে রয়েছে সালফিউরিক এসিডের একটা ছোট বোতল। দোকানের কাউন্টারে এসে মেয়েটি ওষুধ চাইলো। অজিত তখন পকেট থেকে এসিডের বোতলটা বের করে হাতে ধরেছে। দোকানী বললো, "তুমি মিতালী তো, গতকাল আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রেকোয়েস্ট পাঠিয়েছো?"
মেয়েটি বললো , "হ্যাঁ, আমি মিতালী। এই বলে সে মাস্ক খুলে ফেলে বললো যে সে তার পিসতুতো বোন তনুজার পোশাক পরে এসেছে।"
তা শুনে আতঙ্কিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অজিতের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং হাত থেকে এসিডের বোতল পড়ে যায়। ধোঁয়া উড়তে থাকে। ওষুধ দোকানী চিৎকার করে লোক জড়ো করে ফেলে। ততক্ষণে সাত -আট জন লোক এসে অজিতকে পাকড়াও করে। মারাত্মক এসিড ব্যবহার এবং এসিড হামলার প্রয়াসের জন্য পুলিশ এসে অজিতকে ধরে নিয়ে যায়। এবার সে আর ছাড়া পেলো না। আদালতে কেস না ওঠা পর্যন্ত অজিত আপাতত কারাবাসে দিন কাটাচ্ছে।

Tuesday, November 15, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -27


 


দেবীবাবু ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার সাথে আসুন। তিনি পাশের রুমে গিয়ে একটা বড় আয়নার কাছে গিয়ে নিজের চেহারাকে দেখিয়ে বললেন, ঐ লোকটাই আপনার দাদাকে খুন করেছেন।

 দেবীবাবু - । আপনি আমার দাদাকে খুন করেছেন? হ্যাঁ।

 আপনাকে ছাড়বো না দেবীবাবু। আজ হত্যাকারীর রক্ত দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার তর্পণ করবো। ছুরিখানা উপরে তুলে দেবীবাবুর বক্ষে বিদ্ধ করতে যাবো এমন সময় দৈববাণীর মত ময়নার কণ্ঠস্বর আমায় ওপথ থেকে বিরত করলো। মনে হল ময়না যেন বলছে, মা, বাবাকে হত্যা করছ - মা, বাবাকে খুন করছ - মা তুমি ;

ওকথা শুনে ছুরি হাতে নিয়ে নিথর হয়ে স্টাচু হয়ে পড়লাম। পারলাম না। দেবীবাবুর বুকে ছুরিখানা বসিয়ে দিতে। আমার সমস্ত প্রতিহিংসা ক্রোধ এ মুহুর্তে অগ্নিতে জল ঢালায় শীতল হয়ে গেল। কে যেন জোর করে আমার হাত হতে ছুরিটা ছিনয়ে নিলো। পিছন হতে ময়নার ঐ কণ্ঠস্বর আবার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ‘মা বাবাকে মেরো না

ওখানে না দাঁড়িয়ে টলতে টলতে বারান্দয় এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। দাদাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আমি পারলাম না দাদা, তোমার শত্রুকে শেষ করতে পারলাম না। আমার এই সাময়িক হৃদয় দৌর্বল্যের জন্য তোমার আত্মার নিকট আমি ক্ষমাপ্রার্থী দাদা। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কোন সময় যে দেবীবাবু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি জানি না। আমায় কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমায় ক্ষমা কর পদ্মা। অজ্ঞানে অনেক পাপ করেছি, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও একটা গরীব পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছি এবং নিজের জীবনেও চরম অধঃপতন নিয়ে এসেছি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তোমার দাদা আমার শত্রু হয়েছিল। কিন্তু সেই সুমন্ত আমার তমসাচ্ছন্ন জীবনের ঘন কৃষ্ণ মেঘরাশি সরিয়ে দিয়ে আমার জীবনে নব প্রভাতের অরুণ উদয় ঘটিয়েছে। সেই সূর্যশান্তি আলো ঝলমল জীবনে আমি শান্তির বিহগগীতি শুনতে পেয়ে নিজের জীবনকে ধন্য বলে মনে করেছি। আমার অতীত জীবনের ব্যাভিচার, উদগ্র লালসা শুধু আমার জীবনকে ধ্বংস করেনি, আমার সহধর্মিনীকেও এই দুষ্কর্মের জন্য আমিই দায়ী পদ্মা। তাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি। কেন তুমি আমায় শাস্তি দিচ্ছ না।

একটু পর নিজেকে শান্ত করে বললাম, শাক্তি আপনাকে দিতাম দেবীবাবু, কিন্তু এক নিষ্পাপ, সরল শিশুর মুখ স্মরণ কর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। ঐ অবোধ শিশু আমাকে বার বার এই হত্যাকান্ডের হাত থেকে বিরত হবার ইঙ্গিত দিয়েছে।

পদ্মা, ময়নাকে অপার মাতৃস্নেহে তুমি মৃত্যুর কবল হতে বাঁচিয়েছো, সে তোমার মাতৃ হৃদয়ে তোমার অলক্ষ্যে কন্যার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেই স্থান হতে তুমি তাকে কিছুতেই সরাতে পারবে না। তোমার দাদা আমার ক্রোধবহ্নির শিকার হয়েছে ফলে দেখা দিয়েছে পিতা ও পুত্রীর জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বনা। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তোমার জীবনের দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। এবার তোমার সম্মতি আমাদের মিলন পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করে তুলুক। - তোমার নিকট এই আশাই রাখছি।

দেবীবাবু -

হ্যাঁ, পদ্মা, আমি এক চক্রান্তের বশে নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে তোমার দাদাকে খুন করেছি। বিশ্বাস করো এক মুহুর্তের জন্য ভাবিনি কত বড় সর্বনাশ আমি করেছি। আমি তোমার ভ্রাতৃঘাতক হলেও তুমি আমায় ক্ষমা করো। সেদিন কনক নার্সিংহোমে বলেছিলাম সময় হলে বলব আমার অতীত। যে অতীত নোংরা, আবর্জনায় পরিপূর্ণ কেন আমার স্ত্রী চন্দ্রাকে হারিয়েছি, কেন এই সসাগরা পৃথিবী হতে নিরপরাধ গরীব সন্তানকে চিরদিনের ঘুম পাড়িয়েছি। দেবীবাবু চোখের সামনে অতীত ইতিহাস অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠল এবং তখনই তিনি তার স্মৃতি চারণ করতে শুরু করলেন। যে ইতিহাসের কাহিনী সেদিন পর্যন্ত তার অন্তরের অস্তঃস্থলে বিদ্ধ হয়েছিল। তা মোটামুটি হল এরকম।



মাঘের শেষাশেষি। শীত তেমন নেই, বসন্ত দেখা দিয়েছে ফাল্গুনের আগে। এলোমেলো ভাবে বাতাস বইছে। ওতে ভেসে আসছে যেন ফুলের গন্ধ। ধরণীর বুকে রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। একটু পরে শহরের কালো অন্ধকার নেমে আসবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী বলে। একাকী ফুটপাতে দেবীদাস দাঁড়িয়ে আছে যানবাহনের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ব্যাকুল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।

হঠাৎ একটা কালো রঙের ট্যাক্সি কাছে এসে এমনভাবে ব্রেক কষল যে দেহের গ্রন্থিগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন অবশ হয়ে গেলো। ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে পড়ল। কোন প্রকারে সামলে ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল গম্ভীর মুখ তার। চোখ দুটো যেন লাল মার্বেল। স্টীলের ফ্রেমের চশমা চোখে আটকানো। ভূগুলো বেশ মোটা। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। জুলফি কানের পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে গেছে চোয়ালে।; গোঁফটাও মোটাসোটা। গাল ভর্তি দাড়ি তবে মসৃণ। মাথায় একটা কালো টুপি। দেহের দিকে তাকিয়ে দেখল, কালো রঙের ওভারকোর্টে ঢাকা।

ওভাবে তার চেহারার খুঁটিনাটি দিক লক্ষ্য করে চলেছে, ঠিক সেসময় ভদ্রলোক বললেন, কোথায় যাবেন, আসুন না আমার ট্যাক্সিতে?

কেমন হকচকিয়ে গেলো ওর কথা শুনে। বিশেষ করে এক অচেনা অজানা মানুষের সহানুভূতি আশ্চর্য্য করল দেবীদাসকে। কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, তাছাড়া বাড়ীতে বিশেষ কাজ আছে অতএব সুযোগ যখন পাচ্ছে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত নয়।

ট্যাক্সিতে চড়ে বসতেই ষ্টার্ট দিলো ভদ্রলোক। ওর পাশে বসেছিলেন, ফুটখানেক মাত্র ছাড়াছাড়ি। দেবীদাস ও ড্রাইভার ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি ছিলো না। ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে চলছে। পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকান্ড বাড়ীগুলো পলক না ফেলতে ফেলতে সোঁ সোঁ শব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে হিন্দী গানের সুর ভাঁজছে। বেশ ভালোই লাগছিল। একটু পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,

কোথায় যাবেন?

শ্যামবাজার।

তারপর চুপচাপ হিন্দী গানের পুনরাবৃত্তি করতে একটু পর ভদ্রলোক পুনরায় বললেন, আপনি বিখ্যাত শিল্পপতি মিঃ হেমন্ত রায়ের ছেলে নন ?

 ও কথা শুনে হিন্দী গানের সুর ভুলে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ওকে তো কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।

Saturday, November 12, 2022

ছোট গল্প - দরজার পাশে || লেখক - রোহিত দাস || Written by Rohit Das || Short story - Dorjar pase


দরজার পাশে 

রোহিত দাস 



সাহিত্য বিষয়টা চিরকালই‌ আমার কাছে বিরক্তিকর। তবে আজ হঠাৎ করে এভাবে খাতা কলম নিয়ে যে আকারনে তা নয়। বিগত কয়েক মাসে আমি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, সত্যি-মিথ্যে, ভালো-মন্দের যুদ্ধের মাঝে এসে পড়েছি তা আমকে এই কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এতদিন মনের কথা শুনে আসা আমি পড়েছি আজ মাথার কোটি কোটি প্রশ্নের জালে। এই ঘটনার শুরু প্রায় আট মাস আগে।

গত বছর বাবার আদেশে এম.এ কমপ্লিট করে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থায় চাকরির জন্য ছুটেও যখন কোন ফল হলো না, তখন বাবার অবাধ্য হয়ে নিজের গিটারিস্ট হবার লক্ষ্যে এগিয়ে গেলাম। এই নিয়ে বাবা বেশ রাগারাগি করলেও একপ্রকার জোর করেই করি। কলেজ শুরুর সময় যে দলের সঙ্গে পারফর্ম করতাম তারা এককথাতে রাজি হয়ে গেল আমায় দলে নিতে। আসলে গিটারে আমার হাত চিরকালই ভালো, এটা বাবাও অস্বীকার করতে পারবেন না। বেশ নাম করেছে এরই মধ্যে আমার দল। বছরের শেষ তখন, বেশ কিছু জায়গা থেকে শো এর ডাক পায় আমারা। কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করে একবারে বাবার হাতে তুলে দেবো ভেবে একের পর এক জমজমাট শো‌ করতে লাগলাম। রাত করে বাড়ি ফেরা আর শো করতে একটু হলেও নেশা করা হয় বলে বাবা একেবারে কঠোর বিরোধি। মা একটু ‌রাগারাগি করেন তবে তিনি জানেন আমি ওসব খায়না বেশি। তাই তিনি বাবাকে সামাল দেন।

এভাবে একের পর এক শো করে আর একটা মোটা অঙ্কের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতে পেরে আমি একটু নিশ্চিন্ত। তবে গত ছ মাস আগে একটা শো করতে গিয়ে সেবার হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা ওঠে। কোন রকমে শো‌ শেষ করে দেড় ঘন্টা গাড়ি জার্নি করে যখন পৌনে একটার সময় বাড়ি ফিরলাম তখন যন্ত্রনায় আমার চোখ বুজে আসছে। কাঁধের গিটারের ব্যাগটা শ্লিপ করে পরে যাচ্ছে সেটা সামলানোর ক্ষমতাও নেই। বাবা দরজা খুলে আমাকে এঅবস্থায় দেখে তৎক্ষণাৎ আমাকে সোফায় শোয়াতে শোয়াতে চিৎকার করে মা কে ডাকলেন। আমাকে মাও নাড়াতে নাড়াতে ডাকতে লাগলেন। মা'র গলায় কান্নার স্বর।বাবার গভীর গলায় রুদ্র রুদ্র ডাকটা শুনতে শুনতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরলো আবছা চোখে কাঁচের ওপারে কিছু মুখ দেখলাম। একটা একটা করে চিনতে পারলাম। মা বাবা আর পাড়ার ড: অতুল কাকু। জ্ঞান এসেছে দেখে বাবা ছুটে এলেন বাবার মুখে কঠোরতার জায়গায় কষ্ট আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কান্নার স্বরে মা বললো “ এখন আর ব্যাথা হচ্ছে না তো বাবা!!” 

দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না বললাম। বাবা ভাঙ্গা গলায়দেখে বললেন‌ “কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, জল খাবি রুদ্র?”

কষ্ট করে হ্যা বলাতে বাবা জলের গ্লাসটা মুখের সামনে ধরলো ঢকঢক করে পূরো জলটায় খেলাম। বাবা গ্লাস রেখে বেরিয়ে গেলন। দুদিনে চার বার ব্যাথা ওঠার পরেও যখন ডাক্তাররা এর কারণ খুঁজে বের করতে পারলো না তখন বাবা আমাকে ভেলোর‌ নিয়ে যাবেন‌ বলে ঠিক করলেন। তবে ‌সেখানে গিয়েও তে খুব লাভ হলো এমনটা একেবারেই নয়। তারা ব্যাথার কারণ খুঁজে পেল না। কোনো ওষুধে‌য় আমার রোগ সারেনা। সময়ে সময়ে ব্যাথা আসে ওষুধে ব্যথা কমে কিন্তু একেবারে সেরে ওঠে না। ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এভাবে দু মাসে অনেক টাকা খরচ করেও আমার অবস্থা বিন্দুমাত্র ভালো হলো না দেখে অগত্যা বাবা আমাকে আগের হসপিটালে ফিরিয়ে আনেন। বাবার দোকান বহু দিন বন্ধ। বহু টাকা পয়সা খরচের পরও এই অবস্থা।দিন দিন ব্যাথায় ভুগে মুখের স্বাদ নেই। শরীরও ভেঙ্গে গেছে। পেটে ব্যাথা,মা'র কান্না আর বাবার ধরে আসা গলা শুনে আমার তখন বাঁচার ইচ্ছা প্রায় শেষ। উঠে বসতেও কষ্ট হয়।দলের সবাই প্রায় দেখা করে গেছে।আমার দেখাশোনার জন্য একজন নার্স আছেন। সময়ে সময়ে তিনি‌ ওষুধ দেন। একদিন সকাল থেকেই বৃষ্টিটা মুশোল‌ ধারায় শুরু হয়েছিল। সকালে সেদিন ব্যাথাটা একবারই এসেছিল। শুনলাম অনেক নার্স আসেননি। অপর্না দিদিও আসেননি বৃষ্টির জন্য।অন্য একজন ওষুধ দিয়েছিল আমাকে। রাত্রেও বৃষ্টির বেগ কোমলো না। খেয়ে নিয়ে শুয়ে ছিলাম।কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। তীব্র যন্ত্রনায় ঘুমটা ভেঙে গেল। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে কোনরকম করে দুবার নার্স নার্স বলে ডাকলাম। কিন্তু কোন উত্তর এলো না। ব্যাথাটা ক্রমশ যেন বেরেই চলেছে। প্রান তখন ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম। ঠিক তখনই পুরোনো কাঠের দরজাটা ঠেলে কেও ভেতরে এলো। ধীর পায়ে সে আমার মাথায় কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখার ক্ষমতাও আমি তখন হারিয়েছি। সে তার নরম হাতটা আমার একঝাকড়া চুলের ওপর বোলাতে বোলাতে বললো শান্ত হও তুমি। পাশের টেবিল থেকে একটা ওষুধ মুখে দিলো, জল খাওয়ালো। আমার দুচোখে অন্ধকার নেমে এলো। আধ বোঝা চোখেই দেখলাম সে আমার মাথার কাছে বসে।

ঘুম যখন ভাঙলো ঘড়িতে দেখলাম সারে আট্টা। নিজেই কোনোরকমে টেবিল থেকে খাবার আগের ওষুধ গুলো খেয়ে নিলাম। কাল রাতের ঘটনা কিছুটা মনে পরতেই মাথায় ঝিম ধরে এলো। খুব স্পষ্ট না হলেও মনে আছে সেই মানুষটির কথা। কে ছিলো জানিনা কিন্তু নতুন কেও। আশ্চর্য রকম ভাবে সেদিন সকাল থেকে আর ব্যথা ওঠেনি কিন্তু সন্ধ্যে হতে না হতেই অন্যদিনের তুলনায় যেন হাজার গুণ বেশি জোরে ব্যথা উঠলো পরপর দু বার।শুধু পেটে না সারা শরীর জুড়ে, চোখ-মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছিল। জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। জ্ঞান যখন ফিরলো বাবা-মা দুজনেই বসে, মা কাঁদছে বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।আমার চোখ খোলায় তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল। বিছানা শুয়েয় মায়ের হাতে রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম।বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠালাম। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আগের রাতের ঘটনা। কে ছিল সে? আজ সন্ধ্যেয় কি এসেছিল, সেই কি আমার বাবা-মাকে খবর দিয়েছে? ব্যথার সময় কেন আসে? সারাদিন তো তাকে দেখলাম না! আজ রাতে কি তবে সে আসবে? জেগে বসে আছি তার অপেক্ষায়।হঠাৎ আবার ব্যথা, কিছুক্ষনে তার উপস্থিতি অনুভব করলাম।একইভাবে আমায় সান্তনা দিচ্ছ,আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আবচ্ছা চোখে দেখলাম মানুষটি একটা মেয়ে। বয়স কম হয়তো আমারই মতো। এভাবে আরও দুদিন কেটে গেছে,সে রোজ রাতে আসে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেয়, ওষুধ দেয়,আমি জ্ঞান হারায়। বলে রাখা ভালো ইদানিং আমার ব্যথাটা যেন কিছুটা কমেছে আগের তুলনায় অনেকটা কম জোরালো। বলতে গেলে এখন সারাদিনে ব্যথা হয় না খালি রাত হলেই ব্যথা আসে সাথে সেও। এভাবে চলতে চলতে একদিন ঠিক করলাম যতই ব্যথা আসুক কিছুতেই আর জ্ঞান হারালে চলবে না তার সাথে আমাকে দেখা করতেই কে সে? কেনই বা সে খালি রাতেই আসে?আমাকে জানতেই হবে।

সেদিন রাত্রে যখন ব্যথা উঠলো তখন ব্যথার কথা ভুলে আমি জ্ঞান না হারাবার চেষ্টায় মত্ত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিছুক্ষণ ব্যথায় ছটফট করার পর সে টেবিলে রাখা কোন ওষুধ দিল।না সেদিন আমি অজ্ঞান হয়নি। কিছুক্ষণ পর আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে একটা বছর বাইশের মেয়ে। তাকে দেখতে অপূর্ব সুন্দর। আমি স্কুলে-কলেজে সত্যি এত সুন্দরী আমি কাউকে দেখিনি‌।এই প্রথম দেখলাম। খুব লম্বা নয় মাঝারি লম্বায়, লম্বা চুলে তার ছোট্ট মুখখানা আমার দৃষ্টিটাকে কিভাবে যে বেঁধে রেখেছিল তা আজও আমি বলে বোঝাতে পারিনা। আমি বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে খালি চেয়েছিলাম। সে হেসে বলল আর কষ্ট হচ্ছে না তো। আমার গলা থেকে খালি না ছাড়া আর কিছু বেরোলো না। ধীর পায়ে সে দরজার পাশে গিয়ে বসল। ঘরটায় একটা নীল আলো জ্বলছে অতটা জোরালো না হলেও তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল "তোমার খুব কষ্ট হয়না যখন এই ব্যথা ওঠে" আমি বললাম তা হয়।তবে এতদিনে কষ্ট পাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে এখন অতটা কিছু মনে হয়না। মেয়েটা অবাক হয়ে বলল কিন্তু কেন হয়? আমি বললাম জানিনা এর উত্তর হয়তো স্বয়ং উপরওয়ালার কাছেও নেই। মেয়েটা তার মিষ্টি নরম গলায় কোন অচেনা গান গুন গুন করে দু'লাইন গেয়ে আমাকে প্রশ্ন করল তুমি গান গাইতে পারো। আমি হেসে বললাম একটু-আধটু পারি,তা তুমি ওরকম মনমরা হয়ে বসে আছো কেন? অসুবিধা থাকলে আমায় বলতে পারো। এই কথাটা কেন বললাম আমি জানিনা। আমি তাকে চিনিও না। এখনো পর্যন্ত নামই জানি না, আমার উঠার ক্ষমতাও নেই তবু কেন যেন ওকে খুব আপন বলে মনে হলো। সে বলল “তোমার ব্যথা দেখলে না আমারও ব্যাথার কথা মনে পড়ে।এইতো সেদিন যেন খুব ব্যথা উঠেছিল ওরা আমাকে খুব ব্যথা দিয়েছিল।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম কারা তোমাকে ব্যথা দিয়েছিল আর কেন? জবাবে সে কিছু বললো না, মাথা নামিয়ে নিলো। শুধু বলল “আজ তবে আসি”। সে নিঃশব্দে দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেল। পরদিনও ঘুম থেকে উঠে খুব বেলা হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠে ওষুধ খেয়ে নিলাম।অন্যদিনের তুলনায় আজ কিছুটা নিজেকে সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। অনেকদিন হলো ফোনটা দেখিনি। ফোনে ডাটাটা অন করতে একগুচ্ছ মেসেজ এল হোয়াটসঅ্যাপে।বন্ধুদের মেসেজ, খোঁজ নিচ্ছে সকলেই আমি কেমন আছি কিন্তু কাউকেই রিপ্লাই করা হয়নি তাই সবাইকেই একসাথে গ্রুপে বলে দিলাম এখন কিছুটা সুস্থ আছি। মিনিটের মধ্যেই গ্রুপে একসাথে সকলের আড্ডা আবার জমে উঠলো। ফেসবুক টা খুলে নোটিফিকেশন গুলো চেক করতে দেখলাম প্রোফাইল পিকচারের লাইক কমেন্টের বন্যা হয়েছে।প্রোফাইল খুলে পোস্টটা দেখলাম চারশোর বেশি রিয়াক্ট পড়েছে অনেক কমেন্টও এসেছে। ছবির দিকে চোখ পড়তেই চোখটা ভারী হয়ে এলো। শেষ শো এর আগের শো তে ছবিটা তোলা। কবে যে আবার আগের জীবনে ফিরে যাব জানিনা। ফোনটা পাশে রেখে কিছুক্ষণ আগে রেখে যাওয়া খাবারটা খেয়ে নিলাম। রাত্রে বাবা-মাকে সেই মেয়েটার কথা বলতে চেয়েও বলিনি,এইসময় এ কথা শুনলে তারা হয়তো ভাববে আমার শরীর হয়তো আর বিগ্ৰেছে, তাই উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছি। ন'টা নাগাদ ওষুধ খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আমাকে নাড়িয়ে ডাকলো আমি উঠতেই সে বাধা দিয়ে বলল উঠো না! শুয়ে থাকো আমি দরজার পাশে গিয়ে বসছি। সে দরজার পাশে বসে বলল ”আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি!” হ্যাঁ দু চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। তুমি কেমন আছো? সে বলল “আমি তো নেই বললেই চলে..। আচ্ছা আমি “তুমি অসুস্থ হওয়ার আগে কি করতে?” আমি বললাম আমি গিটার বাজাতাম আমার একটা দল আছে তাদের সাথে একসাথে গিটার বাজিয়ে প্রোগ্রাম করতাম। “জানোতো আমারোনা গান শেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ভর্তিও হয়েছিলাম গান শেখার জন্য। অনেক কিছু শিখেছি। তারপর তারপর হঠাৎ একদিন...”‌। ওর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎই কারেন্ট চলে গেল সারা ঘর অন্ধকার। সে সেখানেই বসে বলতে লাগলো। “বাবা রিক্সা চালায়, মা বেশকিছু ঘরে ঝিয়ের কাজ করে, বড় অভাব ঘরে। পড়াশোনা শেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি কোনদিনও কিন্তু গান শেখার ইচ্ছা ছিল। কোনদিনও বলিনি বাবাকে। ভয় লাগতো। সারাদিন তো বাবাকে দেখতে পায়না আর রাত্রে বাবা নেশা করে বাড়ি ফেরে। মাকে মারে, কখনো কখনো আমাকেও..তাই বলতে পারিনি। আমি যখন 18 বছরের হয় তখন মা আমাকে একটা ঘরে কাজ খুঁজে দিলো,বেশ কিছু বছর টাকা জমিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির পেছনদিকে অনেকটা গিয়ে মোরের বাঁকে একজন গান শেখায় তার কাছে গান শিখতে শুরু করেছিলাম।” এতটা বলেই সে থামল। পরিবেশ টা কেমন যেন‌ হয়ে গেছে, তখনই কারেন্ট ‌চলে এলো।ওই আলোতেই দেখলাম মেয়েটির চোখে জল। “আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম সে বলে উঠলো আলো এসে গেছে আজ আসি তবে”। সে উঠে চলে গেল। 

আরও দু দিন কেটে গেলো একই ভাবে।এখন আমার শরীর বেশ সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। শরীরে বেশ বল ফিরে পেয়েছি। সে রোজ রাতে আমার সাথে অনেক ক্ষন গল্প করে। দুদিনে তার নাম জানতে পেরেছি, ইন্দিরা...।

আশ্চর্য রকম ভাবে সেদিন সকাল থেকে একবারও ব্যাথা এলোনা, সন্ধ্যেতেয় না, এমনকি রাত দশটার আগে পর্যন্ত না। শুয়ে শুয়ে তার আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।কিন্তু আজ যেন আমার অপেক্ষার শেষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একঘন্টা.. দুঘন্টা.. কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি জানি না। একসময় অধৈর্য হয়ে যখন সে আসবে না মনস্থ করেছি ঠিক সেই সময় খুব জোরে ব্যথা উঠলো। এত জোরে ব্যথা এই দীর্ঘ কয়েক মাসে কখনো উঠেনি। কষ্টে মরেই যাচ্ছিলাম।ব্যথায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না যে চিৎকার করে কাউকে ডাকবো। ব্যথায় ছটফট করতে করতে যখন বিছানা থেকে পড়েই যাচ্ছি তখন সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল “কিচ্ছু হবে না তোমার একটু শান্ত হও আমি এক্ষুনি ওষুধ দিচ্ছি।” পাশের টেবিলে হাতরে কোন ওষুধ না পেয়ে সে ছুটে বাইরে গিয়ে কোন একটা ওষুধের বাক্স হাতে করে নিয়ে এল।বাক্সের একটা প্যাকেট থেকে একটা ওষুধ আমার মুখে দিয়ে কিছুটা জল খাইয়ে আমার মাথাটা বালিশের উপর রেখে দিল।এরপর কি হয়েছে আমি আর জানি না।

আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেছি। মা বাবা অতুল কাকু সবাই এসেছিলো।

বিগত কয়েক মাসের তুলনায় আজ নিজেকে অনেক বেশি অসুস্থ বলে মনে করছি। বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি দেখে মা-বাবা অতুল কাকু সবার মনে আশার আলো দেখা দিয়েছে,আমারও নিজেকে অনেক বেশি সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। আর ব্যথা ওঠেনি। এই নিয়ে পাঁচ দিন হল। চলাফেরার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি মুখে খাবারের স্বাদ এসেছে। বলতে গেলে কিছুটা আগের জীবনে আবার ফিরে এসেছি। আরো দু-তিন দিন আমাকে অবজারভেশনে রেখে তারপর রিলিজ করে দেবে বলে ঠিক করেছেন অতুল কাকু। সকালের ওষুধ দিয়ে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন হঠাৎই আমি তাকে ডেকে বসলাম। অতুল কাকু বলল “হ্যাঁ কিছু বলবি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা তোমাদের এখানে কি আমার বয়সে বেটে সুন্দর দেখতে কোন নার্স আছে? অতুল কাকু কিছুটা অবাক হয়ে বলল “কেন তুই জেনে কি করবি?” আমি বললাম না আসলে কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাত্রিবেলা যখন আমার ব্যথা হতে তখন একজন অল্প বয়সী মেয়ে আমাকে ওষুধ দিত আর আমার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করতো। দিনের বেলা কোন দিনও আসেনি তো তাই ভাবলাম হয়তো রাতে ডিউটি পরে খালি।

“রাত্রে! কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরে তো রাত্রে সন্ধ্যা দিদি আর তুলসী ছাড়া বাকি তো সব ছেলে নার্স ডিউটিতে আছে। তুই কাকে দেখেছিস? ঠিক দেখেছিস তুই ওটা মেয়ে ছিল?” আমি গলার স্বর দৃঢ় করে বললাম আমি ঠিকই বলছি অতুল কাকু আমি ঠিকই শুনেছি ও মেয়ে ছিল। আমি দেখেছি ওকে। “না সেটা তো হতে পারে না তবে.....” তবে কি অতুল কাকু? পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে একটা ছবি বার করে আমার চোখের সামনে ধরে বলল “দেখতো এই মেয়েটা কি না?” আমি দেখলাম ছবিটা একটা খবরের কাগজের। তাতে একটা রঙিন ছবি একটা মেয়ের বছর বাইশের। হ্যাঁ..হ্যাঁ..হ্যাঁ.কিন্তু মেয়েটা...। মেয়েটির ছবির মাথার ওপরে বড় বড় করে যা লিখা আছে সেটা দেখে আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। অতুল কাকু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল “জানিনা তুই সত্যি বলছিস কিনা তবে তুই যদি সত্যিই একে দেখে থাকিস তবে এটা অলৌকিকে থেকে কম কিছু নয়।” কিন্তু এটা কি করে সম্ভব কাকু। মারা যাবার পর কাওকে কিভাবে দেখতে পাওয়া যায়? অতুল কাকু বলল “জানি না রে... কিচ্ছু বছরে পরছি না।” খবরের কাগজে ছবিটা উপরে লেখা ছিল...“২২ বছর বয়সী এক যুবতী ধর্ষিত”। অতুল কাকু বলল “সপ্তাহ খানেক আগেই কয়েকজন মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে। যখন নিয়ে এসেছিল তখন ওর অবস্থা খুব খারাপ ছিল।‌ দুদিন আমাদের এখানে ট্রিটমেন্টে ছিল। হঠাৎ হঠাৎ করেই তোর মতই পেটে যন্ত্রণা উঠত। তারপর মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুলিশ খোঁজখবর করে জানতে পারে মেয়েটি গান শিখতে গিয়েছিলো, বাড়ি ফেরার পথে কেউবা কারা তার সাথে এই দুষ্কর্ম টি করে। অনেকক্ষণ যন্ত্রণায় ছটফট করে আশেপাশে কেউ ছিল না,অন্ধকার গলি তার পাশেই ফাঁকা মাঠ সেখানেই। মেয়েটির বাবা রিক্সা চালায় এবং জুয়া এবং মাদে সব টাকা ওড়াতো। মেয়েটি‌ একটা বাড়িতে কাজের লোকের কাজ করতো। পুলিশ বাড়ির লোকের খবর দেয়।”

আরো দুই দিন আমাকে অবজারভেশনে রাখার পরও আমার ব্যথা উঠেনি। জানি না কি বলবো? কিভাবে আমার এই অজানা রোগ সেরে উঠলো? শুধু এটুকু জানি হয়তো সেই মেয়েটির জন্যই আজ আমি আমার সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পেরেছি কষ্ট শুধু একটাই তাকে ধন্যবাদ টুকু জানানোর উপায় আমার কাছে নেই। শুধু তার নান আর অপূর্ব সুন্দর মুখখানা আমার কাছে তার স্মৃতি হিসেবে থেকে গেল। অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েও এখনো পর্যন্ত তার কথা ভুলে উঠতে পারিনি। নিজের শেষ রক্ষা না করতে পারলেও আমাকে দিয়ে গেল একটা উপহার।


Wednesday, November 9, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -26


 

আমি দৌড়ে এসে শ্যামলীদিকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অসহ্য জ্বালা কোন প্রকারে দমন করতে পারলাম না। শ্যামলীদির চোখ দুটো জলে ভরে এলো। বহু কষ্টে অস্ফুট গলায় বলল, আর পারলাম না রে তোর বাবাকে বাঁচাতে। তোর কাছেও থাকার দিন ফুরিয়ে এলো। ভালোভাবে থাকিস। বাবাকে নিজের পরিচয় দে, বাকী জীবন আর ফুটপাতে কাটাতে দিস না। আসি রে।

 শ্যামলীদি চলে যেতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কাঁদতে থাকলাম। একি করলে ঠাকুর, তুমি কি সদা সর্বদাই নির্দয়? এই পতিতার কান্না তোমার হৃদয়ের রুদ্ধ দুয়ারে কি আঘাত করতে পারে না? অসহায় নারীর দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল এমনি করেই কি ব্যর্থ হবে? না, ঈশ্বরকে ডেকে কোন লাভ নেই।

 শ্যামলীদিকে আমার কাছ হতে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো, ওকে আর কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এবার আমাকেও মরতে হবে। হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তির শিকার হতে হবে ও লাঞ্ছনায় জীবন কাটাতে হবে।

 আমিও থানাতে যাবো, গিয়ে বলবো, আমিও তো এই দুঃকর্মে শ্যামলীদিকে পরিপূর্ণভাবে সহযোগিতা করেছি। সেজন্য আমি কি অপরাধী নই? শ্যামলীদির সঙ্গে একই কারাবাস গ্রহণ করব।

হঠাৎ কাসার বাসন পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম, তাকিয়ে দেখি বাবা এগিয়ে আসছেন দরজার দিকে। কয়েক মুহুর্ত বাবার কথা ভুলেছিলাম। এগিয়ে আসতে দেখে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জাপটে ধরলাম এ কারণে টিনের ছাউনি বলে সামনে একটা লোহার দণ্ডের কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে, ওতে ধাক্কা মারলে বাবার মাথায় ভীষণ আঘাত লাগবে। বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই বললেন, কে, মা তুমি? এমন করে জড়িয়ে ধরলে কেন ?

আমার মুখ বন্ধ। কোন কথা বলতে পারলাম না। থর থর করে ঠোঁট কাঁপতে থাকলো। কি করে কথা বলবো। আমার কণ্ঠস্বর যে অতি পরিচিত। চোখ দিয়ে টপ্‌ টপ্ করে জল ফেলা ও ঠোঁট কাঁপানো ছাড়া কোনো পথ পেলাম না।

বাবা দ্বিতীয়বার বলে উঠলেন, কি হলো মা, কথা বলছো না কেন? আবার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো। কোন প্রকারে ঘৃণায়, লজ্জায়, দুঃখে কথা বলতে পারলাম না। আমি বোবার মত অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলে বাবাকে বুঝিয়ে দিলাম। আমি একটি বোবা মেয়ে।

বাবা সহজে ধরে ফেললেন যে আমি বোবা। বললেন, তুমি বোবা, কথা বলতে পারো না? ওঃ ভগবান একি তোমার বিচার প্রভু, এ সংসারে কেউ বোবা, কেউ অন্ধ। এই সুন্দর ধরণীতলে তাদের জীবন বিড়ম্বনাময় হয়ে ওঠে এটা কি তুমি জানো দয়াল ? পৃথিবীর সৌন্দর্য্য সূর্যালোক, বৃক্ষের মর্মর ধ্বনি, নদীর কলতান, পাখীর কাকলি এইগুলো কি তাদের জন্য নয়? মা আমাকে একটু রাস্তায় বের করে দেবে? যদি বা একজনের কাছে আশ্রয় পেলাম তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো। আর কত কষ্ট দেবে ঠাকুর? তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো যাবার ক্ষমতা আমার নেই। জানি না কি এমন পাপ করেছিলাম যে এভাবে আমাকে তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে? মা আর দাঁড়িয়ে কেন, রাস্তায় নিয়ে চলো। বাবার কথায় বিচলিত হলেও তাকে রাস্তায় বার করে দেওয়া ছাড়া তখন আর কোন আমার গত্যন্তর ছিল না। -

বাবাকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে বিছানায় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। এটাই আমার কাছে শেষ প্রাপ্য ছিল। একটু পর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বিছানা হতে উঠে ঘরের ভেতরে এসে কপালে করাঘাত করতে থাকলাম। এই পোড়া কপালীর বেঁচে থাকার কি সার্থকতা আছে। নিজের জীবনকে ধিক্কার দিতে থাকলাম! মৃত্যুই আমার শ্রেয়।

 হঠাৎ আমার হৃদয় অন্য রূপ ধারণ করল। না! আমি মরব না, আমি বাঁচব, বাঁচতেই হবে, দেখতে হবে আমার জীবনের চরম পরিণতিকে। যদি এর চেয়ে আরো

কঠিন শাস্তি পেতে হয়, তা নেবার জন্য প্রস্তুত থাকবো। সে সময় মনে পড়লো শ্যামলীদির কথা, সে বলেছিলো এ জীবন নিয়ে যদি বাঁচতে হয়, এই অধঃপতিত জীবনের জ্বালা যন্ত্রণা যদি ভোগ করতে হয় তাহলে সুরাপান করতে হবে। এতে অনেক শান্তি পাওয়া যায়, দুঃখে সুখ পাওয়া যায়, দুর্বলে শক্তি পাওয়া যায়। হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমিও মদ খাবো, সব দুঃখ, যন্ত্রণাকে ভুলতে চাই। বিলম্ব না করে শ্যামলীদির পথ অনুসরণ করে আমার হৃদয় দৌর্বল্যকে সতেজ করে তুলবো সুরাপানে।

উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এলাম এক দোকানে, যেখানে মদ পাওয়া যায়। এক বয়কে বললাম। এক বোতল মদ মিনিটের মধ্যে শেষ করলাম। আরো চাই। পর পর দু'বোতল খাওয়ার পর আমি যেন চারিদিক অন্ধকার দেখলাম। সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গেলো। আমি মদের নেশার ঘোরে আরেক বোতল চাইতে কে যেন শক্ত কঠিন হাতে আমাকে চেপে ধরলো। তার মুখের দিকে তাকিয়েও চিনতে পারলাম না। ধীরে ধীরে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলাম। তারপর

তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো আমি আরামদায়ক খাটের উপর শুয়ে আছি। মাথার উপর বনবন করে একটা বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। ঐ সব দেখে আমার মনে একটা চমক সৃষ্টি হলো। দেখলাম বাড়ীর জানালার কাছে পিছন ফিরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

ধীরে ধীরে লোকটার কাছে গিয়ে বললাম, শুনছেন ? আমি কোথায় এসেছি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে কি আমায় আপনি - দিগন্ত পানে দৃষ্টি নিবন্ধ করে ভদ্রলোক আমার পানে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বিস্ময়ে ভরে উঠল। ভদ্রলোকের মুখখানি দেখে বললাম, দেবীবাবু আপনি!

কেন, আমাকে দেখে বিস্মত হয়েছেন নাকি? আমিই আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় দুলু ঘোষের দোকান হতে তুলে এনেছি। কিন্তু আমার অন্তরে এখন এক প্রশ্নের তুফান ছুটছে, কেন বোতলের পর বোতল মদ খাচ্ছিলেন। আপনাকে পৌঁছে দেবার জন্য বক্তীতে গিয়েছিলাম, ওখানে শ্যামলীকেও দেখতে পেলাম না। তবে কি

ওকে পুলিশে নিয়ে গেছে। পুলিশে নিয়ে গেছে। কেন ?

সে কথা বলার সময় নেই। আমাকে বস্তীতে ফিরে যেতে হবে, এখন আসি। কয়েক পা এগিয়ে এসে দরজার কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়লো কাঠের বড় ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবিকে। ঐ ছবিখানি দেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে দেবীবাবুকে বললাম, এই ছবিখানি কার বলতে পারেন ?

দেবীবাবু মন্থর পদে কাছে এসে বললেন, এটা আমার অন্তরঙ্গ শুভাকাঙ্খী এক পরম বন্ধুর। একজন চরিত্রহীন লম্পটের হাতে অসহায়ভাবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

ঐ যুবকটিকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ।

আমাকে সেই হত্যাকারীর কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?

কেন ?

প্রতিশোধ নেব।

সুমস্ত আপনার কে?

আমার দাদা।

কি বললেন, আপনার দাদা? দেবীবাবু একরকম চমকে উঠলেন। চমকে উঠলেন কেন? যে দাদাকে খুন করেছে তাকে আমি সহজে ছাড়বো না। কারণ দাদার মর্মান্তিক অকালমৃত্যু আমাদের সংসারকে ঝটিকা বিক্ষুব্ধ করে দিয়ে গেছে। ওর জন্য আমি ছিন্নমূল ব্রততীর মতো কলকাতার পতিতালয়ে অধঃপতিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছি, নারী জাতির মর্যাদা হারিয়েছি, জীবনের মূল্যবোধ আমার নষ্ট হয়ে গেছে। এমন কি বাবা অন্ধত্ব বরণ করে কলকাতার রাজপথে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন। আমাদের সুখের সংসারকে তছনছ করেছে? আমি দাদার হত্যাকারীর চরম প্রতিশোধ না নিয়ে আমি ছাড়বো না।

দেবীবাবু, অর্থের বিনিময়ে আপনার মেয়েকে সুস্থ করে তুলেছি সত্য, কিন্তু এর পরেও কি কিছু পাওনা থাকতে পারে না?

দেবীবাবু ঘাড় নাড়লেন। যদি পাওনা থাকে তাহলে ঐ হত্যাকারীকে চিনিয়ে দিন। প্লিজ দেবীবাবু, আমি আপনার পায়ে পড়ে বলছি। কিন্তু

কোন কিন্তু নয় দেবীবাবু। প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। নইলে শাড়ীতে ভেজানো একখানা ছুরি বের করে বললাম, এই ছুরি খানা ওর বুকে বসিয়ে দেব। আমাকে ওই পাষন্ডটার কাছে নিয়ে চলুন।

Tuesday, November 8, 2022

ছোট গল্প - মৃত্যুই শেষ নয় || লেখক - তনিমা সাহা || Written by Tanima Saha || Short story - Mrityuy ses noi


 


মৃত্যুই শেষ নয়

তনিমা সাহা



সাবিত্রীর হাত-পা গুলো শুষ্কতার জন্য ফেটে গেছে। সেখান থেকে এখন রক্ত বেরোচ্ছে। সাবিত্রীর দুচোখ বেয়ে ঝরে পরছে গরম নোনা জল। তবে যতটা না শারীরিক কষ্টের জন্য সে কাঁদছে, তার চেয়েও বেশি কাঁদছে মনের যাতনার জন্য। আজ দুমাস হয়ে গেল মকবুল নেই। পুরোনো অভ্যেসে বালিশের তলায় হাত দিয়েই জোর চমকে উঠল সাবিত্রী।



ভালবাসার বিয়ে মকবুল আর সাবিত্রীর। গরীব বলেই হয়তো বিধর্মে বিয়ে করতে বেগ পেতে হয় নি তাদের বিশেষ। পয়সাওয়ালাদের তো দেখে কিছু একটা হলেই ইয়া বড়ো বড়ো করে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে! কিন্তু তাদের বেলায় পরম দয়াময়ের কৃপায় সেসব কিছুই হয় নি। রিক্সা চালাতো মকবুল আর সাবিত্রী তিনটে বাড়ির রান্নার কাজ করত। কোনোরকমে টেনেটুনে ঠিক চলে যেত ওদের সংসার। খুব সুন্দর হাতের কাজ জানতো মকবুল। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তার পড়াশোনা বা শিল্প ওইসব দিকে কিছু করা হয়ে ওঠেনি। তবে মকবুলের তাতে কোন আফসোস ছিল না। 


সে বলতো, 'জানো তো সাবিত্রী আল্লাহ্ কখনোই সবদিক থেকে আমাদের মারে না। বই পড়া হয়তো বা হয়নি কিন্তু শিল্পকে আমি ছাড়িনি।' 



বিবাহবার্ষিকীতে মকবুল বিভিন্ন সাজের জিনিস দিয়ে কখনও ফুলের মতো বা কখনো অন্য কিছুর আকার বানিয়ে উপহার দিত সাবিত্রীকে। সারাবছর সাবিত্রীর তাতে চলে যেত। মকবুল কী করে যেন আগে থেকেই সাবিত্রীর সব প্রয়োজনের কথা বুঝে যেত। সাতটা বছর ধরে যেন আলোর বন্যায় ভাসছিল তারা। প্রথম প্রথম তারা বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুতেই গর্ভধারণ করতে পারছিল না। ডাক্তারের কাছে যেতে তিনি কি যেন বড়োসরো একটা রোগের নাম বললো, আর তার নামের থেকেও বড়ো ছিল চিকিৎসায় খরচের অঙ্ক। স্পষ্টতঃই সাবিত্রী বুঝতে পেরেছিল যে তাদের কখনো বাচ্চা হবে না। খুব কেঁদেছিল তখন সে। 


মকবুল তাকে দুবাহুতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। একদিকে ভালই হয়েছে! আমাদের এই টানাটানির সংসারে যদি সে আসতো তাহলে সত্যিই কি আমরা তার জন্য কিছু করতে পারতাম। তারচেয়ে একটা কাজ করলে হয়! আমরা যদি এক/দুজন পথশিশুর খাওয়াপরার দায়িত্ব নেই তাহলে কেমন হয়। হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারবো না। কিন্তু ওদের একবেলার খাবার, বছরে একবার জামা-কাপড় দিতে পারবো। তাতে তুমি একজনের নয় অনেকজন বাচ্চার মা হতে পারবে।' 



সাবিত্রী বলল, 'কিন্তু মকবুল তাহলে তো আমরা কখনও টাকা-পয়সা কিছুই জমাতে পারবো না। যখন আমাদের বয়েস হবে বা ভগবান না করুক যদি আমরা অসুস্থ হয়ে যাই তখন তো আমাদের কাছে চিকিৎসার জন্যও পয়সা থাকবে না। তখন আমাদের কী করে চলবে মকবুল।' 



হেসে মকবুল বলেছিল, 'ওসব চিন্তা আল্লাহর উপরই ছেড়ে দাও! যখন উঁনি আমাদের উপায় বলেছেন তখন দেখবে ওই উপায়কে পাওয়ার পথটাও উঁনিই বলে দেবেন।' 


মকবুল কখনওই সাবিত্রীকে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কিছু বলেনি। মকবুল বলতো সবই 'এক শক্তি'। আমরা আমাদের মনের মতো তাকে সাজিয়ে নেই। তাই তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম ভিন্ন ভিন্ন আকার। সাবিত্রী মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল মানুষটির মানসিকতায়। নিজেকে মনে মনে গরীব হওয়ায় ভাগ্যবতী ভাবলো সে। ভাগ্যিস! মকবুলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিল। আর্থিক ভাবে নির্ধন হলেও মানুষটি মনের দিক থেকে ছিল চরম ধনী। এরজন্য কতবার যে সাবিত্রী নিজের ঠাকুরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তার হিসেব নেই। 


একদিন এমনই পথশিশুদের খাওয়ানোর সময় কোথা থেকে এক বেপরোয়া লড়ি এসে চোখের সামনে রাস্তায় পিষে দিল মকবুলকে। সাবিত্রীর গোটা জীবনটা যেন সেখানেই শেষ হয়ে গেল। কতবার ভেবেছিল নিজেকে শেষ করে মকবুলের কাছে চলে যাবে। কিন্তু তখনই পথশিশুগুলোর মুখ ভেসে উঠতো তার চোখের সামনে। আজকাল তো তার মনে হয় মকবুল যেন তার আশেপাশেই কোথাও আছে। মকবুলের মনটা খুব শৈল্পিক ছিল। যখন কথা বলতো তখন যেমন গুছিয়ে বলতো তেমনই সব জিনিসকে জায়গামতো গুছিয়ে রাখতো যাতে হাত দিলেই পাওয়া যায়। যেমন গরমের সময় পাঁচবাড়ির কাজ করতে করতে বেশি জলঘাঁটার জন্যে সাবিত্রীর সারা পায়ে হাজা হতো। তখন মকবুল একটা হাজার মলম নিয়ম করে সাবিত্রীর মাথার বালিশের নিচে রাখতো যাতে সাবিত্রী হাত দিলেই পেয়ে যায়। শীতকালে তার জায়গায় স্থান নিত বোরোলিন। বিয়ে হওয়া ইস্তক এই নিয়মই চলে আসছে।



আজ ফিরতে বড্ড রাত হয়ে গেছে সাবিত্রীর। যে পথশিশুগুলোকে সাবিত্রীরা দেখাশোনা করতো তারমধ্যে বুলবুলি হল সবচেয়ে ছোটো। বুলবুলিটা আজ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রান্নার কাজগুলো শেষ করেই বুলবুলিকে নিয়ে ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। সব সেরে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে তাই। রাত বেড়ে যাওয়ায় রাস্তায় মাতালদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। জোরে পা চালিয়ে হাঁটছে সাবিত্রী। এই তো এই মোড়টা পেরোলেই ওর বাড়ির রাস্তাটা পড়বে। মোড়টা একটু অন্ধকার-অন্ধকার মতো! একটু ভয়ও করছে সাবিত্রীর। মোড়ের সামনে আসতেই হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে তিনটে লোক বেরিয়ে এল। আপাদমস্তক টলছে তাদের। গা থেকে ভুরভুরিয়ে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। সাবিত্রীর বমি পেয়ে গেল ওই দুর্গন্ধ শুঁকে। সেটা দেখে তিনজনের একজন খ্যানখ্যানে গলায় বলল, 'আরেব্বাস! ফুলটুসি…. এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো। শরীরটা তো খারাপ মনে হচ্ছে। একটু এগিয়ে দেবো নাকি বাড়ি পর্যন্ত‌।' 



সাবিত্রী গলায় জোর এনে বলল, 'পথ ছাড়ো! নইলে...ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।'



আরেরজন বলল, 'এই, এই ছেড়ে দে...ছেড়ে দে...নইলে এক্ষুনি 'হালুম' করে উঠবে রে', বলে তিনজনই বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে লাগল। 



তৃতীয়জন ধমকের স্বরে বলল, 'আমরা যাকে ধরি তাকে যে অত সহজে ছাড়িনা ফুলটুসি! ভালয় ভালয় মেনে যাও। নইলে তোমারই কষ্ট বেশি হবে।'



কথাটা বলে আরেক চোট তারা হেসে উঠল। হাতের খালি মদের বোতলগুলো ফেলে দিয়ে এবার ওরা তিনজন সাবিত্রীর দিকে পায়ে পায়ে এগোল। 



সাবিত্রী আবার ধমকে উঠল, 'ভাল হবে না বলছি! পেছনে যা! যেতে দে আমায়।' 



প্রথমজন সাবিত্রীর শাড়িতে ধরে টান দিলে দ্বিতীয় জন সাবিত্রীর পড়নের ব্লাউজটাতে টান মারতে যেতেই হঠাৎই চোখমুখ বিকৃত করে কাটা কলাগাছের মতো ধপ্ করে রাস্তায় পড়ে গেল। লোকটি চিৎকার করে এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়তে লাগল। কিছুপরেই তার চোখ মুখ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। প্রথম জন এই দৃশ্য দেখে মারাত্মক চমকে সাবিত্রীর শাড়ি ছেড়ে কেমন একটা স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। তৃতীয়জন এইসব দেখে ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগল, 'এই পল্টু, এই টনি..কি হল রে তোদের! কথা বলছিস না কেন?'


বলতে বলতে সে তার স্থবির হয়ে যাওয়া সাথীর কাঁধে হাত দিতেই সঙ্গে সঙ্গে স্থবির লোকটি ভষ্মে পরিনত হয়ে গেল। তৃতীয়জন এইবার প্রচণ্ড আক্রোশে সাবিত্রীর দিকে তেড়ে আসতেই কোথা থেকে এক ঘূর্ণি বাতাস এসে তৃতীয় লোকটিকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। সাবিত্রী এই সমস্তকিছু দেখে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। একটু পর হঠাৎই অন্ধকার মোড়টা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং রাস্তার ধুলোরাশি সরে গিয়ে সেখানে কিছু শব্দ ফুটে উঠল…



'ভয় পেয়ো না সাবিত্রী….আমি মকবুল। আমি থাকতে তোমার কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। জীবিত থাকা অবস্থায় যেমন করে তোমায় আগলে রাখতাম মৃত্যুর পরেও তেমনি তোমায় আগলে রাখবো। তারপর যখন সময় হবে তখন দুজনের দেখা হবে মৃত্যুর ওপারে। মৃত্যুই শেষ নয় সবকিছুর.. সাবিত্রী আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্যে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তোমার পাশে থাকবো আমি…..এভাবেই।' 



এবার সাবিত্রীর কাছে সবকিছু স্পষ্ট হল। কিকরে বালিশের তলায় বোরোলিন আসলো বা কেনই তার চারপাশে মকবুলের উপস্থিতি মনে হত। সেসব কিছুর উত্তর তার ক্রন্দনরত ঠোঁটে হাসি হয়ে ফুটে উঠল।


ছোট গল্প - ব্রাত্য জীবন || লেখক - মিঠুন মুখার্জী || Written by Mithun Mukherjee || Short story - Bratto jibon

 



ব্রাত্য জীবন

                  মিঠুন মুখার্জী



সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেই সবার কপালে সুখ থাকে না। ছয় ষষ্ঠীতে ভাগ্যদেবতা যা লেখার লিখে দেয়, তাকে কেউ খন্ডন করতে পারে না। কলকাতা শহরের মস্তবড় এক ব্যবসায়ী দীপঙ্কর রায়ের দুই ছেলের পরে এক মেয়ে। ছেলে পছন্দ হলেও মেয়ে সন্তান তার একদম পছন্দ নয়। বছর পাঁচেক আগে তাঁর সহধর্মিনী আরও এক সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সেই সন্তানটি ছিল তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। বাবা এই খবর পাওয়ার পর পন করেন এই সন্তানের মুখ সে জীবনে দেখবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন অনাথ আশ্রমে এই সন্তানটিকে চুপিচুপি দিয়ে আসবেন। কথায় যা, কাজেও তাই। সকলের অমত থাকা সত্বেও মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন নিয়ে যাওয়া হয়। সন্তান যেমনই হোক মায়ের কাছে সে সন্তানই হয়। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা একজন মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারেন না।
              আজ সেই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানটি পাঁচ বছরে পড়েছে। অনাথ ছেলেমেয়েদের মাঝখানে পিতা-মাতা থাকা সত্ত্বেও অনাথের মতো মানুষ হতে হয় তাকে। এই অপরাধ কার? এদিকে অনাথ আশ্রমে তার নাম হয় বৃন্দাবনী। তার দুই দাদা যথাক্রমে অরুময় ও রাধেময়, এবং দিদির নাম শ্যামা।অরুময় ও রাধেময় যমজ হওয়ায় তারা এখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে এবং শ্যামা নবম শ্রেণীতে পড়ে। ছেলে দুটি দীপঙ্কর বাবুর গর্বের হলেও শ্যামাকে সেভাবে ভালোবাসেন না। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে মেয়েরা এখনো যে ব্রাত্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোট সন্তানের শোকে তাদের মা অসুস্থ দীর্ঘদিন। তাই তাদের দেখাশোনা করার জন্য দুজন কাজের লোক রেখেছেন দীপঙ্কর বাবু। এদিকে কোনরকমে অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে বৃন্দাবনী।
            দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দীপঙ্কর বাবুর বয়স হওয়ায় তার কাজকর্ম অরুময় ও রাধেময় দেখাশোনা করতে শুরু করেছেন। এক উচ্চবংশের ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে শ্যামার বিয়ে দিয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে ছেলেদের দিয়ে খোঁজখবর নেন তিনি। পিতার এহেন আচরন শ্যামার চোখে বুক ফেটে জল এনে দেয়। হঠাৎ অসুস্থ কিছু গুরুতর হওয়ায় শ্যামার মা পরলোক গমন করেন। তার কাজ সম্পন্ন করে দীপঙ্কর বাবু তার ছেলেদের বলেন-- "তোমাদের মার চলে যাওয়ায় আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আমি কিছুদিনের জন্য হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাব। তোমরা বড় হয়েছ, ব্যবসা সামলানোর ক্ষমতা হয়েছে, আমার আর চিন্তা নেই। তোমাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমি তীর্থে যেতে চাই"। ছেলেরা তাদের পিতাকে জানায় তারা পিতার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবেন না।
          এদিকে বৃন্দাবনী এখন পনেরো বছরের যুবতী। তার যৌবন টলমল করছে বটে, কিন্তু সভ্য সমাজের থেকে সে অবহেলিত। নিজের জীবনের দুঃখ চিরসঙ্গী জেনেও নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করে সে। কেউ কেউ তাকে মাসি বলে ব্যঙ্গ করে। তাতে প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো বৃন্দাবনীর। কিন্তু যত দিন যায় ততই গা সওয়া হয়ে যায় তার। হিজরে মাসিদের দলে নাম লেখায় সে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে যা পাওয়া যায় তাতে তার ভাগে মাসে কুড়ি হাজার টাকার বেশি পড়ে। খাওয়া-পরার অভাব না থাকলেও জীবনের অধিকাংশ সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মাঝে মাঝে খুব কষ্ট পায় সে। তার দলের বদন হিজরে, রূপসী হিজরে, ফাল্গুনী হিজরে তাকে খুব ভালবাসে। তার থেকে সকলেই বড় হওয়ায় তাকে স্নেহ করে সকলে।
         বৃন্দাবনী জন্মাবার পর যেহেতু তাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা হয়েছিল, সেহেতু নিজের বংশ পরিচয় কিছুই জানে না বৃন্দাবনী। পিতা-মাতার অভাব মাঝেমধ্যে অনুভব করে, কিন্তু অন্য মাসিরা তার সে অভাব ভুলিয়ে দেয়। একমাত্র শ্যামা ছোটবেলা থেকেই বৃন্দাবনীর খোঁজ নিত। যখন তার পিতা বৃন্দাবনীকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিল, তখন শ্যামা পিছন পিছন গিয়ে সেটি দেখে ফেলেছিল। তাই বৃন্দাবনীকে একমাত্র শ্যামায় চেনে। মাসিদের সমাজে আসার পর শ্যামা তার স্বামীকে নিয়ে দুবার বৃন্দাবনীকে দেখতে এসেছিল। নিজের পরিচয় দেয় নি কষ্ট পাবে বলে। স্বামীকে বিয়ের পরে সব জানিয়েছিল শ্যামা।
       এদিকে দীপঙ্কর বাবু হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাওয়ার সুযোগে অরুময় ও রাধেময় নিজেদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেন, এবং বোনদের ফাঁকি দিয়ে সম্পত্তি নিজেদের নামে করিয়ে নেন। এখানে বলার প্রয়োজন, দীপঙ্কর বাবু অশিক্ষিত থাকায়, একদিন খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে সরকারি স্ট্যাম্প পেপারে টিপ সই দিয়ে নিয়েছিলেন অরুময় ও রাধেময়। দীপঙ্কর রায় বাড়ি ফেরার পর সবকিছু জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যায়। খবর পেয়ে শ্যামা ও তার স্বামী আসেন তাদের বাড়িতে। এদিকে পাড়ার লোকে দীপঙ্কর বাবুকে হসপিটালে ভর্তি করেন। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার ফলে 'ও নেগেটিভ' রক্তের প্রয়োজন হয়। শ্যামার ও তার স্বামীর রক্ত 'ও নেগেটিভ' না হওয়ায় খুব চিন্তায় পড়ে যায় তারা। ডাক্তার বলেছেন-- এক ঘণ্টার মধ্যে রক্ত না দিলে সে তার পিতাকে বাঁচাতে পারবে না।এই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্যামা।
               হঠাৎ করে শ্যামার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।সত্বর হিজরে মাসিদের পল্লীতে গিয়ে বৃন্দাবনীর সঙ্গে দেখা করে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল সে। বৃন্দাবনীর প্রথম পিতার প্রতি রাগ হয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে দেখল পিতাকে বাঁচাতে না পারলে কোনদিন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
               দীপঙ্কর বাবুর অজানতে বৃন্দাবনীর রক্তে সেদিনের মত মরতে মরতে বেঁচে গেলেন তিনি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার পায়ের কাছে দাঁড়ানো বৃন্দাবনী, শ্যামা ও শ্যামার স্বামী। শ্যামা তার পিতাকে বৃন্দাবনী সম্পর্কে সব খোলাখুলি বলে। এরপর দীপঙ্কর বাবু লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, বৃন্দাবনীর ওপর তিনি এত বড় অন্যায় করেছেন, সেই আজ তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাঁর এই অসময়ে ছেলেরা একবারের জন্যও আসেন নি। বৃন্দাবনী চলে যাওয়ার সময় পিতাকে উদ্দেশ্য করে সে শ্যামাকে বলে--" তুমি বললে তাই আমি এখানে এলাম, নতুবা আমি কখনো এখানে আসতাম না। সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, সে সন্তানই হয়। বাবা-মার প্রতি কর্তব্যই প্রমান দেয় সে সুসন্তান, না কুসন্তান। মেয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। আর আমার মত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তো পিতা-মাতাই জন্ম দেয়। তাহলে ঈশ্বরের সৃষ্ট সেই সন্তানের কি দোষ বল তো দিদি?" আমরাও তো মানুষ। এই কথা বলতে বলতে বৃন্দাবনীর চোখের কোনে জল দেখা যায়। বৃন্দাবনীর পিতা সকলের সামনে বৃন্দাবনীর কাছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বৃন্দাবনী তার পিতাকে ক্ষমা করেছিল কিনা জানি না, তবে তাঁর প্রতি অভিমান করে নৈশব্দ্যে হাসপাতাল থেকে হিজরে পল্লীর দিকে পা বাড়ায়।