Monday, December 5, 2022

পশ্চিমবঙ্গে বন্ধন ব্যাংকে প্রচুর কর্মী নিয়োগ || WB Bandhan Bank Recruitment 2022-23 || Bandhan Bank Job Vacancy 2023


 


##রাজ্য জুড়ে বন্ধন ব্যাংকে প্রচুর কর্মী নিয়োগের হবে। বিজ্ঞপ্তি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বেকার যুবক যুবতীদের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। তাছাড়া এখানে চাকরি পাওয়া সোজা। শুধু বায়োডাটা ও ডকুমেন্ট জমা মাধ্যমেই আপনার চাকরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। লিখিত পরীক্ষা দিতে হয় না এখানে। সরাসরি নিয়োগ হয়। বর্তমানে বন্ধন ব্যাংকে কর্মীর প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে। তাই নিয়োগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেই এই ব্যাংকে চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সসীমা, আবেদন পদ্ধতি বিস্তারিত তথ্য নীচে দেওয়া হল--



মোট শূন্য পদ - শূন্য পদ কত তা জানানো হয়নি।






কোন কোন পদে নিয়োগ হবে:




বিভিন্ন যোগ্যতায় বিভিন্ন পদ রয়েছে। পদ গুলি হল-


Branch Relationship Head, Customer Service Officer







শিক্ষাগত যোগ্যতা: অবশ্যই উচ্চমাধ্যমিক পাস বা গ্রাজুয়েশন পাস হতে হবে।




বয়স- বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।




বেতন - মাসিক ১৬,০০০ থেকে ২৪,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হবে।




কাজের ধরন: এটা একটি পার্মানেন্ট চাকরি। 





আবেদন পদ্ধতি: অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন।





কীভাবে আবেদন করবেন :


Online- আপনি নিজেই মোবাইল এর মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের NCS পোর্টাল এ গিয়ে অনলাইন এ ফিলাপ করতে পারবেন।










গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট-




এই চাকরিতে আবেদনের জন্য যে নথিপত্রগুলির প্রয়োজন সেগুলি হলো-




১) শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র


২)বয়সের প্রমাণপত্র 


৩)নিজের সাক্ষর


৪)বাসস্থানের প্রমাণপত্র


৫)পরিচয়পত্র (আঁধার কার্ড, ভোটার কার্ড)


৬) কাস্ট সার্টিফিকেট (যদি থাকে)


৭) পূর্ববর্তী কাজের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র (যদি থাকে)




এছাড়া যদি আরও কিছু জানতে চান আপনাকে অফিসিয়াল নোটিশটি ডাউনলোড (Download) করতে হবে। অফিসিয়াল নোটিশ ডাউনলোডের লিঙ্ক নিম্নে সবার শেষে দেওয়া আছে।









নিয়োগ পদ্ধতি: নিয়োগ করা হবে বায়োটাডেটার উপর ভিত্তি করে । কোনরকমের লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই কেবলমাত্র ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে। আপনি যদি ইন্টারভিউয়ে সিলেক্ট হন তাহলে আপনাকে সরাসরি ট্রেনিংয়ের জন্য ডাকা হবে। 



 ট্রেনিংয়ের চান্স পাওয়া মানে কনফার্ম চাকরি পাওয়া। ট্রেনিং শেষে আপনাকে সরাসরি জয়েনিং করানো হবে। 










আবেদন মূল্য: সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আবেদন করুন






OFFICIALWEBSITE: 


Click here 🔴







________________________________________




চাকরি সংক্রান্ত আপডেট পেতে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন








Telegram group-



Click here 🔴






Whatsapp group-

Click here 🔴





Sunday, December 4, 2022

AC/Washing Machine plant Recruitment 2023 || IFB Recruitment 2023 || Skill India Recruitment 2023


 


NEW VACANCY FOR:12th/ITI/DIPLOMA Normal Graduation candidate


👉👉VACANCY 142

👇

COMPANY PROFILE


IFB INDUSTRY PRIVATE LIMITED 


COMPANY PRODUCTION: AC/WASHING MACHINE PLANT


👇👇👇👇👇👇👇👇👇

JOB DESCRIPTION

Position: PRODUCTION/QUALITY

👇

JOB LOCATION

VASCO DA GAMA, GOA


👇

*ONLINE POLICE VERIFICATION 300/- MANDATORY +  UNIFORM FOR 1000/- FIRST MONTH DEDUCTION SALARY (ORIGINAL ALL DOCUMENTATION : ADHAR CARD+ ITI/DIPLOMA ALL MARKSHEET+CERTIFICATE 10th MARKSHEET AND CERTIFICATE)


* For ITI

* in hand 11500/-(PF+ESI) 


 * FOR Diploma in hand 12500/- (26 DAYS)* NORMALLY WORKING DAYS.


***DAILY 2 HOURS OVER TIME 100/- PER HOUR


👇

 *Food :* Duty time food company will provide.


*TRANSPORTATION: company bus provide

👇

 *Accommodation : Company Will help for your accommodation. (1500/- to 1600/-per month rent) 

 

👇

*Shift duration: 8 hours hours

👇

*Only male gender can apply

👇

 *Age limit 18-28

👇

 *Opening Date of joining : with in  10th December 2022

 👇

*REPORTING TIME: Within 9:00AM.....7.00PM

👇

 *Documents need:


1) 10th marksheet +certificate (original & xerox) 


2) 12th marksheet +certificate (original & xerox)


3) ITI/DIPLOMA MARKSHEET +CERTIFICATE (original & xerox) 


3) PAN CARD + AADHAR CARD + VOTER CARD + BANK PASS BOOK + PHOTOS 3 COPY ( original & xerox) 


 *No charges...  No interview.... Direct joining


 *Contact :    9007895083/ 9830959750

WhatsApp :  9007895083

👇👇👇👇👇👇👇👇

 *JOINING PROCEDURE


 _1. SEND YOUR RESUME_ 


 _2.  TAKE THE TICKET FOR BUS / TRAIN OR FLIGHT_ 


 _3. SENT THAT TICKET PDF FORMAT OR PICTURE IN THIS COMPANY WHATSAPP NO._ 


 _4. YOU WILL RECEIVE YOUR CALL LETTER IN YOUR MAIL WITHIN ONE DAY'S

Saturday, December 3, 2022

বস্ত্রবয়ন শিল্পে কর্মী নিয়োগ || Indian Textile Industry Recruitment 2022-23 || http://handlooms.nic.in/


 

ভারত সরকারের অন্তর্গত মিনিস্ট্রি অফ টেক্সটাইলস অর্থাৎ বস্ত্রবয়ন দপ্তরে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদে গ্রুপ-সি (Group-C) কর্মী নিয়োগ হতে চলেছে।

নিয়োগ টি হবে লিখিত পরীক্ষা এবং প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে।


দেশে যে কোনো প্রান্তের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলা থেকে নারী ও পুরুষ সকলেই আবেদন করার সুযোগ পাবেন। আবেদন করার সুযোগ পাবেন শুধু মাত্র অফলাইন এর মাধ্যমে। কতগুলো পদে, কোন কোন পদে নিয়োগ, বেতন, শিক্ষাগত যোগ্যতা কি লাগবে তার সম্পূর্ণ তথ্য নীচে আলোচনা করা হল -





নোটিশ নম্বরঃ WSC/GAU/3/22


নোটিশ প্রকাশের তারিখঃ 28.10.2022


আবেদনের মাধ্যমঃ শুধু মাত্র অফলাইনের মাধ্যমে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।


বস্ত্রবয়ন দপ্তরে নিয়োগের বিস্তারিত তথ্য (Textiles Department Group-C Recruitment Details)

(1) পদের নামঃ জুনিয়র ওয়েভার (Junior Weaver)


বেতনঃ 29,200 থেকে 92,300 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ। এর সাথে লুম সেটিং ও বিভিন্ন প্রকার তন্তুর সঙ্গে ওয়েভিং এর কাজে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে কমপক্ষে চারবছর।



বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 6 টি।




(2) পদের নামঃ সিনিয়র প্রিন্টার (Senior Printer) 


বেতনঃ 29,200 থেকে 92,300 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ । সঙ্গে টেক্সটাইল প্রিন্টিং এ ITI ডিপ্লোমা পাশ। এর সাথে ব্লক ও স্ক্রিন প্রিন্টিং এর কাজে থাকতে হবে 8 বছরের অভিজ্ঞতা।


বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 1 টি।



(3) পদের নামঃ জুনিয়র প্রিন্টার (Junior Printer) 


বেতনঃ 25,500 থেকে 81,100 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ । সঙ্গে টেক্সটাইল প্রিন্টিং এ ITI ডিপ্লোমা পাশ। এর সাথে ব্লক ও স্ক্রিন প্রিন্টিং এর কাজে থাকতে হবে 8 বছরের অভিজ্ঞতা।


বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 3 টি।


(4) পদের নামঃ জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট (Junior Assistant) 


বেতনঃ 19,900 থেকে 63,200 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ এবং টেক্সটাইল ওয়েভিং এ ITI ডিপ্লোমা পাশ। 


বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 1 টি।


(5) পদের নামঃ অ্যাটেনডেন্ট প্রসেসিং (Attendant Processing) 


বেতনঃ 18,000 থেকে 56,900 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ এবং টেক্সটাইল প্রিন্টিং বা স্ক্রিন প্রিন্টিং এ ITI ডিপ্লোমা পাশ। 


বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 6 টি।


(6) পদের নামঃ অ্যাটেনডেন্ট ওয়েভিং (Attendant Weaving) 


বেতনঃ 18,000 থেকে 56,900 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ এবং টেক্সটাইল প্রিন্টিং বা স্ক্রিন প্রিন্টিং এ ITI ডিপ্লোমা পাশ।


বয়সসীমাঃ 30 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। 


মোট শূন্যপদঃ 10 টি।



(7) পদের নামঃ স্টাফ কার ড্রাইভার (Staff Car Driver)


বেতনঃ 19,900 থেকে 63,200 টাকা।


শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ মাধ্যমিক পাশ এবং মোটর কার চালানোর বৈধ্য ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। মোটর মেকানিজম সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।


বয়সসীমাঃ 27 বছর। সংরক্ষিত প্রার্থীরা সরকারি নিয়মে ছাড় পাবেন। ।


মোট শূন্যপদঃ 3 টি।



আবেদন পদ্ধতি-


আপনাকে শুধু মাত্র অফলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। স্পিড পোস্ট বা রেজিস্টার পোস্টের মাধ্যমে নিচে উল্লেখিত ঠিকানায় আবেদন পত্র পাঠাতে হবে। আবেদন করার জন্য নিচে বলা স্টেপ গুলি ফলো করতে হবে- 



 সর্ব প্রথমে নিচে দেওয়া লিঙ্ক থেকে অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তিটি মোবাইলে অথবা কম্পিউটারে ডাউনলোড করে নিতে হবে। তারপর ডাউনলোড পিডিএফ থেকে 

অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তির 14 নম্বর পেজে দেওয়া আবেদনপত্রটিকে একটি A4 সাইজের পেপারে প্রিন্ট আউট করে নিতে হবে।

 সমস্ত তথ্য দিয়ে সঠিক ভাবে আবেদন পত্রটিকে পূরণ করে নেবেন।

আবেদনপত্র পূরণ করার পর সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র গুলিকে জেরক্স এবং সেলফ অ্যাটেস্টেড করে আবেদন পত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। 

সবশেষে আবেদন পত্র এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র একটি খামে ভরে নিচে দেওয়া ঠিকানায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে।



 জমা দেওয়ার ঠিকানা -

The Director, Weavers’ Service Centre, IIHT Campus, Jawahar Nagar, Khanapara, Guwahati-781022. 



গুরুত্বপূর্ণ তারিখ-


নোটিশ প্রকাশ - 28.10.2022

আবেদন শুরু - 28.10.2022

আবেদন শেষ - 06.12.2022



Official Website-

Click here 🔴


Official notice -

Click here 🔴

Friday, December 2, 2022

ছোট গল্প - ঠকাসের বিয়েতে || লেখক - অরুণোদয় ভট্টাচার্য || Written by Arunodoy Bhattacharya || Short story - Thokaser Biyete


 

ঠকাসের বিয়েতে 

            অরুণোদয় ভট্টাচার্য 




বাপ নেই ।মা নেই । কাকা-কাকি,দাদা-বৌদি, এমন কি দিদিও নেই ।তাই ঠকাসের বৌ জোটে নি।একবার,শুনেছি, প্রেম করতে গিয়েছিল ।তা এমনই বরাত যে,বেধড়ক মার খেয়ে একুশ দিন নার্সিংহোমে থাকতে হয়েছিল ।কিন্তু সম্বন্ধ করে বিয়ে দিতে গেলে তো গার্জেন লাগে,সার্জনের সার্টিফিকেট কাজে আসে না ।দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা বলতেন, হ্যাঁরে,এবার একটা বিয়ে করে ফ্যাল, বয়েসটা যে... 

ও শুকনো হেসে বলত,-দিন না একটা সুলক্ষণা ঘরোয়া মেয়ে দেখে ।বলতে বলতে ঠকাস গত চৈত্রেই পঞ্চাশে পা দিয়েছে ।এখন আসছে আষাঢ় মাস ।

হঠাৎই একদিন অফিসে ঠকাসের ফোন পেলাম ।বলল—প্রণব দা,আমার বিয়ে আগামী শনিবার ।সোমবার বৌভাত ।তোমাকে দু’দিনই যোগ দিতে হবে ।বরযাত্রী যেতেই হবে ।বুঝতেই পারছ,আমার তো কেউ নেই, বরকর্তামণ্ডলীর মধ্যে তোমার থাকা খুব দরকার ।

বিস্মিত হলাম ।একটু আনন্দও পেলাম ।তবু খবরটাকেঠিক সর্বান্তঃকরণে বরণ করতে পারছিলাম না ।এটা মানুষের বেয়াড়া মনস্তত্ত্ব ।গাণিতিক স্বতঃসিদ্ধের মত কতকগুলো জিনিসের পরিবর্তন হবে না,এটা ধরে নিই।ঠকাসের আইবুড়োত্ব সেই পর্যায়ের একটা আইটেম ছিল ।তার বিয়ে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা,নানা মন্তব্য, হাসি তামাসা,এমন কি দীর্ঘশ্বাসমোচন,সবই চলে । কিন্তু অনুষ্ঠানটা সত্যিই ঘটবে,ঠিক ভাবা যায় না । ব্যাপারটা যেন ওর নামের মতোই ঠকাস করে ঘটতে চলেছে!প্রজাপতি ঋষি দিলেন খটাস্ করে দুটো মাথা ঠুকে!

বাড়ি এসে সোমাকে বলতেই ও লাফিয়ে উঠল—গ্রেট নিউজ!এই শোন,তুমি কিন্তু সোমবার পুরো ছুটি নেবে ।আমি ঐ দিন সকাল থেকেই দেবেন্দ্রনগরে গিয়ে থাকব ।ঠকাসের নতুন ফ্ল্যাটটা তো দেখাই হয়নি।

আসলে ঠকাসের সঙ্গে আমার আলাপ শ্বশুর বাড়ির সূত্রে ।ছোটবেলায় ওদের আর সোমাদের পরিবারবসিরহাটে খুব কাছাকাছি বাস করত ।সোমা আর ঠকাস প্রয় একবয়সী ।ঠকাসের মাকে ও জেঠিমা বলে ডাকত ।তিনি ওকে নিজের ছেলের চেয়েও,,,ইত্যাদি ইত্যাদি ।তাই সম্পর্কে ও আমার  শ্যালক ।সায়ান্স গ্র্যাজুয়েট,চাকরিটা সামান্য ।তাই কিছু টিউশান্ করতে হয় উপার্জনটা ভদ্রোচিত করতে। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমার ভবানীপুরের বাড়িতে আড্ডা মারতে আসে ।আর কমপক্ষে তিন কাপ চা নিঃশেষ না করে ওঠে না ।

 

ফোনে বলেই ক্ষান্ত থাকেনি ঠকাস ।দু’দিন পরেই ওর এক মাসী-স্থানীয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসে একেবারে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেল ।ওনার স্বামী বরকর্তা ।চিঠিতে নিমন্ত্রণ তিনিই জানিয়েছেন—আমার ভাগিনেয় শ্রীমান সুরেন্দ্রর সহিত সোদপুর নিবাসী শ্রী মাধব চক্রবর্তীর তৃতীয়া কন্যা কল্যাণীয়া প্রণতির শুভবিবাহ....

সোমা পরমোৎসাহে শুরু করল—প্রণতিকে কেমন দেখলি? র না দিয়ে মুখে ফিকে হাসির ফাটল ধরাল ।

সোমা চেপে ধরল—তোর তো অনেক খুঁতখুঁতুনি ।একে এক কথায়...

ওর মাসি বললেন—সে আর ব’লো না ।আমি এক মাসের মধ্যে এনার জন্যে বাধ্য হয়েএগারোটা মেয়ে দেখেছি ।তারপর নোটিশ দিলাম,আর পারব না ।

এবার ঠকাস সোমাকে বলল—চেহারা খুব অর্ডিনারি ।আর রূপসী খোঁজার বয়স কোথায়,বল?তবে কথাবার্তা ভাল,হাসিখুশি ।আজকালকার মেয়েদের মতো ন্যাকামি নেই ।তাছাড়া ভাল স্বাস্থ্য

ঠকাস উত্ত

 

আমি ওকে অভয় দিলাম—বয়সের জন্য ঘাবড়িও না ।ওটা কোন ব্যাপার নয় ।মূরলীধরের এক প্রফেসার রিটায়ার করার পর তাঁর মেয়ের বয়সী এক এক্স-ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন ।সে দিচ্ছে সেবা-যত্ন,উনি তাকে দিচ্ছেন অর্থ ।দিয়ে যাবেন মোটা টাকা আর কলকাতার সেন্ট্রাল জায়গায় দোতলা বাড়ি ।

সোমা বলল—ধুর!ওসব রাখ তো!এই ঠকাস,প্রণতির বয়স কত রে?

ঠকাস উত্তর দিল—ওরা বলছে তিরিশ ।আর পাঁচ যোগ করতে পারিস ।

--আহা, তোরও তো পঞ্চাশ হয়ে গেল ।ওদের কত বলেছিস?

--যা বলা উচিত ।চল্লিশ ।

সোমার প্রশ্নের সিরিজ চলতে থাকল ।

-ওরা ক’ভাই-বোন?

-দু’ ভাই সাত বোন ।

-অ্যাঁ!এই বিশাল গুষ্ঠিতে বিয়ে করবি?

সোমার সমালোচনার ঝাঁঝে ঠকাস বেচারা মুষড়ে না পড়ে,ভেবে বললাম একটু রসিকতা করে,- এতো থার্ড বোন ।ওপরের দুটো ম্যারেড,মানে, অন্যের সম্পত্তি হয়ে গেছে ।বাকি থাকল চার আইবুড়ো শালী ।তারাও তোমার হাফ্ বৌ ।তার মানে বুঝলে?

ঠকাস ফ্যালফেলিয়ে রইল ।

বললাম,- তার মানে তোমার সবুরে মেওয়া ফলেছে ।বয়সে বিয়ে করে তোমার সাকুল্যে তিনটি বৌ জুটল ।আর আমি দেখ বিলকুল অ-শালী ।অশালীন হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না ।

সোমা ঝামটা দিয়ে আমার হাসি থামিয়ে দেয়—থাক, তোমাকে আর শিব্রামী করতে হবে না!অঙ্কের হিসেবে তো ভুল করেছ!চার ছোট শালীর ওপর আগের দুই জামাইবাবুর ভাগ আছে না?তাহলে ঠকাসের ভাগে কটা বৌ হল?

দু’হাত তুলে সারেণ্ডার করে বললাম, দেখলে তো, ভায়া, বিবাহিত লোকের বাক্-স্বাধীনতা বলে কোন জিনিস থাকতে পারে না!

এসব হাল্কা কথার পর ঠকাস যা বলল, তা একেবারে শরদিন্দুর রহস্যোপন্যাসের মেটিরিয়াল ।বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা ওকে দ্রুত নিতে হল নাকি আত্মরক্ষার তাগিদে!নতুন ফ্ল্যাটটা ওদের দু’ভাইয়ের ‘কমন’ প্রপার্টি । দু’জনের ভাগে একটা করে বেডরুম,তথাকথিত কিচেন আর বাথরুম ।ড্রইংরুমটা এজমালি ।ছোট ভাই বরুণ বছর দুই আগেই বিয়ে করেছে ।সে শাশুড়ির বড় অনুগত জামাই, আর তার স্ত্রী ইতিমধ্যে সন্তানসম্ভবা ।ওরা কত্তা-গিন্নি নাকি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় ‘ফটাস’ অর্থাৎ ক্ষতম করে ফেলার!যাতে পুরো ফল্যাটটা তাদের ভোগে আসে ।কিছু একটা ঘটে গেলে কে আর তদন্তের জন্য খোঁচাবে?তিন কুলে আছে কে ঠকাসের জন্য সত্যিকার দরদ অনুভব করার?তেমন ফ্যাকড়া দেখলে ওরা বড়জোর পুলিশকে কিছু খাইয়ে দেবে ।ব্যস, তারপর গোটা ফ্ল্যাটে সুখের সংসার ।

আমরা যখন জেরা করলাম,এমন আশঙ্কার কি কারণ ঘটেছে, ঠকাস পরপর কয়েকটা ঘটনা বলে গেল । দু’মাস আগে ঠিক ওর অফিস বেরোবার সময় সিঁড়ির মুখে হড়হড়ে সাবান-জল ফেলে রেখেছিল ওরা । ও খুব জোর সামলে নিয়েছিল রেলিং ধরে ।এক রাত্তিরে গ্যাস সিলিণ্ডার এবং ওভেনের চাবি খোলা ছিল। ওরা বেলা করে ওঠে এবং জানে ঠকাস ভোরবেলায় উঠে চা করবে;সুতরাং মরার চান্স ।আর একদিন ও আবিষ্কার করেছে, ওর সর্ষের তেলের শিশিতে তেল নয়, পেট্রল ভর্তি রয়েছে!ব্যাপারটা হাইলি সাসপিশাস্ ।ধরা পড়ার পর ওরা হিজিবিজি ওজুহাত দেখিয়ে বলেছে ‘তোমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি!’ তারপর সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে মাত্র মাস দেড়েক আগে ।একই রান্না বাড়ির সবাই খেয়েছে ।কিন্তু শুধু ঠকাসকে ফুড-পয়জনড্ হয়ে তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হল!

এর পরই সে অবিলম্বে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।তাহলে তাকে এইভাবে ফুস্ করে সরিয়ে দেবার সুযোগ থাকবে না ।সে চেষ্টাও করতে সাহস পাবে না ।কারণ একজন গেলেও সম্পত্তির আর এক দাবিদার থেকে যাবে ।

ঠকাসকে জানিয়ে দিলাম, বরযাত্রী যাওয়া থেকে আমায় রেহাই দিতে হবে ।তবে বৌভাতের দিন সকাল থেকেই সোমা আর আমি গিয়ে হাজির হব ওদের বাড়ি ।

ও চলে যাবার পর আমরা দুজন খানিক গবেষণা করলাম ওর পিছনে বরুণের চক্রান্ত নিয়ে ।সোমা বলল,ও একটু বেশি ভাবছে ।সন্দেহবাতিক হয়ে গেছে ।

--রজ্জুতে সর্পভ্রম বলছ?নাও হতে পারে ।আজকাল কাগজে,টিভি সিরিয়ালে যা সব দেখাচ্ছে, ডিরেক্ট বা ইনডিরেক্ট মার্ডার আলুকাবলি বানানোর মত ইজি হয়ে গেছে ।তাছাড়া মোটিভটা বেশ স্ট্রং!

--আর ইউ সিরিয়াস,মিঃ বক্সী?—সোমা ঠাট্টা করল ।

আমি হেসে ফেললাম ।বললাম,বরুণকে তো চোখেই দেখিনি!ওদের কমন ফ্ল্যাটটাও না ।


                          (২)

ভয় ছিল নেমন্তন্নর দিন যদি প্রবল বর্ষা হয় ।কারণ মাসটা জুলাই ।কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি—ঠিক আগের রাত থেকে সোমা ঘোরতর অসুস্থ হল ।ভাইরাল ফিভার ।সারা শহর আজকাল এর দাপটে বিপর্যস্ত ।প্রবল জ্বর,মাথায় তীব্র যন্ত্রণা,সারা গায়ে ব্যথা,মুখে অরুচি,এবং কোন ওষুধেই উপশম নেই ।চলবে তিন থেকে পাঁচ দিন ।

উপহারের শাড়ি কেনা হয়ে গিয়েছিল ।কিন্তু সোমা ছাড়া আমি ওদের কাছে নো-বডি ।ওদিকে আবার কথা দেয়া আছে, যাওয়াটা কর্তব্য ।আমি একলা গেলে যদিও কোন তরফের তৃপ্তি হবে না, তবু অন্ততঃ ভবিষ্যতে কিছু অভিযোগ থাকবে না ।

যাব-কি-যাবনা করতে করতে শেষে যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম সোমার তাগাদায় ।তবে সকালে নয়, বিকেলে ।এবং ঠকাসের ফ্ল্যাটে নয়, একেবারে অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া করা বাড়িতে, যার ঠিকানা কার্ডে দেয়া ছিল ।বেরবার সময় সোমা শারীরীক ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতেই রসিকতা করে বলল—পারলে ঠকাসের ফ্ল্যাটটাও একবার স্টাডি করে এসো ।কোথায় গ্যাস সিলিণ্ডার থাকে, সিঁড়ির ল্যান্ডিং কতটা চওড়া ।আর বরুণকে তো দেখবেই ।টেক কেয়ার অব ইয়োরসেল্ফ্ ।

                           (৩)

মেট্রো রেলে শ্যামবাজার ।তারপর শেয়ারের ট্যাক্সিতে ডানলপ ।বিকেলের আলো থাকতেই বিটি রোডের বাঁ দিকের একটা সরু রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে, এবং স্থানীয় লোককে দু’বার জিজ্ঞাসা করেই অভীষ্ট ঠিকানা পেয়ে গেলাম ।বিয়েবাড়ি বা বৌভাতবাড়ি বলে চেনার অবশ্য কোন উপায় নেই ।ডেকরেটেড গেট নেই, সানাই নেই, এবং সম্পূর্ণ অ-মাইক ।‘সুরেন্দ্র ওয়েডস্ প্রণতি’—এমন বিজ্ঞপ্তিও নেই ।আসলে এটা স্থানীয় ছেলেদের ক্লাবরুম ।ঠকাস সেক্রেটারির ছেলেকে পড়ায় ।সেই সূত্রেই জায়গাটা একদিনের জন্য ম্যানেজ করা গেছে ।

ঘরটা অবশ্য খুব ছোট নয়, হল বলেও ধরা যায় ।জনা চল্লিশ লোক চেয়ার-টেবিল পেতেবসে খেতে পারে ।এক দিকের দেয়ালে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে দুটি ক্যারম বোর্ড ।এক কোণে দুটি জীর্ণ টেবিল ।তারই পাশে মোটা করে টেপ-জড়ানো এবং ঝুলমাখা একটি ক্রিকেট ব্যাট ।আর এক দেয়াল ঘেঁসে সারি সারি তিনটি আলমারি ।নিশ্চয়ই তার ভিতর ক্লাবের খেলার সরঞ্জাম ।ঘাড় ঘোরাতে চোখে পড়ল স্তূপীকৃত বেশ কিছু ফোল্ডিং চেয়ার ।আর এক কোণে বৌ বসার উঁচু ভেলভেট দেওয়া লৌহাসন ।তাতে এখন একটা নেড়ি কুকুর দেহ এলিয়ে তোফা নিদ্রায় মগ্ন ।ভিতরে খোলা দরজা দিয়ে একফালি উঠোন দেখা যায়। সেখানে কিছু আলু মুলো পেঁয়াজ একটা টবে ঢালা রয়েছে ।এবং সম্ভবত স্টোভে কিছু রান্না চড়েছে ।সেই স্পটে দু’জন কর্মব্যস্ত গামছা পরা লোক চোখে পড়ল ।কিন্তু অভ্যাগত বা আপ্যায়নকারী কোন সম্প্রদায়ের একজনকেও দেখতে পেলাম না ।ঘরের মাঝ-বরাবর একটা সিলিং ফ্যান চালু ছিল ।তার তলায় একটা চেয়ার টেনে বসলাম ।হাঁ করে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, কিংকর্তব্য ভাবতে ভাবতে ।

মিনিট দশ পর এক ছোকরা রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকল ।আমার সম্পূর্ণ অচেনা মুখ এবং পোশাক-আসাক খুঁটিয়ে দেখল ।তারপর খানিকটা ইতস্ততঃ করে বলল—আপনি সাউথ থেকে আসছেন?ঠকাসদার বিয়ের নেমন্তন্ন?

‘হ্যাঁ’ বলে প্রমাণস্বরূপ নিমন্ত্রণ পত্রটাও পকেট থেকে বার করলাম ।

ছোকরা তখন দয়াপরবশ হয়ে বলল—ওঁদের আসতে সাতটা বাজবে ।আপনি বরং ঠকাসদার বাড়ি চলে যান ।রিক্সা রেডি আছে, আজ সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি করার জন্য ।আমার নাম শঙ্কর ।আমি রান্নাবান্না দেখাশোনা করছি ।

প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম ।শঙ্কর রিক্সাঅলাকে ডেকে বলে দিল—দাদাকে সোজা ফ্ল্যাটে নিয়ে যাও ।

রিক্সায় উঠেই পরিস্থিতিটা ঝালিয়ে নিলাম ।এটা এখন সাধারণ রিক্সা নয়, এই নির্দিষ্ট রাস্তাটা যাতায়াতের জন্য,এবং আজকের ভিআইপিদের বহনের জন্য ।বিশিষ্টদের জন্য যেমন স্টেশান বা এয়ারপোর্টে মোটর গাড়ি পাঠানো হয়,যেমন রাজারাজড়ারা হাতি পাঠাতেন, গ্রামের জমিদার এবং বর্ধিষ্ণু লোকেরা গোরুর গাড়ি পাঠাতেন ।তেমনই এই বাঁধা রিক্সা ।এ রাইড সম্মানের, এবং এটা ফ্রী রাইড ।ঠকাস জিন্দাবাদ ।

বিটি রোডে বেরিয়ে উত্তর মখে এগচ্ছিল রিক্সা ।রিক্সাওলাকে শুধোলাম—এখান থেকে ফ্ল্যাট কতক্ষণ লাগবে?

সে বলল—এই তো কাছে ।সাত-আট মিনিট...বলতে বলতে  ডান দিকে এক এবড়ো-খেবড়ো সরু রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল রিক্সাটা ।

কোনরকমে শারীরীক ভারসাম্য রক্ষা করে পতন থেকে বাঁচালাম নিজেকে ।তারপর বর্ষায়-যথেচ্ছ-গজানো বনজঙ্গল,পুকুরপাড় ও খানাখন্দ পাশ কাটিয়ে এক সময় এসে পড়লাম দেবেন্দ্রনগরের তাকলাগানো ফ্যাশান-দোরস্ত কিছু ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে ।এরই একটার গেটে থামল রিক্সা ।

                            (৪)

ঠকাসদের ‘কমন’ ফ্ল্যাট তিন তলায় ।দেখা যাক সিঁড়ি কতখানি খাড়া, কতটা এ্যাক্সিডেন্ট-প্রবণ।বুঝলাম,আশঙ্কার কারণ আছে ।সরু সিঁড়িতে আমার পা খানিকটা বেরিয়ে থাকছে ।ল্যাণ্ডিংও তেমন চওড়া নয় ।

ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল ।স্বয়ং ঠকাসই অভ্যর্থনা করল ক্লান্ত অথচ খুশি মুখে ।ওর চোখদুটো সোমাকে খুঁজল ।দুঃখিত মুখে ওকে ভাইরাল ফিভারের দুঃসংবাদটা দিলাম ।বুঝল ।সোমার প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো তত্ত্বেরট্রেগুলো দেখাল ।পাশের ফ্ল্যাটের ব্যাচিলর ছেলেটি এই উপলক্ষে তার ড্রইংরুম ছেড়ে দিয়েছিল ।সেখানে বসিয়ে আমায় চা খাওয়াল ।বরুণের কথা জিগ্যেস করতে জানালো,ও শ্বশুরবাড়ি থেকে সরাসরি খাবার জায়গায় চলে যাবে ।আর ওর বৌয়ের এখন এ্যাডভান্সড্ স্টেজ, আসতে পারবে না ।

আমার হাতের শাড়ির প্যাকেটটা ঠকাসকেই গছাতে চাইছিলাম ।ও বলল, এসো না, প্রণতির হাতেই দাও ।তোমাদের কথা ও সব জানে ।ব’লে প্রণতির উদ্দেশে বলল—এ্যাই, তোমার সাজগোজ হয়েছে? দ্যাখ প্রণবদা এসেছে ।

বেডরুমের দরজা খুলে প্রণতি বেরল ।নববধূর সাজ সারা হয়ে গেছে তার ।গোলাপী শাড়ি,অলঙ্কার কিছু, মুখে চন্দন-কুমকুম, মাথায় একটা টায়রা পর্যন্ত ।কিন্তু মুগ্ধ হবার কোন ব্যাপার নেই তার শ্যামলা অতিসাধারণ চেহারায় ।শুধু চোখের চাউনি থেকে বোঝা যায় বুদ্ধির ঘাটতি নেই ।আমার হাত থেকে শাড়ির প্যাকেটটা নিতে নিতে বলল—সোমাদি কই? ওর কাছে অনেক শুনেছি আপনাদের কথা ।

বললাম—সোমাও তোমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল ।এমন সময় অসুস্থ হয়ে ও নিজেই নিজের ওপর রাগ করছে ।তোমরা শিগগিরি একদিন এসো আমাদের বাড়ি ।ও যদি তোমায় না নিয়ে যায়, তুমিই ওকে নিয়ে যেও ।

ঠকাস ওর দূর সম্পর্কের মামা এবং রাউরকেল্লা থেকে হঠাৎ এসে পড়া মামাতো ভাই অমলের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল ।দু’চার কথার পর আমরা সবাই ভোজনস্থলে রওনা হবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলাম ।

আমি ক্লাবঘর হয়ে এসেছি শুনে ঠকাস বলল, তাহলে প্রণতি, মাইমা আর রাকা বৌদি আগে চলে যাক প্রণবদার সঙ্গে অমলের মোটরে ।কি অমল,তোমার ড্রাইভার আছে তো?

অমল একটা টিপিক্যাল ওস্তাদি ভঙ্গিতে কথা বলে,--ড্রাইভার ছাড়া কলকাতার রাস্তায় বেরন যায়? সামনের গ্যারেজ থেকে পিক্আপ করেছি আজকের ছোঁড়াটাকে ।কিছু এক্সট্রা প্রমিস করতে হয়েছে ।

সেই ব্যবস্থামত অমলের গাড়িতে নতুন বৌ ও দুই প্রবীণ মহিলার এসকর্ট হিসাবে আমি রওনা দিলাম ঠকাসের ফ্ল্যাট থেকে ।রিক্সায় ক্লাব থেকে এখানে আসতে পাক্কা কুড়ি মিনিট লেগেছিল ।তারপর রাস্তায় ঐ রামঝাঁকুনি ।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, যাক এবার স্মুথলি ভদ্রলোকের মতো যাওয়া যাবে ।আর কোন ঝামেলা নেই ।শুধু আরাম করে হাওয়া খাওয়া ।মহিলাদের পিছনের সীটে বসিয়ে দরজা লক্ করিয়ে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলাম ।গাড়ি ছাড়ল ।গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলাম—অ্যায়সা লাগতা হ্যায়, জো না হুয়া, হো নে কো হ্যায়...


                           (৫)

সত্যিই অভাবিত ঘটনাটা ঘটে গেল হঠাৎ, চরম পরিহাসের মত ।যে গাড়ির আশ্রয়ে পরম নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা বোধ করছিলাম, সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল ।অবশ্য দোষটা ঠিক গাড়ির নয়,চালকের। 

প্রথম বাঁয়ে ঘুরে একবার ডাইনে তারপর আবার বাঁয়ের রাস্তা ।ওদিক থেকে একটা টেম্পো ঢুকছিল । আমাদের গাড়ি একটু থেমে ব্যাক করে তাকে পাশ দিতে গেল ।আনাড়ি ড্রাইভার কিছু বোঝার আগে বাঁ দিকের পিছনের চাকাটা খানিক নেমে গেল রাস্তার ধারে নালার ঢালে ।গাড়ি কাত হয়ে গেল কুড়ি ডিগ্রি এ্যাঙ্গলে!

বড় রাস্তা হলে আমাদের সমবেত আর্তনাদে শ’দুয়েক লোক জড়ো হয়ে যেত ।কিন্তু এখানে দু-এক জন পথচলতি লোক একপলক তাকিয়ে চলে গেল ।

কী ভাগ্য দরজা জ্যাম হয়ে যায় নি ।ডান দিক দিয়ে সকলে নিরাপদে গাড়ি থেকে নামতে পারলাম । বিয়ের ব্যাপারে ঠকাসের একটা ফাঁড়া আছে, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম ।আর একটু বেশি কিছু হলে হয়তো ফুলশয্যার রাত হাসপাতালে কাটাত বৌটা ।আর শ্বশুর ওকে শ্রীঘরে পাঠাত ।কিন্তু এ ব্যাপারে অন্তত বরুণের কোন হাত নেই, এটা হলফ করে বলতে পারি ।

সবাই বেরোবার পর ড্রাইভারকে বললাম—এইবার গীয়ার এ্যাকসিলারেটর বাড়িয়ে দেখ, তোলা যায় কি না গাড়িটা ।

দু’বার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল ছোকরা ।সাফ বলে দিল, লোক ডাকতে হবে ।

গাড্ডায় গড়াতে অন্যকে অনেক দেখেছি; গাড্ডায় পড়া কথাটা জন্ম থেকেই শুনে আসছি ।কিন্তু আক্ষরিক অর্থে আজ প্রথম অভিজ্ঞতা হল ।এখন কি করা যায়? যা করার তো আমাকেই করতে হবে ।সঙ্গে নতুন সালঙ্কারা নবোঢ়া পরস্ত্রী ।রাস্তার মিটমিটে আলোয় ।সন্দেহজনক পরিবেশ ।রাত বাড়ছে ।টিপটিপ বৃষ্টি।এটা ঝেঁপে এলে বিপদের ষোল কলা পূর্ণ হয় ।

মহিলাদের উদ্দেশে বললাম—এমন মাঝপথে ব্যাপারটা হল, এখন আপনাদের ফেলে ফ্ল্যাটে খবর দিতেই বা যাই কি করে!

ঠকাসের মাইমা বললেন—না না,আমরা অপেক্ষা করি ।ওরা কেউ নিশ্চয়ই রিক্সাতে যাবে এ পথ দিয়ে ।

আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম একটা লাইটপোস্টের তলায় হতভম্ব হয়ে ।এদিক ওদিক বাড়ির জানলা ও বারান্দা থেকে কৌতুহলী মহিলা ও শিশুরা নতুন বৌ দেখতে লাগল অবাক চোখে ।চূড়ান্ত বিব্রত মনে হতে লাগল নিজেকে ।

হঠাৎ প্রণতি আমাকে বলল—দাদা, আপনার বেল্টটা দেবেন একটু? চেষ্টা করে দেখি ।

আমি তো অবাক!প্রথমটা বুঝতে পারলাম না কি বলতে চায় নতুন বৌ ।

ও বুঝিয়ে বলল,--আপনার বেল্টটা আমার কোমরে বাঁধব ।আমার কারাটে জুডো অভ্যাস আছে ।আপনি আর ড্রাইভার গাড়ির ডানদিকটা ঠেলবেন ।আমি বাঁ দিকটা তুলছি ।

আমি তখনো হাঁ করে আছি ।প্রণতি শাড়ি খানিক তুলে কোমরে গুঁজে তার নীচে আমার বেল্টটা বেঁধে নিল ।ড্রাইভারকে বলল স্টার্ট দিতে ।নিজে নেমে গেল বাঁদিকের খানায় ।আমি নির্দেশমত গাড়ির ডান দিকটা প্রাণপণেঠেলতে লাগলাম ।

চোখের সামনে যা দেখলাম,একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মতো ।সোমাকে গিয়ে যখন বলব,ও হয়ত টন্ট করে বলবে—গল্পের গরু গাছে উঠতে পারে, কিন্তু বৌভাতের সন্ধ্যায় আধুনিক বৌ কোমর বেঁধে গাড্ডা থেকে মোটর গাড়ি তুলবে...ইটস্ টূ মাচ!

কিন্তু দেখলাম,বাস্তব কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত হতে পারে ।

‘ইয়াক্’ করে এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ ।হঠাৎ এক ঝটকায় গাড্ডা থেকে উঠে পড়ে খানিকটা এগিয়ে গেল মারুতি!

ঘাসে পায়ের কাদা মুছে, শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে প্রণতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল ।এরপর গাড়ি নিরাপদে পৌঁছল গন্তব্যে ।নামার আগে কাঁধে মৃদু ঠেলা খেয়ে পিছন ফিরলাম ।আপনার বেল্টটা ।প্রণতি আমার হাতে ধরিয়ে দিল ।

                             (৬)

ঠকাস ভোজবাড়িতে এসে পৌঁছতে আগে আমিই ওকে ঘটনাটা জানালাম ।শুনে ভয়, বিস্ময়, উদ্বেগ, আনন্দ কিছুই প্রকাশ করতে পারল না ও ।কেবল কয়েক বার চোখ পিটপিট্ করে শেষে বলল—যাক কারো কোন ইনজুরি হয়নি তাই ভাল ।

বললাম, যাও প্রণতির রিস্ট দুটো একটু মাসাজ করে দাও!

ঠকাস এবার বলল—না, শুনে ভয় বাড়ল ।কথা না শুনলেই ধরে ঠ্যাঙাবে!

হাসতে হাসতে বললাম, ভয়ে ভয়েই জীবনটা কাটাবে নাকি?

ঠকাস বলল—আমার প্রফেশানে তো ভয়ই ভয় ।কবে কে ছেড়ে দেয়,ঈশ্বরও বলতে পারেন না ।অফিসেও টেম্পোরারি, আর টিউশানির ক্ষেত্রে গার্জেন ও স্টুডেন্ট দু’তরফের মনোরঞ্জন করে চলা সার্কাসের দড়ির খেলার মতই কঠিন কাজ ।তার ওপর বরুণের কথা তো বললামই ।যাই হোক, সব চে’ বেশি ভয় পেয়েছিলাম এক প্রাইভেট ছাত্রের বাড়িতে ।সে কথা বলেছি কি?...বলি নি ।সেটা একটা অলৌকিক স্টোরির মত ।শোন ।

                        

ছাত্র ক্লাস টুয়েল্ভ-এ পড়ে ।বাবা বিজনেস্ ম্যাগনেট ।বাড়ি আলিপুর রোডের নির্জনে ।আমার পড়ানোর সময় উইকে তিন দিন সন্ধে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা ।

তখন শীতকাল ।এক দিন হঠাৎ লোডশেড হয়ে গেল সাতটার সময় ।ঘুটঘুটে অন্ধকার ।অরিন্দম বলল, স্যার, জেনারেটারটা খারাপ হয়ে গেছে ।কারেন্ট আসা পর্যন্ত ওয়েট করা ছাড়া উপায় নেই ।

তাই করতে লাগলাম ।

হঠাৎ শুনি ওদের ল্যাব্রাডারটা ভীষণ চেঁচাচ্ছে ।যেন বাড়িতে চোর ঢুকেছে ।অরিন্দম ফ্যান্টম্!ফ্যান্টম্!বলে কুকুরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভিতরের ঘরে গেল ।আমি একা, এমন সময় বাগানের দিকের জানল দিয়ে হুহু করে খানিকটা ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকল, আর তারপরই ঢুকল একটা পাখি...না,না, বাদুড়!তখনি মনে হল শুনেছি, কোন কোন বাদুড় রক্ত চোষে ।এটা যদি রক্তচোষা হয়!

ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, অরিন্দম!অরিন্দম!একটা টর্চ নিয়ে এসো শিগগির!

কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না ।

বাদুড়টা আমার মাথার ওপর চক্কর মেরে উড়তে লাগল ।

শীতের সন্ধেতেও আমার কপাল ঘেমে উঠল ।

যাই হোক,খানিক পরে কারেন্ট এল ।বাদুড় বাবাজিও তার কেরামতি দেখিয়ে যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই বিদায় নিলেন ।

কিন্তু অরিন্দম ঘরে ঢুকে যা বলল, তাতে নতুন করে আমার মাথা ঘুরে গেল ।

‘দিয়েছি ব্যাটাকে জাহান্নমে পাঠিয়ে!’

-‘কাকে আবার জাহান্নমে পাঠালে?’

‘বাবুর্চি সুখদেবকে ।খামোখা কুকুরটাকে ধরে পেটাচ্ছিল!’

-‘তুমি কী করলে?’

একটা ভারি হাতা দিয়ে দিয়ছি মাথায় এক জোর ব্লো ।একদম ফ্ল্যাট!বোধ হয় মরে গেছে ।’

শিউরে উঠে বললাম, ‘সে কী!খুন করলে তো পুলিশ ধরবে তোমায়!জেলে যেতে হবে!’

অরিন্দম অদ্ভুত উদাস গলায় বলল, ‘পুলিশ তো ডাকব যদি ও আধ ঘন্টার মধ্যে রিকভার না করে ! কিন্তু আপনি তার আগে কেটে পড়ুন ।পুলিশ এলে আপনাকে বিস্তর জেরা করে রাত কাবার করে দেবে!’ 

আমার একবার মনে হল ডাক্তার ডাকতে বলি ।কিন্তু আত্মরক্ষার তাগিদটা আরো বড় মনে হল ।

বললাম, ‘ঠিক বলেছ!তাহলে আমি আসি এখন!’ 

দরজা দিয়ে সবেগে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম ।তারপর জাজেস্ রোড ধরে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে শেষ পর্যন্ত গোপালনগরের মোড়ে লোকের ভিড়ের মধ্যে এসে স্বস্তি পেলাম ।***

                         (৭)

গল্পটা শুনে বললাম, ‘দারুণ ইন্টারেস্টিং এক্সপিরিয়েন্স তো!...তারপর তুমি আবার ঐ ছাত্রকে পড়াতে গিয়েছিলে?’

ঠকাস বলল, ‘কয়েক দিন পরে একদিন সকালে গিয়েছিলাম ওদের ওখানে ।কয়েকবার কলিং-বেল দিয়ে বুঝলাম ভিতরে কেউ নেই ।এই দরজা আর খুলবে না ।কী যে সে রাতে হয়েছিল, মানে বাবুর্চিটা—যে আমাকে অনেক ফিশফ্রাই, বিরিয়ানি খাইয়েছে—সত্যি মারা গিয়েছিল কি না, সেটা কোনদিন হয়তো জানতে পারব না!’

-‘যাক গে এখন আমাদের ফিশফ্রাই খেতে আর দেরি করা যাবে না!খাবার বন্দোবস্ত ঠিকমত হচ্ছে তো?’

ঠকাস বলল, ‘ও নিয়ে ভাবনা নেই ।সন্টা দা’কে ইন-চার্জ করে দিয়েছি ।সব কাজ ঠিকঠাক হবে ।’

                       

পরের দৃশ্য ।সেই ক্লাবঘর এখন রীতিমত ভোজঘরে রূপান্তরিত ।ঘড়িতে আটটা ।যারা আসার প্রায় সব এসে গেছে ।বুফে স্টার্ট হয়ে গেছে ।নতুন বৌ সিংহাসনে বসেছে মানানসই ভাবে ।হেসে হেসে গল্প করছে নিজের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ।ঠকাসের মামা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পলিটিক্স আলোচনা করছেন ঠকাসের শ্বশুরের সঙ্গে ।দু-চার জন প্রতিবেশী ।ঠকাসের কিছু অফিস কলীগ ।

সাড়ে আটটা ।মুরগীর ঠ্যাং চুষতে চুষতে লক্ষ্য করছি লোকজন ।আর থেকে প্রণতির অদ্ভুত ক্ষমতার কথা ভাবছি ।ওর চেহারার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছি না ।

চোখ পড়ল বরুণের দিকে ।কে একজন ওর নাম ধরে ডাকল বলেই বুঝলাম ।চেহারায় মিল আছে ঠকাসের সঙ্গে ।তবে গোঁফ নেই, আর গতরে একটু ভারি ।চোখের ধূর্ত ভাবটা হয়তো আমার স্বকল্পিত।একজনকে বরুণ বলছিল, বেশি করে নিন ।বুফেতে এটাই সুবিধে ।ও কি খাবার শর্ট পড়িয়ে ভাইকে অপদস্থ করার তাল করছে?ছেলেমানুষের মত আমার চোখ বেশ খানিকক্ষণ অনুসরণ করল ওর প্রতিটি মুভমেন্ট ।যদি তদারকি করার অছিলায় কোন খাবারের পাত্রে পকেট থেকে কিছু বার করে মিশিয়ে দেয়!

আবার সিংহাসনের দিকে তাকালাম ।ক্লাবের সেক্রেটারি এসেছেন ।ঠকাস পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ।প্রণতি মুচকি হেসে তাঁর হাত থেকে ফুলের তোড়া নিচ্ছে ।

না,ঠকাসের চয়েস একদম রাইট চয়েস ।প্রণতি ঠিক সামলে দেব ।বিপদ বা সমস্যা যাই হোক ।আমি নিশ্চিন্ত মনে আইসক্রিমের দিকে হাত বাড়ালাম ।

ছোট গল্প - যোগাযোগ || লেখক - আভা সরকার মন্ডল || Written by Ava sarkar mondal || Short story - Jogajog


 



যোগাযোগ


আভা সরকার মন্ডল


 


ছোট বেলায় বাবা মারা গেছে ভুবনের চোদ্দো বছর বয়সে মাকেও হারিয়েছে ।


কাকুর কাছেই মানুষ হয়েছে ভুবন। কোনমতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে কাকুর ব্যবসার কাজে ঢুকে যায় সে।বলা ভালো --- এর বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না তার কাছে ।


 কাকুর ছেলে মেয়েরা অবশ্য যোগ্যতা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত। তারা কেউ বাবার ব্যবসা দেখাশুনায় আগ্ৰহ দেখায় নি ।


অংকে ভুবন বরাবরই ভালো ছিল। তাই কাকুর কাপড়ের দোকানের হিসেবের বাক্সটা সেই সামলাতো ।সবই চলছিল ঠিকঠাক । কিন্তু নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেই বাঁধে গোলোযোগ । পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলে বাড়ি ছাড়তে হবে কাকুর এই হুংকারের সামনে বিবশ হয় সে বাড়ি ছাড়তে।


 


গড়িয়ে গেছে দশটি বছর মিনির সাথে সংসার পেতে, সে এখন ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের পিতা। একটি কাপড়ের দোকানে সে হিসাবপত্র দেখার কাজ করে, যেমন করত নিজের কাকুর দোকানে । ছুটির দিন এবং সকাল বিকাল সে বাড়িতে টিউশনও পড়ায় । তার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে স্কুল টিচার হবার। মনের সেই ইচ্ছেটাকে ছাত্র পড়িয়েই পুরণ করে সে। কাকু কে কখনও দোষারোপ করে না । তিনি পাশে না দাঁড়ালে, এই স্বপ্নটুকুও সে দেখতে পারত না , একথা কৃতজ্ঞচিত্তেই স্মরণ করে সবসময় ।


ভুবন মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর স্বপ্নে মশগুল এখন ।


একদিন এক অচেনা ছেলে তাকে একটি ফোন নম্বর দিয়ে বলে সে যেন ওই নম্বরে একটা ফোন করে, খুব জরুরি ।অবাক হলেও কাগজের টুকরো টি হাতে নেয় সে। এবং যথারীতি কাজের চাপে ভুলে যায় বুক পকেটে রাখা টুকরোটির কথা।


 


 ছুটির দিনে মিনি তাকে বলে


-- কাপড় ভিজানোর সময় কিছু দিন আগে এই কাগজটা পেয়েছিলাম দ্যাখো তো দরকারি কিনা ?


--- সেটা দেখে সে বলল,এই যাহ্ ! ভুলেই গেছিলাম ! দাও তো, ফোনটা এখনই সেরে নেই । কে যে ফোন করতে বলেছিল ।


----মিনি গম্ভীর হয়ে বলল,দ্যাখো তোমার পুরোনো কোনো প্রেমিকা কি না ।


---- ভুবন হেসে বলল তাড়াতাড়ি দাও ফোনটা, আমার আর তর সইছে না । পকেটে প্রেমিকার ফোন নাম্বার রেখে ভুলে গেছি ।


---মিনি হাসলো,সে জানে শুধু তার জন্যই ভুবন আজ বাড়ি ছাড়া। জাত-ধর্ম এক নয় বলে কাকু মেনে নেন নি তাদের বিয়ে।নিজের বাবা মা ও মানেন নি ,কাজেই মিনি নিজের ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ করে না।


 


ভুবন নাম্বারটি ডায়াল করে বলল


------ আমি ভুবন বলছি ।কেউ আমাকে এই নম্বরটি দিয়েছে ...... ভুবনের কথা শেষ না হতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো কেঁপে যাওয়া একটি গলার আওয়াজ


------ কেমন আছিস বাবা ? আমি কাকু বলছি।--


ভুবন থ হয়ে রইল কিছুক্ষন। দশ বছর পর সে শুনতে পাচ্ছে কাকুর গলা ।বিয়ের পরও তারা দুজনে একবার গেছিল দেখা করতে,বাইরের ঘরে বসে থেকে চলে এসেছে কাকু দেখা করেননি ।


-----আমাদের ভুলে গেছিস ? কাকুর গলাটা কেমন অসহায় শোনাল ।


ভুবন সম্বিৎ ফিরে বলল,


----ভালো আছি কাকু। তুমি কেমন আছো? কাকীমা, নূপুর,রনি ওরা কেমন আছে ?


--- নূপুর তো বিয়ের পর বরের সঙ্গে কানাডা চলে গেছে । রনিও ওখানেই পড়াশুনা করছে।আমরা আছি বুড়োবুড়ি বাড়ি পাহারায় । তোর কাকীমার শরীর ভালো নেই । আমার ও হাই সুগার । বেঁচে আছি এইসব রোগ ব্যাধি নিয়েই ।


আমার দোকানের পুরোনো একটা ছেলে তোর ঠিকানা জানত।ওর মাধ্যমেই ফোন নম্বর টা পাঠিয়েছিলাম দিন দশেক আগে.... তিনদিন হল তোর কাকীমাকে আবার হসপিটালে ভর্তি করেছি। শরীর টা একটু খারাপ হয়েছে।


কাকু কে থামিয়ে দিয়ে ভুবন বলে ওঠে


--- কাকীমা কেমন আছে এখন?তোমরা করোনা ভ্যাকসিন নিয়েছো তো ?


---ধুররর ভ্যাকসিন নিয়ে কি হবে ? এসব ভ্যাকসিন,ট্যাকসিন এর কোনো মানে নেই। কাকীমা এখন ভালোই আছে ডাক্তার বলেছে দুদিন পরে ছেড়ে দেবে ।


 তুই বৌমাকে নিয়ে একবার আয়,দেখে যা আমাদের । কাকুর গলায় আকুতি !


মিনি দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। কথাবার্তা শুনেই সে সব বুঝতে পারছে ।


ভুবন জানে কাকু খুব জেদী মানুষ। নিজে যা ঠিক করবে তার বাইরে কারও কথা শুনবে না তবু সে বলল


--- ভ্যাকসিনটা নিয়ে নিও কাকু। চারদিকের অবস্থা ভালো নয়। দ্বিতীয় ঢেউটা খুব মারাত্মক আকার নিয়েছে।


প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কাকু বললেন


--- আমার উপর রাগ রাখিস না। একদিন আয় সবাই মিলে।এই বুড়ো বাপ টাকে ভুলে যাস না যেন । মাঝে মাঝে মনে করিস।


ভুবন কাকুর বাড়ি যাবে ,কথা দিয়ে ফোন রাখল ।


 


এতদিন পরে কাকুর ফোন পেয়ে সে আশ্চর্য হল তবুও মিনিকে বলল করোনা কমলে একদিন সবাই মিলে যাবে কাকুর ওখানে।মিনি কোনো কথা বলল না। সে খুশি হলো ? , না অখুশি ? ---বোঝা গেল না !


 


এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পর কাকুর নম্বর থেকে একটি ফোন পেল ভুবন। জনৈক সুজয় বাবু জানালেন


রাতে কাকীমা মারা গেছেন,সকালে কাকু। দুদিন আগে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার সময় কাকু নাকি তাঁকে ভুবনের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিল ।কাকীমার করোনা পজিটিভ ধরা পরার আগেই কাকুর জ্বর,কাশি শুরু হয়েছিল। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে আসবেন এটাই কাকুর বিশ্বাস ছিল। তবু সুজয় বাবু কে বলেছিলেন তাঁদের অসুস্থ হওয়ার খবর যেন ভুবনকে না দেয়া হয়।কারণ তাঁর মনে হয়েছিল ভুবনের সাথে তিনি অন্যায় করেছেন। তাই করোনা কালীন এই ঘোর বিপদে তাকে ডাকাটা আরও একটা অন্যায় হবে। এই ছোঁয়াচে রোগের মারণ ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছিলেন। ভ্যাকসিন না নেয়াটাও যে চরম বোকামি হয়েছে তাও তিনি বুঝেছিলেন।ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।


তিনি যদি বেঁচে না ফেরেন, তবেই যেন ভুবনকে খবর দেয়া হয়--- সব কথার শেষে এই কথাটিও তিনি সুজয় বাবুকে বলে গেছিলেন।


 


 ভীষণ একটা কষ্ট ভুবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল । এতদিন একটা অভিমান বুকে বাসা বেঁধেছিল তার,সে জানত কাকু তাকে ভালোবাসে না। আজ তার সেই ভুল ভাঙল। শুধু তার বিপদ হবে বলে, এত বড় বিপদেও কাকু তাকে পাশে ডাকেননি। ভাই বোন বিদেশে আছে,অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়তো তাকেই করতে হবে।সে দ্রুত পায়ে কাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ট্রেনে মাত্র তিনটি স্টেশন। ইচ্ছে থাকলেও বৌ বা মেয়েকে সে সঙ্গে নিল না,করোনার ভয়েই। তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল । চোখের জল মুছতে মুছতে সে ভাবতে লাগল--- এই দশ বছরে তাকে একবারও কেন মনে পড়ল না কাকুর ? মৃত্যুর আগেই কেন হল এই যোগাযোগ ? তবে কি সত্যি মানুষ নিজের মৃত্যু ঘনিয়ে আসাটা টের পায় ? ---


 


Thursday, December 1, 2022

প্রাইমারি টেট পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে বিরাট সিদ্ধান্ত পর্ষদের, সবাই জানতে চাইছে- কি করে সম্ভব? || || Primary Board's big decision on primary tet exam result 2022 || TET Result 2022


 


টেট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের মধ্যে ধুন্ধুমার কান্ড চলছে । সেই নিয়ে নিত্য নতুন খবর  উঠে আসছে। তাই  আমরা যে যে নতুন তথ্য পাচ্ছি ঠিক তেমনটাই আপনাদের সামনে নিয়ে আসছি। তবে টেট নিয়ে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর হল, পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মাথায় ফল প্রকাশ করবে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ!



 সবারির মুখে একটাই প্রশ্ন,সত্যিই কি এতো দ্রুত টেটের ফলপ্রকাশ করা সম্ভব?  ১১ ডিসেম্বর এবারের টেট পরীক্ষা হবে।  অতীতের দিকে একটু তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে,এর আগে যে কয়েকটি  টেট পরীক্ষা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই  সাল ও সাল লেগে গিয়েছে পরীক্ষার পর ফলপ্রকাশিত হতে । ২০১৪ সালে যে টেট পরীক্ষা হয়েছিল তার ফল কয়েকটা দিন মাত্র  আগে প্রকাশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। তাও সেটা আংশিক । তাই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এই ধীর গতিতে দীর্ঘ দিন ধরে চলা কাজকর্ম নিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে  প্রশ্নের পাহাড় তৈরি হয়ে আছে। তবে এইবার অতীতের সমস্ত  দুর্নাম ঘোচাতে  এবং চাকরি প্রার্থীদের একটু সস্তি দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন পর্ষদ সভাপতি গৌতম পাল (Goutam Pal)।


 মুখ্য সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির নেতৃত্বে  বৃহস্পতিবার নবান্নে টেট পরীক্ষা সংক্রান্ত এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে  গৌতম পালের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের কর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।   স্কুল শিক্ষা সচিব মনিশ জৈন ছাড়া বাকি সমস্ত উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা ছিলেন।



 পর্ষদ সভাপতি গৌতম পাল বলেন, টেট পরীক্ষার  ৭ থেকে ১০ দিনের মাথায় তাঁরা ফল প্রকাশ করে দেবেন।  পর্ষদ সভাপতির এই বক্তব্য নিয়ে সভায় বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হয়।ঠিক তারপরেই এই দ্রুত ফল প্রকাশের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেন রাজ্য প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তারা।



 ১১ ডিসেম্বর টেট পরীক্ষা হওয়ার মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মাথায় পর্ষদের ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ কেউ হতবাক। কিন্তু শিক্ষা মহল এতে অবাক হচ্ছে না। সর্বভারতীয় স্তরের বিভিন্ন  পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় অনেক সময়ই এইরকম দ্রুত ফল প্রকাশ হতে দেখা গিয়েছে। তবে ওএমআর শিটে পরীক্ষা হওয়ার জন্যে, কম্পিউটার চেকিং সিস্টেমের মাধ্যমে চাইলেই অতি  দ্রুত নির্ভুল ফল প্রকাশ করা সম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে।


 বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের টেটের ফল দ্রুত প্রকাশ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সাধুবাদ যোগ্য। তবে তাদের এই সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে দিল ২০১৪ ও ২০১৭ টেট-এর ফলাফলও ইচ্ছে করলেই নির্ভুলভাবে দ্রুত প্রকাশ করতে পারতেন তখনকার পর্ষদ কর্তারা।


 প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পাল জানিয়েছেন, এবার ৬ লক্ষ ৯০ হাজারের সামান্য বেশি পরীক্ষার্থী টেট পরীক্ষায় বসবেন। মোট ১৪৫৩ টি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হবে। নবান্নর বৈঠকে টেট পরীক্ষার দিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন।  বিশেষ করে সাঁতরাগাছিতে  ব্রিজ মেরামতের কাজ চালার বিষয়টি পরীক্ষার্থীদের যাতে সমস্যায় না ফেলে তা দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যসচিব।



বিঃদ্র: সমস্ত ধরনের চাকরির আপডেট  পেতে  আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান। নিচে যুক্ত (Join) হওয়ার লিংক দেওয়া রয়েছে ঐ লিংকে ক্লিক করলেই যুক্ত হয়ে যেতে পারবেন। ওখানেই সর্বপ্রথম আপডেট দেওয়া হয়। আর আপনি যদি অলরেডি যুক্ত হয়ে থাকেন এটি প্লিজ Ignore করুন।



আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জয়েন করতে পারেন --

Click here 🔴


আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে জয়েন করতে পারেন --

Click here 🔴

ছোট গল্প - শূন্যতা || লেখক - সুব্রত নন্দী মজুমদার || Written by Sunnyta || Short story - Subrata Nandi Majumdar


 


      শূন্যতা 

         সুব্রত নন্দী মজুমদার 


                              (এক) 

মেয়ের প্রথম জন্মদিনে দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়ি গিয়ে পূজো দেবে মেয়ের মঙ্গল কামনায়, এই কথাটা রুমেলা স্থির করে রেখেছিল অনেক দিন আগেই। আজ সেই দিন। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁতে না ছুঁতেই রুমেলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এলার্ম দেওয়ার দরকার পড়ে না, এটা তাঁর বহুকালের অভ্যাস। তবু সাবধানের মার নেই, তাই ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। আজ মেয়ে রুবেলার প্রথম জন্মদিন। রুমেলা স্বামী তমনীশকে তার মনের বাসনার কথাটা অনেকদিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল যে মেয়ের প্রথম জন্মদিনে সে দক্ষিনেশ্বর কালিবাড়ীতে গিয়ে পূজো দেবে। তমনীশের যদিও দেবদ্বিজে তেমন ভক্তি নেই, কিন্তু পূজো আচ্চার ব্যাপারে রুমেলার অতিভক্তিকে সে বরাবরই মান্যতা দিয়ে এসেছে। যখনই কালীঘাট, দক্ষিনেশ্বর বা বেলুড় মঠ যেতে চেয়েছে সে তাকে নিয়ে গেছে। তাই মাথা নেড়ে সে সম্মতি জানিয়েছিল। 

আগের দিন রাত্রে শুতে যাবার আগে রুমেলা তমনীশকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে সে শুধু বলেছিল, “একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে, কারণ অফিসে কাল বেলা এগারোটায় একটা জরুরী মিটিং আছে, তার আগে আমাকে পৌঁছতে হবে।“ রুমেলা বলেছিল, “ ঠিক আছে, আমরা সেভাবেই টাইম হিসাব করে বেরোব।“ 

কাজের মেয়ে অনীতাকেও রুমেলা বলেছিল সেদিন একটু আগে আগে আসতে। এলার্ম বাজার আগেই রুমেলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে মেয়ে রুবেলা গভীর ঘুমে অচেতন। রুমেলা উঠে দেরি না করে তোয়ালে নিয়ে সোজা চলে যায় বাথরুমে। চানটান সেড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সে শুনতে পায় অনীতা দরজায় কড়া নাড়ছে। যাক বাঁচা গেল। 

রুমেলা প্রথমে দেখে নেয়, পূজোর সব উপাচার ঠিকমত আনা হয়েছে কি না, না হলে এখনো সময় আছে, অনীতাকে দিয়ে আনিয়ে নিতে পারবে। রুমেলা অনীতাকে বলে, “তুই প্রথমে রুবির দুধটা ফুটিয়ে রেডি করে রাখ। আমি ওকে এক্ষুনি ডেকে তুলব। মেয়ে উঠেই দুধ খাবার জন্য কাঁদতে থাকবে।“ 

তারপর রান্নার ব্যাপারে কি কি করতে বলে আবার বলে, “আমরা বেরিয়ে গেলে তুই ভাল করে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রাখিস, আমরা সাড়ে দশটার মধ্যেই ফিরে আসব। রুমেলা তখন তমনীশকে ডাকে, “উঠে পড়, বলেছিলে না তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। অফিসে মিটিং আছে।“ তমনীশ উঠে বাথরুমে যেতে রুমেলা মেয়েকে তুলে ভাল করে মুখহাত ধুইয়ে দুধ বিস্কুট খাওয়ায়। নজর তার সবদিকেই আছে। সে অনীতাকে ডেকে বলে, “দাদাবাবুর চা দিয়ে যা।“ 

কদিন আগে একটা শপিং মল থেকে রুমেলা মেয়ের জন্মদিনের জন্য একটা খুব সুন্দর টুকটুকে লাল রঙের জামা কিনেছিল। ওয়ার্ড্রোব থেকে সে বিয়েতে মায়ের দেওয়া লালপেড়ে গরদের শাড়িটা আর রুবেলার নতুন ফ্রক বের করে মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে যায়। ততক্ষনে অনীতা তাকে দুধ বিস্কুট খাইয়ে দিয়েছে।  

রুবেলাকে চান করিয়ে, ড্রেস করিয়ে রুমেলা অনীতাকে বলে, “তুই একটু রুবিকে দেখ, আমি ততক্ষনে শাড়ি পরে নিচ্ছি।“ 

শাড়ি পরে রুমেলা ড্রইংরুমে এসে দেখে তমনীশ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়ছে। সে বলে, “সাতটা প্রায় বাজে, আমাদের হয়ে গেছে, তুমি তৈরি হয়ে নাও। পরে আমি দেরি করিয়ে দিয়েছি বলে দোষ দেবে না।“ তমনীশ আড়চোখে রুমেলার দিকে তাকিয়ে বলে, “ বাঃ! এই শাড়িটা পরে তোমাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।“ একটু হেসে রুমেলা বলে, “যাও, রেডি হয়ে নাও ।“ 

তখন ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ ,বসন্তের আগমনের বার্তা নিয়ে মন কেমন করা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সূর্যদেব পূব আকাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তমনীশ সম্রতি গাড়ি কিনেছে, সে নিজেই গাড়ি চালায়, তার পাশে রুমেলা মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে মনের আনন্দে গুন গুন করে গাইতে লাগল ‘ আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে….’। তমনীশ মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। 

আগের দিনের উদবেগপূর্ণ রাত্রির ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুম, রাত না ফুরোতেই জেগে ওঠা আর সেই সঙ্গে প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে রুমেলার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। মেয়ে ততক্ষনে তার কোলে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছে।          

                                                                 (দুই) 

“এই ছেলে, অনেক বেলা হয়ে গেছে, ওঠ,” রুমেলা তাগাদা দেয় ছেলে রুবেলকে, “ আজ তোর জন্মদিন, মনে নেই দক্ষিনেশ্বর যেতে হবে। এক্ষুনি তোর বাবা এসে তাগাদা দিতে থাকবে।“ জন্মের প্রথম বছর থেকে রুমেলা নিয়ম করে প্রতি বছর ছেলেকে নিয়ে দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়িতে যায় কালীপূজো দিতে। এবছর ছেলে পনেরো পেরিয়ে ষোলতে পড়বে। কিছুদিন বাদেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই এবছর পূজোর বিশেষ আয়োজন। রুমেলা চান করে এসে ছেলেকে ঠেলে তুলে বাথরুমে পাঠায়। এখনো ওইদিন সে বিয়েতে মায়ের দেওয়া সেই লালপাড় গরদের শাড়িটা পরে। 

রুমেলার ও বয়স বেড়েছে। মাথার দু’পাশের চুলে অল্প স্বল্প রূপোলী রেখা দেখা বা চোখের নিচে সামান্য কুঞ্চন দেখা গেলে ও তার যৌবন অটুট। তমনীশ বলে,” এই শাড়িটা পরলে তোমাকে এখনো মনে হয় বিয়ের কনে। “ কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে রুমেলা বলে, “হয়েছে, থাক। এখন যাও গাড়ি বের কর। দেরি হয়ে যাচ্ছে।“ 

ওঘর থেকে ছেলে চেঁচিয়ে ডাকে, “মাম, কোন শার্টটা পরব? আমি খুঁজে পাচ্ছি না। “ 

“জ্বালাতন করে মারল,” বলে রুমেলা ছুটে গিয়ে ছেলেকে জন্মদিনের জন্য নতুন কেনা শার্টটা বের করে দেয়। 


                                                                  (তিন) 

সামনের ট্রাফিক কন্ট্রোলে লাল আলো জ্বলে উঠতে তমনীশ তাড়াতাড়ি ব্রেক চাপে। গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতে রুমেলার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায় আর রুবেলা ও জেগে উঠে কাঁদতে থাকে। রুমেলা তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে মেয়েকে খাওয়ায় এবং নিজেও এক ঢোঁক খেয়ে তমনীশকে জিজ্ঞেস করে জল খাবে কি না। তমনীশের দিকে সে জলের বোতলটা এগিয়ে দেয়। 

রুবেলা আবার ঘুমিয়ে পড়তে রুমেলা ভাবতে থাকে এতক্ষন ধরে কি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন ও দেখছিল। পনেরো ষোল বছর পরের ঘটনা। এরকম হয় নাকি? আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই স্বপ্ন মেয়ে রুবেলাকে নিয়ে নয়, ছেলেকে নিয়ে। সে ভাবে, তবে কি সে তার অবচেতন মনে মেয়ের বদলে সে ছেলে চাইছিল? এ কিছুতেই হতে পারে না, অসম্ভব। রুমেলা দু’হাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করতে থাকে মেয়েই তাদের কাছে সোনার খনি, ছেলে চাই না। তমনীশ বলে, “কি বলছ?” 

“না, কিছু না”, বলে রুমেলা মেয়েকে আরো কাছে টেনে নেয়।           

“তুমি কি কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন?” তমনীশ জিজ্ঞেস করে, “নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছ।“ 

রুমেলা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলে, “ না, তন্দ্রার মধ্যে কি সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলাম।“ ততক্ষনে ওদের গাড়ি দক্ষিনেশ্বর মন্দির চত্বরে ঢুকে পড়েছে। তমনীশ পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে ওপাশের দরজা খুলে রুমেলাকে নামতে বলে। রুবেলা তখনও মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে। 

গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে খানিকটা এগিয়ে তমনীশ হঠাৎ দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে রুমেলাকে দেখায়, “ঐ দেখ কে যাচ্ছেন?” 

“কে যাচ্ছেন?” রুমেলা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে। 

“ তোমার মনে নেই,” তমনীশ বলে, “ যে নার্সিং হোমে রুবেলা জন্মেছিল তার মালিক পবন বাজোরিয়া। “ 

রুমেলা এবারে চিনতে পারে পবন বাজোরিয়াকে। খুব ভাল মানুষ, একেবারে নিটোল ভদ্রলোক। নিজে ডাক্তার নন, নার্সিং হোমটির মালিক। রোজ সকালে একবার এসে প্রত্যেকের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতেন, কে কেমন আছে। রুমেলা বলে, “ হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। সঙ্গের ভদ্রমহিলা নিশ্চয় তাঁর স্ত্রী। তাঁর কোলে কি সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা।“ 

“হ্যাঁ,” তমনীশ বলে, “তুমি তো জাননা, যেদিন রুবেলার জন্ম হয়, সেদিনই পবনবাবুর স্ত্রীর একটি ছেলে হয় ঐ নার্সিং হোমেই। “  

“তাই নাকি? আমিতো জানতাম না”, রুমেলা বলে। 

“ কি করে জানবে? তোমার অবস্থা তখন খুব খারাপ,” তমনীশ বলে, “যাই বল ভদ্রলোক কিন্তু খুব ভাল লোক। একটা ঘটনার কথা আমি তোমাকে বলিনি।“ 

“কি ঘটনা গো?” রুবেলা জিজ্ঞেস করে। 

“ যেদিন তোমাকে রিলিজ করে দেবে,” তমনীশ বলতে থাকে, “ তার আগের দিন রাতে তোমাদের দেখে ফিরে আসার সময় হেড নার্স সিস্টার নিবেদিতা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন যে ওটা বিল। পরদিন সকালে আমি যেন বিলে লেখা টাকাটা পেমেন্ট করে দিই তোমাকে নিয়ে যাবার আগে। বিল দেখে তো আমার চক্ষু চরকগাছ।“ 

“ কেন, কি ছিল সেই বিলে?” রুমেলা জিজ্ঞেস করে, “ অনেক টাকার বিল বুঝি।“ 

“ অনেক মানে, আশী হাজার টাকা। আমি ভাবতেও পারিনি এত টাকার বিল হবে, “ তমনীশ বলে, “অবশ্য তোমার সিজারিয়ান হয়েছিল আর কিছু জটিলতা ছিল, যার জন্য তোমাকে নার্সিং হোমে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল।“

রুমেলা হা করে তার স্বামীর কথা শুনতে থাকে। তমনীশ বলে, “তারপর কি হল জান? আমি বিল হাতে নিয়ে সাতপাঁচ ভাবছি। কি করে এত টাকা রাতারাতি জোগাড় করব। ব্যাঙ্কে সেই মুহূর্তে আমার বড়জোর পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। ঠিক সেই সময় পবনবাবু এসে ঢুকলেন নার্সিং হোমে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘সিস্টার আপনাকে বলেছেন আপনি আপনার স্ত্রীকে কাল সকালে নিয়ে যেতে পারেন। ‘ তারপর আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বলেন, ’এনি প্রব্লেম?’ আমি কি বলব।“ 

এমন সময় রুবেলা জেগে উঠে কাঁদতে থাকে। রুমেলা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে তাকে খেতে দিলে সে শান্ত হয়। তখন রুমেলা জিজ্ঞেস করে, “ তারপর কি হল?” 

তমনীশ বলে, “ আমি তখন নিরুপায়। শেষ পর্যন্ত লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম আমার সমস্যার কথা যে কিছু টাকা শর্টেজ আছে। মিস্টার পবন বাজোরিয়া তখন আমার হাত থেকে বিলটা নিয়ে বললেন,’আপনি কত দিতে পারবেন?’ আমি বললাম যে আপাততঃ হাজার পঞ্চাশের ব্যবস্থা করতে পারি। আমার কথা শুনে তিনি কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর পকেট থেকে কলম বের করে বিলের এমাউণ্ট আশী হাজার কেটে পঞ্চাশ হাজার লিখে সই করে আমার হাতে বিলটা দিয়ে বললেন,’এবার ঠিক আছে?’ আমি কি বলব, কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে এল। পবনবাবু একটু হেসে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন,’ উইশ ইউ বোথ বেস্ট অব লাক’। বলে তিনি চলে গেলেন। “ 

তমনীশের কথা শুনে রুমেলা বলে, “ উনি তো একজন মহান ব্যক্তি। চল ওকে একবার রুবেলাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। তিনি নিশ্চয় খুশি হবেন।“ 

তমনীশ উৎসাহিত হয়ে বলে,” ওরা চলে যাবেন, আগে চল ওদের সঙ্গে দেখা করে আসি, তারপর মন্দিরে যাব।“ বলে সে এদিক ওদিক তাকায় কিন্তু তাঁদের দেখতে পায় না। সে বলে, “ মনে হচ্ছে ওরা চলে গেছেন। আর দেরি করে লাভ নেই, ভিড় বাড়ছে, চল মন্দিরে যাই।“ 

রুমেলার মন আনন্দে ভরপুর। সুষ্ঠুভাবে আজ পূজো দিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু তার মনটা তখনো খচখচ করছে গাড়িতে বসে সেই স্বপ্নটার কথা ভেবে। সে ছেলের স্বপ্ন দেখল কেন? 

                                                                 (চার)  

যেদিন রাতে রুমেলা এবং পবন বাজোরিয়ার স্ত্রী সেই নার্সিং হোমে প্রায় একই সঙ্গে দু’টি সন্তানের জন্ম দেন, সেদিন নার্সিং হোমের ডাক্তার অপলক বসু পেয়েছিলেন তিন লাখ টাকা আর হেড নার্স সিস্টার নিবেদিতা পঞ্চাশ হাজার টাকা যার বিনিময়ে সন্তান দু’টো বদল হয়ে গেল। রুমেলার ছেলের স্থানে এল বাজোরিয়ার মেয়ে আর পবন বাজোরিয়ার স্ত্রী জানলেন তিনি জন্ম দিয়েছেন এক পুত্র সন্তানের। 

ছোট গল্প - ছায়াজীবনের বিন্দু || লেখক - ঋভু চট্টোপাধ্যায় || Written by Rivu Chattyapadhay || Short story - Chaya Jiboner Bondhu


 


ছায়াজীবনের বিন্দু                   

 ঋভু চট্টোপাধ্যায়


 বাইরে বেরিয়েই গায়ে তাপ লাগল মনসুর চাচার।একবার আশমানের দিকে তাকিয়েও নিল, ‘হায় আল্লা, এই সকালেই এত তাপ।’একটু আগে বিছানা ছেড়ে উঠেই চালের নিচে শুকনো ডাবাগুলো একবার সরিয়ে সরিয়ে রাখল, এটা অবশ্যি ঘুম থেকে উঠে রোজের কাজ, যেদিন পানি হবে যদি কয়েকটা ফোঁটাও ডাবাতে পড়ে এই আশাতেই রাখা।তারপর ডান হাতের লাঠিটা আর একটু শক্ত করে ধরে একপা একপা করে এগিয়ে সামনে হাসমতের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দেখল ও তখন উনুনে পাখা করছে।চাচা এক বার গলা হেঁকারি দিয়ে বলে, ‘কি রে এত দেরি করলি কেনে?’ 

–কি যে বল চাচা, রোজার মাসে চা আর বিক্রি হচে কই? কিন্তু তুমি আজ কি মনে করে ?

-আজ আর সাহরি খেতে উঠি নাই,কাল পা ট কেটি গেছে, গল গল রক্ত, আজ আর রাখব নাই,কাল শরীর ভালো লাগলে রাখব, নইলে সেই সাতাশে।

–পায়ে হল কি?

-হুতরোতে ঘা লেগিছে রে পোতা, পাটা বাঁধার সময়।

উনোনের ধোঁয়ার মাঝেই বেঞ্চে বসতে বসতে বলে,‘সিয়াম রোজা রাখার জন্য স্ময়ং আল্লা আমাদের ফরজ করেছেন, এতে তাকওয়া লাভ হয়, তবে আমার তো বয়স বাড়ছে, আর সবগুলো পেরে উঠিনা।’ তারপর আবার বিড় বিড় করে, ‘রোজা মানে শুধুই না খেয়ে থাকা নয়, সব সময় ভালো থাকতে হবেক, নিজেকে বাঁধতে হবেক, তবে যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে থাকা যাবে।’ কিছুক্ষনের মধ্যে আরো কয়েকজন হাসমতের দোকানে এসে বসে, মনসুর চাচা তাদেরকেও রোজা না করবার কারণ বলে।

 দোকানে সবাই বসলেও সবাই চা পান করে না।হিন্দু পাড়া থেকে যারা এই রাস্তা দিয়ে কাজে বেরায় তারা মাঝে মাঝে এই দোকানে বসে চা পান করে।তাও হাসমত প্রতিদিন সকাল সন্ধে দোকান খোলে, গল্প করে।সাহা পাড়ার বিনোদ এসে দোকানের কাছে দাঁড়াতে যায়।উনোনে তখনও ধোঁয়া উঠছে দেখে আর না দাঁড়িয়ে চলে যায়, যাবার আগে বলে যায়, ‘এত দেরি করে উনোন জ্বালালে হবে, আমরা কাজে যাবো না।’

-রোজার মাসে সকালে এ’পাড়াতে বিক্রি নাইরে।

মনসুর চাচা চুপ করে বসে থাকে,এখন আর ভালো করে দাঁড়াতে পারে না, হাঁটা চলা করলেও সেরকম জোর নাই।বসে বসে গুন গুন করে গান গায়, কয়েক জনকে আসতে দেখেই জিজ্ঞেস করে,‘বীজ কিনলি রে পটল? কত লিছে?’

 –লাল সন্ন, সত্তর,তাও চাচা ভকতের দোকানে খুব লাইন,আমি পাশেরট থেকে নিলম, মনে খুঁত রই গেল। ভকতের দাম বেশি, কিন্তু বীজট ভালো। 

মনসুর চাচা লম্বা শ্বাস ফেলে পটলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বীজ তো হবেক পানি কই? আশমানের কুনু ম্যাগ নাই, সরকার পানি দিবেক কুনু কথা জানিস?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,‘তুই কি আর বাজারের পানে যাবি? তইলে আমার কিলো বিশ আনতিস।’

–তুমি অত কিলো লিয়ে কি করবে চাচা, তুমার তো মোটে চার বিঘা জমি।

মনসুর হাসে, ‘জামাই ঘরে পাঠাতে হবেক রে, উখানে ভালো বীজ নাই।’

-ইবার জমি বিচি দাও চাচা, দেখবেক কে?

 মনসুর চাচা এর উত্তর না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘পানি দিবেক কিনা সেট বল? কি শুনলি তুরা, গত বছর তো দেয় নাই,  উপরের অবস্থা ভালো লয়, অম্বুবাচির আগে বীজ না ফেললে হবেক কেনে?’

-আজ গাঁয়ের সবাই বিডিও অপিসে যাবেক বলছিলেক, জলের কথা হবে, তুমি যাবে?

-আমি!গেলেই পানি দিবেক, গেল বছরের আগের বছর তো গেছলম, দিলেক কিছু?

-বীজ ফেললে পানি না হলেও তো সেই ফের।

চাচা একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে  আস্তে আস্তে উঠে দোকানের পিছনে যায়, ফিরে সামনে এসে বলে, ‘হাসমত, তু তো ডাবা গুলান রাখিস নাই, পানি জমলে তুরই ভালো।’

-আ চাচা, তুমার বেরাম এখনো গেলেক নাই, এই ডাবার পানিতে কি হবেক? একজন শুধায়।

আরেক জন জিজ্ঞেস করে,‘চাচা এখন ক’টা ডাবা রাখলে?’ চাচা উত্তর না দিলেও পাশের থেকে হাসমত বলে ওঠে,‘অনেক কটাই হল, আমার দুকানে, মসজিদে, চাচার ঘরে, মোহরদের ঘরে।ইদগারের পাশকে একটক গোঁরেও করিছে।’

দোকানে আরো কয়েকজন ছিল, তারাও হেসে উঠে বলে, তাদের একজন বলে,‘চাচাতো ইবার ভোদার পানিও জমাইবার লগে বলবেন, অত পানি পানি করে মরবেন, ঘরে তো কেউ নাই, পানি বাঁচাইবার কথা বলেন, ঘরের কাউরে তো বাঁচাইতে পারেন নাই।’

চাচা একপা এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কার ব্যাটা? হাকিমের ?’ 

–হঁ, চাচা। 

-শুনরে পোতা মরা মানে তো আবার আল্লার কাছেই ফিরে যাওয়া, মালাক উল মউত, আজরাইল যেদিন ডাকবে সেদিন তো যেতে হবেই, আমি পানি রাখতে পারব, কিন্তু আখিরাতের দরজাতো বাঁধতে পারব নাই।

–সিরাজুলের কত বয়স হত চাচা?

চাচা আরেকবার যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ‘হিসাব তো করতে পারব নাই, মুদুনির লিখাটও মুছি গেছে, তবে মোল্লা পাড়ার আসগর ও সিরাজুল দোস্ত ছিল।’ 

–আসগর মানে মনিরুলের আব্বা,তারমানে চল্লিশ পেরায় গেছে,তুমার নাতিনট কুথাকে থাকে?

-উয়ার নানির বাড়ি, আমার কাছকে থাকলেক নাই, না উ, না উয়ার আম্মি।

মনসুর চাচা আর কিছু না বলে এক পা এক পা করে এগিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর আগে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমার বীজটা এনে দেবার কি করবি?’ 

-জলিলের বাড়ি যাও, কালকে ভগতের দোকানে বীজ কিনতে পারে নাই, ভিড় ছিল, আমার সাথে দেখা হনছিল। মনসুর চাচা জলিলের বাড়ির দিকে পা বাড়াতে আরম্ভ করে।   

 পথে একবার মসজিদে যায়, ধূপ জ্বালায়, ইমামের সাথে কথা বলে, ডাবাগুলো দেখে।‌চোখ দুটো ভিজে যায়। বাড়িটা এক্কেবারে শেষ হয়ে গেল, একমাত্র ছেলেটা একদিন কেমন হট করে মরে গেল।পতাকা লাগাতে গিয়ে ঝামেলা, একই পার্টি, তাও মাথায় মারল, শেষ।মনসুর আবার সেদিন মেয়ের বাড়িতে ছিল, একটা লাতিনের নিকার কাচের কথা হচিল, এর মাঝেই খবর এল।সে কি ভয়ানক চেহেরা, হাসপাতাল থেকে লাশটা পেল দুদিন পর, গোটা মাথা ব্যান্ডেজ বাঁধা।বুকটা ধক করে উঠেছিল।সেই কয়েকবছর আগে বিবিটা একদিন হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মরল, ছেলের নিকা দিল, পোতা হল, বেশ সুখেই চলছিল।

‘হে আল্লা আমি তো কুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী নেক আমল করে নামাজ, রোজা, জাকাত পালন করিছি, শুধু হজ হয় নাই,হে আল্লা, আমার পোলাটাকে দুনিয়ার ফেতনা থেকে রক্ষা কর।’

মনসুরের চোখের পানিতে মনে হয় যেন আবার কাফন ভিজে যাবে।ভালোই হয়েছে এই সময় ওর আম্মিও নেই, এটা আম্মির নসিবে সইত না। 

মনসুর চাচা এই সব ভাবতে ভাবতেই একপা একপা করে এগিয়ে জলিলের বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দেয়, বীজ কেনার কথা বলে।জলিল বলে, ‘চাচা, বীজ কাল রেতে নিয়ে নিনছি, আশমানে পানির অবস্থা ভালো লয়, ধুলোর বীজ করব, নিয়াজে লাভ হবেক নাই, গত বছর নিয়াজ করে পাঁচ’ছ কিলো বীজ পচে গেল, এবার আর বীজ কেনার টাকা নাই, এখনো তো ধান বিক্রির টাকা ঢুকে নাই, কুথাকে পাবো বল?’ 

–তইলে আমি বীজট আনবো কুথাকে?

-আরে চাচা বীজের ব্যবস্থা হবেক, কিন্তু পানি, উটোতো কিনতে লাড়বে।

–সরকার দিবে নাই?

-আগের বছর থেকেই তো দিছে নাই।

–জল কিনতে হবেক, দেখি কার পাম্প লাগাবেক?

–কুথা থেকে কিনবে চাচা, মাটির জল লিতে দিছে নাই, অবস্থা ভালো লয়, কয়েক দিন দেখ পানির ব্যবস্থা হোক, বীজের ব্যবস্থাও হয়ি যাবেক। 

মনসুর চাচা আর কিছু বলে না।কথাগুলো তো সত্যি, চোখ বন্ধ করতেই মাঠের মাঝে তার আব্বা আসে, পাশে ছোট্ট মনসুর,আব্বার এক জোড়া বলদের মাঝে পাচন।পাচনে, বলদের পায়ে কাদা লাগে। মনসুরের গায়ে কাদা লাগে, মাথায় পানি পড়ে।আব্বা পানিতে ভিজে হাল চালায়, মা ধান ঝাড়ে।কুটো কুড়ায়, মায়ের পেট হয়, নতুন ভাই আসে, বোন আসে, তারা বড় হয়, আব্বার সাথে সবাই মাঠে নামে।মনসুরের দুচোখে পানি নামে।আশমানে শুখা ভাব, এই সকালেই গায়ে জ্বালা ধরে।গ্রামের অনেকেই হাসপাতালে ভরতি।হিন্দু পাড়ায় চব্বিশ পহর হল, ছোট বেলা আব্বা বলত, ‘ঐ শুন, হরিনাম হচে, ইবার পানি নামবেক।’ মনসুর আশমানের পানে তাকিয়ে পানি খুঁজত, পানি পড়ত, মাঠ জল থৈ থৈ করত, কত দিন পাড়ার রহমত, বিলাল, সাবিরদের সাথে চাষের মাঠেই সাঁতার দিত। সাবিরট আলকেউটের কামড়ে মরে গেল, ওর আম্মির সে কি কান্না, মনসুরের চোখের পানির সাথে সাবিরের আম্মির চোখের পানি এক হয়।মনসুর চাচার বুক কাঁপে, শরীরে গরম লাগে, ঘামে ভাসে খালি গা, গলায় গামছা, ঘাম মোছে। 

 চাচা জলিলের ঘর থেকে বেরোনোর পর একটা গাছের নিচে বসে।জলিল বেশি কথা বলতে পারে না, হাটে যাবার তাড়া দেখায়। মুখে বলে,‘চাচা, আজ ইমাম সাহেবের খাবার পালি ছিল, রোজা চলছে, উনি বললেন ইফতার দিয়ে দিতে।’ জলিল হাটে যায়, কিন্তু চাচা যাবে কই?একা একা হাটে যেতে সাহসে কুলায় না,ঘরের ভিতর গরম, পাখা নাই, কারেন্ট নাই, রেতে বাইরের বারান্দাতে শুতে হয়।এক ভাইয়ের পোলা জামিল, দুবেলা ভাত দেয়, চাল নেয়, চাষের ভাগ নেয়, ব্যাটার নিজের জমি নাই, বাপে দেয় নাই, গাঁয়ে গাঁয়ে ফেরি করে।জামিলের বিবি হাসিনা।আর কিছু দেয় না, সকালে এমনি মাসে ভুক লাগে তবে জানে জোর নাই,একবার ডাক্তার ঘর যেতে পারলে হত, কে নিয়ে যাবে? মনসুর চাচা একপা একপা করে এগোয়। 

–চাচা ধানের টাকা ঢুকল ? 

কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ায় মনসুর, ‘ও, হিরু! আমি তো সরকারের কাছে ধান বিচি নাই, মিলে দিনছি, তাও ইবার পুরো টাকা দেয় নাই,ইয়ার থেকে মোহনকে দিলেই ভালো হত হাতে হাতে টাকা তো দিত।’

–আমিও তাই ভাবছি, কিন্তু উটো মহা ফোড়ে।গেল বছরের চাপানের টাকা দিতে পারি নাই, এবছর পুরো টাকা না মেটালে চাপান তুলতেই দিবে নাই।

–হিরু, আমার জন্য দু’বস্তা রেখে দিবি বাবা, আমার তো আর বাইরে থেকে আনার খেমতা নাই।

-সে হবে ক্ষণ, আমি পেলে তুমিও পাবে, তবে এখন ঘরে চলি যাও, গরমে বেশি ক্ষণ বাইরে থেকো না, এই দুদিন আগে এক জন গরমে মরি গেল, হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া গেল না।

–আর বাবা আমার কি আর নসিবে এত সুখ আছে ?

-এরকম কেন বলছ চাচা? জন্ম মৃত্যু সব তো ভগবানের দয়া, দান, তুমি আমি কেউইতো নিয়মের বাইরে নয়। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে হিরু সামনের দিকে এগোতে আরম্ভ করতেই চাচা পিছন ডাকে,‘তুই বীজ কিনতে গেলে আমার লগে আনিস, কিলো বিশ আনতে হবে, আমি আনবার খরচ দিব।’ 

-আমি একটু বেলার দিকে যেছি, তুমাকে বলে যাবো। 

মনসুরের প্রাণ জুড়োয়।বাইরেটা দোজখের আগুনের মত, গায়ে ফোস্কা পড়ে।ছোট বেলাতে তো অতটা তাপ দেখে নাই, গরম কালে দিব্যি সব কাজ করা যেত, চাষ হত, পানি নামত।এবছর বোরোর চাষ নাই, ধানের টাকা নাই। গ্রামের কুয়োতে পানি কমছে, গেরামের পি.এইচ, এক বার জল দিছে।

হিরু  কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসে, ‘চাচা একট কথা বলব? এবছর জমির চাষ আমি করি, অধের্ক হিসাব, কেউ কিছু বলবেক নাই।’

 চাচা শ্বাস ফেলে, ‘ভেবে দেখব, তবে জানিস তো অর্ধেকে আমার হবেক নাই, মেয়েকে প্রতি বছর টাকা দিতে হয়, জামাই যে খুব পাজি, এক্কেবারে ইবলিশ, হাসমতকে দিতে হয়, উয়ার তো জমিন নাই।’ কিছু সময় থেকে বলে, ‘তুদের পাড়ার কালি পুজো কবে?’

-দাঁড়াও ছুটু লোকদের মনসার পুজোট হোক, গেল বছর শুনলে নাই কেমন ঝামেলা হল, ই’বছর বলি দিছি, শালাদের মনসা আগে হোক, তারপর আমাদের কালি হবে।এবছর আমরা মনসার কুনু চাঁদা দিছি নাই চাচা।

মনসুর চাচা আবার শ্বাস ছাড়ে।হিন্দু পাড়ার মনসাটা খুব পুরানো, মনসুর চাচাও ছোট বেলাতে পুজো দেখতে যেত, কতবার ওষুধ এনেছে, এই মুসলিম পাড়ার অনেকের মনসার ওষুধে পেট হইছে, শুনেছে মনসার থানট নাকি সারায়ছে।একবার গিয়ে দেখে আসবার স্বাদ হয়, ভয়ও হয়, পায়ের জোর নাই।গেল বছর মনসার পুজোর সময় ফের ছিল, থানা পুলিশ, কত জনকে পুলিশে ধরে লিয়ে গেছিল, ই’পাড়াতে বসে বসে সব শুনিছে মনসুর।মনসার পুজোতে পার্টিও জড়ায় গেছিল।ই’পাড়াতেও জড়ায় ছে।কয়েকমাস আগে ইসমাইলের ব্যাটটকে মসজিদের থামে  সারারাত বেঁধে বিচার করলেক, ব্যাটাট অন্য পার্টির পতাকা লাগায়ছিল, কি মার মার।ইসমাইল  হাতে পায়ে ধরে,  উয়ার বিবিও পা ধরে।গ্রাম থেকে তার কাছে জরিমানা চায়, কত টাকা মনসুর চাচা জানে না, তবে অনেক টাকা, অত টাকা চোখে দেখে নাই।ইসমাইল জমি বিক্রি করে। সাইকেল, থালা বাটিও বেচে, তাও টাকা ওঠে নাই, গাঁ ছাড়া হয়। 

মনসুর আবার হাঁটতে আরম্ভ করে।একটু ফেরিঘাটের পানে যেতে হবে। পানি থাকলে কারোর কাছে পাম্পটা নিয়ে   ছড়ানো যাবে।একটু আগে করলে লেবার পাওয়া যাবে, এখন আর সাঁওতালগুলো আসতে খুঁজে না, ফিকির বানায়।আগে দল বেঁধে গাঁয়ে আসত, থাকত। একবার রোয়ার সময়, একবার কাটার সময়। চাপানটা গাঁয়ের লেবার দিয়ে হত। হিন্দু পাড়ার ঘোষেদের সাধন ঘোষ প্রতিবছর পাঁকুড় যেত, তখন ফোন ছিল না, সাঁওতাল লেবারদের গ্রামে আনবার জন্য আগে থেকে আসার ভাড়া দিয়ে আসতে হত।একবছর  ফিরে এসে কয়েকদিনের জ্বরে মারা গেল।সবাই একটু অবাক হয়ে গেছিল, কেউ বলল মশা কামড়ে দিয়েছে, কেউ বা, ‘কিছু খাইয়ে দিয়েছিল।’ চাচা শুনল ঘোষের নাকি চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না, ওখানেও কিসব বদমাইশি করেছিল, ওরাই কিছু খাইয়ে দিয়েছিল, ঘরে ফিরে মারা গেল।তারপর থেকে কেউ আর পাঁকুড় যায় না, দু’বছর ওদের ওখান থেকে কেউ আসে নাই, আবার আসছে, তবে এখন  ফোনে বললেই হয়, যারা পারে আসে, সব কাজ করে তারপর টাকা নেয়।  এখন লেবারও কম লাগে, সব মেসিনে হয়, ঘন্টায় আড়াই হাজার দাও ধান কাটো, মিনিটে পঞ্চাশ থেকে একশ টাকা দাও  ট্রাকটর চালাও।মনসুর চাচা জমির দিকে তাকায়, ফাটা জমি, মায়ের পায়ের মত, শুধু জমির বুক খুঁজে পায় না,তাও এক পা একপা করে লাঠি ধরে ধরে যায়, জমির আল ধরে বড় রাস্তা ধরে।ক্যানেলের কাছে গিয়ে অবাক হয়ে যায়, পানি কই, এ’তো ভিতরের পাথরগুলো সব গোনা যেছে, হাঁটুও ডুববে না,‘হায় আল্লা! এই সময় পয়ার উবছে পানি আসে, এখন রুখা শুখা, ভালো লাগে না।’

 এত দূর চলে আসার পর মনসুর চাচার ভয় লাগে, হেবি ভয়।চাচা, ক্যানেলের মুখে দাঁড়ায়।কেউরে নিশ্চয় পাওয়া যাবে, গাঁয়ে ছেড়ে দিতে বলবে,এই রোদে লুক কই? চাচা হাঁটার কথা ভাবে, পারে না, ক্যানেলের পারে বাঁজা আম গাছের নিচে বসে।খোলা আশমানের নিচে দাঁড়ালে গায়ে ফোস্কা পড়ে, এটাই কি দোজখ? রাসুলুল্লাহ আরাইহি ওয়া সাল্লাম।জানে হাল্কা বাতাস লাগে।চাচা গাছের গায়ে হেলান দেয়, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে।একটু পরেই চমকে ওঠে।হা,আল্লা চোখ লেগে গেছিল নাকি? চাচা উঠে ক্যানেলের জল চোখ মুখে ছেটায়, তারপর আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে যেতে যাবে এমন সময় একটা ভিড় তার দিকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ায়।গাঁ থেকেই আসছে তো, এত লোক কুথাকে যাবেক।ভিড়টা চাচা চিনতে পারে, সবাই তার নিজের পাড়ার লোক।আরো সামনে আসতেই চাচা হাঁক দেয়, ‘আরে লিয়াকত, এই গরমে যাস কুথা?’

-চাচা তুমার সাথে এসে কথা বলব, এখন তাড়া আছে।কোমলপুরে হিন্দুরা আমাদের আল কেটে দিনছে, পানি দিলে উদের গাঁকে ঢুকি যাবেক।

–পানি কই, হুই দ্যাখ, পাথর দেখাচ্ছে।

-তুমি বীজতলা করগে যাও পানি দিবেকই, বিডিও অপিসে কথা বলিছি, না দিলে ভেঙি দিব অপিস। 

চাচা আর উত্তর দিতে পারে না।জানটা একটু জুড়াল,বাড়ির রাস্তা ধরে।

একটু বেলা হতেই গ্রামে হল্লা পড়ে।কোমলপুরের সাথে মোহনপুর গ্রামেও হিন্দুরা ক্যানেলের পানি নেবার লগে আল কাটে, তার একটু আগে ভবদিয়ার মুসলিমরা আল কাটে।বিডিও অফিস থেকে সামসের এসে খবর দেয়, খুব ঝামেলা হচে, পুলিশ এয়েছে।জল সবাই নিবেক, চাষ হবেক। চাচার কানে সব কথা আসে, চাচা তাও বসে থাকে, ট্যাঁকে টাকা গোঁজা, হাতে থলি, বীজ কিনতে হবেক।ভয় লাগে, জলের জন্য যদি গ্রাম জ্বলে, কে নেভাবে, কে জমিতে নামবে, কে বীজ ছড়াবে? গেরামের জুয়ান সব যদি গেরাম ছাড়া হয়?সেই যে বছর সিরাজুল মরল, সে বছর গাঁয়ের জোয়ানরা সব গাঁ ছাড়া ছিল, এক মাসের বেশি।চাচা আশমানের  দিকে তাকায় রুখা আশমান, ভয়ে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, দুপুরের রোদ আরো বাড়ে, চারদিক শুখা।মনসুর চাচা বাড়ি ফিরে ভাত দিতে বলে,কেউ শোনে না, লোক নাই।একটা নাতিনকে ডাকে, ভাত দিতে বলে।লাতিন বলে, ‘কে দেবে, আম্মি নাই, আব্বাও জলের অপিস গেছে।’

-তুরা খাস নাই?

-আমাদের আম্মি ভাত রেখে ছিল, তুমি ছিলে নাই।

মনসুর চাচা লাঠি ধরে ধরেই আবার নিজের ঘরের ভিতরে যায়, তাক থেকে মুড়ি বের করে, জল ভিজেয়ে মুড়ি খায়।সারাদিন খুব ঘোরাঘুরি হয়েছে, শরীরে আর যুত নাই।ঘরের ভিতরে খুব গরম, দাওয়াতেই একটা শীতলপাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।চোখও লেগে যায়, কতক্ষণ লেগে ছিল, জানে শান নাই, চোখ দুটো খুলতেই দেখে  চারদিকটা কেমন যেন আঁধার পারা হয়ে গেছে।মাথার কাছকে ভাতের থালা নাই, সাঁজে ভাত খেতেও ইচ্ছে করে না।একপা একপা করে মসজিদের দিকে যায়, ইফতার কি হয়ে গেছে, হলেও বা কিছু না কিছু ঠিক খাওয়া যাবে, না হলে ইমামের ঘরেও কিছু পাওয়া যাবে।চলার পথে বিড় বিড় করে ‘জাহাবাজ জামাউ;ওয়াবতালতিল উ’রুকু; ওয়া ছাবাতাল আঝরু ইনশাআল্লাহ।’( ইফতারের মাধ্যমে পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।’)।মসজিদের কাছে আসতেই থমকে ওঠে, কে রে বাবা, এত লোক! মনসুর গিয়ে ইমামের কাছে বসে।শুধায়, ‘কি হল জি?’

-চাচা কি কবর থেকে উঠে এলে, গাঁয়ের খবর কিছুই জানো না নাকি?

মনসুর ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘না গো বাবা, কিছুর খবর নাই, বয়স হয়ছে তো, জান খারাপ।’

-গাঁয়ের অনেককে পুলিশে বিডিও অফিস থেকেই তুলে লি গেছে, তুমি কিছুই জানো না?

–না গো বাবা, কত জনকে? 

-অনেক পুরুষকে, এই যারা অফিসে যায় নাই তারাই আছে।

মনসুরের আস্তে আস্তে অনেক কিছু মনে আসে।লিয়াকতরা সকালে অফিসে যাচ্ছিল। চাচা বলে, ‘ কোমলপুর আর মোহনপুরের হিন্দুরা ক্যানেলের ড্রেন কেটে নিজেদের গ্রামে পানি ঢোকাচ্ছে।তার মানে ওরাই ঝগড়া করছে?’ 

–ঐ মোহনপুর আর কোমলপুর গ্রামের সাথে কি মারামারি হইছে?

-শুধু হিন্দু গ্রামের দোষ দিয়ে কি লাভ চাচা, আমাদের গ্রামে পানি এলে সবাই পাবে, মোহনপুর কোমলপুরেও মুসলিম আছে।

–ওদের গাঁয়ে পুলিশ এয়েছিল, কয়েকজনকে খুঁজছিল, আমাদের গাঁয়েও আসতে পারেক, বাবুল, জুসিম পালাইছে। 

চাচা কথা বলে না, তবুও জোরে শ্বাস পড়ে।আজ ইফতার হয় নাই, সবাই পানি দিয়ে কোন রকমে রোজা খুলেছে। কাউরির খাবার মন নাই।

–তুমার জামিলও হাসপাতালে ভর্তি সেটো জানো ? 

চমকে ওঠে চাচা,‘কই, বৌ তো কিছু বললে নাকো?’

জামিলের তো জমি নাই, উয়ার বাপ এক ছটাক জমিও দেয় নাই, বেচারা গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরি করে বেড়ায়।

–উয়াকে মারলেক কেনে ?

-তা তো জানি না, বিডিও অপিসে গাঁয়ের কয়েকজন ছিল তারাই হাসপাতালে নিয়ে গেছে, হাসিনা তো থাকছে গা। মনসুর চাচার সব মনে পড়ে, এই জন্য দুপুরে ভাত পায় নাই।কিন্তু একবার বলে যেতে পারত। চাচার চোখের সামনে সিরাজুলেও মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছবিটা চলে ভেসে আসে। কি ভয়ানক, এখনো তো উয়ার খিলালের ত্যানাগুলান মাটিতে মেশে নাই।

 চাচার হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করে।একপা এগিয়েও মসজিদের চাতালে বসে পড়ে।কয়েকজন তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে,‘চাচা, জান খারাপ লাগছে নাকি, ঘরকে যাবে?’ 

চাচা রা কাড়ে না।হাতে লাঠিটা ধরেই বসে থাকে।জামিলটা  সিরাজুল হয়ে যাবে না তো? মনসুর আল্লাহ তায়ালার কাছে দয়া রহমত চায়, দোয়া মোমিনের অস্ত্র,দীনের স্তম্ভ, আসমান ও জমিনের নুর, তার কাছে আর কোন জিনিস এর বেশি ফজিলত ও সম্মানের নেই।জামিলের বড় ব্যাটাটাও তো ছুটু, ঘরে একাই আছে, হাসপাতালেও তো হাসিনা একা, তাহলে?

চাচা কিছু সময় চুপ করে বসে থেকে লাঠি ধরেই ইমামের কাছে গিয়ে বলে,‘হুজুর গাঁ থেকে কেউকে আজকের রাতে জামিলের কাছকে যাবেক নাই?’ 

হুজুর কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দেয়, ‘এমন কথা কেন বলছেন চাচা? বুঝেন তো অনেক জনকে পুলিশ ধরিছে, উখানেও যেতি হবেক।’

-কিন্তু হুজুর আমার জামিলটাও যে খুব একা।

শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই চাচা ডুকরে কেঁদে ওঠে।সবাই অবাক হয়,আশমানের পানে তাকায়, কে’জানে কতজন দোয়া করে আর কতজন আশমানের ঘরে এক টুকরো মেঘ খোঁজে।