Tuesday, October 31, 2023

পরিবর্তনের দুর্গা পুজো - তন্ময় কবিরাজ || Poribortoner Durga Puja - Tanmoy Kobiraj || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article

পরিবর্তনের দুর্গা পুজো

     তন্ময় কবিরাজ



দুর্গা পুজো নিয়ে যখন লিখবো ভাবছি তখন ভয় হচ্ছে। আবার কাকে হারাতে হবে? গত কয়েক বছর করোনা ভাইরাসে সেভাবে পুজো হয়নি। অন্যদিকে, পুজোর সময় চলে খামখেয়ালি বৃষ্টি। আর তাতেই বিপত্তি। মালদা, মুর্শিদাবাদে বন্যা, উত্তরবঙ্গে ধস। রেললাইন বসে যাচ্ছে। বুকিং ক্যান্সেল করে হা _হুতাশ চারদিকে। সরকার পুজোতে ছুটি বাড়িয়েছে তাই বাড়িতে থাকতে চায় না কেউ। বাঙালি এখন আর দিপুদা অর্থাৎ দীঘা পুরী দার্জিলিং এ সীমাবদ্ধ নেই। আবার কোভিদের আগে শারদীয়া মানেই মৃত্যুর প্রহর গোনা। পুজোতে হারিয়েছি দুই গাঙ্গুলিকে _সুনীল আর পীযুষ। তাতে বাঙালির সেন্টিমেন্টে ভাটা পড়েনি। বাঙালি জাতির হয়তো আলজাইমাস আছে নাহলে সারা বছরের সব কষ্ট ভুলে কি করে এত আনন্দ করে?যতই কষ্ট হোক জীবনের ইস্তেহার সব ভুলে আনন্দ উপভোগ করা। হ্যালো ব্রো বলে রাস্তায় নামবে মাইক্রো মিনি সিলিভলেস থেকে জিন্স টপ, ধুতি পাঞ্জাবি। তবে সময়ের স্রোতে পুজোর ধরন পাল্টে গেছে। লেগেছে কর্পোরেটের ফাগুন। তবে তার ঐতিহ্য আজও অমলিন। তাই সে ইউনিস্কো সম্মান অর্জন করেছে।


রসগোল্লার মত দুর্গা পুজো তুমি কার?_এটাও বিতর্কের। বাঙালি দুর্গা পুজোর গর্ব করলেও ওড়িশায় দুর্গা পুজো শুরু হয়েছিল অনেক আগেই খ্রি: পূ ৩০০ শতকে। প্রচলন করেছিলেন রাজা সুরাতা। বাংলাতে শুরু হয় মুঘল যুগে। আকবরের আমলেও দুর্গা পুজো হতো।১৫০০শতকে শুরু হলেও তার স্থান কাল নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেউ বলেন, দিনাজপুর মালদা জেলায় প্রথম পুজো হয়। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর প্রচলন হয়। যদিও দেবীর মূর্তি ছিল একটু আলাদা। গোল চোখ, বাহন ছিল সাদা বাঘ আর সবুজ সিংহ। অন্য একটি মতে, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ান বা নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার এই পুজোর প্রচলন করেন। তবে তখন পুজো হত নিজের বাড়িতেই। বারোয়ারী পুজোর ধারণা আসে অনেক পরে। ১৭৯০সালে গুপ্তি পাড়ায়। যার নাম ছিল বারোপল পুজো।


কলকাতায় প্রথম দুর্গা পুজো করে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০সালে। তখন সনাতন প্রথা মেনেই পুজো হতো। দুর্গা পুজোর মাধ্যমে স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের কাছে বার্তা দিয়েছিলেন। পুনঃ প্রচলন করেন কুমারী পুজো ১৯০১সালে বেলুড়। সিন্ধু তথা দ্রাবিড় সভ্যতা মাতৃ তান্ত্রিক। দেবী বন্দনার কথা শোনা যায়। মানুষ ভক্তি নিষ্টা ভরে দেবীর আরাধনা করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, মা সবার। সবাই কে নিয়ে পুজো করতে হবে। বিবর্তন ঘটলো। পুজো হলো সর্বজনীন। জমিদার থেকে আমজনতার। ভাবের আদান প্রদানে তৈরি হলো মিলন ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধু নরোত্তম কে হয়তো সবার মনে আছে ।

দেবী মহামায়া। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, এ মায়া আমারই। দেবী দুর্গাকে বলা হয় ভগবতী অর্থাৎ অর্থ, বীর্য্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগীর সমাহার।খুব যত্ন করে আরাধনা করতে হয়। যার সুন্দর বর্ণনা আছে মারকেন্দিও পুরাণে। ব্রহ্মবৈবত পুরান বলে, দুর্গা পুজো প্রথম করে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, পরে ব্রহ্মা, শেষে, মহাদেব।


দুর্গা পুজোতে যেমন ধর্ম কৃষ্টি আছে, বর্তমানে তেমনই পুজোতে মিশে আছে রাজনীতির মাইলেজ, তোষামোদের ইকুয়েশন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর পরে রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর করেন। নাম দেন বিজয় উৎসব। মনোরঞ্জনের জন্য আনা হয় বিদেশ থেকে নর্তকী নিকি বাইকে। শুরু হয় সবেকের সঙ্গে আধুনিকতার পথে চলা। রাজনীতি।কে অনুদান পাবে আর কে পাবে না। ভক্তি উড়ে গেলো। বহরটা বড়ো হলো। ক্যাপশন তৈরি হলো, সবচেয়ে বড়ো দূর্গা। পুজোতে এখন কার্নিভাল।বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তি তরঙ্গিনি তে যে ভাব ছিল তা থাকলো না। অথছ এ পুজোর কথা হুয়েন সং এর লেখাতেও আছে। কালিকা পুরাণে দুর্গা পুজোর সময় বসন্ত কাল। যদিও একথা কৃত্তিবাস স্বীকার করলেও বাল্মীকি স্বীকার করেননি। বঙ্গ জীবনে দুর্গা পুজো ঐক্যের প্রতীক। মানুষ আশীর্বাদ চায়,"মা বুদ্ধি দে।"ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, বোধন তো বোধ সূত্র।


সাবেক দুর্গা প্রতিমা থাকতো একচালাতে। পরিবার সম্বলিত। যা গ্রাম্য জীবনে একান্নবর্তি পরিবারের প্রতিফলন। বাবা মা ছেলে মেয়ে। পশু বাহন আর কলা গাছের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সহবস্থান। প্রকৃতির ভিতরে শক্তির বীজ লুকিয়ে। সবেক পূজো নস্টালজিয়া। বাড়ি ফেরার পালা।নতুন জামা। বালিশে নীচে জামা রেখে ঘুম। পুজোতে কবে কোনটা পরব তার প্ল্যান।ঘুগনি খাওয়া। শিউলি আর কাশে অপু দুর্গার ফ্যান্টাসি, দূরে ধোঁয়া উড়া রেল গাড়ী_এ যেনো চিরকালীন রোমান্স। পুজো প্রেম চিরকুটে।শালুকের বনে কৈশোর, রাত জেগে অপেক্ষা,কখন রঙ হবে , চোখ বসবে ঠাকুরের। মহালয়ার পর অস্থিরতা পারদ মন মানে না আর,আর কটা দিন মাত্র। মুড়ি, নাড়ু। তারাশঙ্করের লেখায় এ বঙ্গের শারদ রঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়।


২০০০ সালের পর থেকে অনেকটা বদলে গেছে ছবিটা। পুজোতে লগ্নি এলো, বাড়লো বিজ্ঞাপনের চমক। বিপনন সংস্থার চাহিদা মত বিগ্রহ পাল্টে গেল। দুর্গা পড়লো ভারী গহনা। বাজার অর্থনীতি বাঙালি মেনেও নিল। ধর্মকে ব্যবহার করে উস্কে দিল পণ্যের জাদু। পুজোর মাধ্যমে ক্লাবগুলো বার্তা দেয়। বাড়ছে থিম, প্রতিযোগিতা।ভালো হলে স্পনসর আসবে। তাই শুরুর আগেই কাউন্ট ডাউন। কখনও ফেসবুক, কখনও হোয়াটস অ্যাপে আপডেট।শিল্প না এলেও দুর্গা পুজোর শিল্পতে বাঙালি অনেক এগিয়ে। এগ রোলে কামড় বসাতে বসাতে রাত কখন যেন ভোর হয়ে যায়।লম্বা লাইনে তখনও। এখন গল্প নয়। বরং সেলফি বা রিল। ভিউস বাড়বে। হয়তো হোয়াটস অ্যাপেই কেউ টেক্সট করবে,"আই লাভ ইউ"।


পাল্টে গেছে অনেকে কিছুই। পরিবর্তন ভালো না খারাপ সে তো বলবে সময়। চোখে যা ধরা পড়ে তাই লিখলাম। শুধু ঠাকুর রামকৃষ্ণ কথাটা খুব মনে পড়ছে,"তোমাদের চৈতন্য হোক।"


২,


প্রবন্ধের নাম _মুছে যাওয়া দিন; হ্যারিকেন



কবি বলেছিলেন,"কেবল আরেকপথ খোঁজ তুমি;আমি আজ খুঁজি নাকো আর/পেয়েছি অপার শূন্যে ধরবার মতো কিছু শেষে আমারি হৃদয় মনে..."। বিবর্তন হয়েছে। উন্নত হয়েছে জীবন। চলার পথে গতি বাড়াতে এসেছে বন্দে ভারত। রাতের শহরে নিয়ন আলোয় যানের মিছিল। ভোটের প্রচারে ঘর ঘর বিজলি।সব আছে। তবু যারা তাদের শৈশব বা কৈশোর কাটিয়েছে নব্বইয়ে দশকে তাদের কাছে হ্যারিকেন সু পরিচিত। বিদ্যুতের একমাত্র বিকল্প। গ্রামের সন্ধ্যা প্রদীপের সঙ্গে পাল্লা দিত। বারিফেরত বড়বাবু যাতে সাবধানে বাড়ি আসতে পারে তার জন্য চৌকাঠ থাকতো হ্যারিকেন। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজে হ্যারিকেন। নতুন বউয়ের মুখ দেখতো হারিকেনের আলোতে। দিদিমা আক্ষেপ করতো,"আলোটা বাড়া। চাঁদ পানা মুখ যে দেখা যাচ্ছে না।"নাতি নাতনী তখন সলতে বাড়াতে ব্যস্ত। ভাড়ার ঘরে তেল দেওয়া হতো। কথা গল্প আড্ডা মজার ভেতর রাত যখন ভোর হয়ে যেত তখন আলোর অভাবে হারিকেনের আলো দপদপ করতে করতে নিভে গেল। কাঁচের গায়ে কালো কার্বন।সেদিন এখন অতীত। পৃথিবীর গভীর যে অসুখ সে তো এই দূষণ। হ্যারিকেন তার প্রভাব ছিল কম।তবু সে হারিয়ে গেলো।


শোনা যায়, ১৫০০শতাব্দীর পারস্যে নাকি ব্যাপক হারে হারিকেনের ব্যবহার বাড়ে। তারও আগে নবম শতকে পার্সিয়ান অ্যালকেমিস্ট আলরাজি তার আল_আসরার বইতে হারিকেনের বিবরণ দেন। যার নাম নাফাতাহা।তবে বঙ্গে হারিকেনের প্রচলন কিন্তু শুরু হয় মুঘল রাজাদের হাত ধরে।যার চরম ও শেষ সীমা হলো নব্বই দশক। হারিকেনের যুগে গ্রামীণ জীবন দুই ভাগে বিভক্ত _হ্যারিকেন আর চিমনি। হ্যারিকেন বড়োলোকের প্রতীক। তখন বিদ্যুৎ গেলে আসার বালাই ছিলো না।তাই কেরোসিন সংগ্রহতে চলতো গ্রামীণ কূটনীতি। গরীবের কার্ডে তেল তুলতো ধনীরা। গরীবের বাড়ীতে জ্বলতো চিমনি।গ্রামীণ অর্থীতিতে হারিকেনের অনেক অবদান। মুদির দোকানে খড় ঢেকে বিক্রি হতো কাঁচ আর সলতে। সংসারের খরচ কমাতে মহিলারা বার করলেন ফন্দি। সলতের জায়গায় এলো কাপড়ের সলতে আর ফাটা কাঁচে জড়ানো হতো শক্ত কাগজ। বালি দিয়ে যত্ন করে সে কাঁচ পরিষ্কার করা হতো। কাঁচের ওপর জমা কার্বনে চলতো ভুত ভূত খেলা। হ্যারিকেন জ্বললে বাড়ির মহিলারা ব্যবহার করবে না দেশলাই। কাগজ পাকিয়ে উনন জ্বলতো হারিকেনের আলোতে। অনেক সময় হ্যারিকেন নিভে গেলে গোলযোগ বেঁধে যেতো।


তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষনের লেখায় হ্যারিকেন এসেছে বারবার। সন্ধ্যার পরে উন্নত জীবন বলতে হ্যারিকেন। ভালবাসা বিরহ থেকে শুরু করে শৈশবের ফিস্টি। সন্ধ্যে হলেই হ্যারিকেন নিয়ে ছাত্ররা চলতো মাস্টারের বাড়ি। মাষ্টারমশাই আদেশ দিতেন,সবাই নিজের নিজের হ্যারিকেন আনবে। মায়েরা বিকাল থেকে হ্যারিকেন মুছে রেখে দিত। বিকাল শেষে বাচ্চারা হ্যারিকেন দোলাতে দোলাতে পড়তে যেত। ফলে অনেক সময় দুলুনিতে তেল পড়ে যেতো। মাষ্টারমশাই সমাধান করেদিতেন। একটা হারিকেনে দুজন পড়বে। তাতেও মারামারি।যার হ্যারিকেন সে আলো দেবে না। শেষমেশ যার হ্যারিকেন নেই সে অন্যর আলোর ছায়াতে পড়বে। অন্যদিকে দুষ্ট ছেলে হ্যারিকেনের কল নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।আর মাষ্টারমশাই দেখতেই পিঠে পড়লো লাঠি। পড়ার শেষে অভিভাবকরা নিতে আসতো হ্যারিকেন নিয়ে। মাস্টার হুংকার দিত,"কে?" শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর আসতো,"আমি মাষ্টারমশাই। পিন্টুর বাবা"। হ্যারিকেনটা মুখের উপর তুলে ধরতে পিন্টুর বাবা। চিনতে পেরে মাষ্টারমশাই বলতেন,"বসুন"। হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে পড়ত সবাই। রাতের আলো বলতে তখন চাঁদের জোৎস্না আর অমাবশ্যার রাতে জোনাকি। ছেলেবেলায় সেগুলি কৌটোতে ভরে রাখা হতো ।নাম দিতাম "টর্চ"।


চন্ডিতলার গল্প। চা মুড়ি তেলেভাজা। বুধবারের যাত্রাপালা। সবাই গোল হয়ে বসে শুনত। মাঝখানে হ্যারিকেন।পাশে রেডিও। পোকা আসতো। কেউ বলতো,"আলো টা কমা"। কেউ বলতো,"কমাতে হবে না"। ঝগড়া। যার হ্যারিকেন সে নিয়ে চলে গেলো। অন্ধকারে বসেই সবাই যাত্রা শুনলো। দিদিমা ছেলের বাড়ি যাবে। রাতে ছাড়বে গরুর গাড়ি। গাড়ির সামনে ঝুলানো হ্যারিকেন। নতুন বিয়ের পালকি বনের ভেতর দিয়ে যাবে। সঙ্গে সেই হ্যারিকেন। বাংলার অঙ্গ ছিল হ্যারিকেন। হ্যারিকেনের তাপে সেরে যেত হাঁটুর বাত। কাঁচের ওপর রাখা হতো কাপড়। কাপড় তেতে গেলে সেঁক দেওয়া হতো। ঠান্ডায় বুকের মাঝে আগলে রাখার রোমান্স হ্যারিকেন। সদ্য যুবতী হারিকেনের আলোয় তার ভালবাসার চিরকুট পড়তো গোপনে। হ্যারিকেন কমিয়ে কোলবালিশ চেপে ইচ্ছে করতো ঘনিষ্ট হবার বাসনা। বাড়ীতে চোর এলে হ্যারিকেন নিয়ে পালাতো। বেচে বিড়ি খাবে। সবই এদের বলতো ছিঁচকে চোর। কবির টেবিলে হ্যারিকেন জ্বলতো সারা রাত। হারানো শব্দের সন্ধানে উটানামা করতো হ্যারিকেনের সলতে। বিরক্ত গভীর হলে নিভে যেতো আলো।


হ্যারিকেন এখন ইতিহাস। হ্যারিকেনে লুকিয়ে প্রান্তিক জীবন। সবেক বঙ্গ।এখন তো হ্যারিকেন খেলনা, শোপিস। বোলপুরের সনাজুরির হাটে বিক্রি হয় হ্যারিকেন প্রতীকী। লোকে কেনে। নিয়ে যাবে বাড়ীতে। ছোটরা জানবে এই হ্যারিকেন কেটেছে তার বাবা দাদুদের জীবন যৌবন। অথচ এই হ্যারিকেন হাতে রানার দৌড়েছে একদিন।তাকে চিঠি দিতে হবে।সেই ডাকপিয়নের চরম বন্ধু ছিল সেদিন এই হ্যারিকেন। "হাতে লন্ঠন করে ঠনঠন জোনাকিরা দেয় আলো"।




প্রকৃত জীবন - অভিজিৎ দত্ত || Prokito Jibon - Avijit Dutta || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article

 প্রকৃত জীবন 

অভিজিৎ দত্ত 



পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। তাই তার জীবনচর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন থাকা দরকার। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ' আত্মনং বিধি' অর্থাৎ নিজেকে জানো।আবার স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা।সবই ঠিক। আসল ঠিক হল নিজেকে তৈরী করা বা প্রকৃত মানুষ হওয়া। নিজেকে তৈরী করা বা সঠিক মানুষ হওয়া মুখের কথা নয়।সেই জন্য আমাদের একজন বিখ্যাত মনীষী মন্তব্য করেছেন, মুরগির বাচ্চাকে মুরগি হতে অত কষ্ট করতে হয় না,কিন্ত মানুষের বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়।যে কোন স্বপ্নকে সফল করতে গেলে যেমন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় ,সেইরূপ প্রকৃত মানুষ হতে গেলে অনেক সংযত ও নিয়মমাফিক জীবনচর্চা করতে হয়।


আজ মানুষে,মানুষে এত ভেদাভেদ, হিংসা,খুনোখুনী, পরশ্রীকাতরতা, ব‍্যাভিচার মানুষের শ্রেষ্ঠত্বা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।আজ মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ। আজ মানুষ, মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না।কেন মানুষের এত অধ:পতন দশা?এর উত্তর নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনচর্চার মধ্যেই। উন্নত জীবনচর্চার মধ্যে যে বেড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে একজন অনুন্নত জীবনচর্চার মধ্যে বেড়ে উঠা মানুষের মূল্যবোধ বা জীবনদর্শন কখনোই এক হবে না বা মিলবে না।এইজন্যই শাস্ত্রে বলেছে,সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস/অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। 


জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে,উপরের বাক্যগুলি ধ্রুব সত্য। কজনই তা মনে রাখে।মানুষের জীবনে চারটি স্তর আছে-শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। তার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর খুব মূল্যবান। বাড়ির ভিতের মতো মানুষের জীবনের ভিত হল শৈশব ও কৈশোর। এই সময় সঠিক শিক্ষা ও উন্নত জীবনাদর্শ মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করে।অনেকেই বলবেন সঠিক জীবনাদর্শন কী?এক কথায় এর উওর দেয়া মুশকিল। মোটামুটি বলা যায় সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পথ চলা,সকলের ভালো চিন্তা করা।নেতিবাচক চিন্তা বা কুচিন্তাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং পরমশক্তির প্রতি আস্থা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, চারটি যোগের মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। এই চারটি যোগ হল কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ও ভক্তিযোগ। এছাড়া বিবেকানন্দ একটি সুন্দর কথা বলেছেন, মানুষের মন কোন ডাষ্টবিন নয়,যে ক্রোধ, হিংসা,কুচিন্তা প্রভৃতির ন্যায় বাজে জিনিস দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে।


আমাদের ভারতবর্ষ এক সুপ্রাচীন ও মহান দেশ। অনেকেই বলেন আধ্যাত্মিকতার পীঠস্হান। অনেক মহাপুরুষ ও এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। অনেক ভালো,ভালো উপদেশ তারা দিয়ে গেছেন। যেমন বুদ্ধদেবের আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ ,মহাবীরের পঞ্চ মহাব্রত, গুরু নানকের উপদেশ প্রভৃতি।আবার হজরত মহম্মদ বা যীশু খ্রিষ্ট ও অনেক মূল্যবান উপদেশ পৃথিবীবাসীকে দিয়েছেন। আমরা কি তা অনুসরণ করি ?আজ যদি আমরা মহাপুরুষদের জীবন ও বাণী সম্পর্কে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারতাম তাহলে পৃথিবীটা একটা স্বর্গের দেশ হতো।সেইজন্য কবি বলেছেন, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক/কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক/মানুষেতেই সুরাসুর।


মানুষ আজ প্রচন্ড ব্যস্ত। কিন্ত একটা কথা সকলকেই মনে রাখতে হবে মানুষ খালি হাতেই পৃথিবীতে এসেছে আবার খালি হাতেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।মানুষকে স্মরণীয় করে রাখবে তার ভালো কাজ। এইজন্য শাস্ত্রে বলেছে, জীবনের মূল্য আয়ুতে নয়, কল্যাণময় কর্মে। কাজেই নিজেকে ভালোভাবে তৈরী করতে না পারলে তার পক্ষে কী ভালো কাজ করা সম্ভব?সকলের ই উচিত এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা।আমাদের দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করা,ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতারণ করা।কিন্ত শুধু স্বাধীনতা অর্জনই স্বাধীনতাসংগ্রামীদের লক্ষ্য ছিল না।এরসঙ্গে তারা একটি উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই উন্নত ভারতবর্ষ কাদের নিয়ে গড়ে উঠবে?আমি,আপনি সহ আপামর দেশবাসীকে নিয়ে।কাজেই দেশের ভালো-মন্দ নির্ভর করবে দেশবাসী কেমন শিক্ষা বা জীবনাদর্শ নিয়ে বড়ো হচ্ছে তার উপরে।আজ দু:খের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ সবকিছুকেই শেষ করে দিচ্ছে।এর থেকে উদ্ধার পেতে গেলে একটিই উপায় নিজেকে শিক্ষিত করা ও উন্নত জীবনাদর্শ মেনে চলা ।মহাপুরুষ ও স্বাধীনতাসংগ্রামীদের আর্দশে অনুপ্রাণিত হওয়া ও তাদেরকে মেনে চলা।নাহলে উন্নত জীবন ও উন্নত দেশ তথা বিশ্বের আশা সুদূরপরাহত। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের শ্রেষ্ঠ কথাটি বলে গেছেন-তোমাদের চৈতন্য হোক। আর সাধক রামপ্রসাদ আক্ষেপ করে বলেছেন, এমন মানব জমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা।পরিশেষে কবির উক্তি দিয়েই শেষ করি।সেই ধন্য নরকুলে/লোকে যারে নাহি ভুলে/মনের মন্দিরে সেবে/সদা সর্বজন।

নিকারাগুয়ার কবিতা - শংকর ব্রহ্ম || Nikarguyar Kobita - Sankar Brhama || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article

নিকারাগুয়ার কবিতা

শংকর ব্রহ্ম 



              ‘কবিদের দেশ’ বলা হয় নিকারাগুয়াকে। রাজনীতি আর নিসর্গ’-র মিশ্রিত অভিঘাতের কারণে তুমুল পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে লেখা হয়েছে নিকারাগুয়ার কবিতা। 


            নিকারাগুয়া উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই আমেরিকার হস্তক্ষেপে বারবার আলোড়িত হয়েছে । জলপথের অধিকার কায়েম করতেই আমেরিকা প্রাথমিকভাবে এই আক্রমণগুলো করত নিকারাগুয়াকে। পরে ‘পানামা ক্যানেল’-য়ের ক্ষমতা নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য তাদের নৌ-সেনারা ১৯১২ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত নিকারাগুয়াকে দখলে রাখে। 


           ১৯২৭ সালে ‘অগুস্তো সিজার স্যান্ডিনো’ এই দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলে আক্রমণ শুরু করে দেয়। 



           নিকারাগুয়ার কবিতায় প্রবাদপ্রতিম কবি ‘রুবেন দারিও’(১৮৬৭-১৯১৬) অনেক আগে থেকেই এই দখলদারীকে অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি নিজের এলাকায় কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ষোলো বছর হতে না হতেই সারা দেশে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কবিতায় স্প্যানিশের সাঙ্গীতিক মূর্ছনার প্রয়োগ ছিল। আর ছিল ভাষাগত অস্তিত্বের সঙ্কটের সঙ্গে রাজনৈতিক সঙ্কটের মিথষ্ক্রিয়া।



            ‘রুবেন দারিও’কে বলা হয় নিকারাগুয়ার আধুনিক কবিতার জনক। 


              লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর মতই নানা রকমের জটিল সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিকারাগুয়া গড়ে উঠেছে। ১২০০০ খৃঃপূঃ’-র সময়ে ‘পেলিও-আমেরিকান’রা নিকারাগুয়ায় বসবাস করতে শুরু করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘মেসো আমেরিকান’ সংস্কৃতিই (আজটেক ও মায়া সভ্যতা) মূলধারা হয়ে ওঠে নিকারাগুয়ার। ভাষাগতভাবে দুটি ‘ডায়লেক্ট’ ওই সময় প্রধান ছিল।


            ফরাসি শিল্প-সাহিত্যপ্রভাবিত ‘মদের্নিসমো’ নামের এক আধুনিক কাব্য-ধারার গোড়াপত্তন ঘটে ১৮৮৫ সালে নিকারাগুয়ার রুবেন দারিও, কিউবার হোসে মার্তি প্রমুখ কবির নেতৃত্বে। আবার এ-ধারার বিপরীতে একটি শক্তিশালী সংরক্ষণবাদী ধারারও আবির্ভাব ঘটে, যারা স্বদেশ, দেশের মানুষ ও ঐতিহ্যকে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। ব্যাপকার্থে কাব্য-সাহিত্যের এই আন্তর্জাতিকতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী ধারার বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে, বাস্তবতায় আবার জন্ম নিল এক প্রগাঢ় নিরীক্ষাভিত্তিক 'avant grade' বা 'অগ্রগামী সাহিত্য', যা পূর্বোক্ত দু'ধারার সংশ্লেষণও (Synthesis) বটে।


           ‘মদের্নিসমো’-পরবর্তী বিশ শতকের পাঁচ বিখ্যাত কবি হলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস দ্রামন্দ দে আন্দ্রাদে, পাবলো নেরুদা এবং অক্টাভিও পাস। তাঁদের মধ্যে মিস্ত্রাল, নেরুদা ও অক্টাভিও পাস নোবেল পুরুস্কার পেয়েছেন। তাঁদের পাশাপাশি আরও অনেকের কবিতা আজ বিশ্ব-সাহিত্যের অঙ্গীভূত।। 


             ১৫০২ সালে কলম্বাসের নেতৃত্বে ‘ম্যানগুয়ে’ আর ‘নৌহাট’ প্রথম স্পেনিয় বাহিনী নিকারাগুয়ায় অভিযান চালায়। তবে বছর কুড়ি পরে গঞ্জালেস দ্যাভিলার নেতৃত্বে সফল ঔপনিবেশিক অভিযান শুরু হয়।


              ১৫২৪ সালে ফ্রান্সিস্কো হারান্‌ডেজ দ্য করডোবা প্রথম স্প্যানিশ সেটেলমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন ‘গ্রানাডা’। এরপরের প্রাউ তিনশো বছরের ইতিহাস হল লুঠ, শোষণ, অত্যাচার, প্রতিরোধ আর ভাষাগত এবং জাতিগত সংকরায়ন (hybridization) -য়ের ইতিহাস। স্প্যানিশ এবং স্থানীয় জাতিতত্ত্বমূলক (ethnic) সৃষ্টি হয়েছে ‘মেসিৎজো’ জাতিসত্ত্বার, যারা এখনকার নিকারাগুয়ার প্রধান ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে । 


                এই সামাজিক রূপান্তরের ভেতরেই বিবর্তিত হয়েছে নিকারাগুয়ার সাহিত্য। ‘উত্তর কলোম্বিয়ান’ যুগের প্রথম লিখিত সাহিত্য হল ‘এল গুয়েগুয়েনেজ’। 


          তার আগে গল্প আর পদ্যই প্রচলিত ছিল ‘মৌখিক’ ভাবে। 


             নিকারাগুয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৮২১ সালে। ‘রুবেন দারিও’র প্রস্তাবনায় ‘মর্ডানিজম’ ধারার লেখালিখি শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। সঙ্গে ছিলেন, ‘সালমন ডি লা সিলভা’, ‘কারলোস মার্টিনেজ রিভাস’ প্রমুখ কবিরা। 


              মূলতঃ ‘রোমান্টিসিজম’, ‘পারনাস্‌সিয়ানিজম’ এবং ‘সিম্বলিজম’ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল ‘মর্ডানিজোম’। এই তিনধারাকে মিলিয়েই রুবেন দারিওর কবিতা লেখা হয়েছে। আধুনিকতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আর ‘এলিটিসিজম’ রুবেন দারিওর কবিতাকে অনন্য করে তুলেছিল। এবার আসুন পড়ি ‘রুবেন দারিও’র কিছু কবিতা -



অমোঘ নিয়তি



বৃক্ষেরা সুখী কারণ তারা নিশ্চেতন বললেই চলে 


কঠিন শিলা সংবেদনহীন বলে আরও বেশি সুখী


বেঁচে থাকার মতো এত বিপুল যন্ত্রণা কিছুতে নেই


সজ্ঞান জীবনের মতো কোনও বোঝা এত ভারী নয়।



কী যে হবো জানা নেই, জ্ঞান নেই, এটা সেটা ত্রুটি


যা আছি তাতেই ভয়, যা হবে আতংক তার…


কালকেই পটল তোলার সুনিশ্চিত বিভীষিকা,


আজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকার পার হওয়া


পার হওয়া যা জানি না, যা সন্দেহও করি না


এবং যে মাংস শীতল আঙুরগুচ্ছের সাথে আমাদের টানে,


যে কবর শেষকৃত্যের শুচিজলের অপেক্ষায় থাকে


এবং যে আমরা জানি না কোথায় যাব


এবং জানি না কোথা থেকে আমরা এসেছি!…



 স্পেনের ব্যাগপাইপ


 


ব্যাগপাইপ ওই স্পেনের, গান শোনাতেই পারে


মধুরতম গান আমাদের বাসন্তিকা গান


খুশির আবহাওয়াতে শুরু, যন্ত্রণাতে শেষ


তোমার গানে তোমারই সব আমরা কোথাও নেই



বললে, এটা বর্ষা, গাও বৃষ্টি একে একে


আমি তখন প্রবল খরায় লিখছি দাহ্যতাকে


সোলোমনের কথায় আছে, পড়োনি ব্যাগপাইপ


যে ঋতুরও বহু প্রকার আছে, আলাদা সবিশেষ



 গাছের ঋতু, বপন ঋতু, ঋতু কর্ষণের


রোঁয়ার ঋতু, ফসল-ঋতু, হাসি ও কান্নার


ভিন্ন ঋতুর গানে গানে আশা নিরাশার


মাঝেই আসে প্রেমের ঋতু, ঋতু সঙ্গমের


জন্ম আসে, প্রতি ঋতু্র প্রতিটি জন্মদিনে…



 হেমন্তে


 


আমি জানি,অনেকেই বলে থাকে, সেই মধুরতম গান


সে গায় না কেন? তার প্রশাখাশিহরে বুনো মর্মর আর


শোনা যায়না কেন? তারা কিন্তু একটি ঘন্টার শ্রম বা


এক মিনিটের কাজে হয়ে ওঠা ওই গানের বিস্ময়


না দেখেই এসব বলছে



 আমার বয়স অনেক।যখন ছোট ছিলাম, বাতাস ছুঁলেই


বেজে উঠতাম আমি, তারুন্যে আনন্দধারা বইতো, ছুঁলেই


গাছের শব্দেও বয়েস ছাপ ফেলে যায়, সে চায় গাইতে, আর তার গানে


থেকে থেকে ঝড় তোলে ‘হারিকেনে—এর ঘূর্ণী!



 রুজভেল্টের প্রতি


 


বাইবেলের উচ্চারণ আর হুইটম্যানের কবিতা নিয়ে


আমরা তোমার কাছে পৌঁছব, শিকারী!


পুরনো আর নতুন,সহজ এবং জটিল কিছুটা ওয়াশিংটনের অংশ নিয়ে


কিছুটা নিমরডের, আমরা পৌঁছব!


তুমি, তুমিই আমেরিকা


ভবিষ্যতের আক্রমণকারী আর সেই গ্রাম্য আমেরিকান যার রক্ত ‘ইণ্ডিয়ান’-এর


যে যীশুবাবার পুজো করে, তারাই আমরা


আমরা কথা বলি


স্প্যানিশে


তুমি গর্বিত প্রতীক, আমেরিকার! তুমি সংস্কৃতি বোঝো, বুদ্ধিমান


টলস্টয়ের বিরোধীতা করো, চালাক খুব, তুমি ঘোড়া বা বাঘ


কাউকে রেয়াত করোনা, তুমি প্রতীক হে!


হে যুবরাজ আলজেন্দ্রো নেবুচান্দনেজ্জার (তুমি শক্তি আর স্ফূর্তির অধ্যাপক, পাগল উবাচ), তুমি জীবনকে ভাবো আগুন


প্রগতিকে বিস্ফোরণ


আর বুলেট রেখে বলো, সভ্যতা রাখলাম


না


আমেরিকা বড়, আমেরিকার জোরও বড়


একটু কাঁপলেই ভূমিকম্প হয়


না, আন্দেজের শিরদাঁড়ায় তখন গর্জন শুরু হয় সিংহে


সেই গর্জন শোনো, হে প্রতীক, ভুলে যেওনা হিউগো গ্রান্টকে বলেছিলেন, তুমি ধনী, অগণিত তারার সাম্রজ্য তোমার (সূর্য আর্জেন্টিনায় ওঠে আর তারা চিলিতে), তুমি ধনী, মনে করো হারকিউলিস আর বৈদ্যুতিক আলোর সংযোগ, যে আলোয় লিবার্টি মূর্তি হল


হাতে জ্বলল ‘নিউ-ইয়র্ক’-এর মশাল


সবই আমাদের (অংশ)।


                ১৯১৬ সালে ‘রুবেন দারিও’ মারা যান। 



           তারপরেই আরেক পরিবর্তন আসে ‘নিকারাগুয়া’র কবিতায়। ‘ভ্যানগার্ডিয়া’ নামের গ্রুপটি ১৯২৭ সালে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় নিকারাগুয়ার কাব্যিক পরিমণ্ডলে। এর প্রথম সারিতে ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত কবি ‘পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা’(১৯১২-২০০২)। কিছু গ্রানাডাবাসী তরুণ আমেরিকা থেকে ‘আভা গার্দ’ আন্দোলনের রূপকথা নিয়ে এল নিকারাগুয়ায়। একটি নিবন্ধে পরে এদের এভাবে বর্ণনা করা হয়েছিলঃ



 “A couple of the young Granadino poets went abroad and came home bearing news of the latest in literature and art from France (Cocteau, Apollinaire, Claudel) and the United States (Whitman, Amy Lowell and “imagism,” Pound). And by 1930 little Granada, in its sophistication, had blossomed into a center of the avant-garde. The then boys in the bell tower proclaimed themselves “The Nicaraguan AntiAcademy.” They drew up a manifesto, which was written by Pablo Antonio, calling for a review, banquets, and a theater. They were mischievous. They announced an intention to conquer public attention “by means of artistic coups d’etat, intellectual scandal, aggressive criticism, literary battle, impudent exhibition of modern art, accusation against sterility, anemia, malaria, and other infirmities of academic literature.” They rented a cafe for their proposed new Cafe of the Arts and drew up a menu starting with “Cocktail Cocteau,” but the cafe owner, having noticed their decorations, threw them out. “Cubism,” Cuadra recalled many years later, “had lost its first battle in Nicaragua.” They took over a page of Granada’s Sunday newspaper, El Correo, and made it their own, the “Vanguard Corner.” 


[ কয়েকজন তরুণ গ্রানাডিনো কবি বিদেশে গিয়েছিলেন এবং ফ্রান্স (ককটিউ, অ্যাপোলিনায়ার, ক্লাউডেল) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (হুইটম্যান, অ্যামি লোয়েল এবং "কল্পনা," পাউন্ড) থেকে সাহিত্য ও শিল্পের সর্বশেষ খবর নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। এবং ১৯৩০ সাল নাগাদ ছোট্ট গ্রানাডা, তার পরিশীলনে, অ্যাভান্ট-গার্ডের একটি কেন্দ্রে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। বেল টাওয়ারের তৎকালীন ছেলেরা নিজেদেরকে "নিকারাগুয়ান এন্টিএক্যাডেমি" বলে ঘোষণা করেছিল। তারা একটি ইশতেহার তৈরি করেন, যা পাবলো আন্তোনিও লিখেছিলেন, একটি পর্যালোচনা, ভোজসভা এবং একটি থিয়েটারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা দুষ্ট ছিল।তারা জনসাধারণের মনোযোগ জয় করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছিল "শৈল্পিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, বুদ্ধিবৃত্তিক কেলেঙ্কারি, আক্রমণাত্মক সমালোচনা, সাহিত্য যুদ্ধ, আধুনিক শিল্পের অযৌক্তিক প্রদর্শনী, বন্ধ্যাত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রক্তশূন্যতা, ম্যালেরিয়া এবং একাডেমিক সাহিত্যের অন্যান্য দুর্বলতা।" তারা তাদের প্রস্তাবিত নতুন ক্যাফে অফ দ্য আর্টসের জন্য একটি ক্যাফে ভাড়া নিয়েছিল এবং "ককটেল ককটেউ" থেকে শুরু করে একটি মেনু তৈরি করেছিল, কিন্তু ক্যাফে মালিক, তাদের সাজসজ্জা লক্ষ্য করে, তাদের ফেলে দেয়। "কিউবিজম," কুয়াড্রা অনেক বছর পরে স্মরণ করেছিলেন, "নিকারাগুয়ায় তার প্রথম যুদ্ধে হেরেছিল।" তারা গ্রানাডার রবিবারের সংবাদপত্র, এল কোরিও -এর একটি পৃষ্ঠা দখল করে নেয় এবং এটিকে নিজের করে নেয়, "ভ্যানগার্ড কর্নার"। (পল বারম্যান/ আ চাইল্ড অফ হিজ সেঞ্চুরি)]



              আধুনিক, উত্তরাধুনিক সময়ের সীমাভাঙা জীবন কুয়াদ্রার। তিনি ১৯০৯-৩৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকান হস্তক্ষেপ দেখেছেন। ‘অগুস্তো স্যান্দিনো সিজার’-য়ের গেরিলা লড়াই দেখেছেন। এই সান্দিনো’র নাম নিয়েই ষাট দশকের ‘স্যানদিস্তা’ আন্দোলন গড়ে উঠে। যেখানে তখনকার নিকারাগুয়া’র সবচেয়ে নামী সাহিত্যপত্রিকার ‘লা-পেন্সা’র সম্পাদক কুয়েদ্রার সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে সেই ১৯২৭ সালের ‘ভ্যানগার্ডিয়া’ দলের প্রথম লক্ষ্য ছিল ‘রুবেন দারিও’র আধুনিক পরিসরের যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কবিতাকে প্রাধান্য দেয়া। ‘রুবেন দারিও’র সবরকম ‘টুল’গুলো কুয়াদ্রা অস্বীকার করলেন। বিমূর্ততা, রহস্যময়তা, চিত্রকল্প সহ সবকিছু থেকে বেরিয়ে এসে। তাঁর কবিতায় লোকায়ত প্রাকৃতিক নিকারাগুয়ার সঙ্গে যোগসূত্র ঘটল এখনকার বাস্তবিক নিকারাগুয়ার। জল, গাছ, পাহাড়, সমুদ্র, নাবিক, শোষণ, প্রতিবাদ, হতাশা এইসব কিছুই উঠে এল এক নতুন আঙ্গিকে।  


                 স্বেচ্ছাচারী ‘সামোজা’ পরিবারের শাসন থেকে মুক্তি পেতে ১৯২৯-১৯৭৯ সালে স্যান্দিস্তা আন্দোলন এবং ‘স্যান্দিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে’র উদ্ভবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে কবিতা লিখেছেন। তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল স্বৈরাচারী ‘সামোজা’ সরকারের উৎখাতের পিছসে । 


                 এখনকার শাসক দল ‘এফ.এস.এন.এল’-য়ের সঙ্গেই তিনি ১৯৮০’র শেশদিক পর্যন্ত ছিলেন। একটি মতের প্রাধান্য কখোনই ছিল না তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে। আমৃত্যু তিনি বহুমতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর এই কারণে ‘দ্যানিয়েল’ওর্টেগা’র সরকার যখন তাঁর কাছে আধিপত্যের প্রতীক হয়ে উঠলো কুয়াদ্রা দেশত্যাগ করে কোস্টারিকা এবং টেক্সাসে থাকতে লাগলেন। 


               ২০০২ সালে ‘মুয়ানাগুয়া’ শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। 



এবার পড়ি ‘পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা’র কিছু কবিতা -



 দুঃসাহসী একটি লোকের আঁকা সরিসৃপ


 


আমি পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম


চাঁদ উঠল যখন


সে শপথ করে বলেছিল যে আসবে


দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে


একটা সাঁঝানো চিল


সেই রাস্তাটাই তুলে নিল


তার ধারালো নখ দিয়ে



২.



সাইফার, তার স্বপ্নে, শুনতে পেল সমুদ্রশামুকের চিৎকার, তখন ভোর, কুয়াশায়।


সে দেখলো নৌকোটাকে, স্থির, ঢেউ-এ আটকানো।


– যদি তুমি মাহজরাতের ঘন অন্ধকারে শোন, উঁচু ঢেউ পেরনো কোন চিৎকার জিগগেস করছে বন্দরের নাম, রাডারটা ঘুরিয়ে কেটে পড়ো…


ফেনারেখায় টানা জাহাজের আভাস, চিবোনো অন্ধকার,(“নাবিক নাবিক” তারা চেঁচাচ্ছে), ছেঁড়া দড়ি দুলছে কালো অন্ধকারের ভেসে যাওয়ায় (-‘নাবিক, আমরা নাবিক!’)


সাইফার দাঁড়ালো, মাস্তুল ছুঁয়ে



-যদি চাঁদের আলোয় তাদের আলোকিত ছাই ছাই দাড়িগোঁফের মুখগুলো তোমায় জিগগেস করে, ‘নাবিক, আমাদের বন্দরের রাস্তাটা ব’লে দাও..উত্তর দিও না, রাডারটা ঘরাও আর কেটে পড়ো…


তারা জাহাজ ভাসিয়েছিল সেই কবে


তারা ভসেসে চলেছে শতাব্দী পুরনো স্বপ্নে


আর এসবই তোমার সেই নানারকমের জিজ্ঞাসা, যা তুমি কোন একটা সময়ে হারিয়ে ফেলেছ



  ‘The film ended without the final kiss.


She was found dead in her bed with her hand on the phone.


And the detectives never learned who she was going to call.


She was like someone who had dialed the number of the only


friendly voice and only heard the voice of a recording


that says: WRONG NUMBER.



 Or like someone who had been wounded by gangsters reaching


for a disconnected phone.



 Lord



 whoever it might have been that she was going to call


and didn’t call (and maybe it was no one


or Someone whose number isn’t in the Los Angeles phonebook)


You answer that telephone!’



[ চূড়ান্ত চুম্বন ছাড়াই ছবিটি শেষ হয়েছে।


ফোনে হাত দিয়ে তাকে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।


এবং গোয়েন্দারা কখনই জানতে পারেনি যে তিনি কাকে ডাকতে যাচ্ছেন।


তিনি এমন একজনের মতো ছিলেন যিনি একমাত্র নম্বরটি ডায়াল করেছিলেন


বন্ধুত্বপূর্ণ ভয়েস এবং শুধুমাত্র একটি রেকর্ডিং এর ভয়েস শুনেছি


যে বলছে: ভুল সংখ্যা।



অথবা যে কেউ গ্যাংস্টারদের কাছে পৌঁছে আহত হয়েছে


একটি বিচ্ছিন্ন ফোনের জন্য।



 প্রভু



 যাকেই হতে পারে যে সে ফোন করতে যাচ্ছে


এবং কল করেনি (এবং সম্ভবত এটি কেউ ছিল না


অথবা যার নাম লস এঞ্জেলেস ফোনবুকের মধ্যে নেই)


তুমি ওই টেলিফোনের উত্তর দাও! ’ ]



          শেষ লাইনটা চমৎকার না? কে এভাবে, এত নিরিবিচ্ছিন্ন ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন? যিনি অভ্যস্ত, অর্থাৎ একজন যাজক! কিন্তু যাজক তো নিয়মের বাইরে যাবেন না। কবিতা করবেন না। সেক্ষেত্রে একজন যাজক কবির কথা ভাবা যেতে পারে। এই মুহূর্তে যাজক-কবি এরনেস্তো কার্দেনাল ছাড়া আর কে আছেন? এই অংশটা তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রেয়ার ফর মেরিলিন মনরো’ থেকে নেয়া। তবে তিনি শুধু কবিই নন, বিপ্লবীও বটে। নিকারাগুয়ার স্বৈরাচারী সামোজা পরিবারের বিরুদ্ধে এই মানবদরদী যাজকের অবস্থান বরাবরই খুব দৃঢ় ছিল। ‘কেনটাকি’তে যাজকত্ব পাওয়ার আগে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কবিতা এবং কবিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।১৯৬০ শুরু হওয়া ‘সামোজা’ বিরোধী ‘স্যন্ডিস্তা’ আন্দোলনের তিনি ছিলেন থিওলজিক্যাল মার্ক্সবাদের প্রতিনিধি এবং একজন এমন কবি যাঁকে পাবলো এন্তোনিও কুয়াদ্রার সঙ্গেই একাসনে রাখা হয়। 


Lawrence Ferlinghetti noted in Seven Days in Nicaragua Libre. “And with [Cardenal’s] vision of a primitive Christianity, it was logical for him to add that in his view the Revolution would not have succeeded until there were no more masters and no more slaves. ‘The Gospels,’ he said, ‘foresee a classless society. They foresee also the withering away of the state’ [Ferlinghetti’s emphasis].” 


(লরেন্স ফার্লিংগেটি নিকারাগুয়া লিবারে সাত দিনে উল্লেখ করেছেন। "এবং একটি আদিম খ্রিস্টধর্মের [কার্ডেনালের] দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, তার পক্ষে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল যে তার দৃষ্টিতে বিপ্লব সফল না হত যতক্ষণ না আর কোন প্রভু এবং দাস না থাকত। 'গসপেলস,' তিনি বলেছিলেন, 'একটি শ্রেণীহীন সমাজের পূর্বাভাস দিন। তারা রাজ্যের বিলুপ্তির পূর্বাভাসও দেয় "[ফারলিংগেটির জোর]") লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি তাঁর ‘‘সেভেন ডেজ ইন নিকারাগুয়া ‘লিবের’’’-এ লিখেছেনঃ -


“And with [Cardenal’s] vision of a primitive Christianity, it was logical for him to add that in his view the Revolution would not have succeeded until there were no more masters and no more slaves. ‘The Gospels,’ he said, ‘foresee a classless society. They foresee also the withering away of the state’. 


( এবং এক আদিম খ্রিস্টধর্মের [Cardenal's] দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, তার পক্ষে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল যে, তার দৃষ্টিতে বিপ্লব সফল না হত যতক্ষণ না আর কোন প্রভু এবং দাস না থাকত। 'গসপেলস,' তিনি বলেছিলেন, 'একটি শ্রেণীহীন সমাজের পূর্বাভাস দিন। তারা রাজ্যের বিলুপ্তির পূর্বাভাসও দেয়।) এটাই হল ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’-এর একক বৈশিষ্ট। ‘থিওলজি’কে যে সমাজনীতির সঙ্গে একীভূত করা যায় তার প্রামাণ্য উদাহরণ হলেন ‘বিদ্যাসাগর’। তবে তিনি কবি ছিলেন না। ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’ কবি ছিলেন। পার্থিব দুঃখ কষ্ট নিয়ে রোমাণ্টিক হা হুতাশ করাটাই তাঁর লক্ষ্য হতে পারতো। ১৯২৫-এ জন্মানো এই কবি তা করেন নি। ১৯৭০ এ কিউবায় গিয়ে তিনি মার্ক্সবাদকে খৃষ্ট-দর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন উপযোগী আদর্শে্র কথা ভাবতে শুরু করেন।গসপেল অনুযায়ি শ্রেণীহীন এবং রাষ্ট্রহীন সমাজের স্বপ্ন তিনি মার্ক্সীয় দর্শনের নিরিখে সম্ভব বলে লিখতে ও বলতে শুরু করেন।‘স্যান্দিস্তা বিপ্লব’-এর পরে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৭ অবধি তিনি তিনি নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পোপ জন পল (২) তাঁকে তাঁর ’লিবারেশন থিওলজি’র জন্য সমালোচনা করেন। তবে ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’ কখোনই বামপন্থা থেকে বিচ্যুত হননি। দানিয়েল ওর্তেগার নেতৃত্বে মন্ত্রীত্ব করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি তাঁর সমালোচক হয়ে ওঠেন এবং বিরোধীতা করেন একনায়কসুলভ আচরণের। মনে রাখতে হবে কুয়েদ্রা বা কার্দেনাল এঁরা দুজনেই লাতিন আমেরিকার সামগ্রীক কবিতাধারা এবং ভাবনা থেকে বিছিন্ন ছিলেন না। অ্যালেজো কার্পেন্তিয়র থেকে পাবলো নেরুদা পুরো লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বরাবরই পরস্পরকে সাপ্লিমেন্ট করেছে। এবার ‘এরনেস্তো কার্দেনাল’-এর কবিতা -



 ফর্সা দেবী


 


তো, এটা একটা বই, বিশেষ বই মহিলাদের নিয়ে, যে


পুরুষটি লিখেছে, সে প্রেমিক-স্বামী, মহিলাটির।


যার সম্পর্কে কিছুদিন আগে ‘টাইম’ লিখেছিল, ‘ইনি দুনিয়ার অন্যতম শিক্ষিত এবং সুভদ্র একজন মানুষ’ আর আমি


সেই বইটি পড়ছি


সূর্যস্নাত ডেকে বসে দেখছি সুমুদ্রঈশ্বর ‘পোসেইডনের’ ঢেউ ঢেউ কোঁকড়া চুল


যা সেই ফরাসী নৌকোয় ছিল


আমি যাচ্ছিলাম ‘নিউ ইয়র্ক’ থেকে ‘লা-হার্ভের’ দিকে, আমার প্রথম


ইওরোপ যাত্রা, আর তাই


আমি এখন নীল ভূমধ্যসাগরের উজ্জ্বল দিনটিতে একটা খাপছাড়া গ্রামে হাঁটছি


গ্রামটার নাম ‘দেয়া মাজোরকা’


এখানে ‘রবার্ট গ্রেভস’ থাকেন, আর তাই বই হাতে নিয়ে আমি টোকা মারলাম


তাঁর দরজায়


গ্রেভস দরজা খুলে নিজেই কার্দেনালকে ডেকে নিলেন ঘরের ভেতরে, আর সেই বিদ্বান মানুষটির স্ত্রী জোর করতে লাগলেন তাদের সঙ্গে চিকেন-স্যুপের লাঞ্চ করার জন্য


গ্রেভস গ্লোব নিয়ে এলেন বসার ঘরে


ঘুরিয়ে দিলেন


একসময় নিকারাগুয়ার উপরে তাঁর আঙুল থামলো


গ্লোবও থামলো, তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের বলে উঠলেন, এই যে ছোট্ট বিন্দুটা


এটাই নিকারাগুয়া, আর আমরা এই যে এখানে


ছেলেমেয়রা ঝুঁকে দেখতে লাগল তারা ঠিক কোন বিন্দুতে রয়েছে


আর সেই ছোট্ট বিন্দু নিকারাগুয়া


কতদূরে


তারা খুব মজা পাচ্ছিল…



 সেলফোন


 


তুমি তোমার সেলফোনে কথা বলো


ব’লেই যাও


হাসো, সেলফোনেই


এটা না জেনেই যে সেলফোন কিভাবে তৈরি হয়েছিল


বা কিভাবে এটা কাজ করে


তবে সমস্যা এটাই যে, তুমি জানো না


যেভাবে আমিও জানিনা যে কংগোতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়


এই সেলফোনের জন্য


কংগোর পাহাড়ে সোনা আর হীরে ছাড়াও ‘কোল্টান’ নামের খনিজ পদার্থ আছে


যা সেলফোনের কনডেনসারে কাজে লাগে…



 (‘কোল্টান’ এমনি এক খনিজ যা প্রায় সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয়। কঙ্গোতে এর অফুরন্ত ভাণ্ডার। এরফলে সেই দেশের আর্থিক বিকাশ চূড়ান্ত রকমের হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। বরং কতিপয় ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা এই সম্পদের দখল নিতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ‘গ্যাং-ওয়ার’-য়ের নামে মেরে ফেলেছে!)



নীল, জানলা থেকে দেখা


 ----------------------------------------



ছোট্ট গোল জানলা থেকে সবই নীল


নীলজমি, নীল-সবুজ, নীল(আকাশ)


নীল, সবই নীল


নীল ঝিল, নীল-লেগুন, নীল আগ্নেয়গিরি


অনেকটা দূরে নীলদ্বিপ নীল লেকের কাছে নীল নীল


এই হল মুক্তি পাওয়া দেশের মুখ


যেখানে মানুষ লড়াই করেছিল, আমার তো মনে হয়, ভালবাসার জন্য


শোষণছাড়া জীবনের জন্য


আর এই সুন্দরকে ভালবাসার জন্য সুন্দরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, কারণ


তারা নিজেরাই সুন্দর


তারা সাধারণ মানুষ, সবচেয়ে সুন্দর তারাই, আর তাই


ঈশ্বর এই জমিটুকু দিয়েছেন


সমাজকে ভাল করার ইচ্ছে দিয়েছেন আর তারা লড়াই করেছে


একটা দেশ ভালবাসার হবে বলে


এই দেশ ভালবাসার হবে বলে


একটা জায়গায় নীল গভীর হয়ে উঠেছে


এখানে হয়ত তীব্র লড়াই হয়েছিল, আর আমি ভাবছি, মুক্তির যুদ্ধগুলো দেখা যাচ্ছে


এই জানলা দিয়ে


এই ছোট্ট জানলা দিয়ে যাচ্ছে নীল, নীল আর নীল..


  


          নিকারাগুয়ার কবিতাও ‘স্যান্দিস্তা বিপ্লবে’র আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে উঠেছে ! 


          নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট দানিয়েল ওর্তেগার স্ত্রী একদিকে যেমন প্রথিতযশা কবি ছিলেন অন্যদিকে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে। বিপ্লবের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোন যোগ আছে কিনা জানিনা তবে ‘রোজারিও মারিল্লো’(জন্ম ১৯৫১) কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই কবিতায় সক্রিয় ছিলেন। বিপ্লবে সক্রিয় করার সময়েই কুয়েদ্রা সম্পাদিত নিকারাগুয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় রোজারিও’র লেখা নজর কেড়েছিল। রোজারিও বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন, এখন তিনি নিকারাগুয়ার ফার্স্ট লেডি এবং উপরাষ্ট্রপতি। 


 


রোজারিও মারিল্লো’র কবিতা


 


আমার বন্ধুরা এবং রাস্তার হৈ হৈ


 ------------------------------------------------------------



আমার কিছু বন্ধু আছে, তাদের ফেরানো যাবে না। একটা কালো রঙের পাখি যে খুব ভোরে গান গায়। একটা উড়তে থাকা পতাকা দরজার ওপারে আর একটি দ্রুত পায়ে চলে যাওয়া মেয়ে।আর সেই ছেলেটা যার চোখদুটো দেখলেই আমার মনে পড়ে যেত ঝিলের আয়ানার পড়ে থাকা রামধনুর রঙ। তার পা প্রকৃত কাদার প্রলেপে। বাজার খোলে সকাল সকাল, জীবনও। একটা ব্যাগ যেতে চাইছে না। একটা স্লোগান দেয়ালে। মনে হয় অক্ষরগুলো আমার গর্ভ আঁচড়াচ্ছে। এরাই আজ আমার বন্ধু। তারা ভোরের এই আড়ভাঙা ব্যায়ামগুলো সাজাবার চেষ্টা করছে।



 যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়


-------------------------------------------------------



 যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়


শেষ না হওয়া অপেক্ষা নিয়ে


যখন আরেকবার হাসি ফিরে আসে


আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের মাঝখানে


আমরা সময় নিই


পুরনো ওকে গাছটার পেছনের রাস্তাটায়


যেখানে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, আমাদের যেতে হবে


আমরা মনে করবো আবার সেই আতঙ্কের দিনগুলো


আমরা কথা বলবো সেইসব ঘ্রাণ নিয়ে


একে অপরকে বলবো যুদ্ধের দিনগুলো কিভাবে কাটিয়ে ছিলাম আমরা…



আর্নেস্তো কার্দেনাল


----------------------------



          নিকারাগুয়া তথা লাতিন আমেরিকার স্বনামখ্যাত কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল মার্তিনেজ। তার জন্ম হয় ১৯২৫ সালে। তিনি একজন ধর্মযাজক হয়েও নিকারাগুয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিপ্লবের ধর্মতত্ব বা মুক্তির ধর্মতত্ত্ব (Liberation Theology) অন্যতম জনক। সান্দানিস্তা বিপ্লবের পর কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। এই মার্কসবাদী ধর্মযাজকের সঙ্গে পোপ দ্বিতীয় জন পলের বিরোধ বাধে, কার্দেনাল যাজক হিসেবে গুরুত্ব হারান। পরে সান্তানিস্তা সরকারের, সরকার পরিচালন ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে কবি মন্ত্রীত্বও ছেড়ে দেন।



 তোতাপাখিরা



আমার বন্ধু মাইকেল হন্ডুরাস সীমান্তের


উত্তর সোমোতোর একজন সেনা অফিসার,


তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি কিছু


বে-আইনি তোতার খোঁজ পেয়েছিলেন


যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চোরাচালান হবার জন্য


অপেক্ষা করছিল, সেখানে গিয়ে ইংরিজি বুলি শেখানো হবে।


*


সেখানে ১৮৬টি তোতাপাখি ছিল


যার মধ্যে ৪৭টি তখনই খাঁচার ভেতর মারা গিয়েছিল।


যেখান থেকে তাদের ধরা হয়েছিল সেখানে


তিনি ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসছিলেন


কিন্তু সেই লরি এসে যেই প্রবেশ করল সেই সমতলে


*


ঐ পর্বতমালার কাছে, যেখানে ছিল তোতাদের বাসা


(সমতলভূমির পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিরাট পর্বতসারি)


পাখিগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠল, শুরু করল ডানা ঝাপটাতে


ধাক্কা দিতে লাগলো খাঁচার গায়ে।


*


যখন খাঁচাগুলো খুলে গেল


তারা ঠিক যেন তীর বৃষ্টির মতো ছুটে গেল


সোজা তাদের পাহাড়গুলোর দিকে।


*


আমার মনে হয় বিপ্লব ঠিক এই কাজটাই করে :


সে খাঁচা থেকে আমাদের মুক্ত করে


যেখানে ওরা আমাদের ইংরিজি বুলি শেখাতে ফাঁদবন্দি করেছিল


সেখান থেকে সে আমাদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনে


যেখান থেকে আমাদের উৎখাত করা হয়েছিল,


তাদের সবুজ পাহাড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয় তাদেরই সবুজ তোতাসাথীরা।


*


কিন্তু সেখানে ছিল আরো ৪৭টি, যারা নিহত হয়েছে।



 গিয়াকোন্দা বেল্লি


--------------------------



             উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান পরিবার থেকে আসা নিকারাগুয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী গিয়াকোন্দা বেল্লি । ১৯৪৮ সালে নিকারাগুয়ার মানাগুয়ায় বেল্লির জন্ম হয়। ১৯৭০ সালে সামোজা স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে শুরু হওয়ায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন বেল্লি। বিপ্লবের পরেও তিনি একজন সাহসী গণতান্ত্রিক কন্ঠ হিসেবে সমালোচনা করেছেন সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপের।



 হরতাল



আমি একটা হরতাল চাই যেখানে আমরা কেউ ঘরে থাকব না।


এ হবে কাঁধ, মাথা, চুলের হরতাল,


শরীরে শরীরে জন্ম নেবে যে হরতাল।


আমি একটা হরতাল চাই


শ্রমিকের ঘুঘুপাখির


চালকের ফুলের


কারিগরের শিশুর


চিকিৎসকের মায়ের



আমি একটা বিরাট হরতাল চাই


যাতে এমনকি থাকবে প্রেমও


একটি হরতাল যাতে সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে


ঘড়ি কারখানা


নার্সারি ইউনিভারসিটি


বাস হাসপাতাল


রাজপথ বন্দর


এ হবে চোখের, হাতের, চুম্বনেরও হরতাল,


এমন একটি হরতাল যেখানে নিষিদ্ধ থাকবে শ্বাস চলাচল



একটি হরতাল যেখানে নীরবতার জন্ম হবে


স্বৈরাচারীর পলায়নরত পায়ের শব্দ শোনার জন্য।



 জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা


-----------------------------------------



 নিকারাগুয়ার স্পেনীয়-রোমান ধর্মযাজক, কবি জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানার জন্ম ১৯৪১ সালে। তিনি গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনসাধারণের ভেতরে কাজ করতে গিয়ে অবর্ণনীয় শোষণ অত্যাচার দেখে, প্রচন্ড সমালোচক হয়ে ওঠেন সে সবের। লিবারেশন থিয়োলজিতে বিশ্বাসী লাভিয়ানাকে সামোজার ন্যাশানাল গার্ড তাকে দু'বার গোপনে হত্যার চেষ্টা চালায়। তিনি দেশত্যাগ করে কোস্টারিকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয় দেশত্যাগী সান্দানিস্তা ন্যাশানাল ফ্রন্টের বিপ্লবীদের সঙ্গে। তিনি তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের সাথে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পান এবং FLSN এ যোগ দেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে কোস্টারিকা সীমান্তে সান্দানিস্তা গেরিলা বাহিনীর ইউনিটে তিনি ছিলেন,যেটি পরে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়,সেখানে নিহত হন জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা।


              বিপ্লবের পরে নিকারাগুয়ার খ্যাতনামা কবি আর্নেস্তো কার্দেনালের তত্বাবধানে তাঁর লেখাপত্র ও কবিতাগুলি সংকলিত হয়।



 সরোবরে ধ্যান



নদীতী

রে ধ্যানস্থ এই তোমার থেকে আমি অনেক দূরে


সুরচ্যুত স্বরলিপি বাঁধছি এখন আবার সুরে সুরে


অবিরাম ঢেউ বুনছি নিবিড় শব্দ পুরে ছন্দে এবং ভাষায়


যেমন ছিল সেই সে লিপি পেলাম ফেরত তরঙ্গরা আসায়


সরোবর ফের পাঠ বলে যায়


জল নাচিয়ে ফেনায় ফেনায়


আবার বলে এবং আবার কন্ঠে তুমুল সেই অবিরাম নাম


মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তির সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!



 --------------------------------------------------------------------------------------------


[সংগৃহীত ও সম্পাদিত]


কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার


১). অনুবাদক - মৃন্ময় চক্রবর্তী


২). স্বপন রায়।







Monday, October 30, 2023

অপহরণ কিংবা খোঁজ - সাদ্দাম প্রমিথিউস || Opohoron kinba Khonj - Saddam Promithius || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 অপহরণ কিংবা খোঁজ

   সাদ্দাম প্রমিথিউস


অ্যান অ্যান্সিয়েন্ট সেমেট্রি। আ ল্যান্ড অফ ডেথ। আমার স্বর্গপুরী। বিকেল ভেংগে এলে, কবরের ছায়ায় আমি উৎকট কণ্ঠে কবিতা উচ্চারণ করি। হাজার বছরের লাশ, জেগে ওঠে জীর্ণ কংক্রিট থেকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ। নগ্নদৃশ্য। উফফ উচ্চারণের কবিতা বিভ্রাট আমার দারুণ লাগে .......উফফফ!!! এসো অযাচিত প্রেম, তোমার চুলে গুঁজে দিই কবর থেকে ফুল। আর প্রতিটি ফুলে লেগে আছে এক একটা মৃত্যু-পূর্ববর্তী সংকল্প। এমন কি তোমার আমার। খুঁজে নাও এ ভগ্ন-কবর দেহে 



আরেকটু বিকেল গড়ালে, দেহ থেকে দেহে প্রেম খুঁজি । মৃত্যুর পরোয়ানা লিখি তোমার আঁচলে। আলোর বিপরীতে এসে। অপহরণ.....


এখানেই, প্লুটোর পাথর দেহে আমায় খোঁজো......




জীর্ণ পৃথিবী - রিঙ্কু পাল || Jirna Prithibi - Rinku pal || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 জীর্ণ পৃথিবী 

         রিঙ্কু পাল 



পৃথিবীটা পুড়ে যাচ্ছে ঘুষঘুষে জ্বরে ।

ঘামে ভেজা আস্তিন গুটিয়ে আমরাও যাচ্ছি ক্ষয়ে

কতকটা বা সয়ে প্রখর তাপের দহন ।

হাঁড়িতে ফুটছে জল অথচ চাল বাড়ন্ত ।

বিশ্ব-জোড়া খিদে থেমে থাকে না ; 

নেমে পড়তে হয় সকলকেই 

রোজনামচার অলিতে গলিতে 

কিনে নিতে হয়; ছিনিয়ে নিতে হয় 

মুখের গ্রাসাচ্ছাদন অথবা ফুটপাথ যাপন ।

তারই মাঝে চিনে নিতে হয় জাত গোখরো 

নয়তো খেতে হয় বিষাক্ত ছোবল। 

ভাঙছে-গড়ছে রোজ নদীটার এ-কুল ও-কুল ।

তবু রোজ নদী-পাড়ে বসত গড়ে মানুষ। 

জীবনের ভাঙাগড়া খেলায় বসে সংসারের মেলা ।

জীবিকা-জীবন-সম্পর্কের নিক্তিতে মাপা হতে হতে 

মানুষ ধুলো-কাদা মাখা পৃথিবী থেকেই 

ওড়া'য় সুখ দুঃখের ফানুস। 

এদিকে ক্রমবর্ধমান জীবনের মাশুল গুনতে গুনতে

জীর্ণ পৃথিবীও জীর্ণতর হতে থাকে 

পুড়ে যেতে থাকে ঘুষঘুষে জ্বরে ।

দ্বিতীয় কোন নিক্তি নেই - চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী || Ditio kono nikti nei - Chiranjeet vandari || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 দ্বিতীয় কোন নিক্তি নেই

     চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী



আতসকাচেরও মুখ থুবড়ে পড়ে 

চরম ভাবে ঠকে বাড়ি ফিরে আসা যখন সুনিশ্চিত 

বুকের ভেতর কেবলি এক কুয়াশার পাহাড়

যতই ভাঙি ততই সে বাড়ে দুরন্ত কলেবরে।


এতই সস্তা কী?যে তুমি চিনে নিয়ে

টানবে বিভাজন রেখা

প্রেমিকের বেশে থাকা সুজনের এমনই প্রীতিময় ব্যবহার 

যার মাধুরি মধু টানে কে না হয়েছে মশগুল 

সুগভীর বিশ্বাসে।



মাথা ঘামানোর খুব একটা দরকার নেই 

তুমি শুধু এগিয়ে যাও দুর্বার গতিতে

প্রতিভার আলো বিচ্ছুরণের মতো

দ্বিতীয় কোন নিক্তি নেই মানুষ চেনার।

নতুন জন্মদিন - সৌহার্দ্য মুখার্জী || Notun Jonmodin - Souhardho Mukherjee || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 নতুন জন্মদিন

    সৌহার্দ্য মুখার্জী



আমার বাড়ির পাশে একটা নদী থাকুক।

নগর সভ্যতার কোলাহল ছাপিয়ে তার ভাষা তীব্রতর হোক।

আমার বাড়ির পাশে থাকুক দেবদারু, পাইনদের বিরাট পাহারা।

আর থাকুক পাহাড়ি সর্পগন্ধার দল।

চাঁদের আলো আমায় স্নান করিয়ে যাক প্রতি রাত্রে।

আমি ঘাসের সবুজ গালিচাই শুয়ে ওই চাঁদের আলো মদিরার মত পান করব

আমার বাড়ির পাশে থাকুক আদিত্য রশ্মি মাখা পাহাড়ের দল।

তাদের কোলে দাঁড়িয়ে আমার দর্পের সমাধি বানাতে চায়।

আমি ভোরের কুয়াশায় তামাকের ধোঁয়া মিশিয়ে দেবো প্রতিদিন।

আমার বনানী ঘেরা বাড়ি থাকুক একটা।

যেখানে আবিষ্কার করব আমার নতুন জন্মদিন।


স্বাধীন - সুমিত কুমার রানা || Swadhin - Sumit Kumar Rana || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 স্বাধীন 

সুমিত কুমার রানা



স্বাধীনতা?

সে তো অলীক এক কল্পনা। 

সাম্রাজ্যবাদের থাবায় সাধারণ আজ শিকার ছাড়া কিছুই নয়.....

সাম্যবাদ পুঁজিবাদের পায়ের নীচে পৃষ্ঠ হয় সকাল থেকে সন্ধ্যায় !

মৌলিক অধিকারের হরনে তবু মোরা স্বাধীন, মোরা সবাই স্বতন্ত্র....

মুখ খুললে, উচিৎ বললে সর্বশান্ত হই, লাশ হই।

কতো জন মর্গে, কেউ হয়েছে কাক, চিল, কুকুর, শকুনের আহার !

খবরদারি শুধু ওরা দেখায়, আইন কানুন আছে যতো সব আমাদের তরে-

দিনের শেষে লেলিয়ে দিল, ব্যাস!

আমরা স্বাধীন বলির পাঁঠা,

আমরা সবাই জগতের সাধারণ খেটে খাওয়া লোক।

আশা থাক বুকে ধরা - ঝুমা করাতি || Asha thak buke Dhora - Jhuma korati || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 আশা থাক বুকে ধরা

          ঝুমা করাতি



অমানিশা ঘিরে ধরে কালো ছায়াময়,

ঠোঁটে ধরা নিকোটিন কলজের ক্ষয়।

মার বুকে শিশু কাঁদে অমৃত অভাবে,

হায়না নেকড়ে ঘোরে মাংসের লোভে।

পুড়েছে নরম হৃদয় হয়েছে কঠিন,

পোড়া গন্ধে পচে যায় মনের গহীন।


দীর্ঘ এক সুখ ঘুমে আমি চেয়ে দেখি,

ছাই এর গাদায় ছোট জীবনের উঁকি।

কচি পাতা দুলে ওঠে শীতল হাওয়ায়, 

মায়ের স্তন্য ভরা মাতৃ সুধায়।

পথি মাঝে ভিক্ষুক ভিক্ষা ছেড়ে ,

জীবনের সুর ভাঁজে একতারা ধরে।

নিকোটিনে পোড়া ঠোঁটে জীবনের গান

আনন্দ মুখর হয়ে নেচে ওঠে প্রাণ।

জ্যোৎস্না দিয়েছে ঢেলে আলোর হাসি,

মানুষে মানুষে হোক ভালোবাসা বাসি।

শিকারির শিকার - আঁখি রায় || Sikarir Sikar - Ankhi Ray || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

শিকারির শিকার

        আঁখি রায়



কালো আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে নরম সবুজ প্রাণগুলো ৷

হাত বাড়ালেও পায় না নাগাল শান্ত শিখার আলো ৷

বন্ধ ঘরের চার দেওয়ালে আটকে থাকে অবিচার ৷

সিলিং ছোঁয় অশালীনতা, অট্টহাসি আর চিৎকার ৷

সুযোগবাদী নরপিশাচরা প্রতিশোধের আগুন জ্বালে ৷

নিকোটিনের ছ্যাঁকা দিয়ে নবীন বরণ উৎসবে মাতে ৷

নোনা জলে চাদর ভিজলেও ,প্রতিবাদের মুখে কুলুপ ৷

তুললে আওয়াজ হুমকি দিয়ে শাস্তি দিতে হয় উন্মুখ ৷

রঙিন জলে শরীর ভিজিয়ে,আধুনিকতার বুলি আওড়ায় ৷

বর্বরতা ঠোঁটে রেখে,স্বল্প জ্ঞানে ঝুলি ভরায় ৷

আজ মনুষ্যত্ব গ্রাস করেছে হিংসাত্মক প্রতিযোগিতা ৷

কলার ধরে নামায় মাটিতে,আইন গৃহে পৌঁছায় না কথা ৷

ব্যথায় মোড়া স্বপ্নগুলো চাপা পড়ে যায় বইয়ের ভাঁজে ৷

স্তব্ধ হয় বাঁচার তাগিদ, কোল খালি করা হাহাধ্বনি বাজে ৷

ভোলার মহালয়া শোনা - নিখিল মিত্র ঠাকুর || Volar mohalaya Sona - Nikhil Mitra Thakur || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 ভোলার মহালয়া শোনা

     নিখিল মিত্র ঠাকুর



শিউলি ঝরা ভোরের বেলা,

শুনবে মহালয়া,

রেডিও খুঁজে বেড়ায় ভোলা,

ঘরময় চরকি দিয়া।


গিন্নি ঘুমায় নাক ডাকিয়া,

টেনে তোলে ভোলা,

বলেন গিন্নি দাঁত খিঁচিয়া,

মাচায় আছে তোলা।


নামায় ভোলা ধূলা ঝেড়ে 


সারা বছর পরে,


রেডিও শুধুই বলে কে রে?

আমায় হাতে ধরে!

জ্যোৎস্না - উৎপলেন্দু দাস || Jyotsna - Utpalendu Das || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 জ্যোৎস্না

 উৎপলেন্দু দাস



এখনো আঁধার নামে আনন্দ মুছে

দিবসে নিশীথে না বলে কয়ে

চোখ ভেসে যায় চোখের ভিতরে

অপেক্ষায় কেটে যায় প্রতিদিন

খুঁজে ফিরি তোমায় আকাশ জুড়ে

এই জনমের জননীর স্নেহ করুণার আলো

পরম পাওয়া ছোট্ট যাত্রা পথে

রেখেছে কৃতজ্ঞ অন্তর সদা আলোকিত করে ।


তারপর আঁধার মুছে হেসে ওঠে 

সেই মায়াবী আলো

তারারা সরে যায় ঢের ঢের দূরে 

অজগরের মত এক অমোঘ অনুভূতি 

অদম্য আকর্ষণে টানতেই থাকে

জ্যোৎস্না নাম্নী সেই মানবীর কাছে পেশ

যে রেখে ছিলো জঠরে আমায় দশমাস ধরে।  

প্রেমের সাক্ষী - জয়ন্ত কুন্ডু || Premer Sakkhi - Joyntu kundu || Kabita || কবিতা || Bengali Poems || Bengali poetry

 প্রেমের সাক্ষী

        জয়ন্ত কুন্ডু




তোমার আমার প্রেমের সাক্ষী নদীর প্রতিটি ঢেউ,

আকাশের ওই বাঁকা শশধর, প্রেমের সাক্ষী সে-ও|

আকাশের সব ছোট বড়ো তারা প্রেমের সাক্ষী আছে,

দু'জনের নাম লেখা আছে দেখো বনের প্রতিটি গাছে|

পার্কের যত ঘাস আর গাছ প্রেমের সাক্ষী তারা,

প্রেমের সাক্ষী কালো মেঘ আর প্রতিটি বাদলধারা|

রাস্তার মোড়ে রাস্তার বাঁকে আমাদের শুধু স্মৃতি,

কলেজের প্রতি বেঞ্চিও জানে আমাদের প্রেম-প্রীতি|

সিনেমা হলের কোণার সিটটা আমাদের কথা জানে,

প্রেমের কাহিনী ভেসে ওঠে যেন রবি ঠাকুরের গানে|

আইসক্রিম ও ফুচকা জানে তো দু'জনের কথা যত,

বাইকের সিট সেও তো সাক্ষী প্রেম যে করেছি কত|

রেস্তোরার যে টেবিল চেয়ার, সাক্ষী তারাও আছে,

প্রেমের সাক্ষ্য রাখা আছে সব যেন প্রকৃতির কাছে|