Friday, November 3, 2023

How blue is the Sapphire - Bhaskar Sinha || Short story || Prose || English Story

 How blue is the Sapphire


         Bhaskar Sinha




It was an arduous and over stretched journey, being the only son of a village usurer going to a reputed medical college to the capital city of the country. The closed and unswaying mind dazed with the enormous lights, sounds and extravaganza.


…And there were Naveen, the classmate who seldom went to the class, but reading novels and poetry most of the time in his cosy hostel bed. The whole world admired him with an awe. To get his trivial attention, Avi was ever than fervent. If any time he was searching for some bucks, he was more than eager to open his purse. If Naveen was picking one or two big notes, Avi was reaching for cloud nine.


Shelly, Byron, Keats, Dante, Vinci, Shakespeare, Voltaire, Ruanda, Michelangelo, Picasso, Oscar Wilde, Tolstoy, Mark Twain, Dostoevsky, Nabokov, Pasternak, Pablo Neruda, Chee Guevara, Mao, Mandela, drama, music, guitar and some many other first heard words from the mouth of Naveen captivated Avi. He wanted to be orbited around him, but Naveen used to spin on his own axis and had other planets in his sphere and numerous satellites surrounding him. To Naveen, Avi might be a silly comet at the most.


Avi’s Babuji had a writhing life and fought poverty with tooth and nail. Now people feared him not because he was asking for a huge interest on loans, or he had plenty of properties, but his self-styled obeyed hoodlums could do anything and everything just by the drop of his hat. Babuji very much wanted him to settle down in the village itself. Given chance, he started lecturing him on the rural development and the human welfare. When in particular there was no qualified doctor at the village, it should be Avi’s moral responsibility to treat the ill-nourished villagers. Avi understood the inner meanings of those lectures and responded diligently that rural development was the government duty and his agenda was the utilisation of his knowledge properly for the betterment of humankind, including himself. Babuji was shocked when Avi planned his post doc plan at the overseas. He tried his best to pull Avi back and he tried all his judgements to fly away.


Arcita could have stopped him. Her parents, Avi’s maternal aunt and uncle left for the heavenly abode while a trip to Uttrakhand. The ill-fated cab slipped and shattered into pieces from almost six thousand meters top down. It was an enigma that how an Oak branch pinned her tiny ruffle romper during that mighty fall and kept her hanging and alive. Babuji calmly acknowledged the brave police volunteer, Tiwariji’s super human hill climbing ability with a rope and reaching her by taking chance on his own life.


Arcita was like a fresh air in that dogmatic village atmosphere. Small talks, gossips, ponds, never ending melodramas, etc. etc. all were stifling, but Arcita was far away from those sully muck. Even they came pretty close during their teenage years while spending some lazy summer afternoons, but lastly the butter remained intact, not got clarified. May be Babuji’s strong village ethics in the back of his mind and Arcita’s virtuous innocence saved those days.


Arcita used to realise her life with songs and flowers. The village boys were too lesser taste for her, but in one summer break Naveen visited my village from nowhere and how Babuji whisked away both of them and got them hooked, still not very clear to Avi. Interestingly neither Naveen nor Arcita are in touch with him now. Avi even doubt that whether Babuji keeps a tab of any one of them. He sincerely and secretly hopes that she still loves her songs and butterflies like before as well as was talking gently with the Kash flowers in a windy autumn afternoon. Probably Naveen also still immersed himself into Wordsworth, Beatles, John Lennon, John Denver, Bob Dylan and other great’s works.


Avi understood Babuji’s difficulty of a clear conversation with his own adult educated posterity. Inheritor should follow his footsteps- that was his yearning. Avi was nonchalant. Babuji even pretended health scares to bring Avi back several times. Sometimes Avi returned hurriedly stopping all the work. After some time Avi fathomed those melodramas and tried to reason with him calmly, but he would not listen. Poor Babuji never appreciated that Avi’s anchorage was now somewhere else.


Though how cruel it may be, but Babuji’s and his thought processes are quite divergent now and will never meet. Globe itself has turned into a village and it is of no use to remain confined in an isolated pond. Avi though respects Babuji and will continue to perform his duties towards him, but for sure, he would live his own life. Avi though becomes frustrated with these theatrics sometimes, currently takes a fervent resolution that he will continue to serve the humanity in his way. Probably that will be his way to pay a scant tribute to his beloved Bibhutibhusan, Apu, Ray, and Sarbajaya.

Love is precious - Mausumi Pramanik || Poem || English Poem || Poetry

 Love is precious

Mausumi Pramanik



I wish…If I would have escape from this crowded city,

You could not find me any more…What’s a pity!

Think for a while…I would have been the green bird,

Residing on the top of the palm tree,

You could only see, but could not touch me…as I should have been free.

If I would have been the crystal clear water of a river,

You can feel my coldness, but are unable to hold me ever,

Suppose…I am the wildly wind blowing over the green grasses,

You can take only deep breath…but can’t grasp me…

So it’s better to stay away not to rush like a bee…

Nothing will be achieved except the tremor between the crashes.

I wish…If I would have been lost from this cruel atmosphere,

You will miss me either…or my love…for sure…my dear.


Therefore…do you know what these moments actually show?


Love is more precious than life…don’t let it be go…

Thursday, November 2, 2023

জেনে শুনে বিষ করেছি পান - পাপিয়া চট্টোপাধ্যায় || Jene sune Bish korechi pan - Papiya Chottapadhy || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 জেনে শুনে বিষ করেছি পান

     পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়



দেবারাতি সঙ্গে প্রথম আলাপ, হোয়াটসঅ্যাপে। ফেসবুক মেসেঞ্জার এর মাধ্যমে। প্রথম প্রথম তার কথাবার্তা চালচলন ভালোই লাগতো। অমন আলাপ তো লাখো গন্ডা মেয়েদের সঙ্গে হয়ে থাকে যাস্ট ক্যাজুয়ালি আলাপচারিতা। ইমোশনে সুড়সুড়ি দেওয়া ম্যাসেজ কার না ভালো লাগে? আসিফের ও লাগতো, ফার্স্ট ইয়ার কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে সদ্য এডমিশন নিয়েছে মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর কলেজে। হাজার হাজার ফ্রেন্ড দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে আসিফ। টোয়েন্টি ফাস্ট জেনারেশন দের রিলেশনশিপ বোঝাতে হয় না। মায়ের বোন মাসি সে সম্পর্ক ভুলে পিসি বললেও একটা ছেলে একটা মেয়ে রিলেশন অনলি লাভ রিলেশনে সিপ সেটা তারা জন্মসূত্রে ই প্রাপ্ত করে নিয়ে আসে। ভাবতে অবাক লাগে যে এখন প্রেম করার জন্য কোন বয়স লাগে না ।অর্থাৎ কোন বয়সের মাপকাঠি নেই । ক্লাস ফাইভ সিক্স এর পড়ুয়ারা দিব্যি প্রেম করে বেড়াচ্ছে। আজকাল কার বাচ্চাগুলো সব হাইব্রিড বাচ্চা ফলমূল শাকসবজির মত। বাচ্চা নয় সবকটা এক একটা চৌবাচ্চা যেন, আসীফের লাইফে প্রেম গলি ধরে অনেক মেয়ে এলো গেলো কিন্তু এই দেবারতি মালটি শক্ত আঁটে গলা টিপে ধরেছে তার। যাকে বলে ছেলে ধরা মেয়েছেলে ।বেশ পোক্তা জালে ফাঁসিয়েছে। অনেক ঘাটের জল খেয়েছো,এখন প্রমিক বাবু জব্দ এক্কেবারে বাঘ বন্দি।ট্যাঁ পুঁ করার জায়গা নেই। উস্কে দিয়ে ফস্কে দেবে ওটি হবে না। বাবু ইনিয়ে বিনিয়ে,এঁদিয়ে পেঁদিয়ে ভালোবাসার গল্প বলে সেঁধিয়ে দিয়েছে ভেতরে। প্রেমের সাতকাহন শুনিয়ে শুনিয়ে মাথা টি চিবিয়েছে কষে। নাকি কান্না কেঁদেকেটে নাটক ড্রামা করে টরে এক্কেরে ঘাড়ে চেপে বসেছে। হূঁ হুঁ বাব্বা ঘুঘু দেখেছো ফাঁন্দ দেখো নি ।সে মেয়ে প্রতি মিনিটে গোটা চারেক সিগারেট ফুঁকে রাত্রে বিয়ার না খেলে চোখে ঘুম আসে না তার। সিগারেটের ভিতর গাঞ্জা সেবন ও বাদ যায় না। মানে যাকে বলে জুয়েল কন্যে প্রেমে ব্যাঘাত ঘটলে ই, বা বিরহে ঘনঘন হাতের ভেইন কেটে বিপদ কান্ড ঘটিয়ে বাসে সে মেয়ে‌। প্রেম করেছ বিয়ে করব না বললে গলা টিপে খুন করবো। তখন তো খুব ফুর্তি গায়ে গা লাগিয়ে পার্কে বসে চুটিয়ে প্রেম করেছ ডেটিং করেছ হোটেলে বেড শেয়ার করেছ। নিকো পার্কে বসে উষ্ণ আলিঙ্গনে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছো। ফুরফুরে মেজাজে টোটো তে বসে গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাস খাচ্ছো। আর বউকে কি খাওয়াবো বললে তো চলবে না। সে কথা বলার সাহস ও নেই প্রেমিকের। প্রেমিকা হবু বরকে গলা টিপে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে হুমকি ও বলা যেতে পারে।কর্তীর ইচ্ছে ই কর্ম। আসিফের হবু স্ত্রী চায় না যে তাদের লাভ স্টোরি তে কোন তৃতীয় ব্যক্তি বা থার্ড পার্সেন কারো আবির্ভাব ঘটুক বাবা মা আত্মীয় অনাত্মীয় তাদের দুজনের সম্পর্কের মাঝখানে নট অ্যালাউড ।কেবল ইউ এন্ড আই ।তুমি এবং আমি ।কোন দরকার নেই পাড়া পোড়সী পিসি মাসী ,সব দুমুখো আত্মীয়দের গান্ডে পিন্ডে তিনদিন ধরে চারবেলা পেটপুজো করিয়ে।সব নাকি মানি ওয়েস্টেজ। শাশুড়ি মা জেনেশুনে মদো মাতাল গাঞ্জাড়ি বৌমা কে বরণডালা ঘুরিয়ে বরণ করে নিশ্চয় ঘরে তুলবেন না।মুসলমানের ছেলে হিন্দু র মেয়ে কে বিয়ে করবে। ছেলে র বাড়ি থেকে কোন আপত্তি নেই। ওরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । মানে সংখ্যা য় কম । বিয়ে করে হিন্দু র মেয়ে টানতে পারলে সংখ্যা য় বাড়বে ‌ ।ওদের ধর্মে নাকি বলা আছে যত পারো হিন্দু মেয়ে বিয়ে করো। এন্টনি পড়েছে মহাপাপ এতদিন প্রেম পর্ব চুটিয়ে চলছিল ভালোই। এবার সেই অতি কঠিন কাজ অতি কঠিন ক্ষণ বিয়ে করতে হবে করতেই হবে নইলে প্রেমিকার সাফ কথা হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করবে । নিজের গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়বে সিলিং ফ্যানের গলায়। নয়তো রেললাইনে বুক পেতে দেওয়া কেউ রদ করতে পারবে না। এর আগে ও বারকয়েক ঘুমের বড়ি গুঁজেছে মুখে। এমনকি হাতের শিরা কেটে ফটো তুলে রক্তাক্ত ছবি পোস্ট করেছে ফেসবুক প্রোফাইলে সেন্ড করেছে আসিফকে ও । প্রেমিকাকে বিশ্বাস নেই কোন যাকে বলে ভালোবাসায় উন্মাদ ।প্রেম পাগলী ।মোবাইলের ভিডিও ক্যামেরা হাতের শিরা কেটে লাইভ ভিডিও বহুবার করেছে। সেদিন ব্লেড দিয়ে খচাক্ করে হাতের শিরা কেটে ফেলল দেবারতি ।হুলুস্থুল পড়ে গেল লেডিস হোস্টেল তড়িঘড়ি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা হল । হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল দেবারতি কে। পুলিশ কেস। ভিডিও টিডিও দেখে টেখে বারকয়েক পুলিশ ও থ্রেটনীং দিয়েছে আসিফকে। সে অবশ্য বিয়ে করবে না সে কথা বলেনি কোনদিন বলার মত সাহস নেই শুধু সময় চেয়েছে করুণাময়ী প্রেমিকার কাছে বারবার বুঝিয়ে বলেছে দেখো আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান । তাদের কতো আশা আমার উপর বল তো? অন্তত গ্রেজুয়েশন টা কমপ্লিট করতে দাও। দয়া করে রোজ রোজ কেলোর কীর্তি করোনা ।লোকে বলে প্রেম করলে শরীর মন ভালো থাকে, মেজাজ ফুরফুরে থাকে ,আহ্লাদে আনন্দে গদগদ থাকে মন। এখন দেখছি প্রেম করে আসিফের পেছনে বাঁশ হয়েছে। প্রেমিকের গলায় প্রেমের ফাঁস পরিয়ে, প্রেমিকা গলায় ওড়নার ফাঁস পরছে দিনে পাঁচবার করে। ইমিডিয়েট রেজিস্ট্রি করতে হবে ইডিয়েট প্রেমিককে কোন কিউজ শুনতে রাজি নয় আধা উন্মাদ প্রেমিকা। আজকালের মেয়েগুলো ঐরকমই নিজের সাড়ে সর্বনাশ টা নিজেই টেনে নিয়ে আসে ।সমাজে নারী সুরক্ষার জন্য কত কিছুই তো হল কিন্তু নারী অরক্ষা উত্তরোত্তর বাড়ছে বই কমছে বলে তো সমীক্ষা বলছে না ।বর্তমান ইয়ং লেডি উশৃংখলতা কে স্বাধীনতা বলে মনে করে ।স্বেচ্ছাচারিতা কে স্বাবলম্বী বলে ধরে নেয়। ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াবো যা খুশি তাই করব বড়দের তোয়াক্কা করবো না বাপ মা কে ব্যাকডেটেড ছাড়া বলবে না ।এটা ই আজকের নারী চরিত্র।জীবনে বড় হতে গেলে সসম্মানে বাঁচতে চাইলে জীবনদর্শীদের সৎ পরামর্শ যে কতটা দরকার সেটা আজকের প্রজন্ম মানতে নারাজ নিজেরা বিরাট আধুনিক সবজান্তা ভাব ।বাপের পয়সায় ফুটানি মেরে হাতে বিশাল সেলফোন তাতে দু-চার টি হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুক টুইটার এসব নিয়ে নিজেদের বিশ্বসেরা জ্ঞানীগুণী বলে মনে করে শরীরে হাফ ইঞ্চি করে কাপড় জড়িয়ে আধাউলঙ্গ শরীর খেলিয়ে খেলিয়ে পুরুষের সেক্স এ সুরসুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াবে। সেযুগের রমনী কুল এমনটা হলে নরেন, নেতাজি দের জন্ম হোত না।এ যুগের মেয়েদের চরম দুর্দশার জন্য দায়ী কেবলমাত্র আলট্রা মডার্ন অল্প শিক্ষিত উৎশৃংখল মেয়েদের একাংশ এদের রাশ টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন তম দিন অপেক্ষা করে আছে। বলবেন এটা ফেমিনিজমের যুগ আরে মশাই রাখুন তো , এক পেট মদ গিলে, ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে বাড়িতে না জানিয়ে হোটেল রেস্তোরায় গন্ডা গন্ডা পুরুষের সঙ্গে রাত কাটালেই ফেমিনিজম হয়না ।একের দোষে অন্যের মরণ । বলবেন ড্রেস নিয়ে সমালোচনা কেন ?যে যা খুশি পরতে পারে ।পুরুষেরা গামছা পরে বা জাঙ্গিয়া পরে ঘুরে বেড়াবে তার বেলা দোষ হয় না যত দোষ মেয়েদের বেলায় কেন?আরে বাবা পুরুষের তো আর ইজ্জত খোয়ানোর ভয় নেই তথাকথিত পুরুষ হচ্ছে পেতলের কলসী। আর রেপ হওয়ার ও আশঙ্কা নেই ।দেশেটার নাম ভারত বর্ষ এখানে মেয়েদের লজ্জা ই মেয়েদের আব্রু। এদেশের সংস্কার মেনে ই চলতে হয়‌ যস্মিন দেশে যদা চারং। কোথাও কি শুনেছেন পুরুষ ধর্ষন হয়েছে? ধর্ষিতা হয় নারী ।তাই নারী দের একটু সংযত তো থাকছেই হয়। বেআব্রু রমনী বড়ই দৃষ্টি কটু। মাপ করবেন আমি একজন নারী সর্বোপরি আরেক নারীর মা ও তাই নারী কুলের মঙ্গলকামনার্থে কথাগুলো বললাম। অপসংস্কৃতি গ্রাস করেছে সমাজকে। মেকি সংস্কৃতির আস্ফালনে উন্মত্ত নারীকুল। নিউ জেনারেশন বলছে একেই বলে বিশ্বায়নের যুগে। প্রেমে অশান্তি বেকারত্ব ফাস্ট্রেশন ডিপ্রেশন সবমিলিয়ে ইয়াং জেনারেশন নাস্তানাবুদ ।এসবের থেকে বাঁচার পথ একটাই নেশা । নেশায় ড়ুবে থাকা।একমাত্র পথ।ভেতরে ভেতরে ইয়ং জেনারেশন খোঁকলা হয়ে পড়েছে।এরা সকাল দেখেনি কোনদিন।রাতভর মোবাইল নিয়ে মস্তি তারপর সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুম। গাঁজা র ঘোরে উলটে্ থাকে।চন্দ্র সুর্য এদের দর্শন পায় না। প্রকৃত অর্থে এনারাই বঙ্কিমবাবুর , বাবু চরিত্র । সিগারেট গাঞ্জা মদ মেয়ে মানুষ একটার পর একটা প্যান্ট জামা চেঞ্জের মতো প্রেমিকা চেঞ্জ।প্রেম বিবাহের না আছে গ্যারেন্টি না ওয়ারেন্টি।চঞ্চল মস্তিষ্ক উন্মাদ যুবসমাজ আগামী যুগের ত্রাতা ।এরা নিজেরা নিজের ই ভার বইতে পারে না । সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পা টলমল করছে সবসময়।তাই দেশের ভার বৃদ্ধবাবা-মায়ের ভার সংসারের ভার এরা নিতে পারবে, এমন আশা এদের উপর না করাই যুক্তিযুক্ত। রক্তাক্ত প্রেমে নাস্তানাবুদ আসিফ কলেজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে বাড়ি এখানেই সব শান্তি। সর্বসুখ বাবা মায়ের কোলে জ্বলন্ত হৃদপিণ্ডটা মার কোলে ফেলে দিয়েছে ।মনে শান্তি নেই আ্যবনরম্যাল বিহেভ। কখন কি বলছে না বলছে ,কি করছে না করছে ,কোন হুস নেই তার।বাড়িতে সব সময় যেন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে ।প্রেমিকার সঙ্গে রাতভর তর্কাতর্কি বিনিদ্র রজনী যাপনে চোখের কোনে কালি পড়েছে।কখন ঠান্ডা লড়াই তো কখন খুনোখুনি। ফোনে ফোনে মারামারি চিৎকার চেঁচামেচি গলাবাজি। এদিকে বাবা-মায়ের অস্থির প্রাণ ছেলের জন্য অধীর হয়ে থাকে।*সবে ধ্বনী নীল মনি।এক মাত্র সন্তান আর স্বামী স্ত্রী ছোট্ট সুখের সংসার সুজাতার।কার যে কুনজর পড়েছে ঈশ্বর ই জানেন। ছেলে কে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। খাওয়া দাওয়াতে আগ্রহ নেই। চোখে ঘুম নেই ছেলের সারা টা রাত ধরে ফোনে বক্ বক্ । চোখের কোণে কালি পড়ে গেল বাছার আমার।মনে মনে চরম অশান্তি তে ভুগছে। তবু বাপ মা কে কিচ্ছু টি বলবে না মুখ ফুটে।সুদেব বাবু, আশীফের বাবা তিনি অত্যন্ত চিন্তান্বিত ছেলেকে নিয়ে গিন্নি কে খেঁচাতে থাকেন সবসময়,জানাতে আপত্তি টা কোথায়? প্রেমে টেমে পড়েছে মনে হয় তোমার ছেলে। হাতেই পারে।এ বয়সে প্রেম হবে না তো কি পালক বেরুবে।বাপ কে মোটা মুটি সমঝেই চলে সে। অতটা ফ্রাঙ্ক নয়।সুদেব বাবু ও টেঞ্জড্ ছেলের বিষয়ে। চিন্তা গ্রস্থ সুরে বললেন স্ত্রী কে ছেলের কাছে জানতে চাও কি প্রবলেম তার?সুধোও তাকে আমরা তো এখনো বেঁচে আছি।মরি নি তো। আমরা তো বাবা মা নাকি সমস্যা থাকলে জানতে অসুবিধে কোথায়?যা করছে করুক।বাধা নেই। ছেলে বড় হয়েছে করতেই পারে। তাতে অত টেনশনের কি হোল? বিয়ে করতে চাইলে বলুক সাধ্যমত খরচা পাতি করে সামান্য ধুমধামের সঙ্গে বিয়েটা দিয়ে দেব।দুকোটি টাকারও বিয়ে হয় আবার দু লক্ষ টাকার ও বিয়ে হয়।দু টাকার ও বিয়ে হয়।যার যেমন সাধ্য। বাবা সামান্য স্কুল মাষ্টার জীবন সম্বল বলতে যা রেখেছেন ছেলের সুখের জন্য তাও ঢালতে রাজি আছেন। ‌আমাদের সে ছাড়া আর কে বা আছে?যা কিছু সঞ্চয় সব তো তার ই জন্য।মানলুম আমি ছেলের কাছে অতটা ট্রান্সপারেন্স নই। তোমাকে তো সবকথা খুলে বলতে পারে সে।


আমার এই লেখা টি মৌলিক এবং অপ্রকাশিত। 

পরিচিতি,নাম পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়। পিতার নাম,রবিলোচন মুখোপাধ্যায়।মাতার নাম, মেনকা মুখোপাধ্যায়। জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার পাবড়া গ্রামে। পুরুলিয়া জেলার চয়েন পুর গ্রামের গৃহবধূ।লেখার প্রতি প্রেমে লেখালেখি তে মনোনিবেশ। 

প্রবাহঝড়ের রাত্রিনাচন - মনোজ মন্ডল || Prabhao Jhararer Ratrinachon - Monoj Mondal || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

  প্রবাহঝড়ের রাত্রিনাচন

                  মনোজ মন্ডল


খরপ্রবাহ বৈশাখের দুপুর, রাস্তা দিয়ে গাড়ি মাইক বাজিয়ে আসে আবার মাইক বাজিয়ে চলে যায় ; কে কোন দলের মন্ত্রশক্তি নিয়ে আসছে তা শুনেই বোঝা যায়। এই গাঁয়ে থাকেন ভূদেববাবু মহাশয় ,তার ভালো নাম ভূপতিচন্দ্র মন্ডল ,একালের ছেলে কিনা তাই বাপের দেওয়া অতবড় নাম রাখতে নারাজ । বাপ তার কোম্পানিতে ট্যাক্স লয় ,এ গাঁয়ে চক্কতী বাড়ি আর তারাই একমাত্র শিক্ষিত লোক বাকি সব চাষাভুষা মানুষ , এমনও লোক আছে যারা দিনানি দিন খায়। ভূদেব এর পিতা পশুপতিচন্দ্র মন্ডল এই গ্রামকে ভীষণ ভালোবসেন তাইতো বাপ ও ব্যাটার মধ্যে মাঝে মাঝে লেগে যায় কোন্দল । 


এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে একটা অভিশাপমুক্ত ফল কাজ করে ! তারা ধর্মে নয় কর্মে বিশ্বাসী , নিজ ধর্ম নিয়ে উভয় সমাজের মানুষ মিলেমিশে তিহার পালন করে যেটা ভূদেবকে খুবই প্রভাবিত করে । ভূদেব সেই জন্যই তার পদবী কোথাও ব্যাবহার করেন না , সে একটা কথাতেই বিশ্বাসী "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"তাইতো গ্রামের মানুষজনও ভূদেবকে খুব ভালবাসত।ভূদেব ও এ গাঁয়ের মোল্লা সাহেবের ছেলে বোবা লতিফ দুজন খুব মিশুকে বন্ধু ছিল । মোল্লা সাহেব এ গ্রামের সৎমানুষ ছিলেন ,কোনোদিন কারো দুটাকা মেরে খাইনি,তাদের পরিবারকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন পাড়ার মানুষজন ,খুব শ্রদ্ধা করতেন মোল্লা সাহেবকে । সেই জন্যই তো পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের চাবি মাষ্টারমশাইরা বিশ্বাস করে মোল্লা সাহেবদের বাড়িতে রাখতো,গত বিশ বছর থেকে তার বাড়িতে ছবি রেখে আসছে কোনোদিন দুটো আলু পর্যন্ত চুরি হয়নি চাল ডাল তো দূরের কথা। লতিফ ছিল মুক্কসুক্ক ছেলে কিন্তু দিমাগ তার তেজ চলত। ভূদেব আজকাল কাজবাজ জোগাড় করতে না পারায় বাড়িতেই বসে লেখালেখি করে আর সেই লেখা লতিফকে শোনায় এবং লতিফও তার লেখা শুনে সহানুভূতি যোগায়। 


এই মরশুমে বিভিন্ন বাড়ি থেকে মাংস ভোজনের নেমন্তন্ন আসে ,বেশ আদর করে পিঠে হাত বুলিয়ে খাওয়ানো হয় , কেউ বাড়ির উঠানে ,কেউ ছাদে ,কেউবা বনে ,কেউবা খেলার ফিল্ড এ ,সবাই ভালোবেসে খাওয়াতে চায় , মোল্লা সাহেবের বাড়িতে নেমন্তন্ন আসে ভরে ভরে , লতিফরা যায় নেমন্তন্ন খেয়ে আসে ,এই মরশুমে গরীব মানুষদের- যারা দিনানি দিন খাটে তাদের একটু হলেও খুব উপকার হয় কিন্তু ভূদেবরা অন্যের বাড়িতে রাতবিরাতে আহার থেকে দূরে থাকে । গায়ের রতন ক্ষ্যাপা রোজ একবার করে ভূদেব কে বলে - কিরে ভূদেব্যা কাইল রাইতে পংখোজদের বাড়ি খেতে জাইসনাই? উত্তরে ভূদেব বলে - গিয়েছি তো দেখাসনাই? তারপর তড়িঘড়ি ভূদেব সেখান থেকে কেটে পড়ে । এভাবেই দিন যায় রাত যায়, চলে আসে বনভোজনের অন্তিমপর্ব এর পর আর খাওয়ার পাবেনা কেউ।


সময়টা ছিল বৈশাখের রাত। আকাশটা সারাদিন ধরেই মেঘলা । মেঘলা দিন থাকলেও ঝড়বৃষ্টির কোনো খবর ছিলনা , ভূদেব রাতের বেলা লেখালেখি শেষ করে ঘুমাতে যাবে এমন সময় বিদ্যুৎ প্রস্থান করলো । বিদ্যুৎ এর কথাটা না বলে আর পারলাম না ,তবে বলি শুনুন ,ছোটবেলা থেকেই ঝড় আসার আগে এই কথাটা ভাবাই ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই বিদ্যুৎ চলে যায় কেনো ? এরকম পরিস্থিতি কলকাতার মত বড় শহরকে পোহাতে না হলেও গ্রামগঞ্জে এইরকম পরিস্থিতি নিত্যই লক্ষ্য করা যায় ; বিদ্যুৎ যাওয়ার ক্ষণেক পরেই ইন্দ্রবিদ্যুৎ এর আলোয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো , জানলার দিকে মুখটা বাড়াতেই দেখি সে কোনো ছোটখাটো ঝড় নয় , এক ভয়ানক দৃশ্য ,সেই মুহূর্তের জন্য মনে হল এমন ঝড় হয়তো এর আগে কোনদিন চোখে পড়েনি, মুহূর্তের মধ্যে শুরু হলো ঝাঁই ঝাঁই - সাই সাই আওয়াজ ,বিদ্যুতের শিখা ও গর গর - ঘর ঘর আওয়াজ, যেনো আকাশ - পাতাল ভেদ করে বেরিয়ে আসছে মানুষখেকো বজ্রপাত ! মনে হচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে সব ঘরবাড়ি ভেঙ্গে তলিয়ে যাবে মাটিতে, বোধ হয় স্বয়ং ইন্দ্রদেব পৃথিবীর মানুষের আচরণের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তার বজ্রবাণ চালাচ্ছেন ,যেন সেই বাণে পৃথিবীর উপর স্থাপিত সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করতে চান ,এভাবেই চললো সারারাতের নরকীয় ধ্বংসলীলা ,এভাবেই কখন ঘুমে লিপ্ত হয়ে এল আমার দুই চোখ বুঝতে পারিনি ।


সকালে মায়ের কান্না শুনে ভূদেবের ঘুম ভেঙে গেলো, মাকে বাইরে কাঁদতে কাঁদতে বেরোতে দেখে ভূদেব বাইরে বেড়িয়ে দেখে অতবড় ডালভরা সজনে গাছটা ভেঙে পড়েছে কালকের ঝড়ের তান্ডবে! সে ভাবে মায়ের সাধের লালন করা ছুটির গাছটা শেষ হয়ে গেলো । ছুটির গাছ পার করে আরেকটু দূরে চোখটা যেতেই দেখে লতিফদের ঘর ভির করেছে পাড়াসুদ্ধ মানুষজন সে ভাবে তাদের বাড়ির ডালপাত ভেঙে আসা আম গাছটা বোধহয় ঝড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে । গিয়ে ভিড় সরিয়ে দেখতে যাবে কি তার মাথায় হাত! স্তব্ধ ভাবে দাড়িয়ে রইল ভূদেব ,নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা ভূদেব । এ আমি কি দেখছি ! একি সত্যি লতিফ ?

লতিফের লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে ,পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রক্তের স্রোত ,শুধু তার একার না, তার পুরো পরিবারের , সেই রক্তে অধিকারের ভির বসিয়েছে বিভিন্ন অঙ্গের পিঁপড়েরা ,তার দিদির নগ্ন দেহ পড়ে আছে উঠানের পাশে বুঝলাম তার ওপর পাশবিক অত্যাচার কম হয়নি, মা গিয়ে একটা কাপড় জড়িয়ে কান্নায় জ্ঞান হারানোর অবস্থা ,আমি থ হয়ে দাড়িয়ে রয়েছি , কান্নায় ভেতর আমার ফেঁটে যাচ্ছে ,হায়রে বোবা লতিফ কাল রাত্রে যদি তোর গলায় ভগবান একটু আওয়াজ দিত, তুই ডেকেছিস অনেক কিন্তু শোনার জন্য সে কান ভগবান আমাদের কাউকেই দেয়নি , তোর বাবা নিশ্চয় খুব চেঁচিয়ে ছিল রে ভূদেব আই পশুপতি বাঁচা আমাদের , তাইতো তার গলায় ছুরি টা এখনও লেগে আছে রে ,

শেষ প্রচেষ্টা করেছে মোল্লা সাহেব স্কুলের চাবি সুরক্ষিত রাখার কিন্তু পারেনি কেড়ে নিয়ে গেছে দুষ্কৃতিরা । ভূদেব এর মাথায় সেদিন একটায় কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল "এই আমাদের দেশ , স্বাধীন হয়েছি আমরা , আপন অধিকারেই তার শেষ "


                                               

এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী - শ্রাবনী আচার্য্য || Eek Obisassho vromon Kahini - Shrabani Acharya || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

এক অবিশ্বাস্য ভ্রমণ কাহিনী

          শ্রাবনী আচার্য্য



সাল টা ছিল ২০১৬।আমি হরিয়ানায় বি.এড এ পাঠরত ছিলাম।পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেই শুনলাম বাবা মা আমাকে না জানিয়েই পুরী বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।শুনে খুব খুশিই হলাম,কারণ আমি ভূগোলের ছাত্রী,বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।তার ওপর বেড়ানোটা যদি পরিবারের সাথে হয়,তাহলে তো একদম সোনায় সোহাগা।যাইহোক,যথারীতি লক্ষী পুজোর পরের দিন আমরা পুরী যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।বাসে উঠেই দেখি প্রায়৬০জন মতো রয়েছেন।সবাই বাবার পরিচিত,কেনকি বাবা ডাক্তার।তাই বাবার খাতিরে,ওনার মেয়ে এবং স্ত্রী হিসেবে আমার আর মায়ের সাথেও ওনাদের আলাপ হয়ে গেল।রাত ১০ তার সময় বাস ছাড়লো রামনগর থেকে।

পরেরদিন ভোরবেলা আমরা নন্দনকানন এ পৌঁছলাম এবং ওখানে চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখলাম।বিকেলে আমরা পুরী পৌঁছলাম।যেহেতু আমরা ট্রাভেলার দের সাথে গেছি তাই পুরীতে থাকার জন্য আমাদের ২দিন বরাদ্দ ছিল।তারপর কোনারকের সূর্য মন্দির,খন্ড গিরি,ধবলগিরি,ভুবনেশ্বর এর লিঙ্গেস্বর মন্দির -এসব ঘোরার পর এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা।৬দিন পর আমরা যখন ওড়িশা দিয়ে বাড়ি ফিরছি তখন বিকেল ৫টা বাজে।ওই রাস্তায় নাকি তারিনী মায়ের মন্দির পড়ে।বাসের সবাই বলছিলেন তারিনী মা নাকি খুব জাগ্রত,ওখানে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবেন।অগত্যা বাসের ড্রাইভার কাকু ওই মন্দিরের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেন।আমরা সবাই নেমে একে একে মন্দিরের দিকে রওনা দিচ্ছি।মন্দিরে ঢোকার মুখেই কয়েকজন ১৫-১৬বছরের ছেলে পুজোর ডালা সাজিয়ে বিক্রি করছে।একটা লাল ওড়না,একটা গোটা নারকেল,আর কিছু ফুল,বেলপাতা ও সিঁদুর ছিল ওই ডালা গুলোতে।যথারীতি আমরা একটা ডালা কিনে পুজো দেয়ার জন্য মন্দিরের মধ্যে ঢুকলাম।মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি,মন্দিরটা বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে।একটা ঘরের মাঝে তারিনী মায়ের মূর্তি রয়েছে,আর মায়ের চারদিকে প্রায় ১০ইঞ্চি দূরত্বে গোল করে পুরোহিতরা বসে রয়েছেন।আমরা একজন পুরোহিত কে পুজোর ডালা ধরিয়ে দিতেই উনি লাল ওড়নাটা নারকেল এর গায়ে বেঁধে দিলেন,তারপর নারকেল টাকে ফাটিয়ে তার জল টা তারিনী মায়ের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন,আর ফুল বেলপাতা ও ওড়না জড়ানো নারকেল এর টুকরো মায়ের কাছে নিবেদন করলেন মায়ের দিকে ছুড়ে ছুঁড়ে।এরকম পুজো দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো আমার।৫মিনিটের মধ্যে পুজোও শেষ হয়ে গেল।তারপর মন্দিরের ভেতরটা আর একটু ভালো করে ঘুরে নিয়ে, মাকে প্রণাম করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।মন্দিরের বাইরে এসে দেখি ফুলের ডালা বিক্রেতা ছেলেটার সাথে আমাদের বাসের ড্রাইভার কাকুর কোনও কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে,আর একটু এগিয়ে এসে শুনলাম যে-বাসের ড্রাইভার কাকুএকজন মুসলিম ধর্মের মানুষ। তাই ওকে পূজার জন্য ডালা নিতে বললে কাকুটি রেগে ওর পরিচয় দিয়ে বলেন-আমি তো মুসলিম, কি করে তোমাদের মন্দিরে পূজো দেব?তুমি ডালা রেখে দাও ভাই, আমি পূজো দেব না।আমরা কিছু না বলেই চলে এলাম এবং যথারীতি বাসে উঠে নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলাম।সবাই না এলে তো বাস ছাড়বে না,তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম চিপস খেতে খেতে।২০-২৫মিনিটের মধ্যে সবাই বাসের মধ্যে চলে ও এলেন।এবার বাস ছাড়ার পালা,আর কোথাও নামবার নেই, সোজা বাড়ি যাব। হালকা ঠান্ডাও পড়ছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো।আমরা সবাই এসে গেছি,ড্রাইভার কাকুও এসে গেছেন, কিন্ত বাস ছাড়ছে না কেন?সবাই পেছনের সিট থেকে বলছেন-কি হল গাড়ী ছাড়ুন,সবাই এসে গেছে তো,আর কেউ বাকি নেই তো।কিন্ত গাড়ি ছাড়ছে না দেখে বাবা উঠে গেলেন ড্রাইভার কাকুর কাছে। কি হয়েছে, গাড়ি ছাড়ছেন না কেন জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার কাকু বাবাকে বললেন- জঙ্গল এলাকা,জায়গাটা ভাল নয়,আমি তো আপনাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইছি।কিন্ত বাস টা যে কেন স্টার্ট নিচ্ছে না বুঝতে পারছি না।এটা শুনেই তো আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল।এই অচেনা অজানা জায়গায় কী এই বাসের মধ্যেই সারারাত থাকতে হবে নাকি?বাসটা আর খারাপ হওয়ার জায়গা পেলো না?এই জঙ্গলের মধ্যেই তাকে খারাপ হতে হলো?এখন কি হবে?আমরা বাড়ি যাব কি করে?ধারে কাছে কোনও দোকান ও নেই যে কোনো মেকানিক কে ডেকে গাড়িটা সারিযে নেওয়া যায়।বাসের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষ ও ছিলেন, তারা প্রায় হই হটোগোল ফেলে দিলেন চারদিকে।আবার কিছু কুসংস্কার মাখা কথাও শোনা গেল,যেমন-কেউ হয়তো অপবিত্র ছিল?বা কেউ কোনও দোষ ত্রুটি করে ফেলেছে?তাই তারিনী মা রেগে গিয়ে গাড়ি খারাপ করে দিয়েছেন। এইসব শুনে আমার প্রথমে হাসিই পাচ্ছিল। তারপর এই হাসিটাই মিলিয়ে গেল যখন ব্যাপার টা আরও গুরুতর হয়ে উঠল। ড্রাইভার কাকু তখন পাশেই একটা ছেলেকে ডেকে বললেন-পাশাপাশি কোন মেকানিক আছে কিনা খবর দিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারবে?আমরা খুব বিপদে পড়েছি।তখন ছেলেটি বলল আছেন একজন,১০-১৫মিনিট লাগবে,আমি ডেকে নিয়ে আসছি।যথারীতি ২০মিনিট বাদে একজন মেকানিক কাকু এলেন। উনি অনেকক্ষন দেখার পর বললেন-কই বাসে তো আমি কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না,বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন?স্টার্ট না নেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। উনি প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলন,কিন্ত কোনও ফল পাওয়া গেল না।তখন ওই মেকানিক কাকু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আমার মালিক কে ডাকছি,যদি পারেন তো উনিই পারবেন,তা না হলে আর কিছু করার নেই। উনি ওনার মালিক কে ফোন করার প্রায় ২৫মিনিট পর ওনার মালিক এলেন।উনিও প্রায় ৩০মিনিট ধরে চেষ্টা করলেন, বললেন- না,বাসে কোনও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।বাস স্টার্ট নিচ্ছে না কেন বুঝে উঠতে পারছি না।তারপর উনি হঠাৎই বললেন ড্রাইভার কাকুকে- যে আপনাদের কোনও ভুল ত্রুটি হয় নি তো?সবাই মায়ের পূজো দিয়েছিলেন?মা কিন্ত খুব জাগ্রত, রেগে গেলে কাউকে ছাড়েন না।আমি তো খুব অবাক হয়ে গেলাম ওনার কথা শুনে,ভাবলাম ড্রাইভার কাকু তো পুজো দেয়নি,তাই কি মা রেগে গেছেন?তখন দেখি হঠাৎ করে ড্রাইভার কাকুর চোখে জল,উনি বলেন আমি মুসলিম, তাই আমি ফুলের ডালা কিনে মায়ের পুজো দিতে চাইনি।তাই কি মা আমার ওপর রাগ করলেন?তখন মালিক মেকানিক কাকু বললেন- আমাদের তারিনী মা,সবার মা।উনি জাতপাত মানেন না,সবাই ওনার সন্তান। আপনি শিগগির যান,স্নান করে ফুলের ডালা নিয়ে মায়ের পুজো দিয়ে আসুন।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।অগত্যা ড্রাইভার কাকু ছুটে গিয়ে পাশেই একটা নদীতে ডুব দিয়ে একটা ফুলের ডালা কিনে মন্দিরে ঢোকার ৫মিনিটের মধ্যেই মালিক মেকানিক কাকু গাড়ি স্টার্ট দিতেই, বাস সঙ্গে সঙ্গেই স্টার্ট নিল।তখন বাসের সবাই অবাক। আমার তো গায়ে প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল।তারপর যথারীতি আমরা তারিনী মা কে স্মরণ করে ৭'৩০মিনিটে বাসে রওনা দিলাম। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।আমরা অনেকে বিশ্বাস ই করি না ভগবান আছেন বলে।কিন্ত সেদিন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম যে-না,ভগবান আছেন ই।আর যে জাতপাত নিয়ে সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে এত ভেদাভেদ, তারিনী মা আমাদের চোখের সামনে থেকে সেই ভেদাভেদ দূর করে দিলেন।তিনি জানালেন যে- "সবাই এক,সবার রক্ত এক,সবার একটাই পরিচয়-সবাই মানুষ। "

বিনির সৌর খোঁজ - মনোরঞ্জন ঘোষাল || Binir Soura kojh - Monoronjon Ghosal || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 বিনির সৌর খোঁজ

      মনোরঞ্জন ঘোষাল



ডোমস শুধু আমাকে মেরে ফেলার প্লান করেছিল এমনটা নয়। সে আমার গবেষণাকে অসম্মান করেছে। তাই আমার গবেষণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন‍্য জেদ খানিকটা সে আমার বাড়িয়েই দিয়েছে। তার মত গবেষকদের মুখে ঝামা ঘসে দিতে আমি আবার আমার গবেষণা ভীত্তিক খোঁজ শুরু করলাম। আগে তো চাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবের দর্শন পেয়ে ছিলাম। সেই কথা বিজ্ঞানী মহলে জানিয়ে দিয়েছি। এবারে সূর্যের দিকে একবার নজর দেব বলে মনে করছি। প্রখর আলোর জন‍্য তার দিকে তো তাকানো যায় না। তার জন‍্য এক বিশেষ ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


এদিকে মাইক্রোস্কোপিক দূরবিক্ষন যন্ত্রটি এখন আমার কাছে একটা মস্ত বড় হাতিয়ার। যেমনটি ছিল গ‍্যালিলিয়ের। তবে এটি গ‍্যালিলিওর টেলিস্কোপের থেকে অনেক উন্নত। আসলে আমি এটিতে অত‍্যাধুনিক প্রযুক্তি ব‍্যবহার করেছি। আমি এক বিশেষ প্রকার লেন্স ব‍্যবহার করেছি এই যন্ত্রে। যেটি সাধারণ লেন্সের কার্যকারিতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিতে পারে। এই পদ্ধতি টিও আমার নিজস্ব।


এক বিশেষ সংকর লেন্স। লেন্সের কাঁচের সঙ্গে বিশেষ ধাতুর একটা শতকরা ভাগ মিশ্রিত করলে তার স্বচ্ছতার কোন পরিবর্তন ঘটে না। মানে কাঁচটি ঘোলাটে হয়ে যায় না। সেই কাঁচ দিয়ে লেন্স তৈরী করলে লেন্সের বিস্ফারিত করার ক্ষমতা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। আসলে ঐ অপদ্রব‍্যটি অর্থাৎ যেটিকে এক সামান‍্য ভাগে গলিত কাঁচে লেন্স তৈরীর সময় মেশানো হল। সেটি স্বাভাবিক কাঁচের তুলনায় অনেকটা ক্ষমতা শালী হয়ে ওঠে। সেই অপদ্রব‍্য মিশ্রিত কাঁচ দ্বারা গঠিত লেন্সের মধ‍্যে আলোর প্রতিসরণ ঘটলে তার চ‍্যুতি কোনকে বাড়িয়ে দেয় বেশ অনেকটা পরিমানে। বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর আমি এই সত‍্যটি উদ্ভাবন করতে সমর্থ হয়েছি। সেই বিশেষ ভাবে তৈরী লেন্স আমি আমার মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপে ব‍্যবহার করে অসাধারণ ফল পাচ্ছি। 


এতদিন ওই দিয়ে আমার সৌর গবেষণাকে যাচাই করার কথা মনে আসে নি। সেটিকে গাণিতিক ভাবে আমি তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা করেছি। পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা হয় নি। আজ ডোমসের ওখান থেকে প্রত‍্যাবর্তন করার এক বৎসর কাল অতিবাহিত হল। সকালে আমার হাত ঘড়িটি আমাকে স্বরণ করিয়ে দিল। আমার এই ঘড়িটি এমন স্মরনীয় ঘটনা গুলিকে ওর স্মৃতিতে ধরে রাখে। আর সময় মত আমাকে মনে করিয়ে দেয়। মোবাইল ফোনেও ঐ কাজ করা যায় তবে মোবাইলের ক্ষতিকর বিকিরণের জন‍্য আমি ওটির ব‍্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। বদলে একটি অন‍্য যন্ত্র তৈরী করায় মনযোগ দেবো বলে মনে করে আছি। 


ডোমসের ওখানে আমি ষোলোই আগস্ট গিয়ে ছিলাম। আর ফিরেছি তেইশে আগস্ট। আজও সেই তেইশে আগস্ট। 


আজ তেইশে আগস্ট ২০১৩ সকাল দশটা। আমার অদৃশ‍্য কাঁচ ঘরটায় সৌর খোঁজে মন নিবেশ করব বলে মন স্থির করে নিলাম। সকলের দৃষ্টিকে আড়াল করে আমি আমার সাধের ল‍্যাবে প্রবেশ করলাম। সেখানে এখন অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ক দিনের জন‍্য আমাকে টেবিলে সৌর দর্শনের যন্ত্রপাতি সব সাজিয়ে নিতে হবে। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছেই সাজিয়ে রাখতে হবে। নইলে সময় মত সব জিনিস পত্র দরকারে পাওয়া যাবে না। আমার স্টেচিং চেয়ারের পাশে যন্ত্রপাতি সজ্জিত করতে শুরু করলাম। মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ যন্ত্রটিকে একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করলাম। যাতে সেটি সূর্যের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমান ভাবে একই কৌনিক মাণের হারে আপনা থেকেই সরতে থাকবে। আমি তো আর সারাটা রাত আর দিন ধরে সব সময় সেই অনুবিক্ষনিক দূরবিন যন্ত্রের কাছে বসে থাকব না। মাঝে মাঝে অন‍্য কাজে সেখান থেকে সরে যেতে হতে পারে। তাই তার পর্যবেক্ষণের ছবি সে আপনা থেকেই তুলে রাখবে। আমার খোঁজের যাতে কোন রকম আসুবিধা না হয় তার পাকা পোক্ত ব‍্যবস্থা বলতে পার। এই সব জিনিস পত্র যথাযথ ভাবে সাজাতে বিকেল হয়ে গেল। সূর্য তখন দিগন্ত রেখার কাছে পৌঁছায় নি। একটি বার যন্ত্রের নলে চোখ ঠেকিয়ে তাকালাম সেই হেলে পড়া সূর্যের দিকে। ভাল দেখতে পেলাম না। লাল রঙের বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ‍্যের আলোক রশ্মি গুলি আকাশে ছেয়ে দৃষ্টিকে অস্পষ্ট করে তুলছে। বুঝলাম তার প্রতিরোধের ব‍্যবস্থা করতে হবে। এই নিয়ে এক সময় মনযোগ দিয়ে ছিলাম। তখন এর প্রতিকার করার জন‍্য এক বিশেষ কোটেড চশমা তৈরী করে ছিলাম। আজ তার কথা মনে পড়ে গেল। সেই তৈরী করা স্পেশাল কোটেড চশমার কথা। যেটি চোখে পরে থাকলে চোখে আছড়ে পড়া উজ্জ্বল বেগ বান আলোক রশ্মিকে বাধা দেয়। ফলে চোখকে অযথা আলোর ঝাপটা সহ‍্য করতে হয় না। ঐ নীতি প্রয়োগ করলাম আমার মাইক্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ যন্ত্রের উপরের লেন্সে। একটি লেয়ার সেই স্পেশাল কোট লাগিয়ে দিলাম তার ওপরে। ফলে অযথা অযাচিত আলোর ঝলকানি আর লেন্সের ভেতর দিয়ে যন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পারল না। তাতে আমার দেখাতে কোন বাধা সৃষ্টি হল না। ফলে আমি আরামে বিনা বাধায় সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। সেই জন‍্য আমার আলোক বিশ্লেষণটা অনেকটা সহজ হয়ে পড়ল।  


আলোক বিশ্লেষণ হল এক বিশেষ কৌশল। যেখানে আলোক রশ্মি গুলিকে পছন্দ মত ভাবে আলাদা করে নেওয়া যায়। আলোক রশ্মি যে কণিকার প্রবাহ তা আমরা জানি। সেই কণিকার নাম নিউটন দিয়েছিলেন ফোটন। তিনিতো আলোর কণিকা তত্ত্বের উদ্ভাবক। প্রমাণ করেছিলেন আলোকের কণিকা ধর্ম। তিনি আলো যে কণিকা সেটি বললেও সে কণিকারা যে আকার ও ভরে ভিন্ন হতে পারে তা বলেন নি। তিনি বলেছিলেন আলোর কণিকা গুলি ধর্মে অভিন্ন। 


এই কথা সত‍্য নয়। আইন্সটাইন তার সমীকরণে সেই কথা স্পষ্ট দেখিয়েছেন। তা ছাড়া সনাতনী বলবিদ‍্যার ধারণাকে বিশ্লেষণ করলেই তা জানতে পারা যায়। সাধারণ আলো আর এক্স লশ্মির কথা ভেবে দেখ? সাধারণ আলোকের তুলনায় এক্স রশ্মির ভেদন ক্ষমতা অনেক বেশি। তা হলেই বোঝ? হয় এক্স রশ্মির কণিকা গুলোর গতিবেগ সাধারণ আলোর কণার তুলনায় বেশি। নতুবা এক্স রশ্মির কণিকা গুলো সাধারণ আলোক কণিকার তুলনায় আকারে অনেকটা ছোট। তবে সম্প্রতি প‍্যারিস-জার্মানিরর এল এইচ সির গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে আলোর থেকে বেশি গতি সম্পন্ন কণিকা আছে। সত‍্যেন বসুর নামে সেই কণিকা কে বোসন বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেকে অবশ‍্য ঈশ্বর কণা বলে সেই ক্ষুদ্রতর কণাকে অভিহিত করছেন। ওই ক্ষুদ্রতর না ওর থেকেও ছোট ক্ষুদ্রতম কণিকার কথা আমি অনেক আগেই বলে ছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম একক কণিকা বা ইউনিট পার্টিকল। এটিও আমার এক অমোঘ ধারণা। আমার বস্তুবাদ তত্ত্বে এর উল্লেখ আছে। 


আসলে বস্তু ছাড়া যে বস্তুর সৃষ্টি হতে পারে না সেটাকেই বলা হয়েছে সেখানে। তার সঙ্গে ইউক্লিডের জ‍্যামিতির ধারণা কে জুড়ে দিয়েছি মাত্র। শক্তি আর বস্তু আদতে এক জিনিস। বস্তুর এক বিশেষ অবস্থা হল শক্তি। বস্তুকে যেমন শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। তেমন শক্তিকে বস্তুতে রূপান্তর করা যায়। আমার ল‍্যাবে আমি তা করে দেখেছি। একটা আলোক রশ্মি থেকে ভারি কণার বস্তু গঠন করেছি। আলোক রশ্মি তো একটি কণা না। অজস্র কণার একটা স্রোত। কোয়ান্টামের ধারণায় এক ঝাঁক কণিকার সমাবেশ বলতে পার। এখন থাক সে কথা।


নানা বর্ণের আলোক রশ্মি আসলে নানা প্রকারের কণিকার প্রবাহ। নিউটনই আলোক রশ্মিকে প্রীজমের মধ‍্যে দিয়ে পাঠিয়ে আলাদা করে দেখিয়ে ছিলেন। চুম্বক ঐ নানা বর্ণের আলোক রশ্মির ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই যেমন লাল বর্ণের আলোক রশ্মি চুম্বক দ্বারা বেশি আকর্ষিত হয়। কারণটা খুবই সাধারণ। এতে লোহার কণা থাকে তাই। এই ভাবে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতিতে আলোর কণা গুলিকে আলাদা করে দিয়ে আমি আমার পছন্দ মত আলোক রশ্মি টিকে কাজের জন‍্য বেছে নেবার পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকি। একেই আলোক বিশ্লেষণ বলে থাকি। 


সন্ধ্যা হবার কিছুটা আগে যখন সূর্য অনেকটা দূরে সরে গেছে। তার থেকে নির্গত আলো বেঁকে তেরছা হয়ে ধেয়ে আসছে আমার কাছে। সে আলোর বেগ অনেক কমে গেছে। ঠিক তখনই কিছুটা আলো আমি ধরে নিলাম আমার আলোর ফাঁদ যন্ত্রে। এটি আমার তৈরী এক বিশেষ যন্ত্র। যেটিতে আলো ধরে রাখা যায়।


সকলেই জানে আলো প্রতিফলিত হয়। এবং দর্পণে তা অনেকটাই বেশি পরিমানে হয়ে থাকে। কতগুলো দর্পণকে বিশেষ কোনে স্থাপন করে তাতে আলো ফেললে। সেই আলো যদি সর্বদা এই সকল দর্পণের মধ‍্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। তো সে আর কখনো প্রকৃতিতে মুক্ত হতে পারে না। তৈরী ঐ যন্ত্রে আটকা পড়ে থাকবে অনন্ত কাল। প্রয়োজন মত তুমি কোন একটি দর্পণকে সরিয়ে আলোকে ফাঁদ মুক্ত করে ব‍্যবহার করতে পারবে। আমি তাই করি। প্রয়োজন হলে আলো ধরে রাখি আর প্রয়োজনে সেই আলোকে কাজে ব‍্যবহার করে থাকি। আজ


দিন শেষ হবার আগে আমি কিছুটা আলো তাই ধরে নিলাম আমার আলোক ফাঁদ যন্ত্রে। এবার রাত ঘনিয়ে এল। আমি আমার অদৃশ্য কাঁচ ঘরেই সময় কাটিয়ে চলেছি। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্র সাজিয়ে নজর দিয়ে বসে আছি। অদৃশ‍্য কাঁচ ঘর এমন কিছুই না। আলোর প্রতিফলন ধর্মকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা। 


বস্তু থেকে আলো বেরিয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে আমরা সেই বস্ত টিকে দেখতে পাই। সেই আলো বস্তুর নিজের দহনের আলো হতে পারে আর হতে পারে অন‍্য কোন উৎসের আলো। যা তার গায়ে প্রতিফলিত হয়ে ছোটে চলেছে । যখন বস্তু আলো প্রতিফলন করে এবং সেই আলো কারো চোখে ফিরে না আসে। তবে সেই বস্ত টিকে আর দেখা যাবে না। আমার কাঁচ ঘরের সূক্ষ্ম কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে আলো আনায়াসে ভেতরে চলে আসতে পারে প্রতিসৃত হয়ে। যৎ সামান‍্য যা কাঁচের দেয়ালে বাধা পেয়ে প্রতিফলিত হয় তা চোখে মালুম হয় না। আর ঐ প্রতিসৃত আলোক রশ্মি গুলিকে দর্পন দ্বারা বিশেষ কোনে প্রতি ফলিত করে একত্রিত করে এক বিশেষ কোনে মহাকাশে মুক্ত করে দিয়ে থাকি। ফলে আসে পাশের কেউ আমার ল‍্যাব দেখতে পায় না। উপর থেকে দেখলে আগুনের গোলা বলে মনে হয় । তাই ভয় পেয়ে উড়ন্ত কোন কিছুই এখানে উপর দিয়ে যায় না। সন্দেহের বসে অনেকে সে দৃশ‍্য দেখার পর খোঁজ করতে এসেছিল কিন্তু নীচে এসে দেখলে তারা কিছুই খুঁজে পায় নি। তবে আমার যন্ত্রটি পেলে তারা খুঁজে পাবে। আমি বাহিরে কোথাও গেলে এটিকে সঙ্গে নিয়ে যাই। নইলে আমি নেজেই আর ল‍্যাব খুঁজে পাব না। এটি এক প্রকার ডিটেক্টর। ল‍্যাবের মধ‍্যে থাকা এক বিশেষ যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে বাইরে থেকে এর অবস্থান জানতে সাহায‍্য করে। অবস্থান সূচিত হবার পর আমি কম্পাসে দিক নির্ণয় করে ল‍্যাবের ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে ঢোকার পর সব কিছু দৃশ‍্যমান হয়ে পড়ে। এটি তৈরীর মেকানিজম আমি লিখছি না। তাহলে সকলে বানিয়ে আমার ল‍্যাব খুঁজে বের করবে। আমি বড় বিরক্ত বোধ করব। 


যদিও রাতে সূর্য আলো দেওয়া বন্ধ করে দেয় না। মনে করলে আমি স‍্যাটেলাইটের দ্বারা প্রতিফলিত আলোকে গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারি। অনেকে একটা কথা ঠিক বুঝতে পারে না। যে আকাশে সূর্যের আলো ছড়িয়ে থাকলেও আকাশ রাতে কালো থাকে কেন? আসলে আলো প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত হয়ে আমাদের চোখে না আসলে আমরা উৎস বা প্রতিফলককে দেখতে পাবো না। কারণ আলোক রশ্মিকে চোখে দেখা যায় না। তাই আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলোক রশ্মিগুলো কোথাও প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত হয়ে আমাদের চোখে আসে না। তাই কিছুই দেখা যায় না। সে যাক।


রাতে আলোর ফাঁদে থেকে আলো নিয়ে একটা আলাদা যন্ত্রে একটু নাড়াচাড়া করলাম। কোন লাভ হল না। কারণ তার সূর্যের সঙ্গে সংযোগ সূর্য থেকে অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই তার চলার পথ আর সূর্য পর্যন্ত বিস্তৃত নেই। সেই আলো সূর্যকে প্রত‍্যক্ষ করাতে পারছে না। এবার আর প্রতিফলিত আলোকে উৎস খোঁজায় ব্রতি হলাম না। জানি সে কাজ ভষ্মে ঘি ঢালার মত হবে। আগুনও জ্বলবে না আর ঘি টুকুও নষ্ট হবে।


পরের দিন সকাল হলেই আবার বসে পড়লাম টেবিলে সৌর খোঁজের কাজে। একেবারে সকাল এখনো সৌর কিরণ এখানে এসে পড়ে নি। দেখি বড় একটি মেচলার মত সূর্য সবে উঠে আসছে উপরের দিকে। যেন মনে হয় জ্বলন্ত কয়লা। একেবারে টক টকে লাল হয়ে জ্বলছে। দেখে মনে হয় না সেটি পৃথিবীর থেকে বড়। ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে এনে বড় করতে থাকলাম। ক্রমে বড় হচ্ছে একটা ঘরের মত বড় হয়ে গেল। আরো বড় করতে লাগলাম। এবার একটা গোটা গ্রামের মত হয়ে পড়ল। তখন তাতে সৌর কলঙ্ক খুঁজতে শুরু করলাম। কিচ্ছু পাওয়া গেল না। তাকে আরো বড় করতে করতে একেবারে হাতের কাছে ছুঁয়ে ফেলার মত কাছে নিয়ে চলে এলাম। এবার তার দেহে আমাদের ঘরের মত এতটুকু জায়গা দেখতে কয়েক ঘন্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এতটাই বড় করা হয়ে গেছে তার দেহটি। ভেবে দেখলাম তাহলে তো গোটা গ্রামের মত একটা অংশ স্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বহু সময় লেগে যাবে! সম্পূর্ণ তার দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁজ করতে সারাটা জীবন লেগে যাবে! তাই তার আকার কিছুটা ছোট করে নিলাম। ছোট করতেই এক অদ্ভূত দৃশ‍্য নজরে পড়ল! 


দেখলাম একটা আগ্নেয়গিরি! তার জ্বলা মুখ দিয়ে অগ্নুৎপাৎ হচ্ছে। কোন লাভার নির্গমন হচ্ছে না। বড় বড় জালার মত আগুনের গোলা নির্গত হয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। কয়েকটা তো আমাকে লক্ষ‍্যঃ করে ছুটে এল! আমি ভয় পেয়ে গেলাম! দেখলাম সেগুলি ঠিক যেন আমার মাথার উপর এসে আছড়ে পড়ছে। আমি জানি ওতে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি আমার ল‍্যাবের চারিদিকে অদৃশ‍্য লেজার শিল্ড প্রোটেকশন চালু করে রেখেছি। বড় ধুমকেতু এসে আছড়ে পড়লেও কিছু হবে না। তবে সূর্য এসে আছড়ে পড়লে কী হবে বলতে পারবো না। হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে সেটি যে হবার না তা আমি ভাল মত জানি। আর আমি তো কেবল আমার কথা ভাবি না। পার্থিব সকল জীব জগতের কথা আমাকে ভাবতে হয়। ঐ আগুনের ছুটে আসা গোলা আমার কোন ক্ষতি না করলেও পার্থিব বাকি সব কিছুর ক্ষতি করছে। মনে মনে তাই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ল‍্যব থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলাম দেখার জন‍্য। এই কথা ভেবে যে ঐ ধেয়ে আসা আগুনের গোলা গুলো আসে পাশের পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে। বাহিরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে গেলাম! কোথায় সেই ছুটে আসা আগুনের গোলা? কোথাও কিচ্ছু তো নেই! পরিবেশের এতটুকু ক্ষতি তো কোথাও হয় নি! চারি পাশে গাছ পালা জীব জন্তু সব কিছুই বহাল তবিয়তে রয়েছে। 


বরং রৌদ্রে ঝলমল করে গাছেরা যেন খিল খিলিয়ে হাসছে। দিঘির জল হালকা সেই রোদে তাথৈ তাথৈ নৃত‍্য করছে। পানকৌড়ী মনের আনন্দে টুপ টুপ করে জলে ডুব দিচ্ছে। প্রকৃতিতে মহা সমারোহ। এতটুকু বিমুর্ষতার চিহ্ন কোথাও চোখে পড়ল না।


মনে সনন্দেহ হল! তবে কী আমি যন্ত্রে ভুল দেখলাম! আমার যন্ত্র কী সঠিক দিশা দেখাতে পারছে না?মনটা ভাবনায় ভরে গেল। সমস‍্যাটি কী খুঁজে নেবার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষণ ভেবে একটা আন্দাজ করলাম তবে একবার পরখ না করে একেবারে নিশ্চিত হলাম না। 


আবার গিয়ে বসলাম ল‍্যাবের ভেতরে আমার চেয়ারে। এবারে মন টাকে শান্ত করে চেয়ে দেখলাম সূর্যের দিকে তাক করে থাকা টেলিস্কোপের মুখে লাগানো স্ক্রীন টার উপর। প্রত‍্যক্ষ করলাম আবার সেই দৃশ‍্য। ঝাঁকে ঝাঁকে সেই ভাবেই আগুনের গোলাগুলো সূর্যের দেহের আগ্নের গিরির জ্বালা মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে আমার দিকে। যেন ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র! তখনও ঠিক ভাবে আমার মাথায় আসছিল না কেন এমন দেখতে পাচ্ছি? অনেক ভাবনা চিন্তার পর বুঝতে পারলাম আসল সত‍্য টিকে! প্রত‍্যক্ষ করলাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব! শক্তির কণা গুলো দল বেঁধে নির্গত হয় উৎস থেকে। আর এ তো সেই ঘটনা। এগুলো আলোর কণা ফোটন। আমার ম‍্যাগনিফাইং গ্লাসে সেই অতিব সূক্ষ্ম ফোটন কণা গুলিকে এত বিশাল আকারে দেখাচ্ছে। তাই আলোর কণার নিক্ষেপকে গোলা বর্ষণ বলে মনে হচ্ছে। আমার যন্ত্রে এতটাই বর্ধিত করা সম্ভব হয়েছে যে আলোর ঐ তীব্র গতিও ক‍্যামেরায় ধীর গতি সম্পন্ন মনে হচ্ছে। সিনেমার পর্দায় যেমন স্লো মোশনে ছবি দেখা যায়। এখানে তেমন সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলা আলোক কণাদের একটি সিধারণ কণার মত গতি শীল দেখাচ্ছে। কী আশ্চর্য! এমনটাও হতে পারে? তাহলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারিদিকে যে ইলেকট্রন গুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে বেড়ায় তাকেও তো একটি স্বাভাবিক গতিতে কেন্দ্রকের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে থাকা কণার মত দেখাবে? পরমাণু পর্যবেক্ষণের একটা খুব ভাল দিক উন্মোচন হল আমার কাছে এই গবেষণা করতে গিয়ে। সেই নিয়ে আর এক সময় কাজে বসা যাবে। এই অভাবনীয় দৃশ‍্য সচক্ষে দেখে


একবার মনে হয়েছিল এই দৃশ‍্য আমি বৈজ্ঞানিক সমাজকে প্রত‍্যক্ষ দর্শন করাব। কিন্তু সেটি যে সম্ভব না। আমার এই ল‍্যাবরেটরী আর যন্ত্রের সেটাপ ছাড়া এই দুর্লভ দৃশ‍্য দেখা অসম্ভব। সেটি যে দ্বিতীয় কোথাও সেট করা যাবে না। আর আমার ল‍্যাবের সন্ধানও কাউকে দেওয়া যাবে না। একটা প্রমাণ স্বরূপ এই লেখাটি রাখলাম। তাতে যে যা বোঝে বুঝুক। অসত‍্য বলে মনে করে করুক। তবে কেউ কেউ সত‍্য বলে মনেও তো করতে পারে? তাদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখি আমার এই উক্তি যথার্থ সত‍্য এবং সচক্ষে দেখা বর্ণনা। এটিকে বিশ্বাস করে গবেষণায় লেগে থাকলে সাফল‍্য আসবেই।


এবার মনে এল আলোর কণা গুলো অগ্নুৎপাতের মত নির্গত হচ্ছে ঠিকই। তাবে তা সূর্যের দেহের সমগ্র তল থেকে নির্গত হচ্ছে না। তার দেহের কোথাও কোথাও টর্চ জ্বেলে রাখার মত এমন আগুনের গোলা বের করার আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আর বাকি বেশির ভাগ অংশটাই ফাঁকা। আমাদের পৃথিবীর মাটির মত। সমগ্র পৃথিবীর বুকে কয়েকটা মাত্র আগ্নেয় গিরি আছে তাও আবার সব গুলি জ্বলন্ত নয়। বেশির ভাগ দেহ তলই ফাঁকা। তবে আমাদে দেহ তলের মত এতটা ফাঁকা নয় সূর্যের দেহ তল। তবে সমগ্র তল যেমন আগুনের গোলা বলে মনে হয়। সূর্যের সেই দেহ তল তেমনটি না। সেখানে পাহাড় পর্বত ঘর বাড়ি সব রয়েছে। বড় বড় গর্তও রয়েছে চাঁদের মত। যেখানে কোন আগ্নেয় গিরি নেই তাই আলো জ্বলে না। বাহিরে কোথাও থেকে আলো পৌঁছে গেলেও সে আলো আর ফিরে আসে না কোথাও। তাই কালো হয়েই থাকে সব সময়। এই কালো অংশ গুলো হল সৌর কলঙ্ক।আমরা এগুলো খুব একটা দেখতে পাই না। কারণ সৌর ঝড় আর সূর্যের আবর্তণ গতির জন‍্য। 


সূর্যের দেহে ঝড় বয়ে চলেছে প্রবল বেগে সর্বক্ষণ। সে ঝড় আলোর কণা গুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তার দেহে সর্বত্র। তাই সে দিকে তাকালে ও সব আর দেখা যায় না। শুধু জ্বলছে সারা দেহ বলে মনে হয়। যদিও এর জন‍্য বহুলাংশে দায়ী তার আবর্তণ গতি। পৃথিবীর মত সূর্যও তার নিজের অক্ষের চারিদিকে পোঁ পোঁ করে ঘুরছে। এতটাই তার বেগ যে মুহুর্তের মধ‍্যে আগ্নেয় গিরির জ্বলা মুখ আবার ঘুরে আসছে চোখের সামনে এক পাক ঘুরে। তাই সব সময় ঐ জ্বলা মুখই আমাদের চোখে ধরা দেয়। অনেকটা চরকা বাজি মত ঘটনা বলে মনে করতে পার। চরকার মুখে আগুন জ্বেলে দিলে সে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। দেখে মনে হয় তার দেহের সর্বত্র দিয়েই আগুন জ্বলছে যেন। আদৌ তাই কি জ্বলে? এমন ঘোরার গতি আমাদের মনে করতে বাধ‍্য করায় তার এমন সর্ব দেহ জ্বলমান অবস্থার কথা। 


তাই সূর্যের সারা গায়ে আগুন জ্বলছে বলে দেখালেও আদৌ তার সারা গায়ে আগুন জ্বলছে না। তার দেহের বিস্তৃত জায়গা রয়েছে ফাঁকা পড়ে। সেখানে বাস করে সৌর মানব। আমাদের থেকে দীর্ঘাকায় ও সোনার মত তাদের গায়ের রং। সোনা রদ্দুরের দেশে বাস করে বলে হয়তো এমনটা হয়েছে। পরিবেশের প্রভাবে এমনটা হয়ে থাকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম বলে একটা ব‍্যাপার আছে। আমরা অনেকেই জানি। যেখানে এক এক ইন্ডাস্ট্রি অঞ্চলে ঐ ইন্ডাস্ট্রির জন‍্য বিশেষ পরিবেশ গড়ে ওঠে। সেই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেবার জন‍্য জীব দেহে নানা রকম পরিবর্তন ঘটে থাকে। একেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম বলে। সূর্যের বাসিন্দাদের ঐ রকম সোনালী গড়ন হয়েছে সোনালী রদ্দুরের জন‍্য। আর দেহের আকার বড় হবার কারণ ওদের আবর্তন গতি। যেমন আমাদের বিষুব রেখার বা তার আসে পাশের অঞ্চলে থাকা লোক গুলোর আকার বেশ বড়। ততার পর অক্ষাংশ কমার কারণে আকার কমতে থাকে। অক্ষাংশ কমতে থাকলে তার আবর্তন গতিবেগ ও কম হয়। তাই বাহিরের দিকে ছিটকে যাবার বেগও কম হয়। অর্থাৎ কেন্দ্রাতিগ বল মানুষের লম্বা হয়ে বেড়ে ওঠার পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বল যত বেশি হবে তত তাকে খাঁটো করে দেবে। এটিকে অভিকর্ষ বলা হয়। অভিকর্ষের টান কাটিয়ে মানুষ কে বড় হতে হয়। মেরু দেশে মানুষের ওপর অভিকর্ষ টান বেশি তাই তারা লম্বা বেশি হতে পারে না। তাই বলে ঐ একটি কারণ শুধু লম্বা হবার জন‍্য দায়ী তা বলা যাবে না। অনেক কারণের মধ‍্যে এটিও একটি কারণ। না হলে গোর্খা জাতিদের বেঁটে হবার কারণ আর গাণিতিক হিসাব নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। কারণ ঐ একই অক্ষাংশে পাহাড়ের মাথায় আর ঠিক সেই পাহাড়ের নীচের মানুষদের আকারের উল্টো পরিণতি ঘটবে কেন? সেখানে তো পাহাড়ের ওপরে বসবাসকারী গোর্খাদের লম্বা আর নীচে বসবাসকারী দের বেঁটে হবার কথা। এখানে আর একটা যে সত‍্য লুকিয়ে আছে তা বলে রাখি। তাহল অস্বাভাবিকতা। মানুষের ভর অনুযায়ী পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল তার জন‍্য বরাদ্দ আছে। সেই অঞ্চলের নীচের দিকে বা ওপরের দিকে বাস করলে তার শরীর একটা অস্বভাবিকতা অনুভব করে। ফলে সে স্বাভাবিক ছন্দে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। তখন তার সমস্ত চরিত্রে বৈশিষ্ট্যগত নানা পার্থক‍্য গড়ে ওঠে যেটি তাকে ঐ পরিবেশে মানিয়ে নিতে সাহায‍্য করে। এখন থাক ও কথা। কী আশ্চর্য! সূর্যের দেশে মানুষ!


সেখানে মানুষ দেখে উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আরো ভাল করে খোঁজ করতে থাকলাম সেখানের মাটি। কী আশ্চর্য! তাল তাল সোনায় পাহাড় তৈরী করে রেখেছে সেখানে! আমরা একটু সোনার টুকরোর জন‍্য হাপিত্তেষ করে মরছি।আর সেখানের লোকে সোনা পা দিয়ে মাড়াচ্ছে। সোনার ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সোনার বাড়ি তৈরী করে তাতে বাস করছে। আরো একটু লেন্সটি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখলাম সাদা কিসের যেন পাহাড় রয়েছে মনে হল। প্রথমে মনে হয়ে ছিল অভ্র। তার পরক্ষণেই বুঝলাম সেটি অভ্র না। সে তো হালকা ধাতু। তার তো ওখানে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর কথা। তবে এটি কী? প্লাটিনাম নয় তো?



আলোর দ‍্যুতি পরীক্ষা করে দেখলাম যে ঠিক তাই। যা মনে ভেবেছিলাম!সেটি প্লাটিনামের পাহাড়। ওরে বাবা! এত বড় প্লাটিনামের পাহাড়! এ মুলুকে থাকলে না হয় এক ধামা নিয়ে ঘরে রেখে দিতাম। এখানে তো ওটি সহজে পাওয়া যায় না তাই বেশ দামি ধাতু। তার পর নজর পড়ল এক ঝকঝকে গাছের ওপর। ঠিক যেমন বড় দিনে আমাদের এখানে গাছকে সাজিয়ে বানানো হয় তেমন ঝকছে কিন্তু কোথায় বাতি লাগানো তা দেখতে পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তবে বুঝলাম যে সেটি কোন সাজানো গাছ নয়। ওটি ওখানের স্বাভাবিক গাছ। আমাদের যেমন সবুজ পাতার গাছ হয় ওখানে তেমনই গাছ তবে তার পাতা সবুজ না। রোদের মত সোনালী। 


সাধারণ টেলিস্কোপে এ সব কিছুই দেখা যায় না। ওরা তো দৃষ্টিকে আলোক বলয় ছাড়িয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে পারে না। তাই ও সব টেলিস্কোপে সূর্যকে জ্বলন্ত আগুনের গোলা বলে মনে হয়। আলোক বলয় তেমন বিশেষ কিছু নয়। অপেক্ষা কৃত ভারি আলোর কণা গুলো দেহ থেকে নির্গত হয়ে বেশি দূর পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে না। কিছুটা দূরে গিয়ে তারা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান করে সূর্যের মূল দেহকে বেষ্টন করে আবর্তন করতে থাকে। ঠিক যেমন শনির বলয়। শনির বলয় তো ঘন ধুলি কণার স্তর। যেটি তার দেহের চারি পাশে বলয়ের মত ঘুরতে থাকে। নানা ভরের ছোট ছোট কণা সেখানে ভীড় করে এমন বলয় গঠন করেছে। সূর্যের দেহের চারি পাশেও তেমন ভারি আলোর কণার স্তর ঘুরে বেড়িয়ে আলোক বলয় গঠন করে। সূর্যের দেহ থেকে নির্গত সূক্ষ্ম আলোর কণা গুলোই প্রচন্ড গতিতে ঐ আলোক বলয় ভেদ করে বাহিরে বেরিয়ে আসে। সেই সূক্ষ্ম রশ্মিকে অনুসরণ করা সাধারণ টেলিস্কোপের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। এমন কি হাবল টেলিস্কোপেও তাকে ধরতে পারবে না। যদি পারতো তো ওদেরকে পদ্ধতি বলে দিয়ে তা প্রত‍্যক্ষ দর্শন করাতাম। 


অনেকে বলে থাকেন সূর্যের দেহে এত উত্তাপ ওখানে জীবন থাকা সম্ভব না। তাই গাছ পালা মানুষ এ সব কিচ্ছু নেই। তারা যে এত বোকার মত কথা বলে তা বলে বোঝাতে পারবো না। আগেই তো বললাম যে সূর্যের দেহে সর্বত্র আগুন জ্বলছে না। তাই যেখানে আগুন জ্বলছে না সেখানে জীব থাকতে পারে এবং আছে তা আমি প্রত‍্যক্ষ করলাম। আগুন তো অল্প কিছু জায়গাতে জ্বলছে। সেই আগুন ঝড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেহের অন‍্যত্র। তাই সূর্যের সমগ্র দেহ জুড়ে আগুন জ্বলছে বলে মনে হয়। সেখানের উত্তাপ যতটা মনে করা হয় ঠিক ততটা নয়। তবে আমাদের এখানের থেকে সেখানের উত্তাপ অনেক বেশি। তাই বলে ঠিক ততটাও না যতটা আমরা অনুমান করি অসহ‍্য বলে। আমরা তো জানি আগুনের কাছে পাশাপাশি যতটা হাত নিয়ে যাওয়া যায় উপর থেকে ততটা কাছে হাত নিয়ে যাওয়া যায় না। ঘূর্ণনে অপ কেন্দ্রিক বলের কারণে ঐ ফোটন কণা গুলি ঘূর্ণন কেন্দ্রের বিপরীতে ছুটে চলে যায়। তাই উপরের দিকে হাত বেশি কাছে আনা যায় না। ঐ কণারা তাদের চলার পথে বাধা পছন্দ করে না। যদি কোন বাধা চলার পথে পড়ে তবে তাকে হয় বিদ্ধ করে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। নতুবা সে নিজে তার গায়ে ধাক্কা মেরে প্রতিফলিত হয়ে অন‍্য দিকে চলে যায়। আরো একটা কথা বলতেই হয়। যে মরুতে বা মেরুতে জীবেরা বসবাস করতে পারবে বলে আমরা কখনো ভেবেছিলাম! না তো? অথচ সেখানে জীব রয়েছে। মরুতে বিষাক্ত বালি বোড়া সাপ। কাঁকড়া বিছে ইত‍্যাদিরা উষ্ণ বালির ভেতরে বেশ আরামেই থেকে যাচ্ছে। আর মেরুর প্রচন্ড ঠান্ডায় ক্রায়োজেনিক্স ছত্রাক আর শৈবাল তো রয়েইছে। সঙ্গে মানুষও রয়েছে। এস্কিমো। কেউ ভেবেছিল এ সব কথা! তবে এরা সকলে ঠিক আমাদের মত না। শিতের দেশের পাখি পেঙ্গুইন কে যেমন গরমের দেশে নিয়ে গেলে তাকে তার মত ব‍্যবস্থা নিয়েই নিয়ে যেতে হবে। তেমনই অস্ট্রিচ এমু এদেরকে বরফের দেশে নিয়ে যেতে গেলে তাদের তার মত পরিবেশ গড়ে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ শিতের পাখিকে গরমের দেশে নিয়ে গেলে তাকে শিতের পরিবেশ তৈরী করে সেখানে রাখতে হবে। আর গরমের পাখিকে শিতের দেশে নিয়ে গেলে তাকে গরমের বাঁসা বানিয়ে সেখানে রাখতে হবে। ঐ দুই পরিবেশের পাখি দুটি তাদের পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারলেও বিপরীত পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই বলে গরমের পাখি কী মনে করতে পারে যে শীতের দেশে কোন পাখি বাস করতে পারে না? ওদের ক্ষেত্রেও তাই। সূর্যের দেশের জীবেরা তারা তাদের পরিবেশে বসবাস করায় অভ‍্যস্থ জীব থাকে। তারা গরম সহ‍্য করতে পারে। আবার আমরা অপেক্ষা কৃত ঠান্ডার ভূখণ্ডে বাস করি ওদের মত গরমে থাকতে পারবো না। তাই বলে ওখানে জীব থাকতে পারে না বলে আমাদের মনে করাটা কল্পনা। এটিকে বৈজ্ঞানিক সত‍্য বলে মেনে নেওয়া যাবে না। তবে বিজ্ঞান তো না দেখে সহজে বিশ্বাস করবে না। আমি দেখেছি ফলে সেটিই প্রমাণ এই কথা কেউ মেনে নেবে না। তাদেরকে হাতে নাতে দেখিয়ে দিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে আমার কথা সত‍্য। সেটি যে করা সম্ভব না তা আমি আগেই স্বীকার করেছি। তাই আমার এই নিজের সচক্ষে দেখা ও তার সম্পর্কে লেখা বিবরণ সকলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। সে যাই হোক ওরা বিশ্বাস না করে করুক তাই বলে আমার চোখের দেখা সত‍্য তো আর মিথ‍্যা হয়ে যাবে না। আরো একটু মনযোগ দিয়ে সূর্যের দেহ তল পর্যবেক্ষণ করছি। নানান দৃশ‍্যের মাঝে


এ বার আরো একটা অদ্ভূত দৃশ‍্য দেখতে পেলাম। সেই দৃশ‍্য আমাকে কেবল অবাক করে দিল না বরং এক বিশেষ ভাবনার মধ‍্যে ঠেলে দিল। আমি ঠিক নাস্তিক না হলেও আস্তিক বলতে পারবো না। অর্থাৎ আমি ধর্মকে তেমন অবিশ্বাস না করলেও তেমন বিশ্বাস করি তা বলা যায় না। তাই এই দৃশ‍্য দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম! তবে কী পুরাণ কাহিনী সব সত‍্য! তবে কী দেবতা আর অসুরেরা এখনো জীবিত? এখনো কী তাদের মধ‍্যে ঘটে চলেছে মহা সগ্রাম! এমন কথা মাথার মধ‍্যে ভীড় জমাতে থাকছে। যখন দেখলাম সেখানে রয়েছে দু প্রকার মানুষ! কাল আর সাদা যেটি সোনালী দেখায়।


এক দল কালো যারা দল বেঁধে থাকে ঐ অন্ধকার ময় কালো গহ্বরে। আর এক দল সোনালী মানুষ যারা থাকে আলোর দিকে জড়ো হয়ে। এখন বুঝতে পারলাম তাই আলো এত উজ্বল আর অন্ধকার এতটা কালো।


তাকিয়ে আছি ঐ দিকে। দেখি ঘন কালো অন্ধকারে ভিতর থেকে বিশাল দৈত্যাকার কিম্ভূত কিমাকার সব মানুষ বেরিয়ে আসছে। হাতে তাদের অস্ত্র। তারা এগিয়ে চলেছে আলোর দিকে। সেই আলোর দিকেও চলছে তোড়জোড়। আলো আর আঁধারের দুটি দল। তারা পরস্পরের শত্রু। দিন আর রাতের মত। অসুর আর দেবতাদের মত। এখনি বোধহয় বেধে যাবে যুদ্ধ যা অনন্ত কালের আলো আঁধারের বিরোধ। কেন? কিসের জন‍্য যুদ্ধ তা জানি না। বোধহয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একে অপরকে পরাস্ত্র করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সে জগতে। তাই আঁধার আলোকে গ্রাস করতে চায় সর্বদা। আর আলো অন্ধকারকে প্রতি হত করে চলেছে সর্বদা। একজন হল ধ্বংসের প্রতীক। আর অন‍্য জন সৃষ্টির। আমি অহিংস। হিংসাকে পছন্দ করি না আর প্রশ্রয় দিই না। তাই আমার ওই যুদ্ধ দেখার আর আগ্রহ থাকলো না। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম টেলিস্কোপ থেকে।


একটি অবাঞ্ছিত - আবদুস সালাম || Ekti Obanchito - Abdus Salam || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 একটি অবাঞ্ছিত

      আবদুস সালাম



(এক)



চুমকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে হাসপাতালের দিকে। রুক্ষসুক্ষ চুল। পরণে তার আধ ময়লা ছেঁড়া কাপড় 


       হিতম মাঝি ভোর ভোর বাড়ির মাচানে ধরা কয়েকটি ঝিঁঙে নিয়ে আসছিল মেলা তলার বাজারে বেচতে। তখন ও আঁধার আলোর মুখ দেখেনি।যা দুটো পয়সা পাবে তাই দিয়ে হাসান ডাক্তারের দোকানে ওষুধ নিয়ে যাবে তার অসুস্থ মেয়ের জন্য । দুদিন থেকে খুব জ্বর। শিব মন্দির তলায় তখন ও ঠিক মতো মুখ না চেনা আঁধার। একটি বেপরোয়া পিকআপ ভ্যান থেঁতলে দেয় তার ঝিঙের ঝুড়ি। বেশ লেগেছে তার কোমরে । নেশার ঘোরে ছিল। গত রাতে ভোট চাইতে এসেছিল ওরাই দিয়ে ছিলো ইংলিশ মাল। তীব্র আলো চোখে পড়ায় সে হতবম্ব হয়ে যায়।বেগতিক দেখে ড্রাইভার জোরে গাড়ি ছুটিয়ে পালায়। একাই বেচারী পড়ে আছে রাস্তায়।কেউ ওঠানোর লোক নেই।কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে কাঁদছে,আর বলছে ,"এয়া কি হুঁঙ গেলো রে চুমকি "।


            


  এই সময় মুখুজ্জে বাড়ি, হাজরা বাড়ি,ভটচাজ্ বাড়ির ছেলে মেয়েরা মর্নিং ওয়াকে বের হয়। আজ ও বেরিয়েছে।


       জমি দেখতে আসছিল হাসান ডাক্তার। একজন কে রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে পাশে বাইক রেখে তাকে সোজা করে তোলাতে চেষ্টা করে ।হাত পায়ের রক্ত মুছিয়ে ধুয়ে দেয়। সোজা করে হাঁটানোর চেষ্টা করে। মর্নিং ওয়াকে আসা ছেলে মেয়েরা এই কান্ড দেখে মনে করে ঐ লোকটাই হয়তো আ্যক্সিডেন্টটা করেছে। এখন ব্যাটা সাধু সাজবার চেষ্টা করছে।


 হাসান ডাক্তার ওদের কে বোঝানোর চেষ্টা করছে আমার বাইকে হয়নি। একটা পিক আপ ভ্যানের এই কাজ। কিছুতেই ওর কথা শুনতে চাইছেনা । শালা ভালো মানুষ সাজছো না। দে দুই ঘা বেটার পাছায়। 


বলছি আমার বাইকে হয়নি । কিছুতেই শুনতে চাইছেনা তার কথা। বেশি কথা বললে ঠ্যাং ভেঙে দিবো ব্যাটা।


 ওমনি মারের ভয়ে বলে কি করতে হবে বলো? 


    ওরা বিধান দেয় ডাক্তার ,ওষুধ পত্র কিনতে যা খরচ হবে সব তোকেই করতে হবে। এক ঝুড়ি ঝিঙের দাম ও জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। সব মাথা পেতে নেয়। 


ভালো মানুষি দেখাতে গিয়ে কেমন অযথা ঝঞ্ঝাটে পড়ে গেল। পালিয়ে গেলেই তো হতো। বিবেক তাকে পালিয়ে যেতে দেয়নি।অগত্যা জমি দেখা বাদ দিয়ে জঙ্গিপুর হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে আসে। কর্মরত ডাক্তারবাবু ছিঁড়ে যাওয়া জায়গা গুলো ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। একটা ছবি করে নেওয়ার পরামর্শ দেয় কিছু ভাঙাচোরা হয়েছে কি না জানতে।


    হিতমের বউ খবর পেয়ে ছুটে আসে হাসপাতালে ।হাউমাউ করে কাঁদে ।"এখুন হামি এখন পূজার দিনে কি করবো রে" । 


 তুকে অততো করি বুললাম শালা মদ খ্যাঁসন্যা । তাঁও খেল্লি ।এ্যাক্ষুন হামি কি ক্যোরব্যো- রে —--!কেঁদে কেঁদে হাসপাতাল তোলপাড় করে ।


 লোকেরা মনে করে হয়তো কেউ মারা গেছে। সহানুভূতির ঢেউ আছড়ে পড়ছে হাসপাতালের বারান্দায়।


  হাসান ওষুধ এনে খাইয়ে দেয় ।তারপর বলে তোমার তেমন কিছু হয়নি ।একটু লেগেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ এনে দিয়েছি । ওগুলো খাও , আর থাকো । আমি বিকেলে আসবো ।তোমার খাবার সব দিয়ে গেলাম ।ডাক্তার এক্সেরে রিপোর্ট দেখে বলে কিছু হয়নি ।বিকেলে বাড়ি চলে যাবে।



দুই)



 হাসান বিকেলে হাসপাতাল এসে জানতে পারে কোন কিছু ভাঙাচোরা হয়নি। ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিয়েছে। হাসান হিতম কে বলে তুমি বেডে থাকো আমরা আসছি। টোটো করে তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিবো । হাসানের সাথে চুমকি পেছনে পেছন যায় । বিকেল গড়াতেই ম্যাকেঞ্জি পার্কে শৈলেশের ফুচকা খেতে দলে দলে ছেলে মেয়েরা আসে।  


শৈলেশ দেখতে হ্যান্ডসাম। নায়ক নায়ক ভাব।সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কে প্রাধান্য দেয়।ওর ব্যাবহার টাও খুব ভালো । যুবতী মেয়েরা লাইন দিয়ে শৈলেশের ফুচকা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে । হাসি ,ঠাট্টা ইয়ার্কি ও করা হয় আর ফুচকা খাওয়াটা ও হয় ।


 সবাই যখন ফুচকা খাচ্ছে তখন চুমকির জিভ দিয়ে যেন জল ঝরছে ।বারবার ফুচকার স্টলের দিকে তাকায় আর হাঁটে । পেছন ফিরে হাসান দ্যাখে চুমকির চোখ মুখের অবস্থা ।


 এই চুমকি ফুচকা খাবি ? "না ডাক্তোর আমার ছোট বেটি না খেঁয়ে আছে । আজ চাল কিন্যা হয়নি তো ।তু এ্যকসোডিন টো করলি ।হামার ছ্যেইলা দুট্যা না খেঁই আছে সারাদিন। বাড়িতে এঁঠ্যা রাঁধা আছে রাইতের ।ওয়্যাই খেঁই আছে ডাক্তোর। হামাদের খুব অভাব। এদিকে বড়ো বিটিটোর জ্বর । ঝিঁঙা বিচ্যা পয়সা তে তো বিটিটোর জ্বরের ওষুধ লিত্যাম।"


       আরে না না তোর হিতম কে একটা মোটরে আ্যকসিডেন্ট করেছে। আমি ওকে পড়ে আছে দেখে ঝেড়ে ঝুড়ে দিচ্ছিলাম। "তবে ওই ছুঁড়া গিল্যান যি বুললে তুই মেরাছিস। তোকেই সব খরচ দিতে লারবে"। সব মিছে কথা।


 তোর ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে? খা । আমি পয়সা দিবো । না ডাক্তোর না বলে আর ফুচকার স্টলের দিকে চোখ রাখে ।ফুচকার দিকে একবার তাকায়,আর একবার হাসানের দিকে তাকায় । লজ্জা লজ্জা করছে ওর। বারবার বলাতে চুমকি ফুচকা ওয়ালার কাছে যায় । শৈলেশ কে বলে মেয়েটাকে দশ টাকার ফুচকা দাও তো। শালপাতার ঠোঙা করে চুমকির হাতে দেয় । ফুচকার মাঝখানটা ভেঙে আলু ভর্তা পুরে তেঁতুল ঘোলা জলে ডুবিয়ে শৈলেশ ঠোঙা তে দেয়। কেমন করে ফুচকা খেতে হবে চুমকি যে জানেনা ।বাড়ালা স্কুলের মেয়েদের খাওয়া দেখেছে ভেঁড়া চরাতে এসে। ফুচকা ওয়ালার কাছে যেতে সাহস হয়নি । একে তো টাকা নাই। তার উপর নোংরা কাপড়। ছেলে মেয়েরা যদি খারাপ কথা বলে । তেঁতুল ঘোলা জলে ডুবিয়ে যেই চুমকি ঠোঙাতে দিয়েছে, অমনি মুখে দিয়েছে পুরে। মশলা দেওয়া ঝাঁজ মাখানো তেতুল জল উঠে যায় তালুতে ।হাঁচিতে, কাশিতে ম্যাকেঞ্জি পার্কের ঢোকার মুখটাকে গরম করে তোলে।


    ফুচকা খাওয়া শেষ হলে ওকে নিয়ে যায় স্টাইল বাজার। ওর বাড়ির প্রয়োজনীয় চাল, ডাল ,চিনি ,বিস্কুট ,তেল ,নুন একটা ব্যাগে ভরে তুলে দেয় ওর টোটো তে ।



তিন)



ক্লাবের কয়েকজন ছেলে মিলে প্ল্যান করে আজ খেলা ভালোই হবে । বাসস্টপে ঢোকার মুখে সব জড়ো হয়।ঘোষপাড়া থেকে এসেছে সঞ্জয়, সুমিত ।হাজরা পাড়া থেকে এসেছে শুভম আর কালু ,কুন্ডু পাড়া থেকে এসেছে দেবু ,কালটু আর তাদের গোটা কয়েক সাগরেদ। মন্ডপ তলার একধারে বসে পরামর্শ করে । কি কি করতে হবে।সব লোকে ভাবছে কি ব্যাপার?এক সাথে সব মস্তান কয়টি এসে জুটেছে। কোন গন্ডোগোল তো নিশ্চয়ই হবে আজ। মন্ডপ তলার থমথমে অবস্থা ।কি যেন কি আজ হতে চলেছে।


    যেমন আসবে তেমনি শালাকে দেবো ধোলাই । জরিমানা আদায় করতেই হবে। কারোরই কোনো কথা শোনা হবে না।পরামর্শ মত সবাই প্রস্তুত। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ টোটো এসে হাজির। বসে আছে হিতম হিতমের বৌ আর হাসান ডাক্তার । সাথে তাদের আছে একটা বড়ো ব্যাগ । তাতে এক সপ্তাহ চলার মতো চাল ডাল সবজি সাবান সার্ফ ইত্যাদি ইত্যাদি। 


হাসান ডাক্তার যেমন নেমেছে তেমনি ছুটে এসেছে ওই ছোঁড়াদের দল। ওরা খোশ মেজাজেই ছিল।আজ একটা কিছু আদায় হবেই।ছোঁড়াগুলোর চোখের সামনে দিয়ে হিতম আর হিতমেরবৌ ডাক্তার বাবু কে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করতে করতে টোটোতে চেপে চলে গেল মন্ডলপুরের দিকে। 


###






ভাগিদার


আবদুস সালাম


১৪৮৯


 ভাবতে ভালো লাগছে এমনি করে সেদিন প্রাণে বেঁচে ছিল সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সংসার ও নিজেকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে । সুপ্রিয়া শোভন কে ভালবেসে বিয়ে করেছিল । কলেজের অফ পিরিয়ডে নিজেকে কলেজের পেছনে লিচু বাগানের গিয়ে গল্প করা । আধো-আলো ছায়ায় ভবিষ্যতের গহণ নদীতে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতো দুজনে । এর জন্য কতদিন যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । অন্য বন্ধুদের প্রক্সি দেওয়ার সুবাদে তাদের প্রেম অবলীলায় চলতে দোসর হয়েছিল। প্রেম যমুনায় তরী যখন উথাল পাথাল তখন কোনো বাধা আর দুজনকে বেঁধে রাখতে পারছে না ।মোহনার উদ্দেশ্যে গঙ্গা-যমুনা একই স্রোতে মিশতে শপথ গ্রহণ করেছে যেন । সমুদ্রের লোনা জল, তবুও মিশে যাওয়ার তীব্র আকুতি। বয়ে শত বাধা পেরিয়ে আবর্তিত ঘূর্ণাবর্তে ও তারা সংকল্পে অটল।


 শোভনের বাবা রাশভারী লোক। প্রথম দিকে খুব শাসন করেছে ছেলেকে । পরক্ষণে আবার সুচতুর বাবা ভবিষ্যৎ কিছু বড় রকমের প্রাপ্তির আশায় মত বদলাতে শুরু করেন। ওদের মেলামেশাতেও তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নি ।গ্রামে আছে বিঘে ত্রিশেক জমি, পুকুর বাগান এবং রঘুনাথগঞ্জের মাদারল্যান্ড পল্লীতে প্রাসাদোপম বাড়ি । সুপ্রিয়ারা দুই বোন । দুই বোন সমান সমান ভাগ পেলেও আমার শোভন যে কিছু কম পাবে না তা তিনি ভালো ভাবে বুঝেছিলেন । এই আশাতেই রাশভারী লোকটা ছেলের প্রেমের পথের কাঁটা হননি। ফলস্বরূপ ওদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজে না গেলে ও বি্রোধিতা করেন নি । 


    প্রেমের জল যতদিন স্বচ্ছ থাকে ততদিনই সেই প্রেম স্বর্গীয় থাকে। অন্যদিকে জল যখন ঘোলা হতে শুরু করে তখন সেই জল গলধঃকরণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে ।প্রেমের নদীতে তখন আর জোয়ার আসে না । নিস্তেজ নদী প্রবাহহীনতার অসুখে ভোগে। অজস্র শৈবাল দাম আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে । জন্মনেয় বহু অবাঞ্ছিত জলজের । নদী তখন আর নদী থাকে না। এমনই সুপ্রিয়ার প্রেমের নদী পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত হয়ে গেছে ।


     ক্রমশ শোভনের লাগামছাড়া বায়নার হাতিয়ার হতে হতে বিধবা মা গত হয়েছে। চোখের জল ছিল তার নিত্য সঙ্গী ।সংসারের অশান্তিতে সুপ্রিয়া দিনদিন পোড়া কাঠ করে ফেলেছে নিজের চেহারাকে। আজ আর সেদিনের সুপ্রিয়া নেই । শর্মিলা ঠাকুরের মতো চুল বাঁধা। অনেক ছেলেই সুপ্রিয়া কে ভালবাসার বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছিল।




  সেদিনের সুপ্রিয়া আর আজকের সুপ্রিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ।শোভনের চাল চাল চলন ও আদবের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে । মদের বোতল ছাড়া একটি দিন ও চলেনা। অবাঞ্ছিত মেয়েদের পাড়ায় শুরু হয়েছে যাতায়াত। বাড়িতে এলে সুপ্রিয়ার কপালে জোটে কথায় কথায় খিস্তি, আর তার সঙ্গে যোগ হয় হস্তযোগ্য উপহার যা কোন দিন ভাবতেই পারেনি সে ।


  বাড়িতে ছোট বোন সুভাষিনী জামাই নিয়ে থাকে। ঘরজামাই হয়ে এসেছিল কার্তিক। বেশ সুখেই তারা আছে । অতোবড়ো বাড়িটি একাই ভোগ করছে।


 সুপ্রিয়া বাবার বাড়ি এসেছে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে । বাবা মা না থাকলেও নিজের বোন তো আছে।এই ভরসায় দুদিন প্রাণের জ্বালা জুড়াতে। তার চেহারা দেখে সুভাষীনী অবাক । সে তার দুর্ভাগ্যের কথা বোনকে জানায় । জানায় শোভনের দিন দিন অত্যাচারের কথা। সুভাষিনী বলে" দিদি কেন তুমি ঐ চন্ডালের কাছে আছো? এক্ষুনি তুমি চলে এসো । ওই জানোয়ারটা তোমার কি হাল করেছে দেখেছো ? একদম তুমি ওখানে যেওনা দিদি ।কোনদিন শুনবো তুমি নেই ।


    অর্ধেক বাড়িতো তোমার । একখানা ঘর নিয়ে তুমি থাকবে আর দুখানা ভাড়া দিলে দিব্যি তোমার সংসার চলে যাবে । কিসের আশায় কার জন্য তুমি পড়ে থাকবে দিদি ? সুপ্রিয়া যেন হালে পানি পেল । ছোট বোনের এই জ্ঞানগর্ভ কথা তার মনে ধরেছে ।স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়তে শুরু করেছে ।এখন নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে সুপ্রিয়ার। সামান্য একটু ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে আজ । হায়রে প্রেম!!!


  দিন পনেরো ছোট বোনের কাছে থেকে গেল সুপ্রিয়া, আর নিজেকে নিজের বাড়িতে স্থিতু করার চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়ল ।এমনও চিন্তা করতে লাগল যে বাকি জীবন শোভনের কাছে ডিভোর্স নিয়ে ছোট বোনের কাছেই কাটিয়ে দেবে।


  কার্তিকের চিন্তাভাবনা কিন্তু অন্যরকম ।সে নিজের ছাড়া কিছুই বোঝে না। প্রথম প্রথম কার্তিক ভেবেছিল দিন কয়েক থেকে আবার সে স্বামীর কাছে ফিরে যাবে । প্রথমদিকে তাই আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেনি কার্তিক। কিন্তু যখন জানতে পারল ও আমাদের সুখের সংসারে ভাগ বসাতে এসেছে, তখন কার্তিকের মাথাটা বিগড়ে গেলো। পুরনো স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো তার ।


     কার্তিক প্রথম যৌবনে ছিল ফাঁসিতলার এক নম্বরের গুন্ডা। এহেন কাজ নেই যা সে করেনি ।কতো লোককে যে নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । সবুজ দ্বীপের নদীর ধারে পুঁতে দিয়েছে। কথায় কথায় চেম্বার বের করে মাথায় ঠেকিয়ে ওপারে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে । সুপ্রিয়ার মামা তথা শশাঙ্কবাবুর পোষা গুন্ডা এই কার্তিক । শশাঙ্ক ভেবেছিলো কার্তিকের সঙ্গে যদি ভাগ্নি সুভাষীনীর বিয়ে দিয়ে দিই তবে সব সময় ওকে ব্যবহার করতে পারবো । বাড়িতে সবসময়ের জন্য তৈরী থাকবে তার হাতিয়ার। রাজনীতি করতে গেলে এই সব কার্তিঁকদের বিশেষ প্রয়োজন হয় । বুথ দখল, পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালানো ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে অকারণে এরাই প্রধান হাতিয়ার। কার্তিকের দৌলতেই শশাঙ্ক মামা হতে পেরেছিলেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের জামাই বলে কথা। জামাই হওয়ার সুবাদে বহু পয়সা এদিকে সেদিকে লুটে নিয়েছে । তবে এখন এইসব ছেড়ে দিয়েছে । মামা তার সাগরেদের সবাইকে কিছু না কিছু পেটের ভাত খাওয়ার মত কাজ জুটিয়ে দিয়েছে । এখানে সেখানে লাগিয়ে দিয়েছে । অনেকেই নিমকহারাম হয়ে যায়। কিন্তু মামা এ কাজ করে নি ।সব ক্যাডারদের খুশি করতে যতোটুকু পেরেছেন ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন । অনেকের ভোটে জেতার পর কিছু মনে থাকেনা। কিন্তু চালাক মামা আগামী ভোটের সময় যাতে মাটি খুঁজে না বেড়াতে হয় তার ব্যাবস্হা করে রেখেছেন।


     


    কার্তিক ও সুভাষিনী রাতের বেলায় ফিসফিস করে বলে হ্যাঁ গো শুনেছিলাম গোটা বাড়িটাই নাকি আমাদের হবে ?কিন্তু তো এখন দেখছি এটা ভাগাভাগি হবে।চোখ লাল করে সুভাষীনীকে বলে" মন খারাপ হয়েছে বাবা দু-পাঁচ দিন থাকবি খাবি- দাবি আবার যে গোহালের গরু সেই গোহালে গিয়ে উঠবি ।তা- না একেবারে পাকা পাকি ভাবে থাকার পরিকল্পনা।! কেমন মজা ! শালা নিজের বাড়ি হবে বলে কতো যত্ন করে বাড়িটাকে ঝকঝকে করে রেখেছি।


 থাম মজা দেখাচ্ছি। সাহস তো মন্দ নয়।সুভাষীনী তুমি যদি সাপোর্ট করো তোমার অবস্থা কেমন হবে তুমি বুঝতে পারছো তো?


         সুভাষিনীকে বলে , শোনো--- এই শোনো না ---। 


আরে বাবা আমি তো শুনছি । বলোনা --!


 আরে একটু কাছে এসো --- আরও কাছে---- আরও কাছে ---।


কেন এই তো একেবারেই কাছে আছি বলোনা ----। শুনছি তো ।আমি কি তোমার মতো ঠসা নাকি?


  আরে না না বলছি-- আমার দারুন একটা আইডিয়া এসেছে মাথায় ।এই বলে জোর করে সুভাষীনী কে জড়িয়ে ধরে এক্কেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওকে যদি সরিয়ে দিতে পারি তবে গোটা বাড়িটায় আমাদের হবে। শুনেই প্রথমে আঁৎকে উঠেছিল সে। হাজার নিজের মায়ের পেটের বোন তো বটে । তারপর বলল তা কেমন করে সরাবে শুনি?


বাড়ি আর সম্পত্তি পাওয়ার নেশায় বোধবুদ্ধি লোপ পেতে বসেছে কার্তিকের।


 তোমার দিদির তো জ্বর হয়েছে। ডাক্তারের কাছে গেছে ওষুধ আনতে। আনুক না ওষুধ। ওই ওষুধ ই হবে আমাদের তুরূপের তাস।ওই ওষুধের শিশিতেই সব সমস্যার সমাধান লিখা আছে প্রিয়তমা সুভাষীনী । নিশ্চয়ই কাসি যখন হয়েছে তখন শিরাপ তো অবশ্যই দিবে । ওই শিরাপের শিশিতেই দিবো বিষ মিশিয়ে! তারপরে চিন্তা করতে হবেনা।


 সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার আনন্দে কার্তিক সুভাষীনীকে জড়িয়ে ধরে চুমু চুমুতে ভরিয়ে দিল ।সব লাজলজ্জা কে বিসর্জন দিয়েছে কার্তিক ।


হঠাৎ তোমার ভালোবাসা উৎলে উঠেছে কেন আজ? অনেক দিন তো বিয়ে হয়েছে ।এমন করে তো একদিন ও জড়িয়ে ধরে চুমু খাওনি । কার্তিকের মন গেয়ে উঠছে "আজ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে "-------


পরামর্শ মতো কার্তিক সুপ্রিয়ার শিরাপের শিশিতে দিল তীব্র বিশ মিশিয়ে । নিয়তির কি নিঠুর খেলা । যে এলো বাবার বাড়ি একটু বাঁচার আশায় তাকেই কি না মেরে ফেলার চক্রান্ত।হায় রে নিয়তি।


 নিয়তি ও দরজার আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসছে।


  ওষুধ খাচ্ছি বলে রাতের বেলা টেবিলের উপর ওষুধ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সুপ্রিয়া। সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর । পেটে খাবার পড়াতেই চোখে নেমে এসেছে রাজ্যের ঘুম । কতোদিন যে ভালো ভাবে ঘুমাতে পারে নি ওই মাতালটার অত্যাচারে ।দরজা খোলা পেয়ে ঘরে ঢুকেছিল বিড়াল ।এক লাফে টেবিলে উঠতেই শিরাপের শিশিটা গেল মেঝেতে পড়ে । শিশি ভেঙে শিরাপ ঘরময় পড়লো ছড়িয়ে । মিষ্টি জিনিসের গন্ধ পেয়ে বিড়ালে মজা করে খেয়েছে । পিঁপড়া আরশোলারাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বিষের দাপটে ।তারপর মিয়াঁও মিয়াঁও করে ঘরময় দাপাদাপি করতে শুরু করে ।সেই সঙ্গে মুখে গ্যাঁজলা উঠে সাঙ্গ হলো বিড়ালের ইহলীলা। 




      সুপ্রিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে পড়ে থাকা শিরাপের পাশে মুখে গ্যাঁজলা বেরিয়ে পড়ে আছে বিড়ালটা । ঘরের চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেছে সুপ্রিয়া । আঁচ করতে পেরেছে এদের অভিসন্ধি। এখানে থাকা তার মোটেই সমীচীন হবে না ।মনের যন্ত্রণাকে দমিয়ে রেখে বিছানা থেকে উঠে একেবারে থানা।


 সাতসকালে মেয়ে মানুষকে থানায় দেখে কর্তব্যরত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন এতো ভোরে ভোরে এখানে কেন ?কোনো অঘটন ঘটেছে নাকি ? সুপ্রিয়া তখন হাউমাউ করে কেঁদে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে ফেললো সব ঘটনা।


    অন্য মানুষের কথায় হয়তো সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করতে পাঠাতেন না । কেননা এমন ঘটনা তো হামেশাই ঘটছে ।এ আবার নতুন কি?


তবে মেয়ে ছেলে বলে কথা। ডাগর মেয়ে দেখলেই তো কর্তব্য বোধ উৎলে ওঠে অনেকের ।ও সি সাহেবের দরদ ও একই ফর্মুলায় উৎলে উঠলো। পাশে ছোটবাবু ঢুলছিলেন । ঝাঁঝাঁলো গলায় ডাক দিতেই ছোট বাবু ধড়ফড় করে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠলেন।


কি আপদ মাইরী।একটু ঘুমোতে ও দিবেন না।এই তো দুঘন্টা আগে হোটেল রেড করে বাড়ি ফিরলাম ।


কি হলো বলুন? 


ছোট বাবু একটু যান তো মেয়েটার সাথে। 


গাড়ি নিতে হবে নাকি ? 


না না এই তো কাছেই।


থানার পাঁচ ছ 'টি বাড়ির পরে। 


অগত্যা বড়ো বাবুর হুকুম মেনে সুপ্রিয়ার পেছনে পেছনে হাজির হলেন কার্তিকের বাড়ি।


   ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন সুপ্রিয়ার বিবরণ মতো ঘটনা ।


    কার্তিকের ঘরের দরজা ঠক ঠক করে ওঠানো হলো বাবুদের।সব পাওয়ার নেশায় একটু রঙিন ও হয়েছিল দুজনে। মিষ্টি মিষ্টি রামের গন্ধ তখন ও ঘরময় ম ম করছে। পুলিশের শব্দ শুনে অগোছালো শাড়ী নিয়ে সুভাষীনী খুললো দরজা।


ছোট বাবু ওদের কিছু বোঝার আগেই দুজনের হাতে হাত কড়া পড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে চললো থানায়...

একটি মর্মান্তিক খুশির সংবাদ - সাইয়িদ রফিকুল হক || Ekti Mormantik Khushir Sangbad - Sayed Rofikul Haque || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

একটি মর্মান্তিক খুশির সংবাদ

         সাইয়িদ রফিকুল হক




লোহাগাড়া-বাজারে ঢুকতেই বড় পান-দোকানটিই গোবিন্দ সাহার। এটা বড় রাস্তাটার একপাশে। তাই, দোকানটা সবাই চেনে।

এখান দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করে থাকে। পানও কেনে লোকজন তার কাছ থেকে। তার ভালো ব্যবহারের জন্য প্রায় সবাই তাকে আপন ভাবে।

কাদের মেম্বার রোজ এখানে একবার-দুইবার আসবেই। নইলে, ওর পেটের ভাত হজম হবে না। সে পান কিনতে আসে না। হিন্দুর হাতের পান সে খায় না! আর হিন্দু-লোকজনকে দেখতে তার ভালোও লাগে না। তবু সে এখানে আসে! 

আর সে এখানে আসে বড়সড় একটা স্বার্থ নিয়ে। রোজ সে জিজ্ঞাসা করতে আসে গোবিন্দ সাহাকে—কবে তারা ভারতে চলে যাবেন?

গোবিন্দ সাহা এই একই প্রশ্নের একই উত্তর দিচ্ছেন আজ ত্রিশ বছর যাবৎ। তবু সন্তুষ্ট নয় কাদের মেম্বাররা।

মাঝেমাঝে সে এখানে বসে গোবিন্দ সাহার সঙ্গে নানান রকম গল্পজুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর বলে, “হিন্দুদের আসল দেশ ভারত। এখানে থাকা মানে পরাধীন হয়ে থাকা। তারচে হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়াই ভালো!”

গোবিন্দ সাহা তার সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে যান না। তবে মাঝেমাঝে তার আপত্তিকর কথার দুই-চারটা উত্তর দেন। আজও মেম্বার তাকে বলেছিল, “দাদা, কবে ভারতে যাইতেছেন?”

গোবিন্দ সাহা তাকে বলেছিলেন, “কোনোদিনও যাবো না। এখানে জন্মেছি। আর এখানেই মরবো। ভারতে যাবো কোন্ দুঃখে?”

তবু তার পিছ ছাড়ে না কাদের মেম্বার। সে জোঁকের মতো লেগে থাকে গোবিন্দ সাহার পিছনে। তার এই বাড়িটা মেম্বারের খুব পছন্দের।

বাড়ির সামনে আছে কেয়ারি ফুলের বাগান। নিকানো একটা উঠোন আছে বাড়ির মাঝখানে। তিনটি ভিটায় তিনটি ঘর। আর পাশের একটি ভিটায় আছে মন্দিরের মতো বড়সড় ঠাকুরঘর। বড় সুন্দর লাগে এই বাড়িটা দেখতে! এর পিছনের দিকে আছে বিশাল একটা পুকুর! তার আবার শানবাঁধানো ঘাটও আছে! 

ওই পুকুরের শীতল জলে নামতে ইচ্ছে করে কাদেরের। তার বাপেরও বড় ইচ্ছে ছিল এই বাড়িটা কোনোভাবে হাতিয়ে নেওয়ার। দেশের ভিতরে কতবার কতরকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বাড়িটা হাতিয়ে নিতে পারেনি কাদেরের বাপ। তখন কাদেরের বাপের টাকাপয়সা ছিল না। তাই, সে বাড়িটা ভয়দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো। এখন তার ছেলে কাদেরের টাকাপয়সা হয়েছে। কাদের এখন রিলিফের গম চুরি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই―যা সে করেনি। তার টাকাপয়সা হবে না কেন? আর সেই টাকার জোরে তার এখন ক্ষমতা ও দাপট বেড়েছে।


কাদেরের বাপ একসময় দিনমজুরি করতো। সাহাদের জমিতেও কতদিন কামলা খেটেছে। তখনই সে সাহাবাড়িটা দেখে একেবারে পাগল হয়েছিল! সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বাড়িটা হাতিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কোনোভাবেই তা সে করতে পারেনি। 

তার তিন ছেলে আর চার মেয়ে। অতটুকু বাড়িতে জায়গা হতো না। এখন অবশ্য তার দুই ছেলে এখান থেকে সরে গেছে। আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েরা বাড়ির কিংবা জমির ভাগও পায়নি। জমি থাকলে না ভাগ পাবে।

কিন্তু কাদেরের অবস্থা এখন ফিরেছে। তবু সে এই সাহাবাড়িটার উপর থেকে লোভ ছাড়তে পারেনি। মাসখানেক হলো তার বাপ মরেছে―বলতে গেলে অনাহারে। তিন ভাইয়ের একটাও বাপকে ভাত দিতো না। আর তাদের মা মরেছিল বাপের আগেই। একেবারে ভিক্ষা করে খেতো অসহায় মহিলাটা। 

সেই কাদের কেমনে-কেমনে দু্বার মেম্বারও হয়েছে! এখনও চলছে তার মেম্বারগিরি। কিছু লোক বলে―সামনেও নাকি সে হয়ে যাবে! 

সে এখন ছলে-বলে-কলে-কৌশলে গোবিন্দ সাহার বড়বাড়িটা কিনতে চায়! আসলে, যেন-তেন-প্রকারে দখল করতে চায়।

গোবিন্দ সাহা বেশি কথা বলেন না। তিনি বড় পান-দোকানটা সামলাতেই সময় পান না। তার ছোট ছেলেটা তার কাজে সাহায্য করে থাকে। আর-এক ছেলে ঢাকায় বড় চাকরি করে। তাও আবার সরকারি। মেজো ছেলেটা কাস্টম-অফিসার হয়েছে। টাকাপয়সার অভাব নেই গোবিন্দ সাহার। বড় দুই মেয়েকে আগেই বিয়ে দিয়েছেন অবস্থাসম্পন্ন ঘরে। 

বড় ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছেন ধনীপরিবারে। মেজোটির জন্যও ভালো একটা বংশীয় মেয়ে খুঁজছেন। তার ছোটো ছেলেটা কলেজে পড়ছে। পাশাপাশি তাকে দোকান সামলাতেও সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও তার একজন কর্মচারীও আছে। তবে সে মাঝেমাঝে আসে না।

তার বাড়িঘরের চেহারা আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়েছে। তাই, কাদের পাগলের মতো এখানে প্রতিদিন কয়েকবার ছুটে-ছুটে আসে। কিন্তু গোবিন্দ সাহা তার সঙ্গে দুর্বব্যহার করেন না। চুপচাপ সব সয়ে যান। তাদের সয়ে যেতে হয়। সংখ্যালঘু মানুষের অনেক জ্বালা। সবটা সবাই বোঝে না। দূর থেকে তা বোঝাও যায় না। কাছে এলে তবু কিছুটা আঁচ করা যায়।

আজ গোবিন্দ সাহার উপর ভয়ানক ক্ষেপে গেল কাদের মেম্বার। সে রেগেমেগে বলে উঠলো, “শালা, মালাউন, ভারতে যাইতে মনে চায় না কেন? এখানে থাইকে কী করবেন? বাঁচতে চাইলে ভারতে চইলে যান!”

গোবিন্দ সাহা বললেন, “তুমি কী করবে এইখানে থাইকে?”

কাদের বলে, “এইটা মুসলমানের দেশ। তাই, আমরা থাকপো এইখানে।”

গোবিন্দ সাহা আজ খুব প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। কত আর সহ্য করা যায়! তিনি শান্তভাবেও কঠিন কয়েকটা কথা বলে ফেললেন, “এটা মুসলমানের দেশ না। মুসলমানের দেশ তো পাকিস্তান। তুমি সব বেচেটেচে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছো না কেন? এটা হিন্দু-মুসলমান সবার দেশ।”

কাদের এই এককথায় একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়। একজন মুসলমান-দোকানদার এসে তাকে ধমকায় কিছুক্ষণ। বলে, “এই কামলার ব্যাটা মেম্বার হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। সামনে এরে আর ভোট দেওয়া যাবি নানে।”

কাদের এতে দমে যায়। শেষে তার আম-ছালা দুটোই না চলে যায়! ধমক খেয়ে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। 

ওর উৎপাত দেখে বাজারের আরও কয়েকজন মুসলমান-দোকানদার এসে ও-কে আচ্ছামতো ধমকালো, ‘এই ব্যাটা রোজ-রোজ কী ফাজলামি শুরু করছিস? এই লোকটা ভারতে যাবে কেন? কওয়া লাগে তার চৌদ্দপুরুষ এইখানে থাকে। তোর জন্য সব ছেড়ে দিয়ে তিনি ভারতে চলে যাবেন?’

কাদের আর দাঁড়ায় না। আহত নেকড়ের মতো ভিতরে-ভিতরে জ্বলে উঠে লেজগুটিয়ে পালিয়ে যায়। পালানো যে তার স্বভাব।

গোবিন্দ সাহা এতে খুশি মনে সবাইকে ডবল-ডবল পান বানিয়ে খাওয়ালেন। লোকগুলো কাদেরের বিরুদ্ধে মারমুখো হওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন খুব।


সবাই ভাবলো, সে চলে গেছে। আর হয়তো এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু গোবিন্দ সাহা জানেন―সে একটা আস্ত পিশাচ। সে কোনোভাবেই এ-পথ ছাড়বে না। তাকে বারবার জ্বালিয়ে খাবে।

দুপুর হওয়ায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরলেন গোবিন্দ সাহা। তিনি মনখারাপ করেননি। তবু তার আনন্দ যে, আজ মুসলমান-দোকানদাররাও তার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছেন। আগেও অবশ্য তারা এব্যাপারে কাদেরকে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাদের তা শোনেনি। সেইজন্য সে আস্তে-আস্তে এসে গোবিন্দ সাহার দোকানে বসে তাকে বোঝাতো―ভারতে গেলে তার বিরাট লাভ।

গোবিন্দ সাহা ওর চেয়ে ভালো বোঝেন। তবু সে এ-ব্যাপারটা নিজে বোঝে না।

গোবিন্দ সাহার ছোট ছেলেটা আরও নিরীহ। সে সবসময় চুপচাপ থাকে। এসব ব্যাপারে সে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতে যায় না। যা করার তার বাবাই করবে। এমন একটা ভরসা আছে তার।

দুপুরের পর বাজারের প্রায় সব দোকানপাটই বন্ধ হয়ে যায়। ভিতরের দিকে কেউ-কেউ দোকান খুলে বসে থাকে। তবে এই সময় বেচাকেনা খুব কম হয়। অনেকে তাও থাকে। ওদের বাড়িঘর দূরে হওয়ায় ওরা একবারে বাড়ি ফিরবে বলে। 

গোবিন্দ সাহার বাড়ি বেশি দূরে নয়। তাই, তিনি বাড়ি গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম করে তবেই দোকান খোলেন।

তিনি দুপুরে ভাত খেয়ে বিশ্রাম করতে যাবেন। এমন সময় তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো দুটি যুবক। তারা বললো, ‘দোকানটা সরকারি রাস্তায় পড়েছে―তাই, এটা ভেঙে দিতে হবে, কাকা।’

গোবিন্দ সাহা ওদের কথা শুনে হাসলেন। তারপর বললেন, “তোমাদের টাকাপয়সা দিয়ে কে পাঠিয়েছে? কাদের মেম্বার তা-ই না?”

যুবক দুটি এবার থতমত খেয়ে বলে, “না, মানে, না।” 

তারা আর-কিছু বলতে পারে না। মোটর-সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি সটকে পড়ে।

বিকালে তিনি দোকান খুলে বাজারের প্রায় সব দোকানদারকে এই ঘটনাটা জানিয়ে রাখলেন।

তার পাশের রঙের দোকানদার বললো, “ব্যাটার মেম্বারগিরি এইবারই শেষ। সামনে ভোট আর পাওয়া লাগবে না। ভোট চাইতে আসলে জুতাপেটা করে দেবো।”

গোবিন্দ সাহা কিছু বলেন না। তিনি সব শুনে মনে মনে হাসেন। কাদের মেম্বারদের তিনি খুব ভালোভাবে চেনেন। এরা হলো শকুনের বাচ্চা। একবার যেদিকে চোখ দেয় তা আর ভুলতে পারে না। ছাড়তেও পারে না। শকুনের চোখ বড় ভয়ানক।


দুপুরবেলা পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ফিরে এলো গোবিন্দ সাহার বড় পুত্রবধূ।

সে দেখতে পেয়েছে, পুকুরের ওপাড়ে বড়-হিজলগাছটার তলায় একটা লোক বসে রয়েছে। তার ভাবসাব আর চাউনি মোটেই ভালো নয়। সে ভয় পেয়েছে। 

মেয়েটা দৌড়ে এসে শ্বশুর-শাশুড়িকে সব বলেছে। 

গোবিন্দ সাহা সেখানে গিয়ে দেখলেন, কাদের মেম্বার গাছতলায় বসে রয়েছে! বিড়ি ফুঁকছে মনের আনন্দে।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, “মেম্বার, তুমি এইখানে কেন? বাড়ি ফিরে যাও। আমার বউমা স্নান করবে এখানে।”

সে গায়ে মাখে না গোবিন্দ সাহার কথা। চুপচাপ বসে থাকে আগের মতো। একটু পরে তার এক সাগরেদ এসে বসলো সেখানে। দুটিতে মিলেমিশে গানজুড়ে দিলো।

সে হেসে বলে, “এইখানে বাতাস ভালো। তাই, বইছি, দাদা।”

গোবিন্দ সাহা সব বুঝতে পারলেন। তিনি বাড়ির ভিতরে ঢুকে বললেন, “স্নানঘরে স্নান করো, বউমা। আমি পরে দেখবো ব্যাপারটা।”

এরপর প্রায় প্রতিদিন মেম্বার পুকুরপাড়ে বসে থাকে। সে এখানে আরও লোকজন নিয়ে আড্ডা জমায়। সাহাবাড়ির বউঝিরা পুকুরে নেমে স্নান করতে পারে না। 

সবাই বুঝতে পারে, সে নতুন কোনো ফন্দি করেছে। আর এভাবে জ্বালাতন করতে থাকলে একদিন সাহারা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সে জানে না যে, গোবিন্দ সাহা কখনো এদেশ ছেড়ে যাবেন না। এটা তার প্রতিজ্ঞা। আর এটা তার জন্মভূমি।

হঠাৎ এক মাঝরাতে গোবিন্দ সাহার ঘরের চালে সমানতালে, একের-পর-এক ঢিল পড়তে লাগলো। আর তা প্রায় একটানা দশ-বারো মিনিট পর্যন্ত চললো। 

সাহাবাড়ির সবার ঘুম ভেঙে গেছে ঢিলের শব্দে। 

গোবিন্দ সাহা সবাইকে নিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকলেন। ঠাকুরের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে আর্তনাদ করলেন অনেক সময় ধরে। পরিবারের প্রায় সবাই ভেসে গেল চোখের জলে।

এরপর প্রায়ই মাঝরাতে ঢিল পড়তে লাগলো সাহাবাড়ির টিনের চালে। আর তা চলতে থাকে দীর্ঘসময় পর্যন্ত। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে লোকজন আওয়াজ দিলে উৎপাতকারীরা পালিয়ে যায়। কাউকে চোখে দেখতে পাননি তিনি। কার নামে কার কাছে তিনি বিচার দিবেন? নিশ্চিন্তে মাঝরাতে কাদের মেম্বার তার লোক দিয়ে উৎপাত করাচ্ছে। তবু তারা এরই মধ্যে খাবার খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন।


গোবিন্দ সাহা নানাকারণে মনমরা হয়ে সেদিন সন্ধ্যায় পান-দোকানে বসে ছিলেন। তার মনটা ভালো নেই। বাড়ির বউঝিরা পুকুরে নামতে পারে না। রাতে এখনও মাঝেমাঝে ঘরের চালে ঢিল পড়তে শুরু করে। আর তা চলে প্রায় মিনিট দশেক থেকে আধঘণ্টাখানেক।

তিনি গুম হয়ে বসে ছিলেন। এমন সময় তার তিন-চারটা পরের দোকানদার দিদার বক্স দৌড়ে এসে তার দোকানের একপাশে বসে পড়লো। তারপর হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো, “খবর শুনেছেন কিছু, দাদা?”

গোবিন্দ সাহা মনখারাপ করে বললেন, “না, দাদা। কিছু শুনিনি। কীসের খবর? কী খবর?”

সে এবার সোল্লাসে যেন বলে উঠলো, “আমাগরে কাদের মেম্বার মারা গেছে! খানিকক্ষণ আগে হাট থেকে ইজিবাইকে করে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ তিনমাথার মোড়ে ওর ইজিবাইকটা উল্টে একেবারে বাঁধের তলায় গিয়ে পড়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে মারা গেছে সে। ঘাড়টা নাকি ভেঙে গেছে!”

খবরটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান গোবিন্দ সাহা। এটা তার বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু দিদার বক্স যখন পুনরায় তাকে বলেছে, সে এটা নির্ভরযোগ্য কয়েকজনের নিকট থেকে এইমাত্র শুনেছে। তখন আর এতে অবিশ্বাসের কিছু বাকি থাকে না। 

খবরটা শুনে তার দেহমন কেমন করে যেন কেঁপে উঠলো কয়েকবার! তারপর তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। কারও মৃত্যুকামনা তিনি করেননি কখনো। তিনি শুধু এই জুলুমের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এ কী হয়ে গেল! তিনি হতভম্বের মতো বসে রইলেন আরও কিছুক্ষণ। তবু একসময় তার কাছে হঠাৎ এই খবরটাকে মনে হলো―একটা মর্মান্তিক খুশির সংবাদ!

তিনি এবার আপনমনে ভাবতে লাগলেন―ত্রিশ বছরের এই উৎপাত আর এই জ্বালাতন আর কখনো ফিরে আসবে না তার জীবনে! কেউ কখনো তাকে ভিটেমাটি থেকে আর উচ্ছেদ করতে চাইবে না! এবার কেউ ছলে-বলে-কৌশলে তার সবকিছু গ্রাস করতে চাইবে না! আর তাকে প্রতিদিন ভারতে চলে যাওয়ার কথা বলতে আসবে না কেউ!

 

তিনি যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। তারপর তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে যেতে লাগলেন। এখনই তাকে একবার ঠাকুরঘরে ঢুকতে হবে।

তিনি বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই ভক্তিভরে কয়েকবার হাত ঠেকালেন কপালে। তারপর মনের খুশিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, “ঠাকুর! ঠাকুর! ঠাকুর!”




অবলাদের কথা - লিসা মাঝি || Obolader Kotha - Lisha majhi || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

             অবলাদের কথা

                        লিসা মাঝি 



দিনটা ছিল লক্ষ্মীবার অর্থাৎ বৃহস্পতিবার। তখন সবে একটা-দুটো করে তারারা আকাশের বুকে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, নানানরঙের আবির তখনও চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, বসন্তের ঝিরিঝিরি হাওয়ার সাথে মাথা দোলাচ্ছে শিমুল, পলাশ, কামিনী, ও চম্পা। পাখিরাও সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে খাবার সংগ্রহ করে বাসায় ফিরছে। আস্তে আস্তে চাঁদ পৃথিবীর বুকে তার সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিচ্ছে, মেয়ে-বউরা তুলসি তলায় প্রদীপ দিয়ে শঙ্খধ্বনি করছে।  


এমন সময় মিত্র পরিবারের বড় কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র, বংশের কুলদেবী লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করছেন।


-মা মাগো তুই তো আমায় সব দিয়েছিস, তোর দয়ায় আজ বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পত্তি কোনো কিছুর অভাব নেই, শুধু আমার নাতির অভাব ছিল, কিন্তু আজ দশ বছর পর অবশেষে তুই মুখ তুলে চেয়েছিস, আমার একমাত্র ছেলে কালী কিঙ্করের সন্তান আজ ভূমিষ্ঠ হতে চলেছে, মা আশীর্বাদ কর আমার যেন নাতিই হয়। 


জানিনা ঠিক, মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নাকি অতিরিক্ত আশীর্বাদে মিত্র পরিবারে ভূমিষ্ঠ হলো এক কন্যা সন্তান, মূহুর্তের মধ্যে মিত্র বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন সেই বাড়ির বড়ো কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র। না স্বয়ং বিধাতা পুরুষের ভাগ্যলিখনের জন্য ছয়দিন আর অপেক্ষা করতে হয়নি বোধকরি সেইক্ষণেই নবজাতিকার ভাগ্যলিখনের কাজ নিজ হস্তে তুলে নিয়েছিলেন মিত্র বাড়ির বড়ো কর্তা। অতঃপর সেই সদ্য প্রস্ফুটিত নবজাতিকার স্থান হয়েছিল বাড়ির এক কোণে।

 চারবছর পর বড় কর্তা নিজে সারা বাড়ি আলো দিয়ে সাজিয়ে তুললেন, এইবার মিত্র বংশে জন্ম নিল পুত্র সন্তান। আমরা যেমনভাবে গোলাপ-জুঁই খুব যত্ন করে বাগানে এনে বসাই, পরিচর্যা করি, ঠিক তেমনভাবেই বড় হতে শুরু করলো শিব কিঙ্করের একমাত্র নাতি কমল কিঙ্কর। আর অনাদর অবহেলা সত্ত্বেও বাগানে যেমনভাবে নাম না জানা গাছ বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই ধীরে ধীরে কমলিনী বড় হতে শুরু করলো। কমলিনী মানে পদ্ম, অবশ্যই পঙ্কিলে পদ্ম। তবে কমলিনীর মা সাধ করে নাকি বুড়ো কর্তার উপর বিদ্রুপ করে মেয়ের নাম কমলিনী রেখেছিলেন তা কিন্তু জানা যায় না। দাদু-ঠাকুমা, মা-বাবা আর ভাই এই হল কমলিনীর পরিবার। তবে ওই বাড়িতে কমলিনীর মা ছাড়া কমলিনীকে আর কেউ ভালোবাসে না, আর তাই তার যত আবদার সব শুধু তার মায়ের কাছেই।


ছোট্টো কমলিনী গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো।


-মা সবাই তো স্কুলে যাচ্ছে, আমি কি স্কুলে ভর্তি হবো না? আমি তো সব পারি অ আ, নামতা।

-হ্যাঁ কমু, তুই স্কুলে যাবি আমি তোকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেবো, আমি আজই তোর বাবার সাথে কথা বলবো। 


পান চিবোতে চিবোতে বড় গিন্নির প্রবেশ


-বলি মা-মেয়ে মিলে কি এতো কতা হচ্ছে শুনি?

-মা আসলে কুমুকে স্কুলে ভর্তি করার কথাই বলছিলাম।

-অ, তা ভালো। তবে মেয়েমানুষ নেকাপড়া শিকলেও

 তো আর ব্যাটাছেলে হবে নিকো।

-মা এখন সবারই একটু লেখাপড়া শেখা উচিত।

-অ..তাহলে যা ভালো বোঝো তাই করো। 


(দশদিন পর) 

আজকের দিনটা কমলিনীর কাছে খুব আনন্দের, কারণ আজ কমলিনী প্রথম স্কুলে যাবে। অন্য সব বাচ্চারা যেখানে স্কুল যেতে হবে বলে কাঁদে, সেখানে কমলিনী কখন স্কুলে যাবে, আর স্কুলে গিয়ে কি কি করবে, তা ভাবতে ভাবতেই রাত্রকালীন নিদ্রাসম্পন্ন করে আজ ভোর ভোর উঠে পড়েছে। 


-কমু শোন স্কুলে কিন্তু একদম লক্ষ্মী হয়ে থাকবি, সব পড়াশুনবি মন দিয়ে, স্যার-ম্যাম যা যা বলবেন তাই করবি, দুষ্টুমি করবি না। 

-আচ্ছা মা আমি মন দিয়ে সব পড়া করবো, একটুও দুষ্টুমি করবো না দেখো। 


কমলিনীর মা কমলিনীকে কোলে বসিয়ে চুমু খেয়ে বললেন--


-এইজন্যই তো বলি কমু আমার লক্ষ্মী মেয়ে। চল তোকে স্কুলে দিয়ে আসি। 

-হ্যাঁ চলো মা। 


বাদামী রঙের গেট, সেই গেট পেরিয়ে বড় বিল্ডিং, আর তার উপরেই শোভা পাচ্ছে শিশু শিক্ষা নিকেতন নামটি। সাদা-নীল ফ্রক পরা রঙিন প্রজাপতির মতো একঝাঁক ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে গেট পেরিয়ে হুড়মুড়িয়ে স্কুলে ঢুকছে, কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে আর কেউ কেউ হাসতে হাসতে। তবে কমলিনী ভীষণ খুশি, একসাথে এত মানুষ এর আগে সে কোনোদিন দেখেনি। পাখি যেমন দীর্ঘদিন ধরে খাঁচায় আটকে থাকার পর একসময় খাঁচা থেকে উড়ে গিয়ে প্রথম যেমনভাবে আকাশ দেখে, ঠিক তেমনভাবেই এত মানুষকে দেখে, স্কুল দেখে কমলিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আজ সে আনন্দে আত্মহারা।


-এই সবাই লাইন করে দাঁড়াও, হাত জোড় করো, এখুনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শুরু হবে। 


ম্যামের ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পায় কমলিনী। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সেও হাত জোড় করে গাইতে শুরু করলো। 


- জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা। 


এইভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকটি বছর। তবে কমলিনীর জগৎ বলতে শুধু স্কুল আর বাড়ি। তবে মায়ের অনুরোধে কমলিনীকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য অবশ্য কমলিনীর ঠাকুমা বাড়ির সব কাজের লোক ছাড়িয়ে কমলিনী আর তার মাকে দিয়ে সব কাজ করায়। এত কিছুর মাঝেও কমলিনী মন দিয়ে পড়াশোনা করে। কমলিনী যেমন পড়াশোনায় মেধাবী, তেমন গানের গলাও ভারি সুন্দর। প্রত্যেকবার সে স্কুলে যেমন প্রথম স্থান অধিকার করে, তেমন গানেও ডিস্টিংশন বাঁধা। এইবার সে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা মাধ্যমিক দিলো, আজ তার ফলপ্রকাশ, তাই সকাল থেকেই কমলিনী আর তার মায়ের প্রত্যেকটা মূহুর্ত উৎকন্ঠার মধ্যে কাটছে। 


-মা কি হবে বলো তো? আমার না ভীষণ টেনশন হচ্ছে। আমি সত্যি ভালো রেজাল্ট করবো তো? আমার ভীষণ ভয় করছে মা। 

-ভয় পাচ্ছিস কেন মা। আমি বলছি তো তোর ভীষণ ভালো রেজাল্ট হবে। যা, বাবা, দাদু আর ঠাকুমাকে প্রণাম করে, স্কুলে যা। 

-হ্যাঁ মা এই তো এখুনি যাচ্ছি। 

-থাক থাক আর পেন্নাম করতে হবে না বাছা। বলি মেয়ের ফলপেকাশ হবে বলে কি সারা বাড়ি না খেয়ে থাকবে? যত সব আদিখ্যেতা।

-আমি তাহলে আসছি ঠাকুমা, মা আসছি। 

-হ্যাঁ মা আয় দুগ্গা দুগ্গা। 

-আমি এই স্কুলের হেডস্যার এবং আমার বলতে ভীষণ ভালো লাগছে আমাদের স্কুলের গর্ব একজন মেয়ে। কমলিনী মিত্র শুধু যে আমাদের স্কুলের গর্ব তাই নয় ও জেলারও গর্ব। এই বছর মাধ্যমিকে বর্ধমান জেলার মধ্যে ৬৭৫ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে কমলিনী মিত্র। 


পুরো স্কুল জুড়ে কমলিনীর উদ্দেশ্যে করতালি হচ্ছে, স্যার-ম্যাম থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী সবার মুখে শুধু আজ একটাই নাম কমলিনী মিত্র। 

কমলিনী রেজাল্ট নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে, মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। 


-কি হয়েছে মা কাঁদছিস কেন? কেমন রেজাল্ট হলো? 

-মা আমি পেরেছি, তোমার এতদিনের এত পরিশ্রম আমি বিফলে যেতে দিইনি। আমি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছি। 

কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে কমলিনীর মা বললেন-


-যা কমু, বাবা, ঠাকুমা, দাদু সবাইকে গিয়ে এই খুশির সংবাদটা দিয়ে আয়।

-দেখুন এই বিয়েতে আমাদের তো কোনো আপত্তি নেই। মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়, লেখাপড়াও জানে, গানও জানে, সংসারের সব কাজ জানে কিন্তু আমার আপত্তি বয়স নিয়ে, কমলিনীর বয়স বড্ড কম। আপনার মেয়ে প্রায় আমার ছেলের থেকে

 ১৫বছরের ছোটো, আপনার মেয়ে রাজি হবে তো? 

-সোনার আংটি আবার বাঁকা। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক রাজি হবে। তাছাড়া মেয়েমানুষের এতো পছন্দ-অপছন্দ কীসের? আমরা যাকে দেখে দেবো কমলিনী তাকেই বিয়ে করতে বাধ্য। 


রেজাল্ট জানাতে এসে এইরকম কিছু যে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তা একেবারেই ভাবতে পারেনি কমলিনী, কথাগুলো শুনেই মূহুর্তের মধ্যে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।


-না আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না বাবা। আমি পড়তে চাই, আরও পড়তে চাই। 

-ঠিক আছে কালী কিঙ্কর মিত্র, তাহলে আজ আমরা উঠি, আপনারা নিজেদের মধ্যে এই ব্যাপারে কথা বলে পরে না হয় জানাবেন।

-দাঁড়ান। এই ব্যাপারে আমার কথাই শেষ কথা। কালী কিঙ্কর মিত্র একবার যা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। 

-না বাবা তুমি আমার সাথে এটা কিছুতেই করতে পারো না। বাবা আমি পড়তে চাই, প্লিজ বাবা, আমি হাত জোর করে অনুরোধ করছি। 

-তুই আমার কথার অবমাননা কিছুতেই করতে পারিস না। একবার যখন বলে দিয়েছি বিয়েটা হবে, তার মানে বিয়েটা হবেই। 

-কমু চুপ কর দিকিনি। অনেককন ধরে তোর কতা শুনছি, বাব্বা বাক্যি যেন আর কিছুতেই শেষ হয় না। এত কতার কি আছে বাবু বুঝিনে। মেয়েমানুষ আজ না হয় কাল পরের বাড়ি যেতেই হবে। 

রান্নাঘর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই এইসকল কথা কমলিনীর মায়ের কানে আসছিলো, কিন্তু এই বাড়িতে পুরুষদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা, তাই কমলিনীর মা কমলিনীর বিয়ের কথাটা শুনেও কিছুই বলতে পারছিলেন না। তিনি সবটাই অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন। বোধকরি ওই চোখের জলেই কমলিনীর ভবিষ্যৎ এইবার পরিষ্কার ভাবে ধরা দিল কমলিনীর মায়ের চোখে। তিনি আঁতকে ওঠেন, এবং ছুটে যান বসার ঘরে। 

- ক্ষমা করবেন এইভাবে আপনাদের কথার মাঝে কথা বলছি বলে, আসলে আপনাদের সকলের সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। কমু তো এই সবে মাধ্যমিক দিল, ও এখন অনেকটাই ছোটো আর দু-একবছর যদি....


পুরো কথাটা শেষ করতে পারে না কমলিনীর মা। তার আগেই কালী কিঙ্করের রক্তচক্ষু দেখে কমলিনীর মা চুপ করে যায়। 


-আমি আবারও শেষবারের মতো বলছি আমি বিয়ে করবো না আমি পড়াশোনাই করবো। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার, আর তা আমার জীবনের সাথে জড়িত, তাই আমি যদি না চাই তাহলে আমার অমতে তুমি এই বিয়ে কিছুতেই দিতে পারো না বাবা। মা চুপ করে গেলেও আজ আমি বলবো, বলবোই। আমি জানি এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী শুধু ছেলেরাই সব সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু আমি এই নিয়ম আমার ক্ষেত্রে মানি না। মেয়ে হয়েছি বলে কি আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই? 


একানাগাড়ে চিৎকার করতে করতে কথাগুলো বলতে থাকে কমলিনী। শত অবহেলা, অনাদর সত্ত্বেও যে কমলিনী কোনোদিন কারোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একটা কথাও কাউকে কোনোদিন বলেনি, সে আজ প্রতিবাদ করছে। একটা মানুষ বোধহয় ক্রমাগত কোণথাসা হতে হতে একদিন তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আর তখনই বোধহয় সে প্রতিবাদ করতে শেখে। 


কমলিনীর বাবা, দাদু, কমলিনীর করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার বদলে, কমলিনীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আসলে বাজ পড়ার আগে যেমন চারিদিক নিস্তব্ধ থাকে, মিত্র বাড়িতেও এখন সেইরকমই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এই নিস্তব্ধতা ভাঙে পাত্রপক্ষের গলার আওয়াজে। 

-মিত্র মশাই আজ তাহলে আমরা আসি। আমরা আপনার বাড়ির মেয়েকে আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই না। আমরা মেয়েমানুষের এমন ঔদ্ধত্য কখনই বরদাস্ত করি না, তাই আমরা এই বিয়েটা ভেঙে দিলাম। 


রাগে অপমানে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় কালী কিঙ্কর মিত্রের, চোখদুটো রক্তের মতো লাল। সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কমলিনীর গালে, চুলের মুটি ধরে হির হির করে টানতে টানতে চিলেকোঠার ঘরে আটকে দেয় কমলিনীকে। 


-থাক আটকে এখানে, তোকে কীভাবে সোজা করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে। সবাই শুনে রাখো আজ থেকে কমলিনীর খাওয়া বন্ধ, আর কেউ যদি ওকে কোনোরকম ভাবে খাবার দেওয়ার চেষ্টা করো, তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। 

দুইদিন এইভাবেই কেটে গেল, তৃষ্ণায়-ক্ষুধায় কমলিনী বন্ধ ঘরের মধ্যে ছটফট করতে করতে প্রায় অচেতন হয়ে গেল। ওদিকে কমলিনীর মায়েরও একই অবস্থা, বদ্ধ ঘরের মধ্যে না থাকলেও মনটাতো তার মেয়ের কাছেই বদ্ধ হয়ে আছে। মা কি কখনও সন্তানকে না খাইয়ে খেতে পারে তাই সেও দুদিন ধরে না খেয়ে আছে, আর নিস্তব্ধে চোখের জল ফেলছে এবং এই সকল কিছুর জন্য অদৃষ্টকে দায়ী করেছে। 

-আমি বলি কি কালী, তুই এইবার কমলিনীকে বদ্ধ ঘর থেকে মুক্ত করে দে, আর শাস্তি দিস না। ও তো এইবার মরে যাবে। যতই হোক ও তো আমাদের বংশেরই মেয়ে। 


পরিবারের বড় কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র যার দাপটে এককালে শুধু মিত্র পরিবারই নয় পুরো গ্রাম ভয় পেত, সে আজ প্রথমবার নাতনির হয়ে কথা বললো। কি জানি নাতনির উপর দয়া করে নাকি অপরাধবোধ থেকে নাতনির সপক্ষে কথা বলেছিলেন তা ঠিক বোধগম্য হয়নি। 


-মরলে মরুক, অপয়া মেয়ে একটা। বাবা তুমি একটা জিনিস কোনোদিন ভেবে দেখেছো, কমলিনী যত বড় হচ্ছে তত আমাদের বিষয় সম্পত্তি যা কিছু ছিল, আস্তে আস্তে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, দিন দিন ব্যবসায় লাভের থেকে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে, আর তা শুধু ওই মেয়ের জন্যই হচ্ছে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার উপর বোঝাটা একটু কম হতো, সংসারের একজনের খরচা বেঁচে যেত। তাছাড়া ওর সঙ্গে যদি রায় বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ে হতো, তাহলে সনাতন বাবু হয়তো আমাদের বিজনেস পার্টনার হতেন, এর ফলে আমরাও ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারতাম। 

হায় রে অদৃষ্ট, মেয়েরা নাকি বোঝা। একটু কিছু হলেই মেয়েরা অপয়া। বিয়ের সিদ্ধান্তটা, ঠিক অভাবের জন্য কিনা জানি না, তবে স্বভাবের জন্য তো বটেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই যুগে দাঁড়িয়েও আজও একটা মেয়েকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  


-কালী আমি তবুও বলবো, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। কমলিনীকে আটকে রাখলেই কি সনাতন রায় আবার তার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে? তার থেকে বরং ছেড়ে দে। তাছাড়া এখনও তো কমলিনীর বয়স আঠারো বছর হয়নি, তুই বরং দুইবছর পরেই বিয়ে দিস, তখন আর আমি তোকে আটকাবো না। 


দাদু শিব কিঙ্কর মিত্রের জন্যই সেইবারের মতো রেহাই পেয়েছিল কমলিনী। আসলে সিংহ যেমন বুড়ো হয়ে গেলেও সবসময়ই পশুরাজ হিসেবে মর্যাদা পায়, তেমনই শিব কিঙ্কর মিত্র বুড়ো হয়ে গেলেও এখনও তার কথার অমান্য কেউ করার সাহস পায় না। তবে কালী কিঙ্কর মিত্রের দাপটও কম নয়, তাই সে এতো সহজে দমবার পাত্র নয়, তার উপর আবার মানে আঘাত লেগেছে বলে কথা। তাই কালী কিঙ্কর ছোবল মারতে না পারলেও ফোঁস ফোঁস করেই যাচ্ছে।


 এইভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন....। আজ অনেক ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কমলিনী আর তার মা। আজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সব কাজ সেরে স্কুলে যেতে হবে। ও বলতেই তো ভুলে গেছি আজ একাদশ শ্রেণিতে কমলিনী ভর্তি হবে। 

-যা কমু এইবার তুই স্নানটা সেরে আয়। তোকে আর কিছু করতে হবে না, মোটামুটি সব কাজই হয়ে গেছে, শুধু মাছের ঝালটুকু যা বাকি। 

-ঠিক আছে মা যাচ্ছি। কিন্তু....

-কিন্তু কীসের শুনি? কি হয়েছে রে তোর, কাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি, মুখটা কেমন যেন করে রেখেছিস, কোনো হাসি নেই মুখে। 

-মা তোমার তো ওই বালা জোড়াটুকুই শেষ সম্বল। আমার পড়াশোনার জন্য তুমি সেটাও বিক্রি করে দেবে? এমনিতেই তো তুমি বাবার বিজনেসের জন্য সব গয়নাই বিক্রি করে দিলে। তাই বলছিলাম কি বাড়ির কেউ যখন চায় না, আমি তাহলে আর পড়বো না। 

-তুই এই কথাটা বলতে পারলি কমু? তুই জানিস না আমার কত স্বপ্ন তোকে নিয়ে....তুই পড়াশোনা শিখে একদিন মস্ত বড় মানুষ হবি, বিরাট বড় চাকরি করবি। 

-আমার ভুল হয়ে গেছে মা, আর এইরকম কথা কোনোদিনও বলবো না। আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো দেখো। তোমায় তখন আর একটুও চোখের জল ফেলতে দেবো না, তুমি তখন সবসময় হাসবে। আর মা দেখো তোমায় আমি চাকরি পেয়েই সব গয়না গড়িয়ে দেবো। 

-এই তো আমার সোনা মেয়ের মতো কথা।.....এই রে দেখলি তো তুই বকবক করতে করতে আমার কত দেরী করিয়ে দিলি, যা এইবার তাড়াতাড়ি স্নানে যা নইলে আরও দেরী হয়ে যাবে। 


কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস। ঠাকুমা, বাবা-দাদু, আত্মীয় স্বজন সকলের কথা অগ্রাহ্য করে কমলিনী একাদশ শ্রেণিতে সায়েন্স বিভাগেই ভর্তি হয়েছে। তাদের বক্তব্য ছিল, মেয়েমানুষের মাথায় নাকি অঙ্ক ঢুকবে না, তাই সায়েন্স নিয়ে লোক না হাসিয়ে বরং আর্টস নে। এই কথা যে কতখানি ভুল তা একদিন ঠিকই প্রমাণ করে দেবে কমলিনী। যদিও তার কাছে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স সবই সমান। যে কোনো বিভাগেই, পড়াশোনা না করলে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই শক্ত, আর পড়াশোনা করলে তা সহজ। 


সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে আজ স্কুলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কমলিনী সহ স্কুলের সকল শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এবার স্যার-ম্যামরাও নৃত্য এবং সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। তাই এইবারের অনুষ্ঠানটা একটু ভিন্ন স্বাদের হতে চলেছে। 


এবারে অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকছে এই বিদ্যালয়েরই দ্বাদশ শ্রেণির এক কৃতি ছাত্র অভিনন্দন চৌধুরী। 


-নমস্কার আমি অভিনন্দন চৌধুরী। এখানে উপস্থিত সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম এবং বাকিদের জানাই আমার ভালোবাসা। নলেন গুড় আর পিঠে পুলীর সনে অনেক হল শীতের মেলা, সরস্বতীর আরাধনার মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে এলো বিদায় বেলা, সাঙ্গ হল শীতের খেলা, তাই তো শীতের যাবার পালা। বসন্তেরই আসার পালা, আর তাই কোকিলের কুহুতান নিয়ে এসেছে সেই বার্তা। এই সরস্বতী পুজোর হাত ধরেই বসন্তের সূচনা হয়। যারা একটু শীতকাতুরে তারা যেন এই সময় একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বসন্তকাল মানেই ভোরের দিকে হালকা হালকা শীত ভাব, সকালে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে ঘুম থেকে ওঠা। শীতে যেমন রুক্ষতা বেড়ে যায়, পাতা ঝরতে শুরু করে তেমনই বসন্তে গাছগুলোতে নতুন করে পাতা জন্মাতে শুরু করে। গাছগুলো যেন নতুন করে সেজে ওঠে, চিরসবুজ হয়ে যায়, আর তাই বসন্তকাল মানে আমার কাছে আশার আলো। এ তো গেলো শুধু সকালবেলার কথা, তবে বসন্তের বিকেলগুলোও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। গোধূলি বেলায় সূর্য যখন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় ঠিক সেই সময়ে প্রকৃতিতে এক নতুন রঙের সৃষ্টি হয়, নীল দিগন্তের সাথে ফুলের রঙ। আর তাই তো কবি গেয়ে ওঠেন নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো..


এইভাবেই অভিনন্দন চৌধুরীর মনমুগ্ধকর সঞ্চালনায় একের পর এক নৃত্য, আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশন হতে লাগলো। আর কমলিনী মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিনন্দন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইলো, সে এমনই মুগ্ধ হয়ে গেল যে, কোনো শব্দই তার আর কানে আসে না। আর তাই তো বারবার তার নাম অ্যানাউন্স করার পরও কমলিনীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। 

-কমলিনী মিত্র....কমলিনী মিত্র তুমি যেখানেই থাকো, এখুনি স্টেজে চলে এসো, আমরা নাহলে অনুষ্ঠানটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না। 


কমলিনীর এক বন্ধু সুচেতনার ডাকে হুঁশ ফেরে কমলিনী। সে ধীর পায়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। 

-বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, হৃদয়ে দিয়েছো দোলা। রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা। 


চোখ বন্ধ করে গান গাইতে থাকে কমলিনী। এটা তার ছোটোবেলার অভ্যাস, আসলে কমলিনী মনে করে, চোখ বন্ধ না করলে সে মন দিয়ে গান গাইতে পারে না। কিন্তু, আজ সে চোখ বন্ধ করলেও ঠিক মন দিয়ে গান গাইতে পারছে না। চোখ বন্ধ করলেও সে আজ শুধু অভিনন্দন চৌধুরীকেই দেখতে পাচ্ছে। 

গান শেষ করে আবারও ধীর পায়ে স্টেজ থেকে নেমে আসে কমলিনী। এরপরই শুরু হয় অভিনন্দন চৌধুরীর আবৃত্তি। 


-যেমন আছো তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ। বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে,

নাইবা হলো পত্রলেখায়, সকল কারুকাজ। 


বেশ কিছুদিন পর.....একদিন স্কুলে--


-জানিস তো সুচেতনা, আমি না বুঝতেই পারছি না ছাই, আমার যে ঠিক কি হয়েছে.....আজকাল কোনো কাজেই আমার মন লাগে না, এমনকি পড়াশোনা করতেও ইচ্ছে করে না। আচ্ছা বল নারে, কেন আমার সবসময় অভিনন্দন দা কেই দেখতে ইচ্ছে করে..কই আগে তো এমন হতো না। অভিনন্দন দা তো আমাদের স্কুলেই পড়তো। 

-কবে থেকে তোর এমন হচ্ছে কমলিনী? 

-ওই যে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানের দিন থেকেই। ওইদিন নীল-হলুদ পাঞ্জাবীতে খুব সুন্দর লাগছিল অভিনন্দন দাকে, তারপর স্টেজের ওই রকমারি আলোগুলো যখন অভিনন্দন দার মুখে এসে পড়ছিল, তখন খুব স্নিগ্ধ লাগছিল অভিনন্দন দাকে। 

-হুম বুঝলাম। তুই প্রেমে পড়েছিস।

-হ্যাট কি যে বলিস! 

-আমি ঠিকই বলছি, তুই যা দেরী না করে মনের কথাটা জানিয়ে দে। 

-ও বাবা আমি পারবো না। অভিনন্দন দা সামনে এলেই তো আমি লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে অবধি পারি না, বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। ছাড় এসব। বলছি শোন না তুই প্লিজ এই কথাটা কাউকে বলিস না। 

-আচ্ছা ঠিক আছে কাউকে বলবো না। 


একবছর পর....


কমলিনীর এখন ঠিক শ্রীরাধিকার মতো অবস্থা, যখনই সে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ শোনে তখনই এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যায়, খুঁজতে থাকে তার প্রিয়তমকে। সাইকেলের এই ক্রিং ক্রিং শব্দই যেন বাঁশির অনুরূপ। আসলে অভিনন্দনের সাথে এখন আর কমলিনীর দেখা হয় না। অভিনন্দন এখন কলেজে পড়ে আর কমলিনী উচ্চমাধ্যমিক দিলো। 


কিছু মাস পর....


-তাহলে ওই কথাই রইলো মিত্র মশাই, আগামী পড়শু আমার ছেলের সাথে কমলিনীর বিবাহ হবে। 


এবার আর কমলিনী কোনোভাবেই তার বিয়ে ভাঙতে পারলো না। এমনকি কমলিনীর মাও পাত্রের সরকারী চাকরী আছে বলে আর আপত্তি জানালেন না। বোধকরি তিনিও ভেবেছিলেন মেয়েমানুষকে রান্নাঘরেই মানায়। কমলিনী দৌড়ে গেল অভিনন্দনের কাছে, বোধহয় সে একবার তার স্বপ্ন পূরণের জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করতে চেয়েছিল। 


-কীরে কমলিনী কেমন আছিস? শুনলাম তোর নাকি বিয়ে? মেয়েদের জীবন কিন্তু সত্যিই সুখের, চাকরি করার কোনো দরকারই পড়ে না।  


কমলিনী সেই মূহুর্তে বুঝে গিয়েছিল, পৃথিবীর সকল পুরুষই এক। এরা কখনই নারীদের মনের গভীরতাকে আবিষ্কার করতে পারেনি। এরপর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কমলিনীর। অষ্টমঙ্গলায় সে বাপের বাড়ি এসে তার মাকে বলেছিল-


-গোটা পুরুষজাতির পৌরুষত্ব বোধহয় নারীদের গায়ে হাত তোলাতেই বজায় থাকে। 


উত্তরে তার মা তাকে বলেছিল- মানিয়ে নে মা। এই মানিয়ে নিতে নিতেই বিয়ের একবছরের মধ্যেই কমলিনীর প্রাণ বায়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত কমলিনী মরিয়া বাঁচিয়াছিল। যুগের পর যুগ কেটে যায় কিন্তু কমলিনীদের কথা কেউ জানতে চা

য় না, কেউ বুঝতে চায় না, তাই এইসকল কথা ডায়েরি বন্ধ হয়েই থেকে যায়। তাই আজ আমি নিজেই জানাতে এলাম। নমস্কার আমি কমলিনী।