একাকিত্বের বন্ধু
রীতার মেয়ে তানিয়া বিয়ে করে বিদেশ চলে গেল, রীতার স্বামীও গত হয়েছেন বছর দুই হল। ছেলে তো বউ নিয়ে কলকাতায় আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। মেয়েটাই ছিল রীতার একমাত্র সঙ্গী। মেয়ের অভাবে রীতার বুকটা ব্যথায় টনটন করে। একাকীত্বের বোঝায় ক্লান্ত তানিয়ার চোখের জল বাধা মানে না।
তানিয়ার বিয়ের পাহাড়-প্রমাণ উপহার-সামগ্রী গোছানোর শেষে রীতা দেখে মাত্র পাঁচটা বই তানিয়া উপহার পেয়েছে, অথচ রীতা তার বিয়েতে পেয়েছিল বাষট্টিটা বই। রীতা বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতো বলে রীতার মা বইগুলো রীতাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সব বই তখন পড়া হয়ে ওঠে নি।
সংসারের সব কাজকর্ম, দুই ছেলেমেয়েকে ভালোভাবে মানুষ আর স্বামীর ফাইফরমাস খাটতে খাটতে বই পড়ার অভ্যেসটাতে রীতার ভাটা পড়তে পড়তে ক্রমশ শূণ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল।
একাকিত্বের গ্লানি মুছতে রীতা আঁকড়ে ধরল আলমারিতে সযত্নে রাখা তার সেই বিয়েতে পাওয়া বইগুলোকে। বই পড়তে পড়তে রীতার বুকের ফাঁকাটা কখন যে ভরাট হয়ে যায় রীতা বুঝতেই পারে না। চুঁচুড়ায় রীতার বাড়ি থেকে জেলার গ্রন্হাগারটা খুব দূরে নয়। একদিন গিয়ে রীতা সদস্য হয়ে এল। প্রায়ই সে গ্রন্থাগার থেকে নানান বই নিয়ে এসে পড়তে থাকে। রীতা মনে মনে বলে, "বই, তোমার মত বন্ধু আর পৃথিবীতে কেউ নেই। এত কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করলাম, কিন্তু কেউই তো আর সেরকম খোঁজখবর নেয় না। বই, আমার সই, তোমার জন্যে আমি সব দুঃখ ভুলে নতুন আলোয় বাঁচার দিশা পেলাম।
বি. এ. পড়তে পড়তে রীতার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর অসুস্হ শাশুড়ির সেবা করতে গিয়ে আর পরীক্ষাটা দেওয়া হয় নি। রীতা মনস্থ করল নেতাজী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে সে গ্র্যাজুয়েশনটা করে নেবে। চুঁচুড়ার একটি কলেজে ভর্তি হয়ে শনি আর রবিবার ক্লাশ করতে যেতে শুরু করল। তাদেরই প্রতিবেশী অভাবী ঘরের মেয়ে তানিয়ার বন্ধু পর্ণা, রীতাকে এ ব্যাপারে অনেক খোঁজখবর এনে দিয়েছিল আর সহযোগিতাও করেছিল। পর্ণা একটা চাকরি করে বলে ওপেন থেকে গ্র্যাজুয়েশনটা করে নিচ্ছিল। অবশ্য রীতাও পর্ণাকে গরীব বলে কখনও দূরে সরিয়ে রাখে নি, তানিয়ার সঙ্গে মিশতেও বাধা দেয় নি। যতটা পারত রীতা মেধাবী পর্ণাকে সাহায্যই করে এসেছে এতকাল। সেই উপকারের প্রতিদান দেবার একটু সুযোগকে পর্ণা হাতছাড়া করলো না। রীতার উৎসাহ দেখে সে অবাকও হয়ে যায়! কিন্তু ছেলে সুজয় ভাবল তার মায়ের বোধহয় বুড়ো বয়সে ভীমরতি হল, তানিয়া অবশ্য খুবই মাকে অনুপ্রেরণা দিল বিদেশ থেকে।
অবশেষে বাষট্টি বছর বয়সে রীতা যখন বি এ পাশ করল প্রতিবেশীরা সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। রীতার সাফল্যের আনন্দে পর্ণাই মিষ্টিমুখ করালো সবাইকে রীতার দেওয়া সুন্দর দামী শাড়িটা পরে।
No comments:
Post a Comment