Thursday, March 30, 2023

দংশন - মাইসার মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

 দংশন

                      মাইসার মন্ডল


এসএসসি পরীক্ষার্থী সন্তোষ বেশ কয়েকবার উত্তরপত্রে চোখ বোলাল। তারপর অস্ফুটস্বরে বলল , " নি:সন্দেহে ভাল রেজাল্ট হবে। ইন্টারভিউ-এর রেজাল্টটাও এরকম হলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাব। "

     ওর এরকম আশা করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ও স্কুল- কলেজ- ইউনিভার্সিটির প্রত‍্যেকটি পরীক্ষাতেই বরাবর ভালো রেজাল্ট করেছে। বি.এড ট্রেনিং করেছে।আবার এসএসসি পরীক্ষাতেও প্রায় প্রত‍্যেকটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর লেখেছে।এইসব কারণে ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার আশা করল।ঠিক সময়ে ইন্টারভিউও দিল।তাতেও ভালো রেজাল্ট‌ হ‌ওয়ার আঁচ‌ পেল।সেজন‍্য আত্মবিশ্বাস নামের অসংখ‍্য সুতো দিয়ে চাকরি পাওয়ার দুর্মর আশার জাল বুনতে বুনতে ওর অনেকদিন কেটে গেল । তবুও ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আকাশের চাঁদ হয়েই থেকে গেল।

     কিন্তু ওর ক্লাসফ্রেন্ড এবং এ-বারের এসএসসি পরীক্ষার্থী , মহেশের হাতে ঠিক সময়েই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছে গেল।ব‍্যাপারটা ঠিক আকাশের চাঁদ মহেশের হাতের মুঠোয় নেমে আসার মতো। খবরটা শুনে সন্তোষ অত‍্যন্ত বিস্মিত হয়ে উঠল।ব‍্যাপারটা ওর খুব‌ই রহস‍্যজনক মনে হল। ও একদিন বিশেষ সূত্রে মহেশের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার রহস‍্যটা উদ্ঘাটন করল।

  নিশিকান্ত একজন ডাকসাইটে দালাল। ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন‍্য এ-বারের অনেক এস‌এসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছিল।তার বিনিময়ে 

অযোগ‍্য মহেশ‌ শিক্ষাজগতের মহাসম্রাটে পরিণত হয়ে 'শিক্ষক পদ ' নামের একটা সিংহাসন দখল করে নিয়েছে।

  এই বিচিত্র রহস‍্যটি উদ্ঘাটিত হওয়ায় সন্তোষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে , আজকাল চাকরিও বাজারের পণ‍্যদ্রব‍্যের মতো । এই কারণেই যার ট‍্যা়ঁকে টাকা থাকবে চাকরির খেলায় সে-ই জিতে যাব। অমেধাবী পরীক্ষার্থীটিও ' ম‍্যান অফ দ‍্য সার্ভিস ম‍্যাচ ' হয়ে যাবে।আর যার ট‍্যাঁকে টাকা থাকবে না তার বেলা চাকরি আকাশের চাঁদ হয়ে গিয়ে ধরাছোঁয়ার অনেক--- অ-নে-ক বাইরেই থেকে যাবে।

    সেজন‍্য টাকাহীন সন্তোষ ওটাকে ছ়ু়ঁতে না পেয়ে বেকারত্বের যন্ত্রণা নামের বাসুকি নাগের বিরামহীন দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠল।ওই ক্ষতগুলোর অসহ‍্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন‍্য ওয়াগন ব্রেকার দলের দলপতির বাড়িতে ধর্ণা পাতল।ওকে দেখে দলপতি বিস্ময়ে হতবাক হল।মুহূর্তের মধ‍্যেই ওকে দলে নেওয়ার জন‍্য রাজি হয়ে গেল। সন্তোষের হৃদয়বৃক্ষের কোটরে কোটরে হতাশার যে -পাখিগুলো বাসা বেঁধেছিল তারা বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেল।সন্তোষের জীবনসমুদ্রে ব‍্যর্থতার ভরা জোয়ার ওঠে তান্ডবলীলাও ঘটাতে পারল না। ও ঠিক সময়েই কাজে যোগ দিল।অল্পস্বল্প মদ‍ না খেলে ওই কাজে নাকি ভালো যশ হয় না।সেজন‍্য সন্তোষ‌ও মদ খেতে শুরু করল।

      ও একদিন বেপরোয়াভাবে দু-বোতল মদ

 গ্রাস করে ফেলল।সেজন‍্য নেশায় বিভোর হয়ে উঠল। মাথাটা বোঁ বোঁ করে প্রচন্ড ঘুরপাক খেতে শুরু করল।নেশার প্রেতনী মাথায় চেপে পুরো শরীরটাকেই যেন টারবাইন এর মতো একটা ঘূর্ণমান যন্ত্রে পরিণত করল।ভয়ঙ্কর মূর্তিধারণ করল। ওকে দেখে স্বয়ং যমদূত‌ও যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাবে।আর না পালালে ভবের ক্ষেতে ডাঁশা পটল তুলে বসবে। সন্তোষ পথে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল। হাঁটু থেকে তাজা রক্ত ঝরতে লাগল।কষ্টেসৃষ্টে বাড়ি ফিরল। একটা বাঁশের খ়ু়ঁটিতে হেলান দিয়ে বসল।কীসব আকশ- পাতাল এলোপাতাড়ি চিন্তাভাবনা করতে লাগল।

     শিখা কী-একটা কাজের জন‍্য ঘোষপাড়ায় গিয়েছিল।ওখানে এক আত্মীয়র মুখ থেকে সন্তোষের ওয়াগন বেকারের দলে যোগ দেওয়ার খবরটা শুনে ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। জোর কদমে বাড়ি ঢুকতেই সন্তোষ বলল, "কোথায় গিয়েছিলি রে মুখপুড়ি! শিখা কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিল।কিন্ত ও স্বামীর ভাবমূর্তি দেখে ; ব‍্যাপারটা টের পেতেই বিস্মিত হয়ে উঠল। শিখার গৃহশিক্ষক সন্তোষ এবং আজকের সন্তোষের মধ‍্যে পার্থক‍্য খুঁজতে গিয়েই ওর মস্তিষ্কে সজোর একটা চোট লাগল।

       হৃদয়ে ধ্বংসমাতাল ঘূর্ণিঝড় উঠল।বেদনার বিষবাষ্প বুক ঠেলে বেরিয়ে এল!

---তুমি মদ খেয়েছ ?

---হ‍্যাঁ-য়‍্যা।

---ছি!ছি! ইতর!অসভ‍্য কোথাকার!

--- অ-স-অ-ভ-ভো ? ই-তো-ওর আ -আমি?

---হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ।তুমি চোর, মদখোর।শিক্ষিতজগতের কলঙ্ক!

---শি-ই-খা!মু-মু-উখ ভে-এ-ঙে দে-এ-ব।

---যে-চরিত্রের গুণে মুগ্ধ হয়ে: গ্রামের সবচেয়ে ধনী ঘরের মেয়ে হয়েও--- সকলের বাধানিষেধের পর্বত ডিঙিয়ে ; তোমার মত চালচুলোহীনের 

হাত ধরে ; অচেনা পথে পা রেখেছিলাম,আজ তার এই পরিণতি ?

            শিখা ডুকরে কেঁদে উঠল।অশ্রধারা বাগ মানল না‌। আশাহত গলায় বলল, " সমাজে বুক ফুলিয়ে বলতাম , আমার স্বামী গরিব হলেও জ্ঞানগরিমা ও মানমর্যাদায় অনেক উঁচু দরের লোক। কিন্তু তুমি এত নীচু পথে নেমেছ যে, তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট লোক সমাজে খুব‌ই কম আছে। শিখা কোন‌ওদিন স্বপ্নেও জানত না যে, ওর জীবনের আকাশটি এমন দুর্যোগের মেঘে ছেয়ে যাব। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেও ও অসীম সুখানুভব করত। ওটা থেকেও ও আজ বঞ্চিত হল।ওর জীবনের রঙ্গশালায় সুখনাট‍্যের শেষ দৃশ‍্যটিও মনে হয় অভিনীত হয়ে যবনিকাপাত‌ও হয়ে গেল।  

        কিছুক্ষণ পর সন্তোষের নেশা একটু কমল।কিন্ত ক্ষোভের আগুন সমানেই জ্বলতে থাকল। ক্ষোভের সুরে ও ওর প্রতিক্রিয়া ব‍্যক্ত করতে লাগল, " আমার ক্লাসফ্রেন্ড মহেশ মাধ‍্যমিক নামের ক্ষুদে নালাটা পার হতে গিয়ে দু-দুবার জলে-কাদায় হামাগুড়ি দিয়েছে। তিন বারের বেলা কোন‌রকমে জলে ভিজে ; কাদা মেখে পার হয়েছে।আর হায়ার সেকেন্ডারি নামের ডোবা এবং বি.এ নামের পুকুরটা পার হয়েছে টুকলি নামের জলজাহাজের সাহায‍্যে---মানে বই-খাতা ছিঁড়ে-লেখে।আর শালা মহেশই টাকার বলে উপযুক্ত শিক্ষক হয়ে গেল।আমি এক চান্সে এম.এ.বি.এড নামের মহাসাগরটা পাড়ি দিয়েও ঘোড়ার ঘাস কাটা।সত‍্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!" সন্তোষ একসময় বিড় বিড় করতে-করতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ল ।

          তারপর বিশেষ কারণে রাতে মদ জুটল না।আজকাল মদের নেশা কেটে গেলেই সন্তোষেরর‌ হৃদয়াকাশে 'সত‍্য ও ন‍্যয় ' নামের দুটি বিশালাকারের সূর্য ওঠে।রাতে মদ না জোটার কারণে ওই সূর্যদুটি উঠে পড়ল। সেজন‍্য সন্তোষ ওর নিজের কর্মধারার সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে শিক্ষিতসমাজের কলঙ্ক ও ঘূণ আখ‍্যা দিল। এমনকী ' শিক্ষিত পশু ' আখ‍্যা দিতেও দ্বিধাবোধ করল না। অপরাধ স্বীকার করার সুরে বলল , " দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরি জুটলে কখনোই শিক্ষিত পশুতে পরিণত হয়ে শিক্ষিতসমাজের মুখে চুনকালি লেপে দিতাম না।" সন্তোষ ' বিবেক ' নামের বাসুকি নাগের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল।কাকভোরেই মদের ঠেকে কয়েকটা বোতল উজাড় করল। তারপর আর‌ও কয়েকটা বোতল নিয়ে বাড়ি ফিরল।

        শিখাকে বলল, " একটা গ্লাস এনে দাও। মালটা পেটে পড়লেই ব‍্যস ,বাবা ভোলানাথের আশীর্বাদে সব যন্ত্রণার আকাশছোঁয়া পর্বতটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে পথের ধূলোয় মিশে যাবে।" শিখা কোন‌ও কথা বলল না।কিছুক্ষণ পর সন্তোষ বিরক্ত হয়ে বলল , " ক‌ই রে মুখপুড়ি তোর গ্লাস! " শিখা বিড় বিড় করে কীসব অশ্লীল কথা বলল।নেশাগ্রস্ত সন্তোষ উত্তেজিত হয়ে উঠল। একটা মদের বোতল দিয়ে শিখার মাথায় সজোরে আঘাত করল।বোতলটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল।শিখার মাথা ফেটে দু-গাল বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল।ও অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

      তারপর জ্ঞান ফিরতেই দেখল হাসপাতালের বিছানায়।অনেক রক্তপাত হ‌ওয়ার জন‍্য শরীরটা খুব দুর্বল মনে হল।কীসব সাত-পাঁচ চিন্তা করত করতে অভিমানের সুরে বলল, "পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউই থাকল না। দেখ, ওগো বিশ্বের মানুষ,সোনার চামচ মুখে নিয়ে যার জন্ম সে আজ সর্বহারা। বিষাদাবেগে দরদর করে বুক বেয়ে শিখার চোখের জল পড়তে থাকল। বিষণ্নকণ্ঠে বলল, " সব আশাই তো শেষ হয়ে গেল।আর কিসের জন‍্য বেঁচে থাকব! শিখা চোখ বুঁজে শুয়ে পড়ল। ঘুম এল না। করুণকণ্ঠে বলল, "ভগবান, ঘর -সংসার নামের যমের রাজত্বে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।হাসপাতালের বিছানাতেই যেন আমার মরণ হয় ।"                                                                                                                                                                                                     

      সন্তোষ ওর তিন বছরের ছেলে, প্রদীপকে 

সঙ্গে নিয়ে শিখার বারো নম্বর বেডে পৌঁছাল।প্রদীপ ওর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, " মা তোমার অসুখ সেরে গেছে?" শিখা কোনও কথা বলল না। প্রদীপ করুণ চোখে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

         কীভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে একরোখা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবে----- সেই 

বিষয়েই সন্তোষ এতক্ষণ ধরে একচোট চিন্তাভাবনা করছিল।নরম গলায় বলল, 

"আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি চলো। তা না হলে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।" শিখা একরোখা সুরে বলল, " যাব তো বটেই।কিন্তু অচেনা পথ ধরে একাই যাব।" সন্তোষ বিস্ময়াবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, " কীসব অলক্ষুণে কথা বলছ তুমি!" করুণকণ্ঠে শিখা বলল, " জীবনের খেলায় আমি হেরে গেছি।আমার আশার বাগান শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।তাই ওখানে ছায়া নেই।আছে শুধু খ়াঁ- খাঁ রোদ্দুর।ওটা আজ ধু-ধূ মরুভূমি হয়ে গেছে! ' তাই লু ' হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।আমার চলার পথের‌ সবখানেই ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত ফণিমনসার কাঁটা!ওই কাঁটার আঘাতে পা থেকে রক্ত ঝরছে।রক্তঝরা পায়ে আমি আর পথ চলতে পারছি না।তাই আমাকে অচেনা পথ ধরে--- মানে , যে পথে চোখ যাবে , সেই পথ ধরেই হাঁটতে হবে।" কান্নার আবেগে ওর ঠো়ঁটদুটো কাঁপতে লাগল ওর মানসিক অবস্থা দেখে সন্তোষ অত‍্যন্ত বিমর্ষ হয়ে উঠল।করুণ গলায় বলল, " শিখা, আমাকে আরেকবার শোধরানোর সুযোগ দাও।" শিখা ঝাঁঝাঁলো স্বরে বলল, " তুমি আর কোন‌ও সুযোগ পাবে না।"

             তারপর হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আসতেই---প্রদীপ "মা,মা " বলে কান্না করতে করতে শিখার শাড়ির আঁচল ধরে ফেলল।শিখা ওকে সজোর ধাক্কা মেরে ওর হাত থেকে টেনে -হেঁচড়ে শাড়ির আঁচলটা ছাড়িয়ে নিল। প্রদীপ আবার‌ শাড়ির আঁচল ধরার জন‍্য কাছে যেতেই শিখার পায়ের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ল। ওর ঠোঁট কেটে গিয়ে শিখার পায়ের ওপরে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়ে পড়‌ল।ও মাথা তুলতেই ওর ঠোঁট থেকে শিখা তাজা রক্তের স্রোত বইতে দেখল। অবিলম্বেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা ডুকরে কেঁদে উঠল।                                       

       সন্তান-স্নেহরসে শিখা ওর হৃদয়ের ধূসর- তৃষ্ণার্ত মরুভূমি মুহূর্তের মধ‍্যেই সরস করে তুলল।তারপর এক মুহূর্তেই ওই মরুভূমির বুকে মায়া-মমতাব অসংখ‍্য বীজ ছড়িয়ে দিল। ওই বীজগুলো থেকে চারা গজানোমাত্র‌ই ওগুলো বড় হয়ে গিয়ে মায়া-মমতার একটা বিশাল অরণ‍্য সৃষ্টি করল।শিখা ওই অরণ‍্যের ছায়ায় বসে প্রদীপকে চুমো খেতে লাগল। শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল ক্ষতস্থানের রক্ত পড়া বন্ধ করার জন‍্য নানা রকমের কলাকৌশল প্রয়োগ করতে লাগল। সন্তোষ একটা মলম এনে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল।প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা বলল, " খোকা, মানিক আমার !তোর জন‍্য আমি স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাব না রে।" চোখের জলে শিখার বুক ভেসে গেল।ও সন্তানস্নেহের বশীভূতা হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ‍্য হল। সন্তোষ প্রাণপণে চেষ্টা করেও মদ ছাড়তে পারল না।

    একদিন‌ আর.পি.এফ. -এর গুলিতে ওয়াগন ব্রেকার দলের কয়েকজন আহত হল ।কেউ কেউ ধরা পড়ে জেলে গেল ।সেজন‍্য দলটা ভেঙে গিয়ে সন্তোষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেল।

সেজন‍্য শিখাদের রোজগারহীন সংসারে দিনের পর দিন অভাব বেড়েই চলল।যন্ত্রণার মমিরা জীবনের পিড়ামিড ঘিরে সারিবদ্ধ মিছিলে সামিল হতে লাপল। দিন দিন সন্তোষের মদ‍্যপানাসক্তি বাড়তেই থাকল।একদিন শিখা বিনীত গলায় বলল, " আজকাল বেকারদের জন‍্য সরকার কত রকমের ব‍্যবস্থা করছে।একবার বিডিও অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখনা। তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে।" সন্তোষ কোন‌ও কথাই বলল না।

  তারপর ও একদিন রাতেও বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিল।কখনো দত্তদের আমবাগানের আমগাছের নিচেই , কখনো গ্রামের প্রথমিক বিদ‍্যালয়ের দাওয়ায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাত কাটাতে লাগল। মদের ঠেকে বাকি পড়ায় সন্তোষকে মদ দেওয়া বন্ধ করে দিল।সেজন‍্য নিত‍্যসঙ্গী মদের বোতল'র সঙ্গে ওর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। সন্তোষ নিত‍্যসঙ্গীর বিরহে শশব‍্যস্ত হয়ে উঠল।

          মদের ঠেকের বাকি টাকাটা শোধ করার একটা পরিকল্পনাও করে ফেল‌ল।ওটা বাস্তবায়িত করার জন‍্য শিখাকে বলল , "ঘরের চালটা ছাওয়ার জন‍্য খড় কিনতে হবে।তা না হলে বর্ষায় ঘরে জল পড়বে।তাই বলছিলাম---তোমার কানের গয়না বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা আনতে হবে।শিখা রাজি হল না।

 কারণ, সন্তোষ ঠিক এভাবেই প্রতারণা করে ওর গয়নাগাটি এবং অনেক টাকা-পয়সা তছরুপ করেছে।সন্তোষ মুহূর্তের মধ‍্যে এক‌ইস‌ঙ্গে দু-কানে দু-হাত দিয়ে সজোরে টেনে শিখার কানের গয়না ছিনিয়ে নিল।শিখার দু-গাল বেয়ে রক্ত পড়তে থাকল। পর্বত ওপড়ানো বিভীষিকাময় ঘূর্ণিঝড় ওর হৃদয়ে উন্মত্ততা শুরু করল।সন্তোষ অবিলম্বেই একটা সোনার দোকানে হাজির হল।

        প্রদীপ দাওয়ায় ঘুমোচ্ছিল।শিখা করুণ দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ও মাতৃহৃদয়ের স্নেহরসের শেষ বিন্দুটিও চুমোর সাহায‍্যে ঘুমন্ত প্রদীপের মুখমন্ডলে উজার করে ঢেলে দিল।ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।গায়ে কেরসিন ঢেলে একটা দেশলাই শলাকা ঠুকল। অস্ফুটস্বরে বলল, " অভাগিনী শিখা, এবার তুই কালনাগের দংশন থেকে মুক্তি পাবি।" জলন্ত দেশলাই শলাকাটা গায়ের কাছে নিয়ে যেতেই ওটার ওপরে শিখার চোখের এক ফোঁটা জল পড়ে ওটা নিভে গেল।আরেকটা দেশলাই শলাকা জ্বালাল।

     প্রদীপের ঘুম ভেঙে গেল।ও বন্ধ দরজার কাছে পৌঁছাল।'মা,মা ' বলে কান্না করতে লাগল। ওর মুখচ্ছবি শিখার চোখের সামনে ঘুবপাক খেতে লাগল। যেন একটা বিষধর কালনাগ ওর মাতৃহৃদয়টিকে অবিরাম দংশন করতে থাকল।সন্তোষ ব‍্যাপারটা টের পেয়ে সজোরে লাথি মেরে , দরজা ভেঙে , শিখাকে বাইরে নিয়ে এল।প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা বলল, " পারলাম না রে খোকা ,মানিক আমার !এবারও তোর জন‍্যেই পরপারে যেতে পারলা না। তোর জন‍্য আলোর পথ খুঁজতে হবে।

শিখাদের জীবনের নাট‍্যমঞ্চে আলোর পথ খুঁজে পাওয়ার 'একটি দৃশ‍্যের সূচনা হল।সন্তোষ আঙিনার তালগাছটাতে বাবুই পাখিদের সুশৃঙ্খল জীবনধারাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিচার-বিষ্লেশন করে জীবনবেদের সন্ধান পেল।ও ওটাকেই অনুসরণ করে চলার পরিকল্পনা করল। ওটাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ‍্যে বিডিও সাহেবের পরামর্শে ফিশারি লোন নিল। ওর বাড়ির সামনের পুকুরটাতে মাছ চাষ শুরু করল।অল্পদিনের মধ‍্যেই ভালো রোজগার হল। শিখাও একজন মহিলা দর্জির কাছ থেকে সেলাই বিদ‍্যেটা রপ্ত করল।তারপর সন্তোযের রোজগারের টাকায় একটা সেলাই মেশিন কিনে কাজ শুরু করল।রেডিমেড পোষাক তৈরি করে হোলসেল দোকানে বিক্রি করতে থাকল।স্বামী-স্ত্রীর রোজগারের টাকায় সন্তোষ ওর ফিশারি পুকুরটার পাড়ে একটা আটচালা তৈরি করে কোচিং সেন্টার খুলল।

শিখা একাই দোকানদারদের চাহিদা মেটাতে পারল না।সেজন‍্য ও পাড়ার বেকার ছেলে-মেয়েদেরকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে সে্লাই-এর কাজে নিযুক্ত করল।কয়েকজন সেলসম‍্যান‌ও জুটে গেল।ও একদিন একটা ফুড প্রডাকশন গ্রুপ‌ও তৈরি করল।

       সন্তোষ একটা নার্সারি স্কুল খুলল। একদিন শিখার রেডিমেড পোশাক ও খাদ‍্য আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিল । সেজন‍্য ' শিখা গার্মেন্ট ' ও ' শিখা ফুড প্রোডাকশন প্র‌ইভেট লিমিটেড ' নামে দুটি সংস্থা গড়ে উঠল। শিখা ওর অভিজ্ঞতায় স্পষ্টভাবেই বুঝলো যে, হাতের কাজ মানুষকে স্বাবলম্বী করে।সেজন‍্য ও 'প্রদীপ-শিখা টেকনোলজি কলেজ ' নামে একটি আইটিআই কলেজ তৈরি করল।সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হ‌ওয়া শিখার সাধের বাগানটি যেন মায়ামন্ত্রে শ‍্যামলিমায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল।পাখিদের কলতানে মুখর হতে থাকল।

                খুব অল্প সময়ের মধ‍্যেই ওই দৃশ‍্যটি শেষ হয়ে সন্তোষের জীবনে অসহ‍্য যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হ‌ওয়ার মত একটি দৃশ‍্যের সূচনা হল।কী-একটা দূরারোগ‍্য রোগে শিখা শয‍্যাশায়িনী হয়ে গেল।দেশ-বিদেশের কোন‌ও চিকিৎসক‌ই ওর রোগ সারাতে পারল না।দিন দিন ওর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগল।

শিখা লোকমুখে শুনেছ যে , মৃত‍্যূর আগে মানুষ মৃত মা ,বাবা ইত‍্যাদি লোকদেরকে দেখতে পায়।

ও একদিন ওর মৃত আত্মীয়স্বজনদেরকে স্বপ্নে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।

---ও গো ,এবার আমার যাবার সময় হয়েছে।

----বোল না শিখা, ও কথা বোল ন! আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে!

---সংসার জীবনে অনেক কটু কথা বলে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা করে দাও।

---ও সব তো আমার ভুলেই হয়েছে শিখা।তুমি একটুও অপরাধ করনি।

সন্তোষ অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগল।

     মাঝরাতে প্রদীপের ঘুম ভেঙে গেল। শিখার মাথার কাছে বসল। ।

---মা ,এখন তোমাকে কেমন লাগছে ? 

---তুই কোন‌ও চিন্তা করিস না খোকা।আমার অসুখ সেরে যাবে।

প্রদীপের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অস্ফুটস্বরে শিখা বলল , " তোর মাথার ওপরে সবসময় আমার আশীর্বাদ থাকবে রে খোকা। আমি মরে গেলেও আমার আত্মা এই সংসারের দেখভাল করবে।" 

       ভোরের দিকে শিখা প্রায় মৃত‍্যূর দোরগোড়ায় পৌঁছাল।ওকে বড় বড় শ্বাস ফেলতে দেখে সন্তোষ ডুকরে কান্না করতে লাগল।প্রদীপ‌ও 'মা ,কথা বলো মা ' বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।অনুশোচনার সুরে সন্তোষ বলল, " হতভাগিনী আমার , দিনের পর দিন উপোষ করে কাটিয়েছ। কত লাঞ্ছনা সয়েছ।তবু ভালবাসার বাঁধন ছ়িঁড়োনি। আর আজ কোন্ অপরাধে সব বাঁধন ছিঁড়ে চলে যাবে? ও গো দয়াময় ভগবান, আমার শিখা অনেক ঘাম ঝরিয়ে সংসারে সুখ এনেছে।সেই সুখটুকূ ওকে ভোগ করতে দাও ভগবান, ভোগ করতে দাও। আমার আয়ূ ওকে আধাআধি ভাগ করে দাও। "

             সন্তোষদের অতীতের দারিদ্রপিড়ীত সংসারের নানান দৃশ‍্যগুলো এবং মুমূর্ষু জীবনসঙ্গিনীর করুণ মুখ ; যেন দুটি বিশালাকারের বিষধর কালনাগে পরিণত হল। সন্তোষের হৃদয়টিকে অবিরাম দংশন করতে উন্মত্ত হয়ে উঠল।'ও আকাশের দিকে দু-হাত তুলে বলল , ' ও গো দয়াময় ভগবান , " আমার আয়ু আধাআধি করে শিখাকে ভাগ করে দাও।"

অজানা মানুষ - প্রতীক মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

          অজানা মানুষ

                  প্রতীক মন্ডল




আমি ভ্রমর। আমার নামটা খুব চেনা আপনার। রাত হলে আমায় খুঁজে পান নিজের ঘরের আশেপাশে। স্বপন চারিনী, কবিতার ছন্দের মতন। তবে, হ্যাঁ অন্য লোকে চেনে আমায় অন্য নামে।


বাজারি মেয়ে বলে কথা। বাজারে নাম চামেলী। রাত হলেই ঘরের দরজা খুলে যায়। সকলে বের হয়ে আসে। কেউ শাড়ি,কেউ ছোট পোশাক, কেউ আবার রাজকীয় লেহেঙ্গা। কিন্তু, পেশাটি ভয়ঙ্কর নিম্ন। টাকা আছে, সম্মান নেই, আছে এক গুচ্ছ যন্ত্রনা। তবে সে আমায় যন্ত্রনা পেতে দেয় নি। পাগলের মতন ভালোবাসতো আমায়। ঠিক যেমন এক প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকে, ঠিক তেমনই। সে কোনোদিন দূরে ঠেলে দেয় নি। আমায় মরতে দেয়নি। বারবার বাঁচিয়ে রেখেছে। মনে হয় যেন সে আমার কত কাছের। কিন্তু ওই যে চৌকাঠ পেরোলে তার ঠিকানা জানিনা। আমিও এই চৌকাঠ ছেড়ে বেরোইনি। বাইরের জগৎকে ভয় লাগে। ওদের ভাষায়, ' জিসম কা সওদা ' করতে পারিনা। তাই আমি হয়ত এখনো গনিকার পদমর্যাদা পাই নি। ঘরে কেউ আসে না। মদ গাজা খেয়ে খদ্দের ডাকতে পারিনা। সে দিতো না। সে আমায় আগলে রাখতো। এখনো রাখে। অনেক দূর থেকে রাখে। তবে একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনা আমার জীবন বদলে দিয়ে এক নতুন পথে নিয়ে এসেছিল। হয়ত সেটাই ছিলো আমার ভাগ্য।




মনে পড়ে সেই দুর্দিনের কথা। যেদিন প্রথম এসেছিলাম এই লালবাড়িতে। চোখ খুলতেই দেখি এক ভয়ানক চোখ। ঘিরে রয়েছে অদ্ভুত পোশাকের কিছু মেয়ে আর একটা সাদা ধোঁয়া। কেউ হাসছে কেউ করুণা করছে। কিভাবে এসে পড়েছিলাম জানি না। এটুকু মনে আছে,থাকতে চাইনি। পালাতে গেছিলাম, কিন্তু চুলের মুঠি ধরে টেনে এনেছিল এই ঘরেই। তারপর যখন রাত বাড়ে,ওরা আসে। নিশাচর প্রাণীগুলো। তাদের চোখ হিংস্র, নখ গুলো ভোঁতা,কিন্তু আমার পিঠে সেগুলোর দাগ বেশ স্পষ্ট।  




আমায় সবাই হিংসে করে এখানে। বাকিদের কাছে আমি নাকি রাক্ষুসী। কারন,রূপটা নাকি একেবারে লক্ষ্মী প্রতিমার মতন। কিন্তু, রাতের বেলায় সে প্রতিমার মুখে মিশে যায় কত অযাচিত জন্তুর চিহ্ন সে খবর কে রাখে। তখন থেকে নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হত। কিন্তু বাঁচতেও তো ইচ্ছে হয়। বাঁচিয়ে রাখে আমারই রঙিন স্বপ্ন গুলো। 




তবে আমার খিদে কম।তাই হয়ত, একরাতে একটা জন্তুই যথেষ্ট ছিল। তবে খিদেটাই সব নয়। বেঁচে থাকতে গেলে যে ওষুধ লাগে সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম।কখনো জ্বরে গা পুড়ে যেত। কেউ আসতো না ঘরে। তাই টাকাও নেই। এমনিই সুস্থ হয়ে যেতাম। মাসে একবার এটা হতই।কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতো না। লাল বাড়িতেও খবর যেতো না।সকলে মরত হিংসের আগুনে,আর আমি জ্বরে পুড়ে যেতাম।কিন্তু, সেই রাতটা অন্যরকম ছিল। যদিও শরীরটা বেশ খারাপ ছিলো। এদিকে পেটের ও কিছুটা টান। তাই দরজা খুলে রেখেছিলাম। একটু আফিমও ধার নিয়েছিলাম ।


আজ একটু লড়াই করতেই হবে। 




এখানে সবাই করে। আমি কোনো রাণী নই, আমি কোনো রাজকুমারী নই। আমি এক দেবদাসী মাত্র। এই গলির মাটি ছাড়া দুর্গা মূর্তি তৈরি হয় না। তাহলে আমরা কেমন করে দেবদাসী নই।




কিন্তু, আজ সেসব কথা থাক। কারন ঘরে একজন এলো। আধ ঘন্টা পরে মুখের উপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কি ভয়ানক ব্যাথা করছে তলপেটে। মনে হচ্ছে যেন কেউ জোর করে বেরোতে চাইছে । একটু আফিম নিলাম। কিছুক্ষণ পর ব্যাথা কমতে থাকলো। তবে একটা গরম রক্তের স্রোত নিচের দিকে বয়ে চলেছে সেটা খেয়াল করলাম না। আবার একজন এলো। এসে হুকুম করল, ' দরজা বন্ধ করো।' ……করো! তুমি করে ডাকলো? তার চোখের দিকে দেখলাম। মুখটা হালকা দাড়িতে ভর্তি। একটা কাঠিন্যের ছাপ আছে। ঘরে ঢুকেই সে মাথা নিচু করে বসে রইল। পিঠটা কাঁপছে। আমি গিয়ে বললাম, ' কি রে বাবু। কিছু করবি না? যদি না করিস তাহলে টাকা দিয়ে চলে যা।'


সে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তার চোখটা হালকা লাল হয়ে আছে। বলল,' আমার মন শান্ত নেই।আমার কাছে এসে আমায় একটু শান্ত করো।' 


আমি গিয়ে তার কোলে বসলাম। তার কথা বার্তা শুনে কোনোমতেই মনে হয় না যে সে কোনো খারাপ লোক। এখানে তো ভালো কেউ আসে না। 


তবে?




সকালে ঘুম ভাঙলো। কখন যে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে উঠে দেখি পাশে একটা চিঠি ,আর কিছু ওষুধ। দেখে অবাক হয়ে গেলাম।সঙ্গে লক্ষ্য করলাম আমার বিছানাটা। রক্তে লাল হয়ে গেছে। সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। গায়ে জ্বর ভাব। 




সন্ধ্যে তে দরজা বন্ধই রইলো। ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে রেখেছিলাম।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।কিছু রান্না করতে পারিনি।ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা পরিচিত কণ্ঠের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। দেখি সে বসে আছে। বলল, ' তোমরা নিজেদেরকে এত কষ্ট দাও কেন। খেয়ে নাও এটা। আজ আমি না এলে তো মরেই যেতে হয়ত। আজকে এই ওষুধগুলো খাও, আর আমি যতদিন না বলব ততদিন কোনো কাস্টমারকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। ' বলে সে চলে গেল। কে এই লোকটা, আমার এত খেয়াল কেন রাখছে। সেতো আমার নাম ও জানে না।আমি তার কে হই? তোমাকে চিনিও না, কে হে তুমি! কিন্তু শরীরটা এতটাই অবসন্ন লাগছে, সেটাও জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম যে , ভিতর থেকে আটকানো শিকল টা খুলে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পরে।




ঠিক তিন চারদিন পরের কথা। অনেকটাই সুস্থ লাগছে, কারণ রাতে সে আসে। দেখভাল করে আমার। থাকতে না পেরে আজকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ' তুমি কে? আমি তোমার কি কেউ হই? তাহলে আমার এত কিছু কেন করছ ?এখানে তো কেউ কাউকে দেখে না। কেউ কাউকে ভালোবাসে না।'


কোন উত্তর দেয় না। তারপর বলে ওঠে, ' সেদিন কি আমার আগের লোকটা তোমার সবচেয়ে প্রথম কাস্টমার ছিল তাই তো। আর সেই জানোয়ার, কোন রেয়াত না করে এমন অবস্থায় ফেলে চলে গেছিল। দেখে আমার মায়া পড়ে গেছিল।'


' যদি ওভাবে না দেখতে তুমিও কি আমার সাথে একই কাজ করতে? সত্যি করে বলোতো।'


' না আমি খারাপ লোক হতে পারি কিন্তু জন্তু নই।'


এটা শোনার পরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বহুদিন হয়ে গেল এভাবে কেউ ভালবেসে এরকম কথা আমায় বলেনি। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমি কেঁদে উঠলাম। যেন মনে হচ্ছিল কোন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমায় আশ্রয় দিয়েছে তার মনে। কি আত্মীয়ের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এতো আমি জানিনা, শুধু জানি যে আমি তাকে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলছিলাম। এতদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো না কিন্তু ইচ্ছে বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ পেয়েছিলাম। 


এরপর সে রোজ রাতে আসতো। আমাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যেত আর বলতো যেন আমি কোন কাস্টমারকে ঘরে না ঢুকাই। এ খবর লাল বাড়িতে ও গেল না কারণ আমি আমার আসল আত্মীয় দের কাছে যেমনভাবে ব্রাত্য ঠিক তেমনভাবে এরাও আমাকে দূরে ঠেলে রেখেছে। যাক এটাতো মন্দের ভালো। 


কিন্তু আমার উপর তার কিসের মায়া। সে এত পায় কোথায়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম,উত্তর আসেনি। মৃদু হেসে বলেছিলো একটু, ' ওসব প্রশ্ন ছাড়ো। এগুলোর উত্তর আমিও জানিনা। তবে এটুকু জানি যে রাত হলে আমার শক্তি বেড়ে যায়। …. তখন আমি সব পারি। যা চাইবে তাই এনে দিতে পারি।' 


' পারবে! সত্যি? তবে একটা আবদার করতেই পারি। রাখবে?... আমায় চিরদিনের জন্য তোমার করে নিতে পারবে?... পারবে না? কি হলো চুপ কেন?' 


' আমি আসি। এর উত্তর আমি দেবো না।'




কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চলে গেছিলো। আমি দৌড়ে বাইরে গেলাম, তাকে আটকাতে চেয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। এত দ্রুত সে হারিয়ে গেলো এই আলোর মতন আঁধারের শহরে? 




এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। না, সে এলো না। আমার আশার পাহাড় ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ল। না, বলা ভালো গুঁড়িয়ে গেল। তার সেবায় আমার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, সে আর কতদিন। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সে আর আসবে না। এক গণিকার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানো যায় না, সেটা সেও জানে। তাই তার জন্য আমি এক শয্যা সঙ্গী ছাড়া কেউ না। এসব ভেবে লাভ কি! পেটের টানে শরীর বিক্রি করার কাজ আবার শুরু করলাম। এটা বিক্রি না, এটাকে দেহ বন্ধক রাখা বলে। কিছুক্ষণের জন্য।কিন্তু রাখতে হয়।




১৫ দিন পর বাইরে এসে দাড়ালাম।সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দালালের দলের মুখে একটাই প্রশ্ন, ' এত সুন্দর, তবু মুখটা শুকনো কেন? আজ হটাৎ বাইরে কেন? আরো কত কি!




রোজ আসে অনেকে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকি। তারপর ও দাড়াতে হয়। তবে ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে যেতে থাকে। ব্যাথা গুলো মুছে যায় নেশার অতলে। হিলহিলে সাপ গুলো ভিতরে ঢোকে, বিষ ঢালে,বেরিয়ে যায়। মনে হয় যেন ভিতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। না, আজও বাড়ির কথা মনে পড়ে না। সেসব ও ছিলো দুঃস্বপ্নের মতন।রাত যত বাড়ে সেই গুলো একটু করে ভুলে যেতে থাকি। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে যাই। কে যে আসে, কে জোরে থাপ্পড় মেরে যায় কিছুই মাথায় ঢোকে না। 


পাশের ঘরে থাকা মেয়েটি এসে জিজ্ঞাসা করেছিলো, ' কেমনে থাকো একা একা। কাস্টমার নাও না, পেট চলে?সেই প্রথম থেকে দেকসি,তোমার ঘরে কাউকে তো যেতে দিকিনি বাপু।এত টাকা পাও কোত্থেকে।'


আমি শুনে তাজ্জব হয়ে গেছিলাম।তবে কি, তাকে ও দেখেনি? সবই কি মনের ভুল? আফিমের নেশা? সে উত্তর খুঁজতে চাওয়ার ইচ্ছেটা বেড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু, সব ইচ্ছে থেমে যায়।




 একদিন রাতে হটাৎ একসঙ্গে তিনজন এলো। মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছে ভয়ানক।সেদিন আমার হুশ ছিলো ভালোই। আমি প্রতিবাদ করলাম যে, একসঙ্গে তিনজনকে সম্ভব না। কিন্তু তারা শোনে না। আমায় বিছানায় ফেলে দেয় । এক নিমেষে কেড়ে সব পোশাক। একজন আমার হাত চেপে ধরেছে, আর একজন মুখ। 


প্রায় তিন ঘন্টা পরে বেরিয়ে গেলো। আমি রাগে যন্ত্রনায় কাদতে লাগলাম। নিচ দিয়ে আবার রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন সব কিছু ছিঁড়ে একাকার হয়ে গেছে। কোমর থেকে নিচ অবধি যেন আমি বেঁচে নেই। সব কিছু অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু… কিন্তু আমার কান্না শোনার যে কেউ নেই! ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। 




' ভ্রমর, ও ভ্রমর। কি হয়েছে তোমার। ওঠো!আমি শ্যামল'


চোখ খুলে দেখি বুকের উপর শাড়িটা কোনরকমে চাপা দিয়ে রেখে সে বসে আছে পাশে। আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম , ' শ্যামল!... তুমি!!'




সে এসেছে, আমার জন্য ফিরে এসেছে। বেলা বাড়লো, অনেকটাই সুস্থ লাগছে এখন l আমার ক্ষত গুলোতে যত্ন করে ওষুধ লাগানো রয়েছে। '


হ্যাঁ,সব ক্ষত তেই। আর কোনো লজ্জা নেই আমার।আমি এখন তার জন্য বেঁচে আছি এটুকুই অনেক। সন্ধ্যে তে আরো ঠিকঠাক হয়ে এলো শরীরটা। তখন জিজ্ঞাসা করলাম,


' তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?'


' আমার আসলে খুব বিপদ। আমায় কিছু লোক খুঁজছে। ওরা পেলে আমায় মেরে ফেলবে। আমার বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী।তাই আসিনি। যদি তোমার কোনো ক্ষ্তি হয়। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।'


' কিন্তু তুমি কি করো, যে তোমায় ওরা মারতে চায়।'


' ওসব বাদ, আগে বলো তোমার এই অবস্থা কে করল।  




আমি সব খুলে বললাম। বলতে বলতে তার মুখটাও দেখতে থাকলাম। তার মলিন মুখে এত রাগ কোনোদিন দেখিনি। আমার কথা শেষ হতেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ' কে তারা!!! ওদের আমি শেষ করে ছাড়বো। আমায় বলো কে ? কোথায় থাকে।'




আমার নীরবতা জানিয়ে দেয়, আমি কিছুই জানি না। সে নিজের জামা পরে বেরিয়ে যায় হনহনিয়ে। চলে গেল। সে কি আর ফিরবে?যদি এবার সত্যি না ফেরে! তাহলে আমি নিজেকেই শেষ করে ফেলবো। 




পরদিন রাতে। দরজায় কড়া পড়ল। ভোর ৫টা বাজে। ঘুমোতে যাবো ভাবছি,এমন সময় শ্যামল এলো। হাতে দুটা বড় সুটকেস। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে এতে কি। সে বলল, ' এতে তোমার জন্য একটু উপহার আছে। দেখে ভয় পেয়ে যেও না যেন ,আমাকে এটা করতেই হত , তোমার জন্য।' বলে সুটকেসের ডালাটা খুলল। সুটকেসের ভিতরের জিনিসটা দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠলো। তিনটে উল্টানো কাটা মাথা। সে হাসতে হাসতে একটা করে মাথা তুলে আমাকে দেখাতে থাকলো। এই যে তারাই, যারা সেদিন কি আমাকে ধর্ষণ করেছে একটা জানোয়ারের মতো। আমি ভয় পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ' তুমি কে? তুমি এদেরকে চিনলে কি করে? আমিও চিনি না এদেরকে। ….আর…আর…তুমি জানলে কি করে আমার নাম ভ্রমর। এখানে তো সবাই জানে আমার নাম চামেলী। '


' আমি কি তোমায় জানতে হবে না। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি এটুকুই তুমি জেনে রাখো, এর বেশি কিছু আমি তোমাকে বলতে পারব না। শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখবে?


' কি বলো।'


' আমি এখন চলে যাচ্ছি। তুমি এই বাক্সটা নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও। ওর ভিতরে একটা ঠিকানা দেওয়া আছে সেখানে গিয়ে থাকো। সব ব্যবস্থা করে রেখে এসেছি।' বলে বন্ধ করা বাক্সটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর দ্রুত পায়ে আমি আসছি বলে চলে গেল। আমি আবার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথায় যাব? আমি কি এখান থেকে মুক্তি পেতে পারবো এত সহজে। যদি সত্যিই পারি একটা তো চেষ্টা করতেই হবে। ভেবে বাক্সটা খুলেই ফেললাম। দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে ও কিছুটা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল ।


থরে থরে ২০০০ টাকার নোট সাজানো রয়েছে। কিন্তু, কোথায় ঠিকানা। কিসের মুক্তি। কিছুই খুঁজে পেলাম না। তবে সেদিন বুঝেছিলাম যে সে আর আসবে না। আমাকেই তার কাছে যেতে হবে। কিন্তু, কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো?


আর সেটার উত্তর এসেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাইরে হটাৎ দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। 


'জল জল ,জল আন!' বলে চিৎকার করছে কে একজন। বাইরে দেখতে পাই কালো ধোঁয়া। আর দূরে ,সেই লাল বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সকলে সেদিকেই ছুটে চলেছে। আমি কি করব ভেবে পেলাম না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু না! এভাবে চুপ থাকলে চলবে না। ভালো পোশাক পরে সুটকেসটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাতের আঁধারে এই ধোঁয়া যেন আমার ছদ্মবেশ হয়ে উঠলো। সকলের নজর আগুনের দিকে। আমি সকলের অলক্ষ্যে পালিয়ে গেলাম। যেদিকে পারলাম দৌড়ালাম। জানিনা কোথায় যাচ্ছি। এখন সেটা ভাবার সময় নেই। 




সকাল হয়েছে। ঘুম ভাঙলো আশেপাশে গাড়ির আওয়াজে । তাকিয়ে দেখে চিনতে পারলাম না কিছুই। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল যে, এটা নাকি ডালহৌসি। সেটা কোথায়! কিছুই জানি না। এই ভরা রাস্তায় ব্যাগ খুললে বিপদ হতে পারে। রাতের অপেক্ষা করলাম। তারপর সেই সুটকেসের ভিতর খুঁজতে থাকলাম সেই ঠিকানা। নেই! কোথাও নেই। না, এই তো….




প্রায় ৫ দিনের চেষ্টায় একে ওকে জিজ্ঞাসা করে বর্ধমানের ট্রেনে উঠে বসলাম। শ্যামল আমার জন্য বর্ধমানে অপেক্ষা করছিলো? নাকি আবার কোনো এক আঁধারে ভেসে যাচ্ছি,জানি না তো সেটা। 




একটা বাড়িতে ভাড়ায় উঠলাম। ঠিকানায় লেখা বাড়িটাই এটা। কিন্তু সে এলো না। ১ মাস গেলো, ২ মাস গেলো, কিন্তু শ্যামলের দেখা নেই। তার দেওয়া সুটকেস আর টাকা গুলোই যেন আমার কাছে তার শেষ স্মৃতি। সময় কেটে গেলো অনেকটাই। আমি বাড়িতে বাড়িতে কাজ নিলাম। বাড়ির মালিক আমায় বেশ পছন্দ করত। কাকু কাকিমা দুজনেই ষাটোর্ধ। একদিন উপরের ঘরে ডাকলেন কাকু। ঘরের কয়েকটা কাজ করতে হবে। সত্যি বলতে ওরা কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেন নি আমি একা কেন থাকি। তাই ওদের ও বেশ পছন্দ হয় আমার। 


আমি ঘরে গিয়ে কাজ করতে লাগলাম। কাকিমা এসে গল্প করতে লাগলেন। তারপর ওনার ছেলের কথা উঠতে জানতে পারলাম ওনার ছেলে কলকাতাতে খুন হয়ে গেছে বছর পাঁচেক আগে। তার মৃতদেহ ও সৎকার করতে পারেনি কেউ।গঙ্গায় আধ খাওয়া দেহ পাওয়া যায় নাকি। আমি কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ,' ছেলের নাম কি?' 


কাকিমা উত্তর করলো, ' শ্যামল।…… এই যে ছবি।'




দেখে আমি চুপ করে গেলাম। এ তো আমার শ্যামল। যার জন্য আমি আজ এখানে। সে যদি ৫ বছর আগে খুন হয়,তাহলে ৫ মাসের আগের সেই লোকটা কে?


মাথাটা কেমন যেন টলে উঠলো। ঘরে এসে বসে রইলাম চুপচাপ। অশরীরী? মৃত্যুর পরেও আরেক জীবন? তাহলে কি সব সত্যি? কিন্তু কেন? আমি কে হই তার।সে…সেই রাতে বন্ধ দরজা দিয়ে ও ঢুকে গেছিলো, তারপর এত টাকা….ওই তিনটে লোকের মাথা… সবই তাহলে শ্যামলের মৃত্যুর পরের ঘটনা! আমার জন্য যে অসাধ্য সাধন করেছে সেটা কোনো জীবিত মানুষের কাজ নয়! বুক চিরে যেন কান্নাটা বের হয়ে এলো।' আমি এরকম মুক্তি চাইনি, এরকম মুক্তি দরকার নেই। একা থাকতে চাইনি। তোমায় খুব দরকার আমার। কোথায় তুমি।' 




জানি উত্তর আসবে না, তবু যেন কেউ বলে উঠলো, ' তুমি যতদিন মনে রাখবে, ততদিন আমিই তোমার কাছে থাকবো।'

অন্ধজনে দেহো আলো - সংযুক্তা পাল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

 

অন্ধজনে দেহো আলো

        সংযুক্তা পাল



-‘টিকিট টিকিট। টিকিট’টা দিন দিদি’। কন্ড্যাক্টর হাতটা বাড়িয়ে টাকা চাইল।

আদিরার সম্বিত ফিরল কন্ড্যাক্টরের ডাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। বসার সিট পায়নি আজকে। ভাবছিল অন্ধ মানুষটার কথা।কি করে যে প্রতিদিন রাস্তা পার হয়, কার ভরসায় যে বেরোয় কে জানে! ভাবতে ভাবতেই ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকায়।পার্সটা বড় ব্যাগটাতেই রাখে। এদিক ওদিক হাতড়ালো। নাঃ পার্সটা তো হাতে আসছে না। চলন্ত বাসে ঠিকমতো একহাত দিয়ে ব্যাগ ফাঁক করে দেখতেও পাচ্ছে না। বাসটা প্রচুর স্পিডে ছুটছে। দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। তাও এভাবেই সে প্রতিদিনের যাত্রায় অভ্যস্ত। পিছন দিকের জেনারেল সিটে বসে থাকা প্রায় তারই বয়সী একটি ছেলে বলে উঠল, ‘আপনার ব্যাগটা কিন্তু বাঁ দিক দিয়ে বেশ কিছুটা কাটা। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না কাঁধে রয়েছে বলে। মনে হয় কেও ব্লেড দিয়ে কেটেছে’। আদিরা এবার আৎকে উঠল। সেরেছে। পার্সে তার এটি.এম.কার্ডগুলো,টাকা পয়সা মিলিয়ে চারশো-পাঁচশো টাকা ছিল। কী হবে এখন? কাঁদো-কাঁদো মুখে কন্ডাক্টরের দিকে তাকাল। রোজই যায় এই টাইমের বাসটাতে। কন্ড্যাক্টর তাকে চেনে। হাত নেড়ে আশ্বস্ত করল,’কাল দিয়ে দেবেন’। তবুও আদিরা সৌজন্য দেখাতে বলল, সে নেমে যেতে চায়। মোবাইল থেকে কল করে অফিসের এক বান্ধবীকে বলবে স্কুটি নিয়ে আসতে। কন্ড্যাক্টরটি ভদ্র গোছের। সে বলল,’আপনি আপনার নির্দিষ্ট বাসস্টপেই নামবেন দিদি। তবে রাস্তাঘাটে এত অন্যমনস্ক হয়ে থাকবেন না’ আদিরা অপ্রস্তুত হয়ে হমম বলল।


     টাকা পয়সা নিয়ে আদিরা এতটা ভাবছে না। চিন্তা এ.টি.এম কার্ডগুলোর জন্য। বাস-স্টপে নেমেই আগে এ.টি.এম কার্ডগুলো ব্লক করবে ঠিক করল। মাথাটা'কে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে চিন্তা করল,এই বাসে শুধু সে বসার জায়গা পায়নি,তাই বলে এমন কিছুই ভিড় নেই যে কেউ তার ব্যাগ কেটে পার্সটা তুলে নেবে। তবে কি সেই অন্ধ লোকটা? যাকে বাসে ওঠার কিছুক্ষণ আগে সে রাস্তা পার করিয়ে নিয়ে এসেছিল! না না। এমা। ছিঃ। সন্দেহের বশে এইসব সে কী ভেবে চলেছে? কিন্তু আর নতুন অন্য কারো সাথে ওর তো কথাও হয়নি বা গা ঘেষে দাঁড়াতেও হয়নি। নাঃ। আর এসব ভেবে লাভ নেই। যেদিনই ও মানুষকে সাহায্য করার জন্য এগোয় সেদিনই ভুলভাল কিছু একটা হয়। এটা মনে হয় আদিরার কপাল।


     বাস থেকে নেমে তার যা যা করণীয় ছিল তাই করতে করতে অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। মোবাইলের থ্রুতে এ.টি.এম কার্ড ব্লক হয়ে গেল। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত। মা ফোন করেছে। মাকে এসব ব্যাপার কিছুই বলল না।একগাদা প্রশ্ন করবে আর বাড়ি বসে বসে দুশ্চিন্তা করবে।


       অফিস পৌঁছে নয়নাকে সব ঘটনাটাই বলল। নয়না বলল,‘কি আর করবি! তোর সেই অন্ধ লোকটাই হোক আর অন্য কেউ, টাকাটা গেল।আর কতগুলো দুশ্চিন্তা সঙ্গী করলি’। ‘লাঞ্চ আওয়ারে একটা ডায়েরী করিয়ে নিস’ পাশের ডেস্কের অর্পণের নির্দেশ। আদিরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কাজে ব্যস্ত হল। কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধ লোকটার মুখটা মাঝে মাঝেই ভেসে উঠছিল। তার মানে সত্যি যদি উনি অন্ধ না হন,কি সুন্দর নিখুঁত অভিনয়! এইভাবে গা ঘেঁষে চলার সময় মানুষ ঠকানো! আর ভাবতে পারেনা আদিরা। কাজেও ভালোভাবে মন বসছে না। তাও চেষ্টা করে যথাসম্ভব মনঃসংযোগ আনতে। অফিস আওয়ার শেষ হলে অর্পণ, নয়না আর আদিরা একসাথেই বেরোয়। মাঝে অর্পণের সাথে বেরিয়ে থানায় একটা ডায়রী করে এসেছে ও। এখন সব কিছুতেই ঝামেলা। থানার বড়বাবু কাঁইকুঁই করে বলছিল,আদিরার বাড়ির এলাকার থানাতে ডায়েরী করতে। ওনাকে অনেক অনুরোধের পর কাজ হয়েছে।


   পরদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল আদিরা। একটা লোককে দেখে চোখ আটকে গেল। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ঠেস দিয়ে বিড়ি টানছে। পরনে কালকের সেই জামা-কাপড়। না আদিরার ভুল তো হয়নি। শুধু কালকের কালো চশমাটা চোখে নেই। উল্টো দিক করে দাঁড়িয়ে পাশের দোকানটা থেকে বিড়ি কিনছিল। তার মানে লোকটা ফ্রড। নয়না ঠিক বলছিল আর তার মনেও তো সন্দেহ উঁকি মেরেছে প্রথম থেকেই। ওদিকে আদিরার নির্দিষ্ট বাস এসে গেল। আর লোকটা রয়েছে উল্টো ফুটে। কি করা যায়! বাস ছেড়ে দিয়ে লোক জড় করে লোকটাকে চেপে ধরবে? নাহ। আদিরা বরাবর শান্তশিষ্ট। এসব একা সে পারবেনা। তাছাড়া লোকটার সাথে যদি ছুরি,চাকু থাকে! পকেটমারদের কাছে ওসব থাকতেই পারে। এরা তো প্রফেশনাল সব! আদিরা বাসে উঠে পড়ে।


     কিন্তু মনের মধ্যে কী ভীষণ এক কাঁটা খচখচ করছে সেই জানে। অফিস পৌঁছে নয়না আর অর্পণকে সবটা বলে। নয়না বলে,’বলিস কি রে? আর তুই ওটাকে দেখতে পেয়ে বাসে উঠে চলে এলি’! আদিরা এবার প্রায় কেঁদে ফেলল।অর্পণ বলল, 'আর কাঁদিস না।আমি দেখছি কী করা যায়'। সারাদিন আদিরা অফিসে উসখুস করে সময় কাটালো। বিকেলে অর্পণের সাথে বাড়ির জন্য রওনা হল। অর্পণ যেতে যেতে বলল, 'শোন আদিরা। আগামীকাল তোর বাড়ির কাছের বাসস্টপে আমি দু'জন বন্ধু নিয়ে তুই আসা অবধি অপেক্ষা করব। তোকে দেখে তোর সাথে কথা বলব না। দূরে থাকব। শুধু ইশারায় আমাদের ওই লোকটাকে চিনিয়ে দিবি। আর আগামীকাল যদি লোকটাকে না দেখতে পাস তাহলে আর কিছু বলার নেই। তোর ভাগ্য খারাপ'। আদিরা আশ্বস্ত হয়ে অর্পণের হাতটা ধরে বলল, 'তোর মতো বন্ধু ও সহকর্মী থাকতে আমার চিন্তা কী? তবে কথা দে খুব বেশি বাড়বাড়ি করবি না। মানে ওই মারধর আর কি। যদি পার্সটা নিয়েও থাকে হয়তো এটি এম কার্ডগুলো ফেলে দিয়ে ওই কটা টাকা আত্মস্থ করেছে। তবু ক্রাইম। সেটা অনস্বীকার্য'। অর্পণ বলল, 'বাপরে তোর তো দেখছি চোর বাটপারের ওপর হেভি সিমপ্যাথি। ঠিক আছে দেখা যাবে। আর জ্ঞান দিতে হবে না। বাড়ি যা। অফিসে এসে কেঁদে কেঁদে জ্বালাবে আবার দরদ উথলেও উঠবে। যা বাড়ি যা'। আদিরা নরম গলায় বলল, 'আসি রে। রাগ করিস না। তুইও সাবধানে যা'।


      পরদিন আদিরা পৌঁছনোর আগেই অর্পণ ওর দুই বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছে গেল। আদিরাও চলে এল সময়মতো। আদিরা একটার পর একটা বাস ছেড়ে চলেছে। অর্পণরাও অধৈর্য্য। এমন সময় আদিরা ইশারা করল অর্পণকে। ওরা তিনজন লোকটার কাছে গিয়ে বলল আপনার সাথে বিশেষ দরকার। ওই ওদিকটায় একটু চলুন দয়া করে। বন্ধ কারখানার গলিতে নিয়ে গিয়ে অর্পণ ওনাকে চেপে ধরল। 'আপনি অন্ধ নন তবু অন্ধ সেজে পকেটমারী করছেন। পার্স চুরি করছেন। ততক্ষণে আদিরাও এসে দাঁড়িয়েছে'।লোকটা বলেই চলেছে সে পার্স নেয়নি। অর্পণ বলছে 'আপনি স্বীকার করুন। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে'। লোকটা তবু অস্বীকার করে বলছে উনি নাকি এরকম কাজ কখনোই করেননি। এত অবধি ঠিক ছিল। অর্পণের এক বন্ধু ক্ষেপে গিয়ে লোকটাকে সজোরে এক ঘুষি মারল আর লোকটা টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা জ্ঞান হারাল। আদিরা এবার এক ধমক দিয়ে সবাইকে বলল, 'অনেক করেছিস তোরা। এবার যা। এখন আমি কী করি এনাকে নিয়ে'? অর্পণ বলল,'এই তুই অফিসে চল। অনেক হয়েছে তোর চোর-বাটপারের ওপর মায়া দেখানো। 'ওটা' এখানেই পড়ে থাক'। আদিরা যেতে চাইছিল না। অর্পণের জোরাজুরিতে অফিসের দিকে রওনা দিল।

      আদিরার মনটা বরাবর নরম প্রকৃতির। সারাদিন অফিসে আর কোনো কাজেই মন বসল না। ও আজ কাওকে না বলে একাই বেরিয়ে পড়ল। বাসে উঠল, নিজের বাড়ির ষ্টপেজে নামল। বাসস্টপ থেকেই যে গলিটার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই অন্ধকার গলিটার দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ির রাস্তায় ঢুকে গেল।


   আগামীকাল অফিস না গিয়ে ব্যাঙ্কে যাবে ভাবল। বাড়ি থেকে বের হল ওর মায়ের আর ওর পাশবইটা নিয়ে। ব্যাঙ্কে যাবার পথে আবার সেই অন্ধ লোকটাকে দেখতে পেল। চোখে সেই কালো চশমা। আর পাশে.....পাশে হুবহু এক দেখতে যে লোকটা তাকে ধরে নিয়ে চলেছে তার ঠোঁট আর মুখটা ফোলা। কালকের 'শাস্তি'র চিহ্ন। হে ভগবান এরা যমজ ভাই। ভাইয়ের কথা লোকটা তার মানে বলেনি আবার যদি ভাইকে হেনস্থার শিকার হতে হয়!


       মাথা নীচু করে আদিরা হাঁটতে হাঁটতে চায়ের দোকান থেকে গুঞ্জন শুনতে পেল 'কি দিনকাল পড়ল। দুই ভাই ভাড়া থাকে। একে অপরের ভরসা। আর ওদের গায়ে হাত তুলল! ওদের মতো সৎ কেও আছে'? আর একজন বলল, 'সততার জন্য আবার একজন অন্ধ হয়েছে। সত্যি ভালো মানুষগুলোর জন্য ভগবান এত কষ্ট কেন লেখে কে জানে'!

           আদিরা দৌড়ে বাঁচল।কিন্তু নিজের থেকে বাঁচবে কিভাবে!





তিল - রঞ্জিত মল্লিক || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

  তিল

কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)



               আজ সৌনকের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন ! তার অফিস এই প্রথম তাঁর ওপর এক বিরাট বড় কাজের দায়িত্ব দিয়েছে । এতদিন সহকারী হিসেবে প্রতিটা বড় বড় অপারেশন সামলেছে কিন্তু আজ সম্পূর্ণ নেতৃত্ব তাঁর কাঁধে । পারবে কি সৌনক ? মোবাইলে টুং করে শব্দ হয়ে আলোটা জ্বলে উঠতেই কম্পিউটারের মাউস ছেড়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই মেসেজটা চোখে ভেসে উঠল । এবার বেরোতেই হবে ! জামাকাপড় পরে তার সবসময়ের সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৌনক । যাওয়ার আগে মা কালির ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল 


          "........আজকের দিনটা আমার পাশে থেকো মা !"


            মা কালিকে প্রণাম করেই সৌনক গাড়িতে উঠল। পিছনের সীটে গুটি শুটি মেরে লুকিয়ে পড়ল টম। সৌনকের পাশে থেকে থেকে টম অনেকটাই সৌনকের মতি গতি বুঝে নিয়েছে। আজকের কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সৌনকের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও বেশ চিন্তিত। পাশের সহকারী দুজনের মুখও বেশ গম্ভীর।


             ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির চাদর সরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল বাইপাসের দিকে। মাঝে মাঝে মোবাইলে ফোন ভেসে আসছে।


          "সোনু , খুব সাবধানে কাজটা গোছাতে হবে কিন্তু। প্রতিপক্ষের নেট ওয়ার্কিং অনেক গভীরে। "

         "ওকে স্যার। সব ঠিক মতন হবে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।" 

           "এবার ওদের দলে একজন মহিলাও আছেন। শুনেছি উনার তুখোড় ব্রেন। আমরা যে আসছি সেটা মনে হয় ওরা জানতে পেরেছে।একটু এলার্ট থেকো।"

           "রিয়েলি ?"

           "হ্যাঁ, তাই সাবধানে পা ফেলবে। একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ অনিবার্য। তোমার উপর আমার পুরো আস্থা রয়েছে।" 

       "স্যার , ডোন্ট অরি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।" 


              বাইপাসের ধারে অনেক কটা ছোট বড় হোটেল। যে কোন একটাতে দুবাই থেকে একটা দল এসে উঠেছে। পাঁচজনের টিমে একজন মহিলাও আছেন। মহিলার ছবিটা স্যার বার বার দেখিয়েছেন। ভাল বোঝা যাচ্ছিল না কমপিউটারের মনিটরে। ছবিটা সাথেও আছে।


             সৌনক একবার বের করে দেখল। মুখটা বোরখাতে ঢাকা। তবে চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। মোবাইলে ছবিটা জুম করতেই বাঁ চোখের নীচে একটা ছোট্ট তিল ধরা পড়ল। তিল সমেত চোখদুটো যেন বহুকালের চেনা। বিশেষতঃ তিলটা। সুন্দর ঐ বিউটি স্পটটা কিছু যেন বলতে চাই। সৌনক গভীরভাবে ছবি আর চোখের নীচের কালো বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠল,"সেই চোখ, সেই তিল...। কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে....। ঠিক মেলাতে পারছি না।"


              বাইপাস এসে গেছে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সৌনক দুই সহকারীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। টম গাড়িতেই থাকবে। সেই রকম বিপদ বুঝলে ও এগিয়ে আসবে। তিনজনে সোজা কফি শপের দিকে গেলো কফি খেতে। 


               তিনজন তিনটে হোটেলকে টার্গেটকে করে অন্ধকারে এগোতে থাকে। বৃষ্টির তেজ একটু হলেও কমেছে। একটা হোটেলের সামনে এসেই সৌনক থমকে দাঁড়াল। কিছু একটা ক্লু মনে হয় পেয়েছে। হোটেলে পার্টি চলছে। বেশ জোরালো। একটা জায়গাতে সুইমিং পুলের ধারে আসতেই এক জায়গাতে দৃষ্টি আটকে গেল।


              সন্দেহ ঠিক তাহলে। মোবাইলে দুজনকে ডেকে নিল। 


                দশ মিনিটের টানা অপেক্ষার পর শিকার আসল হাতের মুঠোয়। একটা মৃদু ধ্বস্তাধ্বস্তি। মুখের বোরখাটা সরতেই নিয়ন আলোতে যাকে দেখল তাকে দেখে সৌনক আঁতকে উঠল। এক দৃষ্টিতে দুজন দুজনকে দেখছে। পাঁচ সেকেণ্ড পরেই একটা গুলির আওয়াজ। গুলিটা সৌনকের মাথার পিছনে লাগতে পারত। লাগেনি। মেয়েটা সৌনককে ঠেলে সরিয়ে নিজে গুলিটা হজম করল।


             হালকা গুলির লড়াই চলছে। ততক্ষণে পুরো হোটেলটা ফোর্স ঘিরে ফেলেছে। পনেরো মিনিট লড়াইয়ের পর টিমের চারজন ধরা পড়ল। একজনকে অলরেডী এসকর্ট করে পাঠানো হয়েছে হসপিটালে।


                     ********* ***********


               সৌনক তিনদিন ধরে হসপিটালেই পড়েছিল। মৌবনী আগের থেকে এখন অনেকটাই ভাল। ছোট একটা অপারেশানের পর জ্ঞান ফিরেছে। বিপদ কেটে গেছে। সৌনকের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল , "আমি খুশী তোমাকে বাঁচাতে পেরে। তা না হলে ওরা ......" কথা শেষ হয়না। গলা বুজে আসে।


             "রিল্যাক্স! এখন পুরো বিপদ কাটেনি। বেশী কথা বললে তোমার কষ্ট হবে জানি।" বলেই সৌনক মৌয়ের হাতদুটো চেপে ধরল। চোখের কোণে নোনা নিম্নচাপ। তার দুফোঁটা মৌয়ের হাতেও পড়ল। 


                দুজন দুজনের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে আছে। বহু বছর পরে দুজনের দেখা। তাও এক অপ্রত্যাশিত অবস্থায়। মৌবনী আবার কথা বলার জন্যে তৈরী হল....


                "কত বছর পরে আমাদের দেখা....."

                 "ঠিক বলেছ। সেই শেষবার যখন তোমাকে দেখলাম, তারপর....."


                 সৌনকের দু চোখের নিম্নচাপ গভীর হচ্ছে। বাড়ছে নোনা জোয়ারের তেজ। নিজেকে সামালানোর চেষ্টা করছে। মৌ হাতদুটো বুকের কাছে ধরে অস্ফুটে বলে উঠল....

 

              "আমার জন্যে তোমাকে এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে শুধু শুধু। জানি না কবে যে এই পাপের জীবন থেকে মুক্তি পাব.....


               কথা আবারও শেষ হয় না। ফ্যালফ্যাল চোখে সৌনকের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌনক ওর দু চোখের তারার গভীর মহাসাগরে যেন ডুব দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর মৌবনী একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতেই সৌনক বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেটে মোলায়েম টান দিল।


            দুদিন পরেই মৌ পুরো সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিল। 


              দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। সেদিনের মৌবনী এখন অনেক পরিণত। কালো, অমসৃণ, এবড়ো খেবড়ো পথ ভুলে উজ্জ্বল জীবনের পিছনে ছুটছে। একটু স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দে বাঁচার আশায়। 


                      পাঁচ বছর পরে....


               মৌবনী কয়েক বছর জেল খেটে মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। দুবাইয়ের হীরে আর অস্ত্র পাচারকারীর মূল গ্যাংটা ওর সাহায্যে অনেক আগেই ধরা পড়েছে। পুরো অপারেশনের নেপথ্যের কারিগর সৌনক। ওর পদোন্নতি হয়েছে।


               ........... .......... ..... ........


            আজ মৌবনী, সৌনকের ফুলশয্যা। মৃদু আলোয় মৌবনীকে কাছে বুকে টেনে ওর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে সেদিনের মতন তাকিয়ে আছে। তিলটা বেশ সুচারুভাবে নজরে পড়ছে। চোখের ভিতরে নরম আলোতে ডুব মারতেই পুরানো দিনের কথাগুলো ভেসে আসল।


           বহুবছর আগে এই মৌবনীকেই ভালবেসেছিল। অনেক বছর ছিল দুজনের সম্পর্ক। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওর সাথে আলাপ। প্রথমে পরিচয়। তারপর আসতে আসতে......


            ওর বাবার বাইপাস সার্জারির সময় প্রচুর টাকার দরকার হয়। এদিকে টাকার অভাবে অপারেশানের ডেটটাও পিছোতে হল। টাকা জোগাড় করতে না পেরে শেষে নিরুপায় মৌ বাবাকে বাঁচাতে নোংরা পথে রোজগারে নামতে বাধ্য হয় । সেই শুরু। চেষ্টা করেছিল ফিরে আসতে, পারেনি।


         সৌনকের সাথে তারপর থেকেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুজনের দূরত্ব বাড়লেও মনের কোণে ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল।  


          সৌনক ভাগ্যচক্রে ক্রাইম ব্রাঞ্চের মস্ত বড় অফিসার হয়ে ওঠে। তখন থেকেই ওর উপর সোনা, হীরে, অস্ত্র পাচারকারী দলটাকে ধরার দায়িত্ব এসে বর্তায়। কাজের এসাইনমেন্ট পাবার পর থেকে ও দলটাকে ধরার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। 


           মৌয়ের বাবা বাইপাস সার্জারি হবার পর সুস্থ হয়ে ফিরল বটে। তবে মৌ আর ফিরল না। ও নিজেই অসুস্থতার শিকার। সেই যে অবৈধ উপায়ে টাকার স্বাদ পেল, তারপর থেকে টাকার নেশা ওকে পেয়ে বসল। আর তাতেই ও ক্রমেই অবৈধ লেনদেনের পিছনে ছুটতে ছুটতে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে অসুস্থ হয়ে উঠল দিনের পর দিন।


            ধীরে ধীরে ও বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। আর তার শিকড় ছড়াল বিদেশেও। দুবাইয়ের দামী রত্ন, অস্ত্র পাচারকারী দলেও নাম লেখানো শুরু হল। মৌবনী ছিল শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, স্মার্ট, ইংলিশে বেশ সড়গড়। দু একটা বিদেশী ভাষাও শিখেছিল।তাই ওর পক্ষে এই ধরণের কাজে হাত পাকানো বেশ সহজ হয়েছিল।  


            কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সৌনকের পাতা ফাঁদে ওকে পা দিতেই হল। সৌনক যে এই অপারেশনের মাস্টারমাইণ্ড সেটা মৌয়ের কাছে আগাম খবর ছিল। আর ওর ছবি দেখেই ও সিওর হয়।তাই ও জানত দলটাকে ধরার জন্যে সৌনক এই হোটেলেই আসবে। আর ওর ওপর আক্রমণও হতে পারে। তাই নিজের বুক পেতে ওকে বাঁচিয়ে দিল।


            দুজনের ভালবাসায় সব ফেরাল। ওর চোখের নীচে তিলটাই সব পরিষ্কার করল। ওটাই আইডেনটিফিকেশনের ক্ষেত্রে চরম পরীক্ষা দেয়। মৌবনীর পচ্ছন্দের পারফিউমের গন্ধ আগেই পেয়েছিল। সেটাও কাজে আসে....।


            বহু বছর পরে ওরা দুজন দুজনকে নতুন জীবন দিয়েছে। আজ ওরা দুজনেই তৃপ্ত, সুখী। 


            রাত বেশ গভীর। বাড়ির সব আলো নিভে গেছে। গোটা বাড়ি এখন নিস্তব্ধ। বিয়ে বাড়ির সেই কোলাহল আর নেই।


            সৌনক মৌবনীর ঠ‍োঁটে চুমু খেল। আবছা আলোয় সব কিছু অস্পষ্ট হলেও, ওর দু চোখের ভেজা নোনা আলোতে বহু পরিচিত ভালবাসার চিহ্ন তিলটা যেন আজ অনেক বেশী ঝলমল করছে।



            


নিগ্রো কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা - শংকর ব্রহ্ম || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

 নিগ্রো কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা


শংকর ব্রহ্ম

------------------------------------------------------------------



                           নিগ্রো কবিতার ইতিহাস মাত্র চারশো বছরের।

প্রথম আমেরিকান নিগ্রো 'লুসি টেরী' প্রথম কবিতা লিখেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন মহিলা। 


তারপর কবিতা লেখেন ক্রীতদাসী একজন। নাম-জুপিটার হ্যামস। তারপর ফিলিস্ সুইটল। এই ভাবে একে একে অনেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন নিগ্রোদের মধ্যে ধীরে ধীরে।

                          নিগ্রো কবিতার ইতিহাস ঘাটতে গেলে, দুটি ধারা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রথম ধারা আফ্রিকার বা

তৎসংলগ্ন বসবাসকারী নিগ্রোদের লেখা কবিতা।

দ্বিতীয় ধারাটি যে সমস্ত নিগ্রোরা আমেরিকায় বাস করে, তাদের লেখা কবিতা।

                          দু'টি ধারার কারণ, আফ্রিকায় বসবাস

করে যে সব নিগ্রো তাদের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, 

সামাজিক পরিবেশ আমেরিকায় বসবাসকারী নিগ্রোদের চেয়ে আলাদা। সেই ঐতিহ্য ভাল হোক মন্দ হোক, কুসংস্কার আচ্ছন্ন হোক, তা তাদের নিজস্ব।

                     আর অন্যদিকে আমেরিকায় বসবাসকারী নিগ্রোদের প্রধান সমস্যা ছিল, তাদের শিকড়ের বিচ্ছিন্নতা। ফলে তারা ঐতিহ্যহীন, ইতিহাস বিচ্ছিন্ন।

    তাই আমেরিকান নিগ্রোরা আসলে, " They have been treated as outsider by the outsider. "

ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আগত সাদা গায়ের রঙের মানুষজন, অত্যাচার করত কালো গায়ের রঙের ক্রীতদাসদের সঙ্গে শুধুমাত্র রঙ বৈষম্যের ভিত্তিতে।

সেই জন্যই সমাজবিদ - ডু বয়েস বলেছিলেন, 'বিংশ শতাব্দির প্রধান সমস্য হচ্ছে, বর্ণ বৈষম্য।'

' কবি রে ডারেম- এর নীচের এই কবিতাটি পড়লে, ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন -


রে ডারেম (জন্ম - ১৯১৫ সালে) 

---------------------------------------


বন্ধুত্ব

-------


আমার কিছু কিছু বন্ধু আছে

যাদের চামড়ার রঙ সাদা

অথচ আমি তো তাদের সঙ্গে

অন্য সবার মতোই 

ব্যবহার করি

ঠিক মানুষের মতোই।



                         ১৬১৯ সালের আগস্ট মাসে, স্পেনের লোকেরা প্রথম আফ্রিকান নিগ্রোদের ক্রীতদাস করে নিয়ে আসে আমেরিকার ভার্জিনিয়ার জেমসটাউন শহরে।

তারও কুড়ি বছর পরে আরও কিছু নিগ্রো ক্রীতদাস ইংল্যান্ডে আমদানী করা হয়। এই ভাবে নিগ্রো ক্রীতদাসদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে আমেরিক ও ইংল্যান্ডে।

                         ১৬৬৪ সালে ম্যারীল্যান্ড আইন নিগ্রোদের আজীবন ক্রীতদাস হিসাবে থাকার অনুমতি দেয়।

১৮০০ সালে নিগ্রো ক্রীতদাসের সংখ্যা দাঁড়ায় নয় লক্ষের মতো। তাদের দাস হিসাবে লাগানো হতো - তামাক, আখ, তুলো, নীল, ধান চাষের কাজে। এদের আজীবন ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হতো।

                        তারা মাঝে মাঝেই অমানবিক অত্যাচারে শিকার হয়ে, বিক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ করতো। এছাড়াও মুক্ত ( ক্রীতদাস নয় এমন) নিগ্রোদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ।

                         কবি পল লরেন্স ডানবার নিগ্রো রেঁনেসার যে বীজ বপন করেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই তা হাজার পাপড়িতে বিকশিত হতে শুরু করে। 


পল লরেন্স ডানবার - এর কবিতা( জন্ম - ১৮৭১ সালে)

-----------------------------------------------------------------


মুখোশের মানুষ 

-----------------------


মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে বলে যায়

হাসে মুখোশের আড়ালে

আসল মুখ লুকোনো থাকে

ওই চাতুর্যের জন্য যে ঋণ শোধ করতে হয় 

আমাদের রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত হৃদয় দিয়ে

আমারা হেসে মিথ্যে ইমারত বানাই


আমাদের অশ্রুর

 দীর্ঘশ্বাসের হিসেব করার জন্য

কে-ই বা মাথা ঘামায়

বরং আমরা যখন মুখোশ পরে থাকব

তখনই যেন দেখা হয় তাদের সঙ্গে


আমাদের আর্তনাদ তাদের জন্যই উত্থিত

হে ভগবান নির্যাতিত আত্মার গান কেউ শোনে না

পায়ের নীচের পিছল মাটিতে এগোনো যায় না

ভাগ্যের দূরত্ব ক্রমশই বেড়ে যায়


কিন্ত শুধু সে'সব কিছু নয়

এই পৃথিবীর মানুষজন আমাদের 

অন্য চোখে দেখুক মুখোশ খুলে।



                          ততদিনে আড়াই'শ বছরের দাসত্ব জীবনের ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে।


                          প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই বিশিষ্ট নিগ্রো কবিরা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। তাদের মধ্যে

ক্লড ম্যাকে, জেন টুমার, ল্যাংস্টন হিউজ প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য।



ক্লড ম্যাক-এর কবিতা ( জন্ম - ১৮৯০ সালে).

----------------------------------------------------


যদি মরতেই হয়

-----------------------


যদি মরতেই হয় তা যেন কুকুরের মত নয়

যেমন আমাদের দুর্ভাগ্যকে ব্যাঙ্গ করে 

অনেক ক্ষুধার্ত কুকুর চারদিক থেকে চিৎকার করে ছুটে আসে

যদি মরতেই হয়,

যেন তা হয় মহান,

মূল্যবান রক্তের এক ফোঁটাও যেন বৃথা না যায়

যে সব নরপিশাচদের যেন ঘৃণা করি আমরা

তারাও যেন মাথা শ্রদ্ধায় নোয়ায়। 


ওহে, শত্রুদের সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতেই হবে একসময়

যদিও লোকবল কম

তবুও যেন সাহসের অভাব না হয়,

সামনে কবরের রাস্তা না হয় সোজা না রইল

তাতে কি?


কাপুরুষ খুনিদের সাথে মোকাবিলা করতে চাই মানুষের মতো,

দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও, মৃত্যু হলেও

লড়াইয়ের উত্তেজনা যেন না হারায়।



জেন ট্যুমার- এর কবিতা( জন্ম -১৮৯৪ সালে).

------------------------------------------------------


পাঁচ মুখের চিত্র

---------------------


রক্ত লাল জাহাজগুলি

সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে

কালো মেঘের ভয়ে,


শত সেলাইয়েও

ছেঁড়া কাপড় উড়ে যায়

বাতাসে


আশি বছরের বুড়োও 

স্বাদু টুসটুসে আঙুর খেয়ে চলেছে

অসুস্থ হবার ভয়ে


আমার দুঃখ আবরণে আবৃত থাক

সেলাই করার সময়

তোমার আঙুলে সূঁচ ফুটে রক্ত যেন বের না হয়


বাচ্চা চিনা মেয়েটি পড়ে গেলে

যে কোন বাচ্চার মতোই কেঁদে ওঠে

সর্বত্র।



ল্যাংস্টন হিউজ- এর কবিতা( জন্ম -১৯০২ সালে)

----------------------------------------------------------


জঙ্গী

---------


যাই বল ভাই, যেই পারুক না কেন

কিল খেয়ে চুরি করতে

                  আমি পারব না অন্ততঃ

যখনই জেনেছি এটা ঠিক হচ্ছে না

আমি চিৎকার করে উঠি, 

              না কখনই নয় - বলে উঠি


সৎ পরিশ্রমের জন্য

অস্বাভিক কম মজুরী দিচ্ছো তুমি

আর সৎ স্বপ্নের জন্য

                     লাথি ঝাঁটা মারছো

মুখে থুতু দিচ্ছো সারাক্ষণ

তাই হাতের মুঠো দুটো শক্ত হয়ে উঠছে

তোমার চোয়ালে অমোঘ 

               তীব্র তীক্ষ্ণ ঘুষি মারার জন্য



ল্যাংস্টন হিউজ - এর আর একটি কবিতা -


" লাল অগ্নিশিখার মতো

   আগামী প্রভাত 

   আমাদের সামনে


   বিদায় বলেছি গতকালকে

   সূর্যাস্তের সঙ্গে

   হাত ধরে 

   ফিরে গেছে গতকাল।


   এখন 

   আজ যে পথ দিয়ে

   আসছি আমরা

   অভ্যর্থনায় রঙিন তোরণ

   সেই সব পথে। "



ম্যারী ইভান্স ( জন্ম - ১৯২১ সালে)

--------------------------------------------


বিদ্রোহী

----------


যখন 

মৃত্যু হবে আমার 

আমি জানি

বড়সড় একটা শোক সভার আয়োজন হবে নিশ্চয়ই

কৌতূহলী মানুষজন

চারিদিকে দাঁড়িয়ে দেখবে


ভিড় করে 

অনেকে আসবে দেখতে

আমি

সত্যি সত্যিই মরা গেছি

নাকি 

আবার একটা গোলমাল

পাকাবার চেষ্টা করছি শুধু।



অ্যাডিম ডেভিড মিলার ( জন্ম - ১৯২২ সালে )

-----------------------------------------------------


ক্ষুধার্থ কালো শিশুটি

------------------------


ক্ষমা করুন প্রভু

যদি অস্তগামী 

সূর্যকে টেনে হিঁচড়ে 

রাস্তার আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিই।


সন্ধ্যার আঁধারে ক্ষিদে যখন

পেটের ভিতরে ফুঁসে ওঠে সাতটা অজগর হয়ে

তখন মাঠে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে

দেখতে পাই সূর্যাস্তের লাল আভা

মনে হয় আমাদের বাড়িগুলি জ্বলছে

পেটের নাড়ির মতোই ক্ষিদেয় পুড়ে

সাদা ছাই হয়ে যাচ্ছে।



হেনরী ডুমাস ( জন্ম - ১৯৩৫ সালে )

--------------------------------------------


মহিষ

-----------


আমিই শেষ পর্যন্ত

ভয়ংকর ভয়াল মহিষটাকে

পেড়ে ফেলতে পেরেছিলাম অসীম সাহসে


ধূলো ছিটকে পড়েছিল 

বাতাসে

রক্তের ফোটার মতোন

আর আমি কিনা এতকাল

এর ভয়ে 

ভেবে এসেছিলাম,

ভয়াল জন্তুটা আমাকে আক্রমণ করলেই

আমি মরে যাব অনায়াসে।



অল ইয়ং (জন্ম - ১৯৩৯ সালে) 

—-------------------------------------

কবি
---------

ভালো থাকো হে কবি
কিন্তু সাবধান
খুব বেশী দিন থেকো না আড়ালে
হয়ে যেয়ো না গর্তের ইঁদুুর
কিংবা পোকা মাকড় 
বা গাছের শিকড়
অথবা পাথর

উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে এসো
গর্ত থেকে
বুক ভরে নাও সবুজ নিঃশ্বাস
অনায়াসে পাথরে ধরাও ফাঁটল
সাপেদের সঙ্গে সহবাস রপ্ত কর
পাখিদের নায়ক তুমি কবি

মাটি থেকে তুলে ধরো মাথা
আলোক ঝলকানিতে
চোখ কুঁচকে দেখ চারিপাশ
উজানে সাঁতার কাটো অবলীলা ক্রমে ক্রমে
প্রয়োজনে উড়ে যেতে ভুলো না আবার।


                            ১৯২৫ সালে 'অ্যালেন লক' প্রকাশ করতে শুরু করেন, 'নিউ নিগ্রো' - নামে একটি পত্রিকা।
ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায় 'New spirit' দানা বাঁধতে শুরু করে। মূলতঃ সব নিগ্রো কবিরাই ছিলেন কমিটেড। তাদের জ্বলন্ত জীবনের কথা, ভাল লাগা, ভালবাসা, সংগ্রামের কথা সহজ সরল ও স্বাভাবিক ভাষায় ফুটে উঠেছে তাদের কবিতায়,
যা প্রগতিশীল মানুষকে স্বভাবতই উদ্বুদ্ধ করে থাকে।

—--------------------------------------------------------------
ঋণ স্বীকার - মুকুল গুহ