Tuesday, October 31, 2023

দিনে দুপুরে - কাজল মন্ডল || Dine dupure - Kajal mondal || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 দিনে দুপুরে

      কাজল মন্ডল



রবিবারের বিকাল।আমরা পাড়ার ছেলে ছোকরা-রা মিলে সব আড্ডা মারছি।রাঙাদাদুর বাড়ীর বৈঠকখানায়।প্রতি রবিবার সাধারণতঃ যেমনটি আড্ডা টাড্ডা মারি আর কী।এই খোশ মেজাজে গল্প গুজব করছি।ক্যারাম খেলছি।আর সকলে মনে মনে অপেক্ষা করছি,রাঙাদাদু এই ঘরে কখন আসেন।কখন আসেন।রাঙাদাদু যে প্রতি রবিবার রবিবার আমাদের একটি করে গল্প বলেন।যে গল্প কোনো বইতে কখনো পাওয়া যাবে না।যে গল্প কখনো কোনো সিনেমার পর্দায় দেখা যাবে না। যে গল্প দাদুর একদম নিজের মুখে মুখে রচনা।যাকে বলে মৌলিক গল্প।আর সাথে সাথে অপ্রকাশিতও।

বাইরে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি শুরু হলো।আজ সকাল বেলা থেকেই টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে একটু থামছে।আবার আসছে।

বৃষ্টির শব্দে সামনের খোলা জানালাটা দিয়ে বাইরের রাস্তায় চোখ গেল।রাস্তায় একটা হাল্কা জলের স্রোত বয়ে যেতে শুরু করেছে।তাতে ভেসে যাচ্ছে কয়েকটা ঝরা পাতা।কা-কা- ডাক শুনে পাশের করবী গাছটার দিকে চোখ গেল।একটা কাক করবীর ডালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে।হঠাৎ হুস করে উড়ে গেল কাকটা।ওর উড়ে যাওয়া দেখতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ গেল।আকাশ ঘন কালো।দেখতে দেখতে ঝুপ্ করে সন্ধ্যা নেমে এলো চারপাশে।আর তখনই ঘরের গ্রান্ডফাদার ক্লকটাতে ঢং-ঢং- করে পাঁচটা বাজলো।আর তার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আমাদের বৈঠকখানার ঘরে ঢুকলেন রাঙাদাদু।পরনে সাদা ধুতি আর ঘিয়ে পাঞ্জাবী।চোখে মোটা কালো ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা।দাদু ঘরের লাইটের সুইচটা দিতে বলে আরাম কেদারাটায় আরাম করে বসলেন।

দিপু ঘরের লাইটের সুইচটা টিপে দিতেই ঘরটা লেড লাইটের সাদা আলোয় ঝলমল করে উঠল।আমরা খেলা টেলা ছেড়ে দুদ্দার করে দাদুর পাশের চৌকি,সোফাসেট যে যেখানে পারলাম বসে গেলাম।

''আজ আমি তোমাদের আমার ছেলেবেলার একটা ঘটনা বলি।কী তোমরা শুনতে চাও তো?''

দাদু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন।

''হ্যাঁ হ্যাঁ,শুনবো শুনবো।''

বলে আমরা সব চুপচাপ হয়ে গেলাম।

''তখন আমার এই ফাইভ টাইভ হবে।''

দাদু শুরু করলেন।

''স্কুলে তখন গরমের ছুটি চলছে।আমি গিয়েছি মামার বাড়ী বেড়াতে।এক গাঁয়ে।ওখানে লাল্টুমামা তখন আমার খুব বন্ধু।আমার থেকে বড়জোর দু' এক বছরের বড় হবে।আমরা দুজনে একসাথে খেলি।এখানে ওখানে ঘুরি।বড়দের চোখ এড়িয়ে চুপিচুপি অ্যাডভেঞ্চার করি।''

এই পর্যন্ত বলা হতেই দেখি কাকিমা আমাদের ঘরে ঢুকছেন।দুই হাতে দুটি বড় বড় থালা।ঘরে ঢুকে ঘরের টি টেবিলটাতে থালা দুটি রাখতে রাখতে বললেন,''গরম থাকতে থাকতে আলুর চপ গুলি সকলে খেয়ে নে দেখি।''

বলে বাড়ীর ভেতরে চলে গেলেন।

দেখি একটা থালায় এক থালা মশলা মুড়ি মাখা।আর একটা থালায় বেশ কতকগুলি আলুর চপ।আমরা সকলে গরম গরম খেতে শুরু করলাম।

দাদুও ডান হাত বাড়িয়ে থালা থেকে একটা আলুর চপ তুলে নিলেন।তারপর তাতে একটা আয়েশী কামড় দিয়ে আবার গল্প বলতে শুরু করলেন।

''তা যা বলছিলাম।মামার বাড়ীতে লাল্টু মামার সঙ্গে এদিক ওদিক চুপিচুপি ঘুরি।তো একদিন দুপুর বেলা।ভাত টাত খেয়ে উঠেছি একটু আগে।বড়রা সব ভাত ঘুম দিচ্ছে নিজ নিজ ঘরে।আমি খোলা বারান্দায় একা একা লাট্টু ঘোরাচ্ছি।এমন সময় পাশের বাড়ী থেকে লাল্টুমামা এলো।রোজ যেমনটি আসে।এসে বললে,চল রাঙা আজ দুপুরে আমবাগানে ঘুরে আসি।

আমি এক কথায় রাজি।দুপুর রোদে নির্জন রাস্তা দিয়ে তাও মিনিট দশেক হেঁটে গাঁয়ের শেষ প্রান্তের আমবাগানে পৌঁছালাম।দুজনেই গরমে ঘেমে স্নান হয়ে গেছি।একটা বড় আমগাছের ছায়ায় বসলাম দু'জনে।এদিকটায় এর আগে কখনো আসিনি।লাল্টুমামার সাথেই প্রথম আসা।আমরা যেখানটায় বসেছি তার পেছন দিকটায় আমগাছে আমগাছে ভরা মস্ত আমবাগান।আর সামনে জলা-জঙ্গল, খেত এইসব।গাছের ছায়ায় একটু বসতেই গরমের অস্বস্তিটা কমে আসলো।ঘুউ-ঘুউ-করে করে কাছেপিঠে কোথাও ঘুঘু ডাকছে একটা।নির্জন দুপুরের সেই ক্লান্ত ডাক মনে এনে দিচ্ছে একটা অলসতা।কিঁচিমিঁচি-কিঁচিমিঁচি-করে করে এক ঝাঁক চড়ুই ঐপাশটার পুকুরটার পাড়েতে হুটোপুটি করছে।ঐভাবে ওরা মনের আনন্দে স্নান সারছে।যা গরমটা পড়েছে।পশু পাখি সকলেই শীতল জল খুঁজছে।

- চল আম পাড়ি গাছে উঠে।

বলে লাল্টুমামা উঠে আমবাগাছের দিকে আরো এগিয়ে গেলো।

কচি কচি কাঁচা কাঁচা ছোটো ছোটো আম গাছে গাছে ঝুলছে।দেখেই জিভে জল চলে আসছে।মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই আমের নাগাল পেয়ে যাবো।কিন্তু গাছের নীচে গিয়ে ভুল ভাঙলো।আমি লাফিয়ে লাফিয়েও আমের নাগাল পেলাম না।লাল্টুমামা তরতর করে গাছে উঠে পড়েছে ইতিমধ্যে।আর পট্ পট্ করে আম ছিঁড়ছে গাছের ডাল থেকে।ছিঁড়ে নিজের জামার পকেটে ঢোকাচ্ছে।প্যান্টের পকেটে ঢোকাচ্ছে।গাছের নীচে থাকা আমাকেও ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে।আমি আর গাছে না উঠে খুব খুশিতে আম কুড়াচ্ছি।আর আমার জামার পকেটে,প্যান্টের পকেটে ভরছি।পরে দু'জনে বসে বসে নুন-ঝাল মিশিয়ে আয়েস করে খাবো বলে।পকেটে খাতার লেখা পাতা ছিঁড়ে,তাতে মুড়ে নুন-ঝাল বাটা নিয়ে এসেছি।কচি আমের খোসা ছিলার জন্য পকেটে দেশলাইয়ের বাক্স করে ঝিনুকও এনেছি। আম টাম পাড়া শেষ করে লাল্টুমামা গাছ থেকে নেমে এসে বসলো একটা গাছের নীচে।আমিও বসেছি মামার পাশে।পকেট থেকে ঝিনুকের বাক্সটা বার করে আম ছিলতে যাচ্ছি-----

এমন সময় ' পালা - পালা ' বলে লাল্টুমামা চোঁ চোঁ করে এক ছুট্টে দেখতে দেখতে গাছের আড়া হয়ে গেল।

আমিও একটু ধাতস্থ হয়ে ছুটতে শুরু করেছিলাম কিন্তু দুজন বড় বড় লোক ' ধর- ধর ' বলে জোরসে ছুট্টে এসে আমাকে ধরে নিল।

ওদের একজনের হাতে আবার একটা বাঁশের কঞ্চি।

' আম চুরি করা হচ্ছে খোকা।এবার মজা দেখবি।'

যার হাতে কঞ্চি ধরা সে বললো।

আর একজন মানে যার হাতে কঞ্চি আছে সে বললো,' একে বাগানের একেবারে মাঝে নিয়ে চল।গাছের সাথে বেঁধে সাটাবো।'

বলে ওরা দু'জন আমার আগে থেকেই ধরা দুহাত দু'দিক থেকে আরো শক্ত করে ধরে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে শুরু করলো।

ওদের সাথে যেতে যেতেই আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলছি,- আমাকে ছেড়ে দাও-- আমি আম সব দিয়ে দিচ্ছি--আর কখনো আম নিতে আসবো না বাগানে -

ওরা আমার কথা শুনছে আর হাসছে।খালি হাতের লোকটা বললো,'চোর ধরা পড়লে অমন কথা সব চোরই বলে রে।তবে মারধর দিলে কাজ হয়।আবার চুরি করতে বাছাধন ভেবে দেখবে।আর এ কোথাকার ছেলেরে!একে তো আগে কখনো দেখিনি বল?'

'কোন গাঁয়ে থাকিস রে তুই?'

কঞ্চি হাতে ধরা লোকটা আমাকে দিকে শুধালো।

আমি আমার গাঁয়ের নাম বললাম।আর এও বললাম যে এখানে মামার বাড়ী বেড়াতে এসেছি।

ওরা আর কিছু না বলে বড় বড় আমগাছের তলার পথ ধরে হাঁটছে।আমি কাঁদতে কাঁদতে ওদের সাথে যাচ্ছি।আর এখন কী করবো ভাবছি।কিন্তু কিচ্ছুটি মাথায় আসছে না।মনে মনে লাল্টুমামার ওপরো খুব রাগ হচ্ছে।আমাকে এভাবে ফেলে রেখে মামার পালিয়ে যাওয়া খুব অন্যায় হয়েছে।আমার জন্য ওর এদের কাছে ফিরে আসা উচিত ছিলো।লাল্টুমামাকে নিশ্চয় ওরা চেনে।একই গাঁয়ের লোক।মামা বলে কয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে পারতো।

একটা পথের বাঁক ঘুরতেই দেখি একটা কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে।একদম পথের মাঝে।এমন জায়গায় কাকতাড়ুয়া কেন!

আমরা সকলে দাঁড়িয়ে পড়েছি।

''আঁম দেঁ রে।আঁমি আঁম খাঁবো।''

হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো।আর তারপরেই কাকতাড়ুয়াটা নাচতে শুরু করলো।

তার মানে ঐ কথাটা বললো।

--ভূত-ভূ-

বলে আমার দুহাত ধরা লোকদুটি আমাকে ছেড়ে ছুড়ে কোথায় যে দৌড় দিলো।

আমি এখন মুক্ত।কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছিনা।এমন সময় দেখি কাকতাড়ুয়াটা নিজের মাথার হাঁড়িটা খুলে ফেললো।আর লাল্টুমামার মুখ বেড়িয়ে পরলো।

আমি তো থ।

''আরে এবার দৌড়া রে হাঁদা।আবার ধরা পড়বি নাকি--''

বলে মামা দৌড়াতে শুরু করলো।আমার সম্বিত ফিরে এসেছে এতক্ষণে।আমিও মামার পিছনে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করলাম।কিছুটা রাস্তা দৌড়ে সোজা একেবারে পাড়ায় ঢুকে দম ছাড়লাম দুজনে।

মামা একটা পুকুরে নেমে গায়ের কাদা কালি সব ধুয়ে নিল। 

আমি মামাকে বললাম কী করে করলে এসব।

'আরে কিছুটা দৌড়ে এসে দেখি তুই নেই।এখন কী করে তোকে ওদের হাত থেকে বাঁচাবো!ওদের তো চিনি।একবার আমি ধরা পড়ে ওদের হাতে খুব মার খেয়েছি।ওরা লোক ভালো না মোটেও।তখন মাঠের মধ্যে একটা কাকতাড়ুয়া দেখতে পেলাম।আর মাথার মধ্যে একটা পরিকল্পনা খেলে গেল।নিজের গায়ে কাদা কালি মাখলাম।আর মাথায় পড়লাম সেই কাকতাড়ুয়ার হাঁড়িটা।হলাম জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া।তারপর বাকিটা একটু অভিনয়।তাতেই কাজ হয়ে গেল।যা বিপদে পড়েছিলাম আমরা!'

--এখন আর কোনো বিপদ নাই।বলো আমার কাকতাড়ুয়া মামা।

আমি বললাম।

--ইয়ার্কি হচ্ছে--দাঁড়া দ্যাখাচ্ছি তোর-

বলে মামা আমার মিছিমিছি কান ধরতে গেলো।আমি সঙ্গে সঙ্গে কায়দা করে মাথা সড়িয়ে নিলাম। তারপর দুজনে হো হো হাসিতে ফেটে পড়লাম।''

বিদায় বেলায় - কাশফিয়া নাহিয়ান || Biday belai - Kasfiya nahiyan - Biday belay || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 বিদায় বেলায়

             কাশফিয়া নাহিয়ান



আসুন আসুন...ঘরে আসুন।ঘরে এসে আমাকে উদ্ধার করুন।

এভাবে কেন বলছেন...

তো আর কিভাবে বলবো?গ্রামের বাড়ি গেলাম বাবা মা কে দেখতে...আর তারা কিনা জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। আমি আদিল মাহমুদ। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি।আর তাকে কিনা বিয়ে করতে হলো আপনার মত গেঁয়ো ভূতকে...আনবিলিভেবল..

দেখুন... আমি মোটেও গেঁয়ো ভূত নই।গ্রামে থাকি ঠিকই কিনতু আমি পড়াশোনা জানা মেয়ে... কলেজ পর্যন্ত পড়েছি... অনেক দূর পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছা ছিল। আমার বাবা মাও তো আমাকে জোর করে...

ব্যস ব্যস!ফাহিমা আমি আর আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না...ওই যে ওইদিকের রুমটা আপনার...আর এই দিকেরটা আমার। ভুলেও আমার রুমে আসবেন না।আমাকে একদম বিরক্ত করবেন না...

অবাক হয়ে রুমে ঢুকলো ফাহিমা।সে জানে না আদিল তার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছে...তার কি দোষ?

এই নিন আপনার চা...

আমি কি আপনাকে চা আনতে বলেছি... এরকম গায়ে পড়া অভ্যাস আমার মোটেও পছন্দ না...

আমি তো শুধু...

মুখে মুখে তর্ক করবেন না... ফাহিমা আমার কোনো কাজ আপনি করবেন না।এই বাড়ি থেকে বের হবেন না... আপনার যা প্রয়োজন সব পেয়ে যাবেন.. কিন্তু বাড়ির বাইরে পা রাখবেন না। কথাগুলো মনে থাকবে?

ঠিক আছে...ফাহিমা সব কথা মেনে নিলো আদিলের।কারণ শুধু শুধু বাকবিতন্ডায় নিজেকে জড়ানো উচিত হবে না।

সে জানে না সে ভালো করছে না খারাপ করছে! আদিল তাকে কখনো মেনে নেবে কিনা তার সংসার টিকবে কিনা কিছুরই ঠিক নেই।

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো...

আদিলের মোবাইল! ফোন ধরবে কি ধরবে না বুঝতে পারছে না সে। তবুও ফোনটা ধরলো ফাহিমা...

হ্যালো...

আদিল কোথায় তুই...এক সেকেন্ড... তোর আওয়াজটা মেয়েদের মত লাগছে কেন...

আমি..আদিল না ওনার ওয়াইফ ফাহিমা...

কে...

আ...মি...

হঠাৎ ফোনটা কেটে গেলো।সে বুঝতে পারলো না কে ফোন দিয়েছিলো... কিছুক্ষণ পর কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিলো আদিল।

এই তুই কোথায় ছিলি রে...আর একি শুনছি.. তুই নাকি বিয়ে করেছিস?

ইরফান তুই আ..মার কথাটা শোন...

কি শোনার বাকি আছে... তুই একা একা বিয়ে করে ফেললি...আমাকে জানালি না...হাউ মিন...

সব কিছু এত জলদি হয়ে গেলো যে...

আ..দিল কে এ..সে...ছে?

তো... আপনি.. আদিলের...

জ্বী... আপনি...

আমি ইরফান...আদিলের বেস্ট ফ্রেন্ড।

আপনি এখানে কি করছেন?যান নিজের রুমে যান...

ফাহিমা তার রুমে চলে গেলো।

এভাবে কেউ নিজের বউ এর সাথে কথা বলে...

আর বউ..গ্রামের মেয়ে...আমার সাথে ম্যাচ খায় নাকি?

এভাবে বলছিস কেন?দেখতে শুনতে তো বেশ ভালো...একটু সময় নে।সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেলো ইরফান...এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাটা বললো আদিল।

দিন পার হতে থাকলো।মাস পার হতে থাকলো।আদিলের ফাহিমার উপর অত্যাচার বাড়তেই থাকলো।কথায় কথায় তাকে অপমান করা হয়ে গিয়েছিলো আদিলের শখ।

আর এদিকে ইরফান যার প্রথম দেখাতেই ফাহিমা কে ভালো লেগে গিয়েছিলো...তার নিষ্পাপ চেহারা মায়াবী হাসি তাকে পাগল করে দিয়েছিলো। সবসময় কোনো না কোনো অজুহাতে ছুটে যেতো ফাহিমার কাছে।আর ফাহিমা সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ইরফানের মনে কি চলছে তা সে একটুকু আঁচ করতে পারেনি।

আজ বাইরের খাবার খেতে একদম ইচ্ছা করছে না তাই চলে এলাম...

বসুন... ইরফান ভাই...আমি এখনই আসছি...

ফাহিমা তখনই গোসল করে এসেছে।লম্বা ভেজা চুলে অপূর্ব লাগছে তাকে... ইরফান মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে।সে ভেবে অবাক হয়ে যায় এত সুন্দর একটি মেয়েকে কেউ ভালো না বেসে কিভাবে পারে...

আদিল আপনাকে কখনও মেনে নেবে না..

মানে?

মানে...ওর এত বড়ো একটা ইগো আছে...

ওই সেই বলয় থেকে কখনই বের হয়ে আসতে পারবে না।

এভাবে কেন বলছেন? আমি জানি ও আমার কাছে একদিন ঠিকই ফিরবে।

তুমি কেন বুঝতে পারছো না তুমি এর চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ব করো..আমাকে তোমার চোখে পড়ে না... আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! ফাহিমার হাত চেপে ধরে বললো ইরফান...

এসব কি বলছেন? ছাড়ুন আমাকে...

আমার চোখ দেখে বুঝতে পারো না... তোমার জন্য কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে আছে...

আমি কিছু বুঝতে চাই না... আমি আপনাকে কখনও সেই চোখে দেখিনি... আপনার লজ্জা করছে না আমাকে এসব কথা বলতে?চলে যান এখান থেকে...

আমি কোথাও যাবো না...আজ তোমাকে বলতেই হবে তুমিও আমাকে ভালোবাসো...তাকে জাপটে ধরে বললো ইরফান...

ফাহিমা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না...

ইরফান...

আদিলকে দেখে ফাহিমাকে ছেড়ে দিলো সে...

এখানে এসব কি হচ্ছে...

কেন এত অবাক হওয়ার কি আছে? তুই তো কখনও ফাহিমাকে নিজের বউ হিসেবে মেনে নিবি না...যদি আমি তাকে ভালোবাসি তো এতে ক্ষতি কি?

তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস ইরফান...

কেন তোর এত গায়ে লাগছে কেন? তুই তো কথায় কথায় ফাহিমাকে অপমান করিস...

তখনই তাকে এক ঘুষি মারলো আদিল...

দুই জনের মারামারি চরম পর্যায়ে চলে গেলো... হঠাৎ আদিলের চড় খেয়ে ইরফান টেবিলের সাথে ধাক্কা খেলো...তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়লো... রক্তে ভিজে গেলো চারপাশ...

ইরফান এই ইরফান?কি হলো তোর...আদিলের আর বুঝতে বাকি রইল না ইরফান মারা গেছে...

এ...টা কি হ..লো? কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ফাহিমা...

ও...মা..রা গেছে...

আমরা...এখ..ন কি কর...বো? আমাদের তো পুলিশ...

চুপ একদম চুপ! কিছু হবে না আমাদের... নিজেকে সামলে নিয়ে বললো আদিল। কাউকে কিছু না জানিয়ে আমাদের এই লাশটা সরাতে হবে। নিজেদের বাঁচাতে হবে...

এসব আপনি কি বলছেন?

ঠিকই বলছি... এছাড়া আর কোনো উপায় নেই...

এক বড় স্যুটকেসে ইরফানের লাশটা ভরে ফাহিমাকে সঙ্গে করে নিজের গাড়ীতে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো আদিল।

এক সুনসান জায়গায় গাড়ীটা থামিয়ে ইরফানের লাশটা পুঁতে দিলো সে...

আর ফাহিমা..তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে..

চুপ করো..একদম কাঁদবে না। কিছু হবে না আমাদের...

সে কোনো কথা বললো না...শুধু কেঁদেই চললো...

কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না আদিল...গাড়ী ড্রাইভ করছে সে আর রাজ্যের চিন্তা তার মাথায়... হঠাৎ অসতর্ক অবস্থায় গাড়ীটা আ্যক্সিডেন্ট করলো...

আদিল যখন চোখ খুললো তখন সে হসপিটালের বেডে...

আপনি উঠবেন না প্লিজ...ইউ নিড রেস্ট।

আমি..কো..থা...য়?

আপনি হসপিটালে... তিন দিন পর আপনার জ্ঞান ফিরলো।আপনার একটা বড় আ্যক্সিডেন্ট হয়েছিলো... কিছু মনে পড়ে?

ফা..হি..মা..

কে? আপনার সাথে যিনি এসেছিলেন তিনি তো..

কি হয়েছে ফাহিমার... উত্তেজিত হয়ে বললো আদিল...

উনার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল ছিলো...এখন উনি কোমাতে..

জ্বী...কি বলছেন ডক্টর...

ঠিকই শুনেছেন কখন ওনার জ্ঞান ফিরবে বলা মুশকিল...

আদিলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কিছুই বুঝতে পারছে না সে কি করবে...

নাওয়া নেই খাওয়া নেই...এখন তার একটাই কাজ ফাহিমার পাশে বসে থাকা...

তার হাত ধরে কান্নাকাটি করে। মনমরা হয়ে বসে থাকে।শুধু একটাই চাওয়া ফাহিমার যেন জ্ঞান ফিরে আসে...

প্লিজ একবার চোখ খোলো।আমাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও।জানো অনেকবার জীবনকে প্রশ্ন করলাম। নিজেকে কাটাছেঁড়া করলাম। ফাহিমা আমি বুঝে গেছি তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি তোমার সাথে সূর্যোদয় দেখতে চাই। সূর্যাস্ত দেখতে চাই।তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। তোমার কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে মরতে চাই। তুমি নেই তাই নিজেকে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে...খুব একা লাগে...আমার কিছু ভালো লাগে না... তুমি আমার জীবনে এসেছিলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আর আমি কিনা তোমাকে...

ফাহিমা চোখ খোলে না।কোনো রেসপন্স করে না... হঠাৎ করে গভীর রাতে রুমটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে যায়...কারো গোঙানির আওয়াজ আসে...মনে হয় কেউ কাঁদছে। আদিল কারো উপস্থিতি টের পায়... কিন্তু ভাবে হয়তো তারই মনের ভুল...

কিন্তু আদিলের ভাবনা ভুল নয়।ফাহিমার শিয়রে বসে থাকে ইরফান...যে মরে গিয়েও ফিরে এসেছে তার ভালোবাসার টানে।যে এখনও বিশ্বাস করে ফাহিমা শুধু তার আর কারও না.. যে তাকে নিয়ে যেতে চায় তার জগতে...কারণ ফাহিমার নামই তো উচ্চারিত হচ্ছিলো ইরফানের বিদা

য় বেলায়.... পরিশেষে কার জয় হবে? ইরফানের মত অশরীরীর নাকি আদিল আর ফাহিমার ভালোবাসার?




গোপন কান্না - দেবদাস কুণ্ডু || Gopan Kanna - Devdas Kundu || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 গোপন কান্না

       দেবদাস কুণ্ডু



--একটা কথা বলবো লতিকা।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল লতিকা। দরজার আংটা ধরে। টান দিলে খুলে যাবে দরজা। দু পা হেঁটে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে ঢুকে যাবে লতিকা। কিন্তু তা হলো না। সৌম্য বসাকের কথায় ঘুরে দাঁড়াল লতিকা।

     লতিকার গায়ের রং কালো। কিন্তু মুখে ঝকঝকে লাবন্য। বুক দুটি বেশ উঁচু আর ভরাট। উচ্চতা সাধারণ মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি। স্বাস্থ্যের বাঁধন বেশ টানটান। পিঠ জুড়ে একরাশ কালো চুল। দু চারটে চুল লেপটে আছে কপালে। সব মিলিয়ে মোহনীয় এক নারী।

--কি হলো? কি দেখছেন? আমার কিন্তু কাজ আছে।

      সৌম্য একটু নড়ে চড়ে বসল – বলবো কিনা ভাবছি।

--তাহলে আপনি ভাবুন। আমি চলি। দরজা একটু ফাঁক করল লতিকা।

--আসলে কি---সৌম্যকে থামিয়ে দিয়ে লতিকা বলল—যে কথা বলতে সংকোচ হয় সে কথা না বলা ভালো। আমি আসছি। এবার দরজা অনেকটা খুলে ফেলেছে লতিকা।

--যাবে না। কথাটা শোনা দরকার আছে তোমার। দরজাটা বন্ধ করো।

--করলাম দরজা বন্ধ। এবার বলুন কী বলবেন? লতিকা ঘুরে দাঁড়ায়ে কথাটা বলল।

    লতিকার বয়স কতো হবে। পঁয়তিরিশ ছতিরিশ। পরনে নীল শাড়ি। কালো শরীরে নীল শাড়ি? অবশ্য দেখতে খারাপ লাগছে না।

--কথাটা তুমি কি ভাবে নেবে সেটাই তো একটা প্রশ্ন।

--আমি কোন প্রশ্ন করবো না। আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। আমাকে রাতের রুটি করতে হবে।

--প্রশ্ন করবে না? ঠিক বলছো তো?

--করতেও পারি। যদি দেখি প্রশ্ন করাটা জরুরী।

--তাই তো ভাবছি কি করে বলি তোমায়। সব মানুষ তো সমান নয়।

   লতিকা সোফায় বসলো। সে বুঝে গেছে এখনই তার এখান থেকে যাওয়া হচ্ছে না। সোফায় বসে হাতদুটো রাখলো কোলে। চোখে একটা অদ্ভুত আলো এনে বলল—আপনি কি করে ভাবলেন সব মানুষ এক রকম হবে। আপনার বারান্দায় তো কতো ফুল গাছ। সব গাছে কি এক রংয়ের ফুল হয়? এই ফ্ল্যাট বাড়ি টায় আটটা ফ্ল্যাট আছে। প্রতিটা ঘরে আলাদা রঙ।

--লতিকা তুমি কি দর্শনের ছাত্রী ছিলে নাকি?

--আচ্ছা আপনার বয়স কত হলো বলুন তো?

--আমাকে দেখে তোমার কতো মনে হয়?

--সে আমি বলতে পারবো না।

--বাহান্ন চলছে।

-তাহলে আপনার অভিজ্ঞ চোখে কি মনে হয় আমি খুব পড়াশোনা জানা মেয়ে? আমি দর্শন টর্শন বুঝি না। এতো সাধারণ কথা। সব মানুষ এক রকম হয় না। এ আর নতুন কথা কি বললাম? একটু থেমে চুলের আলগা একটা খোপা করে বলল—আমি নাইন পর্যন্ত পড়েছি। 

    সৌম্য বসাক অবাক হল। ক্লাশ নাইনের বিদ্যে।অথচ কি সুন্দর গুছিয়ে কথাগুলো বললো। সৌম্য গলায় জড়তা নিয়ে বললে-কথাটা তোমায় বলা খুব দরকার অথচ বলতে দ্বিধা হচ্ছে। 

--সব দ্বিধা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি বলুন তো। দরি হলে ছোট মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। 

--তাহলে এখন থাক। পড়ে বলবো।তুমি এখন এসো।

--না। আমি না শুনে যাবো না। আপনি বলে ফেলুন। লতিকা কিশোরী সুলভ গলায় কথাটা বলল। ওর চোখ দুটো কৌতুহলে চঞ্চল। ডাইনিং টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে আছে সৌম্য বসাক। টু রুমের ছোট ফ্লাট। ডাইনিং টা আট বাই দশ হবে। লতিকা আর তার মাঝে তিন ফুটের ব্যবধান।সৌম্য একটা সিগারেট ধরাল। 

--আবার সিগারেট কেন? এই গন্ধটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আপনার কি টেনশন হচ্ছে? 

--তা একটু হচ্ছে বৈকি। সিগারেট এসটেতে গুঁজে দিলেন সৌম্য। 

--এমন কি কথা যে টেনশন হবে। 

--কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আসলে কথাটা তুমি কিভাবে নেবে সেটাই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে। 

--টেনশন হলে বলতে হবে না। থাক কথাটা গোপন। 

--তাহলে যে বিপদ হতে পারে লতিকা। 

--বিপদ? কিসের বিপদ? লতিকার চোখে বিস্ময় ।

--তাহলে বলেই ফেলি কথাটা? 

---হ্যাঁ ।সেটাই ভালো। টেনশন পুযে রাখা ভাল না। শরীর খারাপ হতে পারে। 

---তোমারও টেনশন হয় বুঝি? 


--কখনো সখনো হয় তো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো লতিকা – এমা ন টা বেজে গেল। রুটি করতে হবে। সবজি করতে হবে। আপনি চটপট বলুন তো। আর এক মূহূর্ত দেরি করা যাবে না। এরপর মেয়েটা আমার সত্যি ঘুমিয়ে পড়বে। হাজার ডাকলেও উঠে খাবে না। বলুন। 

--কথাটা হলো তুমি রোজ রোজ আমাকে খাবার পাঠাবে না। 

--ও এই কথা। আমি ভাবলাম কি না কি কথা। লতিকার গলায় হতাশা ঝরে পড়ল। বলল—তা জানতে পারি কেন একথা বলছেন? তারপর নিজের প্রশ্নের উওরের অপেক্ষা না কর বলে উঠল—আজও তো রান্না করতে পূর্নিমা আসে নি। তাই তো? 

---হ্যাঁ ।আসে নি। 

--দুপুরে কী খেলেন? 

---কি আর খাবো। আমি তো হোটেলে খেতে পারি না। পেটের সমস্যা আছে। রান্না করতে জানি না। কোনদিন রান্না করার দরকার হয় নি। এখন বুঝতে পারছি রান্না শেখাটা ভীষণ জরুরী। 

--পুরুষ মানুষ সব পারে না। পারলে তো সংসারে আমাদের জায়গা হতো না। এতো কিছু করেও তো সংসারে জায়গা পাই না। লতিকার কথায় বিযন্নতার আবহাওয়া। 

    লতিকা কি বলতে চাইছে? ওর দুই মেয়ে। বড়টা এবার এইস এস দেবে। ছোটটা এইট।ওর স্বামী ট্যাক্সি চালক। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত করে। তখন স্বাভাবিক থাকে না ওর স্বামী পরেশদা। প্রায় দিনই লতিকার ফ্ল্যাট থেকে পরেশদার চিৎকার ভেসে আসে। হয়তো মারধরও করে। 

-তুমি এমন কথা বললে কেন লতিকা? 

--আগে বলুন দুপুরে কি খেয়েছেন? 

--কদিন ধরে শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। চিঁড়ে মুড়ি খেয়েছি।

--বেশ করেছেন। কেন ঐ কথা বললাম তা জানতে চাইছেন? আপনাকে বলে কি হবে? আপনি তো একজন পুরুষ মানুষ। 

--তুমি কি বলতে চাইছ পুরুষ মানুষের মন নেই? । তারা সব নিষ্ঠুর? 

---এসব কথা ছাডুন। আপনার স্ত্রী রীনাদি বদলি হয়ে বীরভূমে চলে যাবার আগে আমাকে বলে গেলেন আপনার খোঁজ খবর রাখতে। আজ দুপুরে খাবার পাঠাতাম। ব্যাংকএ



 গিয়ে ছিলাম। করোনার জন্য কাউন্টারে বিশাল লাইন পড়ে ছিল। দেরি হয়ে গেল খুব। আমি খাবার দিলে আপনার কি অসুবিধা? হ্যাঁ। রীনাদির মতো অতো ভালো রান্না করতে পারি না আমি। 

--না না। তোমার হাতের রান্নাও ভালো। 

---তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আপনি কেন বারন করছেন? 

--কারন আছে তাই বলছি। 

--কারনটা কি সেটা শুনতে চাইছি। 

--তিনতলার রবীনের বউ, চারতলার বিকাশের বউ, নিচতলার অলোকের বউ এরা একটা গ্রুপ। কে কি করছে তা নিয়ে আলোচনা করে। মানে পরনিন্দা পরচর্চা করে। 

--ও এই কথা। একটু আগে লতিকার মুখে যে বিযন্নতার শ্যামলা আভা ছড়িয়ে ছিল, এখন সেখানে সকালের রোদ্দুর। গলার কাঠিন্য এনে বলল—ওরা কিছু বললে আপনি কোন উওর দেবেন না। যা বলার আমি বলবো। একটু থেমে বলল—ওরা আড়ালে যা ইচ্ছে বলুক আমার কিছু যায় আসে না। 

--কিন্তু পরেশদা যদি কিছু বলেন? 

--কখন বলবে? সারাদিন বাড়ি থাকে না। রাতে কি অবস্থায় ফেরে আপনি জানেন। সকালে উঠে আবার বেরিয়ে যায়। তার সংগে আমার কথা হয় কখন? তাছাড়া সারাদিনে আমি কি করি তা ও জানবে কি করে? 

--কিন্তু তোমার মেয়েরা যদি কিছু বলে? 

--বলবে না। ওরা আমার মেয়ে। আমি ওদের সেভাবেই বড করেছি। এমন আজেবাজে কথা ওরা কখনো মনে আনবে না। বলা তো দূরের কথা। একটু থেমে আবার বলল—সত্যি রীনাদি ভালো রান্না করে। আমি তো খেয়েছি।পূর্নিমা এদেশি মেয়ে। কেমন রান্না করে কে জানে। এর আগে কোন বাড়িতে রান্না করে নি। আপনি খেতে ভালোবাসেন। তাই দিয়ে যাই। এখানে অন্যায়টা কোথায় বলুন? 

    সৌম্য বসাক জবাব দেবার আগে ঘরে ঢুকে পড়েছে তিথি। লতিকার ছোট মেয়ে। সে বলল—মা তুমি এখানে। আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।মোবাইলটাও নিয়ে আসো নি। আমার ঘুম পাচ্ছে। কখন তুমি রুটি করবে? 

--তুই যা। আমি এখুনি যাচ্ছি।ঘুমিয়ে পড়িস না আবার। 

--আচ্ছা ।তুমি আসো।

তিথি চলে গেল। লতিকা উঠে দাঁড়াল – মুড়ি ঘন্টা খেয়ে নেবেন।মুড়ি ঘন্ট তো আপনি ভালোবাসেন। রীনাদি বলছিলেন একদিন। যদিও রীনাদির মতো টেস্ট পাবেন না। খেয়ে বলবেন কেমন লাগলো। লতিকা উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। 

                       দুই

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সৌম্য বসাক। তাদের আবাসনের চারদিকে ছড়ানো ছিটানো বস্তি। চোখে পড়ে বস্তির নোংরা টালির চাল। সেই বিবর্ন টালির চালের ওপর ছুটছে একটা মোটা বেজি। কত দিন কতো বছর পর সে বেছি দেখল। গা টা কেমন শিরশির করল। ক দিন ধরে গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। আজ কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। সংগে দূর্বলতা রয়েছে। তার পরিচিত গৌর ডাক্তারকে ফোন করেছিল। তিনি ওযুধ বলে দিয়েছেন। এখন কে এনে দেবে অযুধ। পনের মিনিট হেঁটে গেলে মা মেডিকেল স্টোরস। কিন্তু শরীরে হাঁটার শক্তি নেই। তিনতলার সূরজকে ফোন করেছিল। সে মামা বাড়ি গেছে। নিচতলার রতনকে ফোন করেছে। রতন পিসির বাড়ি গেছে। বাধ্য হয়ে ফোন করল লতিকাকে। গৌর ডাক্তার বলেছেন পাঁচদিন ওযুধ খেতে হবে। জ্বর না কমলে করোনা টেস্ট করতে হবে। রীনাকে ফোনে জানিয়েছে ।রীনা এখন আসতে পারবে না। বাঁধ ভেঙেছে। তা নিয়ে ব্যস্ত। সে যে ইন্জিনিয়ার। বন্যা হলে তাকে তো ব্যস্ত থাকতে হবে। 

   লতিকা ঘরে টুকল –কবে জ্বর এলো।

--মনে হয় কাল। 

---আমাকে বলেন নি কেন? শাশুড়ির শরীর খারাপ তাই শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছিলাম। লতিকা হঠাৎ সৌম্যর কপালে হাত রাখল—ভালোই তো জ্বর আছে মনে হচ্ছে। থার্মোমিটারে জ্বর দেখেছেন? 

--না। 

--ঘরে থার্মোমিটার আছে? 

--ছিল তো। এখন কোথায় আছে কে জানে। 

--দাঁড়ান। লতিকা চলে গেল। মূহুর্তের মধ্যে চলে এলো থার্মোমিটার হাতে—দেখি হাত তুলুন। ঘড়ির দিকে নজর রেখে দু মিনিট পর থার্মোমিটার বগল থেকে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরল—এ কি এতো একশো দুই জ্বর। কি করে জ্বর বাধালেন? 

--দুদিন বিকেলে চান করেছিলাম। 

--কেন? 

--খুব গরম লাগছিল। 

--বিকেলে চানের অভ্যাস আছে? 

--না। 

--তাহলে? ছাত্র পড়ান তাই সব জায়গায় মাস্টারি করেন বুঝি?   

--কি যে বলো না তুমি। 

--রীনাদি নেই বলে যা ইচ্ছে তাই করছেন। ঘরে প্যারাসিটামল আছে? 

--বোধ হয় নেই। 

-- আচ্ছা মানুষ তো আপনি। কাল থেকে জ্বরে পড়ে আছেন একবার আমার মেয়েদের বললে ওরা ওযুধ এনে দিতো। 

---ওদের বলতে আমার সংকোচ হচ্ছিল। 

--কেন? কিসের সংকোচ? 

---ওরা পড়াশুনা নিয়ে থাকে। ওদের কেন ব্যস্ত করতে যাবো। 

--বুঝেছি। দিন আমাকে। কি ওযুধ আনতে হবে বলুন। 

ওযুধ লেখা কাগজ আর টাকা দিল লতিকার হাতে সৌম্য বসাক। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লতিকা –ডাক্তার না দেখিয়ে ওযুধ খাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? 

--ডাক্তার দেখিয়েছি তো? 

--কখন ডাক্তার দেখালেন? কে নিয়ে গেল? 

--ফোনে ডাক্তারের এ্যাডভাইস নিয়েছি। 

লতিকা বেরিয়ে গেল। 


    ওযুধ নিয়ে ফিরে এলো তাড়াতাড়ি। জল ওযুধ এগিয়ে দিল সৌম্যর দিকে। সৌম্য জল সহ ওযুধ চালান করল গলায়। 

--কিছু খেয়ে ছিলেন? 

--না। 

--খালি পেটে ওযুধ খেয়ে নিলেন? এই আপনি মাস্টারি করেন? 

--কি করবো? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না যে। 

--তা বললে হবে? আচ্ছা আমি ডিম টোস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি। 

--দরকার নেই। ঘরে মুড়ি আছে খেয়ে নেব। 

--মাথা ধুয়ে দিতে পারলে জ্বরটা নামতো। 

--দরকার নেই। ওযুধ তো খেলাম। এবার জ্বর এমনই নেমে যাবে। 

--জ্বর নামতে সময় লাগবে। মাথায় জল দিলে আপনি স্বস্তি পেতেন। 

--তা ঠিক বলেছো। জানো লতিকা আমার না এক সময় প্রতিবছর জ্বর হতো। আমি ঠাকুরমার কাছে থাকতাম। জ্বর হলে মার কাছে চলে যেতাম। জ্বর একটু বাড়লে মা মাথা ধুয়ে দিতো। বড্ড আরাম পেতাম। মায়ের হাতে যাদু ছিল।  

--এ আর নতুন কথা কি। সব মায়েদের হাতে ওমন যাদু থাকে। তারা যে মা। 

--আজ খুব মনে পড়ছে মায়ের কথা। 

--তাই তো বলছি। মাথাটা ধুয়ে দি। 

--শোন লতিকা কোন কথাই নতুন নয়। কেউ অলংকার দিয়ে, কেউ ছন্দ দিয়ে, কেউ উপমা দিয়ে কথা বলে। আসল কথাটা কিন্তু একই থাকে। এই দেখ না সময় কতো পাল্টে গেছে। মাতৃত্ব কি পাল্টেছে? 

-জানি আপনি বই লেখেন। সুন্দর কথা বলতে পারেন। আমরা কি তা পারি? 

-কেন পারবে না লতিকা। মানুষ পারে না এমন কাজ আছে? শুধু একবার নিজের ভিতরে ডুব দিতে হবে। 

--আমি বাবা এতো কঠিন কথা বুঝি না। আমাকে রান্না করতে হবে। ভালো কথা, রাতে কি খাবেন? 

--দুপুরের খাবারই পড়ে আছে। 

--সে কি? তিথি তো সামান্য খাবার দিয়ে গিয়েছিল, সেটাও খান নি? 

--মুখে এতটুকু রুচি নেই। কি খাবো? । 

--রীনাদির সংগে কথা হয়েছে ।উনি ব্যস্ত ।এখন আসতে পারছে না। 

--জানি। 

--এই সময় জ্বর কিন্তু সাংঘাতিক। 

--যদি করোনা হয় লতিকা। তুমি যেভাবে কাছে আসছো—

--করোনা হতেই পারে। বাজার হাটে যাচ্ছি না? একটা মানুষ জ্বরে পড়ে থাকবে আর আমি করোনার ভয়ে দূরে সরে থাকবো? 

--তুমি বুঝতে পারো না লতিকা। তোমার কিছু হলে তোমার মেয়েরা বলবে তুমি জেঠুর কাছ থেকে ভাইরাস নিয়ে এসেছো। 

---বলবে না। আমি আমার মেয়েদের চিনি। আপনাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। 

--না বললেই ভালো। আমি চাই না আমার জন্য তুমি কথা শোন। 

--হয়েছে। আর বলতে হবে না। রুটি তরকারি পাঠিয়ে দি। । 

--তাই দিও। 

--রাতে পাখা চালাবেন না। 

--গরম লাগবে যে। 

--তাহলে হালকা করে চালাবেন। গায়ে একটা চাদর দিয়ে নেবেন। খাওয়ার পর ওযুধ খেয়ে নেবেন। 

--আরে বাবা তুমি কি আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়েছো নাকি? 

--পুর্নিমা কবে আসছে দেশ থেকে? 

--জানি না। 


--ফোন নম্বর নেই? 

--ধরে না। রিং হয়ে যায়। এই আজ বিকেলে ফোন করেছিলাম। ধরল না।দেশে গেলে এমনই করে। দেশে যে কি আছে ওর কে জানে। 

--পূর্নিমার কোন কান্ড ঞ্জান নেই। 









 একজন মানুষের রান্নার দায়িত্ব নিযেছিস। কি করে এতোদিন দেশে পড়ে থাকিস? 

--আর বলো না। 

--কোন অসুবিধা হলে ফোন করবেন। 

--তুমি অতো ব্যস্ত হয়ো না তো। আমি ছেলে মানুষ নই। 

--সব পুরুষ মানুষই ছেলে মানুষ। মেয়ে মানুষ কি করে হবে? 

সৌম্য হেসে ফেলল—ভালো বলেছো তুমি? 

           তিন

   পরদিন সন্ধ্যা বেলা লতিকা এলো—জ্বর কমেছে? 

সৌম্য বলল—মনে হয় না। 

--জ্বর মেপেছেন? 

--ঐ কাজটা পারি না যে। 

--কি পারেন আপনি? রীনাদি যে কি দেখে আপনার সংগে প্রেম করেছিল কে জানে। 

সৌম্য মৃদু হাসে—প্রেম কি আর দেখে হয়? প্রেম হয়… 

--বুঝেছি। আর বলতে হবে না। এখন বগলে থার্মোমিটার চেপে ধরুন তো। দু মিনিট পার করে জ্বর দেখে আজও চমকে উঠল লতিকা—এ কি! আজ একশো দুয়েক আটকে আছে যে





রীনাদিকে খবর দেই যে তুমি এসে স্বামীর জ্বরে বাঁধ দাও আগে। 

--না না। তা করো না। ওখানে বাঁধ ভেঙে বন্যায় অনেক মানুষ বিপন্ন। আমি তো এখানে একজন মাত্র। 

--তাহলে অশোক ডাক্তারকে ডেকে আনি। 

--আশোক ডাক্তার? না না। 

-কেন? 

--বড় নোংরা থাকেন অশোক ডাক্তার। জামাকাপড় পড়ে নোংরা। চেম্বারও নোংরা। একজন ডাক্তার যদি পরিচ্ছন্ন না থাকে তার কাছে রগী কি করে যায়। এই নোংরা থাকার জন্য ওর বউ উনাকে ছেড়ে চলে গেছে। 

--বাবা! এতো খবরও রাখেন দেখছি। 

--আমার এক ছাত্র বলেছিল। ওদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান অশোক ডাক্তার। 

--তাহলে সুমিত পালকে ডেকে আনি। উনি এখন চেম্বারে আছেন। 



--তুমি দেখছি এ পাড়ার সব ডাক্তারের খোঁজখবর রাখ। 

--রাখতে হয়। তিথিটা যে মাঝ মাঝে অসুস্থ হয়। 

--কোন ডাক্তার ডাকতে হবে না। তিনদিন ওযুধ খেলাম। আর দুটো দিন দেখি। তারপর দেখা যাবে। 

--তাহলে এখন মাথাটা ধুয়ে দি? 

--না না। দরকার নেই। 

--আপনার না থাকতে পারে, আমার আছে। শুয়ে পড়ুন তো। 

    লতিকার গলায় শাসনের সুর। সৌম্য অবাধ্য হতে পারলো না। উওর দিকে মাথা রেখে দখিনে পা রেখে শুয়ে পড়ল খাটে। 

    লতিকা বাথরুম থেকে জলের বালতি আর মগ নিয়ে এলো। মাথার তলায় টাওয়াল দিল। চুলে জল ঢালতে থাকল ধীরে ধীরে—কতদিন চুল কাটেন না বলুন তো? কতো বড় হয়েছে। 

--আছে, থাক না। 

--অদ্ভুত কথা তো। লেখাপড়া শিখে পুরুষ মানুষ যে এমন হয় কে জানতো? 

--লেখাপড়া শেখার সংগে চুলের কি সম্পর্ক? 

--সম্পর্ক আছে। 

--শুনি সম্পর্কটা। 

--সব সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না। 

    চুলের ভিতর শীতল জল নেমে যাচ্ছে। লতিকা চুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে ঢেলে যাচ্ছে জল। একটা ঠান্ডা অনূভতি ছড়িয়ে যাচ্ছে সৌম্যর শরীরে।এভাবে রীনা কোনদিন সেবা করে নি। ওর অফিসের দায়িত্বের জন্য সে অনেক সময় অবহেলিত হয়েছে। এখন বড় আরামে অবশ হয়ে আসছে তার মাথার স্নায়ুতন্তগুলি। একটা তন্দাসুলভ আবেশ তাকে বিবশ করে দিল। কিছু সময় পর লতিকা বলল—এবার উঠুন। 

   সৌম্যর কানে গেল না কথাটা। 

লতিকা আবার ডাকল—কি হলো ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? 

   সৌম্যর সাড়া নেই। আরে সত্যি মানুষটা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? 

   লতিকা মৃদু ঠেলা দিল—উঠুন। হয়ে গেছে যে। 

  







সৌম্যর তনদা 


ভাব কাটল। সে চোখ মেলে একরকম ঘোরের মধে তাকিয়ে থেকে বলল—কি হয়েছে? 

--উঠতে হবে না? গাটা তো স্পজ করতে হবে। 

ঘোরের ভিতর সৌম্য উঠল। নীচে নেমে দাঁড়াল। 

--কি হলো? পাঞ্জাবীটা খুলুন।

সৌম্য দাঁড়িয়ে রইল। 

--লজ্জা হচ্ছে? পুরুষ মানুষের খালি গা হতে লজ্জা কিসের। খুলে ফেলুন। 

  গীজার থেকে হালকা গরম জল নিয়ে এলো লতিকা। ভেজা টাওয়াল দিয়ে অতি যত্নে বুক হাত পা মুছিয়ে দিল। যেন নিজের স্বামীর সেবা করছে। এতটুকু অস্বস্তি নেই। লতিকার শরীর থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছে সে। তার স্নায়ুতন্তগুলি কে অবশ করে দিল। প্রগাঢ় আবেশ মাখা গলায় প্রবেশ করল। সৌম্য বলল—কে তুমি? 

    ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। মৃদু একটা আলো জ্বলছে। সেই আলো আঁধারিতে লতিকাকে রহস্যময়ী লাগছে সৌম্যর। সে আবার বলল—কে তুমি? 

  লতিকার হাত সহসা থেমে গেল। হাতে ভেজা টাওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছু সময় । তারপর সৌম্যর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল—আমি লতিকা। 

--না না। তুমি লতিকা নও। তোমার গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি। 

--কিসের গন্ধ বলুন তো? 

--বেলফুল

--কি করে বুঝলেন? 

--আমার এক বান্ধবী ছিল, সে মুখে বেল ফুল বেঁটে মাখতো। 

--শুধুই বান্ধবী? না আরো কিছু? 

--আমি তাকে ভালোবাসতাম লতিকা ।

--তাকে বিয়ে করলেন না কেন? 

--তার নাম ছিল করবী। করবীর বন্ধু ছিল রীনা। রীনা এলে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। 

--করবী এখন কোথায়? 

--আমেরিকায়। 

--যোগাযোগ আছে? 

--আমি রাখি নি যোগাযোগ। 

--আমিও কিন্তু একটা গন্ধ পাচ্ছি। লতিকা বলল। 

--কিসের গন্ধ লতিকা? 

--গোলাপের।

--ঠিক বলেছো। আমি গোলাপ জলে আজ মুখ ধুয়েছি। মাঝে মাঝে ধুই। 

--অনেক বছর পর গন্ধটা পেলাম। কেমন আছে উজান কে জানে? 

--কে উজান? 

--উজান আমাকে ভালোবাসতো। 

--বিয়ে করল না কেন? 

--আমার বাবা রাজি ছিল না। এই ছেলের সংগে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল বাবা। আমার তো মা নেই, তাই কিছু প্রতিবাদ করতে পারি নি। কিন্তু কি পেলাম এই ছেলেকে বিয়ে করে? 

--সবাই সব কিছু পায় না লতিকা। সবার জীবনে কিছু না-পাওয়া থাকে। তাকে ভুলে থাকতে হয়। 









--আমি তো ভুলেই ছিলাম। আজ গন্ধটা মনে করিয়ে দিল। ও যে মাঝে মাঝে গোলাপ জলে মুখ ধুতো। বিশেষ করে যেদিন আমার সংগে দেখা করতে আসতো। 

   পাঞ্জাবী পড়ে নিয়ে সৌম্য বলল—লতিকা তুমি কি একটু চা করে দেবে? তোমার হাতের চা কিন্তু দারুণ। 

--দিচ্ছি ।একটু অপেক্ষা করতে হবে। এগুলো পরিস্কার করে নি। 

--সে ঠিক আছে। তোমার দেরি হয়ে যাবে না তো? 

   সে কথার উত্তর দিল না লতিকা। জানালা দরজা খুলে দিল। আলোয় ভরে গেল ঘর। সৌম্যর চোখে পড়ল লতিকার মুখে ঝুলে আছে এক খন্ড মেঘ। উজানের জন্য বোধ হয়। 

           চার

  শাশুড়ির অবস্থা ভালো নয়। লতিকা শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল। সাতদিন পর ফিয়ে এলো। খোঁজ নিতে সৌম্যর ঘরে এলো। ঘরে ঢুকে অবাক হলো। একজন বয়স্ক বিধবা মহিলা রান্না করছেন। লতিকা বিস্ময় নিয়ে বলল—পূর্নিমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন নাকি? 

--সে তো দেশে গিয়ে আর আসছে না। কতদিন তার অপেক্ষায় বসে থাকি বলো তো? 

--তা উনিই কি এখন থেকে রান্না করবেন? 

--উনি রীনার মাসি। ওনার কেউ নেই। রানাঘাটে একা থাকতেন। রীনা নিয়ে এসেছে। 

--আপনার দেখাশুনা করবে? 


--তা বলতে পারো। 

--ভালো হয়েছে ।এবার আর আপনার অসুবিধা হবে না। শরীর এখন কেমন? 

--সম্পূর্ন ফিট। তোমার শাশুড়ি কেমন আছেন? 

--ভালো না। যাই যাই করছেন। 

--কতো বয়স হলো? 

--আশি পার করে ফেলেছেন। 

--এবার চলে গেলেই ভালো। 

লতিকা কিছু বলল না। 

--লতিকা একটু চা করে দাও না। 







--মাসিমাকে বলুন।আমাকে কেন? লতিকার গলায় একটু ঝাঁঝ। 

--তোমার হাতের চা যে অমৃত। মাসিমা তোমার মতো পারে না। 

--আমি পারবো না। আমার সময় নেই। আমি আসছি। 

--কি হলো লতিকা তোমার? 

--জানি না। দুটো মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সশব্দে দরজা টেনে দিল। একটু সময় পর ওর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হবার দরাম শব্দ হলো। একটু চা করতে বলায় এতো রেগে গেল কেন? 

মাসিমা বলল—কে মেয়েটা? 

সৌম্য শান্ত গলায় বললা—লতিকা।পাশেরফ্ল্যাটের থাকে। এতোদিন ঔ খোঁজ খবর নিতো। বড় ভালো মেয়ে ।

মাসিমা বললেন—সে বুঝলাম। কিন্তু রেগে গেল কেন? বললেই পারতো এখন আমার সময় নেই। পারবো না। এতো ঠেকাম দেখানো কেন বাবা। এতো ভালো লখন নয় ।



 

 

 মাসীমার অত কথা সৌম্যর মাথায় ঢুকলো না। সে বুঝতে পারলো না লতিকার গলায় রাগ না অভিমান ঝড়ে পড়ল। এমন গলায় তো কোনদিন কথা বলে নি। আজ হঠাৎ কি হলো লতিকার? 

        পাঁচ

দুই মেয়ের কেউ এখন ঘরে নেই। মাসি বাড়ি বেড়াতে গেছে। ঝড়ের বেগে সৌম্যর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে টুকলো লতিকা। বিছানায় থম দিয়ে কিছুখন বসল। আবার উঠল। আবার বসল। একটা অস্থিরতা তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। বুকের ভিতর একটা শূন্যতা অনুভব করল। তাহলে আর লতিকাকে দরকার হবে না সৌম্যর? অসুস্থ হলে ওযুধ আনার জন্য তাকে ফোন করবে না সৌম্য? জ্বর হলে মাথা ধুয়ে দিতে হবে না আর।রান্না খাবার আর পাঠাতে হবে না।খোঁজ খবর নেবার কোন প্রয়োজন থাকলো না। মাসিই সব পারবে। ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। তাহলে তার ভিতরটা কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? সৌম্য তার কে হয়? কেউ তো নয়। একজন প্রতিবেশী ছাড়া। তবে কেন তার ভিতরটা একটা গোপন কষ্টে ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পে যেমন ঘর বাড়ি ভেঙে যায়। 

 গলার কাছে কি একটা আটকে আছে। তার কি কান্না পাচ্ছে? কিছু ভালো লাগছে না তার। সারা শরীর 

থর থর করে কাঁপছে। সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল উপুর হয়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তার শরীর ওঠানামা করছে। এদিকে পরেশের আসার সময় হতে চলল। সে খেয়াল নেই তার। অনবরত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তার শরীর উঠছে আর নামছে। কেউ দৈখল না লতিকার মুখের কাছের চাদরটা বেশ ভিজে গেছে। যেমনটা বর্ষার জলে ভিজে যায। 

বোড়়কি - সিদ্ধার্থ সিংহ || Borki - Sidhartha Singha || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 বোড়়কি

সিদ্ধার্থ সিংহ



না। বোড়কিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ছলছল চোখে শিবকুমার এ কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল তার বউ। আর তার কান্না শুনে বইপত্র ফেলে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল তাদের বাকি দুই ছেলেমেয়ে— মেজকি আর ছোটকা। 

কান্না জড়ানো গলাতেই শিবকুমারের বউ বলল, তা হলে ও বোধহয় আবার পালিয়েছে। যাও, থানায় যাও। একবার গিয়ে বলো...


এর আগেও চার-চার বার ও পালিয়েছে। প্রথম বার যখন ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন গ্রাম থেকে অনেক দূরে, কালিন্দী থানায় মিসিং ডায়েরি করার সময় পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, তেরো বছর বয়সেই পালিয়েছে! কার সঙ্গে?

শিবকুমার হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। সেটা দেখে ওই পুলিশটি অফিসারটি বলেছিল, ও তো আর দুধের বাচ্চা নয় যে, কোনও তান্ত্রিক তুলে নিয়ে গিয়ে আর সব বাচ্চাদের মতো ওকেও মায়ের সামনে বলি চড়িয়ে দিয়েছে...

হ্যাঁ, এখানে মাঝে মাঝেই বাচ্চা খোয়া যায়। এবং খুঁজে পাওয়া না গেলে লোকেরা ধরেই নেয়, তাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দিয়েছে। শোনা যায়, বহু বছর আগে ইংরেজ আমলে ছোট, মেজ, বড়, আরও বড় কর্তাকে বারবার অনুরোধ-উপরোধ করা সত্ত্বেও যখন হল না, তখন আশপাশের গ্রামের লোকেরা সবাই এককাট্টা হয়ে বড় রাস্তায় যাওয়ার একমাত্র বাধা, শীর্ণ নদীটার উপরে কাঠের পোল তৈরি করেছিল, সেটা যাতে ভেঙে না পড়ে এবং টেকসই হয়, সে জন্য নাকি ব্রিজ তৈরির আগেই ভাল দিনক্ষণ দেখে খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। সেই খুঁটি পোঁতাকে ঘিরে পুজোআচ্চা, যাগযজ্ঞও হয়েছিল। এবং পূজারির বিধান অনুযায়ীই ধরিত্রী মাকে খুশি করার জন্য নাকি বিভিন্ন জায়গা থেকে তেরোটি বাচ্চাকে চুরি করে এনে রাতের অন্ধকারে বলি দেওয়া হয়েছিল। এখানকার লোকেদের বিশ্বাস, সেই জন্যই নাকি ওই ব্রিজটা এখনও এত শক্তপোক্ত।

তাই আজও অনেকেই বাড়ি তৈরি করার আগে ভিত পুজোর সময় যেমন পুজো করে, সেটা তো করেই, রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে নাকি নরবলিও দেয়। তাই মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায় এক-একটা বাচ্চা। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আশপাশের লোকেরা তাই সদা সতর্ক। কোনও বাচ্চাকেই একা ছাড়ে না। ছাড়লেও চোখে চোখে রাখে। কারণ কোনও বাচ্চাকে চোখের আড়ালে ছাড়াই মানেই নাকি ঘোরতর বিপদ ঘনিয়ে আসা। কিন্তু সে সব বাচ্চাদের বয়স অনেক কম হয়। চার-পাঁচ কিংবা ছয়। বারো-তেরো বছরের বাচ্চাদের সাধারণত কেউ বলি দেওয়ার জন্য নেয় না। ফলে ওই পুলিশ অফিসারটি ভ্রু কুঁচকে শিবকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার কি মনে হয়? ও কার সঙ্গে পালিয়েছে?

শিবকুমার বলেছিল, তা তো জানি না।

— তা হলে যান। গিয়ে খোঁজ করুন আর কে পালিয়েছে...

শিবকুমার বলেছিল, আমি ওর সব ক’টা বন্ধুর বাড়িতেই গিয়েছিলাম। দেখলাম সবাই আছে। শুধু ও-ই নেই। সবাইকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু কেউই বলতে পারল না, ও কোথায় গেছে। ও নাকি কাউকেই কিছু বলে যায়নি।

— তা আবার হয় নাকি? কাউকে কিচ্ছু বলে যায়নি? এ সব ব্যাপারে জানবেন বন্ধুরাই সাঁটে থাকে। আচ্ছা বলুন তো, ও কার কার সঙ্গে মিশত? 

— ও মিশত... ওই তো... বিন্দি, চান্দি, বুড়িয়া... এই তিন জনই তো ওর বন্ধু।

— আরে, আমি তা বলছি না। বলছি, ও কোন ছেলের সঙ্গে মিশত?

— ছেলে! শিবকুমার একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিল।


হ্যাঁ, ওদের গ্রাম থেকে মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়েরা পালায়। এই তো ক’বছর আগেই, সতেরো-আঠারো বছরের দু’-দুটো ছেলে বাবার মুদিখানা দোকান থেকে সব টাকা পয়সা নিয়ে কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই রাতের অন্ধকারে চম্পট দিয়েছিল সুরাটে। অনেক খোঁজখবর করার পরে পুলিশ যখন তাদের তিন মাস পরে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, তারা বলেছিল, আমরা ভাগ্যের সন্ধানে গিয়েছিলাম।

পরে জানা গিয়েছিল, কে নাকি তাদের বলেছিল সুরাটে গেলেই চাকরি পাওয়া যায়। পড়াশোনা কিছু লাগে না। ওরাই শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়। প্রচুর টাকা মাইনে। তাই গরিব বাবা-মায়ের হাতে প্রতি মাসে মাসে কিছু টাকা তুলে দেওয়ার জন্যই নাকি ওরা সুরাটে যাবার জন্য পালিয়েছিল। কিন্তু ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠে পড়ায় ওরা মজফ্ফরপুরে চলে গিয়েছিল। অচেনা-অজানা জায়গায় গিয়ে মহাবিপাকে পড়েছিল। যে ক’টা টাকা ছিল তা দিয়ে চার-পাঁচ দিন কোনও রকমে চলেছিল। কিন্তু তার পরেই দেখা দিয়েছিল বিপদ। কী খাবে, কোথায় থাকবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত একটা ফাস্টফুডের দোকানে কাজে ঢুকেছিল তারা। এঁঠো থালাবাসন মাজা, দূরের টিউবওয়েল থেকে জল তুলে আনা, আনাচ কাটাই শুধু নয়, বাড়ির টুকিটাকি কাজ, মনিবের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসা, বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে আসা থেকে ফাইফরমাস খাটা, কিছুই বাদ যেত না। এমনকী রাত্রিবেলায় যতক্ষণ না মনিব ঘুমিয়ে পড়ত, ততক্ষণ তার হাত-পা টিপে দিতে হত, মাথা ম্যাসাজ করে দিতে হত।

কেবল ছেলেরাই নয়, এই তো কিছু দিন আগে একসঙ্গে দল বেঁধে তেরো-চোদ্দো বছরের চার-চারটে মেয়েও উধাও হয়ে গিয়েছিল। চোখের ঘুম ছুটে গিয়েছিল গোটা গ্রামের। নড়েচড়ে বসেছিল লোকাল থানাও। সে দিনই মধ্যরাতে যখন তাদের রেল স্টেশন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল, তারা বলেছিল, আমরা মুম্বই যাচ্ছিলাম। সিনেমায় নামার জন্য।

শুধু কোনও বন্ধুর সঙ্গে কিংবা দল বেঁধেই নয়, একবার তাদের গ্রামেরই ষোলো বছরের একটি মেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। থানায় মিসিং ডায়েরি করতে গিয়ে তাদের বাড়ির লোকেরা জানতে পেরেছিল, পাশের গ্রামের বছর উনিশের একটি ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই পুলিশ দুয়ে দুয়ে চার করেছিল। এবং তখনই জানা গিয়েছিল, পুলিশের সন্দেহ খুব একটা অমূলক নয়। কারণ, বহু লোকই তখন জানিয়েছিল, ওদের দু’জনকে নাকি প্রায়ই এ দিকে ও দিকে ঘুরতে দেখেছে তারা। কিছু দিন আগে নাকি দু’জনে মিলে সিনেমা দেখতেও গিয়েছিল। অগত্যা সবাই নিঃসন্দেহ হয়েছিল, ওরা দু’জনে পালিয়েছে। কিন্তু অনেক খোঁজ করেও আজ অবধি তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। 

মেয়ের বাড়ির লোকেরা অবশেষে দু’ক্রোশ দূরের নাবিক গ্রামের এক নামকরা বৃদ্ধ গুনিনের কাছে গিয়েছিল। আলো বাতাস-হীন দমবন্ধ হয়ে আসা একরত্তি ঘরে বসে সেই গুনিন নাকি বলেছিল, ওরা আছে। একসঙ্গেই আছে। ভাল আছে। ওদের একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। এই দ্যাখ, বলে, একটা মন্ত্রপূত আয়না বের করে ওদের সামনে ধরেছিল। বলেছিল, সবাই নয়, যে কোনও একজন দ্যাখ। ওদের দেখতে পাবি। ওরা এখন কোথায় আছে। কী করছে। কে দেখবি, তোরা নিজেদের মধ্যে ঠিক কর।

তখন মেয়ের মা বলেছিল, আমি দেখব। আমি।

সেই আয়নায় ছায়া-ছায়া মতো সে নাকি কী একটা দেখেওছিল। স্পষ্ট কিছু দেখা না গেলেও গুনিন যখন বলেছে, ওটা তার মেয়ে, তা হলে নিশ্চয়ই ওটা তার মেয়েই। সে উপরের দিকে তাকিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করে বিড়বিড় করে বলেছিল, ও যেখানেই থাক, ভাল থাক। ওকে ভাল রেখো ঠাকুর। ওকে ভাল রেখো…

ওই মেয়েটা ওই রকমই ছিল। কিন্তু তাদের মেয়ে বোড়কি তো ও রকম নয়। সে তো বাচ্চা। সবে সেভেনে পড়ে। ও কি ও সব বোঝে! তবু কেবল নিজেদের গ্রামেই নয়, আশপাশের সব ক’টা গ্রামে, এমনকী দূর-দূরান্তের স্কুলে গিয়েও শিবকুমার খোঁজ করেছিল, আর কেউ পালিয়েছে কি না...

কিন্তু না। সে রকম কোনও খবর জোগাড় করতে না পাড়ায় ফের থানায় গিয়েছিল সে। এবং থানাও সত্যি সত্যিই খোঁজখবর শুরু করেছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোড়কিকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছিল। ও নাকি রেল স্টেশনের একটা বেঞ্চে একা-একা বসেছিল।

তা হলে কি ওই মেয়েটার মতো ও-ও কারও সঙ্গে ট্রেনে করে পালিয়ে যাওয়ার মতলবে ছিল! তাই প্ল্যাটফর্মে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিল! পুলিশ অফিসারটি অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। পুলিশ চলে যাওয়ার পরে তার বাবা-মাও। কিন্তু ও সেই একই কথা বলে যাচ্ছিল। বললাম তো, আমি ট্রেন দেখতে গিয়েছিলাম…

ওর বাবা অনেক বুঝিয়েছিল। বলেছিল, তুই যে ভরদুপুরে একা একা ঘুরে বেড়াস। তুই কি জানিস, এই দুপুরবেলায় বড় বড় গাছের মগডালে ভূত-পেত্মী-ব্রহ্মদত্যিরা মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্য কী ভাবে ওত পেতে বসে থাকে। একবার পেলে একেবারে ঘাড় মটকে খায়, জানিস না? এই ভাবে কাউকে কিছু না বলে একা-একা কেউ বেরোয়? আর কোনও দিন এই ভাবে কোথাও যাস না, বুঝেছিস? বলেই, ওর বাঁ হাতের বালাটা দেখিয়ে বলেছিল, যদি না যাস, ভাল ভাবে থাকিস, তা হলে গত বার যেমন তোর নাম খোদাই করা রুপোর এই বলাটা বানিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক সেই রকম আর একটা বালা তোকে বানিয়ে দেব…

হ্যাঁ, বোড়কি বায়না করেছিল বলে বিয়েতে পাওয়া বউয়ের রুপোর টিকলি, গলার মোটা হার আর পাশের গ্রামের রথের মেলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাদের পায়ের এক পাটি তোরা ভেঙে গড়িয়ে দিয়েছিল ওটা।

বোড়কি বলেছিল, ওটার মধ্যে আমার নাম লিখে দিয়ো। না হলে, ওটা যদি হারিয়ে যায়, তা হলে তোরা হারানো মেয়েটার মতো আমিও আর ওটা ফেরত পাব না।

ওর বাবা বলেছিল, ঠিক আছে, তাই হবে। স্যাকরাকে বলব, তোর বালার মধ্যে বড় বড় করে ‘বোড়কি’ লিখে দিতে। কী? খুশি তো?

বোড়কি খুশি হয়েছিল। কিন্তু আজ ও রকমই আর একটা বালা গড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও, বোড়কির মুখে কিন্তু সে রকম কোনও খুশির ঝলক দেখতে পেল না শিবকুমার। শুধু ফ্যালফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

দ্বিতীয় বার যখন ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন তার বাবা প্রথমেই গিয়েছিল রেল স্টেশনে। এর আগের বার যেটায় বসেছিল, শুধু সেই বেঞ্চটাতেই নয়, গোটা স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্মে ওই প্ল্যাটফর্মে যতগুলি বেঞ্চ ছিল, সিমেন্টের বাঁধানো বেদি ছিল, সব ক’টা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। কিন্তু না। বোড়কিকে সে পায়নি। অগত্যা কোনও উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত থানায় ছুটে গিয়েছিল।

সে বারও থানার লোকেরাই তার মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। ওকে নাকি একটা পুকুরের পাড়ে তন্ময় হয়ে বসে থাকতে দেখেছিল তারা।

— ওখানে কী করছিলি? জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল, আমি কচুরিপানার ফুল দেখতে গিয়েছিলাম। প্রতিটা পাপড়িতে কী সুন্দর ময়ূরের পেখমের মতো রং। চোখ ফেরানো যায় না...

— কচুরিপানার ফুল দেখতে গিয়েছিলি! তুই কি পাগল? জানিস, কত রকমের লোক ঘুরে বেড়ায়? তারা বাচ্চাদের বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে, অন্ধ করে শহরের রাস্তায় রাস্তায় তাদের দিয়ে ভিক্ষে করায়। তুই কি সেই লোকগুলির খপ্পড়ে পড়তে চাস? তা হলে? অনেক বুঝিয়েছিল শিবকুমার। তবুও...

তৃতীয় বার যখন পালিয়ে গেল, প্রথমেই শিবকুমার গেল সেই পুকুরের পাড়ে। তার পরে রেল স্টেশনে। তার পর ওর বন্ধুদের বাড়িতে। কোথাও না পেয়ে অবশেষে থানায়।

তখনই পুলিশ অফিসারটা তাকে ধমকে বলেছিল, আপনারা কি ইয়ার্কি পেয়েছেন? আমাদের আর কোনও কাজ নেই? আপনাদের মেয়ে রোজ-রোজ পালিয়ে যাবে, আর তাকে খুঁজে খুঁজে আমাদের নিয়ে আসতে হবে? একটা মেয়েকে সামলে রাখতে পারেন না? যান, নিজেরা খুঁজে নিন।

কাঁচুমাচু মুখ করে থানা থেকে বেরিয়ে এলেও পুলিশ অফিসারটি যে ওগুলো শুধু কথার কথা বলেছিলেন, বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আসলে সে থানা থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই মেয়েটিকে খুঁজে বের করার জন্য ফোর্স পাঠিয়েছিলেন, সেটা সন্ধে হওয়ার অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল শিবকুমার।

সে বার স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে বাঁদরখেলা দেখার পরে গ্রামের আরও অনেক বাচ্চাদের মতো সেই বাঁদরওয়ালার পিছু পিছু সেও নাকি গ্রাম ছাড়িয়ে অনেকটা পথ চলে গিয়েছিল। কিছুটা যাবার পরে বাকি বাচ্চারা ফিরে এলেও সে আর ফেরেনি। বাঁদরওয়ালার পিছু পিছু হেঁটেই যাচ্ছিল। সেটা দেখে নাকি বাঁদরওয়ালা বলেছিল, কী রে বেটি, আর কত দূর আসবি? এ বার যা।

বোড়কি নাকি বলেছিল, আমি যাব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব।

বাঁদরওয়ালা নিতে চায়নি। তবুও পিছন ছাড়েনি ও। হাইওয়ের উপরে বাস স্টপেজের ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে আড্ডা মারছিল কয়েকটি স্থানীয় ছেলে। তারা বাঁদরওয়ালার পিছনে পিছনে স্কুলের পোশাক পরা একটা মেয়েকে ওই ভাবে যেতে দেখে ভেবেছিল, বাঁদরওয়ালাটা নিশ্চয়ই ছেলেধরা। মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা বাঁদরওয়ালাটাকে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, এই মেয়েটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

বাঁদরওয়ালা বলেছিল, আমি নেব কেন? ও-ই তো আমার পিছু ছা়ড়ছে না।

ওরা যখন বোড়কিকে জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় থাকিস?

ও সব বলেছিল। গ্রামের নাম। পাড়ার নাম। বাবার নাম। এমনকী স্কুলের নামও।

তখন ওই ছেলেদের মধ্যে থেকেই একজন তার বাইকে করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক খাতে বরাদ্দ টাকায় সদ্য তৈরি হওয়া কালো পিচের চওড়া হাইওয়েটা যতই মসৃণ হোক না কেন, হুসহাস করে ছুটে যাক না কেন দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বাস, মাল-বোঝাই বড় বড় ট্রাক, তার পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া গ্রামে ঢোকার সরু রাস্তাগুলি কিন্তু এখনও যে কে সে-ই। খোয়া বেছানো। গর্ত-গর্ত।

দু’ধারে কোথাও বড় বড়় গাছ, কোথাও আবার ঝোপঝাড়। জঙ্গল জঙ্গল মতো। সেই রাস্তার পাশেই কোথাও হিন্দুপাড়া, কোথাও মুসলমানপাড়া, কোথাও কৈবর্তপাড়া, নাপিতপাড়া, কোথাও আবার ব্রাহ্মণপাড়া।

এক সময় বেশির ভাগ বাড়িই মাটির ছিল। কিন্তু হাইওয়ে হওয়ার আগে থেকেই শুধু রাস্তার ধারের জমিই নয়, ভিতরের, আরও ভিতরের জমির দামও হু হু করে বাড়তে শুরু করেছিল। বাইরে থেকে লোকজন এসে বাড়িঘর করে বসে পড়ছিল। কেউ কেউ দোতলা-তিনতলাও হাঁকাচ্ছিল। আর তারা বাইরে থেকে এলেও, এখানে বাড়ি করার সময় কিন্তু এখানকার চিরাচরিত ধ্যান-ধারনা অনুযায়ীই কেউ কেউ বলিও চড়াতে শুরু করেছিল। 

পিছনে বোড়কিকে বসিয়ে সেই রাস্তা দিয়েই ঝাঁকুনি খেতে খেতে ধুলো উড়িয়ে বাইক নিয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। কিন্তু তাকে আর বোড়কিদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি। মাঝপথেই দেখা হয়ে গিয়েছিল, বোড়কির খোঁজে বেরোনো কালিন্দী থানারই এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ওই পুলিশ অফিসারটিই তার জিপে করে বোড়কিকে শিবকুমারের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, মেয়েকে দেখেশুনে রাখুন। ভাল করে বোঝান। কখন কোন বিপদে পড়ে যাবে, বলা যায়! সব ছেলে তো আর সমান নয়… দরকার হলে ভাল কোনও সায়ক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যান। ও কেন বার বার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে, কাউন্সেলিং করান। এর পরে ও যদি আবার কোথাও চলে যায়, আমাদের কাছে আর আসবেন না। বুঝেছেন?

শিবকুমার বুঝেছিল। মেয়েকেও বুঝিয়েছিল, তুই কি জানিস এখন কত রকমের লোক রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? তারা তোর বয়সি ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে কিডনি, চোখ, হার্ট— সব বের করে বিক্রি করে দেয়। এখনও সময় আছে। সাবধান হ। না হলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবি। আর তোর বিপদ মানে আমাদেরও বিপদ। তুই কি তোর বাবা-মাকে কাঁদাতে চাস, বল?

কিন্তু তার মেয়ে বোঝেনি। পর দিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল। সঙ্গে ছিল তার বোন মেজকি আর ছোট ভাই ছোটকা। ওরা তিন জন একই স্কুলে পড়ে। বোড়কি এ বার ক্লাস নাইনে উঠেছে। মেজকি ক্লাস সিক্সে পড়ে আর ছোটকা থ্রি-তে। বাকি দু’জন ঠিক থাকলেও বোড়কিটাই যেন একটু কেমন কেমন… 

শিবকুমার জোগাড়ের কাজ করে। তার বউ নতুন গজিয়ে ওঠা কয়েকটা বাবুর বাড়িতে। কোথাও সপ্তাহে তিন দিন কাপড়় কাচার কাজ, কোথাও ঘরদোর মোছা-বাসন মাজার কাজ। কোথাও আবার রান্নার কাজ। তাদের কারও কারও বাড়ির মূলত কার্ড এন্ট্রি করার জন্যই রেশন তুলে দেয়। সবার বাড়িতেই গ্যাস আছে। তাই অনেকেই প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে কেরোসিন তোলে না। সেটা সে ধরে। এবং বেশ কিছুটা জমে গেলে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর গড়িয়ে যায়। এসে রান্নাবান্না করে।

সে দিন রান্নাবান্না করার পর হাতের কাজ নিয়ে বসেছিল। কক্ষনো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না সে। গরম যাওয়ার আগেই নানান নকশার সোয়েটার বুনতে শুরু করে। মেয়ের জামায় নানা রঙের সুতো দিয়ে কলকা তুলে দেয়। স্বামীর রুমালে তো বটেই, নিজের রুমালেও চেকনাই সুতো দিয়ে নামের অদ্যাক্ষর লেখে। কারণ রুমালের প্রতি খুব ছোটবেলা থেকেই তার দুর্বলতা। সব সময় কোমরে একটা গোঁজা থাকে। 

বড় মেয়েকে কাঁদতে দেখে সে ভেবেছিল, নিশ্চয়ই বোন বা ভাইয়ের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছে। এক্ষুনি হাতাহাতি লেগে যাবে। তাই হাতের কাজ ফেলে ত়ড়িঘড়ি উঠে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে রে?

বোড়কি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি আর স্কুলে যাব না।

মা বলেছিল, এ আবার কী অলুক্ষুণে কথা! কেন? স্যার মেরেছে?

— না।

— কেউ কিছু বলেছে?

— না।

— তা হলে?

বোড়কি বলেছিল, আমার স্কুলে যেতে ভাল লাগে না। আমি আর স্কুলে যাব না।

— কেন যাবি না, সেটা তো বলবি।

— না। আমি আর স্কুলে যাব না।

ওর মা বলেছিল, তা হলে কি আমার মতো লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করবি? তোর বাবা তোদের জন্য মুখে রক্ত তুলে কাজ করে। আর তুই বলছিস… আসুক তোর বাবা।

ওর বাবা বড় মেয়েকে ভীষণ ভাল বাসে। শত অন্যায় করলেও বকে না। বউ মারতে গেলেও আটকায়। সব সময় বলে, বড়় হোক। সব ঠিক হয়ে যাবে। সে-ই বাবাও বুঝতে পারছে, এই মেয়ে তার বাকি দুই ছেলেমেয়ের মতো নয়। তাই ওকে কাছে ডেকে আদর করে পাশে বসিয়ে বোঝাতে লাগল, এ রকম করতে নেই মা। তুই কেন বারবার পালিয়ে যাস?

বোড়কি বলেছিল, আমার বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না।

— কেন?

কোনও উত্তর না দিয়ে ও চুপ করে ছিল। তাতে আরও মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল শিবকুমারের। তাই গলা চড়়িয়ে ফের জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? কেন? কেন থাকতে ইচ্ছে করে না তোর? 

বোড়কি বলেছিল, জানি না।

— তোর ভাইবোনেরা তো এ রকম নয়। তুই এ রকম করিস কেন?

বাবার কথার উত্তর না দিয়ে, উল্টে ও-ই প্রশ্ন করেছিল, সবাইকে কি একই রকম হতে হবে?

— তুই কি চাস?

— যে দিকে দু’চোখ যায়, আমি সে দিকে যেতে চাই।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে শিবকুমার বলেছিল, এ রকম বললে হয় মা বল? তুই তো মেয়েমানুষ।

— আমি ছেলে মেয়ে বুঝি না। আমার যা মন চায় আমি তাই করব। আর কিছু বলবে? 

মেয়ের বেয়াদব কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল শিবকুমারের। মনে হচ্ছিল ঠাসিয়ে একটা চড় মারে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে কোনও রকমে সামলে নিয়েছিল। সরে গিয়েছিল ওর সামনে থেকে।

না। সে দিন নয়। তার পর দিনও নয়। তার পর দিন ফের বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল বোড়কি। সব জায়গায় খুঁজেছিল শিবকুমার। কিন্তু কোত্থাও পায়নি। বউ বলেছিল, একবার থানায় যাও। ওরা ঠিক আমার মেয়েকে খুঁজে এনে দেবে।

সে বলেছিল, কী করে যাব? এর আগের বার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে উনি কী বলে গিয়েছিলেন তোমার মনে নেই?

— আমার সব মনে আছে। তবু তুমি যাও।

— না। আমি যাব না।

— এই বারই শেষ বার। এর পরে ও গেলেও আমি আর কক্ষনো তোমাকে থানায় যেতে বলব না। যাও।

শিবকুমার গিয়েছিল। সে থানায় ঢুকতেই ওই পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, কী হল? আবার থানায় কেন? আপনাকে বলেছিলাম না, থানায় আসবেন না। মেয়ে হারানো ছাড়া অন্য কিছু বলার থাকলে বলুন…

কোনও কথা নয়। ঝপ করে বসে তার পা জড়িয়ে ধরেছিল শিবকুমার। হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, আরে, ছাড়ুন ছাড়ুন। পা ধরছেন কেন? ঠিক আছে ঠিক আছে, বলুন, কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?

শিবকুমার বলেছিল। এবং অবাক কাণ্ড, সে বারও সন্ধে নামার আগেই… না। মেয়েকে পৌঁছে দেয়নি। থানা থেকে লোক পাঠিয়ে তাকে আর তার বউকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওই পুলিশ অফিসারটি। 

মেয়েকে দেখে শিবকুমারের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। বলেছিল, কোথায় পেলেন ওকে?

পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, আমাদের এক অফিসার গ্রামে টহল দিচ্ছিলেন। উনি হঠাৎ দেখেন, সুনসান রাস্তার ধারে ঢালু জমির নীচে একটি বাচ্চা কী যেন করছে। বাচ্চাটি কে! দেখতে গিয়ে দেখে— ও। 

— কী করছিল?

— উবু হয়ে বসে এক হাত এক হাত করে রাস্তা মাপছিল। 

— রাস্তা মাপছিল? শিবকুমার অবাক।

— তা হলে আর বলছি কী… ও নাকি ওই ভাবে হাত মেপে মেপে দেখতে চেয়েছিল আপনাদের বাড়ির সীমানা থেকে হাইওয়েটা কত হাত দূরে।

— সে কী!

— সে কী, সেটা আপনারাই বুঝুন। বলে, তাদের হাতে বোড়কিকে সঁপে দেওয়ার আগে রীতিমত বেশ কড়া ভাষাতেই ধমকেছিল সে। বলেছিল, একটা মেয়েকে দেখে রাখতে পারেন না? দেখুন তো, শুধু আপনাদের গ্রামেই নয়, আশপাশের কোনও গ্রামে এ রকম আর একটাও মেয়ে আছে কি না। তা হলে আপনাদের মেয়ে এ রকম কেন? 

সে দিন দু’জনেই পুলিশ অফিসারটিকে কথা দিয়েছিল, এ বার থেকে মেয়েকে চোখে চোখে রাখব। ভাল করে বোঝাব। দরকার হলে দুটো বাড়ির কাজ ছেড়ে দেব। মেয়েকে আর পালাতে দেব না।

বাড়ি নিয়ে এসে মা-বাবা দু’জনেই খুব করে বুঝিয়েছিল। বোড়কিকে বলেছিল, তুই যদি এ রকম করিস, তা হলে তোর ভাইবোনেরা তোর কাছ থেকে কী শিখবে বল? তা ছাড়া, তুই বড় হয়েছিস। কোন ছেলে কী রকম তুই জানিস? চারিদিকে কত কী হচ্ছে। যদি সে রকম কোনও বিপদ হয়! তখন? তোকে বিয়ে দিতে পারব? না, আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারব? আমরা গরিব মানুষ মা। এ রকম করিস না।

সে দিন রাত্রে ওর দুই ভাইবোনকে পাশের ঘরে ঘুম পাড়িয়ে বোড়কিকে মাঝখানে শুইয়ে দু’পাশ থেকে দু’জন অনেক বুঝিয়েছিল। বোঝাতে বোঝাতে কখনও কখনও রেগে যাচ্ছিল ওর মা। রাগ সামলাতে না পেরে থেকে-থেকেই মেয়ের উপরে হাত ওঠাতে যাচ্ছিল। আর প্রতি বারের মতোই বউকে বিরত করছিল শিবকুমার। কারণ, আরও দুটো বাচ্চা থাকলেও এই বড় মেয়েটাই ছিল তার প্রাণ।

তবু মেয়েকে আগলে রাখা গেল না। পালিয়ে গেল। না। অনেক খোঁজ করেও তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। ছলছল চোখে শিবকুমার এ কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল তার বউ। আর তার কান্না শুনে বইপত্র ফেলে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে মায়ের কাছ ঘেষে দাঁড়াল তাদের বাকি দুই ছেলেমেয়ে।

ফের কান্না জড়ানো গলায় বউ বলল, যাও না… থানায় গিয়ে একবার বলো না… দরকার হলে হাতে-পায়ে ধরো। আমি যাব?

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেও শিবকুমার নিজেকে কোনও রকমে সামলে নিয়ে এই প্রথম বার একটু কড়া গলাতেই বলল, না।

নিজে তো গেলই না। বউকেও যেতে দিল না।

বিকেল হল। সন্ধে হল। রাত্র হল। না। মেয়ে ফিরল না। সারা রাত স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই খাটের উপর ঠাঁয় বসে রইল। সকাল হল। শিবকুমার কাজে বেরোল না। বউও না। এমনকী তাদের যে আরও দুটো বাচ্চা আছে, সে কথাও যেন তারা বেমালুম ভুলে গেল। ভুলে গেল, নিজেদের জন্য না করলেও ওদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে। রেডি করে স্কুলে পাঠাতে হবে।

ছোটকা এসে মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, মা, দিদি কোথায়?

মেজকি ঘুরে ঘুরে এসেই তার বাবাকে বলতে লাগল, দিদিকে খুঁজতে যাবে না?

কিন্তু কারও কথাই যেন তাদের কানে ঢুকছে না। তারা যেন কেমন পাথর হয়ে গেছে।

সে দিন না। তার পর দিনও না। এমনকী তার পর দিনও তাদের মেয়ে বাড়িতে ফিরল না। চার দিনের দিন এল পুলিশ।


তারা যখন থানায় পৌঁছল, যে তাদের কখনও বসতে বলেনি, বরং দূর দূর করে প্রায় তাড়িয়ে দিত, সেই পুলিশ অফিসারটিই তাদের সঙ্গে অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করল। টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসতে বলল। তার পর জিজ্ঞেস করল, আপনাদের মেয়ে কোথায়?

— পেয়েছেন?

— না। আমি জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের মেয়ে কোথায়?

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।

— কী হল? তাকান আমার দিকে।

ওরা যখন মুখ তুলল, পুলিশ অফিসারটি দেখল, ওদের দু’জনের চোখই ছলছল করছে। তাই একটু থেমে ওদের কাছে জানতে চাইল, কবে পালিয়েছিল?

কাঁদো কাঁদো গলায় বোড়কির মা বলল, আজ চার দিন হয়ে গেল…

— থানায় মিসিং ডায়েরি করেননি কেন?

— আপনি বারণ করেছিলেন, তাই…

ড্রয়ার থেকে এক চিলতে কাপড়ে মো়ড়া একটা পুটুলি বের করে সামনের টেবিলে রেখে কাপড়টা খুলতে খুলতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন কি না…

শিবকুমারের বউ দেখল, যেটা সে তার বিয়েতে পাওয়া রুপোর টিকলি, গলার মোটা হার আর পাশের গ্রামের রথের মেলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাদের পায়ের এক পাটি তোরা ভেঙে নিজের পছন্দ করা ডিজাইনে গড়িয়ে দিয়েছিল, স্যাকরাকে বলে যার মধ্যে বড় বড় করে ‘বোড়কি’ লিখে দিয়েছিল, এটা সেই বালা। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, এটা কোথায় পেলেন?

— আমরা আজ রাস্তার ধারের একটা ঝোপের আড়াল থেকে মুণ্ডুহীন একটা লাশ পেয়েছি। বারো-চোদ্দো বছর বছরের একটা মেয়ের। কিন্তু তার মুণ্ডুটা এখনও পাইনি। তল্লাশি চলছে। শরীরটাও এমন ভাবে ঝলসে গেছে যে, শনাক্ত করা মুশকিল। মনে হচ্ছে, বাচ্চা কাউকে না পেয়ে, একটু বড়় বয়সের মেয়েকেই বলি দেওয়া হয়েছে।

— বলি! আঁতকে উঠল স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই।

— হ্যাঁ, বলি। প্রাথমিক তদন্তে সেটাই মনে হচ্ছে। কারণ, ডেডবডির পাশে বিশাল ব়ড় একটা ফুলের মালাই শুধু নয়, অনেক কুঁচো ফুলও পাওয়া গেছে। আর যারা তাকে বলি দিয়েছে, সে যে কে, সেটা যাতে কেউ চিনতে না পারে, সে জন্যই সম্ভবত তার গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

শিউরে উঠল শিবকুমার। এই ভাবে একটা বাচ্চাকে মেরেছে…

চোখ মুখ কুঁচকে শিবকুমারের বউ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তার সঙ্গে আমার মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার কী সম্পর্ক?

— কারণ, ওই ডেডবডির হাতেই এই বালাটা ছিল…

দু’জনেই থরথর করে কেঁপে উঠল। শিবকুমারের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, মানে?

— চলুন, মর্গে যাই। দেখুন, আইডেনটিফাই করতে পারেন কি না…


উঠেপ়ড়ে লাগল পুলিশ অফিসারটি। যে ভাবেই হোক এর খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে। সে নানান সোর্স মারফত খবর নিতে লাগল, তিন-চার দিনের মধ্যে কারও বাড়িতে কোনও ভিত পুজো হয়েছে কি না… কেউ কোনও মানসিক পুজো দিয়েছে কি না… প্রথমে মনে হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তার আশপাশেরই কোনও বাড়িতে ওকে বলি দেওয়া হয়েছে। কারণ, বলি দেওয়ার পর সেই দেহ বেশি দূর থেকে বয়ে নিয়ে এসে ওখানে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। তা ছাড়া, দূর থেকে নিয়ে এলে বস্তায় ভরে নিয়ে আসতে হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবু চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পুজো হয়েছে, কাছাকাছি এ রকম একটাও বাড়ি যখন পাওয়া গেল না, তখন খোঁজ শুরু হল এলাকার বাইরেও।

তল্লাশি করতে করতে পাওয়া গেল তিনটে বা়ড়ি। প্রথম বাড়িটির কর্তার রোগ কিছুতেই সারছিল না। তাকে রোগমুক্ত করার জন্যই বাড়িতে মহাধুমধাম করে যজ্ঞ করা হয়েছে। এবং সেখানে নাকি বলিও দেওয়া হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে থানায় তুলে নিয়ে আসা হল সেই বাড়ির বড় ছেলেকে। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, বলি দেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে নরবলি নয়, এমনকী ছাগ বলিও নয়, বলি দেওয়া হয়েছে একটা চালকুমরোকে।

দ্বিতীয় বাড়িটাতেও পুজো হয়েছিল। ধুমধাম করেই হয়েছিল। তবে সেখানে নাকি কোনও বলি-টলি দেওয়া হয়নি।

কিন্তু তৃতীয় বাড়িটার লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সেই পুলিশ অফিসারটি। তারা জানিয়েছিল, হ্যাঁ, আমরা বলি দিয়েছিলাম। তবে কোনও প্রাণ নয়, কাম-ক্রোধ-ঈর্ষা-লোভ-ভয়ের প্রতীক হিসেবে মাটি দিয়ে বানানো কয়েকটা পুতুলকে।

ওরা ও কথা বললেও, পুলিশ অফিসারটির কাছে কিছুতেই যখন সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না, তখন আর এক ইনভেস্টিগেশন অফিসার বলল, আচ্ছা, বডির উপরে যে মালাটা পাওয়া গেছে, সেটা কিন্তু সব দোকানে সচরাচর পাওয়া যায় না। অত মোটা গোরের মালা! আমার মনে হয়, অর্ডার দিয়ে বানানো। এখানে তো ফুলের দোকান মাত্র কয়েকটা। হাতে গোনা। একবার খোঁজ করে দেখলে হয় না?

মাথা কাত করেছিল পুলিশ অফিসারটি।

ওরা যখন আলোচনা করছে, তখনই, যেখানে মৃতদেহটি পাওয়া গিয়েছিল, তার আশপাশে কাটা মুণ্ডুর তল্লাশি করতে থাকা তদন্তকারী এক অফিসার রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে পেল একটা লেডিস রুমাল। আর ওটা দেখেই তার সন্দেহ হল, এই খুনের সঙ্গে কোনও মহিলা জড়িত। কোনও মহিলাই তাকে ফুঁসলে নিয়ে এসেছিল। আর সেই মহিলার সঙ্গে ও এসেছিল মানে, ও তাকে খুব ভাল করেই চিনত। সে তার মায়ের কোনও বন্ধু হতে পারে। কোনও আত্মীয়া হতে পারে। আবার তাদের পরিবারের কোনও পরিচিতাও হতে পারে। তবে যে-ই হোক, সে একজন মহিলাই। কারণ, রুমালটা কোনও পুরুষের নয়, মহিলার।

এ ক’দিন আর রান্নাবান্না হয়নি শিবকুমারের বাড়িতে। মুড়ি খেয়েই কাটিয়েছে বাচ্চা দুটো। কিন্তু কত দিন আর ওদের মু়ড়ি খাইয়ে রাখা যায়! তাই চুল্লি ধরিয়ে ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ দেওয়ার জন্য আলু ফালি করছিল শিবকুমারের বউ। মেয়ের মৃতদেহ শনাক্ত করে আসার পর থেকে আর বা়ড়ির বাইরে বেরোয়নি সে। ক’দিন যাবদ বাড়িতেই আছে।

হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজার কাছে এসে দেখে শুধু ওই পুলিশ অফিসারটিই নয়, তার সঙ্গে আরও তিন-চার জন পুলিশ। তার মধ্যে দু’জন মহিলা পুলিশও আছে। গলির মধ্যে পুলিশের ভ্যান ঢুকতে দেখে আশপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকজন। এত জন পুলিশ একসঙ্গে দেখে হকচকিয়ে গেল শিবকুমার। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবু?

— আপনার বউ কোথায়?

— ও তো ভিতরে। রান্না করছে।

ওটা শোনামাত্রই ধুপধাপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল তারা। দু’জন মহিলা পুলিশ রান্নাঘরে ঢুকে শিবকুমারের বউকে বের করে নিয়ে এল।

শিবকুমার আকাশ থেকে পড়়ল। হকচকিয়ে গিয়ে পাগলের মতো বারবার একই প্রশ্ন করে যেতে লাগল, কী হয়েছে বাবু, কী হয়েছে? ও কী করেছে? ওকে ধরছেন কেন?

মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল পুলিশ অফিসারটি। কেন? ও একটা খুনি। বোড়কিকে ও-ই খুন করেছে।

— না বাবু, না। ও খুন করতে পারে না।

পুলিশ অফিসারটি বলল, আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। বোড়কির মৃতদেহের পাশে যে ফুলের মালা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা আপনার বউই কিনে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা ফুলওয়ালার কাছ থেকে জানতে পেরেছি। আর ও-ই যে গিয়েছিল, তার প্রমাণ— ওই মৃতদেহের খুব কাছেই পাওয়া গেছে আপনার বউয়ের একটা রুমাল।

— রুমাল? ওটা যে আমার বউয়েরই, সেটা বুঝলেন কী করে?

— ওটার এক কোনায় ছোট্ট করে লেখা রয়েছে আপনার বউয়ের নামের প্রথম অক্ষর।

— তবু আমি বলছি, ও খুন করেনি। বেশ জোরের সঙ্গেই বলল শিবকুমার।

— ও খুন করেনি?

— না। ও খুন করেনি।

পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, তা হলে কে করেছে? কে?

শিবকুমার খুব ধীর-স্থির হয়ে বলল, আমি।


থানায় এনে জবানবন্দি নেওয়া হল শিবকুমারের। কেন আপনি মেয়েকে মারতে গেলেন? আপনি তো আপনার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওকেই সব থেকে বেশি বাসবাসতেন?

মাথা নামিয়ে ছলছল চোখে শিবকুমার খুব ধীরে ধীরে বলল, ভালবাসতাম দেখেই তো মেরেছি।

— মানে?

— আপনারা তো সবই জানেন, চারিদিকে কী হচ্ছে। এই তো সে দিন একটা মেয়েকে রাস্তার মধ্যে একা পেয়ে কতগুলো ছোকরা তুলে নিয়ে গিয়ে কী করল। তার পর তার রক্তমাখা দেহ পাওয়া গেল কাছেরই একটি নির্মীয়মান বাড়ির ভিতরে। 

তেলেনি পা়ড়ার একটা বা়ড়িতে মা-বাবা না থাকার সুযোগে পা়ড়ারই একজন বাবার বয়সি মানুষ, ঘরে ঢুকে… সে সবাইকে বলে দেবে বলেছিল দেখে, হেঁসো দিয়ে তাকে কোপাতে শুরু করেছিল। তার পর তার চিৎকারে পা়ড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে আসায় তাকে ওই রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেই সে চম্পট দেয়… পাড়ার লোকেরা ধরাধরি করে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরেই তার মৃত্যু হয়।

বুড়ো বটতলার ঘটনাটা তো আরও ভয়াবহ। মায়ের পাশে ঘুমিয়েছিল একরত্তি মেয়েটা। পর দিন সকালে তার বাবা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে, সামনের আমগাছে তার মেয়ের দেহ ঝুলছে। পরনে কিচ্ছু নেই। পরে জানা গিয়েছিল, কারা নাকি রাতের অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে তার মায়ের পাশ থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর… পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে নাকি বলা হয়েছিল, ওকে কয়েক জন মিলে পর পর… ছিঃ… আর তার ফলেই নাকি তার মৃত্যু হয়েছে।

তাই অনেকেই সন্দেহ করেছিল, মরে গেছে বুঝতে পেরেই ওই ছেলেগুলি তার গলায় গামছা বেঁধে ওই ভাবে আমগাছে লটকে দিয়েছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে! সেই ভয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারা খেয়ালই করেনি, তার পা মাটি ছুঁয়ে আছে। যা সহজেই বুঝিয়ে দেয়, ওটা আত্মহত্যা নয়, খুন।

এ সব ওকে বলতে পারিনি। নিজের মেয়েকে কি এ সব বলা যায়! তবু নানা রকম ভাবে ভয় দেখিয়েছিলাম। যাতে ও ভুলভাল খপ্পড়ে না পড়ে। কিন্তু ও শোনেনি।

— কিন্তু ওকে মারলেন কেন? কী হয়েছিল?

— সে দিন ও স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি ওর বইয়ের ব্যাগটা একেবারে ঢাউস হয়ে ফুলে আছে। দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই বেরোবার আগে ও যখন খেতে বসেছিল, তখন চুপিচুপি ওর ব্যাগের চেন খুলে দেখি, তার মধ্যে বেশ কয়েকখানা সালোয়ার-কামিজ । বুঝতে পারলাম, ও আজ পালাবে।

ও বেরোতেই আমিও বেরোলাম। ওর পিছনে পিছনে খানিকটা গেলাম। হঠাৎ ও পিছন ফিরতেই আমাকে দেখে ফেলল। বলল, বাপু, তুমি আমার পিছু পিছু আসছ কেন?

আমি তখন ওকে বললাম, তোর সঙ্গে ক’টা কথা আছে মা। চল, ওই গাছতলায় গিয়ে একটু বসি।

ও বলল, আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।

আমি বললাম, তুই যে স্কুলে যাবি, তোর বইখাতা কোথায়— তোর ব্যাগে তো শুধু ক’খানা সালোয়ার-কামিজ। 

ও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি স্কুলে যাব না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

ও বলল, আমার ভাল লাগে না।

আমি জানতে চাইলাম, তা হলে তোর কী ভাল লাগে?

ও বলল, যে দিকে দু’চোখ যায়, সে দিকে চলে যেতে।

আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, তুই চলে যাবার জন্য বেরিয়েছিস?

ও বলল, হ্যাঁ। একেবারে চলে যাওয়ার জন্য। তোমরা কিন্তু আমাকে আর খুঁজো না।

আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করে বললাম, মা, আমার কথাটা শোন…

ও বলল, না। আমি তোমাদের কারও কোনও কথা শুনব না। আমার ভাল লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাকে আটকিয়ো না।

আমি আবার জানতে চাইলাম, তা হলে তুই ঠিকই করে নিয়েছিস, চলে যাবি?

ও বলল, হ্যাঁ, চলে যাব। চিরদিনের জন্য চলে যাব।

আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল এই বয়সি মেয়েদের উপরে ঘটতে থাকা একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। ভাবলাম, মরার যখন জন্যই বেরোচ্ছে, তখন মরুক। আমি ওকে বললাম, যা। যাবিই যখন, যা। চিরদিনের জন্যই যা।

ও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল, যাব?

আমি বললাম, হ্যাঁ। যা। একেবারে যা। বলেই, আমার মধ্যে হঠাৎ কী হল বুঝতে পারলাম না, ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ওর গলা টিপে ধরলাম।

তদন্তকারি অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, গলা টিপে? তা হলে ওর ধ়ড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করল কে? 

— আমিই।

— কখন?

— মারার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি কী করে ফেলেছি। কিন্তু তখন আর কোনও উপায় নেই। নিজেকে পুলিশের হাতে সঁপে দিতেই পারতাম। কিন্তু দিলে, আমার সংসারটা ভেসে যাবে। আমার আরও ছোট ছোট দুটো বাচ্চা আছে। তারা না খেতে পেয়েই মরে যাবে। তাই নিজেকে কোনও রকমে সামলে ঝোপের আড়ালে ওর দেহটা লুকিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে এলাম। বউকে সব বললাম। ও সব শুনে হাউহাউ করে কাঁদল। তার পর ও-ই বলল, পুলিশে ধরা পড়লে মুশকিল হবে। এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে তুমি ধরা না পরো। আমাদের কিন্তু আরও দুটো বাচ্চা আছে।

সে দিনই ঠিক করি, ধড় থেকে ওর মুণ্ডুটা কেটে ফেলব। যাতে লোকেরা ভাবে, আরও অনেক বাচ্চাদের মতো ওকেও কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দিয়েছে। 

— মুণ্ডুটা আপনিই কাটলেন?

— হ্যাঁ। রাত্রিবেলায় ও দিকে খুব একটা কেউ যায় না। তাই রাতের অন্ধকারে আমিই কাটারি দিয়ে এক কোপে ওর দেহ থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলি।

— তা হলে মু্ণ্ডুটা কোথায়?

— ওর মুণ্ডু কাটার পর সেই মুণ্ডুটা খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে একটা গর্ত করে তার মধ্যে আমি পুঁতে দিই।

— তা হলে ওর শরীরটা পোড়াল কে? 

— ওর মা। মেয়েকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য ওর মা-ই দুপুরবেলায় অর্ডার দিয়ে ওই মালাটা বানিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ওটা দিতে গিয়ে দেখে, মেয়ের দেহটা অনেকখানি ফুলে গেছে। কতগুলো পোকামাকড় ওকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। ও সেটা সহ্য করতে পারেনি। তাই বেশি দামে বিক্রি করার জন্য তিল তিল করে জমানো দশ লিটারেরও বেশি কেরোসিন ভর্তি জারিকেনটা নিয়ে ও হাঁটা দিয়েছিল। মেয়ের গায়ে পুরোটা ঢেলে দিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে কোনও রকমে ছুটে পালিয়ে এসেছিল।

— ও… তা হলে পালাবার সময়ই বোধহয় ওর রুমালটা পড়ে গিয়েছিল, না?

— হতে পারে। কারণ, ওর শরীরে আগুন লাগানোর সময় শক্ত থাকলেও তার পরেই ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এসেই, আমার বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ও ভীষণ কেঁদেছিল। মাঝে মাঝেই আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ মুছছিল। ওর হাতে তখন কোনও রুমাল দেখিনি…

— প্রথমে যখন জেরা করেছিলাম, তখন এগুলো বলেননি কেন?

— বলিনি, কারণ, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না এটা ঘটেছে। এবং আমিই সেটা ঘটিয়েছি। তাই ওই ঘটনাটা আমরা দু’জনেই আমাদের জীবন থেকে একদম মুছে ফেলেছিলাম। এতটাই নিখুঁত ভাবে মুছেছিলাম যে, আমাদের মাথা থেকেই ওটা উবে গিয়েছিল। তাই ওই ঘটনা ঘটার পর দিনই, ও পালিয়ে গেছে মনে করে অন্যান্য বারের মতো ওকে খুঁজতে পর্যন্ত বেরিয়েছিলাম। এবং তার পরও, প্রতিদিনই, আজ এখানে কাল সেখানে ওকে খুঁজতে বেরোতাম। আর প্রত্যেক বারই বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম, মেয়ের জন্য তার মা দরজার সামনে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।

আমাকে আসতে দেখলেই ও ছুটে এসে জিজ্ঞেস করত, ও কোথায়?

আমি ছলছল চোখে বলতাম, না। বোড়কিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। 

কেন জানি না, আমার বারবারই মনে হত, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। যে কোনও সময় ভেঙে যাবে। ঘুম থেকে উঠে দেখব, বোড়কি ছুটতে ছুটতে আমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে… ওই তো বোড়কি… ওই তো… ওই তো ছুটতে ছুটতে আসছে… ওই তো…

শিবকুমার যখন জবানবন্দি দিচ্ছে, ওর বউ তখন ভাঙা রেকর্ডের মতো একটাই কথা বার বার বলে যাচ্ছে, সব দোষ আমার… সব দোষ আমার… সব দোষ আমার…


বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা - শাশ্বত বোস || Baishali parar protimara - Saswata Bose || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা

      শাশ্বত বোস



মফস্বলের ঝিম ধরা বিকেলের চলন্তিকা রোদ, প্রিজম তর্জনীর বর্ণালী ছাড়িয়ে, রাহুরেখা বেয়ে তির্যক ভাবে আলো আঁধারির মায়াজাল বুনেছে পাড়াটায়| আদুর গায়ের ছায়া শরীর আর গলনাঙ্কে ফুটতে চাওয়া তেঁতুল বিচির আঠার রং, যেন কুলহারী বেদব্যাসের স্বমেহ পিন্ডদানের আবহে, খড় –মাটি-রোদ-বৃষ্টির গল্প বলে চলেছে নিরন্তর| গলিটার গা বেয়ে তখন উদলা কাঠামো, নিটোল স্তন আর উর্বীমুখি নিতম্বের সারি| এটা স্থানীয় “কুমোরপাড়া”| আশেপাশের প্রায় তিন চারটে ছোটোখাটো শহরের মাঝে, প্রান্তিক, ক্লেদাক্ত, কস্তুরীয়, ম্রিয়মান প্লবতার নামাবলী গায়ে জড়িয়ে, রক্তাভ ঈশানে, এখানে এক শ্রেণীর মনুষ্যসম জীব, খড়কুটো দিয়ে কাঠামো বাঁধে, সেই বৈরী নগ্নতার গায়ে মাটি চাপায়, বানায় “প্রতিমা”| শাড়ি-গহনা-ডাকের সাজের আড়ালে, নিজের শিল্পসত্তার ফ্যালাসিকে কবর দিয়ে, মূর্তি বিক্রির মৈত্রী চুক্তিতে সায় দিয়ে, দূরে দাঁড়িয়ে যন্ত্রনার সুরহারীর ছেঁড়া তারে, আগমনীর সুর তোলে, আর অনাড়ম্বর সম্যক দৃষ্টির স্থিতিস্থাপকতায় অনুভব করে, সেই প্রতিমার পৃথু দেহজুড়ে লেপন হতে চলেছে, নির্জিত প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনশ্বর অসিয়তনামা| আমাদের গল্পটা শুরু হয় এই পাড়াটারই কোনো এক মৃৎশিল্পীর গোলা থেকে| অশীতিপর ভূতবৈরল্য আকাশের শরীরের উপর দাঁড়িয়ে, স্বয়ম্বরী সন্তাপের মেটাফিজিক্যাল অঙ্ক কষে, ঠাকুর বানায় “মধু কুমোর”, প্রতিমার মুখ গড়ে, চোখ আঁকে নিজে হাতে| হতে পারে সেটা আগত আশ্বিনের আগের বর্ষার কোনো এক সর্বাশী বিকেল কিংবা ওই একই দিনের শুরুর বিবসন ভোরের কাল| সময়ের তফাৎ খোঁজা নিরর্থক| কারণ কাহিনীটার শুরু কিংবা শেষ, আবাহন কিংবা বিসর্জন, যাবতীয় গল্পগুলো সবই আবহমান|

“এবারে ওই দাঁবাল পার্টি এখনও এলুনি, মধুদা? বরাত দেবেনি এইবার?” একতাল এঁটেল মাটিকে দুহাতে চটকাতে চটকাতে, নিজের বুনো চট ধরা চুলগুলোকে চোখের উপর থেকে সরিয়ে প্রশ্ন করে “হাঁদুল”|

মধু কুমোর কথাগুলোয় বিশেষ আমল করে না| তাঁর ধ্রুপদী হাত তখন অস্তিত্ব-শুণ্যবাদের পদাবলী রচনায় ব্যস্ত পিশাচসজ্জার এই ঈশ্বরনগরীতে|

আগের কথার উত্তর না পেয়ে হাঁদুল আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে, “ও পাড়ার মাটি কবে লিবে বলবেক, আগে থেকে| আমি একবারেই যাবক, সবাইলে লিয়ে এসে দিবোক|” 

মধু হালকা সুরেলা গলায় ফিনফিনে পর্দায় উত্তর দেয় এবার, “লাগিবে নি|"

কথাটা শুনে চমকে ওঠে হেঁদো, “লাগিবে নি কি গো?” 

মধু কুমোর আবার হাতের ছাঁচগুলোতে মাটি মাখাতে ব্যস্ত| সবে ঠাকুরের খড় বাঁধা হয়েছে এবার| অন্যবার এতদিনে একমেটে হয়ে যায়| এবার বয়সের প্যাঁচটা বেশ একটু বাগিয়েই ধরেছে তাকে| 

মুখ তুলে, ঘাড়খানা বামেতর বেঁকিয়ে, হাঁদুল মধুর দিকে ফিরে, ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে, “লাগবেনি কি গো? ভীমরতি ধরসে নাকি? ছিষ্টি ছাড়া হইলা নাকি বুড়ো!”| মধু কথাটা শুনে ঋষভ ভঙ্গিতে তাকায় হেঁদোর দিকে| তার অমিত্রাক্ষর চোখ দুটো, নির্বাক শূণ্যতায় তাকায় হেঁদোর খোলা পিঠে| সেই নিস্পলক দৃষ্টির দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে না থেকে, হেঁদো আবার নিজের কাজ করতে থাকে| রিক্ত, বস্তুবাদী বিরক্তিতে এবার সে বলে ওঠে “তোমায় যে কয়েছিলাম, আমার মজুরী বাড়াইতে, কি হইলো?” এই পহায় আমি আর কাজ করবুনি, পত্যেকে বাড়ায়েছে একেনে|” 

প্রতিমা তৈরীর কাজে এক বিশেষ শ্রেণীর জোগাড়ের লোকের দরকার হয়, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই| গঙ্গা থেকে কাঠামো তুলে আনে, স্থানীয় হিন্দুস্তানী পট্টির ছেলেপুলেরা| সেই অস্থিসার কশেরুকার উপর, মাটির প্রলেপ মাখানো চলে| একমেটের জন্য ক্ষেতের আঠালো এঁটেল মাটির জোগান দেওয়া থেকে শুরু করে, সেই মাটি তুশ দিয়ে মেখে, মৃৎশিল্পীর হাতের কাছে ধরা কিংবা এঁটেল আর বালি মাটি মিশিয়ে মুখের ছাঁচে ফেলে, মুখ বানিয়ে দেওয়া, দোঁমেটের জন্য গঙ্গা থেকে বালি মাটি তুলে আনা, দোমেটের পর প্রতিমার গা ফাটলে, এঁটেল মাটিকে জল দিয়ে গলিয়ে পাতলা করে, ন্যাকড়া দিয়ে সেই ফাটলের গায়ে মেরে দেওয়া, এঁটেল মাটিতে মেশানোর জন্য দা দিয়ে পাট কুচিয়ে দেওয়া, এসবই এপাড়ায় বেশ অনেকবছর ধরে একসাথে বেশ কিছু গোলায়, অনুমেয় গুলজারী ধারায় করে আসছে এই হাঁদুল| এই করেই ওর পেট চলে| সারা বছর এই কুমোরপট্টির বিভিন্ন ঘরে, ওর দিন কাটে| কাজের পরিবর্তে মজুরী আর দুবেলা খাওয়া, এই হল ওর রোজনামচার ঋণাত্মক সোপান| রাতে মধুর সাথে সস্তার মদ আর নিকোটিনে চুবোনো নির্কষ সন্তুষ্টি, কাব্যিক গূঢ়তার দিগম্বরী স্পর্ধায় হাঁদুল ভাবতে শুরু করে, সেও “শিল্পী”|  

এই গলিটার শেষে, যেখানে অন্ধকার চুঁইয়ে নামছে, পোড়ো বাড়ির গায়ের, নোনা ধরা দেওয়ালের খসে পরা পলেস্তারার মতো, সেইখানটাতে শর্বরীর শরীর হাতড়ে পাওয়া যায়, কিছু নির্বস্ত্র শরীর| অবাধ পৃথু দেহ জুড়ে যেন তন্দ্রাতুর অশ্লীলতার ছাপ, চোখগুলো জুড়ে অমোঘ নেশা, আর কিছু সবুজ হলুদ শাড়ি-চুমকি-অভ্র| এই গলিতে ভদ্র লোক যায় না| শুধু এই রাস্তার শেষে কসাইয়ের দোকান, আর সেই দোকানের মতো এই গলিতেও দরজায় দরজায় মাংস বিক্রি হয় অবাধে| খদ্দের এসে হাত বাড়ায় বুক, পেটে, ঠোঁটে| দরদাম করে সবশেষে কিনে নিয়ে চলে যায়, এ ঘর থেকে ও ঘরে| পুরো খুললে পাঁচশো, আঁচল সরালে তিনশো, ঘন্টা প্রতি হরেক রকম রেট চলে এখানে| বলার অপেক্ষা রাখে না এটাই “বেশ্যা পাড়া”| পাশাপাশি দুটো পাড়া জুড়ে প্রতিমা আর পতিতা দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি| পাড়ার মোড়ের কালীমন্দিরটায়, অম্বুবাচিতে প্রতিমার মুখ ঢাকা হয়| পোয়াতি বর্ষার অবাধ ধারায় বেশ্যারাও রজঃস্বলা হয়| ভয়, লজ্জা আর প্রার্থনার ঐতিহাসিক সন্ত্রাস চলে এই কদিন| হেঁদো ও এই বেশ্যা পট্টির ফসল, তবু সেই প্রেষিত, কলুষ, ইমারতি জন্মস্রাবের স্মৃতিকে, নিজের একমাত্র পরিচয় না করে, বেশ্যা পাড়ার দালাল বৃত্তি ছেড়ে এই কুমোর পাড়ায় জোগাড়ের কাজ নিয়েছে হেঁদো| এই জন্যই হয়তো বৈবস্বত নগরে বোকা দের অনিবার্য্য জন্ম হয়, বুদ্ধি মত্তার ক্লীবতার স্বার্থে|

তবু হেঁদো দিনে একবার ছুতোনাতায় ঘুরে আসে ও পাড়া থেকে| পুরোনো আধভাঙা সব বাড়ি, অশুচি দেওয়াল ,বায়ুভুক উঠোন, যেন সারা শরীরে সেপ্টিসেমিক রক্ত আর কামব্যবসার ভেজা শীৎকারে ডুবে যাওয়া, অন্তঃসত্ত্বা অঘোরকামিনীর অনুসর্গ টেনে বাঁচতে চাওয়া, প্রসেনিয়ামের সজল এপিটোম| কোনটা একতলা, ব্রাত্যজনের দরজা ঠেলে, এঁটো উঠোনের আঁশটে গন্ধটা গায়ে মেখে, হয়তো বাঁ পাশে একটা লম্বচ্ছেদী সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়| ক্রাফ্টেড মেঘের গা থেকে চুঁইয়ে পরা নিমমাজনের এঁটো থুতুর মতো, মরা উপন্যাসিকের নালবেষ্টিত ঘরগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মৃত প্রিয়ম্বদার এরোটিক যৌনতার মহাকাব্য হয়ে| ঘরের এককোণে একটা তক্তপোষ, আরেক কোণে হয়ত একটা জল খাবার কুঁজো, সাথে উপুড় করা গ্লাস| ঘরের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে, পর্দা ঢাকা ঠাকুরের ছবি যেন লিপি ধর্মঘট টানে, পতিতার রোমান্টিক শ্রাবণী সঙ্গমে| এই ঘরেরই আরেক কোণে, নীরব চারুকলার সাক্ষী হয়ে ঝুলতে থাকা একটা মাদুর, পরকীয়ার তত্ত্ব বোনে| তার ঠিক পাশটাতেই, মেঝেতে ইট দিয়ে ঘেরা ছোট একটা জায়গার ভেতর, একটা নর্দমা, পাশে মগ আর বালতি| ওটাই গণিকার সঙ্গমের পর যোনিপথ সাফ করার জায়গা| বাড়িগুলোর সামনে মহাকাব্যিক দরজা কিংবা রোয়াকে শোভা পায় অপর্ণা, অর্চিতা, মৌসুমী, শোভনার দল| এইরকমই কোনো এক ঘরে জন্মেছিলো হেঁদো| আবঝা আবঝা এখনো মনে পড়ে তার| ঘরে লোক ঢুকিয়ে ওর মা ওকে বাইরে বার করে দিতো| ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ও শুনতে পেত মায়ের গোঙানি আর খদ্দেরের অবিরাম খিস্তিখেউড়| এক এক দিন অনেক রাতে ওকে কাছে টেনে নিতো ওর মা| আধো ঘুমের মাঝেও ও টের পেত ওর মায়ের নিঃশব্দ কান্নার উপস্থিতি| আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা পরিশ্রমী ঘাম, অভিশাপের চুমু ছুঁড়ে দিতো ওর কপালে| সময়ের স্রোতে বদ্ধ ডাস্টবিনে জমা প্লাস্টিক আর আবর্জনার মতো পচতে থাকে সে সব, হেঁদোর অন্তরালে| একদিন বাইরে থেকে খেলে ফিরে, হেঁদো দেখলো ওদের ঘরের সামনে অনেক ভিড়| ছোট্ট দু হাতে একে ওকে সরিয়ে, ঘরের ভেতর বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে, একটা সজোরে ঝটকা খেল হেঁদো| বিশাল চর্বির একটা থলি যেন ওকে চেপে ধরল সজোরে| গদার মতো দুটো হাত দিয়ে ওর ছোট্ট শরীরটা, নিজের পৃথুলা শরীরে চেপে ধরেছিলো “নমীমাসি”| হেঁদোর মা টা মরে গেলো, কোন কাস্টমার নাকি কাজ করার সময় বেশি চড়ে গিয়ে, গলা টিপে মেরে ফেলেছিলো ওর মাকে| তারপর থেকে নমীমাসির কাছেই থাকতো হেঁদো, পাড়ার মেয়েদের ফাইফরমাশ খাটতো| মাঝে মাঝে মাঝরাতে জোরালো হাসি কিংবা কান্নার শব্দে, ঘুম ভেঙে যেত ওর| তখন দেখতো ষণ্ডামার্কা একটা লোক, খদ্দের নিয়ে এসে ঢোকাচ্ছে অন্য মেয়েদের ঘরে| আগে এই লোকটাকে ও দেখেছিলো, ওর মায়ের ঘরে লোক নিয়ে আসতে| লোকটাকে আড়ালে খুব ভয় পেত হেঁদো| ওকে দেখলেই লোকটা যেন আরো ষণ্ডাপনা দেখাতো, চোখ পাকিয়ে তেড়ে আসতো মাঝে মাঝে,মারধরও করতো| একদিন আর থাকতে না পেরে, একটা আধলা তুলে লোকটাকে ছুঁড়ে মেরেছিল হেঁদো| পাশের ঘরের বিন্নি, হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে| মাথায় হাত বুলিয়ে, পাইরিয়ার ক্ষত চিহ্ন শোভিত দাঁত গুলোয় অষ্টকি হাসি তুলে বলে, "অমন করে না মানা, ওটা কে জানিস? তোর বাপ্"| তারপর থেকে একটা মনোক্রমী ভয়, মাথা থেকে নেমে, চোখ, নাক পেঁচিয়ে গলা টিপতে আসতো হেঁদোর| দেহজ পাপ, শুকিয়ে আসা আসঞ্জক আর ক্রমে বন্ধ হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শ্রেণীবদ্ধ বিন্যাসে এক ঋণাত্মক উপলব্ধি জাগছিল তার ভেতর, এই অপার বিশ্বে সে অবাঞ্ছিত, তাঁকে কেউ চায় না| একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও, আর ফেরেনি, গিয়ে জুটেছিল এ পাড়ার “মধু কুমোরে” র কাছে| বৌ, ছেলে মেয়ে নিয়ে মধুর তখন ভরা সংসার| সরকার থেকে পুরস্কারও জুটেছে তার শিল্পকর্মের জন্য| বড় বড় খবরের কাগজের লোক, তখন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে "মধুসূদন পাল শিল্পালয়" এর সামনে|

“মধু খুড়োটার কিছু ভীমরতি হইছেক, দুগ্গা ঠাকুর গড়তে মাগীবাড়ির মাটি লাগব নি?”, জৈবিকতার শ্রাবণী মেঘের জংঘা বেয়ে নেমে আসা, একটা ধ্রুপদী নৈরাশ্য গ্রাস করে হেঁদোকে| তবে বছর কয়েক আগে, নিজের স্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর থেকে, সত্যিই বদলে গিয়েছে মধু| জীবনের সব উচ্ছাস কেড়ে নিয়েছে, পৈশাচিক সন্তাপের দহন| সে এখন কাঁপা কাঁপা হাতে ঠাকুর গড়ে না, যেন দার্শনিক অঙ্ক কষে লিখে রাখে দপ্তরী ঔপন্যাসিকার শেষটুকু| ছেলেটাকে আর্ট কলেজে পড়িয়েছিলো, অল্প বয়সে বাপের মদের নেশা গিলে খেয়েছে ছেলেটাকেও| সে এখন দুগ্গার বাঁ পাশে লক্ষ্মী আর ডান পাশে সরস্বতী গড়ে, পৃথিবীর অভিকর্ষকে অগ্রাহ্য করতে চায়| সত্যি পাগলামো আর খামখেয়ালিপনা এদের রক্তে| 

তবু আজও, এই মাঝ বয়সে পৌঁছেও দিনে একবার না একবার ও পাড়া থেকে ঘুরে আসে হেঁদো| বয়ঃসন্ধির কোনো এক নান্দনিক বিকেলের, অস্থির মেঘের তছরূপী ছায়াপথ বেয়ে, প্রেম এসেছিলো ওর জীবনে| যদিও এ পাড়ায় প্রেম আসে না, খোলা পথে আসতে গিয়ে, কুলোটা দময়ন্তীদের লাল ব্লাউজের ফাঁকে খাঁড়া আপিনে অদুগ্ধতার আশ্লেষে ধাক্কা খেয়ে পালিয়ে যায় চোরাপথে| তবুও হেঁদোর এই মাধুর্য্যহীন, অমানুষের জীবনে, ভালো লাগা এসেছিলো, এই বেবশ্যা পাড়াতেই, নিয়মমাফিক দেহস্রাবের বীর্যে পোয়াতি হওয়া, শুঁয়োপোকার মতো|    

কদিন ধরেই হেঁদো এ পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছে, চার নম্বর বাড়ির দরজার সামনে একটা ফর্সা পানা নতুন মেয়ে, গায়ে ব্লাউজ আর সেমিজ চড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে| কিন্তু মেয়েটা আর চার পাঁচটা মেয়ের চাইতে কোথায় যেন আলাদা| ঋতিচূর্ণতার ত্রাসে নত সূর্য্যাস্তের মতো অসম্ভব শান্ত দুটো চোখ, এক ঢাল আলু থালু চুল, তাতে রঙিন ফিতে দেয় না, কিন্তু চুলে একটা অদ্ভুত জেল্লা আছে| মেয়েটার মুখটা কি অসম্ভব মায়াময়| এ মুখ হেঁদো আগে কোথাও দেখেছে, হয়তো মধুর গড়া লক্ষ্মীঠাকুরের মতনই মুখের গড়ন| তাই মেয়েটাকে হেঁদোর এতো চেনা লাগে| মেয়েটা একএকদিন এক এক রঙের ব্লাউজ আর সেমিজ পরে| এখনকার মেয়েগুলোর মত জিন্স আর টপ ও পরে না, আবার নিজে থেকে কাউকে ডাকেও না| রাস্তা দিয়ে লোক গেলে "এই যে হিরো শোনো, যাবে?” বলে সিটি মারে না| এমনকি পড়তি গতরের মাগীদের মত হাত ধরে টানাটানিও করে না, চুল্লুর পাউচটা কেটে মুখে পুরে, দরজার সামনের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে সিগারেটে অঙ্গার আত্তীকরণের ধোঁয়া তুলে, জটলাও করে না| খদ্দের এসে সামনে দাঁড়ালে, চুপচাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে| হাতে করে টাকাটা এনে মাসির হাতে দিয়ে দেয়| পাড়াটাকে ভালো করেই চেনে হেঁদো, এই বাড়িটাতেই ওরা থাকতো| এদিকটা এখন অনেক বদলে গেছে, পুরোনো অনেক লাইন বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটও উঠেছে| এলাকায় যারা পোড় খাওয়া ক্রিমিনাল, পলিটিকাল লিডারদের ডান হাত, বাঁ হাত, বেনামে তারা ফ্ল্যাটগুলোকে কিনে ধান্দা চালাচ্ছে| তবু এই দরজাটা হেঁদোর ভীষণ চেনা, এই জায়গাটাতেই ওর মা দাঁড়াতো| হাঁ করে মেয়েটাকে দেখতে থাকে হেঁদো| এ দৃষ্টিতে কামরসের দেহি উপসর্গ নেই, বরং মেয়েটির এই অমলিন সুন্দর দেহাবয়ব, এই বৃষ্টিমেদুর অন্ধকারে, প্লেটোনিক উষ্ণতায়, হেঁদোর শরীরে এঁকে দিতে চায় সমাবেশী মনন-শূলানির পদাবলী| মেয়েটাও নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হেঁদোকে| হঠাৎ বাঁ পাশে একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় হেঁদো, সাথে হাতের চুরির ঠুনঠুন শব্দ শুনতে পায়| চোখ ফিরিয়ে সে দেখে, নধর শরীর দুলিয়ে, সারা গায়ে মূর্ছনার হিল্লোল তুলে, হেঁটে যায় পাড়ার ঝুম্পা বৌদি| ভদ্র কাপড়ের আঁচলটা আলতো করে গুটিয়ে কাঁধে জড়ো করা| ঠোঁটের কামিনীঘন কামুক লাল রং, চোখের উরোগামী উনুন আঁচ আর সুডৌল আপিনের সমকোণের আবেদন, হেঁদোর শরীর অববাহিকায় ঢেউ তোলে, ওর মনে অজ্ঞেয় কাম জাগে|


মিসেস দুলারী ব্যানার্জী, আসলে দুলারী পাসোয়ান, এ পাড়ায় সবাই চেনে ঝুম্পা বৌদি নামে| সেই কোন কালে বিহারি জুট মিলের লেবারের ঘর ছেড়ে, মেয়ে কোলে করে, জুটমিলেরই কেরানী “নিমুবাবু”র হাত ধরে, এ পাড়ার কোণের ঘরটাতে এসে উঠেছিল| তাঁর স্বামী পালিয়েছিলো এক ছিনালের সাথে| মরদবিহীন যুবতী শরীর, সাথে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের অভাব, সব থেকে বেশি দুলারীর উঠতি যৌবনের অতলস্পর্শী কস্তুরী, উন্নিদ্র পৃথিবীর যে কোনো পিপাসী পুরুষমন, হয়তো নিমেষে এই নষ্ট শরীরী গুহ্যতায় মজে যেতে বাধ্য|

বিগত যৌবনা বারবনিতার মতো পাংশু, পলেস্তরা খসা, লাইনবাড়িগুলোর কোণের একটা ঘরে, মা মেয়েতে থাকতো দুলারী| জুটমিল বন্ধ হওয়াতে নিমু বাবু, বাইরে সেলস এর চাকরি নিলেন| প্রথম দিকে, ন মাসে-ছ মাসে বাড়ি এলেও, ইদানিং এ বাড়িতে তাকে আর কেউ দেখতে পায় না| যদিও মাসের মাঝখানে, অনলাইনে দুলারীর একাউন্ট এ টাকা এসে যায় ঠিকই| হয়তো বা সে মৃত মাছের, আঁশ না ছাড়ানো, চৈতন্যবাদী টগরবোষ্টমী আর অক্ষৌহিনী নীল শৃগালের, কোমল স্বরযন্ত্রের সান্দ্র মেদুরতায় বোনা, নির্মোক এক প্রায়শ্চিত্তের আখ্যান| দুলারীর মেয়ে “পিউ”, ভালো নাম “অস্মিতা ব্যানার্জী”| নিমুবাবুর পদবীটাই মেয়ের স্কুল কলেজে ব্যবহার করেছে দুলারী, নরম তরুনাস্থি কিংবা অস্থিসন্ধি আড়াল করার জন্য, সাদা চামড়ার একটা পিতৃপরিচয় এর লোভে| বয়সের নরম সমানুপাত বেয়ে, যৌবন খেলা শুরু করেছে পিউ এর শরীর জুড়ে, ঠিক যেন যৌবনের দুলারী| অস্থিসার সেই লাইনবাড়ির, অর্ধেকের বেশিটাই আজ আর নেই, ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে| ছোট খুপরির মতো নিরক্ষীয় প্রকোষ্ঠগুলোর অধিকাংশটাই, বেনামে কিনে নিয়েছে পলিটিক্যাল পার্টির লিডার কিংবা তাঁদের চেলাচামুন্ডারা| সেগুলোতে এখন দিনে রাতে, দিব্যি শরীর ব্যবসা চলে| একটা ফ্ল্যাট ঝুম্পারাও পেয়েছে| সবটাই অবশ্য লোকাল M.L.A “টেঁপা দা” আর তার রাইট হ্যান্ড “মদনা”র কল্যাণে| ঝুম্পা বৌদিতে মজে না, এমন মরদ এখনও জন্মায়নি এই দেবীপুরে| পিউ এর এখন ক্লাস টুয়েলভ, কমার্স নিয়ে পড়ছে এখানকার মালতী হাইস্কুলে| সকাল বিকেল শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়ার পথে, তার শরীরটা হাঁ করে গেলে মোড়ের মাথার মদনারা| পিউ এর সেটা বেশ লাগে, সাধ হয় কিশোরী দেহের খোলস ছেড়ে আদিম, অসভ্য এক নারী হতে| মদনা দা যদি হাতটা ধরে, একবার ওর বাইকে তুলে নেয়, বেশ হয়| ওর সব বন্ধু, কল্পনা, মৌসুমী, স্বেতা, সোমা, সবাই তো মদনাদার সাথে খেপে খেপে ঘুরেছে| 

এইজায়গাটাতে থাকতে আর মন চায় না ঝুম্পার| মেয়েটা বড় হচ্ছে, নতুন করে আবার ঘর পাততে ইচ্ছে হয় ওর| পিউ কে ছেড়ে ঝুম্পার হাত ধরবে না মদনা কিংবা কেউটে| হাজারহোক এরা এন্টি সোশ্যাল, এই বয়সে নতুন করে অনিশ্চিত জীবনের দগদগে পোড়া ঘা চায় না দুলারী| পিছনের জীবনের ঝলসানো কালবেলা, এখনও ওর স্মৃতিতে টাটকা| পিউকে একাউন্টেন্সি পড়াতে, একটা বছর চব্বিশের ছেলে আসে ওদের ফ্ল্যাটে| ফর্সা, সুন্দরপানা চেহারা, নাম “সুমন”| কয়েকদিন হলো ছেলেটা MBA পাস করে ক্যাম্পাসিংয়ে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে| সেদিন সন্ধ্যেবেলা পিউ বাড়ি ছিল না, হাতকাটা শিফন নাইটিটা পরে জলখাবার দিতে যাবার ছুতোয়, সুমনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল দুলারী| ঊষর কবিতায়, শব্দপোকার আখরে ফুঁটে থাকা, প্রান্তিক যতিচিহ্নের তীব্র আশ্লেষে, নিজের ঈষৎ চর্বিল শরীর, গতযৌবনা আপীন কিংবা মাংসল সুউচ্চ নিতম্ব, সমন্বয়ী বর্ষামঙ্গলে ভেজা দেহানলের উত্তাপটুকু, পুরো চেপে ধরেছিলো ওর গায়ে| হাইবারনেশনের পাঁচিল টপকে সুমনের শ্বাস প্রশ্বাস কি একটুও গভীর হয়নি? ফেনিল সাগরের জৈবিক নিয়মানুবর্তীতায় কি উদ্যাপিত হয়নি ওর পৌরুষ?


মধু কুমোর ঠাকুর গড়ে, একমেটে শেষ করে দোমেটে করার প্রস্তুতি নেয়| ফাঁকে অসুর আর দেবীমুখ তৈরী করে পাশাপাশি নির্বাণি ছাঁচে, দপ্তরী হিসেবী আঙ্গুল চালায় প্রতিমার কটিদেশ, নিতম্ব কিংবা বক্ষদেশ জুড়ে| স্থূল থেকে স্থূলতর হয় দেবীকুলের বক্ষ বিভাজিকা, মধুর নিপুণ হাতের টানে| নাগাড়ে বালি মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে চটকে দেয় হেঁদো| দুপুরে খেতে বসে, খাওয়ায় মন থাকে না মধুর| পোষা বেড়ালটা এসে, পাতে মুখ দেয়| পাতটুকু চেটেপুটে শেষ করে গিয়ে, শুয়ে পড়ে প্রতিমার কাঠামোর নীচে| মধুর মন পরে থাকে ঠাকুরে, এখনও কত কাজ বাকি! ঠাকুর গড়া, ঠিক জীবন গড়ার মতো| দুপুরে মনে হয় সামনের রাতটাই বুঝি শেষ| তারপর পোয়াতি যামিনীর জঠর চিরে, প্রত্যয়ী ভোর হয়| আবারও একটা দিনের শুরু| সিংহের কেশর, মহিষাসুরের পেশী, দেবীর স্তন, সব মিলেমিশে জমা হয় বৈতরণীর কূলে|

সেদিন সন্ধ্যে থেকে মদটা একটু বেশি খাচ্ছিলো মধু| হেঁদোটা বার বার বলছিলো, "আরে খেওনি মধুদা, রাত জাগতি হবেক, কাল তো মহালয়া, ঠাকুরের চোখ দেবেনি?” মধু কান দেয়নি ওসবে| ও জানে শুধু আজকের রাতটা, ব্যস তার পরেই গভীর ঘুমের ঘোরে, শস্যের মঞ্জুরি বেয়ে ঢুকে পরবে, আবেগ পোকার ডানা| আর কোনো নির্জিত যন্ত্রনা কিংবা পাতাবাহার পারবে না মধুর রাতের ঘুম ভাঙাতে| ভোর রাতে চোখ আঁকবে মধু, দেবীর ত্রিনয়ন, ঈষৎ অনল আভার সাথে কৌমুদী আবেশ মাখানো থাকবে সেই চোখে| মধু পাল রাষ্ট্রের সম্মান পেয়েছিল দেবীর চোখ এঁকে| সেই চোখ আবার আঁকতে হবে তাকে| আশাবরী রাগে খাম্বাজ মিশে যাবে| তারপর আহিরভৈরবীতে অনুষ্টুপ ছন্দে বিষণ্ণ ভোর, মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ এনে দেবে| টলতে টলতে, নিজের গোলায় ঢুকে যায় মধু| বাইরের চৌকিতে আজ আধজাগা থাকবে হেঁদো| হাতের তুলিটা রঙের তুবড়িতে ডুবিয়ে গভীর শ্বাস নেয় মধু| এবার সেই অমৃতক্ষণের প্রতিক্ষা| আজ বিকেল থেকেই লাইনের ওপারের মুসলমান পাড়ায় ঝামেলা বেঁধেছে| দফায় দফায় লোকাল থানা থেকে ভ্যান দৌড়োচ্ছে সেদিকে| রাত বাড়লে গন্ডগোল বাড়তে পারে| অমাবস্যার গুমোট অন্ধকারে, বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নরম আলোয়, বৃষ্টি ভেজা আধপোড়া রাস্তার ম্যানহোলে, দৌর্মনস্যতার জালবুনে নিঃসাড় গলনাঙ্কে, সাবধানী কান পাতে হেঁদো| মাথার কাছে রেডিওটা আঁকড়ে নেয়| আর কিছুক্ষন, মধু ঠাকুরের চোখ দেবে মহালয়ার ভোরে| মৃদঙ্গ ভৈরবী রাগে, উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠের আবহে, পাড়াটার অসাড় দেহে জেগে উঠবে, অনুচিন্তক মননশীলতা|


খুব ভোরবেলা, চারমাত্রিক নির্লিপ্ত বাতাসে, ভগ্নাংকের পূর্ণজন্মে, ঘুম ভাঙে পাশাপাশি দুটো পাড়ার| দূরের একান্নবর্তী কোঠাগুলোর রংচটা দেওয়ালে, এসে ধাক্কা খায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের "নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমৌ নমঃ", সাথে ত্রিদিবি সংলাপে, কারুবাসনার ছবি আঁকে, ইসলামী অনিন্দ্য আজান| রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে, দিনের শুরুয়াতি পাখির আলাপে| কুমারপাড়ায় মধু কুমোরের গোলার সামনে, ভিড়টা জমাট বাঁধে| বাইরের খাটিয়ায় তখন গোলাপের জীবাশ্মের মতো পরে আছে হেঁদোর থ্যাঁতলানো দেহটা| প্রচন্ড আক্রোশে গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ বসিয়েছে যেন কারা! গোলার দরজাটা সজোরে ভেঙে দিয়ে গেছে কেউ| ভিতরের প্রায় সম্পূর্ণতার কোঠায় পৌঁছানো মূর্তিগুলো, আসুরিক উন্মাদনায় দুরমুশ করেছে| পাশবিক যৌন উল্লাসে, প্রতিমার পরণের কাপড় করেছে ছিন্নভিন্ন| বিবস্ত্র, বিকৃত মুখ মূর্তিগুলো যেন নির্লিপ্ত দেহভৃত অবয়ব, ভগ্ন বাহুদ্বয় সম্মুখে বিস্তৃত করে, নিজেদের বিপন্নতার কথা ব্যক্ত করে চলেছে নিরন্তর| একটু দূরে মাটিতে উপুড় হয়ে পরে রয়েছে মধুর নিথর দেহ| মাথার পিছনে গভীর আঘাতের চিহ্ন| প্লাজমিক শোণিতধারা ক্ষীণ রাস্তা বেয়ে, গিয়ে মিশেছে দূরে উল্টানো রঙের বাটিতে, যেন রক্ত আর রঙের অব্যয় হোলিখেলা| ঠিক পাশটাতে পরে আছে, একটি দেবীমূর্তির খন্ড মস্তক দেশ| দেখে বোঝা যায়, কাল সারারাত ধরে এই নির্দিষ্ট মূর্তিটির মুখাবয়ব, রঙের পরতে, নিপুণ তুলির চক্ষুদানে, পরিপূর্ণ করেছে মধু| তার ঠিক পাশটাতে পড়ে রয়েছে, একটি অষ্টাদশী কিশোরীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি| হয়তো বা শিল্পী মনের, নৈসর্গিক সংবেদ আর কুদরতী অতীন্দ্রিয় প্রবৃদ্ধতায়, একেই ফুটিয়ে তুলছিল মধু| গোলার সামনে জটলা থেকে কেউ আর ভিতরে ঢোকার সাহস করে না| শুধু ভেসে আসে ফিসফাস শব্দ "ওই ও পাড়ার মালগুলারই কীর্তি, ক্ষারটো এইভাবে মিটাইলেক! আশেপাশের গোলাগুলার দরজা গুলান খুলতে পারেকলাই, মধুদার গোলার দরজাটো দরমা বেড়ার, কতবার কয়েছিলুম সারাইতে, সারাইলেনি| এবার লাও| 

-ওই ছবিটা কার গো? আহা কি সুন্দরপনা মুখখানা! 

-আরে ওইটাই ত মধুদার সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা গো, ওর শোকেই তো মধুদার এমন পাগলপানা দশা!” 

বেলা গাঢ় হতে একটা পুলিশভ্যান ঢোকে পাড়াটায়| তবে সকলের প্রত্যাশামতো, সেটা মধুর গোলার সামনে না থেমে, সোজা চলে যায় গলির শেষপ্রান্তে, ৪ নম্বর লাইনবাড়িতে| বাড়ির সামনে তখন মেয়েদের ভিড়| স্থূল চর্বির বাতুলতায়, শরীরে দোল তুলে, পৃথুলা “মাসী” এগিয়ে এসে থানার আইসি কে নিয়ে যায় কোণের ঘরে| সে ঘরে তখন রক্তারক্তি কান্ড! কাল রাতে এ পাড়ার দালাল, “বিষ্টু”, দুটো ষণ্ডা মার্কা লোককে, জোর করে ঢুকিয়েছিল পাড়ার নতুন, সেই সুন্দর মুখের মেয়েটির ঘরে| মেয়েটি নরম গলায় আপত্তি করেছিল, কেউ শোনেনি| রাত বাড়লে লোকদুটো মদের ঘোরে চড়াও হয় মেয়েটির উপর, জোর করে যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করতে চায়| মেয়েটি সহ্য করে প্রথমে, এ লাইনে এটাই তো তাদের জৈবিক নিয়ম| এইরকম প্রতিরাতের শেষেই তো, প্রেমহীন অভাবী ভোরে তারা গান গেয়ে ওঠে, ঠিক যেন আলোর নীড়ে শিস দেওয়া হামিং বার্ড| কিন্তু কালরাতে অত্যাচার চরমে উঠেছিল, আঁচড়ানো কামড়ানোর সাথে চলে বিবস্ত্র করে মারধর| একটা লোক তো ধারালো ছুরি বার করে, মেয়েটার শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছিল| আর চুপ থাকেনি মেয়েটা, হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দেয় একটার গলায়, অন্যটা দ্বিগুণ হিংস্রতায় এগিয়ে এলে সজোরে ছুরিটা বসিয়ে দেয় তার শিশ্নাগ্রে| ফিনকি দেওয়া রক্ত ছিটকে এসে লাগে মেয়েটির সীমন্তপথে| গ্রহণের জোয়ার ভাঁটায়, রোহিণী ভাদ্রপদদের বুক শুকিয়ে, কোমল বিটপীসম শরীরটায় যেন দৈবী রজঃসঞ্চার হয়| 

লেডি কনস্টেবলরা, মেয়েটির দুহাতে হাতকড়া পরিয়ে, ধীরে ধীরে প্রিজন ভ্যানে তোলে| মেয়েটির মুখ জুড়ে, তখনও নির্বিকার মৃতবৎসা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে রয়েছে, শুকনো রক্তের দাগ| ভ্যানটা কুমোর পাড়া হয়ে, মধুর গোলার সামনে দিয়ে, মিলিয়ে যায় গলির শুরুর চোরাপথে| 

ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা, ঝুম্পা বৌদির দিকে, চোখ যায়নি কারও| আলুথালু চুল, গায়ে নাইটির উপর ওড়না জড়ানো চোখে, ভীত মাতৃত্বের স্বতঃপ্রবৃত্ত সন্তাপ| সকালে মেয়ে পিউয়ের ঘরে, টেবিলের উপর রাখা, চিঠিতে লেখা ছিল "মা আমরা চললাম, তুমি ভালো থেকো| আমি আর সুমন ভালো থাকবো, আমাদের খোঁজ করো না|" 

বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালীর, চিকুরী শরীর জুড়ে তখন, অনসূয়া ঢাকের শব্দ|