গোপন কান্না - দেবদাস কুণ্ডু || Gopan Kanna - Devdas Kundu || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 গোপন কান্না

       দেবদাস কুণ্ডু



--একটা কথা বলবো লতিকা।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল লতিকা। দরজার আংটা ধরে। টান দিলে খুলে যাবে দরজা। দু পা হেঁটে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে ঢুকে যাবে লতিকা। কিন্তু তা হলো না। সৌম্য বসাকের কথায় ঘুরে দাঁড়াল লতিকা।

     লতিকার গায়ের রং কালো। কিন্তু মুখে ঝকঝকে লাবন্য। বুক দুটি বেশ উঁচু আর ভরাট। উচ্চতা সাধারণ মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি। স্বাস্থ্যের বাঁধন বেশ টানটান। পিঠ জুড়ে একরাশ কালো চুল। দু চারটে চুল লেপটে আছে কপালে। সব মিলিয়ে মোহনীয় এক নারী।

--কি হলো? কি দেখছেন? আমার কিন্তু কাজ আছে।

      সৌম্য একটু নড়ে চড়ে বসল – বলবো কিনা ভাবছি।

--তাহলে আপনি ভাবুন। আমি চলি। দরজা একটু ফাঁক করল লতিকা।

--আসলে কি---সৌম্যকে থামিয়ে দিয়ে লতিকা বলল—যে কথা বলতে সংকোচ হয় সে কথা না বলা ভালো। আমি আসছি। এবার দরজা অনেকটা খুলে ফেলেছে লতিকা।

--যাবে না। কথাটা শোনা দরকার আছে তোমার। দরজাটা বন্ধ করো।

--করলাম দরজা বন্ধ। এবার বলুন কী বলবেন? লতিকা ঘুরে দাঁড়ায়ে কথাটা বলল।

    লতিকার বয়স কতো হবে। পঁয়তিরিশ ছতিরিশ। পরনে নীল শাড়ি। কালো শরীরে নীল শাড়ি? অবশ্য দেখতে খারাপ লাগছে না।

--কথাটা তুমি কি ভাবে নেবে সেটাই তো একটা প্রশ্ন।

--আমি কোন প্রশ্ন করবো না। আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। আমাকে রাতের রুটি করতে হবে।

--প্রশ্ন করবে না? ঠিক বলছো তো?

--করতেও পারি। যদি দেখি প্রশ্ন করাটা জরুরী।

--তাই তো ভাবছি কি করে বলি তোমায়। সব মানুষ তো সমান নয়।

   লতিকা সোফায় বসলো। সে বুঝে গেছে এখনই তার এখান থেকে যাওয়া হচ্ছে না। সোফায় বসে হাতদুটো রাখলো কোলে। চোখে একটা অদ্ভুত আলো এনে বলল—আপনি কি করে ভাবলেন সব মানুষ এক রকম হবে। আপনার বারান্দায় তো কতো ফুল গাছ। সব গাছে কি এক রংয়ের ফুল হয়? এই ফ্ল্যাট বাড়ি টায় আটটা ফ্ল্যাট আছে। প্রতিটা ঘরে আলাদা রঙ।

--লতিকা তুমি কি দর্শনের ছাত্রী ছিলে নাকি?

--আচ্ছা আপনার বয়স কত হলো বলুন তো?

--আমাকে দেখে তোমার কতো মনে হয়?

--সে আমি বলতে পারবো না।

--বাহান্ন চলছে।

-তাহলে আপনার অভিজ্ঞ চোখে কি মনে হয় আমি খুব পড়াশোনা জানা মেয়ে? আমি দর্শন টর্শন বুঝি না। এতো সাধারণ কথা। সব মানুষ এক রকম হয় না। এ আর নতুন কথা কি বললাম? একটু থেমে চুলের আলগা একটা খোপা করে বলল—আমি নাইন পর্যন্ত পড়েছি। 

    সৌম্য বসাক অবাক হল। ক্লাশ নাইনের বিদ্যে।অথচ কি সুন্দর গুছিয়ে কথাগুলো বললো। সৌম্য গলায় জড়তা নিয়ে বললে-কথাটা তোমায় বলা খুব দরকার অথচ বলতে দ্বিধা হচ্ছে। 

--সব দ্বিধা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি বলুন তো। দরি হলে ছোট মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। 

--তাহলে এখন থাক। পড়ে বলবো।তুমি এখন এসো।

--না। আমি না শুনে যাবো না। আপনি বলে ফেলুন। লতিকা কিশোরী সুলভ গলায় কথাটা বলল। ওর চোখ দুটো কৌতুহলে চঞ্চল। ডাইনিং টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে আছে সৌম্য বসাক। টু রুমের ছোট ফ্লাট। ডাইনিং টা আট বাই দশ হবে। লতিকা আর তার মাঝে তিন ফুটের ব্যবধান।সৌম্য একটা সিগারেট ধরাল। 

--আবার সিগারেট কেন? এই গন্ধটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আপনার কি টেনশন হচ্ছে? 

--তা একটু হচ্ছে বৈকি। সিগারেট এসটেতে গুঁজে দিলেন সৌম্য। 

--এমন কি কথা যে টেনশন হবে। 

--কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আসলে কথাটা তুমি কিভাবে নেবে সেটাই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে। 

--টেনশন হলে বলতে হবে না। থাক কথাটা গোপন। 

--তাহলে যে বিপদ হতে পারে লতিকা। 

--বিপদ? কিসের বিপদ? লতিকার চোখে বিস্ময় ।

--তাহলে বলেই ফেলি কথাটা? 

---হ্যাঁ ।সেটাই ভালো। টেনশন পুযে রাখা ভাল না। শরীর খারাপ হতে পারে। 

---তোমারও টেনশন হয় বুঝি? 


--কখনো সখনো হয় তো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো লতিকা – এমা ন টা বেজে গেল। রুটি করতে হবে। সবজি করতে হবে। আপনি চটপট বলুন তো। আর এক মূহূর্ত দেরি করা যাবে না। এরপর মেয়েটা আমার সত্যি ঘুমিয়ে পড়বে। হাজার ডাকলেও উঠে খাবে না। বলুন। 

--কথাটা হলো তুমি রোজ রোজ আমাকে খাবার পাঠাবে না। 

--ও এই কথা। আমি ভাবলাম কি না কি কথা। লতিকার গলায় হতাশা ঝরে পড়ল। বলল—তা জানতে পারি কেন একথা বলছেন? তারপর নিজের প্রশ্নের উওরের অপেক্ষা না কর বলে উঠল—আজও তো রান্না করতে পূর্নিমা আসে নি। তাই তো? 

---হ্যাঁ ।আসে নি। 

--দুপুরে কী খেলেন? 

---কি আর খাবো। আমি তো হোটেলে খেতে পারি না। পেটের সমস্যা আছে। রান্না করতে জানি না। কোনদিন রান্না করার দরকার হয় নি। এখন বুঝতে পারছি রান্না শেখাটা ভীষণ জরুরী। 

--পুরুষ মানুষ সব পারে না। পারলে তো সংসারে আমাদের জায়গা হতো না। এতো কিছু করেও তো সংসারে জায়গা পাই না। লতিকার কথায় বিযন্নতার আবহাওয়া। 

    লতিকা কি বলতে চাইছে? ওর দুই মেয়ে। বড়টা এবার এইস এস দেবে। ছোটটা এইট।ওর স্বামী ট্যাক্সি চালক। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত করে। তখন স্বাভাবিক থাকে না ওর স্বামী পরেশদা। প্রায় দিনই লতিকার ফ্ল্যাট থেকে পরেশদার চিৎকার ভেসে আসে। হয়তো মারধরও করে। 

-তুমি এমন কথা বললে কেন লতিকা? 

--আগে বলুন দুপুরে কি খেয়েছেন? 

--কদিন ধরে শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। চিঁড়ে মুড়ি খেয়েছি।

--বেশ করেছেন। কেন ঐ কথা বললাম তা জানতে চাইছেন? আপনাকে বলে কি হবে? আপনি তো একজন পুরুষ মানুষ। 

--তুমি কি বলতে চাইছ পুরুষ মানুষের মন নেই? । তারা সব নিষ্ঠুর? 

---এসব কথা ছাডুন। আপনার স্ত্রী রীনাদি বদলি হয়ে বীরভূমে চলে যাবার আগে আমাকে বলে গেলেন আপনার খোঁজ খবর রাখতে। আজ দুপুরে খাবার পাঠাতাম। ব্যাংকএ



 গিয়ে ছিলাম। করোনার জন্য কাউন্টারে বিশাল লাইন পড়ে ছিল। দেরি হয়ে গেল খুব। আমি খাবার দিলে আপনার কি অসুবিধা? হ্যাঁ। রীনাদির মতো অতো ভালো রান্না করতে পারি না আমি। 

--না না। তোমার হাতের রান্নাও ভালো। 

---তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আপনি কেন বারন করছেন? 

--কারন আছে তাই বলছি। 

--কারনটা কি সেটা শুনতে চাইছি। 

--তিনতলার রবীনের বউ, চারতলার বিকাশের বউ, নিচতলার অলোকের বউ এরা একটা গ্রুপ। কে কি করছে তা নিয়ে আলোচনা করে। মানে পরনিন্দা পরচর্চা করে। 

--ও এই কথা। একটু আগে লতিকার মুখে যে বিযন্নতার শ্যামলা আভা ছড়িয়ে ছিল, এখন সেখানে সকালের রোদ্দুর। গলার কাঠিন্য এনে বলল—ওরা কিছু বললে আপনি কোন উওর দেবেন না। যা বলার আমি বলবো। একটু থেমে বলল—ওরা আড়ালে যা ইচ্ছে বলুক আমার কিছু যায় আসে না। 

--কিন্তু পরেশদা যদি কিছু বলেন? 

--কখন বলবে? সারাদিন বাড়ি থাকে না। রাতে কি অবস্থায় ফেরে আপনি জানেন। সকালে উঠে আবার বেরিয়ে যায়। তার সংগে আমার কথা হয় কখন? তাছাড়া সারাদিনে আমি কি করি তা ও জানবে কি করে? 

--কিন্তু তোমার মেয়েরা যদি কিছু বলে? 

--বলবে না। ওরা আমার মেয়ে। আমি ওদের সেভাবেই বড করেছি। এমন আজেবাজে কথা ওরা কখনো মনে আনবে না। বলা তো দূরের কথা। একটু থেমে আবার বলল—সত্যি রীনাদি ভালো রান্না করে। আমি তো খেয়েছি।পূর্নিমা এদেশি মেয়ে। কেমন রান্না করে কে জানে। এর আগে কোন বাড়িতে রান্না করে নি। আপনি খেতে ভালোবাসেন। তাই দিয়ে যাই। এখানে অন্যায়টা কোথায় বলুন? 

    সৌম্য বসাক জবাব দেবার আগে ঘরে ঢুকে পড়েছে তিথি। লতিকার ছোট মেয়ে। সে বলল—মা তুমি এখানে। আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।মোবাইলটাও নিয়ে আসো নি। আমার ঘুম পাচ্ছে। কখন তুমি রুটি করবে? 

--তুই যা। আমি এখুনি যাচ্ছি।ঘুমিয়ে পড়িস না আবার। 

--আচ্ছা ।তুমি আসো।

তিথি চলে গেল। লতিকা উঠে দাঁড়াল – মুড়ি ঘন্টা খেয়ে নেবেন।মুড়ি ঘন্ট তো আপনি ভালোবাসেন। রীনাদি বলছিলেন একদিন। যদিও রীনাদির মতো টেস্ট পাবেন না। খেয়ে বলবেন কেমন লাগলো। লতিকা উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। 

                       দুই

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সৌম্য বসাক। তাদের আবাসনের চারদিকে ছড়ানো ছিটানো বস্তি। চোখে পড়ে বস্তির নোংরা টালির চাল। সেই বিবর্ন টালির চালের ওপর ছুটছে একটা মোটা বেজি। কত দিন কতো বছর পর সে বেছি দেখল। গা টা কেমন শিরশির করল। ক দিন ধরে গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। আজ কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। সংগে দূর্বলতা রয়েছে। তার পরিচিত গৌর ডাক্তারকে ফোন করেছিল। তিনি ওযুধ বলে দিয়েছেন। এখন কে এনে দেবে অযুধ। পনের মিনিট হেঁটে গেলে মা মেডিকেল স্টোরস। কিন্তু শরীরে হাঁটার শক্তি নেই। তিনতলার সূরজকে ফোন করেছিল। সে মামা বাড়ি গেছে। নিচতলার রতনকে ফোন করেছে। রতন পিসির বাড়ি গেছে। বাধ্য হয়ে ফোন করল লতিকাকে। গৌর ডাক্তার বলেছেন পাঁচদিন ওযুধ খেতে হবে। জ্বর না কমলে করোনা টেস্ট করতে হবে। রীনাকে ফোনে জানিয়েছে ।রীনা এখন আসতে পারবে না। বাঁধ ভেঙেছে। তা নিয়ে ব্যস্ত। সে যে ইন্জিনিয়ার। বন্যা হলে তাকে তো ব্যস্ত থাকতে হবে। 

   লতিকা ঘরে টুকল –কবে জ্বর এলো।

--মনে হয় কাল। 

---আমাকে বলেন নি কেন? শাশুড়ির শরীর খারাপ তাই শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছিলাম। লতিকা হঠাৎ সৌম্যর কপালে হাত রাখল—ভালোই তো জ্বর আছে মনে হচ্ছে। থার্মোমিটারে জ্বর দেখেছেন? 

--না। 

--ঘরে থার্মোমিটার আছে? 

--ছিল তো। এখন কোথায় আছে কে জানে। 

--দাঁড়ান। লতিকা চলে গেল। মূহুর্তের মধ্যে চলে এলো থার্মোমিটার হাতে—দেখি হাত তুলুন। ঘড়ির দিকে নজর রেখে দু মিনিট পর থার্মোমিটার বগল থেকে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরল—এ কি এতো একশো দুই জ্বর। কি করে জ্বর বাধালেন? 

--দুদিন বিকেলে চান করেছিলাম। 

--কেন? 

--খুব গরম লাগছিল। 

--বিকেলে চানের অভ্যাস আছে? 

--না। 

--তাহলে? ছাত্র পড়ান তাই সব জায়গায় মাস্টারি করেন বুঝি?   

--কি যে বলো না তুমি। 

--রীনাদি নেই বলে যা ইচ্ছে তাই করছেন। ঘরে প্যারাসিটামল আছে? 

--বোধ হয় নেই। 

-- আচ্ছা মানুষ তো আপনি। কাল থেকে জ্বরে পড়ে আছেন একবার আমার মেয়েদের বললে ওরা ওযুধ এনে দিতো। 

---ওদের বলতে আমার সংকোচ হচ্ছিল। 

--কেন? কিসের সংকোচ? 

---ওরা পড়াশুনা নিয়ে থাকে। ওদের কেন ব্যস্ত করতে যাবো। 

--বুঝেছি। দিন আমাকে। কি ওযুধ আনতে হবে বলুন। 

ওযুধ লেখা কাগজ আর টাকা দিল লতিকার হাতে সৌম্য বসাক। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লতিকা –ডাক্তার না দেখিয়ে ওযুধ খাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? 

--ডাক্তার দেখিয়েছি তো? 

--কখন ডাক্তার দেখালেন? কে নিয়ে গেল? 

--ফোনে ডাক্তারের এ্যাডভাইস নিয়েছি। 

লতিকা বেরিয়ে গেল। 


    ওযুধ নিয়ে ফিরে এলো তাড়াতাড়ি। জল ওযুধ এগিয়ে দিল সৌম্যর দিকে। সৌম্য জল সহ ওযুধ চালান করল গলায়। 

--কিছু খেয়ে ছিলেন? 

--না। 

--খালি পেটে ওযুধ খেয়ে নিলেন? এই আপনি মাস্টারি করেন? 

--কি করবো? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না যে। 

--তা বললে হবে? আচ্ছা আমি ডিম টোস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি। 

--দরকার নেই। ঘরে মুড়ি আছে খেয়ে নেব। 

--মাথা ধুয়ে দিতে পারলে জ্বরটা নামতো। 

--দরকার নেই। ওযুধ তো খেলাম। এবার জ্বর এমনই নেমে যাবে। 

--জ্বর নামতে সময় লাগবে। মাথায় জল দিলে আপনি স্বস্তি পেতেন। 

--তা ঠিক বলেছো। জানো লতিকা আমার না এক সময় প্রতিবছর জ্বর হতো। আমি ঠাকুরমার কাছে থাকতাম। জ্বর হলে মার কাছে চলে যেতাম। জ্বর একটু বাড়লে মা মাথা ধুয়ে দিতো। বড্ড আরাম পেতাম। মায়ের হাতে যাদু ছিল।  

--এ আর নতুন কথা কি। সব মায়েদের হাতে ওমন যাদু থাকে। তারা যে মা। 

--আজ খুব মনে পড়ছে মায়ের কথা। 

--তাই তো বলছি। মাথাটা ধুয়ে দি। 

--শোন লতিকা কোন কথাই নতুন নয়। কেউ অলংকার দিয়ে, কেউ ছন্দ দিয়ে, কেউ উপমা দিয়ে কথা বলে। আসল কথাটা কিন্তু একই থাকে। এই দেখ না সময় কতো পাল্টে গেছে। মাতৃত্ব কি পাল্টেছে? 

-জানি আপনি বই লেখেন। সুন্দর কথা বলতে পারেন। আমরা কি তা পারি? 

-কেন পারবে না লতিকা। মানুষ পারে না এমন কাজ আছে? শুধু একবার নিজের ভিতরে ডুব দিতে হবে। 

--আমি বাবা এতো কঠিন কথা বুঝি না। আমাকে রান্না করতে হবে। ভালো কথা, রাতে কি খাবেন? 

--দুপুরের খাবারই পড়ে আছে। 

--সে কি? তিথি তো সামান্য খাবার দিয়ে গিয়েছিল, সেটাও খান নি? 

--মুখে এতটুকু রুচি নেই। কি খাবো? । 

--রীনাদির সংগে কথা হয়েছে ।উনি ব্যস্ত ।এখন আসতে পারছে না। 

--জানি। 

--এই সময় জ্বর কিন্তু সাংঘাতিক। 

--যদি করোনা হয় লতিকা। তুমি যেভাবে কাছে আসছো—

--করোনা হতেই পারে। বাজার হাটে যাচ্ছি না? একটা মানুষ জ্বরে পড়ে থাকবে আর আমি করোনার ভয়ে দূরে সরে থাকবো? 

--তুমি বুঝতে পারো না লতিকা। তোমার কিছু হলে তোমার মেয়েরা বলবে তুমি জেঠুর কাছ থেকে ভাইরাস নিয়ে এসেছো। 

---বলবে না। আমি আমার মেয়েদের চিনি। আপনাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। 

--না বললেই ভালো। আমি চাই না আমার জন্য তুমি কথা শোন। 

--হয়েছে। আর বলতে হবে না। রুটি তরকারি পাঠিয়ে দি। । 

--তাই দিও। 

--রাতে পাখা চালাবেন না। 

--গরম লাগবে যে। 

--তাহলে হালকা করে চালাবেন। গায়ে একটা চাদর দিয়ে নেবেন। খাওয়ার পর ওযুধ খেয়ে নেবেন। 

--আরে বাবা তুমি কি আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়েছো নাকি? 

--পুর্নিমা কবে আসছে দেশ থেকে? 

--জানি না। 


--ফোন নম্বর নেই? 

--ধরে না। রিং হয়ে যায়। এই আজ বিকেলে ফোন করেছিলাম। ধরল না।দেশে গেলে এমনই করে। দেশে যে কি আছে ওর কে জানে। 

--পূর্নিমার কোন কান্ড ঞ্জান নেই। 









 একজন মানুষের রান্নার দায়িত্ব নিযেছিস। কি করে এতোদিন দেশে পড়ে থাকিস? 

--আর বলো না। 

--কোন অসুবিধা হলে ফোন করবেন। 

--তুমি অতো ব্যস্ত হয়ো না তো। আমি ছেলে মানুষ নই। 

--সব পুরুষ মানুষই ছেলে মানুষ। মেয়ে মানুষ কি করে হবে? 

সৌম্য হেসে ফেলল—ভালো বলেছো তুমি? 

           তিন

   পরদিন সন্ধ্যা বেলা লতিকা এলো—জ্বর কমেছে? 

সৌম্য বলল—মনে হয় না। 

--জ্বর মেপেছেন? 

--ঐ কাজটা পারি না যে। 

--কি পারেন আপনি? রীনাদি যে কি দেখে আপনার সংগে প্রেম করেছিল কে জানে। 

সৌম্য মৃদু হাসে—প্রেম কি আর দেখে হয়? প্রেম হয়… 

--বুঝেছি। আর বলতে হবে না। এখন বগলে থার্মোমিটার চেপে ধরুন তো। দু মিনিট পার করে জ্বর দেখে আজও চমকে উঠল লতিকা—এ কি! আজ একশো দুয়েক আটকে আছে যে





রীনাদিকে খবর দেই যে তুমি এসে স্বামীর জ্বরে বাঁধ দাও আগে। 

--না না। তা করো না। ওখানে বাঁধ ভেঙে বন্যায় অনেক মানুষ বিপন্ন। আমি তো এখানে একজন মাত্র। 

--তাহলে অশোক ডাক্তারকে ডেকে আনি। 

--আশোক ডাক্তার? না না। 

-কেন? 

--বড় নোংরা থাকেন অশোক ডাক্তার। জামাকাপড় পড়ে নোংরা। চেম্বারও নোংরা। একজন ডাক্তার যদি পরিচ্ছন্ন না থাকে তার কাছে রগী কি করে যায়। এই নোংরা থাকার জন্য ওর বউ উনাকে ছেড়ে চলে গেছে। 

--বাবা! এতো খবরও রাখেন দেখছি। 

--আমার এক ছাত্র বলেছিল। ওদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান অশোক ডাক্তার। 

--তাহলে সুমিত পালকে ডেকে আনি। উনি এখন চেম্বারে আছেন। 



--তুমি দেখছি এ পাড়ার সব ডাক্তারের খোঁজখবর রাখ। 

--রাখতে হয়। তিথিটা যে মাঝ মাঝে অসুস্থ হয়। 

--কোন ডাক্তার ডাকতে হবে না। তিনদিন ওযুধ খেলাম। আর দুটো দিন দেখি। তারপর দেখা যাবে। 

--তাহলে এখন মাথাটা ধুয়ে দি? 

--না না। দরকার নেই। 

--আপনার না থাকতে পারে, আমার আছে। শুয়ে পড়ুন তো। 

    লতিকার গলায় শাসনের সুর। সৌম্য অবাধ্য হতে পারলো না। উওর দিকে মাথা রেখে দখিনে পা রেখে শুয়ে পড়ল খাটে। 

    লতিকা বাথরুম থেকে জলের বালতি আর মগ নিয়ে এলো। মাথার তলায় টাওয়াল দিল। চুলে জল ঢালতে থাকল ধীরে ধীরে—কতদিন চুল কাটেন না বলুন তো? কতো বড় হয়েছে। 

--আছে, থাক না। 

--অদ্ভুত কথা তো। লেখাপড়া শিখে পুরুষ মানুষ যে এমন হয় কে জানতো? 

--লেখাপড়া শেখার সংগে চুলের কি সম্পর্ক? 

--সম্পর্ক আছে। 

--শুনি সম্পর্কটা। 

--সব সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না। 

    চুলের ভিতর শীতল জল নেমে যাচ্ছে। লতিকা চুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে ঢেলে যাচ্ছে জল। একটা ঠান্ডা অনূভতি ছড়িয়ে যাচ্ছে সৌম্যর শরীরে।এভাবে রীনা কোনদিন সেবা করে নি। ওর অফিসের দায়িত্বের জন্য সে অনেক সময় অবহেলিত হয়েছে। এখন বড় আরামে অবশ হয়ে আসছে তার মাথার স্নায়ুতন্তগুলি। একটা তন্দাসুলভ আবেশ তাকে বিবশ করে দিল। কিছু সময় পর লতিকা বলল—এবার উঠুন। 

   সৌম্যর কানে গেল না কথাটা। 

লতিকা আবার ডাকল—কি হলো ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? 

   সৌম্যর সাড়া নেই। আরে সত্যি মানুষটা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? 

   লতিকা মৃদু ঠেলা দিল—উঠুন। হয়ে গেছে যে। 

  







সৌম্যর তনদা 


ভাব কাটল। সে চোখ মেলে একরকম ঘোরের মধে তাকিয়ে থেকে বলল—কি হয়েছে? 

--উঠতে হবে না? গাটা তো স্পজ করতে হবে। 

ঘোরের ভিতর সৌম্য উঠল। নীচে নেমে দাঁড়াল। 

--কি হলো? পাঞ্জাবীটা খুলুন।

সৌম্য দাঁড়িয়ে রইল। 

--লজ্জা হচ্ছে? পুরুষ মানুষের খালি গা হতে লজ্জা কিসের। খুলে ফেলুন। 

  গীজার থেকে হালকা গরম জল নিয়ে এলো লতিকা। ভেজা টাওয়াল দিয়ে অতি যত্নে বুক হাত পা মুছিয়ে দিল। যেন নিজের স্বামীর সেবা করছে। এতটুকু অস্বস্তি নেই। লতিকার শরীর থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছে সে। তার স্নায়ুতন্তগুলি কে অবশ করে দিল। প্রগাঢ় আবেশ মাখা গলায় প্রবেশ করল। সৌম্য বলল—কে তুমি? 

    ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। মৃদু একটা আলো জ্বলছে। সেই আলো আঁধারিতে লতিকাকে রহস্যময়ী লাগছে সৌম্যর। সে আবার বলল—কে তুমি? 

  লতিকার হাত সহসা থেমে গেল। হাতে ভেজা টাওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছু সময় । তারপর সৌম্যর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল—আমি লতিকা। 

--না না। তুমি লতিকা নও। তোমার গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি। 

--কিসের গন্ধ বলুন তো? 

--বেলফুল

--কি করে বুঝলেন? 

--আমার এক বান্ধবী ছিল, সে মুখে বেল ফুল বেঁটে মাখতো। 

--শুধুই বান্ধবী? না আরো কিছু? 

--আমি তাকে ভালোবাসতাম লতিকা ।

--তাকে বিয়ে করলেন না কেন? 

--তার নাম ছিল করবী। করবীর বন্ধু ছিল রীনা। রীনা এলে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। 

--করবী এখন কোথায়? 

--আমেরিকায়। 

--যোগাযোগ আছে? 

--আমি রাখি নি যোগাযোগ। 

--আমিও কিন্তু একটা গন্ধ পাচ্ছি। লতিকা বলল। 

--কিসের গন্ধ লতিকা? 

--গোলাপের।

--ঠিক বলেছো। আমি গোলাপ জলে আজ মুখ ধুয়েছি। মাঝে মাঝে ধুই। 

--অনেক বছর পর গন্ধটা পেলাম। কেমন আছে উজান কে জানে? 

--কে উজান? 

--উজান আমাকে ভালোবাসতো। 

--বিয়ে করল না কেন? 

--আমার বাবা রাজি ছিল না। এই ছেলের সংগে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল বাবা। আমার তো মা নেই, তাই কিছু প্রতিবাদ করতে পারি নি। কিন্তু কি পেলাম এই ছেলেকে বিয়ে করে? 

--সবাই সব কিছু পায় না লতিকা। সবার জীবনে কিছু না-পাওয়া থাকে। তাকে ভুলে থাকতে হয়। 









--আমি তো ভুলেই ছিলাম। আজ গন্ধটা মনে করিয়ে দিল। ও যে মাঝে মাঝে গোলাপ জলে মুখ ধুতো। বিশেষ করে যেদিন আমার সংগে দেখা করতে আসতো। 

   পাঞ্জাবী পড়ে নিয়ে সৌম্য বলল—লতিকা তুমি কি একটু চা করে দেবে? তোমার হাতের চা কিন্তু দারুণ। 

--দিচ্ছি ।একটু অপেক্ষা করতে হবে। এগুলো পরিস্কার করে নি। 

--সে ঠিক আছে। তোমার দেরি হয়ে যাবে না তো? 

   সে কথার উত্তর দিল না লতিকা। জানালা দরজা খুলে দিল। আলোয় ভরে গেল ঘর। সৌম্যর চোখে পড়ল লতিকার মুখে ঝুলে আছে এক খন্ড মেঘ। উজানের জন্য বোধ হয়। 

           চার

  শাশুড়ির অবস্থা ভালো নয়। লতিকা শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল। সাতদিন পর ফিয়ে এলো। খোঁজ নিতে সৌম্যর ঘরে এলো। ঘরে ঢুকে অবাক হলো। একজন বয়স্ক বিধবা মহিলা রান্না করছেন। লতিকা বিস্ময় নিয়ে বলল—পূর্নিমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন নাকি? 

--সে তো দেশে গিয়ে আর আসছে না। কতদিন তার অপেক্ষায় বসে থাকি বলো তো? 

--তা উনিই কি এখন থেকে রান্না করবেন? 

--উনি রীনার মাসি। ওনার কেউ নেই। রানাঘাটে একা থাকতেন। রীনা নিয়ে এসেছে। 

--আপনার দেখাশুনা করবে? 


--তা বলতে পারো। 

--ভালো হয়েছে ।এবার আর আপনার অসুবিধা হবে না। শরীর এখন কেমন? 

--সম্পূর্ন ফিট। তোমার শাশুড়ি কেমন আছেন? 

--ভালো না। যাই যাই করছেন। 

--কতো বয়স হলো? 

--আশি পার করে ফেলেছেন। 

--এবার চলে গেলেই ভালো। 

লতিকা কিছু বলল না। 

--লতিকা একটু চা করে দাও না। 







--মাসিমাকে বলুন।আমাকে কেন? লতিকার গলায় একটু ঝাঁঝ। 

--তোমার হাতের চা যে অমৃত। মাসিমা তোমার মতো পারে না। 

--আমি পারবো না। আমার সময় নেই। আমি আসছি। 

--কি হলো লতিকা তোমার? 

--জানি না। দুটো মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সশব্দে দরজা টেনে দিল। একটু সময় পর ওর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হবার দরাম শব্দ হলো। একটু চা করতে বলায় এতো রেগে গেল কেন? 

মাসিমা বলল—কে মেয়েটা? 

সৌম্য শান্ত গলায় বললা—লতিকা।পাশেরফ্ল্যাটের থাকে। এতোদিন ঔ খোঁজ খবর নিতো। বড় ভালো মেয়ে ।

মাসিমা বললেন—সে বুঝলাম। কিন্তু রেগে গেল কেন? বললেই পারতো এখন আমার সময় নেই। পারবো না। এতো ঠেকাম দেখানো কেন বাবা। এতো ভালো লখন নয় ।



 

 

 মাসীমার অত কথা সৌম্যর মাথায় ঢুকলো না। সে বুঝতে পারলো না লতিকার গলায় রাগ না অভিমান ঝড়ে পড়ল। এমন গলায় তো কোনদিন কথা বলে নি। আজ হঠাৎ কি হলো লতিকার? 

        পাঁচ

দুই মেয়ের কেউ এখন ঘরে নেই। মাসি বাড়ি বেড়াতে গেছে। ঝড়ের বেগে সৌম্যর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে টুকলো লতিকা। বিছানায় থম দিয়ে কিছুখন বসল। আবার উঠল। আবার বসল। একটা অস্থিরতা তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। বুকের ভিতর একটা শূন্যতা অনুভব করল। তাহলে আর লতিকাকে দরকার হবে না সৌম্যর? অসুস্থ হলে ওযুধ আনার জন্য তাকে ফোন করবে না সৌম্য? জ্বর হলে মাথা ধুয়ে দিতে হবে না আর।রান্না খাবার আর পাঠাতে হবে না।খোঁজ খবর নেবার কোন প্রয়োজন থাকলো না। মাসিই সব পারবে। ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। তাহলে তার ভিতরটা কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? সৌম্য তার কে হয়? কেউ তো নয়। একজন প্রতিবেশী ছাড়া। তবে কেন তার ভিতরটা একটা গোপন কষ্টে ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পে যেমন ঘর বাড়ি ভেঙে যায়। 

 গলার কাছে কি একটা আটকে আছে। তার কি কান্না পাচ্ছে? কিছু ভালো লাগছে না তার। সারা শরীর 

থর থর করে কাঁপছে। সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল উপুর হয়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তার শরীর ওঠানামা করছে। এদিকে পরেশের আসার সময় হতে চলল। সে খেয়াল নেই তার। অনবরত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তার শরীর উঠছে আর নামছে। কেউ দৈখল না লতিকার মুখের কাছের চাদরটা বেশ ভিজে গেছে। যেমনটা বর্ষার জলে ভিজে যায। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024