যেওনা উৎসব - অর্পিতা বিশ্বাস || Jeuna Utsab - Arpita biswas || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

যেওনা উৎসব

অর্পিতা বিশ্বাস



         টবের গাছগুলোর পরিচর্যা করছিলেন সোমেশ্বর । বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও নিজস্ব কাজ আর লেখালেখি নিয়ে বেশ ভালো আছেন । অবশ্য জীবনভর এই ভালো থাকার চেষ্টাটাই করে গেছেন । আর এটা শিখেছিলেন মনিদার কাছ থেকে । মনিময় সেনগুপ্ত । পাড়ার সবার মনিদা । তা মনিদাকে কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে বলতেন---বেশ ভালো আছি । সেবার নীরু জ্যাঠাকে একই কথা বলতেই রেগে গিয়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর প্রশ্ন করেছিলেন --আচ্ছা মনিদা, নীরু জ্যাঠাকে তুমি মিথ্যে বললে কেন ? 

      মনিদা উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন--পুজো এসে গেছে, তাই না রে ? 

             সোমেশ্বরও একবার নীলাভ আকাশটা দেখে নিলেন । তারপর বললেন -----কথা ঘোরাবে না মনিদা । মাস আধা না পেরোলে জ্যাঠা যে টাকা হাতছাড়া করতে চায় না সেটা তুমি যেমন জানো, আমিও জানি । সময় মতো টাকা না দিলে জ্যাঠার ছেলে মেয়ে দুটোকে পড়াতে যাও কেন ? একটু হেসে মনিদা বললেন --- তোর কি মনে হয়, আমি ভালো নেই বললে নীরু জ্যাঠা পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিত ? আসলে ওটা একটা কথার কথা । যারা জিজ্ঞেস করে, তারা মোটেই 'তুই কেমন আছিস' সেটা জানতে চায় না । কিন্তু যদি সত্যি কথা বলিস, তাহলে হয় তোকে ওরা করুনা করবে নাহলে পরদিন থেকে চিনতে পারবে না ।

             কথাটা যে খুব সত্যি জীবনে তা অনেক বার টের পেয়েছেন সোমেশ্বর । যখনই কাউকে বন্ধু ভেবে, আপনজন ভেবে নিজের কষ্টটুকু শেয়ার করতে গেছেন, তক্ষুনি তাদের চোখের ভাষা পালটে যেতে দেখেছেন । একটা সময় গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে । মনিদার মতোই বলতে শিখে গেছেন, ভাল আছি -বেশ আছি ।

           তবে এ ক'দিন ধরে সত্যিই ভাল আছেন সোমেশ্বর । ছেলে পলাশ, বউ আর মেয়েকে নিয়ে পুজোর ছুটি কাটাতে বাড়িতে এসেছে । সোমেশ্বরের আনন্দ তাই আর ধরছে না । সকাল হলেই ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করছেন । আর কমলা রান্নার মেয়েটাকে নিয়ে নানান রকমের রান্না করছেন । খেতে বসে পলাশ রাগ করলেই, কমলাও মিষ্টি হেসে অভিযোগ করছেন ---তা কি করব আমরা , সারাটা বছর তো বাইরে বাইরেই কাটাস তোরা । কিছুই তো খাওয়াতে পারি না । ব্যস, চুপ করে যায় পলাশ ।

        পলাশের বউ অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । বরং নিজের সাজগোজ আর পুজোর বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকে । যদিও সোমেশ্বর জানেন, এখানকার পুজো মোটেও ভাল লাগবে না ওদের । সেদিন তো শালুক বলেই ফেলল ---- কি করে যে পুজোটা কাটবে এখানে ? ইস, বাপি যে কি করে না ! 

       পলাশ থামাবার চেষ্টা করেছে মেয়েকে । কিন্তু নন্দিনী মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলেছে --- তোমার আর কি । নিজের জায়গায় এসেছো, কত বন্ধু-বান্ধব পাবে, দিব্যি কাটবে দিনগুলো তোমার । শালুকটাই যা একা হয়ে গেল ।

সোমেশ্বর চুপ করে থেকেছেন । মুখের হাসিটুকু বজায় রেখেই । ছেলে--বউর মাঝে কোন কথা বলেননি । তবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তার মানে কমলার কান্নাকাটির জন্য, পলাশ এবার জোর করে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে । আচ্ছা নন্দিনী যদি আজ নিজের মেয়ে হত, তাহলে কি বলত এমন কথা ? বলত না । বরং শালুকের কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে ঘর - দুয়ার সাজিয়ে তুলত, মা-বাবাকে নিয়ে পুজো দেখতে বেরিয়ে পড়ত । 

     কথাগুলো মনের মাঝে উঁকি দিতেই সোমেশ্বর সামলে নিলেন নিজেকে । অথবা বলা উচিত ব্রেক কষলেন ভাবনাগুলোর । সত্যিই তো নন্দিনীর কথাও ফেলার নয় । শালুক তো কাউকেই চেনে না -জানে না এখানে । কেনই বা ভাল লাগবে ওর । শালুকের বয়সে নিজে তো পুজো-পার্বন অথবা কোন উৎসব -অনুষ্ঠান বন্ধুদের ছাড়া ভাবতেই পারতেন না । তাছাড়া ততদিনে কমলাও তো এসে গিয়েছিল জীবনে । একঢাল কালো চুলের সংগে একটু চাপা রঙের মেয়েটাকে কি মিষ্টি যে লাগত সোমেশ্বরের । এক অষ্টমীর সকালে হলুদ তাঁতের শাড়ি পড়া কমলাকে দেখে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন সোমেশ্বর । তারপর ওই বন্ধুদের দয়াতেই ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল । নিজের মনের কথা বলেছিলেন সোমেশ্বর । কোন কথা না বলে একছুটে পালিয়ে গিয়েছিল কমলা । তবে যাবার আগে এক ঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গিয়েছিল সোমেশ্বরকে । সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছিলেন সোমেশ্বর সেদিন কমলার ওই হাসিটুকুতে । প্রতিটা দুর্গাপুজো আজও তাই স্পেশাল সোমেশ্বরের কাছে । এসময়টায় তাই 'কোন মন খারাপ করা কথা' মনের মাঝে ঠাঁই দিতে চান না সোমেশ্বর । 

                           দুই

       আজ ক'দিন ধরে একটা কথা মনের মাঝে ঘুরছিল সোমেশ্বরের । কমলাকে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি । জানেন ঠিক বকুনি খাবেন । তবুও কেন কে জানে কথাটা ভাবলেই একরাশ খুশি লুটোপুটি খাচ্ছিল বুকের ভেতর । আর তাই সাহস করে একসময় বলেই ফেললেন ----আচ্ছা কমলা, হঠাৎ যদি দেখ তোমার ছেলে আর ছেলের বউ সব্বাই তোমার কাছে এসে থাকতে চাইছে তাহলে ? 

      সুপুরি কাটছিলেন কমলা । মুখ না তুলেই বললেন---দিবা স্বপ্ন দেখ না । এই যে ওরা পুজোর ক'দিন আগে থেকে এসে থাকছে আমাদের কাছে, নন্দিনী আমার হাতে হাতে কাজ করছে, তাই অনেক । বসতে পেলে শুতে চাইতে নেই, বোকামি করা হয় তাতে । 

      কমলার আরও একটু কাছে এসে বসলেন সোমেশ্বর । আর গোপন কিছু শেয়ার করার মতো করে বললেন----আচ্ছা, যদি শালুক এই হাউসিং কমপ্লেক্সে বউ হয়ে আসে, তাহলে ?

      তেতে উঠলেন এবার কমলা । সুপুরি কাটা বন্ধ করে বললেন ----তোমার কি মাথাটা একেবারেই গেছে? নাকি কি বলছো বুঝতেই পারছো না ? 

        সোমেশ্বর হেসে উঠলেন এবার জোরে জোরে । প্রানখোলা হাসি যাকে বলে । তারপর আস্তে করে বললেন, সুধাকরের ছেলেটা ডাক্তারি পড়ছে, জানোই তো । সেও কিন্তু আসছে এবারের পুজোতে । ছেলেটা দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম । আমাদের শালুকের নিশ্চয় অপছন্দ হবে না । আর তোমার ছেলে --ছেলের বউ ওরকম হীরের টুকরো ছেলেকে জামাই হিসেবে পেলে খুশিই হবে । মাঝখান থেকে লাভবান হব আমরা । নিজের মেয়ের টানে দেখবে তোমার ছেলে অফিসে দুদিনের ছুটি পেলেও সোজা এবাড়িতে চলে আসছে । আচ্ছা, আমরা তো ওই বয়সেই প্রেমে পড়েছিলাম, তাই না ? তুমি অবশ্য শালুকের থেকে একটু ছোটই ছিলে । সবে মাধ্যমিক দিয়েছিলে বোধহয় তখন । তা তোমার নাতনি হয়ে শালুক একটু প্রেম করতে পারবে না ? আর না পারলে আমি ঘটকালি করব । সুধাকর এককালে আমার ছাত্র ছিল । আমি বললে শালুককে ছেলের বউ করতে মোটেও অরাজি হবে না । 

ব্যাপারটা পছন্দ হলেও, নিজের কিশোরীবেলার প্রেমের কথা তুলতে একরাশ লজ্জা ছড়িয়ে পড়ল কমলার এখনও মোটামুটি সুন্দর মুখের ওপর। আর তাতে আরও রেগে গেলেন । দুপ দাপ পা ফেলে উঠে গেলেন সামনে থেকে । হা হা করে আবারও হেসে উঠলেন সোমেশ্বর ।

তা শালুক কি প্রেমে পড়েছিল ? না, ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি কর্তা-গিন্নি দুজনের কেউই । টানা চার-পাঁচটা দিন গোয়েন্দাগিরি করা সত্বেও । সপ্তমী দিন সোমেশ্বর নিজে উদ্যোগী হয়ে শালুকের সংগে সিদ্ধার্থর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । বেশ কিছুক্ষন কথা বলেছিল দুজনে । অষ্টমী দিনের জন্য তাই নতুন প্ল্যান করেছিলেন কমলা । শালুককে আরও সুন্দরী দেখাবার জন্য উপহার হিসেবে একটা মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি দিয়েছিলেন । প্রথমে রাজি না হলেও কমলার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত শাড়িটা পড়েছিল শালুক । অঞ্জলি দিতেও একসংগে গিয়েছিলেন কমলা স্রেফ সামনে থেকে সিদ্ধার্থর রিয়েকশনটুকু দেখবেন বলে। 

  বাড়ি ফিরে হাসি মুখে সোমেশ্বরকে রিপোর্ট করেছিলেন ---আমার নাতনীকে দেখে তো চোখের পলকই পড়ছিল না তোমার ওই ডাক্তার ছেলের ।

কথাটা সত্যি । খেতে বসে শালুকও বলেছিল--- ইস, শাড়িতে যে কি আছে জানি না, এত কষ্ট হয় সামলাতে, দু'পা হাঁটার পরই মনে হয় এবার নির্ঘাৎ পড়ে যাব । তাও নীচে সুজাতা আন্টি ওরা সব্বাই ডেকে ডেকে বলছিল, কি ভাল লাগছে তোমায় দেখতে শালুক, এমনকি সিদ্ধার্থও বলে কি না........ । কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে গিয়েছিল ।

সিদ্ধার্থ কি বলে সেটা জানার চেষ্টা না করে কমলা একটু হেসে বলেছিলেন --

---- সত্যি কথাই তো বলছিল সবাই । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমারও নিজেকে নিশ্চয় ভালো লাগছিল শালুক । তাই তো এতো মন দিয়ে সাজগোজ করছিলে । আর গয়নাগুলো পড়ার পর তো তোমায় মা দুর্গার মতোই সুন্দর লাগছিল । 

আহা, সেতো তুমি জেদ ধরেছিলে তোমার অর্ণামেন্টস গুলো আমায় পড়াবে বলে । তবে ...

----তবে কি ? 

----ওগুলোর ডিজাইন কিন্তু মোটেও পুরনোকালের নয় । বরং বেশ হালকা সুন্দর কাজ গয়নাগুলোর । ফ্যাশনেবল যাকে বলে ।

    এবার আর কিছু বললেন না কমলা। শেষের বাক্যদুটো শালুকের নাকি ওই ডাক্তার ছেলের সেটাও জিজ্ঞেস করলেন না । বরং আরও একপিস মাছ তুলে দিলেন নাতনীর পাতে । পলাশের মতো ওর মেয়েটাও মাছের কালিয়া খেতে খুব ভালবাসে । ছেলে, ছেলের বউ পূজো মন্ডপেই ভোগের খিচুড়ি খাবে আজ । শালুকের খিচুড়ি পছন্দ নয় আর ওদের দুজনের তো আজকাল পেটেই সহ্য হয় না । তিনজন তাই গল্প করে করে মাছ -ভাতই খেতে লাগলেন ।  

       পরদিন থেকে নজরদারি আরও বেড়ে গেল সোমেশ্বর আর কমলার । উত্তেজনায় টান টান দুজনে । উফ্ কি কঠিন কাজ ! কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না অথচ কাজটা ঠিকঠাক করতে হবে । পালা করে নজর রাখছেন দুজনে । এমনকি শালুকের ফোনেও আড়ি পেতেছেন কমলা, ব্যাপারটা এক্কেবারে দোষের জেনেও । কিন্তু খুব একটা সুবিধে হয়নি । হবেই বা কি করে ? ফোনে যা কথা বলছে শালুক সে তো বেশির ভাগই হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে । বাংলা দু চারটা শব্দ থাকলেও কমলার তাতে লাভ তেমন হয়নি। মনে মনে, দুর ছাই বলে চলে এসেছিলেন ওখান থেকে । পরে এনিয়ে নালিশ করেছিলেন সোমেশ্বরকে । মুখটা গম্ভীর করে সোমেশ্বর বলেছিলেন----- দেখলে তো পড়াশোনায় মন না থাকলে কি হয় । ছোটবেলা মন দিয়ে একটু পড়লে আজ এই অবস্থা হত না । এই জন্যই কিচ্ছু করতে পারলে না জীবনে । 

----তা বিয়েটা করেছিলে কেন ? জানতেই তো টেনেটুনে কোন রকমে মাধ্যমিকটা পাশ করে ছিলাম । তোমার তুলনায় মূর্খ ছিলাম জানতে না ? 

     ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কমলা । নিজের মানুষটার কাছে এত বছর বাদে পড়াশোনা নিয়ে এভাবে কথা শোনাটা মোটেই বরদাস্ত করতে পারলেন না । 

----আহা, যা গেছে তা নিয়ে রাগ করে লাভ কি ? তাছাড়া তুমি যে হারে আজকাল রেগে যাচ্ছ তাতে শালুকের বিয়ের ব্যবস্থা করার আগে আমাদেরই না ডিভোর্স হয়ে যায় । 

      হেসে ফেললেন এবার দুজনেই । তবে কমলা চিন্তায় পড়ে গেলেন । শালুক দিব্যি যখন-তখন ছেলেটার সংগে গল্প করছে, অথচ প্রেমে পড়ার সেরকম কোন লক্ষন নেই । গতকাল শালুকের সংগে কথা বলার সময় সুযোগ বুঝে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন ---আচ্ছা দিদিভাই, সিদ্ধার্থ ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার ? বেশ ভালো কিন্তু ছেলেটা, মানে ছোটবেলা থেকেই দেখছি তো ।

         হাতের ফোনটা ঘাটতে ঘাটতেই উত্তর দিয়েছিল শালুক --ঠিকই আছে । আমার সংগে তো বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেছে ওর । তাছাড়া ওর বন্ধুগুলোও বেশ ভালো । ইনফ্যাক্ট ওদের জন্যই ভালো কাটছে পুজোটা ।

      শালুকের কথা শুনে স্রেফ বোকা বনে গিয়েছিলেন কমলা । হচ্ছে সিদ্ধার্থর কথা, এর মাঝে ওর বন্ধুরা কোথা থেকে এল । তবু ভালো করে ওর মুখটা লক্ষ করছিলেন আর হতাশ হয়েছিলেন । না 'বন্ধুত্ব' শব্দটা উচ্চারন করার সময় চোখেমুখে এতটুকু আলো জ্বলে উঠল না । আর পাঁচটা বন্ধুর মতোই যেন সিদ্ধার্থ । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন কমলা, ছেলে মেয়েদের মাঝে আজকাল 'এই নির্ভেজাল' বন্ধুত্বটাই যত নষ্টের গোড়া। না হলে এত চেষ্টার পরও মেয়ের মন গলে না ! না আর কোন আশাই নেই । 

----কি হল চুপ করে গেলে যে ? 

-----এখনকার ছেলে--মেয়েগুলোকে না ঠিক বোঝা যায় না । কি যে চলে ওদের মনের ভেতর .......

     কথা পুরোটা শেষ করার আর ইচ্ছে হল না কমলার । শুয়ে পড়লেন । ছেলে--ছেলের বউকে কাছে পাবার আশায় এই বয়সে এসে কি না করছেন । কিন্তু আখেরে লাভ কিছু হবে কি না কে জানে ....

        পাশের ঘরে পলাশ আর নন্দিনীও কথা বলছিল । তবে শালুককে নিয়ে নয় । শালুকের ওই বন্ধু প্রীতির সংগে তারা পরিচিত । গা সওয়া হয়ে গেছে এসব তাদের । তারা কথা বলছিল নিজেদের নিয়ে । ফেসবুকে আপলোড করা এ ক'দিনের তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে পলাশ বলে উঠেছিল----- এবারের পুজোটা বেশ কাটল তাই না নন্দিনী ? ভিড় ভাট্টা নেই , কিছু নেই, মনের আনন্দে ঠাকুর দেখে, সবার সাথে বেশ হই হই করে কাটালাম পুজোটা । তাছাড়া মা-বাবাও কত খুশি হল ।

----হুম, নবমী দিন যা নাচ নাচলে । মনে যে খুব আনন্দ ছিল তা তো বোঝাই গেছে । 

----ওটাকে ধূনুচি নাচ বলে । জানো ছোটবেলায় এই আরতি প্রতিযোগিতায় সবসময় আমি ফার্স্ট হতাম ।

---আচ্ছা, হঠাৎ করে এই বুড়ো বয়সে তুমি, কি বলে ওই 'ধূনুচি নাচ' নাচতে গেলে যে ? 

----এই শোনো নন্দিনী, বুড়ো বয়স মোটেই বলবে না । আমার এজের অনেকেই তো আরতি করলো। দেখলে না ? আর আমাকে বলছো যে, ঠাকুর ভাসানে নিয়ে যাবার সময় সবার সাথে তুমিও তো নেচেছিল । তবে নাচলে কিন্তু এখনও তোমাকে দারুন লাগে ।

----‌শুধু আমাকেই দেখছিলে ? নাকি ...

      হাসতে হাসতে বলল নন্দিনী ।

-----মানে ? আর কাকে দেখব ? এই মাত্র না বললে বুড়ো বয়স আমার । তা বুড়ো বয়সে কি আর ......

ঝটপট বলল পলাশ । কথাতে নন্দিনীর কাছে হারতে রাজি নয় ও মোটেই । 

কিন্তু নন্দিনী একথার উত্তর দিল না । বরং আনমনা ভাবে বলল--- -- এসব কথা ছাড়ো, শোনো না, বাবার কথা বলছি না, বাবাতো বরাবরই অন্যরকম, কিন্তু মাও এবার কেমন পালটে গেছে জানো । সবসময় যেন কি ভাবছে । তাছাড়া রান্নাঘরে আমি কাজে উল্টোপাল্টা করলেও কিছু বলছে না । বরং হাসি মুখে নিজেই করে নিচ্ছে কাজটা । সারপ্রাইজড একেবারে আমি । আর শালুকের সংগে তো পাল্লা দিয়ে পুজো মন্ডপে বসে থেকেছে এই ক'দিন । খুব এনজয় করেছে পুজোটা এবার ওরা । 

----ঠিক বলেছো । ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি । তা তোমার তো ভালো লাগার কথা । এই পুজোতে মায়ের সংগে তোমার সম্পর্কটাও বেশ সুন্দর হয়ে গেল ।

---হুম...

----আচ্ছা নন্দিনী, সেদিন শাড়িতে কিন্তু শালুককে খুব মিষ্টি লাগছিল, বড় হয়ে গেল আমাদের মেয়েটা তাই না ? 

       এবার আর কোন উত্তর পেল না পলাশ । পাশ ফিরে তাকালো নন্দিনীর দিকে । কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঠোঁটের কোনে লেগে আছে একটুকরো হাসি । হয়তো কোন স্বপ্ন দেখছে । জাগাতে গিয়েও জাগালো না পলাশ । পাশ ফিরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল ।

          ভোর বেলা থেকেই মন খারাপ আজ সোমেশ্বরের । জোর করেও ভালো থাকতে পারছেন না কিছুতেই । পলাশের ছুটি শেষ । আজই চলে যাবে ওরা । বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন সোমেশ্বর । সামনের শিউলি গাছটার নিচে ফুল ভরা । ছোট্ট ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন সোমেশ্বর । ঘরের ভেতর থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে । কমলার টিফিন কৌটোতে খাবার প্যাক করে দেওয়া, পলাশের শেষমুহুর্তে সব ঠিক আছে কি না দেখে নেওয়া, শালুকের এত সকালে খেতে না চাওয়া, এলোমেলো করে দিচ্ছে সোমেশ্বরের মনটাকে । পছন্দ হচ্ছে না এতটুকু । কেমন বিদায়ের সুর সবটাতে । ইস্ আরও ক'টা দিন যদি বেশি থাকত ওরা । অথবা পুজোটা যদি আরও দুটো দিন বেশি হত ....

        কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে এল ওরা । ছেলে --ছেলের - বউ - নাতনি এসে একে একে প্রনাম করল । কিছু বললেন না সোমেশ্বর । আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাতটা ওদের মাথায় রাখলেন শুধু । চোখের সামনে বাদামি রঙের ট্রলি ব্যাগ দুটো নিয়ে এগিয়ে গেল শালুক আর পলাশ । একটু পিছে নন্দিনী । আজ শাড়ি নয় , লেগিংস -কুর্তিতে নিজের সাজে নন্দিনী । তবুও কি যে অপরূপা লাগছে ওকে । মুখটা যেন ঠিক দুর্গা প্রতিমার মতো । এই প্রতিমাই তো উৎসবের রূপ নিয়ে ক'দিন আগে স্বামী -কন্যা সহ সোমেশ্বরের ঘরে এসেছিল । এখন ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে । মনে মনে চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বর----যেও না নন্দিনী। তোমরা গেলে এবাড়ির উৎসবের রং যে মুছে যাবে । 

       নন্দিনীর চোখটাও কেমন ভিজে উঠল । অবাক হল একটু । আরও তো কতবার এসেছে । এমনটা তো হয়নি কখনো । পিছন ফিরে দেখল একবার, মনে হল, সোমেশ্বর আর কমলা যেন একসংগে বলে উঠলেন --নন্দিনী মানে কিন্তু কন্যা, মনে থাকবে তো ? আবার এসো কিন্তু......। অজান্তেই মাথা নাড়ল নন্দিনী ।

       গাড়িতে ওঠার আগে তিনতলার একটা নির্দিষ্ট ব্যালকনির দিকে চোখ চলে গেল শালুকেরও । সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে । হাত নাড়ছে । হাত নেড়ে বিদায় জানালো শালুকও । কিছু একটা বলছে সিদ্ধার্থ । গতকালের কথাটাই কি ? এত দুর থেকে শুনতে পেল না শালুক ।

        

       

      

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024