একটি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা - ইলা সূত্রধর || Ekti Bristi veja Sondhaya - Ila Sutradhar || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প
একটি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা
ইলা সূত্রধর
আজ সারাটা সন্ধ্যা বৃষ্টিতে ভিজেছে রূপসা। নিজের মনের দ্বন্দ্বে বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে । ক্লান্ত শরীর মন বিছানায় গা লাগাতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে ঘুম ভেঙ্গে যায় রূপসার। ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই চেনা সেই কন্ঠস্বর যা গত দুই দিন থেকে ফোনটা আবার আসছে।
এ যেন মনের ডাইরির পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে, এক এক করে মনে পরছে পুরোনো সব স্মৃতি।
আজ প্রায় পাঁচ বছর রূপসা মেয়েকে নিয়ে আলাদা
রয়েছে কোলকাতায়। প্রানের চেও প্রিয় মা-বাবা,ভাই বোন প্রিয় শহর সবকিছু ছেড়ে এই নির্জন বাস সে কি শুধুমাত্র মেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে।
রূপসা খুব সুন্দরী ও শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেদি ও অভিমানী বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে কিন্তু অবজ্ঞা সহ্য করতে পারে না। রূপসা বিয়ের আগে থেকেই লেখালেখি করত কিন্তু রক্তিমের সেটা পছন্দ ছিল না। তাই ভালোবাসার কাছে নতজানু হয়ে একদিন তার প্রিয় কলম বাক্স বন্দী করে রেখেছিল ,
অবজ্ঞার আগুনে দগ্ধ হয়ে বহুদিন পর আবার সেই কলম আরও দৃঢ় হাতে তুলে নিল। আজ রূপসা একজন বিশিষ্ট স্বনামধন্য লেখিকা। রপসার রূপে গুণে চারিদিকে যেন গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই গন্ধ গিয়ে হয়তো রক্তিমের নাকেও লেগেছে তাই তো এতো দিন পর আবার,,,,,
রক্তিম একটি সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রূপ গুন বিশেষ করে বাইরের চাকচিক্যের দিকে তার নজর বেশি। রূপ দেখেই বিয়ে করেছিল রূপসা কে। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন খুব আগলে আগলে রাখত। রূপসা ও খুব ভালোবাসত রক্তিমকে। আনন্দে আত্মহারা রূপসা ভাবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। বাধ সাজলো রূপসার মা হওয়া। ঘর সংসার , সন্তান সবকিছু একা হাতে সামলাতে গিয়ে নাজেহাল রূপসা নিজের দিকে নজর দিতে ভুলেই গেছে। দিন দিন শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তিমের সঙ্গে দূরত্ব ও বেড়ে চলেছে। কথায় কথায় আজকাল রক্তিম বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করে। রূপসা কে অবজ্ঞা করে বলে সে তার যোগ্যই নয় । অফিসের পর বাড়িতে এসে বঁকি সময়টুকু মোবাইলে মুখ গুজে থাকে। রূপসার প্রতি আর কোন আকর্ষন নেই রক্তিমের। অভিমানী রূপসা মুখে কিছু বলেনা। কিন্তু মনের ভেতর টা তুষের আগুনের মত জ্বলতে থাকে।
তারপর একদিন রূপসা দিদির কাছে জানতে পারে রক্তিমকে অফিসের তার পার্সোনাল সেক্রেটারীর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে দেখেছে। শুনে রূপসার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিছু আর বুঝতে বাকি রইল না। তবুও যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাঁর সুখের সাম্রাজ্যকে এভাবে চোখের সামনে ভাঙতে দেখে উন্মাদিনীর মতো দৌড়ে ঘরে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর মেঘের গর্জনের আড়ালে তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল।
রক্তিমই কায়দা করে মেয়ের পড়াশোনার বাহানায় রূপসা কে মেয়ের সঙ্গে কোলকাতায় পাঠিয়েছিল।
প্রথম প্রথম দু' একটি ফোন কখনো সখনো করত।তারপর বহু দিন কেটে গেছে রক্তিম আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু রূপসা কিছুতেই ভুলতে পারেনি। সে ভাবতো রক্তিম নিজের ভুল বুঝতে পেরে একদিন ঠিক ফিরে আসবে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন সব অভিমান ত্যাগ করে নিজেই ফোন করল রক্তিমকে। ফোন ধরে বিরোক্তির সুরে রক্তিম বলে উঠলো, আমাকে আর কোনদিন ফোন করবে না। তুমি যেমন আছো চুপচাপ তেমনি থাক। তোমার সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়, আমি এখন অন্য কাউকে ভালোবেসি। কথাগুলো যেন তীরের ফলার মতো রূপসার কোমল হৃদয়ে বিঁধে ছিল। সেদিন আর কাঁদতেও পারেনি। চুপকরে বসেছিল অনেকক্ষণ।
অভিমানী, জেদি রূপসা সবকিছু ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। বই, খাতা কলমকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলতে শুরু করল। কেটে গেল কতোগুলো বছর। আজ সে সফল। লেখিকা হিসেবে তাকে আনন্দ পুরস্কার দেয়া হবে। মঙ্চে অনেক গুনীজন বসে আছে। সবাই রূপসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কোথায় যেন রূপসার বুকের ভেতর চাপা দুঃখের চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে।
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সামনে কিছু বক্তব্য রাখে। পাশে ছিল বন্ধুবর মনিশ রূপসা তাকে দেখিয়ে বলে উনার জন্য আজ আমার এই সাফল্য। বন্ধু মনিশের অক্লান্ত চেষ্টায় আমি আজ লেখিকা। ও পাশে না থাকলে কোনো দিনই এই সাফল্য কিছুতেই সম্ভব হতো না। আমার এই সাফল্যের সম্পূর্ণ কৃতীত্ব আমার বন্ধু মনিশকে উৎসর্গ করলাম।
তারপর মনিশ সাংবাদিকদের ভীড় কাটিয়ে রূপসাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। রূপসা তাকিয়ে দেখে রক্তিম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ভুত দেখার মত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রূপসা। দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শেষে মনিশের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো। মনিশ বলল, দেখ কে এসেছে। তাকিয়ে দেখে রূপসা বলে উঠল,,,,,, তুমি
রক্তিম বলল, "আমাকে ক্ষমা করে দাও"। রূপসা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সেদিন তুমি আমাকে ওভাবে অপমান না করলে আজকের এই রূপসার জন্ম হতো না। তোমার অপমান আর অবজ্ঞাই আমার এই সফলতার কারণ। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো
আকাশটা আবার গুমোট মেঘে ভরে আসে। ঘনকালো মেঘ যেন রূপসার বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। জেগে ওঠে পুরোনো সেই চেনা ব্যথা। রূপসা মাটিতে বসে পড়ে
দু'চোখে বন্যা নেমে আসে। আকাশ থেকে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে রূপসাকে ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ধুয়ে যায় সমস্ত রাগ অভিমান। রক্তিম হাত ধরে রূপসা কে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে বসে রূপসা আর মনিশকে দেখতে পেল না। মনিশ রূপসা ও রক্তিমকে রেখে নীরবে চলে গেল। পেছনে ফিরে রূপসা দেখে উল্টোপথে মনিশ এলোমেলো অজানা উদ্দ্যেশ্যে হেঁটে যাচ্ছে।
বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রূপসার গাড়িতে রক্তিম নিজেই ড্রাইভ করে চলেছে অন্য আর এক দিগন্তের দিকে। অথচ অনুষ্ঠানে আসার সময় মনিশ এই গাড়ি চালিয়ে এসেছিল। অথচ যার থাকার কথা সে আদৌ ছিল না। এখন সে চালকের আসনে।
তুমুল বৃষ্টিতে আর সন্ধ্যারাতের রাস্তার আলোয় কোলকাতা যেন অন্য এক মাদকতা বহন করছে, সেকি আনন্দের না দুঃখের-- মনকে প্রশ্ন করে বারবার রূপসা। মা কোনদিন মনে হয়নি আজ এই সন্ধিক্ষনে মনিশের কথা বারবার মনে পড়ছে ,"ওর জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কেন! কেন জানি না মনে হল মনিশ বুঝি অনেকটা যন্ত্রনা নিয়ে ফিরে গেল।"
এসব ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিভেজা অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। রূপসা স্মৃতির পাতাগুলো আরও একবার হাতড়ে নিল। প্রথম কবে মনিশের সাথে দেখা হয়েছিল, ও লেখালেখি নিয়ে কেন এত উৎসাহ দিত, এসব হাজার প্রশ্ন আজ মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। মুসলধারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি ছুটে চলেছে যেন ঠিকানাবিহীন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
হঠাৎ রক্তিম গাড়ি থামালো, রূপসা বলল, "কি হলো থামলে যে "। রক্তিমের মুখটা রাঙা হয়ে উঠলো। রূপসার হাত মুঠোবন্দী করে বলল, নেমে এসো, দেখ আজ প্রকৃতি অপরূপ রূপ, অঝরে বৃষ্টিধারা বয়ে যাচ্ছে, ল্যাম্পপোষ্ট থেকে অজস্র
আলোর সাওয়ার ঝরে পড়ছে, এ যেন রাশি রাশি মুক্তো। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না রূপসা, বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো রক্তিমের আহ্বানে।
পড়নে সিল্কের শাড়ি অঝোরে বৃষ্টিতে ভিজে টইটুম্বুর। কখন খোপার চুল আলগা হয়ে গেছে টেরই পায়নি। চুল গড়িয়ে জল চুইয়ে চুইয়ে মুখে, গলায়, তারপর বুক বেয়ে পড়ছে। মনে পড়ে না শেষ কবে এরকম ভাবে ভিজেছে। বুঝতে পারেনা কেন এতো বছর পর রক্তিম তাকে নিয়ে আবার পাগলামি শুরু করেছে। রূপসার হাতের তালুতে হাত রেখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আরও চেপে ধরলো রক্তিম। শরীরময় শিরা- উপশিরায় রক্তস্রোত দ্রুত গতিতে বইতে শুরু করল। সারাপিঠে সেতারের তারের মতো রক্তিমের আঙ্গুল স্বরগমে সুর বইয়ে দিতে থাকল। রূপসা সেই সুরে সুরে বিহ্বল হয়ে পড়ল। শরীরের উন্মাদনায় চরম এ প্রাপ্তি পুরোনো ভালোবাসা আবার ফিরে পেল।
তবুও কেন মনের ভেতর এতো অস্থিরতা, কেনোই বা এতো আকুলতা। যার দেওয়া শাঁখা সিঁদুর আজও বহন করে, সেই নিজের মানুষকে আবার কাছে পেয়েছে তবু কেন রূপসার বুকের ভেতরটা অস্থির করে উঠছে, নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে।
আজকের এই চুড়ান্ত সফলতার পেছনে ছিল একমাত্র বন্ধু মনিশ। রূপসার ইচ্ছে ছিল পুরস্কার প্রাপ্তির পর মনিশকে নিয়ে কোথাও দুদন্ড সময় কাটানোর। তা আর হয়ে উঠলনা। এখন মনিশের কথা ভেবে বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে,মনিশটা আজ ভীষণ কষ্ট পেলো। গুমের কেঁদে উঠলো রূপসা, মনিশ তুমি কোথায়?
ওর এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কান্নায় ভেঙ্গে পরছে রূপসা। প্রবল বর্ষণে সে কান্না কেউ দেখতে পেলনা। এমনকি রক্তিমও না।
Comments