পরিমলের পরিণয় বন্ধনের পরিণতি - তপন তরফদার || Porimoler porinoy Bondhoner porinoti - Tapan Tarapdar || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 পরিমলের পরিণয় বন্ধনের পরিণতি

              তপন তরফদার

 


        পরিণয়বন্ধনে পা না গলালেই মানুষ সুখে থাকে। এই বিষয়টি পরিমল কে বোঝানো গেলোনা। বিয়ে না করলে মানুষ সুখে থাকে কথায় কথায়, এক দিন একটু অন্যভাবে কথাটা পরিমলের কাছে পারলাম। পরিমল আমাকে সেই গানের কথা বলে দিল, ‘দাদা মেলা থেকে বউ এনে দে।‘ আমরা গণেশ ত্রিপল সাপ্লাইয়ের কর্মচারী। আমার আর প্রদীপের অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তখন পরিমলকে কিছুই বলতে পারলাম না। ওর ঘটক এসে বলল, ভালো খবর আছে বাগনান থেকে একটা ভালো মেয়ের ছবি এনেছি, যাতায়াত বাবদে দুই শত টাকা দেবেন। কিছুক্ষণ আগেই খদ্দেরের সঙ্গে তর্কাতর্কি করেছে পরিমল মেজাজটা এখনো খিঁচড়ে আছে। একটু উঁচু গলাতেই বলে ওঠে ছবি পছন্দ হলে টাকা নয়তো লবডঙ্কা। আমার সঙ্গে চালাকি চলবে না। আমরা ওর দিকে তাকাতে লজ্জা পেয়ে গিয়ে আস্তে করে বলে, ছবিটা বার করুন। পরিমলকে বলতে পারলাম না পরিমল দুর্গতি আছে তোমার কপালে।   


         আজ সোমবার পরিমল ডুব মেরেছে, কাজে আসেনি। মঙ্গলবার কাজে এসে প্রথম কথা দাদা সব ঠিক করে এসেছি এই শ্রাবণ মাসের শেষ লগ্নে বিয়ে। আপনারা সবাই আমার সঙ্গে বরানুগমনকারী হবেন। আমাদের জীবনযাত্রা বর্বর জীবন-যাপনের থেকেও খারাপ। এখানে বরযাত্রীর কথা তো ভাবাই যায় না। বিয়ের নেমন্তন্ন পাড়ায় এখনো জোটে কিন্তু বরযাত্রীর নেমন্তন্ন, ভুলেই গেছি।নিজেদের বিয়ে ছাড়া খুব একটা ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ভি আই পি লোকদের সঙ্গে আমাদের নাম খুব একটা উঠে না। ঠিক করলাম খুব সাজগোজ করে বরযাত্রী যাব। আমরা আলোচনা করতে লাগলাম কতখানি গম্ভীর হয়ে থাকবো না হাসি হাসি মুখ করে বিয়ের আসরে বসে থাকব। পরিমল ফোন করে বলে আপনারা কিন্তু অতি অবশ্যই আসবেন। মেয়ের বাবার নাম বিশ্বনাথ সিং, বাগনানের পঞ্চাননতলায়। আপনারা সিধে পঞ্চাননতলায় চলে আসবেন।


 


       প্রদীপ আর আমি এক সেট ধুতি পাঞ্জাবি এনেছি ওটা পরেই বরযাত্রী যাবো অন্তত একদিনের জন্য বর্বর থেকে প্রবর হবো।


         অফিস থেকে সাজুগুজ করে বেরালাম। বাসে ভিড় নেই সব বাস ফাঁকা। বাসেরাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন। কি করা যায়, সেই এগারো নং বাসেরই শরণাপন্না হয়ে হাঁটতে লাগলাম। বড়বাজার থেকে হাওড়া ব্রিজে ওঠার মোড়টাতে বাসগুলো হঠাৎ সচল হয়ে গেল। প্রদীপ একটা বাসের হাতল ধরে ঝুলে পড়ে বলে, ভবানীদা উঠে পড়ুন। নিমাই দৌড়ে উঠে পড়ল, আমি একটু ছোটার চেষ্টা করতেই বুঝলাম কাপড়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে, কোনো উপায় না দেখে পিছনের বাসটাতেই উঠে পড়লাম। চটিটা খুলে পাদানি তে আটকে গেল। কোনোরকমে চটিটা গলিয়ে নিলাম। বাসের হাতল ধরে বাসের হেলপারের মতো হাত নাড়িয়ে সিগন্যাল দিতে লাগলাম। আগের বাস থেকে নিমাই ও পাকা ট্রাফিক পুলিশের মত ইশারা করতে লাগলো। দুটো বাসই হাওড়া ব্রিজ পার করে একসঙ্গে থামল।আমি ধপাস করে বাস থেকে লাফিয়ে নামলাম। খেয়াল করিনি ওখানে জল জমেছিল।ঝপাস করে জল চারদিকে ছিটকে গেল, চটি দুটো পুরো জলের তলায়। পাশের সহযাত্রী নিজের প্যান্টের জল ঝাড়তে ঝাড়তে এমনভাবে তাকাল তার থেকে কয়েকটা গালাগালি দিলে খুশি হতাম। নিমাই বলে তাড়াতাড়ি চলুন, মেচেদা লোকাল আর দশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে তিন জনেই দৌড়োতে লাগলাম। আমাদের দুজনেরই কোঁচা লুটোপুটি খাচ্ছে।


      টিকিট কাউন্টার না হাওড়ার হাট। টিকিট কাটতে গেলে কম করে এক ঘন্টা লাগবে। রেল কোম্পানি বেকার সমস্যা দূর করার জন্য কিছু দালাল রেখেছে কাউন্টারের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে। ওদের থেকে টিকিট নিয়েই দে দৌড়।


        ট্রেনের ভিড় দেখার মতো। ট্রেনের ভোঁ দিয়ে দিয়েছে। শেষের কামরাটায় সবাই ঝুলছে। একটু এগিয়ে আগের কামরাটা ধরবো বলে এগোতে যাব আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ধুতি পরে আছি, চটিটা পুরো ভেজা, এখনোও যেছিঁড়ে যায়নি আমার ভাগ্যি ভালো। জয় মা কালী বলে ট্রেনের হাতলটা ধরলাম। আর কিছু করতে হলো না, পিছন থেকে পর পর এমন চাপ গায়ে পরলো একদম চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি নিশ্চিত, ধুতি নিশ্চয়ই আমার কোমরে নেই। খুঁটটা কোথায় চলে গেছে কে জানে। প্রদীপ নিমাই কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। নিজের হাতও নাড়তে পারছিনা, পায়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি বরযাত্রী না হলে এমন বর্বর যাত্রা করতে হতো না। হঠাৎ খেয়াল হলো মানিব্যাগটা ঠিক আছে তো, নিজের ধুতি দেখা যাচ্ছে না গায়ের পাঞ্জাবিটা আছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মানিব্যাগটা। একটা উপায় বার করলাম পাঞ্জাবির পকেটটা কোমরের ডান দিকে আছে, পাশের যাত্রীর গায়ে চাপ দিয়ে স্পর্শ অনুভূতির দ্বারা বুঝে নেব মানিব্যাগটা আছে না গেছে। যেই একটু চাপ দিয়েছি ওমনি চিল চিৎকার, ঠিক করে দাঁড়ান মশাই। ঠিক করে যখন দাঁড়াতে পারেন না ট্রেনে কেন উঠেছেন। এই সময়ে যা বলতে হয় তাই বললাম, আমি নয় পেছনের লোক ঠেলছে। কি করি বলুন। মনে মনে ঠিক করলাম, বাগনান স্টেশনে নেমে যদি ধুতি অক্ষয় থাকে তবে আর বাঙালি স্টাইলে পড়বো না মাদ্রাজি স্টাইলে লুঙ্গির মতো পরবো ওইটিও একটা স্টাইল হবে। 


       প্রায় এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ আসলো বাগনান আসছে। আওয়াজ শুনে বাঘের নাদের কথা মনে পড়ে। এ ওকে গজরাচ্ছে, তরপাচ্ছে। কামরার সবাই এই বাগানের ফুল তুলতে এইখানেই নামবে। আমার সামনে দাঁড়ানো যাত্রী বলল কোন চিন্তা করবেননা। গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। যা করার আমরা করে দেব। আপনি স্টেশনে সেফ ল্যান্ডিং করবেন। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াবার আগেই পিছন থেকে এমন গুঁতো মারতে শুরু করলো সামনের মানুষ গুলো টুপটাপ করে পড়তে লাগলো। কেউ যদি হড়কে যায় পিছনের জনই তাকে টসকে দেবে। ভাগ্য ভাল আমি ব্যালেন্স করে সামনের দিকে প্রায় দশ কদম এগিয়ে গেলাম। ধুতির একটা খুঁট কোমরে, বাদ বাকিটা মেয়েদের ওড়নার মত দুলছে।


        তাড়াতাড়ি ধুতিটা জড়িয়ে নিলাম। প্রদীপ ডাকতে শুরু করেছে," তুমি কোথায়, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়।" আমি হাত উঁচু করে গানের সুরে বললাম, "আমি এইখানে। এইই খানে।" প্রদীপ বলল, ভবানীদা স্টেশন থেকে বেরাবার আগে ধুতিটা ভালো করে পরে নিন। আমিও পরে নিচ্ছি। প্রদীপ ধুতিটা খুলে আবার পরতে শুরু করলো। আমরা দুজনে আড়াল করে দাঁড়ালাম। পাবলিকরা যেতে যেতেই হাঁ করে দেখতে লাগলো, যেন সিনেমার দৃশ্য দেখছে। দেখুক আমাদের তো কেউ চিনতে পারছে না। মফস্বলের বিয়ে বাড়ি, নিজেদের পোশাক ঠিক রাখতেই হবে। শহুরে বাবু বলে কথা।  


         স্টেশন থেকে বেরোতেই সবাই টানাটানি করছে তাদের সওয়ারি হওয়ার জন্য। এমন ভাব করছে যেন আমারা ওদের কতদিনের চেনা। একজন রিকশাচালক কে দেখেই বুঝলাম অভিজ্ঞ রিকশাচালক। চশমার ফ্রেমটা লালকার দিয়ে শক্ত করে মাথার পিছনে গিঁট বাঁধা। চশমার কাচটা টিক যেন সোডার বোতলের নিম্নাংশ থেকে কেটে কাচটা চশমার ভিতরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। দুটো চোখই বড় হয়ে ভাসছে। একেই পছন্দ করলাম কারণ আর যাই হোক চশমাটা চোখ থেকে খুলে যাবে না। রিকশাচালক কে বললাম পঞ্চাননতলায় যাবে। রিকশাচালক বলল বড় পঞ্চাননতলা না ছোটো পঞ্চাননতলা। যাঃ বাবা, কটা পঞ্চাননতলা আছে কোনটায় যেতে হবে সেটাও তো আমরা জানিনা। কি করা যায়। নিমাই মোবাইল বার করে পরিমলকে ফোন করে, উত্তর আসে, ‘আপাতত পরিসীমার বাইরে’।


         একজন খুবই উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল ওটা বড় পঞ্চাননতলাতেই হবে। ওখানকার সবারই নাম ওই বাবা বিশ্বনাথের নাম মিলিয়ে রাখা হয়। আমরা এখন সমস্ত সীমানা, পরিষেবার বাইরে চলে এসেছি। বরযাত্রী না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া বোকামি হবে।


        আমি বলে উঠলাম বিশ্বনাথ সিং এর বাড়ি যে পঞ্চাননতলায় সেই পঞ্চানন তলায় যাব। আমাদের কথা শুনে একজন রিকশাচালক খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ওটা বড় পঞ্চাননতলাতেই হবে। ওখানকার সবারই নাম ওই পঞ্চাননের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। আমার রিকশোয় উঠুন পঞ্চাশ টাকা ভাড়া লাগবে। দরদাম ইচ্ছা করেই করতে লাগলাম কারণ দুটো রিকশোয় একশো টাকা খরচা । অনেক দরদাম করে ওকে বললাম ঠিক আছে পঞ্চাশ টাকাই দেবো। তিনজনে যাবো। নিমাই কিছুতেই তিনজনে এক রিকশায় যাবেনা। প্রদীপ বলে, ওরে বিয়েবাড়ির একটু দুরে নেমে যাব। বিয়ে বাড়ির আগেই আমরা নেমে গিয়ে পোশাক-আশাক ঠিক করে নেব। চুলটুল আঁচড়ে নেব।  


            রিকশাচালকের ধূসর লম্বা দাড়ি দেখে মনে হবে সাধক। যেকোনো মুহূর্তেই সাধনায় বসে যাবে। রিকশা চলতে শুরু করল বুঝলাম খুব ভুল হয়ে গেছে। নিমাই তো আমাদের দুজনের হাঁটুর উপর বসেছে, হাঁটুর উপরে যে এত চাপ পড়বে তা বুঝতে পারিনি। গর্তে পড়ে রিকশা যখন টাল খাচ্ছে সবাই টলছে। সবাই তখন দুলছে। হাওয়ায় দাড়ি উড়ছে একবার তো খপ করে রিকশাওয়ালার দাড়িটাই নিমাই খামচে ধরল। দাড়ির বিটকেল গন্ধ নাকে এসে লাগছে। নাক তো ঢাকার উপায় নেই। রাস্তার সব পাবলিক হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে, যেন কার্তিক ঠাকুর যাচ্ছে। অনেক কসরত করে অবশেষে রিকশা বড় পঞ্চানন তলায় হাজির।


        ছোটো একটা চা সহ মিষ্টির দোকান। টিম টিম করে হারিকেন জ্বলছে। কয়েকজন দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চে বসে বিড়ি ফুঁকছে গুলতানি মারছে। নিমাই এক লাফে নেমে জিজ্ঞাসা করলো, বিশ্বনাথ সিং এর বাড়ি কোনটা। আমরা বিয়ে বাড়িতে যাব। দোকানদার বলল বড় বিশু না ছোট বিশু। নিমাই কি বলবে ভেবে পেলনা। প্রদীপ বলে উঠলো তা জানিনা। আমরা আসছি বরযাত্রী হিসাবে, সহকর্মীর বিয়েতে। বেঞ্চির একজন বলল, যার বিয়েতে দেনা পাওনা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল। নিমাই বলে তাতো জানিনা। দোকানদার বলে ওই বাঁদিকের মোরম রাস্তা দিয়ে পাঁচ মিনিট এগোলেই বিয়ে বাড়ি পড়বে। রিকশাচালক আর যেতে চায়না, বলে পঞ্চাশ টাকায় অনেকটা এসেছি আর যাব না। বেঞ্চিতে বসে থাকা লম্বু একজন রহস্য করে বলে, সিধে গেলে ও হয়তো আরো একটু এগিয়ে দিত। টাকা নিয়েই তো ও ওই ঠেকে বসবে। আমি বললাম, কোন ঠেকে ভাই? উত্তর পেলাম, সিধে গেলে হাঁড়িয়ার ঠেক আছে, বিয়েবাড়ির নাম করে ও হাঁড়িয়ার জন্যই এদিকে এসেছে।


       নিমাই বলল বেশি জোর করে কোন লাভ নেই ভবানীদা। ও আমাদের নিয়ে যাবে না চলুন হেঁটেই যাই। বিয়ে বাড়ির ব্যাপারে নিমাই এর একটু বেশি উৎসাহ। ছেলেছোকরা মানুষ তো ইচ্ছে জাগবেই, কিছু বলার নেই। কিছুটা যাওয়ার পর নিঝুম বাঁশবন, ঝিঁঝিঁ ডাকছে, এগোবো কি এগোবো না ভাবছি। প্রদীপকে বললাম অনেক হয়েছে, আর নয় চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। নিমাই বলল চুপ করুন একটু, বলেই হাত দুটো একটা কানের পাশে লাগিয়ে হাতির কানের মত বড় করে বলল,- একটা মাইক বাজার শব্দ আসছে না? আমি কান খাড়া করে শুনলাম, কিছুই শুনতে পেলাম না



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024