Sunday, July 25, 2021

অঞ্জলি দে নন্দীর একটি গল্প

 বড় পুকুরের পাড়ে



চৈতন্যবাটী গ্রামের নন্দীদের বড় পুকুরের পাড়ে একটি বিরাট বহু পুরোনো নীম গাছ আছে। গ্রামের সবাই জানে যে ওই গাছে ভূত ও পেত্নী আছে। 

তবুও চোররা রাতে মাছ চুরি করতে যায়। গভীর রাতে তারা জাল ফেলে মাছ ধরে। খালুই ভরে। তারপরে, সকালে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করবে - এরকমই ওদের পরিকল্পনা রয়েছে। 

এক খালুই ভরে গেছে। এবার জাল থেকে মাছ পাড়ে ঝেড়ে তা দ্বিতীয় খালুইয়ে তুলে রাখছে। এমন সময় একদল ভূত ও পেত্নী তাদের ঘিরে ফেলল। ওরা শুনল, " হাউ মাউ খাউ, তোরা ছ'টা খালুই এনেছিস, সবগুলো মাছে ভর। তারপর চুপচাপ ওগুলি এখানেই রেখে চলে যাবি। না হলে সবার ঘাড় মটকাবো। হাউ মাউ খাউ...। "

এবার চোররা তাই করল। খালি জাল কাঁধে করে ভয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে গেল। 

পরের দিন সকালে নন্দীমশাই প্রাতকালে দাঁত মাজতে মাজতে মাজতে হেঁটে হেঁটে হেঁটে বড় পুকুরের পাড়ে এসে হাজির হলেন। অবাক কান্ড এ যে! উনি দেখলেন ছ'খালুই মাছ। তখন মোবাইলে ফোন করে তিনি তাঁর নাতী আশিসকে ওখানে আসতে বললেন। ব্যাপারটা শুনে আশিস তখন তাদের বাড়ির চাকরকে ও দারোয়ানকে বলল, " ছ'টা বড় থলে নিয়ে বড় পুকুরের পাড়ে চল!" এরপর ওরা সেখানে গেল। দাদু, নাতী ও দারোয়ান সব মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। খালুইগুলো ওখানেই পড়ে রইল। পুকুর পাড়ে ঝোপের আড়ালে চাকর লুকিয়ে রইল। দুপুরে সে দেখল যে জেলে পাড়ার তাদের চেনা ওই লোকগুলো খালুইগুলো নিয়ে কাঁধে তুলছে। সে তখন দৌড়ে গিয়ে চোরগুলিকে হাতেনাতে ধরল। ও ওদের বলল, " নন্দীবাবুর কাছে চল! না হলে খুব খারাপ হবে। " ওরা গেল। নন্দী মশাই ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, " তোরা মাছ ভর্তি খালুইগুলো ফেলে রেখে গিয়েছিলি কেনো? " ওরা তখন ঐ ভূত ও পেত্নীদের কথা বলল। এরপর উনি তাদের ছেড়ে দিলেন। 

এই রাতে নন্দী মশাই( দাদু), আশিস(দাদুর নাতী), আশিসের বাবা(দাদুর ছেলে), চাকর, দারোয়ান সবাই মিলে বড় পুকুরের পাড়ে বসে রইল। মাঝ রাতে ঐ ভূত ও পেত্নীর দল ওদের কাছে এলো। এক এক এক জন করে এসে বলল, " আমি আশিসের দাদুর বাবা। আমি আশিসের দাদুর বাবার বাবা। আমি আশিসের দাদুর মা। আমি আশিসের দাদুর মায়ের মা। আমি আশিসের দাদুর বড় পিসিমা। আমি আশিসের দাদুর বড় মাসীমা। আমি আশিসের দাদুর জেঠু। আমি আশিসের দাদুর জেঠিমা। আমি আশিসের দাদুর ছোট পিসিমা। আমি আশিসের দাদুর ছোট মাসীমা। আমরা বহু বছর ধরে এই নীম গাছের ডালে দিনের বেলায় থাকি। আর রাতে এই বড় পুকুরের পাড়ে ঘুরে বেড়াই। তোরা সবাই মিলে এইবার আমাদের প্রত্যেকের নামে গয়ায় গিয়ে পিন্ড দান কর! তাহলেই আমরা মুক্তি পেয়ে এই নীম গাছ ছেড়ে স্বর্গে যেতে পারব। আমাদের তোরাসকলে মিলে এবার উদ্ধার কর! " ওরা তাদের কথা শুনে রাতে বাড়ি এলো।

সকালে গয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেখানে গিয়ে পিন্ড দান করে তারা ফের নিজেদের বাড়ি এল।

পরের রাতে আবার সেই বড় পুকুরের পাড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু কেউই আর এল না। ওরা বুঝল যে সত্যই সব ভূত ও পেত্নীরা অর্থাৎ তাদের নিজেরজনগণ সকলেই স্বর্গে চলে গেছেন, এই নীম গাছ ছেড়ে, চিরতরে। ওরা সারা রাত ওই বড় পুকুরের পাড়ে থেকে সকালে বাড়ি এল। 

তবে পুকুর পাহারা দেবার জন্য একজন পাহারাদার রাখলেন, নন্দী মশাই। সে বন্দুক নিয়ে সারা রাত নন্দীদের বড় পুকুরের মাছ পাহারা দেয়, এখন। কারণ, এখন তো আর ভূত ও পেত্নীরা তাদের পুকুরের মাছ পাহারা দেবার জন্য পাড়ের নীম গাছে নেই। তাই.........

অর্ণব মিত্রের একটি গল্প

 স্যানাল বাড়ি



সান্যাল বাড়ির মেজ বউ রাজিতা। সান্যাল বাড়ির ভেঙ্গে পড়া আভিজাত্যকে জুড়তে জুড়তে আজ বড় ক্লান্ত ও। তিন পুরুষ ধরে সান্যাল বাড়িতে লেখালেখির চল। রাজিতার দাদাশ্বশুর ছিলেন বিরাট লেখক,নাম পিনাকী সান্যাল। রাজিতার পরিচয় পিনাকী বাবুর মেজ নাতির স্ত্রী। এই বাড়ির সকলেই লেখক। এখানে প্রতিদিন সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষজনের আনাগোনা।


তবে সান্যাল বাড়ির মানসম্মান হঠাৎ করেই ভেঙ্গে পড়েছে। লেখার মান একেবারে নেমে গেছে রাজিতার স্বামী দেবার্ঘ্যর । বাড়ির সবাই রাজিতা কে নিয়ে এই নিয়ে দোষারোপ করত। নাকি রাজিতার উষ্কানীতে এসব হয়েছে। রাজিতার মন্ত্রণায় ওদের বাড়ির বাজারটুকুই হয়না। যাই হোক মেজো ছেলের উপন্যাস নিয়ে বাড়িতে একেবারে সাজো সাজো রব পরে গিয়েছে।


নতুন উপন্যাস রাজিতার মত এক সংসারে উপেক্ষিত নারীর, যে হঠাৎ খুঁজে পায় যে তার গুণ ইচ্ছা করে বাড়ির লোকজন চাপা রেখেছিল।


আনমনে কি যেন ভাবছিল রাজিতা । হুকুম আসে উপন্যাসের সেট নিয়ে আসার জন্য। রাজিতা বই এর পাহাড় থেকে বই নামাতে গিয়ে চোখে পড়ে একটা চেনা নামের বই 'উপেক্ষিত' ।


বইটা হাতে নিয়ে রাজিতার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। বইয়ের প্রচ্ছদে রাজিতার

নাম। লেখিকা রাজিতার এখনও মৃত্যু হয়নি। বিশ বছর আগের লেখা এখনও জীবিত?


রাজিতা বিয়ের আগে খুব লেখালিখি করত। দু একটা কবিতা পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। রাজিতা আর দেবার্ঘ্যর লেখালিখির সূত্রে আলাপ। বিয়ের পর রাজিতার লেখা বন্ধ হয়ে যায়, বলা ভালো বন্ধ করে দেওয়া হয় । তাও জীবনের প্রথম আর শেষ উপন্যাস লিখেছিল রাজিতা । সেটার পাণ্ডুলিপি নিজেই প্রকাশনা সংস্থার কাছে দিয়ে এসেছিল ও কোনোদিনও ও আশা করে নি যে তা ছাপা হবে ।


বইটা নিয়ে ও স্বামীর কাছে গেল।


- এটা কি?

- আরে সেটাই তো আমার প্রশ্ন.. দাও দেখি


দেবার্ঘ্য বই টা দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রশ্ন করে-


-এই বই তোমার কাছে কি করছে? তোমার সবেতে এত

কৌতুহল কেন?


- আমার প্রশ্নের উত্তর দাও


- ...উত্তর দাও মানে? এই বই তুমি আমাদের থেকে লুকিয়ে ছাপতে গিয়েছিলে.. দু কলম লিখে নিজেকে লেখিকা মনে করে সেটা ছাপাতেও দিয়ে দিলে! লেখার তুমি কি বোঝ ? তোমার লেখা পরে আমার কলিগরা বলেছিল তোমার হাতে নাকি আমার দাদুর মুন্সিয়ানা আছে, সান্যাল বাড়ির পুরুষদের থেকে কখনও একটা পরের বাড়ির মেয়ে বেশি নাম করতে পারে না! তাই এসব লুকিয়ে রাখা। হয়েছে শান্তি। এবার যাও। "


নিজের কাছের মানুষদের আরও বেশি অপরিচিত মনে হল রাজিতার। সভ্যতা এগিয়েছে, পাল্টেছে সান্যাল বাড়ির লেখার ধরণ। তাও রাজিতার পরিচয় শুধুই সান্যাল বাড়ির মেজ বউ নাকি হারিয়ে যাওয়া এক লেখিকা যাকে আর লিখতে দেওয়া হয়নি।



এরা ভদ্রলোক? রাজিতা ভুলে যাচ্ছে কে মানুষ আর কে অমানুষ।


এখনও থরথর করে কাঁপছে রাজিতা ।


সিদ্ধার্থ সিংহের একটি গল্প

 আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না 



ডাক্তারের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে মুখ কাঁচুমাচু করে কাজরী বললেন, ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না। এর আগেও দু’জন চাইল্ড স্পেশালিস্টকে দেখিয়েছিলাম। এই যে তাঁদের প্রেসক্রিপশন... বলেই, আগে থেকে বের করে রাখা তিন-চারটে কাগজ উনি এগিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবুর দিকে। ডাক্তারবাবু সেগুলিতে চোখ বোলাতে লাগলেন। 

কাজরী আবার বললেন, ও কিচ্ছু খাচ্ছে না, কী করা যায় বলুন তো? 

ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনগুলোয় চোখ বোলাচ্ছেন। বিশাল চেম্বার। দারুণ সাজানো-গোছানো। এ সি চলছে। সাত দিন আগে নাম লেখাতে হয়েছে। এর আগে যে দু’জন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন, তাঁদের একজন পাড়ার ডাক্তারখানায় বসেন। অন্য জন একটু দূরে। 

ওর ছেলে কিচ্ছু খাচ্ছে না শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, কোন ডাক্তার দেখাচ্ছিস? সুনীল ডাক্তার? কত টাকা ভিজিট? চল্লিশ টাকা? 

কাজরী বলেছিলেন, সুনীল ডাক্তারকে দেখিয়ে কোনও কাজ না হওয়ায় লেক মার্কেটের কাছে একজন খুব বড় ডাক্তার বসেন, তাঁকে দেখিয়েছিলাম। তাঁর ভিজিট দুশো টাকা। শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, ধুর, এ সব রোগের ক্ষেত্রে একদম লোকাল ডাক্তার দেখাবি না। বাচ্চার ব্যাপার তো, একটু ভাল ডাক্তার দেখা। তাতে যদি দু’পয়সা বেশি লাগে তো, লাগুক, বুঝেছিস? 

সহেলী ওর ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ওঁরা মায়েরা স্কুলের কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বসেন। সেখানে নানা কথা হয়। আর সব কথাতেই সহেলীর মায়ের কথা বলা চাই। যেই শুনেছেন ওঁর ছেলের কথা, অমনি আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, সহেলীকে যিনি দেখেন, তার তো ডেটই পাওয়া যায় না। ভীষণ ব্যস্ত। একেবারে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। এক ওষুধেই কাজ হয়ে যায়। তবে ভিজিট একটু বেশি। আটশো টাকা। 

— আটশো টাকা! আঁতকে উঠেছিলেন কাজরী। 

— হ্যাঁ, আটশো টাকা। সুনীল ডাক্তারের চল্লিশ আর এর আটশো। তফাত তো হবেই, না? 

— ডাক্তারের নাম কী? 

— নাম? নামটা কী যেন বেশ। ওর বাবা জানে। দাঁড়া। জি়জ্ঞেস করি... বলেই, টপাটপ বোতাম টিপে মোবাইলে ধরলেন স্বামীকে। এই, আমরা সহেলীকে যে ডাক্তার দেখাই, তাঁর নামটা কী গো? ও, আচ্ছা আচ্ছা। না, কাজরী আছে না, ওর ছেলেও তো কিছু খেতে চায় না, তাই। আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, রাখছি। 

স্বামীর সঙ্গে কথা বলেই আফসোস করেছিলেন সহেলীর মা, না রে, ও-ও নামটা জানে না। আসলে ওর অফিসের এক বন্ধুর স্ত্রী ওই ডাক্তারের খোঁজ দিয়েছিলেন। উনি হয়তো জানতে পারেন। কিন্তু ওঁর নম্বরটা আমার কাছে নেই। 

— তা হলে ওই ডাক্তারকে তোরা কী বলে ডাকিস? 

— ডাক্তারবাবু বলে। 

— না না, তা বলছি না। বলছি, তোরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলিস, তখন ওই ডাক্তারের কথা বলার সময় তোরা কী বলিস? 

— বলি, আটশো টাকার ডাক্তার। 

— আটশো টাকার ডাক্তার? ও, তা আমাকে দে না ওই ডাক্তারের ঠিকানাটা। 

— ওর চেম্বার তো গড়িয়াহাটায়। 

— গড়িয়াহাটায়? রোজ বসেন? 

— ধুর, অত বড় একজন ডাক্তার রোজ রোজ বসবেন? উনি বহু জায়গায় বসেন। বড় বড় সব নার্সিংহোমে। তবে আমাদের কাছাকাছি হল গড়িয়াহাট। 

— ওখানে কবে কবে বসেন? 

— সপ্তাহে দু’দিন। মঙ্গল আর শনি, সন্ধে ছ’টা থেকে রাত আটটা। 

— ভালই হল। আজ তো বৃহস্পতিবার। তার মানে কাল শুক্র, পরশু শনি। তাই তো? তা হলে এই শনিবারই ওকে নিয়ে যাব। 

— আরে, ও ভাবে গেলে কি উনি দেখবেন নাকি? আটশো টাকার ডাক্তার বলে কথা। প্রচুর ভিড় হয়। এক মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। 

— এক মাসে আগে! 

— তা হলে আর বলছি কি? দাঁড়া, তোকে একটা নম্বর দিচ্ছি, এখানে ফোন করে কথা বলবি। আমার কথা বলতে পারিস। আসলে যে ছেলেটা নাম লেখে, সে আমাকে খুব ইয়ে করে... মানে, ওকে বলবি, তুই আমার বন্ধু। একটু রিকোয়েস্ট করবি, ডেডটা যাতে একটু আগে করে দেয়। দেখবি, ও ঠিক করে দেবে।

স্বামী বাড়ি ফেরার পর পরই কাজরী বায়না ধরেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে নতুন ডাক্তার দেখাবেন। স্বামী গাঁইগুঁই করতেই তাঁর মুখের উপরে বলে দিয়েছিলেন, তুমি যদি টাকা দিতে না চাও, দিয়ো না। আমি আমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসব। সহেলীর মা সহেলীকে ওখানেই দেখায়। এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু! 

অগত্যা ডাক্তারের জন্য আটশো এবং যাতায়াত বাবদ আরও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর স্বামী। অবশ্য টাকা হাতে পাওয়ার সাত দিন আগেই ফোন করে চেম্বার থেকে উনি ডেট নিয়ে নিয়েছিলেন। 


কাজরীর মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার, তা হলে ও কী খায়? 

— কিচ্ছু না। 

— কিচ্ছু না মানে? 

— সেটাই তো বলছি, ও না কিচ্ছু মুখে তোলে না।

— কিচ্ছু না? 

— না। 

ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। 

ঠিক এ ভাবেই মাঝেমাঝে ভ্রু কুঁচকে যায় কাজরীর। যখন তাঁর ছেলে হঠাৎ হঠাৎ জানতে চায়, এটা কী, ওটা কী? উনি যে জানেন না, তা নয়। জানেন বাংলাটা। ইংরেজির জন্য তখন তার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এই তো সে দিন, বিকেলবেলায় মুড়ি মেখে ছেলেকে দিতে গিয়ে বললেন, নে, মুড়িটা খেয়ে নে। বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, তাঁর ছেলেকে যে মেয়েটি পড়ায়, সে বারবার করে বলে দিয়েছে, বউদি, ও কিন্তু ইংরেজিতে খুব কাঁচা। ওর সঙ্গে যতটা সম্ভব ইংরেজিতে কথা বলবেন। পুরো না হলেও ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে। তাতে ওর অন্তত স্টক অব ওয়ার্ড বাড়বে। অথচ কাজরী ইংরেজি জানেন না। ছোটবেলায় পড়তেন পাড়ার একটা পাতি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে। এখনও ঠিক করে স্কুল বলতে পারেন না। বলেন ইস্কুল। মার্ডারকে মাডার। ফাস্ট ফুডকে ফাস ফুড। এমন বিদ্যে নিয়ে মাধ্যমিকে ব্যাক পাওয়ার পরে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বইয়ের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তার পরে ছেলের জন্য আবার এই বই নিয়ে বসা। শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকী ওঁর স্বামীও বলেছিলেন, ইংরেজি মিডিয়ামে ভর্তি করাতে হলে বাবা-মাকেও একটু ইংরেজি জানতে হয়। না হলে নার্সারি থেকেই দু’জন মাস্টার রাখতে হবে। তার চেয়ে ভাল দেখে কোনও একটা বাংলা মিডিয়ামে ছেলেকে ভর্তি করে দিই। কাজরী রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, যত দিন পারবেন, তিনি নিজেই ছেলেকে পড়াবেন। আর সে জন্যই আবার নতুন করে পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। যতটা পারতেন, ছেলের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলতেন। l

ইংরেজিতে কথা মানে, ছেলেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনও গাছে একটা প্রজাপতিকে বসতে দেখলেন, অমনি ছেলেকে তিনি বলতে লাগলেন, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, কী সুন্দর একটা বাটারফ্লাই। বা টাপুরটুপুর বৃষ্টি দেখিয়ে বলতে লাগলেন, দেখছিস, কী রকম রেইন হচ্ছে। কিংবা ছেলের খাবার বাড়তে বাড়তে ক’হাত দূরে থাকা চামচটা দেখিয়ে বললেন, যা তো বাবা, ওই স্পুনটা নিয়ে আয় তো। এই রকম। এতে ছেলেকে দারুণ ইংরেজি শেখাচ্ছি ভেবে মনে মনে খুব গর্ববোধ করতেন তিনি। এই তো সে দিন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় কেকার সঙ্গে তাঁর দেখা। কেকা যেই জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি? ও অমনি দুম করে বলে ফেলল, শ্রেয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর মেয়েকে যে বাংলা পড়ায় তার ঠিকানাটা নিতে... 

— বাংলা টিচার! কেন? 

— আর বলিস না। আমার ছেলেটা না একদম বাংলা জানে না। 

— সে কী রে? তুই তো বাংলা স্কুলেই পড়তিস। আর তোর ছেলে কিনা বাংলা জানে না? 

— কী করব বল? ওর আর সব বিষয়ে ঠিক আছে। কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু বাংলা পড়তে গেলেই ওর গায়ে জ্বর আসে। 

— সে জন্য বাংলা মাস্টার খুঁজতে বেরিয়েছিস? 

— আর বলিস কেন? 

— কোন ক্লাস হল ওর? 

— এই তো সবে টুয়ে উঠল। 

— কত পেয়েছে বাংলায়? 

— একচল্লিশ। 

— একচল্লিশ? কতয় পাশ? 

— চল্লিশে। 

— চল্লিশে পাশ, একচিল্লশ? না না, পড়াশোনার ব্যাপারে একদম অবহেলা করবি না। প্রথম থেকেই নজর দে। না হলে পরে কিন্তু পস্তাতে হবে। আমার মেয়েও তো একদম বাংলা জানত না। তার পর মাস্টার রাখার পরে এখন খানিকটা ঠিক হয়েছে। এখন থেকেই ওর জন্য একটা ভাল মাস্টার রাখ। বুঝেছিস? 

ও বুঝেছিল। কিন্তু ওর ছেলে বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা। তাই কেকা চলে যেতেই ও মাকে বলেছিল, আচ্ছা মাম্মি, আমি বাংলায় কত পেয়েছি, সেটা তো তুমি আন্টিটাকে বললে, লেকিন বাকিগুলোতে কত পেয়েছি, তা তো বললে না! 

— বললে থুতু দিত। তোমার মনে নেই, কত পেয়েছ? অঙ্কে গায়ে-গায়ে, আর ইংরেজিতে তো এক্কেবারে এই এত্ত বড় একটা গোল্লা। মনে আছে, দু’-দুটো বিষয়ে ফেল। ক্লাস টুতেই গার্জিয়ান টু সি... আবার কথা বলছ? 

— লেকিন, আমি তো পড়ি মাম্মি। 

— ছাই পড়ো। সারাক্ষণ খালি টিভি, টিভি আর টিভি। 

— হ্যাঁ, টিভি দেখি। লেকিন, প্রোগ্রামের মাঝে মাঝেই যে অ্যাড হয়, তখন তো পড়ি। 

— ও ভাবে পড়া হয় না, বুঝলে? 

— তুমিই তো সবাইকে বলো, আমি খুব পড়ি। 

— কেন বলি, তুমি যখন বাচ্চাকাচ্চার বাবা হবে, তখন বুঝবে। 

— লেকিন মাম্মি, আমরা তো দিদুনের বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি যে আন্টিটাকে বললে, শ্রেয়া আন্টির মেয়েকে যে বাংলা পড়ায়, তাঁর ঠিকানা আনতে গিয়েছিলে... 

— চুপ। একটাও কথা বলবি না। খালি বকবক বকবক। একটু চুপ করে থাকতে পারিস না? ছেলে কী বলতে যাচ্ছিল, উনি ফের ধমকে উঠলেন, চুপ। বলেই, মনে পড়ে গেল ছেলেকে উনি বাংলায় বকছেন। অমনি বললেন, স্যরি। সাট আপ। রেগে গেলে মানুষ কেন যে মাতৃভাষায় কথা বলে, বুঝি না! বাঙালি বাচ্চাদের বাংলা না জানাটা যে কত গর্বের, সেটা অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে দু’মিনিট কথা বললেই টের পাওয়া যায়। সবারই এক কথা, আমার বাচ্চার ইংরেজিতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাংলাটায় ভীষণ কাঁচা। থার্টি নাইনের বাংলা কী? জিজ্ঞেস করো, বলতে পারবে না। কী যে করি! এই ‘কী যে করি!’ বলাটা আসলে কিন্তু গর্ব করে বলা। 

তাই বাংলা নয়, উনি জোর দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। কিন্তু তাঁর ছেলেকে যে তিনি কিছুই শেখাতে পারেননি, সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন, সি বি এস সি বোর্ডের একটা স্কুলে ওকে নার্সারিতে ভর্তি করাতে গিয়ে। রেজাল্টের দিন দেখলেন, তাঁর ছেলের নামই ওঠেনি। তাই উনি ঠিক করলেন, যে করেই হোক, দরকার হলে ডোনেশন দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করাবেন। 

স্বামী একদম রাজি নন। তাই বাবাকে গিয়ে ধরলেন। তোমার নাতিকে সামনের সপ্তাহেই স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু তোমার জামাইয়ের হাতে এখন, এই মুহূর্তে একদম কোনও টাকাপয়সা নেই। তুমি যদি ডোনেশনের টাকাটা এখন দিয়ে দাও, তা হলে খুব ভাল হয়। ও পরে তোমাকে দিয়ে দেবে, বলে বাবার কাছ থেকে কায়দা করে টাকাটা ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা আর দেওয়া হয়নি। সেটা যে কত টাকা, তাও মনে করতে চান না তিনি। এবং তিনি যে ভাবে চান, ছেলেকে সে ভাবে পড়াতে পারছেন না বলে, নার্সারি ওয়ানেই রাখতে হয়েছে একটা মেয়েকে। সেই মেয়েটিই সে দিন বলে গিয়েছে, যতটা পারবেন, ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবেন। 

সেটা বলার জন্যই বিকেলবেলায় ছেলের দিকে মুড়ি-মাখা বাটিটা এগিয়ে দিয়ে, নে, মুড়িটা খেয়ে নে, বলেও, থমকে গিয়েছিলেন। ক’দিন আগেই বাসে করে ফেরার সময় একটা হকারের কাছ থেকে তিন টাকা দিয়ে একটা বই কিনেছিলেন তিনি। বেঙ্গলি টু ইংলিশ। কয়েক পাতার পাতলা একটা চটি বই। সেই বইটা উল্টেপাল্টে মুড়ির ইংরেজিটা দেখে নিজেই হেসে ফেললেন! ফ্রাইডরাইস! মুড়ি ইংরাজি ফ্রাইডরাইস! তা হলে আমরা যাকে ফ্রাইডরাইস বলি, সেটার ইংরেজি কী? 


— ও কবে থেকে খাচ্ছে না? ডাক্তার প্রশ্ন করতেই কাজরী সচকিত হলেন। নড়েচড়ে বসতে বসতে বললেন, প্রথম থেকেই। তবে সেটা আরও বেড়েছে, ওই গানের ক্লাসে গিয়ে। 

গানের কথা বলে ফেলার পরেই নিজেকে একটু সামলে নিলেন কাজরী। কিছু দিন আগে একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে তাঁর এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা। দেখা আরও অনেকের সঙ্গেই। সেখানে সবাই সবার খোঁজখবর নিচ্ছিল। কে কী করছে, কার বর কী করে, কার বাচ্চা কোন ক্লাসে পড়ে। কথায় কথায় কাজরী বলেছিলেন, তাঁর ছেলের গান শেখার কথা। বলতে বলতে তাতে রং চড়ছিল। এক সময় বলে ফেললেন, নিজের ছেলে বলে বলছি না, এই বয়সেই ও যা গায়, কী বলব... ও যেখানে যায়, সেখানেই, সবাই ওকে গান করার জন্য ধরে। পাড়ায় কোনও ফাংশন হলেই হল, ওকে চাই। পাড়ার সবাই তো বলেই, ও আপনাদের ছেলে না, ও আমাদের ছেলে। শুধু গানের জন্য। স্কুলে যাবে, সেখানেও। এমনকী টিফিন পিরিয়ডে ওর আন্টিরা পর্যন্ত ওকে ডেকে নিয়ে যান। ও যার কাছে গান শেখে, তিনিও তো বলেন, ওর মধ্যে পার্স আছে, ও যদি গানটাকে ধরে রাখতে পারে, ও একদিন... 

আশপাশের লোকেরা যত মাথা নাড়ছেন, উনিও তত বলে যাচ্ছেন— এই তো তোন একটা চ্যানেলে ছোটদের গানের কমপিটিশন হচ্ছে না? ওর মাস্টার তো ওর নাম দিয়েই দিচ্ছিল। আণি বলে দিয়েছি, না। একদম না। এক্ষুনি না। আগে লেখাপড়াটা করুক। তার পর এ সব। কারণ, ও যদি ফার্স্ট হয়ে যায়, তা হলে তো আর নিস্তার নেই। মুম্বই যেতেই হবে। একের পর এক গানের রেকর্ড করতে হবে। সিনেমার জন্য গান গাইতে হবে। তোরাই বল, এতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? ওদের স্কুল আবার প্রচণ্ড স্ট্রিক্ট। নাইন্টি এইট পারসেন্ট না থাকলে... সবাই ভিড় করে শুনছিলেন। হঠাৎ পাশ থেকে সেই বন্ধু বলে উঠলেন, ঠিক বলেছিস, এখন গান করলেও তো কত নাম। দেখিস না, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, শান। এঁরা গান করেই যা রোজগার করেন, তাতেই তাঁদের সংসার চলে যায়। আর চাকরি বাকরি করতে হয় না। 

প্রথমটা চট করে বুঝতে না পারলেও, কাজরী যখন দেখলেন, মুখ টিপে টিপে সবাই হাসছেন, তখন বুঝতে পারলেন, ওই বন্ধুটা তাঁর কথা নিয়ে ব্যাঙ্গ করছেন। 

এর পরেই ওঁদের জমাটি আসর ভেঙে যায়। যে যার মতো এ দিক ও দিক ছড়িয়ে পড়েন। সে দিন ওঁর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেও তিনি আর কোনও দিনই ওঁকে ফোন করেননি। তার পর থেকে ছেলের গানের কথা কাউকে বলতে গেলেই ওঁর মনে পড়ে যায়, ওই বন্ধুর কথা। তাই ডাক্তারবাবুকে ছেলের গানের কথা বলে ফেলেও কথা ঘোরালেন কাজরী আসলে এমনিতেই ও কিছু খেতে যায় না। 

— সকালে কী খায়? 

— কিচ্ছু না। 

— জলও না? 

— না, জল খায়। 

— দুধ? 

— হ্যাঁ, দুধ খায়। আধ গ্লাস। 

— দুধের সঙ্গে? 

— কিচ্ছু না, ওই একটু কর্নেফ্লক্স। 

— তার পর? 

— তার পর আর কিচ্ছু না। সামান্য লবণ দিয়ে একটা দেশি ডিম, ব্যস... 

— দুপুরে? 

— দুপুরেও তাই। কিচ্ছু খায় না। শুধু একটু স্টু, ছোট্ট এইটুকুনি এক পিস মাছ আর একটু ভাত, ব্যস। 

— তার পরে? 

— তার পরে আর কিচ্ছু না। সেই বেলা চারটে নাগাদ একটা আপেল আর একটু সিজিন ফল। 

— সন্ধেবেলা? 

— কিচ্ছু না। ঘরে যা হয়, তাই। কোনও দিন ম্যাগি করে দিলাম, কি কোনও দিন একটা এগরোল কিনে দিলাম... 

— আর কিছু? 

— না না, আর কিচ্ছু না। ওই কখনও সখনও একটু চিপস্‌ বা এটা ওটা সেটা, ব্যস। 

— রাতে? 

— রাতে খেলে তো ধন্য হয়ে যেতাম। কিচ্ছু খায় না। ওই একটু ভাত, একটু তরকারি, কখনও দু’-চার পিস চিকেন বা একটু মাছ কিংবা একটা ডিম। ডিমটা ও খুব ভাল খায়। 

— আর কিছু খায় না? 

— না। সে জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। না খেয়ে খেয়ে আমার ছেলেটা, কি বলব ডাক্তারবাবু, একেবারে ঝেঁটার কাঠি হয়ে গেছে। 

— ও কোথায়? 

— গানের ক্লাসে। আসলে সপ্তাহে একটা দিন ক্লাস তো। তাই ভাবলাম, আপনি যদি এই প্রেসক্রিপশনগুলো দেখে আর আমার মুখের কথা শুনে কোনও ওষুধ-টসুধ দিয়ে দেন, তা হলে... এর পর যে দিন আসব, সে দিন না হয়... 

— না, ওকে আনতে হবে না। 

— ও! আপনি বুঝে গেছেন, ওর কী হয়েছে? 

— হ্যাঁ। 

— কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? 

— কিছু না। 

— কিন্তু ও যে একদম খেতে চায় না... জানেন? আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে আছে। সবাই ওকে ভয় পায়। বড়রা পর্যন্ত সমঝে চলে। সে দিন তাকে সামনে দাঁড় করিয়েও ওকে এতটুকু খাওয়াতে পারিনি। 

— শুধু ওই ছেলেটা কেন? ওর সামনে যদি একটা বাঘ এনেও দাঁড় করিয়ে দেন, ও আর খাবে না। 

— কেন ডাক্তারবাবু? খাবার দেখলেই ও পালায় কেন? 

— ও কেন? ও ভাবে যদি আমাকেও আপনি খাওয়ান, দেখবেন, পরের দিন থেকে আমিও খাবার দেখলে পালাচ্ছি। আর ওর বয়স তো সবে সাত বছর... 

— কেন? আমি কি ওকে বেশি খাওয়াচ্ছি? 

— বেশি না। খুব বেশি। হিসেব করে দেখবেন, ও যা খায়, আপনিও তা খান না। সুতরাং এ সব নিয়ে একদম ভাববেন না। পারলে এক-আধ বেলা ওকে না খাইয়ে রাখুন। খেতে না চাওয়া পর্যন্ত ওকে কোনও খাবার দেবেন না। দেখবেন, খিদে পেলে ও নিজেই আপনার কাছে এসে খাবার চাইবে। জোর করে কখনও খাওয়াতে যাবেন না। জানবেন, না খেলে কেউ মরে না, খেয়েই মরে। 

ডাক্তারের কথা শুনে কাজরী হাঁ হয়ে গেলেন। তিনি কত আশা করে এসেছিলেন, ডাক্তারবাবু তাঁকে এই পরীক্ষা করাতে বলবেন, সেই পরীক্ষা করাতে বলবেন, এত এত ওষুধ দেবেন, তা নয়, উেল্ট বলছেন কি না, যা খায়, সেটাও কমাতে! পারলে দু’-এক বেলা না খাইয়ে রাখতে! এ কেমন ডাক্তার রে বাবা! এর ভিজিট আটশো টাকা! যাক বাবা, আর কিছু না হোক, একটা কাজ তো হল, এ বার থেকে সহেলীর মায়ের মতো তিনিও বড় মুখ করে বলতে পারবেন, আমি আমার ছেলেকে আটশো টাকার ডাক্তার দেখাই। সেটাই বা কম কী! 


অমিত পালের একটি কবিতা

 তুমি পাল্টাবে না


তোমরা তো দেখছি নতুন ভাবে সারি বেঁধেছ৷

পিঁপড়েরাও তোমাদের দেখে লজ্জা পাবে৷

হাতে হাতে ধর্মধ্বজা----

লাল, সবুজ, গেরুয়ার সমুদ্র সফেন৷

তোমরা নিজেদের ডিম্ব গুলি রক্ষা করতে চাও----

পিঁপড়ের বংশধর সব৷


আমি জানি একথা----

তুমি থামবে না ধমকানিতে৷

জয়গান গেয়ে যাও নিজ পেটের ভাত রক্ষার্থে----

বোকামিতে হোক বা ছলচাতুরীতে৷


আমি জানি তুমি থামবে না৷ গর্জে উঠবে বারবার৷

তোমার তো সম্পদ-প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি

একটা নিগূঢ় লালসা আছে---- একথা আমি জানি৷

তুমি চিৎকার করছ নিজের জন্য৷

কিন্তু তোমার সঙ্গীরা...

টিফিন পেলেই তৃপ্ত পাশে থাকা গিরগিটি----

একথা তুমি জানো?


আমি জানি তুমি থামবে না৷ অনশনে বসবে৷

কিন্তু তোমার সভা-সমাবেশের ভবিষ্যত কি?

সে কথা প্রত্যুত্তরে বলো আমায়...

কৌশিক বড়ালের একটি কবিতা

 ধুলো


কত রাত ধরে জল জমে আসে

ধুলো পড়ে ছিল ঘরে


আমাদের তো তিনটেই সিট

চারজন চেপে চুপে...


সময় জানে এতো মাস ধরে

কীভাবে কেঁদেছে। চুপে।


হকারের ঘরে বহুদিন হলো


ইচ্ছেরা মারা গেছে।


চাকা চলো তবে ঘুরে আসা যাক


পথ হারিয়েছি কবেই...


যত ঝুল সব দখলে ছিল

মারা গেছে ভালোবেসে

সর্বাণী ঘড়াই এর দুটি কবিতা

   ছন্দ পতন 

            

চলো ফিরি কবিতার ভিড়ে 

             যেটুকু বাকি আছে অতৃপ্ত প্রেম 

  পুর্ণ করুক অক্ষর আর শব্দ মিলে-


হৃদয় চিহ্নে কালবৈশাখি 

                এসেছিল কাক ভোরে 

ভেজা পাতায় সোঁদা গন্ধরা 

স্মৃতির স্বপ্নে ঘোরে।


তুমি চেয়েছিলে মেঘ•••

              আমি ভাবিনি বৃষ্টি হব


বজ্র এঁকেছি তোমার শরীর জুড়ে

             প্রেম অনুভূতি শব্দ ছন্দ পোড়ে ।


এসো কবিতায় খুঁজি যৌবন বারবেলা 

            আর অক্ষর খোঁজে সুখ দুঃখ খেলা


বার্ধক্যের খাতায় জমেছে আয়ু

           কবিতাই প্রেম প্রাণ শক্তি বায়ু •••••


_______________________________________


 সন্ধিক্ষণ


আমি যখন অষ্টাদশী-

বনসাই এর মতো বলিষ্ঠ শেকড়

ফুল-ফল নিয়ে ঘর কন্নায় মত্ত এক পুর্ন বয়স্কা নারী

প্রকান্ড এক টবে লাগান গাছ আমি-

 মৌমাছি প্রজাপতিদের আনাগোনা আছে সেখানে


গুঞ্জন আর রামধনুচ্ছ্টা এসে ছুঁয়ে যায় মন


যৌবনেরা যুবতী শরীর ছুঁয়ে 

পেতে চায় ওম


এখন সকাল গড়িয়ে বিকেলে মিশেছে


বয়স সন্ধিক্ষণে এসে কোঁকড়ানো চামড়া বলিরেখা আঁকা মুখ ভাঙা দাঁতের ফোকলা হাসি নিয়ে যখন জীবন মানচিত্রে ছানিপড়া দৃষ্টি ফেলি-

তখন মনে হয় এখনো বনসাই আছি

শেকড় ছড়িয়েছে মাটির গভীরে বলিষ্ঠ হয়েছে আরো-

এখন আর মৌমাছী নয় কাকেরা ডানা ঝাপটায় বনসাইর আকাশে।

মানসী ঘোষের একটি কবিতা

 পুরুষত্ব


নারীজাতিকে নিজের পায়ের নীচে দমিয়ে রাখাই যদি পুরুষের পুরুষত্ব ! 

তবে এমন পুরুষত্ব ধূলোয় মিশুক।

নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাওয়ার নামই যদি পুরুষত্ব হয়!

তবে এমন পুরুষত্ব নিশ্চিহ্ন হোক।

নারীর দেহে তোমার দেওয়া কালশিটে দাগ যদি তোমার পুরুষত্বের প্রমাণ হয়!

তবে পুড়ে ছাই হোক তোমার পুরুষত্ব।

এমন পুরুষত্বের চেয়ে, হে পুরুষ! 

তুমি বরং পুরুষত্বহীন হও। তুমি বরং পুরুষত্বহীন হও

বিক্রম দাসের একটি কবিতা

নির্যাতন

 

অনেক ছবি দেখলাম শহরের রাস্তায়

পথ শূন্য ছিলো তবু হারিয়ে গিয়েছিলাম ভিড়ে

হঠাৎ করে শুনতে পেলাম তুমি বেশ্যা নাকি

ভরসা করে বলবো তাকে কী মাথায় আসছিলো না

তখন প্রান হয়ে ছিলো মুল্যহীন তাঁতের দু্রত্ব বেশি ছিলো না

আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তারাও ছিলো আমার মতন

কিন্তু তারা যৌবনের শিকার হয়েছিলো

এখন রাত হলেই বের হয়

এটা সত্যি বেঁচে আছে তারা

এখনো শহরের গলি গলিতে এক ঘরের আড়ালে

পায়নি তারা ন্যায় বিচার,

হ্যাঁ এটাই সত্যি ইচ্ছে করে হয়নি তারা

ভয় তো আমারও হচ্ছিলো তাঁদের মতোন

পরিচয় আমাকে দেবে না তো

আমার ব্যাথা তারা বুঝতে পেরে তারা

আমার হাতে মোমবাতি তুলে দিলো

আর গায়তে বলল তাদের গান আমি বেশ্যা আমি বেশ্যা

বলল তারা কানে তুমি প্রবিত্র তা না কেউ জানে

ওই দেখা যায় সাদা বাড়ি ওখানে তে সবার বাড়ি যাও রাত টা স্বপ্ন ভেবে ঘুমিয়ে যাবে

তারা অবুঝ ছিলো আমার ছলা কৌশলের কাছে আমি পুলিশ তা ওরা না জানে

কিন্তু কিছু খনের জন্যও আমি সেই পরিচয় হারিয়ে ফেলে ছিলাম আমি ও তো এক মেয়ে

ভয় আমারও লাগছিলো বহুরূপী সেই রাক্ষসদের কে দেখে

বুঝতে তো আমি তখনি পারলাম যখন একলা হয়ে রাতে রাস্তায় বের হলাম

আমি দেখতে পেলাম প্রতিকারহীন শক্তে অপরাধে বিচার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

আর দেখলাম বহু রূপী মানুষ নির্জন জায়গায় নারী যৌবন শিকার করে রাতে অন্ধকারে জোর করে 

সেই ধর্ষিত নারী ছবি পত্রিকায় পত্রিকায় বের হয় ভোরের সাথে সাথে বহুরূপী নিজের পরিচয় বদলে বলে

 আমি জানতাম সে ওই রকম আজ নয় তো কাল ওর সাথে এটা হবার ছিলো

সত্যি টা কে চাপা দিয়ে সব

প্রথমে এক অন্য ছবি সমাজে তুলে ওরা 

আর আমার মতন অজ্ঞাত হাজার হাজার মানুষ সেই মেয়ে টার চরিত্র নিয়ে যত কথা তুলি তা কাপুরুষের আত্মসম্মান ঢাকার জন্য অপরিসীমা বস্ত্র হয়ে যায়।


শ্রাবণী মুখার্জীর একটি কবিতা

 ছায়াপথ 


তোমার রক্তে সৃষ্ট এ প্রান ,মাতৃদুগ্ধে সিঞ্চিত অবিরাম ...

সাহসী হওয়ার আশ্বাস পাই ,তুমি আছো তাই চিন্তা নাই  

বংশের নাম তোমার দান ,পরিশ্রান্ত জীবনের পরিত্রাণ ।

 জীবন জুড়ে মূলমন্ত্র জানি ,তোমাকে-ই সাক্ষী ভগবান মানি ।

তিলে তিলে বাড়ি ছত্রছায়ায় ,এই ছায়াপথ বাঁধা তোমার মায়ায় ।

স্নেহ ভোলায় অভিমান গুলো রোজ, আমি না নিলেও তুমি করো খোঁজ ।

দেহ মন ছুঁয়ে আদরের আলোয়ান ,শীর্ণ মলিন বেশে ও পালোয়ান ,

 প্রখর রোদের তেজ হোক বা বিপদ বৃটবৃক্ষের ছায়াতলে শান্তি নিরাপদ ।

তোমার কাছেই শিখছি নতুন অবিরত, সন্তান সুখে ঢেকে দিতে ব্যথা যত ।

তোমার পদবী আমার উঁচুমাথা ,তোমার শেখানো বুলি প্রতিহৃদয়ে গাঁথা ।

অন্তরে হালকা পরশ, বাইরে কঠিন জানি শোধ হবার নয় পিতৃঋণ ।

কতোশত লজ্জাহীন কাহিনী জীবন যা বলতে শেখেনি ।।

ইলা চক্রবর্তীর দুটি কবিতা

অন্য স্বাদের প্রেম 


পেয়েছি সব অশান্ত এক নদী, ঘৃণায় ভরা বাতাস,

কাল্পনিক ভালোবাসা, স্নায়ুবিক উষ্ণতা আর তোমায়,,,!

ভুলের পথ ধরে চলতে চলতে এখন মস্ত পাহাড়ের সামনে আমি।

অথৈ জলে ঝাঁপ দিয়ে খুঁজি ফিরি মনটারে!

তার খোঁজ পেয়েছি কি?

কে জানে!!!

কোনো এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায় কথা দেওয়া নেওয়া হয়েছিল হয়তো,,,

ঝড়ের মুখে ঠিকানা হারিয়েছে সে!

এক মুঠো সোনা ঝরা দিন উপহার দেবে বলেছিল সে!

বার বার আবার পথ হারিয়েছে দিশা বদলিয়েছে,,,

পোড়া মন আর নদী হতে পারেনি,

পারেনি সাগরে মিলতে,,,!

আদরে সোহাগে বিরহে ভেজা যে হলোনা আর!

নতুন শহর নতুন নাম নতুন কথা দেয়া নেয়া!


অন্য ভাবে মুখ এঁকেছ অন্য স্বাদের প্রেম,

তাই তুমি অনেকটা এগিয়ে,,!


_____________________________________


জীবন রহস্য


অনল তুমি অনিলা আমি,

জড়িয়ে রাখো আমারে।       

তোমার তীব্র শিখায় উজ্জ্বল করো,

শুদ্ধ করো আত্মারে। 


 ফিরে যেতে চাই আবার আমি,

আদিমতার রহস্য দ্বারে।


   বুকের মাঝে ভীষণ তৃষ্ণা,

আহুতি দিলাম নিজেরে,,!


    রামধনু রঙ বুঝি খুঁজে পাই,

    তোমার তপ্ত স্রোতে।


 অনল তুমি অনিলা আমি

   ভালোবেসেছি আমি তোমারে। 


  দাউ দাউ করে পুড়ে যেতে চাই,

    ভেঙে যাওয়া মন পুড়ে হলো ছাই,

   উড়ে যায় ওই আকাশে।পরে থাকে শুধু ছাই আর ছাই, 


দগ্ধ স্মৃতির প্রেম সুধা ভাসে বাতাসে।


 অনল তুমি অনিলা আমি,

চির শান্তির ঠিকানাটা তাই,

তোমার মাঝে আমি খুঁজে পাই,

অনল তুমি আমার !তুমি আমার!

 আমি ভালোবেসে পুড়ে পুড়ে ছাই হতে চাই।


সায়ন তরফদারের একটি কবিতা

 যারা রোজ মরে যায়


শহর বোঝে না ভালোবাসার মাপকাঠি

সে জানে না কত দুঃখ জমেছে আকাশে

ভালোবাসা মরে যায় রোজ এখানে―

বাঁচতে চায় মানুষ প্রায়ই শ্রমে ও চাষাবাদে


বাঁচতে চেয়েছিল ছেলেটাও বারবার

বুঝতে পারেনি ভালোবাসায় মায়ার পরিমাপ

কর্মহীনতায়, প্রেমহীনতায় মরেছে প্রায়ই

শরীরটা সতেজ তবুও, জীবন পায়নি মনের জবাব


তবুও রোজ স্বপ্ন দেখি, বাঁচবো আবার ঠিকই

কিচ্ছু চাইনি সত্যিই...শুধু চাই একটু 'বাঁচতে শিখি'।

সুব্রত মিত্রের দুটি কবিতা

 মন্বন্তরে রূপান্তর


এখন শুকনো ঢেউয়ে আমি মায়া খেলা করি

বাঁচিবার তাড়নায় স্বার্থের সাথে ঘর করি,

দিবানিশি পলায়ন ঘটে স্বার্থত্যাগের বাণীর

সমোচিত ভাবনার মুক্ত গগন খানি চূর্ণ দেবতার মত হয়ে ওঠে অভিমানী। 


বাস্তবের নাব্যতা আরো কত গভীর বলে দাও সখা

আমি পিপাসা ভুলে গিয়ে ক্ষুধাটাকে মেনে নেব; যাব ভুলে সৌখিনতা;

প্রমাণ্য প্রায়শ্চিত্তে অবলিলার লুণ্ঠন দাবি করে ন্যায্যতা,

আমি পাপের বিচক্ষণের দায় মাখা হাড়ি সরা

দুঃখের প্রসারতা করে অবগাহন ফিরে আসে মৌনতা। 


ভাতে ছাই পড়ে আছে ঐ

সাহারার হাতখানি এলো কই?

বাস্তবের নদী জীবনে আছাড় খায়

উঁকি দেয় ঘোলাটে মলাটের বেণু ছায়া,

নীল আকাশ কালো হয়ে আসে কেন

উড়ে আসে কেন ভিনদেশী মায়া। 


আমি আস্তরনের মেঘ ফাটা রোদ হতে গিয়েছিলাম

কোন ক্ষন প্রতাপ ইশারায় নিমজ্জিত সুর জীবনকে করছে নিলাম

আমি বেদনায় অপহৃত মায়ার পাথর

গন্তব্যের শীতলতম আবহে মানুষের মন্বন্তর করে তোলে কাতর।

_______________________________________


পরিসর জ্ঞাপন


আজ তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে,

ইচ্ছেরা গণ্ডি হারা কোন সমুদ্রে সাঁতরায়

পৃথিবীটা জীবন্ত রাক্ষসের মত দাঁড়িয়ে আছে। 


আমি ঠিকানাহীন এক অযোগ্য পথিক

ক্লান্তি আর নিস্তেজতা আমাকে ঘিরে ধরে সারাক্ষণ

কিভাবে তোমরা সর্বদা হেসে থাকো আমি জানিনা

মৃত্যুরা প্রতিমুহূর্তে কলিং বেল টিপে চলে যায়

আমার সকল সহপাঠীরা আজ সফল যমুনার নাবিক

দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে সময়ের ছায়া,

ছায়াতে মায়া নেই; আছে টাকার ছবি আঁকা। 


গোধূলি বিকেল লুকোয় অগ্নি তপ্তসম রৌদ্রের আগ্রাসে

ডুবে যাওয়া আশ্রয় ভেসে ওঠে মৃত কান্নায়,

সময়ের পাশে কেউ সময়ের গান বাঁধে

সময়ের কাছে কেউ সময়ের বন্ধক রাখে,

অহরহ অবিচল কল্পনারা বিশৃংখল যাপন রোধে--

স্বল্প পরিসরে মুক্তির কানায় কানায় পৃথিবীর মায়ায়। 


অগোচর সমাপন তথা হেসেছিল বৃথা

কবি কলহের আত্মগোপনের কৃপায় সেজে ওঠে মনোমালিন্যতা,

সৃষ্টির কাছে দেখি সাজানো বাগানের মাধুর্য

অনিমেষ পাথরের গায়ে আছে ঐ স্মরণীয় কদর্য।


মুহা আকমাল হোসেনের একটি কবিতা

 ভাঙন


 পাহাড়ী ময়াল নদী নেমে আসছে,

 নড় বড়ে কাঠের সেতু। 

আকাশ মুখি গাছ চিৎকার-

 ভাঙবে! ভাঙবে! 



ভাঙন সমর্থিত একটি রাগী আকাশের নিচে

 একটি সন্ত্রস্ত মিকচার বস্তি! 


 অসংখ্য গণকবরের দাগ

 আজ অলিখিত ইতিহাস!